০৮৫. কৃষ্ণের জন্ম

৮৫.

কৃষ্ণের জন্ম নিয়ে বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ঝগড়া আছে। এমনকি সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসও আছে নানা রকম। সবচেয়ে বড় কথা হল–আমাদের চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণব-সজ্জনেরা কৃষ্ণকে আদপেই বসুদেব-দেবকীর ছেলে বলে মনে করেন না। তাদের কাছে কৃষ্ণ জন্ম থেকেই যশোদা-দুলাল, নদ-নন্দন। এ বিষয়ে দার্শনিকদের কচকচিতে যাবার আগে কৃষ্ণের সত্য স্বরূপটি কী এবং তাঁর লীলার উদ্দেশ্যটা কী সেটা বলে নেওয়া ভাল। দার্শনিক-কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ পদ্যময়ী ভাষায় কৃষ্ণের স্বরূপ যেমনটি বর্ণনা করেছেন, তা হল

কৃষ্ণের যতেক খেলা সর্বোত্তম নরলীলা
নরবপু তাহার স্বরূপ।
 গোপবেশ বেণুকর নবকিশোর নটবর
নরলীলার হয় অনুরূপ।

চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবদের মতে কৃষ্ণলীলার বিশেষত্বই হল এই যে, তিনি স্বয়ং ভগবান হওয়া সত্ত্বেও তার সমস্ত ক্রিয়া–কর্মগুলিই মানুষের মতো এবং জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই তিনি এই মনুষ্যত্ব অতিক্রম করেননি। তার অবতার গ্রহণের মুখ্য উদ্দেশ্যও অসুর-রাক্ষস বধ করা নয়, যেমনটি অন্যান্য অবতারের হয়েছে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন–পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতা–এই সাধারণ বাক্যটি নাকি কৃষ্ণের ক্ষেত্রে খাটেই না। তাঁর লীলার প্রধান উদ্দেশ্য গোপীপ্রেম আস্বাদন করা এবং কংসবধ ইত্যাদি দুরূহ কর্ম সাধারণ্যে যতই চমৎকারী হোক না কেন এগুলি তার কাছে গৌণ কর্ম। আর এই অসুর–মারণাদি ক্র–কর্মও তিনি নিজে করেন না। এগুলি করেন তার অন্তঃশায়ী ঈশ্বর-স্বরূপ, যিনি অবতার গ্রহণের সময়েই কৃষ্ণের সঙ্গে এসে মেলেন।

লক্ষ্য করে দেখবেন–চৈতন্যপার্ষদ রূপ গোস্বামী তার তিনখানি বড়-সড় নাটকের মধ্যে কোথাও কৃষ্ণকে বসুদেব-দেবকীর ছেলে বলে একবারও উল্লেখ করেননি এবং রূপের তত্ত্বজ্ঞ ভাইপোটি, যাকে আমরা ধুরন্ধর দার্শনিক জীব গোস্বামী নামে চিনি, তিনি তো হরিবংশের প্রমাণ দিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, জন্মকালেই কৃষ্ণ দ্বিভুজ, যশোদাদুলাল, সম্পূর্ণ মানুষ। ঈশ্বরত্বের কোনও স্পষ্ট চিহ্ন তাঁর শরীরে এবং কাজে আপাতদৃষ্টে পাওয়া যাবে না। পরবর্তীকালে এই ব্রজশিশুটির হাতে একটি মুরলী পাওয়া যাবে, কোমরে গোরু চরানোর পাঁচনী পাওয়া যাবে, আর তার মাথার বাঁদিক ঘেঁষে হেলানো থাকবে একটি ময়ূরের পুচ্ছ।

আমরা জানি, এই রকম একটি কৃষ্ণ-মূর্তির জন্য চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবদের ভাবাবেশ কতখানি! স্বয়ং মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের লেখক গুণরাজ খানের (মালাধর বসু) সম্বন্ধে কী বলেছিলেন মনে আছে তো? বলেছিলেন–এই গ্রন্থের মধ্যে শুধু একটিমাত্র পংক্তি আছে বলে তিনি কবির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারেন এবং সেই পংক্তিটি হল–নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ। অতএব নন্দ-নন্দন কৃষ্ণই চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবদের কাছে পরম ঈশ্বরের মূল স্বরূপ।

আসলে এই বিশ্বাসের পিছনে দুটি শক্ত কথা আছে। এই কথা দুটি হল ঐশ্বর্য আর মাধুর্য। ঐশ্বর্য হল ঈশ্বরের ভাব। ভক্তের হৃদয়ে যদি সর্বদা ভগবানের ঈশ্বরভাব জাগরিত থাকে, তবে তিনি ভগবানকে কখনই খুব একটা প্রিয় ভাবতে পারেন না। সব সময়েই মনে হবে–ইনি তো আমার প্রভু, ইনি যা ইচ্ছে তাই তো করতে পারেন। এই প্রভুত্বের নিরিখেই ভক্তের হৃদয়ে ভয়-ভীতি-সন্ত্রস্ততা কাজ করতে থাকে। বৈষ্ণব দার্শনিকেরা বলেন–বসুদেবের মনে কৃষ্ণের সম্বন্ধে এই ঐশ্বর্য-জ্ঞান ছিল টনটনে। এর ফলে নিজপুত্র কৃষ্ণ-বলরামকেও তিনি পুত্র বলতে ভয় পান। তিনি বলেন–তোমরা আমার ছেলে মোটেই নও, বাবা! তোমরা হলে পরম পুরুষ ঈশ্বর–যুবাং ন নঃ সুতৌ সাক্ষাৎ/প্রধানপুরুষেশ্বরী।

ভাগবত পুরাণে দেবতারা দেবকীর গর্ভস্তুতি করেছেন এবং কৃষ্ণের জন্মকালে তার চতুর্ভুজ নারায়ণ-মূর্তিকে বসুদেব এবং দেবকী দুজনেই স্তব করেছেন। ভাসের বালচরিত নাটকেও বসুদেব কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধে ভীষণ সচেতন। জন্মমাত্রেই দেবকীর কোলে শিশুটিকে দেখে তিনি স্বগতোক্তি করেছিলেন–আমার ছেলে বলে এই শিশুর একটি উপাধি জুটেছে বটে, তবে এই শিশুটি হল আসলে কংসরাজার যম–সুত ইতি কৃতসংজ্ঞং কংসমৃত্যুং বহষ্ঠী। এর পরে বসুদেব যখন শিশু-কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে বৃন্দাবনে এলেন, তখন নানাবিধ অলৌকিক চমৎকার দেখে তিনি নন্দগোপকেও অনুরোধ করেছেন–আরে এই বাচ্চাটাকে নমস্কার করো–বাল এব নমস্যতাম্।

 নিজ পুত্রের ভগবা অথবা ঈশ্বরের ঈশ্বরত্বের এই জাগ্রত বোধ নিয়ে মাথুর বসুদেব যেখানে সদাই আপ্লুত হয়ে আছেন, সেখানে তাঁর বিপরীত কোটিতে দাঁড়িয়ে আছেন বৃন্দাবনের নন্দগোপ। এমনকি মহামতি চৈতন্য যখন জন্মের সম্ভাবনাতেও দাঁড়িয়ে নেই, সেই তখনই আমরা নদপোপর হৃদয়ে মাধুর্যের সত্তা দেখতে পাচ্ছি। নন্দগোপ শিশু-কৃষ্ণের ভগবত্ত বা ঐশ্বর্যে বিশ্বাস করেন না। তিনি গ্রাম সরল মানুষ, কৃষ্ণের ভগবত্তা সম্বন্ধে তাঁকে হাজার বোঝালেও তিনি বোঝেন না, এক ঐশ্বরিক বিভূতি দেখালেও তিনি হেঁ–হেঁ–আক্তে–তা–বটে–তা–বটে বলে এড়িয়ে যান!

এই তো বালচরিত নাটকে বসুদেব তাঁর পূত্রকে যেই নন্দের কোলে দিলেন, তখন শিশুটিকে তার বেশ ভারী লাগল এবং তার পরেই দেখা গেল–ভগবান বিষ্ণুর দিব্য অস্ত্র-সম্ভার–শঙ্খ, চক্র, কৌমোদকী গদা, শার্গ-ধন এবং তাঁর দিব্য বাহন গরুড়–সকলে এসে শিশু-কৃষ্ণের স্তব করছে। এসব দেখেই মাথুর বসুদেব নন্দগোপকে বালকের উদ্দেশে নমস্কার জানাতে বললেন। কিন্তু নন্দগোপ মোটেই ভগবত্তার ধারে-কাছে গেলেন না। তিনি হেঁ-হেঁ করে বললেন–তা তো বটেই, তা তো বটেই, তোমার ঘরের রাজপুত্র বলে কথা, নমস্কার তো করতেই হবে। তা নমস্কার তোমায় রাজপুত্তুর। আমাদের ঘরে বাপু তোমার নিজেকে নিজেই চালিয়ে নিতে হবে। আমরা মুখ-সুখ গোয়ালা মানুষ, তোমাকে মানুষ করার ক্ষমতা কি আমাদের আছে–হী, ভবতু! আত্মনৈবাত্মানং নির্বাহয়। অস্মাকং গোপজনস্য ত্বং গ্রহীতুং কো বল-পরাক্রমঃ।

অর্থাৎ মথুরাবাসী রাজবাড়ির ছেলে বসুদেবের পুত্রকে তিনি বড়জোর রাজপুত্র বলে যৎসামান্য সম্মান জানাতে পারেন। এবং তাও হয়ত বসুদেবের সামনে। এমনিতে তিনি তাও ভাবেন না। ভগবান-টগবান তো নয়ই, বরঞ্চ বসুদেবের আড়ালে কীভাবে তিনি এই ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে মানুষ করবেন, তারও একটা চিত্র তিনি দিয়েছেন এবং আমরা তা পূর্বে উল্লেখ করেছি।

বস্তুত বৃন্দাবন হল সেই জায়গা যেখানে কৃষ্ণের ঐশ্বরিক ক্ষমতার কোনও মূল্য নেই। ঈশ্বরের ক্ষমতা কী? না, তিনি ইচ্ছামাত্রেই কার্য সম্পাদন করতে পারেন, যেটা করার কথা বা আপনিই হওয়ার কথা, সেটা তিনি না করতেও পারেন এবং যেটা যেভাবে হওয়ার কথা সেটা তিনি অন্যরকমও করতে পারেন–ক অকর্তুম্ অন্যথা কর্তৃঞ্চ সমর্থঃ। কিন্তু এই বৃন্দাবন এমন জায়গা, যেখানে তার স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। এখানে মা খেতে না দিলে খাওয়া নেই, অথবা চুরি করে খাও। এখানে তার একটু বয়স হলেই রূপ গোস্বামী তার নাটুকে ভাষায় মা যশোমতীকে দিয়ে বলবেন–আচ্ছা কানাই? তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি জীবনে হবে না। দেখছিস তোর বাবা বুড়ো হচ্ছেন, বাড়িতে এতগুলো গোরু। এগুলিকে চরানো, দুধ দোয়া–কত কাজ? সবই কি এখনও তোর বাবা করবেন, আর তুই খেলে খেলে বেড়াবি?

অতএব কৃষ্ণকে গোষ্ঠে যেতে হয়, গোরু দুইতে হয়–এসব তার কাজ। কিন্তু এই কাজ তিনি ভালবেসে করার জন্যই পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন। যশোমতীকে মা বলে ডাকবার জন্য, নন্দবাবাকে বাবা বলে ডাকবার জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের এই স্বেচ্ছাকৃত লঘুতা। বৈষ্ণবরা তাই বলেন। তারা বলেন–পরম শক্তিমত্তা কখনও কাউকে সুখ দেয় না। শক্তিমানকে লোকে ভয় পায়। অতএব ভয় নয়, মা-বাবার স্নেহ, বন্ধুদের সৌহার্দ এবং কিশোরীর প্রেম এত সব মধুর সম্বন্ধ কেমন লাগে–সেটা নিজে পরখ করার জন্যই তার কৃষ্ণ-লীলা–বিহার এবং এই লীলা আস্বাদনের সবচেয়ে আদর্শ জায়গা হল বৃন্দাবন।

চৈতন্যপন্থী দার্শনিক জীব গোস্বামী তাই বিশ্বাসই করেন না যে, কৃষ্ণ বসুদেব-দেবকীর ছেলে। কারণ বসুদেব-দেবকীর প্রসঙ্গ মানেই ঈশ্বরত্বের বোধ আর কৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলায় এই ঐশ্বর্যের স্থান নেই। জীব গোস্বামী তার গোপালচ গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, কৃষ্ণ আসলে নন্দ যশোমতীর ছেলে। হরিবংশে যে জায়গার কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি–অর্থাৎ যেখানে ভগবান বিষ্ণু এবং তন্নিষ্ঠা যোগমায়া একই সঙ্গে দেবকী এবং যশোদার গর্ভে জন্ম নিলেন বলে বলা হয়েছে, সেখানে টীকাকার নীলকণ্ঠ টিপ্পনী দিয়েছেন–অর্ধরাত্রে অভিজিৎ নক্ষত্র যখন বিমূর্ত হয়েছে তখন নবমী তিথিতে ভগবতী যোগমায়া জন্মালেন এবং অষ্টমী তিথিতে জন্মালেন দ্বিভুজ কৃষ্ণ। দেবকী-বসুদেবের ঘরে সেই মুহূর্তেই শখ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভুজ নারায়ণ আবির্ভূত হয়েছেন এবং তিনি তাদের জানিয়েছেন–আমি তোমার ঘরে জন্ম নেব। ভাগবত পুরাণেও তাই আছে।

আমরা জানি–দেবকী-বসুদেব ভগবান বিষ্ণুর স্তুতি করে তাঁকে তাঁর অলৌকিক রূপ সম্বরণ করতে বলেছেন। চৈতন্যপন্থী জীব গোস্বামীর ধারণা–এই অলৌকিক রূপ সম্বৃত হবার মুহূর্তেই অঘটনঘটনপটীয়সী যোগমায়া যশোদার ঘরে জন্ম-নেওয়া দ্বিভুজ কৃষ্ণকে প্রতিস্থাপন করেন দেবকীর কোলে। তারপর যেমন যা ঘটবার তাই ঘটেছে–অর্থাৎ বসুদেব কংসের কারাগার থেকে ছেলে নিয়ে বৃন্দাবনে এসেছেন এবং যশোদার মেয়েটিকে নিয়ে গেছেন নিজের ঘরে। আরও লক্ষণীয় হল কৃষ্ণ শব্দটি। ভেবে দেখুন–দেবকীর সপ্তম গর্ভ আকর্ষণ করে রোহিণীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করার জন্য কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরামের এক নাম সঙ্কর্ষণ। কিন্তু যে কৃ ধাতু (কর্ষণ, বা আকর্ষণ করা) থেকে সন্ধর্ষণ (সম্–কৃ+অনট) শব্দের উৎপত্তি, কৃষ্ণ শব্দের মধ্যেও কিন্তু সেই কৃ ধাতুই আছে। কাজেই যোগমায়া যেমন সঙ্কর্ষর্ণকে রোহিণীর গর্ভে আকর্ষণ করেছেন। তেমনই তিনি যশোদাকে মূৰ্ছিত রেখে তাঁরই পুত্রটিকে আকর্ষণ করে দেবকীর কোলে দিয়েছেন। অতএব মূলে তিনি নন্দ-যশোদার ছেলে–দ্বিভুজ মনুষ্যরূপ।

যাই হোক, এসব ইল সাম্প্রদায়িক কচকচি। কিন্তু কচকচির মধ্যে এমন একটা আধুনিকতা আছে যে, সেই আধুনিকতার কারণেই আমরা এই সাম্প্রদায়িক কথাগুলি উল্লেখ করলাম। আধুনিকতাটার কথা বলি এবার এবং জনান্তিকেই বলি। আমাদের দেশের এবং ওদেশের অনেক বাঘা-বাঘা পণ্ডিতেরা মনে করেন কি, যে, কৃষ্ণ মোটেই একটা নয়। বৃন্দাবনের কৃষ্ণ এক মানুষ আর মথুরা-দ্বারকাবাসী কৃষ্ণ আরেক মানুষ। মহাভারতের মধ্যে কৃষ্ণকে যেমন এক প্রখর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমরা পেয়েছি–যার বুদ্ধি ক্ষুরধার, যথেষ্ট কুটিল এবং যথেষ্টই শক্তিমান–সেই কৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনের ননী-খাওয়া অথবা কিশোরীদের প্রেমে লুটোপুটি খাওয়া কৃষ্ণকে পণ্ডিতরা কিছুতেই মেলাতে পারেন না। বিশেষ করে দুই কৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের মধ্যেই তারা সামঞ্জস্য খুঁজে পান না।

আমার মতে, নিতান্ত ব্যক্তিগতভাবেই আমার মতে–এগুলি পণ্ডিত মহোদয়দের বুদ্ধি-ব্যায়াম ছাড়া আর কিছু নয়। গবেষণা বস্তুটা সত্যই বড় মহান জিনিস, তবে গবেষণা করতে গিয়ে পূর্বাহ্নেই যদি কোনও সিদ্ধান্ত মনের মধ্যে আসন পেতে নেয়, তবে অতি বড় মহান গবেষকেরও বুদ্ধিভ্রংশ হয়। মহাভারতে কৃষ্ণাকে যখন থেকে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ যুবক। মহাভারতে পাঞ্চালী দ্রৌপদীর বিবাহ-সভায় প্রথম তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে এবং তখন তার নিজের বিয়ে-থা হয়ে গেছে অথবা শিগগিরই হবে, এই রকম একটা অবস্থা। মহাভারতে যে মানুষটাকে একটি পক যুবক এবং পরিণত ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রবেশ করতে দেখছি, সেই মানুষটার কোনও বিচিত্র-ক্রীড়ামোদিত বাল্যকাল থাকবে না, পণ্ডিতজনেরা এটা ভাবলেন কী করে?

 আসলে গবেষক-পণ্ডিতেরা বড় কঠিন-হৃদয় ব্যক্তি। অনেক সহজ জিনিসও তারা কুটিল ব্যবহারজীবীর মতো কঠিন করে নিতে পারেন। কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। মহাভারতে যেখানে ভীম-অর্জুন সবার বাল্যকাল এবং শিক্ষাকাল বর্ণিত আছে, সেখানে কৃষ্ণের বাল্যকাল সম্বন্ধে কোনও কথা নেই বলে কি মানুষটা সোজাসুজি যৌবনে পদার্পণ করলেন? ওঁরা বলবেন–নিশ্চয়ই বাল্যকাল ছিল, তবে সেই বাল্যকালের চরিত্র মহাভারতীয় কৃষ্ণ-চরিত্রের সঙ্গে মেলে না।

 এও এক জ্বালা। একজনের ছেলেবেলা এবং প্রথম যৌবন-সন্ধির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিণত যৌবনের দৃঢ়তার কি মিল থাকে সব সময়? অর্থাৎ আমিই যদি যৌবনের অনুকূল লগ্নে বহুতর রমণীর মন পেয়ে থাকি তবে সেই মানুষটি কি যৌবনের মধ্যলগ্নেও একেবারে একই রকম থাকবেন? তা ছাড়া বয়ঃসন্ধি এবং বয়ঃসন্ধির পরিণতির মধ্যে এতটাই পার্থক্য থাকে কখনও, যে সেই মানুষটাকে একেবারে বিপরীত বলেও মনে হতে পারে। অল্পবয়সে যিনি ভীষণ ভীষণ রোম্যান্টিক ছিলেন, তিনিই ভবিষ্যতে প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন–এরকম উদাহরণ আমিই অনেক দেখেছি। কাজেই কৃষ্ণকে সাধারণ বুদ্ধিতেই এমন একটি উদাহরণ ভাবা যেতে পারে।

 আরও একটি যুক্তিও তো আছে। এই ধরুন, আপনি আগে গ্রামে ছিলেন, গ্রামেই মানুষ হয়েছেন এবং স্বাভাবিক কারণে একটু গ্রাম্যও ছিলেন। কিন্তু যৌবনের আরম্ভে আপনি শহরে পড়তে এলেন, পড়া শেষ করলেন, চাকরি আরম্ভ করলেন। এখন আপনি দারুণ স্মার্ট যথেষ্ট উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন, ঝকঝকে এক শহুরে ব্যক্তিত্ব। কাজেই বৃন্দাবনের গ্রাম থেকে যে মানুষ মথুরায় এলেন এবং মথুরার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন, সেই মানুষ এক, আর বৃন্দাবনের কৃষ্ণ আরেক–এরকম যুক্তি অন্তত সাধারণ বুদ্ধিতে আসে না। কিন্তু গবেষককে তো গবেষণা অথবা গো-এষণা করতেই হবে। অতএব তিনি বহু সাধনা করা বহু যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন–কৃষ্ণ মোটেই একজন নন, কৃষ্ণ অনেক। এই গবেষকদের ফাঁদে আমাদের বঙ্কিমবাবুও পড়েছেন–সেই যা দুঃখ।

কৃষ্ণের কথা বলতে গেলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এখানে এসে পড়বে। সেটা হল অবতার-তত্ত্ব। কৃষ্ণকে আমরা যেমন মানুষ ভাবি, আবার তেমনই অবতারও ভাবি। আমাদের ভারতবর্ষে অন্তত দশজন অবতার-পুরুষ আছেন–মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন ইত্যাদি, কিন্তু তার মধ্যে আমাদের কৃষ্ণ ঠাকুরের নামই নেই। গীতগোবিন্দে দশাবতারের লিস্টি আছে, সেখানেও কৃষ্ণের নাম নেই। কিন্তু জয়দেব কবি বাংলার মানুষ। তিনি ভারি মিষ্টি করে বলেছেন–কৃষ্ণ মোটেই এত সাধারণ নন যে, দশজনের ভিড়ে তাকে জায়গা করে নিতে হবে। তিনি সাধারণ অবতার মাত্র নন, তিনি অবতারী-কেশবধৃত-দশবিধরূপ, জয় জগদীশ হরে। চৈতন্যপন্থী দার্শনিকেরাও তাই বলেন। তারা বলেন–সমস্ত অবতারের মূল নিদান হলেন কৃষ্ণ! রূপ গোস্বামীর ভাষায়-অবতার-লীলা-বীজ।

লক্ষণীয় বিষয় হল–অন্যান্য অবতারের ক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে–ভূভারহরণ, জগদুদ্ধার। পরবর্তী পণ্ডিতেরা অবতারের গতি-প্রকৃতি চিন্তা করে বলেছেনএই ভূভারহরণ টরনের মতো ব্যাপার ওই প্রথম কয়েকটি অবতারের ক্ষেত্রেই খাটে। অর্থাৎ মৎস্য-কুর্ম-বরাহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে। পণ্ডিতেরা অবশ্য এই তিন অবতারের মাধ্যমে জগৎ–সৃষ্টির একটা পরম্পরাও বার করে ফেলেছেন। প্রথমে মাছ, তারপর উভচর কূর্ম এবং তারপর প্রাণী-বরাহ। নৃসিংহ অবতারের মধ্যে প্রাণী এবং মনুষ্যের এক অদ্ভুত সমাহার ঘটিয়ে সৃষ্টির পরম্পরায় এক নতুন সংযোজন ঘটিয়েছেন। কারণ মনুষ্যরূপী অবতারগুলির শেষ পদক্ষেপ হল নৃসিংহ অবতার। তারপরেই সেই বেঁটেখাটো মানুষটি, যার মধ্যে চরম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটল। তিনি বলিকে ছলনা করে সাধুজনের প্রতি করুণা প্রকাশ করলেন।

একজন ফরাসি পণ্ডিত নানা গবেষণা করে জানিয়েছেন যে, দশ অবতারে প্রথম তিনটিতেই ভূভারহরণের মতো মোটা দাগের একটা উদ্দেশ্য আছে বটে, কিন্তু পরম ঈশ্বর যখন থেকে এই মনুষ্যজগতের নানান সুখ-দুঃখে অংশীদার হতে আরম্ভ করলেন, তার প্রথম কল্পারম্ভ নৃসিংহ অবতার থেকে।

.

৮৬.

অবতারবাদের দিক দিয়ে দেখতে গেলে নৃসিংহ-বামন ইত্যাদি অবতারে ঈশ্বরের জগদ্ধার প্রবৃত্তির সঙ্গে করুণা মিশে থাকায় ভক্ত-জনের ভক্তির পথও প্রশস্ত হয়েছে কিন্তু ঈশ্বর যখন সম্পূর্ণ সলীল হয়ে জীবন এবং জগতের স্নেহ-মায়া-মমতায় অংশ নিলেন, তখন ভক্তের ভক্তি রসে পরিণত হল। ঈশ্বর এবং ভক্তের সরসতার প্রথম মাধ্যম যিনি, তিনি হলেন রামচন্দ্র। পারিন্দার সাহেব রাম সম্বন্ধে গবেষণা করতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন–In the story of Rama, the youth, marriage, renunciation, sufferings and triuamph all make up a human picture, the details of which are cherished by millions.

পারিন্দার সাহেবের রাম-লীলায় খুব মুগ্ধতা আছে বুঝি, কিন্তু কৃষ্ণ-জীবনের অসামান্য বৈচিত্র্য এবং জটিলতা সম্বন্ধে তার ধারণা এত দৃঢ় হয়নি বলেই তিনি হঠকারিতা করে লিখে ফেলেছেন যে, মহাভারতের মধ্যে কৃষ্ণের বহুধা বিভিন্ন ক্রিয়াকর্ম লক্ষ্য করা গেলেও তার ভূমিকা নাকি hardly dominating কেমন করে, কী ভেবে এবং কী পড়ে যে, গবেষকরা এমন কথা লেখেন বুঝি না। মহাভারত যিনি ভাল করে পড়েছেন, তিনিই খুব ভাল করে জানেন যে, মহাভারতের সমস্ত বিপন্ন সময়ে তিনি উপস্থিত আছেন; কখনও সামনে কখনও আড়ালে। কৃষ্ণের অসামান্য বুদ্ধি বলেই শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় সম্পন্ন হয়। উপরন্তু যুদ্ধজয়ের পথে পাণ্ডবদের যে অন্যায় এবং দোষ কল্পনা করা হয়েছে তারও দায় বর্তেছে কৃষ্ণেরই ওপর।

এর পরেও কী করে এই মানুষটিকে লঘু করি, হয়তো বা এই অসামান্য মহাভারতীয় চক্রের কারণেই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ অবতারে পরিণত। জগতের পাপ-মুক্তিই শুধু নয়, দুষ্টের দমন মাত্রই শুধু নয় মানুষের জীবন-বৈচিত্র্যে তিনি ভীষণ ভীষণভাবে জড়িত হয়ে গেছেন। মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হিসেবে যেমন তিনি মহাভারতে উপস্থিত, তেমনই সজীবভাবে উপস্থিত তিনি পুরাণগুলিতে। মহাভারতে তার পরিণত যৌবনের সফলতা আর পুরাণগুলিতে তার কৈশোরগন্ধি যৌবনের উচ্ছ্বাস। আমরা তার পরিণতিতে বিশ্বাস করব, আর তার কৃষ্ণ হয়ে ওঠার ক্রমিকতায় বিশ্বাস করব না, এমন তো হতে পারে না।

আমাদের দেশীয় রাজা ভোজবর্মা একটি তাম্রশাসনের মধ্যে কৃষ্ণকে সম্পূর্ণরূপে ধরে রাখার জন্য যে বিশেষণ দুটি প্রয়োগ করেছেন, সত্যি কথা বলতে কি, তার চাইতে ভাল বিশেষণে কৃষ্ণের সম্পূর্ণতা প্রকাশ করা যায় না। ভোজবর্মা বলেছেন–সোপীহ গোপী–শতকেলিকারঃ কৃষ্ণো মহাভারত-সূত্ৰধারঃ। অর্থাৎ সেই কৃষ্ণ, যিনি শত-গোপীর কেলি-কলা-রসজ্ঞ এবং যিনি মহাভারতের সমস্ত ঘটনার সূত্রধার।

শত গোপীর সাহচর্য যিনি উপভোগ করেছেন, তিনি মহাভারতের অন্তরাল–নায়ক হতে পারেন না–এ কথা যেমন ভোজবৰ্মা বিশ্বাস করেন না, তেমনি এ কথা আমরাও বিশ্বাস করি না। আমাদের ধারণা–দুটি, তিনটি বা চার রকমের কৃষ্ণ আছেন–এ রকম একটা সন্দেহ প্রধানত দানা বেঁধেছে ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি পঙক্তি থেকে। ছান্দোগ্য বলেছে–ঘোর নামক অঙ্গিরার পুত্র দেবকীর পুত্র কৃষ্ণকে এই যজ্ঞ-দর্শন উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই দেবকীপুত্র উক্ত উপদেশ শুনে (অন্য বিদ্যা বিষয়ে] নিস্পৃহ হয়েছিলেন–তদ্ধৈতদূঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্রায় উক্ত্বা চ অপিপাস এব স বভূব।

মনে রাখা দরকার, কৃষ্ণ দেবকীপুত্রের সম্বন্ধে এই ছান্দোগ্যের উক্তিই হল প্রাচীনতম উল্লেখ এবং উল্লেখই সমস্ত পণ্ডিতদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। কী সন্দেহ? প্রথম সন্দেহ–কৃষ্ণকে এখানে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরাণগুলিতে যেহেতু কৃষ্ণকে সান্দীপনি মুনির শিষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং যাদবদের কুলগুরুর নাম যেহেতু গর্গ, তাহলে তো ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য এই দেবকীপুত্র কৃষ্ণ নিশ্চয়ই অন্য ব্যক্তি হবেন।

শ্রদ্ধেয় বিমান বিহারী মজুমদার এই সংশয়ের নিরসন করেছেন। তিনি বলেছেন পণ্ডিতদের এই মত অজ্ঞতাপ্রসূত। মহামতি শঙ্করাচার্যের ছান্দোগ্য–টীকা থেকেই পণ্ডিতদের ধারণা হয়েছে যে, কৃষ্ণ ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য। মূল উপনিষদে কোথাও কৃষ্ণকে ঘোর আঙ্গিরসের শিয্য বলা হয়নি। ঘোর আঙ্গিরস তাকে বিদ্যা উপদেশ করেছেন মাত্র। উপনিষদে বহু জায়গায় কোনও সুযোগ্য অধিকারী শিষ্য না হওয়া সত্ত্বেও ব্রহ্মর্ষি ব্যক্তির কাছ থেকে উপদেশ লাভ করছেন–এমন অনেক দেখা গেছে। আমাদের ধারণা শঙ্করাচার্যও এখানে শিষ্য কথাটা অত আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করেননি। যাঁকে উপদেশ করা যায় তিনি তো শিষ্য বটেই। তাছাড়া কৃষ্ণের মত মহাবুদ্ধি ব্যক্তি তার বৈচিত্র্যময় জীবনে নানা জনের কাছ থেকে উপদেশ লাভ করেছেন। ঘোর আঙ্গিরস তাদেরই একজন। পুরাণগুলির মধ্যে যদি এই একান্ত উপদেশের কথা উল্লিখিত নাই হয়ে থাকে, তাহলেই এত পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীন দেবকীপুত্র কৃষ্ণের নামটি কি অন্যভাবে ব্যাখ্যাত হওয়া উচিত?

কিন্তু পণ্ডিত-গবেষকদের একথা বোঝানো যায়নি, তারা উপনিষদের মধ্যে দেবকীপুত্র কৃষ্ণ নামটি ঘোর আঙ্গিরসের সঙ্গে যুক্ত দেখা মাত্রই তাকে অন্য একটি কৃষ্ণ হিসেবে কল্পনা করেছেন। আরে! কৃষ্ণ না হয় তিন–চারটে পাওয়া গেল কিন্তু দেবকীপুত্র কৃষ্ণ কটা আছে? কিন্তু কষ্ট-কল্পনার লাগাম যখন ছেড়ে দেওয়াই হল, তখন আর-আর পণ্ডিতজনাই বা অল্প কল্পনা করবেন কেন! তারা যশোমতীর ছোট্ট ছেলেটিকে গোপাল কৃষ্ণ বললেন, শত গোপীর সরসতার নায়কটিকে আভীর-কৃষ্ণ বললেন এবং মহাকাব্যের কৃষ্ণকে আরেক কৃষ্ণ বলে গবেষণার তুফান তুলে দিলেন। তারপর একটি মহান পারিভাষিক শব্দের ওপর নির্ভর করে তারা বললেন–একে বলে Syncretism–অর্থাৎ ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য দেবকীপুত্র কৃষ্ণ, গোপাল-কৃষ্ণ, আভীর-কৃষ্ণ এবং মহাভারত-সূত্ৰধার মূলে আলাদা লোক হলেও কালের গতিতে জনমনে তারা একই কৃষ্ণের মায়া তৈরি করেছেন।

 আমাদের বিনীত নিবেদন–পণ্ডিতেরা যেখানেই মেলাতে পারেননি, সেখানেই এই Syncretism সমাধান বাতলেছেন। স্বীকার করি–মৌলিকভাবে বিভিন্ন অনেক পৌরাণিক চরিত্রকে মানুষ এক করে দেখেছে, কিন্তু সেই সত্যটি কৃষ্ণের ওপর চাপানো মোটেই ঠিক হবে না। এই জন্য ঠিক হবে না যে, অন্যান্য পৌরাণিক চরিত্রের ক্ষেত্রে সময়ের একটা ব্যবধান আছে, কিন্তু গোপাল-কৃষ্ণ, আভীর-কৃষ্ণ এবং মহাভারতের কৃষ্ণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কল্পনা করা কঠিন। অন্তত পুরাণগুলি থেকে এই ব্যবধান কল্পনা করা খুবই কঠিন।

বরঞ্চ এ ব্যাপারে আমরা চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবদের অনেক বড় ঐতিহাসিক মনে করি। তারা মহাভারতের মহান-ঐশ্বর্যশালী কৃষ্ণকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন বটে, তাকে তারা আলাদা কোনও ব্যক্তিত্বও ভাবেন না বটে, কিন্তু ওই ঐশ্বর্যশালী কৃষ্ণ তাঁদের মনের মানুষ নন। যাঁকে নিয়ে তাদের ভাব-ভাবনা-ভক্তি, যাঁকে নিয়ে তাদের দর্শন এবং রসশাস্ত্র, এবং যিনি তাদের দেবতা এবং মনের মানুষ, তিনি হলেন গোপাল কৃষ্ণ, আভীর কৃষ্ণ। এমনই তাদের মুগ্ধবোধ যে, এই কৃষ্ণকে তারা দেবকীর পুত্র হিসেবে সংঙ্কিত করতে চান না, কেন না সেখানে ঈশ্বরত্বের প্রকাশ ঘটেছে। তাদের কৃষ্ণ নন্দলালা-যশোদানন্দন কৃষ্ণ গোপাল গোবিন্দ।

যদি একটু তলিয়ে দেখা যায়, তবে দেখবেন দার্শনিক দিক দিয়েও কৃষ্ণ একটা রিলিফ এনে দিয়েছেন। বৈদিক যুগের স্বাহ-স্বধা-বকারের আড়ম্বর শেষ হতেই উপনিষদের গাম্ভীর্য আরম্ভ হল। ব্রহ্মতত্ত্বের ব্যাপারটা এতই বেশি গভীর এবং এতই সেটা সূক্ষ্ম যে, সাধারণ মানুষের বুদ্ধি সেখানে পৌঁছয় না। অতএব সাধারণ বুদ্ধিকে প্রশান্ত করবার জন্যই পরম-ঈশ্বরের অবতার-কল্প সৃষ্টি হল। কিন্তু মানুষ দেখল–অবতারেরাও সবাই তত সহজ নন–মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ–এঁরা দুষ্টের দমন করেন, শিষ্টের পালন করেন। এমনকি রাম–অবতারেও তাঁর মুখ্য উদ্দেশা রাবণ বধ। অর্থাৎ অবতারবাদের মুখ্য উদ্দেশ্য–দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন–এখানেও একই আছে।

কিন্তু কৃষ্ণের কল্পনাতে এসেই দেখা গেল যে, কংস-বধ বা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব-পক্ষের পরাজয় এমন কোনও বড় ঘটনা নয়। বরঞ্চ কৃষ্ণ-জীবনের বৈচিত্র্যে অবতারের মুখ্য উদ্দেশ্য–দুষ্ট দমন-শিষ্ট পালনের বিধি অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি যে এক সময় যশোমতীর আদরের দুলালটি হয়ে উঠলেন, তিনি যে গোপ রমণীদের প্রেমিকটি হয়ে উঠলেন, অথবা পাণ্ডব অর্জুনের সখা হয়ে উঠলেন অথবা দ্রৌপদীরও পরম সখা হয়ে উঠলেন–এই অতি রমণীয় মনুষ্য–সম্বন্ধগুলিই কিন্তু কৃষ্ণের জীবনে মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। অববাদের মধ্যেও আর কোনও Intellectual Construction থাকল না। পরম ঈশ্বর অথবা পরং ব্রহ্ম আর শ্বেতকেতু-যাজ্ঞবল্ক্য-জনকের মতো ঋষিদেরই একমাত্র বোধ্য হয়ে রইলেন না–ভগবান হয়ে উঠলেন সাধারণের মনের মানুষ। সে আর তাকে ভয় পায় না, সে তাকে ভালবাসে–কথাটা মহামতি প্যাসকাল বলেছিলেন এইভাবে–God of Abraham. Isaac and Jacob, not of the philosophers and scholars, God who is found only in the ways taught by the Gospels.

এই Gospel কে যদি বিশ্বাস করতে হয়, তবে কৃষ্ণ-জীবনের বিচিত্র সঙ্গতি খুঁজতে গেলে মহাভারত ছাড়াও আমাদের হরিবংশ, এবং অন্যান্য পুরাণগুলিকে মান্য করতেই হবে। তা না হলে কৃষ্ণের বাল্য, কৈশোর এবং প্রথম যৌবন বাদ দিয়ে একেবারেই মহাভারতে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এমন কল্পনা সম্ভব নয় বলেই আমরা কৃষ্ণের শৈশবে ফিরে যাচ্ছি।

প্রথম কথাটা আগে মিথলজিস্টদের মতো বুদ্ধিদীপ্ত কায়দায় বলে নিই। মিথলজিস্টরা বলেন–সৌরকুলের দেবতা যাঁরা (Solar gods), তাঁদের জন্মটা সব সময়েই প্রায় অলৌকিক। সাধারণ মানুষের মতো তারা যোনি–সম্ভব নন। যিশুখ্রিস্ট, বুদ্ধ, রামচন্দ্র অথবা অ্যাপোলর মতো কৃষ্ণও দেবকীর কোলে এসেছেন অলৌকিকতার আবেশ ছড়িয়ে। হরিবংশ, বিষ্ণু অথবা ভাগবত পুরাণে এমনটিই আছে। আবার দেখুন জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সৌরদেবতাদের জীবন-সংশয় উপস্থিত হয় দেশের রাজার হাতে, যেমনটি হয়েছিল হেরডের হাতে যিশু খ্রিস্টের, ফারাও–এর হাতে মোজেসের এবং অবশ্যই কংসের হাতে কৃষ্ণের।

এইরকম ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিথলজিস্ট লেখেন–Perhaps the sun ris ing suddenly out of the dark night appears as an unaccountable and mysterious creation which in these myths has been translated into miracu lous births.

আবার দেখুন জন্মের পরেই সৌরকুলের দেবতারা অনেক সময়েই পিতা অথবা মাতার দ্বারা পরিত্যক্ত হন। ভারত-মহাকাব্যে ভীষ্ম এবং কর্ণ যেমন এই পরিত্যাগের উদাহরণ। তেমনই ওদেশে মোজেস পরিত্যক্ত হয়েছিলেন নল-খাগড়ার বনে। সৌর দেবতার অন্যতম কৃষ্ণও একইভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিলেন বৃন্দাবনে গোপ-গৃহে। তবে এরও কারণ আছে। পিতা-মাতার দ্বারা এইভাবে পরিত্যক্ত হলে নাকি এই বীর-চরিত্রের ব্যাপারে মানুষের মায়া, ভীতি এবং বিস্ময় সবই হয়। অন্যদিকে তার সম্বন্ধে একটা heroic isolation তৈরি হয়। তারপরে এই পরিত্যক্ত শিশু যখন বড় হয়ে নানা বীরোচিত কর্ম করেন, তখন তার সম্বন্ধে মানুষের বিস্ময় গাঢ়তর হয়।

এতক্ষণ যা শুনলাম, যা বুঝলাম, তাতে মনে হয় যেন মিথলজিস্টরা একটা প্যাটার্ন তৈরি করেন এবং তুলনামূলক বিচার করলে সেটা বেশ বিশ্বাসযোগ্যও মনে হয়। কিন্তু আমাদের মনে হয় কৃষ্ণকে এরকম একটা প্যাটার্নের মধ্যে ফেলে তাঁর জীবনের বিচার করলে খানিকটা ঐতিহাসিকতা নষ্ট হয় যেন। অন্যদিকে এটাও ঠিক যে, কৃষ্ণের মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব যখন এইভাবে পরিত্যক্ত হবার পর এক সময় মহাভারতের নায়কে পরিণত হন, তখন তিনি অতি কৃষ্ণবর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সৌরকুলের দেবতা বলেও পরিগণিত হন, আবার তিনি প্যাটার্নের অন্তর্গত হয়ে মানুষ থেকে দেবতাতেও পরিণত হন।

কৃষ্ণ সম্বন্ধে মিথলজিস্টদের প্যাটার্ন যাই হোক, আমরা যখন তাকে বৃন্দাবনের পরিসরে মানুষ হতে দেখলাম, তখন তার মনুয্যোচিত ভাবটাই চোখে পড়ে বেশি, আর সেই সরল মনুষ্য-জীবন প্রদর্শন করার জন্য পৌরাণিকেরাও ভারি সুন্দর ব্যবস্থা নিয়েছেন। হরিবংশে দেখছি–কৃষ্ণের শৈশব-জীবনের প্রসঙ্গে যাবার আগেই যথাসম্ভব বৃন্দাবনের শোভা বর্ণনা করে নেওয়া হচ্ছে। বস্তুত শিশু কৃষ্ণ যেখানে থাকবেন, যেখানে বড় হবেন, সেই জায়গাটা যে মথুরা নগরের শহুরে পরিবেশের বাইরে এক সরল গ্রাম্য জীবন, সে ব্যাপারটা আগেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন হরিবংশের কথক-ঠাকুর।

প্রাকৃতিক দিক দিয়ে বৃন্দাবনের প্রধান আকর্ষণ হল যমুনা এবং গোবর্ধন পর্বত। নন্দগোপ বৃন্দাবনের নির্জন অরণ্যপথে ফিরে আসছিলেন। সেখানে যমুনার গভীর শীতল জলের স্নিগ্ধতা তাকে যেন আরও স্নিগ্ধ করে তুলল। নন্দগোপ গোবর্ধন পর্বতের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। সেখান থেকে সমস্ত ব্রজভূমি দেখা যায়–যমুনার তীরে ধীর সমীরে অনেকটা জায়গা জুড়ে এই ব্রজভূমি-যমুনাতীর–সম্বদ্ধং শীতমারুত সেবিত। লতা-বল্লীতে জড়ানো বড় বড় গাছ। তৃণভূমিতে চরতে আসা শত শত গোর–গোভিণবিলগ্নাভি স্যন্দীভি রক্তৃত। গোরুগুলি যেখানে ঘাস খাচ্ছে সে জায়গাটা মোটামুটি সমভূমি–সমপ্রচারঞ্চ গবা। মাঝে মাঝে পুকুর, তাতে কোথাও বা বাঁধানো ঘাট। বনপ্রান্তে গভীরতর অরণ্যভূমিতে হিংস্র শাপদের আবাস আছে বটে, তবে তারা লোকালয়ে উৎপাত সৃষ্টি করে না।

ভূমির উর্বরতায় বন যদি লোকালয় গ্রাস করে সে জন্য এখানকার মানুষেরা একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা করেছে। পড়ে–যাওয়া বড় বড় গাছ দিয়ে তারা ব্রজভূমির সীমান্ত বানিয়েছে। গোর বাছুরের হাম্বা রব, বৃক্ষনিম্নভাগে অলস বৃদলের শৃঙ্গ-ঘর্ষণ ব্রজভূমিতে অদ্ভুত এক মন্দাক্রান্তা ছন্দের আবিলতা সৃষ্টি করেছে। ব্রজের গ্রাম্যতার যে শোভা আছে, সে শোভা নাগরিক-জনের বোধগম্য নয়। ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো শকটবাহী বলদ, এখানে-সেখানে পোঁতা বাছুরের খুঁটি আর ছড়ানো-ছিটনো দড়ি–এগুলিই ব্রজের শোভা–বৎসানাং রোপিতৈঃ কীলৈ-দামভিশ্চ বিভূষিত। এমনকি যেখানে-সেখানে স্তূপীকৃত করীষ (গোবর, ঘুঁটে) এবং শন-বিছানো কুটীর–এই অপরিচ্ছন্নতা এবং পরিচ্ছন্নতা দুটিই যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত–করীষাকীর্ণবসুধং কটচ্ছন্নকুটী-মঠম।

এখনকার মানুষগুলির চেহারা চাছা-ছোলা লম্বা ঢ্যাঙা নয়। সকলে বেশ নাদুস-নুদুস, ময়রাদের ঘরে যেমনটি হয়–হৃষ্টপুষ্ট জনাবৃত। কুটীরগুলির অন্তরাল থেকে দুগ্ধ মন্থনের গর্গর-ধ্বনি ভেসে আসে। ঘরে ঘরে তৈরি হয় দধি, ক্ষীর, তক্র আর এইসব ঘর থেকেই ধ্বনিত হয় ব্রজভূমির শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত–গোপরমণীদের হাতের কঙ্কনধ্বনি মিশ্রিত হয় গর্গরী চালনার শব্দভ্রমিতে। হরিবংশের কথক-ঠাকুর এরপরেই কতগুলি বালক-কিশোরের দিকে নজর করেছেন, তাঁর কাছে সবচেয়ে লক্ষণীয় হয়েছে এই কিশোর বালকদের জুলফিওয়ালা চুল–কাকপক্ষধরৈ বালৈ গোপাল–ক্রীড়নাকুল।

 কোথায় কাকে ভোলাবার জন্য, অথবা কাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য এই কাকপক্ষধর গোপবালকেরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে (গোপাল-ক্রীড়নাকুলম) তার দিকেও হরিবংশঠাকুরের সজাগ দৃষ্টি আছে। এখান-ওখান থেকে উনুনে চাপানো ঘিয়ের কড়াপাক গন্ধটাই যে শুধু ঠাকুরের নাকে এসে লেগেছে তাই নয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নজর পড়েছে কতগুলি নীল শাড়ি আর হলুদ শাড়ির দিকে। ওদিকে কাকপক্ষধারী তরুণরা খেলা করছে, আর এ দিকে নীল পীতাম্বরা তরুণীরা–নীলপীতাম্বরাভিশ্চ তরুণীভিরলঙ্কৃত।

 বনজাত পুষ্পের কর্ণভূষণ এই তরুণীদের কানে। মাথায় পয়োকুম্ভ। স্তনের অগ্রভাগ স্কুটাস্ফুট-ব্যঞ্জনায় বস্ত্রাঞ্চলে আবৃত–শিরোভি-ঘৃতকুম্ভাভি-বদ্ধৈরগ্রস্তনাম্বরৈঃ। যমুনার তীরগামী বিস্তীর্ণ পথ বেয়ে তারা জল নিয়ে আসে কাখের কলসী পুরে। আর ঠিক এই বর্ণনার পরেই–হরিবংশ ঠাকুরের সময়জ্ঞান কত প্রখর–ব্রজভূমির গোপরাজ নন্দ গোবর্ধন পর্বত ছেড়ে এসে প্রবেশ করেন ব্রজভূমিতে–যেখানে গোপবালকেরা তাদের ক্রীড়ামাতাল শব্দগুণে আকাশ মুখরিত করেছে–গোব্ৰজং গোপ-নাদিত। এই শব্দ-নিনাদের কারণ কি সেই যমুনায় জল আনতে যাওয়া জলহারিণী গোপরমণীরা–যমুনা-তীর-মার্গেন জলহারীভিরাবৃত?

 হরিবংশ ঠাকুরের এই সামান্য এবং অসামান্য বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়–আর্যভূখণ্ডের সন্ত্রস্ত নাগরবৃত্তি এই অঞ্চলে তেমন প্রচলিত নয়। এই জনস্থানের তরুণ-তরুণীরা যথাসম্ভব মুক্ত মনে বিচরণ করে। তাদের অবাধ মেলামেশা, ঘোরা-ফেরার মধ্যে বৃদ্ধ-জনের তত কঠোর কটাক্ষ চোখে পড়ে না। অধ্যাপক ফ্রিলহেম হার্ডি বৃন্দাবনের এই সরল গ্রাম্য জীবনের মুগ্ধতা লক্ষ্য করেছেন নিপুণভাবে এবং তিনি দেখেছেন–হরিবংশের এই সহজ সরল গ্রাম্যতাই সম্পূর্ণ ধরা রয়েছে ভাসের বালচরিত নাটকে। এমনকি তার ধারণা–এখানকার যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যে ভাষায় কথা বলে তাও তেমন কোনও পরিশীলিত ভাষা নয়। সেটা গয়লাদের ভাষা।

আমরা হরিবংশের এই বৃন্দাবনী বর্ণনা খানিকটা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, কৃষ্ণের শৈশব এবং বেড়ে ওঠাটা যদি ঠিক-ঠাক বুঝতে হয় তবে গ্রাম্য-জীবনের নানান সরলতা এবং মুগ্ধতাও আমাদের বুঝতে হবে। বৃন্দাবনের নন্দগ্রামে যে গোপরাজটি মথুরা-নগরের রাজশিশুর অধিকারী হলেন, তিনি প্রায় গয়লাদের মোড়ল গোছের; কিন্তু তাই বলে গোরু চরাতেও তার বাব না, গোরুর গাড়ি চালাতেও তার বাধে না। মাথুর বসুদেব যখন তার শিশুটিকে নন্দ-গোপের হাতে দিলেন, তখন তিনি দেখলেন শিশুটি বড় ভারী। তিনি বললেন–এই বালকটিকে হাতে ধরতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে।

ভাস এখানে বড় অদ্ভুতভাবে নন্দ গোপের সরলতা এবং কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বের সচেতনতাটুকু তুলে ধরতে চেয়েছেন। বসুদেব তাকে বললেন–তুমি তো যথেষ্টই শক্তিমান মানুষ। নন্দগোপ সঙ্গে সঙ্গে বসুদেবের সেই প্রশংসা স্বীকার করেন। কিন্তু ঈশ্বর বলেও হয়তো নয়, হয়তো শুধু মাথুর কুলের রাজপুত্র বলেই সরল নন্দরাজ বলে উঠছেন–দেখুন কত্তা। আমার শক্তি-ক্ষ্যাতা কিছু কম নয়–একটি ষাঁড় তেড়ে এলে আমি তার শিঙ দুটি ধরে নিজেকে বাঁচিয়েছিলাম–সন্দারয়মাণে বৃষভে শৃঙ্গং গৃহীত্বা মোচয়ামি। দুধের ভাড় সমেত গোরুর গাড়ি পাকে পড়ে গেলে আমি নিজেই পাঁক থেকে সেই গাড়ি তুলেছি–পঙ্কনিমগ্না ভাণ্ডশকটান্ আঘট্টয়ামি। আর সেই আমি এই শিশুটিকে ধরতে পারছি না?

 শেষ পর্যন্ত এই গোপরাজ শিশুটিকে কক্ষপুটে নিয়েছেন, তাকে নিজগৃহের পরিচ্ছন্ন শয়নে শুইয়েও দিয়েছেন–সংবেশয়ামাস শিশুং শয়নীয়ং মহামতিঃ। কিন্তু মনে রাখতে হবে–এই ঘরে যদি কৃষ্ণকে বড় হতেই হয়, তবে মাঝে মাঝেই ব্রজভূমির গোরুর কথা আসবে, ষাঁড়-বলদের কথা আসবে। আর আসবে সরলমতি গোপবালকদের কথা, যারা যমুনা-পথবর্তিনী জলহারিণী গোপ কন্যাদের দেখে বৃন্দাবনের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে।

.

৮৭.

 পৌরাণিক পণ্ডিতেরা বলেন সৌরকুলের দেবতাদের (solar gods) একটা বিরাট বৈশিষ্ট্য নাকি এই যে, তারা অল্প বয়সেই অনেক দৈত্য-দানব সংহার করে ফেলেন। এঁদের প্রত্যেকেরই একটা করে চরম শত্রু থাকেন এবং সেই চরম শত্রুকে বধের ব্যাপারটাই তাদের বীরত্বেরও চরম পরিণতি বয়ে আনে। ঠিক যেমন বৈদিক ইন্দ্র তার পূর্ব জীবনে বহু শত্রু বধ করেছেন, কিন্তু তার চরম পরিণতি হল বৃত্র-বধ–যা তাকে যশের চরম পদবীতে পৌঁছে দিয়েছে। তার পরিচয় হয়েছে বৃত্রয় (আবেস্তায় বেরিত্রগ্ন), বৃত্ৰহা বা বৃত্রহ নামে।

ইন্দ্রের চরম শাস্তিযোগ্য শত্রু যেমন বৃত্র, তেমনি ওদেশে অ্যাকিলিসের (Achilles) শেষ শত্রু হলেন হেকটর। পারস্যদেশীয় মিথ্র-দেবতার পরম শত্রু যেমন একটি বৃষ, তেমনি গেলগামেশ হত্যা করেছেন এনকিডুকে, মারদুক (marduk) বধ করেছেন টিয়ামকে (Tianat)। আবার দেখুন–যিশুখ্রিস্ট যেমন শয়তানের শেষ জয়টি লাভ করেছেন, তেমনি আমাদের বুদ্ধ–তিনিও সৌর দেবতা–তিনি শেষ কীর্তি লাভ করেছেন মার–বিজয়ের পরে। আর আমাদের পুরাণ চরিত্রে আসুন–রামচন্দ্রের শেষ মারণাস্ত্রের লক্ষ্য হলেন যেমন রাবণ, তেমনিই কৃষ্ণের প্রধান এবং শেষ লক্ষ্য হয়ে উঠবেন আপাতত কংস। কিন্তু এই রাবণ-বধ বা কংসবধের মতো যুগান্তকারী ঘটনা ঘটবার আগেই সৌর-দেবতা অনেক দৈত্য-রাক্ষস মেরে নিজের অসামান্য বীর্যবত্তার প্রমাণ দেন। ভবিষ্যতের মহানায়ক নিজেকে জানান দিতে থাকেন যে, তিনি এসে গেছেন–আর ভয় নেই।

জগৎত্ৰাতা সৌর দেবতাকুলের চরিত্রই নাকি এইরকম। পণ্ডিত মিথলজিস্টরা বিচিত্র বাক্য-বিভঙ্গে জগত্তারণ ঈশ্বরের (saviour God) সম্বন্ধে যা বলে থাকেন, ভারতবর্ষের অবতারবাদী ভক্তজনেরাও তাই বলে থাকেন। কাজেই সেই প্যাটার্নের কথা আমরা বলতে ভালবাসি না। কৃষ্ণ এক মহান ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই সৌরদেবতা বা অবতারবাদের প্যাটার্ন তারও ভাগ্যে এসে জুটেছে; কাজেই বলতে ভাল না লাগলেও সেসব কথা একটু উল্লেখ করতে হবে বই কি! তাছাড়া কৃষ্ণের শৈশব-ক্রীড়ার সময়েই যেসব শত্রু-শাতনের কাহিনী তৈরি হয়েছে, তা ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের মনে রীতিমতো গেঁথে বসে গেছে, কাজেই সামান্যভাবে হলেও আমাদের উল্লেখ করতে হবে।

কৃষ্ণ-জীবনের এই কাহিনীগুলি কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার একটা বড় প্রমাণ কিন্তু সেই বালচরিত নাটক। সেই কাহিনীগুলি হয়তো জনসাধারণের মুখে মুখে চালু ছিল বলেই আমরা কৃষ্ণের শকট-ভঞ্জন, পূতনা-বধ বা আরও ছোট-খাটো ঘটনা এক বুড়ো গয়লার মুখে বসানো দেখছি। বুড়ো গয়লা তার ভাগনে দামকের কাছে শিশু কৃষ্ণের নানা অলৌকিক কাহিনী বলছে। কাজেই কৃষ্ণজীবনকে সম্পূর্ণ ধরতে হলে আমাদের পক্ষেও এই oral tradition বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।

বস্তুত বালচরিত নাটকে বৃদ্ধ-গোপালকের মুখে যে ঘটনাগুলি সংবাদ দেবার ভঙ্গিতে ধরা আছে, সেগুলি সবিস্তারে বর্ণিত আছে আমাদের পুরাণগুলিতে। তবে হ্যাঁ পুরাণে যে কথা আগে আছে, সে কথা হয়তো বুড়ো গয়লার মুখে এসেছে পরে। এই যেমন হরিবংশে আগে শকটাসুর ভঞ্জনের কাহিনী, পরে পূতনা-বধ। কিন্তু বালচরিত নাটকে আগে পূতনা-বধ, পরে শকটাসুর-ভঞ্জনের কাহিনী। বিষ্ণুপুরাণেও তাই। ভাগবত পুরাণেও তাই। আর স্বাভাবিকতার দিক দিয়েও বিষ্ণু-ভাগবত পুরাণই ঠিক।

বালচরিত নাটকে বুড়ো গয়লা তার ভাগনেকে কৃষ্ণের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা বলছে–এই তো দেখ না। নন্দ-গোপের ছেলেটা জন্মানোর পর দশদিন মাত্র গেছে। তারই মধ্যে পূতনা নামে এক রাক্ষসী স্তনে বিষ মাখিয়ে যশোদার রূপ ধরে এল–দশরাত্র-প্রসূতে নন্দগোপপুত্রে পূতনা নামী দানবী বিষসম্পূরিত-স্তনা নন্দগোপ্যা রূপং গৃহীত্বাগতা। তারপর সে ছেলেটাকে নিয়ে তার মুখে স্তন পুরে দিল। তারপর সে ঘুমচ্ছে দেখে ছেলেটা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেও রাক্ষসীর রূপ ধারণ করে তক্ষুনি মরে গেল–সাপি দানবী ভূত্বা তত এব মৃতা।

 বুড়ো গয়লা এরপর অন্য একটি কাহিনীতে চলে গেছে। বালচরিত নাটকে এই ঘটনাটা লোক-পরম্পরা প্রাপ্ত (oral tradition) সংবাদের মতো পরিবেশিত হওয়ায় কাহিনীর রসবত্তা খানিকটা ব্যাহত হয়েছে বই কী! কিন্তু নাট্যকার সম্ভবত যেখান থেকে তার কাহিনীর উপাদান সংগ্রহ করেছেন সেটা হরিবংশ বা বিষ্ণুপুরাণে পূতনার কাহিনী।

হরিবংশে পূতনা ভোজরাজ কংসের ধাত্রী ছিল এবং তার চেহারা ছিল পক্ষিণীর মতো–পূতনা নাম শকুনী ঘোরা প্রাণিভয়ঙ্করী। সে মাঝরাত্রিতে বৃন্দাবনে আসে এবং সবাই যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন স্ত্রী–বেশ ধারণ করে সে তার বিষদিগ্ধ স্তন কৃষ্ণের মুখে পুরে দেয়। কৃয় তার স্তন্যপানের সঙ্গে প্রাণটিও বুঝি পান করে ফেলেন–তস্যাঃ স্তনং পপৌ কৃষ্ণঃ প্রাণৈঃ সহ বিনদ্য চ। পূতনা নিজের রূপ ধারণ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বিষ্ণু পুরাণেও পূতনা-বধের কাহিনী প্রায় অনুরূপ, তবে নর-রূপী কৃষ্ণের মধুর স্পর্শ যেন এখানে একটু বেশি এবং ভাগবত পুরাণে এই মধুরতা দার্শনিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। আসছি সে কথায়।

 পূতনা সম্বন্ধে মিথলজিস্টদের ধারণাটা একটু বলে নিই। মিথলজিস্টরা সাধারণত কৃষ্ণের মধ্যে বৈদিক ইন্দ্রের প্রতিরূপ দেখতে পান। অতএব কুশাব বলে যে অদ্ভুত জীবটি ইন্দ্রকে বাল্যকালেই হত্যা করতে চেয়েছিল, তারই প্রতিরূপ লক্ষিত হয়েছে বালঘাতিনী পূতনার মধ্যে। তুলনামূলক ধর্মীয় বিচারে পূতনাকে আমরা অবশ্য আরও একটু অন্যভাবে পাই। গ্রিস দেশের পৌরাণিক কাহিনীতে ডেলফাই নগরে অ্যাপোলো যে সর্প-রাক্ষসটিকে হত্যা করেছিলেন তার নাম টাইফও (Typhaon), যার থেকে ইংরেজিতে পাইথন (Python)। লক্ষণীয় বিষয় হল ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দতন্ত্রে দুই ভগিনী-ভাষার দুটি শব্দ পূতনা এবং পাইথো (Pytho) কিন্তু একই ধাতু থেকে জন্মেছে। সেই ধাতুর সংস্কৃত রূপ থেকে পুতি (পচন) শব্দের উৎপত্তি আর গ্রিসীয় রূপ থেকে আসে পুথেয়ি (puthein) যার অর্থ putrefaction মানে সেই পচন। ওদেশের ভাবনায়–সূর্যের অলৌকিক শক্তিতে পাইথনের মৃতদেহ গলিত হয়েছিল এবং সেটা সম্পূর্ণ পচন ধরার পর (puthein) সেই পচনের জায়গাটার নামই হয়ে গিয়েছিল পাইথথা (Pytho)। মহামতি হেসিয়ড হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই পচনের ঘটনাটিকে টাইফাঁও অথবা পাইথনের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখান। অপিচ এই গ্রিসীয় পচনের স্বরূপ তথা পূতনা শব্দের ধাতু-মূল পুতি (পচন) থেকেই পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করেছেন–The element of rot or poison is symbolised by the poisoned breast of Putana. উল্লেখ্য, পূতনার বিষয়ে মনস্বী বঙ্কিমচন্দ্র যে মত ব্যক্ত করেছেন, সেটাকে খুব নির্ভরযোগ্য মনে করা যায় না।

যাইহোক, হরিবংশ ছেড়ে বিষ্ণু-পুরাণে যে মধুর স্পর্শটুকু পেয়েছি, সেটা আগে বলে নিই। বিষ্ণুপুরাণে দেখছি–পূতনা মারা গেছে রাক্ষসীর রূপ ধারণ করে এবং আমরা যশোমতী-নন্দন কৃষ্ণকে কিন্তু কোনও অলৌকিক রূপ ধারণ করতে দেখছি না। তিনি যেমন শিশুটি ছিলেন, সেই স্তন্যপান–লুব্ধ শিশুটির মতোই তাকে দেখা গেল পূতনার ক্রোড়গত অবস্থায়–দদৃশ্যঃ পূতনোৎসঙ্গে কৃষ্ণং তাঞ্চ নিপাতিতা। সাহিত্যিকের ভাবনাকে আরও এক গুণ বেশি করে দিয়ে যে শিল্পীরা সেই গুপ্ত যুগে বসে পূতনা-বধের ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন, তাদের সেই খোদাই করা প্রস্তর-মূর্তিতে কৃষ্ণ যখন পূতনার বুকের ওপর স্তন্যপান-রত, তখনও তাঁর মাথায় ছোট্ট শিখিপুচ্ছটি আছে। আর তার মুখে আছে সেই শিশুর অনাবিল নির্বোধ বিশ্বাস–যা তার ভাগবত্তা বা ঈশ্বর-স্বরূপ সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিয়ে আমাদেরই ঘরের এক দেবশিশুর মতো করে তুলেছে তাকে।

বিষ্ণুপুরাণে দেখেছি–পূতনার প্রাণান্তক চিৎকার এবং ব্রজবাসীদের চিৎকারে জননী যশোমতী যখন সম্পূর্ণ বুঝলেন যে তার শিশুটি বেঁচে গেছে, তখন তিনি সাধারণ গ্রাম্য জননীর মতোই ছেলের সর্বাঙ্গে গোপুচ্ছের ঝাড়া দিয়ে অপদেবতার দোষ অপনোদন করলেন গোপুচ্ছং ভ্রাম্য হস্তেন বালদোষমপাকরো। স্নেহময় নন্দরাজ, যিনি প্রায় বুড়ো বয়সে পুত্রলাভ করেছেন, তিনি নির্দ্বিধায় গোময়-চূর্ণ হাতে নিয়ে শতেক দেবতার নাম উচ্চারণে ছেলের প্রত্যঙ্গ-রক্ষার মন্ত্র উচ্চারণ করলেন

গোঙ করীষমাদায় নন্দগোপোপি মস্তকে।
কৃষ্ণস্য প্রদদৌ রক্ষাং কুংশ্চৈত দুদীরয়।

পূতনা-বধের বিষয়ে ভাগবতপুরাণে যে শ্লোকটি আছে, সেটি নিয়ে পণ্ডিতজনের নানা বক্তব্য আছে। ভাগবত বলেছে–কৃষ্ণ যখন পূতনার স্তন্য পান করার সময় তার প্রাণও শোষণ করলেন, তখন তাকে যেন কিঞ্চিৎ ক্রোধাবিষ্ট দেখা গেছে–প্রাণৈঃ সমং রোষ সমন্বিততাপিবৎ। পণ্ডিতজনেরা তর্ক করেছেন যে, অতটুকু শিশুর মুখে যে ক্রোধাবেশ লক্ষ্য করা গেছে, তাতে বোঝা যায় মনুষ্য-রূপায়ণের মধ্যেও তাঁর ঈশ্বরত্বের বোধটুকু বোধহয় পুরোপুরি যায়নি। কেননা ক্রোধ হয়েছে মানেই তিনি স্ত্রীবেশী পূতনার রাক্ষসী-রূপটুকু বুঝতে পেরেছেন এবং সেইজন্যই তার ক্রোধাবেশ দেখা গেছে।

 বৈষ্ণব টীকাকারেরা বলে উঠলেন–মনুষ্যলীলায় ঈশ্বরত্বের বোধ এক অসম্ভব ব্যাপার। হতেই পারে না। দেখুন না ভাগবত পুরাণেরই অন্য শ্লোকে তাকে নির্ভয়ে পূতনার কোলে খেলা করতে দেখছি–বালঞ্চ তস্যোরসি ক্ৰীড়ন্তম অকুতোভয়ম। যশোদা-রোহিণী ইত্যাদি ব্রজমাইদের দেখতে পাচ্ছি–তারা কৃষ্ণকে গোমূত্রে স্নান করিয়ে শিশু কৃষ্ণের মস্তক স্পর্শ করে অঙ্গ-রক্ষার মন্ত্র পড়ছেন। স্বয়ং ঈশ্বর হয়ে যদি তাকে গ্রাম্য-সংস্কারের কাছে মাথা নত করতে হয়, তবে সেটাই তো কৃষ্ণের ঐশ্বর্যবোধহীনতার যথেষ্ট পরিচয়। তবে হ্যাঁ, পূতনাবধের সময় তার মুখে যে রাগটুকু দেখা গেল, ওটা কৃষ্ণের রাগ নয়, ওটি তাঁর ঐশী-শক্তির অসচেতন প্রকাশ। পরম ঈশ্বর সম্পূর্ণ মনুষ্যের ভাব অঙ্গীকার করলে অবতারের অন্যতম দুষ্ট-সংহারিকা শক্তি তার অন্তরশায়িনী হয়ে থাকে। সেই শক্তিই পূতনার প্রাণ হরণ করে এবং সেই শক্তিরই ক্রোধময় অভিব্যক্তি ঘটেছে কৃষ্ণের মুখে, এটি কৃষ্ণ নন–রোষময়ী দুষ্ট-সংহারিকা শক্তিরেব অপবিত্রা প্রাণান্ স্তনঞ্চাপিবৎ অশোষয়ৎ, ন তু সঃ।

সনাতন গোস্বামী আবার এই শ্লোকটির মধ্যে অন্য এক গুঢ়ার্থ নির্ণয় করে বলেছেন–মনুষ্য-স্বরূপেও যখন ভগবানকে এই দুষ্ট-বিনাশের মতো কাজটি করতে হয়, তখন হত্যা-মারণের অভিনয় বা অনুকরণটুকু করতেই হয়–স্বয়ং তু তদনুকরণমাত্রং কৃতবান্। একটা গাছ কাটার ব্যাপারে একটি কুঠার যেমন অচেতন করণ-মাত্র, তেমনি কৃষ্ণও তার ঐশী শক্তির সম্বন্ধে অচেতন। কিন্তু বৃক্ষ-ছেদন প্রক্রিয়ায় কুঠার যেমন তার কাজটি করে, তেমনি অবতার-পুরুষের দুষ্টবিনাশিনী ঐশী শক্তি তার কাজটুকু করেই যায়। হয়তো সেইজন্যই পূতনা-বধের মতো একটা বড় ব্যাপার কী করে ঘটল, তা ব্রজবাসীরা বুঝতেই পারলেন না। আর তারাও যেহেতু কৃষ্ণের ঐশী শক্তি সম্বন্ধে অচেতন, তাই হরিবংশে দেখছি–নন্দ-গোপ এবং যশোমতী মাতা সকলেই ভয় পাচ্ছেন। তারা কংসের দুষ্ট-বুদ্ধি সম্বন্ধে ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন–কংসাদ্ভয়ং চকারোগ্ৰং বিস্ময়ঞ্চ জগাম চ।

আপনারা হয়তো এতক্ষণে বুঝেছেন যে, আমরা কেন পূতনা-বধের ব্যাপারটা যথাসম্ভব সবিস্তারে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। চেষ্টা করলাম এইজন্য যে, আমাদের প্রায় একই কথা বলতে হবে শকটাসুর-বধ, যমলাজুন-ভঙ্গ, অঘাসুর, বকাসুর, তৃণাবর্ত অথবা অরিষ্টাসুর-বধের সম্বন্ধেও। তবে হ্যাঁ, এইসব সবিস্তারে বলতে গেলে আমাকে ভক্তি গদগদ চিত্তে ভাগবত-পাঠ শুরু করতে হয়। তাই কোনও বিস্তারে যাচ্ছি না। শুধু জানাই–শকটাসুরকে বাংলা ভাষায় গাড়ি-রাক্ষস বলা যায়। নন্দগোপ গয়লাদের রাজা হলেও গয়লাদের বসতবাটিতেই বাস করেন। রাজপুত্র রক্ষার ভাবনা-চিন্তা তার নেই। যশোমতী একটি গোরুর গাড়ির পাশে বাচ্চা শুইয়ে রেখেছিলেন। লোকে দেখল–গোরুর গাড়ি ভেঙে গেছে। সহজবুদ্ধি গোপজনেরা তবু একবারের তরেও শিশু-কৃষ্ণের ভগবত্তায় বিশ্বাস করল না, তারা শুধু বিস্ময়ে হতবাক হল, শুধু ভয় পেলন চ তে শ্রদ্ধু–গোপাঃ সর্বে মানুষ বুদ্ধয়ঃ–শুধু ভাবল, কেমন করে একটা, গাড়ি এমনি এমনিই ভেঙে পড়ল কৃষ্ণের পাশেই–কথং স্বয়ং বৈ শকটং বিপর্যগাৎ।

শকট-ভঞ্জনের মধ্যে এমনিতে কিছুই নেই, শুধু চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবদের মাধুর্যের টিপ্পনীটুকু ছাড়া। শিশুকৃষ্ণ কাদল, বড় বড় মানুষের ভয় দেখে ভয় পেল, আর যশোমতীর জননী-হৃদয় মন্থন করা স্তন্য পান করে সে ক্রন্দন থেকে বিরতও হল। যাঁরা বলেন–কৃষ্ণের এসব মধুরতার টিপ্পনী এসেছে অনেক পরে, ভাগবত পুরাণের কালে, তাদের আমরা পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে তৈরি দেওগড়ের প্রস্তরাকীর্ণ দশাবতার-মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বলি। দেখবেন–ভাগবত পুরাণের শকটভঞ্জনের উপাখ্যানে যে মধুরতা জড়িত আছে, সেই মধুরতা পঞ্চম খ্রিস্টাব্দেও বিরাজমান।

তাই বলছিলাম কৃষ্ণজীবনে মধুরতার আমদানি শুধু বৈষ্ণবেরাই করেননি। করেছে মানুষ। করেছে ভাস্কর। তার আকুল শিল্পীজনোচিত বেদনার স্পর্শ দিয়ে শিশু কৃষ্ণের জীবনে মনুষ্যত্ব দিয়েছে ভাস্কর। আসল কথা হল–কৃষ্ণের জীবনে অনেক বীরত্ব, অনেক ক্ষমতা অনেক শক্তির প্রদর্শনী আছে বলেই হয়তো দার্শনিকের চোখ বেয়ে ভগবত্তা নেমে এসেছে তার সমস্ত ক্রিয়াকলাপে। কিন্তু পুরাণ-ইতিহাসের মানুষ তার মানব-স্বভাবটাও কখনও তোলেনি। আর ভোলেনি বলেই তার মধ্যে ভগবত্তার চরম রূপ দেখেও কৃষ্ণকে তারা জীবৎকালে কখনও ভগবান বলে মেনে নেয়নি।

 কোনও সন্দেহ নেই, হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ কী ব্ৰহ্মপুরাণের তুলনায় ভাগবত পুরাণই বোধহয় সবচেয়ে বেশি করে তাকে মানুষ করে রেখেছে এবং সেই মনুষ্যত্বের অভিব্যক্তি চরম সরসতায় পরিবেশিত হয়েছে যমলাৰ্জুন-ভঙ্গে। যমল-অর্জুন মানে দুটি একসঙ্গে বেড়ে ওঠা অর্জুন গাছ, যেগুলির অধিষ্ঠান ছিল যশোমতীর কুটীর প্রাঙ্গণে। বালচরিত নাটক অনুযায়ী তখন কৃষ্ণের বয়স খুবই কম। সে এক গয়লা-বাড়িতে ননী খায়, ননী না দিলে ননী নষ্ট করে। এক বাড়িতে দুধ খায়, অন্য বাড়িতে ঘোলের হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে লুব্ধ দৃষ্টিতে।

ব্রজমাইরা বিরক্ত হয়ে যশোদার কাছে নালিশ করেন। যশোদা রাগে লজ্জায় একটি চাল-ডাল ভাঙার জাঁতাকল বা উলুখলের সঙ্গে কৃষ্ণকে বেঁধে রাখেন। কৃষ্ণ গোঁয়ার্তুমি করতে থাকেন এবং এক সময় উলুখল উলটে পড়ে। কৃষ্ণও গিয়ে পড়েন যমজ অর্জুন গাছের ওপর। বালচরিতের নট-নায়ক বুড়ো গয়লা মনে করিয়ে দিয়েছে যে, ওই গাছ দুটি ছিল বৃক্ষরূপী দানব–যমলাৰ্জুনোর্নাম দানবয়ো–নিক্ষিপ্তম্। কৃষ্ণ এদের ওপর এসে পড়তেই তারা দানবের রূপ ধারণ করে এবং মারা যায়– তাবপি দানবৌ ভূত্বা তত এব মৃতৌ।

যমলার্জুনের এই দানব-রূপই বোধহয় এই কাহিনীর সবচেয়ে পুরনো চেহারা। প্রাচীন পুরাণগুলির মধ্যে হরিবংশ এবং বিষ্ণুপুরাণ ছাড়া আর সব পুরাণেই–যেমন ভাগবত বা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে–যমজ অর্জুন হল কুবেরের দুই ছেলের অভিশপ্ত রূপ। ভাগবত পুরাণ অর্জুন বৃক্ষ-দুটির জন্য নতুন একটি অধ্যায় যোজনা করেছে এবং সেখানে দেখা যাচ্ছে কুবেরের লম্পট-প্রায় দুটি পুত্র নারদের অভিশাপে অর্জুন-বৃক্ষতা প্রাপ্ত হয়েছে–পুরা নারদশাপেন বৃক্ষতাং প্রাপিতৌ মদাৎ।

 ভাগবত পুরাণের বর্ণনা এবং কবিকৃতি অপূর্ব, মধুর। কিন্তু এখানে পরম ঈশ্বরের করুণাগুণ যতখানি রসতা প্রাপ্ত হয়েছে, স্বাভাবিকতা ঠিক ততখানিই কম। প্রতি তুলনায় হরিবংশ কিংবা বিষ্ণুপুরাণের দিকে তাকিয়ে দেখুন। কত সহজ, সংক্ষিপ্ত এবং অনাড়ম্বর সেই বর্ণনা। ঠিক যেমন সহজভাবে পূতনা, শকটাসুরেরা কৃষ্ণকে মারতে এসেছিল, তেমনি সহজভাবেই এই বৃক্ষরূপী দানবরা দাঁড়িয়ে ছিল যশোমতীর প্রাঙ্গণে। বালচরিত নাটক, হরিবংশ অথবা বিষ্ণুপুরাণ–তিনজনেই যমলাৰ্জুনের কাহিনী আরম্ভ করেছে কৃষ্ণের বাল্য-চাপল্য এবং দুষ্টুমির সূত্র ধরে। অর্থাৎ কিনা কৃষ্ণের দুষ্ট-ক্রীড়ার কথা বলতে গেলেই অর্জুন-বৃক্ষের কথাটি আপনিই এসে পড়ে।

বিষ্ণুপুরাণে দেখছি–সেই দুষ্ট বালক সর্বাঙ্গে গোময় মেখে, ভস্ম আর ধূলি মেখে–করীষ ভস্ম-দিগ্ধাঙ্গৌ–এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় এবং রোহিণী অথবা যশোদার ক্ষমতা হয় না যে তারা কৃষ্ণকে আটকাবেন–ন নিবারয়িতুং শেকে যশোদা ন চ রোহিণী। এই এখনই সে গোয়ালঘরে যাচ্ছে, এই একটা সদ্য-জন্মানো বাছুরের ল্যাজ ধরে টানছে–তদহজাত-গোবৎস-পুচ্ছাকর্ষণ-তৎপরৌ-এই রকম সব স্বেচ্ছাকৃত ছেলেমানুষি। যশোদা সইতে না পেরে কৃষ্ণকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলেন উদুখলের কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মায়ের দড়ির (দাম) বাঁধন যেই কৃষ্ণের পেটে পড়ল সেই থেকে তাকে ভালবাসার একটি নামই হয়ে গেল দামোদর। ইতিমধ্যে উদুখল উলটে পড়ল, যমলাৰ্জুন বৃক্ষ ভেঙে পড়ল মড়মড় করে।

কিন্তু এ অতি সামান্য কথা যে, গাছ-রাক্ষস মারা গেল। সবচেয়ে সাংঘাতিক কথাটা হল–তিন ভুবনের ঈশ্বরের পেটে মায়ের নিজে হাতে সাজা দেওয়া দড়ির বাঁধন পড়ল। ভাগবতের কবি আর থাকতে পারেননি। অসামান্য কাব্যবন্ধ তৈরি করে তিনি বললেন–যাঁর আদি-অন্ত নেই, যাঁর পূর্ব-উত্তর সীমারেখা নেই সেই সর্বব্যাপ্ত বিভু ঈশ্বরকে জননী যশোমতী প্রাকৃত শিশুর মতো বেঁধে ফেললেন–গোপিকোখলে দাম্ন ববন্ধ প্রাকৃতং যথা। আর ঈশ্বরের কী অবস্থা? রবীন্দ্রনাথ কোথাও বলেছিলেন–যিনি মুক্ত, তিনি আসতে চান বন্ধনের মধ্যে। মর্ত জননীর পরিশ্রম দেখে তিনি নিজে ধরা দিলেন মায়ের স্নেহবন্ধনের রজ্জুতে দৃষ্টা পরিশ্রমং কৃষ্ণঃ কৃপয়াসীৎ স্ববন্ধনে। চৈতন্যপন্থীরা তৃপ্ত হলেন এই ভেবে যে, পরম ঈশ্বর–তত্ত্ব বাৎসল্য–রসের বশীভূত হলেন। তিনি ঈশ্বর থাকলেন না, তিনি মানুষ হয়ে আনন্দ পেলেন। ভাগবত পুরাণে দেখছি–পাণ্ডব-জননী কুন্তীর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছে কৃষ্ণের। তিনি যুবক কৃষ্ণকে দেখে মন্তব্য করছেন–আমার ভাবতে ভারি মজা লাগে যে, যাকে ভয়ও নাকি ভয় পায়, সেই তুমি যখন মায়ের-বন্ধন রঞ্জুতে আবদ্ধ হয়ে মাথা নীচু করে কাঁদছিলে আর ক্রোধাবিষ্ট মাকে দেখে ভয় পাচ্ছিলে–সেই দৃশ্যটা ভাবতে আমার ভারি মজা লাগে।

 হয়তো কৃষ্ণজীবনের এই কাহিনীগুলির পিছনে অন্য কোনও গূঢ় তত্ত্বও আছে। হয়তো এই গাছ-গাড়ি আর পূতনার কাহিনী রূপকথার কল্পমাত্র। কিন্তু ছিটে-ফোঁটা পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে চাইলে এর মধ্যেই রিলিজিয়নের মোবিলিটি লক্ষ্য করা যেতে পারে। বলা যেতে পারে–কৃষ্ণের জন্মকালে প্রকৃতির নানা স্বরূপকে মানুষ যেভাবে পুজো করত, সেই প্রকৃতি পূজার ভাঙন শুরু হয়েছে শকট-ভঞ্জন, যমলাৰ্জুনভঙ্গের মধ্য দিয়ে। বাস্তবিকই আমরা হরিবংশের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি যে, যমলাৰ্জুন ভগ্ন হবার পর গোপবৃদ্ধরা এই অদ্ভুত ভগ্নবৃক্ষ দেখার জন্য সবাই এসে জমায়েত হল। তারা মন্তব্য করল–জল্পতুস্তে যথাকামং–কী আশ্চর্য ঘটনা! এই বৃক্ষ দুটি আমাদের গয়লা-লোকেদের কাছে মন্দিরের মতো ছিল, সেই গাছ দুটিকে ভাঙল কে–কেনেমৌ পাতিতৌ বৃক্ষৌ ঘোস্যায়তনোপমৌ। কোথাও ঝড় হয়নি, বৃষ্টি হয়নি এমনকি বিদ্যুৎপ্রপাত–একটা বাজও পড়েনি। এমনও বলতে পারি না যে, বন থেকে হাতি এসে এই গাছ দুটো ভেঙে দিয়েছে। তাহলে কে এই গাছ দুটি ভাঙল–

বিনা বাতং বিনা বর্ষং বিদ্যুৎ–প্রপতনং বিনা।
 বিনা হস্তিকৃতং দোয়ং কেনেমৌ পাতিতৌ মৌ।।

 যে বৃক্ষ-দুটিতে ব্রজবাসীদের দেবতার প্রতিষ্ঠা, সেই বৃক্ষ-দুটিকে তারা যেমন ভালও বাসত, তেমনি ভয়ও পেত। তারা বলতে থাকল–হায়! আজ থেকে এই শিকড়-উপড়ে যাওয়া অর্জুন গাছ দুটি আর ব্রজের শোভাবর্ধন করাবে না! নন্দ-গোপকে ডেকে গোপ বৃদ্ধরা জানাল–ভাই নন্দ! এতকাল যদি এই গাছ দুটি এখানে আমাদের সকলের কল্যাণ বিধান করে থাকে–যদিমৌ ঘোষ–রচিতৌ ঘোষ-কল্যাণ-কারিণৌতবে এ দুটো উপড়ে পড়ার ওপরেও তোমার মঙ্গল করে গেছে। কেননা এত বড় গাছ হওয়া সত্ত্বেও গাছ-দুটি তোমার ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছেনন্দলোপ প্রসন্নৌ তে দ্রুমাবেব গতাকপি।

 বেশ বোঝা যায় ব্রজবাসীরা অর্জুন বৃক্ষ দুটির মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠা করেছিল– ঘোষরচিতৌ–এবং দিব্য-জ্ঞানে এই বৃক্ষ দুটির পূজাও করত। আবার শকট-ভঞ্জনের পর আমরা বিষ্ণু পুরাণেও দেখেছি যে জননী যশোমতী সন্ত্রস্ত হৃদয়ে ফুল-ফল এবং দই-খই দিয়ে শকটপূজা করেছিলেন–শকটং চার্চয়ামাস দধি-পুষ্প-ফলাতৈঃ।

এই দুটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে, ব্রজবাসীরা এই ধরনের পূজায় অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণের জন্মের পর থেকেই প্রকৃতি-পূজার এই নিসর্গ প্রত্যয়গুলি আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। শকট-ভঞ্জন অথবা বৃক্ষ-ভঞ্জন কৃষ্ণ-জীবনের ক্ষেত্রে যতখানি বাস্তব, তার থেকেও এর ধর্মীয় ইঙ্গিত বেশি। আগে যে পূজা-পর্ব, আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল, কৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব সেই সব পূজা-পার্বণ আচারের ওপর নিজের প্রতিষ্ঠা ঘটাচ্ছে। সর্বত্র একটা পরিবর্তন আসছে। সে পরিবর্তন আসছে বিশ্বাসে, কথায়, সমাজে, রাজনীতিতে এবং এই সমস্ত পরিবর্তনেরই মাথায় চেপে বসে আছেন সেই অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব, যার নাম কৃষ্ণ, পূতনা-বধ, শকট-ভঞ্জন এবং অর্জুন-বৃক্ষ পাতিত হবার পর যার নতুন নামকরণ হল দামোদর। বালচরিত নাটকের বুড়ো গয়লা সোচ্ছ্বাসে তার ভাগনেকে জানিয়েছে যে, এইসব বড় বড় ঘটনার পর বোঝা গেছে যে এই বালক মহাপরাক্রমশালী, অতএব সবাই তাকে এখন প্রভু বলে মেনে নিয়েছে, এখন থেকে সেই আমাদের মোড়ল–ততে গোপজনৈরুক্ত–মহাবলপরাক্রমমোদ্য প্রভৃতি ভর্তৃদামোদর নাম ভবতু ইতি।

মাথুর বসুদেব যখন তাঁর পুত্রটিকে গোপ নন্দের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন–বালকটির গতি কী হবে। নন্দ অকপটে জানিয়েছিলেন–ও আমাদের ঘোষ পল্লীর মোড়ল হবে–অস্মাকং ঘোষস্য পতি ভবতি। নন্দের আশা বা স্বপ্ন এখন সার্থক, তার ছেলে এখন ভর্তা দামোদর। ব্রজবাসীদের সে ভরণ করে সবার সুখ-দুঃখে সেই এক সুসহায়।

.

৮৮.

আগেই জানিয়েছি, যারা তিন-চার রকমের কৃষ্ণ-তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, আমি তাদের দলে নেই। মথুরা-দ্বারকার পরম ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিত্বকে যাঁরা বৃন্দাবনের মোহন কৃষ্ণের সঙ্গে মেলাতে পারেন না, তাদের কূট বুদ্ধিকে আমরা শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তাদের সাধারণ বুদ্ধি নেই, হৃদয়ও নেই। বস্তুত বৃন্দাবনে নন্দ গোপের গৃহে মানুষ হওয়া কৃষ্ণকে এতটা নবনীত-কোমল ভাবার কোনও কারণ নেই, যাতে করে মথুরা-দ্বারকার কৃষ্ণের সঙ্গে তাকে বেমানান লাগে। বৃন্দাবনে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তাতে অঘাসুর-বকাসুর অথবা পূতনা-তৃণাবর্তের চেহারায় আপনাদের বিশ্বাস নাই থাকতে পারে। কিন্তু মথুরারাজ কংসকেও এমন কোমল-স্বভাবের রাজা ভাবার কারণ নেই যিনি শত্ৰুপ্রতিম বসুদেবের সন্তানকে প্রোষিত জেনেও নিশ্চেষ্ট বসে থাকবেন। অর্থাৎ অসুরের সংখ্যাতত্ত্বে না গিয়ে এটাই বলা ভাল যে, কৃষ্ণ বিপদগ্রস্ত হচ্ছিলেন বারবার।

বস্তুত বৃন্দাবনে গোপগৃহের সমাদর-পুষ্ট বালকটির জীবনে ছোটবেলা থেকেই যে সব অসুর-রাক্ষসদের আমদানি হচ্ছে, তাতে খুব বিশ্বাস না করে কীভাবে তার ব্যক্তিত্বের পরিণতি ঘটছে, সেটাই ভাল করে বুঝে নেওয়া ভাল। বালচরিত নাটকে দেখেছি–যমলাৰ্জুন বৃক্ষ ভগ্ন হবার পর থেকেই বৃন্দাবনের মানুষরা কৃষ্ণকে ভর্তৃ-দামোদর বলতে আরম্ভ করেছে। এই ভর্তা বা ভরণ-পোষণ করার মতো একটা যোগ্য পদবি কৃষ্ণের ভাগ্যে একদিনে জোটেনি। তিনি কটি অঘাসুর-বকাসুর বধ করেছেন, সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু বৃন্দাবনে যারা অন্য জায়গা থেকে এসে উপদ্রব করত, তাদের তিনি প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে বৃন্দাবনের মানুষদের মনে চিরাচরিত বিশ্বাস–শকট-পূজা, বৃক্ষ-পূজা এগুলোর মূলে আঘাত করে কৃষ্ণ তাদের নিজস্ব ব্যবহারিক জীবনকে অনেক বড়, অনেক শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিণতি ঘটছিল এইভাবেই।

লক্ষণীয়, হরিবংশ এবং বিষ্ণুপুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণেও কৃষ্ণের এখন একটা নতুন নাম হয়েছে। অর্থাৎ সেই দামোদরস চ তেনৈব নাম্না তু কৃষ্ণো বৈ দামবন্ধনাৎ। সকলেই তাকে এখন দামোদর বলে ডাকে। কিন্তু বালচরিত নাটকে তিনি এখন শুধু দামোদর নন, ভত্ত্ব দামোদর। যমলাৰ্জুন-ভঙ্গের পর কৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব যতখানি মর্যাদায় আরোহণ করেছে, সেই মর্যাদা আস্তে আস্তে পরিণতি লাভ করেছে কালিয়-দমনের ঘটনায় এবং এরও পরে কৃষ্ণের ভর্তা বিশেষণটি চরমভাবে সার্থক হয়ে উঠেছে ইন্দ্র-যজ্ঞের নিষিদ্ধতায়।

কৃষ্ণের বাল্য-কৈশোরের নানা বীর-কাহিনীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনী হল কালিয়-দমন। কারণ কালিয় কংসের প্রেরিত কোনও অসুর-রাক্ষস নয়, সে নিজেই মূর্তিমতী বিপন্নতা। প্রবাহিনী যমুনার যে জল সমস্ত বৃন্দাবনবাসীর জীবনদায়িনী, সেই যমুনার জল বিষাক্ত করে তুলেছে কালিয়। কালিয়র পরিচয় হলসে নাগরাজ। ভয়ঙ্কর বিষ তার মুখে, শরীরে। যেখানে সে থাকে, সেখানে জনমানব তো আসেই না, এমনকি কোনও পশু-পক্ষীও তার ধারে কাছে আসে না–ন গোপৈ–গোধনৈর্বাপি তৃষ্ণার্তৈরুপযুজ্যতে।

নাগরাজ কালিয়কে কৃষ্ণ প্রাণে মারেননি, তাকে ঘরছাড়া করেছিলেন। পৌরাণিকেরা কালিয়-দমনের বৃত্তান্ত নিয়ে বিচিত্র কাব্যশোভা তৈরি করেছেন, নাটকীয়তাও বাদ যায়নি। ভাগবত পুরাণে দেখছি–কৃষ্ণের বয়স তখন কৈশোরগন্ধি। গোরু চরানোর জন্য গোপ-বালকদের নিয়ে তিনি এ বনে সে বনে ঘুরে বেজম। এই গোচারণের সময় সদা-সর্বদা তার সঙ্গী থাকেন দাদা বলরাম, যিনি রোহিণীর গর্ভজাত বসুদেবের পুত্র। যেদিন কৃষ্ণ কালিয়ের আবাসের কাছাকাছি হলেন, সেদিন বলরাম তার সঙ্গে ছিলেন না। বিষ্ণুপুরাণও তাই বলেছে– একদা তু বিনা রামং কৃষ্ণো বৃন্দাবনং যযৌ। বিষ্ণুপুরাণে দেখছি–কালিয়ের বিষময় অত্যাচারের কথা কৃষ্ণের জানা ছিল এবং কালিয়ের আবাস দেখামাত্রই তাকে শাস্তি দেবার কথা মনে হয় তাঁর–তদস্য নাগরাজস্য কর্তব্যো নিগ্রহো ময়া।

ভাগবত পুরাণে ঘটনাটা একটু নাটকীয়-কৃষ্ণ তাঁর সখাদের সঙ্গে গোরু চরাতে চরাতে যমুনার জল-ধোয়া এক নির্জন বনপ্রান্তে এসে পড়েছেন। গরমের সময়। সকলেই তৃষ্ণায় কাতর। এমনকি গোরুগুলোরও জল খাওয়া প্রয়োজন। অবশ্য এদের কাউকেই আর জল খাবার নির্দেশ দিতে হয়নি। আকুল তৃষ্ণাই তাদের যমুনার জলে জল খেতে নামিয়েছে–দুষ্টং জলং পপুস্তস্যা–তৃষ্ণার্তা বিষদুষিত। আর যায় কোথা! কালিয় নাগের বিষে সেই জায়গার জলরাশি বিষদগ্ধ হয়েই ছিল। জলপান করতেই গোরু-বাছুর এবং কৃষ্ণ-সখারা ঢলে পড়ল যমুনার তীরে। তাদের দেহ থেকে প্রাণই চলে গেছে। গোরু এবং গোপালক বন্ধুদের অবস্থা অন্তরের যোগবিভূতিতে বুঝতে পারলেন কৃষ্ণ। অমৃতবর্ষিণী দৃষ্টির প্রসাদে কৃষ্ণ তাদের বাঁচিয়ে তুললেন–ঈক্ষয়ামৃতবর্ষিণ্যা সনাথান্ সমজীবয়ৎ। ঈশ্বরের লীলাবশে গোপ-বালকেরা কৃষ্ণের অন্তরশায়ী ঐশ্বর্যের কথা কেউ বুঝতে পারল না, কারণ ঐশ্বর্য বুঝলে সখ্যরসের ব্যাঘাত ঘটত। অতঃপর কালিয় দমন। ভাগবত পুরাণে সে কাহিনীতে রসবত্তার সঙ্গে কৃপা-মাধুর্যের মিলন ঘটেছে, অতএব তার জন্য আমাদের অন্যত্র রসিক হয়ে উঠতে হবে। এখানে নয়।

এখানে আমরা কৃষ্ণের ঐতিহাসিক পরম্পরা নিয়ে ব্যস্ত আছি। অতএব আমাদের ভাবনাটা ইতিহাসের দিক থেকে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, কালিয় হলেন নাগদের রাজা! যমুনার একটি অঞ্চলে তিনি থাকেন এবং সমস্ত পুরাণেই দেখা যাচ্ছে তিনি সর্পভোজী গরুড়ের ভয়ে যমুনার নিরুপদ্রব বসতিতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এ খবরটা কৃষ্ণেরও অজানা নয়।

এই সামান্য তথ্যসূত্র থেকেই আমাদের ইতিহাসের পথে যেতে হবে এবং সেটা বেশ কঠিন। তবু কথাটা কি, ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের সংবাদ কখনই সহজ সরল উপায়ে আমরা লাভ করিনি। বিশেষত আমাদের বিষয় এতই প্রাচীন যে, সেখানে সাহিত্যের পদ-পদার্থগত মাধ্যম ছাড়া কৃষ্ণ-জীবনের নানা কাহিনীর ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করা আমাদের পক্ষে খুব কঠিন। কালিয়–নাগের কাহিনীর মধ্যে থেকে পৌরাণিকদের রসবত্তার প্রলেপটুকু সরিয়ে দিলে যেটুকু বিষ্ণুপুরাণে, ভাগবত পুরাণে পড়ে থাকে, তাতে করে ঐতিহাসিকতার বিচার করা যায় না। বরঞ্চ এ বাবদে হরিবংশ পুরাণ অনেক ভাল।

তবে হরিবংশের কথা আরম্ভ করতে হবে একটু আগে থেকে, নইলে ইতিহাসটা ঠিক বোঝা যাবে না। হরিবংশে দেখবেন–পূতনা-বধ, শকট-ভঞ্জন এবং যমলাৰ্জুন-ভঙ্গের পর ব্রজবাসীরা সেই জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছেন। হরিবংশে এই স্থান-পরিবর্তনের মধ্যে একটু অলৌকিকতাও আছে। কিন্তু এ বাবদে বিষ্ণুপুরাণের বক্তব্য একেবারেই উঁছা-ছোলা। বিষ্ণুপুরাণে যমলাজুন-বৃক্ষ ভেঙে পড়ার পরেই নন্দ গোপ এবং ব্রজবৃদ্ধরা পারস্পরিক আলোচনা করে–গোপবৃদ্ধাস্ততঃ সর্বে নন্দগোপপুরোগমাঃ–ঠিক করলেন–এখানে আর থাকব না ভাই! যা সব উৎপাত আরম্ভ হয়েছে। পূতনা মারা গেল, বিনা কারণে শকট ভেঙে পড়ল। হাওয়া নেই, ঝড় নেই, গাছ ভেঙে পড়ল। এ সব উৎপাত নিয়ে আর এখানে থাকা যায় না। আমরা অন্য কোনও এক মহাবনে আস্তানা বসাই চলো–স্থানেনেহ ন নঃ কাৰ্য্যং গচ্ছামোন্য মহাবনম্।

নন্দগোপ থেকে আরম্ভ করে সকলে অন্য যে জায়গাটিতে এসে নতুন আস্তানা গাড়লেন, সেই জায়গাটাই হল বৃন্দাবন। আমরা পূর্বে স্থানসাম্যে পুরাতন জায়গাটিকে বৃন্দাবন বলেছি বটে, তবে সেটা নিতান্তই বৃন্দাবন থেকে কাছে বলে, অপিচ নন্দগোপের আবাস চিরন্তনভাবে বৃন্দাবনে চিহ্নিত হয়েছে বলেই বিষ্ণুপুরাণ বা হরিবংশ পূর্বে নন্দ গোপের বসতিস্থলের কোনও ঠিকানা দেননি। যাই হোক এই বৃন্দাবন হল আসল ঠিকানা।

লক্ষ্য করে দেখবেন–নতুন একটা বসতিস্থাপনের কথা সর্বত্রই স্বীকার করা হচ্ছে। বৃন্দাবনে বেশ বড় একটা জায়গা জুড়ে ঘোষেরা বসতি স্থাপন করল এবং তাদের জীবিকার গোরুগুলি রাখবারও সুবন্দোবস্ত করা হল

ততঃ ক্রমেণ ঘঘাষঃ স প্রাপ্তো বৃন্দারনং বনম্।
নিবেশং বিপুলং চক্রে গবাং চৈব হিতায় চ৷৷

ঘোযপল্লীর গোরুর গাড়িগুলি দুইদিকে সাজিয়ে একটি অর্ধচন্দ্রাকার সীমারেখাও তৈরি করা হল এবং সম্পূর্ণ অধিকৃত জমির পরিমাণ দাঁড়াল মাঝখানে প্রস্থে এক যোজন এবং আয়তনে দুই যোজন। চারদিকে কাটাগাছ আর বড় বড় গাছ লাগিয়ে অপরিচিত জনের প্রবেশপথ নিরুদ্ধ করা হল–কণ্টকীভিঃ প্রবৃদ্ধাভিস্তথা কণ্টকিতমৈঃ।

এরপর হরিবংশে ঘোয-পরিবারের নতুন করে সংসার পাতার বর্ণনা আছে। দুধ-দই, ঘি-মাখন তৈরি করার জিনিস, মন্থন-দণ্ড, রজু আর গোশকটের আকীর্ণ বর্ণনায় হরিবংশের দশ পনেরোটা শ্লোক ব্রজবাসীদের সংসারের খুঁটি-নাটি তুলে ধরেছে। বর্ষাকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনাও এখানে আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা প্রণিধানযোগ্য, সেটা হল–কৃষ্ণ ছোট ছিলেন বড় হয়েছেন। তিনি এখন একা একা ঘুরে বেড়ান কখনও বা বন্ধুদের সঙ্গেও গরু চরাতে আসেন।  

 এই গোরু চরানোর ব্যাপারটাও কিন্তু নিস্তরঙ্গ কর্তব্যসাধনমাত্র ছিল না। কৃষ্ণের গোপালক বন্ধুরা রীতিমতো তানপুরা, বীণা-টিনা নিয়েই গোরু চরাতে আসে। কৃষ্ণের হাতে যেন একটি বাঁশী দেখছি, একটি ময়ূর-পুচ্ছও দেখছি তার কণ্ঠসূত্রের সঙ্গে লাগানো আছে। তিনি কখনও গান করছেন, কখনও খেলা করছেন, কখনও তালপাতার বাঁশী বানিয়ে বাজাচ্ছেন–কচি গায় ক্কচিৎ ক্রীড়ংশ্চৰ্য্যংশ্চ কচি ক্কচিৎ।

বোঝা যাচ্ছে কৃষ্ণের মধ্যে নতুন এক ব্যক্তিত্বের স্পর্শ লেগেছে, হয়তো বা তিনি একটু রোম্যান্টিকও হয়ে উঠছেন। ভাগবত পুরাণে এখন কৃষ্ণের মধুর রূপ আরও মধুরতর হয়ে কবি–কল্পের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, কিন্তু হরিবংশে এখনও বাস্তববোধ এবং ইতিহাসবোধটুকু চলে যায়নি। দেখতে পাচ্ছি–কৃষ্ণ একদিন গোরু চরাতে চরাতে এবং খেলা করতে করতে যমুনার তীরে এসে পড়েছেন।

এর আগে যে বৃন্দাবনের বর্ণনা আছে, তাতে কোথাও যমুনার উল্লেখ নেই। এখন যমুনার জলরাশির মোহন রূপে কৃষ্ণকে প্রায় মোহগ্রস্ত দেখছি। কৃষ্ণ দেখতে পেলেন–যমুনায় নামবার জন্য ঘাট আছে এখানে। জলের স্বাদও অতি চমৎকার। বোঝা যায়কৃষ্ণ এসব আগে দেখেননি। বেশ কয়েকটি শ্লোকে এখানে যমুনার বর্ণনা করা হয়েছে রমণী-শরীরের সারূপে। কিন্তু এমন সুন্দর যমুনা এবং যমুনার তীর বৃন্দাবনবাসী গোপজনের ভোগর আওতায় আসেনি।

তীরের কাছাকাছি যমুনার প্রবাহ কিছু ক্ষীণ এবং সেইজন্যেই যমুনার মধ্যে একটা জায়গায় চরা পড়েছে। সেটা অবশ্য তীরভূমির কাছাকাছি। কৃষ্ণ জানেন এই হ্রদের এলাকায় নাগেরা বাস করে এবং তারা থাকে তীরভূমিতেই–দুঃখোপসৰ্পং তীরে সসর্পৈ বিপুলৈ বিলৈঃ। বস্তুত সাপেরা জলে এবং গর্তে বাস করে বলেই হয়তো এই হ্রদ এবং বিলের উচ্চারণ। কিন্তু আমাদের ধারণা, এরা ঐতিহাসিক নাগ জনজাতি। তাদের আস্তানা বা বসতি-স্থান হয়তো আর্যদের মতো নয় বলেই এই হ্রদ আর বিলের কল্পনা। জায়গাটা এখানকার নতুন আবাসিক ঘোষদের অগম্য ছিল বলেই হরিবংশকার বারবার বলেছেন যে, সাপের বিষের তাড়নায় এখানে কেউ যেতে পারে না। পশুপক্ষীও যায় না, এমনকি আর্যদের যজ্ঞ-সবনপ্রার্থী দেবতারাও এই স্থান সযত্নে পরিহার করেন–উপভোগৈঃ পরিত্যক্তং সুরৈখ্রিষবনার্থিভিঃ।

এই একটিমাত্র পংক্তি–দেবতারা এই স্থান ত্যাগ করেছেন–এই নিন্দাপংক্তি থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জায়গাটা আর্যপ্রায় মনুষ্যের আওতায় ছিল না। এটি ছিল সম্পূর্ণ নাগ জনজাতির দখলে। হরিবংশ আরও বলেছে বৃন্দাবনের উত্তরদিকে এক ক্রোশ জায়গা শুধু ছিল যেখানে ওই সর্পতুল্য নাগদের বিষাগ্নির জ্বালা পৌঁছত না–ব্রজস্যোত্তরতস্তস্য ক্রোশমাত্রে নিরাময়ে। কিন্তু তার পরেই নাগদের বসতি। অনুমান হয়–এই নাগদের বসতি পেরিয়ে তবেই যমুনায় পৌঁছনো যেত। কিন্তু ঘোযপল্লীর নতুন আবাসিকদের কাছে এই যমুনা নদী ছিল ভীষণ প্রয়োজনীয় এবং সেখানে সবচেয়ে সহজে পৌঁছতে হলে এই নাগদের বসতিটি উচ্ছিন্ন হওয়া দরকার।

কৃষ্ণ এই দরকারটা বুঝেছিলেন, ব্রজবাসীদের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনাও কিছু হয়ে থাকবে হয়তো। কৃষ্ণ খুব ভালভাবেই জানতেন যে, যমুনার তীরভূমি-ঘেঁষা এই হ্রদে নাগরাজ কালিয় বাস করেন। তার গায়ের রঙ কালো কাজলের মতো। চিরশত্রু খগরাজ গরুড়ের ভয়ে তিনি এসে এই যমুনার জলে আশ্রয় নিয়েছেন

অস্মিন্ স কালিয়ো নাম কালাঞ্জনচয়োপমঃ।
উরগাধিপতিঃ সাক্ষাত্ হ্রদে বসতি দারুণঃ।
উৎসৃজ্য সাগরাবাসং যো ময়া বিদিতঃ পুরা।

 আমরা এর আগে জানিয়েছি যে, এই সর্প-নাগেরা কোনও সরীসৃপজাতীয় প্রাণী নয়, এরা সেকালের আর্যভূমিতে পূৰ্বাধিকারী নাগ জনজাতি। পণ্ডিতজনেরা কেউ তাদের অসুরগোষ্ঠীর অন্যতম মনে করেছেন কেউ তাদের তুরাণী-গোষ্ঠীর নাগ-পূজক জনজাতি ভেবেছেন, আবার কেউ বা তাদের সাধারণ মানুষই ভেবেছেন আমাদের মতো। আর সত্যিই তো মানুষ না ভাবার কোনও কারণও নেই। এই মহাভারতেই দেখব–স্বর্গের ইন্দ্ৰসারথি মাতলি তার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে এসে কোথাও তার উপযুক্ত পাত্র পেলেন না; শেষে নাগলোকের এক নাগ-বরের সঙ্গে মাতলির মেয়ের বিয়ে হল। এরকম বিবাহ-সম্বন্ধ আরও কত হয়েছে। অর্জুনপত্নী উলুপীর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, ভারতবর্ষে নাগ-জন-জাতির সঙ্গে সখ্যর উদাহরণ আছে কত। অবশ্য শত্রুতার উদাহরণও কম নেই।

এখানে এই মুহূর্তে যেটা দেখছি–তা হল নাগরাজ কালি গার্যভূখণ্ডের একটি স্থানের পূর্বাধিবাসী। জলের কাছে নদীর সামনে তার বাস। যে ঘোষের এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় আস্তানা গাড়ল তাদের মধ্যে পশুপালক গোপালক আর্য-জাতির চরৈবেতির মর্ম মেশানো আছে। কিন্তু তাদের এখন আরও জায়গা দরকার। জলের জন্য দরকার যমুনার তীরভূমির সেই অংশটি যেখানে পূর্বেই ঘাট বাঁধানো আছে। সবচেয়ে দরকার ঘোষপল্লীর কাছে যমুনা যাবার সবচেয়ে সহজ পথটি।

হরিবংশে দেখতে পাচ্ছি–নাগরাজ কালিয় সোজা মানুষ নন। হতে পারে–খগরাজ গরুড়ের তাড়া খেয়ে তিনি পালিয়ে এসেছেন এখানে। কিন্তু নিজভূমিতে তার অখণ্ড প্রতাপ। আমরা আগে জানিয়েছি–নাগগোষ্ঠীর জনজাতিরা যেমন সাপের টোটেম ব্যবহার করতেন, তেমনি খগ-গোষ্ঠীর লোকেরাও ব্যবহার করত পাখির টোটেম। হয়তো খগ বা পক্ষীর টোটেম ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নাগ গোষ্ঠীর জনজাতির চিরন্তন শাশুতিক শত্রুতা ছিল এবং হয়তো তারা খগদের হাতে প্রচুর মারও খেয়েছেন।

কিন্তু যমুনার তীরভূমিতে বৃন্দাবন থেকে এক ক্রোশ পথ পরে কালিয় হলেন অবিসংবাদিত রাজা। কোনও মানুষ এই নাগদের ত্রিসীমানার মধ্যে প্রবেশ করে না বা প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে না। সেইজন্যেই কৃষ্ণ বলেছেন–কালিয় যমুনাকে দূষিত করেছে তেনেয়ং দূষিতা সর্বা যমুনা সাগরঙ্গমা। তবে আসল কথাটি হরিবংশ থেকেই টের পাওয়া যায় এবং সেটা ঐতিহাসিক তথ্য। কৃষ্ণ নাগরাজ কালিয়ের সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে যা দেখেছেন তা হল–বড় বড় ঘাস বনটাকে ছেয়ে রেখেছে একেবারে। ছোট ছোট আগাছা এবং বড় বড় গাছে এই ভূখণ্ড পরিপূর্ণ এবং নাগরাজ কালিয়র বিশ্বস্ত মন্ত্রীরা এই বন সযত্নে রক্ষা করে–রক্ষিতং সর্পরাজস্য সচিবৈরাগুকারিভিঃ।

 অনুমান করা যায়–এরা কেউ আমাদের দেখা সাপের মতো নয়। কৃষ্ণ আরও বলেছেন–এই বনটি যেন আকাশের মতো নিরালম্ব। বিয-মিশ্রিত অন্নের মতো এই বনকে যেন স্পর্শও করা যায় না এবং বনের চতুর্দিকে কালিয়র গুপ্তচরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে– তৈরাপ্তকারিভি নিত্যং সর্বতঃ পরিরক্ষিতম্।

বিষণ্ণমিব দুঃস্পৃশম–বিষমিশ্রিত অন্নের মতো দুস্পর্শ–এই পংক্তিটি থেকে বোঝা যায়–এই বনের মধ্যে ঢোকা মোটেই নিরাপদ নয়। কৃষ্ণ কালিয়র মন্ত্রীদের কথা, গুপ্তচরদের কথা বলছেন বটে, কিন্তু তাদের দেখতে পাচ্ছেন না কোথাও। হয়তো কালিয় এবং তার মন্ত্রীদের এই দুস্পর্শ, অদৃশ্য চরিত্রই তাদের ওপর সর্পের চরিত্রের অনুমান ঘটিয়েছে। কৃষ্ণ একটি হ্রদ দেখতে পাচ্ছেন যার তীরে শৈবাল, পদ্ম এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লতা-বৃক্ষ দেখা যাচ্ছে। আমাদের অনুমান–এটি জলাধার, কোনও হ্রদ নয়, বিস্তীর্ণ বনভূমির মধ্যে এটিই কালিয়র আবাসস্থল, যার পাশে আছে প্রবাহিনী যমুনা। কৃষ্ণকে বলতে হচ্ছে–আমাকে এই হ্রদ পর্যন্ত আসবার জন্য দুই দিক থেকে উপযুক্ত পথ তৈরি করতে হবে–কর্তব্যমাগো ভ্রাজেতে হ্রদস্যাস্য টাবুভৌ। তারপর শাস্তি দিতে হবে কালিয়কে।

হরিবংশের পরবর্তী বর্ণনা বিষ্ণুপুরাণ বা ভাগবত পুরাণের মতোই। তিনি কালিয়-হ্রদে এলেন, কদম-গাছের উচ্চচূড়ে উঠলেন আর ঝাঁপ দিলেন যমুনায়। বাস্! কালিয়র সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেল। কিন্তু এই মনোমুগ্ধকর বর্ণনায় যাবার আগে সাহিত্যের অন্তরে বসে ইতিহাসের তথ্যটুকু সাজিয়ে দিয়েছেন হরিবংশের লেখক-ঠাকুর। কৃষ্ণ বলেছেন–আমি যদি এই নাগরাজকে দমন-নিগ্রহ করি, তবে এই নদীর জল সমস্ত ব্রজবাসীর উপকারে আসবে, ব্রজোপভোগ্যা চ যথা…ভবেচ্ছিবজলাশয়া। উদ্দেশ্য আছে আরও–নাগরাজ দমিত হলে–এইখানে সমস্ত ব্রজবাসী সুখে বিচরণ করতে পারবে এবং এই নদীর সমস্ত ঘাট আমাদের সুখের আশ্রয় হয়ে উঠবে–সর্বত্রসুখসঞ্চারা সতীর্থ-সুখায়াঃ।

 বেশ বোঝা যায়–কালিয়ের বসতি স্থানটি ব্রজবাসীদের ভীষণ প্রয়োজন–শুধু জমির জন্যই নয় জলের জন্যও। তাছাড়া অন্য জায়গা থেকে নতুন জায়গায় এসে কাঁধের ওপর জাতি-শত্রু নিয়ে বাস করা যায় না। অতএব কালিয়কে নিগ্রহ করা দরকার। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে–আর্যায়নের প্রথম কল্পে আর্যরা যখন সপ্তসিন্ধুর ধারে এসে পৌঁছেছিলেন, তখন বৈদিক ঋষির বর্ণনায় আমরা দেখেছি বৃত্রাসুর সর্পের রূপ ধরে সপ্ত সিন্ধুর জল আটকে রেখেছিলেন। বৃত্রকে বার বার সেখানে অহি নামে ডাকা হয়েছে। আর দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা–পুরুষ ইন্দ্র সেই বৃত্ররূপ অহিকে মেরে সপ্তসিন্ধুর ধারা মুক্ত করেছিলেন–যো হত্বাহি অঋণাৎ সপ্তসিন্ধু।

 বেদের এই বর্ণনা-কল্প মাথায় থাকলে কালিয়কে সর্পের টোটেম ধারী নাগগোষ্ঠীও ভাবতে হবে না। বরঞ্চ ভাবা যাবে–এঁরা আর্যদের ভূখণ্ড দখলের পথের কাঁটা, শত্রু। বেদের টীকাকার সায়নাচার্য মিথলজিস্টদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব-বুদ্ধি সম্পন্ন। তিনি একবারও অহি মানে সাপ লেখেননি। লিখেছেন অহিম আহন্তার অর্থাৎ যারা আক্রমণ করে। কালিয়ও তাই। তিনিও আর্যায়নের শত্রু, আক্রমণকারী। তার নিরুপদ্রব বৃক্ষচ্ছায়াসমন্বিত হ্রদ-তুল্য আবাসটি আক্রান্ত হলে, তিনিও পালটা আক্রমণ করবেন–এইটাই স্বাভাবিক।

.

৮৯.

পণ্ডিতেরা বলেছেন–সৌরকুলের দেবতা হলে অমনই হয়। কৃষ্ণের মধ্যে ইন্দ্রের প্রতিচ্ছায়া দেখে অথবা বৈদিক ইন্দ্রের মধ্যে কৃষ্ণের আনটিসিডেন্ট দেখে আমরা যে শুধু সপ্তসিন্ধুর ধারারোধী বৃত্রাসুর, বা অহির কল্পনা করছি, তা শুধু এই ভারতবর্ষেই নয়, সমস্ত পুরাতন সভ্যতাতেই এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাবে। মিরচা এলিয়াদে, যাকে নিয়ে কল্পনায় মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে রচিত হল, সেই মিরচা-মহাশয়ের দু-একখানা তুলনামূলক ধর্মেতিহাস পড়লেই এ বিষয়ে নানা কথা জানা যাবে। অ্যাপোলো যে টাইফঁও নামক নাগরাজকে মেরেছিলেন, সে কথা আমরা পূতনা-রাক্ষসীর নাম–সাম্য দেখানোর সময়েই বলেছি। এবার এলিয়াদের দৃষ্টিতে আরও কিছু কথা।

বস্তুত পৃথিবীর সূর্যসম্ভব দেবতারা সকলেই মহা–মহা সর্পরাজকে মেরেছেন জীবনের কোনও না কোনও সময়ে–এ কথা পৃথিবীর সমস্ত পণ্ডিতেরা এক ধরনের প্যাটার্ন হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তারা বলেছেন–কত উদাহরণ চাই? থ্রাকটাওনা অজি দহককে মেরেছেন, ফেরেসাপা মাথা নুইয়ে দিয়েছেন সর্প–রাক্ষস গান্ডারেওয়ার। এমনকি পরম আবেশের মুহূর্তে খ্রিস্টকেও দেখা যাবে–তিনি এক সর্পরূপী ড্রাগনের গর্ব খর্ব করেছেন। আরও প্রাচীন সভ্যতা মিশরে আসুন। দেখুন, রা পরাজিত করেছেন সাপের মাথাওয়ালা সেবানকে অথবা সাপ-দানো নাককে। উপকথার রাজ্যে মারডুক টিয়ামাটকে জয় করছেন আর স্বয়ং গ্রিক হেরাক্লিস পরাজিত করেছেন জল–সর্প হাইড্রাকে।

গ্রিক পণ্ডিত মেগাস্থিনিস তো হেরাক্লিসের মধ্যেই কৃষ্ণের সন্ধান পেয়েছেন। অতএব কালিয়–নাগের ব্যাপারে আমাদের এই আন্তর্জাতিক প্যাটার্নও খুব ভালভাবেই খাটে। আমরা অবশ্য আমাদের পুরাণ-ইতিহাসের ধারায় কালিয়-দমনের ঘটনাটি বিবৃত না করে পারব না। কৃষ্ণ যখন কদম গাছের ওপর থেকে কালি-দহে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তখন কালিয় জল ছেড়ে ওপরে চলে এল–উদতিষ্ঠজ্জলাৎ সর্পো রোষ–পৰ্যাকুলক্ষণঃ। ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশির মতো তার শরীর। ক্রোধে চোখ লাল হয়ে গেছে এবং পঞ্চমুখে সে বিষাগ্নি উদগিরণ করছে। নাগরাজের স্ত্রীরা, পুত্রেরা এবং তার অনুগত সাপেরাও নাগরাজের সঙ্গে যোগ দিল কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য। তারা সকলে মিলে কৃষ্ণকে কামড়াতে লাগল বটে, কিন্তু হরিবংশঠাকুর মন্তব্য করেছেন যে, কৃষ্ণ তাতে মারা গেলেন না–ন মমার চ বীর্যবান।

 আসলে ঘটনাটা সত্যিই খুব বিপজ্জনক ছিল। কৃষ্ণ একা কালিয়র আবাসে এসেছেন এবং আমরা আগেই দেখেছি কালিয়র বাসস্থান সাধ্যমতো ঘেরা ছিল। সহজপথে তিনি কালিয়র আবাসে প্রবেশ করতে পারেননি বলেই গাছে উঠে তাকে কালিয়র শাসন-সীমা অতিক্রম করতে হয়েছে। তারপর কদমগাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কালিয়র কাছে যেতে হয়েছে। এটা সত্যি মনে হয়, কারণ এইভাবে শত্রু-শিবিরে প্রবেশ করার অভ্যেস কৃষ্ণের আছে। যারা মহাভারতের ঐশ্বর্যশালী কৃষ্ণের সঙ্গে মধুর গোপালক-কৃষ্ণকে মেলাতে পারেন না, তাদের জানাই–এহল সেই একই উপায় বা স্ট্র্যাটেজি যা জরাসন্ধকে হত্যা করার সময় কৃষ্ণ অবলম্বন করবেন। দেখবেন, সেখানেও কৃষ্ণ সোজাপথে আসেননি। দুই পাণ্ডব-ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের এক পাশ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষ্ণ জরাসন্ধের আবাসে ঢুকেছিলেন। এখানেও একই ব্যাপার, শুধু পাহাড়ের বদলে গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কৃষ্ণ। সোজা পথে না ঢুকে অতর্কিতে আক্রমণ–সামগ্রিক কৃষ্ণ-চরিত্রের সঙ্গে এটা বেশ মেলে।

 কৃষ্ণ কালিয়র ডেরায় ঢুকে যাবার পর বৃন্দাবনের মানুষ এবং তাঁর রাখাল বন্ধুরা নন্দরাজ এবং যশোমতীকে খবর দিল, খবর দিল অন্যান্য সবাইকে। তারা ভয়ত্রস্ত হয়ে আকুলি-বিকুলি করতে লাগলেন যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে। কালিয়কে কৃষ্ণ যখন শায়েস্তা করেছেন, তখন তার যা বয়স এবং সেটা পুরাণকারেরা যেমন বলেছেন, তাতে রীতিমতো সন্দেহ জাগাবে যে, ওই বয়সে এমন অদ্ভুত কর্ম করা সম্ভব কিনা। এ বিষয়ে বালচরিত নাটকে ভাস যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে নাটকীয়তার জন্যই হোক অথবা সত্য ঘটনাই হোক কৃষ্ণাকে অনেক বেশি বাস্তবচরিত্র বলে মনে হয়।

বালচরিত নাটকে দেখা যাচ্ছে–কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরামই আগে কালিয়র খবর পেয়েছিলেন। কৃষ্ণকে কালিয়র খবর দিচ্ছে সেই বুড়ো গয়লার ভাগনে দামক! সে কৃষ্ণের কাছে এসে বলছে–বলরামকে বারণ করুন, কত্তা! বারণ করুন। তিনি কালিয়কে রুখতে গেছেন। কৃষ্ণ বললেন–এই কালিয়র কথা আমিও অনেক শুনেছি বটে। তাকে শায়েস্তা করা দরকার বৃন্দাবনের সমস্ত মানুষ এবং গো-ব্রাহ্মণকে সে বড় হেনস্তা করে গোব্রাহ্মণাদয়স্তেন সুহৃষ্যন্তে কিল প্রজাঃ।

গো-ব্রাহ্মণ এবং বৃন্দাবনের মানুষ–এই তিনটি শব্দ শুনলেই আর্য-সভ্যতা; বিরোধী এই নাগ-জনজাতির প্রতিপক্ষতা বেশ সপ্রমাণ হয়ে যায়। যাই হোক, কৃষ্ণ যখন কালিনহের দিকে এগোতে লাগলেন, তখন কৈশোরগন্ধী যুবতীরা বারণ করতে লাগলেন কৃষ্ণকে। গোপপল্লীর মধ্যে যে বালকটি নিজের শক্তি এবং মাধুর্যে এখন ভর্তা দামোদরে পরিণত, সে যে পল্লীবাসিনী রমণীদের কাছে অথবা জনপদবধূর কাছে যথেষ্ট স্পৃহণীয় এক নায়ক হয়ে দাঁড়াবে, তাতে সন্দেহ কি?

বালচরিত নাটকে কৃষ্ণ যখন কালিয়কে শাস্তি দেবার জন্য এগিয়ে চলেছেন, তখন গোপকন্যারা তাঁকে বাধা দিল। গোপকন্যাদের সম্বন্ধে কৃষ্ণের স্বগতোক্তিগুলি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। কৃষ্ণ বলছেন–এই মেয়েরা সরাজের ভয়েই আমার পিছন পিছন আসছে। এদের চোখগুলো চকোরপাখির মতো। এদের শরীরে উদ্ভিন্ন যৌবন, ঠোঁটগুলি কাঁপছে, কেশরাশি আলুলায়িত। ভয়ে ত্রাসে তাদের উত্তরীয়বস্ত্র বিস্রস্ত হয়ে পড়েছে।

কৃষ্ণের স্বগতোক্তির মধ্যে যে নিপুণ দৃষ্টিশক্তি আছে, তাতেই বোঝা যায়–তিনি নায়ক হয়ে উঠেছেন। গোপরমণীরা কৃষ্ণকে যথাসাধ্য বারণ করতে লাগলেন, কিন্তু যতই এই বারণ-বাণী তীব্র হতে থাকে কৃষ্ণের সংকল্পও তত বাড়তে থাকে। কৃষ্ণ কালিয়ার আবাসে প্রবেশ করলেন, কিন্তু লক্ষণীয়, যারা এই অমানুষী যুদ্ধ দেখতে চাইছে–যেমন তাদের মধ্যে একজন সেই বুড়ো গয়লা–তাকে কিন্তু একটি কুম্ভপলাশ গাছে উঠে কৃষ্ণ-কালিয়র যুদ্ধ দেখতে হচ্ছে। যুদ্ধে কালিয়র পরাজয় নেমে আসল ক্রমে ক্রমে। জলের মধ্যে নয়, কৃষ্ণ কালিয়কে ধরে আছাড় মারছেন মাটিতে–এষ প্রসহ্য সহসা ভুবি নিক্ষিপাসি।

আমরা জানি–কালিয়র মাথার ওপরে কৃষ্ণের একটা নৃতরঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে অনেক পুরাণেই। কালিয়র পাঁচটি ফণার ওপর ক্রমান্বয়ে নৃত্য করতে করতে একেবারে মধ্য ফণাটির ওপর তাঁর নাচটা স্টিল হয়ে যায় এবং তখনি সেটা ছবি এবং ভাস্কর্যের বিষয় হয়ে পড়ে। ভাগবতপুরাণে এই নৃত্যভঙ্গির মধ্য দিয়েই কালিয়-দমন সম্পূর্ণ হয় এবং সেখানে শত্রুর দর্পমোচনের সঙ্গে নাগপত্নীদের স্তব কবি-দার্শনিকের হৃদয় বিগলিত করবে। হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং সব পুরাণেই এমনকি বালচরিত নাটকও কালিয়র মাথার ওপর কৃষ্ণকৃত এই নৃত্যের কথা আছে এবং সোজা কথায় এই নৃত্যের অর্থ একদিকে যেমন শত্রুদমনের সম্পূর্ণতা সূচনা করে, তেমনি অন্যদিকে শত্রুদমনে কৃষ্ণের নান্দনিক স্বাতন্ত্র্য রচনা করে।

আমরা জানি–কালিয়দমনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন বসতি বানানো ব্রজবাসীদের রিহ্যাবিলিটেশন–যাতে ব্রজবাসীরা নির্ভয়ে যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলে তাদের অধিকার, পায়নিস্ক্রাসাস্তু সুখং যেন চরেয়ু-ব্রজবাসিনঃ। কৃষ্ণ কালিয়কে মারেননি, তাকে নিষ্প্রভ করেছেন মাত্র। কালিয়কে তিনি যমুনা ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। বালচরিত নাটকে কালিয় স্বীকার করেছেন যে, তিনি যমুনার জল বিষাক্ত করেছেন এবং যাবার সময় তিনি সমস্ত বিষ তুলে নিয়েই চলে যাবেন। সত্যি কথা বলতে কী, এই বিষ-সংহরণ করার মধ্যেই আমাদের জাগতিক যুক্তিগুলি কাজ করতে থাকে। এর আগে কৃষ্ণ তাঁকে অনুরোধ করেন–তুমি আজ থেকে এই বৃন্দাবনের গো-ব্রাহ্মণ এবং বৃন্দাবনবাসী প্রজাদের আর কোনও ক্ষতি করবে না–অদ্য প্রভৃতি গো-ব্রাহ্মণপুরোগাসু সর্বপ্রজাসু অপ্রমাদঃ কর্তব্যঃ।

গো-ব্রাহ্মণ হল আর্য সভ্যতার প্রতীক। নতুন জায়গার পুরাতন আবাসিককে দমন করে গো-ব্রাহ্মণের সুরক্ষার ব্যবস্থা হতেই কৃষ্ণের সঙ্গে ব্রজবাসীরাও নিশ্চিত হয়েছেন। হরিবংশ থেকে আরম্ভ করে ভাগবত পুরাণ, অথবা ভাসের বাচরিত থেকে আরম্ভ করে চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবদের লেখা কাব্য-নাটকে বর্ণিত কালিয়-দমনের উপাখ্যানে কৃষ্ণের বীরতা বা ঐশ্বর্যশালিতার কোনও মূল্য নেই, ঠিক যেমন মূল্য নেই কালিয়র বিষময়তা নিষ্ফল হওয়ার। এমনকি পরাজিত কালিয় যে কৃষ্ণকে ভগবান নারায়ণের স্বরূপ বলে মেনে নিলেন, তারও খুব একটা তাৎপর্য নেই। লিয়-দমনের মধ্যে যেটা সবচেয়ে বড় মুগ্ধতা তৈরি করে সেটা হল পরাজিত শত্রুর প্রতি কৃষ্ণের করুণার মাহাত্ম্য। এমনকি ভাসের বালচরিত নাটকের মধ্যেও কৃষ্ণের একান্ত মনুষ্যোচিত গুণগুলি এমনভাই প্রকট হয়ে উঠছিল, যাতে বলা যায় চৈতন্যপন্থীরা কৃষ্ণের মনুষ্য-মাধুর্য আবিষ্কার করে সাংঘাতিক নতুন কিছু করে ফেলেননি। তার পরম্পরা রয়ে গেছে হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে ভাগবত পুরাণে অথবা বালচরিত নাটকের মানবিক অভিসন্ধিতে।

 হাইনারিখ জিমার, যিনি ভারতবর্ষের প্রাচীন ভারতের শিল্প, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি নিয়ে অসাধারণ কিছু কাজ করেছেন, সেই জিমারের মতে–কৃষ্ণ কালিয়র সঙ্গে এমন কষ্টকর অপমানের ব্যবহার করেননি, যা একজন বিজেতা পুরুষ পরাজিত শত্রুর প্রতি করে থাকে। এখানে কৃষ্ণের ব্যবহারে এমনই এক মধুর মর্যাদা যুক্ত হয়েছে যাতে অন্যদের মতো কালিয়কে মেরে ফেলেননি তিনি। তিনি যা করেছেন, তা হল কালিয়কে তিনি তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিয়েছেন–banishes him to his proper place at the periphery of the cosmos, sending him back to the sea where he belongs.

 বালচরিত নাটকে বা অন্যান্য পুরাণে যেমন দেখছি, তাতে নৃত্যপর ভঙ্গিতে কৃষ্ণ তাঁর পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন কালিয়র মাথায়। কালিয়র বসবাস ছিল সমুদ্রে, কিন্তু তিনি সর্পভোগী গরুড়ের ভয়ে যমুনার আবাস বেছে নিয়েছিলেন। কৃষ্ণ তাঁকে অভয় দিয়ে বলেছেন–তোমার মাথায় আমার পদচিহ্ন আঁকা রইল, নাগরাজ! গরুড় যদি এই পদচিহ্ন দেখেন তবে কোনওদিন তোমার প্রতি বিরূপ হবেন না।

মম পাদেন নাগেন্দ্র চিহ্নিতং তত্ব মূর্ধনি।
সূপর্ণ এব দৃষবৈং অভয়ৰ্থতি প্রদাস্যতি।

 কৃষ্ণকে যাঁরা অবতার হিসেবে মেনে নিয়েছেন, তাঁরা বলেন কৃষ্ণাবতারের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল শত্রুর প্রতি করুণা–প্রকাশ। কিন্তু লক্ষণীয়, শত্রুর প্রতি করুণা প্রকাশের এই বৈশিষ্ট্য যতই উজ্জ্বল হয়ে উঠুক প্রায় সর্বত্রই কৃষ্ণের শত্রুরা কিন্তু সশরীরে হত হয়েছে। এমনকি রূপ গোস্বামী কৃষ্ণকে যে হতারিগতিদায়ক (শত্রু হত হলেও তাকে তার প্রাপ্যের চেয়েও ঊর্ধ্ব গতি যিনি দান করেন) বলে একটা জব্বর বিশেষণ দিয়েছেন, সেটা যতই সার্থক হোক, তাতে পূতনাও জননীর গতি লাভ করতে পারে, অঘাসুর, বকাসুরও মুক্তির পদবি লাভ করতে পারে, কিন্তু তাদের সবাইকে মরতে হয়েছে।

 এই নিরিখে কালিয় কিন্তু এক অসাধারণ ব্যতিক্রম। কৃষ্ণ তাকে মারেননি এবং কালিয়কে তিনি নিজের জন অথবা পরম ভক্তের মর্যাদা দান করেছেন। ভাগবত পুরাণে কালিয় নাগের পত্নীরা স্বয়ং জানিয়েছে যে, কালিয়র মাথায় কৃষ্ণের পদচিহ্ন হল তার অপরিসীম করুণারই অম্লান প্রকাশ। যে পরম পদ লাভ করার জন্য লক্ষ্মী অযুত বৎসর তপস্যা করেন–যায়া শ্রীললনাচরত্তপঃ–সেই পদচিহ্ন তিনি স্বয়ং এঁকে দিয়েছেন কালিয়র মাথায়। এর থেকে বেশি করুণা আর কীই বা হতে পারে। ভাগবত পুরাণে এই ভক্তিবাদী কথা শুনে অন্যেরা হাঁ-হাঁ করে ওঠেন। বলেন–ভাগবতের ওই একই স্বভাব। সব জায়গাতেই কৃষ্ণের করুণা দেখে ভাগবতের স্রষ্টা একেবারে বিগলিত হয়ে ওঠেন। আমরা বলি–তা না হয় হল। কিন্তু ভাসের বালচরিত তো খ্রিস্টীয় ২/৩ শতাব্দীতে লেখা হয়েছে। সেখানে কালিয়র মাথায় পদচিহ্ন নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কথা কেমন করে এল? ভাস তো আর চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণব নন, তিনিই বা কেন কালিয়র মাথায় কৃষ্ণের পদচিহ্ন দেখে এত বিচলিত হলেন।

 আসলে সত্যিই এখানে কৃষ্ণের নলীলা মাধুর্যের পরিসর বেশি। ডেভিড কিংসলে (David Kinsley) সাহেব শত্রুদমনরত অবস্থাতেও তার নৃত্য পরায়ণ ভাবটি দেখে বলেছেন–শুধু এই কালিয়র ব্যাপারেই নয়, যে কোনও দৈত্য রাক্ষসের ক্ষেত্রেই কৃষ্ণের খেলা-খেলা এই ভাবটা কোথাও যেন নষ্ট হয় না। কালিয়কে বাগে পেয়েও এই যে তিনি তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজ-জনের মর্যাদা দিলেন এর মধ্যে কৃষ্ণের মাধুর্যের প্রকাশই ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। কালিয়কে দমন করার সময়েও কৃষ্ণ তাঁর লীলায়িত ক্রীড়া-স্বভাব থেকে একটুও চ্যুত হননি।

কালিয়-দমনের মধ্যে কৃষ্ণের করুণাগুণ এবং মাধুর্যের সরসতা শতমুখে বলেও মিথলজিস্টরা কিন্তু ধর্মীয় ইতিহাসের টিপ্পনীটুকু উল্লেখ করতে ভুললেন না। হাইনরিখ ডিমার লিখলেন–কালিয়কে দমন করার আসল মানে হল–a primitive snake-cult was super seded by the worship of an anthropomorphic divine Saviour.

 কৃষ্ণের কথা শুনে কালিয় যমুনা ছেড়ে চলে গেলেন কৃষ্ণের পদচিহ্ন মাথায় নিয়ে। গৃহ্য মূত্ন তু চরণৌ কৃষ্ণস্যোরগপুঙ্গবঃ। কৃষ্ণ যখন কালিয়–হুদ অথবা আমাদের বিপর্যয়ী ভাষায় কালিদহ থেকে ব্রজের মানুষদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন, তখন সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন গোপকুলপতি নন্দের। তারা বলেন–ধন্য মশাই, আপনি ধন্য যাঁর এইরকম একটি ছেলে আছে। আজ থেকে এই ছেলে হবে আমাদের বিপদের আশ্রয়, আমাদের প্রভু। শুধু আমাদেরই নয়, আমাদের জীবিকা এই গোরুগুলি এবং আমাদের বাসস্থান এই গোষ্ঠভূমিরও রক্ষক, আশ্রয় এবং অধিকারী প্রভু হবে এই তোমার ছেলে

অদ্য প্রভৃতি গোপানাং গবাং গোষ্ঠস্য চানঘ।
আপৎসু শরণং কৃষ্ণঃ প্রভুশ্চায়তলোচনঃ।

 মনে আছে–যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে রাজভয়-ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ নিজের পুত্রকে ত্যাগ করার মুহূর্তে নন্দগোপালকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–একে কেমন করে মানুষ করবে তুমি?–তখন নন্দগোপ বলেছিলেন–ও একবাড়িতে দুধ খাবে, আরেক বাড়িতে ননী, একবাড়িতে দই আরেক বাড়িতে মিষ্টান্ন, অন্য বাড়িতে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে ঘোলের হাঁড়ির দিকে। এককথায় ও হবে আমাদের ঘোষেদের প্রভু।

নিশ্চয় লক্ষ্য করলেন–নাগ জনজাতির এক প্রবল প্রতিপক্ষ প্রতিহত হবার পর আজ সেই বালক সত্যিই ঘোষেদের প্রভু হয়ে গেছেন। ঘোষেরা অন্যের অধ্যুষিত এক ভূখণ্ড অধিকার পেয়ে আজকে নিজেদের আবাস সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত। যমুনার জল তারা আজ স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করছে, শক্ররা এখন আর তাদের গোরুগুলি ধরে নিয়ে যাবে না–তীরে চাস্যাঃ সুখং গাবো বিচরিষ্যন্তি নঃ সদা।

গোপেরা কৃষ্ণের অনেক প্রশংসা করল বটে, কিন্তু তাই বলে তাকে কেউ ভগবান বলে ভাবেনি। তাদের সমস্ত আবেগের মধ্যে কৃষ্ণের মনুষ্যত্ব ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ধরা আছে, যদিও কৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব পরিণত হওয়ায় কৃষ্ণ তাদের কাছে এখন খুবই বড় মানুষ। তারা বলেছে–আমরা গ্রাম্য গয়লা মানুষ–ব্যক্তমেব বয়ং গোপা–আমাদের কৃষ্ণ যেমন ছাই চাপা আগুনের মতো, তার যে এত ক্ষমতা তা আমরা সত্যিই বুঝিনি–মহভূতং ন জানীমচ্ছন্নমগ্নিমিব ব্রজে।

ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণের মহত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য সর্পরাজ কালিয়র অপনয়ন যেমন দায়ী, ঠিক তেমনি দায়ী হল ব্রজভূমির মধ্যে চিরপরিচিত ইন্দ্ৰযজ্ঞের প্রতিরোধ। এই ঘটনাকে মানুষেরা জানেন গোবর্ধন-ধারণের মাহাত্ম্যে। কিন্তু ঐতিহাসিক দিক দিয়ে গোবর্ধন-পাহাড় আপন অঙ্গুষ্ঠে ধারণ করাটা নিশ্চয়ই অলৌকিক শোনাবে, কিন্তু এর পিছনে খুব বড় ঘটনা যেটা সেটা কিন্তু ওই চিরপ্রচলিত এক প্রথা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কতখানি ব্যক্তিত্ব থাকলে গ্রাম্য গোপ-সমাজে এই প্রথা স্তব্ধ করে দেওয়া যায়। কালিয়-দমনের প্রসঙ্গে জিমার যেমন মন্তব্য করেছেন এই ঘটনার মাধ্যমে পূর্বতন নাগপূজার তত্ত্ব নিরস্ত হয়ে কৃষ্ণের মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হল, ঠিক তেমনি গোবর্ধন-ধারণের মাধ্যমে পূর্বর্তন ইন্দ্ৰ-পূজা বন্ধ হয়ে ব্রজবাসীদের আপন জীবিকার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হল।

মনে রাখা দরকার–ইন্দ্র হলেন একজন বৈদিক দেবতা। মহাভারতের যুগে তার মাহাত্ম্য যতই ক্ষীণ হয়ে আসুক, তখনও তার বৈদিক পরম্পরা সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। শুধু তাই নয় বৈদিক দেবতাকুলের মধ্যেও ইন্দ্রের মাহাত্ম বোধহয় সবচেয়ে বেশি। তিনি সমস্ত দেবতার রক্ষাকর্তা এক ক্ষত্রিয় নেতা, তাই শুধু নয়। ঋগবেদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মন্ত্র রচিত হয়েছে ইন্দ্রেরই উদ্দেশে। সে যাই হোক, গোপজনের মধ্যে ইন্দ্রপূজার চল ছিল খুব বেশি। এই পূজা-উৎসবে গোপজনের সার্বিক অংশগ্রহণ এতটাই প্রথাসম্মত ছিল যে আমরা পূর্বে দেখিয়েছি–যেদিন নন্দের ঘরে মৃত শিশুকন্যাটি জন্ম নিল, নন্দ সেই রাত্রেই সেই শিশুর শব-শরীর যমুনায় বিসর্জন দেবার জন্য বেরিয়ে পড়েছেন। এর পিছনে কারণ একটাই। পরের দিন ঘোষেদের বার্ষিক উৎসব ইন্দ্রযজ্ঞের অনুষ্ঠান হবার কথা। সেই উৎসবে গোপজনের মন যাতে মলিন না হয়, সেইজন্যেই নন্দ শিশু-কন্যাকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন। সামান্য শোক করবার মতোও অবকাশ পাননি তিনি। ঘোষেদের কাছে ইন্দ্রযজ্ঞের মহিমা বা আড়ম্বর এতটাই।

হরিবংশের বৃত্তান্ত অনুযায়ী কৃষ্ণ যে সময় কালিয়-দমন করেছেন, সে সময়টা বর্ষাকাল চলছিল। এখন বর্ষাকাল চলে গেছে–ব্যতিতৌ স্ম বার্ষিকৌ। এর মধ্যে কংসের পাঠানো দু-একটি তথাকথিত অসুরবধও হয়ে গেছে। ধেনুকাসুর আর প্রলম্ব–এদের একজনের চেহারা গর্দভের মতো অন্যজন মানুষের রূপ ধরতে ওস্তাদ–এরা দুজনেই মারা পড়ল বৃন্দাবন-সংলগ্ন তালবনে এবং ভাণ্ডীর বনে। আমাদের মতে এরা কংসের চর নাও হতে পারে। হয়তো এই তালবনে, ভাণ্ডীবনে এদেরই পূৰ্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল; এরা মারা যেতে–হরিবংশে দেখছি ঘোষেদের গোরু চরানোর অনেক সুবিধে হয়েছে। তারা নতুন জায়গায় নির্ভয়ে বিচরণ করছে–বীতশোকভয়ায়াসাশ্চর্যন্ত সমস্ততঃ।

বর্ষার দুই মাস চলে যেতেই রাখালদের বার্ষিক উৎসব ইন্দ্রযজ্ঞের সময় এসে গেল। লক্ষণীয়, শরৎকালে যখন পাকা ধান ঘরে ওঠে, তখনি এই পূজার সময়। পণ্ডিতেরা এর মধ্যে ফার্টিলিটি কাল্ট দেখতে পাবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, অনেকে আবার ইন্দ্রপূজার উপাচারের ফ্যালিক কাল্ট ও নজর করবেন। কারণ এই পূজার সময় গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বংশদণ্ড পুঁতে তার চারপাশে কাপড় জড়িয়ে পূজা করা হয়, সেটাকেই ইন্দ্ৰধ্বজ বলা হয়। ধ্বজ অর্থ আপনারা জানেন এবং ধ্বজপূজাকে ফ্যালিক ওয়ারশিপের মধ্যে পরিগণনা করতে পণ্ডিতদের আয়াস আছে স্বাভাবিক কারণেই।

 আমাদের দৃষ্টিতে এই ফার্টিলিটি বা ফ্যালিক কাল্ট-এর মতো পণ্ডিতী বিষয় আপাতত দূরে থাকুক। আমরা ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণের গুরুত্ব লাভের পরম্পরা ব্যাখ্যায় ব্যস্ত আছি। মনে রাখা দরকার, যারা মথুরা-দ্বারকার কৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনের-কৃষ্ণকে মেলাতে পারেন না, তাদেরই মনে রাখা দরকার–একটি মানুষ শুধু কংস-জরাসন্ধকে প্রতিহত করে ঐতিহাসিকতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না এবং এই ঐশ্বর্যশালিতারও একটা পরম্পরা আছে। আমরা মনে করি বৃন্দাবনেই সেই পরম্পরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা মনে করি–রাজশক্তি এবং পররাষ্ট্রনীতির কৌটিল্য-বুদ্ধি হৃদয়ে থাকলে একটি কংস বা একটি জরাসন্ধকে প্রতিহত করা অনেক সহজ, কিন্তু একটি সমাজ-সচল প্রথাকে স্তব্ধ করে দিয়ে অন্য প্রথা চালিয়ে দেওয়াটা অনেক কঠিন। মানুষ দীর্ঘকাল ধরে যা বিশ্বাস করে আসছে, যে বিশ্বাসের ওপর তাদের জীবন এবং জীবিকা ভিত্তি করে আছে, সেই বিশ্বাসকে উম্মলিত করে নতুন প্রথার প্রস্তাবনায় অনেক বেশি ব্যক্তিত্ব লাগে।

আমরা আগে দেখেছি–শকট-পূজা, বৃক্ষ-পূজা এমনকি জিমারের দৃষ্টিতে নাগপূজাও প্রতিহত হয়েছে কৃষ্ণের ব্যক্তিত্বে। এই ব্যক্তিত্ব এতটাই যে জে. এন. ব্যানার্জির মতো মহাপণ্ডিত বলতে বাধ্য হবেন যে, পূর্বর্তন শকট-বৃক্ষ নাগের ঘটনাগুলি আসলে–accounts of the subjugation of some of the lower cults by the higher one which was soon to be accepted as authoritative by the orthodox Vedic section of the people. এই ব্যক্তিত্ব কি মথুরা-দ্বারকার কৃষ্ণের চেয়ে কিছু কম হল যে, বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে আলাদা মানুষ বলব?

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *