০৮. আধুনিক সোভিয়েট সাহিত্য

অষ্টম অধ্যায় – আধুনিক সোভিয়েট সাহিত্য

জীবনের সঙ্গে শিল্পের ও সাহিত্যের যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে এ—কথা সর্ববাদীসম্মত। জীবনের ভিত্তি যখন নড়ে যায়, যখন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আঘাতে জীবনের প্রাচীন অর্থ, আদর্শ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, সমস্ত জীবনাকাশে যখন বিচিত্র রঙের রোমাঞ্চ তুলে এক নূতন আদর্শ সূর্যোদয়ের মতো চারদিকে তার দীপ্ত আহ্বানের গম্ভীর প্রতিধ্বনি তোলে, তখন শিল্পেরও রূপান্তর ঘটে। জীবনের নূতন স্বচ্ছন্দ গতিবেগের সঙ্গে সাহিত্য তখন মিলিত হয়ে যায়। একদিন রুশ কবি পুশকিন (Pushkin) দুঃখ করেছিলেন যে তাঁর কবিতার সৌন্দর্য উপলব্ধি করবার মতো মানুষ রাশিয়াতে খুব কম আছে, কারণ রাশিয়াতে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুব কম। পুশকিনের যুগ কেটে গিয়েছে এখন। এখন রাশিয়াতে জনগণের সামনে সমাজতন্ত্রবাদের যে নূতন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তাতে তাদের জীবনের বিস্তৃতি বেড়ে গিয়েছে অনেক, জীবনের অর্থের ও সৌন্দর্যের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সুন্দরের কোনো স্বতন্ত্র সত্তা এখন আর নেই। নন্দনশাস্ত্র (Aesthetics) আজ গৃহকোণের বধূর নির্জনতাকে বিসর্জন দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মানুষের কোলাহলময় হাটের মাঝখানে, আজ জনগণের জনতাতেই তার বসতি, তাকে আজ সিংহাসন গড়তে হবে ভুয়ো কল্পনার চুনিপান্না দিয়ে নয়, পথের ধূসর ধূলিকণা দিয়ে। তাই ওলেশা (Olesha) ও ব্যাবেলের (Babel) মূল্য আজ কেউ দিতে চাইবে না, কারণ মানুষের নূতন জীবনের জয়গান তাঁরা গাননি, সে—জীবনের উদবোধনী বাণী তাঁদের হৃদয়ের কেন্দ্রমাঝে ধ্বনিত হয়নি। অবশ্য শিল্পীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা আমাদের নৈতিক কর্তব্য, কিন্তু মানুষের জীবনের মতো শিল্পের জীবনও স্থাণু নয়। জীবনের মতো শিল্পও গতিশীল, ডোবার মতো বদ্ধতা ও সংকীর্ণতা তার বৈশিষ্ট্য নয়, নদীর মতো বৈচিত্র্য ও গতিশীলতাই হচ্ছে তার ধর্ম। শিল্পীর যে অহংকার তা ওই ধর্মকে পালন করে, তাকে অস্বীকার করে নয়। মানুষ কী চায়? মানুষ চায় তার জীবনের সত্য রূপ শিল্পের মধ্যে প্রতিফলিত হোক। সামাজিক দুর্বলতা ও দোষত্রুটির অতিসচেতনতা এবং তাকে নূতনভাবে ভেঙেচুরে গড়বার মতো অনুপ্রেরণা ও শক্তির অভাবের ফলে শিল্পীর সামনে নানারকম ভৌতিক কাল্পনিক জগতের আবির্ভাব হয়, যেখানে হয় তাঁরা কাপুরুষের মতো আশ্রয় নেন সংস্কারকের জাঁকালো মুখোশ পরে, আর না—হয় এক বায়বীয় অবাস্তবতার আড়ালে নিজেদের অক্ষমতাকে গোপন করে রাখেন। মাতাল কবি ব্লক (Alexander Blok) তাঁর ক্লিন্ন পারিপার্শ্বিকতায় অসন্তুষ্ট হয়ে শেষকালে সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন মদের গ্লাসের তলায়। নীরস ব্রুসভ (Brusov) পার্থিব বাস্তবতাকে এক বিরাট শূন্যতার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

“I fashioned in deep meditation
A world in which nature was far,
Before which to a vast desolation
Plains, waters and mountain compare.”

সমাজতন্ত্রবাদের সোনার কাঠির ছোঁয়া লেগে রাশিয়ার সংঘবদ্ধ চাষিমজুরের দল আজ নবজীবন লাভ করেছে, আজ তাদের নৈতিক স্বাস্থ্য অনেক উন্নত, তাদের মানবিক শক্তি প্রচুর। আজ তারা দেখতে চায় শিল্পের মধ্যে তাদের নিজেদের জগৎকে, যে—জগৎকে তারা ঘাম আর রক্তের ভিত্তির উপর নিজেদের হাতে গড়ে তুলেছে। মাকড়সার মতো কবি বা শিল্পী কোনো ভৌতিক জগতের জাল বুনুক—এ তারা কেউই চায় না।

চার্নিশেভ্স্কি (Chernishevsky) বলেছিলেন যে শিল্পের চেয়ে জীবন হল বৃহত্তর। এই কথা বলে তিনি শিল্পকে জীবনের কাছে খাটো করেননি। তাঁর উদ্দেশ্যই তা নয়। এই কথা বলে তিনি শুধু সৌন্দর্যতাত্ত্বিকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন যে তাদের কাল্পনিক লক্ষ্য অর্থহীন ও ভিত্তিহীন, শিল্পের প্রধান লক্ষ্য হল জীবন। জগতের শ্রমজীবী শ্রেণি (Proletariat), যারা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম সর্বসাধারণের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ভিত্তিভূমির উপর নিজেদের আদর্শানুরূপ জগৎ গড়ে তুলেছে, চাষিরা যারা সমষ্টিবাদের সহায়তায় গ্রাম্য নির্বুদ্ধিতা ও নিঃসঙ্গতাকে বর্জন করে সম্মিলিত জীবনের অমৃতাস্বাদ পেয়েছে, তারা সকলেই চায় যেন সাহিত্যের মধ্যে কর্মাবলি ও কর্মীবৃন্দের রূপ সুন্দরভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। ধনিকগোষ্ঠীর বা অভিজাত সম্প্রদায়ের ইমারতের কোণে সাহিত্যের যে রসদ সঞ্চিত ছিল তা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে—আজ সাহিত্যের উপকরণ বহুল পরিমাণে ছড়িয়ে রয়েছে কারখানায়, শ্রমিকের গৃহকোণে, যন্ত্রের দানবীয় গর্জনে। স্ট্যালিন (Stalin) বলেন : “The people want literature to help them to root up the last remmant of the mentality of propertied individuals”—লোকে চায় প্রাচীনের যা কিছু ধ্বংসাবশেষ তাকে যেন লোকচক্ষুর সামনে প্রকাশ করা হয় সমসাময়িক সাহিত্যে বিদ্রুপ করে, তীক্ষ্ন নির্মম ভাষায় উপহাস করে। তাদের সাহিত্যে থাকবে সাম্যবাদী জগতে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে—সম্বন্ধ তার পরিষ্কার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, সাম্যনীতির জয়গান। সে—সাহিত্যের রূপ কুৎসিত বা বিকৃত হবে না, শুধু অর্থহীন শব্দচাতুর্য তার বৈশিষ্ট্য হবে না। সে—সাহিত্য হবে সবল, সুষ্ঠু, স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত, সৎ, সহজ ও সুন্দর।

এই সরলতার (Simplicity) অর্থ সরলীকরণ (Simplification) নয় বা আদিমতাও (Primitiveness) নয়। এর অর্থ জীবনের বর্ণহীন রেখাঙ্কনও নয়। রাশিয়ার জনগণ চায় দীপ্ত সরলতা, যে—সরলতার মধ্যে জীবনের সর্বাঙ্গীণ পরিপূর্ণতা পরিষ্ফুট হয়ে উঠবে, যে—সরলতার স্বচ্ছ সংকেতে বিপ্লবের প্রত্যেকটি স্তর সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। সাহিত্যকে এই সরল পোশাক দিয়ে ভূষিত করা সহজ নয়। লেনিন ও স্ট্যালিনের রচনা খুব সরল ও সুবোধ্য, কারণ সেগুলি মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাধারার সুন্দরতম বিকাশ : আর সেগুলি মুখ্যত লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে সহজভাবে পরিবেশন করবার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সরলতা : ‘artificiality’ নয়, ‘buffoonery’ নয় বা ‘muddleheadedness’ ও নয়। ফরম্যালিস্টরা content ‘involved form’—কে ঘৃণা করেন এবং একটা প্রচার করেন। এই ফরম্যালিজম্ সত্যবিরোধী, অর্থহীন ও মূল্যহীন। ঠিক তেমনি ন্যাচারালিজমও জীবনের সত্য অর্থ প্রকাশের পথে ভীষণ অন্তরায়। তাহলে এই সরলতা কী? ভি. কিরপোটিনের (V. Kirpotin) ভাষায় : “It is not the accumulation of self-sufficient literary traditions or professional habits, but changes in the people’s life that explain in the last resort the changes in the subject-matter, imagery and style of art” এবং “Soviet Literature, the literature of socialist realism, is a new literature, both in content and idea.” সোভিয়েট সাহিত্য সোশালিস্ট বাস্তবতার সাহিত্য, ভাবে ও ভাষায় এক সম্পূর্ণ নূতন সাহিত্য, যার সঙ্গে চিরাচরিত রীতিনীতির কোনো সম্বন্ধ নেই। সোভিয়েট সাহিত্য হচ্ছে সমাজতন্ত্রবাদের নূতন আদর্শে অনুপ্রাণিত মানবের অন্তরের অন্তরতর সত্যের সহজ ও সুন্দর অভিব্যক্তি, নিপীড়িত মানবতার নবজাগরণের, নবজীবনের বন্দনাগান। প্রাচীন আদর্শ, প্রাচীন ঐতিহ্যের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আজ সে নূতন মানবজগৎ প্রতিষ্ঠার জয়যাত্রায় বেরিয়েছে।

আমরা যখন আধুনিক পাশ্চাত্য লেখকদের লেখা পড়ি তখন কতকগুলি বিষয় আমাদের চোখের সামনে অতি সহজেই পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে। আমরা দেখতে পাই এইসব লেখকদের সর্বপ্রধান চিন্তা হচ্ছে মৃত্যুর বিভীষিকা আর নৈরাশ্যের অর্থহীনতা, মধ্যযুগে যখন মানুষ ভগবান বিশ্বাস করত সেই সময়ে এবং তার পরবর্তী যুগেও আমরা এই মৃত্যুর বিচিত্র কাব্যিক রূপ দেখতে পাই। পশ্চিমের আধুনিক শিল্পী ও সাহিত্যিকরা দেবতা বিশ্বাস করেন না, শুধু মৃত্যুচিন্তাতেই তাঁরা অধীর হয়ে উঠেছেন। মানুষের এই অবশ্যম্ভাবী বিরতির কথা স্মরণ করে তাঁরা জীবনের উপর কোনো মূল্যই আরোপ করতে চান না। একদল শিল্পী জগতের হারানো সৌন্দর্য ও সজীবতা ফিরিয়ে পাবার জন্য সকরুণ আর্তনাদ করেন, যেমন হেমিংওয়ে (Earnest Hemingway) ও হপকিন্স (G. M. Hopkins), আর জেমস জয়েস (James Joyce) প্রমুখ একদল শিল্পী জোর করে স্বেচ্ছায় সৌন্দর্যের অস্তিত্বের সম্ভাব্যতাটুকুও ধ্বংস করতে চান। জয়েসের সুদীর্ঘ যান্ত্রিক বিশ্লেষণ অত্যন্ত ‘undialictical’ ও ‘unconstructive’ এবং ফলে সাহিত্য না হয়ে গোটা জিনিসটা একটা ফিজিয়োলজি হয়, শুধু দৈহিক সম্বন্ধের ব্যাখ্যা ও পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার দুর্গন্ধ ভিন্ন আর কিছুই তাতে থাকে না। আমরা জানি এই মরণাত্মক ও নৈরাশ্যবাদের একমাত্র কারণ মরণোন্মুখ প্রাচীন সমাজ। বুর্জোয়া ইয়োরোপের তাই আজ সৃষ্টির ক্ষমতা লোপ পেয়েছে, শিল্পী আজ পঙ্গু, তার ভাষা আজ নিস্তেজ, রং পাণ্ডুর, তার চিন্তাশক্তি আজ অবশ হয়ে এসেছে।

And it seems to them that the death theme is the only theme for contemporary mankind. The artists of the West have no creative idea. They play, about with form. Instead of Beethoven’s mighty conversations with God, with destiny and with death, there is nothing left but bizarre combinations, disintegration of a fabric, interest in what is strange, occult, mad—(International Literature—No. 6, 1936). জয়সের এই ন্যাচারালিজম একটা দৃষ্টান্ত দিলেই পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। জয়েস লিখেছেন : “Cheese is the corpse of milk”—ক্ষীর হচ্ছে মৃতদুগ্ধ, অর্থাৎ দুধের মৃত্যু পর্যন্ত পাশ্চাত্য শিল্পীর কাছে সম্ভব। আজ পাশ্চাত্য শিল্পীর দৃষ্টিতে বুর্জোয়া ইয়োরোপের মৃত্যুমলিন হয়েছে, তাই আজ চারদিকে শুধু মৃত্যুর কালিমা, জীবনের স্পন্দন যেন থেমে গিয়েছে, এই ন্যাচারালিজম বা ‘formal conceits’—এ আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা চাই ‘artistic’ সত্য, ‘dialectical’ সত্য এবং সেই ‘dialectical’ সত্যানুসারে দুধ মায়ের বুক থেকে নিঃসৃত হয়ে শিশুর মুখের মধ্যে যায় এবং শিশু তা—ই পান করে সবল ও সুন্দর হয়ে জীবনধারণ করে। তাই আমাদের কাছে দুধ কোনোদিন মরে না।

পাশ্চাত্য শিল্পীর কথা থাক। সাহিত্যের বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এবং বাস্তবতার গুণে সাহিত্যের ইতিহাসে ম্যাক্সিম গোর্কি (Maxim Gorki) যুগান্তর আনলেন রাশিয়ায়। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে নিজনির এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং চার বৎসর বয়সে চর্মকার পিতাকে হারিয়ে গোর্কিকে আশৈশব ভীষণ দুঃখদুর্দশার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে হয়েছিল। তাছাড়া মাঝে—মধ্যে রাজপুরুষদের হুমকিও খেতে হয়েছে অনেক, কিন্তু সেসব গোর্কির জয়যাত্রার পথে শুধু ফুলই ছড়িয়েছে। তিনি সেই অকথ্য বিপর্যয়ের মাঝখানেও কোনোদিন লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। আজীবন মনে রেখেছেন যে গ্রাসাচ্ছাদন, স্ফূর্তি, হল্লা, শিক্ষা, সংস্কৃতি শুধু ধনিক সম্প্রদায়ের করায়ত্ত হলেই যথেষ্ট নয়। সভ্যতার একমাত্র ব্রত হচ্ছে সর্বসাধারণের উৎকর্ষসাধনে, শ্রমজীবীদের সুখসম্পাদনে। তাই তাঁর জীবনে অনবদ্য শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে অকাতর সমাজসেবার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখতে পাই। শুধু সাহিত্যের ভিতর দিয়ে নয়, সশস্ত্র রাজদ্রোহে পর্যন্ত সর্বান্তঃকরণে যোগ দিয়ে তিনি এই শ্রমজীবীদের অক্লান্ত সেবা করে গিয়েছেন। আইভান বুনিন (Ivan Bunin) প্রমুখ স্বদেশপলাতক লেখকদের মতো মাতৃভূমির কুৎসাপ্রচারে তিনি উৎসাহ দেখাননি। গোর্কি কোনোদিন মনুষ্যধর্মের বাদ সাধেননি, সাধারণ স্বত্ব ব্যতীত ব্যক্তিস্বরূপের পূর্ণ পরিণতি যে অসম্ভব তা বুঝতে পেরেই তিনি সাম্যবাদকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। গোর্কির হৃদয় অনেক বড়ো। তাঁর রচিত ‘ফোমা গাডেইয়েভ’, ‘দ্য মাদার’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলির জীবনবেদ অসাধারণ—এদের চরিত্র অত্যন্ত জীবন্ত। প্রাদেশিক কুসংস্কারের সূচিভেদ্য অন্ধকারও যে স্বাধীনতার জ্যোতির্ময় সূর্যকে চিরদিন আবৃত করে রাখতে পারে না তা এরা সকলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। গোর্কির ছোটোগল্পগুলি আরও চমৎকার, তাদের তুলনা হয় না। গোর্কির রসবোধ ও তীক্ষ্নদৃষ্টির দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘দ্য বার্থ অফ এ ম্যান’, ‘টোয়েন্টিসিক্স মেন অ্যান্ড এ গার্ল’, বিশেষ করে ‘লোয়ার ডেপথস’ উল্লেখযোগ্য। এগুলির মধ্যে তাঁর অসাধারণ রূপনৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। গোর্কির ভাষা চেখভ (Tchekoff) টুর্গেনিভের মতো মাত্রাজ্ঞানসম্পন্ন স্থির, ধীর ভাষা নয়, টলস্টয়ের মতো গম্ভীর, শান্ত ভাষা নয়। গোর্কির ভাষা সিংহের গর্জনের মতো। ‘ফোমা গাডেইয়েভ’—এর মুখ বন্ধ হার্মান বার্নস্টাইন লিখেছেন :

In its elementary power is the heart-rending cry of a sincere but suffering soul that saw the brutality of life in all its borrors, and now flings its experiences into the face of the world with unequalled sympathy and the courage of a giant.

রাশিয়ার আধুনিক তরুণ লেখকদের মধ্যে মিখেইল শোলোখভের (Mikhail Sholokhov) নাম সকলের কাছে পরিচিত। তাঁর ‘And Quiet Flows The Don’ বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস এবং তারপরে ‘Virgin Soil Upturned’। শোলোখভের রচনা যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুন্দর। তাঁর চরিত্রগুলি জটিল হলেও সেগুলি এমন সুকৌশলে চিত্রিত করা হয়েছে যে তারা সকলেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আধুনিক সোভিয়েট সাহিত্যিকদের মধ্যে এত সজীব করে, এত হুঁশিয়ার হয়ে চরিত্র সৃষ্টি করতে আর কাউকে দেখা যায় না। শোলোখভের বর্ণনার ক্ষমতাও অসীম। এই ক্ষমতার পরিচয় দেবার জন্য আমি ‘And Quite Flows The Don’ থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি :

“Grigori half turned to the company :

“Sabres out! Charge! After me, boys! Lightly grasping his sabre he was the first to cry : ‘Hurraaaah’! and experiencing a familiar, shivering lightness in his whole body, he let his horse go, the reins firmly grasped in his left hand, trembled, the blade lifted above his head whistlingly cut the current of the onrushing breeze.

“A huge white cloud that the spring wind had rolled up covered the sun for a minute and, overtaking Grigori, cast a seemingly slow-moving grey shade upon the hillock. Grigori shifted his glance from the nearing houses of Klimovka to this shadow which was slipping over the still moist soil of the hillock, to the brightly golden, joyful strip of light which was flying away somewhere ahead. Suddenly he had an inexplicable and unreasoning desire to overtake the light that was running over the earth. Spurring on his horse. Grigori let it go at full speed and began to come close to the uncertain boundary separating light from shade. A few seconds of desperate riding and then outstretched head of the horse was scattered with seed of flaming beams, its reddish hair suddenly flared out with a fierce, shooting brilliance. At the moment when Grigori leaped over the imperceptible margin of the cloudy shade shots slowly rang out from the lane.

এত বড়ো একটি অনুচ্ছেদ এখানে উদ্ধৃত করবার কারণ হচ্ছে এইটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে শোলোখভের চরিত্রচিত্রণ ও ঘটনাবর্ণনের ক্ষমতা যে কতখানি এবং সেগুলি কত সজীব ও স্বাভাবিক তা বুঝতে কষ্ট হবে না। সাধারণ মানুষ, চাষা—মজুর ও কস্যাকদের দৈনন্দিন জীবনের গতিবিধি, তাদের অনুভূতি, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে শোলোখভ সুপরিচিত। যে—অনুপ্রেরণায় ও যে—অনুভূতিতে তিনি তাঁর চরিত্রগুলিকে পরিচালনা করেন, সেগুলি জটিল হলেও ঘটনার সঙ্গে তারা সুন্দর ও সুবিন্যস্তভাবে গ্রন্থিত এবং মূল গল্পের স্বচ্ছন্দ প্রবাহকে তারা কোথাও বাধা দেয়নি। শোলোখভ বস্তুবাদী, তাই পাঠককে পরিশ্রম করে অনুমান করে নিতে হয় না কেন গ্রিগরি মেঘের ছায়া অনুসরণ করেছিল, কেন সে মাঠের উপর আছড়ে পড়েছিল। পাঠক সবকিছু পরিষ্কার বুঝতে পারেন। জটিলতার বিশাল পটভূমিকায় বিচিত্র ভাব ও ঘটনার রঙে শোলোখভের চরিত্রগুলি চিত্রিত হলেও, তাঁর ঘটনা—গ্রন্থন কোথাও শিথিল হয়নি। তাঁর ঘটনা—গ্রন্থন সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত। শোলোখভের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘটনার তীব্রতার দিকে তীক্ষ্নদৃষ্টি রেখে ভাষার ও বর্ণনার আনুপাতিক সংযম। কস্যাকরা যখন ক্যাম্পে চলেছে তখন পথের উপর তাদের সরল সুন্দর গ্রাম্য গীতি, ঠাট্টা—বিদ্রুপ, হল্লা, তর্ক, কথাবার্তার এক সুদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন শোলোখভ, কিন্তু যে—ঘটনাগুলি ভীষণ চাঞ্চল্যকর সেগুলি অত্যন্ত সংক্ষেপে বৈজ্ঞানিকের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন, যেমন অ্যাক—সিনিয়র রেপ এবং ওই জাতীয় আরও অনেকগুলো ঘটনা। এই সংযমের ফলে এই সুদীর্ঘ বইখানির সৌন্দর্যের অঙ্গহানি হয়নি কোথাও।

আধুনিক সোভিয়েট লেখকদের আনন্দের একমাত্র কারণ হচ্ছে যে তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন সর্বসাধারণের জন্য, লক্ষ লক্ষ মানুষের আন্তরিক পরিতৃপ্তি ও নৈতিক উন্নতিসাধনের জন্য। তাঁদের সাহিত্যের বাণী হচ্ছে জনগণের কল্যাণ। তাঁরা এক নূতন জগতের স্রষ্টা হিসেবে মানুষের কাছে এসেছেন, যে—জগতে একশ্রেণি অন্য শ্রেণিকে শোষণ করে গলগণ্ডের মতো ফাঁপে না, যেখানে শাস্ত্রসম্মত নৈতিকতার আড়ালে লাম্পট্য নেই, যেখানে স্বাধীনতায় সকলের সমান অধিকার, যেখানে জীবনধারণের প্রত্যেকটি উপায়ের উপর সকলের সমান দাবি, যেখানে জাতির ভাগ্যবিধাতারা তথাকথিত মঙ্গলাচরণের হুমকি দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার বিলাসিতায় ডোবে না, যেখানে মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিনিময়ে প্রাণ বলি দেওয়া মানুষের ধর্ম। যুগে যুগে মানুষের পারিপার্শ্বিকতার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সত্যেরও রূপ বদলায়। যে—সত্য নির্বিকার, যে—সত্যের কালের কাছে অপরিবর্তনীয়তার অর্ঘ্য দাবি করবার মতো ধৃষ্টতা আছে, সে—সত্য—সত্য কখনো নয়, বিরাট মিথ্যা। আজ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সত্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ, ধনতান্ত্রিক শোষকশ্রেণির অবশ্যম্ভাবী বিনাশ, শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য হচ্ছে সেই সাম্যবাদী সমাজের সৌন্দর্য, সেখানে শুধু দেবতার ও রাজার মুষ্টিমেয় প্রিয়জনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিধিব্যবস্থা নেই, সর্বসাধারণের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারলাভের সুবন্দোবস্ত আছে। আর বৃহত্তম সংখ্যার মহত্তম কল্যাণের বাইরে শিবের কোনো পরিচয় নেই। তাই সোভিয়েট শিল্পই সত্য, শিব ও সুন্দরের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এবং সোভিয়েট সাহিত্য বিশ্ববরেণ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *