অহল্যা ইতিমধ্যেই ভাত নামিয়েছে উনুন থেকে। ভরত আজ সদর কাছারিতে যাবে। মামলার দিন আজ। এরকম মাঝে মাঝেই সে যায়।
গোবিন্দ ঢুকে অহল্যাকেই জিজ্ঞেস করল, মহী কই বউঠান?
অহল্যা ফ্যান গালতে গালতে আগুনের আঁচে লাল মুখটা টিপে হেসে বলল, কেন, ঘুম হয় নাই বুঝি কাল রাতে?
হওয়ারই সামিল, বউঠান। দেওর তোমার ভাল আছে তো? ভাল কি মন্দ বলতে পারি না। তারও তো তোমারই মতো রাত কেটেছে। যাও, সে তার ঘরে কাজ করছে, দেখো গে।
গোবিন্দ বুঝল, মহিম সুস্থই আছে। সেদিকে তাড়াতাড়ি না করে সে জিজ্ঞেস করল, তা তোমার রাত না পোহাতেই ভাত নামল যে?
সদরে যাবে আজ মহীর দাদা। খানিকটা উৎকণ্ঠা দেখা দিল অহল্যার মুখে চোখে। এ মামলা করেই সব যাবে দেখছি। কাল সারা রাত ঘুমোয়নি মহীর দাদা। সকালে উঠেও থম ধরে বসেছিল। এই এখুনি নাইতে যাবার আগে বলে গেল, এবার মামলায় যদি হারি বড়বউ, মাঠে নামতে হবে নাঙল নিয়ে।
এতে অহল্যার দুঃখ নেই। দুঃখ তার ভরতের বিভ্রান্তিতে। যে আভিজাত্যের বীজ ভরতের বাবা চাষী দশরত বয়ে এনেছিল এ ভিটেয়, সেই বীজেরই মহীরুহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ভরতের মনে। মাঠে লাঙল দিতে ভরত দুঃখ পাবে, মুখে নাকি তার কালি পড়বে, সম্মান হবে ক্ষুন্ন।
তাই অহল্যার বাপ-ভাই ভরতের বাড়িতে আসতে সংকোচ করে, জামাই তাদের ভদ্রলোক। তাদের ঘর-দোরে বিছানায় মাঠের ধুলো, গায়ে মাথায় পায়ে মাঠের ধুলোতারা মাঠের চাষী। অহল্যার সঙ্গে তাদের সম্বন্ধই বিচ্ছিন্ন হয়নি, জাতটাই পালটে গেছে খানিক। হাঁ, ভরতও কোনও দিন শ্বশুরবাড়ির লোককে তেমন তোয়াজ করেনি আর তা কেবল ওই মিথ্যে ভদ্রলোকী আভিজাত্যের জন্য।
অথচ অহল্যা তো চাষীর ঘরেরই মেয়ে। বাপ-ভাইয়ের সঙ্গে মাঠে মাঠে ঘুরেছে সে জন্মের পর থেকে। কিন্তু ভরত আজ বিভ্রান্ত।
কিন্তু গোবিন্দ সম্পূর্ণ অন্য রকম ভাবল। দুনিয়াব্যাপী মানুষের এ স্বার্থান্ধ রূপটা তার মনকে কালো করে। এইটুকুই কি জীবনের পরিধি—এই স্বার্থ আর হানাহানি? এই মামলা আর মারামারি, দৈনন্দিন জীবনের সুখটকু কড়ায় গণ্ডায় পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি। মানুষের জীবন, তার ধর্ম, তার ধর্মের ইতিহাসের নেই কোনও খোঁজ। যে ঈশ্বরকে ঘিরে আর নিয়ে মানুষের জগৎ সে ঈশ্বরকে এমন দূরে ঠেলে ফেলে দিয়ে দূরে দাঁড়ানোর এ জঘন্য শিক্ষা মানুষ কোথা থেকে পেল? কেন পেল?
সে জিজ্ঞেস করল, আজই বুঝি রায় বার হইবে?
না, আজ নয়। তবে দেরিও নাই আর।
মেজিস্টর বিচার করবে বউঠান, তবে মহেশ্বরেরই হাত সবকিছুতে। তাঁকে ডাকো।
তাঁকে তো রাতদিনই ডাকছি ভাই!
যেন ডেকেও কিছু হল না। গোবিন্দ আঘাত পেল অহল্যার কথার, ধমক দিতে ইচ্ছে করল অহল্যাকে।
মনে মনে ভাবল, তোমরা কোনওদিনই ডাকোনি। ছবি আর মূর্তি পূজো করেছ কেবল তোমরা, দেবতার নাম করে খেয়েছ গোগ্রাসে খাদ্য-অখাদ্য, কিন্তু সেই একক মহেশ্বরকে জানবার চেষ্টা তোমরা কেউ করোনি। তার রূপ দিয়েছ কোটি কোটি, গল্প বলেছ হাজার রকম, তোমরা মজে আছ জীবনের ঘৃণ্য পাঁকে। মহেশ্বরকে ডাকলে না, তার কাছে চাইলে ধান, জমি, অর্থ, সুখ-শান্তি। অথচ মহেশ্বরেরই সৃষ্টি এরা। বিচিত্র মহেশ্বরের সৃষ্টি।
কিছু না বলে সে চলে গেল মহিমের কাছে।
মহিম তো তখন পাগল। অন্য জগতে চলে গেছে। উন্মত্ত ক্ষিপ্ত শিবের মূর্তির গা থেকে মাটি খুটে খুঁটে তুলছে ভরছে, কখনও সামনে যাচ্ছে, কখনও পেছিয়ে আসছে, কখনও মাথা নাড়ছে, অস্ফুট শব্দ উঠছে মুখ থেকে। কখনও মুখে ফুটছে হাসি, কখনও গম্ভীর, কখনওবা একেবারেই স্থাণুর মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ছে।
আছে সর্বক্ষণের একজন মাত্র দর্শক। সে হল কুঁজো কানাই মালা। কালো কুচকুচে গায়ের রং, মাথায় একরাশ ঝাঁকড়া চুল, পিঠে মস্ত বড় একটা কুঁজ। সেই কুঁজের ভারে সে অনেকখানি নত হয়ে পড়েছে। ফলে, হাত দুটো সব সময় বাতাসে দোল খাওয়ার মতো দোলে। ঘাড় উঁচু করতে কষ্ট হয় বলে চোখের মণি দুটো উপরের দিকে ঠেলে উঠেছে তার। কুঁজো কানাই মালা। গাঁয়ের শিশুদের কল্পনারাজ্যের বীভৎস পথে তার গতি। অশান্ত দামাল শিশু কান্নায় বাধা না মানলে কুঁজো কানাইয়ের নাম ধরে ডাক দেয় মা, যেমন ডাকে জুজুবুড়িকে। বয়স্কদের কাছে সে জন্তুবিশেষ, ভয়েরও বটে। নয়নপুরের মেয়েমানুষ কাউকে শাপ-শাপান্ত করতে হলে বলে, আর জন্মে তুই কুঁজো কানাই হবি। পুরুষ হিসাবে মেয়েমানুষের কাছে কুঁজো কানাই যে এক মস্ত বিভীষিকা। অভিশপ্ত কুঁজো কানাই।
কিন্তু মূর্তি গড়ার সময় মহিমকেও ছাপিয়ে ওঠে তার পাগলামি। ঠেলে-ওঠা চোখ দুটোতে তার কী গভীর উত্তেজনা, আর সমস্ত রুক্ষ, শক্ত পেশি বহুল চেহারাটা যেন আবেগে থরো থরো। কখনও ঘাড় এ-দিকে কাত করছে, কখনও ও-দিকে, কখনও এ-দিকে যায়, কখনও ও-দিকে। যখনই তার মনোমতটি হচ্ছে তখনই একটা বিচিত্র শব্দ বেরিয়ে আসছে তার মুখ থেকে।
সত্য কথা, শিল্পীর হাত আজ কিছুটা বাঁধা পড়েছে কুঁজোর আবেগভরা দৃষ্টির মাঝে। মহিম তার এই সৃষ্টি-সঙ্গীর যাচাইয়ের চোখকে আজ আর অবহেলা করতে পারে না। কাজ করে আর জিজ্ঞেস করে, বলো তো কানাইদা, কেমনটি হইল?
কুঁজো কানাই তার কুৎসিত মুখে বিচিত্র হাসি নিয়ে বলে, ভাল। কিন্তুক—
শিল্পীর পরের কাজের দিকেই ঝোঁক তার বেশি! অর্থাৎ, এর পর কী হবে?
গোবিন্দ সাধক, কিন্তু মহাশক্তির। তার কোনও নাম নেই, নেই মূর্তি। তার ধ্যান ধারণা শক্তিরই উপাসনা, কিন্তু উপচারবিহীন। তবু প্রেমিক, উন্মত্ত শিবের যে মূর্তি মহিম গড়ছে তা তাকে মুগ্ধ না করে পারল না। যে হাতে শিব সতীর মৃতদেহ জড়িয়ে ধরেছে, যে ঘৃণা ও দৃঢ়তা শিবের মুখে ফুটে উঠেছে, এই উভয় ভঙ্গির পার্থক্য গোবিন্দের সমস্ত অন্তরকে আচ্ছন্ন করে দিল। হাতের দিকে তাকালে মনে হয়, মৃত প্রিয়াকে কী আকুল আবেগেই আঁকড়ে ধরেছে। যেন ওই হাত থেকে জগতের কোনও শক্তিই প্রিয়াকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আর ত্রিনয়নের সেই অগ্নিদৃষ্টির মাঝে গোবিন্দ দেখল, কোথায় যেন অশ্রুর বাষ্প জমে উঠেছে। আহা! শেষে তার সমস্ত আবেগ জমে উঠল বন্ধুর প্রতিভার প্রতি; মহিমের এই গভীর অনুভূতি ও দৃষ্টির তল খুঁজতে সে আকুল হয়ে ওঠে। হাঁ, মহিমের প্রতি তার বন্ধুত্বের যে টান ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, সে বুঝি তার এই আকুলতা, মহিমের হাত আর চোখকে এতখানি শক্তি ও দৃষ্টি দিয়েছে যে মন, সেই মনটাকে স্পর্শ করার আকুলতা।
সে ডাকল, মহী!
জবাব পাওয়া গেল না। তখন মহিমকে ডাকা বুঝি ওই মাটির মৃর্তি ক্ষিপ্ত শিবকে ডাকারই সামিল। একটা মস্ত দোমড়ানো গাছের গুঁড়ির মতো ফিরে ইশারায় ডাকতে বারণ করল কুঁজো কানাই। তারপর গোবিন্দের একটা হাত ধরে খানিক দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে তার মাথাটা হাত দিয়ে ধরে নিজের মুখের কাছে নামিয়ে নিয়ে এল কানাই। কয়েকটা দাঁতে বিচিত্র হেসে ফিসফিস করে বলল, ভগবানের বেবভোম। হইলে মায়ের এমন খুনে বাপের বাড়িতে আসতে কেন সাধ হইবে, বললা?
কুঁজোর কথার ধারা ধরতে পারল না গোবিন্দ। বলল, কী বলছ?
ওই গো, তোমায় দক্ষ রাজার মেইয়ের কথা বলছি। সতী মায়ের কথা। বলে সে তার ঠেলে-ওঠা চোখ দুটো দিয়ে শিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাং-গ্যাঁজার মানুষ তুমি ঠাকুর, মায়ের নীলা দেখে ভুললে। আমি নইলে—
কথা শেষ না করে সে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা দোলতে লাগল। গোবিন্দের বড় ভাল লাগল কুঁজো কানাইয়ের এই সরল হৃদয়ের আফসোেস। জিজ্ঞেস করল, তুমি হইলে কী করতে?
মুই? কানাইয়ের কালো কুজ দেহ ঘৃণায় যেন সোজা হয়ে ওঠার জন্য কেঁপে উঠল। সমস্ত চোখ মুখ দারুণ ক্রোধের অভিব্যক্তিতে উঠল থমথমিয়ে। মুই হইলে, অমন শউরের ঘরে বউ পাঠাইতাম না। হুঁ, হক কথা বললাম। দু-দিন উপোস করে আড়ি দিত বউ, তবু–
গলা বন্ধ হয়ে এল কুঁজো কানাইয়ের! গোবিন্দ দেখল তার ঠেলেওঠা চোখ দুটোতে দু-ফোঁটা জল চকচক করছে। হায়! তবু এই বিকটদর্শন কুঁজো বউ নিয়ে ঘর করা দূরের কথা, জন্মাবধি গর্ভধারিণী মা থেকে শুরু করে কোনও নারীর মিষ্টি কথাও শোনেনি। তার বুকে আজ গুমরে ওঠে কান্না শিবের বউ সতীর বিরহে! আশ্চর্য জগৎ। তার চেয়েও আশ্চর্য জগতের মানুষ। সাধকের সাধনায় জমে-ওঠা মস্তিষ্কে যেন টঙ্কার পড়ে। মানুষ। মানুষকে তার পুরোপুরি চিনে ওঠার মধ্যে কোথায় যেন মস্ত ফাঁক রয়ে গেছে। সে ভীত হয়, যখন তার নিরাকার ঈশ্বর সাধনা এমনি কোনও মুহূর্তে চমকিত হয়। সেও তো মানুষ। কুঁজো কানাইও মানুষ। তবু মানুষের সমাজ তাকে মানুষ বলে মানতে বাধা পায়। অথচ কুঁজো কানাইয়ের আবদার আর দশজনেরই মতো। আর সেই মানুষের সঙ্গে তার সাধনার যেন এক মস্ত গরমিল। মানুষ তার কাছে বড় কিঞ্চিৎ।…না না, মানুষের জন্য তো সে মঙ্গল কামনা করে দিবারাত্রি তার ঈশ্বরের কাছে। মানুষ তো তাঁরই সৃষ্টি, সেই তাঁর সাধনার চেয়ে মহিমাময় আর কি থাকতে পারে।
তবু কুঁজো কানাইয়ের এ বিচিত্র আকাঙক্ষা তার পরমেশ্বরের কাছে এক বিচিত্র প্রশ্নের মতো ছোট্ট একটি দাগ কেটে রাখল মনের কোণে।
সে দেবতার বহুরূপ ও তার জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না। তবু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল কুঁজো কানাইয়ের কুঁজের উপর আলতো করে একখানি হাত রেখে, এ তো দেবতার লীলা ভাই কানাইদাদা, এর জন্য তুমি দুঃখ স্কোর না।
কিন্তু এ কথা মানবার পাত্র নয় কুঁজো কানাই। গোবিন্দর মানুষ না-চেনার হালকা দুঃখতে যেন দারুণ বিদ্রপ করেই কুঁজো কানাই আচমকা গর্জনের মতো চিৎকার করে উঠল, না না না, কক্ষনো নয়।
সে চিৎকারে মহিমের সম্বিত ফিরে এল। ফিরে দেখল, বন্ধু গোবিন্দ অপ্রতিভ শঙ্কিত মুখে কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কুঁজো কানাই দুর্নিবার বেগে মাথা নেড়ে চলেছে। বুঝি ঘাড়টাই ছিটকে পড়বে ধড় থেকে, এতই তার বেগ। ছিটকে পড়ছে লাল তার মুখ থেকে।
মহিম হাত ধরল কুঁজোর। জিজ্ঞেস করল, কী হইছে কানাইদা?
কানাই তার ঠেলে-ওঠা রক্তবর্ণ চোখে গোবিন্দের দিকে তাকিয়ে বলল, এটারে কয় বেব্ভম, হাঁ, তোমার দেবতার বেব্ভোম।
—বেব্ভোম? আশ্চর্য! গোবিন্দর চাপা-পড়া গলা কেঁপে উঠল।
–লয়? বিকলাঙ্গ কানাই চকিতে যেন খ্যাপা জানোয়ারের মতো হয়ে উঠল। বুঝি বা ঝাঁপিয়ে পড়বে গোবিন্দের উপর। তবে তোমার মুনি দেবতার এত বিবাদ কেন, জগতে এত দুঃখ কেন গো? কালু মালার সোন্দরী টুকটুকে মেইয়ে বুড়ো ভাতারের ঠ্যাঙানি রোজ খায় কেন?
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে দরজার কাছে গিয়ে বুনো মোষের মতো ফিরল কুঁজো কানাই। জিভ দিয়ে লালা চেটে নিয়ে বলল, তোমার সবার বড় ভগমানের লোম যদি না হইবে, তবে মোরে কেন জন্ম দিল সম্সারে?
বলতে বলতেই তার নিষ্ঠুর চোখ ছাপিয়ে হু হু করে জলের ধারা বইল। বলল কপালে চাপড় মেরে, এ কী লীলা তোমার ভগমানের, এ কী খেলা মোরে নিয়ে?
বলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে গেল সে হাত ঝুলিয়ে, তেমনি তীব্র বেগে মাথা নাড়তে নাড়তে। আর ছুঁচলো কুঁজটা যেন ক্লান্ত জানোয়ারের পিঠে নিশ্চল নিষ্ঠুর সওয়ারের মতো তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। তার তীব্র মাথা নাড়া যেন জগৎটাকেই অস্বীকার করার অনিরুদ্ধ বেগ।
ত্রস্ত অহল্যা এসে দাঁড়াল। মহিম ও গোবিন্দকে নির্বাক দেখে বলল, কী হইল, কুঁজো মালা অমন খেপল কেন?
গোবিন্দ বলল, ওরে আমি দুঃখুক দিইচি। কিন্তুক অজানিতে।
সকাল থেকে অহল্যার মন ভার। তবু একটু হেসে বলল, একেরে সামলানো দায়, তায় তিন পাগল একত্র হইছ। দেখো বাপু, মাথার চালটাকে ভিটেয় ফেলল না।
বলে দরজার কাছ থেকেই সরে গেল সে।
মহিম বলল, ওরে দুঃখুক দেওয়া তো বড় চাট্টিখানি কথা নয় গোবিন। তবে ঈশ্বরের গুণের কথায় ও বড় খ্যাপা। তাই বুঝি বলছ?
–আমি বুঝতে পারি নাই মহী ভাই।
তার ঠোঁটে কান্নার আভাস দেখা দিল। বনলতার নিষ্ঠুর সাধক আর সবার কাছে সব কিছুতে বড় নরম। মনটা তার তুলোর মতো। রোদে হাওয়ায় ফোলে, জলে নেতিয়ে যায়। টানলে বাড়ে, টিপলে গুটি মেরে যায়। পরমেশ্বরের দিকে ছুটে চলার সাধনাটা যেন তার বালিশের খোলের বেষ্টনীর মধ্যে আশ্রয় নেওয়া যেখান থেকে কেউই তাকে টেনে বার করতে পারবে না।
মহিম তাড়াতাড়ি বলল, বুঝেছি বুঝেছি।
ব্যাপারটাকে হালকা করে দেওয়ার জন্য বলল, তা তুমি হঠাৎ আসলা যে সকালবেলা?
–কাল রাতে তো তুমি যাও নাই? ভাবলাম বুঝি—
–সে এক কাণ্ড গোবিন ভাই।
কাল রাতের কথা মনে, হতেই সব কথা গোবিন্দকে বলার জন্য প্রাণটা হাঁপিয়ে উঠল মহিমের। বলল, কাল একটু বাবুদের, মানে, ওই জমিদারবাড়ি থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কাণ্ডখানা বড় তাজ্জবের।
সে বলে গেল সব কথা। প্রতিমা গড়ার কথা, হেমবাবু ও উমার মতো দুইজন বিচিত্র অপরিচিত নরনারীর কথা। কী তার মনে হয়েছিল, কেমন করে তারা কথা বলেছিল। হ্যাঁ, সেই নাম-না-জানা গদিটাতে বসবার কথা পর্যন্ত সে বলে গেল গোবিন্দকে। উমা যে পাগলা বামুনের সহপাঠিনী, সে কথাটিও বলতে ভুলল না সে। তার পর কৈফিয়ত দেওয়ার মতো বন্ধুকে বলল, সে কেন প্রতিমা গড়তে চাইল না। নিজের অনিচ্ছার কথা নানানখানা বলে সে শেষে বলল :
—আর তা কি আমি পারি গোবিন ভাই? অর্জুন পালমশাই চিরদিন বাবুদের পিতিমে গড়ে আসছে। আর পালমশাই আমার গুরুজন। ছোটকাল-থে তার কাজ দেখেই যে প্রাণে আমার সাধ হইছিল। সে কথা আর কেউ না জানুক, আমি আর আমার গুরু তো জানি। পাল পাড়ায় যে আমার কত মান। আমি কি তা পারি?
এত কথাতেও গোবিন্দের মুখের কোনও ভাব পরিবর্তন না দেখে বলল মহিম, শরীল কি তোমার খারাপ হইছে?
গোবিন্দ বলল, না, মনটা বড় খারাপ হইছে মহী ভাই। তবে তুমি পিতিমে গড়ার ভার না নিয়ে ভালই করছ। অন্যান্য কথার কোনও জবাব না দিয়ে সে বলল, সন্ধেবেলায় আসছ তো? আমি এখন যাই। এসো কিন্তু।
সাধকের মগজে কানাই কুঁজোর শেষ কথা প্রচণ্ড কলরব তুলে দিয়ে গেছে। বেব্ভোম যদি না হয়, তবে মোরে নিয়ে ভগমানের এ কী খেলা! ভগবানের বিভ্রম! তা হলে ভগবান ভগবান কেন?
যেতে যেতে হঠাৎ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে বলল, হ্যাঁ, বনলতা তোমারে ডাকছে।
—মোরে? মহিম বলল, তার সঙ্গে তোমার দেখা হইছে?
চকিত কুণ্ঠায় মুহূর্ত চুপ থেকে গোবিন্দ বলল, হ্যাঁ। যেয়ো কিন্তু, নইলে মোরে জ্বালাতন করবে।
মহিমের ঠোঁটে চকিতে এক ঝিলিক হাসি খেলে গেল। পথে যেতে যেতে গোবিন্দের মাথায় হঠাৎ ভাবনা এল, সকালের এ বিভ্রাট কি তবে প্রভাতে বনলতার দর্শন!