একটা সূক্ষ্ম কোন পরিবর্তন ঘটে গেছে।
কেউ কিছু বলছে না কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। সব বলতে হয় না। না বললেও অনেক কিছু বোঝা যায়। তা ছাড়া আসমানী বোকা মেয়ে নয়। সে বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে এবং তাকে নিয়েই হয়েছে। সেই কিছুটা কি? তাকে কেউ বলছে না। কখনো বলে না। সে কি নিজেই কাউকে জিজ্ঞেস করবে? এতটা নির্লজ্জ কি সে হবে?
জহির নামের যে ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে আছে, আজ থেকে মাত্র চারদিন পর যে বিয়ের অনুষ্ঠানটি হবে তাতে কি কোন সমস্যা?
ওরা কি হঠাৎ ঠিক করল এরকম বিয়ে হওয়া মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়া যায় না? তারা কি অন্য একটি মেয়ের খোঁজ পেয়েছে যার আগে বিয়ে হয় নি? বিয়ে মানে কি ছিঁড়ে নেয়া ফুল? যে ফুল আর ব্যবহার করা যাবে না।
আসমানী রান্নাঘরে ঢুকল। তার মামী কড়াইয়ে কী যেন নাড়ছেন। সে কি কিছু জিজ্ঞেস করবে মামীকে? মামী একা থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত। তিনি একানো। তিনচারজন মানুষ রান্নাঘরে। এদের মধ্যে অপরিচিত সুন্দরমতো একটি মেয়েও আছে। এর সামনে কিছু জিজ্ঞেস করার অর্থই হয় না।
আসমানীকে ঢুকতে দেখেই মামী বললেন, কিছু বলবি না-কি রে আসমানী?
আসমানী বলল, না।
যাচ্ছিস কোথায়?
কোথাও না।
আসমানী লক্ষ করল রান্নঘরে উপস্থিত সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সমস্যাটা কি? তাকে বলে ফেললে কি হয়? তার মন এখন শক্ত হয়েছে। সে এখন আগের মতো না। অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে না, পড়বেও না।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসমানী ভেতরের বারান্দায় খানিকক্ষণ ইতস্তত হাঁটল। ভেতরের বারান্দায়ও বেশ কিছু মানুষ। বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনরা আসতে শুরু করেছেন।
ওরা সবাই এমন করে তাকাচ্ছেন কেন?
সুতিয়াখালির বড় ফুপুও দেখি এসেছেন। ইনাকে আসমানীর মোটেই পছন্দ না। সুতিয়াখালির ফুপু ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে ভয়ঙ্কর সব ঝগড়া করেন। ঝগড়ার পর কঠিন অভিশাপ দেন। লোকে বলে, তাঁর অভিশাপ নাকি সঙ্গে-সঙ্গে লেগে যায়।
বড় ফুপু বললেন, আসমানী যাস কই?
একটু বাইরে যাচ্ছি বড় ফুপু।
তোর সাথে কথা আছে।
মামী রান্নাঘর থেকে এই কথা শুনতে পেয়ে ছুটে এসে বললেন, না না কোনো কথা নেই। আসমানী যেখানে যাচ্ছে যাক।
আসলে আসমানীর কোথাও যাবার জায়গা নেই। ঘর থেকে শুধু বের হওয়া। বের হয়েইবা সে কোথায় যাবে? সে শুনেছে পুরুষদের একা-একা ঘুরতে ভালো লাগে। মেয়েদের লাগে না-অন্তত তার লাগে না। তার সব সময় ইচ্ছা করে পাশে কাউকে না কাউকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটার সময় ছোটখাট দুএকটা কথা হবে, গল্প হবে, হাসাহাসি হবে। তবেই না হেঁটে আনন্দ।
আসমানী একটা রিকশা নিল।
রিকশাওয়ালাটা বেশ মজার। কোথায় যাবে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। উঠে বসার সঙ্গে-সঙ্গে চালাতে শুরু করেছে। যেন সে আসমানীর গন্তব্য জানে। আসমানীও কিছু বলল না। যাক না যেখানে যেতে চায়।
আচ্ছা, ঐ লোকটির বাসায় হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হলে কেমন হয়? খুব কি অন্যায় হয়? না কোনো অন্যায় হয় না। থাক, বাসা ভর্তি লোকজন থাকলে সে লজ্জা পাবে। আসমানী আবার ভাবল, লোকজন বোধহয় থাকবে না। ঐ লোকটি বড়ই একা।
জহির দরজা খুলে তাকিয়ে রইল।
আসমানী লাজুক গলায় বলল, আসব?
আসমানীর পরনে হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি। চুলগুলি বেণী করে বাঁধার কারণে তাকে বালিকা-বালিকা দেখাচ্ছে।
জহির বলল, এস।
কি করছিলেন?
রান্না করছিলাম।
আপনি কি নিজেই রান্না করেন? মাঝে-মাঝে করি। তবে বেশিরভাগ সময় বাইরেই খাই। ঘরে একটা কাজের লোক আছে, ও আবার রান্না জানে না।
বসব?
বস বস। কেন বসবে না?
আপনাকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছেন। আপনার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
মনে হচ্ছে আপনার খুব শরীর খারাপ।
না আমার শরীর খারাপ না।
ইস ঘরটা আপনি এত বিশ্রী করে রেখেছেন। এত ক্যালেন্ডার কেন আপনার ঘরে? পুরানো ক্যালেন্ডারও দেখি আছে। ফেলতে মায়া লাগে, তাই না?
হ্যাঁ।
আমারও মায়া লাগে। আমিও সব পুরানো জিনিস জমা করে রাখি। আপনি আজ কী রান্না করছেন?
তেমন কিছু না। ভাত আর ডিম।
আসমানী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনার সম্পর্কে আমি একটা খুব অদ্ভুত কথা শুনেছি, আপনি নাকি সাত বছর বয়স থেকে মিথ্যা কথা বলেন না।
কার কাছ থেকে শুনেছ?
যার কাছ থেকেই শুনি না কেন, সত্যি না মিথ্যা সেটা বলুন।
ঠিকই শুনেছ। আমার এক বাংলার স্যার বলেছিলেন কেউ যদি চল্লিশ বছর মিথ্যা কথা না বলে থাকতে পারে, তাহলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়। তখন আমার বয়স ছিল কম। কম বয়সী বাচ্চারা তো পৃথিবীর সব কথাই বিশ্বাস করে। আমিও করেছিলাম। আমি তখন থেকেই মিথ্যা বলি না।
আসমানী বলল, মিথ্যা না বললে যে অদ্ভুত ব্যাপারটা হয়, সেটা কি?
অদ্ভূত ব্যাপারটা হচ্ছে তখন আল্লাহ ঐ লোকের একটি প্রশ্নের জবাব দেন। প্রশ্নটি যত কঠিনই হোক, জবাব পাওয়া যায়।
আসমানী লজ্জিত গলায় বলল, ঐ দিন আমি আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছিলাম। এটা ভেবে আমার এখন খুব খারাপ লাগছে। আপনি কিছুমনে করবেন না। আমি বাকি জীবনে কখনো আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। ঐ লোকটির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি সারাদিন উনার সঙ্গে ছিলাম।
জহির শান্ত গলায় বলল, আমি জানি।
আপনি জানেন?
হ্যাঁ, জানি। কেউ মিথ্যা বললে আমি ধরে ফেলতে পারি।
সত্যি।
হ্যাঁ সত্যি। সারাজীবন পরের বাড়িতে মানুষ হয়েছি। আমাকে সারাক্ষণ খেয়াল রাখতে হয়েছে কে আমার সম্পর্কে কি ভাবছে, কে আমাকে কীভাবে দেখছে। এইসব দেখতে দেখতে একসময় টের পেলাম আমিও অনেক কিছু বুঝতে পারি। কেউ যখন সত্যি করে বলে ভালবাসি, সেটা যেমন বুঝি, আবার কেউ যখন মিথ্যা করে বলে ভালবাসি, সেটাও বুঝি। শুধু একজনেরটাই পারি না।
সেই একজনটা কে?
জহির চুপ করে রইল।
আসমানী বললআপনার মামাতো বোন অরু, তাই না?
হ্যাঁ।
দেখলেন তো আমিও অনেক কিছু বুঝতে পারি।
তাই তো দেখছি।
আচ্ছা উনি কি বয়সে আমার বড়?
না মনে হয়।
উনি কি খুব কথা বলেন।
না। ও সবচেয়ে কম কথা বলত। এখন খুব কথা বলে। সারাক্ষণ কথা বলে।
কেন বলে জানেন?
না।
আমি জানি। উনি উনার স্বামীর কাছ থেকে বেশি কথা বলা শিখেছেন। নিশ্চয়ই উনার স্বামী খুব কথা বলেন। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর মতো হয়ে যায়।
জহির হো-হো করে হেসে ফেলল।
আসমানী বলল, দেখলেন আমার কত বুদ্ধি? এখন আপনি দয়া করে একটু সরুন, আমি আমার নিজের জন্য এক কাপ চা বানাব।
মেয়েটা হাসছে। এত ভালো লাগছে দেখতে। জহির লক্ষ করল তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তার বড়ই লজ্জা লাগছে। সে খুব চেষ্টা করতে লাগল চোখের পানি শুকিয়ে ফেলতে।
আসমানী বলল, জানেন আপনার এখানে আমি খুব ভয়ে-ভয়ে এসেছি।
কেন বল তো?
আজ বাসায় কি জানি হয়েছে। মনে হয় বিরাট কোনো ঝামেলা। আমার বিয়েটা সম্ভবত ভেঙ্গে গেছে।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, কি বলছ এসব!
সত্যি বলছি। আমি আগে-আগেই অনেক কিছু বুঝতে পারি।