০৮০. শারদণ্ডায়নীর উপাখ্যান

৮০.

পাণ্ডু কুন্তীর কাছে শারদণ্ডায়নীর উপাখ্যান বলে তাঁকে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করার ব্যাপারে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেন। কুন্তী তাতে একটুও প্ররোচিত হন না এবং স্বামী ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সংসর্গে তিনি আপত্তি প্রকাশ করেন। শারদণ্ডায়নীর উপাখ্যান শুনে প্রত্যুত্তরে তিনিও একটি উপাখ্যান শোনান পাণ্ডুকে। এই উপাখ্যান আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডুর প্রতি কুন্তীর একান্ত নিষ্ঠার কথা জানতে পারি। পিতৃগৃহের প্রথম যৌবনে যে কলঙ্কের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, তারই প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হবে এই ঐকান্তিকতার মধ্যে। কুন্তীর পূর্ব এবং ভবিষ্যৎ জীবনে যে সমস্ত দেবতা তার শরীর স্পর্শ করেছেন এবং করবেন, সেই স্পর্শের ইতিহাস লঘু হয়ে যাবে স্বামীর প্রতি কুন্তীর ঐকান্তিকতার নিরিখে।

কুন্তীর জীবনে সামাজিক অতিক্রম থাকা সত্ত্বেও তাকে কেন পঞ্চসতীর মধ্যে অথবা নিত্য-স্মরণীয়া পঞ্চ-কন্যার মধ্যে অন্যতমা বলে মনে করা হয়, তার কারণ এই নিষ্ঠা। পূর্বজীবনে যা হয়ে গেছে, তা অতীতের বিভীষিকা মনে করে এখন তিনি আজীবন স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চান। তাঁর সতীত্বের নিষ্ঠা এইখানেই।

কুন্তী প্রিয় স্বামী পাণ্ডুকে বললেন–মহারাজ! আমাদের এই পুরুবংশেই ব্যুষিতাশ্ব বলে এক পরম ধার্মিক রাজা ছিলেন–পুরা পরমধর্মিষ্ঠঃ পুরোবংশবিবর্ধনঃ। তিনি এমন বিরাট যজ্ঞ করেছিলেন যে, সেখানে দেবতা এবং ব্রহ্মর্ষিরাও যজ্ঞকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন–দেবা ব্ৰহ্মাৰ্যয়শ্চৈব চকুঃ কর্ম স্বয়ং তদা। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করে সমস্ত রাজাদের আপন পরাক্রমে পরাভূত করেছিলেন। এই ব্যুষিতাশ্ব রাজার প্রিয় পত্নী ছিলেন কাক্ষীবান রাজার মেয়ে কাক্ষীবতী ভদ্রা। তিনি পরমা সুন্দরী ছিলেন এবং তার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি এবং কামনায় রাজা ব্যুষিতাশ্ব যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন। সূর্য অস্ত গেলে যেমন নিষ্প্রভ হয়ে পড়েন, অতিরিক্ত সম্ভোগ-তাড়নায় রাজাও তেমনই নিষ্প্রভ হয়ে অল্পদিনের মধ্যে মারা গেলেন। প্রিয় স্বামীর মৃত্যুতে ভদ্রা চরম শোকগ্রস্ত হলেন এবং স্বামীর শবদেহ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।

মহাভারতে ভদ্রার এই বিলাপের অংশ অন্তত বারটি শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে, যা কুন্তীর বক্তব্যের মধ্যে ছিল। আমরা এই বিলাপোক্তির মধ্যে যাচ্ছি না। আসল কথা হল– কাক্ষীবতী ভদ্রার জীবন ছিল তাই অসম্পূর্ণ। অন্য পুরুষের সংসর্গে পুত্রোৎপাদন করতে তিনি রাজি নন। তিনি স্বামীর শবদেহ আঁকড়ে বসে রইলেন। ব্যুষিতাশ্বের মৃত আত্মার উদ্দেশে ভদ্রা বললেন– তোমাকে দেখা দিতেই হবে এবং এই অবস্থায় আমি কী করব, তাও তোমাকে বলে দিতে হবে– দর্শয়স্ব নরব্যাঘ্র শাধি মাম্ অসুখান্বিতাম্। ভদ্রা শব-শরীর আগলে রইলেন দৃঢ়ভাবে।

ভদ্রার আকুতি দেখে শেষ পর্যন্ত দৈববাণী নেমে এল মৃত ব্যষিতাশ্বের প্রেতলোক থেকে। তিনি বললেন তুমি ঘরে যাও, ভদ্রে। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে যাও। মনে রেখো–আর কেউ নয়, আমিই তোমার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করব– জনয়িষ্যাম্যপত্যানি ত্বয্যহং চারুহাসিনি। ব্যুষিতা আরও বললেন–সুন্দরী আমার! তোমার ঋতুদর্শন ঘটুক, তারপর চতুর্দশী বা অষ্টমী তিথিতে তোমার শয্যাতেই তোমারই সঙ্গে মিলিত হব আমি আত্মকীয়ে বরারোহে শয়নীয়ে… ময়া সহ। মৃত স্বামীর কথা শুনে ভদ্রা ঘরে গেলেন এবং যথোক্ত দিনে স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলন হল তাঁর। সেই মৃত স্বামীর সংসর্গেই– সাভন সুষুবে দেবী শবেন ভরতভ তার অন্তত সাতটি পুত্র হল। এঁদের মধ্যে তিনজন শাশ্বদেশের অধিবাসী এবং চারজন মদ্রদেশের অধিবাসী।

 ব্যুষিতাশ্ব এবং ভদ্রার কাহিনী পাণ্ডুকে শুনিয়ে শেষে তার সিদ্ধান্ত জানালেন কুন্তী। বললেন–মহারাজ! তুমি তো বুযিশ্বের মতো মৃত ব্যক্তি নও এবং তুমি যথেষ্ট তপোবল এবং যোগবলের অধিকারী। অতএব সেই তপস্যা এবং যোগের শক্তিতে আমার গর্ভে মানস পুত্র উৎপাদন কর তুমি– তথা ত্বমপি মায্যেবং মনসাপি নরর্ষ শক্তো জনয়িতুং পুত্রান…।

কুন্তীর এই কাহিনীর পর কথা–উপকথা আসবে। মহাকাব্য রচনার রীতিই তাই। পাণ্ডু শারীরিক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন, কুন্তী সামাজিক সমস্যায় পড়েছেন। এই সমস্যার আশু সমাধান করে ক্ষণিকের মধ্যেই তার মূল কথাচক্রে ফিরে আসতে পারেন না মহাভারতের কবি। সামাজিক সমস্যা মেটানোর জন্য, তাকে যথাশক্তি যুক্তিযুক্ত করে তোলার জন্যই এই উপাখ্যান-পরম্পরা। এই উপাখ্যানগুলির মাধ্যমেই একদিকে যেমন মহাভারতীয় চরিত্রগুলির প্রকৃতি বুঝে নেওয়া যাবে, তেমনই অন্যদিকে আস্তে আস্তে যা ঘটতে যাচ্ছে, সেটাও সযৌক্তিক হয়ে উঠবে।

মৃত স্বামীর উদাহরণ দিয়ে কুন্তী বোঝাতে চাইলেন–প্রিয় স্বামীর সংসর্গজাত সন্তান ছাড়া, অন্য কোনওভাবেই তিনি সন্তান কামনা করেন না। আমরা জানি–ব্যুষিতা এবং ভদ্রার কাহিনীর মধ্যে অলৌকিকতাই বেশি। মৃত স্বামীর ঔরসে পুত্র লাভ করার মধ্যে এক মহান অতিবাদ আছে। কিন্তু সময় বিশেষে অতিবাদেরও কার্যকারিতা আছে। আমরা যখন বলি– মৃত পিতার শ্রাদ্ধ করলে পিতার আত্মার শান্তি হয়, তার ঔরসজাত সন্তানের মঙ্গল হয়, তখন কিন্তু আমরা এই শ্রাদ্ধকর্মের অদৃষ্ট ফল চোখে দেখতে পাই না। কিন্তু শ্রাদ্ধ-শান্তির মধ্য দিয়ে সন্তানদের মধ্যে যে আত্মতৃপ্তি নেমে আসে, সেই তৃপ্তিটুকু তত মিথ্যে নয়। নানা কৃচ্ছসাধন করে শ্রাদ্ধ-কর্ম সম্পাদন করে, পিতার তুষ্টির জন্য আত্মীয়স্বজনকে খাইয়ে দাইয়ে দায়ভাগী পুত্রেরা যে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, হয়ত সেই তৃপ্তিটুকুই উপাখ্যানধর্মী অতিবাদের ফল।

এখানে ব্যুষিতাশ্ব এবং ভদ্রার উপাখ্যান বলে কুন্তীও এক ধরনের তৃপ্তি লাভ করলেন। মৃতপতিকার গর্ভে এই প্রক্রিয়ায় সন্তান হয়েছিল কিনা, তা কুন্তীর জানা নেই, কিন্তু এই উপাখ্যান বলে তিনি স্বামীর প্রতি যে নিষ্ঠাটুকু দেখালেন, এই নিষ্ঠাটুকুই তাঁর উপাখ্যানের ফল। আমরা দেখছি–কুন্তীর মুখে এই উপাখ্যান শুনে পাণ্ডু পরম তৃপ্তি লাভ করেছেন। প্রজনন-ক্ষমতা হারানোর ফলে যাঁর মন বিষণ্ণ হয়েছিল; সেই পাণ্ডুও তার নিজের প্রতি কুত্তীর নিষ্ঠা দেখে পরম তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠেছেন– দেবী! তুমি যা বললে তা খুব খাঁটি কথা, খুব সত্যি কথা– এবমেতৎ পুরা কুন্তি ব্যুষিতাশ্চকার হ– সত্যিই তো ব্যুষিতা এইভাবেই পুরাকালে পুত্রলাভ করেছিলেন। কিন্তু এই কথাটুকু বলার সঙ্গে সঙ্গেই একদিকে যেমন কুন্তীর স্বামী-নিষ্ঠার স্বীকৃতি দিলেন পাণ্ডু, তেমনই এই ঘটনার অতিলৌকিকতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন– আসলে তিনি ছিলেন দেবতার তুল্য। তাঁর কত ক্ষমতা! সে ক্ষমতা কি আমার আছে, কুন্তী–যথা ত্বয়োক্তং কল্যাণি স হ্যাঁসীদমরোপমঃ। তুমি বরং আমার কাছে আরও কিছু কথা শোনো– যা ধর্মসঙ্গতও বটে এবং পুরাকালের ঋষি-মুনিরা আমার এই কথা সমর্থনও করেছেন।

উক্তির পর প্রত্যুক্তি। উপাখ্যানের পর প্রতি-উপাখ্যান। কুন্তীকে অন্য উপায়ে সন্তান লাভ করার জন্য রাজি করাতে হবে পাণ্ডুকে। অতএব দুনিয়ার সমাজ-সংস্কার, পুরাতন সংস্কার এবং তার পরম্পরাগুলি উল্লেখ করে পাণ্ডু আস্তে আস্তে ভঁর ইষ্টলাভের পরিমণ্ডল তৈরি করছেন। পাণ্ডু বললেন– জান কুন্তী! এই যে একটি পুরুষের সঙ্গে একটি স্ত্রীলোকের বিবাহ হচ্ছে, তাদের সন্তান জন্মাচ্ছে– এসব নিয়ম তো আগে কিছুই ছিল না। সেকালে এমন ছিল যে, মেয়েদের কোনও আচরণের ওপর কোনও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না–অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ক্রিয় আসন্বরাননে। মেয়েরা যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়াতে পারত, তাদের স্বাধীনতায় কেউ বাধা দিত না–কামচারবিহারিণ্যঃ স্বতন্ত্রাশ্চারুহাসিনি।

আমরা পূর্বেই জানিয়েছি–অন্য কোনও উত্তম পুরুষের সংসর্গে কুন্তীর গর্ভে সমাজ-স্বীকৃত পুত্র লাভ করতে চান পাণ্ডু। কিন্তু বিবাহের সংস্কার অতিক্রম করে এই প্রস্তাবে রাজি হবার মতো মানসিক অবস্থা কুন্তীর না থাকায় পাণ্ডু এমনভাবেই তাঁকে সমাজের ইতিহাস শোনাতে বসেছেন যেন অন্য পুরুষের সংসর্গ ব্যাপারটা কিছুই নয়। ঠিক এই কারণেই পুরুষান্তর সংসর্গের কঠিন সামাজিক অতিক্রমটিকে ভয়ঙ্করভাবে লঘু করে দিয়ে পাণ্ডু বললেন– সেকালেও তোত বিয়ে হত। কিন্তু বিয়ের পরেও মেয়েরা স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত তাসাং ব্যুচ্চরমাণানাং কৌমারাৎ সুভগে পতীন্। আর জান তো– এতে কোনও অধর্মও হত না, কেন না সেকালে ওটাই ধর্ম ছিল– স হি ধর্মঃ সনাতনঃ।

মনুষ্য সমাজের বাইরে পশু-পক্ষীদের মধ্যে এই রীতি এখনও চালু আছে– পাণ্ডু সেটারও উল্লেখ করলেন। কিন্তু পশু-পক্ষীর ইনস্টিটিভ আচার দিয়ে তো আর মানুষের আচার ব্যাখ্যা করা যায় না। অতএব স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা কবে কোথায় কেমনটি ছিল সে সব প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন পাণ্ডু। পাণ্ডু বললেন– মেয়েরা যে স্বামী ছাড়াও অন্য পুরুষের সংসর্গ করতে পারে–স্ত্রীলোকের এই স্বাধীনতাটুকু মহা-মহা-ঋষিরাও প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এই ব্যবহার তারা অপছন্দ করেননি–প্রমাণদৃষ্টো ধর্মোয়ং পূজ্যতে চ মহর্ষিভিঃ! অপছন্দ যে করেননি, তার কারণও আছে। কারণ সমাজের স্ত্রীলোকেরাই শুধু এই সামাজিক বন্ধনের মধ্যে অবসন্ন হবেন কেন? পুরুষ মানুষেরা তো ইচ্ছে করলেই অন্য স্ত্রীর সংসর্গ করতে পারেন, সেখানে স্ত্রীলোকেরাই বা কেন শুধু একতম পুরুষের বাহুপাশে আবদ্ধ হবেন? তাদেরও তো মুক্তির প্রয়োজন আছে। এই প্রথায় যেহেতু স্ত্রীলোক তার পতি ছাড়াও অন্য পুরুষের ভজনা করতে পারেন, অতএব এই প্রথা স্ত্রীলোকের প্রতি এক ধরনের অনুগ্রহের মতো। ঋষিরা তাই এটাকে ধর্মসঙ্গতই মনে করেছেন স্ত্রীণামনুগ্রহকরঃ স হি ধর্মঃ সনাতনঃ।

অনুগ্রহ শব্দটার মধ্যে একটু দয়ার ভাব আছে বটে, তবে এই শ্লোকে দয়ার কোনও অর্থ নেই। আসলে পাণ্ডু বোঝাতে চাইছেন যে, স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা বা লিবার্টির বিষয়টাও এখানে যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য। পাণ্ডু যে সময়ে এই কথা বলেছেন, তখনও স্ত্রীলোকের এত স্বাধীনতা ছিল না। এমনকি আধুনিক যুগেও এত স্বাধীনতা স্ত্রীলোকের কাম্য কিনা এবং এতটা স্বাধীনতা প্রগতিবাদী রমণীরাও মেনে নেবেন কিনা, তাতে আমাদের বিলক্ষণ সন্দেহ আছে। তবে এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে, পাণ্ডুর উচ্চারিত স্বাধীনতা সুশৃঙ্খল সমাজ–গঠনের পূর্বেকার স্বাধীনতা এবং পাণ্ডু এই স্বাধীনতার কথা বলছেন নিজের অসামর্থ্যের প্রতিক্রিয়ায়। এমনকি বেদে যেমনটি পাই সেইরকম স্বাধীনতাও এটা নয়। এ স্বাধীনতা প্রায় আদিম পর্যায়ের যখন সমাজ এবং সম্পত্তির বোধ তত প্রখর ছিল না। পাণ্ডু একটি দেশের নাম করে বলেছেন–উত্তরেষু চ রম্ভোরু কুরুঘদ্যাপি পূজ্যতে– এখনও উত্তরকুরু দেশে স্ত্রীলোকের এই স্বাধীনতা আছে। তারা স্বামী ছাড়াও অন্য পুরুষের সংসর্গে দ্বিধা বোধ করে না।

উত্তরকুরু দেশের কথা আমরা বহু পূর্বেই বলেছি। এ দেশ আর্যদের পুরাতন বাসভূমি এবং হয়তো এই জায়গা থেকেই আর্যরা এক সময় এ দেশে আসেন। পুরাণ-ইতিহাস যখন লেখা হচ্ছে, তখন উত্তর-কুরু-দেশের কথাটা সব সময়ই এসেছে বিচিত্র বিষয়ের উদাহরণ হিসেবে, কখনও বা নস্টালজিয়ার মতো করেও। কিন্তু ব্রাহ্মণ-গ্রন্থগুলি রচনার সময়েই উত্তরকুরু দেশের অবস্থিতি অনেকটাই– ওই তো সেদিনের কথার মতো। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উত্তর–কুরু হিমালয়ের ওপারে কিন্তু মহাভারতের সময়ে এসে বুঝতে পারি– এ দেশ কতটা দূরে। সুমেরুর কাছে যে দেশ, যাকে আধুনিকেরা পামির বলে ডাকেন, যে দেশকে গ্রিস দেশের প্রাচীনেরা পর্যন্ত প্রায় সমোচ্চারণে (ottorocorrae) পৃথিবীর স্বর্গ বলে মেনেছেন, সে দেশ মহাভারতের সময়েই ইতিহাসে পর্যবসিত। পাণ্ডুও সেই ইতিহাসের কথাই বলছেন কুন্তীকে। বলছেন সে দেশের মেয়েদের নির্বাধ মেলামেশার কথা, সামাজিক শৃঙ্খলের অনুপস্থিতির কথাও।

পাণ্ডু যা বলছেন, তাই যদি সামাজিক রীতি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কেমন করে এই বিবাহের নিগড়ে আবদ্ধ হলেন স্ত্রীলোকেরা? পাণ্ডু সেই ইতিহাসও জানালেন কুন্তীকে। বললেন–বেশিদিন নয়, কুন্তী! এই বিবাহ অথবা স্বামী-স্ত্রীর এই মর্যাদার বন্ধন খুব বেশি দিনের নয়— অস্মিংস্তু লোকে ন চিরান্মর্যাদেয়ং শুচিস্মিতে। স্থাপিতা যেন…কে এই বিবাহের নিয়মটি বেঁধে দিলেন, তাও তোমাকে বলছি কুন্তী।

