০৮. ইদানীং সরিৎশেখর কোরা ধুতি পরেন

ইদানীং সরিৎশেখর কোরা ধুতি পরেন। একজোড়া মিলের কাপড় সস্তায় কিনে দুটো টুকরো করে নেওয়া যায়। সব দিক থেকে খরচ কমিয়েও যেন আর তাল ঠিক রাখতে পারছেন না। হেমলতার সঙ্গে এখন প্রায়ই তার ঝগড়া হয় জিরে মরিচ কয়লা নিয়ে। বিশ সের কয়লায় এক সপ্তাহ যাওয়ার কথা, সেখানে একদিন আগে হেমলতা কোন আক্কেলে ফুরিয়ে ফেলেন! এসব কথাবার্তা চলার সময় যদি অনি এসে পড়ত তা হলে আগে ওঁরা চুপ করে করে যেতেন। কিন্তু ইদানীং আর যেন তার। প্রয়োজন হয় না। খালিবাড়িতে দুজন চিৎকার করলে বাইরের লোকের কানে যাবে না। পরম সুখে ওঁদের ঝগড়া করতে দ্যাখে অনিমেষ। পিসিমার মেজাজ আরও খারাপ, কারণ কদিন আগে ব্যাংক থেকে পিসিমার টাকা তুলে দাদু বাড়ির কাজে লাগিয়েছেন।

বাড়িতে এখন মাছ আসে না। হেমলতার যত বয়স হচ্ছে তত মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারছেন না। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, মাছ খাবার ইচ্ছে হলে লোক রাখুন বা হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসুন। সরিৎশেখরের মাছ খাওয়া বন্দ হয়েছিল আগেই, শুধু অনিমেষের জন্য মাছ আসত বাড়িতে। হেমলতার ঠ্যাচামেচিতে তিনি সেটা বন্ধ করে দিলেন এবং হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। জলপাইগুড়িতে মাছের দাম এখন আকাশছোঁয়া। কই মাগুর চল্লিশ টাকা সের বিক্রি হচ্ছে। পোনামাছ চালান আসে বাইরে থেকে, সেখানে ঢোকে কার সাধ্য! বাজারের বরাদ্দ টাকার প্রায় আড়াই ভাগ অনির মাছের পেছনে চলে যেত। সেটা বেঁচে যেতে মনটা একটু খারাপ হলেও স্বস্তি পেলেন। সম্প্রতি ইংরেজি কাগজে একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে আমিষ-নিরামিষ নিয়ে। ভেজিটেবল প্রোটিন অ্যানিমেল প্রোটিনের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। ভারতবর্ষের প্রচুর মানুষ যে নিরামিষ আহার করে তাতে তাদের কার্যদক্ষতা বিন্দুমাত্র কমে না, বরং অনুসন্ধানে জানা গেছে যে নিরামিষাহারী মানুষ দীর্ঘজীবি হয়। কাগজটা তিনি অনিকে পড়তে দিয়েছিলেন। যদিও মাঝে-মাঝে তার এই নাতির মুখে এক টুকরো মাছ দিতে পারছেন না বলে মনেমনে আক্ষেপ হয়, কাউকে বলেন না।

বাজারদর হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। গ্রাম-অঞ্চল থেকে মানুষের মিছিল কাজের আশায় শহরে ভিড় করছে। এমনিতেই তাঁদের শহর পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি খরচের জায়গা, কারণ এখানে ধনীদের প্রাধান্য বেশি। সরিৎশেখরের মাথার ঠিক থাকছে না, হেমলতার সঙ্গে ঝগড়া বেড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সবাই ঠকাছেআকে। যে-গয়লাটা দুধ দিয়ে যায় তার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল অতিরিক্ত জল মেশাচ্ছে বলে। কয়লাওয়ালা কাঁচা কয়লা দিয়ে টাকা লুটছে। পরপর কয়েক বছর বন্যা এসে পলিমাটি ফেলে বাগনটার যে-চেহারা হয়েছে তাতে তোক দিয়ে শাকসবজি লাগালে কোনো কাজ হবে না। মহীতোষ যে-টাকা পাঠায় তা বাড়ছে না। এদিকে বাজারদর যে থেমে থাকছে না! ছেলের কাছে টাকা। চাইতে এখন আর কুণ্ঠা নেই, কিন্তু মহীতোষের সাধ্যের সীমাটা তিনি জানেন। যে-টাকাটা সে পাঠাচ্ছে তাতে অনিমেষ হোসেটলে আরামে থাকতে পারত।

মাস শেষ হতে আর দুদিন আছে। সরিৎশেখর কিং সাহেবের ঘাট থেকে বেড়িয়ে ফিরছিলেন। আজ ছুটির দিন, কোর্টকাছারি বন্ধ। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে কোনো লোক তাই শহরে আসেনি। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন তিনি। আজ সকালে বাজার করার পর ওঁর কাছে তিনটে আধুলি পড়ে আছে। সামনে আর দুটো দিন, তারপর স্বৰ্গছেঁড়া থেকে টাকা আসবে। কী করে এই দুদিন চলবে? চাকরি করার সময় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তাকে কোনোদিন এই অবস্থায় পড়তে হবে হঠাৎ ওঁর মনে হল রিটায়ার করার পর বেশিদিন বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। দীর্ঘজীবি অর্কর্মণ্য হয়ে থাকলে এইসব সমস্যার সামনে দাঁড়াতেই হবে।

আজকাল জোরে হাঁটলে ভাঙা পা-টা টনটন করে। খুব আস্তে-আস্তে তিনি পি ডর ডি অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। ওদিকে তিস্তার পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। এতদিন পর তিস্তা বাধ প্রকল্প হয়েছে। প্রতি বছরের বন্যা থেকে বাঁচার জন্য জলপাইগুড়ি শহরের গা-ঘেঁষে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। জোর তোড়জোড় চলছে ওখানে। পি ডর ডির অফিসটা পেরোতেই একটা জিপগাড়ি সজোরে ওর পাশে ব্রেক কষে দাঁড়াল। এখন খুব সতর্ক হয়ে রাস্তার বাঁপাশ ঘেঁষে হাঁটেন সরিৎশেখর। চোখ তুলে দেখলেন দুই-তিনজন লোক জিপ থেকে নেমে তার দিকে আসছেন।

ধুতিপরা এক ভদ্রলোক বললেন, যা স্যার, আমার ভুল হয়নি, ইনিই সরিৎশেখরবাবু। মাথা নেড়ে একজন লম্বাচওড়া টাই-পরা ভদ্রলোক সরিৎশেখরের সামনে এসে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন, আপনি সরিৎশেখর?

একটু অবাক হয়ে ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর।

ভালোই হল পথে আপনার সাথে দেখা হয়ে। আমরা আপনার বাড়িতে যাচ্ছিলাম। আমি তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের অ্যাসিস্টেন্ট একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।

সরিৎশেখর নমস্কার করে উদ্দেশ্যটা শুনবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

সঙ্গের ভদ্রলোক বললেন, স্যার, বাড়িতে গিয়ে কথা বললে ভালো হয় না?

ইঞ্জিনিয়ার বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সে-ই ভালো। আপনি বোধহয় বাড়িতেই যাচ্ছিলেন, তা আসুন আমার গাড়িতেই যাওয়া যাক।

তার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে ভদ্রলোক জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন। এক-একজন মানুষ আছেন যারা কথা বললেই একটা কওঁতের আবহাওয়া তৈরি হয়ে যায়, যেন তিনি যা বলছেন তার পর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। সরিৎশেখর বুঝতে পারছিলেন না যে তার সঙ্গে তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের কী সম্পর্ক থাকতে পারে। ইঞ্জিনিয়ার জিপে বসে আবার ডাকলেন, কই, আসুন!

অগত্যা সরিৎশেখরকে জিপে উঠতে হল। ধারের দিকে জায়গা করে দিলেও সরিৎশেখরের বসতে অসুবিধে হচ্ছিল। শক্ত-হাতে সামনের রড আঁকড়ে বসেছিলেন তিনি জিপটা হুহু করে টাউন ক্লাবের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল। ইঞ্জিনিয়ার বললেন, আপনার ফ্যামিলি মেম্বার কত, মানে এই বাড়িতে?

সরিৎশেখর বললেন, তিনজন। কেন?

ইঞ্জিনিয়ার অবাক হলেন, সেকী! আপনার বাড়ি তো শুনেছি বিরাট বড়। তা এত বড় বাড়িতে তিনজন মানুষ কী করেন?

সরিৎশেখর এবার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন, ব্যবহার হয় না ঠিক নয়, আত্মীয়স্বজনরা এলে থাকবে তাই করা।

ততক্ষণে জিপটা বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। রাস্তাটা আগ বড় ছিল। কিন্তু যেহেতু জমিটা পি ডব্লু ডির, সরিৎশেখর অনেক চেষ্টা করেও তাদের স্টাফদের কোয়ার্টার বানাবার ব্যাপারে বাধা দিতে পারেননি। এখন জমি ঘিরে রাস্তাটা এত সরু হয়ে গেছে যে রিকশা অথবা একটা জিপ কোনোক্রমে ঢুকতে পারে। এই নিয়ে বহু চিঠি লিখেছেন তিনি, কোনো কাজ হয়নি।

ইঞ্জিনিয়ার বললেন, বাবঃ, এত সরু রাস্তা! মিউনিসিপ্যালিটি অ্যালাউ করল? সরিৎশেখর বললেন, আপনাদের সরকার বাহাদুরের ব্যাপার, আমরা বললে তো হবে না।

ভদ্রলোক যেন বিরক্ত হয়েছেন খুব, না না, এ খুব অন্যায়। বাড়ি করতে দিলে তাকে যাতায়াতের রাইট দিতে হবে। ঠিক আছে, আমি ব্যাপারটা দেখছি।

গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো, আপনাদের আসবার উদ্দেশ্যটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না।

ইঞ্জিনিয়ার তখন কোমরে হাত দিয়ে বাড়িটা দেখছিলেন। এখন ভর-বিকেল রোদ গাছের মাথায়। নতুন বাড়িটা খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সরিশেরের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমরা শহরে ভালো বাড়ি খালি পাচ্ছি না। আজ আপনার বাড়ির খবরটা পেয়ে চলে এলাম। তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে এ-বাড়িটা আমরা চাই।

চাই মানে? হতভম্ব হয়ে গেলেন সনিৎশেখর।

অবশ্যই ভাড়া চাই। তবে ভেতরটা দেখে নিতে হবে আগে।

আপনি বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছেন?

আমি নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

সরিৎশেখর কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। বাড়িটা ভাড়া দেবার কথা হেমলতা প্রায়ই বলে থাকেন তাকে। যেভাবে রাজারদর বাড়ছে তাতে সামলে ওঠা যাচ্ছে না। এই তো আজই তার পকেটে কয়েকটা আধুলি পড়ে আছে। আগে গল্পচ্ছলে বলতেন এই বাড়ি তার ছেলের মতন, অসময়ে দেখবে। কিন্তু যাকে-তাকে ভাড়া দিতে একদম নারাজ তিনি, বিশেষ করে ফ্যামিলিম্যানকে। এর আগে অনেকেই এসেছে তার কাছে। কিন্তু হেগে-মুতে একাকার হয়ে যাবে বলে মুখের ওপর না বলে দিয়েছেন সবাইকে। এখন সরকার যদি তার বাড়ি ভাড়া নেয় তা হলে তো ঝামেলার কিছু থাকে না। মাস গেলে ভাড়াটা নিশ্চিত। তা ছাড়া জলপাইগুড়িতে এখন বাড়িভাড়া হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। খালি পড়ে থাকলে বাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। ভাড়া দিলে প্রতি মাসের টাকাটায় কী উপকার হবে ভাবলে পায়ে জোর এসে যায়। কিন্তু, তবু একটা কিন্তু এসে যাচ্ছে যে মনে! যারা এসে থাকবে তারা লোক কেমন হবে। সরকারি অফিস তো, পাঁচ ভূতের ব্যাপার, বাড়ির ওপর কারও দয়াময়া থাকবে না।

ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেছেন। সরিৎশেখর ওঁর পেছন পেছন উঠতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ভাবছেন আপনি?

সরিৎশেখর সত্যি কথাটা একটু অন্যভাবে বললেন, এ-বাড়ি ভাড়া দেব কি না আমি তো এখনও ঠিক করিনি। তা ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ভদ্রলোক এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমাদের ওপর নির্দেশ আছে যেকোনো খালি বাড়ি আমরা প্রয়োজন বোধ করলে রিকুইজিশন করে নিতে পারি। যে-কয় বছর ইচ্ছে আমরা থাকব-আপনার কিছু বলার থাকবে না। তাই আপনি আমার সাজেশনটা নিন, ভাড়া দিতে রাজি হয়ে যান, নইলে পরে আফসোস করবেন।

এদিকটা জানতেন না সরিৎশেখর। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর মাথা গরম হয়ে গেল। এরা কি ভয় দেখিয়ে তার বাড়ি দখল করতে চায়? সরকারের কি এ-ক্ষমতা আছে? ওর মনে পড়ল সেই পঞ্চাশ সালে কংগ্রেস থেকে তাঁর বাড়িতে অফিস করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তখন কেউ ভয় দেখায়নি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন তিনি। তারপর হেমলতাকে ডেকে দরজা খুলতে বললেন। অনিমেষ বাড়িতে নেই। খুব বিরক্ত হলেন কথাটা শুনে। আজকাল যেস কোথায়-কোথায় যোরে টের পান না। তিনি। মাথায় লম্বা হয়েছে, গালে দুএকটা ব্রন বের হয়েছে। এই সময় মন চঞ্চল হয়।

সরিৎশেখর ইঞ্জিনিয়ারকে বাড়িটা দেখালেন। দুটো ঘর তার চাই। বাকি ঘরগুলো ওঁরা নিতে পারেন। বাড়ি দেখে খুব খুশি ইঞ্জিনিয়ার। সরিৎশেখরের থাকার ঘর দুটো আলাদা করে দিলে সামনের দিকে সমস্ত বাড়িটাই ওঁদের হাতে আসবে। একদম সাহেবি বন্দোবস্ত, অফিস কাম রেসিডেন্স করতে কোনো অসুবিধা নেই। ঘুরে ঘুরে খুব প্রশংসা করলেন সরিৎশেখরের বাড়ি বানাবার দক্ষতার। দেখলেই বোঝা যায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করানো, কোনো কন্ট্রক্টরের ওপর ছেড়ে দেওয়া নয়।

শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার বললেন, কাল আমার অফিসে আসুন, ভাড়াটা ঠিক করে নেওয়া যাবে।

সরিৎশেখর এতক্ষণ মনেমনে আঁচ করছিলেন কীরকম ভাড়া পাওয়া যেতে পারে।

এখন বললেন, সরকার কত ভাড়া দেবেন মনে হয়?

ইঞ্জিনিয়ার বললেন, আমি এখনই বলতে পারছি না। ওপরওলার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সাধারণত সরকার বাড়িভাড়া ঠিক করেন ভ্যালয়ার দিয়ে, স্কোয়াফিট মেপে। কিন্তু এখন তার সময় নেই। আমাদের ইমিডিয়েটলি বাড়ি দরকার। তাই এমাজেন্সি ব্যাপার বলে আমরা নিজেরাই ঠিক করে অ্যাপ্রভ করে নেব।

সরিৎশেখর বললেন, তবু যদি আভাস দেন!

ভদ্রলোক হাসলেন দেখুন, এসব কথাবার্তা তো এভাবে হয় না। আপনি চাইবেন ভাড়াটা বেশি হোক, আমরা চাইব কম হোক। ভ্যালুয়ার অবশ্যই বেসরকারি ভাড়া থেকে অনেক কম রেট দেবে। তাই মাঝামাঝি একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

সরিৎশেখর নিজের অজান্তে কেমন বিগলিত গলায় বললেন, আপনাকে আর কী বলব, এই বাড়িটাই আমার অসা। এখন শহরে বাড়িভাড়া হুহু করে বাড়ছে, কিন্তু কোনো ফ্যামিলিকে ভাড়া দিতে চাই না। আপনি একটু দেখবেন।

ভদ্রলোক হেসে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ালেন। সরিৎশেখর ওঁর পিছুপিছু আসছিলেন। এখন একটু খাতির করা উচিত। মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোকের হাতেই সব নির্ভর করছে। সরিৎশেখর বললেন, একটু চা খেয়ে যদি যান!

দ্রুত মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, না না। সন্ধে হয়ে গেলে আমার চা চলে না তাছাড়া পাবলিক অন্যভাবে নেবে। তা হলে কাল ঠিক দশটায় আমার অফিসে আসুন। আমি কাগজপত্র রেডি করে রাখব। পয়লা তারিখ থেকেই আমরা ভাড়া নেব। আমার অফিসটা চেনেন তো?

সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন। এই শহরে কোনোকিছুই অচেনা থাকে না। হঠাৎ ইঞ্জিনিয়ার ওঁর দিকে এগিয়ে এলেন, সরিৎশেখরবাবু, আপনার ভাড়াটা যাতে রিজনেবল হয় আমি নিশ্চয়ই দেখব, কিন্তু দেখাটা যেন পারস্পারিক হয়। বুঝতে পারছেন আশা করি। কাল একটু সকাল সকাল আসুন। অ্যান্ড কিপ ইট এ সিক্রেট। হনহন করে হেঁটে গিয়ে ভদ্রলোক জিপে উঠলেন।

জিপটি চলে গেলেও সরিৎশেখর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, এমন সময় হেমলতার ডাকে তার চেতনা এল। বাবা যে এদের বাড়িটা দেখাচ্ছেন কী জন্যে তা তিনি অনুমান করতে পারছিলেন। এতদিনে বাবার যে হুঁশ হয়েছে তাতে তিনি খুশি। এইভাবে বুড়ো মানুষটার অর্থকষ্ট তিনি দেখতে পারছিলেন না। তবু খানিকটা দূরত্ব রেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা, বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন নাকি?

সরিৎশেখর ঘুরে মেয়েকে দেখলেন, তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, সেদিনের একটা পুঁচকে ছেলে আমার কাছে ঘুষ চাইল, বুঝলে, ঘুষ!

ভাড়ার সঙ্গে ঘুষের কী সম্পর্ক আছে বুঝতে পারলেন না হেমলতা। সরিৎশেখর তখন বলছিলেন, ভাড়া না দিলে সরকার জোর করে বাড়ি নিয়ে নেবে। আমি ন্যায্য ভাড়া চাইলাম তো বলল ওকে দেখতে হবে আমাকে। চা খেতে চায় না, ঘুষ খেতে চায়। ভগবান! স্বাধীন হয় আমরা কোথায় এলাম! নেহরুর পোষ্যপুত্রদের চেহারা দেখলে!

হেমলতা বললেন, যে-যুগ সেরকম তো চলতে হবে! তা যদি বেশি ভাড়া দেয় তা হলে আর আপত্তি করবেন না!

আপত্তি! সরিৎশেখর হাঁহ করে উঠলেন, আমার পকেটে মাত্র দেড় টাকা পড়ে আছে, আমি আপত্তি করব কেন? কোনো মানে হয় না। আপত্তি করা তো বোকামি। চাকরি করার সময় যে ঘুস নিইনি সে-বোকামিটা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি! এখন কাল সকালে দর-কষাকষিটা কীভাবে করব তা চিন্তা করতে হবে।

হেমলতা একটু ভেবে বললেন, সাধুবাবুর কাছে একবার যান-না, ওঁর তো এসব রাস্তা ভাল জানা আছে।

সরিৎশেখর মেয়ের ওপর খুশি হলেন। সত্যি, সাধুচরণই ভালো পথ বাতলাতে পারে। খুব ধূর্ত লো। আর দাঁড়ালেন না তিনি, দরজাটা বন্ধ করে দাও, আমি এখনই ঘুরে আসি! গেট খুলে বাইরে আসতেই নজরে পড়ল অনিমেষ বাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে।

কাছাকাছি হতেই সরিৎশেখর চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলো তোমার এখন সিরিয়াস হওয়া উচিত, সেকেণ্ড ক্লাসে পড়ছ, এভাবে চললে রেজাল্ট ভালো হবে না।

দাদুর মুখে হঠাৎ এই ধরনের কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গেল অনিমষে। ইদানীং ওর ব্যাপারটাকে চাপা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি ডান হাতে ধরা খামটাকে এগিয়ে দিল। কী ওটা? সরিৎশেখর খামটার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন।

টেলিগ্রাম। টাউন স্কুলের সামনে পোস্টঅফিসের লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে ও দিয়ে দিলে। আজ অবধি অনিমেষ কখনো এ-বাড়িতে টেলিগ্রাম আসতে দেখেনি। পিয়নের কাছ থেকে প্রায় আবদার করেই ও খামটা এনেছে।

হঠাৎ কেমন নার্ভাস হয়ে গেলেন সরিৎশেখর। খামটা হাতে নিয়ে ছিড়তে ছিড়তে বললেন, আবার কার কী হল!

তারপর একনিশ্বাসে টেলিগ্রামটা পড়ে ফেলে চিৎকার করে হেমলতাকে ডাকলেন, হেম, প্রিয় টেলিগ্রাম করেছে, আগামীকাল প্লেনে করে আসছে।

হেমলতা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কে আসছে বললেন? প্রিয়-মানে আমাদে প্রিয়তোষ?

জলপাইগুড়ি শহরের কাছাকাছি বড় এয়ারপোর্ট বাগডোগরা-শিলিগুগি ছাড়িয়ে যেতে হয়। কিন্তু চা-বাগান এবং ব্যবসায়ীদের সুবিধের জন্য কলকাতা থেকে বেসরকারি কোম্পানি জলপাইগুড়ি শহরের কাছাকাছি একটা প্লেন নামর জায়গা করে নিয়েছিল। জায়গাটাকে কখনোই এয়ারপোর্ট বলা যায় না তবু যেহেতু অন্য নাম মাথায় চট করে আসনা তাই প্লেনে করে কলকাতায় যেতে হলে লোকে বলে এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। ঠিক এ-ধরনের বেসরকারি প্লেন নামার জায়গা ছিল স্বৰ্গছেঁড়ার কাছাকাছি তেলিপাড়ায় এবং কুচবিহারে। মালবাহী প্লেনগুলো যাত্রী নিত খুব কম ভাড়ায়। তবু সাধারণ মানুষ কেউ প্লেনে আসছে শুনলে লোকে বুঝত তার পয়সা আছে বেশ। প্রিয়তোষের প্লেনে করে জলপাইগুড়ি আসার টেলিগ্রাম পেয়ে খুব নার্ভাস হয়ে গেলেন সরিৎশেখর।

যে-ছেলেটা কমিউনিস্ট হওয়ায় পুলিশের ভয়ে এক রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল আচমকা এবং এতগুলো বছরে যার কোনো খোঁজখবর পাওয়া গেল না, সে হঠাৎ প্লেনে করে ফিরে আসে কীভাবে? প্রিয়তোষ যদি হঠাৎ বড়লোক হয়ে গিয়ে থাকে (কমউনিস্টদের সঙ্গে বড়লোক কথাটা কিছুতেই জুড়তে পারেন না সরিৎশেখর) আলাদা কথা, তা হলে এর মধ্যে তো সে তাকে চিঠি দিতে পারত! এতদিন ড়ুব দিয়ে হঠাৎ এত জানান দিয়ে আসছে সে-সরিৎশেখর খুব অস্বস্তিতে পড়লেন। ওকে আনতে যাওয়ার কথা লেখেনি প্রিয়তোষ, কিন্তু সরিৎশেখরের অভিজ্ঞতায় প্লেনে করে কেউ আসছে জানলেই রিসিভ করতে যেতে হয়।

বাড়িভাড়া এবং প্রিয়তোষ এই দুটো চিন্তা কাল রাত্রে তাকে ঘুমোতে দেয়নি। আজ ভোরে উঠেই মনে পড়ল সকাল-সকাল বাঁধ প্রকল্প অফিসে তাকে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিক করলেন প্রিয়তোষকে আনতে অনিমেষকে পাঠাবেন। একবার ভেবেছিলেন, যে-ছেলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে তাকে বরণ করে আনার দরকার নেই। কিন্তু হেমলতা তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, এই বংশে কেউ কখনো প্লেনে, চাপেনি, প্রিয়তোষ যখন সেই দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছে তখন সেই পালিয়ে যাওয়া প্রিয়তোষের সঙ্গে এই প্রিয়তোষের নিশ্চয়ই অনেক পার্থক্য। কথাটা চট করে মনে ধরেছিল সরিৎশেখরের। এই বংশে কেউ যদি সম্মানজনক বিরল দৃষ্টান্ত দেখায় তাকে তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন, তার জন্য গর্ব হয় তাঁর। এইরকম একটা গর্ব নিয়ে তিনি সযত্নে লালন করছেন যে অনিমেষ একদিন এম এ পাশ করবে-এই বংশে যা কোনোদিন হয়নি।

অতএব স্থির হল অনিমেষ তার ছোটকাকাকে আনতে এয়ারপোর্টে যাবে।

আজ অবধি শিলিগুড়িতে কখনো যায়নি অনিমেষ। শিলিগুড়ির বাসে চেপে ওর খুব রোমাঞ্চ হচ্ছিল। তা ছাড়া এয়ারপোর্টে প্লেন ওঠানামা দেখার কৌতূহলটা ক্রমশ ওকে অস্থির করছিল আজ স্কুল খোলা অথচ ও যাচ্ছে না-এরকম ঘটনাও কখনো ঘটেনি। আসবার সময় দাদু ওকে একটা টাকা দিয়েছেন, দুটো আধুলি! বাস-বদল করে যেতে আটআনা লাগে। ও যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছাল তখন বেলা দশটা, শুনল কলকাতার প্লেন আসতে দেরি আছে। জায়গাটা দেখে খুব হতাশ হল অনিমেষ। মাঠের একপাশে কিছু ঘরবাড়ি, মাঝে-মাঝে বিভিন্ন রঙের কাপড় উড়ছে মাঠের এখানে-সেখানে। একটাও প্লেন নেই ধারেকাছে। যে-জায়গাটায় প্লেন নামে সেটাও খোলামেলা। একটি টিস্টল দেখতে পেল সে। বয়ামে কেক রাখা আছে। ওর খুব লোভ হচ্ছিল কেক খেতে, কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। যদি ছোটকাকা না আসে তা হরে ফেলার বাসভাড়া থাকবে না। দাদু এত টায়-টায় পয়সা দেয়। অনির মনে পড়ল আজ সকালে পিসিমা বাজারে যাওয়ার কথা বলতে দাদু রেগে গিয়েছিলেন। বাড়িতে যা আছে তা-ই খেতে হবে ওঁকে বলে ধমক দিয়েছিলেন। পিসিমা অনিমেষকে আসবার সময় বলে দিয়েছিলেন, ফরেস্ট বাংলা চৌকিদারকে ডেকে দিতে। ও জানে চৌকিদার বাড়িতে মুরগি পুষে ডিম বিক্রি করে। ডেকে দিয়েছিল অনিমেষ। আজ দুপুরে নিশ্চয়ই ডিমের ডালনা হবে-ঘোটকাকা আসছে বলে অনেকদিন বাদে ডিম খাওয়া যাবে।

প্লেন আসছেনা। অনেকেই গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছে। তিন-চারটে ট্যাক্সি সামনে দাঁড়িয়ে। কলকাতায় বৃষ্টি হয়েছে বলে প্লেন ছাড়তে দেরি হচ্ছে। অনিমেষ ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিছু সুরেশা মহিলা ওর পাশ দিয়ে চলে গেল। ওর মনে হল এবার জোর করে ফুলপ্যান্ট বানাতে মরে। মেয়েদের সামনে হাফপ্যান্ট পরে হাঁটতে আজকাল বিশ্রী লাগে। দাদু যে কেন ছাই বোঝে না।

ছোটকাকাকে সে চিনতে পারবে তো? পিসিমা জিজ্ঞাসা করেছিলেন সকালে। যদি জ্যাঠামশাইকে অ্যাদিন পর চিনতে পারে, তাহলে ছোটকাকাকে পারবে না? আপনমনে হাসল অনিমেষ। ইয়ে আজাদি ঝুট হ্যায়-মনে রাখিস অনি! হঠাৎ ওর মনে হল, এই ভারতবর্ষ বিরাট দেশ। সেই পাঞ্জাব থেকে কন্যাকুমারিকা–ম্যাপে যে-ভারতবর্ষ মুখ বুজে পড়ে থাকে, ছোটকাকা বোধহয় সেই ভারতবর্ষের মানুষকে এই কথাটা নিয়ে এল-ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। কিন্তু ছোটকাকাকে সে এবার জিজ্ঞাসা করবে, এই কথাটা সত্যি কি না। আজাদি যদি মিথ্যে হত, তা হলে ছোটকাকাকে সে এবার জিজ্ঞাসা করবে, এই কথাটা সত্যি কি না। আজাদি যদি মিথ্যে হত, তা হলে ছোটকাকারা সব কথা এত খোলাখুলি বলছে, কিন্তু কই পুলিশ তো তাদের অ্যারেস্ট করছে না। ইংরেজ আমলে সেরকম ব্যাপার কি হত? নিশীথবাবু বলেন (অনিমেষ ওঁকে আজকাল আর নতুন স্যার বলে ডাকে না), ভারতবর্ষ স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক মানুষ তার ইচ্ছেমতন কথা বলতে পারেন, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন শুধু তার আচরণের দ্বারা অন্যের অথবা দেশের যেন ক্ষতি না হয়। কংগ্রেস সরকার এই মহৎ অধিকার দেশবাসীর হাতে তুলে দিয়েছে। দীর্ঘ সগ্রামের পর কংগ্রেস যে-অধিকার অর্জন করেছে তা সে নিজের মুঠোয় লুকিয়ে রাখেনি। সেক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস কী বলে? দেশবিভাগে। আগে এরা নেতাজির নামে নোংরা ছিটোয়নি? যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের সঙ্গে হাত মেলায়নি। স্বাধীনতার পর তারা এমন বাড়াবাড়ি করেছিল যে দেশের স্বার্থে তাদের দলকে ব্যান করে না দিরে চলত না। কন্তু সে কটা কমিউনিস্টদের ছুড়ে ফেলে দিল। কথাটা ভীষণ সত্যি-অধিকার কেউ হাতে তুলে দেয় না, তাকে অর্জন করতে হয়। কমিউনিস্টরা তা পারেনি, এটা তাদের ক্রটি। আর এই যে ওর কংগ্রেস সরকারকে যা-তা বলতে পারছে, তা আমাদের এই স্বাধীনতা সত্যি বলেই পারছে।

নিশীথবাবুর এই কথাগুলো আজ ছোটকাকাকে জিজ্ঞাসা করবে অনিমেষ। মটুর কথাটা চট করে মনে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মণ্টু বলে, কংগ্রেস হল চোরের সরকার। যে যেখান থেকে পারে চুরি করে যাচ্ছে। অবশ্য এসব কথা আমি বিরাম করাকে উদ্দেশ করে বলছি না। উনি যে রম্ভার বাবা!

কংগ্রেসের সব ভালো, ইতিহাস ভালো, নেতারাও ভালো। কিন্তু কেন যে সবাই ওদের চোর বলে কে জানে! আচ্ছা, চোর যদি তবে ভোট দিয়েছে কেন?

হঠাৎ মাইকে কে যেন কী বলে উঠতে অনিমেষ দেখল সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দিল। খুব জড়ানো ইংরেজি বলে ও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু এখন তো সবাই বুঝতে পারছে যে কলকাতার প্লেন এখনই নামবে।

আর কয়েক মিনিট বাদে ডানায় রুপোলি রোদ মেখে একটা মাঝারি চকচকে পাখি এয়ারপোর্টের ওপর দুবার পাক খেয়ে অনেক দূর থেকে নিচে নেমে আসতে লাগল। একসময় তার বুক থেকে চাকা। বেরিয়ে মাটির ওপর গড়িয়ে যেত লাগল যতক্ষণ-না সেটা নিরীহ মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ওর বুকের র খুলে গিয়ে সিঁড়ি জুড়ে গেল। আর লোকগুলো কেম গম্ভীরপায়ে নেমে আসতে। লাগল মাটিতে। অনিমেষ দেখল রেলস্টেশনে অথবা বাসে প্যাসেঞ্জাররা যেরকম জামাকাপড় পরে যায় এঁরা তার চেয়ে দামি-দামি জামাকাপড় পরেছেন। একজন খুব মোটা ভীষণ কালো গোঁফওয়ালা মানুষ-ধুতি, ভূঁড়ি-সামলানো পাবি আর মাথায় ইয়া বড় গান্ধীটুপি, নামতে অনেকে মালা নিয়ে ছুটে গেল তার দিকে। চার-পাঁচজন পুলিশ অফিসার তাকে স্যালুট করে ঘিরে দাঁড়াল। ওপাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, মিনিস্টার আয়া, মিনিস্টার।

এই প্রথম মন্ত্রী দেখল সে। রাজা ভারতবর্ষের মানুষরা, আর মন্ত্রী মাত্র কয়েকজন। তাদের একজনকে দেখতে পেয়ে অনিমেষের খুব গর্ব হচ্ছিল। কেমন বিনয়ী হয়ে হাতজোড় করে এগিয়ে আসছেন। ও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশ দিয়ে ওঁকে যেতে হবে, অনিমেষ যন্ত্রচালিতের মতো দুটো হাত জোড় করে নমস্কার জানাল। আর সেই সময় ওর নজরে পড়ল মন্ত্রীর পেছন পেছন যে হেঁটে আসছে তার দিকে। ছোটকাকা। একদম চেনা যাচ্ছে না, অ্যাশ কালারের সুট, লম্বা সরু নীল টাই, চোখে চশমা, হাতে বড় অ্যাটচিব্যাগ। এই পোশাকে অনিমেষ ছোটাকাকাকে কখনো দেখেনি। চট করে চেনা অসম্ভব। কিন্তু ছোটকাকার মুখচোখ এবং হাঁটার ভঙ্গি একই রকম আছে। ও দেখল। মন্ত্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে ছোটকাকাকে কিছু বলতেই ছোটকাকা হেসে জবাব দিয়ে নমস্কার করে এবার একা এগিয়ে আসতে লাগল লম্বা-লম্বা পা ফেলে। তার মানে মন্ত্রীর সঙ্গে ছোটকাকার ভাব আছে। অনিমেষ কেমন হতভম্ব হয়ে পড়ল। কংগ্রেসি মন্ত্রীর সঙ্গে ছোটকাকার ভাব হল কী করে? আর সেই ছোটকাকার সঙ্গে এই ছোটকাকার পোশাকে একদম মিল নেই কেন?

ভীষণ নার্ভাস হয়ে ছোটকাকার দিকে এগিয়ে গেল সে।

চোখাচোখি হলেও প্রিয়তোষ অন্যমনস্ক হয়ে কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ঘুরে অনিমেষের দিকে ভালো করে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, আরে অনি না?

অনিমেষের ভালো লাগল বলার ধরনটা। ও হেসে সামনে এগিয়ে এসে নিচু হল প্রণাম করতে। সঙ্গে সঙ্গে ওকে এক হাতে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরল প্রিয়তোষ, আরে কী আশ্চর্য, তুই যে দেখছি ভেরি গুড বয়, প্রণাম-ট্রনাম করিস! আমি তো তোকে প্রথমে চিনতেই পারিনি-কী লম্বা হয়ে গেছিস! তা তুই কি আমাকে রিসিভ করতে এসেছিস?

ঘাড় নাড়ল সে, দাদু আসতে বললেন।

আমি ভাবছিলাম টেলিগ্রামটা আমার আগে আসবে কি না। যাক, বাবা এখন কেমন আছেন? প্রশ্ন করল প্রিয়তোষ। অনিমেষ দেখল ছোটকাকার মাথা ওর চেয়ে সামান্য ওপরে।

অনিমেষ বলল, দাদু ভালো আছেন। এই সময় ও দেখল পাঁচ-ছয়জনের একটা দল এগিয়ে আসছে। দলের সামান্য বিরাট মোটা একটা ফুলের মালা-হাতে বিরাম কর মহাশয়। বিরামবাবুর ছোই শরীররটার পেছনে মুভিং ক্যাসেল। বিরামবাবু এগিয়ে গিয়ে মন্ত্রীমশাই-এর গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। একটা হাততালির ঝড় উঠল। বিরাম কর কিছু বলতেই মন্ত্রীমশাই মুভিং ক্যাসেলকে নমস্কার করলেন। অনিমেষের মনে হল এই মুহূর্তে মুভিং ক্যাসেলকে একদম বাচ্চা মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। এই দলের মধ্যে নিশীথবাবুকে দেখতে পেল না সে।

কোন পাড়ায় থাকে?

আমাদের পাড়ায়। আমার সঙ্গে আলাপ আছে। অনিমেষ বেশ গর্বের সঙ্গে কথাটা বলল। বাইরে তখন গাড়িগুলো নড়াচড়া করছিল।

প্রিয়তোষ বলল, একটা ট্যাক্সি দ্যাখ, সোজা বাড়ি যাব।

ছোটকাকা যে বাস যাবে না এটা ও অনুমান করতে পারছিল। এখান থেকে পুরো ট্যাক্সি রিজার্ভ করে যাওয়া যায়। অনির খেয়াল হল ওর আট আনা পয়সা বেঁচে যাচ্ছে। দাদু যদি ফেরত না চান তা হলে কী ভালোই-না হয়!

মন্ত্রীর জন্য সরকারি গাড়ি এসেছিল। তিনি তাতে চলে গেলেন। অনিমেষ ট্যাক্সিওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে হতাশ হচ্ছিল। সবাই আজ রিজার্ভড হয়ে আছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয়তোষ ব্যাপারটা, দেখছিল। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসে অনিমেষকে বলল, তুই এখনও নাবালক আছিস। দাঁড়া আমি দেখছি।

প্রিয়তোষ গিয়ে ট্যাক্সি-ড্রাইভারদের সঙ্গে যখন কথা বলছিল তখন অনিমেষ দেখল বিরামবাবুরা সদলে ফিরে যাচ্ছেন। মুভিং ক্যাসেল ওকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে এলেন কাছে, ওমা তুমি! একদম দেখতে পাইনি গো! কখন এলে?

অনিমেষ বলল, অনেকক্ষণ।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, কালই নিশীথকে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম, ছেলের দেখা নেই কেন? তা মিনিস্টারকে দেখতে এসেছ বুঝি?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। আমার ছোটকাকা এসেছেন ওই প্লেনে। ও ইশারা করে প্রিয়তোষকে দেখাল।

ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে কথা শেষ করে প্রিয়তোষ তখন এদিকে আসছিল। তাকে এক পলক দেখে নিয়ে একটু উত্তেজিত গলায় মুভিং ক্যাসেল বললেন, ওমা, ইনি বুঝি তোমার কাকা। মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন না প্লেন থেকে নেমে? অনিমেষ ঘাড় নাড়তেই ফিসফিস করে বললেন, খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক মনে হচ্ছে। কলকাতায় থাকেন?

প্রিয়তোষ কোথায় থাকে জানে না অনিমেষ। কিন্তু জলপাইগুড়ির বাইরে সভ্য জায়গা বলতে চট করে কলকাতার নামই মনে আসে। ও দ্বিধা না করে মাথা নেড়ে হাঁ বলল। প্রিয়তোষ তখন প্রায় কাছে এসে পড়েছে, মুভিং ক্যাসেল ফিসফিসিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও।

প্রিয়তোষ বলল, চল, ট্যাক্সিটা পাওয়া গেছে! এই কয় বরে জলপাইগুড়ির হাল কী হয়েছে রে, ট্যাক্সির রেট দিল্লির থেকেও বেশি?

মুভিং ক্যাসেলকে প্রিয়তোষ যেন দেখেও দেখল না, অনিমেষের হাতে-ধরানে অ্যাটচিটা নিয়ে ট্যাক্সির দিকে ফিরল। মহা ফাপরে পড়ে গেল অনিমেষ। মুভিং ক্যাসেলের ভালো নাম তো জানা নেই, কী বলে পরিচয় করিয়ে দেখে ও! প্রিয়তোষকে ফিরতে দেখে মুভিং ক্যাসেল জকটি করে আলতো চিমটি কাটলেন অনিমেষের হাতে। তৎক্ষণাৎ অনিমেষ বলল, ছোটকাকা, ইনি-মানে ইনি না আমাদের মাস্টারমশাই-মানে এখানকার কংগ্রেসের…, কীভাবে কথাটা শেষ করবে বুঝতে না পেরে চট করে শেষ করে দিল, শ্রীবিরাম করের স্ত্রী।

খুব অবাক হয়ে প্রিয়তোষ ভাইপোকে একবার দেখল, তারপর হাতজোড় করে মুভিং ক্যাসেলকে নমস্কার করল। অনিমেষ শুরু করা থেকেই মুভিং ক্যাসেল যুক্তহস্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখন হাত নামিয়ে সলজ্জ মিষ্টি হাসলেন, আমি সামান্য কংগ্রেস করি, কোনো ইতিহাস নেই, আর ভূগোল তো দেখছেন।

এইভাবে নিজের পরিচয় দিতে বোধ করি প্রিয়তোষ কাউকে শোনেনি। খুব অবাক হয়েও সেটাকে দ্রুত কাটিয়ে নিয়ে বলল, আমি তো অনেকদিন জলপাইগুড়ি ছাড়া, তুই আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমি প্রিয়তোষ।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, আপনারা তো বাড়ি ফিরবেন, তা আমাদের গাড়িতে আসতে পারেন, কোনো অসুবিধে হবে না।

প্রিয়তোষ বলর, না না, অনেক ধন্যবাদ। ট্যাক্সিওয়ালাটাকে আমি কথা দিয়ে ফেলেছি।

মুভিং ক্যাসেল খুব ছোট একটা ভাঁজ দুই ভুরুর মাঝখানে এনে বললেন, আপনি বুঝি কথঘা দিরে কখনো খেলাপ করেন না।

প্রিয়তোষ হাসল, ঠিক উলটো। এত বেশি খেলাপ করি যে মাঝে-মাঝে রাখবার জন্য বদখেয়াল হয়। শহরে আশা করি আপনার দেখা পাব।

মুভিং ক্যাসেল হঠাৎ কেমন নিস্তেজ গলায় বললেন, বাঃ, নিশ্চয়ই। তারপর এক হাতে অনিমেষের চিবুক নেড়ে দিয়ে বললেন, এই ছেলে, কাকাকে নিয়ে আমার বাড়ি আসবে।

প্রিয়তোষের সঙ্গে ট্যাক্সির দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের মনে হল এতক্ষণ সেয়ানে-সেয়ানে। কক-ঠোকাঠুকি হচ্ছি। কার্তিকদা যখন অন্য কারওর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেন তখন ককটা বেশিক্ষণ শূন্যে থাকে না, কিন্তু প্রতুলদার সঙ্গে ম্যাচ হলে শুধু ছটফটিয়ে এপার-ওপার করতে থাকে, মাটিতে পড়তে চায় না। নিশীথবাবু বা তার কাছে মুভিং ক্যাসেল যত সহজভাবে বলতে পেরেছেন, আজ ছোটকাকার সঙ্গে যেন তা একদমই পারেননি। খুব মজা লাগছিল ওর।

ট্যাক্সির পেছন-সিটে ওরা দুজন, ছোটকাকা পকেট থেকে একটা চকচকে সিগারেটের টিন বের করে সিগারেট ধরাল, তারপর খবরাখবর বল।

অনেকক্ষণ থেকে যে-প্রশ্নটা অনিমেষের মুখে আসছিল সেটা ফস করে বলে ফেলল এবার, ছোটকাকা, তুমি একদম বদলে গিয়েছ।

অ্যাঁ? বলে চমকে ওর দিকে তাকিয়ে হোহো করে হেসে উঠল প্রিয়তোষ, তারপর বলল, আমার কথা পরে হচ্ছে। আমি চলে যাবার পর কী হয়েছিল বল!

চট করে অনিমেষ সেসব দিনের কথা মনে করতে পারল না। একটু ভেবে নিয়ে বলল, পুলিশ এসে খোঁজ করেছিল, দাদু রেগে গিয়েছিলেন তোমার ওপর।

সিগারেট খেতে-খেতে প্রিয়তোষ বলল, তারপর?

অনিমেষ বলল, দাদু অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছিলেন কিন্তু কোনো খবর পাননি। তারপর এতদিন আর কোনো কথা হত না তোমাকে নিয়ে।

দিদি কেমন আছেন?

পিসিমার শরীর খারাপ। অনিমেষ একটু ভেবে নিয়ে বলল, আজ দাদু বাড়িভাড়া দেবার জন্য সরকারের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন।

বাড়িভাড়া? কেন?

অনিমেষ ছোটকাকার দিক তাকিয়ে বলল, তুমি কাউকে বোলো না। দাদুর হাতে একদম পয়সা নেই। আমরা অনেকদিন মাছ খাই না।

সে কী! চমকে সোজা হয়ে বসল প্রিয়তোষ, তোর বাব টাকা পাঠায় না? আমি জানি তোর বাবা আবার বিয়ে করেছে। আমি এখানকার সব খবর রাখি। কিন্তু বাবা যে অর্থকষ্টে আছে তা তো কেউ বলেনি!

অবাক হয়ে ছোটকাকাকে দেখল অনিমেষ। এখানকার সব খবর রাখে ছোটকাকা! কী আশ্চর্য! ও বলল, বাবা টাকা পাঠান, কিন্তু তাতে চলে না। জলপাইগুড়িতে জিনিসপত্রের দাম নাকি খুব বেশি।

ছোটকাকা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অনিমেষ দেখল জলপাইগুড়ি এসে যাচ্ছে।

ও হঠাৎ সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ছোটকাকা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে নলি?

দ্রুত ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, কারও কাছে না!

খুব ঠাণ্ডা গলায় প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ তোর একথা মনে হল কেন?

প্রিয়তোষের বলার ধরনের এমন একটা অস্বাভাবিক সুর ছিল যে, অনিমেষ বুঝতে পারছিল প্রশ্নটা করা ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। ও তাকিয়ে দেখল ছোটকাকা ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরায়নি। খুব অস্বস্তি নিয়ে অনিমেষ বলল, এখানে যারা কমিউনিষ্ট তাদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।

প্রিয়তোষ যেন এ-উত্তরটা আশা করেনি, মানে?

এখানকার কমিউনিস্টদের চুলটুল উশকোখুশকো হয়, বেশিরভাগ গেরুয়া পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে আর কাধে একটা কাপড়ের ঝোলা থাকে। দেখলেই বোঝা যায় খুব গরিব-গরিব। তারপর যেন মনে করতে পেরে বলল, আগে তুমি এইরকম পোশাক পরতে।

হোহো করে হেসে উঠল প্রিয়তোষ। হাসি যেন আর থামতেই চায় না। তা দেখে অনিমেষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। শেষ পর্যন্ত প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করল,আর কংগ্রেসিরা, তাদের কী দেখে বোঝা যায়। ফিনফিনে ধুতি, খদ্দরের ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি আর মাথায় সাদা ধবধবে গান্ধীটুপি-তাই তো?

এটা অবশ্যই কংগ্রেসিদের পোশাক। এই তো মন্ত্রীকে সে এইরকমই দেখল, তবু সবাই তো এরকম নয়। নিশীথবাবু, নবীনবাবু শশধরবাবু, তো একদম অন্যরকম। আবার মুভিং ক্যাসেল-তিনিও তো কংগ্রেস করেন।

ওর দিকে তাকিয়ে প্রিয়তোষ বলল, তা আমার পোশাক দেখে নিশ্চয়ই কমিস্ট মনে হচ্ছে না, কিন্তু কংগ্রেসিও মনে হচ্ছে না তো? তা হলে আমি কী? হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে প্রিয়তোষ ড্রাইভারকে বলল, একটু বাজারের দকিটায় যাব ভাই, দিনবাজারের পুলটা দিয়ে না হয় ঘুরে যাবেন।

তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আর কোনো পার্টি করি না।

একথাটাই এতক্ষণ মনে হচ্ছিল অনিমেষের, সে অবাক-গলায় জিজ্ঞাস করল, তুমি বুঝি অফিসার?

মাথা নাড়ল প্রিয়তোষ, না রে! আমি চাকরি করি, কিন্তু ঠিক সেরকম চাকরি নয়। তগুই এখন এসব কথা বুঝবি না। বাঃ, শহরটার তো অনেক উন্নতি হয়েছে। ওটা কী সিনেমা হল, আলোছায়া? দীপ্তি টকিজ আছে না?

প্রসঙ্গটা এমন সহজে ঘুরে গেল যে অনিমেষ ধরতে পারল না, হ্যাঁ। আর-একটা সিনেমা হল হয়েছে। ও মুখ বের করে দেখল আলোছায়াতে দস্যু মোহন হচ্ছে। এই সিনেমাটার কথা মণ্টু খুব বলছিল। ও চট করে পকেটে পড়ে-থাকা আধুলিকে স্পর্শ করে নিল।

তুই সিগারেট খাস?

প্রশ্নটা শুনে চমকে ছোটকাকার দিকে তাকিয়ে দ্রুত মাথা নাড়ল অনিমেষ। এরকম প্রশ্ন বড়রা কেউ করবে ও ভাবেনি। ছোটকাকা নির্বিকার-ওদের ক্লাসের অনেকেই এখন সিগারেট খায়। মণ্টু ওকে একবার জোর করে সিগারেট টানিয়েছিল, কী বিচ্ছিরি তেতো-তোতো! কি আরাম যে লোকে পায়।

তুই পার্টি করিস?

এই প্রশ্নটার অর্থ এখন অনিমেষের জানা হয়ে গেছে। পার্টি করা বলতে এখন সবাই কমিউনিস্ট পার্টি করার কথাই বোঝায়। যেন কংগ্রেসি পার্টি করে না। নিশীথবাবু ওকে নিয়ে কংগ্রেস অফিসে কয়েকবার গিয়েছিলেন। সামনের নির্বাচনে ওকে কংসের হয়ে যে কাজ করতে হবে সেটা নিশ্চিত। সেদিন একটা মজার বক্তৃতা শুনেছিল ও। জেলা থেকে নির্বাচিত একজন কংগ্রেসি বলছিলেন, ওরা বলে আমরা চোর, ভালো কথা। কিন্তু গদিতে যে-ই যাবে সে সাধু থাকতে পারে না। এখন কথা হল আমরা খেয়ে-খেয়ে এমন অবস্থায় এসেছি যে আর খাওয়ার ক্ষমতা নেই। এখন ইচ্ছে না থাকলেও আমরা সাধারণ মানুষের জন্য দুএকটা কাজ করব। কিন্তু ওরা তো উপোসী ছারপোকা হয়ে আছে, গদিতে গেলে তো দশ বছর লুটেপুটে খাবে! তার বেলা? কথাটা অনিমেষের ঠিক মনঃপুত না হলেও বিকল্প কোনো চিন্তা মাথায় আসেনি। তাই ঘাড় নেড়ে এখন সে বলল, আমি কংগ্রেসকে সার্পোট করি।

একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে প্রিয়তোষ মনে করতে পারল, ও, তুই সেই বন্দেমাতরম্ বলতিস, না? স্বাধীনতা দিবসে ফ্ল্যাগ তুলেছিলি, না?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। এটা ওর গর্ব!

হঠাৎ অনিমেষের জ্যাঠামশাই-এর কথা মনে পড়ে গেল, জান, জ্যাঠামশাই একদিন জেঠিমা আর ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। দাদু ছিল না তখন।

তাই নাকি? তারপর?

খাওয়াদাওয়া করে দাদু আসার আগেই চলে গেল। এ-খবর তুমি জান?

অনিমেষ সন্দেহের চোখে ছোটকাকার দিকে তাকাল। প্রিয়তোষ হেসে ঘাড় নাড়ল, না।

জ্যাঠামশাই তোমাকে কমিউনিস্ট পার্টি কর বলে বোকা বলছিল। আখের গোছাতে হলে নাকি কংগ্রেসি হতে হয়। আমার খুব রাগ হয়েছিল। বলে কথাটা কি ঠিক? হাতের সব আঙুল কি সমান? অনিমেষ বেশ উত্তেজিত গলায় বলল।

প্রিয়তোষ দিনবাজারের সামনে গাড়িটা দাঁড় করাতে বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল, কেন, তুই একটু আগে বললি না চেহারা দেখে বোঝা যায় কে কমিউনিস্ট আর কে কংগ্রেসি। তা সুখে থাকতে গেলে তো কংগ্রেসি হতে হবে। ভালো করেছিস।

ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে অনিমেষের সামনে ধরল প্রিয়তোষ, যা, চট করে এক সের ভালো কাটা পোনা এক সের রাবড়ি আর কিছু মিষ্টি কিনে আন। আমি আবার মাছ ছাড়া খেতে পারি না। তা ছাড়া বাবার এসব অনেকদিন পর খেতে ভালো লাগবে।

অনিমেষ দেখল ছোটকাকার ব্যাগটা একশো টাকা নোটে ফুলে ঢাউস হয়ে আছে। কত টাকা! বাড়ানো হাতে নিয়ে ওর খেয়াল হল পিসিমা আজকাল একদম মাছ হোন না, ও একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু পিসিমা যে মাছ রান্না করেন না!

সে কী! প্রিয়তোষ যেন কথাটা বিশ্বাস করল না, ঠিক আছে, সে আমি দেখব। হ্যাঁ, এক কাজ কর, আসার সময় এক পোয়া ছানার জিলিপি আনবি। দিদি ছানার জিলিপি পেলে কোনোকিছুতেই না বলবে না।

প্রিয়তোষ যেন বাড়িতে একটা উৎসবের মেজাজ নিয়ে এল। এতদিন ধরে সরিৎশেখরের এই সংসার যে-জলার মধ্যে পাক খাচ্ছিল তার যেন অনেক মুখ খুলে গেল আচম্বিতে। হেমলতা প্রিয়তোষকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ মন খুলে কেঁদে নিয়ে মাছ কুটতে বসে গেলেন। কান্নার সময়। অনিমেষ দূরে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো নাম শুনতে পেল, যাঁদের মধ্যে সেই অদেখা শচীন পিসেমশাইও ছিলেন। হেমলতা কান্নায় আপেক্ষটাই বড় হয়ে উঠেছিল, প্রিয়তোষ অ্যাদ্দিন কোথায় ছিল—এদিকে যে সংসার ভেসে যায়-আর কতদিন এই পোড়া বোঝা বইতে হবে ইত্যাদি। কান্নার মাঝখানে একবার সরিৎশেখরের বিরুদ্ধেও কিছু বলা হল। তারপর কান্না থামলে প্রিয়তোষের আনি মিষ্টি তাকে খেতে দিয়ে গল্প করতে করতে মাছ কুটতে বসে গেলেন। যেন যন্ত্রের মতো ব্যাপার হচ্ছে, অনিমেষ অবাক হয়ে দেখছিল। খুব শোক বা খুব আনন্দ মানুষকে তার সংস্কার ভুলিয়ে দিতে পারে সহজেই।

একটু বেলা বাড়লে একমাথা রোদ ভেঙে সরিশখর বাড়ি ফিরলেন। এই দৃশ্যটা দেখার জন্য আড়লে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল অনিমেষ। সরিৎশেখর আসছেন, এক হাতে বিবর্ণ ছাতি অন্য হাতে লাঠি। কোরা ধুতি হাঁটুর নিচ অবধি, পাঞ্জাবি লালচে। বেশ দ্রুত হাঁটছিলেন প্রথমটায়, গেটের কাছাকাছি এসে মুখ তুলে ঠাওর করতে চাইলেন বাড়িতে নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না। অনিমেষ দেখছিল দাদু ঠিক বুঝতে পারছেন না, তাই গেটটা বন্ধ করার সময় শব্দ করলেন খুব জোরে। তারপর যেন হাঁটতে পারছেন না আর, এইরকম ভঙ্গিতে লাঠিতে শরীরের ত্র দিয়ে এগোতে লাগলেন। কয়েক পা হেঁটে থমকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন কোনো আওয়াজ পান কি না। দাদুর এইরকম ব্যাপারস্যাপার কোনোদিন দেখেনি অনিমেষ। গেটের আওয়াজ ভেতরে হেমলতার কানে গিয়েছিল। পিসিমাকে হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখল ও। দাদুকে দেখে পিসিমা চিৎকার করে উঠলেন, ও বাবা, দেখুন কে এসেছে-প্রিয়-প্রিয়তোষ, একদম সাহেব হয়ে এসেছে-আপনার জন্য মাছ মিষ্টি এনেছে। অনি দেখল দাদু যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে হাঁটছেন। তার শরীরের কষ্ট যেন ছোটকাকার ফিরে আসার চেয়ে অনেক জরুরি।

বারান্দায় উঠে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে সরিৎশেখর বললেন, এক গেলাস জল দাও।

হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, এই রোদে পুড়ে এলেন, এখনই জল খাবেন কী!

অনিমেষ দেখল ছোটকাকা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে গম্ভীরমুখে দাদুকে প্রণাম করল। ছোটকাকার পরনে এখন ধোপভাঙা পায়জামা আর গেঞ্জি। দাদু একটা হাত উঁচু করে কী যেন বললেন, তারপর ছোটকাকা উঠে দাঁড়ালে জিজ্ঞাসা করলেন, কখন এলে?।

একদম হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ। এত বছর পর এভাবে বাড়ি ফিরল যে, তাকে দাদু এমনভাবে প্রশ্ন করলেন যেন কদিন বেরিয়ে কেউ বাড়ি ফিলেছে! ছোটকাকাও বলল, এই তো খানিক আগে আপনি কেমন আছেন?

ততক্ষণে পিসিমা ভেতর থেকে একটা তালপাতার পাখা এনে জোরে জোরে দাদুকে বাতাস করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। সে-বাতাস খানিকক্ষণ নিয়ে দাদু বললেন, বড় অর্থকষ্ট, এ ছাড়া ভালোই আছি। আজ বাড়িটা ভাড়া দিয়ে এলাম।

পিসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কত টাকায় ঠিক হল?

আড়াইশো। তাতে আমার চলে যাবে। কথাটা বলে দাদু ছোটকাকাকে আর-একবার দেখলেন, তোমার শরীর আগের থেকে ভালো হয়েছে। বিয়ে-থা করেছ।

না, কী আশ্চর্য, আপনাকে না বলে বিয়ে করব কেন? কেমন বোকার মতো মুখ করল ছোটকাকা।

পিসিমা বললেন, মন্ত্রী আবার বিয়ে করেছে, জানিস? আর পরি একটা কোত্থেকে মেয়ে ধরে বিয়ে করেছে, একটা বাচ্চাও হয়েছে।

হঠাৎ খুব জোরে ধমকে উঠলেন দাদু, থামো তো, তখন থেকে ভড়ভড় করছ।

পিসিমা চুপ করতেই খুব আস্তে বলে ফেললেন, তুমি অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে জানতে চাই না, মনে হচ্ছে সুখেই আছ। চাকরিবাকরি কর।

হ্যাঁ। খুব সংক্ষিপ্ত জবাব দিল ছোটকাকা।

পিসিমা আবার বলে উঠলেন, হ্যাঁ বাবা, প্রিয় যখন এল আমি তো অবাক। কী দামি কোটপ্যান্ট, আবার সাহেবদের মতো টাই! খুব বড় অফিসার আমাদের প্রিয়। আপনার আর কোনো কষ্ট হবে না।

হঠাৎ দাদু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আজকাল কমিউনিস্ট পার্টি কর না?

মাথা নাড়ল ছোটকাকা, না, আমি কোনো দলে নেই।

সে কী! যে-পার্টির জন্য বাড়ি ছাড়লে সেই পার্টি ছেড়ে বড়লোক হয়ে গেলো আমার আজকাল প্রায়ই মনে হয় তোমার বন্ধুরা ঠিক কথাই বলে। আমি অবশ্য তোমার বন্ধুদের বেশি চিনি না। সরিৎশেখর মেয়ের দিকে তাকালেন, হেম, প্রিয়তোষ মিষ্টি এনেছে বলছিলে না, দাও খাই, অনেকদিন মিষ্টি খাই না!

সরিৎশেখরের এই মিষ্টি খেতে চাওয়াটা থেকেই বাড়িতে বেশ উৎসব-উৎসব আমেজ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু অনিমেষ দেখছিল দাদু যখন ছোটকাকাকে বন্ধুদের নাম করে কীসব শোনার কথাটা বললেন এবং বলে কথাটা ঘুরিয়ে নিলেন তখন ছোটকাকা ভ্রূ কুঁচকে দাদুকে এমন ভঙ্গিতে দেখল যেটা মোটেই ভালো নয়। তার পর থেকে এ-বাড়িটা একদম পালটে গেল। এত বয়স হয়ে গেলেও এখনও কী শক্ত উনি, একই দিনবাজার থেকে বাজারের বোঝা এক হাতে বয়ে আনেন। সেই দাদু একন যেন হঠাৎই অথর্ব হয়ে যাচ্ছেন। কথা বলছেন আস্তে-আস্তে। খেয়েদেয়ে দুপুরে ছোটকাকা ঘুমুলে পিসিমা শব্দ করে বাসন মাজছিলেন বলে চাপা গলায় ধমকে উঠলেন, যেমন তোমার গলার শব্দ তেমনি হাতের আওয়াজ! ছেলেটাকে ঘুমাতে দেবে না?

বিকেলে চা খেয়ে বেরুবার সময় ছোটকাকা দাদুকে দশটা একশো টাকার নোট দিল। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অনিমেষ দেখল টাকাটা নেবার সময় দাদু একটুও উত্তেজিত হলেন না। যেন গচ্ছিত টাকা ফেরত নিচ্ছেন এমন ভাব। বাড়ি থেকে বের হবার আগে ছোটকাকা অনিমেষকে ডাকল, কী করছিস তুই?

এখন ভর–বিকেল। তিস্তার পাড়ে মণ্টুরা এসে গেছে। অনিমেষ ওদের কাছে আজকের এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতাটা বলবার জন্য ছটফট করছিল। মুখে বলল, কিছু না।

তা হলে চল, আমার সঙ্গে ঘুরে আসবি। তারপর পিসিমাকে ডেকে বলল, তোমরা কখন শুয়ে পড়?

পিসিমার সময়ের হিসেব ঠিক থাকে না, নটা-দশটা হবে, বাংলা খবর শেষ হলেই বাবা শুয়ে পড়েন।

ছোটকাকা বললেন, আমাদের ফিরতে দেরি হবে।

ছোটকাকার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টাউন ক্লাবের রাস্তায় আসতে-আসতে অনিমেষের মনে হল আজ অবধি ও কাউকে এভাবে কুম করে বাড়ি থেকে বের হতে দেখেনি। ক্রমশ ও বুঝতে পারছিল ছোটকাকা ওদের থেকে একদম আলাদা। এই যে সিল্কের শাটপ্যান্ট পরা শরীরটা ওর পাশে-পাশে হেঁটে যাচ্ছে তাকে ও ঠিক চেনে না। এই শরীরটা থেকে যে বুক-ভরে-যাওয়া সুগন্ধ বেরুচ্ছে সেটাই যেন একটা আড়াল তৈরি করে ফেলেছে। এত সুন্দর গন্ধ মুভিং ক্যাসেলের শরীর থেকেও বের হয় না। বিলিতি সেন্ট বোধহয়।

মোড়ের মাথায় এসে একটা রিকশা নিল ছোটকাকা। কোনো দর-কষাকষি করল না, বলল, ঘণ্টা চারেক থাকতে হবে, দশ টাকা পাবে।

রিকশাওয়ালাটা বোধহয় এরকম খদ্দের আগে পায়নি, অবক হয়ে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়ল। ছোটকাকার পাশে রিকশায় বসতে অনিমেষের মনে হল ওর জামাকাপড়ও গন্ধে ভুরভুর করছে এখন। হাওয়া কেটে ছুটছে রিকশাটা টাউন ক্লাবের পাশ দিয়ে। ছোটকাকা বলল, আগে পোস্টঅফিসের দিকে চলো। ঘাড় নেড়ে রিকশাওয়ালা পি ডব্লু ডি অফিস ছাড়িয়ে করলা নদীর পুলের ওপর উঠল। করলা নদীর একদিকটায় কচুরিপানা কম। আরও একটু বাঁদিকে তাকালে তিস্তা দেখা যায়-করলা-তিস্তার সঙ্গমটায় কিং সাহেবের ঘাট।

করলা নদীর দিকে তাকাতেই চট করে অনির সেই ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ও সোজা হয়ে বসল। অলসভাবে শরীরটা রেখে প্রিয়তোষ শহর দেখছিল। এই কয় বছরে একটুও বদলায়নি জলপাইগুড়ি, শুধু নতুন নতুন কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছে এদিকটায়। করলার পারে বিরাট জায়গা জুড়ে হলঘরমতন কিছু হচ্ছে। হঠাৎ ও লক্ষ করল অনিমেষ কেমন সিঁটিয়ে বসে আছে।

কী হল তোর? প্রিয়তোষ পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে জিজ্ঞাসা করল। মনে পড়ে যাওয়া থেকে অনিমেষ চুপচাপ ভাবছিল কথাটা বলবে কি না। ও ঠিক বুঝে উঠছিল না যে ছোটকাকা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে। ও নিজে অবশ্য আর গার্লস স্কুলে যায়নি, কিন্তু তপুপিসি যে এখনও এখানে আছে এ-খবর সে জানে। আর আশ্চর্য, এতদিন জলপাইগুড়ি শহরে থেকে তপপিসি একদিনের জন্যও ওদে বাড়িতে আসেনি! তপুপিসির কথা ছোটকাকুকে কীভাবে বলবে মনেমনে গোছাচ্ছিল সে। প্রিয়তোষ অবাক হচ্ছিল ওর মুখ দেখে। নরম গলায় বলল, কিছু বলবি?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। তারপর উলটোদিকে কারখানার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার একটা চিঠি আমি পুলিশকে নিতে দিইনি। চিঠিটা দাদুর বড় আলমারিতে আছে।

প্রিয়তোষ ব্যাপারটা ধরতে পারল না একবিন্দু, আমার চিঠি? কী বলছিস, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি সুটকেসে রেখে গেল ছোটাকাক, অথচ এখন কিছুই মনে পড়ছে না। চিঠির সমস্ত লাইনগুলো অবশ্য অনিমেষের নিজের মনে নেই, কিন্তু সব মিলিয়ে এই বোধটা ওর মনে আছে যে তপুলিসি খুব দুঃখ পেয়েছিল আর চিঠিটা পেলে পুলিশ নিশ্চয়ই তপুপিসির ওপর অত্যাচার করত। অথচ ছোটকাকা কিছু বুঝতে পারছে না!

তপুপিসির লেখা একটা চিঠি তোমার সুটকেসে পেয়েছিলাম আমি। তোমাকে খুঁজতে আসার আগেই লুকিয়ে ফেলেছিলাম। চিঠিটা দাদুর কাছে আছে। অনিমেষ আস্তে-আস্তে কথাগুলো বলল।

ব্যাপারটা বুঝতে যেন একটু সময় লাগল ছোটকাকার। তারপর নিজের মনেই যেন বলল, ও, আচ্ছা! আমার একদম খেয়াল ছিল না চিঠিটার কথা। তারপর অনিমেষের দিকে ফিরে বলল, তুই পড়েছিস?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমি জানতাম না ওটা কার চিঠি। কথা বলেই ও বুঝতে পারল যে ঠিক বলা হল না। কারণ ছোটকাকুর সুটকেসে অন্য কার চিঠি থাকতে যাবে! আর চিঠিটা খুলেই ও তপুপিসির নাম দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু চিঠিটা তখন না-পড়ে উপায় ছিল না-এটা মনে পড়ছে।

রিকশাওয়ালা পোস্টঅফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছোটকাকা এফ ডি আই স্কুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কদমতলা দিয়ে মাষকলাইবাড়ি চলো।…বাবা কী বলল?

শেষ প্রশ্নটা ওকে করছে বুঝতে পেরে অনিমেষ বলল, দাদু কিছু বলেননি, শুধু আলমারিতে তুলে রেখে দিলেন।

রাহুতবাড়ির তলাটা জমজমাট। এখনও সন্ধে হয়নি, আশেপাশে প্রচুর সাইকেলরিকশা ছুটে যাচ্ছে। প্রিয়তোষ চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না ছোটকাকা তাকে ছোটকাকা একবারও কিন্তু তপুপিসির কথা জিজ্ঞাসা করল না। নাকি এখানকার সব খবর যেমন ছোটকাকা জানে তপূপিসির কথাও অজানা নয়! তপুপিসি ওকে খবরটা দিয়ে নিজে থেকেই বলেছিল, তাই হোটকাকাকে বলা ওর কর্তব্য।

ছোটকাকা, তপুপিসি তোমাকে দেখা করতে বলেছে।

তপু তোকে বলেছে?

হ্যাঁ।

তোর সঙ্গে কেথায় দেখা হল? স্বৰ্গছেঁড়ায়?

না। তপুপিসি স্বৰ্গছেঁড়ায় নেই এখন। এখানে গার্লস স্কুলে কাজ করে তপুপিসি। তোমার খবর নিতে আমি একদিন ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

আমার খবর নিতে? আমার খবর ওর কাছে পাবি কী করে মনে হল।

অনেক কষ্টে অনিমেষ বলতে পারল, তোমার চিঠিটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল।

প্রিয়তোষ কোনো কথা বলল না। থানার পাশ দিয়ে রুবি বোর্ডিং ছাড়িয়ে কদমতলার রাস্তায় যাচ্ছিল রিকশাটা। অনিমেষ দেখল রূপশ্রী সিনেমার সামনেটা একদম ফাঁকা, সামান্য কয়েকটা রিকশা দাঁড়িয়ে। আর ওপরে বিরাট সাইনবোর্ডে একটা ছোট ছেলে তার চেয়ে বড় একটা মেয়ের সঙ্গে দৌড়ে যাচ্ছে। সামনে একটা গাড়ি রাস্তা জুড়ে থাকায় ওদের রিকশাটা দাঁড়িয়ে গেল। অনিমেষ সিনেমার হোডিং-এ ছবির নামটা পড়ল, পথের পাঁচালী। কীরকম ছবি এটা একদম ভিড় নেই কেন? ওর মনে পড়ল আলোছায়াতে দস্যু মোন হচ্ছে, মণ্টু বলছিল ভীষণ ভিড় হচ্ছে। আর তখনই অনিমেষ সিনেমা হলের গেটের দিকে তাকিয়ে প্রায় উঠে দাঁড়াল। প্রিয়তোষ চমকে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, তপুপিসি!

প্রিয়তোষের কপালে সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারটে ভজ আঁকা হয়ে গেল! মুখ ঘুরিয়ে অনিমেষের দৃষ্টি অনুসরণ করে ও সিনেমা হলের সামনেটা ভালো করে দেখল। আট-দশজন স্কুলের মেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে নীলপাড় সাদা শাড়ি পরে তপু টিকিট গুনছে। কিছু বলার আগেই অনিমেষ লাফ দিয়ে নেমে দ্রুত হেঁটে তপপিসির কাছে গিয়ে হাজির হল।

ওকে দেখতে পায়নি তপুপিসি, অনিমেষ কাছে গিয়ে ডাকল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিমেষকে দেখতে পেয়ে তলুপিসি ীষণ অবাক হল, ওমা অনি, তুই কোথা থেকে এলি? সিনেমা দেখছিস?

চটপট ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। তুমি দেখছ।

খুশি-খুশি মুখে পিসি বলল, হ্যাঁ। হোস্টেলের ওপর-ক্লাসের মেয়েদের নিয়ে এসেছি। এত ভালো ছবি বাংলাভাষায় এর আগে হয়নি। তুই অবশ্যই দেখবি কিন্তু।

এসব কথা এখন কানে যাচ্ছিল না অনিমেষের। ও একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, জান তপুপিসি, ছোটকাকা এসেছে!

ছোটকাকা? তপুপিসি যেন কথাটা মনের মধ্যে দুএকবার আওড়ে নিলেন, কবে এসেছে।

এই তো, আজ সকালে। অনিমেষ রিকশার দিকে তাকিয়ে বলল, ওই তো রিকশায় বসে আছে। একটু আগে আমরা তোমার কথা বলছিলাম, তুমি অনেকদিন বাঁচবে, দেখো।

রিকশায় বসে প্রিয়তোষ দেখল তপু মুখ তুলে ওকে দেখছে। ও ধীরেসুস্থে রিকশা থেকে নেমে দূরত্বটা হেঁটে এর। তুপ চশমা নিয়েছে মোটা কালো ফ্রেমের। খুব ভারিক্কি দেখাচ্ছে। স্কুলের মেয়েগুলো বড় বড় চোখ করে ব্যাপারটা দেখছিল। অনিমেষের দিকে কেউ-কেউ চোরা-চাহনি দিচ্ছে, কেউ মুখ টিপে হাসছে। বোঝা যায় তপুপিসিকে এরা ভয় করে, কারণ কেউ কোনো শব্দ করছে না। অনিমেষ ছোটকাকাকে বলতে শুনল, কেমন আছ তপু?

তপুপিসি বারবার ছোটকাকাকে দেখছিল। যেন সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, প্রশ্নটা শুনতেই একটু নড়ে উঠল শরীরটা, তারপর বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?

হাসল ছোটকাকা, কেমন দেখছ?

বেশ আছ মনে হচ্ছে। কবে এলে?

আজ সকালে।

কদিন থাকবে?

কালই চলে যাব।

উত্তরটা শুনে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। ছোটকাকা যে কালই চলে যাবে একথা তো আগে একবারও বলেনি! এমনকি দাদু-পিসিমাও জানেন না।

কেন এলে?

এলাম। অনেকদিন এদিকে আসিনি, ভাবলাম দেখে যাই। তাছাড়া এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজছে সেটা সারতে হবে। এখন সেখানেই যাচ্ছি।

ও। ঠিক আছে, তোমাকে আর আটকাব না, কাজ সারো গিয়ে। আমাদেরও সিনেমা শুরু হল বলেঃ তপুপিসি আস্তে-আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।

অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে এদের দেখছিল। এতদিন পরে দেখা হল অথচ ওরা কীভাবে কথা বলছে! তপুপিসির সঙ্গে ওর যেদিন শেষ কথা হয়েছিল সেদিন তপুপিসি কত ব্যাকুলভাবে ছোটকাকার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। অথচ আজ সেই মানুষটাকে সামনে পেয়ে কেমন দায়সারা কথা বলছে। আবার ছোটকাকা যেভাবে কথা বলছে তার উত্তর আর কীভাবেই-বা দেওয়া যায়। না, তপুপিসিকে সে কোনো দোষ দিতে পারছে না।

হঠাৎ যেন প্রিয়তোষের গলাটা অন্যরকম শোনাল, ঠিক আছে, তোমরা সিনেমা দ্যাখো, আমরা চলি।

আচ্ছা! শোনো, এই সিনেমা দেখাটা আমার যতটা আনন্দ করার জন্য, তার চেয়ে কর্তব্য করা কিন্তু একবিন্দু কম নয়। তপুপিসি মেয়েদের এগোতে নির্দেশ দিল হাত নেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা সাপের মতো নড়ে এগোতে লাগল।

আরও খানিক বাদে যখন রিকশাটা কদমতলার মোড় ঘুরে শিল্প-সমিতিপাড়া হয়ে মাষকলাইবাড়ির দিকে যাচ্ছিল, যখন শহটার বুকজুড়ে ছুড়ে-দেওয়া হাতজালের মতো অন্ধকার আকাশ থেকে নেমে আসছিল তখন অনিমেষের মনে হচ্ছিল ও একদম বড় হতে পারেনি। এখনও অনেক অজানা ইংরেজি শব্দের মতো এই পৃথিবীর চেনা চৌহদ্দিতে অনেক কিছু অজানা হয়ে আছে। তপূপিসি আর ছোটকাকু যে-কথা সহজ গলায় বলে গেল ও কিছুতেই তা পারত না। কিন্তু ওর কাছে। এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে আসছে যে তপপিসি আজ খুব দুঃখ পেল, সেই কতদিন আগে-লেখা চিঠিতে যে-দুঃখটা ছিল আজ একদম কিছু না বলে তার চেয়ে অনেক বড় দুখ নিয়ে তপুপিসি সিনেমা হলের। ভেতর চলে গেল। ওর মনে একটুও সংশয় নেই, এখন এই মুহূর্তে তপপিসি একটুও সিনেমা দেখছে না। অনিমেষের ইচ্ছে হচ্ছিল এখন চুপচাপ হেঁটে বাড়ি ফিরে যেতে। ছোটকাকার বিলিতি সেন্টের গন্ধ নাকে নিয়ে রিকশায় যেতে একদম ভালো লাগছে না।

মাষকলাইবাড়িতে পৌঁছতে সন্ধেটা গাঢ় হয়ে গেল। বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকের মাটির পথটায় রিকশাওয়ালাকে যেতে বলল ছোটকাকা। অনিমেষ এর আগে এইসব জায়গায় কখনো আসেনি। বাড়িঘরদোর দেখলেই বোঝা যায় সদ্য-গজিয়ে-ওঠা একটা কলোনি এটা। প্রিয়তোষ একটু অসুবিধেতে পড়েছিল প্রথমটা। খুব তড়িঘড়ি জায়গাটার চেহারা বদলেছে। কিন্তু একটা টিনের চালওয়ালা একতলা বাড়িটাকে খুঁজে বের করল শেষ অবধি। কাঁচা রাস্তটায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো আসেনি। কেমন অন্ধকার হয়ে আছে চারধার। দুপাশের বাড়িগুলো থেকে চুইয়ে-আসা হারিকেনের আলোটুকুই এতক্ষণ রিকশাওয়ালার সম্বল ছিল। বাড়িটার সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে পড়ল প্রিয়তোষ, তারপর অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কী ভেবে নিয়ে বলল, নেমে আয়। আমি ইশারা করলে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসবি।

ব্যাপারটা খুব রহস্যময় লাগছিল অনিমেষের কাছে। এই অন্ধকারে এমন অপরিচিত পরিবেশ আসা, বোধহয় সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা যার জন্য ছোটকাকা এসেছে তা এখানেই এবং ইশারা করলেই বেরিয়ে আসতে হবে-ও কী করবে ঠাওর করতে পারছিল না। ও বলতে গেল যে সে রিকশাতেই বসে আছে, ছোটকাকা কাজ শেষ করে আসুক। কিন্তু ততক্ষণে ছোটকাকা রাস্তা ছেড়ে সেই বাড়িটার বারান্দায় উঠে পড়েছে। অগত্যা অনিমেষ রিকশা থেকে নেমে অন্ধকারে কোনোরকমে বারান্দায় চলে এলে। প্রথমবার কড়া নাড়ার সময় ভেতর থেকে কোনো শব্দ হয়নি, এবার কেউ খুব গীর গলায় কে বলে উঠল। অনিমেষ অস্পষ্ট দেখল প্রিয়তোষ গলাটা শুনেই পকেট থেকে রুমাল বের করে চট করে মুখ মুছে নিয়ে জবাব দিল, আমি প্রিয়তোষ।

দরজা খুলতে একটুও দেরি হল না এবার। প্রিয়তোষ এগিয়ে যেতে অনিমেষ পিছু নিল। খোলা দরজার ওপাশে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তার মাথায় ঘোমটা, বাঁ হাতে শাখা-নোয়া নেই। দেখলেই বোঝা যায় বিয়ে-থা হয়নি। মুখে এবং কাপড় পরার ধরনে এমন একটা ব্যাপার আছে যে তাকে পরিচিত। বিবাহিত বা অবিবাহিত মেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করা যায়। ঘরে আসবার বলতে একটা তড়পোশ আর দুটো কাঠের চেয়ার। তক্তপোশের ওপর বাবু হয়ে একজন মাঝবয়েসি মানুষ বসে আছেন। বোঝাই যায় এককালে স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল। মাথায় চুল আছে যথেষ্ট, কিন্তু সেগুলো অগোছালো আর ঘরের ভেতর যেটুকু হারিকেন দিচ্ছিল তাতেই চুলগুলোর অর্ধেক যে পাকা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। একটা ফতুয়া আর লুঙ্গি পরেছেন ভদ্রলোক, নাকটা ভীষণ টিকলো। অনিমেষ দেখল ভদ্রলোকের ডান হাতটা ফুতয়ার হাত থেকে বেরোয়নি। লতপত করছে সেটা। এই প্রথম ও আবিষ্কার করল মানুষটার একটা হাত নেই।

প্রিয়তোষ ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়েছিল। অনিমেষ দেখল ওঁরা দুজন একদৃষ্টে ছোটকাকার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রমহিলার চোখের বিস্ময় মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ছোটকাকা বলল, তেজেনদা, আমার চিঠি পেয়েছেন?

সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা কাঠ-কাঠ গলায় বলে উঠলেন, ঠিকানা যখন ঠিক লেখা হয়েছে তখন না পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

ছোটকাকা বলল, এভাবে কথা বলছ কেন রমলাদি?

ভদ্রমহিলা বললেন, তোমার সঙ্গে আর কীভাবে কথা বলা যায়!

ছোটকাকা কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় ভদ্রলোক কথা বললেন। অনিমেষ শুনল ওঁর গলার স্বর বেশ গম্ভীর, এই ছেলেটি কে?

ছোটকাকা বলল, আমার ভাইপো।

একে সঙ্গে এনেছ কেন?

ছোটকাকা একটু সময় নিল উত্তরটা দিতে, ওকে নিয়ে শহরটা দেখতে বেরিয়েছিলাম, সেই থেকে সঙ্গে আছে।

তুমি কি পলিটিক্যাল আলোচনা অ্যাড করতে চাও?

এবার ছোটকাকা ঘুরে দাঁড়াল, অনি, তুই বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর।

দরজা ভেজানো ছিল। অনিমেষ আস্তে-আস্তে সেটা খুলে বাইরে এল। ওর মনে হচ্ছিল এই ঘরে একটা দারুণ কোনো ব্যাপার হবে-চলে গেলে সেটা দেখতে পাবে না ও। অথচ এর পর চলে না যাওয়া অসম্ভব। দরজাটা ভেজিয়ে ও বারান্দায় দাঁড়াল। বাইরে ঘুটেঘুটে অন্ধকার। রিকশাওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু রাস্তার একপাশে রিকশার তলায় ছোট একটা লাল আলো একচক্ষু রাক্ষসের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে। বারান্দা দিয়ে কয়েক পা হেঁটে অনিমেষ একটা বন্ধ জানলার পাশে এসে দাঁড়াল। আশ্চর্য, ঘর থেকে কোনো শব্দ বাইরে আসছে না! ওরা কি খুব চাপাগলায় কথা বলছে কী কথা? হঠাৎ অনিমেষের মনে হল ছোটকাকার হঠাৎ করে চলে যাওয়া, এতদিন উধাও হয়ে থেকে এভাবে বড়লোক হয়ে ফিরে আসা-এতসব রহস্যের কথা এই বন্ধ ঘরের আলোচনা থেকে জানা যাবে। ওই হাতকাটা ভদ্রলোক তো বললেন পলিটিক্যাল আলোচনা হবে। অনিমেষ শুনবার কৌতূহল ওকে এমন পেয়ে বসল যে ও নিঃশব্দে বারান্দা থেকে নেমে বাড়ির এপাশটায় চলে এল। এধারের মাটি কোপানো, বোধহয় শাকসবজির গাছ লাগানো হয়েছে। অন্ধকারে পায়ে হাতড়ে ও ঘরটার একপাশে চলে এল। এদিকের জানলাটা আধা-ভেজানো, একটা পর্দা ঝুলছে। ও চুপটি করে জানলার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। পাশেই একটা ঝাঁপড় গাছে বসে একটা পাখি ডানা ঝাঁপটে উঠল। অনিমেষ শুনল ছোটকাকা বলছে, এভাবে কথাবার্তা বলার জন্য আমি নিশ্চয়ই এতদিন পর আপনাকে চিঠি দিইনি তেজেনদা।

সঙ্গে সঙ্গে সেই মহিলা, যাকে ছোটকাকা রমলাদি বলেছেন, হিসহিস করে বলে উঠলেন, একজন বিশ্বাসঘাতক দালালের সঙ্গে এর চেয়ে দ্রভাবে কথা বলা যায় না।

ছোটকাকা উত্তেজিত গলায় বাল, তেজেনদা, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, এই ভদ্রমহিলাকে আপনি চুপ করতে বলুন।

তেজেনদার গলা পেল অনিমেষ, প্রিয়তোষ, তুমি হঠাৎ এলে কেন? আমি তো তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি।

আপনি কি জানতেন আমি কোথায় আছি?

গত তিন বছর ধরে তোমার সব খবর আমি পেয়েছি। দিল্লিতে–

গলাটা হঠাৎ থেমে গেল। তার পরেই ছোটকাকার গলা ভেসে এল, বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, আমি যা বলব আপনাকেই বলব, এই মহিলাকে এই ঘর থেকে যেতে বলুন।

কেন আমাকে কেন প্রিয়তোষ?

আশ্চর্য, আপনি আমাকে এই প্রশ্নটা করলেন!

হ্যাঁ।

আপনি আমাকে কমিউনিস্টজমে দীক্ষা দিয়েছিলেন, আপনাকে আমি গরু বলে মেনেছি।

সে তো এতকালে। সেই কোন কালে। এখন তো তুমি কমিউনিস্ট নও। আমার সঙ্গে তোমার তো কোনো সম্পর্ক নেই, তুমিই রাখনি। তা হলে এসব কথা কেন?

ছোটকাকার গলাটা কেমন শোনাল, মাঝে-মাঝে তেজেনদা আমি ভাবি। ইদানীং প্রায়ই মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা কররে মনটা পরিষ্কার হবে। কোনো মানে নেই জানি, কিন্তু এককালে আমি আর আপনি দিনরাত একসঙ্গে কীভাবে কাটিয়েছি-সেগুলো আমাকে হষ্ট করে। এ-ফিলিংস শুধু আপনার আমার ব্যক্তিগত রিলেশন নিয়ে, তেজেনদা। তাই কথাগুলো শুধু আপনাকে চলতে চাই।

হুঁ। কিন্তু প্রিয়তোষ, তোমার চিঠি পাওয়ার পর আমরা পার্টি থেকে ডিভিশন নিয়েছি যে, কোনো ব্যক্তিগত আলোচনা তোমার সঙ্গে অসম্ভব। ইন ফ্যাক্ট, তোমাকে অভিযুক্ত করার জন্য রমলাকে পার্টি থেকে এখানে থাকতে বলেছে। তুমি কাল মিনিস্টারের সঙ্গে প্লেন থেকে নামার পরই আমরা মিটিং করি।

কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ, তারপর ছোটকাকা বলে উঠল, আমি কোনো পার্টির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। তেজেনদা, ব্যক্তিগত ব্যাপার পার্টির লেভেলে নিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা আপনার কাছে সেটাকে আমি ঘৃণা করি। বেশ, আমি উঠছি।

সঙ্গে সঙ্গে রমলাদি বললেন, না। উঠি বসলেই এখন ওঠা সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি, তেজেনদার একটা অস্বস্তি থাকায় আমরা কিছু করিনি এতদিন। কিন্তু তোমার সাহস যখন এতটা বেড়ে গেছে তখন আর শেয়ার করা যায় না। তুমি জলপাইগুড়ি ঢোকার পর থেকে আমাদের ছেলেরা তোমাকে ওয়াচ করছে এবং এই মুহূর্তেও।

প্রিয়তোষের কী প্রতিক্রিয়া হল অনিমেষ দেখতে পেল না, কিন্তু ওর নিজের শরীরে কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল এবার। ও চকিতে মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে যে-আলো আসছে তাতে কোনোকিছুই ভালো করে দেখা যায় না। এই বাড়িতে কেউ কি আছে যে। ওদের ওয়াচ করছে। ছোটকাকা যদি এই শহরে আসা অবধি কেউ বা কারা ফলো করে থাকে, তবে তারা এখানেও আছে। অনিমেষের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, ও অন্ধকারে ঠাহর করেও কিছু দেখতে পেল না। এই যে ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাও নিশ্চয়ই ওদের নজরে পড়েছে। নাকি পড়েনি?

হঠাৎ রমলাদির গলা শুনতে পেল অনিমেষ, প্রিয়তোষ, তোমার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, পার্টির বিপর্যয়ের সময় তুমি যখন অন্যাদের মতো গা-ঢাকা দিয়েছিলে তখন তোমার হদিস কোনো কমরেড জানত না।

ছোটকাকার গলা পাওয়া গেল না। রমলা বললেন, চুপ করে থেকে সময় নষ্ট করছ। আমরা এখানে আড্ডা মারতে আসিনি। তবু কোনো উত্তর এল না ছোটকাকার কাছ থেকে। রমলাদি আবার বললেন, যাবার আগে তুমি পার্টি ফান্ড ডিল করতে, আমরা পরে হিসাব মেলাতে পারিনি। কেন?

এবারে ছোটকাকা বলে উঠল, চমক্কার। যেহেতু আমি আর পার্টির সদস্য নই, তাই এইসব আজেবাজে প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই। তবু যখন শুনতে চাইছ তখন বলছি, আমি যা-কিছু করেছি সবই তেজেনদার আদেশে করেছি। লোকাল কমিটির ফাভে লাখ লাখ টাকা থাকে না। যা গরমিল হচ্ছে তা তেজেনদার আদেশেই হয়েছে। ব্যস!

সঙ্গে সঙ্গে তেজেনদার চিৎকার কানে এল ওর, কী, কী বললি প্রিয়? আমি তোকে বলেছি চুরি করতে? তুই পারলি বলতে এসব কথা? তোকে আমি হাতে করে গড়েছিলাম এইজন্যে?

রমলাদি বললেন, তুমি যে-কথা বলছ তা কি দায়িত্ব নিয়ে বলছ?

হঠাৎ প্রিয়তোষ চেঁচিয়ে উঠল, আমার কী দরকার দায়িত্ব নেবার! তোমরা যা অভিযোগ করছ তা কি প্রমাণ করতে পারবে কখনোই না। অতএব আমি যদি বলি তেজেনদাই সবকিছু করেছেন তোমাদের সেটা শুনতে হবে। কী করেছ তোমরা? ফিফটি টুর ইলেকশনের পর কোথায় দাঁড়িয়েছ এসে! সাধারণ মানুষকে তোমরা কখনোই কাছে আনতে পারনি, তাদের আস্থা পাওয়া তো দূরের কথা। কংগ্রেস সুইপ করে বেরিয়ে গেছে এটা তাদের ক্রেডিট, তোমাদের সজ্জা। পার্টির যখন এই হাল করেছ তখন তোমাদের কোনো কথা বলার অধিকার নেই। আমি চললাম।

তেজেনদা বললেন, তোর মতো কিছু বিশ্বাসঘাতকের জন্য আজ আমাদের এই অবস্থা। আমরা যতদিন তোদের ঝেড়ে না ফেলতে পারি ততদিন এক পা-ও এগোতে পারব না। কিন্তু মনে রাখিস, কমিউনিস্ট পার্টি চিরকাল এইভাবে পড়ে-পড়ে মার খাবে না। তুই বলতিস এককালে, তেজেনদা, আপনার একটা হাত ইংরেজদের দিয়েও আপনি এত অ্যাকটিভ? হ্যাঁ, এই পার্টি যখন মিলিট্যান্ট হবে, যখন কোনো আপস করবে না, তখন এই দেশের মানুষ আমাদের পাশে আসবেই। হয়তো আমি তখন থাকব না, কিন্তু পার্টি ক্ষমতায় আসবেই।

রমলাদির তীক্ষ্ম গলা ভেসে এল, তেজেনদা, আপনি সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছেন!

এবার ছোটকাকার গলার স্বর পালটে গেল আচমকো, তেজেনদা, ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। আমি কাদের হয়ে কাজ করছি সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু যেজন্য আমি আপনার কাছে এলাম তা আলোচনা করার সুযোগ দিলে ভালো করতেন।

রমলাদি বললেন, কী জন্যে তুমি এসেছ।

আস্তে-আস্তে ছোটকাকা বলল, আমরা চাই উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলে অ্যান্টিকংগ্রেস মুভমেন্ট শুরু হোক, টাকার জন্য তোমরা চিন্তা করো না। তেজেনদা, আন্দোলন না করলে কোনো পার্টি জনতার আস্থা অর্জন করতে পারে না।

আমাদের টাকা দেবে কে? তোরা মানে কারা? কী লাভ তোদের? তেজেনদার গলাটা কাঁপছিল।

ছোটকাকা বলল, মাপ করো, এর উত্তর আমি দিতে অক্ষম। তবে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব আমার ওপর দেওয়া হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে রমলাদি শক্ত গলায় বলে উঠলেন, তুমি কাদের হয়ে টোপ ফেলছ প্রিয়তোষ? আমাদের পার্টি ঘুষ খেয়ে কাজ করে না। তোমার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম সেটা সত্যি তা হলে। ছি ছি, ছি!

দরজা খোলা শব্দ পেল অনিমেষ, রমলাদি, তোমাদের পার্টির নিয়ম হল কোনো প্রশ্ন না করা। ওপরতলা থেকে যখন আদেশ আসবে তখন দেখব তুমি কী করে অস্বীকার কর।

হঠাৎ রমলা বললেন, তুমি এখান তেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না, প্রিয়তোষ।

হাসল ছোটকাকা, ভুলে যাচ্ছ কেন, এটা রাশিয়া নয়। আর এটা দেখছ, তোমার সঙ্গীদের কেউ সাহস দেখাতে এলে আমাকে এটা ব্যবহার করতে হবে।

খুব ফ্যাসফেসে গলায় তেজেনদা বললেন, প্রিয়তোষ!

ছোটকাকা বলল, আমি কাল সকাল অবধি আছি। আমার প্রস্তাব যদি ভালো লাগে খবর দিও। এবং খবরটা, রমলাদি, তুমি নিজে গিয়ে দিও। আনঅফিসিয়ালি একটা কথা বলি ফালতু গোঁড়ামি বাদ দিলে যদি আখেরে কাজ হয় তা-ই করাটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।

দরজা খুলে গেল। তেজেনদা বললেন, ওর হাতে রিভিলভার আছে, বোকামি কোরো না রমলা। ছেলেদের নির্দেশ দেবার দরকার নেই। ও যেমন এসেছিল তেমনি যাক।

ঠিক এই সময় অনিমেষ ছোটকাকাকে ওর নাম ধরে ডাকতে শুনল। দুবার ডাকবার পর ছোটকাকা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল ওর কথা। অনিমেষের এখন একটুও ইচ্ছে করছিল না? ছোটকাকার সঙ্গে যেতে। ছোটকাকা কী? কংগ্রেসের মিনিস্টারের সঙ্গে ভাব আছে, কিন্তু কংগ্রেসি নয়। আবার কমিউনিস্ট না হয়েও কমিউন্টিদের বলে গেল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। আবার কমিউনিস্ট না হয়েও কমিউনিস্টদের বলে গেল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে। ছোটকাকার সঙ্গে রিভলভার আছে ও জানতই না!

বন্দেমাতরম্ বা ইনকিলাব জিন্দাবাদের বাইরে কি কোনো দল আছে। তারা কারা? তাদের কি অনেক টাকা আছে? অনিমেষের মনে হল তারা যে-ই হোক এই দেশকে একফোঁটাও ভালোবাসে না। তারা শুধু পক্ষের মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দিতে চায়। দাদুকে দেওয়া ছোটকাকার টাকাগুলো মনে করে ও যেন কিছু হদিস খুঁজে পাচ্ছিল না। ছোটকাকা আবার ওর নাম ধরে ডেকে উঠতে অনিমেষ নিজের অজান্তেই একটা ঘৃণা মনে লালন করতে করতে রিকশার দিকে এগিয়ে গেল।

আজ দুপুরে প্লেনে প্রিয়তোষ চলে যাবে। অনিমেষ ভেবেছিল এতদিন পর বাড়ি এসেএইভাবে হঠাৎ চলে যাওয়ায় দাদু নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু কার্যত দেখা গেল হেমলতাই একটু চ্যাঁচামেচি করলেন, ভাইকে অভিমানে দুকথা শুনিয়ে দিলেন এবং খবরটা সরিৎশেখরের কাছে পৌঁছে দিয়ে অনুযোগ করতে লাগলেন। সরিৎশেখরের তখন সবে বাজার থেকে ফিরে হাতপাখা নিয়ে বসেছেন, শুনে বললেন, ও, তা-ই নাকি নাকি! কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, আবহনও নেই, বিসর্জন নেই বড় হবার পর দাদুকে যত দেখছে তানিমেষ তত অবাক হচ্ছে। কোনো শোক-দুঃখই যেন দাদুকে তেমনভাবে স্পর্শ করে না। ছোটকাকাকে প্রথম দেখে দাদু কী নির্লিপ্তের মতো প্রশ্ন করেছিলেন, কখন এল? এখন খবরটা পাওয়ার পর মুখোমুখি হতে সেইরকম গলায় শুধোলেন, প্লেন কটায়?

প্রিয়তোষ বোধহয় এরকম আশা করেনি। ভেবেছিল দিদির মতো বাবাও রাগারাগি করবেন।

একটা পঁয়তাল্লিশ। প্রিয়তোষ নিজের ঘড়ি দেখল, আটটা বাজে।

একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেও। তোমার দিদিকে বলে দিচ্ছি তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করতে।

ব্যস্ত হবার কিছু নেই। অনেক দেরি আছে। প্রিয়তোষ অবাক হয়ে বাবাকে দেখছিল।

হঠাৎ সরিৎশেখর বললেন, তুমি ওই চেয়ারটায় বসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে। বেতের চেয়ারের ওপর পাতা গদিগুলো দীর্ঘকাল না পালটানোয় কালো হয়ে গিয়েছে ময়লা জমে, প্রিয়তোষ সাবধানে বসল।

সরিৎশেখর উঠোনের পাশে বাতাসে দোল-খাওয়া বকফুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি জানি না তুমি এখন কী কর। আজ বাজারে এলাম তুমি নাকি খুবই ইনমেনশিয়াল লোক। আমার বাড়িতে এসে উঠেছ অনেকে বিশ্বাস করে না।

খুব লজ্জিত হয়ে পড়ল প্রিয়তোষ, কে বলেছে এসব কথা?

ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর, যেন ছেলের প্রশ্নটাকে ঝেড়ে ফেললেন, তুমি আমার একটা উপকার করবে?

বলুন।

আমার বাড়ির চারপাশে কী দ্রুত বাড়িঘর গজিয়ে উঠেছে। একটা বড় গাড়ি ঢোকার পথ নেই। অথচ মিউনিসিপ্যালিটির প্ল্যানে আমার জন্যে রাস্তা দেখানো আছে। আমি ডি সি, মিউনিসিপ্যালিটিসবাইকে চিঠি দিয়েছি, কোনো কাজ হয়নি। এরকম চললে ক্রমশ আমার বাড়িটা বন্দি হয়ে যাবে।

প্রিয়তোষের দিকে মুখ ফেরালেন সরিৎশেখর। প্রিয়তোষ সমস্যাটা অনুধাবন করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আপনার রাস্তা অন্য লোক দখল করবে কী করে?

অসহায় ভঙ্গিতে সরিৎশেখর বললেন, সবই তো হয় এ-যুগে। স্বাধীতার পর আমরা যে-জিনিসটা খুব দ্রুত শিখেছি সেটা হল টাকা দিয়ে আইন কেনা যায়। এখন এ-যুগে উচিত বলে কোনো শব্দ সরকারি কর্মচারীদের কাছে আশা করা বোকামি। আমাকে ওরা বলে এই বাড়ি নিয়ে যখন এতন সমস্যা তখন ওটাকে বিক্রি করে দিন, নিস্তার পাবেন। যেন আমি নিস্তার পাবার জন্য এই বাড়ি বানিয়েছি।

প্রিয়তোষ বলল, আপনার বাড়ি তো এবার গভর্মেন্ট ভাড়া নিচ্ছে, ওদের প্রয়োজনেই রাস্তা বেরিয়ে যাবে। সরকারি গাড়ি আনার জন্য রাস্তা দরকার হবেই।

সরিৎশেখর খানিকক্ষণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে তোমাকে বলছি কেন?

প্রিয়তোষ বোঝাতে চাইল, না, এ তো গভর্মেন্ট নিজের গরজেই করবে, মাঝখান থেকে আপনার বাড়ির জন্যে একটা রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে।

সরিৎশেখর আস্তে-আস্তে বললেন, কাল হয়ে যাওয়ার পর আমি জানতে পারলাম এই বাড়িতে ওরা অফিস করছে না, রেসিডেন্সিয়াল পারপাসে নিচ্ছে। আগে জানলে আমি ভাড়া দিতাম না।

কিন্তু বাড়ি ভাড়া দেওয়াটা তো আপনার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। প্রিয়তোষ বলল।

হ্যাঁ ছিল, কারণ মানুষ শেষ বয়সে এসে কারও ওপর বাঁচার জন্য নির্ভর করে। আমার পুত্রদের কাছে থেকে সেটা আশা করা বোকামি। আমার বাড়ির কাছ থেকে আমি তা পাব, এ এখন আমাকে দেখবে। তুমি প্রায়ই বলছ, আপনার বাড়ি। যেন এই বাড়িটা শুধু একা আমারই, তোমাদের কিছু যায়-আসে না!

প্রিয়তোষ বলল, কিন্তু আমার পক্ষে তো জলপাইগুড়িতে এসে সেটলড করার কোনো প্রশ্ন ওঠে। দাদারা আছেন!

দাদারা বোলো না, দাদ-তোমার বড়দার অস্তিত্ব আমার কাছে নেই। চট করে ছেলেকে থামিয়ে দিলেন সরিৎশেখর, কি, আজেবাজে কথা বলে লাভ নেই। দেশের কত বড় বড় কাজে তোমাদের সময় ব্যয় হচ্ছে, আমার এই সামান্য উপকার যদি তোমার দ্বারা সম্ভব হয় তা হলে খুশি হব।

প্রিয়তোষ উঠল, দেখি কী করা যায়।

সরিৎশেখর বললেন, শুনলাম সেন্ট্রালের মিনিস্টারের সঙ্গে তোমার খাতির আছে। তাকে বললে তো এই মুহূর্তেই কাজ হয়ে যায়।

প্রিয়তোষ বলল, এত সাধারণ ব্যাপার তাঁকে বলা ঠিক মানায় না।

সরিৎশেখর মনেমনে বিড়বিড় করলেন, আমার কাছে তো মোটেই সাধারণ নয়! তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তুমি কি এখন বাইরে যাচ্ছ?

হ্যাঁ। প্রিয়তোষ ঘাড় নাড়ল।

দাঁড়াও। সরিৎশেখর দ্রুত ঘরের ভেতর চলে গেলেন। অনিমেষ ওর পড়ার ঘর থেকে বাইরের বারান্দাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। প্রিয়তোষ কাল রাত্রের পোশকটাই পরেছে এখন। দাদু ভেতরে গলে একা দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। এই লোকটাকে ওর একবিন্দু পছন্দ হচ্ছে না এখন। কাল রাত্রে বাড়িতে ফেরার পর অনিমেষ ভেবেছিল কেউ হয়তো এসে ছোটকাকার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এমনকি আজ সকালে দুবার ঘোটকাকা অনিকে বলেছে কেউ এলে যেন ডেকে দেয়। কিন্তু কেউ আসেনি। অনিমেষের মনে হল তেজেনদাদের কেউ নিশ্চয়ই আসবে না। আজ একটু আগে ছোটকাকা অনিমেষকে একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কাল রাত্রের কোনেকিছু সে শুনেছে কি না। এখন চট করে সত্যি কথা না বলতে কোন অসুবিধে হয় না। বিশেষ করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের উপদশটা পড়ার পর থেকে। ছোটকাকা আশ্বস্ত হয়ে ওকে হঠাৎ বিরাম করের বাড়ির পজিশনটা জানাতে বলল। অনিমেষ ভাবছিল ছোটকাকা নিশ্চয়ই তাকে সঙ্গে যেতে বলবে। কিন্তু প্রিয়তোষ ঠিকানা জেনে নিয়ে এ-বিষয়ে কোনো কথা বলল না। অবশ্য কাল স্কুল-কামাই হয়েছে, আজ না গেলে দাদু খুশি হবে না। কিন্তু মুভিং ক্যাসেলের বাড়িতে ছোটকাকা কী জন্য যাচ্ছে জানবার জন্য ওর ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। অথচ কোনো উপায় নেই। ওর মনে হল একটু পরেই উর্বশীরা রিকশা করে স্কুলে চলে যাবে। ছোটকাকার সঙ্গে কি ওদের দেখা হবে?

সরিৎশেখর বাইরে এলেন হাতে একটা কাগজ নিয়ে, এটা তোমার জিনিস, নিয়ে যাও।

অনিমেষ দেখল ছোটকাকা খুব অবাক হয়ে দাদুর হাত থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী এটা?

দাদু কোনো উত্তর দিলেন না, একটা হাত শূন্যে কীভাবে নেড়ে আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। ছোটকাকা কাগজটা টানটান করে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুঠোয় পুরে মুচড়ে ফেলল। তারপর তাকে কয়েক টুকরো করে ছিঁড়ে টান দিয়ে উঠোনের একপাশে ফেলে দিল।

ছোটকাকা বেরিয়ে গেলে অনিমেষ উঠোনে নেমে এল। দাদু ঘরের মধ্যে বসে হাতপাখা চালাচ্ছেন, পিসিমা রান্নাঘরে। ও প্রায় পা টিপে টিপে ছোটকাকার ছুড়ে-ফেলা কাগজের মোড়কটা তুলে নিল। টুকরোগুলো দেখেই ওর পা-দুটো কেমন ভারী হয়ে গেল। এক টুকরোয় অনিমেষ পড়ল, কী বোকা আমি। দায় তুলে নিলাম। তপু। আর-একটা টুকরোর প্রথমেই, পৃথিবীতে চিরকাল মেয়েরাই ঠকবে, এটাই নিয়ম।

তপুপিসির সেই চিঠিটা যেটাকে সে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, যেটাকে দাদু এতদিন যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন সেটার এই অবস্থা হওয়ায় অনিমেষের বুকটা কেমন করে উঠল। গতকাল সন্ধ্যায়-দেখা পাথরের মতো মুখটা মনে পড়তেই অনিমেষ বুঝতে পারল, তপুপিসি অনেক বুদ্ধিমতী। ও হঠাৎ দ্রুতহাতে কাগজগুলো কুটিকুটি করে ছিড়তে লাগল। এর একটা শব্দও যেন কেউ পড়তে না পরতে। তপুপিসির এই চিঠির প্রতিটি অক্ষরে যে-দুঃখটা ছিল সেটা যেন এখন ওর লজ্জা হয়ে পড়েছে। অনিমেষ তপুপিসিকে সেই লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য অক্ষরগুলো নষ্ট করে ফেলেছিল।

সেদিন স্কুলে নিশীথবাবু এলেন না। প্রথম পিরিয়ডেই ওঁর ক্লাস ছিল। প্রেয়ারের পর ক্লাসরুমে গিয়ে ওরা গল্পগুজব করছিল। গতকাল এয়ারপোর্টে যা যা ঘটেছিল অনিমেষ যখন সবিস্তারে ঘটনা ঘটে না। হোস্টেলের ছাত্রদের কারও গার্জেন এলে হেডস্যার দারোয়ান দিয়ে ডাকান, অনিমেষের বেলায় আজ অবধি এরকম হয়নি।

দারোয়ানের পিছুপিছু হেডস্যারের ঘরে গেল অনিমেষ। হেডস্যারের ঘরের সামনেই অফিস-ক্লার্ক বসেন। তিনি অনিমেষকে দেখে বললেন, তোমার বাড়ি থেকে দিয়েছে, এখনই বাড়ি চলে যাও।

অবাক হয়ে অনিমেষ বলল, কেন?

নিশ্চয়ই কোনো বিপদ-আপদ হয়েছে।

আমি কি বই-এর ব্যাগ নিয়ে যাব?

ভদ্রলোক একটু দ্বিধা করে বললেন, না, তুমি যাও। আমি দারোয়ানকে দিয়ে ক্লাস থেকে ব্যাগ আনিয়ে রাখছি, কাজ শেষ হলেই চলে এসো।

কোনোদিন এত সকাল-সকাল ও স্কুল থেকে বের হয়নি। স্কুলের বাগানটা এখন হরেকরকম ফুলে উপচে পড়ছে। এত প্রজাপতি আর মৌমাছি উড়ে বেড়ায় যে সাবধানে শান-বাঁধানো প্যাসেজটা দিয়ে হাঁটতে হয়। বাড়িতে কার কী হল? আসবার সময় তো তেমন-কিছু দেখে আসেনি! দাদুর কি শরীর খারাপ হয়েছে? কে এসে খবর দিল? ও হঠাৎ দৌড়তে শুরু করল। স্কুলের গেট খুলে রাস্তায় পা দিতেই দেখল মেনকাদি ওদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই হাত নেড়ে কাছে ডাকল।

এই, তোমার জন্য ঠায় আধঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসো।

মেনকাদি একগাল হাসল। অনিমেষ বুঝতে পারল না মেনকাদি কেন তার জন্য অপেক্ষা করবে। ও বলল, আমাকে বাড়িতে যেতে হবে, খুব বিপদ। কিছু-একটা হয়েছে, খবর এসেছে।

ঠোঁট ওলটাল মেনকাদি, তুমি একদম বন্ধু, আমরাই খব দিয়েছি। প্রিয়দই দিতে বললেন। নিজের হাতে গেট খুলে দিলেন মেনকাদি।

এক-এক সময় অনিমেষের নিজের ওপর খুব রাগ হয়। সবকথা অনেক সময় ও চট করে ধরতে পারে না। যেমন এই মুহূর্তে ও মেনকাদির কথার মানে বুঝতে পারছে না। ওর বাড়িতে বিপদ হলে মেনকাদিরা কী করে জানবেন! নাকি বিপদটিপদ কিছু নয়, শুধুশুধু মেনাদিরা ওকে ডেকে আনল! কিন্তু কেন?

মেনকাদি গেট বন্ধ করতে করতে অনিমেষ দেখে নিল গেটের বাইরে বিরাম কম শব্দটার আগে আজ অ অক্ষরটা লেখা নেই! মেনকাদি ওর চোখ দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল, হেসে বলল, আজ বাবার নামটা ঠিক আছে, না! আচ্ছা, যারা দেওয়ালে এসব লেখে তারা কী আনন্দ পায় বলো তো?

অনিমেষ বলল, জানি না, আমি কখনো লিখিনি।

মেনকাদি বলল, জানি না, আমি কি তা-ই বলছি। তারপর অনিমেষকে নিয়ে বারান্দার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আচ্ছা, আমাদের বাড়িতে তো তুমি সেদিন এলে, কাকে তোমার সবচেয়ে ভালো লাগল? বাবা, মা, আমি, উর্বশী আর রম্ভা-চটপট ভেবে নাও, কাকে খুব ভালো লেগেছে তোমার?

এরকম বোকা-বোকা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল। অনিমেষ হাসল, সবাইকে।

মিথ্যে কথা! একদম মিথ্যে কথা! রম্ভা আমাকে বলেছে। হাসতে হাসতে মেনকাদি বারান্দায় উঠে পড়লেন। রম্ভা আবার কী বলল মেনকাদিকে রম্ভার সঙ্গে তো ওর তেমন কোনো কথা হয়নি। কিন্তু এ-ব্যাপারে মেনকাদি ইতি টেনে দিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, এই নিন, আপনার ভাইপোকে এনে দিলাম।

অনিমেষ দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল ঘরে বেশ একটা মিটিংতো ব্যাপার চলেছে। বিরাম কর তেমনি গিলে–করা দুধ-রঙা পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন, তাঁর একপাশে নিশীথবাবু একটা লম্বা কাগজে কীসব লিখছেন! উলটোদিকে ছোটকাকা গম্ভীরমুখে বসে সিগারেট খাচ্ছে। ছোটকাকার পাশে মুভিং ক্যাসেল বসে। অভিং ক্যাসেলের দিকে নজর যেতেই অনিমেষ চোখ সরিয়ে নিল। অসাবধানে আঁচল সরে যাওয়ায় মুভিং ক্যাসেলের বড়-গলার জামার উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না, কেমন অস্বস্তি হয়।

প্রিয়তোষ বলল, আয়! আজ আর স্কুল করতে হবে না। তোর মাস্টারমশাই অনুমতি দিয়েছেন।

অনিমেষ নিশীথবাবুকে আর-একবার দেখল। এর আগে অসুখবিসুখ ছাড়া নিশীথবাবু কোনদিন স্কুল-কামাই করেননি। নিশীথবাবু বললেন, ফার্স্ট পিরিয়ড কেউ নিল? ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

প্রিয়তোষ বলল, মোটামুটি একইভাবে কাজ হলে কিছু আটকাবে না। নিশীথবাবু, আপনি তা হলে জেলার সবকটা স্কুলের প্রথম চারজন ছেলের একটা লিস্ট করে ফেলুন। ক্লাস এইট আর নাইন। টেন দরকার নেই, ওদের ইনফ্লুয়েন্স করার সময় পাবেন না। এইট নাইনের মেরিটোরিয়াস ছাত্রদের জন্য স্কলারশিপ দিলে কাজ হবে। কটা বাজল?

বিরাম কর সরু গলায় বললেন, দেরি আছে। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করেছি?

মুভিং ক্যাসেল বললেন, তা হোক, গরিবের বাড়িতে একটু খেয়ে যেতে হবে ভাই।

প্রিয়তোষ বলল, কী দরকার। দুপুরের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে যাব।

মুভিং ক্যাসেল ছেলেমানুষের মতো মুখভঙ্গি করলেন, আহা! না খেয়ে গেলে আমার মেয়েদের বিয়ে হবে না, সেটা খেয়াল আছে।

যেন বাদ্য হয়েই মেনে নিল ছোটকাকা, মাথা নাড়ানো দেকে অনিমেষের তা-ই মনে হল। নিশীখবাবু বললেন, আমরা কি সবাই এয়ারপোর্ট যাব?

মাথা নাড়ল ছোটকাকা, না না, আপনারা পরিচিত লোক, ওদের দৃষ্টি এড়াতে পারবেন না। বেশি লোক যাবার দরকার নেই। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, অনি, তুই এক কাজ কর, বাড়িতে গিয়ে আমার ব্যাগটা চট করে নিয়ে আয়। দিদিকে বলবি না এখানে আমি আছি, বলবি জরুরি দরকারে এখনই চলে যেতে হল। পরে চিঠি দেব। আর কেউ যদি তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় আছি না-আছি তুই কোনো উত্তর দিবি না। যা।

অনিমেষকে অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল। ছোটকাকা এখন বাড়ি ফিরবে না। তার মানে যাবার আগে দাদু-পিসিমার সঙ্গে দেখা করবে না। এখানে এইভাবে ছোটকাকা বসে আছে কেন? বললেন, এখানে খেয়েদের বাড়ি গেলে ওঁর প্লেন ধরতে দেরি হয়ে যাবে বলে তোমাকে ব্যাগটা এনে দিতে বলেছেন।

মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল অনিমেষ। বারান্দা থেকে নামতেই পেছনে ছোটকাকার গলা পেল, অনি!

অনিমেষ ঘুরে তাকাল। ছোটকাকা কাছে এসে বলল, রাজনীতিতে অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়, তুই আর-একটু বড় হলে ব্যাপারটটা বুঝতে পারবি। যদি দেখিস বাড়ির সামনে লোকজন আছে, পেছন-দরজা দিয়ে লুকিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আসবি। তুই তো কংগ্রেসকে ভালবাসিস। আজ তুই যা করছিস তা কংগ্রেসের জন্যে। কেউ যেন না জানতে পারে আমি এখানে আছি। যা।

আচ্ছন্নের মতো সমস্তটা পথ অনিমেষ হেঁটে এল। ছোটকাকা কি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসি হয়ে গেল। দ্যুৎ তা কী করে হবে! কাল রাত্রেই তো তেজেনদাকে বলল অ্যান্টিকংগ্রেস মুভমেন্ট করতে, টাকার চিন্তা নেই। অথচ আজ যেভাবে বিরামবাবুদের সঙ্গে বসে মিটিং করছে তাতে তো কালকের রাত্রের ঘটনাটা বিশ্বাস করাই যায় না। বাড়ির সামনে এসে ও দেখল পাঁচ-ছয়জন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বেশির ভাগই পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একজনের দাড়ি আছে। সরু গলি দিয়ে যেতে গেলে ওদের পাশ কাটাতে হবেই। একজনরেই অনিমেষ বুঝতে পারল এরা এপাড়ার ছেলে নয়। চুপচাপ গলি জুড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কাছাকাছি হতেই ওরা অনিমেষকে ঘিরে ধরল, কোথায় যাচ্ছ?

অনিমেষ দেখল দাড়িওয়ালা লোকটা ওর সঙ্গে কথা বলছে। প্রথমে একটু নার্ভাস-নার্ভাস লাগছিল ওর, কিন্তু চট করে ভেবে নিল নিজের দুর্বলতার প্রকাশ করলে বোকামি হবে। আর দেশের কাজ করতে গেলে এর চেয়ে বড় বিপদে পড়তে হয়। ও গম্ভীরমুখে বলল, কেন? বাড়িতে যাচ্ছি!

ওদের মধ্যে কে যেন বলল, হ্যাঁ, এই বাড়িতেই থাকে?

প্রিয়তোষবাবু তোর কে হন? দাড়িওয়ালা জিজ্ঞাসা করল।

কাকা।

এখন বাড়ি যাচ্ছ যে, স্কুল নেই।

এই প্রশ্নটার সামনে পড়তেই একটু হকচকিয়ে গেল অনিমেষ। সত্যি তো, এখন ওর স্কুলে থাকার কথা। কী উত্তর দেওয়া যায় বুঝতে না পেরে ও খিঁচিয়ে উঠল, তাতে আপনার কী দরকার? আর বলমাত্র ওর নাভির কাছটা চিনচিন করে গেল।

দরকার আছে বলেই বলেছি।

দাড়িওয়ালার গলার স্বরে এমন একটা গম্ভীর ব্যাপার ছিল যে অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে এবার সত্যি সত্যি একটা কারণ খুঁজতে গিয়ে ব্যাথাটাকে সম্বল করল, আমি ল্যট্টিনে যাচ্ছি।

দাড়িওয়ালা যেন এরকম উত্তর আশা করেনি, চোখ কুঁচকে বলল, সত্যি?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

তোমার কাকা কোথায় গেছে জান?

কেন?

বড় প্রশ্ন করে তো! শোনো, তোমার কাকাকে আমাদের দরকার। প্রিয়তোষবাবুর বাবা বললেন যে বাড়িতে নেই, কোথায় গেছে জানেন না। তুমি জান।

এমন সরাসরি মিথ্যে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। যতই শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের গল্প পড়া থাক এই মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল এরা একদম খারাপ লোক নয়। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে দাড়িওয়ালা আরও কাছে এগিয়ে এল, শোনো ভাই, তুমি জলপাইগুড়ির ছেলে, আমাদেরই মতন, তুমি নিশ্চয়ই জান না তোমার ছোটকাকা এতদিন পর এখানে এসে কী বিষ ছড়াচ্ছে। তাকে আমরা মারব না, কিছু বলব না, শুধু চাইব এই মুহূর্তে সে যেন জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে যায়। দালালরা এসে আমাদের সর্বনাশ করুক তা আমরা চাই না। তুমি চাও?

আস্তে-আস্তে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। কিন্তু ওর মনে হল টের চিনচিনে ব্যথাটা ক্রমশ পাক খেতে শুরু করেছে। ছোটকাকা বলল, দেশের কাজ করতে। এরা নিশ্চয়ই কংগ্রেসি নয়। যা-ই হোক, এরা যদি ছোটকাকার চলে-যাওয়া যায় তো ছোটকাকা তো একটু বাদেই চলে যাচ্ছে। ছোটকাকার যাওয়াটা যদি কাম্য হয় তা হলে তার ঠিকানা না বললেও তো এদের কাজ হচ্ছে।

অনিমেষ বলল, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।

খুব হতাশ হল দাড়িওয়ালা। একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, বাড়িতে গিয়ে যদি জানতে পার কিছু আমাদের বলবে, বলবে তো?

অনিমেষ সত্যি আর দাঁড়াতে পারছিল না। ওর কপালে ঘাম, আর দুটো হাঁটু হঠাৎ দুর্বল হয়ে শিরশির করছিল। পেটের মধ্যে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে ও আড়ষ্ট পা জোরে জোরে ফেলে বাড়িতে চলে এল। বাইরের দরজা বন্ধ। কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে এখন। সমস্ত শরীর দিয়ে প্রচণ্ড জোরে অনিমেষ দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল। ভেতর থেকে সরিৎশেখরকে কে বলে চিৎকার করতে করতে এসে দরজা খুলতেই অনিমেষ তীরের মতো তার পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল। আচমকা ছেলেটাকে ছুটে যেতে দেখে হকচকিয়ে গেলেন সরিৎশেখর, মেয়ে নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলেন, হেম, ও হেম, দ্যাখো অনিকে বোধহয় ওরা মেরেছে। ছেলেটা ছুটে গেল কেন, ও হেম!

মহীতোষ অনেকদিন আগে স্বৰ্গছেঁড়া থেকে ভালো কালামোনিয়া চাল এনে দিয়েছিলেন। হেমলতা রান্নাঘরে বসে কুলোয় করে সেই চাল বাছছিলেন। প্রিয়তোষের জন্য আজ স্পেশাল ভাত। বাবার ডাকে তিনি হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিলেন, কে মেরেছে, কে ছুটে গেল, ও বাবা, কার কথা বলছেন, ও বাবা!

সরিৎশেখর ভেতরে এসে তেমনি গলায় বললেন, অনি ছুটে গেল, কোথায় গেল দ্যাখো, আঃ, আমি আর পারি না!

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা রান্নাঘরের বাইরে এসে চিৎকার করে অনিকে ডাকতে লাগলেন, ও অনি, অনিবাবা, তোকে মারল কে? এ-ঘর সে-ঘর উঠোন বাথরুম কোথাও না পেয়ে হেমলতা থমকে দাঁড়ালেন, ও বাবা, আপনি ঠিক দেখেছেন তো, অনি না অন্য কেউ!

সরিৎশেখর বিরক্ত হয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন, আঃ, আমি অনিকে চিনি না?

কী জানি, ও হলে তো বাড়িতেই থাকত। মা-মরা ছেলেটাকে মারবেই-বা কেন? না, আপনাকে ঠিক বাহাতুরে ধরেছে, কী দেখতে কী দেখেছেন।

পেছনে দাঁড়ানো বাবার দিকে চেয়ে হেমলতা এই প্রথম দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা যা তিনি কিছুদিন হল মনেমনে বিশ্বাস করছিলেন অর্কপটে ঘোষণা করলেন। সরিৎশেখর নিজের কানকে হেমলতার অভিযোগটা সত্যি হয়ে যাবে তিনি ভেবে রাখলেন যে মেয়েকে এই ব্যাপারে পরে আচ্ছা করে কথা। শোনাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে ছেলেটাকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

পৃথিবীতে এর চেয়ে মূল্যবান আনন্দ আর কী থাকতে পারে? সমস্ত শরীরে অদ্ভুত তৃপ্তি, জমেথাকা ঘামগুলোয় বাতাস লেগে একটা শীতল আমেজ-অনিমেষ উঠোনের আর-এক প্রান্তের পুরনো পায়খানার দরজা খুলে বাইরে এল। প্যান্টের বোম আঁটতে আঁটতে ওর নজরে পড়ল, দুটো মুখ অপার বিস্ময় মুখচোখে এঁটে তার দিকে চেয়ে আছে। ওর চট করে মনে পড়ল যে, পায়খানায় ঢোকার সময় আজ একদম সময় ছিল না স্কুলের জামাকাপড় ছেড়ে যাবার। আক্রমণটা বোধহয় এদিক দিয়েই আসবে। অবশ্য নির্ভয় হতে-হতে ও দাদু পিসিমার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু সূত্রটা ধরতে পারছিল না।

হেমলতা প্রথম কথা বললেন, তুই! পায়খানায় গিয়েছিলি?

খুব দ্রুত ঘাড় নাড়র অনিমেষ হুঁ।

পেছন থেকে সরিৎশেখর হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, হবে না! দিনরাত গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াচ্ছ, পেটের আর দোষ কী? হ্যাঁ, আমায় বাহাত্তরে ধরেছে, না? চোখে কম দেকি! দ্যাখো হেম, তোমার দিনদিন জিভ বেড়ে যাচ্ছে, যা নয় তা-ই বলছ। হবে না কেন, যেমন ভাই তেমনই তো বোন হবে!

একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন হেমলতা, সত্যি সত্যি অনি এসেছে, বাবা ভুল দেখেননি। কিন্তু শেষ কথাটায় ওঁর গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল, কী বললেন, যেমন ভাই নে বোন, না? তা আমরা কার ছেলেমেয়ে? আমি যদি না থাকতাম তবে এই শেষ বয়সে আপনাকে আর ভাত মুখে দিতে হত না!

কী বললে! তুমি খাওয়া নিয়ে খোটা দিলে? সরিৎশেখর চিৎকার করে উঠলেন।

আপনি কি কম দিচ্ছেন! আপনার কফ ফেলা থেকে শুরু করে কী না আমি করেছি! বিনা পয়সার চাকরানি। আর-কেউ এক বেলার বেশি আপনার সেবা করতে ঘেঁষত না। থাকত যদি সে-চট করে পালটে গেল হেমলতার গলার স্বর, আমার পোড়া কপাল যে!

এবার সরিৎশেখর চাপা গলায় বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

অনিমেষ দাদু-পিসিমার এই রাগারাগি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। হঠাৎ দেখল পিসিমা তার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছেন, কপালের আর দোষ কী! বাড়িসুদ্ধ সবাই উচ্ছন্নে গেলেও এই ছেলেটা আমার কথা শুনত। মাধুরী চলে যাবার পর বুকের আড়াল দিয়ে রাখলাম, সে এমন হেমস্তা করল আমাকে!

সরিৎশেখর অবাক হয়ে বললেন, কী করল ও!

অনিমেষ এতক্ষণ আক্রমণটাকে এভাবে আসতে দেকে দৌড়ে বাথরুমে যেতে-যেতে শুনল পিসিমা বলছেন, বাইরের জামাকাপড় পরে পায়খানায় ঢুকছে, সাহস দেখছেন!

জামাকাপড় পালটে অনিমেষ বাইরে এসে দেখল সরিৎশেকর চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ওকে দেখে আঙুল তুলে কাছে ডাকলেন। দাদুর এরকম ভঙ্গি এর আগে দেখেনি ও কাছে গিয়ে দাঁড়াতে সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি চলে গেছেন?

কার কথা জিজ্ঞাসা করছেন বুঝতে অসুবিধে হল না অনিমেষের, সে নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।

কোথায় আছে জান? সরিৎশেখর চাপা গলায় প্রশ্ন করছিলেন।

হুঁ! দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলা যায় না।

কোথায়?

বিরাম করে বাড়িতে। অনিমেষ এমন গলায় কথা বলল যেন তৃতীয় ব্যক্তি শুনতে না পায়।

বিরাম কর! কংগ্রেসের বিরাম কর তোমাদের স্কুলের সামনে যার বাড়ি?

হ্যাঁ।

ওখানে সে কী করছে। সেই মুটকি মেয়েছেলেটার খপ্পরে পড়েছে নিশ্চয়ই। যাক, আমার কী! কিন্তু ওর সঙ্গে আলাপ হল কবে? নিজের মনেই সরিৎশেখর কথাগুলো বলছিলেন।

মুটকি মেয়েছেলেটা! সামলাতে সময় লাগল অনিমেষের। দাদুর মুখে এ-ধরনের কথা এর আগে শোনেনি ও। আর খপ্পরে বললেন কেন, উনি কি রাক্ষুসী না ছেলেধরা যে তার খপ্পরে পড়েছে বলতে হবে! অনিমেষ নির্লিপ্ত হয়ে বলতে চেষ্টা করল, কাল এয়ারপোর্টে আলাপ হয়েছিল। ওঁরা কংগ্রেসের নেতা।

কংগ্রেস! ওদের তুমি কংগ্রেসি বলছ চোরের আবার ভালো নাম! কংগ্রেসের নাম করে এখানে বসে রক্ত চুষে খাচ্ছে! কংগ্রেস যারা করতেন তারা স্বাধীনতার আগেই মারা গিয়েছেন। শেষ মানুষ ওই গান্ধীবুড়ো। এসব চোখে দেখতে হবে বলে ঈশ্বর সাততাড়াতাড়ি সরিয়ে নিলেন। তোমার কাকা কার দালাল? সরিৎশেখর ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন।

দালাল।

হ্যাঁ, বাইরে দাঁড়ানো ছেলেগুলোকে দেখনি? ওরা বলল তোমার কাকার ঠিকানা চায়। সে নাকি দালাল। টাকা দিয়ে সব কিনতে চায়। আমাকে তো মাত্র হাজার টাকা দিল, দিয়ে কিনে নিল। কার দালাল ও?

জানি না!

করত কমিউনিজম, এখন দেখছি কংগ্রেসিদের বাড়িতে আড্ডা মারছে। আর বেছে বেছে তার বাড়িতে যার বউ-মেয়ের নাম শহরের দেওয়ালে-দেওয়ালে লেখা আছে। শাবাশ।

হঠাৎ হেমলতার গলা পাওয়া গেল। তিনি যে কখন রান্নাঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন টের পায়নি আঁনি। হেমলতা বললেন, প্রিয়তোষ যা-ই করুক সে বুঝবে, এই বাপে-তাড়ানো মায়েবেদানো ছেলেগুলোর তাতে মাথা ঘামানোর কী দরকার?

সরিৎশখর সোজা হয়ে বসলেন, আছ তো রাতদিন রান্নাঘরে বসে, কিছু টের পাও না। পিলপিল করে পাকিস্তানের লোক এসে জুটছে এদেশে, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়েছে খবর রাখ। কিন্তু কংগ্রেস সরকারের সেদিকে খেয়াল আছে। মানুষ কী খাবে তাদের সেসব ভাববার সময় কোথায়? এই ছেলেগুলো অন্তত দিনরাত চাঁচাচ্ছে দ্রব্যমূল্য কমাও, এটা চাই সেটা চাই বলে। পরজন্মে বিশ্বাস কর? আমার মনে হয় এইসব কমিউনিস্ট হয়ে গেছে।

হেমলতা বললেন, কী যে আবোলতাবোল কথা বলেন! জিজ্ঞাসা করলাম প্রিয়তোষের কথা, আপনি সাতকাহন শুনিয়ে দিলেন।

সরিৎশেখর আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, তোমার ভাই হল দুমুখো সাপ। এর কথা তাকে বলে, ওর কথা একে। জনসাধারণের উপকার হোক এ-ই নেই। কম চাকরি করে সে যে অত টাকা পায়। বিদ্যে তো জানা আছে। নিশ্চয়ই কেউ দিচ্ছে কোনো অপকর্ম করার জন্য। তা এই ছেলেগুলো ওকে দালাল বলে ছিঁড়ে খাবে না?

এতক্ষণে একটু ফুরসত পেল অনিমেষ, ছোটকাকা আমাকে ব্যাগটা নিয়ে যেতে বলেছে, আজকের প্লেনেই চলে যাবে!

ফ্যাসফ্যাসে গলায় হেমলতা জিজআসা করলেন, এখানে খাবে না?

না। মিসেস কর খেতে বলেছেন। অনিমেষ টের পেল কাকাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ওর বেশ আনন্দ হচ্ছে।

সে কী। আমি যে এত রান্না করলাম! পিসিমার আর্তনাদ অনিমেষকে নাড়া দিল।

সরিৎশেখর গম্ভীর গলায় বললেন, হেম, পাখি যখন ডানায় জোর পায় তখন তার মা-বাপ আর একফোঁটা চিন্তা করে না। বিরাম করে বাড়িতে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে, তোমার ভাই সেসব ছেড়ে দিদির রান্না খেতে আসবে কেন? বরং চৌকিদারের ছেলেমেয়েকে ডেকে দিয়ে দাও, ওরা খেয়ে সুখ পাবে।

হেমলতা কেঁদে ফেললেন। অনিমেষ আর দাঁড়াল না। একদৌড়ে ঘরে গিয়ে ছোটকাকার ব্যাগটা আলমারির ওপর থেকে নামিয়ে আনল। টেবিলে টুকিটাকি জিনিস ছড়ানো ছিল, সেগুলোজড়ো করো ব্যাগে রাখতে ওটাকে খুলতে হল। একটা সুন্দর গন্ধ ভক করে নাকে লাগল। ব্যাগটার মুখে চাবি নেই। ওর হঠাৎ মনে হল একবার দেখে সেই রিভলভারটা ব্যাগের মধ্যে আছে কি না। না নেই। অনিমেষ পেল না সেটা। তার মানে ছোটকাকা রিভালভার পকেটে নিয়ে বসে আছে বিরাম করের বাড়িতে। গাটা শিরশির করে উঠল অনিমেষের।

ব্যাগ নিয়ে বাইরে এল সে। চড়চড়ে রোদ উঠেছে। ও দেখল, দাদু-পিসিমা উঠোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। ও একবার সদরদরজার দিকে তাকাল। এখান দিয়ে গেলে ছেলেগুলো নিয়েই তাকে ধরবে। এপাশের মাঠ পেরিয়ে গেলে নিশ্চয়ই কোনো বাধা পাবে না। ও চলতে শুরু করতেই সরিৎশেখর বললেন, শোনো, প্রিয়তোষকে বলে দিও, আমার কোনো উপকার করতে হবে না, আর এ-বাড়িতে যেন সে কখনো না আসে, বুঝলে?।

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বলে উঠলেন, আপনি ওর টাকা ফেরত দিয়ে দিন বাবা। ও টাকা ছোবেন। কাল থেকে ভাড়াটে এসে যাচ্ছে, এ-মাসটা আমার বালা বিক্রি করে চালান।

প্রথমে যেন একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন সরিৎশেখর, তার মাথা নেড়ে বলরেন, কেন নেব না টাকা আমার এক-একটা ছেলের পেছনে আমি কত খরচ করেছি সে-খেয়াল আছে আমি সব হিসেব করে রেখেছি। সেগুলো আগে শোধ করুক তারপর অন্য কথা।

হেমলতা বললেন, আপনাকে আমি বুঝতে পারি না না বাবা। ওর টাকা ছুঁতে আমার ঘেন্না হচ্ছে।

হাসলেন সরিৎশেখর, তাহলে বোঝে, ওই ছেলেগুলো কেন এত রেগে গেছে।

হঠাৎ কী হল অনিমেষের, ও পেছনের মাঠের দিকে না গিয়ে সদরদরজার দিকে হাঁটতে লাগল। সরিৎশেখর সেটা লক্ষ করে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। অনিমেষ যখন দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন চেঁচিয়ে বললেন, অনিমেষ, বিনা কারণে এইভাবে তোমার স্কুল-কামাই করা-আমি একদম পছন্দ করছি না।

মাথা নিচু করে ব্যাগটা নিয়ে হাঁটছিল অনিমেষ। ও নিজে থেকে স্কুল-কামাই করেনি, দাদু কি জানেন না? দাদু যেন কেমন হয়ে গেছেন! বিরামবাবুর মেয়েদের নিয়ে ছোটকাকার সঙ্গে ইঙ্গিত করে কীসব বললেন! যাঃ, হতেই পারে না! হঠাৎ ওর উর্বশীর কথা মনে পড়ল। উর্বশী আজ স্কুলে গেছে। মেনকাদির সঙ্গে তো নিশীথবাবুর ভ, দাদু এসব কথা জানে না। না জেনে কথা বলা ওদের বাড়ির স্বভাব।

কিন্তু দাদু ছোটকাকুকে এ-বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছেন। জ্যাঠামশাই-এর তা ত্যজ্যপুত্র করলেন না অবশ্য, কিন্তু আসতে না-বলা মানে সম্পর্ক ছিন্ন করা। ওর মনে হল, একটু একটু করে দাদু কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছেন ইচ্ছে করে। কেন?

ছোটকাকার ওপর ওর কাল সন্ধে থেকে জমা রাগটা অস্তে-আস্তে বে; যাচ্ছিল। তপুপিসি, তেজেনদা-সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে ওর মনের মধ্যে একটা আক্রোশ তৈ হয়ে গেল। ও টিক করল দাড়িওয়ালা ছেলেটাকে গিয়ে সব কথা বলে দেবে, ব্যাগটা দেখাবে। : হোক ছোটকাকার, ওর কিছু এসে যায় না। দোষী মানুষের শাস্তি হওয়া দরকার। ছোটকাকা তো কংগ্রেসি নয়। কাল রাত্রে অ্যান্টিকংগ্রেস মুভমেন্টের কথা বলেছে। অতএব ছোটকাকাকে ধরিয়ে দিলে কোনো অন্যায় হবে না।

বড় বড় পা ফেলে ও সরু গলিটায় চলে এলে। ক্রমশ ওর গতি কমে গেল এবং অবাক হয়ে চারধারে চেয়ে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। গলিটা একদম ফাঁকা। যেখানে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে একটা গোরু নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। খুব হতাশ হয়ে পড়ল অনিমেষ। ওরা গেল কোথায়? একটু একটু করে গলিটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও ভীষণভাবে আশা করছিল ছেলেগুলোর দেখা পাবে। অথচ এই দুপুরবেলায় গলি এবং বড় রাস্তা ঠাসা রোদ্দুরে মেখে চুপচাপ পড়ে আছে। ওরা কি খোঁজ পাবে না বলে চলে গেল।

ব্যাগটা ওজন যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। কোনো উপায় নেই, অনিমেষ সেটাকে টেনে টেনে বিরাম করের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *