আবার পানি কাটা, ঢেউ ভাঙা। দীর্ঘ একটানা পাড়ি।
সমুদ্রের হু-হু হাওয়া আর ঢেউয়ের দোলায় বুঝি কেটে যায় বন্দরের ঘোর। আবার ওরা সাগরের নাবিক, ভাসমান তরীর নির্ভীক কাণ্ডারী। ধীর শান্ত স্থির।
ঘুম ভেঙেই বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ল কদম। খুলে দিল ক্যাবিনের জানালা। খোলা বুকটাকে মেলে ধরল বাতাসের ঝাপটার মুখে। যতদূর যেতে পারে ততদূর ছেড়ে দিল চোখ দুটোকে।
উষায় এই সমুদ্র আর আকাশ, বিচিত্র তার শোভা। সেই চৌদ্দ বছর বয়স থেকে গেল পনেরোটি বছর দেখে আসছে কদম। তবু যেন পুরনো হয় না। চোখটা লেগে থাকে, উঠে আসতে চায় না।
সকাল দুপুর বিকেল নানা বেলার নানা আকাশ, নানান মেঘ আর নোনা পানির রঙ-এ সব নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় না কদম। কদম যেন বুঝেও না এসব, এত রঙ এত রূপের কৌতুক। লালচে পানি, কালচে পানি, ধলা পানি, পোড়ামাটির পানি থৈ থৈ নীলটার দিনে-রাতে এতবার পোশাক বদল, বুঝি মাথা গুলিয়ে যায় কদমের। তালগোল পাকিয়ে যায় আকাশের লীলা দেখে থৈ থৈ নীল বদলাবে তার পোশাক আর তারই সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশ বদলাবে তার রঙ। লাল রঙ, গোলাপি রঙ, সিসা রঙ, ধলবরন, কুচবরন– কত যে রঙের পাখনা, বাহারি রঙ আকাশটার। সত্যি মাথা গুলিয়ে যায় কদমের।
তবু কী যে কেরামতি এই সমুদ্রের! সমুদ্রে এসেই কদমের চোখজোড়া আপনা আপনিই চলে যায় বিশাল বেশুমার ওই বিস্তৃতির রাজ্যে। যেখানে আকাশ আর পানির বিচিত্র লীলা, ক্ষণে-ক্ষণে রঙ বদল ঢং বদল বেশ বদল।
আজও এই ভোরের লগ্নে আসমান আর সাগরের রঙের খেলায় চোখ জোড়া ডুবে থাকে কদমের। চোখ দুটো উঠে আসতে চায় না।
পুবের দিকটায় যেখানে আকাশটা নেবে এসে বুক দিয়েছে সমুদ্রকে সেখানে এখন প্রথম সূর্যের অরুণারাগ। সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে উঠে আসছে সূর্যটা আর আকাশ তাকে বাড়িয়ে দিয়েছে সম্ভাষণের হাত। এ যেন কোন মহাজন্মের কোন মহাজাগরণের আনন্দ লগ্ন। তাই আকাশ চঞ্চল। বাতাস উদ্দাম। সাগর উচ্ছল।
তরঙ্গে তরঙ্গে বুঝি ছড়িয়ে পড়ছে সেই মহাজন্মের বারতা। আকাশের বিচিত্র বর্ণচ্ছটা দিকদিগন্তে উড়ে চলেছে এ জাগরণের শুভ ঘোষণার। আর উদ্দাম বাতাসটা লক্ষ আনন্দের ঢেউ হয়ে ছুটে চলেছে লোকালয়ে, অরুণ গহিনে, ঘুমন্ত
পৃথিবীতে, সেখানে পৌঁছে দেবে আনন্দ জাগরণের প্রথম খবর।
ভোরের সমুদ্র গম্ভীর নয়। মৌন নয়।
ভোরের সমুদ্র ভয়ংকর নয়। হিংস্র নয়।
ভোরের সমুদ্র যেন একটি মেয়ে, যে পেয়েছে জীবনে মধুরতম অভিজ্ঞতার প্রথম স্বাদ। আনন্দের পাত্র তার ভরে গেছে কানায় কানায়, অঙ্গে অঙ্গে তার মধুরতার মৃদুল ছন্দ। লক্ষ আনন্দে উপচে পড়তে চায় মেয়েটি, ভুবনময় জানিয়ে দিতে চায় ওর এই আনন্দবারতা। কিন্তু প্রথম অভিজ্ঞতার সেই মধুর শিহরণ, মনে পড়তেই লজ্জায় রাঙিয়ে যায় মেয়েটি। সলাজ কমনীয়তায় মনোরম হয়ে আপনার মাঝেই ভেঙে পড়ে, ঝরে পড়ে। ভোরের সমুদ্র যেন সেই মেয়ে।
এখন জাগরণের লগ্নে আনন্দ বিভোর সমুদ্র। ভোরের সমুদ্র লাল তরল সোনার তরঙ্গ খেলা। আকাশের সাথে তার কোলাকুলি বাতাসের সাথে কত চুমোচুমি।
আসমান আর সাগরের এখন একই রঙ। এটা বুঝি জন্মলগ্নের রঙ। গাঢ় লাল। তরল লাল।
সোনালি থালার মতো সূর্য। ধীরে ধীরে সাগরের কোল ছেড়ে উঠে আসছে। আকাশের আলিঙ্গনে। চারপাশে তার সোনালি বেশে মেঘের কুর্ণিশ।
সূর্যের মতো উজ্জ্বল রঙিন হাসিতে হেসে উঠল আকাশ আর সমুদ্র। দূর পৃথিবীর মানুষ এতক্ষণে টের পেল ভোর হয়েছে।
আর এখানে জাগরণের লগ্ন বুঝি শেষ। সূর্যের এখন অনেক তাড়া। সুপ্তিভঙ্গের আলসেমিটা কাটিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলছে সূর্য। লক্ষ্য তার ঊর্ধ্বলোক।
বদলে যাচ্ছে সমুদ্র আর আকাশের রঙ। গাঢ় সোনালি হয়ে এলো ফিকে লাল। ফিকে লাল হাল্কা গোলাপি আর নীলের মিশেলে বিচিত্র রঞ্জন আকাশের গায়ে। সেই রঞ্জিত আকাশের প্রতিবিম্ব নিচের নীলাম্বু আরশিতে!
আর এই মুহূর্তেই, আকাশ আর সমুদ্র পরস্পরের আলিঙ্গন থেকে যেন ছিটকে পড়ল। ছিটকে পড়ল অনেক দূর। পুবের সীমানায় রক্তরাখিতে গড়ে উঠেছিল যে মিতালি সে রাখির সুতোটা যেন আচমকাই ছিঁড়ে গেল। তাই এখন ওরা কেউ আর কারো খবর রাখছে না। মেঘের পেখম মেলে আকাশ নাচছে সূর্যকে ঘিরে। আর সমুদ্র চলেছে আপন মনে, উচ্ছল ছলছল কলকল অনাদি কোন গানের সুরে।
হঠাৎ বেজে উঠল ঘণ্টা। বিপদের ঘণ্টা। চোখের নিমেষে ক্যাবিন ছেড়ে ছুটে গেল কদম।
আগুন লেগেছে জাহাজের সেকেন্ড হোল্ডে। বলকে বলকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বাতাস এসে উসকিয়ে দিচ্ছে আগুনটা। এখনি বুঝি সর্বনাশা আগুন ছড়িয়ে পড়বে সারা জাহাজে।
চারদিকে মহাসাগরের অথৈ পানি। তারই মাঝে আগুন লেগে গেছে রুতুন্দা জাহাজে। পাড়ের মানুষের কাছে এটা একটি খবর। তার বেশি নয়। কিন্তু রুতুন্দা জাহাজের নাবিক, ওদের কাছে এটা জীবন-মরণের লড়াই। হয় আগুন নিভবে, অক্ষত থাকবে জাহাজের শরীর, কলকব্জা। নতুবা সর্বনাশা আগুন গ্রাস করে নেবে গোটা জাহাজটাকে। লিকলিকে শিখাগুলো খোলের উপর জুড়ে দেবে প্রমত্ত নাচন। দেখতে-দেখতে ছাই হবে কোটি টাকার পণ্য। দগ্ধ খোলের গায়ে জাগবে ফুটো, ফেটে যাবে খোলটা। পানি ঢুকবে গলগলিয়ে। সওদাগরি জাহাজ রুতুন্দা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে আটলান্টিকের অতলে। তখন ক্লান্ত ব্যর্থ নাবিকের দল প্রাণটা হাতে লয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে অথৈ-পানি মহাসাগরের অজানায়। রুতুন্দা তলীর কাণ্ডারী, ওরা হুঁশিয়ার। ঝড়-ঝঞ্ঝায় ওরা নির্বিচল। দুর্যোগের মুখে দুঃসাহসী। সবাই মিলে ওরা আগুনটাকেই ঘিরে ধরেছে। সক্রিয় হয়েছে পাম্পগুলো। হাতে হাতে পাইপের মুখগুলো নিবদ্ধ আগুনের দিকে। অগ্নিনির্বাপণী শতসহস্র তীরের মতো পানির ধারা ছুটে পড়ছে আগুনের ওপর।
কিছুক্ষণের ভেতর আয়ত্ত হয়ে গেল আগুনটা। অক্ষত রইল জাহাজ। পুড়ে গেছে কিছু পণ্য। তা নিয়ে মাথা ঘামায় না নাবিকের দল। ওদের মায়া জাহাজের জন্য।
বুঝি সফল সংগ্রামের কৃতী অধিনায়ক কাপ্তান হিকস। তাই আনন্দে ডেকের ওপরই ধেইধেই নাচ শুরু করে দিয়েছে হিকস। হাতে হাতে বিলিয়ে দিয়েছে বোতল। খুলে দিয়েছে রসদের ঘর। আজকের জন্য কোন কিছুতেই মানা নেই, নিষেধ নেই।
কদমের চোখে বুঝি ঘোর ধাঁধা হিকস সাহেব। বৌর অসুখ সংবাদে কেঁদে বুক ভাসায় হিকস। আরোগ্য খবরে রাস্তার মাঝে নাচে, ফুর্তি করে, বন্দরের মেয়েকে নিয়ে শুতে যায় ক্যাবিনে। সামান্যতেই রেগে যায় হিস, মুখ খারাপ করে, গালির চোটে তুলে নেয় কালা আদমির গায়ের চামড়া। কিন্তু খুশির মুহূর্তে সে যেন পৃথিবীর সম্রাট, গোটা পৃথিবীটাই বিলিয়ে দেবে আপন নাবিক সাথীদের। হিক সাহেবের মতো অমন দিল খুলে খুশি বানাতে আর কাউকে কখনো দেখেনি কদম। এ বুঝি সাদা চামড়ার ধর্ম, ভাবে কদম। হাতে হাতে বোতল ঘুরে চলেছে, আর ঘুরে চলেছে শুকনো মাংসের প্যাকেটগুলো। মৃত্যুকে হটিয়ে দিয়েছে ওরা। মৃত্যুর গহ্বর থেকে ছিনিয়ে এনেছে প্রাণ। তাই প্রাণ বয়ে ওদের ফুর্তির বান।
মাংসের শুঁটকি দিয়ে পেটটাকে ঠেসে নেয় কদম। তারপর আলগোছে আনন্দের ভিড়টা ছেড়ে উঠে আসে নিজের ক্যাবিনের পাশে খোলা ডেকটায়। সকালের সেই লাল সূর্যটা এখন মাথার উপর। মাথার উপর সাদা আগুনের গোলাকার পিণ্ড হয়ে অবিশ্রাম জ্বলে চলেছে।
আর সেই আকাশটা, যেন আরো দূরে সরে গেছে। দূরে গিয়ে দিব্যি বসে আছে মসজিদের মাথায় প্রকাণ্ড গম্বুজটির মতো। সকালবেলাকার সাগরের সঙ্গে এত যে মাখামাখি কোলাকুলি, সেসব কথা যেন মনেই নেই তার।
নিচের সমুদ্রের পানিটা এখন ঘন নীল। ঘন নীলের বুকে রুপালি রৌদের ঝিকিমিকি খেলা। ঢেউয়ের পিঠে পিঠে নীলে শুভ্রতায় ঝিলমিলি নকশা। অমন যে রোদ, সাগর পানির ছোঁয়া পেলে কেমন নরম হয়ে গলে যায়। মিয়ে যায়। সেকেন্ড হোল্ডের সেই আগুনের আঁচ লেগে চোখ-মুখটা কেমন তেতে গেছিল কদমের। মহাসাগরের নীল মেখে স্নিগ্ধ হলো, ঠাণ্ডা হলো ওর চোখ জোড়া।
লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ছুটে ছুটে আসছে ঢেউ। আছড়ে পড়ছে আর একটি ঢেউয়ের কোলে। ঢেউয়ের পিঠে ঢেউ। ঢেউ ঢেউ ঠোকাঠুকি কোলাকুলি। অবাক হয়ে ভাবে কদম, কতদূর থেকে আসে ঢেউগুলো? বুঝি অনেক দূর থেকে। অনেক দূরে সহস্র ঢেউ মিলে তৈরি হয় একটি বিরাট ঢেউ। সেই ঢেউটা কী আক্রোশে, কী এক গর্জনে ক্রুদ্ধ সাপের মতো ফণা উঁচিয়ে তেড়ে আসে। ওই যে আসছে। একটার পেছনে আর একটা। কদম গুনে চলে, দুটো তিনটে পাঁচটা আরো…আরো…আরো গোণা হয় না। কাছের ঢেউটা একেবারে চোখের সুমুখে এসে পড়েছে।
কাছে আসতে আসতে যেন আরো বিশাল হয়, আরো ফুলে ওঠে ঢেউটা। উঁচু হয় পর্বতের মতো। মনে হয় অমন একটি ঢেউয়ের আঘাতে গুঁড়িয়ে যাবে জাহাজটা। জাহাজটাকে চুরমার করে দিয়ে, জাহাজটার উপর দিয়েই চলে যাবে ঢেউয়ের পর্বত। কিন্তু, কী আশ্চর্য! জাহাজটার কাছে এসেই যেন পরম বাধ্যতায় গা-টা ছেড়ে দেয়, মাথাটা নিচু করে নেয় ঢেউ। অতি অবজ্ঞায় বিশাল সেই পানির পাহাড়টাকে পাশে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় রুতুন্দা জাহাজ।
সাগরের বুঝি এক লহমার বিশ্রাম নেই, শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। কী এক বিক্ষোভে, কী এক বেদনায় যেন আপনার মাঝে আপনিই নিরন্তর মাথা কুটে মরে সমুদ্রটা। আপনার মাঝেই গর্জে গুমড়ে ফুলে ফুলে একাকার হয়। তরঙ্গে তরঙ্গে বুঝি সেই অস্থিরতারই প্রকাশ, ক্ষুব্ধ সেই বেদনারই কান্না। এই বিক্ষোভ এই অস্থিরতা, এ বুঝি অনন্ত যুগের, মহাকালের। এ বেদনার কোন শেষ নেই।
কদম এসব কথা ভাবে না। ও ভাবে, ওই সাগরের সাথে তার গড়ে উঠেছে কী এক আত্মীয়তা, কী এক মমতার বন্ধন। হাজার চেষ্টা করেও এ বন্ধন বুঝি কোন দিন ছিঁড়তে পারবে না কদম। সাগরটা যেন ওর আপন। যেমন আপন নবিতুন। যেমন আপন আককি।
নবিতুন বলত, ওই শরবতির বাপ, ওই কোরবান, জাহাজের কাজ ছেড়ে জমি কিনেছে ওরা। তুমি কেন কিনছ না এক কানি জমি?
নবিতুনের কথাটাকে আমল দিত না কদম। জমির কথাটা নিরুত্তরে যাওয়ায় নিজের কথা বলত নবিতুন, মানুষটাকে বিদেশ পাঠিয়ে কোন বৌ শান্তি পায়? জিন্দেগিটাই কি এমনি বিদেশ করে কাটাবে সারেং? তবু চুপ থাকত কদম। ওর নীরবতায় বুঝি উৎসাহ পেত নবিতুন। বলে চলত নবিতুন, ক্ষেতখামার গেরস্তের লক্ষ্মী। ক্ষেতি নেই খোন্দ নেই, সে কেমন গেরস্ত গো?
এবার উত্তর না দিয়ে থাকতে পারত না কদম। কদম বলত, আমি যা রোজগার করে আনি গেরস্তিতে যে তার অর্ধেকও পাবি না নবিতুন!
তখখুনি জবাব দিত নবিতুন। — থাক রোজগার। গেরস্তি কর। গেরস্তিতে আয়। গেরস্তিতে লক্ষ্মী।
কিন্তু নবিতুনের কথায় কোন দিনই সায় দেয়নি কদমের মনটা। ছুটির দিনগুলো শেষের দিকে কেমন একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর মনে হতো কদমের। হাঁসফাঁস করত কদম। মনে হতো সমুদ্র যেন ডাকছে ওকে। সাড়া দিয়ে সমুদ্রের কোলে ফিরে আসার জন্য কেমন অস্থির হয়ে উঠত কদম।
ফিরবার দিনটা যতই ঘনিয়ে আসত ততই বেড়ে যেত সেই অস্থিরতাটা। আর বেড়ে যেত নবিতুনের আবদার, অনুযোগ, চোখের পানি। লতার মতো কদমের গলার সাথে ঝুলে থাকত নবিতুন, কিছুই বলতে পারত না। বলার মতো কথা সবই চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ত।
আপন বুকের উপর ধরে রাখা নবিতুনের বুক। সে বুকের ধুকধুক পিটুনি, কান্নার শব্দ সবটাই শুনতে পেত কদম! কিন্তু মন যে তার চলে গেছে মহাসাগরের নীলে। নবিতুনের বাহুজোড়া আস্তে ছাড়িয়ে আলগা হতো কদম। বিদায় নিত!
দেশে মাটির আশ্রয়ে নবিতুনের উষ্ণতায় কয়েকটা দিন কাটতে না কাটতেই কদমের কানে বাজে সমুদ্রের গান। আর এই সমুদ্রের পানি কেটে কেটে চলতে গিয়ে কেবলই মনে পড়ে ডাঙায় সেই শক্ত মাটির কথা, দেশের কথা, ঘরের কথা, বৌ নবিতুনের কথা। ইচ্ছে করে কদমের উড়ে যায় বামনছাড়ি গ্রামের সারেং বাড়ির সেই উত্তরের হিস্যায়। কেন এমন মনে হয়? এ রহস্যের কোন কিনারা পায় না কদম।
এ যেন একই স্রোতের দুমুখী টান। যখন ও নবিতুনের বুকে তখন সমুদ্রের পিছুটান। আর যখন ও সাগরের কোলে তখন দেশের ডাক, নবিতুনের টান! এ বড় রহস্য। এই একই স্রোতের দুমুখী টানের কোন মীমাংসা আছে কি? এমনি সব কথা ভাবতে ভাবতে কখন বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে কদম। ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙে সেই সন্ধ্যার দিকে। চলে যায় ইঞ্জিন ঘরে। ডিউটি শেষ করে ফিরে আসে মাঝরাতে। আবার ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে ওঠে সকালবেলায়। জেগে উঠে খুলে দেয় সেই জানালাটা। চোখ জোড়া ছেড়ে দে আদিগন্ত সমুদ্র-বিস্তারে।
সেই সোনালি জল, রুপালি জল, নীল জল।
সোনালি ঢেউ, রুপালি ঢেউ।
সেই ঢেউয়ের আরশিতে যেন নবিতুনের মুখ। বুঝি সোনা-রুপা অলংকার পরা ওই নীল ঢেউগুলোর মতোই ঝলমলিয়ে ডগমগিয়ে হাসছে নবিতুন। বন্দব ছাড়তে না ছাড়তেই বন্দরের সেই উদ্ভ্রান্ত করা, ভ্রষ্ট করা নেশাটাও কেটে গেছে কদমের। এখন নবিতুনের কথাটা মনে পড়তেই নবিতুনের মুখটাও ভেসে ওঠে। চোখের সুমুখে। স্পষ্ট পরিষ্কার মুখ। সেই শঙ্খশুভ্র বাহু, সেই নীল চোখ জেগে উঠে ঝাপ্সা করে না নবিতুনের মুখ। বন্দরের এ এক কারসাজি যেন। নবিতুন বলে জাদু– জাদুর ফাঁদ। সত্যি ফাঁদই বুঝি। বুঝি জাদুর ফাঁদ। নইলে বন্দরের মেয়ে মানুষ, বন্দরের আলো ধাঁ ধাঁ, বন্দরের বিপণি– হোক তার যত কারসাজি– কেমন করে ভুলিয়ে দেয় ঘরের কথা?
ডি সিলভা, হিকস অথবা মন্তু সারেংয়ের মতো কদম তো কখনো উন্মত্ত হয়নি বন্দরের নেশায়। কদম ছোঁয় না হারাম রুজি। কদম ছোঁয় না হারাম পানি। খোদার কসম আছে, বাপের দোহাই আছে। হয়তো সে জন্যই হারামের পথে পা চলে না কদমের।
তবু বন্দরে পা রেখে বেঘোর হয়, বেখেয়াল হয় কেন কদম? কেন ভুলে যায় শান্ত বধূ নবিতুনের মুখটি?
নেশা নেশা। না, নেশা নয়। এ সেই জাদুকরি ফাঁদ, বন্দরের ফাঁদ, যে ফাঁদকে এত ডর নবিতুনের। ফাঁদও নয়। জাদুও নয়। এ এক ধাঁধা, বন্দরের ধাঁধা। এ ধাঁধার কোন জবাব নেই কদমের কাছে। চিরকালের নাবিক এ ধাঁধার রহস্যে বন্দি। মুক্তি নেই তার।
এও বুঝি সাগরের কেরামতি। কেননা বন্দর থেকে দূরে এই সাগর পানির নীল আরশিতে শুধু নবিতুনের মুখ। বন্দর মেয়ের কথা মনেও পড়ে না কদমের। অবাক হয়েই ভাবে কদম, কত কেরামতি সমুদ্রের।
নবিতুনকে নিয়ে এখন আর দুর্ভাবনা নেই কদমের। রুতুন্দা জাহাজে চড়বার আগেই সালেক সাহেবের সাথে ব্যবস্থা করে এসেছে কদম। তিন মাস বাদ বাদ কোম্পানির কাছ থেকে মাইনে বাবদ কিছু টাকা নেবে সালেক সাহেব। টাকাটা পাঠিয়ে দেবে বামনছড়ি।
হিন্দুস্তান-পাকিস্তান। টাকা পাঠানোর কত ঝক্কি। তবু সালেক সাহেব যখন দায়িত্ব নিয়েছে নিশ্চিন্ত কদম। নবিতুন ঠিকমতোই টাকা পাচ্ছে। নিশ্চিন্ত হয়েও মাঝে মাঝে খটকা লাগে মনে। সেই কলম্বোতে চিঠি পেয়েছে নবিতুনের। তারপর ভারতমহাসাগর পেছনে ফেলে আটলান্টিকটাও এপার-ওপার পাড়ি দেয়া সারা, কিন্তু আর কোন চিঠি নেই নবিতুনের। যেখানেই থেমেছে জাহাজটা সেখানেই একটি করে চিঠি ডাক বাক্সে ফেলেছে কদম। নবিতুনের তরফ থেকে একটি চিঠিরও জবাব নেই, একটি প্রাপ্তি স্বীকার নেই।
কেমন আনমনা হয়ে যায় কদম। খটকা লাগে, চিঠিগুলো কি পাচ্ছে না নবিতুন? কলম্বোতে পাওয়া চিঠিটার ঠিকানা ছিল খিদিরপুরের। বুঝি সালেক সাহেবই ঠিকানাটা কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে কলম্বোর দিকে। নবিতুন কি তবে জানে না রুতুন্দা জাহাজের ঠিকানা? পায়নি কদমের চিঠি পেয়েছে নিশ্চয়। পায়নি এমন তো কখনো হয়নি? আসল কথা, নবিতুন তো আর চিঠি লিখতে জানে না, চিঠি লেখার জন্য লোক খুঁজতে হয় ওকে। হয়তো লোক পাচ্ছে না লেখার। তাই এত দেরি।
কিন্তু মনকে তো আর যা খুশি তা বুঝান যায় না? দুমাস, দুমাসের জায়গায় না হয় চার মাস লেগে গেল নবিতুনের চিঠি লেখার লোক খুঁজতে। এদিকে তো বছর ঘুরে এলো। এর মাঝেও কি নবিতুন চিঠি লেখার লোক খুঁজে পেল না? না, মনকে অত সহজে বিশ্বাস করতে পারে না কদম।