কলিং বেল টিপে নাসিম অপেক্ষা করছে। তার হাতে কুড়িটা রজনীগন্ধার স্টিক। ফুলগুলি থেকে সে কোন গন্ধ পাচ্ছে না। গন্ধহীন রজনীগন্ধা। তার কাছে মনে হচ্ছে–ফুলের মধ্যে কোন ভেজাল আছে। সব কিছুতেই ভেজাল। এ বাড়ির কলিং বেলেও ভেজাল আছে মনে হয়। তিনবার টেপা হল। কেউ আসছে না। শব্দই হয়ত হচ্ছে না। দরজা ধাক্কাধাক্কি করাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। এ বাড়িতে আজ নিয়ে তার দ্বিতীয় দফার আসা। প্রথমবার কাতল মাছ নিয়ে এসেছিল। আজ রজনীগন্ধা। নাসিম বিসমিল্লাহ বলে আরেকবার কলিং বেল টিপল। এবারে দরজা খুলল। বুড়ো একজন লোক দরজা খুললেন। সব বুড়ো মানুষ অসুখী অসুখী চেহারা করে রাখেন–এঁর চেহারা সুখী সুখী। চোখে সোনালী ফ্রমের চশমা। হাতে ইংরেজী গল্পের বই। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ অংশটা তাঁর আনন্দে কাটছে।
কাকে চান?
মিসেস মেহেরুন্নেসাকে একটু প্রয়োজন ছিল।
মিসেস মেহেরুন্নেসাটা কে?
ডাকনাম সম্ভবত তুহিন।
তুহিন ডাকলামের কেউ এ বাড়িতে নেই।
নাসিম ধাঁধায় পড়ে গেল। এর আগের বার তুহিন নামটা সে শুনেছে। ডাকনাম ঘনঘন বদলাবার নিয়ম আছে কি?
আমি রহমান সাহেবের মেয়ের কাছে এসেছিলাম।
ও, মেঝো বৌমা? মাহীনকে চাও?
জ্বি।
তুমি কে?
নাম বললে আমাকে উনি চিনবেন না। আমার নাম নাসিম। বন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড থেকে এসেছি।
তুমি বোস। বৌমা খোকাকে খাওয়াচ্ছে।
আমার কোন তাড়াহুড়া নেই, আমি বসছি।
বুড়ো ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। নাসিম স্বস্তি পেল। মাহীনের আসতে দেরি হলেই ভাল। কিছুক্ষণ ঠাণ্ডামাথায় চিন্তা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। কথাগুলি কিভাবে বলতে হবে প্রাকটিস করে নেয়। প্রথম কথা যা বলবে তা হচ্ছে–আপা আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? আরেকদিন এসেছিলাম। আমি বন এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেডের নাসিম। আপনাকে একটা কার্ড দিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের একটা বিলের ব্যাপারে। বিলটা আপনার বাবার কাছে আটকে আছে। আপা, আপনার কি মনে পড়েছে? আপনি বলেছিলেন সব ঠিকঠাক করে দেবেন। খুব সমস্যার মধ্যে আছি। লোকজনদের কাছ থেকে ধারটার নিয়ে কাজটা করেছি ওরা এখন আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলার মতলব করেছে। সবচে বেশি সমস্যা করছে আমার নিজের বোন…
চিন্তার সময় তেমন পাওয়া গেল না। পর্দা ঠেলে মাহীন ঢুকল। নাসিমকে দেখে তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। নাসিম তার সাজিয়ে রাখা কথা একটাও বলতে পারল না। মাহীন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আপনার সাহস তো কম না। আপনি আবার এসেছেন?
নাসিম হকচকিয়ে গেল। এ জাতীয় আক্রমণ তার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। মাহীন বলল, আপনার কথা শুনে ঐদিনই বাবার কাছে গিয়েছিলাম। বাবা আকাশ থেকে পড়েছেন। বাবা অনেক ঝামেলা করে আপনাদের কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। আর এইভাবে স্ত্রীর নামে আজেবাজে কথা ছড়িয়ে আপনি তার প্রতিদান দিচ্ছেন? এত সাহস আপনার?
হৈচৈ শুনে বুড়ো ভদ্রলোক আবার ঢুকলেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, কি হয়েছে বীমা? মাহীন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, দেখুন মা বাবা, এই লোক আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছে। বাবার নামে আজেবাজে কথা আমার কাছে বলছে।
বুড়ো তীক্ষ্ণ গলায় বলল–কি চাও হে ছোকরা? কি ভেবেছ? মতলবটা কি? পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করে দেব? বৌমা লালবাগ থানার নাম্বারটা কত বল তো?
অতি দুঃখেও নাসিমের হাসি পেল। বুড়ো একজন মানুষের ভয় দেখানোর একি ছেলেমানুষি চেষ্টা–বৌমা লালবাগ থানার নাম্বারটা কত বল তো? ভাবটা এরকম যে তাদের আদরের বৌমা অবসর সময়ে সব থানার নম্বর মুখস্থ করে বসে থাকে। এটাই হচ্ছে আদরের বৌমার হবি।
নাসিম মিষ্টি করে হাসল। হাসিতে যদি কাজ হয়। কাজ হল না। বুড়ো আরো রেগে গেল।
ছোকরা তোমার গায়ের চর্বি পানি বানিয়ে ছাড়ব। বৌমা লালবাগ থানার ওসিকে টেলিফোনে ধর। বল–খায়রুল ইসলাম কথা বলবেন।
নাসিম বলল, স্যার আপনি বেশি রেগে গেছেন। এই বয়সে বেশি রেগে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। স্ট্রোক এখন ডালভাত হয়ে গেছে। বিশেষ করে আপনার মত দুধ ঘি খাওয়া মানুষদের জন্যে তো রাগ করা খুবই রিস্কি।
শাট আপ–ইউ স্কাউনড্রেল।
আমি তো শার্ট আপ করেই আছি। চিৎকার যা করার তো আপনিই করছেন।
সান অব এ বিচ বলে কি? বৌমা টেলিফোনটা দেখি।
নাসিম হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, মাহীন তুমি বুড়োমিয়াকে টেলিফোনটা দাও। বুড়োমিয়া কোথায় টেলিফোন করতে চায় করুক। আর শুনুন বুড়ো মিয়া, আমি একা এখানে আসি নি। দলবল নিয়ে এসেছি। ওরা নিচে অপেক্ষা করছে। মালমসলা নিয়ে অপেক্ষা করছে। হৈচৈ শুনলে উপরে চলে আসতে পারে। উপরে চলে এলে আপনাদের সামান্য অসুবিধা হতে পারে।
বুড়ো এবং তার বৌমা দুজনের মুখই শুকিয়ে গেল। নাসিম পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে খুব স্বাভাবিক গলায়–যেন ঘরোয়া আলাপ করছে এমন ভঙ্গিতে বলল, মাহীন শোন, তোমাকে এবং তোমার বাবাকে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। এখন বাজে এগারটা পঁয়ত্রিশ। বুধবার এগারটা পঁয়ত্রিশের মধ্যে আমাদের অফিসে টাকা-পয়সা পৌঁছে দিতে হবে। এটা তুমি তোমার বাবাকে বলবে। আমি এম্নিতে অত্যন্তু মধুর স্বভাবের মানুষ আশা করি–ইতিমধ্যে তা বুঝতে পেরেছ। কিন্তু বুধবার এগারটা পঁয়ত্রিশের পর মধুর স্বভাব নাও থাকতে পারে। চলি, কেমন? বুড়ো মিয়া চলি? আমার সঙ্গে তিনটা দুদীর কোটা আছে। ব্যবহার করলাম না। যদিও আপনার ব্যবহারে বেশ বিরক্ত হয়েছি। আজকের মৃত বিদায় হচ্ছি। ও মাহীন ভাল কথা, এই রজনীগন্ধাঙ্গুলি তোমার জন্যে এনেছিলাম। রেখে দাও। এগুলি দেখতে আসলের মত হলেও আসল না। গন্ধবিহীন রজনীগন্ধা। এর ডাঁটাগুলি তরকারী হিসেবে খাওয়া যায়। ঝাল ঝাল করে রান্না করতে হবে। চেষ্টা করে দেখতে পার।
নাসিম মুখ ভর্তি করে ধোঁয়া ছাড়ল। মধুর ভঙ্গিতে হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কয়েকবার শিস দেবারও চেষ্টা করল। পেছন থেকে কেউ কোন শব্দ করল না।
নাসিম বলেছিল নিচে তার দলবল আছে। দলবল বলতে বাবু একা। সে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে চা খাচ্ছিল, নাসিমকে দেখে চায়ের কাপ রেখে এগিয়ে এল।
কিছু হয়েছে?
না। ভয় দেখিয়ে এসেছি।
সে কি–কি ভয় দেখালি?
কোন টেকনিকই যখন কাজ করছে না–ভয় টেকনিকটা ট্রাই করলাম।
বাবু চিন্তিত মুখে বলল, আমার মনে হচ্ছে তুই একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছিস। টাকা উদ্ধারের আমি কোন আশা দেখছি না।
টাকা ঠিকই উদ্ধার হবে, যে অসুখের যে অষুধ। বুধবারের আগেই দেখবি টাকা-পয়সা সব দিয়ে গেছে।
বুধবার কেন?
বুধবার পর্যন্ত ওদের সময় দিয়েছি। ফোর্টি এইট আওয়ার টাইম। ধর, সিগারেট নে। তুই মুখ এমন শুকনো করে রেখেছিস কেন? ভয় পাচ্ছিস না-কি? ভয়ের কিছু নেই।
আমার তো মনে হচ্ছে ভয়ের অনেক কিছুই আছে।
তোর মত ভিতুর ডিম নিয়ে কাজ করা মুশকিল। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে ভিতুদের কোন স্থান নেই। বর্তমান কালটা হচ্ছে শরে। যে অন্যকে ভয় দেখাতে পারবে সেই টিকে থাকবে। অন্যরা পারবে না। তাদের স্থান হবে নর্দমায়।
কি বলে ওদের ভয় দেখালি?
কি কি বলেছি নিজেরো মনে নেই তবে বুড়ো এক লোক ছিল–তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। হাত থেকে বই পড়ে গেছে। মনে হয় লুঙ্গিও ভিজিয়ে ফেলেছে–হা হা হা। হো হো হো।
তুই হাসছিস? আমার কিন্তু ভয় লাগছে।
ভয়ের কিছু নেই।
ভয়ের কিছু নেই বাক্যটি বিকেল নাগাদ মিথ্যা প্রমাণিত হল। পুলিশ এসে বন এন্টারপ্রাইজের অফিস থেকে নাসিমকে ধরে নিয়ে গেল।