কলীম উঠোনে নেমে গেলে বুড়ির গলা দিয়ে ভাত নামে না। দুতিনবার খেয়ে দুই ঢোক পানি গিলে উঠে পড়ে। বুকের ভেতর ভাতের দলা আটকে যায়।
তল্লাশি কুকুরের মত সারা গায়ে সলীমকে খোঁজে ওরা। মনসুর মেম্বারের পালিয়ে যাওয়ার খবর অতোটা বিশ্বাস হয়নি। সলীমকে না পেয়ে কলীমকে ধরেছে। তখন ভোরের আজান দিয়েছে। কলীম বিছানায় কুঁকড়ি মেরে শুয়ে আছে। বুড়ি কেবল দরজা খুলে বেরিয়েছে, তখনই ওরা সাতজন সজনে গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। বুড়ি কিছু ভেবে কুলিয়ে ওঠার আগেই ঘরে ঢোকে। রমিজা পুকুরঘাটে ছিল ওখান থেকেই সুপপারি বাগানে পালিয়ে যায়। বুড়ি বাঁশের খুঁটি ধরে বারান্দার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। কলীমকে ধরে আনে ওরা। ওদের হাতে কলীমকে দেখে দৈত্যের হাতে রাজপুত্রের মত মনে হয় বুড়ির। কলীমের চোখে তখনো ঘুম ভাঙা আমেজ। কলীমকে নিয়ে ওরা উঠোন পেরিয়ে চলে যায়। বুড়ি কিছু বলতে পারে না। ছুটে জলপাই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। কলীম একবারও পেছন ফিরে তাকাবার সুযোগ পায় না। ওরা সাতজন সৈনিক রাস্তা কাঁপিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওদের কলরবে মাঠের চড়ই নিশ্ৰুপ হয়ে যায়।
সারা বাড়িতে বুড়ি একলা। পাড়ার অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ছেলে বুকে নিয়ে পালিয়েছে রমিজা। ওর বাইশ বছরের যৌবনে ঝড়ের আশঙ্কা। কলীমকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় রমিজা হকিয়ে গেছে। কোন কিছুই ভেবে উঠতে পারে না। পাট ক্ষেত না কচুরীপানা ভর্তি ডোবায় গিয়ে ঢুকেছে ও তা জানে না। জানার ইচ্ছেও নেই। রমিজা। আপাতত নিরাপদে থাকুক এটাই কামনা। রমিজার ছেলের কথাও আর তেমন করে ভাবতে পারছে না। ঘরের মধ্যে রইস বসে আছে। রইস থাকা না থাকা সমান। যার কোন বোধই নেই সে আর কি কাজে লাগবে। নিরাসক্ত মুখে বারান্দায় বসে বাঁশবনের মাথার ওপর তাকিয়ে থাকে বুড়ি। পাতার ফাঁকে ছোট্ট একটু আকাশ দেখা যায়। ঝকঝকে নীল আকাশ। কোথাও কোন মেঘ নেই। প্রখর রোদুর। রমিজা আজ ভাত ফোটায়নি। রমিজার চুলোয় আগুন নেই। ওর ইচ্ছে করছে আগুন জ্বালাতে। বাঁশপাতা আমপাতা বুকে নিয়ে চুলোটা যদি এখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠে তবে বেশ হয়। ওরা দেখুক সবাই পালায় না। কেউ কেউ আগুন জ্বালায়। কিন্তু উঠতে পারে না। বুড়ির বুক তোলপাড় করে। গফুরের মৃত্যুর সময় অনুভূতি যেমন থমকে গিয়েছিল আজ ঠিক তেমনি লাগছে। কিন্তু বুড়ির মুখে তার কোন প্রকাশ ছিল না। প্রাণপণে সমস্ত জাগতিক চিন্তাগুলো বাতাসে ওড়া তুলোর মত উড়িয়ে দিতে চাইছে। পায়ের কাছে বসে থাকা বাঘা কুকুরটা লেজ নাড়িয়ে গরগর করছে। বুড়ি তাও দেখছে না। সমস্ত বাড়ি এক অসীম শূন্যতায় খা খা করছে। পুব দিকের আমড়া গাছটা ভীষণ চুপ। হাঁস দুটো পালকে মুখ গুঁজে বসে আছে। অথচ সবকিছু ছাপিয়ে বুড়ির চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলীমের চলে যাওয়ার দৃশ্য।
রমিজা অনবরত কাঁদে কলীমের জন্য। বুড়ি তাও পারে না। বুড়ির চোখে কোন জল নেই। সেটা এখন খা-খা মরুভূমি। দুদিন পার হয়ে গেছে। রমজান আলীর কাছ থেকে খবর পেয়েছে কলীমকে খুব মারধাের করছে। সলীমের খবর জানতে চাইছে। কলীম কিছুই বলে না। কেবল যন্ত্রণায় কোঁকায়। বুড়ি নিজের হাত কামড়ায়। ঠিকই বলতো ওরা, বুড়ি আসলে কিছুই করতে পারে না। কিছুই করার ক্ষমতা নেই। পেরেছে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিতে পারে বারান্দায় নইলে পুকুরঘাটে চুপচাপ বসে থাকতে। পারে অনেক দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতে।
–আম্মা কলীম ভাইয়ের কি হবে?
বুড়ি রমিজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তর জানে ও। কিন্তু বলতে পারে না। জানে কলীমের মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। যেমন গায়ের আরো কয়েকজন গেছে তেমন। ওদের লাশ পুঁতে ফেলেছে, নয় খালে ভাসিয়ে দিয়েছে। কলীমকেও কি তাই করবে? বুড়ি ছটফটিয়ে ওঠে।
–আম্মা আপনি কথা বলেন না কেন?
বুড়ির ঠোঁট কাঁপে। কথা বেরোয় না। রমিজা ফুঁপিয়ে ওঠে। ফুলি এসে খবর দেয়।
রমিজাবু তাড়াতাড়ি পালাও মিলিটারি আসছে।
রমিজা পালিয়ে যায়। কোথাও আর কেউ নেই। শুধু বাঘা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তখুনি পুরো বাড়িটার ভৌতিক নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে বুটের শব্দে গা ভাসিয়ে ওরা সাতজন খাকি পোশাক পরা লোক বুড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। কলীমকে বেঁধে এনেছে। ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় বুড়ি। ও একদম অন্যরকম হয়ে গেছে। ওর দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অমানুষিক অত্যাচারে ওর এখন ভিন্ন আদল। মহামারী কবলিত হলদী গাঁ হয়ে কলীম এখন বুড়ির চেতনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তার জন্যে কোন শোক নেই, দুঃখ নেই, বেদনা নেই। তাকে সাক্ষী করে জন্ম হয় আগুনের। সে বলে দিতে পারে প্রতিশোধের অবদমিত স্পৃহা।
কলীম তোর ঘাড়টা ঝুলে পড়েছে কেন? তুই একবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকা। সাহসী বারুদজ্বলা দৃষ্টি ছড়িয়ে দে হলদী গাঁয়ের বুকে। মুছে যাক মহামারী, বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ। হলদী গাঁয়ের মাটি নতুন পলিমাটিতে ভরে উঠুক?
বুড়ি প্রাণপণ শক্তিতে নিজেকে শক্ত রাখে, যেমনি ছিল তেমনি বসে থাকে। ও যেন ঠিক এমনি কতগুলো সময়ের সমষ্টির অপেক্ষায় ছিল। জানত বন্দী রাজপুত্রের মত কলীম আসবে। এই বাড়িটা জনমানবশূন্যপুরী হয়ে যাবে। কদাকার দানবের দল ছিন্নভিন্ন করে দেবে সাজানো সংসার। ওদের হিংস্র মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় বুড়ি। একজন উঠোনে কলীমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। বাকি ছয়জন বুড়ির পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে। দুরন্ত আক্রোশে ক্রুদ্ধ হয়েছে ওরা। রইসের পিঠে এক ঘা লাগায়। হাবা-বোবা ছেলেটার কাছে কোন উত্তর না পেয়ে এক ধাক্কায় ওকে বারান্দায় ফেলে দেয়। রইস কাঁদতেও ভুলে যায়। মুখ দিয়ে গোঙানির মত শব্দ বের হয়। ও গুটিসুটি বুড়ির পাশে এসে বসে। পিঠে মুখ ঘষে। সান্তুনা চায়। পায়ে যে চোট লেগেছে তা ইশারা করে দেখায়। রইসের হাতটা নিজের মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে বুড়ি। এতক্ষণ ও নিজের ভেতর একটা অবলম্বন খুঁজে পায়।