আবারও এক উপাখ্যান। এই উপাখ্যানও বলা হচ্ছে কুন্তীর মানসিক প্রস্তুতির জন্য! পাণ্ডু বললেন– উদ্দালক বলে এক মহর্ষি ছিলেন। তার ছেলের নাম ছিল শ্বেতকেতু। তিনি একদিন বসে আছেন। আরণ্যক ঋষির কুটির, হয়ত পিতা-পুত্রে বেদ-পাঠে নিরত ছিলেন। এমন সময় একটি লোক এসে মহর্ষি উদ্দালকের সামনেই শ্বেতকেতুর মায়ের হাতখানি জড়িয়ে ধরল– শ্বেতকেতঃ কিল পুরা সমক্ষং মাতরং পিতুঃ। শুধু হাত ধরাই নয়, সেই রমণীকে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে প্রণয় নিবেদন করার জন্য পিতা-পুত্রের সামনেই শ্বেতকেতুর জননীকে অচেনা লোকটি বলল আর দেরি কেন? চল, আমরা যাই–জগ্রাহ ব্রাহ্মণঃ পাণৌ গচ্ছাব ইতি চাব্রবীৎ।

ছেলের সামনে সেই ব্রাহ্মণ মাকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তথাকথিত উদ্দালক-পত্নী সামান্য বাধা দিয়েছিলেন বোধহয়। শ্বেতকেতুর ক্রোধ উদ্দীপ্ত হয়েছিল সেইজন্যই। তিনি ভাবলেন– মাকে বুঝি জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে– নীয়মানাং বলাদিব। কিন্তু বস্তুত অচেনা ব্রাহ্মণটি যে কোনও জোর খাটাননি এবং রমণীর বাধা দেওয়াটাও যে রীতিমতো ছেলে–দেখানো একটা ব্যাপার ছিল, সেটা বোঝা যায় রমণীর তথাকথিত স্বামী উদ্দালকের কথায়। শ্বেতকেতুকে রাগে কাঁপতে দেখে ক্রুদ্ধন্তু তং পিতা দৃষ্টা বেপমানমুবাচ হ–পিতা শ্বেতকেতুকে বললেন– তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন, বাছা–এরকমটা তো হয়েই থাকে। সমাজের চিরকালের নীতিই তো এইরকম–মা তাত কোপং কার্যাস্তুমেষ ধর্মঃ সনাতনঃ।

 মৈথুন-কামী কোনও রমণীকে প্রত্যাখ্যান করা খুব অন্যায়–এইরকম একটা কথা বেদে ব্রাহ্মণে আছে বটে– ন কাঞ্চন পরিহরে– কিন্তু বেদের এই বিধান একটি নির্দিষ্ট ব্রতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। টীকাকারেরা বলেছেন– কামদেব্য ব্রতে ওই বিধান। হয়ত বা এই ব্রতের মধ্যে প্রাচীন নির্বাধ সমাজের ছায়া পড়েছে। এই সুপ্রাচীন সমাজের প্রতিভূ উদ্দালক তাই অচেনা ব্রাহ্মণটির তথাকথিত অপব্যবহারে একটুও ব্যথিত হলেন না। ক্রুদ্ধ শ্বেতকেতুকে তিনি বললেন–রাগ কোরো না বাছা! আমাদের সমাজে স্ত্রীলোকেরা অনেকটা ছাড়া গোরুর মতো–যথা গাবঃ স্থিতা স্তাত। তাদের আটকে খার নিয়ম নেই কোনও। নিজের বর্ণ অতিক্রম না করলে একটি ব্রাহ্মণের সঙ্গে আমার স্ত্রীরও মিলনে বাধা নেই কোনও। তারা স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে–অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্ণানামঙ্গনা ভুবি।

 প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে লোকে এই রমণীটিকে উদ্দালকের স্ত্রী অথবা শ্বেতকেতুর জননী হিসেবেই বা চিনবে কী করে? উদ্দালক যা বলেছেন, তাতে তার সমসাময়িক সমাজে একজন স্ত্রী বাড়ির ঘরকন্না সামলাচ্ছে অথবা রান্নাবাড়ি করছে এবং অন্তত ঋতুকালের অব্যবহিত পরে স্বামী ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সংসর্গ করছে না–ঋতুকালে চ সংপ্রাপ্তে ভর্তারাং ন জহুস্তদা–শুধু এই চিহ্নগুলি দেখেই কোনও রমণীর স্ত্রীত্ব স্বীকার করা হত।

 পিতা উদ্দালকের এই নির্বিকার টিপ্পনীতে শ্বেতকেতুর মন একটুও শান্ত হল না। শ্বেতকেতুন চক্ষমে। নিজের জননীকে এইভাবে এক পুরুষাত্তরের সঙ্গে মিলিত হতে দেখে তিনি ঠিক করলেন একটা নিয়ম করতে হবে, যাতে এমন উচ্ছুঙ্খলতা আর না ঘটে। শ্বেতকেতু বললেন–আজ থেকে আর এমনটি চলবে না। আজ থেকে যে রমনী নিজের স্বামী ছেড়ে অন্য পুরুষের সংসর্গ করবে তার নিদারুণ পাপ হবে– ব্যুচ্চরত্যাঃ পতিং নাৰ্য্যা অদ্যপ্রভৃতি পাতক। আবার যে পুরুষ পতিব্রতা রমণীকে ছেড়ে অন্য রমণীর সংসর্গ করবে, তারও পাপ হবে একই রকম।

শ্বেতকেতুর তৈরি করা বৈবাহিক নিয়মের কথা সাড়ম্বরে জানালেও পাণ্ডু কিন্তু নিজের ব্যাপারে একই রকম সচেতন রয়ে গেছেন। তিনি কুন্তীকে বলছেন–শ্বেতকেতুই প্রথম এইরকম একটা কড়া নিয়ম করেছিলেন বলে শুনেছি। তবে জান তো– এ নিয়ম শুধু মানুষের মধ্যেই চলে, ইতর প্রাণীজগতে এই নিয়ম চলে না–মানুষেষু মহাভাগে ন ত্বেবান্যে জন্তুষু।

 বেচারা পাণ্ডু! তিনি নিজের জগতে কোনও উদাহরণ না পেয়ে এখন তিনি পশু-জগতের উদাহরণ টানলেন। শ্বেতকেতুর দুটি নিয়ম শোনানোর পর আরও একটি নিয়ম তিনি কুন্তীকে শোনালেন। বললেন–শ্বেতকেতু আরও বলেছিলেন–যে স্ত্রী স্বামীর আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও পুরুষান্তরের সংসর্গে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করে না, তারও ভীষণ পাপ হবে। কারণ মহামতি শ্বেতকেতু তার তপস্যার সিদ্ধিতে এই নিয়ম তৈরি করেছিলেন–ইতি তেন পুরা ভীরু মর্যাদা স্থাপিতা বলাৎ।

 আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা– এই শেষোক্ত নিয়মটি শ্বেতকেতুর তৈরি করা নয়। পাণ্ডু নিজের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে সমাজের একটি ব্যতিক্রমিক রীতিকে সাধারণ নিয়ম বলে চালিয়েছেন। আর সত্যিই এতে সন্দেহ নেই যে, সমাজের সুশৃঙ্খল বৈবাহিক নীতি-নিয়মগুলি চালু হবার পর যখন দেখা গেল বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও পুত্র-কন্যালাভের সমস্যা ঘটতে পারে, তখন সমাজের প্রয়োজনেই এর একটি নিরীহ স্বামী-স্ত্রীর হৃদয়ে বাৎসল্য-সুখের আস্বাদ অনুস্যুত করার জন্যই ক্ষেত্রজ পুত্রের বিধান মেনে নেওয়া হয়। তবু এটা ব্যতিক্রমই এবং এই ব্যতিক্রমের কথাই পাণ্ডু সাড়ম্বরে কুন্তীকে বলতে লাগলেন সাধারণ নীতির মতো করে।

পাণ্ডু বড় বড় দু-চারজন রাজার উদাহরণ দিয়ে কুন্তীকে স্বকার্যে প্ররোচিত করতে চাইলেন। পাণ্ডু বললেন সৌদাস রাজার স্ত্রী ছিলেন ময়ন্তী। তাদের পুত্র-কন্যা ছিল না বলে মহারাজ সৌদাস নিজের স্ত্রী ময়ন্তীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য মহর্ষি বশিষ্ঠকে নিযুক্ত করেন। সৌদাসেন চ বামোরু নিযুক্তা পুত্ৰজন্মনি। ময়ন্তী স্বামীর কথা শুনে বশিষ্ঠের সঙ্গে মিলিত হন এবং অম্মক নামে একটি পুত্র লাভ করেন।

 অশ্বক একটি ইতিহাস-প্রসিদ্ধ নাম। তার নামে একটি রাজগোষ্ঠীও পুরাকালে তৈরি হয়েছিল। অন্যান্য রাজার উদাহরণ দিয়ে পাণ্ডু এবার নিজের জন্ম-প্রসঙ্গে আসলেন। এর থেকে বড় প্রমাণ তো আর কিছু হতে পারে না। পাণ্ডু বললেন– এই আমার কথাই ধর না। সে তো তোমার জানাও আছে– বিদিতং কমলেক্ষণে। শুধুমাত্র কুরুবংশের বৃদ্ধির জন্য মহর্ষি বেদব্যাস আমাদের তিন ভাইকে জন্ম দিয়েছিলেন কৃষ্ণদ্বৈপানাদভীরু কুরূণাং বংশবৃদ্ধয়ে। লক্ষণীয় বিষয় হল–পাণ্ডু কুন্তীর কাছে যত উদাহরণ প্রত্যুদাহরণ দিলেন, তার মধ্যে অন্তত বেশ কয়েকবার ভীরু বলে তিনি সম্বোধন করেছেন কুন্তীকে। তিনি ধারণা করছেন– পুরুষান্তরের সংসর্গে যে সাহসিকতা লাগে সে সাহসিকতা কুন্তীর নেই। অথবা এখানে সাহস কথাটা না ব্যবহার করাই ভাল। বলা উচিত অনীহা। কুন্তী বারংবার পাণ্ডুর কাছে এই অনীহা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই অনীহাকে সাহসের অভাব, দ্বিধা অথবা নিজের মায়ের উদাহরণে ঘৃণা বলেই মনে করেছেন পাণ্ডু, ফলত বারবার কুন্তীকে তিনি সম্বোধন করছেন ভীরু বলে–ভাবটা এই–ভীতু মেয়ে, কিচ্ছু ভয় নেই।

সমস্ত কথার অবসানে পাণ্ডু এবার তার শেষ সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন। পাণ্ডু বললেন– আমার সমস্ত কথা মাথায় রেখে আমার এই ন্যায়সঙ্গত কথাটা তুমি শোনো। পূর্ববর্তী নিয়ম অনুসারে তুমি তোমার ঋতুকালে আগের মতোই পতিনিষ্ঠ থেকো। তাতে আপত্তি কী? কিন্তু ঋতুভিন্ন সময়ে পুরুষান্তরের সংসর্গে তো দোষই নেই। তখন তো তুমি তোমার স্বেচ্ছানুসারে অন্য পুরুষের সঙ্গ করতে পার, তাতে তো ধর্মজ্ঞ পণ্ডিতেরা সায়ও দিয়েছেন–শেষেম্বন্যেষু কালেষু স্বাতন্ত্রং স্ত্রী কিলাতি। তাছাড়া স্বামী হিসেবে আমার কথাটাও তত তোমার শোনা উচিত–যদ ক্ৰয়াত্তত্তথা কার্য।

সবার শেযে পাণ্ডু আত্মনিবেদন করলেন কুন্তীর কাছে। বললেন–তুমি তো জান–একটি পুত্রলাভের জন্য আমি কীরকম ব্যগ্র আছি। কিন্তু মৃগমুনির অভিশাপে আজ আমার এই অসহায় অবস্থা। আমাকে পুত্রমুখ দর্শন করাও।

হয়ত, কুরুবংশের বৃদ্ধির জন্য, হয়ত আত্মপরম্পরায় হস্তিনাপুরের রাজ্য লাভ করার জন্য অথবা হয়ত চিরন্তন বাৎসল্যের আস্বাদ মেটানোর জন্য পাণ্ডু তার পদ্মপত্রসন্নিভ রক্তিম করতলদুটি অঞ্জলিবদ্ধ করে মাথায় তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে কুন্তীর চরণে সানুনয়ে ঈষৎ আনত হলেন পাণ্ডু

তথা রঙ্গাঙ্গুলিতলঃ পদ্মপত্রনিভঃ শুভে।
 প্রসাদার্থং ময়া তেয়ং শিরস্যভদ্যতোঞ্জলিঃ।

.

৮১.

 পাণ্ডু স্ত্রীর কাছে হাত জোড় করে সাননুয়ে বললেন–তুমি আমার আদেশ মেনে কোনও তপস্বী ব্রাহ্মণের সংসর্গে সর্বগুণান্বিত পুত্রের জন্ম দাও–পুত্ৰান্ গুণাসমাযুক্তান উৎপাদয়িতুমহসি। এরকমটি যদি হয় তবেই আমি জানব যে, পুত্রবান লোকেরা যে সুখ পায় আমিও তোমার জন্য সেই সুখ পেলাম–ত্বৎকৃতেহং পৃথুশ্রোণি গচ্ছেয়ং পুত্রিণাং গতিম্।

প্রিয় স্বামীর অপার অনুরোধে উপরোধে কুন্তী যে খুব অখুশি হলেন, তা মোটেই নয়। নিজের সামাজিক শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত মাধুর্য মিশিয়ে তিনি অঙুলিবদ্ধ পাণ্ডুর হাত দুখানি তাঁর মাথা থেকে নামিয়ে দিয়ে বললেন–এ বড় অপরাধ হয়ে যাচ্ছে, মহারাজ–অধর্ম সুমহানে। যেখানে স্বামী বলে আমারই উচিত তোমাকে প্রসন্ন করা, সেখানে তুমি হাত জোড় করে আমার প্রসাদ ভিক্ষা করছ–এ বড়ই অপরাধ হয়ে যাচ্ছে, মহারাজযৎ প্রসাদয়তে ভর্তা প্রসাদ্যঃ ক্ষত্রিয়ভ। সে যাইহোক, আমি ছোটবেলায় আমার পিতার ঘরে এক দৃঢ়ব্রত এবং কোপনস্বভাব অতিথির সেবায় নিযুক্ত হয়েছিলাম। সেই ধর্মজ্ঞ মহর্ষিকে লোকে দুর্বাসা বলে জানে। আমি আমার সমস্ত চেষ্টা–প্রযত্ব দিয়ে সেই মহর্ষিকে তুষ্ট করেছিলাম–তমহং শংসিতাত্মানং সর্বত্নৈ– রতোযয়ম্।

কুন্তী তাঁর প্রিয় স্বামীর কাছে আনুপূর্বিক দুর্বাসার বৃত্তান্ত নিবেদন করে বললেন–তিনি আমাকে যে মন্ত্র দিয়েছেন, সেই মন্ত্রবলে যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করলে তিনি আমার গর্ভে দেবতার তুল্য পুত্র দান করবেন–তয়াহুতঃ সুরঃ পুত্রং প্রদাস্যতি সুরোপমুম্। তুমি যদি অনুমতি কর তবে আমি কোনও দেবতাকেও মন্ত্রবলে আহ্বান করতে পারি। আবার তুমি যদি বল–তবে কোনও ব্রাহ্মণকেও আমি আহ্বান করতে পারি। আসলে নিয়োগপ্রথার চিরন্তন নিয়মে পাণ্ডু কোনও উৎকৃষ্ট তপস্বী ব্রাহ্মণকেই আহ্বান করতে বলেছিলেন। কারণ সে কালের মানুষেরা ভাবতেন–ব্রাহ্মণই সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত এবং মহান বলে তাদের ঔরসে গুণবান পুত্রের জন্ম হবে। পাণ্ডুও সেই ভেবেই কথাটা কুন্তীকে বলেছেন। কিন্তু কুন্তী তার দেববশীকরণের ক্ষমতা আগেভাগে জানিয়ে পাণ্ডুর লোভ তৈরি করলেন প্রথমত। তারপর তার পূর্বের ইচ্ছা মান্য করে বললেন–ব্রাহ্মণকে আহ্বান করার ব্যাপারেও আমার কোনও অসুবিধে নেই। তুমি যেমনটি বলবে তাই করব–যং ত্বং বক্ষ্যসি ধর্মজ্ঞ দেবং ব্রাহ্মণমেব চ। অর্থাৎ এখানেও তিনি সম্পূর্ণ পতিনিষ্ঠ, স্বামীর ইচ্ছায় তিনি কার্যে প্রণোদিত হবেন, নিজের ইচ্ছায় নয়। কুন্তী অবশ্য দেব–ব্রাহ্মণের বিকল্পে কোনটা বেশি সুবিধেজনক, সেটাও বলতে ভুললেন না। বললেন–দেবপুরুষকে ডাকলে আমি অবশ্য সদ্যসদ্যই গর্ভবতী হব। কিন্তু ব্রাহ্মণ আহ্বানের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্রাহ্মণের নিযুক্তি, তার উৎকর্ষ বিচার এবং শেষ পর্যন্ত সেই প্রক্রিয়া–সব কিছু মিলে মিশে বেশ দেরি হয়ে যাবে–দেবাৎ পুত্রফলং সদ্যো বিপ্ৰাৎ কালান্তরে ভবেৎ।

কুন্তী জানেন–একটি পুত্র-লাভের জন্য তার স্বামী কতটা ব্যগ্র আছেন। তার মধ্যে মনুষ্যলোকের অদৃষ্টের অধিকার যাঁদের হাতে, ব্রাহ্মণরাও যাঁদের যজ্ঞাহুতি দিয়ে তৃপ্ত করেন, সেই দেবতার ঔরসে পুত্র লাভ করলে, সেই পুত্রের পিতৃপরিচয় দিতে পাণ্ডু অনেক বেশি সম্মানিত বোধ করবেন। পাণ্ডুর মনস্তত্ত্ব কুন্তী বোঝেন বলেই দেবতাত্মানের ক্ষমতা তিনি জানিয়ে রাখলেন পাণ্ডুকে। আর ব্রাহ্মণের কথাটা শুধু উল্লেখ করলেন পাণ্ডুর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য এবং অবশ্যই তার পতিনিষ্ঠা জানানোর জন্য।

লক্ষণীয় বিষয় হল–পাণ্ডুকে দুর্বাসার সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেও কুন্তী কিন্তু তার মন্ত্রপরীক্ষার কৌতূহলের কথা নিবেদন করলেন না। জানালেন না তার পূর্বপ্রসূত দেবপুত্রটির কথাও। তাছাড়া দেবতা এবং ব্রাহ্মণের বিকল্পে দেব–পুরুষের প্রতি যে তার নিগূঢ় পক্ষপাত আছে–সে কথা তিনি ইঙ্গিত করেছেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে। দেব-ব্রাহ্মণের একতমকে নির্বাচন করার ভার পাণ্ডুর ওপর দিয়ে কুন্তী তার পুরাতন এবং পরীক্ষিত মন্ত্রসাধনের দক্ষতা নিবেদন করেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। প্রিয় স্বামীকে তিনি বলেছেন–কোন দেবতাকে ডাকব, কখনই বা ডাকব, সে সব কিন্তু তুমি সময়মতো বলে দিও। আমি কিন্তু শুধু তোমার আদেশের অপেক্ষা করছি–আবাহয়ামি কং দেবং কদা বা ভরতর্ভ।

কুন্তীর কথা শুনে পাণ্ডু যে কত খুশি হলেন, তা বলবার নয়। হৃদয়ের সমস্ত কৃতজ্ঞতা উজাড় করে দিয়ে পাণ্ডু কুন্তীর হাত ধরে বললেন–আমি ধন্য হলাম কুন্তী! তুমি আমাকে পুত্রলাভের ব্যাপারে রীতিমতো অনুগ্রহ করেছ। আমি নই, তুমিই এই প্রসিদ্ধ বংশের ধারক ধন্যোস্মি–অনুগৃহীতোস্মি ত্বং নো ধাত্রী কুলস্য হি। কুন্তীর সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডু কৃতজ্ঞ হলেন সেই মহামুনির কাছেও, যে মুনি কুন্তীকে পাণ্ডুর বিপত্তারণ মন্ত্র দিয়েছিলেন। বললেন–আমার প্রণাম সেই মুনিবরকে, যিনি এমন বর দিয়েছেন তোমায়।

 পাণ্ডুর আর কোনও তর সইল না। কুন্তীকে ডেকে বললেন–আর দেরি নয়। আজই তুমি তোমার মোহন মন্ত্রে ডাক তোমার দেবতাকে–অদৈব ত্বং বরারোহে প্রযতম্ব যথাবিধি। তুমি আহ্বান কারো ধর্মরাজকে। কেননা দেবতাদের মধ্যে তিনিই তো সবচেয়ে বেশি পুণ্যবান অথবা পুণ্যজনক–ধর্ম আবাহয় শুভে স হি দেবেযু পুণ্যভা।

আমরা এর আগে জানিয়েছি যে, মহাভারতের সামাজিক ভাব এবং ভাবনার মধ্যে তার অব্যবহিত পূর্ব যুগের পরম্পরা অনেকটাই নেমে এসেছে। পুত্র লাভের জন্য পাণ্ডু পরে যাঁদের আহ্বান জানাবেন, যাঁদের ঔরসে ভীম, অর্জুন, নকুল এবং সহদেব জন্মাবেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বৈদিক দেবতা। কাজেই সেখানে বৈদিক যুগের পরম্পরাটা ঠিকই আছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল–পাণ্ডু তার প্রথম সন্তান লাভের জন্য আহ্বান করতে বললেন ধর্মকে, যে ধর্মের সঙ্গে বৈদিক যুগের পূর্বান্বয় ঘটানো খুবই কঠিন। কঠিন এই জন্য যে, ইন্দ্র, বায়ু, যমের মতো ধর্মকে আমরা কোনও দেবতা হিসেবে বেদের মধ্যে পাইনি। অন্যদিকে পাণ্ডুর আহূত ধর্মদেব একেবারে বৈদিক পরম্পরা-বিরহিত কিছু হবেন–সেটা ভাবাও বেশ কঠিন।

এই সমস্যার সমাধান করার জন্য পণ্ডিতদের চেষ্টার অন্ত নেই। জর্জেস ডুমেজিল থেকে আরম্ভ করে মাদাম বিয়ার্দোর মতো চিন্তাশীল মহাভারতের সমালোচকেরা পাণ্ডুর মনোনীত দেব-পুরুষটিকে নিয়ে অনেক ভাবনা করেছেন। ডুমেজিল মনে করেন–সম্পূর্ণ মহাভারতেরই একটা বৈদিক পূর্ব–গঠন নির্ণয় করা যায়, যাকে, ইংরেজিতে বলা যায়– Re-Working of vedic material into a new narrative. এই পদ্ধতিতে বিচার করতে গিয়ে পাণ্ডু-পুত্রদের দৈব গঠনের কথাও এসেছে। ডুমেজিল বিশ্বাস করেন–পাণ্ডুর মনোনীত ধর্মদেব বৈদিক দেবতা মিত্রের পুনরুজ্জীবন মাত্র (rejuvenation), কারণ বৈদিকদের দেব–রাজ্যে মিত্রই হলেন সেই সার্বভৌম নায়ক যিনি সত্যের অধিপতি বলে খ্যাত–সত্যস্য পতিঃ। তাছাড়া বৈদিক দেবতাদের জাত-বিচারে মিত্র হলেন ব্রাহ্মণ এবং তাকে পুরোহিত বলেও সম্বোধন করা হয়েছে। মহাভারতের ধর্ম-দেবতার মধ্যে বৈদিক মিত্রের পুনরুজ্জীবন দেখতে পাওয়ার আরেকটা কারণ হল মিত্র-দেব হলেন ধর্মের রক্ষক এবং তিনি সম্রাটও বটেন। অবশ্য ধর্ম এবং সাম্রাজ্যের ব্যাপারে তার আরও একজন অংশীদার আছেন। তাঁর নাম বরুণ। তারই সঙ্গে সহাযযাগিতায় মিত্রদেব মানুষকে ঋতের পথ দেখান, সত্যের পথ দেখান।

মাদাম বিয়ার্দো অবশ্য মহাভারতের ধর্মরাজকে মিত্রের পুনরুজ্জীবন বলতে রাজি নন। তাঁর মতে ধর্ম একটি অ্যাবস্ট্রাক্ট আইডিয়া মাত্র যাকে এক কথায় বলা যায় শুভ এবং তাই যদি হয় তবে ধর্ম-দেবকে বৈদিক মিত্রের পুনরুজ্জীবন না বলে বৈদিক ঝতের পুনরুজ্জীবন বলাই ভাল। মাদাম বিয়ার্দো অবশ্য লিখেছেন–And Dharma is the Hindu name for that God. If the god Dharma Yudhisthiras father were to be connected with any older concept, he could be considered as a rejuvination of the vedic rta. not of Mitra, But it is useless to recall a vedic model and it might prove misleading, since dharma does not retain much of sta.

তার মানে মাদাম বিয়ার্দো মিত্রের পক্ষেও নয়, ঝতের পক্ষেও নয়, ধর্মের কোনও বৈদিক পূর্বান্বয় খোঁজার পক্ষেই তিনি নন। তাঁর মতে–More important is the place of Dharma rather than a god or a function it appears here and elsewhere in classical hinduism as the all–enveloping and ultimate value of society.

মাদাম নিজের ধারণাটা মহাভারতের প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেননি বটে–এবং সে দায়িত্ব আমরা না নিলেও পারি–কিন্তু মহাভারতের মধ্যেই যেহেতু ধর্ম শব্দের এমন বিশদ এবং বিচিত্র অর্থ পাওয়া গেছে, যা সমাজের বৃহত্তর শৃঙ্খলা, সত্য, আইন, আচার এবং শুভৈষণাকেই বোঝাতে চায়, তাই ধর্ম বলতে সমাজের চরম মূল্যবোধকেই আমরাও বোঝাতে চাইব। কথাটা পাণ্ডুর নিজের জবানী থেকেই যথেষ্ট পরিষ্কার হয়ে যায়।

পাণ্ডু কুন্তীকে বলেছিলেন–ধর্মকে যদি আহ্বান করা যায় তবে আমাদের প্রজা-পালনের ধর্ম কোনওভাবেই আর অধর্মের সঙ্গে যুক্ত হবে না–অধর্মেনন নো ধর্মঃ সংযুজ্যেত কথঞ্চন। পাণ্ডু ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু অধর্ম কথাটিরও উল্লেখ করেছেন, তাই অন্বয়-ব্যতিরেকের পদ্ধতিতে ধর্ম বলতে ভারতবর্ষের চিরন্তন রাজধর্মের অন্তর্গত শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়দের অন্তর্জাত শৃঙ্খলার আধার সেই চরম শুভৈষণাকেই বোঝায়, যাতে মানুষের চরম হিতসাধন হয়, প্রজারা রঞ্জিত হয়। পাণ্ডু আরও বললেন–স্বয়ং ধর্ম যাঁকে তোমার গর্ভে উৎপন্ন করবেন, সে লোকের মন কখনও অধর্মে প্রবৃত্ত হতে পারে না–দত্তস্যাপি চ ধর্মের্ণ নধর্মে রংস্যতে মনঃ। পূর্বপংক্তিতে অধর্মের নিরাস ঘটিয়ে ধর্মের কথা বলেছিলেন, এবারে ধর্মের কথা আগে বলে অধর্মের নিরাস ঘটালেন। আমরা একেই অন্বয়-ব্যতিরেক বলেছি এবং এতে অধর্মের বিপরীত সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট আইডিয়া টাই বোঝায়। পাণ্ডু সেই শুভৈষণার চরম অ্যাবস্ট্রাকশনকে রূপ দিতে চাইলেন নিজের সন্তান-পরম্পরার মধ্যে, একই সঙ্গে কুরুবংশের রাজপরম্পরায় তিনি এক চরম উদাহরণ তৈরি করতে চাইলেন। আমার সেই পূত্র হবে কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ ধার্মিক–ধার্মিকশ্চ কুরূণাং স ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ–এইরকম একটা স্বপ্ন দেখতে দেখতে পাণ্ডু কুন্তীকে বলেলন–তুমি সংযত চিত্তে তোমার ঋষির আদিষ্ট মন্ত্রের অভিচার কাজে লাগিয়ে ধর্মকে দেবপ্রধান মনে করে, তাকেই আহ্বান কর– উপচারাভিচারাভ্যাং ধর্মমাবাহয়স্ব বৈ।

পাণ্ডু বললেন–তুমি উপচার এবং অভিচার দুইই প্রয়োগ করো–উপচারাভিচারাভ্যাম্। মনে রাখতে হবে–অভিচার শব্দটার মধ্যে শক্তিমত্তার তাচ্ছিল্য আছে কিছু। অথর্ববেদের মধ্যে প্রথম সেই অভিচারের আরম্ভ। মন্ত্রের সিদ্ধি দিয়ে মারণ-উচাটন-বশীকরণের ক্ষমতা কীভাবে লাভ করা যায়, তার বিশেষ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে অথর্ববেদে। এই ক্ষমতা এবং প্রক্রিয়াকেই এক কথায় বলে অভিচার। অভিচার শব্দটির মধ্যে যেহেতু ব্যক্তিগত সিদ্ধির সাফল্য এবং সচেতনতা ধরা থাকে, তাই মন্ত্রশক্তির বলজনিত একতাচ্ছিল্যও ক্রিয়া করে মন্ত্রজ্ঞের অন্তরে। কুন্তী আগে পাণ্ডুকে বলেছিলেন–দুর্বাসা আমাকে বশীকরণ শক্তিসম্পন্ন এই উৎকৃষ্ট মন্ত্রটি আমাকে দিয়েছিলেন–স মেভিচার-সংযুক্তমাচষ্ট ভগবান্ বর। অভিচার শব্দটি কুন্তী নিজেই ব্যবহার করায় পাণ্ডু তাকে যেন সাবধান করে দিলেন। অর্থাৎ তোমার এই শক্তি আছে, অতএব তাচ্ছিল্য করে দেবতাকে ডাকবে–এমনটি যাতে না হয়। তুমি তোমার মন্ত্রের শক্তি প্রয়োগ করো, কিন্তু তার মধ্যে যেন দেবতার প্রতি সমাদর থাকে যত্ন থাকে–অভিচারের সঙ্গে যেন উপচারও থাকে, সংযমও থাকে, এবং সেই উপচার-সমাদর যেন অভিচারের পূর্বগামী হয়–উপচারাভিচারাভ্যাং..নিয়তা ত্বং শুচিস্মিতে।

 কুন্তী পাণ্ডুর আদেশ মেনে নিয়ে তার অনুকূল কাজ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। বুঝিয়ে দিলেন–এ কাজে তার কোনও কর্তৃত্ব নেই, তিনি কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করছেন মাত্র অভিবাদ্যাভ্যনুজ্ঞাতা প্রদক্ষিণ অবর্তত।

কুন্তী যখন পাণ্ডুর কথা শুনে ধর্মদেবকে আহ্বান করতে প্রস্তুত হচ্ছেন, ঠিক তখনই মহাভারতের কবি একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনালেন। বললেন–কুন্তী যখন গর্ভ ধারণের জন্য ধর্মকে আহ্বান জানালেন, তখন ধৃতরাষ্ট্র-পত্নী গান্ধারীর গর্ভকাল এক বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে –সংবৎসরভৃতে গর্ভে গান্ধাৰ্যা জনমেজয়। আমরা জানি–গান্ধারী শত পুত্র লাভের জন্য মহাদেবের কাছে বরলাভ করেছিলেন বিবাহের পূর্বেই। এখন সেই বরদান কার্যে পরিণত করার সময় আরও একটি মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন হল। তিনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস। মহামতি ব্যাস একদিন ক্ষুধায় এবং পথশ্রমে কাতর হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ভবনে পৌঁছলেন। গান্ধারী তখন ক্ষুধার্ত ব্যাসকে অনেক শুশ্রূষা করে তুষ্ট করলেন–তোষয়ামাস গান্ধারী ব্যাসস্তস্যৈ বরং দদৌ। সন্তুষ্ট ব্যাস বর দিতে চাইলে গান্ধারী বললেন–আমার স্বামীর মতো বলবান এবং গুণবান একশত পুত্র তোক আমার। ব্যাস তাঁকে সেই বর দিলে গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র ধারণ করলেন নিজের গর্ভে–ততঃ কালেন সা গর্ভং ধৃতরাষ্ট্রাদথাগ্রহী।

পাণ্ডব এবং কৌরবদের জন্মাবার আগেই পণ্ডিতদের আরও একটা টিপ্পনী এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। পণ্ডিতেরা অনেকেই মনে করেন যে, মহাভারতের বিশাল যুদ্ধটি এক অর্থে সেই চিরন্তন দেবাসুরের যুদ্ধ। মহাভারতের আরম্ভেই একটা অংশাবতরণ অধ্যায় আছে। সেখানে কে কোন দেবতার অংশে জন্ম নিয়েছেন, কেই বা অসুর-দৈত্যদের অংশে জন্ম নিয়েছেন, তার একটা তালিকা আছে। সেখানে মহাভারতের উত্তম চরিত্রগুলির জন্ম দেবতাদের অংশে, আর দুষ্ট চরিত্রগুলির জন্ম সব সময়ই অসুর-দৈত্যদের অংশে। কুরুকুলের অন্যতম প্রধান পুরুষ দুর্যোধন কলির অংশে জন্মেছেন। কলি অর্থ কলহ, দুর্যোধন তার মূলভৃতকারণ।

দেবাসুরের এই অংশাবতরণ আমাদের মতে অবশ্যই মহাভারতের পরবর্তী সংযোজনগুলির অন্যতম এবং সেই অংশাবতরণের ভাবনা থেকে মহাভারতের ঐতিহাসিক যুদ্ধের মধ্যে অলৌকিকতার কোনও স্পন্দন অনুভব করাও খুব যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু পণ্ডিতেরা ভাবনা করেন এবং তাঁদের ভাবনাও নিরর্থক নয়, নির্বিষয়কও নয়। এই অংশাবতরণের ঘটনাকে বাদ দিয়েও মহাভারতের যুদ্ধটাকে যেহেতু স্বয়ং মহাভারতের কবিই এক যজ্ঞের ভাবনায় দেখেছেন, তাই পণ্ডিতেরা ভারত-যুদ্ধের মধ্যে পুরাতন দেবাসুর-যুদ্ধের ছায়া দেখতে–The war between the Bharata cousins is seen as auother battle in the eternal struggle between the gods and demons, this time faught on the earth.

প্রোফেসর এ. কে. রামানুজন দেবাসুর দ্বন্দ্বের এই তত্ত্বটাকে অনেকটা মনুষ্যত্বের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন–মহাভারতের চরিত্রগুলির মধ্যে এক ধরনের পুনরুক্তির ঘটনা ঘটেছে। অন্তত তিনটি জেনারেশন ধরে মহাভারতের প্রধান চরিত্রগুলির প্রায় প্রত্যেকেই–ভীষ্ম থেকে আরম্ভ করে সহদেব পর্যন্ত প্রত্যেকেই যাঁদের পিতা বলে ডাকেন, তাদের একজনের সত্ত্বা অলৌকিক, অন্যজনের লৌকিক। কিন্তু এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন দুর্যোধন ইত্যাদি কৌরব ভাইয়েরা। তৃতীয় জেনারেশনে এসে দেখা যাচ্ছে আমরা দুই ধরনের জ্ঞাতি-সংঘ পাচ্ছি–যাদের একটি বর্গের পিতৃত্ব দেবলোকের হাতে, অন্য বর্গের পিতৃত্ব মনুষ্যলোইে সীমাবদ্ধ। পাণ্ডুপুত্রেরা প্রত্যেকেই জন্মেছেন নির্দিষ্ট দেবতার ঔরসে, অন্যদিকে আছেন ধৃতরাষ্ট্র যিনি সম্পূর্ণ মনুষ্যোচিতভাবে জন্ম দিয়েছেন তাঁর পুত্রদের ততঃ কালেন সা গর্ভং ধৃতরাষ্ট্ৰাথাগ্রহী।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, গান্ধারীর ওপর মহাদেবের যে বর ছিল অথবা পরবর্তীকালে ব্যাসের কাছ থেকেও যে বরলাভের কথা শুনলাম, তার মধ্যে কিছু অতিবাদ থাকতেই পারে; হয়ত গান্ধারী শতপুত্র না হলেও অনেকগুলি পুত্র লাভ করেছিলেন, হয়ত তার প্রসবের নির্দিষ্ট সময় অবশ্যই পেরিয়ে গিয়েছিল এবং হয়ত তার গর্ভমুক্তির পর অন্যতম কিছু শুক্রবারও পরামর্শ পেয়েছিলেন গান্ধারী। কিন্তু তার পুত্র জন্মের মধ্যে সাংঘাতিক কোনও অলৌকিকতা নেই। যা পাণ্ডুর ক্ষেত্রে আছে।

আমরা এ বিষয়ে আর বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। শুধু এইটুকু বলব যে, ভবিষ্যতে যে বিশাল ঐতিহাসিক যুদ্ধটি ঘটবে, অথবা হস্তিনাপুরের সিংহাসন নিয়ে ভবিষ্যতে যে বিশাল দ্বন্দ্ব আরম্ভ হবে, তারই যেন সামান্য মুখপাত করে দিলেন মহাভারতের কবি এবং তাও একটি মাত্র পংক্তিতে–গান্ধারীর গর্ভকাল যখন এক বৎসর হয়ে গেছে, কুন্তী তখন ধর্মদেবকে আহ্বান করার জন্য প্রস্তুত হলেন। লৌকিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে গান্ধারী যে পুরো এক বৎসর কাল গর্ভধারণ করেছিলেন এবং কুন্তী যে তার পরে ধর্মদেবকে আহ্বান করেছেন–তা মনে হয় না। আমাদের ধারণা–গান্ধারীর গর্ভধারণের সংবাদ অরণ্যবাসী পাণ্ডুর কাছে পূর্বাহ্বে পৌঁছে গিয়েছিল বলেই পাণ্ডু পুত্রলাভের জন্য অত ব্যস্ত হয়েছিলেন। তারপরে পাণ্ডু যখন কুন্তীর কাছে শুনলেন যে, দেবতার ঔরসে পুত্রাকাক্ষা করলে সদ্যই পুত্র জন্মাবে, তখন তিনি আর দেরি করেননি। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ধর্মদেবের কাছ থেকে পুত্র লাভ করার জন্য কুন্তীকে অনুরোধ করেছেন।

 পাণ্ডুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে কুন্তী সেই নিরাকার নির্বিশেষ ধর্মদেবের পূজা করলেন, পূজা করলেন বিশ্বজনের হিতের আধার সেই দেবতাকে। তারপরে দুর্বাসার সঙ্গম-সাধন সিদ্ধমন্ত্র জপ করে আহ্বান জানালেন ধর্মরাজকে–জজাপ মন্ত্রং বিধিবদ দত্তং দুর্বাস পুরা। মন্ত্রের বশীকরণ স্পর্শ করল ধর্মরাজের মর্মস্থানে। বশীকৃত দেবতা সূর্যসঙ্কাশ বিমানে আরোহণ করে অন্তরীক্ষ লোক থেকে নেমে এলেন ভূঁয়ে। তিনি সহাস্যে বললেন–কী চাও তুমি আমার কাছে, কী দিতে হবে আমায়। ধর্মরাজের হাসির উপহার হাসি দিয়েই ফিরিয়ে দিলেন কুন্তী। টীকাকারেরা বললেন–ঋষির মন্ত্রশক্তি কাজ করছে, তাই হাসির উপঢৌকন দিয়ে কুন্তী খানিকটা লঘু করে দিলেন সঙ্গম-সাধনের ব্যাপারটা। বললেন–কী আবার? একটি পুত্র চাই–সা তং বিহস্যমানাপি পুত্রং দেহব্রীদিদম্।

পাণ্ডু পুত্রার্থে এই দেবতার নিয়োগ অনুমোদন করেছেন বটে, কিন্তু তার সামনেই তার পত্নীর সঙ্গে উপস্থিত দেবতার শারীরিক সংসর্গ রুচিকর নয় বলেই মহাভারতের কবি একটু অরণ্য-পর্বতের বর্ণনা দিলেন। বললেন–শতশৃঙ্গ পর্বত বহু পশু-পাখী-সমাকীর্ণ এবং অরণ্যসঙ্কুল। সেই অরণ্যের ভিতর কুন্তী পাণ্ডুর জন্য–শুধু পাণ্ডুর জন্য–ধর্মদেবের সঙ্গে মিলিত হলেন–পাণ্ডারর্থে মহাভাগা কুন্তী ধর্মমুপাগমৎ। ঋতুস্নাতা কুন্তী পবিত্র শুক্লবাস পরিধান করে ধর্ম–দেবতার সঙ্গে শয্যা গ্রহণ করলেন–শয্যাং জগ্রাহ সুশ্রোণী সহ ধর্মের্ণ সুব্রতা। একই পংক্তিতে যুগপৎ সুশ্রোণী এবং সুব্রতা কথাটি সঙ্গম-সাধনে কুন্তীর আকর্ষণীয়ত্ব এবং যান্ত্রিকতা–দুইই সূচনা করে।

 ধর্মদেব জগতের হিতের প্রতীক, সত্য এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতীক। তিনি আজ কুন্তীর বশীকরণমন্ত্রে আপ্লুত হয়ে যোগের ঐশ্বর্যে মূর্তি ধারণ করেছেন। সেই যোগমূর্তিধর ধর্মের সঙ্গে সঙ্গত হয়ে–ধর্মেণ সহ সঙ্গম্য যোগমূর্তিধরেণ সা–যাঁকে পুত্র হিসেবে পেলেন কুন্তী, সেই তিনিই পাণ্ডুর প্রথম পুত্র। তার নাম হল যুধিষ্ঠিরযুধিষ্ঠির ইতি খ্যাতঃ পাণ্ডেঃ প্রথমজঃ সুতঃ।

সে সময়টা ছিল জ্যৈষ্ঠমাস, পূর্ণিমা লেগেছে। দিনের বেলায় সূর্য যখন একেবারে আকাশের মাঝখানে স্থির হয়ে তাপ বিকিরণ করছেন, সেই সময়ে যুধিষ্ঠির জন্মালেন। তার জন্মমাত্রেই আকাশ থেকে দৈববাণী হল–এ ছেলে তোমার ধার্মিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবে। এমন মানুষও দ্বিতীয়টি দেখা যাবে না। এ ছেলে তোমার বিখ্যাত রাজা হবে–ভবিতা প্রথিতে রাজা ত্রিষু লোকে্যু বিশ্রুতঃ। তোমার এই ছেলের যশ যেমন হবে, তেমনই হবে তার তেজ, আর তেমনই নির্মল চরিত্র–যশসা তেজসা চৈব বৃত্তেন চ সমন্বিতঃ।

আচ্ছা, যুধিষ্ঠিরের নাম যুধিষ্ঠির হল কেন? এর কি কোনও কারণ আছে? হয়ত নেই, হয়ত আছে। মাতা-পিতা অনেক আশায় পুলকিত হয়ে পুত্রের নামকরণ করেন। কখনও সে নাম পুত্রের স্বভাব বা কর্মের সঙ্গে মেলে, কখনও বা তা মেলে না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের নাম তার পিতা-মাতা রাখেননি। অন্তরীক্ষলোকের ভাষায় দৈববাণীতে তার নাম উচ্চারিত হয়েছে। যুধিষ্ঠির বলে। কাজেই এ নাম একেবারে অর্থহীন হবে বলে মনে হয় না।

.

৮২.

 যুধিষ্ঠিরের পিতা ধর্মদেবের বৈদিক কল্প খুঁজতে গিয়ে প্রোফেসর ডুমেজিল যে কেন বৈদিক মিত্রকে খুঁজে বের করলেন, তার একটা কারণ বুঝতে পারি। এ কারণ তিনি নিজে বলেননি, তবে আমাদের ধারণা, এটা একটা কারণ হতে পারে। যুধিষ্ঠিরের নামও দেখুন, কাজও দেখুন। যুধিষ্ঠিরের মানে যুদ্ধেও যিনি স্থির থাকতে পারেন–যুধি স্থিরঃ। সামান্য তর্কাতর্কি করতে গেলেই যেখানে আমাদের মাথা ঠিক থাকে না, সেখানে যুদ্ধকালেও যুধিষ্ঠির মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। যুদ্ধে তিনি হেরে গেলেন, তাতে বয়ে গেল, আবার জিতলেন, তাতেও কিছু বিকার হল না। অস্ত্রপরীক্ষার সময় কোনও অস্ত্ৰক্ষমতা প্রদর্শন করতে না পেরে আচার্য দ্রোণের কাছে বকুনি খেলেন, তাতে তার কোনও লজ্জাও হল না, মান-সম্মানও গেল না। আবার জ্ঞাতিশত্রুর উপদ্রবে বনে গেলেন, তাতেও তার কোনও দুঃখ নেই। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে শাস্ত্রচর্চা করে তার দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। আবার যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ জিতে সিংহাসন এল তার হাতের মুঠোয়, তখন তিনি শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি দেখে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন।

অতএব এ এক আশ্চর্য স্থির, শীতল চরিত্র। বৈদিক দেবতা মিত্র হলেন সত্য, ধর্ম এবং সামাজিক শৃঙ্খলার অধিকর্তা। যে দেবতার সঙ্গে তার গাঁটছড়া বাঁধা আছে সেই বরুণের চরিত্র কিন্তু অন্য রকম। এমনকি দুজনের খাবার-দাবারের আহুতিও অন্যরকম। মিত্রাবরুণের বরুণ যদি গরম গরম খাবারের আহুতি পছন্দ করেন তো মিত্র পছন্দ করেন ঠান্ডা–শীতল আহুতি বরুণদেব পাপ-তাপ-খারাপ–সব গ্রহণ করেন, কিন্তু মিত্র গ্রহণ করেন সত-ঋত-ভালটা যুধিষ্ঠিরের পিতা ধর্মদেবের মধ্যে মিত্রদোবের এই স্থিরতা, শীতলতা এবং ধর্মবুদ্ধি বৈদিক অনুক্রমেই এসেছে এবং ধর্মদোবের এই সব দৈবগুণ সঞ্চারিত হয়েছে তার পুত্র যুধিষ্ঠিরের মধ্যে। বৈদিক মিত্রের মধ্যে পুরোহিত ব্রাহ্মণের স্বভাব–ব্রহ্মব মিত্রঃ। সত্যেই তাঁর প্রতিষ্টা!

ধর্মের পরম্পরায় যুধিষ্ঠিরও যতটা না ক্ষত্রিয়, তার চেয়ে বেশি ব্রাহ্মণ। এই স্থিরতা শীতলতার জন্যই তিনি যুদ্ধেও স্থির–অর্থাৎ যুধিষ্ঠির।

ক্ষত্রিয়ের বর্ণে জন্মগ্রহণ করেও যুধিষ্ঠিরের ব্রাহ্মণত্বের কথায় পরে সময়মতো আসব। আপাতত জানাই–পাণ্ডু বনবাসী হলেও তিনি হস্তিনাপুরের ন্যায়সঙ্গত রাজা এবং রাজা বলেই তার প্রথম পুত্রের জন্ম-সংবাদ খুব তাড়াতাড়িই হস্তিনাপুরে পৌঁছল। আর এদিকে ধর্মদেবের কাছ থেকে এক পরম ধার্মিক পুত্র লাভ করায় পাণ্ডু কুন্তীকে বললেন–লোকে বলে–শক্তিতে, ক্ষমতায় ক্ষত্রিয় জাতি হল সবার প্রধান। তাই বলছিলাম–আবার এমন একটি পুত্র তুমি দেবতাদের কাছে চাও যে পুত্র হবে অসীম শক্তিধর–আহুঃ ক্ষত্রং বলজ্যেষ্ঠং বলশ্রেষ্ঠং সুতং বৃণু। পাণ্ডুর কথা শুনে কুন্তী বায়ুকে আহ্বান করলেন–বায়ুমেবাজুহাব সা। লক্ষণীয় ধর্মদেবকে ডাকবার সময় পাণ্ডু নিজেই তার মনোনয়ন জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বায়ুর কথা বালেননি। কুন্তী নিজেই তাকে ডেকেছেন। এই ঘটনা থেকে–অন্তত যদি দৈব-সন্তান লাভের ঘটনায় বিশ্বাস করতে হয়, তবে এই ঘটনা থেকে বুঝতে হবে যে, বৈদিক দেবতার বলাবল সম্বন্ধে কুন্তী যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। বেদে বায়ু হলেন সবচেয়ে দ্রুতগতির দেবতা–বায়ু র্বৈ ক্ষেপিষ্ঠা–এবং তাঁর তেজ, শক্তি এবং সোমপানের ক্ষমতা নিয়েও নানা মুখরোচক কাহিনী আছে বেদে। ক্ষেত্রবিশেষে তিনি দেবশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রের থেকেও বেশি শক্তিমান।

 পাণ্ডু যেহেতু কুন্তীর কাছে শুধু মহাবলী এক পুত্র চয়েছেন, অতএব বায়ুকে মনোনীত করতে কুন্তীর দেরি হয়নি। আহ্বানমাত্রেই বায়ু তার বাহনে চড়ে কুন্তীর কাছে এসে উপস্থিত হলেন–ততস্তামাগত বায়ুগারূঢ়ো মহাবলঃ। বেদে, কিন্তু আমরা বায়ু-দেবতাকে অশ্বের বাহনে চড়ে আসতে দেখেছি এবং সেই অশ্বগুলির রঙ আবার কালচে লাল। মহাভারতেও বায়ুর মৃগবাহনটিকে হরিণ ভাবার কোনও কারণ নেই। মৃগ বলতে সংস্কৃতে যে কোনও পশুকেই বোঝায় এবং এখানে সেই পশুকে অশ্ব ভাবাই ভাল। বায়ু কুন্তীর কাছে এসে বললেন–তুমি কী চাও আমার কাছে? যা তোমার মন চায় খুলে বল–হি যত্তে হিদি স্থিত। কুন্তী সলজ্জে হেসে বললেন–পুত্র চাই দেব। সমস্ত বীরের দর্প খর্ব করে দিতে পারে এমন এক মহাকায় এবং মহাবীর পুত্র চাই তোমার কাছে–বলবন্তং মহাকায়ং সর্বদর্পপ্রভঞ্জনম।

কুন্তী পূর্বোক্ত পদ্ধতিতেই মিলিত হলেন বায়ুদেবের সঙ্গে এবং তার ঔরসে কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র জন্ম গ্রহণ করলেন। তার নাম ভীম, শক্তিতেও তিনি ভীষণতম্মা জজ্ঞে মহাবাহু–ভীমো ভীমপরাক্রমঃ। ভীমের জন্মমাত্রেই আকাশ থেকে দৈববাণী হল–সমস্ত শক্তিমান লোকের মধ্যে তোমার এই ছেলে হবে সবচাইতে শক্তিমান–সর্বোং বলিনাং শ্রেষ্ঠো জাতোয়মিতি ভারত। ভীম জন্মাবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর লোকোত্তর শারীরিক শক্তির পরিচয় পাওয়া গেল। সেদিন শিশু ভীমকে কোলে নিয়ে কুন্তী এমনিই বসে ছিলেন। শতশৃঙ্গ পর্বতের অরণ্যভূমি। বাঘ-সিংহের ভয় সেখানে যথেষ্ট। হঠাৎই চোখের সামনে একটা বাঘ দেখে কুন্তী হতচকিত হয়ে প্রাথমিক রিফ্লেকসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তার কোলের মধ্যে যে শিশু ভীম ঘুমিয়ে আছেন, সেকথা তার খেয়ালই হল না–নাম্ববুধ্যত তং সুপ্তমুৎসঙ্গে স্বে বৃকোদর।

 ভীম কুন্তীর কোল থেকে একটি পাথরের ওপর পড়ে গেলেন। মহাভারতের কবির মতে ভীম পড়ে যাবার ফলে তার নিজের কোনও শারীরিক ক্ষতি তো হলই না, বরঞ্চ যে পাথরটির ওপর তিনি পড়ে গিয়েছিলেন, সেটি তার শরীরের চাপে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল। ছেলের এই অতিমানুষিক শক্তি দেখে পিতা পাণ্ডুর বুক গর্বে ভরে উঠল। তিনি অবাক বিস্ময়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, হয়ত বা ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে তার অন্তরাত্মা পরিপূরিত হল।

বাস্তবে আমরা এই ঘটনাটা নাও বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু মহাকাব্যের কবি যখন নিজের বর্ণনাকে অতিবাদে ভারাক্রান্ত করেন, তখন তার কথার ভাবটুকু গ্রহণ করতে হয়। অর্থাৎ ভীম পড়ে গেলেন এবং তার শরীরের আঘাতে পার্বত্য শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হল–পততা তেন শতধা শিলা গাত্রৈর্বিচূর্ণিত–এই ঘটনার মধ্যে শিলা বিচূর্ণনের অতিবাদে মহাকাব্যের কবি বুঝিয়ে দিলেন যে, ভীমের শরীরের গঠন ছিল অতিশয় শক্তপোক্ত। হয়ত তিনি কোনও সময় মায়ের কোল থেকে পড়ে গিয়েছিলেন, তবু তার তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। ব্যস, এ ঘটনার মধ্যে এইটুকুই ধরার। তার বেশি কিছু নেই।

পাণ্ডুর পুত্র জন্মের অন্তরে অন্তরে মহাভারতের কবি কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির জরুরী খবর শুনিয়ে যাচ্ছেন। একবার যুধিষ্ঠিরের জন্মের সময় তিনি বলেছেন যে, পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ-পুত্রের জন্ম-সংবাদ হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছল। এখন তিনি খবর দিচ্ছেন–যে দিনে ভীম জন্মেছিলেন, দুর্যোধনও জন্মেছিলেন সেইদিনই–যস্মিন্নহনি ভীমস্তু জজ্ঞে ভরতসত্তম। দুর্যোধনোপি তত্রৈব প্রজজ্ঞে…। আসলে ভীম জন্মেছিলেন চৈত্রমাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে দিনের বেলায় আর দুর্যোধন জন্মেছিলেন ওইদিনই রাত্রিবেলায়। সময়ের এইটুকু হেরফেরে দুজনের ঠিকুজি-কোষ্ঠী একটু অন্যরকম হয়ে গেল। দুজনেরই সিংহরাশি কিন্তু ভীমের মিথুন লগ্ন আর দুর্যোধনের তুলা-লগ্ন। আর লগ্ন থেকেই যেহেতু জাতকের ভাল-মন্দ বিচার হয়, তাই দুর্যোধনের স্বভাব ভীমের থেকে আলাদা। অবশ্য ভীমের জন্ম যত সহজে হল, দুর্যোধনের জন্ম তত সহজে হয়নি।

ভূয়োদর্শিনী গান্ধারী যুধিষ্ঠির জন্মাবার আগেই গর্ভধারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রসূতা হননি। যে মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের জন্ম-সংবাদ অন্তঃপুরে এসে পৌঁছল–ত্ব কুন্তীসুতং জাতং– সঙ্গে সঙ্গে গান্ধারী ঈর্ষায় ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের গর্ভে আঘাত করলেন। এই মুহূর্তটির কথা ধৃতরাষ্ট্র নাকি জানতেন না। কিন্তু গান্ধারী ইচ্ছে করে নিজের গর্ভপাত করলেন–সোদরং পাতয়ামাস, গান্ধারী দুঃখমূচ্ছিা।

এখানে দুঃখমূচ্ছিতা মানে, দুঃখে কাতর হয়ে গান্ধারী তার গর্ভমোচন করলেন অকালে–এমনটিই হয়। কিন্তু এই দুঃখ যে ঈর্ষাজনিত, সেকথা গান্ধারী নিজেই পরে স্বীকার করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল–গান্ধারীকে আমরা একটু অন্যভাবে চিনি। গান্ধারীর ধৈর্য এবং ধর্মবোধ পরে প্রবাদে পরিণত হবে। সেই গান্ধারীর এমন অদ্ভুত অসহিষ্ণুতা দেখে মনে হয়–ধৃতরাষ্ট্রের জটিলতাই এখানে গান্ধারীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে থাকবে। যতই বলা হোক ধৃতরাষ্ট্র কিছু জানতেন না–অজ্ঞাতং ধৃতরাষ্ট্রস্য–আর গান্ধারী স্বেচ্ছায় এই কর্ম করে বসলেন–এ কথা ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। অন্ধত্বের কারণে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য পাননি–এই ক্ষোভ ধৃতরাষ্ট্রকে অহর্নিশি পীড়া দিত। পাণ্ডু বনে প্রব্রজিতা হবার পর থেকে তার মনে তীব্র আশা ছিল যে, জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজে রাজা হতে পারেননি বটে, কিন্তু তাঁর পুত্র যদি পাণ্ডুর পুত্রটির থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ হয়, তবে তাঁর পুত্রই রাজ্য লাভ করবে। অন্তত আত্মজ পুত্রের রাজসুখ দেখে তিনি নিজের মনে মনে রাজা হবার সুখ মেটাবেন।

আমাদের ধারণা—ধৃতরাষ্ট্রের এই মনোবৃত্তি কিংবা আশা আকাঙ্ক্ষার কথা মনস্বিনী গান্ধারী জানতেন এবং এই বিষয় নিয়ে গান্ধারীর সঙ্গে তাঁর বারংবার আলোচনাও হয়েছে নিশ্চয়। কাজেই আমাদের ধারণা, আপাতত এই গর্ভপাতের ঘটনাটা ধৃতরাষ্ট্রের অজান্তে ঘটলেও গান্ধারী তাঁর মনোগত ইচ্ছার দ্বারা এতটাই চালিত হয়েছিলেন যে, তার মতো ধর্মশীলা নারীর মধ্যেও ঈর্ষার বীজ উৎপন্ন হয়েছিল। কিন্তু দূরদৃষ্ট এমনই যে, গর্ভে আঘাত হানার পরেও তার অভীষ্ট পূরণ হল না। তার গর্ভ থেকে বহির্গত হল লোহার মতো শক্ত এক মাংসপিণ্ড–ততো জজ্ঞে মাংসপেশী লৌহষ্ঠীলেব সংহতা। গর্ভপাতের লক্ষণযুক্ত সেই মাংসপেশীটি ফেলে দেওয়ার কথাই ভাবলেন গান্ধারী।

মহাভারতের কবি লিখেছেন–গান্ধারীর এই ইচ্ছের কথা ধ্যানযোগে জানতে পারলেন ব্যাস। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হলেন হস্তিনাপুরে। তিনি মাংসপিণ্ডটি দেখে গান্ধারীকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি এই মাংসপেশীটি নিয়ে কী করতে চাও এখন–কিমিদং তে চিকীর্ষিত?

