০৮. অর্থনীতিক অবস্থা

অষ্টম অধ্যায় – অর্থনীতিক অবস্থা

মধ্যযুগে বাংলা দেশে অতুল সম্পদ ও ঐশ্বর্যের কথা এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বিবৃত হইয়াছে। কিন্তু ইংরেজশাসনের আরম্ভ হইতেই ইহা ক্রমশঃ হ্রাস পাইতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে অগাধ ঐশ্বর্যের পরিবর্তে চরম দারিদ্র্য উপস্থিত হয়। ইহার প্রধান প্রধান কারণগুলি নিম্নে আলোচিত হইল।

১. বিদেশী লুট

যতদিন পর্যন্ত বাংলা দেশ স্বাধীন ছিল ততদিন বাংলার অর্থসম্পদ এই দেশেই থাকিত। বিদেশী শাসনের ফলে বহু অর্থ বাংলার বাহিরে চলিয়া যাইত, তাহার বিনিময়ে কোন সম্পদ এদেশে আসিত না। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে প্রতি বৎসর যে নানা কারণে বিপুল অর্থ এইরূপে বাংলাদেশের বাহিরে যাইত তাহার বিবরণ দ্বিতীয় খণ্ডে দেওয়া হইয়াছে। পলাশি যুদ্ধের পরে ইংরেজদিগকে মীরজাফর প্রায় তিন কোটি টাকা দিয়াছিলেন। মীরকাশিমও ঐভাবে বহু টাকা দিলেন। পলাশি যুদ্ধের পর নয় বৎসরের মধ্যে (১৭৫৭-৬৬ খ্র.) এইভাবে অন্ততঃ পাঁচ কোটি টাকা ইংরেজ কর্মচারীদের হস্তগত হয়। ইংরেজ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করিবার পর ব্যবস্থা করিল, মোট রাজস্ব হইতে শাসনসংক্রান্ত খরচ বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে তাহা ইংরেজ কোম্পানি ইচ্ছামত ব্যয় করিবে। এই টাকায় এদেশের জিনিসপত্র কিনিয়া কোম্পানি বিলাতে চালান দিত, বিক্রয়লব্ধ অর্থ বিলাতেই থাকিত। অর্থাৎ কোম্পানি বিনা-মূলধনে লাভের ব্যবসা চালাইত। বাংলা হইতে রপ্তানি দ্রব্যের মূল্যের যে-পরিমাণ টাকা প্রতি বৎসর বিদেশে যাইত, তাহার বিনিময়ে কোন দ্রব্য বা টাকা বাংলায় ফিরিয়া আসিত না। ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে বিলাতের পার্লামেন্টে যে হিসাব দাখিল করা হয় তাহাতে দেখা যায় যে, বাংলার মোট রাজস্ব তের কোটি টাকার মধ্যে নয় কোটি টাকা এদেশে ব্যয় হইয়াছে, বাকী চার কোটি টাকা বিলাতে চলিয়া গিয়াছে।

ইহা ছাড়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারিগণ ভারত হইতে অবসর গ্রহণের পর বিলাতে যাইবার সময় যে বহু টাকা সঙ্গে নিয়া যাইতেন তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ আছে। ক্লাইভ নিঃস্ব অবস্থায় এদেশে আসিয়াছিলেন। বিলাতে ফিরিবার সময় তাঁহার সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৫ লক্ষ টাকা এবং বাংলা দেশে তাঁহার যে জমিদারি ছিল তাহার বাৎসরিক আয় ছিল দুই লক্ষ সত্তর হাজার টাকা। তিনি নিজেই স্বীকার করিয়াছিলেন, মাত্র দুই বৎসরে তিনি দশ লক্ষ টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন। বড়লাট হেষ্টিংসের কাউন্সিলের একজন সদস্য ৮০ লক্ষ টাকা বিলাতে লইয়া যান। এইরূপ অন্যান্য ইংরেজ কর্মচারীরাও সঞ্চিত টাকা বিলাতে পাঠাইতেন। দেওয়ানি লাভের পরে তিন বৎসরে (১৭৬৬-৬৮ খ্র.) মোট ছয় কোটি ত্রিশ লক্ষ টাকার বেশী মূল্যের জিনিস বাংলা দেশ হইতে বিলাতে রপ্তানি হয়, তাহার বিনিময়ে মাত্র ষাট লক্ষ টাকার জিনিস আমদানি হয়–অর্থাৎ, পাঁচ কোটি সত্তর লক্ষ টাকা বিদেশে চলিয়া যায়, তাহার বিনিময়ে কোন ধনসম্পদ এদেশে আসে না।

বাংলা সরকারের জন্য বিলাতে নানারকম অজুহাতে বহু টাকা খরচ হইত। ইহাকে বলা হইত Home Charge। ১৮৫১ সনে ইহার পরিমাণ ছিল আড়াই কোটি টাকা, ১৯৩৩-৩৪ সনে ইহা বাড়িয়া হয় সাড়ে সাতাশ কোটি টাকা।

২. বাংলার শিল্পবাণিজ্যের ধ্বংস

মুঘল আমলে বহু টাকা বাংলার বাহিরে গেলেও বাংলার ঐশ্বর্য ও সম্পদ নষ্ট হয় নাই। কারণ তখন বাংলার শিল্পবাণিজ্য সম্পদের আকর ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কিরূপে ইহা ধ্বংস হইল তাহা সংক্ষেপে বিবৃত করা প্রয়োজন।

বাংলা দেশে ইংরেজের প্রভুত্বস্থাপনের অল্পকাল পরেই ইংলণ্ডে নবাবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির ও বাষ্পীয় শক্তির সাহায্যে শিল্পের নবযুগ আরম্ভ হয়। অনেকের মতে কেবলমাত্র নূতন নূতন আবিষ্কার দ্বারা এই শিল্প-বিপ্লব ঘটান (Industrial Revolution) সম্ভব হইত না। ইংরেজ বাংলা দেশ হইতে যে বিপুল অর্থ ইংলণ্ডে নিয়া যায় তাহাকে মূলধন করিয়াই এই বিপ্লব সম্ভবপর হইয়াছিল। কারণ যাহাই হউক, শিল্প-বিপ্লবের ফলে কারখানা-শিল্পের যে অদ্ভুত উন্নতি হয়, তাহার ফলে অল্প সময়ের মধ্যে হস্তশিল্প অপেক্ষা বহু পরিমাণ দ্রব্য উৎপন্ন করা সম্ভব হয় এবং তাহার খরচও অনেক কম পড়ে। এদেশের তাঁতীরা হাতে যে কাপড় বুনিত তাহা বিলাতী কলে প্রস্তুত কাপড়ের প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকিতে পারিত কিনা সন্দেহ। কিন্তু রাজকীয় ক্ষমতার অপব্যহার করিয়া নানা অবৈধ উপায়ে বাংলার কুটিরশিল্প সমূলে ধ্বংস করিয়া যাহাতে বিলাতী শিল্পজাত দ্রব্যের একচ্ছত্র আধিপত্য হয় ইংরেজ-সরকার সে-বিষয়ে বদ্ধপরিকর হইল।

পলাশি যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি রাজনীতিক ক্ষমতার বলে যেরূপ বেআইনী ও অবৈধ উপায়ে ব্যবসায় দ্বারা এদেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করিয়াছিল এবং মীরকাশিম তাহার প্রতিবাদ করার ফলে যে রাজ্যভ্রষ্ট হন, এই পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডে তাহা বিবৃত হইয়াছে। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে দেওয়ানি লাভ করার পর রাজকীয় ক্ষমতা পুরাপুরি হাতে পাইয়া নানাবিধ আইনের সাহায্যে এই ধ্বংসযজ্ঞের পূর্ণ আহুতি হয়। ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে নূতন সনদ অনুসারে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য বন্ধ হয়, যে-কোন ইংরেজ কোম্পানি বিনাশুল্কে অথবা নামমাত্র শুল্কে এদেশে বাণিজ্যদ্রব্য আমদানি করিতে পারিত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাংলার যে সমুদয় দ্রব্য বিলাতে আমদানি হইত তাহার উপর অসম্ভব শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়। আর বাংলার তাঁতীদের উপর নানারকমের অত্যাচার চলিতে থাকে, যাহাতে তাহারা কম মূল্য পাইলেও তাহাদের মাল অন্য বিদেশী কোম্পানির নিকট বিক্রয় না করিয়া ইংরেজের নিকট বিক্রয় করিতে বাধ্য হয়।

১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে ১লা সেপ্টেম্বর তুলা ও রেশমের কারবারী ১১৭ জন বাঙ্গালী ইংরেজ গভর্নমেন্টের নিকট এক দরখাস্ত করে। তাহার সারমর্ম এই :

“সম্প্রতি বিলাতী কাপড়ের আমদানি এত বৃদ্ধি পাইয়াছে যে আমাদের ব্যবসায় বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে। বিলাতী দ্রব্যের উপর এদেশে কোন শুল্ক আদায় করা হয় না। কিন্তু বাংলায় উৎপন্ন সুতি ও রেশমী কাপড়ের উপর বিলাতে যথাক্রমে শতকরা ১০ ও ২৪ টাকা শুল্ক দিতে হয়। সুতরাং আমাদের প্রার্থনা যে এদেশে আমদানি বিলাতী কাপড়ের উপর যখন যে শুল্ক নির্ধারিত হয় বিলাতে আমদানি বাংলা দেশের কাপড়ের উপর তাহার অধিক শুল্ক যেন বসান না হয়।”

এই প্রার্থনায় কোন ফল হয় নাই। কিন্তু ইংলণ্ডের অনুসৃত বাণিজ্যনীতি এত অসঙ্গত ছিল যে একদল ইংরেজ বণিকও বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের উক্ত আবেদন সমর্থন করে। তাহারা আরও বলে, ইংলণ্ডে প্রস্তুত রেশমীদ্রব্যের রপ্তানির উপর পূর্বে যে শুল্ক ধার্য হইয়াছিল তাহার ক্ষতিপূরণস্বরূপ উহার তুল্য পরিমাণ টাকা ব্যবসায়ীগণকে ইংরেজ গভর্নমেন্ট দিত-সুতরাং ঐ নীতি অনুসরণ করিয়া ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাহাদের রপ্তানিদ্রব্যের উপর যে শুল্ক দেয় তাহারও ক্ষতিপূরণ করা উচিত।৪ ইংরেজ কোম্পানি ইহা করে নাই। বলা বাহুল্য, ভারতবর্ষে কারখানা-শিল্প প্রতিষ্ঠা করিয়া ভারতের বয়নশিল্পকে বিলাতের প্রতিযোগিতা হইতে রক্ষা করা তো দূরের কথা, পরবর্তীকালে যখন ভারতীয়েরা নিজের চেষ্টায় কাপড়ের কল তৈরি করিতে আরম্ভ করিল তখন বিলাতী বস্ত্র-ব্যবসায়ীদের স্বার্থের খাতিরে ভারতে প্রস্তুত বস্ত্রের উপর শুল্ক বসান হইল। ইহার ফলে এদেশের তুলাজাত দ্রব্যের রপ্তানির হ্রাস ও বিলাতী দ্রব্যের আমদানি কিরূপে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাইতেছিল নিম্নলিখিত সংখ্যাগুলি হইতে তাহা সহজেই বোঝা যাইবে।৫

বৎসরএদেশ হইতে রপ্তানি তুলার দ্রব্যের মূল্য সিক্কা টাকাবিলাত হইতে আমদানি তুলার দ্রব্যের মূল্য সিক্কা টাকা
১৮১৬-১৭১,৬৫,৯৪,৩৮০৩,১৭,৬০২
১৮১৭-১৮১,৩২,৭২,৮৫৪১১,২২,৩৭২
১৮১৮-১৯১,১৫,২৭,৩৮৫২৬,৫৮,৯৪০
১৮১৯-২০৯০,৩০,৭৯৬১৫,৮২,৩৫৩
১৮২৩-২৪৫৮,৭০,৫২৩৩৭,২০,৫৪০
১৮২৬-২৭৩৯,৪৮,৪৪২৪৩,৪৬,০৫৪
১৮২৯-৩০১৩,২৬,৪২৩৫২,১৬,২২৬
১৮৩২৩৩ ৮,২২,৮৯১৪২,৬৪,৭০৭

১৮২৪-২৫ সনের পূর্বে বিলাতী সুতা এদেশে আমদানি হইত না। ১৮২৫-২৬ সনে মোট ৭৫,২৭৬ টাকার বিলাতী সুতা আমদানি হয়। ছয় বৎসরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৩১-৩২ সনে সুতার আমদানি বাড়িয়া মোট ৪২,৮৫,৫১৭ টাকায় উঠিল।

সার চার্লস ট্রেভিলিয়ান (Sir Charles Trevelyan) ১৮৩৪ সনে লিখিয়াছেন : “বাঙ্গালায় প্রস্তুত তুলার দ্রব্যের জিনিস বিদেশে রপ্তানি প্রতি বৎসর এক কোটি টাকা হ্রাস পাইয়াছে এবং এদেশের বাজারে বিক্রয় (সুতা সহ) বৎসরে আশী লক্ষ টাকা কমিয়াছে। অর্থাৎ মোটের উপর প্রতি বৎসর ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার মাল কম বিক্রি হইয়াছে। অল্প যে কিছু দ্রব্য এখনও রপ্তানি হয় তাহাও ইংলণ্ডে প্রস্তুত সুতার তৈরি।”৬।

অন্যান্য বিলাতী শিল্পদ্রব্যের আমদানিও এইরূপ দ্রুতবেগে বাড়িতে থাকে। ১৮১৩-১৪ সনে বিলাত হইতে বাংলায় মোট আমদানি হইয়াছিল ৮,৭৭,৯১৭ পাউণ্ড মূল্যের দ্রব্য। ১৮২৭-২৮ সনে ইহার পরিমাণ হইয়াছিল ২২,৩২,৭২৫ পাউণ্ড। ১৮১৪-১৫ সনে সমগ্র ভারত হইতে ৩,৮৪২ গাঁইট কাপড় বিলাতে চালান হয়। ১৮২৮-২৯ সনে ইহার সংখ্যা হয় ৪৩৩।

১৮৫১ সনে আমদানি অপেক্ষা রপ্তানি দ্রব্যের মূল্যাধিক্য ছিল ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। ১৯৩৩-৩৪ সনে ইহার পরিমাণ ছিল ৬৯ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। ইহার মধ্যে ২৭ কোটির দ্রব্য ও প্রায় ৪৩ কোটি মুদ্রা রপ্তানি হইয়াছিল।

বাংলার বাণিজ্য ধ্বংসের আর-এক কারণ ইংরেজ-কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য। ১৭৬৫ সনে লবণ, সুপারি ও তামাকের বাণিজ্য একচেটিয়া করা হয়। অর্থাৎ, বাংলা দেশের ভিতরও কেবলমাত্র কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত একটি ইংরেজ সমিতি ছাড়া আর কেহ পাইকারী হিসাবে এই সমুদয় দ্রব্য বেচাকেনা করিতে পারিবে না এই ব্যবস্থা হয়। প্রত্যেক জমিদারের নিকট হইতে মুচলেকা নেওয়া হইল যে তাহাদের জমিদারির মধ্যে যে লবণ উৎপন্ন হইবে তাহার কণামাত্রও কোম্পানির অনুমতি ব্যতীত কাহারও নিকটে বিক্রয় করা হইবে না। ইহার ফলে বাংলায় সাধারণ লোকের লবণ তৈরি করা বন্ধ হইল এবং হাজার হাজার লোকের জীবিকা নষ্ট হইল। আর পূর্বোক্ত ইংরেজ সমিতির ৬০ জন সভ্য দুই বৎসরে প্রায় ৭ লক্ষ পাউণ্ড অর্থাৎ ৭০ লক্ষ টাকা মুনাফা করিলেন। ১৭৬৮ সনে এই সমিতি উঠিয়া যায়, কিন্তু ১৭৭২ সনে হেষ্টিংস লবণ-ব্যবসায়ে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করিয়া ইংরেজ এজেন্ট দ্বারা লবণ তৈরির ব্যবস্থা করেন। ইংরেজদের এই একচেটিয়া ব্যবসায়ের লোভে নানা রকমের বাংলার শিল্প-বাণিজ্য নষ্ট করে। বাঙ্গালী তাঁতীরা বাংলা দেশে উৎপন্ন কার্পাস সুতা ব্যবহার করিত এবং প্রয়োজনমত উত্তরপ্রদেশ হইতে গঙ্গা যমুনা নদীর পথে সুতার আমদানি হইত। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি এই সকল সুতার উপর শতকরা ৩০ টাকা শুল্ক বসাইল যাহাতে সুরাট হইতে সমুদ্রপথে তাহাদের আমদানি সুতা বাংলার তাঁতীরা কিনিতে বাধ্য হয়।৮

বাংলা দেশের অনেক রকমের কাপড় ভারতের বাহিরে বসোরা, জেড্ডা, মোচা প্রভৃতি নানা দেশে চালান যাইত এবং ঐ দেশের বণিকেরা তাহা কিনিতে বাংলায় আসিত। ইংরেজ কোম্পানি এই প্রকার কাপড়ের ব্যবসা করিত না। কিন্তু তাহাদের কর্মচারীরা এই ব্যবসা আরম্ভ করিল। তাহাদের অত্যাচারে তাঁতীরা অন্য কাহারও নিকট ঐসব বস্ত্র বিক্রয় করিতে পারিত না।

ইংরেজ কোম্পানি চা-বাগান, লৌহের কারখানা প্রভৃতি আরম্ভ করিবার জন্য ইংরেজদিগকে নানারকম সুবিধা দিত ও অর্থ সাহায্য করিত, কিন্তু কোন বাঙ্গালীর ভাগ্যে তাহা জুটিত না।

বাংলার আভ্যন্তরিক বাণিজ্যে একাধিপত্য স্থাপনের জন্য ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারিগণ কিরূপ অত্যাচার করিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ তাহার এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন : “বিভিন্ন ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার স্থাপনের ফলে ঐ সমুদয় ব্যবসায়ীগণের উপর সমগ্র দেশব্যাপী অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশঃই বাড়িয়া চলিয়াছে। ইংরেজ ব্যবসায়ী ইচ্ছামত যে সামান্য দাম দেয় তাহার চেয়ে ফরাসি ও ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা অনেক বেশী দাম দিতে প্রস্তুত–সুতরাং তাঁতীরা গোপনে তাহাদের নিকট বিক্রি করিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ধরা পড়িলে সমূহ বিপদ, কারণ কোন তাঁতী তাহার মাল ফরাসি, ওলন্দাজ বা অন্যের নিকট বিক্রয় করিলে এবং কোন দালাল বা পাইকার এবিষয়ে তাহাকে সাহায্য করিলে অথবা এইরূপ বিক্রয়ের কথা জানিয়াও কোন বাধা না দিলে কোম্পানির গোমস্তা বা পিওন তাহাদের সকলকে ধরিয়া হাতে কড়ি দিয়া কয়েদ করিয়া রাখে, মোটা টাকা জরিমানা করে, বেত মারে এবং এমনকি নানা উপায়ে তাহাদের জাত মারে”।৯

ইংরেজের প্রতিযোগিতা ও অত্যাচার বাংলার শিল্প ধ্বংসের প্রধান ও প্রত্যক্ষ কারণ। কিন্তু ইংরেজের সহিত সংস্পর্শের প্রভাবও বাংলার কুটিরশিল্প ধ্বংসের অন্যতম অপ্রত্যক্ষ কারণ। এই প্রভাবের ফলে দেশের মধ্যবিত্ত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের অনেক বিষয়ে রুচির পরিবর্তন হয়। বিশেষতঃ কলে তৈরি বস্ত্র ও অন্যান্য অনেক শিল্পদ্রব্য কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য অপেক্ষা দামে সস্তা, দেখিতে সুন্দর ও ব্যবহারের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক হওয়ায় স্বভাবতই তাহার ব্যবহার বাড়িল। বিলাতে লোকের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণাও বিলাতী দ্রব্যের আভিজাত্য স্থাপন করিবার পক্ষে সহায়তা করিল। প্রয়োজন ও সৌন্দর্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গী অনেক পরিবর্তিত হইল। সাহেবেরা যাহা ব্যবহার করেন, তাহারা যাহা ভাল মনে করেন, নব্য ইংরেজীশিক্ষিত ও ধনী অভিজাত সম্প্রদায় তাহার অনুকরণ করা আভিজাত্যের নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করিলেন। ইহার ফলে অনেক পুরাতন জিনিসের ব্যবহার কমিতে লাগিল এবং নূতন নূতন বিলাতীদ্রব্যের আকর্ষণ বাড়িতে লাগিল। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পুরাতন শিল্পের অবনতি ঘটিল, কিন্তু নূতন রুচি অনুযায়ী সকল দ্রব্য এদেশে প্রস্তুত করার সম্ভাবনা বা ইচ্ছারও যথেষ্ট অভাব ছিল। কারণ, নূতন জিনিসগুলির বেশীর ভাগই কারখানা-শিল্পের তৈরী। কুটিরশিল্পের স্থানে কারখানা-শিল্পের প্রবর্তন অনেক আয়াসসাধ্য, এবং গভর্নমেন্টের বিশেষ সহায়তা ব্যতীত ইহা অনেক স্থলেই সম্ভবপর হয় না। কিন্তু ইংরেজ তখন দেশের রাজা, এদেশে কারখানা-শিল্প স্থাপন তাহাদের স্বার্থের বিরোধী। সুতরাং সহায়তা তো দূরের কথা তাহারা পুরাপুরি প্রতিবন্ধকতা করিল। ভারতবর্ষে কাপড়ের কলের প্রতিষ্ঠা হইলে বিলাতে ম্যাঞ্চেষ্টারের কাপড়ের কলগুলির সর্বনাশ হইবে এই আশঙ্কায় যখন আমেদাবাদ ও অন্যান্য স্থলে এদেশীয় লোকের চেষ্টায় কাপড়ের কলের প্রতিষ্ঠা আরম্ভ হইল, তখন ইংরেজ সরকার ইহার উন্নতির পথে নানারকম বাধা সৃষ্টি করিতে লাগিল। একসময় কলে তৈরী বিলাতী কাপড় এদেশ ছাইয়া ফেলিয়াছিল বলিয়াই বাংলার বয়নশিল্প সমূলে ধ্বংস হইয়াছিল। আজ এদেশে কাপড়ের কলকারখানা প্রতিষ্ঠার ফলে দেশ হইতে বিলাতী কাপড়ের ব্যবহার প্রায় উঠিয়া গিয়াছে বলিলেই চলে।

সর্বদেশে সর্বকালেই বৈজ্ঞানিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের রীতি ও প্রকৃতির পরিবর্তন হয়, আর ইহার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া নূতন প্রণালী অনুসরণ করিতে না পারিলে শিল্পের অবনতি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আঠারো ও উনিশ শতকে ইংলণ্ডে যে শিল্প-বিপ্লব হয়, গভর্নমেন্টের আনুকূল্যে নানাবিধ উপায়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ তাহার অনুকরণ করিয়া নিজেদের শিল্পকে তাহার সহিত প্রতিযোগিতা করিবার উপযুক্ত করিয়া তোলে। কিন্তু এদেশের ইংরেজ-সরকারের স্বার্থ ছিল ঠিক তাহার বিপরীত। অর্থাৎ, ভারতবর্ষে যাহাতে নূতন প্রণালীর কারখানা-শিল্প গড়িয়া না ওঠে এবং বিলাতী শিল্পজাত দ্রব্যের দ্বারা এদেশের অর্থ-শোষণ অব্যাহত থাকে সেইদিকেই তাহাদের দৃষ্টি ছিল। অনেকে তর্ক করেন, বাংলার বস্ত্রশিল্পের পক্ষে কারখানা-শিল্পের প্রতিযোগিতা সম্ভবপর ছিল না, সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই ইহা ধ্বংস হইয়াছে–ইহার জন্য ইংরেজশাসনকে দায়ী করা উচিত নহে। কিন্তু তাঁহারা ভুলিয়া যান, প্রতি দেশের গভর্নমেন্টেরই প্রথম ও প্রধান কর্তব্য তদ্দেশীয় জনসাধারণের উন্নতিসাধন। ইউরোপের অন্যান্য দেশে গভর্নমেন্ট যাহা করিয়াছিল তাহা না-করা এবং এ-বিষয়ে দেশের লোকের স্বাধীন চেষ্টা যাহাতে সফল না হইতে পরে তাহার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করা–এই দুইটি অবিসম্বাদিত ঐতিহাসিক তথ্য মনে রাখিলে ইংরেজ গভর্নমেন্টই যে এদেশের বাণিজ্য ও শিল্পের ধ্বংসের জন্য প্রধানত দায়ী ইহা কোনমতেই অস্বীকার করা যায় না।

বাংলার শিল্প ধ্বংসের এই করুণ ইতিহাস এদেশের লোক বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিল। সমসাময়িক পত্রিকায় এই বিষয়ে বহু আলোচনা দেখা যায়। উনিশ শতকের শেষভাগে বাংলার শিল্প-বাণিজ্য সম্বন্ধে ‘সোম প্রকাশ’-সম্পাদক যে বিস্তৃত মন্তব্য করেন নিম্নে তাহা উদ্ধৃত হইল :

“বর্তমান প্রস্তাবে দেশাভিজাত শিল্প সম্বন্ধে কিরূপ ব্যবসায় হইয়াছে, তাহার আলোচনা করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে যে বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্রবে দেশীয় শিল্প ব্যবসায় ক্রমেই লোপ হইতেছে। যে শিল্পকাৰ্য্য সভ্যতার অকাট্য প্রমাণ, যে শিল্পকাৰ্যে দেশের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি ও অর্থের অভাব দূরীভূত হয়, বঙ্গের যাহাতে মানব সমাজের ভূরি পরিমাণে কল্যাণ সাধিত হয়, দারিদ্র্য দুঃখ অপহৃত হয়, বঙ্গের সেই শিল্পের কিরূপ হীনদশা উপস্থিত হইয়াছে, পাঠকবর্গ এতৎ প্রস্তাব পাঠে অনায়াসেই তাহার উপলব্ধি করিতে পারিবেন। বঙ্গদেশের এমন কোন শিল্পজাত দ্রব্য নাই যাহা বিদেশে আগ্রহসহকারে নীত হইয়া থাকে। পূর্বে ঢাকা অঞ্চলের নানাবিধ মনোহর সূক্ষ্ম বস্ত্ৰসকল নানা দেশে প্রেরিত হইত, এক্ষণে তন্তুবায়গণ সে প্রকার উৎকৃষ্ট বস্ত্র প্রস্তুত করিতে পারে না, ঢাকাই জামদান নবাব সুবারা পাইয়া কত আনন্দ প্রকাশ করিতেন, এক্ষণে সে সকল বস্ত্রের নামমাত্র অবশিষ্ট হইয়াছে। দেশীয় শিল্পীগণ আপন আপন ব্যবসায় ভুলিয়া যাইতেছে।…এটি দেশের শ্রীবৃদ্ধির কি অবনতির চিহ্ন তাহা পাঠক অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন। এক্ষণে বঙ্গদেশের মধ্যে যে কিছু শিল্পদ্রব্য উৎপন্ন হয় তাহা বঙ্গদেশ ছাড়িয়া বাহিরের মুখ দেখিতে পায় না। পূৰ্ব্বে যে যে শিল্পের সদ্ভাব ছিল, পাশ্চাত্ত্য বাণিজ্য সংস্রবে তাহার যে মহত্তর অনিষ্ট ঘটিয়াছে, চিন্তাশীল লোকমাত্রেই তাহা অনুভব করিয়াছেন। ১৮৮২ ৮৩-এর বঙ্গদেশীয় শাসন সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনীতে স্পষ্ট লিখিত হইয়াছে যে, “ইংলণ্ড হইতে বাহুল্যরূপে বস্ত্রের আমদানী হওয়াতে দেশীয় উৎকৃষ্ট শিল্প ও যন্ত্রসকল বিনষ্ট হইতেছে।”

পূর্বের ন্যায় আর ঢাকায় মসলিন প্রস্তুত হয় না, এখানকার ঢাকাই তন্তুবায়গণ আর সে প্রকার সুতা প্রস্তুত করিতে পারে না। তাহারাও সম্পূর্ণরূপে ম্যাঞ্চেষ্টারের অধীন হইয়া পড়িয়াছে। দেশীয় তন্তুবায়েরা সুতার কাজ প্রায় পরিত্যাগ করিয়াছে। বিলাত হইতে যে সকল সুতার আমদানি হয়, এখানকার তাঁতীরা তাহারই ব্যবহার করে। বস্ত্রবয়ন কাৰ্য্য প্রায় উঠিয়া গেল। এক্ষণে চটের গোলের ব্যবসায় তৎস্থান অধিকার করিয়াছে। কলিকাতা ও অন্যান্য স্থানাদিতে চটের কলে খাঁটিয়া অধিকাংশ লোক জীবিকা উৎপাদন করে। এক্ষণে যে যে স্থানে যে যে সামান্য প্রকার দ্রব্য উৎপন্ন হয় তদৃত্তান্ত লিখিত হইতেছে। বর্ধমান বিভাগে কালনায় লালবাগানে যে সকল ধুতি ও শাড়ী প্রস্তুত হইয়া থাকে, তাহা এখনও উৎকৃষ্ট বলিয়া প্রসিদ্ধ। বিলাতের বস্ত্রের আমদানিতে ইহারও ক্রমশঃ অবনতি হইতেছে। বর্ধমান জেলায় ৯টা পাটের কল ও ৩টা কাপড়ের কল আছে। এই সকল কলে চট ও বস্ত্র উৎপন্ন হইয়া থাকে। রামপুর উপবিভাগে পাটের দড়ি অধিক হইয়া থাকে। গত বৎসর পাটের কলে ৭১৪৭৫৭ মণ দ্রব্য প্রস্তুত হইয়াছিল। হাবড়ায় তুলার কলের কাৰ্য্যের ক্রমশই হ্রাস হইয়া আসিতেছে। পশ্চিম অঞ্চলে তুলার কলে যেরূপ লাভ হইতেছে, হাবড়ার কলে সেরূপ হইতেছে না। কিন্তু চটের কলে উত্তমরূপ লাভ হইতেছে। পাটের গাইট কষার জন্য ৩টি কোম্পানী হইয়াছে। বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলায় কতকগুলি লাক্ষার কারখানা আছে। এক বাঁকুড়ায় ৩৪টা লাক্ষার কল হইয়াছে। উক্ত জেলায় লাক্ষার ব্যবসায়ই প্রধান। বীরভূমে ইসলামবাজার নামক স্থানে এ দেশীয়দিগের ৮টি লাক্ষার কারখানা আছে। এস্থলে বলাবাহুল্য যে বহির্বাণিজ্য সম্বন্ধে ঐ একটি পদার্থ এ দেশের প্রধান দ্রব্য। বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর অঞ্চলে ধাতু পাত অধিকাংশ প্রস্তুত হয়, তাহাও বিদেশে রপ্তানি হইয়া থাকে। ১৮৮২-৮৩ অব্দে বর্ধমান জেলা হইতে আট লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার টাকার কাঁসা বিলাতে প্রেরিত হইয়াছিল। ঐ অব্দে হুগলী হইতে ছয় লক্ষ সাঁইত্রিশ হাজার ও মেদিনীপুর হইতে আটাশ লক্ষ ঊনষাইট হাজার টাকার পিতল বিলাতে রপ্তানি হয়। বর্ধমান জেলার মধ্যে কাঞ্চননগর শিল্পের একটি প্রসিদ্ধ স্থান। তথায় ছুরি কচি প্রভৃতি অস্ত্র সকল অতি উত্তমরূপে প্রস্তুত হইয়া থাকে। রাণীগঞ্জ ও বর্ধমানের কাটরা বিভাগে কুম্ভকারের কার্যের কিছু কিছু উন্নতি আছে। বর্ধমানের মধ্যে রঘুনাথচক নামক স্থানে পোর্ট সিমেন্ট প্রস্তুত করিবার একটি কারখানা হইয়াছে। উহার বাণিজ্যে কিছু কিছু লাভ হইতেছে। রাণীগঞ্জে উক্ত সিমেন্ট করিবার জন্য একটি বৃহৎ কারখানা প্রস্তুত হইতেছে। ইহার কাৰ্য্য অদ্যাপি আরম্ভ হয় নাই। বালির কাগজের কাৰ্য্য উত্তমরূপে চলিতেছে। ২৪ পরগণার মধ্যে ৩৪টি কল আছে। ঐ সকল কলে সাতাইশ হাজার লোক খাঁটিয়া থাকে। ঐ সকল কলে থোলে, কাপড়, সুতা, ইট, চাউল, তৈল, লাক্ষা প্রস্তুত হয়। কেরোসিন তৈলের আমদানি নিবন্ধন রেড়ি তৈলের আমদানি কলের কাৰ্য মন্দ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। উক্ত বিভাগে মৃৎপাত্র, লৌহ ও পিত্তল পাত্র, অস্ত্রাদি ও শৃঙ্গের কাৰ্য্য বহুল পরিমাণে হইতেছে। শান্তিপুরের উৎকৃষ্ট বস্ত্র-ব্যবসায় বিলাতি বস্ত্রের আমদানি নিবন্ধন ক্রমেই অবনতি হইতেছে। রেশম প্রস্তুত করিবার প্রধান স্থান মুর্শিদাবাদ। এ ব্যবসারও ক্রমে লোপ হইবার সূচনা হইয়াছে। নদীয়াতে রেশমের একটি কুটি আছে। বিলাতি সাটিন ও অন্যান্য বস্ত্রের আমদানি হেতু এ ব্যবসায়টিও লোপ পাইতে বসিয়াছে। খুলনা জেলাতে মৃত্তিকাঁপাত্র পাটও অধিক জন্মে। কোন কোন স্থানে লবণও প্রস্তুত হইয়া থাকে। রাজসাহী ও কুচবিহার বিভাগ হইতে চটের থান ও থোলে প্রস্তুত হইয়া জেলায় জেলায় আইসে। দিনাজপুর জেলাতেই উক্ত দ্রব্য অধিক প্রস্তুত হয়। পাবনা জেলায় উত্তম বস্ত্রসকল হইয়া থাকে। এই ব্যবসাতে উক্ত জেলা ক্রমশঃ খ্যাতি লাভ করিতেছে। রাজসাহী ও রঙ্গপুরের পিত্তলের বাসন বিদেশে অধিক রপ্তানি হইয়া থাকে। দিনাজপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি, পাবনা প্রভৃতি জেলাতে নানা প্রকার মাদুরের ব্যবসায় আছে। রঙ্গপুরের অন্তর্গত থানা বড়বাড়ীতে হস্তিদন্তে অনেক দ্রব্য প্রস্তুত করা হয়। রঙ্গপুরেও স্বর্ণ রৌপ্যের নানা অলঙ্কার প্রস্তুত হয়। ঢাকা বিভাগে অধিক পাটের গাঁইট প্রস্তুত করা হইয়া থাকে। বস্ত্রের বাণিজ্য অপেক্ষাকৃত বেশী হয় বটে কিন্তু পাটের তুল্য নহে। ঐ বিভাগে শঙ্খের কাজ, নারিকেল তৈল, চিনি, পিত্তল পাত্র, স্বর্ণ ও রৌপ্যের দ্রব্যাদি, মাদুর, সাবান, পনির ইত্যাদি অনেক দ্রব্য উৎপন্ন হয়। ইহা ভিন্ন নৌকানিৰ্মাণ প্রভৃতি সূত্রধরের কাৰ্য্য ও কুম্ভকারের কাৰ্য্যও অধিক হয়।”১০

মধ্যযুগের শেষে সপ্তদশ শতকে বাংলার ঐশ্বর্য পৃথিবীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছিল। বিদেশী পর্যটক মানুষী (Manucci) এদেশের অবস্থা প্রত্যক্ষ করিয়া লিখিয়াছেন : “মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে বাংলাদেশের নামই ফরাসীদের নিকট বেশী পরিচিত। এই দেশ হইতে যে অপরিমিত ধন সম্পদের দ্রব্য ইউরোপে চালান যায় তাহাই ইহার উর্বরতার প্রমাণ। মিসর দেশ অপেক্ষা ইহা কোন অংশে নিকৃষ্ট নহে বরং রেশম, সুতা, চিনি ও নীল প্রভৃতির উৎপাদনে মিশরকেও ছাড়াইয়া যায়।”১১

সমসাময়িক ট্যাভার্নিয়ার (১৬৬৬ খ্রী.) লিখিয়াছেন যে, অতি ক্ষুদ্র নগণ্য গ্রামেও ধান, গম, দুগ্ধ, তরী-তরকারী, চিনি, গুড় প্রভৃতি মিষ্টান্ন প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে পলাশির যুদ্ধের অব্যবহিত পরে (১৭৫৭ খ্রী.) ক্লাইব বলেন যে মুর্শিদাবাদ নগরীর বিস্তৃতি, লোকসংখ্যা ও ধনসম্পদ লণ্ডন শহরের তুল্য, কিন্তু মুর্শিদাবাদে এমন বহু ধনীলোক আছেন যাঁহাদের ঐশ্বর্য লণ্ডনের ধনীলোকের অপেক্ষা অনেক বেশি।

ইংরেজরাজ্যের একশত বৎসর গত হইলে, ১৮৬৮ সনে ভারতীয়দের গড়ে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল কুড়ি টাকা। ১৮৯৯ সনে ইহার পরিমাণ সরকারী হিসাব অনুসারে ৩০ টাকা, বেসরকারী (ইংরেজ ডিগবীর) মতে ১৮ টাকা।

ইংরেজ বণিকদের আগমনের ফলে বাংলা দেশে যে দুর্দশার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল। বাঙ্গালীরা যে ইহা মর্মে মর্মে বুঝিয়াছিল সোমপ্রকাশের পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্য হইতে তাহা বেশ বোঝা যায়। কিন্তু জগতে কিছুই অবিমিশ্র ভাল বা মন্দ হয় না, অশুভের মধ্যেও শুভের বীজ নিহিত থাকে। ইংরেজের সংস্পর্শে আসিয়া বাঙ্গালীর সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও রাজনীতিক চেতনা যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করিয়াছিল–ইহা পরে বিবৃত হইবে। অর্থনীতিক দিক দিয়াও কিছু শুভ ভাল ফলিয়াছিল। ইংরেজ বণিকদের দেওয়ানি, বেনিয়ান ও মুৎসুদ্দিগিরি এবং তৎসহ দালালি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করিয়া এদেশের একদল লোক প্রভূত অর্থসম্পদ অর্জন করিয়াছিলেন। ইঁহারা প্রধানত সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ভুক্ত। ইহাদের মধ্যে মদন দত্ত, রামদুলাল দে সরকার, মতিলাল শীল, প্রাণকৃষ্ণ লাহা, নিমাই চরণ মল্লিক, বিশ্বম্ভর সেন, সাগর দত্ত প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই বা তাঁহাদের পূর্বপুরুষ মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র সপ্তগ্রামের অধিবাসী ছিলেন। সপ্তগ্রাম সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত সমৃদ্ধশালী বন্দর ছিল। কিন্তু সরস্বতী নদী স্রোতহীন হইয়া মরা নদীতে পরিণত হওয়ার ফলে বৃহৎ বাণিজ্যতরী এখানে আসিত না, সুতরাং এখানকার বণিকরা গঙ্গার উভয়তীরস্থ হুগলী, চুঁচুড়া, কলিকাতা প্রভৃতি নানা স্থানে ছড়াইয়া পড়িলেন। ইংরেজ, ফরাসী, ওলন্দাজ প্রভৃতি বণিকগণ এই সমুদয় স্থানে বাণিজ্যকুঠি স্থাপিত করায় সুবর্ণবণিক সম্প্রদায় তাহাদের বেনিয়ান প্রভৃতি পদে নিযুক্ত হইয়া বহু সাহায্য করে, নিজেরাও অনেক ধন উপার্জন করে।

পূর্বে যেসব ধনী বণিকের নাম করা হইয়াছে তাহাদের বংশের প্রাচীন নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে ইহাদের কেহ কেহ যে ইংরেজশাসনের গোড়া হইতেই ইংরেজ বণিকদের সহযোগিতা করিয়া নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি করিতে সমর্থ হন এবং পরে তাঁহাদের পুত্র-পৌত্রগণ ঊনবিংশ শতাব্দীতেও ধনশালী ব্যবসায়ী এবং জমিদার সম্প্রদায়ভুক্ত হন সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমেরিকার অনেক ক্রোড়পতিদের ন্যায় ইহাদের মধ্যেও কেহ কেহ অতিদরিদ্র অবস্থা হইতে প্রভূত ধনসম্পত্তির মালিক হইয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।

১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দে মতিলাল শীলের জন্ম হয়। তাঁহার পিতার একখানি সামান্য দোকান ছিল। মতিলাল বাল্যাবস্থায় পিতৃহীন হইয়া দুরবস্থায় পড়েন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের কয়েকজন সামরিক কর্মচারীর সাহায্যে তিনি ঐ দুর্গের প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্যাদির সরবরাহ করিয়া কিছু অর্থ উপার্জন করেন। তারপর খালি শিশি বোতল ও কর্কের (শোলা) ব্যবসায় করিয়া তিনি প্রচুর ধন লাভ করেন। ইহার ফলে ইউরোপীয় বণিকসমাজ তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি একজন প্রসিদ্ধ ইংরেজ-ব্যবসায়ীর বেনিয়ান বা মুৎসুদ্দি হইলেন। ইহাতে যে অর্থাগম হইল তাহা দ্বারা তিনি বিলাতী জাহাজ কলিকাতায় আসিলে তাহার পণ্যদ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিয়া এবং ঐ সকল জাহাজ ফিরিবার সময় তাহাদের প্রয়োজনীয় মাল সরবরাহ করিয়া প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হইলেন। ক্রমে ক্রমে তিনি ১০।১২টি ইংরেজ কোম্পানির মুৎসুদ্দি এবং তিনটি হৌসের অর্থাৎ ইউরোপীয় বাণিজ্যাগারের অধ্যক্ষ হন। পরে স্বয়ং আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা আরম্ভ করেন এবং ১২ ১৩খানি জাহাজ ক্রয় করিয়া তাহাতেই নিজের মাল চালান দিতেন। প্রচুর ধনৈশ্বর্যের অধিকারী হইয়া জমিদারি ক্রয় করিতে লাগিলেন এবং বাংলার একজন বড় জমিদারে পরিণত হইলেন। তিনি এই অর্থের বহু সদ্ব্যবহার করিয়াছেন এবং তাঁহার দানশীলতা প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে। নিজব্যয়ে কলেজ, গঙ্গাস্নানের ঘাট, চিকিৎসালয়, অতিথিশালা, ঠাকুরবাড়ী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করিয়া তিনি চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য তিনি প্রচুর অর্থ দান করেন। ১৮৫৪ সনে তাহার মৃত্যু হয়।

রামদুলাল দে সরকারের কাহিনীও অতি বিচিত্র। তাঁহার পিতা এক সামান্য পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন এবং বাল্যে পিতৃমাতৃহীন হইয়া নিতান্ত দুরবস্থায় দরিদ্র মাতামহের গৃহে কালাতিপাত করেন। তাঁহার মাতামহী পূর্বোক্ত ধনী ব্যবসায়ী মদন দত্তের বাটিতে পাচিকা নিযুক্ত হওয়ায় রামদুলালও সেই গৃহে আশ্রয় পাইলেন। ঐ বাটির বালকগণের দৃষ্টান্তে ও সহায়তায় এবং নিজের অধ্যবসায়ে তিনি বাংলায় লিখিতে পড়িতে ও ইংরেজীতে কথাবার্তা বলিতে শিখিতেন। তাঁহার কার্যদক্ষতা ও শ্রমসহিষ্ণুতা দেখিয়া মদনমোহন দত্ত তাঁহাকে প্রথমে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে বিল সরকারের ও পরে দশ টাকা বেতনে শিপ সরকারের পদে নিযুক্ত করিলেন। এই কার্যব্যপদেশে তিনি বিলাতী মালবাহী জাহাজ সম্বন্ধে সর্বদা তথ্য সংগ্রহ করিতেন। একখানি জলমগ্ন জাহাজ নিলাম হইতেছে শুনিয়া তিনি তথায় গেলেন। এই জাহাজের বহুমূল্য মালের সম্বন্ধে তিনি সঠিক সংবাদ জানিতেন বলিয়া অন্য এক নিলাম ডাকিবার জন্য তাঁহার প্রভুদত্ত চৌদ্দ হাজার টাকা দিয়া এই জাহাজ নিলামে ক্রয় করিলেন। ইহার অব্যবহিত পরেই একজন ইংরেজ আসিয়া এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার টাকায় ঐ জাহাজখানি ক্রয় করিলেন। রামদুলাল ইচ্ছা করিলে মুনাফা এক লক্ষ টাকা নিজেই আত্মসাৎ করিতে পারিতেন। কিন্তু, তাহা না করিয়া প্রভুকে সমস্ত বৃত্তান্ত বলিয়া সব টাকাই তাঁহাকে দিলেন। দরিদ্র বালকের এই সাধুতার পরিচয় পাইয়া মদন দত্ত ঐ লক্ষ টাকা রামদুলালকে দিলেন। এই টাকা মূলধন করিয়া রামদুলাল ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। ব্যবসায়ে প্রচুর লাভ হইল এবং তিনি চারিখানি জাহাজ কিনিয়া আমেরিকার সহিত বাণিজ্য করিতে লাগিলেন। রামদুলাল আমেরিকার সমস্ত বাণিজ্যাগারের একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন এবং আমেরিকার বণিকগণ তাঁহাকে বাংলার রথচাইলড’ বলিত। নানাবিধ ব্যবসা করিয়া তিনি কোটিপতি হইলেন। কথিত আছে যে, মৃত্যুকালে তিনি এক কোটি তেইশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি রাখিয়া যান। রামদুলাল অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেন ও ৭৩ বৎসর বয়সে প্রাণত্যাগ করেন।

উপরোক্ত অসাধারণ কৃতকার্যতার কথা স্মরণ করিলে মনে হয়, বাণিজ্য ও ব্যবসায়ে সফলতার জন্য যতগুলি সদ্‌গুণের প্রয়োজন, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে বাঙ্গালীর মধ্যে তাহার খুব অভাব ছিল না। অথচ উনবিংশ শতকের শেষার্ধ হইতেই বাংলা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙ্গালীদের প্রতিপত্তি কমিয়া যায় এবং সুদূর পশ্চিম ভারতের গুজরাটি, মারওয়াড়ীরা তাহাদের স্থান অধিকার করে। সে যুগের ব্যবসায়ী ধনীব্যক্তিরা অনেকে জমিদারিতে অর্থ নিয়োজিত করিয়াছিলেন। রামদুলাল দে, মতিলাল শীল, কলিকাতার লাহা ও মল্লিকেরা, হাটখোলা ও রামবাগানের দত্তরা, পাইকপাড়ার রাজা সিংহ-বংশ, এমনকি ব্যবসায়-বাণিজ্যে লব্ধপ্রতিষ্ঠ দ্বারকানাথ ঠাকুরও শহরে ভূসম্পত্তি ও মফঃস্বলের জমিদারি ক্রয় করেন। তাঁহাদের পুত্র-পৌত্রেদের অনেকেই শ্রমবিমুখ অলস জীবন যাপন করেন অথবা ভোগবিলাসে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু ব্যবসায়ের দিকে তাঁহাদের কোন আকর্ষণ ছিল না। ইহার কারণ নির্ণয় করা কঠিন। অথচ এই সময়ের, অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষার্ধের বাংলা সাময়িক পত্রিকায় শ্রম, শিল্প, বাণিজ্য, ব্যবসায় প্রভৃতির প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষভাবে পুনঃপুনঃ আলোচিত হইয়াছে। ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘Bangal Spectator প্রভৃতি পত্রিকায় বাঙ্গালীর এই বাণিজ্যবিমুখতার বিরুদ্ধে কঠোর আলোচনাও করা হইয়াছে।

ভোগ-বিলাসিতায়, মামলা-মোকদ্দমায়, দান-ধ্যানে, পুত্র-কন্যার বিবাহে, মাতাপিতার শ্রাদ্ধাদি কর্মে, দুর্গোৎসব প্রভৃতি পূজা-পার্বণে ও নানাবিধ ধর্মাচরণে ও মন্দিরপ্রতিষ্ঠায় বিপুল অর্থব্যয়ে পূর্বপুরুষের সঞ্চিত ধননাশ ব্যবসায়-বিমুখতার অন্যতম কারণ বলিয়া মনে হয়। সংবাদ প্রভাকর’-সম্পাদক বাংলা ১২৬০ সালে এ-বিষয়ে যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত হইল :

“অপিচ কেহ বলেন যে এই বঙ্গদেশ মধ্যে অনেক ধনাঢ্য লোক আছেন, তাঁহারা যদ্যপি আপনাপন ধন দ্বারা ইংরাজদিগের ন্যায় বাণিজ্য করেন তবে অন্যান্য লোক সকল তাঁহারদিগের দৃষ্টান্তের অনুগামি হইতে পারেন, সুতরাং এই রাজ্য মধ্যে বাণিজ্যের আতিশয্য হয়, এ কথা অতি যথার্থ বটে, ফলতঃ যাহারা অতুল ধনের অধিকারি হইয়াছেন, তাঁহারদিগের আবার সেই প্রকার সাহস নাই, তাঁহারা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়া সাহেব বিশেষের অধীনে মুচ্ছদ্দিগিরি কর্ম করিতে পারেন, তথাচ স্বাধীন রূপে বাণিজ্য করিতে পারেন না। বিশেষতঃ গত পাঁচ বছরের মধ্যে কতিপয় ধনি ব্যক্তি আফিম, নীল প্রভৃতি বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া অতুল সম্পদের পদ হইতে দুরবস্থায় পতিত হওয়াতে আর কোন ব্যক্তি বাণিজ্য করিতে ইচ্ছা করেন না, অনেকে কোম্পানীর কাগজকেই ভাল জানিয়াছেন। আমারদিগের রাজপুরুষেরা কোম্পানির কাগজের সুদ এত ন্যূন করিতেছেন, তথাচ সকলে কাগজ রাখিবার ইচ্ছা করিতেছেন।

“পূর্বে জমিদারী বিষয়ে জমিদারগণের বিশেষ সুখ ও আয় ছিল, কিন্তু আমারদিগের গবর্ণমেন্ট রাজস্ব আদায়ের নিমিত্ত ক্রমে কঠিন নিয়ম সকল নির্ধারণ করাতে এবং প্রজাসকল দুরবস্থায় পতিত হইয়াই সেই সুখ ও আয়েরও অন্যথা হয়, এ কারণ অনেক জমিদারী কালেক্টর সাহেবের নিলাম দ্বারা হস্তান্তরিত হইয়াছে, পূৰ্ব্বে যাঁহারা সম্ভ্রান্ত জমিদার বলিয়া রাজদ্বারে ও সাধারণ সমাজে মান্য ও প্রতিপন্ন। ছিলেন, অধুনা তাঁহারদিগের পরিবারগণ অন্নের নিমিত্ত লালায়িত হইয়াছেন।

“অতএব এতদ্দেশীয় লোকদিগের সৌভাগ্যোন্নতির কোন প্রকার বিশেষ উপায় দৃষ্ট করা যায় না। আমারদিগের রাজপুরুষেরা এখানকার কৃতবিদ্য ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত রাজকার্য্যের যে সমস্ত নিম্নপদ নির্ধারিত করিয়াছেন, তাহাতে পরিশ্রম বিস্তর করিতে হয়, অথচ অন্ন বস্ত্রের দুঃখ নিবারণ ব্যতীত কোনমতে সঞ্চয় হইতে পারে না এরূপ নানা কারণে এই বঙ্গদেশীয় লোক সকল ক্রমে ক্রমে দুরবস্থায় পতিত হইতেছেন, যে পর্যন্ত আমারদিগের রাজপুরুষেরা সম্ভ্রান্ত রাজকীয় পদে এতদ্দেশীয় কৃতবিদ্য লোকদিগকে নিযুক্ত করণের নিয়ম নির্ধারণ না করিবেন এবং সাধারণে স্বাধীনরূপে বাণিজ্য করণে প্রবৃত্ত না হইবেন তদবধি এই বঙ্গরাজ্যের সৌভাগ্য বৃদ্ধি হইবেক না।”১২

এই সুদীর্ঘ মন্তব্যটি উদ্ধৃত করার কারণ এই, উনবিংশ শতকের শেষদিক হইতে শিক্ষিত ভদ্র বাঙ্গালীর মধ্যে যে চাকুরীজীবির মনোবৃত্তি পরিপুষ্ট হইয়া উঠিতেছিল এই অপ্রীতিকর সত্যটির স্পষ্ট আভাস ইহাতে পাওয়া যায়। কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন বাণিজ্যে আত্মনিয়োগের প্রবৃত্তির উল্লেখ থাকিলেও ইহা যে মুখ্য নহে, গৌণ উদ্দেশ্য, তাহারও ইঙ্গিত আছে। এবং সেইজন্যই ইহা বিশেষ ফলবতী হয় নাই। “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী”–এই মহাজন-বাক্য বাঙ্গালীর জীবন-রহস্যের সন্ধান দেয়। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী উচ্চ সরকারী পদলাভই জীবনযাত্রা সুগম করিবার আদর্শ উপায়রূপে গ্রহণ করিয়াছিল–এবং তাহাতে অনেকটা সিদ্ধিলাভও করিয়াছিল–তদভাবে ডাক্তারী, ওকালতি পেশা গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্যের দিকে আকৃষ্ট হয় নাই। এ সম্বন্ধে ৯০ বৎসর পূর্বে লিখিত ‘সোমপ্রকাশের নিম্নলিখিত উক্তিগুলি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :

“আজকাল যেরূপ অবস্থায় ও নিয়মে এই বাণিজ্য ব্যবসায় আমাদিগের দেশে সম্পাদিত হইতেছে তাহা নিতান্ত শোচনীয়। সচরাচর বাণিজ্য ব্যবসায় এই যুগ্ম শব্দ আমাদিগের শ্রুতিগোচর হইয়া থাকে। এ দুটী শব্দের অর্থ ভেদ আছে কিনা নির্ণয় করা আবশ্যক। বাণিজ্য ব্যবসায় এই দুটী শব্দের অর্থগত বিস্তর বৈলক্ষণ্য আছে। ব্যবসায় অর্থে জীবনোপায়ের সাধারণ পথ। এক্ষণে যিনি জীবনোপায় নিৰ্ব্বাহের জন্য যে পথ অবলম্বন করেন, তিনি সেই ব্যবসায়ী। কেহ ডাক্তার, কেহ উকীল, কেহ মোক্তার, কেহ সূত্রধর, কেহ কুম্ভকার, কেহ বণিক ইত্যাদি। এই বণিকের ব্যবসায়ের নামই বাণিজ্য ব্যবসায়।

“বাণিজ্য কি? এক স্থানের দ্রব্যাদি নৌকা বা রেলওয়ে বা অন্য কোন সুযোগে অন্য কোন স্থানে বহন করিয়া লইয়া গিয়া তাহা বিক্রয় করা বা তদ্বিনিয়মে তদ্দেশজাত উত্তমোত্তম দ্রব্য আনয়ন করার নাম বাণিজ্য। প্রধানতঃ এই বাণিজ্য দুই প্রকার, বহির্বাণিজ্য ও অন্তর্বাণিজ্য। এক দেশজাত দ্রব্য অন্য দেশে লইয়া গিয়া ক্রয়-বিক্রয়ের নাম বহির্বাণিজ্য ও সে দেশজাত দ্রব্য, সেই দেশেই ক্রয়-বিক্রয় করার নাম অন্তর্বাণিজ্য। পূৰ্ব্বে রেলওয়ে না থাকাতে নৌকা ও অর্ণব ষানাদি দ্বারা বিদেশে দ্রব্যাদি প্রেরিত হইত। তাহাতে বহুকাল বিলম্ব হইত। এখন রেলওয়ে ও টেলিগ্রাফ হওয়াতে এই বাণিজ্যকাৰ্য্যের বিশেষ উন্নতি হইয়াছে। এক দিনে এক মাসের পথের দ্রব্যাদি পৌঁছিয়া দিতেছে। সেখানে কোন বিপদ বা দ্রব্যাদির অসুবিধা হইলে তৎক্ষণাৎ টেলিগ্রাফযোগে সমাচার পাওয়া যাইতেছে। পূৰ্ব্বে যদিও ইহা ছিল না, কিন্তু পুরাকালের বাণিজ্যের বিষয় ও অবস্থা যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সমালোচনা করা যায়, তবে তাহাকে এখন কাল্পনিক বলিয়া প্রতীতি হয়। সে সম্বন্ধে আধুনিক বাণিজ্য ব্যবসায়কে প্রকৃতরূপে বাণিজ্য ব্যবসায় বলিতে পারা যায় না। তখন ভারতের প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক পল্লী, অধিক কি প্রত্যেক স্বাধীনচেতা মনুষ্যহৃদয় “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” এই হৃদয়োত্তেজক বীজমন্ত্রের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। প্রত্যেক স্বাধীনচেতা ব্যক্তিই এই বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া অকাতরে পিতা মাতা পুত্র পরিবারবর্গের বিচ্ছেদক্লেশ তুচ্ছ করিয়া অর্ণবযান আরোহণ পূর্বক সিংহল, সুমাত্রা, বালী প্রভৃতি দূরতর স্থানে বাণিজ্য করিতে যাইতেন। চাঁদ সওদাগর ধনপতি সওদাগর প্রভূতি তাহার নিদর্শনস্থল। এতদ্ব্যতীতও ভূরি ভূরি প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায়। অদ্যাপিও বালী দ্বীপে হিন্দুগণ বাস করিতেছেন। বর্তমান সময়ের ন্যায় তখন অর্ণবপোতে দূরদেশে যাত্রা করা দূষণীয় ছিল না। করিলেও কেহ চিরকালের জন্য সমাজচ্যুত হইতেন না। এখন অর্ণবযানে আরোহণ করিলে তিনি আর হিন্দুসমাজে স্থানপ্রাপ্ত হন না, চিরকালের জন্য হিন্দুসমাজ হইতে বহিস্কৃত হইতে না পারিলে আর কাহারও সমুদ্রপথে বিদেশে যাইবার উপায় নাই, সুতরাং অনেকে ইচ্ছা সত্ত্বেও সমাজচ্যুত হইবার ভয়ে বিশেষতঃ স্ত্রীপুত্রদিগের প্রেমপাশ ছিন্ন করিতে না পারিয়াই বিদেশে যাইতে স্বীকৃত নহেন। এই সকল কারণে বহির্বাণিজ্য একালে অন্তর্হিত হইয়াছে।…

“কালচক্রের কুটিল আবর্তনে সেই ভারত প্রতিধ্বনিত “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” এই স্বাধীনতা ও হৃদয়োত্তেজক বীজমন্ত্র, ভারতবাসীর অদৃষ্ট দোষে কালচক্রের নিম্নভাগে পড়িয়া গিয়াছে। এখন তৎপরিবর্তে “হা অন্ন হা ভিক্ষাবৃত্তি!” এই হৃদয়বিদারক চীৎকার শব্দে কুমারিকা হইতে হিমাচল পর্যন্ত ভারত ভূমি স্থানে স্থানে পরিপূরিত হইতেছে। যাহার এই দুরন্ত কালচক্র, সেই অনাদি ঈশ্বর অবগত আছেন কতদিনে আবার ভারতের সুপ্রভাত হইয়া এই বর্তমান হৃদয়বিদারক ধ্বনি কালচক্রের নিম্নে পড়িয়া যাইবে এবং পুনরায় “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” এই বীজমন্ত্র ভারতের প্রত্যেক নগরে প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক পল্লীতে অধিক কি প্রত্যেক স্বাধীন চিত্তে প্রতিধ্বনিত হইবে। সে দিন কি আর হইবে? যদি হয় তা সাহস করিয়া বলিতে পারি তাহা বোম্বাইবাসীদিগের অসাধারণ অধ্যবসায় যত্ন ও প্রাণস্বরূপ প্রতিজ্ঞাবলে হইবে। আমাদিগের বঙ্গীয় ভ্রাতারা অদ্যাপিও চাকুরিতে শশব্যস্ত। চাকুরিই আমাদিগের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হইয়া উঠিয়াছে। কোনরূপে বহু অনুসন্ধানের পর যদি একটি কর্ম জুটিল ত তিনি জন্মের মত পরিশ্রমের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন। অনেক শ্রমকাতর আত্মীয় কুটুম্বও আসিয়া তাহার গলগ্রহস্বরূপ হইয়া পড়িলেন। শতকরা ৩ টাকা করিয়া সুদে গবর্ণমেন্টে টাকা জমা দিবেন, সেও সহস্র গুণে ভাল, তথাপি প্রাণান্তেও স্বাধীন দেশহিতকর বাণিজ্য কার্যে মনকে ক্ষণকালের জন্যও বিচলিত হইতে দিবেন না। সে চেষ্টাও নাই। তবে যে জনকতক লোক বাণিজ্য ব্যবসায় করিয়া থাকেন, সে সামান্য অন্তর্বাণিজ্য মাত্র। তদ্বারা দেশের কিছুমাত্র উপকার হয় না।….

“কিন্তু বোম্বাইবাসীরা সেরূপ নহে। দুর্ভাগ্যক্রমে একবার ক্ষতিগ্রস্ত হইলেও বসিয়া না পড়িয়া কপাল ঠুকিয়া আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কাহারও সাহায্যভাগী হইয়া বাণিজ্য কাৰ্য্যে রত হয় এবং অসাধারণ অধ্যবসায় বলে অল্প দিনেই ক্ষতি পূরণ করিয়া লয়। ফল কথা তাহারা আর বাঙ্গালীদিগের ন্যায় সামান্য একটি উঁচ হইতে প্রয়োজনীয় যাবতীয় দ্রব্যের জন্য পরমুখপ্রত্যাশী থাকিতে ভালবাসে না। তাহারা সাবান, দেশলাই, কাপড়, সুতা, প্রভৃতির কল বিলাত হইতে আনয়ন করিয়া এক্ষণে তাহার কতদূর উন্নতি করিয়া তুলিয়াছে, তাহাদের কাছে কি কলিকাতার বাণিজ্য ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ী নামে অভিহিত হইতে পারেন, …

“এক্ষণে অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন বঙ্গবাসীরা কোথায় এরূপ মূলধন পাইবে? কেই বা সাহস দান করিবে? এতদুত্তরে প্রথমেই বঙ্গবাসী জমিদার ও ধনীদিগের উপর আমাদের দৃষ্টি পতিত হয়, এবং হৃদয় হঠাৎ তাঁহাদিগের নিকটে তাঁহাদের হস্ত ধরিয়া এরূপ বলিতে প্রবৃত্ত হয় : ও ভ্রাতঃ কলিকাতা ও মফস্বলবাসী জমিদার ও ধনিগণ! আপনারা অতঃপর ৩ পার্সেন্ট ৪ পাশেন্ট সুদে গভর্নমেন্টে টাকা জমা দিয়া ৪৫৬ জনে একত্রিত ও প্রণয়সূত্রে বদ্ধ হইয়া মুলধন সংগ্রহ করিয়া বিদেশ হইতে বাণিজ্যোপযোগী দ্রব্যাদি আনয়ন এ স্বদেশেৎপন্ন দ্রব্যে বাণিজ্য জাহাজে পরিপূরণ করিয়া সমুদ্রপথে দূর দেশে চালান দিয়া বহির্বাণিজ্যে নিযুক্ত হও। আর মধ্যবিত্ত লোকেরা একত্র মিলিয়া আপন আপন অবস্থানুসারে মূলধন প্রয়োগ করিয়া মুঙ্গেরের হিন্দু-কো-অপারেটিব সোসাইটির ন্যায় স্থানে স্থানে বাণিজ্যিক সভা ও ব্যবসায় খুলিয়া অন্তর্বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধনে মনোনিবেশ করুন।”১৩

এইরূপে সাময়িক পত্রিকায় শিল্পের উন্নতি সম্বন্ধে সাধারণের দৃষ্টি পুনঃপুনঃ আকৃষ্ট করা হইয়াছে। ১২৮৯ সনের ১৯ বৈশাখে সোমপ্রকাশে একটি সুদীর্ঘ সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়, তাহা হইতে কিছু উদ্ধৃত করিতেছি :

“অগ্রে শিক্ষা না করিয়া কাৰ্য্যানুষ্ঠানে উৎকর্ষ লাভ হয় না। এদেশে শিল্প শিক্ষার প্রথা নাই বলিলেই হয়। শিক্ষা প্রথা না থাকাতেই শিল্পকার্য্যের প্রাচুর্য্য নাই। যাহারা যে কিছু শিল্পচর্চা করে, তাহারা প্রায় না পড়িয়া পণ্ডিত। পিতৃপিতাদিক্রমে পুরুষপরম্পরা যে কাৰ্য্যনীতি প্রচলিত আছে, তদনুসারে কাৰ্য্য করিয়া আসিতেছে। এদেশে জাহাজ, রেলের গাড়ি ও মুদ্রাযন্ত্র প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ কাৰ্যে কাহারও হস্তক্ষেপ দেখিতে পাই না। কামার, কুমার, কাঁসারি, তাঁতি প্রভৃতি যে যে ব্যবসায় সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কেবল কাজ চালান গোছের ব্যবসায়। আমাদের এগুলি না হইলে চলে না, কৰ্ম্মকার, কুম্ভকার প্রভৃতি যথা কথঞ্চিৎ ঐগুলি প্রস্তুত করিয়া দেয়। কামার বৃদ্ধ হইলেন, লোহা শক্ত হইল, তিনি আর পারেন না, তাহার যুবা পুত্র সেই কার্যে ব্রতী হইল। সেই যন্ত্র সেই উপকরণ সেই কাৰ্যপ্রণালী, কিছুরই পরিবর্তন হইল না। তবে যেখানে ভদ্র সমাজে, সমাজের লোকে অধিক উৎসাহ দেন সেখানে কামার কুমারাদির কাৰ্য্যের কিছু উৎকর্ষ হয় বটে, কিন্তু সে উৎকর্ষ সকল কামারে বা সকল কুমারে লাভ করিতে পারে না। যাহার কিছু অধিক বুদ্ধি যোগ থাকে, সেই কেবল কিছু উৎকর্ষ সাধন করিতে পারে। ঢাকা ও শান্তিপুর প্রভৃতি স্থানের তাঁতিরা সৰ্ব্বসাধারণ্যে অত্যুকৃষ্ট বস্ত্র প্রস্তুত করিতে পারে না। দুই চারিঘরের গুণে ঐ ঐ স্থান বিখ্যাত হইয়াছে। এ দেশের একটি মহৎ দোষ এই, যাহারা অসামান্য বুদ্ধিযোগে নূতন কৌশল উদ্ভাবন করে, তাহারা আপনাদিগের লাভ ক্ষতির ভয়ে অন্যকে কৌশল শেখায় না; সুতরাং সেই সেই ব্যক্তির মৃত্যু হইলে সেই সেই কৌশলের লোপ হইয়া যায়। আমরা ইহার দুই একটি দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিতেছি : শ্রীরামপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার নিজ বুদ্ধিগুণে অতি সুশ্রী সীসার অক্ষর প্রস্তুত করিয়াছিলেন। তিনি সে কৌশল আর কাহাকে শিখান নাই। তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই সুশ্রী অক্ষরগুলি অন্তর্হিত হইয়াছে। বর্ধমান জিলার অন্তঃপাতী কুমারগঞ্জ নামক স্থানের কয়েকজন কাঁসারি পিত্তলে অতি সুন্দর রঙ করিতে পারিত। আমরা আমাদের বাসগ্রামের সন্নিহিত কয়েকজন কসারিকে সেইরূপ রঙ প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত আদর্শ দিয়াছিলাম, কিন্তু তাহারা কৃতকার্য হইতে পারে নাই। এখন শুনিতে পাই, কুমারগঞ্জের সেই পূৰ্ব্ব কারিকরদিগের মৃত্যু হইয়াছে, এখন আর পিত্তলের সেরূপ রঙ হয় না।১৪

“এই সকল কারণে আমরা প্রস্তাব করিতেছি, স্থানে স্থানে শিল্পকাৰ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া এদেশীয়দিগকে শিল্প বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া গবর্ণমেন্টের কর্তব্য… জর্জ সি. এম. বার্ডউড সাহেব তাঁহার ভারতীয় শিল্প নামক গ্রন্থে শিল্পদ্রব্যের যেরূপ সুন্দর কতকগুলি প্রতিকৃতি প্রকাশ করিয়াছেন, তদ্দর্শনে আমাদিগের কোনক্রমেই এরূপ বোধ হয় না যে ভারতবর্ষের লোকে শিল্প বিষয়ে অনভিজ্ঞ ছিলেন। পূৰ্ব্বে ভারতবাসীরা সৰ্ব্বপ্রকার শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত করিয়া যে বিক্রয় করিতেন তাহা এই গ্রন্থখানি পাঠ করিলে বিশেষরূপে উপলব্ধি হয়; কিন্তু কালসহকারে অবস্থা-বৈগুণ্যে সে সমুদায়ই লুপ্তপ্রায় হইয়াছে। এখন তাহার পুনরুদ্ধার করিতে হইলে দেশের লোকের ও গভর্নমেন্টের বিশেষ প্রয়াস পাওয়া আবশ্যক।… এদেশের শিল্প বাণিজ্য কৃষি, সকলেরই অবস্থা অনুন্নত। অতএব দেশের অবস্থা হীন না হইবে কেন? যাঁহাদের হৃদয়ে দেশের এই হীন অবস্থা দূর করিবার ইচ্ছা না হয়, তাহারা যে স্বদেশকে ভালবাসেন না তাহা বলা বাহুল্য। দেশের লোকের স্বদেশের প্রতি মমতা বিনা কি উন্নতি হইবার সম্ভাবনা আছে? যাঁহাদের পল্লীগ্রামে বাস, তাঁহারা চতুর্দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখুন গ্রামের অধিকাংশ লোক কিরূপে কালক্ষেপ করিয়া থাকেন। অধিকাংশেরই কোন কাজকর্ম নাই, কোন কাজকৰ্ম্ম করিবেন, সে উপায়ও নাই; সুতরাং তাঁহাদের জীবন একপ্রকার বিড়ম্বনা হয়, তাঁহারা নিতান্ত অকর্মণ্য হইয়া কালহরণ করেন। কিন্তু চতুর্দিকে যদি কৃষি বাণিজ্য ও শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা হয়, সকলেই কাজের লোক হইয়া উঠিবে। গভর্নমেণ্টের ও দেশের লোকের চেষ্টা ব্যতিরেকে কি এ অভীষ্ট সিদ্ধি হইবার সম্ভাবনা আছে?

“এস্থলে আমাদের আর একটি বক্তব্য এই, স্থানে স্থানে শিল্পকাৰ্য্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া কেবল অভিলষিত সিদ্ধি হইবার সম্ভাবনা নাই। এখানে নিবারক বিধি প্রচলিত করিয়া ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায়ীদিগকে রক্ষা করিতে হইবে। যদি বল, এ বিধি প্রবর্তিত করিলে রাজার পক্ষপাতদোষ ঘটিয়া উঠিবে, তদুত্তরে আমরা যদি বলি যদি রাজার সৰ্ব্ববিষয়ে সমব্যবহার দৃষ্ট হইত, তাহা হইলে এ প্রস্তাবে আমাদের ধৃষ্টতা প্রকাশিত হইত সন্দেহ নাই। কিন্তু সে পূজনীয় সমব্যবহার কোথায়?

“ইংরাজেরা নিষ্কর বাণিজ্যের পক্ষপাতী কিন্তু কাৰ্যতঃ ইহা ঘটিয়া উঠে না। বস্ত্রর শুল্ক রহিত করিলে ম্যাঞ্চেষ্টরের বণিকদিগের উপকার করা হইবে, তন্নিমিত্ত সকলেই নিষ্কর বাণিজ্যের প্রশংসাবাদ করিতেছে। কিন্তু এতদ্দেশ হইতে প্রেরিত চা শর্করা প্রভৃতি পণ্য দ্রব্যের উপর শতকরা পঞ্চাশ টাকা করিয়া কর নির্দিষ্ট আছে এস্থলে কই, অপক্ষপাতিতা ও সমদর্শিতার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ নাই, নিষ্কর বাণিজ্যের গুণ ঘোষণাও এখানে নীরব হইয়া আছে। আমরা বলিতে না পারি, কিন্তু মনে মনে রাজনীতির মর্ম বুঝিতে পারিতেছি,যে কাৰ্য্যে ইংলণ্ডের অভীষ্ট সিদ্ধ হয় তাহাই যুক্তিযুক্ত ও সমাজের হিতকর, আর যে কার্যে ভারতের উপকার সম্বন্ধ আছে, তাহা অবশ্য পরিত্যাজ্য, তাহা হইতে কল্যাণ হয় না।…

“ভারতবাসীরা শিল্পকৌশলে এখনও অজাতদন্ত নিঃসহায় শিশুর তুল্য। তাঁহারা কদাচিৎ দুই একটি শিল্পকর্ম শিক্ষা করিতে অভিলাষ করিতেছেন। ইউরোপীয়েরা তাহাদের শিক্ষাগুরুর নিকট কতকাল উপদেশ গ্রহণ করিলে তবে তাহাদের শিল্পবিদ্যায় ব্যুৎপত্তি জন্মিবে। এখনও এদেশীয়দিগের শিল্পকাৰ্য্যে পরিপক্ক হইতে অনেক বিলম্ব আছে; এ সময় যদি শিক্ষকেরা শিষ্যের প্রতিযোগী হইয়া দাঁড়ান, আর কি কখন তাঁহার মস্তক উন্নত করিতে পারিবেন? ভারতবর্ষ তো শিল্প বিষয়ে নিতান্ত নিম্নে পতিত হইয়া আছে; যে নিম্নে পড়িয়া আছে তাহার আর পতনের স্থান কোথায়?”

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের বাণিজ্যের কিরূপ দ্রুত উন্নতি হইয়াছে তাহার বিবরণ দিয়া তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় (১৭৯২ শক–৩২১ সংখ্যা) নিম্নলিখিত মন্তব্য করা হইয়াছে :

“কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, এই বাণিজ্যে বঙ্গবাসীদিগের হস্ত প্রায় কিছুই নাই। এক্ষণে আমাদের দেশে আর সকল বিষয়ে উৎসাহ লক্ষিত হইতেছে। আমাদের যুবকেরা আর সকল বিষয়েই যশোলাভ করিতেছেন; কি রাজনীতি, কি বিদ্যাশিক্ষা, কি ওকালতি, কি চিকিৎসা, সকল বিষয়েই জয়লাভ করিতেছেন; কেবল এই এক বিষয়ে-বাণিজ্য ব্যবসায়ে এখনও তাঁহারা নিরুদ্যম রহিয়াছেন। এ বিষয়ে বোম্বাই-এর ভ্রাতৃগণ আমাদের অপেক্ষা অনেক অগ্রসর। বোধ হয় সকলেই অবগত আছেন, সম্প্রতি দুইজন বোম্বাই প্রদেশস্থ হিন্দু মারকিন দেশের সহিত বাণিজ্য-সম্পদ সংস্থাপন করিবার নিমিত্ত, ও তত্ৰত্য কারখানা প্রভৃতির কার্যপ্রণালী স্বচক্ষে সন্দর্শন করিবার নিমিত্ত, তথায় অবস্থিতি করিতেছেন। বঙ্গীয় যুবকেরা তাহাদের এই প্রশংসিত দৃষ্টান্ত কেন না অনুসরণ করেন? যদি তাঁহারা স্বদেশের উন্নতি সাধনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া থাকেন, যদি তাঁহারা মাতৃভূমিকে অন্যান্য উন্নততর সভ্যতাসম্পন্ন জাতিদিগের সমকক্ষ করিতে চাহেন, তাহা হইলে সর্বাগ্রে তাহারা বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতি মনোযোগী হউন।…

“কেহ কেহ বলেন, যে বাঙ্গালিদিগের সাহস নাই বলিয়া এই বাণিজ্যে তাঁহারা পরাজুখ রহিয়াছেন। কিন্তু ইহা ভ্রম মাত্র। এতদ্দেশীয় ব্যবসায়ী শ্রেণীর মধ্যে যেরূপ উদ্যম, যেরূপ সাহস, যেরূপ অধ্যবসায়, যেরূপ কাৰ্যদক্ষতা ও চতুরতা লক্ষিত হয়, যদি তাহারদিগের বাণিজ্যপথে দেশাচারগত কতকগুলি বাধা না থাকিত, তাহা হইলে বোধ হয়, তাঁহারা ব্রিটিশ কিম্বা আমেরিকার বণিকদিগের অপেক্ষা কোন অংশে নূন হইতেন না। এই শ্রেণীর মধ্যে বিদ্যার আলোক যত প্রবেশ করিবে, যতই তাহাদিগের মন হইতে কুসংস্কার সকল তিরোহিত হইবে, ততই এতদ্দেশীয় বাণিজ্য-উদ্যম পরিসর প্রাপ্ত হইবে। অধুনাতন কৃতবিদ্যগণের এক্ষণে কর্তব্য যে তাঁহারা এই শ্রেণীর লোকদিগকে অগ্রে পথ প্রদর্শন করেন।…

“কি উপায়ে আমাদের দেশীয় বাণিজ্যের উন্নতি হইতে পারে, সাধারণের মধ্যে বাণিজ্যম্পৃহা কিরূপে সঞ্চারিত হইতে পারে, এই সকল বিষয় আলোচনা করা ও তাহা কার্যে পরিণত করা এক ব্যক্তি কি দুই ব্যক্তির কৰ্ম্ম নহে। আমাদের মহাজনগণ একত্রিত হইয়া যদি একটি সভা স্থাপন করেন, তাহা হইলে উহা দ্বারা অনেক কাজ হইতে পারে। এই প্রকার সভা না থাকাতে আমাদের বণিকমণ্ডলীর মধ্যে একটি মহৎ অভাব রহিয়াছে।”১৫

ব্যবসায়-বাণিজ্যের অভাবে বাঙ্গালীর দারিদ্র্য সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে সোমপ্রকাশ পত্রিকা (১২৯২, ৯ ভাদ্র) বাঙ্গালীর উপজীবিকার বিভাগ ও তাহার প্রত্যেকের সম্বন্ধে যে সুচিন্তিত মন্তব্য করিয়াছে, ৮৫ বৎসর পরেও বাঙ্গালী সমাজ সম্বন্ধে তাহা প্রযোজ্য। নিম্নে উপজীবিকার বিভাগমাত্র উদ্ধৃত করিলাম।

“সর্ব্বাগ্রে বাঙ্গালীর উপজীবিকা বিভাগ করা যাইতেছে।

১ম। সামান্য ব্যবসা বাণিজ্য; এই শ্রেণীতে আড়তদার, গোলাদার, দোকানদার হইতে সামান্য মুদি ও ফেরিওয়ালা পৰ্য্যন্ত এবং যাহারা নগদ টাকা ও ধান্য ইত্যাদির তেজারত করে, সেই সমস্তই বুঝিতে হইবে। কারণ ইহারা সকলেই একটা মূলধন লইয়া লাভ লোকসানের দায়িত্ব স্বীকারে জীবিকা অর্জন করে।

২য়। ভূসম্পত্তির উপস্বত্ব ভোগ; এই বিভাগে জমীদার, পত্তনীদারী, তালুকদার, জোতদার, গাতিদার, বৃত্তি-ব্রহ্মোত্তর ভোগী ও কৃষক শ্ৰেণী বুঝিতে হইবে। কারণ ঐ সকল সম্প্রদায় ভূমির উপস্বত্ব ভোগ দখল দ্বারা জীবিকা নিৰ্বাহ করে।

৩য়। দৈহিক ও মানসিক শ্রম বিক্রয় অথবা চাকুরি, হাইকোর্টের জজ হইতে সামান্য মুটে মজুর, চা বাগান অথবা রেলওয়ে প্রভৃতিতে নিযুক্ত কুলি ইত্যাদি সকলকেই বুঝিতে হইবে। উকীল, মোক্তার, ডাক্তার প্রভৃতিও এই শ্রেণীভুক্ত। কারণ উহারা সকলেই অপরের কাৰ্য্য উপকার সাধন অথবা অভাব মোচন জন্য নিরূপিত মাসিক সাপ্তাহিক, দৈনিক বা উপস্থিত বেতন গ্রহণে নিয়োগকর্তার রুচি অনুসারে শ্রম বিক্রয় করিয়া গ্রাসাচ্ছাদন ও সাংসারিক অভাব দূর করে।

৪র্থ। জাতীয় ব্যবসাযোগে জীবিকা-শিল্পী, ইহাতে পুরোহিত, বোগা, নাপিত, তন্তুবায়, কৰ্ম্মকার, সূত্রধর, কাংসকার, গন্ধ ও সুবর্ণবণিক প্রভৃতি বুঝায়। কারণ উহারা প্রাচীনকাল হইতে কাৰ্য্য ব্যবসায়ভেদে সেই জাতি বা শ্রেণীভুক্ত হইয়াছে, সেই হেতু পুরাকালপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় কাৰ্য্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে।

৫ম। তোষামোদ, ভিক্ষা ও উঞ্ছবৃত্তি চাটুকার, পরভোগ্যাপজীবী ভিক্ষুক, পরমুখাপেক্ষী, উঞ্ছবৃত্তিধারী, পরতেজ্যবস্তু সংগ্রহ করিয়া দিনপাত করে। নিতান্ত অক্ষমতায়, ধর্মের জন্য অথবা আলস্য পরবশ হইয়া অনেকে ঐরূপ ঘৃণিত বৃত্তি অবলম্বন করে।

জীবিকা নির্বাহ জন্য অধুনা আরও কয়েকটি পন্থা অবলম্বিত হইতেছে। পুরাকালে হিন্দুজাতির মধ্যে এরূপ কুপ্রবৃত্তিমূলক জঘন্য বৃত্তি অবলম্বিত হইত এরূপ বোধ হয় না।

৬ষ্ঠ। আত্মবিক্রয় অথবা ধৰ্ম্মবিক্রয়, বেশ্যাবৃত্তি, বিবাহের কন্যা বিক্রয় ও বি এ, এম-এ পাশযুক্ত পুত্রের প্রভূত পণ গ্রহণ, শিষ্যের নিকট গুরুর অর্থ গ্রহণ; এ সকল বৃত্তি প্রাচীন সমাজে বড় প্রচলিত ছিল না। হিন্দুশাস্ত্রে এরূপ বৃত্তি অবলম্বনে বিশেষ নিষেধ আছে ও ঘোর অধৰ্ম্ম বলিয়া দণ্ডের বিধান আছে।

৭ম। প্রতিভা বিক্রয় : এই বিভাগে প্রতিভাসম্ভূত কাব্য নাটক নভেল বিক্রয়, বিজ্ঞান, রসায়ণশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র অথবা উপদেশপূর্ণ কোনরূপ সাময়িক পত্রাদি বিক্রয় দ্বারা আবিষ্কৰ্ত্তা, প্রণেতা, রচয়িতা যে স্বত্ব ভোগ করেন, সেই স্বত্বাধিকারিগণকে প্রতিভা বিক্রেতা বলা যায়। পুরাকালে এ প্রথাটি প্রচলিত ছিল না। ঐ সকল বৃত্তি ব্যতীত চৌৰ্য, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি বৃত্তি কেহ কেহ অবলম্বন করেন। কিন্তু সাধারণ বা প্রকাশ্যবৃত্তি নহে বলিয়া উহাকে বৃত্তি মধ্যে গণ্য করা যাইতে পারে না।

এক্ষণে উল্লিখিত উপজীবিকা বিভাগের ব্যাঘাত সংঘটন কিভাবে হইতেছে, তাহাই দেখান যাইতেছে।”১৬

৩. কৃষকের অবস্থা

শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের ফলে সাধারণ শ্রেণীর অনেক লোকেই জীবিকা অর্জনের জন্য কৃষিকার্য অবলম্বন করিতে বাধ্য হইল। কিন্তু জমির পরিমাণ সীমাবদ্ধ। এইভাবে বেশী লোকের এই জমিচাষের কার্যে অগ্রসর হওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল হইল কৃষির আয়ের হ্রাস। ইংরেজ কোম্পানিও সুযোগ পাইয়া রাজস্বের পরিমাণ ক্রমশঃ বৃদ্ধি করিতে লাগিল। ইংরেজ কোম্পানি দেওয়ানি পাইবার পূর্ব বৎসর (১৭৬৪-৬৫) মোট রাজস্ব আদায় হইয়াছিল ৮১,৭০,০০০ টাকা। দেওয়ানি লাভের পর প্রথম বৎসর (১৭৬৫-৬৬) ১,৪৭,০০,০০০; ১৭৭১-৭২ সন ২,৩৪,১০,০০০; এবং ১৭৭৫-৭৬ সনে ২,৮১,৮০,০০০ টাকা রাজস্ব আদায় হইয়াছিল।১৭

১৭৬৯ সনে ইংরেজ কোম্পানির মুর্শিদাবাদে নিযুক্ত রেসিডেন্ট (Resident) কোম্পানিকে লিখিলেন :

“ইংরেজ মাত্রেরই ইহা মনে করিতে ক্লেশ হইবে যে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করিবার পর এই দেশের লোকের অবস্থা পূৰ্বের অপেক্ষা অনেক খারাপ হইয়াছে। কিন্তু ইহা যে সত্য সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এই সুন্দর দেশে স্বেচ্ছাচারী রাজাদের অধীনেও স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্পদ ছিল, কিন্তু যখন ইহার শাসন ভার প্রধানতঃ ইংরেজদের হাতে আসিল তখন হইতে ইহা ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইতেছে।

“আমার এখনও মনে পড়ে যে এ দেশবাসীরা যখন স্বাধীন ভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করিতে পারিত তখন ইহার কি ঐশ্বৰ্য্য ও সম্পদ ছিল। ইহার বর্তমান ধ্বংসের অবস্থা দেখিয়া আমি খুবই দুঃখিত, এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যই ইহার প্রধান কারণ।”১৮

রেসিডেন্টের এই বর্ণনা যে কতদূর সত্য, ১৭৭০ সালের (বাংলা ১১৭৬ সালের) দুর্ভিক্ষ (ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই দুর্ভিক্ষের ফলে দেশের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ এক কোটি লোকের মৃত্যু হয়। কিন্তু ইহাসত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে নাই। কোম্পানির কলিকাতাস্থিত কাউন্সিল ১৭৭১ সনের ১২ ফেব্রুআরি তারিখে যে রিপোর্ট দাখিল করেন তাহাতে বলা হইয়াছে : “সম্প্রতি যে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল এবং ফলে বহুলোকের প্রাণনাশ হইয়াছিল তাহা সত্ত্বেও বর্তমান বৎসরে রাজস্ব বৃদ্ধি হইয়াছে।” এক-তৃতীয়াংশ লোক ধ্বংস এবং তদনুরূপ কৃষির হ্রাস হওয়ায় রাজস্বও কম হইবার কথা–কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ১৭৭১ সনের মোট রাজস্বের পরিমাণ ১৭৬৮ সন অপেক্ষাও যে বেশি হইয়াছে, হেষ্টিংস বিলাতের কর্তৃপক্ষের নিকট তাহার কারণ ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে “জোর জবর করিয়া পুরাতন পরিমাণের রাজস্ব আদায় করা হইয়াছে।”১৯

অথচ এই দুর্ভিক্ষের ফলে বাঙ্গালীর আর্থিক অবস্থা কিরূপ শোচনীয় হইয়াছিল ইংরেজ লেখকগণই তাহা স্বীকার করিয়াছেন। ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সভ্য উইলিয়ম ফুলার্টন (William Fullerton) লিখিয়াছেন : “পূর্বে বাংলা দেশ সকল জাতির শস্যের ভাণ্ডার এবং প্রাচ্য দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও সম্পদের কেন্দ্র বলিয়া পরিগণিত হইত। কিন্তু আমাদের অতিরিক্ত কুশাসনের ফলে গত বিশ বৎসরের মধ্যে এই দেশের অনেক স্থান প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে। অনেক স্থলে জমিতে চাষ হয় না–বিস্তৃত জঙ্গল তাহার স্থান অধিকার করিয়াছে। কৃষকের ধন লুণ্ঠিত, শিল্পীরা উৎপীড়িত। পুনঃ পুনঃ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছে–এবং ইহার ফলে লোকসংখ্যা কমিয়া গিয়াছে।”

ভারতের বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিস এদেশে কার্যভার গ্রহণ করার পরে ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে নিম্নলিখিত মন্তব্য (Minute) লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন : “আমি একথা নিঃসঙ্কোচ বলিতে পারি যে কোম্পানির শাসনাধীন ভূভাগের এক-তৃতীয়াংশ কেবলমাত্র বন্য পশুর বাসস্থান জঙ্গলে পরিণত হইয়াছে।” অথচ এই কর্ণওয়ালিস যখন জমিদারদিগের সহিত রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিলেন তখন মোট রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত করিলেন তিন কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা অর্থাৎ ১৭৬৫ সন হইতে এ যাবৎ যে বার্ষিক রাজস্ব আদায় হইত তাহার চেয়ে অনেক বেশি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নীতি অনুসারে অনেক জমিদার বর্ধিত হারে রাজস্ব দিতে না পারায় তাহাদের ভূসম্পত্তি নিলাম হইয়া যায় এবং কলিকাতার ধনশালী ব্যক্তিরা এই সমুদয় ক্রয় করায় এক নূতন জমিদার-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। ইহারা জমিদারির এলাকায় বাস করিতেন না, কলিকাতায় বাস করিয়াই কর্মচারী দ্বারা কাজ চালাইতেন। অবশ্য প্রাচীন অনেক জমিদারবংশ টিকিয়া ছিল, কিন্তু তাহাদের মধ্যেও অনেকে ক্রমে ক্রমে কলিকাতায় বাড়ী নির্মাণ করিয়া বৎসরের বেশী ভাগ কলিকাতাতেই থাকিতেন, মাঝে মাঝে স্বয়ং জমিদারি দর্শন করিতে যাইতেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারের আর্থিক উন্নতি ও সামাজিক প্রতিপত্তি যথেষ্ট বাড়িল এবং বাংলা দেশে এক নূতন অভিজাত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইল। কিন্তু প্রজার অবস্থা যে প্রথম প্রথম খুবই খারাপ ছিল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। নানাবিধ–বিশেষতঃ ১৮৫৯ সনের আইনের ফলে তাহাদের দুঃখ-দুর্দশা কতক দূর হইলেও মোটের উপর তাহাদের অনেক কষ্ট ও লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইত।

জমিদারেরা প্রজাদিগের নিকট হইতে খাজনা খাদায় না করিতে পারিলে সরকারী রাজস্ব দিতে পারেন না–সুতরাং ইহার প্রতিষেধের জন্য সরকার নূতন আইন পাশ করিয়া প্রজাদের নিকট হইতে জোর জবরদস্তি করিয়া খাজনা আদায় করিবার অধিকার জমিদারদিগকে দিলেন। ইহাতে প্রজাদের উপর ঘোর অত্যাচার হয়–ইহার ফলে এই আইনটির কিছু সংশোধন হয়। এই দুইটি আইন হপ্তম পঞ্চম’ নামে কুখ্যাত (Regulation VII of 1799, Regulation V of 1812)। ইহার বলে, “সংবাদ প্রভাকরের ভাষায়, (জমিদার) “প্রজার বক্ষের উপর বাঁশ দিয়া টাকা সংগ্রহ করেন।”২০

রেভারেণ্ড আলেকজাণ্ডার ডা ও আরও ২০ জন মিশনারী বলেন (এপ্রিল ১৮৭৫ : “জমিদাররা চাষীদের সঙ্গে ব্যবহার করেন ঠিক প্রজাদের মতো নয়, কতকটা ক্রীতদাসের মতো। তারা নিজেদের রাজা মহারাজাদের মতো মনে করেন। প্রজাদের কাছে খাজনাদি যা তাদের ন্যায্য পাওনা, তার চেয়ে অনেক বেশি তারা নানা কৌশলে আদায় করেন এবং বিনা পারিশ্রমিকে নিজেদের নানারকমের কাজে প্রজাদের খাঁটিয়ে নেন। তাছাড়া অত্যাচার যে কতরকমের করেন তা বলে শেষ করা যায় না।”২১

জমিদারগণ প্রজাদের উপর কিরূপ নৃশংস অত্যাচার করিতেন সমসাময়িক পত্রিকায় তাহার বিবরণ পড়িলে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইতে হয়। এই সমুদয় বিস্তৃত বিবরণ উদ্ধৃত করা সম্ভবপর নহে। ১৭৭২ শকে (১৮৫০ খ্রী.) “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মন্তব্য উদ্ধৃত করিতেছি২২ :

“ভিন্ন ভিন্ন ভূস্বামী যে কত প্রকার ভিন্ন ভিন্ন ছল করিয়া প্রজা নিস্পীড়ন করেন, তাহার গণনা করা দুষ্কর। তাঁহারা স্বাধিকারস্থ সমুদায় প্রজার সমুদায় বস্তুই আত্মবস্তু জ্ঞান করিয়া তদনুযায়ী ব্যবহার করিয়া থাকেন। ইহা কাহার অবিদিত আছে যে, প্রজাদিগের ফল মূল বৃক্ষ পৰ্য্যন্ত ভূ-স্বামীর সৰ্ব্বগ্রাসক লোভের নিকট রক্ষা পায় না? কোন নিরাশ্রয় দুঃখিপ্রজা কোন ফল-বৃক্ষ রোপণ পূর্বক যথোচিত যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া তাহাকে রক্ষিত ও বর্ধিত করিয়াছে, এবং বহু বৎসরের পর তাহার শাখা সকল ফলভারে অবনত দেখিয়া মনে মনে পরম আনন্দ প্রাপ্ত হইতেছে, ইতিমধ্যে যদি তাহার উপর ভূম্যধিকারির ত্রুর দৃষ্টি পতিত হয়, তবে আর তাহা রক্ষা করে কাহার সাধ্য? যখন সে অনাথ ব্যক্তি তাঁহার নিদারুণ অনুমতি শ্রবণ করিলেক, তখনই নিশ্চয় জানিলেক, ভস্মেতে ঘৃতাহুতির ন্যায় আমার এত বৎসরের পরিশ্রম অদ্য বিফল হইল। কি বিষম নৈরাশ্য! কি অসহ্য যন্ত্রণা! ২৩

“বাঙ্গলাদেশের অনেক ভূস্বামিরই এই প্রকার উপদ্রব, এবং অনেক প্রজারই এই প্রকার যাতনা। সম্প্রতি কৃষ্ণনগর জেলার কোন ভূস্বামী ও তাঁহাদের কৰ্ম্মচারিদিগের চরিত্র শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াপন্ন হওয়া গেল। তাহারা প্রজাদের স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি দূরে থাকুক, তাহারদিগের শরীরও আপনার অধিকারভুক্ত জ্ঞান করেন, এবং তদনুসারে তাহারদিগের কায়িক পরিশ্রমও আপনার ক্রীত বস্তু বোধ করিয়া তাহার উপর দাওয়া করেন। তাঁহারদের এই প্রকার অখণ্ড্য অনুমতি আছে যে বিনা মূল্যে বিনা বেতনে তাঁহারদিগকে গোপেরা দুগ্ধ দান করিবেক, মৎস্যোপজীবিরা মৎস্য প্রদান করিবেক, নাপিতে ক্ষৌর করিবেক, যানবাহকে বহন করিবেক, চৰ্ম্মকারে চর্মপাদুকা প্রদান করিবেক, ইত্যাদি সকলেই স্ব স্ব উপজীব্যোচিত অনুষ্ঠান দ্বারা তাঁহারদিগের সেবা করিবেক।২৪

“ব্রাহ্মণের ব্রহ্মোত্তর ও দেবতার দেবোক্তর গ্রহণ করা কোন কোন ভূস্বামির সঙ্কল্প হইয়াছে। আমারদিগের সৰ্ব্ব-শোষক গভর্নমেন্টকে যথাসৰ্ব্বস্ব সমর্পণ করিয়া ব্রাহ্মণদিগের যৎকিঞ্চিৎ যাহা অবশিষ্ট আছে, তাহারা তাহা অপহৃত করিয়া আত্মসাৎ করেন। কত কত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এ বিষয়ে প্রতীকারার্থে ব্যক্তি-বিশেষের দ্বারে দ্বারে ক্রন্দন করিয়া ভ্রমণ করিতেছেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁহাদের অন্ন-হন্তা ভূস্বামিদিগের কঠোর হৃদয়ে কারুণ্য রসের সঞ্চার হয় না। তাহারা রোদন করিলে তিনি বধিরবৎ ব্যবহার করেন; বোধ হয়, যেন আপনাকে স্বাধিকারস্থ সমস্ত প্রজার সমস্ত বস্তুর অদ্বিতীয় স্বত্ত্বাধিকারি জ্ঞান করিয়া তাহা অধিকার করিবার নিমিত্ত সৰ্ব্বদাই ব্যস্ত থাকেন। কখন দেখ, তিনি লোভাক্রান্ত হইয়া পুনঃ পুনঃ ভূমি পরিমাণ পূৰ্ব্বক নানা কৌশলে রাজস্বের বাহুল্য করিতেছেন,২৫ কখন কোন প্রজার নিরূপিত কর পরিবর্তন করিয়া যথেচ্ছা বৃদ্ধি করিতেছেন, কখন বা সাতিশয় ধন তৃষ্ণা-পরবশ হইয়া স্বেচ্ছানুসারে এক প্রজার ভূমি গ্রহণ পূৰ্ব্বক অধিকতর করে, অন্যের হস্তে সমৰ্পণ করিতেছেন।

“প্রজারা এই প্রকার যন্ত্রণা নিরন্তর ভোগ করিতেছে, তথাপি তাহার প্রতীকার চেষ্টায় সমর্থন হয় না, চিরদিন অন্তর্দাহে দগ্ধ হইতেছে, তথাপি অন্তরের ব্যথা ব্যক্ত করিতে পারে না! কেহ কেহ কহেন, তাহারা বিচারালয়ে ভূস্বামির নামে অভিযোগ না করে কেন? হায়! তাহারদের কি সে সামর্থ্য আছে?…

“প্রজারা আপনারদের অভিযোগ সপ্রমাণ করিবার নিমিত্ত কোথায় বা সাক্ষী পাইবে? তাহারদের এ প্রকার প্রচুর ধনই বা কোথায়, যে তদ্বারা বিচারালয়ের কর্মচারিদিগকে আয়ত্ত বশীভূত করিয়া রাখিবে?

“অতএব তাহারা রাজদ্বারেও তাঁহাকে পরাভব করিতে পারে না, লাভ হইতে তাঁহার কোপানলে পতিত হইয়া তাহারদের উচ্ছিন্ন যাইবার উপক্রম হয়। খড়ি নদীর তীরবর্তি গ্রাম বিশেষের কতকগুলি ইতর লোক ভূস্বামির অত্যাচার সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া বিচারালয়ের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল, এবং ধন-প্রাণ রক্ষার্থে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হইয়া প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিল। এক দিবস তাহারা সবিশেষ মনঃসংযোগ পূৰ্ব্বক নিজ নিজ ক্ষেত্রকর্ষণে নিযুক্ত ছিল, ইত্যবসরে ভূস্বামির শত শত দুরন্ত দূত যুগপৎ আগমনপূর্বক তাহারদের সমস্ত গরু হরণ করিয়া লইয়া গেল। এই দস্যু ক্রিয়াতে তাঁহার মনস্কামনা সম্যরূপে সিদ্ধ হইল; কারণ সেই অতি দীন পরাধীন প্রজাগণ যখন এইরূপে হৃত-সৰ্ব্বস্ব হইল, তখন চতুর্দিক শূন্য দেখিয়া নিতান্ত অনুপায় ভাবিয়া তাঁহার পদানত হইল, এবং তাঁহার দাসত্ব স্বীকার করিয়া মনের অগ্নি মনেতেই জাপ্য করিয়া রাখিল।…

“এ প্রকার ঘটনা সৰ্ব্বদাই ঘটে; আমারদিগের অন্তঃকরণে এইরূপ হৃদয় বিদীর্ণকারী কত ব্যাপারের উদয় হইতেছে! কিয়ৎ বৎসর হইল, সুপ্রসিদ্ধ পলাশিগ্রাম সন্নিহিত মাঙ্গনপাড়া নিবাসী এক ব্যক্তি নানামতে নিগৃহীত হইয়া এবং তৎপার্শ্ববর্তি প্রজাদিগের দারুণ দুর্দশাদৃষ্টে দয়ার্দ্র হইয়া ভূস্বামির অত্যাচার নিবারণার্থে যত্ন পাইতেছিলেন, এবং অপরাপর প্রজাদিগকে তদ্বিষয়ে উৎসাহ দিতেছিলেন। তাহাতে ভূস্বামির ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইল, এবং তিনি তাহার প্রতিফল প্রদানার্থে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলেন। সে প্রতিফল স্মরণ করিলে শরীর রোমাঞ্চ হয়, কলেবর কম্পমান হয়, হৃদয়ের শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়! তাহার প্রেরিত দস্যুদল ঐ ব্যক্তির গৃহ আক্রমণ ও সৰ্ব্বস্ব হরণ করে, তাহার পরিবারস্থ স্ত্রীদিগের প্রতি অহিতাচরণ করে এবং তাহার কোন স্নেহপাত্রকে আনয়নপূর্বক ভূস্বামির গৃহে রুদ্ধ করিয়া রাখে।”২৬

“সে বৎসর নবদ্বীপ অঞ্চলে ঢোলমারি, চাপড়া, কাঁপাসডেঙ্গা প্রভৃতি কতিপয় গ্রামের কতগুলি এতদ্দেশীয় খ্রীষ্টান আপনারদিগকে রাজ-ধৰ্ম্মাক্রান্ত ভাবিয়া ভূস্বামির অন্যায় অনুমতি সকল প্রতিপালনে অস্বীকার গিয়াছিল। কিন্তু বাঙ্গলার ভূস্বামিরা ধর্মবিশেষের অনুরোধ রাখেন না, এবং সামান্য সাহেবদিগকেও ভয় করেন না, অতএব উল্লিখিত ভূম্যধিকারী তাহারদিগকে অন্যান্য ইতর প্রজার সহিত অবিশেষ জানিয়া যৎপরোনাস্তি শাস্তি প্রদান করেন। তাহারদিগের সহায় স্বরূপ মিশনারীরা এবিষয় অবশ্যই অবগত হইয়া থাকিবেন, কিন্তু কোন প্রকার প্রতীকার করিতে সমর্থ হন নাই। সুতরাং সেই সকল খ্রীষ্টান প্রজা তদবধি নত-মুণ্ড হইয়া তাঁহার পদানত হইয়া রহিয়াছে।

“এইরূপ অত্যাচার করা দুঃশীল দুরাশয় ভূস্বামিদিগের অভ্যাস পাইয়া গিয়াছে। যেরূপ নরহন্তা দস্যুরা অবলীলাক্রমে অম্লান বদনে মনুষ্যের মুণ্ডে দণ্ডাঘাত করে, সেইরূপ তাঁহারাও নিতান্ত নির্দয় ও ধৰ্ম্মাধৰ্ম্ম-বিবেচনা-শূন্য হইয়া লোকদিগকে অশেষ প্রকারে যন্ত্রণা প্রদান করেন। তাঁহারদের এইপ্রকার সংস্কার জন্মিয়া গিয়াছে, যে আমার আজ্ঞা অখণ্ডনীয় ও আমিই সকলের মরণ জীবনের কর্তা।”২৭

প্রজাদিগের উপর জমিদার কতরকম অত্যাচার করেন তাহার নিম্নলিখিত বর্ণনা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :

“ভূম্যধিকারির লোকে বল দ্বারা প্রজাদের ধান্যগ্রহণ করে, গো সকল হরণ করে, এবং তাহারদিগকে গোণী-বন্ধ করিয়া জল-মগ্ন করে ও প্রহার করে। ভূস্বামী ও দারোগা এবং তাহারদের কর্মচারিরা প্রজাদিগের যে প্রকার শারীরিক দণ্ড করে, তাহা কলিকাতাবাসি অনেক লোকে সবিশেষ অবগত নহেন। অতএব পশ্চাৎ কয়েক প্রকার কায়দণ্ডের বিবরণ করা যাইতেছে, যথা :

১- দণ্ডাঘাত ও বেত্রাঘাত করে।

২- চৰ্ম্মপাদুকা প্রহার করে।

৩- বংশকাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন করিতে থাকে।

৪- খাপরা দিয়া কর্ণ ও নাসিকা মর্দন করে।

৫- ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ করায়।

৬- পৃষ্ঠভাগে বাহুদ্বয় নীত করিয়া বন্ধন করে এবং বন্ধন করিয়া বংশদণ্ডাদি দ্বারা মোড়া দিতে থাকে।

৭- গাত্রে বিছুটি দেয়।

৮- হস্তদ্বয় ও পাদদ্বয় নিগড়-বন্ধ করিয়া রাখে।

৯- কর্ণধারণ করিয়া ধাবন করায়।

১০- কাটা দিয়া হস্ত দলন করিতে থাকে।২৮

১১- গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রৌদ্রে পাদদ্বয় অতি বিযুক্ত করিয়া ইষ্টকোপরি ইষ্টক হস্তে দণ্ডায়মান করিয়া রাখে।

১২- অত্যন্ত শীতের সময় জলমগ্ন করে ও গাত্রে জল নিঃক্ষেপ করে।

১৩- গোণীবদ্ধ করিয়া (ছালার মধ্যে পুরিয়া) জলমগ্ন করে।

১৪- বৃক্ষে বা অন্যত্র বন্ধন করিয়া লম্বমান করে।

১৫- ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুরিয়া রাখে। (সে সময়ে গোলার অভ্যন্তর অত্যন্ত উষ্ণ হয়, এবং ধান্য হইতে প্রচুর বাষ্প উঠিতে থাকে।)।

১৬- চূণের ঘরে রুদ্ধ করিয়া রাখে।

১৭- কারারুদ্ধ করিয়া উপবাসি রাখে, অথবা ধান্যের সহিত তণ্ডুল মিশ্রিত করিয়া তাহাই এক সন্ধ্যা আহার করিতে দেয়।

১৮- গৃহ মধ্যে রুদ্ধ করিয়া লঙ্কা মরিচের ধূম প্রদান করে।

প্রজাদের উপর অত্যাচার কেবল জমিদারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। জমিদারেরা রাজস্ব-আদায়ের সুবিধার জন্য জমিদারী ও সম্পত্তি নানা লোকের মধ্যে বিলি করিয়া দিতেন–তাহারা একটা থোক টাকা দিতে স্বীকৃত হইত, সুতরাং জমিদারদের আর প্রত্যেক কৃষকের নিকট হইতে আদায় করিবার অসুবিধা ভোগ করিতে হইত না। যাহারা এইভাবে একখণ্ড জমির রাজস্ব আদায়ের ভার অর্থাৎ পত্তনি পাইত তাহারা আবার ইহাকে কয়েকটি ক্ষুদ্রতর খণ্ডে ভাগ করিয়া ইজারা দিত। অর্থাৎ, এখন যেমন একজন কন্ট্রাক্টর তাহার অধীনে সাবু কন্ট্রাক্টর নিযুক্ত করে, সরকারী রাজস্ব আদায়ের কন্ট্রাক্টর জমিদারগণও সেইরূপ তাহাদের অধীনে সাবৃ-কন্ট্রাক্টর নিযুক্ত করিতেন, ইহারা আবার নিজেদের অধীনে সাক্-কন্ট্রাক্টর নিযুক্ত করেন। এইরূপে জমিদার ও কৃষকের মধ্যে কতগুলি মধ্যস্বত্ব ভোগীর দল, উপদল প্রভৃতির সৃষ্টি হইল। ১৮১৯ সনের ৮নং রেগুলেশান (Regulation) অনুসারে এই সকল মধ্যস্বত্বভোগীর অধিকার জমিদারের স্বত্বের ন্যায় স্বীকৃত হইল এবং ইহার ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর অর্থাৎ নানা স্তরের ইজারাদারদের শ্রেণী ও সংখ্যা এত বৃদ্ধি পাইল যে প্রকৃত জমিদারের অধীনে খাস জমির পরিমাণ খুবই সামান্য থাকিত। ১৮৭২-৭৩ সালের রিপোর্টে দেখা যায় যে, তখন জমিদারির সংখ্যা দেড় লক্ষেরও বেশী ছিল। ইহাদের বিভিন্ন স্তরের পরিমাণ এইরূপ :

জমির পরিমাণ – জমিদারের সংখ্যা

৬০,০০০ বিঘার উপর — ৫৩৩

৬০,০০০ হইতে ১৫০০ বিঘা — ১৫,৭৪৭

১৫০০ বিঘার কম — ১৩,৭৯,২০৩

১৮৭১-৭২ সালের সরকারী রিপোর্টে জমিদার ও কৃষকদের মধ্যবর্তী বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগী-শ্রেণীর যে তালিকা আছে তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইল।২৯

১। কৃষক — ৬৩,৯১,০৭৪

২। জমিদার — ৪২,৬১৮

৩। ইত্মাামদার — ৫৮৬

৪। ঠিকাদার — ৩০৩

৫। ইজারাদার – ৩,৩৫৪

৬। লাখেরাজদার – ২৩,০৭০

৭। জায়গীরদার – ৩৬৫

৮। ঘাটোয়াল – ৬৬৮

৯। আয়মাদার – ২,০০৪

১০। মকরারীদার – ৯,৯৩৩

১১। তালুকদার – ৯৬,০৫০

১২। পত্তনিদার – ৩,৩৭২

১৩। খোদকস্ত প্রজা – ৭,৫৫২

১৪। মহলদার – ১,১২৮

১৫। জোতদার – ১৯,৫৬৪

১৬। গাঁতিদার – ৩,৮২৪

১৭। হাওলাদার – ৯,৩৪৩

এই সকল মধ্যস্বত্বভোগীরা কিরূপে প্রজাদের অর্থশোষণ ও তাহাদের উপর নানা অত্যাচার করিত সমসাময়িক পত্রিকার নিম্নোদ্ধত অংশগুলি হইতে তাহার কতকটা ধারণা করা যায় :

“গভর্নমেন্টের নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করিয়া কেবল জমীদারেরাই ভূমির উৎপন্নের লাভাংশ ভোগ করিয়া থাকেন এমত নহে, জমীদারদিগের অধীনে যে সমস্ত তালুকদার ও পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, ইজারাদার প্রভৃতি আছেন, তাহারা কৃষকের শ্রমোৎপাদিত দ্রব্যাদির প্রতি আপনাপন সুখসেবা ও সংসারযাত্রা নির্বাহ করণের সম্যক নির্ভর করিয়া থাকেন অর্থাৎ কৃষকদিগকে আপনাপন শ্ৰমার্জিক ধন দিয়া এই সকল লোকেরও পুষ্টিবর্ধন করিতে হয়।” (সংবাদ প্রভাকর, ১২৯৯)

“কোন বৎসর শস্য হউক বা না হউক তাঁহারা নিয়মিত রাজস্বের একটি পয়সাও পরিত্যাগ করেন না। (ইহাতে) কৃষকের অবস্থা অতিশয় ক্লেশদায়ক হইয়াছে।”৩০ (সংবাদ প্রভাকর, ১২৫৮)।

“মফঃসলে অর্থাৎ পল্লীগ্রামমাত্রে কৃষক লোকেরা প্রায়সকলেই নির্ধন অন্নাচ্ছাদনের সামর্থ্য রহিত, সুতরাং তাহারদিগের অন্ন জন্য উপায় কি আছে কাযেই ধান্যের বাড়ীদাতা মহাজনগণের নিকট যাইতে হয়। ঐ ধান্যের মহাজন সকলের মধ্যে অধিকাংশ তালুকদার, অপর লোক অত্যল্প, কৃষকেরা কর্ষণের সময়ে অর্থাৎ আষাঢ় শ্রাবণ মাসে যত পরিমাণে ধান্য লইয়া খত লিখিয়া দেয়, পৌষ ও মাঘ মাসে তাহার দেড়া দিতে হয়, এরূপ নিয়মবদ্ধ আছে, অনন্তর যদি দৈব বশতঃ ফসল না জন্মে তবেই সৰ্ব্বনাশ ঘটিয়া উঠে, খতের লিখিত ধান্য উক্ত নিয়মে পরিশোধ করিতে না পারিলে ঐ দেড়া ধান্যের খত লেখাইয়া লয়, তাহাতে দেড় বৎসরের ভিতর চারি শলি ধান্য লইলে গুণশালি ঋণদাতাকে নয় শলি প্রদান করিতে হয়, দেখুন, প্রথম ৪ শলিতে ৬ শলি, পরে ৬ শলিতে ৯ নয় শলি, যাহারা একবার এ প্রকার ঋণগ্রস্ত হয়, তাহারদিগের মৃত্যু ব্যতীত ঐ ঋণ হইতে উদ্ধার হওনের অপর উপায় কিছুই দেখি না।”৩১ (সংবাদ প্রভাকর-সম্পাদকীয়, ১২৫৮)

প্রজাদের দুরবস্থার আর-একটি কারণও এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক। জমিদারগণের দেয় রাজস্বের পরিমাণ চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল কিন্তু প্রজাগণের কর সেরূপভাবে নির্দিষ্ট করা হয় নাই। ভূমির জরিপও হয় নাই। ইহার ফলে পত্তনিদারেরা কৃষকের উপর অত্যাচার করিত। সমসাময়িক পত্রিকায় তাহার বর্ণনা হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :

“১৮১৯ সালের ৮ আইনের বিধান মতে পত্তনি দিবার যেরূপ বন্দোবস্ত আছে, তাহা প্রজাগণের অধিকতর অনিষ্টের কারণ। সুচতুর জমিদারগণ স্বীয় অধিকারস্থ জমিদারী জরীপ ও নিরিখ ধার্য্য করিয়া পত্তনি দিবার ঘোষণা করিয়া দেন, নীলামের ডাকের ন্যায় উহার ডাক বাড়িতে থাকে, যে ব্যক্তি অধিক পণ জমা দিতে সম্মত হয়, তাহার সহিত পত্তনির বন্দোবস্ত হইয়া থাকে। পত্তনিদার মহলে উপস্থিত হইয়া খাজনা আদায় করিবার পূর্বে এই কথা প্রচার করিয়া দেয় যে, যে প্রজা টাকায় সিকি বৃদ্ধি স্বীকার না করিবে তাহার সহিত বন্দোবস্ত হইবে না। এই নিমিত্তই প্রজারা ভূমিতে জমিদারের জরীপের রজ্রপাতকে হৃদয়শল্য জ্ঞান করে…ভূমি মাপিবার রসি স্থির না থাকাতে সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় পত্তনিদারের লোকেরা ১৮ কাঠায় বিঘা হয়, এমত রসি লইয়া মাপ আরম্ভ করে, এবং ১০ বিঘার বন্দকে জরীপ মুখে ১২ বিঘা করিয়া তুলে, যখন প্রজারা মাঞ্চেষ্টারের মজুরদিগের ন্যায় নিতান্ত নিরুপায় হইয়া পত্তনিদারের দুরাকাঙ্খ পূর্ণ করিতে বাধ্য হয়। এই প্রকার দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার ইজারদার, ছে ইজারদারের হস্তে নিত্য নূতন যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, ইহাতে কি প্রজাদিগের সুখ-সৌভাগ্যের প্রত্যাশা আছে।”৩২ (সোমপ্রকাশ, ১২৭০)

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার ও কৃষকের মধ্যবর্তী স্বত্বভোগী সম্প্রদায় ও তৎসংসৃষ্ট নানা লোক লইয়া এক নূতন মধ্যবিত্তশ্রেণী গঠিত হইল। সমসাময়িক পত্রিকাগুলির বিস্তৃত বিবরণ আলোচনা করিয়া শ্রীযুক্ত বিনয় ঘোষ এ-সম্বন্ধে লিখিয়াছেন:

“পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, ইজারাদার, গাতিদার, তালুকদার, জোতদার প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী, নায়েব গোমস্তা দেওয়ান ম্যানেজার তহশীলদার থেকে আরম্ভ করে পাইক-বরকন্দাজ, এমনকি জমিদারের বাজার সরকার পর্যন্ত আমলাবর্গ, নতুন পুলিশের দারোগা কনেষ্টবল, মহাজন এবং আইন আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দালাল থেকে উকিল পৰ্য্যন্ত নানারকমের লোক নিয়ে বাংলার গ্রাম্যসমাজে যে বিপুল-কলেবর এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হল, অর্থনীতি-ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদনের (Production) সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক রইল না। পরনির্ভর স্বার্থপর অর্থপিশাচ বেতনভুক এই গ্রাম্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাজার নখদন্ত বাংলার কৃষকদের দিকে ধাবিত হল। বাংলার কৃষকরা, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ভাষায়, “রজনীতে নায়েব, দারোগা, গোমস্তা, নালিশ, দণ্ড, এই সকলই স্বপ্ন দেখে। সৰ্ব্ব-সন্তাপ-নাশিনী নিদ্রাও তাহাদের উদ্বেগ দূরীকরণে সমর্থ নহে!” সহস্রমুখী জোঁকের মতো কৃষকদের শ্রম ও মার্জিত অর্থশোষণ করা ছাড়া গ্রাম্য মধ্যশ্রেণীর আর কোন উপায় রইল না। সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছেন : “পত্তনিয়াদার তালুকদার দরপত্তনিয়াদার ইত্যাদি ভূমির উৎপন্ন ভোগির সংখ্যা রাজনিয়মবলে যত বৃদ্ধি হইয়া আসিয়াছে ততই কৃষকের ক্লেশ বৃদ্ধি হইয়াছে, এতদ্ভিন্ন খোদকস্তা, পাইকস্তা, যোতদার, বীজধান দাতা ইত্যাদিও ভূমির উৎপন্ন গ্রহণকারি বিস্তর আছে, তাহারা স্বহস্তে ক্ষেত্ৰ কৰ্ষণ বীজবপন ইত্যাদি ক্ষেত্রের কাৰ্য্য কিছুই করে না, অথচ কৃষকের উপর কর্তৃত্ব করে” (৫ ভাদ্র, ১২৬৪)। কৃষকের শ্রমোৎপন্নভোগীর সংখ্যা গ্রাম্যসমাজে বেড়েছে, ব্রিটিশ শাসকরা আইনবলে তাঁদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি করেছেন। উৎপাদনকর্ম থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন এরকম শোষণমুখী অর্থলোভী বিপুলাকার মধ্যশ্রেণী বাংলার গ্রাম্যসমাজে ব্রিটিশপূৰ্ব্ব যুগে, মুসলমান বা হিন্দু রাজত্বকালে, ছিল না। বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজের এই পরিবর্তন একদিক থেকে যুগান্তকারী বললেও অত্যুক্তি হয়

৪. দ্রব্য ও শ্রমমূল্য

অর্থনীতি-প্রসঙ্গের উপসংহারে সেকালের দ্রব্য ও শ্রমমূল্য সম্বন্ধে সাময়িক পত্রিকার বিবরণ হইতে কিছু উল্লেখ করিলে উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাঙ্গালীর নাগরিক জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কিছু ধারণা হইবে।

“নগর মধ্যে দ্রব্যাদি সকল অগ্নিমূল্য হইয়া উঠিয়াছে, পূৰ্ব্বে যে মোটা তণ্ডুল মোন ১টাকা—১টাকা ২আনা মূল্যে বিক্রয় হইত গতকল্য সেই তণ্ডুল মোন ১টাকা ২ আনা—১টাকা ১২আনা হইয়া উঠিয়াছে। গোলাধারিরা মধ্যম প্রকার তণ্ডুল মোন ২ টাকার নূনে দেয় তাহাতেও দুই তিন কোর ওজন কমী হয়, টাকায় আড়াই মোন কাষ্ঠ বিক্রয় হইতেছে, প্রকৃত ওজনে তাহা দুই মোনও হয় না, দোকানি পসারিরা সকল দ্রব্যের ওজনে এই প্রকার অন্যায় করিতেছে…”৩৪ (সংবাদ ভাস্কর, ১৮৫৬)।

বর্তমানের তুলনায় দ্রব্যের স্বল্প মূল্য দেখিয়া যদি কেহ মনে করেন যে শত বৎসর পূর্বে বাংলায় রাম-রাজ্য ছিল, লোকে মহাসুখে জীবন ধারণ করিত, তাহা হইলে তিনি বিষম ভুল করিবেন। কারণ তখন শ্রমের মূল্যও ছিল অনেক কম। উনিশ শতকের শেষে গ্রামের চাষী মজুরের মাসিক বেতন ছিল গড়ে তিন টাকা, শহরের মুটে মজুর পাইত মাসিক পাঁচ টাকা, আর চাউলের মন ছিল দুই টাকার কিছু বেশি।৩৫

***

পাদটীকা

১. Dutta, R. Palme, India Today, ১১১ পৃ

২. ঐ, ৯৪ পৃ.

৩. Basu, Major B.D. Ruin of Indian Trade and Industries, ৬২-৫৩ পৃ.

৪. ঐ, ৫৪-৫৫ পৃ.

৫. ঐ, ৩৫ পৃ.

৬. ঐ

৭. Dutt, R.P., ১১১ পৃ.

৭ক. বিনয় ঘোষ-সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, প্রথম খণ্ড, ৪৯৬ পৃ. (পাঁচ খণ্ডে সম্পূর্ণ এই গ্রন্থ অতঃপর বিনয়, ১, ২, ৩, ৪, ৫ এইভাবে উল্লেখিত হইবে)।

৮. Basu, B.D, ১২০ পৃ.

৯. ঐ, ১১৮-১৯ পৃ.

১০. বিনয় ৪। ১৬৮-৭০পৃ.

১১. Dutta, R. P., ২২ পৃ.

১২. বিনয়, ১। ৯২-৯৩ পৃ.

১৩. বিনয়, ৪। ১২৪-২৮ পৃ.

১৪. বিনয়, ৪। ১৪৩-৪৭ পৃ.

১৫. বিনয় ২। ২৪৮-৫০ পৃ.

১৬. বিনয়, ৪। ১৮১-৮২ পৃ.

১৭. Dutt., R.P., ৯১ পৃ.।

১৮. ঐ, ৯২ পৃ.

১৯. Violently kept up to its former standard (Dutt, R.P., ৯২পৃ.)

২০. বিনয়, ১। ৯৫ পৃ.

২১. বিনয়, ৫। ২১ পৃ.

২২. বিনয়, ২। ১১৮-২৪ পৃ.

২৩. অনেকানেক ভূস্বামির এরূপ আচরণ শ্রুত হওয়া গিয়াছে, যে যদি তাহারা স্বকীয় প্রয়োজন সাধানার্থে আপন প্রজা বিশেষের আম্র, কাঁঠাল, বা অন্য বৃক্ষ ছেদন করিবার অনুমতি দেন, তবে সেই প্রজাকে তাহা তৎক্ষণাৎ প্রদান করিতে হয়। ইহাতে দীন দুঃখী প্রজার বৃক্ষটি যায়, কিন্তু তাহার ফল ভোগার্থে ভূস্বামীকে যে কর দিতে হইত তাহা রহিত হয় না। তিনি সেই বৃক্ষস্থানে আর একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষ রোপণ করিতে কহিয়া পূৰ্ব্ববৎ করগ্রহণ করিতে থাকেন। আর এ প্রকারও ঘটে, যদি কোন ভূম্যধিকারের পাঁচ অংশি থাকে, এবং তন্মধ্যে কেহ প্রজার নিকট কোন দ্রব্য গ্রহণ করেন, তবে তাহাকে ক্রয় করিয়াও আর চারজনকে চারটি সেই দ্রব্য দিতেই হইবে, নতুবা তাহার নিস্তার নাই।

২৪. কুমর, বারুই, মুটে, মজুর, ধোপা প্রভৃতি সকলকেই নায়েব, গোমস্তা, মুহুরি প্রভৃতির এইরূপ সেবা করিতে হয়। আর ভূস্বামী যখন স্বাধিকারে স্থিতি করেন, তখন তাঁহাকেও নিজধনে বাসার ব্যয় সম্পাদন করিতে হয় না। তদ্ভিন্ন তাঁহার বাটীতে কোন ক্রিয়া উপস্থিত হইলে বিনা মূল্যে চতুর্দিক হইতে নানা প্রকার সামগ্রীপত্র আসিতে থাকে।

২৫. কিন্তু ইহা আশ্চর্যের বিষয় যে এইরূপ পরিমাণ প্রজার ভুমি প্রায়ই অধিক হইয়া থাকে, কখনও নূন হইতে দেখা যায় না।

২৬. শ্রুত হওয়া গিয়াছে, এ-বিষয় রাজপুরুষদিগের গোচর হইয়া বিচারারূঢ় হইয়াছিল। লোকে কহে, তিনি ৩০০০০ টাকা ব্যয় করিয়া পরিত্রাণ পান। যাহার ধন ব্যয়ের সামর্থ্য আছে, সে ব্যক্তি দিবা দ্বিপ্রহর কাল দস্যুবৃত্তি করিয়া মুক্ত পুরুষের ন্যায়। নির্ভয়ে বিচরণ করিতে পারে।

২৭. সম্প্রতি এ-বিষয়ে এক উদাহরণ উপস্থিত হইয়াছে। নবদ্বীপের নিকটবর্তী কোন গ্রামের এক ভূস্বামী তৎপ্রদেশীয় গ্রামান্তরবাসি কোন ব্যক্তির কন্যাকে উদ্বাহার্থে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, সে ব্যক্তি তাহা স্বীকার না করাতে তাহার ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইল, এবং তিনি যষ্টিধারি লোক প্রেরণ করিয়া বল দ্বারা সেই কন্যাকে হরণ করিয়া আনিলেন।

২৮. অর্থাৎ দুইখানি কঠিন বাখারির এক দিক বাঁধিয়া তাহার মধ্যে হস্ত রাখিয়া মদন করিতে থাকে। এই প্রাণ-ঘাতকযন্ত্রের নাম কাটা।

২৯. বিনয়, ৫। ২৮ পৃ.

৩০. বিনয়, ৫। ২৫ পৃ.

৩১. বিনয়, ১। ৭৭ পৃ.

৩২. বিনয়, ৫। ২৬ পৃ.

৩৩. বিনয়, ৫। ৩০ পৃ.।

৩৪. বিনয়, ৩। ৩২৪ পৃ.

৩৫. History and culture of the Indian People. Vol. IX. p., 1161. f.n.8.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *