৮. অলকা
লন্ড্রিওয়ালা আমার একটি শাড়ি হারিয়েছে। মনটা ভীষণ খারাপ। লড্রিওয়ালা অবশ্য বলেছে– পাওয়া যাবে, ভাববেন না। কিন্তু আমার ভরসা নেই। আজ সকালে গিয়ে লোকটাকে খুব বকাবকি করেছিলাম। প্রথমটা তেমন রা করেনি। তারপর হঠাৎ কথার পিঠে কথা বলতে শুরু করল। বলল সব লড্রিতেই ওরকম হয়। আমাদের নিয়ম যা আছে, ওয়াশিং চার্জের দশগুণ ক্ষতিপূরণ ত্রিশ টাকা। আমি ক্ষতিপূরণ নিয়ে যেতে পারেন।
আমি অবাক, বলে কী! ধোলাই তো মোটে তিন টাকার, তার দশগুণ হয় ত্রিশ টাকা। কিন্তু আমার চাঁদেরি শাড়িটার দাম পড়েছিল একশো নব্বই, জয়দেব একটা একজিবিশন থেকে কিনে দেয়। খুব বেশি শাড়িটাড়ি জয়দেব আমাকে কিনে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু যে কখানা কিনে দিয়েছিল তার কোনওটাই খেলো ছিল না। এ সব ব্যাপারে ওর রুচিবোধ ছিল দারুণ ভাল।
শাড়িটার জন্য রাগে-দুঃখে আমি পাগল-পাগল। বললাম–ইয়ার্কি করছেন নাকি? দুশো টাকার শাড়ির ক্ষতিপূরণ ত্রিশটাকা? আমি ক্ষতিপূরণ চাই না, শাড়ি খুঁজে দিন।
লন্ড্রিওয়ালাও মেজাজ দেখাল-হারানো শাড়ির দাম সবাই বাড়িয়ে বলে। ও সব আমাদের জানা আছে। যা নিয়ম আছে সেই অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নিতে পারেন, শাড়ি পাওয়া যাবে না। যা করবার করতে পারেন, যান।
শেষের ওই যান কথাটাই আমাকে ভীষণ অবাক আর কাহিল করে দিল। লন্ড্রিওয়ালা লোকটার চেহারা ভীষণ লম্বা, কালো, গুণ্ডার মতো, বয়সেও ছোকরা। কয়েকদিন কাচিয়েছি এ দোকানে, খুব একটা খারাপ ব্যবহার করেনি। আজ হঠাৎ মনে হল, এই ইতর লোকটাই বুঝি দুনিয়ার সেরা শয়তান। আমারই বা কী করার আছে? কী অসহায় আমরা! যান বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
রাগে, দুঃখে ফেটে পড়ে আমি বললামযান মানে! কেন যাব? আপনি যে কাপড়টা চুরি করে নেননি তার প্রমাণ কী? ওয়াশিং চার্জের দশগুণ ক্ষতিপূরণ দিলেই যদি অমন দামি একখানা কাপড় হাতিয়ে নেওয়া যায়!
লোকটা বুক চিতিয়ে বলল–অ্যাঃ,দামি কাপড়! আমরা ভদ্রলোকের ছেলে, বুঝলেন! দামি জিনিস অনেক দেখেছি, ফালতু পাটি নই।
দোকানের দু-একজন কর্মচারী মালিকের পক্ষে সায় দিয়ে কথা বলছে। খুব অসহায় লাগছিল আমার। এ সময় একজন জোরালো পুরুষ সঙ্গীর বড় দরকার হয় মেয়েদের।
একথা ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ যেন দৈববলে একজন ভদ্রলোক রাস্তা থেকে উঠে এলেন দোকানে। বেশ ভদ্র চেহারা, তবে কিছু রোগাভোগা। চোখেমুখেও বেশ দুঃখী বিনয়ী ভাব।
লোকটা দোকানে ঢুকে কয়েক পলক আমাকে দেখে নিয়ে মাথা নিচু করে বলল-ট্রাবলটা কী?
শোনাবার লোক পেয়ে আমি বেঁচে গেলাম। অবিরল ধারায় কথা বেরিয়ে আসছিল মুখ থেকে।
লোকটা শুনল। কথার মাঝখানে মাথা নাড়ল! দোকানদার বাধা দিয়ে নিজের কথা বলতে চাইছিল, কিন্তু লোকটা তাকে পাত্তা দিল না। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনেটুনে একটা শ্বাস ফেলে বলল–হু।
লোকটাকে আমার চেনা-চেনা ঠেকছিল প্রথম থেকেই। কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু তখন শাড়ি হারানোর দুঃখ আর লড়িওয়ালার অপমানে মাথাটা গুলিয়ে ছিল বলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
লোকটা লন্ড্রিওয়ালার দিকে একটু ঝুঁকে খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে কী যেন বলল। লন্ড্রিওয়ালা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, দেখলাম।
আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছি। কিছু শুনতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছিল লোকটা যেন লড্রিওয়ালার বন্ধু, আবার আমারও শুভানুধ্যায়ী।
খানিকক্ষণ ওইসব ফিসফাস কথাবার্তার পর হঠাৎ লন্ড্রিওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল–দিদি, একটা শেষ কথা বলে দেব? আমি একশোটা টাকা দিতে পারি খুব জোর।
আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। যদিও আমার শাড়িটার দাম অনেক বেশি, তা হলেও সেটা তো অনেকদিন পরেছি। তা ছাড়া ত্রিশ টাকার জায়গায় একশো টাকা শুনে একটা চমক লেগে গেল। তবু বেজার মুখ করে বললাম–তাও অনেক কম। তবু ঠিক আছে।
লড্রিওয়ালা টাকা নিয়ে কোনও গোলমাল করল না, সঙ্গে সঙ্গে একটা ড্রয়ার টেনে টাকা বের করে দিল। রসিদ সই করে দিলে লন্ড্রিওয়ালা লোকটিকে বলল-প্রভাসবাবু, আপনিও সাক্ষী হিসেবে একটা সই করে দিন।
লোকটা সই করলে আমি নামটা দেখলাম। প্রভাসরঞ্জন। কোনও পদবি লিখল না।
বেরিয়ে আসার সময় প্রভাসরঞ্জনও এল সঙ্গে সঙ্গে। রাস্তায় কাঠফাটা রোদ। এই সকালের দিকেই সারা দিনের অসহনীয় গরমের আন্দাজ দিচ্ছে। আমি ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নিলাম। এখন অফিস যাব, তাই ট্রাম রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার আগে প্রভাসবাবুকে বললাম আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি না এলে লোকটা টাকাটা দিত না।
প্রভাসবাবু মৃদু হেসে বললেন–আপনি কি টাকাটা পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন?
আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। প্রশ্নটার মধ্যে একটু যেন খোঁচা আছে। বললাম না। কেন বলুন তো!
–একটা শাড়ির সঙ্গে কত কী স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। শাড়ির দামটা তো বড় নয়।
আমি মৃদু হেসে বললাম–তাই। তা ছাড়া শাড়িটাও বড় ভাল ছিল।
প্রভাস মাথা নেড়ে বলেন-বুঝেছি। ও টাকা দিয়ে আর একটা ওরকম শাড়ি কিনবেন?
–কিনতে পারি। কিন্তু একরকম শাড়ি তো আর পাওয়া যায় না। দেখা যাক।
প্রভাসরঞ্জন আমার সঙ্গে ট্রাম রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন–শাড়িটা আপনাকে কে দিয়েছিল?
এবার আমি একটু বিরক্ত হই। গায়েপড়া লোক আমার দুচোখের বিষ। বললাম–ওটা আমার খুব পারসোনাল ব্যাপার।
প্রভাসরঞ্জন আমার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে বললেন–আমি অবশ্য আন্দাজ করতে পারি।
করেছিস না হয় একটু উপকার, তা বলে পিছু নেওয়ার কী? পুরুষগুলো এমন বোকা হয়, কী বলব! তবু ভদ্রতা তো আর আমাদের ছাড়ে না। আমার আবার ওই এক দোষ, সকলের সঙ্গে প্রত্যয়ের একটু সুরে কথা বলে ফেলি। তা ছাড়া, লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওর আন্দাজটা সত্যিই হতে পারে।
বললাম কী আন্দাজ করলেন?
প্রভাসরঞ্জন মৃদু স্বরে বললেন–আপনার স্বামী।
আমি একটু কেঁপে উঠলাম মনে মনে। কপালে বা সিথিতে আমি সিঁদুর দিই না। সম্পূর্ণ কুমারীর চেহারা আমার। তা ছাড়া যে এলাকায় আছি সেখানকার কেউ আমাকে চেনে না। এই লোকটা জানল কী করে যে আমার একজন স্বামী আছে?
এবার একটু কঠিন স্বরে কথা বলাটা একান্ত দরকার। লোকটা বড় বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।
বললাম–আমার স্বামীর খবর আপনাকে কে দিল? আমার স্বামী-টামী কেউ নেই।
লোকটা অবাক হয়ে বলে–নেই! তা হলে তো আমার আন্দাজ ভুল হয়ে গেছে!
–হ্যাঁ! এরকম অকারণ আন্দাজ করে করে আর সময় নষ্ট করবেন না। পুরুষমানুষদের কত কাজ থাকে। পরের ব্যাপার নিয়ে মেয়েরা মাথা ঘামায়।
প্রভাসরঞ্জন কিন্তু অপমান বোধ করলেন না। বড় গরম আর রোদে ভদ্রলোক ঘেমে নেয়ে যাবে। একটা টার্কিশ রুমালে ঘাড় গলা মুছলেন। পরনে একটা পাজামা আর নীল শার্ট। শার্টের কাটছাঁট বিদেশি। বাঁ হাতে বড়সড় দামি ঘড়ি। চেহারা দেখে সচ্ছল মনে হয়।
অপমান গায়ে না মেখে প্রভাসরঞ্জন বললেন–আমি আপনার ফ্ল্যাটের নীচের তলায় থাকি। আপনি তো ঠিক চিনবেন না আমাকে। পাঁচুবাবু নামে যে বুড়ো ভদ্রলোক হাসপাতালে গেছেন আমি তাঁরই ফ্ল্যাটে
আমি হাসলাম। বললাম–ও, ভালই তো। আমি অবশ্য ও বাড়ির কারও সঙ্গে বড় একটা মিশিনা।
–ভুল করেন।
–কেন?
–মেশেন না বলেই আপনাকে নিয়ে তোক খুব চিন্তা-ভাবনা করে, নানা গুজব রটায়।
আমি তা জানি। রটাবেই, বাঙালির স্বভাব যাবে কোথায়? বললাম–আমি ভুল করি না, ঠিকই করি। ওদের সঙ্গে মিশতে রুচিতে বাধে।
প্রভাসরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন–সেটা হয়তো ঠিকই। তবে আমি অন্য ধাতুতে গড়া, সব রকম মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
উনি কার সঙ্গে মিশেছেন, কেন মিশেছেন সে সম্পর্কে আমার কৌতূহল নেই। পার্ক সার্কাসের ট্রামস্টপে দাঁড়িয়ে আমি সানগ্লাসের ভিতর দিয়ে পার্কের দিকে চেয়ে থাকি। একটা কাক বুঝি ডানা ভেঙে কোনও খন্দে পড়েছে, তাকে ঘিরে হাজারটা কাকের চেঁচামেচি। কান ঝালাপালা করে দিল। তবু কাকের মতো এত সামাজিক পাখি আর দেখিনি। ওদের একজনের কিছু হলে সবাই দল বেঁধে দু জানাতে আসে। মানুষের মধ্যে কাকের এই ভালটুকুও নেই।
ট্রামের কোনও শব্দ পাচ্ছি না। বললাম-তাই নাকি?
এই তাই নাকি কথাটা এত দেরি করে বললাম যে প্রভাসরঞ্জন একটু অবাক হয়ে বললেন কিছু বললেন?
আমি বললাম কিছু না।
প্রভাসরঞ্জন আমার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। রোদ, গরম সব উপেক্ষা করে। আজকাল প্রায়ই পুরুষেরা আমার প্রেমে পড়ে যায়। এর সম্পর্কেও আমার সে ভয় হচ্ছে। বেচারা!
একটু ভদ্রতা করে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম-লন্ড্রিওয়ালা কি আপনার চেনা?
না তো! বলে ফের বিস্ময় দেখালেন উনি।
আমি বলি–আপনার কথায় লোকটা তা হলে ম্যাজিকের মতো পাল্টে গেল কেন?
–ওঃ! সেও এক মজা। ওর দোকানে আমিও কাঁচাতে-টাচাতে দিই, সেই সুবাদে একটু চেনা। একবার একটি প্যান্টের পকেটে ভুলে আমার পাসপোর্টটা চলে গিয়েছিল। সেইটে দেখে ও হঠাৎ আমাকে সমীহ করতে শুরু করে।
–পাসপোর্ট! আপনি বিদেশে ছিলেন নাকি?
এখনও কি নেই? গোটা পৃথিবীটাই আমার বিদেশ।
ট্রাম কেন এখনও আসছে না এই ভেবে আমি কিছু অস্থির হয়ে পড়লাম। কারণ, আমার মনে হচ্ছিল, এ লোকটা পাগল। এর সঙ্গে আমি এক বাড়িতে থাকি ভাবতেও খুব স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
প্রভাসরঞ্জন হাতের মস্ত ঘড়িটা দেখে কিছু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন–আপনার ট্রাম তো এখনও এল না। অফিস কটায়?
আমি বললাম-দশটায়। তবে দশ-পনেরো মিনিট দেরি করলে কিছু হবে না।
ব্যথিত হয়ে প্রভাসরঞ্জন বলল–ওটা ঠিক নয়। দশ-পনেরো মিনিট দেরি যে কী ভীষণ হতে পারে।
আমি হেসে বললাম কী আর হবে! সকলেরই একটু দেরি হয়। ট্রাম বাসে সময়মতো ওঠাও তো মুশকিল।
হু। প্রভাসরঞ্জন বললেন–তার মানে কোথাও কেউ একজন দেরি করছে, সেই থেকেই দেরিটা সকলের মধ্যেই চারিয়ে যাচ্ছে। ধরুন একজন স্টার্টার বাস ছাড়তে দেরি করল, ড্রাইভারও একটা পান খেতে গিয়ে দু মিনিট পিছোল, বাস দেরি করে ছাড়ল, সেই বাস-ভর্তি অফিসের লোকেরও হয়ে গেল দেরি। এই রকম আর কী। একজনের দেরি দেখেই অনন্যরা দেরি করা শিখে নেয়।
আমি হাসছিলাম।
উনি বললেন কী করে অবস্থাটা পালটে দেওয়া যায় বলুন তো।
পলিটানো যায় না। ওই বুঝি আমার ট্রাম এল—
–হ্যাঁ। কিন্তু খুব ভিড়, উঠতে পারবেন না।
ভিড় ঠিকই। ট্রাম বাসের একটু দেরি হলেই প্রচণ্ড ভিড় হয়। তবে আমার অভ্যাস আছে।
চলি। বলেই ট্রামের দিকেই এগোই।
প্রভাসরঞ্জন হঠাৎ আমার পিছন থেকে অনুচ্চ স্বরে বললেন–সেদিন দুপুরে কে একটা লোক আপনার ঘরে ঢুকেছিল বলুন তো, আপনার স্বামী।
কথাটা শুনে আমি আর ঘাড় ফেরালাম না; শুনিনি ভান করে ভিড়ের ট্রামে ধাক্কাধাক্কি করে উঠে গেলাম ঠিক।
আমার কোনওদিনই তেমন ঘাম হয় না, ইসিনোফিলিয়া আছে বলে প্রায় সময়ই বরং আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ শীত করে ওঠে। কিন্তু আজ আমি অবিরল ঘামছিলাম। সারাদিন বড় বেশি অন্যমনস্কও রইলাম আমি। মনে হচ্ছে, লন্ড্রিতে ওই লোকটার আসা, গায়ে পড়ে উপকার করা আর তার পরের এত সব সংলাপ এ সবই আগে থেকে প্ল্যান করে করা। এতদিন আমার জীবনটা যত নিরাপদ আর নির্বিঘ্ন ছিল এখন যে আর ততটা নয় তা বুঝতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এরা বা এই লোকটা অন্তত আমার বিয়ের খবর রাখে।
.
সাতদিন কেটে গেছে, প্রভাসরঞ্জনের সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময় বা নামবার মুখে পাঁচুবাবুর বাইরের ঘরে থেকে খুব টাইপ রাইটারের আওয়াজ পাই। দরজা ভেজানো থাকে, কাউকে দেখা যায় না। আমিও তো আমার সিঁড়ির গোড়ায় বেশিক্ষণ থাকিনা। বরং ভূতের ভয়ে কোনও জায়গা দিয়ে যেতে যেমন গা ছমছম করে, তেমনি একটা ভাব টের পাই। তাই সিঁড়ির মুখটা খুব হালকা দ্রুত পায়ে পেরিয়ে পক্ষিণীর মতো উড়ে যাই।
আমি খুব সাবধান হয়ে গেছি আজকাল। বাইরের দরজাটায় সব সময় ল্যাচকিতে চাবি দিয়ে রাখি। স্পাই হোল দিয়ে না দেখে আর নাম ধাম জিজ্ঞেস না করে বড় একটা দরজা খুলি না। অবশ্য আমার ঘরে আসবেই বা কে?
একদিন আমার দাদা অভিজিং এল। সে বরাবর রোগা দুর্বল যুবক, শীত গ্রীষ্মে গলায় একটা সুতির কক্ষটার থাকবেই। ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে পারে না, সারা বছর তার সর্দি থাকে। ডাক্তার বলেছে এ রোগ সারার নয়।
সকালবেলায় দাদা এসে ঘরে পা দিয়েই ঝগড়া শুরু করল–এ তুই শুরু করেছিস কী বল তোর আমাদের পরিবারটা মডার্ন বটে, কিন্তু তুই যে সব লিমিট ছাড়িয়ে গেলি!
রাগ করে বললাম–ও কথা বলছিস কেন? একা থাকি বলে যত খারাপ সন্দেহ, না?
বটেই তো। জয়দেবের সঙ্গে না থাকিস আমরা তো রয়েছি। এ দেশের সমাজে একা থাকে কোন মেয়ে?
–আমি থাকব।
–না, থাকবি না। তোর ঝাটি-পাটি যা আছে গুছিয়ে নে, আমি ট্যাকসি ডাকি।
নিজের বাড়ির কোনও লোককেই আজকাল আমার সহ্য হয় না। ওরা আমাকে স্বাভাবিক জীবন গ্রহণ করতে শেখায়নি। সেটা আজকাল আমি বড় টের পাই। চারদিকে যখন স্বামী-স্ত্রীর বসবাস দেখি তখনই আমার মনে হয়, আমারই যেন কী একটা ছিল না, হয়তো সইবার শক্তি বহনের ক্ষমতা, যা না থাকলে বিবাহিত জীবন বলে কিছু হয় না।
আমি দাদার জন্য চা করতে গিয়ে মনটাকে শক্ত করলাম খুব।
ফিরে এসে বললাম-জয়দেব বা আর কারও সঙ্গে আমি থাকব না।
–জয়দেবেরই বা দোষটা কী?
যাই হোক। সব কি তোকে বলতে হবে নাকি?
কথায় কথায় ঝগড়া লেগে গেল। দাদা খুব জোরে চেঁচিয়ে কথা বলছিল। এই সময় ফোনটা আবার বাজল। দৌড়ে গিয়ে রিসিভার কানে তুলতেই সেই ধীর গম্ভীর গলায় বলল–আপনার ঘরে লোকটা কে?
আমি ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে বললাম আসুন না প্রভাসবাবু একটু হেলপ করবেন। এ লোকটা আমার দাদা, বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।
টেলিফোনে গলাটা শুনেই আজ আমি লোকটাকে চিনে ফেলেছি। কথা কটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশে হাসি শোনা গেল। প্রভাসরঞ্জন বললেনবড্ড মুশকিল হল দেখছি! চিনে ফেললেন! দাদা কী বলছেন?
–ফিরে যেতে।
–তাই যান না। জয়দেববাবুর তো কোনও দোষ নেই।
–আপনি সেটা জানলেন কী করে?
খোঁজ নিয়েছি। ইনফ্যাক্ট আমি জয়দেববাবুর সঙ্গেও দেখা করেছি কদিন আগে।
–মিথ্যে কথা।
না, মিথ্যে নয়। আমি এখন একটা ডেইলি নিউজ পেপারের স্পেশাল রিপোর্টার। মধু মল্লিক যে কাগজে কাজ করেন।
–তাতে কী?
–সেই কাগজের তরফ থেকে স্মল স্কেল আর কটেজ ইন্ডাস্ট্রির একটা সার্ভে করেছিলাম। জয়দেববাবু ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। খুব পণ্ডিত লোক।
আমার কথা উঠল কী করে?
উঠে পড়ল কথায় কথায়।
দাদা এসে এ ঘরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে ফোনের কথা শুনছে। একবার চোখের ইশারা করে জিজ্ঞেস করল–কে?
আমি হাত তুলে ওকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে ফোনে বললাম, আপনিই আমার কথা তুলেছিলেন।
-তাই না হয় হল, ক্ষতি কী?
ক্ষতি অনেক। তার আগে বলুন, আপনার এ ব্যাপারে এত ইন্টারেস্ট কেন?
প্রভাসরঞ্জন কিছু গাঢ় গলায় ইংরিজিতে বললেন–বিকজ আই হ্যাভ অলসোঁ লস্ট সাম অফ মাই হিউম্যান পজেশনস।
ফোন কেটে গেল।
দাদা বলল-কে রে?
একজন চেনা লোক।
দাদা গম্ভীর হয়ে বলল–চেনা লোক! বাঃ, বেশ। চেনার পরিধি এখন পুরুষমহলে বাড়ছে তা হলে।
আমি ছোট্ট করে বললাম–বাড়লে তোর কী?
–আমার অনেক কিছু। সে থাকগে, একি লোকটা তোকে কী বলছিল?
আমি হঠাৎ আক্রোশে রাগে প্রায় ফেটে পড়ে বললাম–তোরা কেউ কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না!
দরজার কাছ থেকে প্রভাসরঞ্জন বললেন শান্তিতে কি এখনই আছেন? যান তো, একটু চা করে এনে খাওয়ান। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম লোকটার সাহস দেখে।