গান্ধারী তার হৃদয়ের সমস্ত সত্য নিবেদন করলেন শ্বশুর ব্যাসের কাছে। তিনি যে কুন্তীর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে আপন গর্ভে আঘাত হেনেছিলেন সেকথাও অকপটে জানালেন তাকে দুঃখেন পরমেণেদমুদরং পাতিতং ময়া। সামান্য একটু অভিমানও করলেন ব্যাসের প্রতি। বললেন–আপনি আমাকে শত পুত্র লাভ করার বর দিয়েছিলেন, কিন্তু শতপুত্র দূরে থাক আমার গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে এই লোহার মতো এক মাংসপেশী।

ব্যাস বললেন–আমি বৃথা আলাপের সময়েও কখনও মিথ্যা কথা বলিনি, তাই আমার আশীর্বাদ মিথ্যা হবে না। তুমি খুব তাড়াতাড়ি একশটা কলসী নিয়ে এস এবং সেগুলিতে ঘি ভরে রেখে দাও। এইবার অতিশীতল জলে এই মাংসপিণ্ডটিকে ভিজিয়ে রাখ– শীতাভিরদ্ভিরষ্ঠীলামিমাঞ্চ পরিষেচয়। ব্যাসের কথা শুনে গান্ধারী শীতল জলে মাংসপিণ্ডটিকে বারবার সিঞ্চন করতে থাকলেন। আস্তে আস্তে মাংসপিণ্ডটি অনেকগুলি খণ্ডে বিভক্ত হল। ব্যাস প্রত্যেকটি খণ্ডকে তারপর রেখে দিলেন ঘৃতপূর্ণ কলসীতে। সুরক্ষিত স্থানে কলসীগুলি রেখে দেওয়া হল। ব্যাস বললেন–ঠিক এক বৎসর পরে কলসীগুলির মুখগুলি তুমি খুলবে–উদঘাটনীয়ান্যেতানি কুম্ভানীতি চ সৌবলীম্।

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস তার সুপরামর্শ দিয়ে হিমালয়ে প্রস্থান করলেন। লক্ষণীয়, এও কিন্তু এক কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় পুত্রোৎপাদনের ব্যাপার। আমরা একথা বলছি না যে, এখনকার দিনে যেভাবে টেস্টটিউব বেবি তৈরি হচ্ছে, যেভাবে মাতৃগর্ভে কৃত্রিম বীজ স্থাপন করা হচ্ছে–সেই পদ্ধতিতে তেমন কিছু এখানেও করা হয়েছে। সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে, চিকিৎসাশাস্ত্রের এই আধুনিক উন্নত ভাবনাগুলি তাদের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু উলটোদিকে একথা ঠিক যে, তাদের নিজের মতো করে প্রাচীনেরাও এই বিদ্যা কিছু কিছু জানতেন। সবচেয়ে বড় কথা–ব্যাসের এই গর্ভসংস্থাপনের প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত শীতল জল এবং ঘূতপূর্ণ কলসীগুলি আধুনিক চিকিৎসা–পদ্ধতির গন্ধবহ বটেই।

 অথবা এমনও বলা যায় যে, দা ভিঞ্চি যেমন এয়ারোপ্লেনের যুগে জন্মগ্রহণ না করেও বহুপূর্বেই বায়ুযানের ছবি আঁকতে পেরেছিলেন, তেমনই টেস্টটিউব বেবির যুগে না জন্মেও ব্যাস মাতৃগর্ভ প্রতিস্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দা ভিঞ্চি চিত্রকর, ব্যাসদেব কৰি। এই দুই &দর্শী শিল্পীর মনে যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নের ছায়া পাই এয়ারোপ্লেনের ছবিতে অথবা মাংসপেশীর প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়ায়।

যে যাই হোক, বাস যেহেতু গান্ধারীকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে বললেন, অতএব তার জ্যৈষ্ঠ পুত্রের জন্ম অন্তত এক বছর পিছিয়ে গেল এবং দুর্ভাগ্যক্রমে তা মিলে গেল কুন্তার পুত্র ভীমের জন্মতিথির সঙ্গে। দুর্যোধন ভীমের জন্মরাশিতে যেন পদার্পণ করেই জন্মালেন। দিন আর রাতের এই দুই জাতক দিন-রাত্রির মতোই বিপরীত আকর্ষণে শত্রু হয়ে থাকবেন চিরকাল।

মহাভারতের কবি ধৃতরাষ্ট্রের প্রথম পুত্র দুর্যোধন জন্মাবার সঙ্গে-সঙ্গেই নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের মতো ঘোষণা করে দিলেন যে, জন্মের প্রমাণে যুধিষ্ঠিরই কৌরব-পাণ্ডবদের মধ্যে সবার চাইতে বড়-জন্মতস্তু প্রমাণেন জ্যেষ্ঠো রাজা যুধিষ্ঠিরঃ। ভবিষ্যতে হস্তিনাপুরের সিংহাসনের অধিকার নিয়ে যে লড়াই লাগবে, সেখানে তৎকালীন দিনের ভাবনা অনুযায়ী ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরই যে সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত দাবিদার–সে ব্যাপারে মহাভারতের কবি নিজের মতটি আগেই জানিয়ে রাখলেন।

ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর প্রথম পুত্র দুর্যোধন জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি গর্দভের মতো কর্কশ শব্দ করে কেঁদেছিলেন–রাসরাবসদৃশং ররাব চ ননাদ চ। দুর্যোধনের ওই শব্দের প্রতিধ্বনি করে ডেকে উঠেছিল শেয়াল, শকুন, কাকেরা। চারিদিকে নানা দুর্লক্ষণও দেখা দিল এবং তাতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র চিন্তিত হলেন রীতিমতো। তিনি ভীষ্ম, বিদুর এবং অন্যান্য মন্ত্রী ব্রাহ্মণদের সভায় ডেকে এনে বললেন–আমাদের এই বিখ্যাত কুরুকুলের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে যে ছেলেটি, সেই যুধিষ্ঠির তো রাজ্য পেয়েই গেছে, অতএব সেখানে আমার কিচ্ছুটি বলার নেই; কুমার যুধিষ্ঠিরের পর আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন রাজা হতেরবে তো–অয়ন্তু অনন্তরস্তম্মাদপি রাজা ভবিষ্যতি?

 ধৃতরাষ্ট্রের এই সামান্য কথা থেকেই বোঝা যায় রাজ্য পাবার জন্য তার কতটা আকূতি ছিল। নিজে নাই পেলাম, অন্তত–ছেলে রাজ্য পাক–এইরকম এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই ধৃতরাষ্ট্রের মানসিক জটিলতা তৈরি হতে থাকে। এরপরে তিনি যখন বুঝলেন যে, জন্মের প্রমাণে যুধিষ্ঠিরই সর্বজ্যেষ্ঠ এবং তিনি হস্তিনাপুরের অধিকার পাবেন, তখন তিনি সখেদে বলেছেন–যুধিষ্ঠির রাজ্য পাক–তাতে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই–ন তস্মিন্ বাচ্যমস্তি নঃ–কিন্তু তার পরে আমার দুর্যো। রাজ্য পাবে তো?

প্রশ্নটা সভাসদগণের কাছে অত্যন্ত বিরক্তিকর ছিল। কে যুধিষ্ঠির, কোথায় যুধিষ্ঠির এখনও তাঁকে চোখে দেখা যায়নি। যদি বা ধরে নেওয়া যায়–পাণ্ডুপুত্র নিজের অধিকারে না হয় এসেই পড়লেন হস্তিনায়, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের চেয়ে একবছরের মাত্র ছোট হয়ে দুর্যোধন কতদিন তার অগ্রজের মৃত্যুর অপেক্ষা করবেন আর কবেই বা রাজা হবেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নটা মোটেই এত সরল নয়। তিনি ভাবছেন–বয়সে বড় ভাই হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাজ্য পাননি। তার পরবর্তী বংশেও তাঁর অনুজের পুত্র যুধিষ্ঠির রাজা হবেই। এরপর আবার বংশপরম্পরায় যুধিষ্ঠিরের পুত্রই রাজা হবে ভবিষ্যতে। ধৃতরাষ্ট্র এটা চলতে দিতে চান না। তার ইচ্ছে–যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকাল পেরিয়ে যাবার পরেও যদি দুর্যোধন রাজা হয়, তবে সেই অভিষিক্ত রাজার পুত্রটি অন্তত হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসবে, অন্তত তাতে ধৃতরাষ্ট্রের বংশ-পরম্পরা সিংহাসনের অধিকারী হবে, পাণ্ডুরা নয়।

ধৃতরাষ্ট্রের এই কূটবুদ্ধি সভাসদ মন্ত্রীরা, বিশেষত ভীষ্ম এবং বিদুর অবশ্যই খুব ভাল বুঝেছেন। জন্মের তারিখ এবং বয়সের নিরিখে যুধিষ্ঠিরই যে রাজ্যলাভের ন্যায়সঙ্গত অধিকারী–সে কথা ভীষ্ম এবং বিদুরকেও আলাদা করে জানানো হয়েছিল–তদাখ্যাত ভীষ্ময় বিদুরায় চ ধামতে। অতএব ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন শুনে তারা কী বুদ্ধিকরলেন, সেটাও লক্ষ্য করার মতো। ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি আবারও সেই শেয়াল-কুকুর শকুনের অমঙ্গলসূচক শব্দ শোনা গেল আর সেই অমঙ্গলের শব্দ শুনেই বিদুর বলে উঠলেন–আপনার বড় ছেলে জন্মাবার সঙ্গে-সঙ্গেই যখন এইসব অকল্যাণকর প্রাণীদের শব্দ শোনা যাচ্ছে, অতএব আপনার এই পুত্র এই বিখ্যাত কুরুবংশের সর্বনাশ ডেকে আনবে বলেই আমাদের মনে হচ্ছে। আপনি বরং আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে পরিত্যাগ করুন। একশ ছেলের জায়গায় একটিকে বাদ দিয়ে যদি আপনার নিরানব্বইটি ছেলেও থাকে–শতমেকোনমপ্যস্ত –তাতেও এই কুলের শান্তি থাকবে–ত্যজৈনমেকং শান্তিঞ্চেৎ কুলস্যেচ্ছসি ভারত।

শান্তি। বিখ্যাত ভরতবংশের শান্তি নেমে আসবে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে মহারাজ ভরতের নামে সম্বোধন করলেন, কারণ রাজ্যের স্বার্থে এবং বৃহত্তর প্রজাপালন-ধর্মের স্বার্থে মহারাজ ভরত তার অনুপযুক্ত পুত্রদের ত্যাগ করেছিলেন। বিদুর সেই দৃষ্টান্তের অনুবৃত্তি কামনা করলেন ভরতবংশের অধস্তন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। বস্তুত শেয়াল-শকুনের ডাক এবং অন্যান্য দুর্নিমিত্তের মহাকাব্যিক বর্ণনার মধ্যে সত্যই কোনও দুর্লক্ষণ ছিল কিনা আমাদের জানা নেই। কিন্তু স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের মধ্যেই কুরুবংশের অশান্তির লক্ষণ সুপ্ত ছিল। যুধিষ্ঠির যখন রাজা হবেনই এবং সেটা যখন নিয়তির মতো ধৃতরাষ্ট্রের ভাগ্যে নেমে এসেছে, সেখানে ধৃতরাষ্ট্রের ওই প্রশ্নের মধ্যেই অশান্তির দুর্লক্ষণ ছিল। সেটা বুঝেই মহামতি বিদুর এবং হস্তিনাপুরের রাজসভার অন্যান্য ব্রাহ্মণ-মন্ত্রীরা রাজধর্মের বিধান দিয়ে বললেন–বংশের শান্তির জন্য একজনকে পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়–ত্যজেদেকং কুলার্থে। আর যদি একটি জনপদ বা গ্রাম রক্ষার জন্য আপন বংশকেও ত্যাগ করতে হয়, র্বে তাই করা উচিত–গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।

ভারতবর্ষে রাজধর্মের আদর্শ এইরকমই ছিল। বৃহত্তরের স্বার্থে আত্মস্বার্থ বলি দেওয়ার কথাই এখানে বলা হয়েছে। বিদুর সেই বৃহত্তর স্বার্থগুলি কোনটার চেয়ে কোনটা বড়–এই অনুক্রমে দেখিয়েছেন। বংশজনের জন্য কুলের অশান্তিকারী মানুষকে, একটি গোটা গ্রামের জন্য নিজের বংশকে, এবং সম্পূর্ণ দেশের জন্য একটা গ্রামকেও ত্যাগ করাটা রাজধর্মের নীতি। সবার ওপরে আছে নিজের কথা। অর্থাৎ তুমি নিজে যদি বিপন্ন হও, মৃত্যু যদি তোমার শিয়রে এসে দাঁড়ায় তবে তুমি দেশকেও জলাঞ্জলি দিতে পার। কারণ তুমি নিজে না বাঁচলে কিসের বংশ, কিসের গ্রাম কিসের দেশ–অতএব আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ। মানুষের কল্যাণকামী শ্রুতিশাস্ত্রও তাই বলে নিজেকে সর্বদা রক্ষা করবে–আত্মানং সততং গোপায়ীত।

যাই হোক বিদুরের এই নীতি উপদেশে ধৃতরাষ্ট্রের কিছু হল না। মহাভারতের কবি মন্তব্য করলেন–পুত্রস্নেহে অন্ধ রাজা বিদুরের কথা শুনলেন নান চকার তথা রাজা পুত্রস্নেহ-সমন্বিতঃ। মহাকাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী দুর্যোধনের পর ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের জন্ম হল এবং তার একটি কন্যাও হল, যার নাম দুঃশলা। গান্ধারী ছাড়াও একটি বৈশ্যা দাসী মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের ভোগ্যা ছিলেন। তিনি ঠিক বিবাহিতা স্ত্রী নন, অতএব ভোগ্যাত্বই তার বৈশিষ্ট্য। সেই বৈশ্যার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের আরও একটি পুত্র জন্মাল। তার নাম যুযুৎসু। ক্ষত্রিয়ের ঔরসে বৈশ্যার গর্ভজাত সন্তানের জাত হল করণ। যুযুৎসু এই করণজাতের সংকরজন্মা–জজ্ঞে ধীমাংস্ততস্তস্যাং যুযুৎসুঃ করণে নৃপ।

.

৮৩.

শতশৃঙ্গ পর্বতের রম্য বনভূমি ছেড়ে আমাদের আরও একবার যেতে হবে মথুরায়। নির্জন অরণ্যে বসে হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক জটিলতা কিছুই টের পাচ্ছিলেন না পাণ্ডু। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র যুধিষ্ঠির জন্মানোর এক বছর পর ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধন জন্মালেন। এই ঘটনায় হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে যে আবর্ত তৈরি হল, তার কোনও সংবাদই শতশৃঙ্গ পর্বতে এসে পৌঁছল না। অন্যদিকে মথুরায় কংসের কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন বসুদেব। তার ছয়টি পুত্র মারা গেছে। তার স্ত্রীর সপ্তম গর্ভটি অঘটনঘটনপটীয়সী যোগমায়ার শক্তিতে বসুদেবের পৌরবী গৃহিণী রোহিণীর গর্ভে প্রতিস্থাপিত হয়েছে এবং রোহিণীর গর্ভে বসুদেবের প্রথম পুত্র বলরাম জন্মেছেন বৃন্দাবনে।

আমরা যদি অলৌকিকতার মধ্যে না যাই, তবে এই মুহূর্তেই একটি কথা নিবেদন করতে। চাই। আমরা পূর্বে জানিয়েছি যে, বসুদেবের ছয়টি মৃত পুত্রকে সংখ্যাগতভাবে না দেখাই ভাল। আমরা পুরাণের প্রমাণ দিয়ে পূর্বে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, বসুদেবের ছয়টি পুত্রকে স্বচ্ছন্দে একটি একক ধরে নেওয়া যায়। অর্থাৎ পুরাণে উল্লিখিত ছয় বসুদেব-পুত্রের পূর্বজন্মের প্রমাণে যেহেতু এই একক ধরেই নেওয়া যায়, অতএব বলরামের জন্ম নিয়েও কোনও অলৌকিক ভাবনার মধ্যে আমাদের যেতে হয় না। কংস নিশ্চয়ই দেবকীর কোনও পুত্র-সন্তানকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনার পুর্বেই এবং বসুদেবের কারাগার প্রবেশের পূর্বেই তার পৌরবী পত্নী রোহিণীর গর্ভাধান সম্পূর্ণ হয়। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস–কংসের অত্যাচারে ভীত হয়েই বসুদেব বৃন্দাবনে তার প্রিয় সখা নন্দগোপের বাড়িতে রোহিণীকে পূর্বেই রেখে আসেন। এদিকে কারাগারে আবদ্ধ হবার পর দেবকীর গর্ভজাত তার একটি পুত্রের মৃত্যু যেমন ঘটে, তেমনি অন্যদিকে বৃন্দাবনেই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বলরাম জন্মগ্রহণ করেন। রোহিণীর গর্ভে দেবকীর গর্ভ প্রতিস্থাপনের অতিলৌকিক কাহিনী এইভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় বলে আমরা মনে করি।

বসুদেবের ওপর কংসের নজরদারি চরম অবস্থায় পৌঁছল। কারারক্ষীরা কংসকে খবর দিয়েছে যে, দেবকী পুনরায় গর্ভধারণ করেছেন। এর মধ্যে দেবতার রাজ্যে যে সব অভিসন্ধি রচনা হল, তা আগে পৌরাণিকের ভাষায় বলে নিই। পৌরাণিকেরা কৃষ্ণকে পরম ঈশ্বর বিষ্ণু হিসেবে কল্পনা করেছেন। অতএব পরমেশ্বর যখন মর্ত্য গর্ভে প্রবেশ করবেন, তখন আকাশ, নদী এবং প্রকৃতির রাজ্যে এক অপূর্ব প্রসন্নতার সৃষ্টি হবে–এটাই স্বাভাবিক–অথ সর্বগুলোপেতঃ কালঃ পরমশোভনঃ। বিষ্ণুপুরাণ আবার সালংকারে এমনই একটি শ্লোকরচনা করেছে, যাতে বোঝা যাবে যে কৃষ্ণ আসলে আধুনিক মিথলজিস্টদের বহুচর্চিত সৌরগোষ্ঠীর দেবতা (Solar god)।

বিষ্ণুপুরাণ বলেছে–জগৎরূপ পদ্মের বিকাশের জন্য দেবকীরূপ পূর্বসন্ধ্যাতে বিষ্ণুরূপ সূর্য আবির্ভূত হলেন

ততোখিল জগৎ–পদ্ম–বোধায়–অচ্যুতভানুনা।
দেবকী–পূর্বসন্ধ্যায়ামাবির্ভূতং মহাত্মনা।

বৈদিক বিষ্ণু আসলে সূর্যেরই স্বরূপ। সেই বিষ্ণু-সূর্য দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করলেন জগতের চেতনা উন্মীলনের জন্য। বৈদিক সূর্যের চরম মাহাত্ম্য আত্মসাৎ করে কৃষ্ণ যেদিন বসুদেব-দেবকীর সামনে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ধারণ করে দাঁড়ালেন, তখন কংসের অত্যাচার ক্লিষ্ট এই স্বামী-স্ত্রী-যুগলের মনের মধ্যে এক মিশ্রক্রিয়া তৈরি হল। একদিকে পরম-ঈশ্বরের চেতনা, একদিকে বাৎসল্য এবং অন্যদিকে কংসের ভয়-সব কিছু মিলে বসুদেব-দেবকী মোটেই শান্তি লাভ করলেন না। বসুদেব বললেন–আপনার এই দিব্যরূপের কথা আমরা জানি–জ্ঞাতোসি দেবদেবেশ শঙ্খ-চক্র-গদাধর। কিন্তু দয়া করে আপনার এই বিভূতি প্রকাশ বন্ধ করুন। দুরাত্মা কংস যদি একবার জানতে পারে যে, পরমেশ্বর বিষ্ণু আমারই ঘরে জন্ম নিয়েছেন, তাহলে আজই সে আমাদের মেরে ফেলবে–অদৈব দেব কংসোয়ং কুরুতে মম ঘাতন।

বসুদেবের সঙ্গে তাঁর পত্নীও এই অনুনয় করেছেন এবং ভাগবত-পুরাণে অপূর্ব স্তুতিময়ী ভাষায় এই অনুনয় ব্যক্ত হয়েছে। এই স্তুতি-নতির মধ্যে ব্রহ্ম-পরমাত্মা-ভগবানের দার্শনিক সমন্বয়ই শুধু নয়, পরম ঈশ্বরের কাছে এক বিত্ৰাসিত অসহায় মাতা-পিতার হাহাকার এমনভাবেই ব্যক্ত হয়েছে যে, পাঠকের কাছে তা সবিস্তারে তুলে ধরতে ইচ্ছা করে। গ্রন্থগৌরবের ভয়ে আমরা সে লোভ সম্বরণ করলাম এবং অতৃপ্তও থাকলাম। শুধু এইটুকুই জানাই যে পরমেশ্বর বিষ্ণু বসুদেব-দেবকীর উদ্দেশে বললেন–স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর নাম ছিল পৃশ্নি এবং সুতপা। কঠোর তপস্যা করে তোমরা আমাকে পুত্র হিসেবে পেতে চেয়েছিলে–বরং মৎসদৃশং সুতম্। আজকে তোমাদের সেই আশা পূরণ হবে এবং তোমাদের পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরিয়ে আনবার জন্যই আজকে এই অমর্ত্য রূপ তোমাদের সামনে প্রকট করলাম–এতদ্বাং দর্শিতং রূপং প্রাঞ্জন্মস্মরণায় মে।

পুরাণগুলির এই অংশে, যেখানে অবতারী ঈশ্বরের প্রতি দেবতাদের স্তুতি এবং বসুদেব দেবকীর স্তুতি বর্ণিত হয়েছে–এই অংশটিকে পৌরাণিকদের কল্পনা হিসেবেই চিহ্নিত করবেন আধুনিকেরা। আপাতত যদি অবতারবাদের মাহাত্ম্য এবং ভক্তির রাজ্য থেকে বিদায় নিই, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াবে হরিবংশ-পুরাণের ধারণা-মতো। হরিবংশ বলেছে–যে রাত্রিতে বৃষ্ণিবংশের ধুরন্ধর পুরুষ কৃষ্ণ বসুদেবের স্ত্রী দেবকীর গর্ভে জন্মালেন, সেই রাত্রেই নন্দগোপের পত্নী যশোদাও একটি কন্যা প্রসব করলেন

যামেব রজনীং কৃষ্ণো জজ্ঞে বৃষ্ণি কুলোদ্বহঃ।
তামেব রজনীং কন্যাং যশোদাপি ব্যজায়ত।

 যশোদাগর্ভজাতা এই কন্যাটি মহামাস-স্বরূপিণী কি না এবং তিনি শক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছায় কোনও মায়ার প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন কি না, সেই সব দার্শনিক তর্কেও আপাতত যাচ্ছি না; কারণ পুরাণকারেরা বহুবার বহুভাবে সে সব কথা বলেছেন, সহৃদয় পুরুষেরা বিশেষ আকৃষ্ট হলে সে সব কথা আপনিই জানতে পারবেন। তার চেয়ে আমরা যদি পৌরাণিকদের হাত ধরে কংসের কারাগারে প্রবেশ করি তাহলে দেখতে পাব–সেখানে গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। রোহিণী নক্ষত্র যুক্ত হল শুভদায়ী অভিজিৎ নক্ষত্র-মুহূর্তের সঙ্গে। এমনিতে কৃষ্ণাষ্টমীতে অন্ধকার এত তীব্র হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তখন বর্ষাকাল চলছে। আকাশে ঘন মেঘ। অবিরাম জলধারার মধ্যে বিদ্যুতের দ্যুতিতে মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কারাগারের অন্তর্দেশ। বসুদেব-দেবকী পুত্রের মুখ দেখতে পান এইভাবেই। শিশুটি শ্যামবর্ণ, অপূর্ব তার মুখ। শিশুর এই জন্ম-মুহূর্তে কোনও পৌরাণিক তার দেহ-সৌষ্ঠব বর্ণনা করেননি। শুধু হরিবংশ ঠাকুর একটি শ্লোকের অর্ধাংশমাত্রে নিবেদন করলেন যে, শিশুটি জন্মগ্রহণ করেই তার চোখ দুটি দিয়ে সমস্ত জগৎকে যেন ভুলিয়ে দিল–নয়নৈর্মোহয় প্রভু। পরবর্তী কালের আলংকারিকেরা বলেছেন–চোখ নাকি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রতিভূ হিসেবে কবিদের লেখনীতে ব্যবহৃত হয়। এখানেও হয়ত তাই–নয়নৈর্মোহয় প্রভুঃ।

আমরা এই মুহূর্ত থেকে ভাগবত এবং বিষ্ণুপুরাণের অতীন্দ্রিয় কবিত্বকল্প অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি যে, এই সব পুরাণগুলির থেকে হরিবংশ ঠাকুরের বর্ণনা অনেক বেশি বাস্তবের কাছাকাছি। হ্যাঁ, সেখানেও কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বের বিজ্ঞাপন কিছু কম নেই, কিন্তু তবু কৃষ্ণ-জীবনের কাহিনী সেখানে অনেকটাই মনুষ্যোচিত। তবে হরিবংশের বর্ণনা অনুযায়ীও আমরা এখন চলব না। বরঞ্চ সব ছেড়ে এখন আমরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো একটি নাটকের প্রথম দৃশ্যে মন দেব। কৃষ্ণের শিশু-কাল নিয়ে এর চেয়ে পুরনো নাটক আর নেই এবং সেই নাটকের মধ্যে অলৌকিকতার কিছু ভাগ থাকলেও, এখানকার ঘটনাপ্রবাহ অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। সবচেয়ে বড় কথা, পণ্ডিত-সুজনেরা মনে করেন যে মহাকবি ভাসের এই বালচরিত নাটকটি লেখা হয়েছে হরিবংশ পুরাণের পরিমণ্ডল ব্যবহার করে। সোজা কথায় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শতাব্দীতে লিখিত এই নাটকটি তার অব্যবহিত পূর্বের রচনা হরিবংশের সামাজিক বিশ্বাসটুকু উত্তরাধিকারীর কৃতজ্ঞতায় তুলে ধরেছে।

কৃষ্ণের জন্মকাল বর্ণনার সময় পুরাণগুলি বর্ষামুখর রাত্রির ঘোষণা করেছে বারবার। কিন্তু কৃষ্ণের জন্মকাল বলেই বর্ষার ধারাসার বর্ষণের পূর্বে বায়ু সেখানে সুখস্পর্শ, নদী প্রসন্নসলিলা, অগ্নি শান্ত। কিন্তু ভাসের নাটকের মধ্যে বর্ণনার এই অদ্ভুত দ্বিচারিতা নেই, বর্ষাকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ইমেজারি হিসেবে। বর্ষার জলধারা এবং বিদ্যুৎকে বসুদেব-দেবকী এখানে মোটেই সুলক্ষণ মনে করছেন না। তাদের মতে এ পরম দুর্লক্ষণ, কিন্তু দুর্লক্ষণ যেন রান্না কংসের দুর্ভাগ্য সূচনা করছে। দেবকী বলছেন–ছেলের জন্মের সময় যে সব সাংঘাতিক লক্ষণ দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে আমার ছেলেটি বেশ বড় মানুষ কেউ হবে–পুত্ৰকস্য মে মহানুভাবত্বং সূচয়িষ্যস্তি। জন্মসময়–সমুদ্ভূতানি মহানিমিত্তানি। নিষ্ঠুর কংসের নৃশংসতার কথা চিন্তা করে আমি অবশ্য কিছুই ঠিক করতে পারছি না। আর ঠিক এই সময়ে কোথায় যে গেলেন উনি। আরে এই যে, উনি তো এই দিকেই আসছেন। আনন্দে আর বিস্ময়ে ওঁর চোখ দুটি একেবারে আপ্লুত হয়ে গেছে।

বসুদেব প্রবেশ করলেন সেই বর্ষণ-বিদ্যুতের ইমেজারি মুখে উচ্চারণ করে। আর নিজপত্নী দেবকীর ব্যাপারে তিনি ভীষণ রকমের বাস্তববাদী। তিনি বলছেন–ছটা ছেলে গেছে, কম কথা তো নয়। সেই দুঃখ ভুলতেই দেবকী তার সপ্তম সন্তানটিকে কেমন করে আগলে রেখেছে–অপচয়-গমনার্থং সপ্তমং রক্ষমানা। লক্ষণীয়, ভাস এই ছেলেটিকে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান না বলে সপ্তম বললেন। এতে আমাদের সিদ্ধান্ত ঠিক থাকল। বলরামের জন্ম তাহলে স্বাভাবিকভাবেই রোহিণীর গর্ভে সম্পন্ন হয়েছে। দেবকীর গর্ভ-পুত্র বিনাশের পরই তার গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। হরিবংশে দেখেছি–রোহিণী পুত্র প্রসব করার আগেই বসুদেব তাকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং মথুরার রাজধানীতে থেকেই তিনি শুনেছিলেন যে, রোহিণীর গর্ভে তার একটি পুত্র জন্মেছে–প্রাগেব বসুদেবস্তু ব্ৰজে শুশ্রাব। রোহিণীম্। প্রজাতাং পুত্রমেবাগ্রে চন্দ্রাৎ কাতরানন। বালচরিত নাটকের সংস্থানে দেখছি–এই পুত্রটিকে কোলে নিয়ে বসুদেব পত্নী দেবকী কংসের মৃত্যুর স্বপ্ন দেখছেন বিভোর হয়ে।

বসুদেব বাস্তব বোঝেন। অতএব দেবকীকে দেখামাত্রই তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল–দেখ, এখন একেবারে মাঝরাত। মথুরা নগরীতে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে অতএব এই শিশুটিকে আমি এক্ষুনি নিয়ে চলে যাই, যাতে আর কেউ না দেখতে পায়–প্রসুপ্তো মধুরায়াং সর্বো জনঃ। তস্মাদ যাবন্ন কশ্চিৎ পশ্যতি তাবলং গৃহীত্ব অপক্রামামি।

দেবকী কিন্তু আর্যপুত্র। একে তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?

বসুদেব সত্যি বলছি দেবকী। আমিও ঠিক জানি না–অহমপি ন জানে সমস্ত পৃথিবী দুরাত্মা কংসের আজ্ঞাধীন। তাই কোথায় যে এই বালককে নিয়ে সংগোপনে রাখব, তা আমিও

জানি না। তবে অদৃষ্ট যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাব আর কি।

দেবকী আমি এই শিশুটিকে একটু ভাল করে দেখতে চাই, আর্যপুত্র।

বসুদেব ভাল বলেছ। রাহু মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে গেলার জন্য। আর সেই হাঁ–মুখের মধ্যে তুমি চাঁদ দেখতে চাইছ–কিং দ্রষ্টব্যঃ শশাঙ্কোয়ং রাহোবদনমণ্ডলে? তুমি একে যত ভাল করেই দেখ, কংসের হাতে এর মৃত্যু হবে।

দেবকী না। কোনও মতেই হবে না।

বসুদেব তুমি যা বলছ, সমস্ত দেবতারাও তাই বলুন। সে যাক, তুমি ছেলে নিয়ে এসো।

দেবকী ছেলে এনে তুলে দিলেন বসুদেবের হাতে। বসুদেব শিশুপুত্র কোলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পৌরাণিকেরা নানা অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা করেছেন। কারাগারে কংসের রক্ষীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল। আপনা–আপনিই মুক্ত হয়ে গেল বন্দিশালার দরজা–দ্বারস্তুঃ সর্বাঃ পিহিতা দুরত্যয়া/বৃহৎ-কপাটায়সকীল-শৃঙ্খলৈঃ। আমরা আগেও বলেছি যে, বসুদেব দেবকীকে কংসের কারাগারে চেন টেনে দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল বলে আমরা মনে করি না। আমাদের বিশেষ ধারণা বসুদেব-দেবকী তাঁদের স্বগৃহেই কংসের নজরবন্দী ছিলেন। রক্ষী-পুরুষেরা অবশ্যই সেখানে ছিল। কিন্তু দিনের পর দিন পাহারা দিতে দিতে তাদের পাহারার ধার কমে গিয়েছিল। তাছাড়া রাজপুরুষ হিসেবে বসুদেবের সম্মান কিছু কম ছিল না এবং রক্ষী পুরুষেরা তাকে অবিশ্বাস করার কারণ কিছু খুঁজে পেত না।

আমরা বিশ্বাস করি, সেদিন অবিরাম বর্ষণের মধ্যে বসুদেবের দরজা খোলার শব্দ তারা। টের পায়নি এবং এমন বাদলা দিনে ঘুমটাও ছিল তাদের স্বাভাবিক। বসুদেবের ওপরে কংস কিংবা কারারক্ষীদের যে বিশ্বাস ছিল, সেই বিশ্বাসটা এক্সপ্লয়েট করেই বসুদেব সেই রাত্রে বাইরে যেতে পেরেছিলেন। সেদিন রাত্রে সত্যই বৃষ্টি হচ্ছিল–ববর্ষ পর্জন্য উপাংশুগর্জিতঃ সেই বৃষ্টির মধ্যে তিনি কী করে যমুনা পার হলেন, শেষ নাগ তাঁর মাথায় ছত্রধারণ করেছিলেন কি না, কোনও শৃগাল তাকে পথ দেখিয়েছিল কি না–সে সব তর্কে আমরা যাচ্ছি না। তবে সেই রাত্রে বৃন্দাবনের যশোমতী এবং মথুরার কারাগারে দেবকী–দুজনেই যে একসঙ্গে প্রসূতা হলেন এবং বসুদেব যেভাবে সন্তান পরিবর্তন করলেন, সেই তর্কটায় আমাদের যেতেই হবে।

 ভাগবত-পুরাণ, হরিবংশ কিংবা বিষ্ণুপুরাণ সর্বত্রই এই কথাটি বলা আছে, যে যশোদার গর্ভে যিনি বৃন্দাবনে জন্মেছিলেন, সেই মেয়েটি ছিল যোগমায়া। ভাগবত এবং হরিবংশে দেখেছি–মাঝরাতে বৃন্দাবনে সকলে যখন ঘুমিয়ে আছে, তখন বসুদেব যশোদার অজ্ঞাতসারেই তার শিশু কন্যাটি পরিবর্তন করে নিজের ছেলেটিকে দিয়ে আসেন। হরিবংশের জবান থেকে পরে কিন্তু জানা যাচ্ছে যে, যশোদার কন্যাটি জন্ম থেকেই মৃতা ছিল, আধুনিকেরা এটা বলেছেন Still-born। ভাসের বালচরিত নাটকের বর্ণনাকে যারা নিরপেক্ষ ইতিহাসের মূল্য দিয়ে থাকেন, তারা কিন্তু বলেন যে, ভাস হরিবংশ এবং বিষ্ণুপুরাণের আখ্যানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

সত্য কথা বলতে কি–যশোদা হয়ত একটি মৃত কন্যাই প্রসব করেছিলেন এবং এই ঘটনা স্নেহময়ী যশোমতীকে ভীষণ দুঃখ দিতে পারে ভেবেই নন্দগোপ হয়ত সেই কন্যার সদগতি করার জন্য বাইরে বেরিয়েছিলেন, কারণ বিষ্ণুপুরাণে দেখতে পাচ্ছি–সেই রাত্রে ভোরের দিকে নদ–ইত্যাদি গোপজনেরা কংসকে কর দেবার জন্য যমুনার ধারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বসুদেব তাঁদের দেখেওছিলেন।

কংসস্য করমাদায় তত্রৈবাভ্যাগতাংস্তটে।
নন্দাদীন গোপবৃন্দাংশ্চ যমুনায়া দদর্শ সঃ।

 হরিবংশের মৃতা কন্যার সংবাদ এবং বিষ্ণুপুরাণে যমুনাতীরে উপস্থিত নন্দগোপের সংবাদ ব্যবহার করে ভাস যেভাবে তার নাটক রচনা করেছেন, তা যতখানি নাটকীয়, তার চেয়েও বেশি সত্যনিষ্ঠ মনে হয়। বসুদেব তখন বৃন্দাবনে ঘোষপল্লীর কাছাকাছি চলে এসেছেন এবং স্বগতোক্তি করছেন–কাছের এই ঘোযপল্লীতেই আমার বন্ধু নন্দগোপ বাস করে। কংসের আদেশে আমি তাকে শেকল দিয়ে বেঁধেছি, চাবুকও মেরেছি।

এই কথাটা শুনতে অস্বাভাবিক লাগছে যে, বসুদেব আবার নন্দগোপকে শেকল দিয়ে বাঁধতে যাবেন কেন আর কেনই বা তাকে চাবুক মারতে যাবেন। এই কথাটার যৌক্তিকতা বোঝবার জন্য একটা কথাই মনে রাখতে হবে যে, বসুদেব একজন রাজপুরুষ, কংসের মন্ত্রিসভায় তিনি একজন মন্ত্রী ছিলেন। ফলত বৃন্দাবনের এই ঘোষপল্লীর মানুষজনেরা যদি কংসের কর দিতে দেরি করতেন, তাহলে কংসের আদেশে বসুদেব এঁদের ওপর অত্যাচার করতে বাধ্য হতেন। বন্ধু নন্দগোপের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, কিন্তু নন্দগোপ এবং বসুদেব দুজনেই জানতেন, তারা পরস্পরের বন্ধু। যাই হোক, ঘোষপল্লীর কাছাকাছি এসে নন্দগোপের কথা মনে পড়তেই বসুদেব মনে-মনেই বললেন–এই রাত্রিতে আমি এই ঘোষপল্লীতে প্রবেশ করেছি জানলে গোপজনেরা নানা আশঙ্কা করবে। তার চেয়ে রাতটুকু এই বটগাছের তলায় কাটিয়ে সকালের জন্য অপেক্ষা করি। রজনীর অন্ধকারে পুত্র কোলে নিয়ে বসে বারবার আকাঙ্ক্ষা করতে লাগলেন, যাতে নন্দগোপ একবার আসেন তাঁর কাছে। অদৃষ্টে এমন সমাপতনও ঘটে। শোকক্লিষ্ট অবস্থায় নন্দগোপকে আমরা যমুনার তীরে আসতে দেখছি এই মুহূর্তে।

নন্দগোপ বিলাপ করছেন নিজে নিজেই। তার কোলে একটি মৃত শিশু-কন্যা। নন্দ বলছেন–

হায়রে মেয়ে আমার! তুই আমার গৃহলক্ষ্মী হয়ে উঠলি না, এখন। আমাদেরও ছেড়ে চলেছিস। উঃ কী ভীষণ অন্ধকার, যেন একশটা। কালো মহিষ একসঙ্গে মাথার ওপর পড়ছে–সম্প্রতি হি মহিষ-শত সম্পাত-সদৃশোহো বলবানন্ধকারঃ। আজ মাঝরাতেই আমার গিন্নি যশোদা এই মেয়েটাকে প্রসব করেছে। হতভাগী জন্মেই মারা গিয়েছে–প্রসূতেয়ং চ দারী তপস্বিনী জাতমাত্রৈবাপগতপ্রাণা সংবৃত্তা। কাল আবার আমাদের ঘোষেদের পবিত্র ইন্দ্রযজ্ঞের অনুষ্ঠান। এদিকে আমার পায়ে শেকল বাঁধা। চলতেও কষ্ট হচ্ছে। তবু আমি এই মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি যাতে গোপজনের আনন্দে ব্যাঘাত না ঘটে। হতভাগিনী যশোদাও মূৰ্ছা গেছে। সে জানেই না ছেলে হল না, মেয়ে হল–যশোদাপি তপস্বিনী নৈব জানাতি দারকো বা দারিকা বা প্রসূত ইতি মোহং গতা। হায় মেয়ে আমার।

প্রায় প্রত্যেক পুরাণেই আমরা দেখেছি–প্রসবের পর যশোদা অজ্ঞান হয়ে ছিলেন এবং সেই সুযোগে বসুদেব সন্তান পরিবর্তন করেছেন। আমাদের মনে হয়–কন্যাটিকে মৃত দেখেই যশোদা মূৰ্ছিত হয়েছেন। বসুদেবের পুত্রটির আগমন পর্যন্তও তার এ ঘোর কাটেনি। আরও একটা কথা ভেবে দেখা দরকার। সেটা হল, সে যুগের সামাজিক পরিস্থিতিতে একটি পুরুষ মানুষ মেয়েদের অন্দরমহলে ঢুকে সদ্যপ্রসূতা-রমণীর কোল থেকে মেয়ে নিয়ে চলে এল–এ ঘটনা তেমন আদরণীয় নয়। তার চেয়ে ভাসের বালচরিত অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।

রাত্রি গম্ভীর হয়েছে। তখনও অন্ধকার মোটেই কাটেনি। গাছতলায় বসে বসুদেব নন্দগোপের কষ্টকর বিলাপ শুনতে পেলেন। বসুদেব বললেন–কে এই রাত্রে বিলাপ করে? আমারই মতো এও বুঝি এক হতভাগ্য।

নন্দ কেন তুই আমার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে উঠলি না, এখন আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেলি তুই।

বসু কণ্ঠস্বরে আমার বন্ধু নন্দগোপ বলে মনে হচ্ছে। হাগো, কে তুমি, আমার বন্ধু নন্দগোপ নাকি, এদিকে এসো।

নন্দ (ভয় পেয়ে) কে আমাকে এখানে নন্দগোপ বলে ডাকে। গলাটা চেনা মনে হচ্ছে। ব্যাটা রাক্ষস না পিশাচ। একে এই ভয়ঙ্কর রাত, তাতে এই মরা মেয়ে আমার হাতে। কী যে করি–ঈদৃশ্যাং প্রতিভয়রজন্যাং মৃতা দারিকা মম হস্তে। কিং নু খলু করিষ্যামি।

বসু ভাই নন্দগোপ। ভয় নেই, এদিকে এসো।

নন্দ আরে গলার স্বর শুনে প্রভু বসুদেব বলে মনে হচ্ছে। যাই এগিয়ে যাই। অবশ্য গিয়েই বা কী করব? কংসের কথা শুনে ইনিই আমাকে চাবুক মেরেছেন, শেকল লাগিয়েছেন। পায়ে। অবশ্য উনি আমার অনেক উপকারও করেছেন। আমার দুঃখে দুঃখ পেয়েছেন, সুখে সুখী হয়েছেন। তবু মনে পড়ে–উনি রাজার আদেশে আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধেছেন। যাই এগিয়েই যাই। হাতে আবার এই মরা মেয়েটা রয়েছে। কী যে করি?

নন্দগোপের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব যত কাটল, রজনীর অন্ধকারও কেটে এল ততটাই। যমুনার তীরে দুই পুরনো বন্ধুর সাক্ষাৎ হল অদ্ভুত এক পরিবেশে। একজনের হাতে মৃত শিশুকন্যা, অন্যজন আরেক হতভাগ্য-ছেলেকে বাঁচানোর জন্য সদ্যপ্রসূত পুত্র জননীর কোল থেকে কেড়ে নিয়ে এখন বটচ্ছায়ায় বসে আছেন। অদূরে যমুনা কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে, সমস্ত ঘটনার সাক্ষী বয়ে নিয়েই যেন।

.

৮৪.

যমুনার তীরে বসুদেব যখন বন্ধু নন্দগোপকে চিনতে পারলেন, তখন তার কিছু লজ্জা হল, কিছুটা দ্বিধাও। কংসের আদেশে এই বন্ধুকে তিনি অপমান করেছেন, চাবুক মেরেছেন। কিন্তু পূর্বতন এই পরিবেশটার মধ্যে বসুদেবের দিক থেকে এমন এক অসহায়তা ছিল এবং এই মুহূর্তে দুজনেই বিপন্ন বলে বসুদেব এবং নন্দ দুজনেই পরস্পরের মুখোমুখি হলেন খুব তাড়াতাড়ি।

নন্দগোপ বৃন্দাবনের গয়লা শ্রেণীর মানুষ। গোচারণ তার বৃত্তি। অতএব বসুদেব নদগোপের সঙ্গে প্রথম কথাটাই যেটা বললেন, সেটা হল–তোমার গোরুগুলো সব ভাল আছে তো? নন্দগোপ একেবারে গ্রাম্য গয়লা ভাষায় জবাব দিলেন–আম ভর্তঃ কুশল–হা কর্তা! সব ভাল। বসুদেব এবার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু–বান্ধবদের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং তারপরেই দেখলেন–নন্দগোপ কী যেন একটা লুকোতে চাইছেন তাঁর দৃষ্টি থেকে। বসুদেব কোনও ভণিতা না করেই বললেন–তুমি কী লুকনোর চেষ্টা করছ তখন থেকে–বয়স্য কিমিদানীং প্রচ্ছদ্যতে? নন্দগোপ সপ্রতিভভাবে বলার চেষ্টা করলেন–কই কিছু না তো?

বসু–আমার দিব্যি! সত্যি করে বলো, কী ওটা?

নন্দ–কী যে করি, শুনুন তাহলে। আজ মাঝরাত্রে আমার গিন্নি যশোদা এই মেয়েটাকে প্রসব করেছে। কিন্তু হতভাগী জন্মই মারা গেছে। এদিকে কাল আবার আমাদের ঘোযেদের ইন্দ্রযজ্ঞের উৎসব। তাই আমি একা এই মরা মেয়ে নিয়ে বেরিয়েছি, যাতে ঘোষেদের আনন্দের ব্যাঘাত না ঘটে। ওদিকে যশোদাও মূৰ্ছিত, সে হতভাগিনী জানতেও পারল না কিছু।

বসু– হায়! হায়! কী আর করা যাবে? যাকে তো কেউ আর বঞ্চনা করতে পারে না। তোমার এই মেয়ের শরীর যে কাঠ হয়ে গেছে, তা ফেলেই দাও, আর কী করবে? বয়স্য কাষ্ঠভূতং কলেবরং ত্যজ্যতাম্।

নন্দ–না কর্তা! আমি পারছি না, পারছি না; হায়রে মেয়ে আমার–ন শক্লোমি ভর্তঃ, ন শক্লোমি।

বসু–কী উপায়? এই তো লোকধৰ্ম। শব-শরীর তোমাকে ত্যাগ করতেই হবে।

বসুদেব আস্তে আস্তে কিসের যেন ইঙ্গিত করলেন। নন্দগোপ তার মৃত মেয়েটিকে রেখে বসুদেবের কাছে এলেন। বসুদেব বললেন–তুমি তো জান আমার ছটি ছেলেকে কংস মেরে ফেলেছে। এই সপ্তম পুত্রটি আমার দীর্ঘজীবী। তবে আমার কোনও পুত্ৰভাগ্য নেই। আমি চাই–পুত্রটি তোমার ভাগ্যে বেঁচে থাক। তুমি এই ছেলেটিকে নাও।

নন্দগোপ বসুদেবের ছেলেটি নিতে ভয় পেলেন। বললেন–কংস যদি একবার জানতে পারে যে, বসুদেবের ছেলেকে নন্দগোপের ঘরে গচ্ছিত রাখা হয়েছে, তাহলেই হয়ে গেল–আমার মাথাটা আর নেই–যদি কংসো রাজা শৃণোতি–বসুদেবস্য দারকো নন্দগোপস্য হস্তে ন্যাসো নিক্ষিপ্ত ইতি, কিং বহুনা, গতমেব মে শীষ।

 ভাসের বালচরিত নাটকের পরবর্তী দৃশ্য আপাতত স্তব্ধ হয়ে থাক। শুধু জানাই–নন্দগোপ যখন বসুদেবের ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলেন, তখন বসুদেব তাকে বলেছিলেন–যাদবদের অধিকাংশ বীজ পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। অবশিষ্ট এই বীজটি রক্ষা করার জন্যই তোমার হাতে এই পুত্র তুলে দিলাম।

অস্মিন কালে দগ্ধভূয়িষ্ঠ–শেষং
ন্যস্তং বীজং রক্ষিতুং যাদবানা।

আমাদের ধারণা–বসুদেবের এই কথাটির মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সত্য আছে। যাদবরা সর্বত্র কংসের ভয়ে সন্ত্রস্ত, কেউ লুক্কায়িত, কেউ পলায়িত। যাদবদের এই দুঃসময়ে বসুদেব তার শিশু পুত্রটিকে শুধু বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন। তিনি ভাবছেন–হয়ত এই শিশুই একদিন বড় হয়ে যাদবদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবে, অত্যাচারী কংসের হাত থেকে সেই হয়ত একদিন ছিনিয়ে নেবে মথুরার রাজশাসন। বিপন্ন অবস্থাতেও এই শিশুটির দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-সুখ নিয়ে বসুদেবের চিন্তা আছে। হাজার হলেও এ ছেলে যাদবদের অন্যতম রাজগোষ্ঠীর ছেলে। সে এই গ্রাম্য আবাসে কেমন করে মানুষ হবে–তা নিয়ে বিলক্ষণ চিন্তা আছে বসুদেবের। এই বিপন্ন মুহূর্তেও নন্দগোপালকে তিনি একবার ডেকে শুধোলেন–তুমি এ ছেলেকে কেমন করে মানুষ করবে, বন্ধু?

 নন্দলোপ গয়লাদের গ্রাম্য সরলতার জবাব দিলেন–ও এক বাড়িতে গিয়ে দুধ খাবে, আরেক বাড়িতে খাবে দই–একয়িং গেহে গচ্ছিঅ খীরং পিবই, অন্নষিং গেহে গচ্ছিঅ দধিং ভখই। এক বাড়িতে গিয়ে ননী খাবে আর এক বাড়িতে পায়েস। আবার কোনও বাড়িতে গিয়ে হয়ত ঘোলের হাঁড়ির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। আরে এক কথায় বলি–ও হবে আমাদের ঘোষেদের মোড়ল।

বসুদেব বুঝলেন–বৃন্দাবনের প্রবাসে তার ছেলেটি রাজভোগ লাভ করবে না হয়ত। কিন্তু গ্রাম্যজনের সাধারণ স্বাভাবিক আন্তরিকতায় ব্রজবাসীর নয়নের মণি হয়ে উঠবে তাঁর পুত্রটি। এই আন্তরিকতার মূল্য রাজভোগের চাইতে হাজার গুণ বেশি। বসুদেব এবার নিশ্চিন্তে বললেন–যেমনটি তুমি বললে, তেমনটিই হোক। তুমি এবার ফিরে যাও। নন্দগোপ বসুদেবের পুত্রটি কোলে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে চললেন।

এরপর বালচরিত নাটকে নন্দগোপের পরিত্যক্ত কন্যাটি অলৌকিকভাবে হঠাৎই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং দুরাত্মা কংসকে বঞ্চনা করার জন্য বসুদেব সেই শিশু-কন্যাটিকে কোলে নিয়ে মথুরায় ফিরে এলেন। বালচরিত নাটকে বসুদেবের পুত্র এবং নন্দগোপের মৃত কন্যাটির মধ্যে অবতার–বাদের সমস্ত আবেশটুকুই ধরা আছে, কিন্তু সেই আবেশের ওপরেও এখানে ঘোষিত হয়েছে এই শিশুপুত্রটির মনুষ্যভাবের জয়কার–কোথাও কোনও ঘরে সে ননী খাবে, কোনও ঘরে খাবে পায়েস আর কোথাও বা লুব্ধ চোখে ঘোল–ভরা হাঁড়ির দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে–অপরষিং গেহে গচ্ছিঅ ণবনীদং গিলই, অনুষিং গেহে গচ্ছিঅ পায়সং ভুঞ্জই। ইদলষিং গেহে গচ্ছিত এঘটং পলোঅদি।

বসুদেব যে শিশু কন্যাটিকে নিয়ে মথুরায় ফিরে এলেন সেটি সত্যই মৃত না জীবিত সে ব্যাপারে ঠিকঠাক বলার কোনও উপায় আমাদের নেই। শুধু বলি–পুরাণের কথক-ঠাকুরের যে অলৌকিকতায় বিশ্বাস, তাতে যদি আমাদের বিশ্বাস থাকে তবে এই শিশুকন্যাকে ভগবতী যোগমায়া ভাবাই ভাল এবং তাতে কন্যাটি মৃতা হয়ে জন্মালেও তার বেঁচে ওঠাটা অকল্পনীয় হয় না। অন্যদিকে যদি এই ঘটনাটা আধুনিকভাবেই বিশ্বাস করতে হয়, তবে এই কন্যাটিকে মৃতাই ধরে নিন। বসুদেব নন্দগোপের মৃত কন্যাটি নিয়ে গেছেন বলেই কংসের হাতে সে কন্যাকে তুলে দিতে তার দ্বিধা হয়নি এবং কংস তাকে খস্তরশিলায় আছড়ে ফেললেও সেই মৃতা কন্যার গতি মৃত্যুর চেয়ে বেশি কিছু হয়নি।  

যাই হোক, বসুদেব মথুরার কারাগারে ফিরলেন প্রায় রজনী প্রভাতে। শিশুকন্যাটিকে শুইয়ে দিলেন দেবকীর পাশে–প্রগৃহ্য দারিকাঞ্চৈব দেবকী-শয়নে ন্যসৎ। এইবারে আমাদের হরিবংশের বিবরণটি অবহিত হয়ে বুঝতে হবে। কারণ কৃষ্ণের শৈশবকালের সবচেয়ে বিশ্বস্ত নথি হল হরিবংশ, মহাভারত নয়। দ্বিতীয়ত ভাসের বালচরিতের মূল ভিত্তি হল হরিবংশ। এই হরিবংশে দেখতে পাচ্ছি–আরও সকাল হতেই বসুদেব নিজে কংসের কাছে গিয়ে তার কন্যার জন্ম-সংবাদ জানাচ্ছেন–নিবেদয়ামাস তদা…কংসায়ানকদুন্দুভিঃ। এর থেকেও বুঝতে পারি— বসুদেবের গতায়াতে খুব একটা বাধা-নিষেধ ছিল না।

অন্যান্য পুরাণে অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা রোমাঞ্চকরভাবে পরিবেশন করার জন্যই সকাল হতে না হতেই কংসের কারাগার থেকে শিশুর ক্রন্দন-ধ্বনি শুনতে পাওয়া গেছে এবং কংসের রক্ষী-পুরুষেরা এই ক্রন্দনধ্বনি শুনেই কংসের কাছে দেবকীর সন্তান হবার খবর জানিয়েছে– ততো বালধ্বনিং ত্বা রক্ষিণঃ সহসোখিতাঃ। হরিবংশের বিবরণ এখানে অনেক বেশি লোকসম্মত, কেননা বসুদেব নিজেই কংসের কাছে তার কন্যার জন্ম-সংবাদ দিয়েছেন। এতে যেমন একদিকে বসুদেবের চরিত্রের দৃঢ়তা, সত্যরক্ষার চেষ্টা প্রমাণিত হয়, তেমনি অন্যদিকে কন্যাটির পূর্ব–মরণ সূচিত করে।

 কংস বসুদেবের কাছে খবর পেয়ে তাঁর নিজের অঙ্গরক্ষক রক্ষী-পুরুষদের সঙ্গে নিয়ে বসুদেবের ঘরে এসে উপস্থিত হলেন–আজগাম গৃহদ্বারং বসুদেবস্য বীর্যবান্। লক্ষ্য করে দেখুন, হরিবংশ একবারও বসুদেবের আবাসটিকে কারাগার বলল না, আমরা আগেই বলেছিলাম–বসুদেব আপন গৃহে কংসের নজরবন্দী হয়েছিলেন। এই নজর এড়ানোর জন্যই তাকে রাত্রে মথুরা রওনা হতে হয়েছিল এবং তার ফিরতে দেরি হওয়ায় তিনি যথেষ্ট ভয়ও পেয়েছিলেন–পরিবর্তে কৃতে তাভ্যাং গর্ভাভ্যাং ভয়বিক্লবঃ।

কংস গৃহদ্বার থেকেই শুধোলেন–কোনও শিশু জন্মেছে? দাও, আমার হাতে দাও। বলেই তিনি হ্যান করেঙ্গা–ত্যান করেঙ্গা করে নানারকম তর্জন-গর্জন করতে লাগলেন–বাগভিঃ সমভিতর্জয়ৎ। বসুদেব-পত্নী দেবকী কংসের আচরণে বড় কষ্ট পেলেন। রাত্রির অন্ধকারে তার স্বামী কোথায় খুঁজে খুঁজে একটি মৃত শিশু-কন্যা কোলে করে নিয়ে এসেছেন। এখন সেই কন্যাটিকে আছড়ে ফেলে কত বীভৎস আচরণ করবেন কংস–এই আশঙ্কায় দেবকী বললেন–তুমি আমার ছয়-ছয়টি ছেলেকে মেরে ফেলেছ। এটি একটি মেয়ে, তাও সে হতভাগিনী মরা অবস্থাতেই জন্মেছে। বিশ্বাস না হয় হাতে নিয়ে দেখ–-দারিকেয়ং হতৈবৈষা পশ্যস্ব যদি মন্যসে।

কংস জানেন–দেবকীর পুত্রই হোক আর কন্যাই হোক সেটি তার প্রাপ্য, সে জীবিতই থাকুক অথবা মৃত–সেটি তার প্রাপ্য। কংস দেবকীর কথা যাচাই করার জন্য মৃতা কন্যাটিকে ভাল করে দেখলেন। মনে মনে বললেন–এ বেটি যখন মেয়ে হয়েই জন্মেছে তখন এটি নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই–হতৈবৈষা যদা কন্যা জাতেZক্কা বৃথামতিঃ। মেয়েটি এখনও যেন গর্ভশয়নের কষ্টে পীড়িত হয়ে আছে, এর চুলগুলো এখনও গর্ভের জলে আর্দ্রসা গর্ভশয়নে ক্লিষ্টা গর্ভান্নিমূর্ধজা। দেবকী আস্তে আস্তে তার জড় নিশ্চল নিশ্চেষ্ট কন্যাটিকে শুইয়ে রাখলেন কংসের সামনে।

হরিবংশের এই বিবরণ আমরা অতিশয় বিশ্বাসযোগ্য মনে করি। কন্যাটি মৃতা ছিল বলেই কংস কর্তৃক এই কন্যার হত্যার সূত্র ধরে ভগবতী যোগমায়ার আবির্ভাব ঘটানো আরও সুবিধেজনক হয়েছে। কংস তার স্বাভাবিক আক্রোশে অথবা অবিশ্বাসে মৃতা কন্যাটিকেও হয়ত শিলায় আছড়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই শিলায় আক্ষিপ্ত শিশুকন্যা চূর্ণবিচূর্ণ হবার আগেই অলৌকিকভাবে আকাশে উড়ে গেলেন–সাবধূতা শিলাপৃষ্ঠে অনিষ্পিষ্টা দিবমুৎপতৎ।

সঙ্গে সঙ্গে তার গর্ভবাস-ক্লিন্ন তনু বিলীন হল আকাশে। সেখানে রূপান্তর গ্রহণ করলেন ভগবতী যোগমায়া। আলুলায়িত কেশরাশি। কোনও পুরাণে তিনি চতুর্ভুজা, কোনও পুরাণে অষ্টভুজা। দিব্য গন্ধ আর অনুলেপন তার দেহে। হারশোভিত-সর্বাঙ্গী মুকুটোজ্জ্বল-ভূষিতা। নীল এবং পীতবর্ণের বস্ত্র পরিধানে, গজকুম্ভোপমস্তনী, মনোরম চন্দ্রমুখ, অঙ্গকান্তিতে বিদ্যুতের ছটা, নয়ন দুটি ঊষার সূর্যের মতো মোহন লাল। চিরকালের সেই কন্যারূপিণী দেবী–কন্যৈব সাভবন্নিত্যং–কখনও নাচছেন, কখনও হাসছেন, কখনও বা বিপরীতভাবে উল্লম্ফন করছেন–নৃত্যতী হসতী চৈব বিপরীতেন ভাস্বতী।

হরিবংশে এরপরে যে বর্ণনা আছে তাতে দেবীর সঙ্গে মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীর কোনও তফাত নেই। মহিষাসুর বধের পূর্বাহ্নে তিনি যেমন মধু পান করেছিলেন, এখানেও তাই বিহায়সি গত রৌদ্রা পপৌ পানমনুত্তমম্। অট্টহাসি হেসে কংসকে তিনি বললেন–কংস! তুই নিজের বিনাশের জন্য আমাকে মারতে চেয়েছিলি। তোকে যিনি মারবেন, দেবতাদের সর্বস্বভূত সেই পুরুষ জন্ম নিয়েছেন–জাতত যত্ত্বাং বধিষ্যতি। কংসের মৃত্যুর নিদান জানিয়ে দেবী অন্তর্হিত হলেন।

চিরকাল পিতৃ-মাতৃ পরম্পরায় আমরা এইভাবেই পরমা প্রকৃতির আবির্ভাবের কথা শুনে এসেছি। বৈষ্ণবদর্শনে এই ভগবতী যোগমায়া কৃষ্ণের প্রধানা লীলা-সহায়িকা হিসেবে কীর্তিত। ভাগবত পুরাণের অন্যতম রসিক টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন–মহামায়া যেমন করে মানুষকে সংসারের মায়া দিয়ে ভুলিয়ে রাখেন যোগমায়াও তেমনই পরম ঈশ্বরকে ভুলিয়ে রাখেন। ঈশ্বর যে তার মনুষ্য-লীলার কালে নিজের ষড়ৈশ্বর্য স্মরণ করতে পারেন না, তিনি যে ঈশ্বরত্ব ভুলে কখনও পুত্র, কখনও সখা এবং কখনও প্রেমিকের মতো ব্যবহার করতে পারেন, তা নাকি ওই অঘটনঘটনপটীয়সী যোগমায়ার প্রভাব। লীলাপুরুষের আবির্ভাবের পূর্বেই তিনি জন্মান। লীলা–পুরুষের লীলা চলাকালীন সময়ে তিনি তাকে সাহায্য করেন এবং তার অন্তর্ধানকালে তিনিও অন্তৰ্হিতা হন।

 তবে এসব হল দর্শনের কথা, আমরাও সেই দর্শনে বিশ্বাস করি। কিন্তু অবিশ্বাসী যাঁরা তাদের এসব কথা বিশ্বাস না করলেও চলে। হরিবংশে যেমনটি দেখেছি, তাতে নন্দগোপের বাড়ি থেকে আনা ওই শিশুকন্যাটিকে মৃতা ভাবতে কোনও অসুবিধে নেই। কংস তাকে শিলাপৃষ্ঠে আছড়ে মেরেছেন কি না অথবা তিনি যোগমায়ার স্বরূপ ধারণ করেছিলেন কি না, সে তর্কে না গেলেও চলে। ধরেই নিলাম তিনি মৃতা ছিলেন এবং পরবর্তী রূপান্তরগুলি কথক-ঠাকুরের দৈব-কল্পনা। এমনকি দেবী যে আকাশবাণী সৃষ্টি করেছিলেন–তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সেজাত সত্ত্বাং বধিষ্যতি–এ কথাটাও দৈববাণী হিসেবে না নিয়ে মথুরার জনগণের সমষ্টিগত বিশ্বাস হিসেবেই মেনে নেওয়া যায়।

বসুদেব রাতের অন্ধকারে তার পুত্রটিকে বৃন্দাবনে রেখে এলেও মথুরার জনগণ সে কথা জানত অথবা জেনে ফেলেছিল। মনে রাখতে হবে–বসুদেব কংস-বিরোধী গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা এবং তিনি নজরবন্দী ছিলেন। তাঁর ক্রিয়া-কলাপ কেউ টের পাননি–এ কথা তেমন আদরণীয় নয়। হরিবংশে দেখবেন–সন্তান পরিবর্তন করে এসে তিনি যখন বাড়ি ঢুকছেন, তখন কার্যসিদ্ধি ঘটা সত্ত্বেও তিনি ভীত হয়ে উঠেছেন–পরিবর্তে কৃতে তাভ্যাং গর্ভাভ্যাং ভয়বিক্লবঃ। এই ভয়টা কিছু অমূলক নয়। লোকে কিছু দেখেছে, বিশ্বাস করেছে এবং কংসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একথা প্রচারও করেছে যে–ব্যাটা! তোকে যে মারবে সে জন্মেছে। অন্য জায়গায়–জাতো যন্ত্বাং বধিষ্যতি।

 লক্ষণীয়, অলৌকিকী দেবী অন্তৰ্হিৰ্তা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কংস দেবকীর সঙ্গে ভীষণ নরম করে কথা বলছেন। অন্তত হরিবংশে তাই দেখছি। আমাদের বিশেষ ধারণা–জনরোষ বিপুলভাবে প্রচারিত হবার পর কংস কিছু ভয় পেয়েছেন এবং তার পরেই তিনি দেবকীর সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেছেন। তবে এই সদয় ব্যবহারের মধ্যে অনেকটাই যে লোক-দেখানো সেটা আন্দাজ করতে দেরি হয় না। কারণ কংস অতিশয় কুটিল মানুষ, তার ওপরে রাজা। আকার-ইঙ্গিত চেষ্টা এবং ভাব গোপন করাটা তাঁর রাজধর্মের অন্তর্গত। অতএব দৈববাণী শুনেই হোক অথবা প্রভূত জনরোষ থেকে আপাতত মুক্তি পাবার জন্যই হোক, কংস সবার আড়ালে গিয়ে দেবকীর কাছে মাথা নত করলেন সলজ্জে–বিবিক্তে দেবকীং চৈব ব্রীড়িতঃ সমভাষত।

হরিবংশে যেভাবে কথোপকথন চলেছে, তাতে ধারণা হয় দেবকী কংসের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। কংস দেবকীর পাদস্পর্শ করেছেন মাথা দিয়ে এবং বলেছেন–আমি তোমার পুত্রের মতো তোমার চরণে মাথা নুইয়ে বলছি–এষ তে পিদয়োমঁধা পুত্রবত্তব দেবকি। এরপর দেবকীর দিক থেকেও যেরকম পুত্রবৎ সমাশ্বাস নেমে এসেছে, তাতেও মনে হয় দেবকী কংসের বয়োজ্যেষ্ঠা ছিলেন।

আপাতত কংস বেশ দার্শনিকের মতো কথা বলছেন। বলছেন–বোনটি আমার! আমি মরণ থেকে বাঁচবার জন্য তোমার সব কটি ছেলেকেই মেরেছি। কিন্তু এখন দেখছি আমার মৃত্যু আসবে অন্যরূপে অন্য জায়গা থেকে–অন্য এবান্যতো দেবি মম মৃত্যুরুপস্থিতঃ। তুমি জান–আমার মধ্যে একটা হতাশা, একটা নৈরাশ্য কাজ করছিল, যার জন্য আমি অতি আপন জনকেও মেরে ফেলেছি–নৈরাশ্যেন কৃতো যত্নঃ স্বজনে প্রহৃতং ময়া। লক্ষণীয়, যাঁরা মনস্তত্ত্বের বিচার করেন, তাঁরা ইংরেজিতে এটাকে বলেন–ফ্রাস্ট্রেশন। এই ফ্রাস্ট্রেশন থেকে যে এমন হত্যার প্রবৃত্তি জন্মাতে পারে, সেটা সেকালের লোকেরাও জানতেন–নৈরাশ্যেন কৃতো যত্নঃ।

কংস এখন আরও ফ্লাস্ট্রেটেড। সেইজন্য তিনি দার্শনিক হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেছেন–আমি আমার পুরুষকার দিয়ে দৈবের বিধানকে লঙ্ঘন করতে পারিনি। কিন্তু সে যাই হোক, বোন! তুমি তোমার পুত্রশোক ত্যাগ করো। মহাকালই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। মহাকালই মানুষকে সংসার থেকে সরিয়ে নেয়, আমি এখানে নিমিত্তমাত্র–কালো নয়তি সর্বং বৈ হেতুভূতস্তু মদ্বিধঃ। নিজের ভাগ্য বা কর্মানুসারে এসব উপদ্রব তো জীবনে আসেই, বোন! তবে দুঃখের কথা হল–মানুষ নিজেকে কর্তা বলে মনে করে–ইদস্তু কষ্টং যজন্তুঃ কর্তাহমিতি মন্যতে।

এসব জায়গায় ভগবদ্গীতার সেই উপদেশ–কালোস্মি, লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধঃ অথবা অহংকারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে–এই পংক্তিগুলির সঙ্গে কংসের মানসিক সাম্য আছে। বিশেষ করে পুত্রশোকের সান্ত্বনা বাক্য ভগবদ্গীতার বক্তব্যের সঙ্গে মিলে গেলে সেটা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়। কংস সেই কার্যকরী সান্ত্বনা দিয়ে দেবকীর চরণ স্পর্শ করেছেন পুত্রের মতো। বললেন–জানি আমি অপরাধ করেছি, তবু আমি তোমার পায়ে ধরছি, তুমি আর আমার ওপর রাগ করো নামদগত–স্ত্যজ্যতাং রোযো জানাম্যপকৃতিং ত্বয়ি।

 দেবকীর হৃদয় তখন পুত্রশোকে স্তব্ধ হয়ে ছিল। সেই অবস্থায় একটি বয়স্ক ভাই যখন তার পায়ে হাত দিয়ে নিজেকে পুত্র বলে প্রতিস্থাপন করল, তখন তার জননী-হৃদয় ডুকরে কেঁদে উঠল। একদিকে তিনি কংসের মাথায় হাত রাখলেন, অন্যদিকে তার পুত্র-শোকাতুর স্বামীর দিকে তাকিয়ে অশ্রুধারা মোচন করতে লাগলেন। কংসকে তিনি আস্তে আস্তে ওঠালেন মায়ের মতো করেই–উত্তিষ্ঠোত্তিষ্ঠ বৎসেতি কংসং মাতেব জল্পতী।

দেবকী কংসের তত্ত্ব মহাকালের কথা মেনে নিলেন, কারণ সেই তত্ত্ববোধ তাঁর আছে। বললেন–তুমি আমার ছেলেগুলিকে মেরে ফেলেছ, তাতে তুমি যে একমাত্র কারণ, তা নয়, মহাকালও নিশ্চয়ই তার কারণ। কিন্তু তুমি যে আমার পায়ে মাথা কুটে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছ, তাতেই হয়ত আমার গর্ভনাশের অসহ্য কষ্টও কোনও রকমে সহ্য করতে পারব–গর্ভকর্তনমেন্মে সহনীয়ং ত্বয়া কৃতম্। দেবকী মহাকালকৃত দুর্বিপাকের কথা সম্পূর্ণ মেনে নিয়ে কংসকে আশ্বাস দিলেন–যাও পুত্র! আমার পুত্রদের মৃত্যুর জন্য যে দুঃখ হচ্ছে, তার জন্য তুমি আর অন্যভাবে ভেবো না

–তদগচ্ছ পুত্র মা তে ভূগ্নদগতং মৃত্যুকারণম্। মৃত্যু প্রথমে মানুষকে প্রহার করে, তারপর আমরা তার হেতু বিচার করি অর্থাৎ দেবকী বলতে চাইলেন–তুমি যে আমার পুত্রগুলিকে মেরেছ–সেগুলি একেকটি প্রহারের মতো, এখন তার হেতু বিচার করলে অনেক কথাই আসবে–পূর্বকৃত কর্মদোষ, মহাকাল, বাস্তবে–ঘটা তাৎকালিক কারণ, মাতা-পিতার দোষ–আরও কত কী।

দেবকী এমন সুন্দর তির্যক ভঙ্গিতে কংসকে এই কথাগুলি বললেন যাতে বোঝা যায়–কংসকৃত অত্যাচার তার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত্যুর এই ঘটনা যখন ঘটেই গেছে তখন মরণ প্রহারের পরেও হেতু বিচার করতে হয়, নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই–মৃত্যুনা প্রহৃতে পূর্বং শেষো হেতুঃ প্রবর্ততে।

 কংস সব বুঝলেন। দেবকী যতই বলুন–তোমার কোনও দোষ নেই, মহাকালই এর কারণ–কারণং ত্বং ন বৈ পুত্র কৃতান্তোপ্যত্র কারণ–কংস নিজের অসাফল্যে–এত হত্যা করেও নিজের মৃত্যুর কারণ রোধ করতে পারলেন না–এই অসাফল্যে মনে মনে জ্বলতে জ্বলতে নিজের ঘরে ঢুকলেন–প্রবিবেশো সসংরক্কো দহ্যমানেন চেতসা।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *