০৮. আধা শহর

আধা শহর।

কালো কালো পাথরের কুচি দেওয়া চওড়া রাস্তা। দুই পাশে দোকান-পান-বিড়ি, মিষ্টি, মনিহারী, চকচকে ঠুনকো জিনিসে ভরা, সবারই মাঝে একটা বহিঃসৌন্দর্যের আস্ফালন।

ওপাশে রেলস্টেশনের ধারে স্তৃপ বাধা কয়লার ডিপো, কালিতে রাস্তাঘাট কালিমাখা, সব যেন রুক্ষ, রৌদ্ৰে কয়লার স্থূপ ঝাঝে ভরা। আশপাশ পর্যন্ত ওই উত্তাপে তপ্ত।

লোহার দোকান, শুধু ঝনঝন শব্দ, মাটির বুক ফালি ফালি করিয়া ফাড়িয়া ফেলিবার কত অস্ত্ৰ—টামনা, গাঁইতি, শাবল, সব যেন তীক্ষ হিংস্র, রৌদ্রের আলোয় চকচক করে।

ধারে ধারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা ঘিরিয়া ধানের কল, বয়লারের আঁচে গরম জলের ভাপে সব যেন আগুন।

দুইটা বাজারের মাঝে স্টেশন, মস্ত জংশন।

সারি সারি কালো কালো সুকঠিন লোহার লাইন, মাটির বুক চিরিয়া পাতা; লোহার বাঁধনে দুনিয়াটাকে বাধিবার কি সে উদঘ চেষ্টা! দূর—সুদূর পর্যন্ত কালো কাটে। লাইনের দাগের রেশ চোখে বাজে, মনের চোখে আরও দূর পর্যন্ত, দুনিয়ার সীমারেখা পর্যন্তওই রেশ আগাইয়া যায়।

মাঝে মাঝে সিগ্নালের স্তম্ভগুলা যেন লোহার বিশ্বজয়ের বিজয়নিশান।

রাত্রের অন্ধকারে ওগুলার মাথায় আবার রক্ত-রাঙা জ্বলজ্বলে আলোর সারি ধকধক করে।

ও যেন মানুষের উদগ্ৰ বুভুক্ষার উগ্রতা, রাত্রে ঘুমন্ত বিশ্বেও সে জাগিয়া আছে; আপন। উগ্রতার জ্বালায় ও আপনি জ্বলে। দিন নাই, রাত্রি নাই, বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই, ও আপন তৃপ্তি হেতু আপন গ্রাসের কাজ চালাইয়াছেই; রেল চলে, টেলিগ্রাম চলে, মানুষ কাজ করে, বিশ্রামের হুকুম দেয় না ও চব্বিশ ঘণ্টাই শহরটা ধ্বনিয়া বেলের বাশির অশ্রান্ত তীক্ষ্ণ চিৎকার, তন্দ্ৰা টুঁটিয়া যায়, অন্যমনস্ক চমকিয়া ওঠে, মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাগুলা পর্যন্ত ঝনঝন করে; সকল শান্তি তৃপ্তি যেন শিহরিয়া ওঠে। গাড়ি কাটে, গাড়ি টানে, শান্টিং হয়, গাড়িতে ধাক্কা মারে—ঘড়াং, ঘড়াং আশেপাশের মাটি কঁপে, ধরণী-মায়েরও বুঝি ভার লাগে, হাড়পাঁজরা মড়মড় করে যেন।

দারুণ বুভুক্ষায় মাতৃস্তন্যে তৃপ্তি হয় না উহাদের, মায়ের বুক চিরিয়া নিঃসঙ্কোচে রক্ত শোষণ করে।

মালের গাড়ি সব বোঝাই হয়, ধানে চালে আহারের সামগ্রীতে বোঝাই করে, আহার যাহাদের জোটে না তাহারাই।

মাটিতে মাথা বুঝি ঠেকিয়া যায়, কাখ বাকাইয়া গরুর গাড়ি হইতে দুইমনী বস্তাগুলা গাড়িতে বোঝাই করে অর্ধাহারী মজুরের দল।

পাশে গাড়ির গরুগুলার মুখে ফেনা ভাঙে, শ্রান্তিতে হাঁপায়, গায়ে সেটা সঁটা চাবুকের দাগ, বিশ-পঁচিশ মন বোঝাই গাড়িগুলা ওই পাথরের রাস্তার উপর দিয়া জিভ বাহির করিয়া টানিয়া আনিতে কষ্ট হয়, মানুষ এদের চাবকায়। নির্মমভাবে গুঁতা মারে, তাহাতে মাথা নাড়ে পাছে, তাই নাকে দড়ি দিয়া টানে।

মজুরগুলারও গা হইতে টসটস করিয়া ঘাম পড়ে, দাঁড়াইয়া দম লইতে গেলে মারোয়াড়ী মহাজন গালি দিয়া তাড়া দেয়, এ শালালোক বদমাশ, চালাও চালাও; দের হোনেসে গাডিড্ডমে ড্যামরেজ লাগেগা, চালাও চালাও।

মারিতে তাড়াও করে।

পশুর উপরে মানুষ যে অত্যাচার করে, মানুষের উপরেও তার চেয়ে কম অত্যাচার করে না; আট আনা, দশ আনা মজুরিতে ইহাদের সাত-আট ঘণ্টার আয়ু বিকায়, এই সাত-আট ঘণ্টার মাঝে এদের বাঁচিবার প্রয়াসে নিশ্বাস লইবার অধিকার নাই।

মজুরগুলার বাস ওই উত্তাপ, ওই লৌহ-বন্ধনের মাঝে, লাইনের ধারেই ছোট ছোট পায়রাখুপীর মত ঘরওই মজুরের বস্তি, সমাজের আঁস্তাকুড়, অর্থশালীর ডাস্টবিন। পূর্ব দিকে কলের সারি, কালো কালো লম্বা লম্বা চিমনি, সারাদিন ধোঁয়া উদগীরণ করে। উত্তরেও তাই। পশ্চিমে রেলের মালগুদাম। মহাজনকে টাকা আনিয়া দেয়, আর ইহাদের আলো-বাতাসের পথ রোধ করে। রেলইঞ্জিনও ধোঁয়া ছাড়ে। ওদিকে দক্ষিণে মদের ভাটি; হতভাগ্যদের আয়ুবিক্রয় করা পয়সাগুলা লুঠ করে।  ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আকাশ পর্যন্ত কেমন ঘোলাটে; দীপ্ত রৌদ্র পর্যন্ত এখানে স্লান। কেমন একটা অভিভূতি আসে, মদের গন্ধে ম্লান আলোয় সব যেন কেমন নেশায় বিকারগ্রস্ত।

তবু এখানকার মানুষগুলি তালু নয়—জীবনের দুরন্তপনার সাড়া পাওয়া যায়, সে দুরন্তপনা বিচিত্র।

এতকালের বিশ্বের সঙ্গে মেলে না। হয়ত বা প্রেত ইহারা, কিন্তু প্রেত জীবনে জীবন্ত।

***

পড়ন্ত বেলা।

গোষ্ঠ আর দামিনী ওই স্টেশনটির ধারে একটা বটতলায় আশ্রয় লইয়াছিল। গোষ্ঠ পড়িয়া অকাতরে ঘুমাইতেছিল, সে যেন নিশ্চিন্ত। আর দামিনী বটগাছের একটা শিকড়ে হেলান দিয়া বসিয়া ভাবিতেছিল, অন্তহীন অর্থহীন চিন্তা। কুলিমজুরের দল ঘরের দিকে ফিরিতেছিল।

কর্মক্লান্তির অবসাদের মাঝে খলখল উচ্ছঙ্খল হাসি, ইহাদের বেতালা পায়ের মলের মতই বাজিতেছিল।

মেয়েরা গান ধরিয়াছিল—

ধকধকিয়ে আগুন জ্বলে ভকভকিয়ে ধূমা,
মিস্ত্রি বলে, বয়লার আড়ে দে লো একটা চুমা।

একজন পুরুষ বলিতেছিল, দোব মাইরি এইবার শালার মাথাটা ফেড়ে, এক শাবলের ঘা, বাস্, ডিমফাটা হয়ে যাবে; বাবু হল তো হল কি!

