০৮. আমার প্রেমিকেরা

প্রেম শব্দটি আমার শৈশব কৈশোরে নিষিদ্ধ একটি শব্দ ছিল। সবে প্রেম করার বয়সে পড়লাম, কিশোর যুবকরা আমার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়, আমারও ইচ্ছে করে ওদের দেখতে, তখন প্রেম নিষিদ্ধ। আর যা কিছুই করি, প্রেম যেন না করি। অথচ সিনেমা দেখছি, প্রেম। থিয়েটার দেখছি, প্রেম। গল্প উপন্যাস পড়ছি, প্রেম। গান শুনছি, প্রেম। সবখানে প্রেম কিন্তু জীবনে প্রেম চলবে না। যে যত প্রেমহীন জীবন কাটাবে, সে তত ভালো। এভাবে এই পরিবেশে বড় হয়েছি আমি। নিষিদ্ধ জিনিস বলেই বোধহয় আগ্রহ জাগতো প্রেমে। প্রেম করছি বলে বাবার মার খেতে হত অনেক। বাবা চাবুক দিয়ে পেটাতেন, ঘরবন্দি করতেন, ভাত বন্ধ করতেন, দিনরাত ‘ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ’ বলা বাবা এমনকী আমার ইস্কুল কলেজও বন্ধ করে দিতেন।

কিশোরবয়সে দুএকটি ছেলেকে আমার বেশ লাগতো। দূর থেকে একটু দেখা, আর মাঝে মাঝে ভালোবাসি-চিরকুট জীবন ভরিয়ে রাখতো। প্রেম কী করে করতে হয় শিখেছি ছোটদার কাছ থেকে। ছোটদা আমার চেয়ে আট বছরের বড়। পাড়ার এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতো। সেই মেয়েকে লেখা ছোটদার প্রেমের চিঠিগুলো আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। ছোটদা বাড়ির বাইরে বেরোলেই তার টিনের ট্রাঙ্ক খুলে চিঠি বার করতাম। টিনের ট্রাজ্ঞে পুরোনো খবরের কাগজ পেতে ছোটদা তার নানান জিনিস রাখতো, চিঠিগুলো থাকতো সেই পুরোনো খবরের কাগজের তলায়। প্রতিদিনের চিঠি ওখানে জমা হয়ে থাকতো, ছোটদা সুযোগ সুবিধে পেলে মেয়ের জানালায় গিয়ে কেউ যেন না দেখে চিঠি চালান করতো। প্রেম পরে ছোটদা আরেকজনের সঙ্গে করেছে, ওকেও ওরকম চিঠি লিখতো। কত যে সে ভালোবাসে ডলি পালকে বা গীতা মিত্রকে, তার অসাধারণ বর্ণনা থাকতো চিঠিতে। ওসব চিঠি পড়েই প্রেম কী জিনিস, বুকের কাঁপন কী জিনিস, নির্ঘুম রাত কী জিনিস আমি জেনেছি। ওই সময়েই বড়দার তোশকের তলায় রাখা বড়দের পত্রিকা ‘কামনা’ পড়ে যৌনতায় আমার হাতে খড়ি।

ওই কিশোরবয়সেই আমার লেখালেখি শুরু হয়ে যায় পত্রিকায়। শিল্প সাহিত্য সিনেমা সবকিছুর মিশেল পত্রিকাগুলো খুব জনপ্রিয় ছিল তখন। তখন পত্রমিতালির রমরমা অবস্থা। আমি যেই না কিছু লিখি পত্রিকায়, অমনি পত্রমিতালির আমন্ত্রণ জানিয়ে আমার ঠিকানায় দুশ চিঠি। সবই তাজা তাজা যুবকদের। অনেকে ছবি পাঠাতো। যাদের ছবি বা হাতের লেখা বা চিঠির ভাষা পছন্দ হত তাদের উত্তর লিখতাম, কেউ দুদিনেই বন্ধু হত, কেউ নিমেষে বড় ভাই হয়ে উঠত, রাজ্যির উপদেশ বর্ষণ করতো। দূরের দূরের শহরে অচেনা যুবকদের কাছে চিঠি লিখতে লিখতেই একদিন প্রেমের চিঠি লিখতে শুরু করি। এক কবির কাছে। তখন আমি নিজেই ছোট একটি কবিতা-পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক। বয়স সতেরো। কবি যেহেতু প্রেম নিবেদন করেছে, আমাকেও সে প্রেমে সাড়া দিতে হবে, ব্যাপারটি এমন। মাথায় ছোটদার প্রেমের চিঠিগুলো আর সন্ধে হলেই শিস দিয়ে পাশের বাড়ির জানালায় ভেসে ওঠা মেয়ের দিকে তার তাকানো। কবিকে আমি তখনও দেখিনি, কবির বয়স কত, বাড়ি কোথায়, কী পড়ে কী করে কিছুই জানি না, আর কথাচ্ছলে ‘জীবন’ চাইলো সে, অমনি আমিও বলে বসলাম, ‘এ আর এমন কী, নাও।’

কবির প্রেমে সাতসমুদ্র সাঁতার কাটা শেষ হলে কবির সঙ্গে দেখা হয়, প্রথম দেখা। চোখ তুলে তাকাতে পারিনি লজ্জায়। ভাববাচ্যে দুতিনটে বাক্য উচ্চারণ করে দৌড়ে বাড়ি ফিরেছি। পছন্দ হয়নি কবির দৈর্ঘ্য প্রস্থ। দাড়িগোঁফ। কিন্তু না হলেও মাথায় তো ‘প্রেম’ ব্যাপারটি, যার প্রতি তীব্র আমার আকর্ষণ। আমি তখন তন্বী সুন্দরী, আমি তখন কবিতা লিখি, মেডিক্যালের প্রথম বর্ষ। কবির কবিতা আমি ভালোবাসি। আর ভীষণভাবে ভালোবাসি প্রেম। ওই প্রেম আর কবিতার কাছে পরাজিত হয় কবির বাইরের রূপ। হলে কী হবে, লজ্জাবতী নারী তো চোখে চোখ রাখে না। পাঁচ বছর সময় লেগেছে প্রেমিককে তুমি বলে সম্বোধন করতে। শুয়েছি বিয়ে করারও কয়েক বছর পর। বিয়ে করেছি গোপনে, নোটারি পাবলিকের কাগজে। বাড়ির কেউ জানে না। বাবা জানলে খুন করবেন, এটা অনুমান করেছিলাম বলেই গোপন রেখেছিলাম বিয়ের খবর। আমি ডাক্তারি পড়ছি, আর আমার প্রেমিক এক উদাস বাউত্রুলে, পথে পথে ঘোরে আর আত্তা দিয়ে বেড়ায়। কবি আর আমি দুজন দু’শহরে। রাত জেগে জেগে কবির কাছে চিঠি লিখি। কবির চিঠি আসে প্রতিদিন, চিঠিগুলো বারবার পড়ি। চিঠি তো নয়, যেন কবিতা। হলুদ রঙের খামে সেসব চিঠি। খাম হাতে নিতেই বুকের ভেতর কী রকম যেন করতো। সেই ‘কীরকম করা’টি ঠিক কী রকম, তা আজও আমি বুঝিয়ে বলতে পারি না। চিঠিগুলো না পড়ে অনেকক্ষণ হাতে রাখতাম, চিঠি থেকে কী যেন কী উঠে এসে আমাকে শীতল করতো। জলপতনের শব্দ টের পেতাম। ঝেঁপে কোথাও বৃষ্টি নামতো! অপেক্ষার প্রহর একদিন ফুরোয়। একদিন আমি আমার স্বজন বন্ধুদের কাঁদিয়ে ভাসিয়ে কবির হাত ধরে বেরিয়ে যাই। ছোটদাও ঠিক এরকম করেছিল, গীতা মিত্রর জন্য বাড়িঘর সব ছেড়েছিল। সংসারে ছোটদা যা যা করেছে প্রেমে পড়ে, আমিও ঠিক তাই তাই। ছোটদার ওই টিনের ট্রাজ্ঞে লুকোনো চিঠিগুলোর মধ্যেই এমন তীব্র প্রেমের বীজ অত্রুরিত ছিল যে সে মহীরূহ হয়ে ছোটদাকে যেমন আঁকড়েছিল, একইরকম আমাকেও। কিন্তু আষ্টেপৃষ্টে আমাকে এমনই বেঁধেছিল ওই প্রেম যে আমি দেখতে পাইনি প্রেমিক আসলে ভালো আমাকে বাসে না, যেখানে সেখানে রমণী পেলেই রমণ করে আর ক্তমাগতই আমাকে মিথ্যে বলে। তার কাছে প্রেমিকার এবং গণিকার শরীরে কোনও পার্থক্য নেই। সে শুধু প্রথামতো একটি স্ত্রী চায়, স্ত্রীর সেবা চায়, আর রাতে রাতে বিনে পয়সার নিশ্চিত সম্ভোগ চায়। প্রেমিকের শরীরে যৌন ব্যাধি, যে ব্যাধিতে আমাকে সংক্তামিত করতে সে সামান্যও দ্বিধা করে না। না, সে প্রেমিক ছিল না, ছিল শুধুই পুরুষ। যে কোনও পুরুষ। আমিই কেবল বধির বোকা বালিকা প্রেম প্রেম বলে উন্মাদ হয়েছিলাম।

প্রেম এরপর দুপুরের ঝিরঝিরে হাওয়ার মতো জীবনে পরশ বুলিয়ে যায়। পালকের মতো সামান্য ছোঁয়া। কেউ একদিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল, কেউ একদিন হাত ধরে হাঁটলো, কেউ একদিন শুধু কানে কানে একটি গান শুনিয়ে গেল। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ সময় জুড়ে উতল যৌবন জুড়ে একা থাকা। যে একা থাকা নিজের প্রতি আমার আত্মবিশ্বাস, আমার শ্রদ্ধা সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে দৃঢ় করেছে আরও, দুর্বিনেয় করেছে। স্বনির্ভর একজন চিকিৎসক-লেখক একা বাস করছি। নারীর স্বাধীনতার জন্য আগুন আগুন লেখা লিখছি। দেশ উত্তাল। কিন্তু হৃদয়ের দুয়ার হঠাৎ হাট করে খুলে যায় কোনও ফাগুন হাওয়ায়। চোখের সামনে আশ্চর্য সুন্দর এক যুবক দেখি একদিন। যুবকের দীর্ঘাঙ্গ, যুবকের চুল চোখ নাক ঠোঁট চিবুক আমাকে টানে, ফিরে ফিরে দেখি যুবককে। একদিন তো এত অপলক তাকিয়ে ছিলাম, যে, লজ্জায় যুবক বারবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল। চোখে আমার মুগ্ধতা, আমার মুগ্ধতার একশ তীর গিয়ে তার গায়ে কি বিঁধছিল না! একদিন কমলার রসের সঙ্গে কয়েকফোঁটা ভদকা পান করে মাতাল হলাম। আর যেই না টলোমলো পা, যুবক তার হাত দিল বাড়িয়ে। সেই স্পর্শ আমাকে আরও বেশি মাতাল করলো, আমার প্রতি অঙ্গ তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদিল। সেই শুরু তীব্র তীক্ষ্ণ দুর্দমনীয় প্রেমের। সেই প্রথম কোনও বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হল আমার। না, আমার কোনও উপায় ছিল না তাকে না ভালোবেসে। সারা শহর তাকে নিয়ে ঘুরছি। রাস্তায় হাত ধরে হাঁটছি। বন্ধুদের আত্তায় আমি, সঙ্গে সে। বাড়িভর্তি স্বজন আত্মীয়, যুবককে নিয়ে আমি নিভৃত নির্জন ঘরে। হ্যাঁ, যুবকের সঙ্গে আমার প্রেম, তাকে নিয়ে আমি মগ্ন হব, মঙ্গ হব। কার কী বলার আছে! না, কারওর নেই। আমার স্বাধীনতাকে এত তীব্র করে উপভোগ আগে আর করিনি। আমার সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, আমার অধিকারবোধ, আমার মনুষ্যত্ব, মানবতা, আমার প্রাণময়তার কাছে যুবক বড় ম্লান। যুবকের সঙ্গে প্রেম এবং নিশ্চিত পৃথকবাস আমাকে প্রশান্তি দিয়েছে প্রচুর। আমার জীবন যাপনে, আমার লেখায়, রেখায়, আমার নান্দনিক যা ইচ্ছে তাই-এ প্রেমিকের অবাধ প্রবেশ নেই, তার নাককানমাথা গলিয়ে দেবার নেই। কিন্তু যখন প্রেম জাগছে, আমি তাকে চুমু খাচ্ছি, পালজ্ঞে শুইয়ে গায়ে তার প্রেমের পালক বুলোচ্ছি, স্রোতে নামিয়ে ভিজিয়ে ভাসিয়ে একাকার করছি, তুমুল তুফানে হারাচ্ছি। তাকে প্রেমিকে নির্মাণ করি আমার ত্যাগে নয়, বিসর্জনে নয়, প্রেমে। প্রেমিক আমাকে ছাড়া বাঁচবে না, এমন। জগতে তার আমি ছাড়া কেউ নেই, তখন এমন। আর সেসময়ই আমার লেখা, আমার নীতি আদর্শ, সমতার জন্য আমার লড়াইএর বিপরীতে জমা হচ্ছে লোক। শঠবাদ, পুরুষবাদ, মৌলবাদ আমার ফাঁসি চেয়ে মিছিল করছে, আমার রক্ত নিতে ধেয়ে আসছে, সেদিন একদিন প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছি আমি, রাতের চাদর মুড়ে দৌড়োচ্ছি। তখন প্রেমিককে খুঁজি, কোথায় সে? না সে নেই। নিরাপদ দূরত্বে সে তার বিবাহিত জীবন যাপন করছে। বিশ্বাস ধ্বসে পড়ে প্রবল ভূমিকম্পে ন-তলা দালানের মতো।

এরপর উত্তর ইওরোপের শীতার্ত নির্বাসন জীবন। একাকীত্বের সুঁই বিঁধছে আমার সর্বাজ্ঞে। বছরের পর বছর উড়ে যাচ্ছে উদাসী হাওয়ায়। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। খ্যাতির মধ্যে খাবি খাচ্ছি। কিন্তু হৃদয়ে খরা। শরীর শ্যাওলা পড়া। ওই শ্যাওলা পড়া শরীর এক নির্জন দুঃসহ রাতে পুরুষের স্পর্শে কাঁপলো ভীষণ। সামান্য ঘনিষ্ঠতায় আমার একত্রবাস শুরু। কিন্তু কদিনেই আমি বুঝি আমি পুরুষ চাই না, আমি প্রেম চাই। প্রেম পেতে পেতে বছর গড়ালো। ফরাসি এক যুবক, বয়সে বছর ছয়েকের ছোট। উতল প্রেমে দুজন ভাসলাম। তখন আমি প্যারিসবাসী, তখন আমি প্রেমের শহর, আমি তিরিশের শেষদিক। ফরাসি প্রেমিক তুলুজ শহর থেকে ছুটিছাটায় ছুটে ছুটে প্যারিস আসে। সেইন নদীর পাড়কে আমরা চুমু খেতে খেতে স্নিগ্ধ করি। বিমানে, গাড়িতে, বাসে, নৌকোয়, বারে রেস্তোরাঁয়, পথে ঘাটে পরস্পরকে গাঢ় আলিঙ্গন করে গভীর গহন চুমু খেয়ে যাচ্ছি। না কাউকে দেখাতে নয়। কেউ যে আছে আমাদের চারপাশে তা তো ভুলে যাই। আমরা তো জগত ভুলে ছিলাম। প্রেম এমনই। অন্ধ করে রাখে। বাঙালি পুরুষের কাছ থেকে প্রেমের যে পাঠ নিয়েছিলাম, তা ফরাসি প্রেমিক প্রমাণ করে দেয় যে, নির্ভুল নয়। সারা শরীর যে প্রেমে, যে শ্রদ্ধায় স্পর্শ করে প্রেমিক, দেখে মুগ্ধ হই। না, প্রেম যে এত সুন্দর, এত যে সমতার, এত গৌরবের, আগে জানিনি। তার চুম্বন, তার আলিঙ্গন, তার পূর্বরাগ আমাকে প্রেমের অন্য ভুবন চেনায়। যে ভুবনের ঙ্গিসীমানায় কোনও বাঙালি পুরুষ আমাকে নেয়নি আগে। যৌনতা যে একটি অসামান্য শিল্প, এর আগে আমি শিখিনি। আমার নির্জনতা চুরচুর করে ভেঙে ফরাসি প্রেমিক সত্যি আমাকে একটি আকাশ দিয়েছিল। আমাকে শিখিয়েছিল সত্যিকারের শরীরী-প্রেম। কিন্তু মুশকিল হল, প্রেমিক আমাকে চায়। তার একার করে চায়। চায় আমি তার সঙ্গে একত্রবাস করি। প্যাশনপূর্ণ প্রেম তার, প্রচণ্ড প্রেম। আমাকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে। তার জীবনের কোনও আর অর্থ রইল না। না, আমি বলে দিই, প্যারিস ছেড়ে কেবল তার সঙ্গে বাস করার জন্য তুলুজে যাবো না। তুমি বরং চলে এসো প্যারিস। অথবা এভাবেই হবে প্রেম পৃথকবাসে। প্রেমিক তা মানে না। মনে করে আমি তাকে তুচ্ছ করছি। অভিযোগ করে সে আমার টয়বয়, অন্য কিছু নয়। আকুল হয়ে কাঁদে। তুমি তো বিখ্যাত, তুমি কেন আমার মতো অখ্যাত কাউকে ভালোবাসবে! ভালোবাসা কি খ্যাত অখ্যাত দেখে হয়! কে শোনে আমার কথা! প্রেমিক কাঁদে ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে আমাকেই শুয়োরের বাচ্চা বলে। পুরুষের আদেশ না মানলে পুরুষ ছিঁড়ে কামড়ে খেতে পারে। প্রেমেও তত নয়, নিয়ন্ত্রণে যত সুখ পুরুষের। একদিকে তার ঈর্ষা, হীনম্মন্যতা আর অন্যদিকে আমার দৃঢ়তা আমাদের সম্পর্ককে এক টানে বিচ্ছেদের পাড়ে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রেমের জন্য জীবন উৎসর্গ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশাল একটি পৃথিবী আমার সামনে, কোনও ক্ষুদ্র গঙ্গিতে শখ করে বাঁধা পড়বো, না হয় না তা। আর প্রেম প্যাশন যৌনতার যাবতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শিল্প বাদ দিলে পুব-পশ্চিমের সব পুরুষই একটি মানসিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করে, তারা বুঝি নারীর চেয়ে বেশি কিছু, বড় কিছু। এই মিথ্যের সঙ্গে আপোস করবো কেন আমি?

আবার কয়েক বছরের নৈঃশব্দ। পুরুষহীন জীবন। লেখায় পড়ায়, দর্শনে শিল্পে, বন্ধুত্বে, ভ্রমণে বুঁদ হয়ে থাকা। একসময় সুদূর ইওরোপের বাস থেকে মাঝে মধ্যেই এই বাংলায় আসা যাওয়া শুরু হয়। প্রিয় শহর, প্রিয় মানুষ। ভালোবাসায় ভরে থাকে মন। যেহেতু হৃদয়ের দুয়ার খোলাই থাকে, ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ে এক বাঙালি পুরুষ। এ প্রেম সেই কিশোরবয়সের প্রেমের মতো। না ছুঁয়ে, না শুয়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমি রিসার্চ করছি। মন কী আর বসে ওতে। বাংলা তখন হৃদয়, বাঙালি তখন স্বপ্ন। বয়সে কুড়ি বছর বড়, অথচ তাকে তুই তোকারি প্রেমিক করে ফেলি কদিনেই। প্রেম ইমেইলে, ফোনে। প্রতিদিন কেমব্রিজ কলকাতা, কলকাতা কেমব্রিজ। প্রতিদিন সুপ্রভাত, প্রতিদিন শুভরাত। প্রেম কবিতার শব্দে অক্ষরে। প্রেমের তোড়ে জীবন ভেসে যায়। আর যেদিন প্রেমিকের সঙ্গে মিলবো বলে ছুটে আসি, সারা শরীর কাঁপছে মিলন লাগি, প্রেমিক এসে চুমুর নামে ঠোঁট কামড়ালো, আদরের নামে বুক খামচালো। তারপর গালে চিমটি কেটে টা-টা বলে চলে গেল, ওটুকুই তার প্রেম। আমি হাঁ হয়ে রইলাম! ফরাসি প্রেমিক পালকের মতো স্পর্শ করতো শরীর, আর এ কেমন স্পর্শ করা! যে সমাজে যৌনসামগ্রী ছাড়া মেয়েদের অন্য কিছু ভাবা হয় না, সেখানে এমন হিংস্রতাই তো স্বাভাবিক। তারপরও প্রেম বাধ মানে না, আকুল হই প্রেমিকের জন্য। না, দিন রাতের পাগল করা প্রেমে সে নেই। সে সন্ধেয় বা বিকেলে একটুখানির তরে দেখতে আসে, শহরের সংস্কৃতিতে পরকীয়া প্রেমের এমনই নাকি নিয়ম। প্রেমকে আমি চিরকালই প্রেম বলে মানি বলে বড় বিস্মিত হই পর আপনের শহুরে সংত্তায় আর ব্যাখ্যায়। সবচেয়ে স্তম্ভিত হই দেখে যে, এতকাল প্রেমের জলে আমাকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে আমার প্রেমিক-পুরুষ অক্ষমাযোগ্য অপরাধ করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি একটি সত্য লুকিয়ে, যে, সে উত্থানরহিত।

সে বন্ধু হয়ে রইল। কিন্তু চল্লিশ ছোঁয়া শরীরে তো মুহূর্মুহু বান ডাকছে। আমার কুড়ির, আমার তিরিশের শরীরেও বুঝি এত তীব্র তৃষ্ণা ছিল না। আবারও প্রেমের উতল হাওয়া আমাকে ভিজিয়ে ভাসিয়ে এক কবির মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। রক্ষণশীল শহরটির সংস্কার গুঁড়ো করে দিয়ে কবিকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে উড়ি ঘুরি। কবি আমার সকাল দুপুর বিকেল। কবি আমার সন্ধে, আমার রাত। কবিকে প্রেম বুঝিয়ে বত্রিশ কলা শিখিয়ে যখন পরম প্রেমিক করে তুলেছি, দেখি কবির সারা শরীরে যৌনরোগের দাগ। জগত আমার লাটিমের মতো ঘোরে । হাতুড়ি পিটিয়ে আমাকে যেন কে ইস্পাত করতে চায়, পারে না। কবি আনন্দ আমাকে দেয় ঠিকই, যন্ত্রণা দেয় ঙ্গিগুণ। সেই প্রথম-জীবনের মতো কাঁদি আমি। না, কবি প্রেম জানে না। আমার কষ্টের দিকে ফিরে তাকানোর হৃদয় তার নেই। আমি এমনই রক্তাক্ত তখন, যে, এক শীত শীত রাতে হাতে উষ্ণ হাত রাখে এক পুরুষ, আর নিমেষে নদী হয়ে উঠি। অন্ধকারে সে স্পর্শ আমাকে ভীষণ স্রোতার্ত করে। বুঝি, ভালোবাসি। অদ্ভুত এই পুরুষ অবোধ বালকের মতো আমাকে কামগন্ধহীন প্রেমে জড়িয়ে রাখতে চায়। কেন চায়, কী চায়, কিছু তার বুঝি না। আমি কেন ঘন কুয়াশায় হাঁটবো তার সঙ্গে, যখন মেঘ সরিয়ে রোত্রুর আনবো বলে পণ করেছি!

পুরুষদের আমি অকাতরে দিয়েছি । সে প্রতারক হোক, প্রেমিক হোক, বুঝে বা না বুঝে অকৃঙ্গিম প্রেম দিয়েছি। যখন মাঝে মাঝেই রাতের হুহু হাওয়া আমার নির্জন জীবনকে খেলাচ্ছলে ছুঁয়ে যায়, বড় একা লাগে। লেখালেখির একটি জীবন আছে আমার, সে জীবনটিতে চূড়ান্ত ব্যস্ততা, লক্ষ মানুষের আনাগোনা। আরেকটি জীবন একান্তই ব্যক্তিগত। এই জীবন, জীবনের শুরু থেকে, আমি একরকম একাই যাপন করছি। হঠাৎ হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কেউ আসে, নিঃশব্দে চলেও যায়। হাতে গোনা ক’জন পুরুষকে আমি প্রেমিক নামে ডাকি, কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পেলে এমন নয় যে স্বগোতক্তি করি না এই বলে, যে, আমার প্রেমিক হওয়ার যোগ্য আদৌ তারা নয়। প্রেমিকেরা অনেকে অনেক কারণে আমার সান্নিধ্য চেয়েছে। কেউ আমাকে ভালোবেসে আমাকে চায়নি। কেউ নামের জন্য, কেউ বিজ্ঞের জন্য, কেউ যশখ্যাতির জন্য, কেউ শরীরের জন্য, কেউ হৃদয়ের জন্য। কেবল ভয়ংকর চাই চাই দেখেছি চারদিকে। আমার নিজের চাওয়া হেলায় ফেলায় তুলোর মতো উড়ে গেছে উদাস হাওয়ায়।

তারা ঠগ। প্রতারক। হিপোক্রেট। ভীতু। ভণ্ড। তারা প্রেমিক ছিল কি একজনও? আজ বেলায় এসে, দুখের দিনগুলোকেও যে সুখের দিন ভেবে সুখ পেতাম, টের পাই। হৃদয় নিংড়ে প্রেম দিয়েছি, যাদের দিয়েছি, বুঝি তারা পুরুষ ছিল সবাই, প্রেমিক ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *