৮. ওষুধ ফ্যাক্টরি
বাসায় এসে দেখি বাইরে লুঙ্গি ঝুলছে এবং ভিতর থেকে বাবার জিব পরিষ্কার করার বিকট শব্দ বের হচ্ছে। পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকে দেখলাম, রান্নাঘরে মা রাঁধছেন এবং রান্নাঘরের দরজার পিছনে লাবলু দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে কাঁদছে। আমি টেবিলের উপর বইগুলি রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। শিউলি গাছটা বেশ বড়োসরো হয়েছে। নিচে আর কোন ডাল নেই, বাবা আজ কোন ডালটা ভাঙবেন কে জানে। আমি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললাম। সলীলের সাথে বাসা থেকে পালিয়েই যেতে হবে, এভাবে আর থাকা যায় না।
সে রাত্রে খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, বাবা আমাদের মারলেন না। মারতে চাননি সেটা অবিশ্যি সত্যি নয়, কিন্তু ঠিক সময় করে উঠতে পারলেন না। মগরেবের নামাজ পড়েই বাবা টেবিলের ওপর কয়েকটা খবরের কাগজ বিছিয়ে কি একটা কাজ শুরু করে দিলেন। টেবিলের ওপর শিশি বোতল প্যাকেট রাখতে রাখতে বাবা আমাকে আর লাবলুকে খুব খারাপ খারাপ কথা বলে গালি দিতে লাগলেন। আমাকে বললেন শুওরের বাচ্চা, বদমাইশ, জানোয়ার এবং হারামখোর। লাবলুকে বললেন কুত্তার বাচ্চা, ইবলিশ, বেতমিজ এবং জুতাচোর। হ্যাঁচকা টান মেরে আমার কান ছিঁড়ে ফেলবেন এবং চড় মেরে লাবলুর সবগুলি দাঁত ফেলে দেবেন বলে হুমকি দিতে লাগলেন। গালিগালাজ এবং এরকম হম্বিতম্বিকে আমি অবিশ্যি বেশি ভয় পাই না। সত্যিকার পিটুনী হলে অন্য কথা।
যে কাজটা করার জন্যে বাবা আমাদের মারতে পর্যন্ত সময় পাচ্ছেন না সেটা কি আমার খুব জানার কৌতূহল হচ্ছিল। বাবা সেটা লুকানোর চেষ্টাও করলেন না, কাজেই আমরা সবাই দেখলাম। প্রত্যেকবার বাবা অফিস থেকে ওষুধ চুরি করে আনেন। এবারে শুধু ওষুধ নয়, ওষুধের সাথে অনেকগুলি ওষুধের খালি বাক্স আর শিশি এনেছেন। সাথে আরেকটা ঠোঙা ভর্তি ক্যাপসুল। ক্যাপসুলগুলি খালি। ক্যাপসুল যে খালি হতে পারে এবং সেটাকে টেনে খুলে ফেলা যায় আমি জানতাম না। বাবা সেই ক্যাপসুলগুলি খুলে ভিতরে একটু ময়দা ভরে সেগুলি আবার বন্ধ করে রাখতে লাগলেন। তারপর ওষুধের শিশির মাঝে গুনেগুনে কুড়িটা করে ক্যাপসুল রেখে মুখটা বন্ধ করে বাক্সের। মধ্যে রাখতে শুরু করলেন। একেবারে নিখুঁত কাজ, দেখে আমাদের তাক লেগে গেল। বাবার মুখ গম্ভীর দেখে মনে হয় সাংঘাতিক একটা জরুরি কাজ করছেন।
মা এসে একবার জিজ্ঞেস করলেন, কি করছেন?
বাবা মুখ খিঁচিয়ে প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বললেন, চোখের মাথা খেয়েছ? দেখছ একটা কাজ করছি, তার মাঝখানে এসে কথা বল। আক্কেল নাই তোমার?
বাবার ধমক খেয়ে মা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেলেন।
ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে বাবা সবগুলি ওষুধ তৈরি করে তার বাজারের ব্যাগের মধ্যে ভরে বের হয়ে গেলেন। লাবলু তখনো বিশ্বাস করতে পারছিল না যে আজ আমরা মার খাইনি। দাঁত বের করে হেসে বলল, বাবা মারেন নাই আজকে।
আমি বললাম, না।
কেন মারেন নাই?
সময় পান নাই। মনে হয় কালকে ডাবল মার হবে।
কালকেরটা কাল, লাবলুকে সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত দেখা গেল না। হাসি হাসি মুখে বলল, কেন সময় পান নাই?
দেখিস নাই, ওষুধের ফ্যাক্টরী খুলেছেন বাসায়।
লাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, কেমন করে ওষুধ বানাতে হয় বাবা জানেন?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তুই একটা আস্ত গাধা।
লাবলু চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার, আমাকে গাধা বলবে না।
বাবা কি করেছে তুই দেখিসনি?
কি করেছে?
বসে বসে ভেজাল ওষুধ তৈরি করেছে, তারপর সেই ওষুধ নিয়ে গেছে বিক্রি করার জন্যে।
ভেজাল ওষুধ?
হ্যাঁ। দেখিসনি, ক্যাপসুলগুলি খুলে তার মাঝে ময়দা ঢুকিয়েছে। দেখিসনি?
লাবলু বোকার মত মাথা নাড়ল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ভেজাল ওষুধ খেলে কি হয়?
অসুখ ভাল হয় না। অসুখ যদি বেশি হয় তাহলে মানুষ মরে যায়।
মরে যায়? লাবলুর মুখ কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেল, সত্যি মরে যায়?
এত অবাক হচ্ছিস কেন? মানুষ অসুখ হয়ে মরেছে তুই কোনদিন শুনিসনি?
লাবলু মাথা নাড়ল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ঢোক গিলে বলল, বাবা মানুষকে মেরে ফেলবে?
মারতেও তো পারে।
সত্যি?
আমি রেগে বললাম, ধেত্তেরী ছাই! ঢং করিস না। দেখছিস না, আমাদের দুইজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে কোনদিন।
লাবলু আর কোন কথা বলল না, কেমন জানি মনমরা হয়ে বসে রইল।
.
পরদিন স্কুল ছুটির পর আমি আর সলীল জারুল চৌধুরীর সাথে দেখা করতে রওনা দিলাম। আমাদের কথা শুনে এত সুন্দর জায়গাটা বিক্রি করেন নাই, আমাদের গিয়ে অন্ততঃ তাঁকে সেজন্যে কিছু একটা বলে আসা দরকার।
দুজনে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি, তার মাঝে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা সলীল, তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি।
কি জিনিস?
যদি তুই দেখিস একটা মানুষ এমন একটা কাজ করছে যেটা খুব খারাপ-–
সলীল আমাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কত খারাপ?
খুব খারাপ।
কত খুব খারাপ?
এত খারাপ যে–আমি একটু ইতঃস্তত করে বলেই ফেললাম, এত খারাপ যে সে জন্যে মানুষ মারা যেতে পারে।
সলীল রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, সব্বোনাশ!
যদি তাই দেখিস তাহলে তুই কি করবি?
আমি সেই মানুষকে সেই কাজ করতে দিব না। কিছুতেই না।
কিন্তু তুই যদি সেই মানুষকে খুব ভয় পাস?
কত ভয়?
খুব বেশি ভয়।
কত খুব বেশি?
এত খুব বেশি যে তাকে দেখলে তোর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। যে যখন খুশি তোকে মারতে পারে। যে এমন মার মারে যে–
সলীল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোর বাবা? মিস্টার স্যাডিস্ট?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, সেটা আমি বলব না। কিন্তু যদি সেরকম একজন মানুষ হয় এরকম খারাপ কাজ করে তাহলে তুই কি করবি?
সলীল অনেকক্ষণ তার মাথা চুলকাল। আকাশের দিকে তাকাল, মাটির দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, তাহলে আমি কি করব আমি জানি না। কঠিন সমস্যা। অনেক কঠিন সমস্যা।
আমি আর সলীল কোন কথা না বলে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম। ছোট মানুষের বড় সমস্যা খুব সহজ জিনিস নয়।
.
জারুল চৌধুরীর বাসায় গিয়ে দেখি তার গাছঘরটা মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। গাছঘরটা যেটুকু সুন্দর হবে ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক বেশি সুন্দর। উপরে ছাদ দেয়া হয়েছে, এক পাশে বড় জানালা। সামনে ছোট বারান্দা, সেখানে পা ঝুলিয়ে বসে বসে জারুল চৌধুরী একটা ইংরেজি বই পড়ছেন। আমাদের দেখে একগাল হেসে বললেন, আরে! মানিকজোড় দেখি! কি খবর তোমাদের?
আমার হেসে বললাম, আমাদের স্কুলে দুজন মানুষ গিয়েছিল। দুজনেই মোটা আর ফরসা। একজনের মাথায় টাক, আরেকজনের চোখে চশমা। একজন—
জানি! জানি! জারুল চৌধুরী মাথা নেড়ে বললেন, আরেক মানিকজোড়। আমি পাঠিয়েছিলাম, ফিরে এসে সে কি রাগারাগি! যখন উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করল, ধমক দিয়ে বের করে দিলাম।
কি উল্টাপাল্টা কথা বলেছে?
আজেবাজে কথা। আমাকে নাকি লোক লাগিয়ে খুন করে ফেলবে! জারুল চৌধুরী হা হা করে হাসলেন যেন খুব মজার ব্যাপার হয়েছে একটা।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, সত্যি সত্যি যদি খুন করে ফেলে?
আরে ধুর! মানুষ খুন করা এত সোজা নাকি? রাজাকার বাহিনী, বদর বাহিনী আমাকে খুন করতে পারে নাই, আর সেদিনের দুই পুচকে ছোঁড়া আমাকে খুন করবে! মাথা খারাপ নাকি তোমাদের?
আমরা গাছঘরে বসে বসে জারুল চৌধুরীর সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বললাম। খুব মজা করে গল্প করেন জারুল চৌধুরী আর সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ার মত সেটা হচ্ছে, আমাদের সাথে এমনভাবে কথা বলেন যেন আমরা ছোট না, তার মতই বড় মানুষ। গাছঘরটা শেষ করে এখন একটা নৌকা কিনবেন ঠিক করেছেন। সেই নৌকায় করে নাকি নৌকা ভ্রমণে বের হবেন। নৌকায় থাকা, নৌকায় খাওয়া। রাত্রিবেলা হারিক্যান জ্বালিয়ে বই পড়বেন! শুনে আমাদের এমন লোভ লাগল যে বলার নয়।
জারুল চৌধুরী বললেন আমরা যখন খুশি তাঁর গাছঘরে আসতে পারি। এমনিতে গাছঘরে তালা দেয়া থাকবে। নিচে গাছের ফোকড়ে একটা ছোট প্লাস্টিকের কৌটায় চাবিটা রাখবেন। গাছঘরে শুকনো খাবার, পড়ার বই, স্লিপিং ব্যাগ, মোমবাতি সব কিছু রাখা থাকবে। আমরা যদি চাই কোনদিন রাতেও এসে থাকতে পারি।
জারুল চৌধুরীর সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন হঠাৎ সলীল আমাকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, জারুল স্যারকে বলবি?
কি?
তোর সেই কঠিন সমস্যাটা?
আমি প্রথমে মাথা নেড়ে বললাম, না না না—
কেন না?
আমার লজ্জা করছিল এবং সেটা বলতেও আমার লজ্জা করল। সলীল তখন আবার খোঁচা দিয়ে বলল, বল না।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখলাম। আসলেই ব্যাপারটা খারাপ হয় না। জারুল চৌধুরী মনে হয় বলতে পারবেন কি করা যায়। আমি একটু ইতঃস্তত করে সমস্যাটা খুলে বললাম, মানুষটা যে বাবা সেটা আর বললাম না, কিন্তু মনে হল তিনি বুঝে গেলেন।
আমার কথা শুনে তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার শুনে খুব খারাপ লাগল মুনীর যে তুমি এত ছোট মানুষ। কিন্তু তোমার এত বড় সমস্যা। কিন্তু মুনীর, জেনে রাখ, তুমি একা না। তোমার মত অনেকে আছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমারও একই সমস্যা ছিল। বড় বড় মানুষ ছিল যাদেরকে লোকজন সম্মান করত কিন্তু আমি জানতাম তারা কত বড় বদমাইশ। আমি ছোট ছিলাম, তাই ভান করতাম কিছু বুঝি না, কিন্তু আসলে সবই। বুঝতাম। তোমাদের এরকম হয় না?
আমরা মাথা নাড়লাম।
তোমাদের শুধু একটা জিনিস বলে রাখি। তোমরা যেটা সত্যি জান কখনো সেটা থেকে বিশ্বাস হারাবে না। বড় মানুষেরা বদমাইশ হয় হোক, তোমরা কখনো বদমাইশ হবে না। বড় মানুষেরা যে কাজ করে তার সব কাজ ভাল সেটা সত্যি না।
আমরা আবার মাথা নাড়লাম।
আর মুনীর, তোমার যে সমস্যা সেটা খুব সহজ সমস্যা না। অনেক কঠিন সমস্যা। এটা সমাধান করতে হবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে। তোমরাও ভাব, আমিও ভাবি। নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের হবে। যদি কোন বুদ্ধি বের করতে পার আগে আমাকে জানিও! তারপর দেখি কি করা যায়! কি বল?
আমি আর সলীল আবার মাথা নাড়লাম। বাসায় আসার সময় আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকলাম। সত্যি কথা বলতে কি, বাসায় আসতে আসতে বেশ কয়েকটা বুদ্ধি বের হয়ে গেল।