ওরা ঘরের ভেতর তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছে। এ বাড়ির প্রতিটি জিনিসের প্রতি ওদের আক্রোশ। সব কিছু তছনছ করে মজা পায়। কাঁথা বালিশ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। কাপড় চেরার ফতৃত শব্দ কানে এসে লাগে। ওর মনে হয় এসব জিনিসের ওপর এখন আর কোন মায়া নেই। ওগুলো ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেললে একটুও খারাপ লাগবে না। বুড়ি একদৃষ্টে কলীমের দিকে তাকাতে পারে না। ওর সারা শরীরে কালশিটে দাগ। চোখের ওপরটা ফুলে গেছে বলে ভাল করে তাকাতে পারছে না। তবুও পাংশু বিবর্ণ দৃষ্টিতে বুড়িকেই দেখছে। ওর ঠোঁট নড়ছে। ও হয়ত কিছু বলতে চাচ্ছে। বুড়ি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না যে ঠিক এ মুহূর্তে কলীম কি বলতে পারে? ওর মনে এখন কিসের দাপাদাপি? বুড়ির মনে হয় কলীমের জন্মের ছয় মাস পর ওর মা মারা গিয়েছিল। সে মায়ের কথা কলীমের মনে নেই।
বুড়ি কে? বুড়ি শুধু ওকে মমতা দিয়েছে। কিছু ভালবাসা। দুটো মিষ্টি কথা শুনিয়েছে। এর বেশি কিছু বুড়ি ওর জন্যে করেনি। ঐটুকু সম্বল করেই এখন ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে চায়। শুনতে চায় কলীম কি বলবে। ওর কাছে যাবার জন্যে সিড়ি দিয়ে নামে। দুপা এগোতেই রাইফেলধারী তেড়ে আসে। যেখানে বসেছিল সেখানে বসে থাকতে হাত দিয়ে নির্দেশ করে। ওর সেই ক্রুদ্ধ ভয়াবহ মুখের দিকে চেয়ে বুড়ির চোখের সামনে হলদী গা দুলে ওঠে। সমস্ত কিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ফিরে আসে। অথচ ওর এখন ভীষণ ইচ্ছে করছে কলীমকে একবার ছুঁয়ে দেখতে। ওর রক্তে কিসের মাতামাতি একবার কান পেতে শুনতে চায়। মৃত্যুর ছায়া ভাসে যুবক কলীমের সমস্ত অবয়বে। বুড়ি আর তাকাতে পারে না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। সৈনিকের হেলমেটের ওপর দিয়ে দিগন্তে সে দৃষ্টি আছড়ে পড়ে। রইস ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাঁশবনের মাথায় মৃদু বাতাস। বুড়ির অবয়বহীন কঠিন মন শিমুল বীজের মত ফেটে যেতে চাইছে।
যমদূতের মত বুড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা ছয়জন। ঘরের ভেতর কিছু না পেয়ে ক্ষিপ্ত। এতক্ষণ অকারণ শক্তি ক্ষয় করেছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে ওদের একজন। জানতে চাইছে সলীম গোলাবারুদ রেখেছে কোথায়? হলদী গাঁয়ের আন্দোলনের নেতার কাছে অস্ত্রশস্ত্র নেই এ কি করে সম্ভব? বুড়ি ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। ওরা যে ভাষায় কথা বলছে বুড়ির এত বছরের জীবনে তা কোন দিন শোনেনি। কেবল সলীমের নামটা ধরতে পারছে। ওরা বুড়িকে আকারে ইঙ্গিতেও বোঝাতে চেষ্টা করছে। বারবার। অনেকবার। উত্তর দেয় না। ওর গলার মধ্যে বাঘা কুকুরটার মত গরগর শব্দ হচ্ছে। তখুনি বুড়ির মনে হয় এরা কারা? এরা কি হলদী গাঁয়ের জলহাওয়া, পলিমাটি, নদীর কূলে বেড়ে ওঠা লোক? গাঁয়ের নেংটিপরা মানুষগুলো বুড়ির চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওদের কথা ও বোঝে। শহর থেকে দুচারজন এলে কষ্ট হলেও ওদের কথা বোঝে। কিন্তু এরা কেন বুড়ির খুব কাছের মানুষ নয়? তখুনি ও চিক্কার করে ওঠে, ঐ কলীম এই শুয়োরগুলি কি বলে?
ওরা কলীমকে ধাক্কা দিয়ে বুড়ির পায়ের কাছে ফেলে দেয়। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা কলীমের দেহটা ওরা একজন পা দিয়ে চেপে রাখে। কলীম বুঝি বাঁকানো বেত। ছেড়ে দিলে ছিটকে উঠবে। আসলে কলীম কিছুই করতে পারছে না। কলীমের হাত বাঁধা। অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত। তবুও হাত বাধা না থাকলে ও হয়ত একটা কিছু করত। অন্তত করতে চেষ্টা করত। সেটাও বুড়ির জন্য সান্ত্বনার কারণ হত। কলীমের অসহায়ত্ব বুড়িকে মরমে মারে। ওরা কলীমের পিঠে বুটের লাথি বসিয়ে বলছে, কোন খবর না দিলে ওরা কলীমকে মেরে ফেলবে। ওদের ক্রুদ্ধ আক্রোশে এখন বারুদের স্ফুলিঙ্গ। যে, কোন মুহূর্তে দপ করে জ্বলে উঠবে। . বুড়ি বিড়বিড় করে, তোর মা থাকলে কি করত আমি জানি না কলীম। কিন্তু আমি কিছু করতে পারি না? বড় পাওনার জন্য কাউকে কাউকে বুঝি এমনি করে মরতে হয় কলীম। তুই আর আমাকে মা ডাকিস না। আমি তোর মা হওয়ার উপযুক্ত না।
বুড়ি হাত দিয়ে চোখ মোছে। সলীমের মুখটা মনে হয়। পাশাপাশি দুজনের। কে আগে সলীম না কলীম? বুড়ি সলীমকে কথা দিয়েছে ওর কথা কাউকে বলবে না। কিন্তু নিজেও তো জানে না সলীম কোথায়? কলীম এখন মরে যাচ্ছে। একদম বুড়ির চোখের সামনে। বুড়ি কি করবে? বুড়ির জীবনের বিনিময়ে কি ওরা কলীমকে ছেড়ে দেবে? হঠাৎ বুড়ি চিৎকার করে বলতে থাকে, তোমরা আমাকে মার। ওকে ছেড়ে দাও। ছুটে গিয়ে একজনের পা ধরে, তোমরা আমাকে মার? আমাকে মার ….।
ওরা ছয়জন পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। বুড়ির কথা বুঝতে পারে না। ফাঁক পেয়ে কলীম ছিটকে ওঠে।
–মা
সঙ্গে সঙ্গে ওরা কলীমকে বুটের লাথি দেয়। কলীমের আর্তচিৎকারে বুড়ি চুপ করে যায়। আবার সিঁড়ির ওপর ফিরে আসে। আজ ওরা ছয়জন আজরাইলের মত। বুড়ি আজরাইলের একটা স্পষ্ট চেহারা বহুবার মনে করার চেষ্টা করেছে। পারেনি। এখন একটা সুস্পষ্ট ধারণা হচ্ছে।
ওরা বুড়িকে ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। বুকের ওপর রাইফেলের ঠাণ্ডা নল চেপে ধরে আছে। গুলি করবার ভয় দেখাচ্ছে। কলীম মাঝে মাঝে মুচড়ে উঠছে। ফাটা মাঠের মত কলীমের মুখ। একটা কিছু চাচ্ছে। এক একবার ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু শরীরটা পাথরের চাইতেও ভারি। টেনে ওঠানো যায় না।
ওদের গর্জনের মুখে বুড়ি কেবল বিড়বিড় করে, আমার কিছুই করার নেই। কেউ কেউ এমনি করেই মরে যায়। কাউকে কাউকে মরতে হয়।
বুড়ি আর কিছু করতে পারছে না। কণ্ঠে কোন শব্দ নেই। এমনকি কোরানের আয়াতও না? যে আয়াত স্মরণ করলে বুকে বল ফিরে আসে তা কেন একটাও স্মরণে আসছে না? গফুরের মুখ স্মরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাও পারে না। সমস্ত হলদী গাঁ একাকার হয়ে বুড়ির চোখের সামনে লুটোপুটি খায়। ওর কেবলই মনে হয় রমিজার ছেলে কোথায় যেন কাঁদছে।
বুড়ির কাছে কোন উত্তর না পেয়ে ওরা ফিরে দাঁড়ায়। নিজেরা কয়েক মুহূর্ত কি যেন আলোচনা করে। সদম্ভ পদক্ষেপে ভীষণ কিছু ঘোষণা করে। হেঁচকা টানে কলীমকে দাঁড় করিয়ে দেয়। উঠোনের মাঝখানে নিয়ে গুলি করে। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া কলীমের দেহটা এক লাথি দিয়ে ওপাশে গড়িয়ে দেয়। আবার এক লাথি দিয়ে এপাশে। তারপর হাসিতে শিসে গানে আনন্দ প্রকাশ করতে করতে ওরা চলে যায়।
গুলির শব্দ এসে বিধে বুড়ির হৃদয়ে। গুলির শব্দটা ঠিক সেই মুহূর্তে কলীমের মা ডাকের মত। তীক্ষ। তীব্র। এঁফোড় ওফোড় করে বেরিয়ে যায়। বুড়ির মুখ দিয়ে কোন আর্তনাদের ধ্বনি বের হয় না। কেবল কুকুরটা ভীষণ শব্দে ঘেউ ঘেউ করছে। ইতস্তত ছুটোছুটি করছে। মাটি আঁচড়াচ্ছে। দাঁড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চাইছে। সারা বাড়িতে আর কোথাও কোন শব্দ নেই। রইস মাকে ধরে আঁকুনী দেয়। হাত ধরে টানাটানি করে।
বুড়ি দেখে কলীমের দেহ থেকে রক্তের স্রোত নেমেছে। গুচ্ছ গুচ্ছ শিমুল ফুলের মত লাল। ঐ শিমুল থেকে বীজ হবে। বীজ হয়ে ফাটবে। বাতাসে উড়ে বেড়াবে সাদা ধবধবে উজ্জ্বল তুলো। বুড়ির মনে হয় সমগ্র হলদী গাঁটা গুচ্ছ গুচ্ছ শিমুল হয়ে গেছে। ঐ শিমুলের সাঁকো পেরিয়েই হলদী গাঁ একমুঠো উজ্জ্বল তুলো হয়ে যাবে। আচমকা। বুড়ির মনে হয় সলীমরা এ কথাই তো বলত। হলদী, গায়ের লোকগুলোর চোখে মুখে এ স্বপ্নই তো ভাসতো। হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে পড়ছে, যে শব্দটা ওরা সারাদিন বলাবলি করত, তা ছিল স্বাধীনতা। শিমুলের মত লাল রক্ত পেরিয়ে সে স্বাধীনতা তুলোর মত ধবধবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বুড়ি লক্ষ্য করে রইস কখন যেন কলীমের পাশে গিয়ে বসেছে। খুব আস্তে আস্তে কলীমের গায়ে মাথায় মুখে হাত বুলাচ্ছে। ও কিছু বুঝতে পারছে না। নিজের হাতে রক্তের দলা নেড়েচেড়ে দেখে। গন্ধ শোকে। তারপর একদৌড়ে বুড়ির কাছে ছুটে আসে। অবাক বিস্ময়ে দুর্বোধ্য শব্দে ও চিল্কারে বুড়িকে টানাটানি করে। চোখের সামনে সব কিছু কেমন আবছা অস্পষ্ট হয়ে যায়। রইসকে জড়িয়ে ধরে বুড়ি ডুকরে কেঁদে ওঠে। কলীমের তাজা রক্তের গন্ধ বুড়ির চেতনায়।
এক সময় কান্না থেমে যায়। রইসকে ধরে প্রবল ঝাঁকুনী দেয়। তুই কেন চুপ করে থাকিস রইস? তুই কোন কিছু করতে পারিস না? তুই ফেটে পড় রইস। আমিও তোর সঙ্গে থাকব। আমরা দুজনে মিলে হলদী গাঁয়ের জন্যে একটা কিছু করব। তোর কানটা যদি বোমা হয়ে ফেটে যায়। জিভটা যদি বুলেটের মত ছোটে? ও রইস তুই আমার গলা চেপে ধর। তুই আমাকে মেরে ফেল। বুড়ি গলা ফাটিয়ে কাঁদে। চিৎকারে বুকের ভেতরের সাত পরত দেয়াল ভেঙে গুড়িয়ে যায়। আশপাশের ঘরের লোকজন এসে ভিড় করে কলীমের পাশে। রমিজা কতদূরে পালিয়েছে কে জানে? এখনও ফিরেনি। রমজান আলী এবং আরো কারা যেন কলীমকে বারান্দার ওপর উঠিয়ে নিয়ে আসে। কবর দেয়ার কথা বলাবলি করে। বাকি সবাই বিমূঢ়। বুড়ি কোন কিছু শুনতে পায় না। কোন কিছু দেখতে পায় না। দেখে কলীমের রক্ত হলদী গাঁ শুষে নিচ্ছে। মাটি ভেদ করে সে রক্ত নিচে চলে যাচ্ছে। উপরের অংশ জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। ও বিড়বিড় করে, হলদী গাঁ রক্ত খাচ্ছে। রমজান আলী জিজ্ঞেস করে, কি বলেন রইসের মা?
এ বুড়ি শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়।
–কলীমকে সুপারি বাগানে কবর দিন রমজান ভাই।
–সে আমি সব ঠিক করব। আপনি কিছু ভাববেন না।
রমজান আলী চোখ মুছতে মুছতে নেমে যায়। ছেলে-মেয়েরা ভিড় করে রক্ত দেখছে। কেউ কেউ হাত দিয়ে নাড়ছে। বুড়ির শূন্য দৃষ্টি আবার সে রক্তের ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ে। মনে হয় কলীমের রক্ত হলদী গাঁয়ের মাটিতে নতুন পলিমাটি। আপন শক্তিতে উর্বরা হবার জন্যে হলদী গা সে রক্ত ধারণ করছে। ওর মাথা পাক দিয়ে ওঠে। বাঁশের খুঁটিতে হেলান দেয়। তখুনি শুনতে পায় বুক ফাটা চিৎকার করতে করতে রমিজা ঘরে ফিরছে।
দিন গড়ায়। বদলে যায় বুড়ির আপন ভুবন। যেন একটু ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে ওরা কটা প্রাণী চুপচাপ বসে থাকে। রাত্রি হলে কারো মধ্যে কোনো প্রাণ থাকে না। মাঝে মাঝে রমিজার ছেলে যখন জোরে কেঁদে ওঠে তখন ওরা বুঝি নিজেদের অস্তিত্ব টের পায়। তাও কি কাদবার জো আছে। ছেলে কাদলে রমিজা যেখানে থাকুক ছুটে আসবে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে থামিয়ে ফেলবে। বুড়ির মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে যে ছেলেটা চেঁচাক। জোরে জোরে কেঁদে এই গা-টা মাতিয়ে তুলুক। ঐ দৈত্যগুলো ভাবুক যে এ গাঁয়ের লোকগুলো সব মরে যায়নি। বুড়ির ভাবনা রমিজা ধরতে পারে না। ধরার ক্ষমতাও নেই। তাই বুড়ির সঙ্গে ও রাগ করে। ওর ধারণা বুড়ি ছেলেটাকে ইচ্ছে করে কাদায়। কাদিয়ে মজা পায়। তাই বুড়ির কাছে দিয়ে রমিজার স্বস্তি নেই। বুড়ি আপত্তি করে কখনো কখনো।
–ওকে একটু কাঁদতে দে না রমিজা? ওর দম আটকে কি তুই ওকে মেরে ফেলবি?
–কি যে বলেন আম্মা? কাদলেই তো দৈত্যগুলো ছুটতে ছুটতে আসবে। তারপর সবাইকে গুলি করবে।
–করলেই হলো আর কি?
কথাটা বলেই থমকে যায় বুড়ি। থমকে যায় রমিজাও। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে কলীমকে কবর দেয়া হয়েছে। সুপোরির ছায়ায় নিরিবিলি শুয়ে আছে। সবুজ ঘাসে ভরে গেছে সে কবর। রমিজা পাতা বাহারের গাছ লাগিয়েছিল সেটাও বেশ বড় হয়েছে। হলদী গাঁ কলীমের জন্যে কি সুন্দর সবুজ শান্তির ঘর বানিয়ে দিয়েছে। বুড়ির বুক কেমন করে। বড় করে শ্বাস নেয়। ঐ কবরের কাছে গিয়ে বসলে হলদী গাঁ-র জন্যে মমতা বাড়ে। কলীম যুদ্ধ করেনি, কিন্তু হলদী গাঁ-র জন্যে প্রাণ দিয়েছে। বুড়ি এখন রইসকে নিয়ে বাগানে সুপপারি খুঁজতে যায় না। কলীমের কাছে যায়। কিছু দোয়াদরুদ পড়ে। চোখের পানি আঁচলে মুছতে মুছতে ফিরে আসে। উঠোনের দিকে চোখ পড়ে। মাটি খুঁড়লে হয়তো উঠোনে রক্তের দাগও বেরিয়ে যেতে পারে। তবুও বুড়ি আস্তে আস্তে বলে, গুলি করা কি অত সহজ?
–সবই সহজ। রমিজা কথা খুঁজে পায়। এখন সবই সহজ। ছোট ভাইকে মেরে ফেললো। শামুর মার কথা একবার চিন্তা করেন আম্মা। কি যে দিনকাল হল।
রমিজা চাল বাছায় মনোযোগী হয়। শামুর মার কথা ও সহ্য করতে পারে না। বুড়ির বুকটাও মোচড় দিয়ে ওঠে। বেচারী।
কলীমকে যেদিন মারলো ঐদিনই পাটক্ষেতের একবুক পানির মধ্যে লুকিয়েছিল ওরা সবাই। একটু দূরের রাস্তা দিয়ে একদল সৈন্য যাচ্ছিল।
কোলের ছেলেটা কেঁদে উঠতেই শামুর মা ওকে পানির তলে চেপে ধরে। কোন কিছু ভাববার সময় ছিল না তখন। মিলিটারি চলে গেলে ওরা সবাই উঠে এল। শামুর মার বুকে তখন ছেলে মরে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার অর্ধেক পথ এলে শামুর মা টের পায়। ভয়ে এত তটস্থ ছিল যে বুঝতেই পারেনি। কোল বদল করার সময়ই টের পায় যে ছেলেটা নড়ছে না। ভয়ে শামুর মা চিৎকার করেও কাঁদতে পারেনি। অসাড় হয়ে গিয়েছিল অনুভূতি! বোবার মত ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। এখন ওর মাথার ঠিক নেই। দিনরাত বলে, ছেলেটাকে আমি নিজের হাতে মেরে ফেললাম। আল্লারে আমার কি হল? বুড়ি শামুর মার সামনে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। সইতে পারে না টলটলে জলভরা বোবা চাউনি। রমিজার মত বুড়িও বিড়বিড় করে, কি যে দিনকাল হল। এমনি আরো কত ঘটনা আছে। রোজই কিছু না কিছু ঘটে। কোনটা ছেড়ে কোনটা মনে রাখবে। রমিজার চাল বাছা শেষ হয়েছে। ভাত চড়াবে। ও চালের টুকরি নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকে। যেতে যেতে বলে, দেখবেন আম্মা ও যেন কাঁদে না। কান্না শুনলে আমার বুক ধড়ফড় করে।
ছেলেকে নিয়ে রমিজার বড় ভয়। ও সারাক্ষণ ছেলেটাকে বুকে আঁকড়ে বেড়ায়। সলীম চলে যাবার পর থেকে একদম দুর্বল হয়ে গেছে। কারো সঙ্গে জোর করে কথাও বলতে পারে না। যেন সলীম চলে যাবার দায়-দায়িত্ব সব ওর। কলীমের মৃত্যু ওকে আরো অপরাধী করেছে।
–ও না গেলে ছোট ভাই বোধ হয় মরতো না, না আম্মা?
–কি জানি মা সবই আল্লার ইচ্ছা।
বুড়ি উদাসীন হয়ে থাকে। বলতে পারে না যে সলীম না গেলে ওরা সলীমকেই, মারতো। অথবা দুজনকেই মেরে ফেলতো। তখন কি হত রমিজার? কলীম গেছে, কলীমের কোন পিছু টান নেই। কিন্তু সলীম গেলে রমিজার বৈধব্য বুড়ির বাকি জীবনটুকুতে কাঁটা হয়ে থাকত। তার চেয়ে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। সলীম যেন ঠিকঠাক ফিরে আসে এই দোয়াই করে। এর মধ্যেই বুড়ি কলীমের মৃত্যুর সান্ত্বনা খোঁজে। কিন্তু রমিজা কোন সান্ত্বনা পায় না। ওর বিবেক ওকে কাঁদায়। রমিজা প্রায়ই কাঁদে। পুকুর ঘাটে বসে, বিছানায় শুয়ে, ভাত রাঁধতে বসে সব সময়ই কাঁদে। বুড়ির মনে হয় শুধু কলীম নয়, সলীমের জন্যেও কাঁদে ও। সেই যে গেল ছেলেটা কতদিন হয়ে গেল অথচ কোনো খবর নেই। বেঁচে আছে, ভাল আছে এই একটা খবরও কি সলীম পাঠাতে পারতো না? কোন দুর্গম এলাকায় আছে যে খবর আসে না? বুড়ির রাগ হয়। সলীম নেই, কলীম নেই। রইস বেঁচে থেকেও না থাকার মত। শুধু ঐ একরত্তি ছেলেটা এখন এই বাড়ির প্রাণ। তাও জোরে কাদার অনুমতি নেই ওর। রমিজার কড়া শাসন ওকে দমিয়ে রাখে। হাত পা ছুড়ে ও যখন হাসে আর খেলে তখন বুড়ির বুক
জুড়িয়ে যায়। ভয়-কাতুরে রমিজা শুকনো মুখে হাসতে চেষ্টা করে।
-বুড়ি বলে, দ্যাখ রমিজা দ্যাখ। ওর দিকে তাকিয়ে সাহসী হতে শেখ।
–ওর মত বয়স পেলে আমিও হাসতাম আম্মা।
–সাহস বুকের মধ্যে থাকে রে। ওর জন্যে বয়স লাগে না।
রমিজা কথা বলে না আর। ও জানে ওর কোন সাহস নেই। ছোটবেলা থেকেই ও একটা ভীতুর ডিম। তাই সারাদিন বাড়িতে ও চুপচাপই থাকে। প্রায় নিঃশব্দে। একদম থাকার মত।
গ্রামের অবস্থা দিনদিনই খারাপ হতে থাকে। ওরা একটা নারকীয় উৎসবে মেতে উঠেছে। সামান্য ছুতো ধরে গুলি করে। ঘরে আগুন দেয়। লাশ টেনে আধাআধি মাটি চাপা দেয়। শকুন ভীড় জমায়। শেয়াল টেনে বের করে সে সব লাশ। গ্রামের লোক ভয়ে সেদিকে যেতে সাহস পায় না। কদিন পর মাথার খুলি গড়ায় মাঠে। হাড়ি জেগে থাকে মাটির ফঁাকে। কখনো মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে ঘুম ভেঙে যায় ওদের। বিছানায় উঠে বসে থাকে। বাকি রাতটুকু কেউ ঘুমুতে পারে না। কখনো কখনো রাতের অন্ধকারে ওদের দুতিনজন মেয়ে খুঁজতে আসে। ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে চলে যায়। সেসব মেয়েরা আর ফিরে আসে না। কাউকে ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। কাউকে প্রয়োজন শেষে মেরে ফেলেছে। দিনের বেলায় গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি নিয়ে যায়। জবাই দিয়ে ক্যাম্পে উৎসব করে। হৈ হুল্লোড় চিৎকার ভেসে যায় অনেক দূর পর্যন্ত। বুড়ির দুটো গরু নিয়ে গেছে। খুঁজতে গিয়ে দেখেছে জবাইয়ের দৃশ্য। আর একটা গাছতলায় বাঁধা ছিল। ভীষণ ভাবে ডাকছিল সে গরুটা! বুড়ি কাছে যেতে পারেনি। সে সাহস হয়নি। শুধু হাম্বা ডাকে থরথর করে কাঁপছিল হাঁটু দুটো। ফিরে এসে হাউমাউ করে কেঁদেছিল বুড়ি। রমিজা সান্ত্বনা দিয়েছিল, আম্মা থাক দরকার নেই আমাদের গরুর। এর চেয়ে বড় বিপদও তো আমাদের হতে পারতো। হ্যাঁ, তা হতে পারতো। ওরা ঘর পুড়িয়ে দিতে পারতো। বুড়িকে মেরে ফেলতে পারতো। রমিজাকে ধরে নিয়ে যেতে পারতো। বেয়োনেটের মাথায় গেঁথে নিতে পারতো বুড়ির প্রিয় নাতির শরীর।
–ভেবে দেখেন আম্মা ছোটভাইকে মারার পর ওরা আর এ বাড়িতে আসেনি। বুড়ির কান্না থেমে যায়। মাঠ থেকে গরু নিয়ে গেছে যাক গে।
–বড় মায়ার গরু ছিল রে রমিজা!
–কি আর করবেন।
রমিজা হাত পাখা দিয়ে বুড়িকে বাতাস করে। রমিজার সান্ত্বনার কথায় বুড়ি চুপ করে যায় কিন্তু বুকের নিচটা ঝাঁঝরা হয়ে থাকে। ভুলতে পারে না সেই হাম্বা ডাক।
রমিজাকে নিয়েও আতংক দানা বাঁধতে থাকে বুড়ির মনে। ভয়ে কিছু বলতে পারে না ওকে। রমিজাও বোঝে। কিন্তু কিছু বলে না। ওর যৌবন এখন ভয়ের কারণ। যে কোন মুহূর্তে তছনছ করার জন্য দর দল আসতে পারে। রমিজার চুপসে যাওয়া শুকনো গাল নিষ্প্রভ হতে থাকে দিন দিন। কাজ কর্মে মন নেই। উৎসাহও নেই। উঠোনে শ্যাওলা জমে। আগাছা গজায়। এখন আর লেপে-পুছে ততকে ঝকঝকে করে রাখে না ঘর-দুয়োর। চুলোয় তিন বেলার আগুন এক বেলায় জ্বলে। ও এখন আর দাউদাউ করে আগুন জ্বালে না। টগবগিয়ে ভাত ফোটে না। বুড়িও বসে বসে সে আগুন দেখে না। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। বুড়ি বাকী একটা গরু নিজেই চরাতে নিয়ে যায়। বাঁশবন পর্যন্ত কিংবা খালের ধারে, এর বেশি যায় না। শেষ সম্বল এই গরুটা কিছুতেই আর মাঠে চরতে পাঠায় না। কখনো বুড়ি নিজেই ঘাস কেটে আনে। খড় যোগাড় করে। হাঁসগুলোকে সন্ধ্যার আগে খোয়াড়ে ঢুকিয়ে দেয়। নিজেরাও খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলে। রাত্রিবেলা আর বাতি জ্বলে না ঘরে। বুড়ি অনুভব করে অভাব ক্রমাগত মুখ হাঁ করে এগিয়ে আসছে। শুধু ভয়ে নয় কেরোসিনের অভাবেও বাতি জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না। সারা বছরের চাল ঘরে আছে বলে ভাত জুটছে। এর বাইরেও নিত্যদিনের টুকিটাকি কত কি লাগে সেগুলো আর জোটে না। গতকাল রমজান আলীকে দিয়ে একমণ ধান বিক্রি করিয়েছে। তার থেকে হলুদ, মরিচ, লবণ, তেল, সাবান কিনেছে। কোনদিন শাকভাজি, কোনদিন কাঁচা মরিচ এই তো চলছে। বুড়ি কি করবে কিছু ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না।