৮. আবিষ্কারের ধাক্কা
বইয়ের দোকানে বল্টু একটা খুব মজার বই পেয়ে গেলো–ভেতরের ছবিগুলো লাল আর সবুজ রঙ দিয়ে আঁকা, বইয়ের সাথে একটা চশমা দেওয়া আছে, কার্ডবোর্ডের ফ্রেম, দুই চোখে দুই রঙের প্লাস্টিকের কাঁচ, একটা সবুজ অন্যটা লাল। সেই চশমাটা দিয়ে ছবিগুলো দেখলে মনে হয়ে বই থেকে ছবিগুলো লাফ দিয়ে বের হয়ে এসেছে। বিচিত্র সব ছবি, সেগুলো দেখতে বল্টুর খুব মজা লাগছিল, কিন্তু ব্যাপারটা কেমন করে ঘটে সেটা বুঝতে নিশ্চয়ই আরো অনেক মজা। দোকানে দাঁড়িয়ে বল্টু সেটা বুঝতে পারল না, এটা বুঝার জন্যে বইটা বাসায় নিয়ে দেখা দরকার।
বল্টু তার আম্মুর কাছে বইটা নিয়ে গেলো, বলল, “আম্মু, তুমি বলেছিলে না আমি ভালো হয়ে থাকলে তুমি একটা গিফট কিনে দেবে?”।
“হ্যাঁ, বলেছিলাম।”
বল্টু সতর্কভাবে চেষ্টা করল, “আমি তো অনেক ভাল হয়ে থাকলাম—”
রিতু ঝংকার দিয়ে বলল, “তুই মোটেও ভালো হয়ে থাকিস নি। তোর যন্ত্রণায় আমার জীবন শেষ–এখন আমার জঙ্গলে গিয়ে থাকতে হবে।”
রিতু কথাটা খুব আস্তে বলে নাই, তাই বইয়ের দোকানের অনেকেই মাথা ঘুরিয়ে দেখলো কোন মানুষটার কারণে রিতুর জঙ্গলে গিয়ে থাকা দরকার হয়ে পড়েছে। বল্টু রিতুর কথাটা না শোনার ভাণ করে বলল, “ঠিক আছে, আমি যদি সামনের মাসে ভালো হয়ে থাকি তাহলে কী একটা গিফট কিনে দেবে?”
রিতু সরু চোখে বল্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আগে সামনের মাসটা পার হোক, আমি দেখি।”
“তুমি কী আগেই গিফটটা দিতে পার না, আমি পরে ভালো হয়ে থাকলাম।”
রিতু সুখ শক্ত করে বলল, “না।”
“কেন না?”
“তোর সাথে আমার কোনো বাকি কারবার করি না। তুই আগে আমাকে অনেকবার ঠকিয়েছিস।”
বল্টু সেটা অস্বীকার করতে পারল না, বিজ্ঞান গবেষণা করতে অনেক কিছু কিনতে হয়, টাকা-পয়সার দরকার, আম্মুকে নানাভাবে বোকা বানিয়ে সে মাঝে মাঝে এগুলো কিনেছে। এই লাইনে সুবিধা করতে না পেরে বল্টু তখন অন্য একটা লাইন ধরল, বলল, “আম্মু।”
“কী হলো।”
“তুমি তো সবসময়েই জন্মদিনে গিফট কিনে দাও। দাও না?”
“হ্যাঁ দেই।”
“আমার সামনের জন্মদিনের গিফটটা কী এখন কিনে দিতে পারবে।”
“তুই আমাকে বোকা পেয়েছিস? গতমাস চশমার দোকান থেকে আমাকে দিয়ে কী সব লেন্স ফেন্স কিনিয়েছিস মনে আছে? তখন বলেছিস এটা তোর জন্মদিনের গিফট? একবছরে তোর কয়টা জন্মদিন হবে?”
ব্যাপারটা বল্টুর মনে ছিল কিন্তু মনে মনে আশা করেছিল আম্মুর মনে নাই! মনে হচ্ছে আম্মুর ঠিকই মনে আছে। মানুষ এরকম ছোটখাটো জিনিস কেন মনে রাখে?
