আমার জীবনের গল্প প্রায় শেষ হয়ে এল।
আঠাশ বছরের জীবন, তার উনিশ বছর কাটল রবি ঠাকুরের বউ হয়ে।
তার আবার দশ বছর কাটল ক্রমাগত ওঁর পাঁচটি শাবক প্রসব করতে-করতে। আমাদের সন্তান সম্পর্কে ‘শাবক’ কথাটি উনিই একবার ব্যবহার করেছিলেন।
তা-ই আমিও সেই সাহস দেখালাম।
আরও একটি পেটে ধরেছিলুম। পড়ে গেলুম বলে সেটা নষ্ট হল। আর আমার সর্বনাশ হল।
আমি জানি, আমার এ-অসুখ সারবে না। শরীর শেষ হয়ে আসছে। শরীরের আর অপরাধ কী!
যা গেল উনিশ বছর ধরে এই শরীর আর মনের উপর দিয়ে!
শরীরের যে-অবস্থা, বেশিদিন আর লিখতে পারব বলেও মনে হয় না। লুকিয়ে-লুকিয়ে লিখছি তো—কেউ দেখে ফেললেই লেখাটা লোপাট হয়ে যাবে।
আর লিখতেও পারছিনে। দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সারা গায়ে জ্বালা। আর সারাক্ষণ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
এত দুর্বল লাগে, বলে বোঝাতে পারব না। ডাক্তার বলছে, এত রক্তপাত হচ্ছে শরীরে আর রক্ত নেই।
শুনছি, শান্তিনিকেতনে থাকলে চিকিৎসা তেমনভাবে হবে না।
তবে প্রথম থেকেই আমার চিকিৎসা তো উনিই করছেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। কতরকমের এক্সপেরিমেন্ট করছেন ওষুধ বদলে-বদলে।
এবার আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে পড়লে কি আর লিখতে পারব?
আমার বিয়ের পরেই বাড়িতে যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল।
কীসের উৎসব?
নতুন বউঠানের শোবার ঘরের খোলনলচে বদলে একেবারে নতুন করে সাজানো হচ্ছে।
কেন?
কারণ, নতুন বউঠানের মনখারাপ। তার মনের ব্যামো হয়েছে।
সেই ব্যাধি সারানোর জন্যে ঘর সাজিয়ে ওঁর মন ভালো করার চেষ্টা চলছে।
কীরকম সাজানো হচ্ছে ঘর?
জ্ঞানদানন্দিনীর যেমন পছন্দ তেমনভাবে।
কে সাজিয়ে দিচ্ছেন?
জ্ঞানদানন্দিনীর প্রিয় দেওর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
আমার বর একদিন তিতিবিরক্ত হয়ে বললে, বাড়িতে এসব কী হচ্ছে বলো তো? যার মন ভালো করার জন্যে ঘর সাজানো তার কি ওইরকম পছন্দ? আমি তো নতুন বউঠানের পছন্দ জানি। দেয়ালে ওইরকম কড়া রং ওর পছন্দই নয়। তাছাড়া, পালঙ্কটাই বা বদলে দেওয়া হল কেন? ওই পালঙ্কটাই তো ওর কত পছন্দের। এক সময়ে দুপুরবেলা আমরা দু’জনে ওই পালঙ্কে কত গল্প পড়েছি। ওখানে শুয়ে শুয়ে কত কবিতা লিখে আমি শুনিয়েছি নতুন বউঠানকে। বরাবর তো বউঠান ওই পালঙ্কেই শুয়েছে—এ-বাড়িতে বউ হয়ে আসার দিন থেকে। কী সুন্দর ফুল ফলের, পাখির, বাগানের ডিজাইন ছিল পালঙ্কটায় নতুন বউঠান একদিন বলেছিল, ঠাকুরপো, আমার এই পালঙ্কটাও একটা নন্দনকানন। সেটাও কিনা বদলে দিলেন মেজোবউঠান? নতুন দাদাও একটিবার ভেবে দেখল না, নতুন বউঠান তার ঘরে এইসব পরিবর্তন চাইছে কি না?
এই সবের মাস কয়েক পরেই ঘটল সেই ঘটনা।
আমার বিয়ে হল ১৮৮৩-র ডিসেম্বরে। ১৮৮৪-এর এপ্রিল মাসে নতুন বউঠান আত্মহত্যা করলেন।
সেই দিনটা মনে আছে আমার।
আমি ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারিনি।
শুধু এইটুকু জানি, সেদিন নতুন বউঠানের ঘর সারাদিন বন্ধ ছিল।
ভোরবেলা কাজের লোকেদের সন্দেহ হয়, নতুন বউঠান বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
ওর ঘুম ভাঙে খুব সকালে।
ও নতুন বউঠানের ঘরে খুব জোরে জোরে আঘাত করে চিৎকার করতে থাকে, নতুন বউঠান দরজা খোলো, দরজা খোলো।
আমি বারান্দায় বেরিয়ে আসি।
কেউ যখন দরজা খুলল না, দরজা ভাঙা হল।
ততক্ষণে বাবামশায় ঘরের সামনে এসে গিয়েছেন।
প্রথমে ঘরে ঢুকল ও।
কিছুক্ষণ পরে বাবামশায়।
আমাকে ভিতরে যেতে দেওয়া হয়নি।
নতুন বউঠান অজ্ঞান। একেবারে কোনও জ্ঞান নেই।
কিন্তু তখনও বেঁচে ছিলেন।
ও ঘরে ঢুকেই বেশকিছু কাগজ চাদরের মধ্যে লুকিয়ে বেরিয়ে এল।
সেই কাগজ আমি কোনওদিন দেখিনি।
বাবামশায়ও অনেক ছেঁড়া কাগজ—চিঠির মতো কিছু–নিয়ে বাইরে এলেন।
তারপর ওর উদ্দেশে বললেন, জ্যোতিকে খবর দাও। সে কোথায় ছিল রাত্তিরে?
বাবামশায়কে কখনও এরকম রাগতে দেখিনি। বললেন, বউমা এখনও বেঁচে আছেন। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। আর তাঁর আত্মহত্যার সমস্ত প্রমাণ লুপ্ত করার ব্যবস্থা করো। আর জ্যোতিকে বোলো, আমাদের এস্টেট থেকে তার সমস্ত বাড়তি পাওনা আমি বন্ধ করে দিলুম।
আমি প্রমাণ পেয়েছি, সে চরিত্রহীন!
এ-আমি ক্ষমা করতে পারব না।
বেশ বেলায় এলেন জ্যোতিদাদা।
তখন কী বিধ্বস্ত অবস্থা তাঁর!
মুখচোখ সব ফুলে আছে।
তিনি নাকি নতুন বউঠানকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি সে-রাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন।
ফিরলেন তার পরদিন বেশ বেলায়।
আমার মনে আছে, আপনাদের রবি ঠাকুর আর তাঁর নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দু’জনে দু’ধার থেকে ধরে নতুন বউঠানকে দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটাবার চেষ্টা করছেন।
নতুন বউঠানের আঁচল খসে মাটিতে লুটোচ্ছে।
তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
তিনি হাঁটবেন কী করে?
বিষ খেয়ে তাঁর চৈতন্যই নেই।
তিনি কিন্তু আরও দু-দিন বেঁচে ছিলেন অচৈতন্য হয়ে।
বাবামশায়ের হুকুমে তাঁর এই দু-দিন বেঁচে থাকার তথ্যটাই লোপাট করা হল।
পুলিশ থেকে ডাক্তার—সবাই ভয়ে বা ঘুষ খেয়ে চুপ করে গেল। বলা হল, তিনি হঠাৎ হার্টফেল করেছেন।
দুদিন আগে যে নতুন বউঠান আফিম খেয়েছিলেন, সেই ব্যাপারটাই ঠাকুরবাড়ি চেপে গেল।
এই হল এই বড় বাড়ির একতা।
আমি শুনেছি, নতুন বউঠান শেষ দিনে অনেক বড় একটি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়তম রবিকে।
সে-চিঠি কোথায় গেল, কেউ জানে না।
নতুন বউঠান আর একটি ছোট চিঠি লিখেছিলেন তাঁর স্বামীকে।
শুনেছি, সেই চিঠির মধ্যে ছিল আর একটি চিঠি।
সেই ভালোবাসার চিঠিটা লিখেছিল কলকাতার এক বিখ্যাত নটী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে।
নতুন বউঠান নাকি সেই চিঠিটা পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর জোব্বার পকেটে।
নতুন বউঠান তাঁর স্বামীকে শেষ দিনে যে চিঠিটি লেখেন তার মধ্যে নটীর চিঠিটি—সবটা গিয়ে পড়ে বাবামশায়ের হাতে।
বাবামশায়ের পক্ষে ক্ষমা করা সম্ভব হয়নি তাঁর পুত্রকে।