আজমল তরফদার
আজমল তরফদার মোবারক হোসেনের চেক ক্ষীণ সন্দেহ নিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল। চেক ক্যাশ হবে না। বড়লোকদের নানান খেয়াল হঠাৎ মাথায় চাপে আবার হঠাৎই মিলিয়ে যায়। হঠাৎ উদয় হওয়া শখ হঠাৎ মেটাই স্বাভাবিক। চেক দেবার পর পরই হয়তো উনার শখ মিটে গেছে। উনি ব্যাংকে টেলিফোন করে বলে দিয়েছেন এত নাম্বারের চেক ক্যাশ করবেন না।
বড় চেকের সঙ্গে চিঠি দিতে হয়। ব্যাংক ম্যানেজার চিঠি না পেলে চেক ক্যাশ করেন না। অনেকে আবার আরেক কাঠি সরাস–কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চেক না কেটে সেভিংস অ্যাকাউন্টে কাটে। আজমল তরফদার এইসব জটিলতার সঙ্গে পরিচিত। পরিচিত বলেই খানিকটা হলেও সন্দেহ নিয়ে তিনি ছিলেন। তিন দিনের ভেতরে চেক ক্যাশ হবার কথা, তারপরেও তিনি সাত দিন সময় দিলেন। সাত দিন পর ব্যাংকে টেলিফোন করে জানলেন চেক ক্যাশ হয়েছে।
তিনি তার পর পরই মোবারক সাহেবকে টেলিফোন করলেন। ছবি নিয়ে কথাবার্তা বলা দরকার। সামান্য বিয়ের মতো ব্যাপারে এক লাখ কথা খরচ হয়–আর এ হলো ছবি। কুড়িটা বিয়ে একসঙ্গে হবার মতো যন্ত্রণা–এখানে কথা বলতে হবে খুব কম করে হলেও কুড়ি লাখ।
টেলিফোন ধরলেন মোবারক সাহেবের পিএ। তিনি জানালেন, স্যার ব্যস্ত আছেন। কথা বলবেন না।
আজমল তরফদার বললেন, আপনি কি আমার নাম বলেছেন? বলেছেন যে ফিল্ম ডাইরেক্টর আজমল তরফদার। আমি স্যারের জন্যে ছবি বানাচ্ছি।
জ্বি আপনার নাম এবং পরিচয় বলা হয়েছে।
আমি কি পরে টেলিফোন করব?
করতে পারেন, তবে স্যার কথা বলবেন বলে মনে হয় না।
আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। এরকম মনে হবার কারণ কী?
কারণ সার বলেছেন ছবি নিয়ে যা কথা বলার তা বলা হয়েছে, নতুন কিছু বলার নেই।
আমার টেলিফোন নাম্বারটা রাখুন। যদি স্যার কথা বলতে চান।
দিন, টেলিফোন নাম্বার দিন।
আজমল তরফদার টেলিফোন নাম্বার দিয়েছেন। কেউ সে নাম্বারে টেলিফোন করে নি। ছবি তৈরি কোনো সহজ ব্যাপার তো না। স্ক্রিপ্ট রাইটারকে দিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখাতে হবে, তাকে টাকা দিতে হবে; আর্টিস্ট ঠিক করতে হবে, তাদের শিডিউল নিতে হবে; এফডিসিতে চার লাখ টাকার মতো জমা দিতে হবে–এই কাজগুলো করবে কে? আজমল তরফদার আবার টেলিফোন করলেন। পিএ ধরল।
আমি ফিল্ম ডাইরেক্টর আজমল তরফদার…
কথা শেষ করার আগেই পিএ বলল, স্যার ব্যস্ত আছেন, কথা বলতে পারবেন না।
আজমল তরফদার বিরক্ত গলায় বললেন, কথা তো আমাকে বলতেই হবে, গল্প লাগবে, চিত্ৰনাট্য লাগবে, গান লাগবে –এর প্রতিটির জন্যে…
আমি যতদূর জানি এইসব দায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে বলা হয়েছে।
ভাইসাহেব, দায়িত্ব তো পালন করব কিন্তু এর প্রতিটির জন্যে টাকা লাগবে। টাকা দেবে কে?
টাকা স্যারের অফিস দেবে, স্যার তো দেবেন না। আপনি অফিসে চলে আসুন। কোন খাতে কত দরকার বলুন। ভাউচারে সই করে টাকা নিয়ে যান।
কখন আসব?
অফিস টাইমে আসবেন।
অফিস টাইম কখন?
দশটা থেকে চারটা।
এখন বাজছে তিনটা, এখন আসতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
আজমল তরফদার তৎক্ষণাৎ অফিসে চলে গেলেন। তার ধারণা ছিল তিনি নিতান্তই বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়বেন। এই টেবিল থেকে ঐ টেবিলে যেতে হবে। ম্যানেজার টাইপের একজন শেষ পর্যায়ে শুকনো মুখে বলবে, আপনার কী ডিমান্ড একটা কাগজে লিখে দিয়ে যান আমরা ইনকোয়ারি করি–সপ্তাহখানেক পরে এসে খোঁজ নেবেন।
বাস্তবে তিনি সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার দেখলেন। ছবির কাগজপত্র এবং টাকা-পয়সার ব্যাপারে দেখাশোনার জন্যে আলাদা একজন লোক রাখা হয়েছে। তার নাম বিমলচন্দ্ৰ হাওলাদার। বাচ্চা ছেলে কিন্তু মনে হচ্ছে কাজকর্মে খুব সেয়ানা।
আজমল তরফদার ঘরে ঢুকতেই সে তাকে অত্যন্ত যত্ন করে বসাল। কফি খাবেন না চা খাবেন জানার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বিমল হাসিমুখে বলল, ছবির কাজ কি সম্বর শুরু হচ্ছে?
হ্যাঁ হবে। তবে ছবি তো আর স্পিঙের খেলনা না যে চাবি দিলেই চলবে। গল্প, চিত্ৰনাট্য–এইগুলো লেখাতে হবে না?
স্যার অবশ্যই হবে।
এর জন্যে টাকা লাগবে না?
চেক বই তো স্যার আমার কাছে। আপনি বলবেন, আমি চেক লিখব। আপনি যেদিন বলবেন আপনার সঙ্গে যাব–আর্টিস্টদের বাসায় চেক পৌছে দেব। স্যার, এখন বলুন কী খাবেন? কফি দিতে বলি?
বলুন।
আমাকে তুমি করে বলুন স্যার।
এফডিসিতে টাকা জমা দিতে হবে। পি টাইপ ছবির জন্যে সাড়ে চার লাখ টাকা জমা দিতে হয়।
ঐ টাকাটা স্যার জমা দেয়া হয়েছে।
বল কী?
শুটিং শিডিউলও স্যার নেয়া আছে।
আজমল তরফদার বিস্মিত হলেন। বিমলচন্দ্র তাঁর দিকে ঝুকে এসে বলল, স্যার, আমাদের অফিস হলো দশটা-চারটা কিন্তু আপনার জন্যে আমি সারাক্ষণই থাকব। যখন বলবেন তখন আপনার বাসায় উপস্থিত হব।
বাসার ঠিকানা জান?
জানি। ফাইলে আছে।
কফি চলে এসেছে। কফির পেয়ালা হাতে নিতে নিতে আজমল তরফদার বললেন, কিছু মনে করবে না বিমল, ছবির ফান্ড কি আলাদা করা, নাকি মেইন ফান্ড থেকে খরচ হচ্ছে?
স্যার, ছবির জন্যে আলাদা ফান্ড দেয়া হয়েছে।
মোট কত টাকা আছে সেই ফান্ডে? বলতে যদি কোনো বাধা না থাকে।
বলতে কোনো বাধা নেই স্যার। মোট দেড় কোটি টাকা আলাদা করা হয়েছে। সেখান থেকে খরচ হয়েছে চার লাখ টাকা। ডাইরেক্টর হিসেবে আপনাকে টাকা দেয়া হয়েছে।
আজমল তরফদার বললেন, ছবির লাইনে তোমার কি কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে?
বিমল হাসিমুখে বলল, স্যার, ছবির লাইনে কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। কিন্তু আপনি আমার উপর ভরসা করতে পারেন। আমি খুব দ্রুত কাজ শিখতে পারি। বড় সাহেব এই কারণে আমাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি যে-কোনো নতুন প্রজেক্ট আমাকে দিয়ে শুরু করেন।
ও আচ্ছা।
স্ক্রিপ্ট লেখার টাকাটা আজ স্যার আপনি নিয়ে যান। কত দেব?
এক লাখ টাকা দাও।
একটা কথা বলব স্যার?
বল।
পুরো টাকাটা একসঙ্গে দিলে কাজ আদায় হবে না। আমরা যদি শুরুতে দশ হাজার টাকা দেই এবং বলি যেদিন স্ক্রিপ্ট শেষ হবে সেদিনই পুরো টাকা একসঙ্গে দেয়া হবে তাহলে বোধহয় ভালো হবে।
কথাটা মন্দ বল নি।
আরেকটা কাজ স্যার করা যেতে পারে। আমরা বলতে পারি–স্ক্রিপ্ট যদি খুব ভালো হয় এবং স্যারের যদি খুব পছন্দ হয় তাহলে পঞ্চাশ হাজার টাকা বোনাস।
ক্রিপ্টের জন্যে কত টাকা ধরা আছে?
স্ক্রিপ্টের জন্যে দশ লাখ টাকা ধরা আছে।
এত টাকা?
স্ক্রিপ্ট তো স্যার একটা হবে না, বেশ কয়েকটা হবে। এর মধ্যে আমরা একটা বেছে নেব।
কে বাছবে?
আপনি বাছবেন।
আবার কে? স্যার, আরেক কাপ কফি দেই?
দাও।
আপনার কি কোনো ট্রান্সপোর্ট আছে স্যার?
জ্বি না।
অফিস থেকে আপনি একটি গাড়ি রিকুইজিশন নিয়ে নিন। যতদিন কাজ করবেন। ততদিন গাড়ি চব্বিশ ঘণ্টা আপনার সঙ্গে থাকবে।
ড্রাহভারসহ?
অবশ্যই ড্রাইভারসহ। আমি বলি কি স্যার আপনি বড়ো একটা গাড়ি নিন–মাইক্রোবাস বা পিক-আপ, এতে আপনার কাজের সুবিধা হবে।
বিমল, তোমার এখানে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
জ্বি স্যার, খাওয়া যায়।
আরেকটা কথা–মোবারক সাহেব নামের লোকটির কত টাকা আছে তুমি জান?
আমার কোনো ধারণা নেই স্যার।
কোনো আন্দাজ আছে?
আমি স্যার ছোট মানুষ, ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আন্দাজ করি। বড় বিষয় নিয়ে আন্দাজ করে সময় নষ্ট করি না। স্যার, কী ধরনের গাড়ি নেবেন তা তো বললেন না?
দাঁড়াও একটা সিগারেট খেয়ে নিই। বিমল তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
বিমল হাসতে হাসতে বলল, আমাকে আপনার আরো পছন্দ হবে। যত দিন যাবে। ততই আপনি আমাকে পছন্দ করবেন।
কেন বল তো?
স্যার, আমি যে-কোনো কাজ খুব সুন্দর করে করতে পারি।
আমার তো মনে হচ্ছে তুমি অহঙ্কারী।
কিছু অহঙ্কার তো স্যার থাকবেই। রাস্তার যে ভিখিরিটি অন্যদের চেয়ে বেশি ভিক্ষা পায় সেও অহঙ্কার করে, আমি কেন করব না?
স্যার কি আরেক কাপ কফি খাবেন? আগেরটা খান নি এই জন্যে বলছি।
দাও খাই আরেক কাপ।
আপনার বোধহয় সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। সিগারেট আনিয়ে দেব?
দাও।
আজমল তরফদারের জন্যে নতুন করে কফি আনতে গিয়েছে, কিন্তু তিনি মনের ভুলে ঠাণ্ডা, সরপড়া কফিতেই চুমুক দিয়ে ফেলেন।
বিমল।
জ্বি স্যার?
তোমাদের এই বড় সাহেবের, আই মিন মোবারক সাহেবের ছবি বানানোর শখের পেছনের কারণটা কী?
ব্যবসা। ছবির ব্যবসা তো ভালো ব্যবসা। বাংলাদেশে পাঁচ শ’র মতো সিনেমা হল-প্রতি হল থেকে গড়পড়তা দশ হাজার টাকা পেলেও প্রথম রানে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উঠে আসে। তাছাড়া আমি যতদূর জানি উনি সিনেমা হলও বানাবেন।
সিনেমা হল বানাবেন?
জায়গা নেয়া হয়েছে, আর্কিটেক্টকে ডিজাইন করতে বলা হয়েছে।
বল কী?
স্যার, উনি খুব গোছানো মানুষ।
তাই তো দেখছি। আমার ধারণা ছিল ছবি তৈরির ব্যাপারটা হুট করে মাথায় এসেছে।
নতুন কফি এসেছে। পিরিচে বেনসন এন্ড হেজেস-এর প্যাকেট এবং দেশলাই। আজমল তরফদার বললেন, বিমল তুমি সিগারেট খাও?
জ্বি স্যার, খাই।
নাও সিগারেট নাও।
আপনার সামনে খাব না স্যার।
খাও খাও, ফিল্ম লাইনে সব সমান।
বিমল সিগারেট ধরাল না। আজমল তরফদাব সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে কফিতে চুমুক দিলেন। বিমল বলল, স্যার যারা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে তারা শুধু যে ভাগ্যের জোরে সেটা করে তা কিন্তু না। ভাগ্য থাকে তাদের হাতের মুঠোয়, ভাগ্য নিয়ে তারা খেলা করে। পৃথিবীতে যারা বিলিওনিয়ার আছে তারা কোনো কারণ ছাড়াই বিলিওনিয়ার হয় নি।
তুমি কী বলতে চোচ্ছ বুঝতে পারছি না।
আমি বলতে চাচ্ছি—বড় সাহেব হুট করে কোনোদিনই কিছু করেন না। তিনি যখন ছবির জগতে এসেছেন তখন ধরে নিতে হবে এই জগৎ তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন।
আজমল তরফদার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমি বিলিয়নিয়ার না, সামান্য ফিল্ম মেকার–আইএ পাস বিদ্যা। আমি তোমাকে একটা কথা বলছি, শুনে রাখ। ছবি বানানোর এই ঝোঁক তোমার বড় সাহেবের হঠাৎ করেই হয়েছে। আমাদের ছবি পাড়ার একটা মেয়ে–আজেবাজে টাইপের মেয়ের জন্যে এটা তার গিফট। তবে ঝানু ব্যবসায়ীরা গিফট থেকেও লাভ করে। যে কারণে এত আটঘাট বেঁধে ছবিতে নামা হচ্ছে। রেশমা নামের বলতে গেলে পথের-কুকুরি সুপারস্টার হিসেবে বের হয়ে আসবে। সে তার পুরস্কার পেয়ে গেল। একই সঙ্গে ছবির বাণিজ্যও হলো।
বিমল চুপ করে আছে। কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। আজমল তরফদার বললেন, বিমল তোমাকে আমার মনে ধরেছে বলে আমি এই কথাগুলো বললাম।
বিমল বলল, স্যার আপনাকেও আমার মনে ধরেছে। ছবি বানানোর ব্যাপারে আমাদের টিমওয়ার্ক খুব কাজে আসবে। আপনি গাড়ি রিকুইজিশন না করেই উঠে যাচ্ছেন। কী গাড়ি নেবেন তা তো বলেন নি। আরেকটু বসুন–কাজটা শেষ করি। আপনি কিন্তু দ্বিতীয়বারের কফিটাও খান নি–ঠাণ্ডা করে ফেলেছেন।