অপর জন কহে, শালা রোজ আমাদের হাজরি চুরি করে। উঃ, আমরা শালারা খেটে মরব আর হাজরিবাবুর পরিবারের শাঁখের শাঁখা সোনার হবে, ইঃ–রে!

নারীকন্ঠের সমবেত তীক্ষ্ণ উচ্চসুরে গোষ্ঠ জাগিয়া ওঠে, বিস্মিতের মত ইহাদের পানে চাহিয়া থাকে।

ওই বেতালা চাল কেমন নূতন ঠেকে; মনে খট করিয়া বাজে; আবার ওই বিচিত্র নূতন ধারার কোনো সূক্ষ্মতম সুর তাহাকে আকর্ষণ করে।

সহসা পিছনের পানে একটা কোলাহল ওঠে, দুইটি সমান উত্তেজিত কণ্ঠে। মজুরের দল ঘুরিয়া দাঁড়ায়, গোষ্ঠও ফিরিয়া তাকায়।

উত্তরদিকের কলের ফটকে দুই জন লোক,এক জন জামা কাপড় জুতায় বাবু, আর এক জন মজুর, গায়ে হাতকাটা কামিজ, হাফপ্যান্ট, সারা অঙ্গে তেল-কালি-মাখা, হাতে একটা হ্যামার। সে কহিতেছে, আমার খুশি আমি ওপরটায়েন খাটব না।

মজুরের দল কহে, ছোট মিস্ত্রি আর ক্যাশবাবু, শালা খুঁড়েও কম নয়, সবেই শালা পাক মারে।

ওখানে ক্যাশবাবুটা বলে, অঙ্গ জল করে দিলে আর কি আমার; পাম্প না সারলে কল যে কাল বন্ধ থাকবে, তার কি? সে লোকসান দেবে কে? তুমি সিরাজউদ্দৌলার নাতি লবাব সরফরাজ খা? বলি, মালিকের মাইনে খাও না? কল বন্ধ হবে আর নবাব ঘরে বসে আরাম করবেন।

মাগনা মাইনে দেয় আমার, নয়? দাতাকৰ্ণ রে আমার! গতর খাটাই, পয়সা নিই; বাধা টায়েনের কাজ না করি, বলতে পার; ওপরটায়েন খাটা আমার গতরে পোেষাবে না, আমি খাটব না, সিধা বাত।

সে দুই পা আগায়।

পিছন হইতে ক্যাশবাবু ক্ৰোধে ভুঁড়ি নাচাইয়া, হিন্দি বাত ছাড়িয়া দেয়, আলবৎ খাটনে হোগা, তোমার ঘাড়কে খাটনে হোগা, উল্লুক গিধ্বড় কাঁহাকা।

হাতের হ্যামার উঁচাইয়া ছোট মিস্ত্ৰি কহিল, খবরদার মুখ সামাল কর।

বাবু দশ পা পিছু হটিয়া যায় আর কহে, মারবি নাকি, মারবি নাকি রে বাপু?

ওদিকে পিছনে হাত বাড়াইয়া কলের ফটক খোঁজে।

মজুরদের একজন শূন্যে হাত হানিয়া কহে, লাগাও হ্যাম্মর, ফটাং ভস, আন্ডা তোড় যায়।

জনকয় হাততালি দিয়া ওঠে, যেন এ রুদ্র সঙ্গীতে তাল দিয়া যাইতেছে।

একজন প্রৌঢ়, সেও তেল-কালিমাখা, সে আসিয়া ছোট মিস্ত্রির উদ্যত হাতখানা ধরিয়া নামাইয়া লয়, মানাইয়াও লয়।

মজুরের এক জন কহে, বড় মিস্ত্রি।

ওদিকে বাবু ফটক বন্ধ করিয়া শাসায়।

কাল যদি আমারা কলমে মাথা গলায়েগা তো জুত্তি লাগায়েগা, পুলিশমে দেগা। জবাব তোমারা।

বড় মিস্ত্রির আকর্ষণের মাঝেও ঈষৎ পাশ ফিরিয়া ঘুরাইয়া ছোট মিস্ত্ৰি কহে, নেহী মাংতা হ্যায় তুমহারা নোকরি, কিস্মাৎ থাকে আমার, কাল আবার তোরাই ডাকবি।

আপন বুকে ঘা মারে, দম্ভের ঘা।

গোষ্ঠ দাঁড়াইয়া ওঠে, তাহার মনের দ্বিধা টুঁটিয়া যায়, সকল অন্তর তাহার যেন ওই ভাবধারা বুক পুরিয়া লইতে চায়।

দামিনীর চক্ষু জ্বলিয়া ওঠে। জ্বলে, কিন্তু ওই জ্বলনের মাঝেও প্রসন্নতার আভাস পাওয়া যায়।

ঘাড়ে পাষাণ চাপানো নতদৃষ্টি বন্দি যেন ঊর্ধ্বে নীলাকাশের পানে, আলোর পানে চাহিবার উপায় দেখিতে পায়।

গোষ্ঠ কহে, বেশ ঠাঁই, হেথায় থাকা যাক, কি বল?

দামিনীর মুখপানে সম্মতির জন্য তাকায়।

দামিনীরও বেশ লাগে, হউক এ জীবন প্রেতের, কিন্তু বন্ধনহীন, হাঁফ ফেলিয়া বাঁচিতে পারা যায়; সেও ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি দেয়, বেশ।

গোষ্ঠ আগাইয়া চলে মিস্ত্রি দুই জনের দিকে।

ওদিকের ঝগড়া মিটিয়া গেল দেখিয়া মজুরের দল বস্তির পানে পথ ধরে।

দামিনী বসিয়া রহিল, অবসন্ন দেহে শ্ৰান্তিতে, ক্ষুধায়; কাল হইতে একটা দানাও পেটে পড়ে নাই, মানুষের ভয়ে লোকালয় দিয়া পথ দিয়া হঁটে নাই, আসিয়াছে প্রান্তরে প্রান্তরে রেখাচিহ্নহীন বিপথ ধরিয়া।

হাওয়ায় ঘোমটা খসিয়া পড়ে, সেটা তুলিয়া দিতেও হাত ওঠে না; অবসাদ আসে; অবসন্ন। দৃষ্টিতে সম্মুখের ছবি বেশ ধরা পড়ে না, যেন ক্ষণে ক্ষণে মুছিয়া যায়, আবছায়ার মত কাপে।

সমস্ত অন্তরাত্মা তাহার একটি দানার জন্য কাঁদে।

তার মত একটা আচ্ছন্নতা সর্বদেহ ব্যাপিয়া ফেলে, মাথাটা ঝুঁকিয়া পড়ে, ইচ্ছা করে ঘুমায়।

বউ!

দামিনীর ওই তন্দ্ৰা টুঁটিয়া যায়, পিছন হইতে কে যেন ডাকে, বউ! ফিরিয়া দেখে সুবল।

তেমনই সলাজ নত দৃষ্টি, কুণ্ঠিত ভঙ্গি।

দামিনীর সর্বদেহে একটা উত্তেজনা বহিয়া যায়; ঋণমুক্ত খাতক যে উগ্রতায় মহাজনের সম্মুখে দাঁড়ায়, সেই উগ্রতায়, সেই ভঙ্গিতে কহে, কি?

ওই একটি কথায় সুবল কাঁপিয়া ওঠে, সে কথা কহিতে পারে না, শুধু হাতটি বাড়াইয়া সম্মুখে ধরে, সে হাতও থরথর করিয়া কঁপে। হাতে একটি ঠোঙা, তাহার মাঝে খাবার, সে কত কি! যত ভাল যত রকমে মেলে, তত ভাল তত রকম উপচারে সাজানো।

দামিনীর কথা ফোটে না।

তাহার সকল ক্ষুধা উন্মুখ হইয়া ওই উপচা ধরিতে চায়, ইচ্ছা করে, একই লোলুপ বিপুল গ্রসে ওইগুলি গ্ৰাস করিয়া ফেলে।

তবু যেন কিসে বাধে; সে একাগ্ৰ বিস্মিত দৃষ্টিতে সুবলের পানে চাহিয়া থাকে; ক্ষুধার তাড়নায় সে দৃপ্ত মহিমা আর থাকে না।

দামিনীর ওই একাগ্র দৃষ্টি, ওই নীরবতার মাঝে কি যেন সাহস পায়, সে কথা কয়। বলে, ছেলেবেলার কুল খাওয়ার কথা মনে পড়ে না।

দামিনী হাত বাড়াইয়া ঠোঙাটি ধরে, সে যেন বার বছরের অনভ্যস্তা বধূটির বয়সে ফিরিয়া যায়।

তারপর সে কি বুভুক্ষার গ্রাস, সে যেন গিলিয়া খাওয়া!

সুবল চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে থাকিতে কহে, বউ, আমিও হেথায় থাকব, আমার আর সেথায় কে আছে; আমি তোমাদের সঙ্গেই এসেছি।

দামিনীর অবসর হয় না, সে খায়।

সুবল সাহস পাইয়া কত বকিয়া যায়।

আমার তো যেখানে থাকব সেইখানেই ঘর, এইখানেই ভিক্ষে করব।

দামিনী এতক্ষণে কহে, ছিঃ, ভিক্ষে!

সুবল কহে, তবে মুড়ি-মুড়কির দোকান করব, আঁ, কি বল বউ? তুমি মুড়ি ভেজে দিও।

দামিনী কহে, বানি দিও। হাসিয়া দামিনী মাথায় কাপড় টানিতে খুঁট খসিয়া পড়ে, হাতে বাজে সেই সাতুর বাঁধিয়া দেওয়া বালা দুইগাছা।

সুবলের ইচ্ছা করে, মুখে তুবড়ির মত কথার ফুলঝুরি ছুটাইয়া দেয়; কিন্তু পারে না; কথা যোগায় না, শুধু অনেক চেষ্টায় বলে, সবই তোমাকে দোব বউ।

ক্ষুধার নিবৃত্তিতে দামিনীর সহজ বৃত্তি জাগিয়া ওঠে, তাহার মনে পড়ে সেদিনের কথা।

সে যেন পাগল হইয়া ওঠে; হাতের অর্ধভুক্ত ঠোঙাটা মাটিতে আছাড় মারিয়া ফেলিয়া দিয়া কহে, আবার?

একদিনের ভুল ভুলে যাও ভাই বউ।

সুবলের চোখ ছলছল করিয়া ওঠে, দামিনীর পা ধরিতে যায়; সৰ্পস্পৃষ্টার মত দামিনী পিছাইয়া যায়, বলে, ছুঁয়ো না তুমি আমাকে।

চোখে তাহার আগুন জ্বলিয়া ওঠে।

সুবল নত নেত্ৰে চলিয়া যায়।

দামিনী হাফ ছাড়ে, মনে বল পায়, অপরাধ যেন তাহার লঘু হইয়া গিয়াছে; কিন্তু উত্তেজনাটা কাটিয়া যাইতেই মন কেমন ম্লান হইয়া পড়ে।

সে বসিয়া ভাবে, ঠিক ভাবা নয়, কথাগুলা মনের মাঝে ঘোরাফেরা করে।

সুবলের যাওয়া-পথের পানে উদাস দৃষ্টিতে তাকায়, দেখা মেলে না; মনে পড়ে, আমার আর সেথায় কে আছে, আমি তোমাদের সঙ্গেই এসেছি।

দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

অনেকক্ষণ পর গোষ্ঠ ফেরে, চোখ দুইটা লাল, হাত পা নাড়ে একটু বেশি, কথা কয় বেশি।

দামিনী বুঝিল, নেশা মিলিয়াছে।

গোষ্ঠ সোল্লাসে কয়, উঠাও তল্পি।

দামিনী মুখের পানে চায়, গোষ্ঠ বলে, ঘরদের কাজকন্ম সব ঠিক। কলে কাজ, ফিটারমিস্ত্রির কাছে; ছমাস পরে পঞ্চাশ-ষাট দিয়ে পায়ে ধরবে লোকে। তার ওপর মহান্তকে পেলাম, ভালই হল, গায়ের লোক, গায়ে মায়ে সমান কথা, কি বল? কই, গেল কোথা? ওই যে ফিটার-বুড়োর সঙ্গে কথা কইছে। মহান্ত, ও মহান্ত, এস এস, এই হেথা বউ রয়েছে।

আজ এই নিরাশ্রয়ের মাঝে আশ্রয়প্রাপ্তিতে মেজাজটা গোষ্ঠর দিলদরিয়া, ঈৰ্ষা-দ্বেষের কথা মনে জাগে না; আর বিদেশে এই স্বদেশের অপ্রিয় জনটিও পরম প্ৰিয় আত্মীয় হইয়া ওঠে।

গোষ্ঠ হাতছানি দিয়া সুবলকে ডাকে; সুবল ভয়ে আগাইয়া আসে।

দামিনী ঘোমটা টানিয়া দিয়া তাহার পানে তাকায়, আবার সেই উগ্ৰ দৃষ্টি, সুবলকে দেখিয়া আবার দামিনীর অন্তর বিরূপ হইয়া ওঠে।

গোষ্ঠ আবার বলে, মহান্তও আর গায়ে ফিরবে না গো, হেথা মুড়ি-মুড়কির দোকান করবে, তা বেশ হবে, কি বল? তুমি মুড়ি ভেজে দেবে, বানি পাবে; দুজনার রোজগার, আমাদের ভাত ভূতে খাবে এইবার।

দামিনী মুখ ফিরাইয়া লয়।

মহান্ত, বউকে নিয়ে এস ভাই, ঘরটা আমি দেখে নিই, মাসে দু টাকা ভাড়াই নেবে।–বলিয়া গোষ্ঠ আগাইয়া চলে।

দামিনীও গোষ্ঠর পিছন ধরিয়া চলে, সুবলের পানে ফিরিয়া চায় না পর্যন্ত; লাজুক লোকটি সঙ্গ ধরিতে সাহস করে না, তেমনই দাঁড়াইয়া থাকে।

অনেকক্ষণ পর বলে, যা চলে, বয়েই গেল; এবার মলেও চেয়ে দেখব না। আমিও মরব। না, সব চেয়ে দেখব। কত হবে, এই তো কলির সন্ধেবেলা।

কতক দূর গিয়া গোষ্ঠ পিছনে দামিনীকে দেখিয়া কহে, ওই!

কথার শব্দে ফিটার-বুড়া চোখ ফিরায়, ঘোলাটে চোখের নিষ্প্রভ দৃষ্টি; ছোট মিস্ত্রির রক্তবর্ণ চোখের দৃষ্টি ধকধক করে।

দামিনী মুখ ফিরায়।

ফিটার-বুড়া চোখ ফিরাইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে; ছোট মিস্ত্রির চোখ ফেরে না, গোষ্ঠর সম্মুখেও তাহার ভ্রুক্ষেপ নাই, সঙ্কোচও নাই।

গোষ্ঠ কহে, মহান্ত কই?

জানি না। দামিনীর কথার সুরে সুরে একটা আঁজ। উচ্ছঙ্খল আনন্দের একটা পিচ কাটিয়া ছোট মিস্ত্রি সোল্লাসে কহে, ভারি কঁজালো বউ হে; বাঃ। চলিতে চলিতে মাথা নাড়িয়া যেন উপভোগ করিতে করিতে সে আবার কহে, আঁজালো মেয়েকেই ভাল হে; তা না প্যানপ্যান–চোখের কোণে নোনা পানি, দূর! ঝাড়, মার, দু চক্ষে দেখতে পারি না আমি।

দামিনীর পানে আবার সেই রক্তবরন ললালুপ দৃষ্টি হানে।

দামিনীর ইচ্ছা করে, চোখ দুইটি টিপিয়া গালিয়া দেয়।

বড় মিস্ত্রি শুধু বলে, আঃ!

ছোট মিস্ত্রি হি-হি করিয়া হাসে, বলে, বাবা, মাছ সব পাখিতেই খায়, মাছরাঙাই ধরা পড়েছে, দোষ আমাদের ঢাকু ঢাকু করি না পেটেও যা, মুখেও তাই।

দামিনী থমকিয়া দাঁড়ায়।

গোষ্ঠ বলে, এস।

না, আমি যাব না।

কি? হল কি?

আর কোথাও চল!

গোষ্ঠ বিষম চটিয়া কহে, ট্যাঁকে আমার ব্ল্যাকশাল ঝমঝম করছে, আর কোথাও চল! ব্যাডব্যাড় করতে হবে না, এস। ওদের কথাই অমনই।

ছোট মিস্ত্রি তবু হাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *