০৮. একটি বিশেষ গুজব

একটি বিশেষ গুজবের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে আনন্দময় চাপা উত্তেজনা। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন উৎসব হতে যাচ্ছে। উৎসবের প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শোনা যাচ্ছে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করা হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আলাদা মর্যাদা পাবেন। তাদের বেতন বৃদ্ধি ঘটবে। সবার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। যারা বাসা পাবেন না, তাদের এমনভাবে বাড়িভাড়া দেওয়া হবে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেই বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হবেন অতিরিক্ত মর্যাদার শিক্ষক।

এখানেই শেষ না, আরও আছে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রস্তাব করা হবে যেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের আজীবন প্রেসিডেন্ট হন। বঙ্গবন্ধু এই প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে মেনে নেবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এত কিছু পাচ্ছেন, তার বিনিময়ে কিছু তাঁদের দিতে হবে। এটাই দ্রতা এবং শিষ্টতা। শিক্ষকেরা সবাই এদিন বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশাল’-এ যোগদান করবেন। সব শিক্ষকের বাকশালে যোগদানের অঙ্গীকারনামা একটি রুপার নৌকার খোলের ভেতর ভরে সমাবর্তন অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়া হবে।

শিক্ষকদের বাকশালে যোগদানের অঙ্গীকারনামায় দস্তখত সংগ্রহ এর মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। তাদের মধ্যে আগ্রহের কোনো কমতি দেখা গেল না। ক্ষমতার সুনজরে থাকা ভাগ্যের ব্যাপার। হাতেগোনা কিছু শিক্ষক অবশ্যি বাকশালে যোগদানে রাজি হলেন না। তারা ভীত এবং চিন্তিতমুখে সময় কাটাতে লাগলেন। এদের একজন আমি, রসায়ন বিভাগের সামান্য লেকচারার। আমি কেন উল্টা গীত গাইলাম তা নিজেও জানি না। বহুদলীয় গণতন্ত্র, একদলীয় গণতন্ত্র বিষয়গুলি নিয়ে কখনো চিন্তা করি নি। আমার প্রধান এবং একমাত্র চিন্তা লেখালেখি। তিনটি উপন্যাস বের হয়ে গেছে। চতুর্থ উপন্যাস ‘অচিনপুর’ রাত জেগে লিখছি। আমাকে ডেকে পাঠালেন অধ্যাপক আলী নওয়াব। ছাত্রাবস্থায় তাকে যমের মতো ভয় পেতাম। শিক্ষক হয়ে সেই ভয় কাটে নি, বরং বেড়েছে। ছাত্রাবস্থায় অনেকের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা যেত। এখন তা সম্ভব না। তার সঙ্গেই ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি প্রাকটিক্যাল ক্লাস নেই। আমাকে সারাক্ষণ তার নজরদারিতে থাকতে হয়।

দুপুরের দিকে নওয়াব স্যারের আলসারের ব্যথা ওঠে। তাঁর মেজাজ তুঙ্গে অবস্থান করে। আমি তুঙ্গস্পর্শী মেজাজের সামনে দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, বসো। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে না। চেয়ার টেনে বসবে। তুমি এখন আমার ছাত্র না, কলিগ।

আমি বসলাম। স্যার বললেন, দুঃখজনক হলেও একটা সত্যি কথা শোনো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হলেন অমেরুদণ্ডী প্রাণী। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের স্রোতের সঙ্গে থাকতে হয়। কী বলছি বুঝতে পারছ?

আমি বললাম, পারছি।

যাও জাফরের সঙ্গে দেখা করো। সে যা বলবে সেইভাবে কাজ করবে।

আমি বললাম, স্যার। অবশ্যই।

অধ্যাপক জাফর মাহমুদ আমার সরাসরি শিক্ষক। তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। ডিগ্রির সঙ্গে ব্রাইটনদের কিছু স্বভাবও নিয়ে এসেছেন। সারাক্ষণ সঙ্গে ছাতা রাখেন। রিকশায় যখন ওঠেন, রিকশার হুড ফেলে ছাতা মেলে বসে থাকেন।

এই মেধাবী অধ্যাপক মানুষ হিসেবে অসাধারণ। তিনি বিড়ালপ্রেমিক। তাঁর ঘরভর্তি বিড়াল। এর মধ্যে একটি বিড়াল অন্ধ। বিড়ালটি তার অসম্ভব প্রিয়। নিজের শোবার বিছানা তিনি এই অন্ধ বিড়ালের জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

জাফর স্যার সম্পর্কে একটি গল্প আগে বলে নেই। এতে মানুষটি সম্পর্কে সবাই কিছু ধারণা পাবেন। তাঁর গাড়ি নেই, সবসময় রিকশায় চলাচল করেন। একদিন তিনি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখেন রিকশাওয়ালার সিটে রক্তের দাগ। স্যার বললেন, এখানে রক্ত কেন?

রিকশাওয়ালা জানাল, কিছুদিন আগে তার পাইলসের অপারেশন হয়েছে। ডাক্তার পনের দিন রিকশা চালাতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু তার সংসার অচল বলে বাধ্য হয়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছে।

স্যার সেদিনই বেতন তুলেছেন। বেতনের পুরো টাকাটা রিকশাওয়ালার হাতে দিয়ে বললেন, এই টাকায় সংসার চালাবে। পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে রিকশা চালাবে না—এটা আমার অর্ডার।

যাই হোক, আমি জাফর স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। স্যার বললেন, তুমি এখনো পিএইচ.ডি করো নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করতে হলে এই ডিগ্রি লাগবেই। তুমি যে কাণ্ড করেছ, এতে সরকারের কাছে বৈরী হয়ে যেতে পার। তখন স্কলারশিপেরও সমস্যা হবে। আমার আদেশ, তুমি বাকশালের কাগজপত্রে সই করবে।

আমি বললাম, আপনার আদেশের বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

বাকশালে যোগদানের কাগজে দস্তখত করার জন্যে রসায়ন বিভাগের অফিসে গেলাম। আমাকে জানানো হলো কাগজপত্র রেজিস্ট্রার অফিসে চলে গেছে। রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে জানলাম সব কাগজপত্র ভাইস চ্যান্সেলরের বাসায় চলে গেছে। আগামীকাল ভোর সাতটা পর্যন্ত সময় আছে ভাইস চ্যান্সেলরের বাসায় গিয়ে বাকশালে ভর্তি হওয়ার। আমি মনে মনে আনন্দিতই হলাম। স্যারকে বলতে পারব, চেষ্টা করেছিলাম।

আমরা তখন থাকি বাবর রোডের একটা পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ির একতলায়। সরকার শহীদ পরিবার হিসেবে আমার মাকে সেখানে বাস করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

এই নিয়েও লঙ্কাকাণ্ড। এক রাতে রক্ষীবাহিনী এসে বাড়ি ঘেরাও করল। তাদের দাবি—এই বাড়ি তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা এখানে থাকবেন। মা শহীদ পরিবার হিসেবে বাড়ি বরাদ্দ পাওয়ার চিঠি দেখালেন। সেই চিঠি তারা মায়ের মুখের ওপর ছুড়ে ফেলল। এরপর শুরু হলো তাণ্ডব। লেপ-তোষক, বইপত্র, রান্নার হাঁড়িকুড়ি তারা রাস্তায় ছুড়ে ফেলতে শুরু করল। রক্ষীবাহিনীর একজন এসে মায়ের মাথার ওপর রাইফেল তাক করে বলল, এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে বের হন, নয়তো গুলি করব। মা বললেন, গুলি করতে চাইলে গুলি করুন। আমি বাড়ি ছাড়ব না। এত রাতে আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাব?

আমার ছোটভাই জাফর ইকবাল তখন মায়ের হাত ধরে তাকে রাস্তায় নিয়ে এল। কী আশ্চর্য দৃশ্য! রাস্তায় নর্দমার পাশে অভুক্ত একটি পরিবার বসে আছে। সেই রাতেই রক্ষীবাহিনীর একজন সুবেদার মেজর ওই বাড়ির একতলায় দাখিল হলেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠে পড়লেন।

একটি শহীদ পরিবারকে অপমানের হাত থেকে রক্ষার জন্যে দুজন মহৎপ্রাণ মানুষ এগিয়ে এলেন। একজনের নাম আহমদ ছফা। তিনি ঘোষণা দিলেন, বঙ্গভবনের সামনে গায়ে কেরোসিন ঢেলে তিনি আত্মাহুতি দেবেন। তিনি এক টিন কেরোসিন কিনে আনলেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছেন মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সমকালের সম্পাদক সিকানদার আবু জাফর।

দুজনের চেষ্টায় ওই বাড়ির দোতলায় দুই মাস পরে আমরা উঠলাম। একতলায় রক্ষীবাহিনীর সুবেদার। তিনি কঠিন বৈরীভাব ধরলেন।

আমাদের বাড়ির ছাদটা ছিল আমার খুব পছন্দের। সন্ধ্যার পর ছাদে হাঁটতাম। পাটি পেতে শুয়ে থাকতাম। আকাশের তারা দেখতাম।

রক্ষীবাহিনীর সুবেদার সাহেব একদিন ঘোষণা করলেন, এই বাড়ির ছাদ তার দখলে। আমরা কেউ ছাদে যেতে পারব না। আমাদের রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আমার ছাদ-ভ্রমণ বন্ধ হয়ে গেল।

আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তার পানির নল সব ভাঙা ছিল। পাইপে করে একতলা থেকে পানি আনার ব্যবস্থা ছিল। সেটাও নির্ভর করত সুবেদার সাহেবের মর্জির ওপর। কোনো কোনো দিন তিনি পানির সাপ্লাই বন্ধ করে দিতেন। আমাদের পানি ছাড়াই চলতে হতো। স্নান বন্ধ।

আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে পরিত্যক্ত বিশাল এক তিনতলা বাড়িতে দলবল নিয়ে থাকতেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। রক্ষীবাহিনী আমাদের রাস্তায় বের করে দেওয়ার পর সাহায্যের আশায় আমি তার কাছেও গিয়েছিলাম। তিনি অতি তুচ্ছ বিষয়ে তাঁকে বিরক্ত করায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। মহাবিপদে মানুষ খড়কুটো ধরে, আমি বঙ্গবীরকে ধরতে গিয়ে দেখি তিনি খড়কুটোর মতোই।

সেই সময় ঢাকা শহরে গুজবের অন্ত ছিল না। একটা প্রধান গুজব হলো— সরকারের নিমূল বাহিনী কাজ করছে। সন্দেহভাজন যুবক ছেলেদের ধরে ধরে নিয়ে যায়, তারপর আর তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। এই গুজবের কিছু সত্যতা থাকতেও পারে।

সেই সময় নিজেকে নিয়ে আমি খুব ভীত ছিলাম। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমার মনে হতো, এই বুঝি দরজায় কড়া নড়বে। আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। শেখ কামালের নামে ভয়ঙ্কর সব গুজব কিংবা রটনা প্রচলিত ছিল। এর একটি ব্যাংক-ডাকাতি বিষয়ক। আমি এই গুজব তখনো বিশ্বাস করি নি, এখনো করি না। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে বাড়তি অর্থের জন্যে ডাকাতি করার প্রয়োজন পড়ে না। দুঃখের সঙ্গে বলছি, সেই সময় নিজ দেশে আমাকে মনে হতো পরবাসী। দেশটাকে বুঝতেও পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল দেশের এনট্রপি শুধুই বাড়ছে। থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র—এন্ট্রপি হলো বিশৃঙ্খলার মাপ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে ঠিকঠাক করে তুলতে সবাই সাহায্য করবে। এটাই আশা করা হয়, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে তখন অস্বাভাবিকের রাজত্ব। সব দল বর্ষার কই মাছের মতো উজিয়ে গেছে। মাঠে নেমেছে সর্বহারা দল। যেহেতু তারা সর্বহারা, তাদের আর কিছু হারাবার নেই। তারা নেমেছে শ্রেণীশত্রু খতমে। তাদের প্রধান শত্রু আওয়ামী লীগ। পত্রিকার পাতা উল্টালেই সর্বহারার হাতে নিহত আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবি পাওয়া যায়। সর্বহারা দলের প্রধান সিরাজ সিকদার। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সর্বহারাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তারা বাংলাদেশকে বদলে দেবে। বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক দেশ। বিশেষ ধরনের এই সমাজতন্ত্র কায়েম শ্রেণীশত্রু খতম দিয়ে শুরু করতে হয়। চলছে হত্যাকাণ্ড।

গোকুলে বাড়ছে রক্ষীবাহিনী। সাভারে তাদের বিশাল ক্যাম্প। ট্রেনিংয়ে আছেন ভারতীয় মেজর রেডিড। রক্ষীবাহিনীর পোশাকও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো জলপাই রঙের। এই বাহিনীর অফিসাররা ট্রেনিং পেতেন ভারতের দেরাদুন ব্যাটল স্কুল থেকে। রক্ষীবাহিনীর ফরমেশন সাইন’ ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত তর্জনি। এ থেকে মনে করা স্বাভাবিক, বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্যই ছিল এই বাহিনীর মূলমন্ত্র। এটা স্বাভাবিকও ছিল, কারণ রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যই ছিল প্রাক্তন মুজিব এবং কাদের বাহিনীর সদস্য।

আমি কচ্ছপস্বভাবের মানুষ। ঝামেলার আঁচ পেলে খোলসের ভেতর ঢুকে বসে থাকতে পছন্দ করি। খোলসের ভেতর আবদ্ধ থেকে দেশের সে সময়কার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আমার পক্ষে করা কঠিন। তারপরেও মনে হয়, রক্ষীবাহিনী ছিল সামরিক বাহিনীর প্রতিপক্ষ। এই বাহিনী এমনভাবে সাজানো ছিল যে, অতি দ্রুত তাদের সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে দাঁড়া করানো যায়।

যখন সত্যিকার প্রয়োজন দেখা দিল তখন রক্ষীবাহিনীর টিকির দেখাও পাওয়া গেল না। অল্পকিছু সেনাসদস্যের বিদ্রোহ দমন তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। বরং তারা উল্টোটাই করল। সাভারে রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে তখন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। রক্ষীবাহিনী তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে কী করতে হবে জানতে চেয়ে বারবার বিদ্রোহীদের কাছে খবর পাঠাতে লাগল। ভাবটা এরকম যে, আমরা ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। ইঙ্গিত পেলেই বিদ্রোহী সরকার যা করতে বলবে করব। বান্দা হাজির।

রাজনীতির কচকচানি থাকুক, নিজের কথা বলি। আমি তখন চরম অর্থনৈতিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমার বেতন এবং বাবার পেনশনের সামান্য (দুইশত) টাকা গোটা পরিবারের সম্বল। মাসের শেষের দিকে মা বের হন ধার করতে। মার পরিচিতজনরা তাঁকে দেখলেই আতঙ্কিত বোধ করেন।

গোদের ওপরে ক্যানসারের মতো অপ্রয়োজনীয় মেহমান আমাদের বসার ঘর আলো করে বসে থাকেন। এদের একজন কাইয়ুম ভাই। তিনি অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। রাজশাহী বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় থার্ড হয়েছিলেন। ঢাকায় পড়তে এসে তার ব্রেইনে গিটু লেগে গেল। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তিনি ইসলামি লেবাস গায়ে তুলে নিলেন। দাড়ি রাখলেন। চোখে সুরমা দেওয়া শুরু করলেন। ধর্মের প্রতি প্রবল আসক্তি যে-কোনো বয়সেই আসতে পারে। এটা দৃষণীয় না। দূষণীয় হলো—তার মা-বাবা ঢাকায় থাকেন। কাইয়ুম ভাই নিজের বাসা ছেড়ে ভোরবেলা আমাদের বাবর রোডের বাসায় চলে আসতেন। নাস্তা খেতেন, দুপুরের খাবার খেতেন, রাতের ডিনার শেষ করে নিজের বাসায় যেতেন। পরদিন ভোরে আবার উপস্থিত। খেতে বসে প্রায় সময়ই বলতেন, খাবারের মান আরেকটু উন্নত হওয়া প্রয়োজন।

চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসায় রাতে রুটি খাওয়া হতো। শুকনো রুটি কাইয়ুম ভাইয়ের গলা দিয়ে নামে না বিধায় তার জন্যে ভাত রাঁধা হতো।

দ্বিতীয় যে মেহমান ড্রয়িংরুমে মাঝে মাঝে এসে বসে থাকত, তার সঙ্গে আমি ঢাকা কলেজে পড়েছি। সুদর্শন রূপবান যুবক। সবসময় ইংরেজিতে কথা বলত বলে কলেজে তার নাম ছিল ইংলিশম্যান’। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তার পুরোপুরি মাথা খারাপ হয়ে যায়। তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি শুরু করেছি। আমার দায়িত্ব ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের স্লাইড রুমের ব্যবহার শেখানো। হঠাৎ দেখি ক্লাসে মাথা নিচু করে ইংলিশম্যান বসে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি ইংলিশম্যান না?

সে উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে বলল, Yes sir.

আমি বললাম, তুমি আমাকে স্যার বলছ কেন? তুমি আমার বন্ধু।

সে বলল, Now you are my respected teacher.

তার কাছে শুনলাম অনেকদিন মস্তিষ্কবিকৃতি রোগে ভুগে এখন সে সুস্থ হয়েছে। আবার পড়াশোনা শুরু করেছে।

আমি তাকে বাবর রোডের বাসায় নিয়ে গেলাম। তার জন্যে আমি অত্যন্ত ব্যথিত বোধ করছিলাম। তাকে বললাম, পড়াশোনায় সবরকম সাহায্য আমি করব। আমাকে স্যার ডেকে সে যেন লজ্জা না দেয়। আগে যেভাবে হুমায়ূন ডাকত এখনো তা-ই ডাকবে।

তিন থেকে চার মাস ক্লাস করার পর আবার সে পাগল হয়ে গেল। একদিন হতভম্ব হয়ে দেখি, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সে ইউনিভার্সিটিতে এসেছে। রসায়ন বিভাগের প্রতিটি রুমেই সে ঢুকে ব্যাকুল হয়ে বলছে, হুমায়ূন কোথায়? হুমায়ূন? My friend and my respected teacher হুমায়ূন?

সে শুধু রসায়ন বিভাগে না, বাবর রোডে আমার বাসাতেও হানা দিতে শুরু করল। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন সে আসবেই। একটি যুবক ছেলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসার ঘরে সারা দিন বসে আছে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

শুধু একজন বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতেন, তিনি কাইয়ুম ভাই। জাব্বা জোব্বা পরা মাওলানা, পাশে নগ্ন ইংলিশম্যান। কাইয়ুম ভাইয়ের ভাবভঙ্গি থেকে মনে হতো বিষয়টা স্বাভাবিক।

 

১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার। ইউনিভার্সিটিতে কোনো ক্লাস ছিল না। হেঁটে হেঁটে বাবর রোডের বাসায় এসেছি। অর্থ সাশ্রয়ের চেষ্টা। আমি রোগাভোগা হওয়ার কারণে বাসে ঠেলাঠেলি করে কখনো উঠতে পারি না। রিকশা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাসায় ঢুকে দেখি, কাইয়ুম ভাই এবং ইংলিশম্যান পাশাপাশি বসা। ইংলিশম্যান যথারীতি নগ্ন। কাইয়ুম ভাই বললেন, হুমায়ূন, তোমরা তরকারিতে বেশি ঝাল দাও। আমি এত ঝাল খেতে পারি না। তোমার মাকে আমার জন্যে কম ঝালের তরকারি রাঁধতে বলবে।

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। একবার ভাবলাম বলি, অনেক যন্ত্রণা করেছেন। এখন আমাদের মুক্তি দিন। বলতে পারলাম না। যৌবনের শুরুতে আমি অনেক ভদ্র, অনেক বিনয়ী ছিলাম।

ইংলিশম্যান আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মনে হয় শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখিয়ে দাঁড়ানো। কাইয়ুম ভাইয়ের কথা শেষ হওয়ামাত্র সে গলা নামিয়ে বলল, হুমায়ূন, আমাকে একটা প্যান্ট দাও। কিছুক্ষণ আগে তোমার ছোটবোন শিখু উঁকি দিয়েছিল। তাকে দেখার পর থেকে লজ্জা লাগছে। একটা প্যান্ট দাও। প্যান্ট পরে চলে যাব।

আমার তখন দুটামাত্র প্যান্ট। একটা দিয়ে দেওয়া মানে সর্বনাশ। তারপরেও প্যান্ট এনে তাকে পরালাম। সে ইংরেজিতে বলল, তুমি আমার একমাত্র বন্ধু। আমার আর কেউ নেই। এইজন্যে তোমাকে একটা খবর দিতে এসেছি। গোপন খবর। কেউ জানে না, শুধু আমি জানি। পুরোপুরি পাগল হলে গোপন খবর পাওয়া যায়। খবরটা হচ্ছে, আগামীকাল থেকে রক্তের নদী—River full of fresh blood. Blood blood and blood. কার রক্ত দিয়ে শুরু হবে তা জানতে চাও? জানতে চাইলে তোমাকে বলব, আর কাউকে বলব না। মাছিকেও বলা যাবে না।

আমি বললাম, জানতে চাই না।

পাগল প্রলাপ বলবে তা-ই স্বাভাবিক। পাগলের কথার কোনো গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

ইংলিশম্যান গলা নিচু করে বলল, হুমায়ূন, সাবধানে থাকবে।

আচ্ছা থাকব।

দরজা জানালা বন্ধ করে খাটের নিচে শুয়ে থাকবে।

আমি বললাম, আচ্ছা থাকব।

ইংলিশম্যান প্যান্ট পরে ঘর থকে বের হলো। আমাদের বাসা পার হওয়ার পর পর প্যান্ট খুলে ছুড়ে ফেলে নগ্ন হয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু নিল কয়েকটা কুকুর। তারা ঘেউ ঘেউ করছে, ইংলিশম্যানকে কামড়ানোর ভঙ্গি করছে। ইংলিশম্যান ফিরেও তাকাচ্ছে না। পাগলরা কুকুর ভয় পায় না—তা জানতাম না। প্রথম জানলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *