কাটুসোনা
আজ দুপুরে হাউহাউ করে হঠাৎ পপির জন্য খানিকটা কাঁদলাম।
দুপুরে এক বারনাচওলাকে ধরে এনেছিল বাঁটুল, দড়ি বাঁধা দুটো বাদর ডুগডুগির তালে নাচল, ডিগবাজি খেল, পরম্পরকে পছন্দ করল, বিয়ে করল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে পুটুর পুটুর চেয়ে দেখল ভিড়ের মানুষদের। বসে বসে আমাদের দেওয়া কলা ছাড়িয়ে খেল।
বড় কষ্ট বাঁদরগুলোর। খেলা দেখতে দেখতে অবোলা জীবের কষ্টেযখন বুকে মোচড় দিল একটু তখনই পপির কথাও মনে পড়ে গেল। কাজল-পরানো মায়াবী একজোড়া চোখ ছিল পপির। কী মায়া ছিল ওর দৃষ্টিতে! তাকিয়ে থাকত ঠিক যেন আনজনের মতো। কথাটাই শুধু বলত না, কিন্তু আর সবই বোঝাতে পারত হাবেভাবে। এসব মনে পড়তেই বুকের মোচড় দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ঘরে গিয়ে কাঁদতে বসলাম।
কাঁদতে যে কী সুখ! কাঁদতে কাঁদতে পপিকে ছেড়ে আরও কত কী ভাবতে ভাবতে আরও কাঁদতে থাকি।
গতবারই কলকাতায় একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল। ভৈরবকাকার সঙ্গে মা আর আমরা ভাইবোনেরা মামাবাড়ি বেড়াতে গেলাম। মার বাপের বাড়ি যাওয়া আর সেই সঙ্গে কলকাতা থেকে পুজোর বাজার করে আনা, দুই-ই হবে। মামারা কেউ এক জায়গায় থাকে না। তাছাড়া কারওরই বাসা খুব বড় নয়। ফলে আমরা এক এক বাসায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম। আমাকে নিয়ে গেল হাতিবাগানের বড়মামা।
বলতে কী মামাবাড়িতে আমাদের বড় একটা যাওয়া হয় না। কলকাতা শহরটা আমাদের কাছে বড় ভয়ের। সে এক সাংঘাতিক ভিড়ে ভরা শহর। মাথা গুলিয়ে দেওয়া ধাঁধার মতো রাস্তাঘাট। তার ওপর আত্মীয়দের কারও বাড়িতেই হাত পা ছড়িয়ে থাকার মতো জায়গা হয় না! আমরা সেখানে গেলে একা বেরোতে পারি না, রাস্তা পেরোতে বুক ঢিপ ঢিপ করে। ফলে আমরা কলকাতায় কালেভদ্রে যাই। হয়তো নিচার বা পাঁচ বছর পর। ততদিনে কলকাতার আত্মীয়দের সঙ্গে আবার একটু অচেনার পর্দা পড়ে যায়।
বড়মামার মেয়ে মঞ্জু আমার বয়সী, ছেলে শঙ্কু তিন-চার বছরের বড়। সেই বাড়িতে পা দিতে না দিতেই আমি টের পেলাম আমার মামাতো দাদা শঙ্কর মাথা আমি ঘুরিয়ে দিয়েছি। বলতে নেই, ব্যাপারটা আমি উপভোগই করেছিলাম। কাছাকাছি একটা কাঁচা বয়সের ছেলে রয়েছে, অথচ আমাকে দেখে সে হাঁ করে চেয়ে থাকছে না, নিজের কেরানি দেখানোর জন্য নানা বোকা-বোকা কাণ্ড করছে না বা নিজের কৃতিত্বের কথা বলতে গিয়ে আগডুম বাগড়ম বকছে না–সেটা আমার অহংকারে লাগে।
তবু হয়তো আমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। একে তো আমার বিয়ে একজনের সঙ্গে পাকা হয়ে আছে, তার ওপর শঙ্কুদা আমার আপন মামাতো ভাই। কিন্তু বয়সটাই এমন যে, আত্মীয়তার বেড়া বাঁধ মানতে চায় না। যাতায়াত কম বলে আত্মীয়তাটা তেমন জোরালোও হয়ে ওঠেনি। ভাই বোন বলে জানি, কিন্তু সেরকম কিছু একটা দায়িত্ব বোধ করি না। আরও একটা কথা আছে। সেটা হল কিছু কিছু মানুষ বোধ হয় এরকম অসামাজিক, বাঁধভাঙা কাণ্ড করতে বেশি আনন্দ পায়।
লম্বার ওপর শঙ্কুদার চেহারাটা খারাপ নয়। একটু মস্তানের মতো হাবভাব। এ জি বেঙ্গলে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে এবং বিয়ে-টিয়ের কথাও ভাবছে। দ্বিতীয় দিন অফিস থেকে ফিরেই আমাকে বলল, সাত দিনের ছুটি নিলাম। তোকে কলকাতা শহরটা খুব ঘুরিয়ে দেখাব বলে।
আমি মুখেও হাসলাম, মনে মনেও হাসলাম। দুটো অবশ্য দু’রকম হাসি মুখে বললাম, খুব ভাল করেছ। কলকাতাকে যা ভয় আমার। মনে মনে বললাম, সব জানি গো, সব বুঝি!
ছেলে নতুন চাকরিতে ঢুকে ছুটি নেওয়ায় মামা মামি খুশি হননি তা তাদের মুখ দেখেই বুঝলাম। মধু তো মুখের ওপরেই বলল, তোকে দরকার কী? কলকাতা তো কাটুকে আমিই দেখাতে পারি।
কিন্তু শুধু আমিই মাঝে মাঝে টের পাচ্ছিলাম কলকাতা দেখানো না হাতি!
শঙ্কুদ পরদিনই গুচ্ছের ট্যাকসি ভাড়া দিয়ে আমাকে আর মঞ্জুকে নিয়ে গিয়ে পার্ক স্ট্রিট দেখাল, রেস্টুরেন্টে খাওয়াল, সিনেমায় নিয়ে গেল। মঞ্জু বারবার আমার কানে কানে বলছিল, ইস্! কী পরিমাণ টাকা ওড়াতে দেখেছিস!
শুনে আমার একটু লজ্জা হল। বেচারা শকুদা! এখন তো ওর মাথার ঠিক নেই। পরদিনই বাড়িশুদ্ধু সবাইকে স্টারে থিয়েটার দেখাল। মামি বলল, যাক, কাটুর কল্যাণে শঙ্কুর পয়সায় থিয়েটার দেখা গেল।
এমনি দু’-তিন দিন যাওয়ার পরই বাড়ির লোক কিছু ক্লান্তি বোধ করে ক্ষ্যামা দিল। তখন শঙ্কুদা আমাকে নিয়ে একা বেড়াতে বেরোল। চার দিনের দিন ট্যাকসিতে আমার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, পুজোর আগে কিন্তু ছাড়ছি না। কলকাতার পুজো দেখে যাও এবার।
তুই থেকে তুমিতে প্রোমোশন পেয়ে আমি আবার মুখে আর মনে দু’রকম হাসি হাসলাম। বললাম, যাঃ, তাই হয় নাকি?
কেন হবে না? ইচ্ছে থাকলেই হয়। আমি পিসিকে বলে পারমিশন নেব।
মা আমাকে রেখে যাবেই না।
খুব যাবে।
উঁহু। পুজোর পরেই আমার পরীক্ষা।
পরীক্ষা-টরিক্ষা রাখো তো। পুজোর পর কেন, সারা জীবনই যদি আর যেতে না দিই?
কথাটা বড় সোজাসুজি বলে ফেলে বোধ হয় নিজেই ঘাবড়ে গিয়েছিল শঙ্কুদা। তাড়াতাড়ি বলল, সাবিরের রেজালা খেয়েছ? চলো আজ খাওয়াব।
বাঁধ ভাঙতে আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু তার একটা মাত্রা আছে। দিন পাঁচেকের মধ্যেই বুবলাম, শহুদাকে একটু বেশি প্রশ্রয় দিয়ে আমি বিপদ ডেকে এনেছি। ভাড়াটে বাড়ির ছাদে ওঠার এজমালি সিঁড়িতে শম্ভুদা আমাকে সেদিন চুমু খাওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। দু’ দিনের দিন সকালে ওর ঘোর লাল চোখ দেখে বুঝলাম, সারা রাত ঘুমোয়নি। আমার কথা ভেবেছে।
বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল। পুরুষরা জন্মসূত্রেই বোকা, মেয়েরা তো তা নয়। আমি সাবধান হই। মামাকে সেদিনই বললাম, আজ খিদিরপুরে মেজোমামার বাড়িতে যাব। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মামার মাথায় তো ঘোরপ্যাঁচ নেই। বলল, তা আমার তো অফিস, তোকে বরং শঙ্কু গিয়ে রেখে আসুক। প্রস্তাব শুনে শদা আমার দিকে নিস্পলক অদ্ভুত পাগলা দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে, বিকেলে নিয়ে যাব। বলেই বেরিয়ে গেল। দুপুরে বেশ দেরিতে ফিরে এসেই বলল, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।
আমি তৈরিই ছিলাম। ভাত খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। রাস্তায় পা দিয়েই শঙ্কুদা বলল, কাটু, আমাকে বিট্রে করবে না তো? তাহলে কিন্তু মারা যাব।
বলতে নেই, আমি বুদ্ধিমতী। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, এখন যদি কোনও কড়া কথা বলি তাহলে একদম খেপে যাবে। তাই মুখে হাসি মাখিয়ে বললাম, তুমি এরকম করছ কেন বলো তো! আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি।
আমেরিকার ছেলেটাকে চিঠি লিখে দাও যে, তুমি তাকে বিয়ে করবে না।
আমার বুক তখন ধুকপুক করছে। বললাম, ওরম কোরো না। তোমাকে ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে।
পুরুষেরা বোকা বটে, কিন্তু কখনও-সখনও ভারী বিপজ্জনকও। বিশেষ করে প্রেমট্রেমে পড়লে। সেটা বুঝলাম যখন আমাদের ট্যাক্সি খিদিরপুরে না গিয়ে বিচিত্র সব পথে চলতে লাগল।
শঙ্কু পাগলের মতো কখনও আমার হাত চেপে ধরে, কখনও কাঁধে হাত রেখে, কখনও গলা পেচিয়ে ধরে কেবল ভালবাসার কথা বলে যেতে লাগল। সেদিন শঙ্কুদার সব বাঁধ ভেঙে গেছে, কোনও আত্রু নেই, লুকোছাপা নেই, লজ্জা নেই, ভয় ভীতি নেই। বলে, বিশ্বাস করো আমার মা বাবা কিছু মনে করবে না..আমি আলাদা বাসা করব…বিয়ে করেই দ্যাখো, প্রথমে একটু সবাই হয়তো রাগ টাগ করবে, কিন্তু দু’দিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে…কলকাতায় এরকম ভাইবোনে কত বিয়ে হয়, এটাই আজকাল ফ্যাশান…আমি আলাদা বাসা নেব, না হয় খুব দুরে বদলি হয়ে চলে যাব…
শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা। মাথা চক্কর দিচ্ছে। লজ্জাও হচ্ছিল খুব।
ট্যাকসিতেই অবশ্য শেষ হয়নি। ট্যাকসিওয়ালা স্পষ্টই সব শুনছে।
আমরা ময়দানে বসলাম, রেস্টুরেন্টেও খেলাম, রাস্তাতেও হটলাম।
বেলা পড়ে এলে বললাম, শঙ্কুদা, এবার আমাকে দিয়ে এসো। আমি না গেলে মা আর ভৈরবকাকা পুজোর বাজার করতে বেরোবে না।
ও! পুজোর বাজার এখন রাখো। তার আগে আমাদের বিয়ের বাজার তো হোক।
শঙ্কুদা সত্যিই নিউ মার্কেটে নিয়ে গিয়ে আমাকে একটা দেড়শো টাকার শাড়ি কিনে দিল জোর করে। এত খারাপ লাগছিল কী বলব।
সন্ধে হয়ে এল, তবু শঙ্কদা আমাকে রেখে আসার নাম করে না। বরং বলল, চলো, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। এক জায়গায় আমার বন্ধুরা আসবে।
আমি ভয়ে কেঁপে উঠে বললাম, না না।
চলো না। তারপর ঠিক রেখে আসব।
ডাক ছেড়ে তখন আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। শঙ্কুদা যত পাগলামি করছে তত ওর ওপর বিতৃষ্ণা আসছে আমার। পারলে তখন ছুটে পালাই। কিন্তু চারদিকেই তো বিপজ্জনক অচেনা কলকাতা। কোথায় যাব?
ধর্মতলার কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে সত্যিই নিয়ে গেল আমাকে শঙ্কুদা। সেখানে পাঁচ-ছ’জন ছোকরা বসে আছে। শঙ্কুদা আমাকে তাদের সামনে হাজির করে বলল, এই আমার ভাবী ওয়াইফ। তারপরই একটু হেসে বলল, ভাবীও নয়। শুধু ওয়াইফ!
আমার কান মুখ ঝা ঝা করছে এখন। রাগে দুঃখে ছিঁড়ে যাচ্ছে বুক। কিন্তু অত লোকের সামনে কী করব? হেসে বরং ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কথাটথাও বলতে হল। বন্ধুগুলো খারাপ নয়! তবে এক-আধজন একটু মোটা ইঙ্গিত করছিল। আমি তাদের মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছি বন্ধুদের কাছে আমাকে নিজের বউ পরিচয় দিয়ে শঙ্কুদা আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। সাক্ষী রাখতে চাইছে। বেঁধে ফেলতে চাইছে।
একবার পালাতে পারলে জীবনে আর কোনওদিন ওর ছায়া মাড়াব না, মনে মনে তখন ঠিক করেছি। তাই দাতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে যাচ্ছিলাম। জানি, আর একটু পরেই মুক্তি পাব।
কিন্তু খুব ভুল ভেবেছিলাম! আমি মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছিলাম। তবু বন্ধুদের সঙ্গে অনেক রাত করে ফেলল শকুদা।
রাত ন’টা নাগাদ বন্ধুদের বিদায় দিয়ে শঙ্কুদা রাস্তায় নেমে বলল, এত রাতে আর কোথায় যাবে কাটু?
আমি চমকে উঠে বলি, তার মানে?
এখন বাস ট্রামের অবস্থা খুব খারাপ! ট্যাকসিও খিদিরপুর যেতে চাইবে না।
তাহলে?
শঙ্কুদা হেসে বললে, আমাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারো, কিন্তু সেটা হয়তো খারাপ দেখাবে।
তুমি কী বলতে চাইছ?
ভয় পেয়ো না কাটু। আমি একটা খুব ভাল পথ ভেবে বের করেছি। আজকের রাতটা আমরা একটা হোটেলে কাটাব।
শুনে আতঙ্কে কেমন হাত পা ছেড়ে দিল আমার। বুক ঠেলে কান্না এল। কোনও বাধা মলিন। সেই কান্না আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম, এব তুমি কী বল?
শঙ্কুদা অনেক সান্ত্বনা দিচ্ছিল, ক্ষমা চাইছিল। বলল, বুঝছ না কেন, কেউ টের পাবে না। রং এত রাতে কোনও বাড়িতে গিয়ে উঠলেই সন্দেহ করবে বেশি। কোনও ভয় নেই।
পুরুষরা যখন পাগল হয় তখন বেকামির মধ্যেও তাদের শয়তানি বুদ্ধি কাজ করে। আমার তখন পাগলের মতো এলোমেলো মাথা। তবু আমি বুঝতে পারলাম, আমি যে ওকে কাটাতে চাইছি তা ও বুঝতে পেরেছে। তাই আমাকে এটো করে রাখতে চায়, যাতে আমি বাধ্য হই মাথা নোয়াতে।
কোথায় সেই হোটেলটা ছিল তা আমি আজও বলতে পারব না। তবে কলকাতার মাঝামাঝি কোথাও। হোটেলটার নামও আমি লক্ষ করিনি। কিছুই লক্ষ করার মতো অবস্থা নয়। তবে মনে হচ্ছিল, আগে থেকেই বন্দোবস্ত করা ছিল সব।
দোতলার একটা ছোট ঘরে আমাকে নিয়ে তুলল শকুদা। সে ঘরে একটা মাত্র অবল খাটের বিছানা। টেবিলে দুজনের খাবার দিয়ে গেল বেয়ারা, কিছু না বলতেই। শসা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ঘাবড়ে যেয়ো না। ওসব কিছুই কেউ জানবে না। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো।
বিপদের অনুভূতির প্রথম প্রবল ভাবটা কেটে গেল তখন। বাথরুমে গিয়ে আমি অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলাম। মাথা বশে এল একটু। বুকে ঢিপিঢিপিনি কমে গেল।
মানুষের মনে কত কী থাকে তার হিসেব নেই। সেই হোটেলের ঘরে আবার যখন কছিলাম তখন খুব খারাপ লাগল না। বরং মনে হল, দোষ কী? কে জানবে? আমার জীবনটা বড় বাধা পথে চলছে। একটু এদিক ওদিক তোক না।
এমনকী আমি তখন ভাতও খেতে পারলাম। হয়তো খাওয়ার পর বিছানাতেও চলে যেতাম কিছু পরে।
কিন্তু শঙ্কুদা যখন দরজার ছিটকিনি তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তখন সমস্ত প্রতিটা কেটে গেল।
ছেলেদের মুখে ওরকম কাঙালপনা দেখতে আমার এমন ঘেন্না হয়।
শঙ্কুদা আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে এসে ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল।
কেন নয় কাটু? একটুখানি। একবার। কেউ জানবে না।
তা হয় না। মেয়েরা ও জিনিসটা এত সহজে দিতে পারে না।
প্লিজ কাটু। আজ থেকে তুমি তো আমার স্ত্রী।
আমি চেয়ারে বসে রইলাম বুকের ওপর হাত আড়াআড়ি রেখে, দৃঢ়ভাবে। তারপর সারা রাত চলল অনুনয় বিনয়, পায়ে ধরা, মাথা কোটা, কান্না হাসি। আক্রমণ এবং প্রতিরোধ। একটা রাত যে কত লম্বা হতে পারে তার কোনও ধারণা ছিল না আমার। তবে একটা কথা আমি জানতাম। কোনও মেয়ে যদি ইচ্ছে না করে তবে দশটা পুরুষেরও সাধ্য নেই তাকে রেপ করে। মেয়েদের তেমনই ক্ষমতা প্রকৃতি দিয়ে রেখেছে। মেয়েরা যে ভোগের জিনিস তা কি ভগবানের মতো চালাক লোক জানেন না! ভৈরবকাকাও একবার দারোগা কাকার সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে বলেছিল, যে সব মেয়েদের ওপর অত্যাচার হয়, তারা হয় নিজের ইচ্ছেতেই কল মানে, না হলে ভয়ে হাল ছেড়ে দেয়।
কথাটা ঠিক। শঙ্কুদা রাজি করাতে না পেরে শেষরাতে জোর খাটাতে লাগল। সে এক বীভৎস লড়াই। কিন্তু সে লড়াই শেষ হওয়ার আগেই ভোর হয়ে গেল। আমার গায়ে কয়েকটা আঁচড় কামড়ের দাগ বসে গিয়েছিল শুধু। আর কিছু নয়।
মা আর বড়মামা ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। যুক্তি করে খুব বুদ্ধির সঙ্গে তারা ঘটনাটা চেপে দেয়। বড়মামি আর মঞ্জুও নিশ্চয়ই টের পেয়েছিল, কেননা সেই রাতে শঙ্কুদা বাসায় ফেরেনি। কিন্তু কতখানি টের পেয়েছিল তা আমি জানি না! ওদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
অনেকক্ষণ কাঁদলে মনের ভার কমে যায়। কিন্তু আজ অনেকক্ষণ কেঁদেও কেন যে আমার মনটা তবু ভার হয়ে রইল!
এ শহরের স্কুল কলেজ গত কয়েকদিন ধরে বন্ধ। আশপাশের নিচু জায়গা বানে ভেসে যাওয়ায় বহু লোক এসে উঠেছে সেখানে। লঙ্গরখানা চালু হয়েছে। বৃষ্টির জন্য সাত দিন বাড়িতে আটকে আছি। বিকেলে রোদ ফুটল। ভাবলাম, যাই লিচুকে দেখে আসি।
লিচু আমাকে দেখে খুশি হল না। গোমড়া মুখ করে রইল।
ওর মা বলল, এসো এসো। বড়লোকের মেয়ে এসেছে আমাদের ঘর আলো করতে।
কথাটায় খোঁচা ছিল কি না কে বলবে! তবে অত ভাববার সময় নেই।
কেমন আছিস?- লিচুকে জিজ্ঞেস করি।
ভাল। খুব ভাল। বেঁচেই আছি মরে যাইনি।
আজ তোকে ভাল দেখাচ্ছে।
ভাল দেখাবে না কেন? ভালই আছি তো।
বাবাঃ। অত মেজাজ করছিস কেন বল তো?
কোথায় মেজাজ! আমাদের মেজাজ বলে কিছু থাকতে আছে নাকি?
কমও তো দেখছি না।
একখাতে হঠাৎ লিচু হ-হুঁ করে কেঁদে উঠল হাঁটুতে মুখ গুঁজে।
ওর পিঠে হাত রেখে বললাম, কাঁদছিস কেন? আজকাল ওসব ব্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নাকি?
লিচু জবাব দিল না। অনেকক্ষণ মুখ গুঁজে কেঁদে তারপর একটু শান্ত হয়ে মুখ তুলল। আস্তে করে বলল, আমি কাঁদছি হারমোনিয়ামটার জন্য।
আবার হারমোনিয়াম? সেটার কী হল?
কর্ণবাবুর টাকা শোধ দেওয়ার জন্য এবার সেটা মা বেচে দিচ্ছে পশুপতিবাবুর কাছে। আমার তবে আর কী থাকল বল?
টাকা শোধ দেওয়ার তাড়া কী? সময় নে না। না হয় আমিই বলে দেবখন কর্ণবাবুকে।
ছিঃ– লিচু জ্বলে উঠে বলে, কক্ষনও নয়। ওঁর কাছে আমরা একদিনও ঋণী থাকতে চাই না।
পাগলা দাশুর ওপর দুই খুব রেগে গেছিস।
ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো তক্ষুনি বাড়ি ফিরে গলায় দড়ি তি। কলকাতার ছেলেরা যে এরকমই হয় তা অবশ্য জানতাম। তোর দেওর, তাই বেশি কিছু বলতে চাই না।
দেওর তো কী?
তুই হয়তো ভাববি, দোষটা আমারই।
মোটেই না। তবে তোর আর একটু খোঁজ খবর নেওয়া উচিত ছিল। শুনেছি কর্ণর কলকাতায় একজন লাভার আছে।
আছে।-বলে লিচু চোখ কপালে তুলল, কী শয়তান।
তুই যেটা ধরিস সেটাকেই বড় সিরিয়াস ভাবে ধরিস। আজকাল এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কেউ ভাবে নাকি?
আমি তো তুই নই।
কেন, আমি কীরকম?
তোর সবই মানায়। আমার তো তোর মতো রূপ, গুণ বা টাকা নেই যে একজনকে ছেড়ে দিলেও আর একজন জুটবে। আমাদের সব কিছু হিসেব কষে করতে হয়।
আমি বুঝি প্রায়ই একজনকে ছেড়ে আর একজনকে ধরি?
তা তো বলিনি। বললাম, রূপ গুণ থাকলে ওরকম করা যায়। নিজের গায়ে টানিস না। রাগ করলি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, তোর কথা ভেবেই আমি কৰ্শর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেছি।
কী বলল?
বলল, ওর লাভার খুব স্মার্ট। খুব সুন্দর।
মুখখানা কালো হয়ে গেল লিচুর। বলল, তা হলে তো ভালই, আমাকে কখনও অবশ্য লাভারের কথা বলেনি।
তুই হয়তো জানতে চাসনি। কোনও ছেলের সঙ্গে আলাপ হলে ওটাই প্রথম জেনে নিতে হয়।
জেনে রাখলাম। তুই বুঝি তাই করিস?
নিশ্চয়ই। তবে আমার ইন্টারেস্টটা অ্যাকাডেমিক। তোর তো তা নয়। আবার একজনকে হাতের কাছে পেলেই হয়তো হুড়মুড়িয়ে প্রেমে পড়বি। তাই জানিয়ে দিলাম।
লিচু থমথমে মুখে বলে, আমার জেনে দরকার নেই। যে ছেলেদের মাথা চিবিয়ে বেড়ায় তারই ওটা বেশি জানা দরকার।
আমার মনের মধ্যে তখন থেকে কী যেন একটা ধিক ধিক করছে। কী যেন একটা মনে পড়ি-পড়ি করছে। পড়ছে না। মনটাও ভীষণ ভার। কিছুতেই কাটাতে পারছি না। তাই কথা কাটাকাটি করতে ইচ্ছে করছিল না। তবু একটু মোলায়েম বিষমেশানো গলায় বললাম, ছেলেরা কাউকে কাউকে মাথা চিবোতে দেয়। সুযোগ পেলে চিবোতে কেউ ছাড়ে না।
সন্ধে হয়ে এসেছে। উঠব উঠব করছি, এমন সময়ে পাগলা দাশু বাইরে থেকে ডাকল, লিচু।
আমি টুক করে উঠে পড়লাম।
ডাক শুনে লিচু এত চমকে উঠে, শিহরিত হয়ে, শুন্তিত মুখে বসে রইল যে আমার সরে পড়াটা লক্ষই করল না। ওর মুখে ভয়, চোখে অবিশ্বাস, মুখে স্বপ্নের আস্তরণ। বেচারা।
আমি উঠোনের দরজা দিয়ে পালিয়ে আসার সময় একবার উঁকি দিয়ে দেখলাম। কর্ণর চেহারাটা সত্যিই বেশ। লম্বা চওড়া, পুরুষোচিত। কিন্তু সাজগোজ অত্যন্ত ক্যাবলার মতো। মুখে অন্যমনস্কতা। হঠাৎ মনের মধ্যে টিকটিকিটা খুব জোর ডেকে উঠল। এমনকী দুলে উঠল হৃৎপিণ্ড। পায়ের নীচে মাটিও কেঁপে গেল যেন। আশ্চর্য। কর্ণ মল্লিককে যে আমিও আগে কোথায় দেখেছি।