অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলে আজ শিক্ষকদের বেতন হচ্ছে। তাও ভাঙ্গা বেতন না। পুরো বেতন। পুরো ব্যাপারটা শিক্ষকদের কাছে অপ্রত্যাশিত। বেতন হবে, এই সম্পর্কে হেড স্যার আগে কিছু বলেন নি। কোন আদায় পত্রও হয়নি। টাকাটা পাওয়া গেল কোথায়? কেউ এ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করছে না। বেতন হচ্ছে এটাই বড় কথা। কোত্থেকে হচ্ছে, কি ভাবে হচ্ছে সেটা বড় কথা না। জানতে না চাওয়াই ভাল। শিক্ষকরা হেড সারের ঘরে ঢুকছেন, রেভিনিত্যু ষ্ট্যাম্পে সই করে বেতন নিচ্ছেন।
মাহবুব সাহেব বেতন নিতে এলেন শেষে। এসিসট্যান্ট হেড মাস্টার হিসেবে ভার একটা দায়িত্ব আছে। ফান্ড কোথায় পাওয়া গেল তার জানা দরকার। তিনি শুকনো মুখে বললেন, টাকাটা কোত্থেকে দেয়া হচ্ছে?
ইমার্জেন্সি ফান্ড থেকে দিচ্ছি।
স্কুল কমিটির অনুমতি ছাড়াতো স্যার আপনি ইমার্জেন্সি ফান্ড ভাঙতে পারেন না।
অনুমতি পরে নিয়ে নিব। শিক্ষকরা অনেকদিন থেকে কষ্ট করছেন। তিন মাস বেতন হচ্ছে না। তাদের ইমার্জেন্সিওতো ইমার্জেন্সি।
আমাদের তো স্যার আইন কানুন মানতে হবে।
ইমার্জেন্সির সময় কোন আইন কানুন থাকে না। সাধারণ সময়ের সাধারণ আইন। জরুরী সময়ের জরুরী আইন। মাহবুব সাহেব টাকা গুনে Fani
কাজটা স্যার ভুল করলেন।
মানুষ হয়ে জন্মেছি ভুল করব না তাতো হয় না। দশবার শুদ্ধ করব, একবার ভুল করব তবেই না আমি মানুষ। আজ আমি একটা মিটিং দিয়েছি মাহবুব সাহেব।
কিসের মিটিং?
স্কুল বিষয়ে আপনাদের সবার সঙ্গে কিছু কথা বলব। মুক্ত আলোচনা। আপনারও যদি বলার কিছু থাকে আপনিও বলবেন।
মিটিং হবে কখন?
পাঁচটার সময়।
চারটার দিকে করতে পারেন না? আমার পাঁচটার সময় এক জায়গায় যাবার কথা।
স্কুল পিরিয়ডে ছাত্রদের ক্ষতি করে তো আর মিটিং করতে পারি না। আপনার খুব জরুরী কোন কাজ থাকলে কাজে যাবেন। খুব জরুরী কিছু না থাকলে থাকুন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলব।
দেখি।
মাহবুব সাহেবের কাজটা তেমন জরুরী না। আজ নিমখালি বাজারে হাট বার। হাটে গরু-ছাগল উঠে। ছেলের আকীকার জন্যে একটা গরু কেনার কথা। ফজলুল করিম সাহেবের মিটিংয়ের চেয়ে ছেলের আকীকা অনেক জরুরী। দুদিন পর পর ছেলে অসুখে ভুগছে। শরীর হয়েছে পাট কাঠির মত। আকীকা করা থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। তাছাড়া হেড মাস্টার সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় আসলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকবে না। স্কুল স্কুল বলে চেঁচিয়ে তো কিছু হবে না। তারপরেও মাহবুব সাহেব মিটিং এ থেকে যাওয়াই ঠিক করলেন। আরেক বুধবার পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। উপায় কি?
দপ্তরী হরিপদ বড় একটা ধামায় পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে মুড়ি মাখছে। কেতলীতে করে চা এসেছে। মুড়ি খাওয়ার পর চা দেয়া হবে। মুড়ি এবং চা দুটার টাকাই হেড মাস্টার সাহেব দিয়েছেন।
খবরের কাগজ বিছিয়ে মুড়ি টেলে দেয়া হয়েছে। মুড়ি চিবানোর কচাকচ শব্দের ভেতর ফজলুল করিম সাহেব ঢুকলেন। শিক্ষকরা উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করলেন তবে কেউ পুরোপুরি উঠলেন না।
ফজলুল করিম সাহেব হাসি মুখে বললেন, মুড়ি খাওয়ার কচ কচ শব্দ একটু কমুক তারপর কথা বলি।
মাহবুব সাহেব বললেন, যা বলার এর মধ্যেই বলুন। কথা শুনতেতো অসুবিধা হচ্ছে না। সবারই তাড়া আছে।
করিম সাহেবের জন্যে পিরিচে করে মুড়ি এবং একটা চামুচ এসেছে। তিনি মুড়ির দিকে তাকালেন মুড়ি মুখে নিলেন না।
নীচু গলায় কথা বলা শুরু করলেন। একটা দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। নতুন করে বলার কিছু না সবাই তো জানেন। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে দুঃসময়টা সাময়িক।
মাহবুব সাহেব বললেন, দুঃসময় সাময়িক মনে হবার কারণ কি?
তেমন কোন কারণ অবশ্যি দেখছি না, তবু মনের ভেতর থেকে কে যেন বলছে দুঃসময় থাকবে না।
নতুন সায়েন্স টিচার হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, উইথফুল থিংকিং নাতো স্যার!
হতে পারে, উইথফুল থিংকিং হতে পারে। দেখি এক কাপ চা খাওয়া যাক।
হরিপদ চায়ের কাপ এনে সামনে রাখল। করিম সাহেব মামুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছে আপনার কাছে কি আছে?
মামুন সিগারেট বের করে দিল। করিম সাহেব সিগারেট টান দিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামিয়ে সহজ গলায় বললেন, মামুন সাহেব আমি যা বলছি তা ঠিক উইথফুল থিংকিংও না। কিছু যুক্তি আছে। এত দিনের পুরনো একটা স্কুলতো জলে ভেসে যেতে পারে না।
এটাতো স্যার কোন যুক্তি হল না।
তা অবশ্যি হল না।
মাহবুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, এটা বলার জন্যেই কি মিটিং ডেকেছেন?
না, আসল কথা বলা হয়নি আসল কথা হচ্ছে–এস, এস, সি পরীক্ষার আর আছে মাত্র তিন মাস। এই তিনমাস আমাদের প্রাণপন খাটতে হবে। এবারে তিনজন খুব ভাল ছেলে আছে। এর মধ্যে একজন তো অসম্ভব। ভাল–বদরুল আলম। এদের ঠিক ঠাক মত কোচিং করতে হবে। অসাধারণ একটা রেজাল্ট ওদের দিয়ে করাতে হবে। স্কুলের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ এসেছে। সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এদের কোচিং এর বিষয়ে আপনাদের কোন মতামত আছে?
কেউ কোন জবাব দিল না। কোচিং এর বিষয়ে নতুন তো কিছু বলার নেই। আগে যেমন হয়েছে এবারও তেমন হবে।
করিম সাহেব বললেন, আমি চিন্তা করছি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এই ছেলেদের মনিটার করলে কেমন হয়। ইরতাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। আপনাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। আমি যা ভাবছি তা হচ্ছে না…
পরীক্ষার্থী যারা সবাই একসঙ্গে থাকবে। একসঙ্গে পড়বে। এতে একটা টিম স্পিরিট তৈরী হবে। দায়িত্ব শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। যেমন ভোর ছটা থেকে দুপুর বারটা পর্যন্ত একজন শিক্ষক। দুপুর বারটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত একজন এ রকম। প্রতিট বিষয়ের জন্যে আলাদা আলাদা ক্লাস হবে। আইডিয়াটা আপনাদের কাছে কেমন লাগছে।
এবারো কোন জবাব পাওয়া গেল না। করিম সাহেব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এটা যে পুরোপুরি আমার মৌলিক আইডিয়া তাও না। তিব্বতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এইভাবে বড় বড় পরীক্ষার জন্যে তৈরী করা হয়।
মাহবুব সাহেব বললেন, এটাতো স্যার তিব্বত না।
আমি জানি এটা তিব্বত না। আমার কথা হল, তিব্বত যদি এই নিয়মে কাজ করে আমাদের দেশেও করবে। একটা বড় কিছুর জন্যে সবাইকে এক সঙ্গে তৈরী করা। একটা টিম স্পিরিট সবার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। যদি আমাদের এই গ্রামের দরিদ্র স্কুল অসাধারণ একটা রেজাল্ট করে তার ফল হবে সুদূর প্রসারী। স্কুল তখন টিকে যাবে। দূর দূর থেকে ছাত্ররা আমাদের এই স্কুলে পড়তে আসবে। সরকারী সাহায্য আসবে। দানশীল মানুষেরা এগিয়ে আসবেন।
মাহবুব সাহেব বললেন, আপনার কথা শুনতে ভাল লাগছে। কিন্তু যে আইডিয়া শুনতে যত ভাল সেই আইডিয়ার মূল্য ততকম। তিনমাস পড়িয়ে ছেলেদের ফার্স্ট সেকেন্ড বানাবেন তা হয় না।
হবে না এটা আগে থেকে ধরে নেয়াটা কি ঠিক? চেষ্টাতো করা যেতে পারে।
এতগুলি ছেলে একসঙ্গে থাকবে কোথায় থাকবে। এরা খাবে কি?
এইগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্যেইতো মিটিং। আপনারা বলুন কি ভাবে করা যায়?
চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ হচ্ছে না। মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাড়াতে বললেন, স্যার আমি তাহলে উঠি?
উঠবেন? কিছু বলবেন কি?
এখনি বলতে হবে? পরে বলি?
করিম সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা বলুন পরেই বলুন।