০৮. অফিসে সাজ্জাদের প্রথম দিন

অফিসে আজ সাজ্জাদের প্রথম দিন। সে সারা জীবন শুনে এসেছে। দশটা-পাঁচটা অফিস। এখানে এসে দেখছে আটটা-চারটা। প্রথম দিনেই দু ঘন্টা লেট। প্রথম দিনে অনেক কিছু র চোখে দেখা হয়। দুঘণ্টা দেরিও নিশ্চয় ক্ষমার চোখে দেখা হবে। অফিসে পা দিয়ে কি করতে হবে না করতে হবে হোসেন সাহেব ছেলেকে ভালমত বুঝিয়ে দিয়েছেন–প্রথমেই চলে যাবি অফিসের যিনি প্রধান ব্যক্তি তার ঘরে। নিজের পরিচয় দিবি। তারপর বলবি, Sir, with permission I intend to join today.

ইংরেজিতে বলতে হবে?

ভদ্রলোক বাঙালী হলে বাংলায় বলতে পারিস। তবে মালিন্টন্যাশনাল কোম্পানি। সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে, অফিসা—বস হবেন বিদেশী।

সে ক্ষেত্রে আমাকে বলতে হবে–Sir, with your kind permission I intend to join today,

হ্যাঁ। ভাল কথা, তুই মিটমিটি হাসছিস কেন?

তুমি যেভাবে আমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠাচ্ছ তাতেই হাসি আসছে। আমি স্মার্ট একটা ছেলে। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি।

হোসেন সাহেব সরু চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলের কথা তার পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না–আবার অবিশ্বাসও হচ্ছে না। ছেলেটা দেখতে তার মার মত–স্বভাব-চরিত্র মার মত নয়। বাবার মতও নয়। অন্য কারোর স্বভাব নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছে। অথচ বৈজ্ঞানিক নিয়মে তাঁর অর্ধেক স্বভাব, তার মার অর্ধেক স্বভাব পাওয়ার কথা। ছেচল্লিশটা ক্রমেজমের ভেতর তেইশটা আসে মার কাছ থেকে, তেইশটা অসে বাবার কাছ থেকে।

সাজ্জাদ। বলল, বাবা, আমি রওনা হয়ে যাই।

হোসেন সাহেব বললেন, এক কাজ করলে কেমন হয়–আমিও বরং তোর সঙ্গে যাই।

তুমি যাবে কেন?

তোকে অফিসে দিয়ে এলাম, তোর অফিসটা দেখলাম। তোর যে বাস। উনার সঙ্গে এক কাপ চা খেলাম।

সাজ্জাদ বলল, বাবা, আমার মনে হয় তোমার,ব্লেনে শর্টসার্কিট হয়ে গেছে। তুমি আমাকে হাত ধরে অফিসে নিয়ে যাবে? এই উদ্ভট চিন্তা তোমার মাথায় এল কি ভাবে? আমাকে অফিসে দিয়ে আসবে এটা কখন ঠিক করেছ? কাল রাতে?

আরে না। এখন মনে হচ্ছে তোর সঙ্গে গেলে মনপা হয় না।

তোমার এখন মনে হয়নি। তুমি জামাই সেজে বসে আছা সকাল থেকে। হোসেন সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে কাশলেন। সাজ্জাদের সঙ্গে অফিসের ভেতর ঢোকার তার কোন পরিকল্পনা ছিল না। তবে তিনি ভেবে রেখেছিলেন–সাজ্জাদের সঙ্গে গাড়ি করে যাবেন, তাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে আসবেন।

বাবা যাই?

আচ্ছা। সালাম করে যা। শুভ কাজে যাচ্ছিস, মুরুঝবীদের দোয়া নিবি না?

চাকরি করতে যাওয়া কোন শুভ কাজ না বাবা।

সজিদ বাবাকে সালাম করল–সঙ্গে সঙ্গে হোসেন সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। মাত্র সেদিনের কথা–কত ছোট্ট ছিল সাজ্জাদ! রোগা-ভোগা চেহারা। সামান্য কিছুতেই ভয়ে অস্থির হয়ে উঠত। প্রথম দিন স্কুলে নিয়ে গেলেন, সাজ্জাদ বাঁদরের বাচ্চার মত গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতে লাগল। কিছুতেই গলা ছাড়বে না। কান্না না, চিৎকার না, হৈ চৈ না। শুধু গলা জঁড়িয়ে ধরে থাকা। কাঠি কাঠি হাত। কিন্তু কি প্রচণ্ড শক্তি সেই হাতের! অনেক কষ্টে ছেলের হাত ছাড়িয়ে তাকে স্কুলে দিয়ে তিনি স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সেদিনও তার চোখে পানি এসেছিল।

ক্লাস ফোরে। যখন পড়ে তখনকার কথা। ভূতের কি একটা বই পড়েছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। একা ঘুমাবে না–বাবার সঙ্গে ঘুমাবে। বাবার পাশে বালিশে শোবে না। বাবার বুকের উপর শুয়ে থাকবে। হোসেন সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, শুয়ে থোক।

সেই ছেলে আজ চাকরি করতে যাচ্ছে। বিরাট বড় পোস্ট। চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে তিনি অনেক ধরাধরি করেছেন এটা ঠিক। তবে তার ছেলে মাকাল ফল নয়, এটাও ঠিক। এই ছেলে রেকর্ড মার্কস নিয়ে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিল। দেশের সব কটা খবরের কাগজে তার ছবি ছাপা হয়েছে। সাজ্জাদের সঙ্গে তার ছবিও ছাপা হয়েছে।

ইন্টারমিডিয়েটে সাজ্জাদ কোন রকমে ফার্স্ট ডিভিশন পেল। লেটার, স্টার কিছু নেই। তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, সাজ্জাদ বাবা, কি হয়েছে রে? সাজ্জাদ হাসিমুখে বলল, গাড্ডু খেয়েছে।

গাড্ডু খেলি কেন?

সাজ্জাদ আবারো হাসল। আনন্দের হাসি। যেন গাড্ডু খাওয়ার মত আনন্দ আর কিছু নেই। হোসেন সাহেব ভয়ংকর মন খারাপ করলেন।

সেই মন খারাপ ভাব দূর হল যেদিন ফিজিক্স অনার্সের ফল বেরুল। সাজ্জাদ আবার মেট্রিকের মত রেজাল্ট করেছে। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তবে পত্রিকাওয়ালাদের কাছে এই পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ না। এই পরীক্ষার ফার্স্ট হওয়া ছেলেমেয়ের ছবি ছাপা হয় না। হোসেন সাহেব বিজ্ঞাপন হিসেবে তিনটা পত্রিকায় ছবি ছাপার ব্যবস্থা করলেন। সাজ্জাদ এম. এসসি. পরীক্ষ দিল না। তার নাকি পরীক্ষা দিতে আর ইচ্ছা করছে না। বড় অদ্ভুত ছেলে! উঠার ঘরে এরকম ছেলে কি করে হল কে জানে?

 

সাজ্জাদের পরনে সাদা প্যান্ট। গায়ে কমলা রঙের স্বল্‌টাইপ দেয়া হাফ হাওয়াই শািট সে অফিসে ঢুকেছে হাসিমুখে। অফিসটা তার পছন্দ হয়েছে। সবকিছু ঝকঝকি করছে। মেঝেতে নিশ্চয় ফ্লোর পালিশ দেয়া। মেঝে আয়নার মত চকচক করছে। মনে হয় পুরো বাড়ি সেন্টালি এয়ারকন্দ্রিশান্ড। কোথাও কোন ফ্যান দেখা যাচ্ছে না–অথচ শীত শীত লাগছে।

অফিসের চরিত্র বোধহয় এখন পাল্টে গেছে। আগে যে কোন অফিসে ঢুকলে কানে আসত টাইপ রাইটারের খট খট শব্দ, নাকে আসত। সস্তা সিগারেটের উৎকট গন্ধ।

সাজ্জাদের কানে টাইপ রাইটারের খট খট শব্দ আসছে না। সিগারেটের গন্ধও নেই। সম্ভবত পুরো বাড়ি ধূমপান মুক্ত। কোথাও অবশ্যি এ জাতীয় কোন সাইনবোর্ড নেই। হোটেলের রিসিপশনের মত একটা কাউন্টারে জনৈক তরুণীকে দেখা যাচ্ছে। তার সামনে–INQUIRY

সাজ্জাদ মেয়েটির দিকে এগোল। সে কম্পিউটার নিয়ে এতই ব্যস্ত যে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি লাগছে। সাজাদ র্দাড়িয়ে রইল। একসময় না একসময় মেয়েটির ব্যস্ততা কমবে, তখন তার সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।

আপনার প্রয়োজন কি জানতে পারি?

সাজ্জাদ হাসিমুখে বলল— এই অফিসের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি।

প্রধান ব্যক্তি বলতে আপনি কি বুঝাচ্ছেন?

যাকে বলে বাস।

আপনি কি রকিব সাহেবের কথা বলছেন?

হ্যাঁ, রকিব সাহেব হতে পারেন।

উনার সঙ্গে কি আপনার কোন এপয়েন্টমেন্ট আছে?

জ্বি-না।

এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া উনার সঙ্গে দেখা হবে না।

তাহলে নেক্সট যিনি আছেন তার সঙ্গে কি দেখা করা যাবে?

কি জন্যে দেখা করতে চান সেটা কি আমাকে বলা যাবে? Maybe I can help.

আমার নাম সাজ্জাদ। এরনাস ইন্টারন্যাশনালে আমার একটা চাকরি হয়েছে। জয়েনিং রিপোর্ট দিতে চাই। কি ভাবে কি করব বুঝতে পারছি না।

স্যার, আপনার নাম কি সাজ্জাদ হোসেন?

জ্বি।

কি আশ্চর্য স্যার, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। আসুন, আপনাকে রকিব স্যারের কাছে নিয়ে যাই। উনি আজ সকালেও আপনার প্রসঙ্গে জানতে চাচ্ছিলেন। আপনি জয়েন করছেন না কেন তা নিয়ে উনি চিন্তা করছিলেন। স্যার ভেবেছেন, আপনি বোধহয় এপয়েন্টমেন্ট লেটার পাননি। আমাকে মেইল লিস্ট চেক করতে বললেন।

ও, আচ্ছা।

আপনাকে আসতে হবে না।

আমাকে ঘরটা দেখিয়ে দিলেই হবে।

জ্বি না। স্যার, আসুন।

অফিসের বাস সম্পর্কে যেসব ধারণা থাকে–রকিব সাহেবকে তার কোনটির সঙ্গেই সাজ্জাদ মিলাতে পারল না। একজন বয়স্ক হাসি-খুশি মানুষ। সাজ্জাদের পরিচয় শুনে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–আরো ইয়াং ম্যান এসো, এসো। আজ সকালেই তোমার কথা হচ্ছিল। লীলাকে বললাম–লীলা, দেখ তো আমাদের নিউ রিক্রটের কি হল। আমার তো মনে হচ্ছে সে চিঠি পায়নি।

সাজ্জাদ বলল, চিঠি আগেই পেয়েছি। জয়েন করতে দেরি করে ফেলেছি। দেরি করলে কেন বল তো? এইসব চাকরির জন্যে সবাই হা করে বসে থাকে। তুমি পেয়েও আসছে না। আশ্চর্য! চা খাও— নাকি কফি খাবে?

একটা হলেই হবে।

বেশ, তাহলে কফি খাওয়া যাক। খুব ভাল কফি আছে। দাঁড়াও, দিতে বলছি। তুমি করে বলায় রাগ করছ না তো?

জ্বি না।

তুমি করে বলার আমার রাইট আছে। আমাকে তত বুড়ো না দেখালেও আমি কিন্তু যথেষ্টই বুড়ো। আমার বড় মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়–ডঃ ইয়াসমিন। কাজেই আমার বয়স আন্দাজ করে নাও। সিক্সটি থ্রি।

সাজ্জাদ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমি কিন্তু কোন কাজকর্ম জানি না। এরনস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাপারটা কি তাও জানি না।

সবই জানবে। অতি দ্রুত জানবে। এটা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী। এদের অনেক রকম ব্যবসা–আলপিন তৈরি করা থেকে জাহাজ বানানো সবই করে। ইনসেকটিসাইডের ব্যবসা আছে, ফার্মাসিউটিক্যালস আছে। এরা বাংলাদেশে এসেছে। ফার্মাসিউটিক্যালস নিয়ে। অসুখ-বিসুখের দেশ তো, কাজেই অষুধ বিক্রি করতে চায়। দশকোটি মানুষের কাছে অষুধ বিক্রি তো সহজ কথা না। লালে। লাল হবার কথা। তুমি কি সিগারেট খাও সাজ্জাদ?

জ্বি, খাই।

এই অফিসটা টোবাকো ফ্রী। তবে তুমি খেতে পার। আমার ঘরে অনুমতি আছে। আমি চুরুট খাই।

সাজ্জাদ সিগারেট ধরালো। রকিব সাহেব চুরুট ধরলেন। গলার স্বর নিচু করে বলতে লাগলেন–মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীতে কর্পোরেট পজিশনে চাকরি করা খুব আরাম। প্রচুর টাকা। প্রচুর সুযোগ-সুবিধা। বৎসরে একবার কোম্পানীর খরচে ফ্যামিলি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা যেখানে যেতে চাও যাবে। হলিডে কাটিয়ে আসবে। এরা টাকা চুষে নেয়। সেই চোষা টাকার খানিকটা দিয়ে যায় যারা টাকা চুষতে সাহায্য করে তাদের। বুঝতে পারছ?

পারছি।

প্রচুর খাটনি। তবে এরা খাটনি পুষিয়ে দেয়। চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে গাড়ি পাবে। ফার্নিসড় ফ্ল্যাট পাবে। একজন কুক, একজন মালি পাবে। অসুখ-বিসুখে আমেরিকান হসপিটালে চিকিৎসার সুবিধা পাবে। কাশি হয়েছে, সারছে না। চলে যাও সিঙ্গাপুর। সেখানে আমেরিকান হাসপাতাল আছে। এসো আমার সঙ্গে, তোমার ঘর দেখিয়ে দি।

সাহেবকে দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছি, ইনি তোমাকে হাতে-কলমে সব বুঝবেন। খুব এফিসিয়েন্ট লোক।

সাজ্জাদ দুপুর বারোটার মধ্যে নিজের ঘরে স্থায়ী হল। সুন্দর ঘর। ইউনুস সাহেব প্রবল আগ্রহে সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

স্যার, এই টে। একটা ডিরেক্ট লাইন, আরেকটা পিবিএক্স। ফ্যাক্স এইখানে। আইবিএম কম্পিউটার আছে। অফিসের সব কম্পিউটারের সঙ্গে এটা যুক্ত। তবে আপনার ঘরে কোন প্রিন্টার নেই। ফটোকপিয়ার আছে।

সাজ্জাদ হাই তুলতে তুলতে বলল, অনেক কিছুই দেখি আছে। কি নেই সেটা বলুন।

ইউনুস সাহেব দাঁত বের করে হাসলেন। ফেন অফিসে সব কিছু থাকার পুরো কৃতিত্ব তার।

ইউনুস সাহেব!

জ্বি স্যার।

দুপুরে খাবার ব্যবস্থা কি?

আমাদের ক্যান্টিন আছে। সাবসিডাইজ ফুড সার্ভিস। খুবই ভাল। রান্নাও ভাল। চাইনীজ, ইংলিশ, বেঙ্গলী সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়।

ভাল। ভেরী গুড।

আজ প্রথমদিন আপনি স্যার রিল্যাক্স করুন। অফিস ঘুরে দেখুন। কাল থেকে ইনশাল্লাহ আমরা কাজ শুরু করব। ইচ্ছা করলে আজ স্যার আপনি বাসায়ও চলে যেতে পারেন।

আপনাদের অফিস ছুটি হয় কখন?

চারটার সময়। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা। মাঝখানে একটা থেকে দুটা পর্যন্ত লাঞ্চ ব্রেক। শুক্র, শনি এই দুদিন ছুটি।

সপ্তাহে দুদিন ছুটি? ভালই তো।

ইউনুস সাহেব। আবার দাঁত বের করে হাসলেন। যেন সাপ্তাহিক দুদিন ছুটির ব্যবস্থা তিনিই করেছেন।

ইউনুস সাহেব!

জ্বি স্যার।

আপনি যান, আপনার কাজ করুন। লাঞ্চের সময় এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। দুজন একসঙ্গে লাঞ্চ করব।

জ্বি আচ্ছা স্যার। আপনার পার্সোনাল একজন পিওন আছে। মতি নাম। বেল টিপলেই সে আসবে। চা-টা কিছু লাগলে এনে দেবে।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

ইউনুস সাহেব বিদেয় নিলেন। সাজ্জাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অফিসের এই চাকরি সে করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। জানালা বন্ধ বলেই কি দমবন্ধ লাগছে? জানালা খোলা যাবে না। সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড বাড়ির জানালা খোলা যায় না।

পিঁ-পিঁ করে টেলিফোন বাজছে। সাজ্জাদের কাছে কেউ টেলিফোন করবে না। এই অফিসের নাম্বার কারোর জানার কথা নয়। সে নিজেই জানে না। সাজ্জাদ রিসিভার হাতে নিল।

হ্যালো।

স্যার, আমি রিসিপশান থেকে বলছি–লীলা।

ও আচ্ছা, কি ব্যাপার?

আপনার একটা টেলিফোন এসেছে। দেব?

সাজ্জাদ টেলিফোন কানে নিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ বাজনা বাজল, তারপর হঠাৎ মনে হল। লাইন কেটে গেছে। সাজ্জাদ যখন রিসিভার নামিয়ে রাখতে যাচ্ছে তখন হোসেন সাহেবের গলা শোনা গেল—

সাজ্জাদ।

জি।

জয়েন করেছিস?

হ্যাঁ।

কেমন দেখছিস?

ভাল।

সবার সঙ্গে পরিচয়-টরিচয় হয়েছে?

আস্তে আস্তে হচ্ছে।

তারা তোকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করছে তো?

সেটা তো বুঝতে পারছি না। তুমি আমার নাম্বার পেলে কোথায়?

সে এক বিরাট ইতিহাস। হয়েছে কি…

আচ্ছা বাবা, তোমার ইতিহাস বাসায় এসে শুনব।

ব্যস্ত আছিস?

হ্যাঁ, ব্যস্তই আছি।

গুড। ভেরী গুড। জীবনে উন্নতি করতে হলে ব্যস্ত থাকতে হবে। যে যত ব্যস্ত তার জীবন তত উন্নত। ভাল কথা–আতাহারের টেলিফোন নাম্বার জানিস?

ওর কোন টেলিফোন নেই।

বাসার ঠিকনা?

বাসা কোথায় জানি। ঠিকানা জানি না। ওকে দরকার কেন?

ভাবছি, তোর চাকরিতে যোগ দেয়া উপলক্ষে কোন ভাল রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাব। আইডিয়া কেমন?

ভাল।

তুই কি অফিস থেকে ফেরার পথে ওকে একটা খবর দিয়ে আসতে পারবি?

পারব।

নীতু অবশ্যি বলছিল ওকে বাদ দিতে। সে চাচ্ছে শুধু নিজেরা নিজেরা যেতে। আমি চাচ্ছি। ওকে সঙ্গে নিতে। ছেলেটাকে আমার খুবই পছন্দ। এ ভেরি গুড বয়।

বাবা, আমি রাখি।

নীতু বলছিল গুলশানে নতুন একটা জাপানি রেস্টুরেন্ট খুলেছে। ওর কাছে টেলিফোন নাম্বার আছে। বুকিং দিয়ে রাখি?

রাখ।

কাচা মাছ-ফাছ খাওয়ায় কিনা কে জানে। জাপানিবা তো আবার কাচা মাছ খাওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ।

বাবা, এখন রেখে দেই।

আচ্ছা। তুই কিন্তু আতাহারকে একটা খবর দিস। তুই চাকরি শুরু করছিস। আনন্দের একটা ব্যাপার। এই আনন্দ বন্ধু-বান্ধব সবাইকে নিয়ে শেয়ার করা দরকার। সে অবশ্যি মনে কষ্ট পাবে। তোর এত ভাল চাকরি হল তার কিছু হল না। মনে কষ্ট পাবারই কথা। দেখি তার জন্যে কিছু করা যায় কিনা।

বাবা, আমি রাখলাম।

সাজ্জাদ টেলিফোন নামিয়ে রাখল। চুপচাপ বসে থাকতেও ভাল লাগছে না। জানালা খোলা থাকলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যেত। জানালা বন্ধ। জানালায় ভারি পদা টান। কবিতা লেখার চেষ্টা কি করবে? না, নতুন কিছু লেখা যাবে না। প্রিয় ইংরেজ্বি কবিতার অনুবাদের চেষ্টা করা যেতে পারে। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। কোন কবিতাই পুরোটা মনে নেই। চার লাইন, ছলাইন।

অফিসের একটা ব্ল্যাক ইংরেজ কবিদের বইয়ে ভর্তি করে ফেলতে হবে। বাংলা কবিতার বই একটাও রাখা যাবে না। মালিন্টন্যাশনাল কোম্পানীর লোকজন অফিস ঘরে বাংলা কবিতার বই দেখলে সন্দেহজনক চোখে তাকবেন। ইংরেজ্বি কবিতার বই দেখলে কিছু মনে করবেন না। বরং রুচি, মেধা ও মননের প্রশংসা করবেন।

These pools that, though in forests still reflect
The total sky almost without defect,
And like the flowers beside them, chill and shiwer,
Will like the flowers beside then soon be gone,
And yel not out by any brook or river,
But up by Tools to bring dark foliage om

‘বনের মাঝে মাঝে কাকচক্ষু জলের আভাস
সেই জলে বাস করে পরিপূর্ণ সমগ্র আকাশ।’

আভাসের সঙ্গে আকাশের মিল ঠিক আছে। তবে জলে প্রতিফলন হয়ের জায়গায় বাস করে বলাটা  কি ঠিক হচ্ছে? প্রতিফলন এবং বাস করা কি এক অর্থে নেয়া যায়?

সাজ্জাদ ভুরু কুঁচকে বসে রইল। একটা বেজে গেল। ইউনুস সাহেব দরজা খুলে উকি দিলেন। স্যার, লাঞ্চের সময় হয়েছে। এখন খাবেন?

সাজ্জাদ কঠিন গলায় বলল, খবৰ্দার, বিরক্ত করবেন না। ইউনুস সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তিনি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছেন না।

প্ৰচণ্ড মাথা ধরেছে। কাউকে টেলিফোন করতে ইচ্ছা করছে। কাকে টেলিফোন করবে? এমন কাউকে যার সঙ্গে কথা বললে মাথা ব্যথা কমে যায়। লীলাবতীকে করা যায়। লীলাবতীর নাম্বারটা যেন কি?

সাজ্জাদ কিছুতেই নাম্বারা মনে করতে পারল না।

 

সন্ধ্যা থেকে হোসেন সাহেব সেজেগুজে বসে আছেন। জাপানি রেস্টুরেন্টে চারজনের বুকিং নেয়া হয়েছে। তিনি, নীতু, সাজ্জাদ এবং আতাহার। রেস্টুরেন্টে খেতে বসে কি কি গল্প করবেন মনে তার একটা তালিকাও তিনি তৈরি করেছেন। খেতে বসে হালকা গলাপ করতে ভাল লাগে। মজার মজার রসিকতা, এনেকডোটস। আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করা। তার হাতে এক হাজার পৃষ্ঠার বিশাল এক বই। বইটির নাম পার্টি জোকস। অনেকগুলি রসিকতা এর মধ্যেই তিনি পড়ে ফেলেছেন। কোনটিতেই তেমন হাসি আসছে না।

নীতু এসে চা দিয়ে গেল। হোসেন সাহেব বললেন, কি রে, তুই সাজগোজ করলি না? নীতু বলল, ভাইয়া আগে আসুক তারপর সাজব। আমার সাজতে সময় লাগে না। সুন্দর মেয়েরা অনেক সময় নিয়ে সাজে। অসুন্দররা সাজে ঝটপট।

তুই অসুন্দর কে বলল? তোর গায়ের রঙটা একটু চাপা। সৌন্দর্য মানুষের গায়ের রঙে না। সৌন্দর্য যদি গায়ের রঙে হত তাহলে শ্বেত কুণ্ঠ যারা শরীরে নিয়ে ঘুরছে তারা হত সবচে সুন্দর মানুষ।

নীতু বিরক্ত গলায় বলল, সৌন্দর্য নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছা করছে না বাবা।

যা, রেডি হয়ে নে।

বাবা, আমার মনে হচ্ছে ভাইয়া আসবে না। আটটা বেজে গেছে এখনো যখন আসেনি। আজ বাইরে খেতে যাবার কথা বোধহয় ভুলে গেছে।

ভুলবে কেন? দুপুরেই তার সঙ্গে কথা বললাম।

তারপরেও ভুলে গেছে। আমার ধারণা সে পথে পথে ঘুরছে। কিম্বা কোন পাকে বসে কবিতা নিয়ে ভাবছে।

তুই কাপড় পর তো মা, ও চলে আসবে।

নীতু কাপড় বদলাতে গেল। রাত নটার সময় হোসেন সাহেব মোটামুটি নিশ্চিত হলেন–সাজ্জাদ। আসবে না। তিনি তারপরেও বারান্দায় বসে রইলেন।

একা একা অন্ধকারে বসে থাকা বিরক্তিকর ব্যাপার। মশা কামড়াতে থাকে। ইদানীং মশাদের চরিত্রে পরিবর্তন ঘটেছে–তাদের কামড় আগের মত ভদ্র না। কামড়বার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা ফুলে ওঠে–এবং অনেকক্ষণ ধরে চুলকাতে থাকে। আগে দিনের বেলায় মশা কামড়াতো না, এখন দিনেও কামড়ায়। মশা নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কি রিসার্চ হচ্ছে? রিসার্চ হলে এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হত।

হোসেন সাহেব বারান্দায় পা গুটিয়ে বসে আছেন। তাঁর সামনে ছোট্ট একটা টেবিল। এই টেবিলে তার পা রাখার কথা। সেখানে মশা তারানোর স্তেপ্রা। তিনি তার চারদিকে স্প্ৰে করে মশার অযুধ দিয়েছেন। অষুধে সম্ভবত কোন ভেজাল আছে। মশা আরো বেশি বেশি আসছে। শুধু মশা না— মশার মত দেখতে অন্যান্য পোকারাও আসছে।

পৃথিবীতে হাজারো রকমের ইনসেকটিসাইড। তার পরেও পোকার সংখ্যা এত বাড়ছে কেন? পোকাগুলির বুদ্ধিও মনে হয় বাড়ছে। এক সময় পৃথিবীটা কি পোকাদের দখলে চলে যাবে? পোকারা মানুষ মারার স্ত্ৰে বের করে সমানে মানুষ মারতে থাকবে। এই যে তিনি বারান্দায় বসে আছেন–পোকারা তাকে দেখতে পেয়ে এক বোতিল স্পেপ্ৰ নিয়ে এসে ফুস করে তার নাকে ছেড়ে দিল।

চুপচাপ বসে থাকলে অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা তার মাথায় আসে। এইসব চিন্তাভাবনা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তার আলোচনা করতে ইচ্ছা করে। আলোচনার মানুষ পান না। সবাই মনে হয় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে নীতুকে পাওয়া যায়, তবে সে মনে হয় গম্প। গুজব শোনার ব্যাপারে আগ্রহী না। সাজ্জাদকে তো পাওয়াই যায় না। তিনি যখনই খোঁজ নেন তখনি শোনেন বাসায় নেই। ছেলেটাকে ঘরমুখো করার ব্যবস্থা করা দরকার। বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। তার পছন্দের কেউ থাকলে ব্যাপারটা সহজ হত। মনে হচ্ছে পছন্দের কেউ নেই। কণার কথা শুনেছেন। মেয়েটা কে? আতাহারকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। আতাহারের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়–আসল ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে মনে থাকে না। সে যদি আজ রেস্টুরেন্টে খেতে যেত তাকে জিজ্ঞেস করা যেত। পার্টিতে হাসি হাসি মুখে অনেক জটিল প্রশ্ন করা যায়।

সাজ্জাদের পছন্দের কেউ যদি না থাকে তাহলে মেয়ে খোজার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। তাকেই যেতে হবে। তবে এ ব্যাপারে সাজ্জাদের মার একটা মতামত নেয়া যেতে পারে। সেটা দোষের কিছু না। দীর্ঘদিন আগে কি হয়েছিল না হয়েছিল সেসব মনে রেখে লাভ নেই।

হোসেন সাহেবের স্ত্রীর নাম সাবেরা। স্ত্রীর নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছিলেন সাজ্জাদ। মেয়ের নাম রেখেছিলেন। সারা। মেয়ের নাম সারা থেকে কি করে নীতু হয়ে গেল। তিনি ঠিক জানেন না। এটা ঠিক হয়নি। মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়েই ছেলে মেয়ের নাম হওয়া উচিত। ডে অব জাজমেন্টের দিন মায়ের নাম ধরেই ছেলেমেয়েকে পুনরোথিত করা হবে। বাবার নামে না।

সাবেরার উপর হোসেন সাহেব অসম্ভব খুশি ছিলেন। তার ধারণা এ রকম বুদ্ধিমতী মেয়ে পৃথিবীতে কম জন্মেছে। শুধু বুদ্ধিমতী না, বুদ্ধিমতী এবং ভাল মেয়ে। সাধারণত এই দুয়ের কম্পিবনেশন হয় না। বুদ্ধিমতী মেয়েগুলির ভেতর নানান রকম জটিল প্যাঁচ থাকে। সাবেরার ভেতর এইসব ছিল না। স্বভাব্যচরিত্র অবশ্যি খানিকটা অদ্ভুত ছিল। যেমন মাঝ রাতে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, তিনি চাদর গায়ে দিয়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছেন–সাবেরা তাকে ডেকে তুলে বলবে–এই শোন, ওঠতো, বৃষ্টি হচ্ছে। আমার সঙ্গে একটু ছাদে চল, বৃষ্টিতে ভিজব।

রাত তিনটায় বৃষ্টিতে ভিজা পাগলামী ছাড়া আর কি? তিনি স্ত্রীর সঙ্গে ছাদে যেতেন ঠিকই। চিলেকোঠায় বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সাবেরার বৃষ্টিতে ভেজা শেষ হতই না। ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে আসত–আর এদিকে সাবেরা ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথায় যাচ্ছে। ছাদে জমে থাকা পানি পা দিয়ে ছিটাচ্ছে। এবং মাঝে মাঝে চিৎ হয়ে ছাদে শুয়ে পড়ছে। গোসল শেষে হিহি করে শীতে কাঁপিতে কাপতে নেমে আসছে। ঠাণ্ডায় ঠোঁট নীল হয়ে আছে। এ জাতীয় পাগলামীকে প্রশ্ৰয় দেয়া উচিত না–তিনি প্রশ্ৰয় দিয়েছেন, কারণ স্ত্রীর মনে কষ্ট দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। প্রতিদিন কোট থেকে একবার হলেও বাড়িতে টেলিফোন করতেন–তার কারণ একটাই, স্ত্রীর গলা শোনা। টেলিফোনে সাবেরার গলার স্বর শুনতে তাঁর এত ভাল লাগতো যে বলার না।

একবার সাবেরা বলল–সংসার টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সাত দিনের জন্যে আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যাব। এক যাব। এই সাতদিন তুমি সজিদকে রাখতে পারবে না?

তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তবু তিনি বললেন, পারব। অবশ্যই পারব। না। পারার কি আছে?

তাহলে তুমি সাজ্জাদকে নিয়ে থাকে। তোমার সমস্যা হলে তুমি তোমার মার কাছে রেখে এসো। সেখানে সে খুব ভালই থাকবে। আমি এক এক কয়েকটা দিন থাকব।

তিনি শুকনো গলায় বললেন, আচ্ছা। স্ত্রীকে চিটাগাং মেলে তুলে দিলেন। ট্রেন ছাড়ার সময় তার চোখ ভিজো গেলো। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।

সাবেরা চলে যাবার পর তিন রাত তিনি এক ফোঁটা ঘূমুতে পারলেন না। চতুর্থ দিনে সাজ্জাদকে তার দাদীর কাছে রেখে চিটাগাং চলে গেলেন।

সাবেরা তাঁকে দেখে খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, কি ব্যাপার?

তিনি হড়বড় করে বললেন, চিটাগাং-এ খুব জরুরি একটা কাজ পড়েছে। কোম্পানি আইনের একটা মামলা, পার্টি এমন করে ধরেছে–না এসে পারলাম না। ওরা আগ্রাবাদ হোটেলে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছে। ভাবলাম তুমি যখন এখানে আছ শুধু শুধু হোটেলে থাকব কেন?

নীতুর দুবছর বয়সে সাবেরার কিছু একটা হল যা তিনি ঠিক ধরতে পারলেন না। রাতে মাঝে মাঝে বাথরুমে যাবার জন্যে তাঁর ঘুম ভাঙ্গে। তিনি দেখেন তঁরা পাশে সাবেরা নেই। সে বারান্দায় মেঝেতে পা ছড়িয়ে রেলিং-এ হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তাকিয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। তার চোখে-মুখেরাজ্যের ক্লান্তি তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছেন, কি ব্যাপার সাবেরা?

কিছু না। ঘুম আসছে না। তাই চুপচাপ বসে আছি। তুমি শুয়ে পড় আমি আসছি।

ঘুম আসছে না কেন?

ঘুম আসছে না কেন সেটা আমি কি করে বলব?

মাথায় পানি ঢেলে–এক কাপ গারম, দুধ-খেলে। …

তুমি ঘুমুতে যাও তো। তোমার ঘুমের ডাক্তার হবার দরকার নেই। ঘরের ভেতর গরম। বাইরে বসে থাকতে আমার ভালই লাগছে।

আমি বসব তোমার সঙ্গে?

তুমি বসবে কেন? তোমার তো ঘুমের সমস্যা না। বিছানায় যাওয়া মাত্ৰ তুমি ভুসভুস করে নাক ডাকাবে। বললাম তো আমি আসছি। তুমি শুয়ে পড়।

তিনি শুয়ে পড়লেন। ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করে নিজে ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষ রাতে জেগে দেখেন–সাবেরা পাশে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। কখন সে বিছানায় এসেছে কে জানে।

তারপর ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল। নভেম্বর মাসের এগারো তারিখ ঠিক এগারোটার সময় হোসেন সাহেব সাবেরার টেলিফোন পেলেন। সে কখনোই তার চেম্ববারে টেলিফোন করে না। হোসেন সাহেব অসম্ভব খুশি এবং অসম্ভব অবাক হয়ে বললেন, কি ব্যাপার সাবেরা?

সাবেরা বলল, তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলব। তোমার কি এখন সময় হবে?

আরে কি বল, সময় হবে না কেন? আমি বাসায় চলে আসছি।

বাসায় আসতে হবে না। কথাগুলি টেলিফোনে বলাই ভাল। তোমার আশে পাশে কি কেউ আছে?

না।

শোন–তোমার সংসারে আমার মন টিকছে না।

হোসেন সাহেব হতভম্বর গলায় বললেন, কি বললে?

তোমার সংসারে আমার মন টিকছে না। অনেকদিন ছিলাম, খুব কষ্ট করে ছিলাম।

সাবেরা বললেন, আমি এখন চলে যাচ্ছি–তুমি সাজ্জাদ এবং সারাকে দেখবে। ওদের খানিকটা কষ্ট হবে–কি আর করা।

কি বলছো সাবেরা?

ডিভোর্সের কাগজপত্র তোমার কাছে চলে আসবে। তুমি সই করে দিও। আমি চাইনা ডিভোর্সের মামলা কোর্টে উঠুক।

ডিভোর্সের কথা কি বললে?

আমার লইয়ারের কাছ থেকে তুমি চিঠি পাবে। সেই চিঠিতে অনেক আজে বাজে কথা তোমার সম্পর্কে লেখা। এইসব ছাড়া না-কি ডিভোর্স মামলা টেকে না। কাজেই বাধ্য হয়ে লিখতে হয়েছে। তুমি কিছু মনে করো না। যে সব অভিযোগ তোমার সম্পর্কে করা হয়েছে তা সবই মিথ্যা। সেটা তুমি যেমন জান, আমিও জানি।

হোসেন সাহেব আবারো বললেন, সাবেরা তুমি কি বলছো?

সাবেরা বলল, রাখি, কেমন?

হোসেন সাহেব দুঘণ্টার মত চেয়ারে বসে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন। বাসায় ফিরে সাবেরাকে আর দেখলেন না।

উকিলের চিঠি পেলেন তার পরদিন। সাবেরা তার বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছে। চরিত্রহীনতার অভিযোগ এনেছে। কাজের মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের কথা বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এবং এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে বাদী স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের আবেদন করেছে।

এতবড় একটা ঘটনা নিয়ে চিন্তা করার মত সময় হোসেন সাহেব পেলেন না–বাসায় ফিরে শোনেন সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে সাজ্জাদ গড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে আছে। তার নাক দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। বাসায় সাবেরা নেই। কাজের লোক, মালি, এরা ছোটাছুটি করছে–কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। পরবর্তী সাতদিন হোসেন সাহেব প্রচণ্ড ঘোরের মধ্যে কাটালেন। ছেলে অচেতন–ডাক্তার সন্দেহ করছে ব্রেইন হেমারেজ। অপারেশন করার মত সাহসও পাচ্ছে না। ছেলের স্বাস্থ্য খুব খারাপ। অথচ অপারেশন করে মস্তিকে জমে যাওয়া রক্ত পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয় দিনের দিন অপারেশন হল। সাধারণত যে কোন অপারেশনের পর সার্জন বলেন, অপারেশন সাকসেসফুল। সাজ্জাদের বেলায় বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না! আমার যা করার করেছি, কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। পঞ্চম দিনের দিন সে চোখ মেলে তাকালো। তারপরের দিন বলল–আন্মু কোথায়?

সাবেরা ছিল না। ছেলের এমন ভয়াবহ সমস্যার কথা তার না জানার কথা না। জেনেও সে আসেনি বা যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। হোসেন সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সাবেরার উকিল। মোটাসোটা একজন মানুষ। ভালমানুষ টাইপ চেহারা। হাসিখুশি স্বভাব। উকিল সাহেবের বক্তব্য হচ্ছে–মামলা কোটে উঠলে নানান সমস্যা হবে। মান সম্মানের প্রশ্ন। মান সম্মান অনেক বড় ব্যাপার।

হোসেন সাহেব বললেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সবই মিথ্যা–কাজেই মানসম্পমানের প্রশ্ন আসছে না।

অভিযোগ মিথ্যা সেটা আপনি জানেন, আপনার স্ত্রী জানেন। কোিট তো জানে না। কোট বিচার করবে। সাক্ষ্য-প্রমাণ।

কি সাক্ষ্য-প্রমাণ?

যে কাজের মেয়েটির সঙ্গে আপনার অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং যে সম্পর্কের কারণে সে গৰ্ভবতী হয়ে পড়ে সেই মেয়ে সাক্ষ্য দিবে। যে ক্লিনিকে গর্ভপাত করানো হয়েছে–সেই ক্লনিকের ডাক্তার সাক্ষ্য দেবে। টাকা পয়সা খরচ করলেই আজকাল সাক্ষী পাওয়া যায়। কি করবেন বলুন–সময় বদলে গেছে। এই জন্যেই বলছি মিউঁচুয়েল এগ্রিমেন্টে চলে আসুন। দুজন এক সঙ্গে গিয়ে কাগজপত্রে সই করে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলুন।

আমি সাবেরার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান না। উনি কিছুই চান না, চাইলন্ড কাস্টডিও চান না। উনার নামে যে বাড়িটা আছে তাও চান না। উনি শুধু চান সম্পমানজনক নিষ্পত্তি।

হোসেন সাহেব দীর্ঘ সময় ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন–আচ্ছা, ঠিক আছে।

উকিল সাহেব পকেট থেকে কাগজের তাড়া বের করে বললেন–স্যার, আপনাকে কোথাও যেতেও হবে না। এইখানে সই করলেও হবে।

হোসেন সাহেব সই করলেন। উকিল সাহেব বললেন, পড়ে দেখবেন না? পড়ে দেখুন–টার্মস এন্ড কন্ডিশনস।

না, পড়তে হবে না।

সাবেরার সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ নেই। তিনি জানেন সে ঢাকা শহরেই আছে। কোথায় আছে সেই ঠিকানাও তিনি জানেন। টেলিফোন নাম্বার জানেন। মাঝে মাঝে খুব গোপনে সেই নামারে টেলিফোন করেন। বেশির ভাগ সময় শ্লেষ্মা মিশানো বয়স্ক এক ভদ্রলোকের গলা শোনা যায়–হ্যালো, কে?

তিনি খট করে টেলিফোন নামিয়ে দেন। হঠাৎ হঠাৎ এক-আধাদিন সাবেরা টেলিফোন করে। অতি চেনা গলায় বলে, হ্যালো।

তাঁর খুব বলতে ইচ্ছে করে–কেমন আছ সাবেরা? বলা হয় না। মানুষ তার সবচে জরুরী কথাগুলিই আসলে কখনো বলতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *