আয়ের বহরটা বোঝা যায় না। কিন্তু খরচের বহরটা বোঝ যায় খাজাঞ্চিখানায় গেলে।
বিধু সরকার মধ্যেখানে উবু হয়ে বসে, আর দু পাশে আরো চার পাঁচজন ঢালু বাক্সর ওপর খেরো খাতায় লেখাপড়া করছে।
বিধু সরকার কানে কলমটা গুজে হাত বাড়ায়—পাট্টা-বইটা দেখি কেশব।
মোটা খেরো খাতাটা এগিয়ে দিয়ে আবার লিখতে বসে কেশব।
ভূতনাথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। খেরো খাতার ওপর মোটা মোটা হরফে লেখা—ফিরিস্তি কাগজ পাট্টা-নকল বহি, শ্ৰীযুৎ মিস্টার উইলিয়ম ফ্র্যাঙ্কল্যাণ্ড সাহেব, সন…
বিধু সরকার চিৎকার করে কেশবকে বলে—আমি বলি তুমি লেখো-আরকুলী সিমলা মছলন্দপুর গ্রামে পুষ্করিণী খনন জন্য শোভারাম বসাককে ৩০ বিঘা জমি লাখেরাজ স্বরূপে জমা দেওয়া হইল। বামাপদ সেন পোদ্দারের পৌত্র ক্ষমাপদ সেন, তাহার মছলন্দপুরের বাস্তুভিটা ভুক্ত ১৮ কাঠা জমি তারাপদ মুন্সীকে আঠারো শত সিক্কা-টাকায় বিক্রয়.. হঠাৎ মাথা তুলে সামনে ভূতনাথকে দেখে বলে—তোমার কী?
ভূতনাথ হাতের কাগজখানা এগিয়ে দিয়ে বলে—আমি ব্ৰজরাখালবাবুর সম্বন্ধী, তার এ মাসের মাইনেটা আমার হাতে…
—রোসো–বলে বিধুসরকার সমস্তটা পড়ে বলে—এ সই কার?
—আজ্ঞে ব্ৰজরাখালের।
-–ও ব্রজরাখাল শুধু বললে তো চলবে না, ব্ৰজরাখাল কী, দাস রুইদাস, বামুন না কায়েত, কার পুত্র, নিবাস কোথায়-আর তুমি কে, শুধু ভূতনাথ চক্রবর্তী বললে তো আমি শুনবো না, কার পুত্র, নিবাস কোথায়, এসব পোসাপিস নয় হে ছোকরা, জমিদারী সেরেস্তার কাজ অমন সোজা নয়, সই মিললেই ছেড়ে দিলাম, সে সরকারী আপিসে পাবে, এখেনে চলবে না..তুমি লিখে দিলে কেলার পাতে আর আমি অমনি টাকা দিয়ে দিলাম, তেমন কাজ করলে বিধু সরকার আর বাবুদের জমিদারী রাখতে পারতো না—তা তিনি আসতে পারলেন না কেন শুনি?
—আজ্ঞে তিনি গিয়েছেন বরানগরে?
—ওসব আমি দিতে পারবে না, তা সে যাই বলুক আর তাই বলুক। হাতকড়ি পড়বার কাজ আমি করিনে…এবার তোর কী?
ভূতনাথ একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার তার পাশের লোকের ডাক পড়লো।
হিন্দুস্থানী। সামনে এগিয়ে বললে—হুজুর আমার সেই টাকাটা–
–কিসের টাকা বল না বেটা, তুই কি আমার বাপের সম্বন্ধী যে তোকে চিনে বসে আছি, লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার এখানে, হাজার হাজার প্রেজার নাম আর বংশ পরিচয় অমনি মুখস্ত রাখতে পারে মানুষে?
–আজ্ঞে, বরফের পাওনা, চার মাসের একেবারে জমে গেল।
-বোস, দৈনিক জমা খরচের খাতাটা দেখি কেশব।
বিচিত্র লোক এই বিধু সরকার। ভূতনাথের মনে পড়ে—প্রথম দিন ভারি রাগ হয়েছিল তার। যেন লাট না বেলাট!
বিধু সরকার বলে—মেজবাবু বললে কী হবে, মুখের কথায় খাজাঞ্চীখানা চলে না হে, এখানে লেখা-পড়ি সই-সাবুদের কারবার। মেজবাবুর হাতের লেখা দেখ, আমি টাকা ফেলে দেবো। আমার কী, আমি তো হুকুমের চাকর-জমা-খরচের খাতায় সব লিখে রাখবে। সিকিপয়সা, কড়ি, দামড়ি, ছেদামাটি পর্যন্ত হিসেবে ভুল হবে না। এ তোর কারবারের পয়সা নয়, এ হলো জমিদারী, এর হিসেব রাখা যার তার কম্ম নয়। তারপর থেমে আবার বলে—গোমস্তা যদি লেখে সুখচরের কালেক্টরীর কাছারিতে উমাচরণ মুহুরীকে পান খাওন বাবদ ১৫ দেওয়া হইল, আমার খাতায় অমনি খরচ পড়ে যাবে ৩১৫ উমাচরণ মুহুরীর পান খাওন বাবদ কাউকে বলে—এ পোস্টাপিসের সরকারী কাজ নয় হে যে, পাঁচটা বাজলে আর দরজায় তালা পড়লো। অত তাড়াহুড়ো করলে চলে না এখানে, ছোটকাল থেকে এ-কাজ করছি, এ তো আমার জাত-পেশাই বলা চলে, এখনো এ-কাজের হদিস পেলাম না। রোজই নতুন, রোজই নতুন একটি পয়সা এদিক-ওদিক হলে নায়েব-গোমস্তার গলা টিপে ধরবো না। বাবুদের ধম্মের পয়সা, বিধু সরকার আর সব পারে দাদা অধৰ্ম্ম সইতে পারে না। তারপর হঠাৎ ভূতনাথের দিকে নজর পড়ায় বললে—তুমি দাঁড়িয়ে কেন ছোকরা? আমি তো বলেছি তোমায়, কাজের সময় বিরক্ত করো না আমায়—আমি কম কথার মানুষ… লেখো কেশব, সেখ আসানুল্লার পুত্র সেখ জয়নুদ্দীনকে মৌরুসীমোকরীর..এখন বিরক্ত করে না যাও দিকি সব—বলে বিধু সরকার আবার নিজের কাজে মন দেয়।
ভূতনাথ চলে এল।
ব্ৰজরাখাল এসে সব শুনে বললে—তা ভালোই তো করেছে। নগদ-টাকাকড়ির কারবার, একটু দেখে শুনে হিসেব করে দেওয়াই তো নিয়ম। বিধু সরকার খুব হুঁশিয়ার লোক কি না—তা ছাড়া তোমায় চেনে না। একটু মুখচেনা হয়ে যাক—তখন আবার…