৮
আমাদের হোটেলটা অন্যদিক দিয়ে খুব একটা কিছু না হলেও, রান্নাটা এখানে বেশ ভালই হয়—বিশেষ করে পাঁঠার মাংসের ঝোল। আমি আর ফেলুদা দুজনেই রাত্রে রুটি খাই, আর নিশিকান্তবাবু দু’বেলাই খান ভাত। আজ তিনজনে এক সঙ্গে খেতে বসেছি। নিশিকান্তবাবু একটা নলি-হাড় চুষে চোঁ করে ম্যারো বার করে খেতে খেতে বললেন, ‘ডিসেন্ট লোক মশাই।’
‘ডক্টর বৈদ্যর কথা বলছেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘আশ্চর্য ক্ষমতা। কী রকম সব বলে-বলে দিলে।’
ফেলুদা হেসে ঠাট্টার সুরে বলল, ‘আপনার তো ভাল লাগবেই—বলেছে ফাঁড়া কেটে গেছে—আর কী চাই!’
‘আপনার বুঝি ওঁর কথাগুলো বিশ্বাস হয় না?’
‘কথাগুলো যদি ফলে যায়, তা হলে হবে নিশ্চয়ই। এখনও তো সে স্টেজে পৌঁছয়নি। এমনিতে এ সব লোকের উপর চট করে শ্রদ্ধা হওয়া কঠিন। এত বুজরুকের দল আছে এ লাইনে।’
কিন্তু সত্যি করে গুণী লোকও তো থাকতে পারে। এঁর কথাবার্তার স্টাইলই আলাদা। শুনলেই ইম্প্রেস্ড হতে হয়। আর যদি ধরুন গিয়ে মার্ডার হয়েই থাকে…’
ফেলুদা মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল; কেন, সেটা বুঝতে পারলাম না। হয়তো মনের মধ্যে কোনও খট্কা রয়েছে। এত ভাল মাংস খাবার সময়ও তার চোখ থেকে ভ্রুকুটি যেতে চাইছে না।
‘মার্ডারের কথা যে বললেন, সেটা আপনার বিশ্বাস হয়?’ নিশিকান্তবাবু প্রশ্ন করলেন।
ফেলুদা বলল, ‘হয়।’
‘হয়?’
‘হয়।’
‘কেন বলুন তো।’
‘কারণ আছে।’
এর বেশি আর কিছু বলল না ফেলুদা।
খাবার পরে কালকের মতোই দুজনে পান কিনতে বেরোলাম। বৃষ্টি এখনও নামেনি, তবে বাতাস একদম বন্ধ হয়ে গেছে। আজ আমাদের হোটেলের সামনে দিয়ে দু’-একজন নতুন লোককে হাঁটতে দেখলাম। তারা সবাই বিদেশি, বোধহয় আমেরিকান। এসব বিদেশি টুরিস্টরা সাধারণত এসে ‘নরখিল’ বলে একটা হোটেলে থাকে; ওটাই এখানকার সবচেয়ে বড় হোটেল।
ফেলুদা পান খেয়ে রাস্তায় পায়চারি করতে আরম্ভ করেছিল, হঠাৎ থেমে বলল, ‘সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কিছু ক্যালকুলেশন আছে, সেরে ফেলি গে। তুই বরং এক কাজ কর। কাছাকাছির মধ্যে একটু ঘুরে আয়। আমি আধঘন্টা আন্ডিস্টার্বড কাজ করতে চাই।’
ফেলুদা হোটেলে ফিরে গেল। ওর কাজে ব্যাঘাত করার ইচ্ছে বা সাহস কোনওটাই আমার নেই—বিশেষ করে তদন্তের এই জট পাকানো অবস্থায়।
দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় লোক নেই বেশি। হোটেলের কাছেই একটা বন্ধ দোকানের সামনে কয়েকটা নেপালি গোল হয়ে বসে জুয়া খেলছে। মাঝে মাঝে ঘুঁটি নাড়ার শব্দ আর তাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
আমি শহরের দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। এখনও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর তার সঙ্গে অনেক দূর থেকে মেঘের গর্জন। তবে মনে হয় না বৃষ্টি খুব শিগ্গির আসবে। ধীরে ধীরে তোড়জোড় চলেছে, নামবে গিয়ে হয়ত সেই মাঝরাত্রে।
রাস্তার বাতিগুলোর খুব জোর নেই, আর উপর দিক থেকে পড়ে বলে চেনা লোকের মুখ চিনতে সময় লাগে।
উল্টোদিক থেকে কে যেন আসছে। এখনও প্রায় বিশ-ত্রিশ গজ দূরে। এবার একটা আলোর তলায় এসে পড়াতে মাথার ব্রাউন চুলটা চক্চক্ করে উঠল।
পরের আলোটায় পরিষ্কার চিনতে পারলাম হেলমুটকে। সে অন্যমনস্ক ভাবে মাটির দিকে চেয়ে হাঁটছে।
এখন দশ হাতের মধ্যে হেলমুট। তার ভুরু কুঁচকানো, হাত দুটো প্যান্টের পকেটে গোঁজা।
হেলমুট আমার পাশ দিয়ে গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেল, অথচ আমাকে যেন দেখতেই পেল না।
আমি মুখ ঘুরিয়ে হতভম্বভাবে কিছুক্ষণ ওর ক্রমে-ছোট-হয়ে-যাওয়া চেহারাটার দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।
ঘরে এসে দেখি ফেলুদা বুকের ওপর খাতা খুলে চিত হয়ে খাটে শুয়ে আছে। বললাম, ‘আধঘন্টা হয়ে গেছে ফেলুদা।’
ফেলুদা বলল, ‘সাসপেক্টের তালিকাটা আপ-টু-ডেট করে ফেললাম।’
আমি বললাম, ‘বীরেন্দ্র শেলভাঙ্কার যে সাসপেক্ট সেটা তো আগেই জানতাম, শুধু নামটা জানা ছিল না। ডক্টর বৈদ্যও কি সাসপেক্ট?’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘লোকটা ভেল্কি দেখিয়েছে ভালই। অবিশ্যি, এমন ভেল্কি যে সম্ভব নয় তা বলছি না। আর আজকের ব্যাপারে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার যে, বৈদ্যর শেলভাঙ্কারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। শেলভাঙ্কার ওকে কী বলেছিল না-বলেছিল সেটা না জানা অবধি এই বৈদ্য ভণ্ড-বৈদ্য না খাঁটি-বৈদ্য সেটা জানা যাবে না।’
‘কিন্তু নিশিকান্তবাবুর ব্যাপারটা যে বলে দিল।’
‘জলের মতো সোজা। নিশিকান্ত যে-রেটে নখ কামড়াচ্ছিল, তার নার্ভাসনেস বুঝতে অলৌকিক ক্ষমতার দরকার হয় না।’
‘আর মার্ডার?’
‘মার্ডার না বলে স্বাভাবিক মৃত্যু বললে নাটক জমে না। লোকটা এসেনশিয়ালি নাটুকে। অনেক গুণী লোকই নাটুকে হয়, অভিনয় পছন্দ করে, লোককে চমকে দিতে ভালবাসে। এটা মানুষের অনেকগুলো স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে একটা।’
‘তা হলে সাসপেক্ট কাকে কাকে বলতে হয়?’
‘যথারীতি সকলকেই।’
‘ডক্টর বৈদ্যও?’
‘হোয়াই নট? মূর্তির কথাটা ভুলিস না।’
‘আর হেলমুট?’ আমি হেলমুটের ঘটনাটা বললাম।
ফেলুদা কিন্তু খুব বেশি অবাক হল না। বলল, ‘হেলমুটও যে রহস্যময় চরিত্র সেটা আমি আগেই বুঝেছি। ও বলছে প্রোফেশনাল ফোটোগ্রাফার, সিকিম সম্বন্ধে একটা ছবির বই করছে, অথচ রুমটেকে যে এত বড় একটা উৎসব হচ্ছে, সে খবরটা সে জানত না। এখানেই তো খট্কার কারণ রয়েছে।’
‘তার মানে কী হতে পারে?’
‘তার মানে এই যে, ওর এখানে থেকে যাওয়ার অন্য কোনও একটা কারণ রয়েছে, যেটা ও আমাদের কাছে প্রকাশ করছে না।’
ফেলুদা আরও কিছুক্ষণ ধরে খাতায় হিজিবিজি লিখল। আমি আকাশ-পাতাল ভেবেও এই সব ঘটনার জট ছাড়াতে পারলাম না। আমরা এর আগেও অদ্ভুত সব রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়েছি, কিন্তু কোনওটারই সমাধান এত কঠিন বলে মনে হয়নি। একবার মনে হল ফেলুদার পুলিশে খবর দেওয়া উচিত। ও একা কেন সমস্ত ব্যাপারটা ঘাড়ে নিচ্ছে? শেলভাঙ্কারকে যে-ই খুন করুক না কেন, সে যে একটা ডাকসাইটে ক্রিমিন্যাল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যদি সেই লোক ফেলুদার তদন্তের কথা জেনে ফেলে, আর ওকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে? কিন্তু তারপরেই আবার মনে হল, পুলিশ যদি ফেলুদার আগে খুনিকে ধরে ফেলে, তা হলে সেটা আমার মোটেই ভাল লাগবে না। তার চেয়ে ফেলুদা যা করছে তা একাই করুক। যদি ও এই কঠিন রহস্যের সমাধান করতে পারে, তা হলে ওর গৌরব পঞ্চাশ গুণ বেড়ে যাবে।
পৌনে এগারোটার সময় নিশিকান্তবাবু দরজায় টোকা মেরে ‘গুড নাইট’ করে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ গল্পের বইটা পড়ার চেষ্টা করলাম। জুল ভার্নের ‘কার্পেথিয়ান কাস্ল’। জানি খুব ইন্টারেস্টিং বই, কিন্তু তাও মন বসল না। কিছুক্ষণ পরে বই বন্ধ করে চোখ বুজলাম। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখেছি ফেলুদা তার খাতায় নোট করে চলেছে।
মনে যত দুশ্চিন্তাই থাকুক না কেন—রাত্রে একবারও ঘুম ভাঙেনি। সকালে যখন উঠেছি, তখন জানালা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে রোদ দেখা যাচ্ছে। ফেলুদা ঘরে নেই—বোধহয় স্নান করতে গেছে।
যেখানেই যাক—যাবার আগে তার খাটের উপর একটা সাদা কাগজ অ্যাশ-ট্রে চাপা দিয়ে রেখে গেছে—বোধহয় আমারই দেখার জন্য।
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে—আমাদের চেনা একটা তিব্বতি কথা—যার মানে হল মৃত্যু।