বল্টু তবু হাল ছাড়ল না, বলল, “ঠিক আছে আম্মু, আমাকে এরপরের জন্মদিনে কোনো গিফট দিতে হবে না। এখন এই বইটা কিনে দাও।”
রিতু ভুরু কুচকে বলল, “কতো দাম বইটার।”
বল্টু দেখেছে বইটার দাম আড়াইশ টাকা, কিন্তু সে ভান করল দামটা জানে না। ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “কতো আর হবে! বইতো আর বেশি হয় না। তোমার বইয়ের সাথে দিয়ে দিচ্ছি।”
“উঁহু। আগেই না।” রিতু বইটা হাতে নিল, বইয়ের দামটা দেখলো, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “না। এতো দাম দিয়ে বই কেনা যাবে না।”
বল্টু শেষ চেষ্টা করল, “আম্মু! তুমি নিজেই বলেছ কে জানি বলেছে বই কিনে কেউ কী জানি হয় না।”
“দেউলিয়া হয় না। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন।”
“তাহলে?”
“সৈয়দ মুজতবা আলীর যদি তোর মতো একটা ছেলে থাকতো তাহলে মোটেও ওরকম কথা বলতেন না।”
কাজেই বল্টুর বইটা কেনা হলো না। বল্টু অবশ্যি হাল ছেড়ে দিল না, সে এতো সহজে হাল ছেড়ে দেয় না।
.
সন্ধ্যেবেলা খবর শোনার সময় রাজু দেখলো টেলিভিশনের উপরের ডান কোণার রংটা কেমন যেন বিদঘুঁটে হয়ে আছে। কয়েকটা চ্যানেল পাল্টে দেখলো সব চ্যানেলেই এক অবস্থা। তার মানে টেলিভিশন সেটটারই সমস্যা। সে রিতুকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “রিতু, টেলিভিশনের এরকম অবস্থা কেন?”
রিতু দেখে বলল, “জানি না তো!”
রাজু বলল, “এতো টাকা দিয়ে টেলিভিশন কিনি, দুদিন যেতে না যেতেই এই অবস্থা!”
বল্টু কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল, চোখের কোণা দিয়ে খুব সতর্কভাবে তার আব্বু আর আম্মুর কথা শুনছিলো, এবারে গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“আব্বু।”
“কী হলো?”
“আমি যদি টেলিভিশনটা ঠিক করে দিই, আমাকে কী দেবে?”
সাথে সাথে রাজু আর রিতু বুঝে গেলো এটা বল্টুর কীর্তি। রিতু প্রায় লাফ দিয়ে এসে বল্টুর কান ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু বল্টু তার হাত গলে। বের হয়ে বলল, “টিভি মেকানিকের কাছে নিলে সে দুই তিন হাজার টাকা নিবে, আমি অনেক কম টাকায় ঠিক করে দিব।”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “তুই আবার কবে থেকে টাকার কারবার শুরু করেছিস?”
বল্টু বলল, “মাত্র আড়াইশ টাকা।”
রিতু কোমরে হাত দিয়ে বলল, “এক্ষুণি ঠিক করে দে বলছি! না হলে কান ছিঁড়ে ফেলব। এক পয়সাও পাবি না।”
কাজেই বল্টু অত্যন্ত মন খারাপ করে টেলিভিশনের ওপরে রাখা চুম্বকটা সরিয়ে নিল, সাথে সাথেই টেলিভিশনের বিদঘুঁটে রং ঠিক হয়ে গেলো। ব্যাপারটা বল্টু অনেকদিন আগেই আবিষ্কার করেছে, টেলিভিশনের স্ক্রীনের কাছে চুম্বক ধরে রাখলে রং ওলট-পালট হয়ে যায়। কেন সেটা হয় সেটাও সে জানে–কিন্তু কেউ তার কাছে সেটা জানতে চায় না! বল্টু দেখেছে তার মতো বিজ্ঞান নিয়ে কারো কোনো কৌতূহলে নেই।
.
পরের দিন রাতের খাবারের পর বন্দু রাজুকে বলল, “আব্বু তুমি বল পয়েন্ট কলম দিয়ে লিখতে পার?”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “পারব না কেন?”
বল্টু বলল, “কিন্তু আমি বলছি তুমি পারবে না।”
“পারব না?”
“না। এই দেখো ফ্রিজে একটা কাগজ লাগিয়ে রেখেছি, আমি বলছি তুমি এই কাগজটাতে বল পয়েন্ট কলম দিয়ে লিখতে পারবে না।”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “কেন পারব না?”
বল্টু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি বলছি তুমি পারবে না। তুমি যদি বিশ্বাস না করো তাহলে আমার সাথে বাজী ধরতে পার।”
বাজী ধরব? তোর সাথে?”
“হ্যাঁ।”
“কয়দিন পরে বলবি তোর সাথে জুয়া খেলতে হবে। বলবি নাকী?”
“নাহ। সেটা বলব না। কেমন করে জুয়া খেলতে হয় আমি জানি না। কিন্তু বাজী ধরতে পার। আড়াইশ টাকা।”
আড়াইশ টাকার জন্যে হঠাৎ করে বল্টু কেন খেপে উঠেছে রাজু সেটা এর মাঝে রিতুর কাছ থেকে জেনে গেছে সে সেটা বল্টুর কাছে প্রকাশ করল না। বলল, “আমি বাজী ধরতে পারব না–কিন্তু বল পয়েন্ট কলম দিয়ে লিখে দেখতে চাই।”
বল্টু হতাশ হয়ে বলল, “বাজী ধরবে না?”
“উঁহু। তোর সাথে বাজী ধরে বিপদে পড়ব নাকী?”
রাজু ফ্রিজে রাখা কাগজটাতে বল পয়েন্ট কলম দিয়ে লিখতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সত্যি সত্যি একটুক্ষণ পরেই আর লেখা যাচ্ছে না, মনে হয় বল পয়েন্ট কলমের কালি শুকিয়ে গেছে।”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “কী আশ্চর্য!”
বল্টু ব্যাখ্যা করল, “বল পয়েন্ট কলমের কালি নিচের দিকে যেতে হয়–এই কাগজটাতে লেখার জন্যে কলমটা এইভাবে ধরেছ তো তাই কালিকে উপরের দিকে যেতে হবে! সেই জন্যে শুকিয়ে যাচ্ছে।”
রাজু চমৎকৃত হলো। কতো সহজ বিষয় কিন্তু সে নিজে কখনো খেয়াল করে নি। রাজু পরের দিন বল্টুর জন্যে বইটা কিনে আনল, বল্টুকে সেটা জানাল না।
সন্ধ্যেবেলা বল্টু ডাইনিং টেবিলে একটা কাপের মাঝে খানিকটা পানি ভরে নিয়ে এসেছে, সাথে একটা ব্লেড আর কয়েকটা সুঁই। রিতু আর রাজুকে ডেকে বলল, “আব্বু আর আম্মু, তোমার কী মনে হয় পানির মাঝে এই ব্লেডটা আর সুইটা ভাসাতে পারব?”
রিতু বলল, “তুই যখন জিজ্ঞেস করছিস নিশ্চয়ই পারবি। না পারলে কী আর জিজ্ঞেস করিস?”
“আমি যদি ভাসাতে পারি তাহলে আড়াইশ টাকা দিবে?”
“কেন? আড়াইশ টাকা দিব কেন? তুই যদি ভাসাতে পারিস তাহলে নিশ্চয়ই তার একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। সে জন্যে তোকে টাকা দেব কেন?”
“ভাসানোর জন্যে আড়াইশ টাকা দেবে না?”
“না। বৈজ্ঞানিক নিয়মে যেটা ভাসার কথা সেটা ভাসবেই। যে কেউ ভাসতে পারবে। সেটাই নিয়ম। তার জন্যে টাকা পাবি কেন?”
রাজু মুখ টিপে হেসে বলল, “এটার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে সারফেস টেনশান। পৃষ্ঠটান। পৃষ্ঠটানের জন্যে পানিতে পুঁই ব্লেড এসব ভাসানো যায়। কোনো কোনো পোকা আছে পানির উপর দিয়ে দৌড়াতে পারে।”
রিতু বলল, “আমাদের কী বোকা পেয়েছিস? আমরাও মাঝে মাঝে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখি। এই বাসায় তুই একা বৈজ্ঞানিক নাকী? আমরাও হাফ বৈজ্ঞানিক! কোয়ার্টার বৈজ্ঞানিক।”
বল্টুর মুখে এইবার এক ধরনের হাসি ফুটে উঠে, সে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, এই ব্লেড আর সুঁইটা পানিতে ভাসানোর জন্যে যদি আড়াইশ টাকা দিতে না চাও তাহলে যদি এটা ভাসাতে না পারি তাহলে দেবে?”
রাজু ভুরু কুচকে বলল, “কী বললি?”
“আমি যদি সারফেস টেনশান নাই করে দিই–”
“কীভাবে নাই করবি?”
“আড়াইশ টাকা দাও বলব।”
“বলতে চাইলে বল, না হলে বলিস না। কিন্তু কোনো টাকা পয়সা পাবি না।”
বল্টু মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিল, তখন রাজু বলল, “বল্টু, যাবার সময় ঐ প্যাকেটটা নিয়ে যা।”
বল্টু মুখ ভোতা করে বলল, “কোথায় নেব?”
“তোর ইচ্ছা।”
বল্টু মুখ ভোলা করেই প্যাকেটটা হাতে নিল এবং মুহূর্তের মাঝে তার মুখ একশ ওয়াট বালবের মতো জ্বলে উঠল। টান দিয়ে প্যাকেটটা ছিঁড়ে সে বইটা বের করে আনন্দে চিৎকার করে উঠে দৌড়ে রাজুর কাছে এলো, “আব্বু, সাবান দিয়ে!”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “কী সাবান দিয়ে?”
“সারফেস টেনশান নাই করতে হয় সাবান দিয়ে। পানির মাঝে যদি সাবান দেও তাহলে সারফেস টেনশান থাকে না!”
রাজু চোখ কপালে তুলে বলল, “ও আচ্ছা!”
“আমার কথা তুমি বিশ্বাস করলে না?”
“করেছি। করেছি।”
“না করলে তুমি পরীক্ষা করে দেখো–“ বলে বল্টু বইটা বগলে নিয়ে উধাও হয়ে গেলো।
.
পরদিন সকালে নান্টু এসে দেখলো বল্টু গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে। নান্টু সাধারণত কোনো প্রশ্ন করে না তাই সেও বল্টুর পাশে বসে বইটা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। বল্টু বলল, “বুঝলি নান্টু, এইটা হচ্ছে ফাটাফাটি বই।”
“যেটা চাচী কিনে দিতে চাচ্ছিলেন না?”
“হ্যাঁ। না কিনে যাবে কোথায়। বুঝলি, প্রথমে এমনিতে চেষ্টা করতে হয়, যখন কাজ না করে তখন কী করতে হয় জানিস?”
“কী?”
“ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতে শুরু করতে হয়। চোখে একটু পেয়াজের রস দিবি দেখবি ঝরঝর করে চোখ থেকে পানি বের হবে। মনে করবে সত্যি সত্যি কাঁদছিস।”
নান্টু মাথা নাড়ল। বল্টু বলল, “কান্নাকাটিতে যদি কাজ না হয় তাহলে কী করতে হয় সেটাও ঠিক করে রাখা আছে।”
“ও আচ্ছা।”
বল্টু বিরক্ত হয়ে বলল, “ও আচ্ছা বলিস না, জিজ্ঞেস কর কী ঠিক করে রাখা আছে।”
“কী ঠিক করে রাখা আছে?”
“বগলে রসুন দিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে থাকব। তাহলে জ্বর উঠে যাবে। জ্বর উঠলে সব আম্মুরা একেবারে মাখনের মতো নরম হয়ে যায়। এটা শিখে রাখ।”
নান্টু মাথা নেড়ে বিষয়টা শিখে রাখলো।
বল্টু তখন নান্টুকে নিয়ে তার এই নতুন বইটা পড়ে, সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সাধারণ একটা ছবি লাল সবুজ চশমা দিয়ে দেখলে কেন সেটা লাফ দিয়ে বের হয়ে আসছে সেটা বোঝার চেষ্টা করে।
নান্টু বোঝাবুঝির ঝামেলায় গেল না, বল্টু যেটা বলল সেটাই শুনে মাথা নাড়তে লাগলো। বল্টুর কথা শুনতেই তার ভালো লাগে, মাথা নাড়তে আরো বেশি ভালোলাগে!
.
পরের দিন রাতে বল্টু ঘুমানোর আগে রিতু জিজ্ঞেস করল, “বল্টু হোমওয়ার্ক করেছিস?”
‘করেছি আম্মু।”
“কী কী হোমওয়ার্ক ছিল?”
“ইংরেজি আর বাংলা।”
“দুটোই করেছিস তো, নাকী তোর বই নিয়েই সারাদিন পড়েছিলি?”
বল্টু এক গাল হেসে বলল, “দুইটাই। বইটা দিয়েই হোম ওয়ার্ক করেছি।”
রিতু ভুরু কুচকে বলল, “মানে?”
“আমি একটা বিশাল আবিষ্কার করেছি আম্মু। সেই আবিষ্কার দিয়ে হোমওয়ার্ক করেছি।”
বল্টুর কথা শুনে রিতু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো, প্রায় প্রতিদিনই বল্টু বিশাল কিছু আবিষ্কার করে আর তার প্রত্যেকটা আবিষ্কারই হয় একটা করে বিশাল অঘটন।
রিতু ভয়ে ভয়ে বলল, “দেখা দেখি তোর আবিষ্কার। দেখি, কীভাবে সেটা দিয়ে হোম ওয়ার্ক করলি?”
বল্টু খুব উৎসাহ নিয়ে তার হোম ওয়ার্কের খাতাটা বের করল। খুলে ভেতরের হোমওয়ার্কটা বের করতেই রিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। পুরো পৃষ্ঠাতে হিজিবিজি লেখা। একই সাথে লাল আর সবুজ কালিতে বাংলা আর ইংরেজি লেখা। সেখান থেকে একটা অক্ষর পড়ার উপায় নেই। রিতু চোখ কপালে তুলে বলল, “এটা কী করেছিস?”
বল্টু হাসি হাসি মুখে বলল, “হোমওয়ার্ক।”
“এটা হোমওয়ার্ক একটা কিছু পড়া যায় না!”
বল্টু তখন কার্ডবোর্ডের লাল সবুজ চশমাটা বের করে রিতুর হাতে দিয়ে বলল, “এইটা চোখে দিয়ে একবার বাম চোখে দেখো, আরেকবার ডান চোখে দেখো।”
রিতু চশমাটা হাতে নেয়, ডান চোখ বন্ধ করতেই হতবাক হয়ে দেখলো সব হিজিবিজি লেখা উধাও হয়ে মুহূর্তে সেখানে ঝকঝকে বাংলা হোমওয়ার্ক। রিতু অবাক হওয়ার একটা শব্দ করে বাম চোখ বন্ধ করতেই হতবাক হয়ে দেখলো মুহূর্তে বাংলা লেখাগুলো উধাও হয়ে সেখানে ইংরেজি লেখা বের হয়ে এসেছে! রিতু অবাক হয়ে বলল, “কী আশ্চর্য! কেমন করে করলি?”
বল্টু বলল, “সোজা আম্মু! খুবই সোজা! চশমার লাল কাঁচ দিয়ে শুধু সবুজ লেখাগুলো দেখা যায়। সবুজ কাঁচ দিয়ে দেখা যায় শুধু লাল লেখা!”
“তাই নাকী?”
“হ্যাঁ আম্মু–এই দেখো।” বলে বল্টু মহা উৎসাহে তার আম্মুকে ব্যাপারটা বোঝাতে শুরু করে।
.
রাত্রে বিছানায় শুয়ে রিতু রাজুকে বলল, “তোমার ছেলে এক কাগজে দুই হোম ওয়ার্ক করে রেখেছে দেখেছ?”
রাজু বলল, “দেখেছি! ভেরি ক্লেভার।
“সেটা ঠিক। কিন্তু স্কুলে টিচাররা তো এটাকে ক্লেভার ভাববে না। বেচারা এতো উৎসাহ নিয়ে স্কুলে যাবে, টিচাররাতো তাকে বকাঝকা করে বারটা বাজাবে।”
রাজু বলল, “সেটা ঠিকই বলেছ।”
রিতু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এতো উৎসাহ নিয়ে হোমওয়ার্কটা রেডি করেছে আমি আর না করতে পারলাম না।”
রাজু চিন্তিত মুখে বলল, “দেখা যাক কী হয়।”
.
পরের দিন বল্টু স্কুল থেকে যখন ফিরে এলো তখন তার মুখ গম্ভীর। রিতু তাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। বিকেল বেলা যখন নান্টু এলো তখন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বল্টু রাগে একেবারে ফেটে পড়ল, হাত পা নেড়ে চিৎকার করে বলল, “আমি এখন কী আবিষ্কার করব জানিস?”
নান্টু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“এটম বোমা। তারপর সেই বোমা দিয়ে পুরো স্কুলটা উড়িয়ে দেব। স্কুলটা উড়িয়ে দেবার সময় ভেতরে কাকে কাকে রাখব জানিস?”
না কিছু বলার আগেই বল্টু নিজেই বলল, “আমাদের বাংলা মিস আর ইংরেজি স্যারকে।”
নান্টু মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল, “ঠিক আছে।”
“আজকে কী হয়েছে জানিস?”
“না। জানি না।”
লাল সবুজ হোমওয়ার্ক বের করে বলল, “এই দেখ, আমি এক পৃষ্ঠায় দুই হোম ওয়ার্ক করেছি।”
নান্টু ভয়ে ভয়ে বলল, “কোনোটাই তো দেখা যায় না।”
বল্টু তার লাল সবুজ চশমা বের করে বলল, “চশমা ছাড়া তো দেখা যাবেই না। এই চশমা পড়ে একবার ডান চোখ দিয়ে দেখ, আরেকবার বাম চোখ দিয়ে দেখ।”
নান্টু দেখে অবাক হয়ে বলল, “কী সুন্দর! কী মজা!”
“আর আমার বাংলা মিস কী বলেছে জানিস?”
নান্টু মাথা নাড়ল, “জানি না।”
“বলেছে, যত্তো সব পাগলামী। তারপর আমার কান মলে দিয়েছে।”
নান্টু উদাস মুখে বলল, “কাজটা ঠিক করে নাই।”
বল্টু বলল, “আর ইংরেজি স্যার তো আরো ডেঞ্জারাস। এই চশমাটা দিয়ে দেখতেই রাজী হয় নাই। হোমওয়ার্কের খাতায় হিজিবিজি লেখার জন্যে এত্তো বড় একটা গোল্লা দিয়েছে। বলেছে আব্বুর কাছে নালিশ করবে।”
নান্টু নিশ্বাস ফেলে বলল, “কাজটা ঠিক করে নাই। একেবারে ঠিক করে নাই।”
বল্টু তার ঘরে কয়েকবার পায়চারী করে বলল, “আমি বাংলা মিস আর ইংরেজি স্যারকে বুঝতেই পারলাম না যে সবাই যদি এইভাবে হোমওয়ার্ক করে তাহলে দেশের অর্ধেক কাগজ বেঁচে যাবে! দেশের কতো বড় উপকার হবে জানিস?”
নান্টু মাথা নেড়ে বলল, সে জানে। “কিন্তু আমি স্যারদের আর মিসদের সেটা বুঝতেই পারলাম না!”
নান্টু একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “বড় মানুষেরা আসলে খুবই বোকা হয়।”
বল্টু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস।”
.
পরের দিন নান্টু এসে দেখল বল্টু তার টেবিলের নিচে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা কিছু তৈরি করছে। নান্টুকে দেখে বল্টু এক গাল হেসে বলল, “কী তৈরি করছি বল দেখি?”
নান্টু বলল, “এটম বোমা।”
“উঁহু। এটম বোমা বানানো খুব কঠিন। ইউরেনিয়াম পুটোনিয়াম লাগে, আম্মু কিনতেই দেবে না।”
নান্টু বলল, “অ।”
“আমি বানাচ্ছি ইনডাকশান কয়েল।”
“অ।”
“একটা ব্যাটারী দিয়ে অনেক হাই ভোল্টেজ তৈরি করা যায়। তারপর সেইটা আমার কানে লাগিয়ে রাখব। বাংলা মিস পরের বার যখন কানে ধরবে তখন ইলেকট্রিক শক খেয়ে ধুরুম করে পড়বে!” বিষয়টা চিন্তা করেই বল্টু পেটে হাত দিয়ে খিক খিক করে হাসতে থাকে!
ইনডাকশান কয়েলটা পুরোপুরি দাঁড় করাতে বল্টুর অবশ্যি কয়েকদিন লেগে গেলো। দুটো টার্মিনাল কানে লাগানোর ব্যবস্থা করতেই তার সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে কাজ করছে কী না সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে নান্টু যা একটা ইলেকট্রিক শক খেলো সেটা আর বলার মতো নয়!
.
পরের দিন বল্টু যখন স্কুলে যায় তখন রিতু বলল, “তোর কানে এটা কী লাগানো?”
“ইনডাকশান কয়েলের টারমিনাল।”
রিতু ভুরু কুচকে বলল, “সেটা আবার কী?”
“তুমি বুঝবে না আম্মু।”
“চেষ্টা করে দেখ, বুঝতেও তো পারি।”
ব্যাপারটা আম্মুকে বুঝালে আম্মু সেটা তার কানে লাগিয়ে স্কুলে যেতে দেবে বলে মনে হয় না। তাই সে হাত নেড়ে বলল, “স্কুল থেকে এসে তোমাকে বুঝাব।”
রিতুর তাড়াহুড়ো ছিল তাই সে আর জোর করল না। তবে জোর করা উচিত ছিল সেটা টের পেলো ঘণ্টাখানেকের মাঝেই, যখন স্কুল থেকে হেড মিস্ট্রেস তাকে ডেকে পাঠালেন, খুব নাকী জরুরি ব্যাপার।
রিতু প্রায় ছুটতে ছুটতে স্কুলে গিয়ে দেখে হেড মিস্ট্রেসের ঘরে বল্টু বসে আছে। রিতুকে দেখে ফিস ফিস করে বলল, “আম্মু, আজকে যা একটা মজা হয়েছে!”
হেড মিস্ট্রেস তার দিকে কটমট করে তাকাতেই বল্টু চুপ করে গেলো। রিতু দুশ্চিন্তিত মুখে হেড মিস্ট্রেসকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
হেড মিস্ট্রেস বললেন, “আপনি এই ছেলেটির গার্জিয়ান?”
“হ্যাঁ।” রিতু শুকনো মুখে বলল, “বল্টু আমার ছেলে। কী হয়েছে?”
হেড মিস্ট্রেস বললেন, “আমি ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।” তারপর বল্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বল্টু, তুমি একটু বাইরে অপেক্ষা কর। আমি তোমার মায়ের সাথে একটু কথা বলি।”
বল্টু মাথা নেড়ে বাইরে গেলো। তার মুখে হাসি ঝলমল করছে। যেটাই হয়ে থাকুক তার ভারী আনন্দ হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
হেড মিস্ট্রেস মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বললেন, “আজকে বাংলা ক্লাস একটা একসিডেন্ট হয়েছে।”
“কী একসিডেন্ট?”
“আপনার ছেলে কী একটা যন্ত্র নিয়ে এসে সেটা দিয়ে বাংলার টিচারকে এমন ইলেকট্রিক শক দিয়েছে!”।
রিতু চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
হেড মিস্ট্রেস বললেন, “এতো ছোট বাচ্চা এরকম ডেঞ্জারাস যন্ত্রপাতি পেয়ে যাচ্ছে, আপনাদের এটা দেখা উচিত।”
রিতু বলল, “আসলে আমরা ওর হাতে কিছু দেই নাই। সে নিজেই এগুলো বানায়।”
হেড মিস্ট্রেস চমকে উঠে বললেন, “কী বললেন? কী বললেন আপনি? সে নিজে বানায়? নিজে?”
“হ্যাঁ।” রিতু ভয়ে ভয়ে বলল, “ছেলেটার বিজ্ঞান নিয়ে খুব কৌতূহল, দিনরাত কিছু না কিছু বানাচ্ছে। আমার জীবন অতিষ্ঠ। আপনাদের জীবনও অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। আই এম সরি।”
হেড মিস্ট্রেস তখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। চোখ বড় বড় করে বললেন, “সে নিজে তৈরি করে? এতো ছোট ছেলে?”
রিতু মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।”
“কিন্তু এতো জিনিস থাকতে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার যন্ত্র আবিষ্কার করল কেন?”
রিতু বলল, “আমি ঠিক জানি না। তবে অনুমান করতে পারি।”
হেড মিস্ট্রেস জিজ্ঞেস করলেন, “কী অনুমান করছেন?”
“আমার মনে হয় কোনো টিচার হয়তো কানে ধরে শাস্তি দিয়েছে। ব্যাপারটা পছন্দ করে নি, তাই কানে এই যন্ত্রটা লাগিয়ে রেখেছে!”
“আপনার তাই ধারণা?”
“হ্যাঁ। বল্টুকে ডেকে জিজ্ঞেস করি?”
“ঠিক আছে।”
রিতু বল্টুকে ডাকলো। মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তোর কানের যন্ত্রটা কই?”
“এখন তো অংক ক্লাস সেই জন্যে সাকিব ধার নিয়েছে।”
“ধার নিয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
বল্টু হাসি হাসি মুখে বলল, “সাকিব তো একেবারে অংক পারে না, সেজন্যে! স্যার যেই কান ধরবে”
বল্টুর কথা শেষ হবার আগেই দূরে কোনো একটা ক্লাসরুম থেকে একটা গগনবিদারী শব্দ শোনা গেলো। কিছুক্ষণের ভেতরেই কালো মুশকো চেহারার একজন হাঁপাতে হাঁপাতে হেড মিস্ট্রেসের ঘরে এসে ঢুকলো, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ম্যাডাম। আপনি বিশ্বাস করবেন না কী হয়েছে!”
“আপনি ইলেকট্রিক শক খেয়েছেন?”
কালো মানুষটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, “আ-আপনি কেমন করে জানেন?”
“তার আগে বলেন, আপনি কী কোনো ছেলের কানে ধরেছেন?”
কালো মানুষটা বলল, “মানে—মানে–”
“আমাদের স্কুলে কখনো কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার কথা না। কারো কানে ধরার কথা না”
“কিন্তু মানে—”
হেড মিস্ট্রেস শক্ত মুখে বললেন, “আমি আপনার সাথে এটা নিয়ে পরে কথা বলব। এখন ক্লাসে যান।”
কালো মানুষটা মুখ আরো কালো করে চলে গেলো। তখন হেড মিস্ট্রেস বল্টুকে ডাকলেন, “বল্টু এদিকে এসো।”
বল্টু কাছে এগিয়ে গেলো। হেড মিস্ট্রেস জিজ্ঞেস করলেন, “ইলেকট্রিক
শক দেওয়ার এই যন্ত্রটা তুমি তৈরি করেছ?”
বল্টু মাথা চুলকে বলল, “মানে আসলে তৈরি করতে চাই নাই কিন্তু
হেড মিস্ট্রেস বল্টুর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “ইট ইজ অলরাইট। তুমি ঠিকই করেছ। তবে–”
“তবে কী?”
“এর পরের বার তুমি যখন কিছু একটা আবিষ্কার করবে সেটা ব্যবহার করার আগে তুমি আমাকে দেখিয়ে নেবে।”
“আপনি দেখবেন?”
“দেখব।”
“আমার এক কাগজে দুই হোমওয়ার্ক করার আবিষ্কারটা দেখবেন?”
“অবশ্যই দেখব।”
“বাংলা মিস আর ইংরেজি স্যার দেখতে চায় নাই!”
হেড মিস্ট্রেস বল্টুর মুখের কাছে তার মুখটা নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, “তারা কাজটি ঠিক করেন নি। আমি সবসময় দেখব। ঠিক আছে?”
“আমি এখনই নিয়ে আসব?”
“না, এখনই আনতে হবে না। পরে আনলেও হবে।”
“আমার অন্য আবিষ্কারগুলোও দেখবেন?”
“অবশ্যই দেখব। তুমি নিয়ে এসো, ঠিক আছে?”
বল্টু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
“যাও। ক্লাসে যাও।”
বল্টু ক্লাসে চলে যাবার পর হেড মিস্ট্রেস রিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই আপনার ছেলে নিয়ে খুব গর্বিত। তাই না?”
রিতু মাথা নাড়ল, বলল, “আসলে ব্যাপারটা সেরকম না।”
“ব্যাপারটা কী রকম?”
“আপনি নিজেই টের পাবেন।”
“কীভাবে টের পাব?”
রিতু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “কখনো কোনো পাগলকে সঁকো নাড়ানোর কথা বলতে হয় না। আমরা বলি না। আপনি বলেছেন। এর দায় দায়িত্ব কিন্তু আর আমার না–আপনার!”
হেড মিস্ট্রেসের এক মুহূর্ত লাগলো কথাটা বুঝতে, যখন বুঝতে পারলেন তখন জোরে জোরে হাসতে শুরু করলেন।
রিতুর হাসার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু হেড মিস্ট্রেসকে দেখে না হেসে পারল না।