তৃতীয় অনুবাক
প্রথম সূক্ত : প্রতিসরো মণিঃ
[ঋষি : শুক্র। দেবতা : মন্ত্রোক্ত দেবতাগণ। ছন্দ : বৃহতী, গায়ত্রী, জগতী, অনুষ্টুপ পংক্তি, ত্রিষ্টুপ, শক্করী]
অয়ং প্রতিসররা মণিবীরো বীরায় বধ্যতে। বীর্যবান্তসপত্নহা শূরবীর পরিপাণঃ সুমঙ্গলঃ ॥১॥ অয়ং মণিঃ সপত্নহা সুবীরঃ সহস্বান্ বাজী সহমান উগ্রাঃ। প্রত্যক কৃত্যা দূষয়শ্নেতি বীরঃ ॥২॥ অনেনেন্ট্রো মণিনা বৃত্রমহন্ননেনাসুরা পরাভাবয়ন্মনীষী। অনেনাজয় দ্যাবাপৃথিবী উভে ইমে অনেনাজয়ৎ প্রদিশশ্চতঃ ॥৩অয়ং স্রাক্ত্যো মণিঃ প্রতীবৰ্তঃ প্রতিসরঃ। ওজন্ বিমৃধো বশী সো অম্মান পাতু সর্বতঃ ॥৪৷৷ তদগ্নিরাহ তদু সোম আহ বৃহস্পতিঃ সবিতা তদিন্দ্রঃ। তে মে দেবাঃ পুরোহিতাঃ প্রতিচীঃ কৃত্যাঃ প্রতিসরৈরজন্তু ॥৫॥ অন্তর্দধে দ্যাবাপৃথিবী উতাহরুত সূর্যম্। তে মে দেবাঃ পুরোহিতাঃ প্রতীচীঃ কৃত্যাঃ প্রতিসরৈরজন্তু ৷৬৷৷ যে ক্ত্যং মণিং জনা বর্মাণি কৃথতে। সূর্য ইব দিবমারুহ্য বি কৃত্যা বাধতে বশী॥৭॥ স্রাক্ত্যেন মণিনা ঋষিণেব মনীষিণা। অজৈষং সর্বাঃ পৃতনা বি মৃধো হন্মি রক্ষসঃ ॥৮ যাঃ কৃত্যা আঙ্গিরসীৰ্যাঃ কৃত্যা আসুরীৰ্যাঃ কৃত্যাঃ স্বয়ংকৃতা। যা উ চান্যেভিরাভূতাঃ। উভয়ীস্তাঃ পরা যন্তু পরাবতো নবতিং নাব্যা অতি ॥৯॥ অস্মৈ মণিং বর্ম বর্ধন্তু দেবা ইন্দ্রো বিষ্ণুঃ সবিতা রুদ্ৰো অগ্নিঃ। প্রজাপতিঃ পরমেষ্ঠী বিরাড় বৈশ্বানর ঋষয়শ্চ সর্বে ॥১০৷
বঙ্গানুবাদ –এই তিলকবৃক্ষ হতে নির্মিত মণি প্রতিসরণসাধনীয়া, অর্থাৎ কৃত্যা-করণশালী শত্রু প্রভৃতির কর্মের প্রতিকার করণশালিনী। এটি বীর কর্মশালিনী, শত্রুগণকে বিতাড়িত করণে সমৰ্থা। এটি শত্রুঘাতিনী, সংগ্রাম ক্ষেত্রে বীর্য প্রকটনকারিণী। এটি যজমানকে রক্ষা করণশালিনী এবং সুন্দর কল্যাণময়ী। এই মণি অধিকারী পুরুষেরই বশ্যা ॥১॥৷
এই মণি শত্রুগণের নাশিকা এবং সুন্দর বীর পুত্র ইত্যাদি দানশালিনী, এটি বলবান শত্রুগণকে অবদমিত করণশালিনী এবং কৃত্যাকে কৃত্যাকারীর উপরেই প্রেরণকারিণী। (অর্থাৎ অভিচার কর্মকারীর উপরেই তার অভিচার কর্মের ফল প্রেরয়িত্রী)। আমার বাহুতে বন্ধনের নিমিত্ত এই মণি আগতা হচ্ছে। ২৷
এই মণির প্রভাবেই ইন্দ্র পূর্বকালে বিজয় প্রাপ্ত হয়ে অসুরবর্গকে বিনাশ করেছিলেন এবং এরই প্রভাবে বৃত্রকে পরাভূত করেছিলেন। এই মণিবন্ধনের সামর্থ্যের দ্বারা মনীষী (অর্থাৎ জয়োপায় সম্পর্কে জ্ঞানবান) ইন্দ্র অন্যান্য অসুরগণকে পরাভূত করেছেন। এরই দ্বারা তিনি আকাশ ও পৃথিবীর অধিপতি হয়েছেন এবং এই মণিরই প্রভাবে তিনি চতুর্দিককে আপন অধীনে আনয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন (স্বাধীনং কৃতবান) ॥ ৩
এই তিলকবৃক্ষের বিকারোৎপন্ন মণি বিদ্বেষীগণকে বিপরীত মুখে (প্রতিকূলে) প্রেরয়িত্রী, রোগ ইত্যাদির প্রতিসরণসাধনভূতা (অর্থাৎ প্রতিকার করণশালিনী), শত্রুকে নিরসনক্ষম তেজে তেজোময়ী। এই মণিকে যিনি ধারণ করেন, তাঁকে দর্শনমাত্রই শত্রু বিমর্দিত হয়ে পলায়ন করে থাকে। সকলকে বশীভূত করণশালিনী এই মণি সকল তিরস্কার বা অভিভব হতে আমাদের রক্ষা করুক ॥ ৪৷
অগ্নির উক্তিই হলো যে, স্বাক্ত্যমণির (অর্থাৎ তিলকমণির) বন্ধনে সকল সম্পদ সাধিত হয়। এই কথা বৃহস্পতি, সূর্য এবং ইন্দ্রও বলেছেন। এই মণির দ্বারা সর্বসাধনত্ব সম্পর্কে নির্দেশ দানকারী এই অগ্নি ইত্যাদি দেবগণ, শত্রুদের দ্বারা আমাদের প্রতি অন্যের উৎপাদিত কৃত্যাকে তারই কর্তার (অর্থাৎ সেই কৃত্যকারীর) দিকেই আপন প্রভাবের দ্বারা প্রতিসারিত করে দিন। ৫।
আমি আকাশ ও পৃথিবীকে এবং দিবস ও দিবাকরকে আমার নিজের ও কৃত্যার মধ্যে ব্যবধান রূপে স্থাপিত করছি। সেই হিতকর ফলশালী দেবতা (অর্থাৎ দ্যাবাপৃথিবী ইত্যাদি) প্রতিসর মন্ত্রের বলে কৃত্যাকে বিপরীত দিকে প্রত্যাবর্তিত করিয়ে দিন। ৬।
যে মনুষ্য এই ক্ত্য বা তিলক মণিকে কবচ রূপে ধারণ করে থাকে, তার নিমিত্ত সাধিত কৃত্যা (অর্থাৎ আভিচারিক ফল) পরিহার করণশালিনী এই মণি সূর্যের দ্বারা অন্ধকারকে বিদূরিত করণের সমান শত্রুর দ্বারা সাধিত সেই কৃত্যাকে বিনাশ করে দিয়ে থাকে ॥ ৭
আমি সাধক, অতীন্দ্রিয় দ্রষ্টা মহর্ষি অথর্বর ন্যায় তিলকবৃক্ষের বিকাররূপ এই মণির দ্বারা আমি শত্রুসেনার উপর বিজয়লাভ সম্পন্ন করেছি, এবং প্রমাথী (অর্থাৎ পীড়নকারী) রাক্ষসগণকে এই মণির প্রভাবের দ্বারাই আঘাত (বা বধ) করছি ॥৮॥
মহর্ষি অঙ্গিরা-কৃত যে কৃত্যা ও অসুরগণ কর্তৃক নির্মিত যে কৃত্যা এবং স্বয়ংকৃত অর্থক কোন বৈকল্যের দ্বারা কৃত যে কৃত্যা ও অন্যের প্রযুক্ত (পরার্থপ্রয়োগে) যে নিষ্ফল কৃত্যা–এই উভয়বিধ কৃত্যাই নবতিসংখ্যকা মহানদীরও পার অতিক্রম করে দূরে গিয়ে পতিত হোক। (এইস্থানে চতুষ্প্রকার নির্দিষ্ট কৃত্যার কথা বলা হলেও আঙ্গিরস ও অসুরগণের কৃত্যাকে এক দিকে এবং স্বয়ংকৃত ও অপর মনুষ্যগণের কৃত কৃত্যাকে অপর দিকে দেখানো হয়েছে। সুতরাং উভয়বিধ কৃত্যা রূপে উল্লিখিত হয়েছে)। ৯।
ইন্দ্র-বিষ্ণু-সবিতা ইত্যাদি আদিত্যগণ, রুদ্র, অগ্নি প্রজাগণের স্রষ্টা প্রজাপতি ও পরমেষ্ঠী, নিরতিশয় স্থানে বর্তমান ব্রহ্মাণ্ডাভিমানী দেব বিরাট, সকল মনুষ্যের হিতকরী বৈশ্বানর বা হিরণ্যগর্ভ এবং সমস্ত ঋষিবর্গ অপরের দ্বারা কৃত কৃত্যার প্রহার প্রতিকারের (বা পরিহারের) আকাঙ্ক্ষাশালী এই যজমানকে এই তিলকমণিরূপ কবচ ধারণ করিয়ে দিন ॥ ১০
বিনিয়োগঃ –অত্র অয়ং প্রতিসরঃ ইতি সূক্তং অর্থসূক্তং অভিলষিতার্থং। অনেনার্থসূক্তেন দধি মধুনি চ ত্রিরাত্রং বাসিতং তিলকমণিং সম্পত্য অভিমন্ত্র বধুীয়াৎ। সূত্রিতং হি।…তথা অস্য সূক্তস্য কৃত্যাপ্রতিহরণগণে পাঠাৎ শান্ত্যদকাভিমন্ত্রণহোমাদৌ বিনিয়োগ। সূত্রিতং হি।..তথা ..রৌদ্ৰাখ্যায়াং মহাশূন্তৌ তিলমণিবন্ধনে এতৎ সূক্তং বিনিযুক্তং। তদ্ উক্তং নক্ষত্রকল্পে (১৭,১৯)।… ইত্যাদি। (৮কা, ৩অ. ১সূ১-১০ঋ) ৷৷
টীকা— উপযুক্ত দশটি ঋক ৮ম কাণ্ডের ৩য় অনুবাকের ১ম সূক্তের অন্তর্ভূত। এই অংশটি এবং এর পরবর্তী অংশ অর্থসূক্ত নামে অভিহিত এবং এটি অভিলষিতাৰ্থে বিনিযুক্ত হয়। এই সূক্তমন্ত্রের দ্বারা দধি ও মধু ত্রিরাত্র বাসিত পূর্বক সূত্রোক্তপ্রকারে তিলকমণিতে সম্পাতিত ও অভিমন্ত্রিত করে তা বন্ধন করণীয়। এই সূক্ত কৃত্যা পরিহার কল্পে পঠিত ও শান্তু্যদক অভিমন্ত্রণে হোম ইত্যাদিতে বিনিয়োেগ হয়। রৌদ্রখ্য মহাশান্তি কর্মে সূত্রানুসারে তিলমণিবন্ধনে এই সূক্ত বিনিযুক্ত হয়।…ইত্যাদি। (৮কা. ৩অ. ১সূ১-১০ঋক)।
মন্ত্রঃ ই সূক্ত বিনিযুক্ত হয় হোম ইত্যাদিতে বিনত করে তা বন্ধন কর উত্তমো অস্যোষধীনামনড়ান্ জগতামিব ব্যাঘ্রঃ পদামিব। যমৈচ্ছামাবিদাম তং প্রতিষ্পশনমন্তিত৷৷ ১১। স ইদ ব্যাঘ্রো ভবত্যথো সিংহো অথো বৃষা। অথো সপত্নকর্শনো যো বিভীমং মণিম্ ॥ ১২৷৷ নৈনং ঘ্যরসো ন গন্ধর্বা ন মতাঃ। সর্বা দিশো বি রাজতি যো বিভীমং মণিম৷৷ ১৩৷৷ কশ্যপস্তুামসৃজত কশ্যপস্থা সমৈরয়ৎ। অবিভস্কৃন্দ্রো মানুষে বিভ্র সংশ্লেষিণেহজয়ৎ। মণিং সহস্রবীর্যং বর্ম দেবা অকৃথত। ১৪ যা কৃত্যাভির্যা দীক্ষাভির্যজ্ঞস্থা জিঘাংসিত। প্রত্যক ত্বমি তং জহি বজ্রেণ শতপর্বণা ॥ ১৫৷৷ অয়মিদ বৈ প্রতীবৰ্ত ওজস্বান্ সজয়োমণিঃ। প্রজাং ধনং চ রক্ষতু পরিপাণঃ সুমঙ্গলঃ ॥ ১৬। অসপত্নং নো অধরাদসপত্নং ন উত্তরাৎ। ইন্দ্রাসপত্নং নঃ পশ্চাজ্জ্যোতিঃ শূর পুরস্কৃধি ॥ ১৭ ৷৷ বর্ম মে দ্যাবাপৃথিবী বর্মাহবর্ম সূর্যঃ। বর্ম ম ইন্দ্ৰশ্চাগ্নিশ্চ বর্ম ধাতা দধাতু মে ৷ ১৮। ঐন্দ্রাগ্নং বর্ম বহুলং যদুগ্রং বিশ্বে দেবা নাতি বিধ্যন্তি সর্বে। তন্মে তন্বং ত্ৰায়তাং সর্বতো বৃহদায়ুষ্মং জরদষ্টিযথাসানি ॥ ১৯৷৷ আ মারুদ দেবমণিমহ্যাঁ অরিষ্টতাতয়ে। ইমং মেথিমভিসংবিশধ্বং তনূপানং ত্রিবরুথমোজসে৷ ২০ অস্মিন্নিন্দ্রো নি দধাতু নৃমিমং দেবালো অভিসংবিধ্বম। দীর্ঘায়ুত্বায় শতশারদায়ায়ুম্মান জরদষ্টিৰ্যর্থসৎ ২১ স্বস্তিদা বিশাং পতিবৃত্ৰহা বিমৃধো বশী। ইন্দ্রো বধাতু তে মণিং জিগীবা অপরাজিতঃ সোমপা অভয়ঙ্কররা বৃষা। স রক্ষতু সর্বতো দিবা নক্তং চ বিশ্বতঃ ॥ ২২৷৷
বঙ্গানুবাদ –হে মণি বা মণির উপাদানরূপ বৃক্ষ! তুমি সর্বাভিমতফলসাধনত্বের কারণে কতিপয় ফল দানশালিনী হলেও ঔষধিসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ভারবহনে সমর্থ, উপকারী ও গমনশীল চতুষ্পদ পশুর মধ্যে যেমন বলদ শ্রেষ্ঠ, বন্য পদগণের মধ্যে শত্ৰুহিংসা ইত্যাদি ক্রকর্মের নিমিত্ত ব্যাঘ্র যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনই তুমি হেন শ্রেষ্ঠ যে সর্বপুরুষার্থসাধক বলকে লাভ করতে আমরা আকাঙ্ক্ষা করেছি, তাকে প্রাপ্ত হয়েছি, (অথবা তোমা হেন প্রতিকূল দ্বেষ্টাকে অন্তিকে প্রাপ্ত হবো) ॥ ১১৷
উক্ত মহিমাশালিনী মণিকে যে পুরুষ ধারণ (বা বন্ধন) করে, সে ব্যাঘ্রের ও সিংহের মতো পরাভিভবনশীল (অর্থাৎ অপরকে পরাভবক্ষম) হয়ে থাকে; সে (অর্থাৎ সেই মণিধারণকারী পুরুষ) গাভীসমূহের মধ্যে স্বচ্ছন্দসঞ্চারী বৃষের মতো শত্রুগণকে বশ করণশালী হয়ে থাকে। ১২৷৷
এই মণির ধারণকর্তার উপর অপ্সরাবর্গ, গন্ধর্বগণ এবং মনুষ্যবৃন্দ প্রহার করতে পারে না। সে সর্বদিকে সুশোভিত হয়ে আধিপত্য লাভ করে। ১৩৷৷
হে মণি! তোমাকে প্রজাপতি কশ্যপ সৃষ্টি করে সকলের উপকারের নিমিত্ত প্রেরিত করেছিলেন। হে প্রশস্ত মণি! সকল দেবতার অধিপতি ইন্দ্র আপন বৃত্রহনন ইত্যাদি সিদ্ধির বিষয়ে এবং আপন রাজ্য প্রাপ্তির নিমিত্ত তোমাকে ধারণ করেছিলেন; অতএব যে পুরুষ তোমাকে ধারণ করে থাকে, সে পরস্পর সংশ্লেষণসাধনে (অর্থাৎ যুদ্ধে) অজেয় হয়ে থাকে। এই ভ্রাক্ত্য মণিকে দেবতাগণ কবচের সমান রক্ষাত্মক প্রভাবশালী করে দিয়েছিলেন ॥ ১৪
হে শান্তিকামী, পুরুষ! যে জন হিংসক কৃত্যাসমূহ (অর্থাৎ মারণাত্মক আভিচারিক ক্রিয়া), দীক্ষাসমূহ (অর্থাৎ যজ্ঞিয় নিয়ম ইত্যাদি); এবং হিংসা সাধন শ্যেন ইত্যাদি যাগ (শ্যেনেম্বাদিভির্যাগৈঃ) সাধনের দ্বারা তোমাকে হত্যা করতে আকাঙ্ক্ষা করছে, ইন্দ্রদেব সেই জিঘাংসুর উপর তার শতপর্বশালী বজ্র প্রহার করুন। ১৫৷
এই পরম শক্তিশালিনী মণি কৃত্যা ইত্যাদিকে নির্বীর্য করণশালিণী, অতিশয় ওজস্বিনী এবং বিজয়াত্মক সাধনসমূহের দ্বারা সমৃদ্ধ। এই মণি সকল দিকে হতে আমার নিমিত্ত রক্ষক ও সুন্দর কল্যাণসমূহের সাধনরূপ হোক। এই মণি আমার সন্তান ইত্যাদি প্রজা এবং ধন ইত্যাদি সম্পৎ রক্ষা করুক ॥ ১৬
হে ইন্দ্র (বা হে মণি)! তুমি শূর; আমাদের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকস্থায়ী শত্রুকে বিনাশ করো। উত্তরতঃ পশ্চাৎ বা পূর্ব দিকে শত্ৰুনিপাতক জ্যোতিকে আমাদের সম্মুখে প্রকাশিত করো। ১৭।
আকাশ ও পৃথিবীর দেবতাদ্বয় আমাকে তনুত্ৰাণ অর্থাৎ বর্ম প্রদান করুন। এইরকমেই দিনের অভিমানী দেবতা, সূর্য, ইন্দ্র, অগ্নি ও ধাতা আমাকে কবচ প্রদান করুন।১৮
ইন্দ্র ও অগ্নি দেবতার যে মণিরূপ প্রচণ্ড বলসম্পন্ন কবচ আছে, তাকেই সকল (বিশ্ব) দেবতাগণ অতিবেধন (অতিক্রমণ বা বিদ্ধ) করতে পারেন না; বরং তা পালন করেন। সেই কবচ সকল দিক হতে আমার রক্ষক হোক, যাতে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত আমি জীবিত থাকতে পারি, (অর্থাৎ শত সম্বৎসর পর্যন্ত আয়ু ভোগ করতে পারি) ॥ ১৯৷৷
এই দেবমণি বা ইন্দ্রের দ্বারা ধৃত এই মণি আমার মঙ্গলের নিমিত্ত আমার বাহু ইত্যাদি প্রদেশে আরূঢ় হয়েছে (অর্থাৎ আমি ধারণ করেছি)। হে মনুষ্যবর্গ! এই হেন মণিকে শত্রুর উৎপীড়ন, শরীর রক্ষণ এবং বলের নিমিত্ত ধারণ করো। (অথবা, হে ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ! তোমরা এই মেথীস্থানীয় অর্থাৎ শক্রবর্গকে বিলোড়য়িত বা বিনাশকারক মণিতে অধিষ্ঠিত হও) ॥ ২০
ইন্দ্র এই মণিতে আমাদের অভীপ্সিত সুখরাশিকে ব্যাপ্ত করুন। হে দেববর্গ! তোমরা এই মণিতে স্বয়ং ব্যাপ্ত (বা বিরাজমান) হও। তোমরা এই মণিকে এই প্রকার মঙ্গলকারিণী করে দাও, যাতে আমরা (যজমানগণ) শত শরৎ অর্থাৎ শত সম্বৎসরব্যাপী আয়ুষ্মন হতে পারি এবং বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত নিরোগ দেহ ভোগ করতে পারি। ২১।
আপন সেবকগণের মঙ্গল করণশালী দেবতা, মনুষ্য ইত্যাদির অধিপতি বা পালক, বৃত্রের হননকর্তা, বিগতযুদ্ধ বা নানা শত্রুবিনাশকারী, সকলকে বশকারী (বশী), জয়শীল (জিগীবান), স্বয়ং অন্য কর্তৃক অনভিভূত (অপরাজিত), সকল সোমযাগে স্বয়ং মুখ্যরূপে সোেমপানকারী (সোমপা), ভয়রাহিত্যের কর্তা (অভয়কর) ও অতিশয়িত পুস্ত্রের বা অভিমত ফলের বর্ষক (বৃষা) ইন্দ্রদেব তোমাকে মণিবন্ধন করান এবং তিনিই সকল দিক হতে দিবারাত্র সর্বদাই তোমাকে সকল ভয় হতে রক্ষা করুন ॥ ২২
বিনিয়োগ –উত্তমমা অসি ইতি মন্ত্রস্য পূর্বমন্ত্রেণ সহ উক্তো বিনিয়োগঃ ॥ (৮কা, ৩অ. ১সূ-১১-২২ঋক)৷৷
টীকা –উপযুক্ত দ্বাদশটি মন্ত্র প্রথম সূক্তেরই অন্তর্ভুক্ত। অতএব এই মন্ত্রগুলির বিনিয়োগ একই সঙ্গে করণীয় ॥ (৮কা, ৩অ. ১সূ১১-২২ঋক)।
.
দ্বিতীয় সূক্ত : গর্ভদোষনিবারণম
[ঋষি : মাতৃনামা। দেবতা : মন্ত্রোক্ত দেবগণ, মাতৃনামা, ব্ৰহ্মণস্পতি। ছন্দ : অনুষ্টুপ, বৃহতী, জগতী, পংক্তি, শক্করী]
যৌ তে মাতোন্মমার্জ জাতায়াঃ পতিবেদনে। দুর্ণামা তত্র মা গৃধদলিংশ উত বৎসপঃ ॥১॥ পলালানুপলালৌ শকুং কোকং মলিম্লচং পলীজকম্। আশ্রেষং বব্রিবাসসমৃক্ষগ্রীবং প্রমীলিনম ॥ ২॥ মা সং বৃতো মোপ সৃপ ঊরু মাৰ সৃপোহন্তরা। কৃণোম্যস্যৈ ভেষজং বজং দুর্ণামচাতনম্ ॥ ৩॥ দুর্ণামা চ সুনামা চোভা সংবৃতমিচ্ছতঃ। অরায়ানপ হন্মঃ সুনামা স্ত্রৈণনিচ্ছতাম্। ৪৷৷ যঃ কৃষ্ণঃ কৈশ্যসুর স্তম্বজ উভ তুন্ডিকঃ। অরায়ানস্যা মুষ্কাভ্যাং ভংসসোহপ হন্মসি ॥ ৫৷৷ অনুজিঘ্নং প্রশন্তং ক্ৰব্যাদমুত রেরিহ। অরায়াংছুকিষ্কিণো বজঃ পিঙ্গো অনীনশৎ। ৬। যস্তুা স্বপ্নে নিপদ্যতে ভ্রাতা ভূত্বা পিতেব চ। বজস্তান্তসহতামিতঃ ক্লীবরূপাংস্তিরীটিনঃ ৷৷ ৭৷ যা স্বপন্তীং সরতি যা দিম্পতি জাগ্রতীম্। ছায়ামিব প্র তান্তসূর্যঃ পরিক্রামনীনশৎ ॥ ৮৷৷ যঃ কৃপণতি মৃতবৎসামবতোকামিমাং স্ত্রিয়। তমোষধে ত্বং নাশয়াস্যাঃ কমলমঞ্জিৰম৯। যে শালাঃ পরিনৃত্যন্তি সায়ং গর্ভনাদিনঃ। কুসূলা যে চ কুক্ষিলাঃ ককুভাঃ করুমাঃ মিঃ। তানোষধে ত্বং গন্ধেন বিমূচীনা বি নাশয় ॥ ১০
বঙ্গানুবাদ –হে গর্ভিণী! তোমার উৎপত্তিমাত্রে তোমার জননী পতিকে দেয় যে দুর্নাম ও সুনাম বা দুর্নামবৎসপাখ্য প্রতিবেদন পরিহার বা উন্মার্জন করেছেন তার মধ্যে ত্বচা দোষ তোমাকে যেন ইচ্ছা না করে; পক্ষান্তরে অলীশ অর্থাৎ ভ্রমরাকারে বর্তমান কোন রোগ বা তার অভিমানী দেবতা এবং সম্বর্ত নামক বৎসপালক দেবতাও যেন তোমাকে বাধা না দান করেন ॥১॥
গর্ভিণীকে পীড়া দানশালী পলাল সদৃশ অতি সূক্ষ্ম রাক্ষসকে এবং অনুপলাল নামক অতি তুচ্ছ অঙ্গকে বিনাশ করছি। সেই সঙ্গে শকু নামক শরশর শব্দকারী, কোক বা চক্ৰবাকের ন্যায় আকৃতিশালী মলিম্লচ অর্থাৎ অত্যন্ত মলিনাঙ্গসম্পন্ন, পলীজক অর্থাৎ পাণ্ডুবর্ণের ন্যায় বর্তমান বা পলিতকারী, আশ্রেষ অর্থাৎ আলিঙ্গনের দ্বারা পীড়াপ্রদানকারী, বব্রিবাসস অর্থাৎ রূপোপেত বসনধারী, প্রমীলিন অর্থাৎ প্রতিক্ষণে নেত্র সঙ্কোচনকারী, এবং ঋক্ষগ্রীব অর্থাৎ বানরের ন্যায় গ্রীবাশালী–এই সকল রাক্ষস, যারা গার্ভিণীগণকে পীড়া প্রদান করে, তাদের প্রত্যেককে বিনাশ করছি। ২।
হে দুনাম নামক রোগের অভিমানী (দেবতা)! তুমি এই গর্ভিণীর ঊরুদ্বয়ের অন্তঃপ্রদেশকে সঙ্কুচিত করো না; এবং এর উরুদ্বয়ের মধ্যে নীচের দিকে প্রবেশ করো না। আমি এই দুর্নাম রোগ-নাশিনী শ্বেতসরিষারূপ ঔষধিকে প্রাপ্ত করছি ৷ ৩৷
দুর্নাম ও সুনাম এই দুই দোষ একত্রে বর্তমান থাকতে বা সঞ্চরণ করতে ইচ্ছা করে। এর মধ্যে দুর্নাম প্রভৃতি অলক্ষ্মীক রোগকে আমরা বিনাশ করে দিচ্ছি। দ্বিতীয় সুনামা রোগ স্ত্রীসম্বন্ধীরূপে থাকতে বা স্ত্রী-অঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকতে ইচ্ছা করণশালী হোক। ৪
প্রসিদ্ধ কৃষ্ণবর্ণ কেশবান্ নামক অসুর, স্তম্বজ অর্থাৎ স্তম্বে জাত অসুর, তুণ্ডিক অর্থাৎ কুৎসিত তুণ্ড বা মুখশালী অসুর,–এগুলি সবই ব্যাধিসমূহের দুর্ভাগরূপ। এগুলিকে এই গর্ভিণীর মুষ্ক নামক অঙ্গস্থান ও কটিদেশের সন্ধিস্থান হতে অপসারিত করে দিচ্ছি। (মুষ্ক হলো অণ্ডকোষ। বলা হয়েছে স্ত্রীণামপি মুষ্কং অস্তি অর্থাৎ শরীর-বিজ্ঞান অনুসারে স্ত্রীগণেরও মুষ্ক থাকে) ॥ ৫॥
অনুজিঘ্র অর্থাৎ যারা আঘ্রাণের দ্বারা মারণশীল, প্রমৃশ অর্থাৎ যারা বলপ্রয়োগে (বা স্পর্শের দ্বারা) হত্যাকারী, ক্ৰব্যাদ অর্থাৎ যারা হত্যা করে মাংস ভক্ষণ করে ফেলে, রেরিহ অর্থাৎ যারা লেহন করে হত্যাকারী, উক্ত ব্যতিরিক্ত অন্যান্য অলক্ষ্মীকর কিকি শব্দকারী সকল ব্যাধি-রাক্ষসগণকে এই (অভিমন্ত্রিত) পীতবর্ণ-সরিষা বিনাশ করুক ৷৷ ৬ ৷
হে গর্ভিণী! পিতা বা ভ্রাতার ন্যায় রূপ ধারণ করে যে রাক্ষস স্বপ্নে অর্থাৎ নিদ্রাবস্থায় তোমার শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে তোমার গর্ভকে ধ্বংস করে, তাদের এই শ্বেতসরিষা অভিভব করুক। এবং নপুংসক (হিজড়া) রূপে বা অলক্ষিত রূপে এই গর্ভিণীর নিকটে আগমনশীল দুষ্টবৃন্দকে এই সরিষা বিনাশ করে দিক। ৭
হে গর্ভিণী! শয়নের মধ্যে (অর্থাৎ স্বপ্নবস্থায়) কিংবা জাগরণের মধ্যে বিচরণকারী যে রাক্ষস তোমাকে হিংসা করতে ইচ্ছা করে। থাকে, তাদের সকলকেই এই (অভিমন্ত্রিত) সরিষা, সূর্য কর্তৃক তমোনাশের মতো, নষ্ট করে দিক ॥ ৮।
হে সরিষা-রূপা ঔষধি! রাক্ষস ইত্যাদি যে দুষ্টগণ এই স্ত্রীকে মৃত সন্তানের জন্মদাত্রী (অর্থাৎ মৃতবৎসা) করে দেয় বা যারা এর গর্ভকে বিপত্তিগ্রস্ত (অবতোকা অর্থাৎ গর্ভস্রাববিশিষ্টা বা অবপন্নগর্ভা অর্থাৎ অধঃপতিতগর্ভা) করে, তুমি তাদের বিনাশ পূর্বক এর গর্ভদ্বার (কমলং) অভিব্যক্ত বা ক্ষণেপেত করো, (অর্থাৎ এর গর্ভকে পুষ্ট করণশালিনী হও) ॥ ৯৷
যে পিশাচগণ সায়ংকালে আক্রোশন্ত হয়ে গর্দভের ন্যায় চিৎকার পূর্বক গৃহের সর্বদিকে নৃত্য করতে থাকে, যারা কুসূলাকৃতি (অর্থাৎ ধানের গোলার ন্যায় আকৃতিধারী) হয়ে নৃত্য করে, যারা বৃহকুক্ষিযুক্ত (অর্থাৎ ভয়ঙ্কর জঠরসম্পন্ন আকৃতিধারী হয়ে নানারকম শব্দ সহকারে গৃহের সর্বদিকে নৃত্য করতে থাকে, তাদের, হে শ্বেত ও পীত সরিষারূপা ঔষধি! তোমরা আপন গন্ধের দ্বারাই নাশ প্রাপ্ত করিয়ে দাও ১০
বিনিয়োগঃ –যৌ তে মাতা ইতি অর্থসূক্তং। অস্য অর্থসূক্তস্য দিব্যো গন্ধর্বঃ (২/২) ইমং মে অগ্নে (৬/১১১) যৌ তে তে মাতা (৮/৬) ইতি মাতৃনামানি ইতি (কৌ. ১/৮) মাতৃগণে পাঠাৎ শান্তু্যদকাভিমন্ত্রণাদ্ভুতহোমশান্তিহোমাদৌ গণপ্ৰযুক্তো বিনিয়োগোবগন্তব্যঃ। সূত্রিতং হি।… সীমন্তোন্নয়নকর্মণি অনেন অর্থসূক্তেন শ্বেতপীতসর্ষপান সম্পত্য অভিমন্ত্র গার্ভিণ্যা বর্ধীয়াৎ। তথা চ সূত্রং… ইত্যাদি। (৮কা. ৩অ. ২সূ১-১০ঋক)।
টীকা –৮ম কাণ্ডের ৩য় অনুবাকের মোট ২৬টি মন্ত্র সম্বলিত এই ২য় সূক্তটি অর্থসূক্ত নামে অভিহিত উপরে উল্লেখিত অপরাপর অর্থসূক্তের মতোই এই সূক্তমন্ত্রগুলি শান্তুদকাভিমন্ত্রণে, অদ্ভুতহোমে ও শান্তিহোমে সূত্রোক্তপ্রকারে অর্থসূক্তের দ্বারা শ্বেত ও পীতবর্ণের সরিষা গর্ভিণীর অঙ্গে বন্ধন করতে হয় ॥ (৮কা, ৩অ. ২সূ১-১০ঋক)।
মন্ত্রঃ যে কুকুন্ধাঃ কুকুরভাঃ কৃত্তীর্দশানি বিভ্রতি। ক্লীবা ইব প্রত্যন্তা বনে যে কুর্বতে ঘোষং তানিত নাশয়ামসি। ১১ : যে সূর্যং তিতিক্ষন্ত আতপন্তমমুং দিবঃ। অরায়া বস্তবাসিনো দুর্গন্ধীংল্লোহিতাস্যা মককান নাশয়ামসি ॥ ১২। য আত্মানমতিমাত্ৰমংস আধায় বিভ্রতি। স্ত্রীণাং শ্রোণিপ্রততদিন ইন্দ্র রক্ষাংসি নাশয় ॥ ১৩। যে পূর্বে ব যন্তি হস্তে শৃঙ্গাণি বিভ্রতঃ। আপাকেষ্ঠাঃ প্রহাসিন স্তম্বে যে কুর্বতে জ্যোতিস্তানিতো নাশয়ামসি ॥ ১৪যেষাং পশ্চাৎ প্রপদানি পুরঃ পাষ্ণীঃ পুরো মুখা। খলজাঃ শকধূমজা উরুণ্ডা যে চ মটমটাঃ কুম্ভমুষ্কা অয়াশবঃ। তানস্যা ব্ৰহ্মণস্পতে প্রতীবোধেন নাশয় ॥ ১৫৷ পর্যস্তাক্ষা অপ্রচঙ্কশা অস্ত্রৈণাঃ সন্তু পণ্ডগাঃ। অব ভেষজ পাদয় য ইমাং সংবিবৃসত্যপতিঃ স্বপতিং স্ক্রিয়ম্ ॥ ১৬৷ ঊর্ধর্ষিণং মুনিকেশং জম্ভন্তং মরীমৃশম্। উপেষন্তমুদুম্বলং তুলেমুত শালুড। পদা প্র বিধ্য পাষ্ণা স্থানীং গৌরিব স্পন্দনা ॥ ১৭৷ যস্তে গর্ভং প্রতিমৃশাজ্জাতং বা মারয়াতি তে। পিঙ্গস্তমুগ্ৰধা কৃপোতু হৃদয়াবিধম্ ॥ ১৮। যে অস্লো জাতা মারয়ন্তি সূতিকাঃ অনুশেরতে। স্ত্রীভাগা পিঙ্গো গন্ধর্বা বাতো অভ্রমিবাজতু। ১৯৷৷ পরিসৃষ্টং ধারয়তু যদ্ধিতং মাব পাদি তৎ। গর্ভং ত উগ্রেী রক্ষতাং ভেষজৌ নীবিভাষৌ ৷ ২০৷৷
বঙ্গানুবাদ –মোরগের ন্যায় কু কু রবকারী, দূষিত কর্মকারী, উন্মাদের ন্যায় অঙ্গভঙ্গী করণশালী এবং অরণ্যে শব্দকারী যে কৃকন্ধ (বা কুকুন্ধ) নামক পিশাচ আছে, তাদের আমরা এই গর্ভিণীর নিকট হতে অপসারিত (বা বিনাশ) করছি ৷৷ ১১৷৷
যে পিশাচগণ (বা ভূতবিশেষ) দ্যুলোক হতে প্রেরিত সূর্যের তাপ সহ্য করতে পারে না, যারা শ্রীহীন, ছাগচর্ম-পরিধায়ী, দুর্গন্ধযুক্ত অঙ্গসম্পন্ন, সর্বদা নব-মাংস ভক্ষণের কারণে রক্তাপ্লুত মুখশালী, অস্থি ইত্যাদির অলঙ্কার ধারণকারী ও কুৎসিতগতিসম্পন্ন, তাদের আমরা বিনাশ করছি৷৷ ১২।
যে পিশাচগণ গর্ভের কারণে অতিরিক্ত স্থূলদেহশালিনী গর্ভিণীদের স্কন্ধে বহন করে নৃত্য করতে থাকে, স্ত্রীগণের কটি প্রদেশকে ব্যথিত করণশালী সেই পিশাচগণকে, হে ইন্দ্র! তুমি বিনষ্ট করে দাও। ১৩।
যে পিশাচগণ আপন স্ত্রীগণ। সহ তাদের অগ্রগামী হয়ে হস্তে, শৃঙ্গ (অর্থাৎ বিষাণ নামক বাদন) ধারণ করে পরিভ্রমণ করে, পাকশালায় গমন করে অট্টহাস্য করে, যারা ব্রীহি ইত্যাদি স্তম্ভে বা গৃহস্তম্ভে অগ্নিরূপ জ্যোতি উৎপাদন করে, সেই সব পিশাচকে আমরা গর্ভিণীর বাসস্থান হতে বিদূরিত (বা বিনাশ) করে দিচ্ছি ৷৷ ১৪৷
যে রাক্ষস প্রভৃতির পশ্চাৎ দিকে পাদাগ্রপ্রদেশ এবং পুরোভাগে পাষ্ণী (অর্থাৎ গোড়ালি), যারা খলজা অর্থাৎ ধান্যশোধনপ্রদেশে জাত, যারা শকধূমজা অর্থাৎ গোবর ও অশ্ব ইত্যাদি জন্তুর বিষ্ঠায় উৎপন্ন, যারা উরুণ্ডা অর্থাৎ মুণ্ডহীন, যারা মটমটা অর্থাৎ মুমুটু শব্দকারী বা ছিন্ন-সর্বাবয়বী, যারা কুম্ভমুষ্ক অর্থাৎ কুম্ভের ন্যায় মুম্বযুক্ত (বিশাল অণ্ডকোষধারী), যারা অয়াশব অর্থাৎ বায়ুবৎ আশুগামী, হে বেদরাশির অধিদেব ব্রহ্মণস্পতি! তুমি এই অভিমন্ত্রিত শ্বেত-সরিষার প্রভাবে তাদের (অর্থাৎ সেই রাক্ষস প্রভৃতিকে) বিনাশ করে দাও। ১৫।
যে রাক্ষসবৃন্দ বিকীর্ণলোচন (অর্থাৎ যাদের দৃষ্টি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয় বা যারা বিস্ফারিত নেত্রে দৃষ্টিপাত করে) ও যে রাক্ষসগণের উরুদেশ প্রক্ষীণ (প্রচঙ্কশাঃ), যারা পন্নগ অর্থাৎ পদের দ্বারা গমন করে না, তারা অস্ত্রৈণ অর্থাৎ স্ত্রীরহিত হোক অথবা সর্পে পরিণত হোক। আরও, হে সরিষারূপা ঔষধি! যে, রাক্ষস ইত্যাদি এই পতিরহিতা স্বাধীনপতিকা নিদ্রিতা স্ত্রীকে সংবর্তিত করতে (বা লুকিয়ে রাখতে) ইচ্ছা করছে, তুমি তাদের অধোমুখ করে নিপাতিত করো ৷৷ ১৬৷৷
উদ্ধষী অর্থাৎ উক্তৃষ্ট ধর্ষণযুক্ত, মুনিকেশ অর্থাৎ মুনিবৎ জটাত্মক কেশযুক্ত, জম্ভয়ন্ত অর্থাৎ হিংসুক, মরীমৃশ অর্থাৎ পুনঃ পুনঃ বলাকারী, উপৈষন্ত অর্থাৎ সর্বতং গর্ভিণীর অন্বেষণকারী, উদুম্বল অর্থাৎ উৎসৃষ্ট বলশালী, তুণ্ডেল অর্থাৎ প্রকৃষ্ট তুবন্ত, এবং শালুড নামক পিশাচগণকে এই সরিষারূপা ঔষধি সেইরকম ভাবেই পদাঘাত পূর্বক বিতাড়িত করুক, যেমন ভাবে দুষ্টা গাভী দোহনের পর দুগ্ধের পাত্রকে পশ্চাতের এ পদদ্বয়ের দ্বারা আঘাত করে থাকে ॥ ১৭ ॥
হে গর্ভিণী! তোমার গর্ভকে পীড়িত করণশালী বা আর তোমার উৎপন্ন শিশুকে মারণের ইচ্ছাশালী পিশাচ ইত্যাদি হিংসকগণকে এই ঔষধি পদদলিত করে বিনষ্ট করুক। হে শ্বেত-সরিষা! তুমি সেই গর্ভঘাতক রাক্ষসদের হৃদয়ে মহাধনুর্ধরের (উগ্রধনার) মতো তাড়িত করো (অর্থাৎ উদয়ূর্ণগতি হয়ে তাদের হৃদয়-প্রদেশকে বিদ্ধ করো)। ১৮৷৷
যে পিশাচ ইত্যাদি রাক্ষসগণ অর্ধ-উৎপন্ন (অর্থাৎ অসম্পূর্ণ) গর্ভকে নষ্ট করে দিয়ে থাকে, যারা স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে সূতিকার অর্থাৎ অভিনবপ্রসবার সাথে শয়ন করে, (অর্থাৎ তার ক্ষতি সাধনের সুযোগে রত থাকে), সেই গর্ভিণীকে আপন ভাগরূপে (গ্রহণযোগ্যারূপে) মান্যকারী গন্ধর্ব রাক্ষস-পিশাচগণকে জলরহিত মেঘের বায়ুর দ্বারা তাড়িত করণের মতো এই শ্বেত-সরিষা। বিতাড়িত করে দিক ॥ ১৯
হবন ইত্যাদি হতে বিনিয়োগবশিষ্ট (বিনিয়োগের পর অবশিষ্ট) সরিষাকে গর্ভিণী ধারণ করুক, যাতে তার অভিপ্রায় অনুসারী পুত্র ইত্যাদি লক্ষণযুক্ত গর্ভ বিনষ্ট না হয়। হে গাভিণী! এই উদগ্র্ণ অর্থাৎ উগ্র বলশালিনী ভেষজরূপা শ্বেত ও পীত উভয়বিধ সরিষা নীবিদেশে বস্ত্রাঞ্চলে ধারণ করণের পর, এরাই তোমাকে রক্ষা করবে। ২০।
বিনিয়োগঃ— যে কুকুন্ধাঃ ইতি মন্ত্রস্য পূর্বসূক্তেন সহ উক্তো বিনিয়োগঃ ॥ (৮কা. ৩অ. ২সূ১১-২০ঋ)।
টীকা –৮ম উপযুক্ত ১০টি মন্ত্র দ্বিতীয় সূক্তেরই অংশবিশেষ। এগুলির বিনিয়োগ পূর্বেই উক্ত হয়েছে। …ইত্যাদি। (৮কা, ৩অ. ২সূ-১১-২০ঋ)।
মন্ত্রঃ পবীনসাৎ তঙ্গাল্বচ্ছায়কাদুত নগ্নকাৎ। প্রজায়ৈ পত্যে ত্বা পিঙ্গঃ পরি পাতু কিমীদিনঃ ॥ ২১৷৷ দ্ব্যাস্যাচ্চতুরক্ষাৎ পঞ্চপাদাদনঙ্গুরেঃ। বৃন্তাদভি প্ৰসৰ্পতঃ পরি পাহি বরীবৃতাৎ ॥ ২২৷৷ য আমং মাংসমদন্তি পৌরুষেয়ং চ যে ক্রবিঃ। গর্ভান খাদন্তি কেশবাস্তানিতে নাশয়ামসি। ২৩৷৷ যে সূর্যাৎ পরিসর্পন্তি সুষেব শ্বশুরাদধি। বজশ্চ তেষাং পিঙ্গশ্চ হৃদয়েহধি নি বিধ্যতাম৷ ২৪৷৷ পিঙ্গ রক্ষ জায়মানং মা পুমাংসং স্ত্রিয়ং ক্রন্। আণ্ডাদো গর্ভার্মা দখন বাধম্বেতঃ কিমীদিনঃ ॥ ২৫৷৷ অপ্রজাস্তুং মাৰ্তবৎসমাদ রোদমঘমাবয়ম্। বৃক্ষাদিব স্ৰজং কৃত্বাপ্রিয়ে প্রতি মুঞ্চ তৎ ॥ ২৬।
বঙ্গানুবাদ –হে গর্ভিণী! পবীনসাৎ অর্থাৎ বজ্রসদৃশ নাসিকোপেত এবং তঙ্গ, সায়ক ও নগ্নক নামক অসুরগণের নিকট হতে এই পীত-সরিষা (ঔষধি) তোমাকে রক্ষা করুক; সেইসঙ্গে পুত্রলাভার্থে ও পতির আনুকূলার্থে এই ঔষধি তোমার সহায়ক হোক। ২১।
হে ঔষধি! দুই মুখ, চতুনেত্র, পল্ক পাদযুক্ত, অঙ্গুলিরহিত, লতাপুঞ্জের অভিমুখে গমনকারী, সর্বাঙ্গ ব্যাপ্ত পিশাচগণের · (অর্থাৎ সর্বাঙ্গব্যাপী পৈশাচিকতা-সম্পন্ন দুষ্টদের) নিকট হতে তুমি এই গর্ভিণীকে রক্ষা করো ॥ ২২।
যে পিশাচ মনুষ্যের অপরু (কাঁচা) মাংস ভক্ষণ করে, প্রকৃষ্ট কেশযুক্ত যে পিশাচগণ মায়াপূর্বক গর্ভে প্রবেশ করে (গর্ভস্থ ভ্রূণকেও) ভক্ষণ করে যায়, সেই ত্রিবিধ পিশাচগণকে আমরা এই গর্ভিণীর সমীপ হতে বিনাশ (বা বিদূরিত) করছি। ২৩।
শ্বশুরের আজ্ঞাক্রমে পুত্রবধূ যেমন শ্বশুরের পুত্রের (অর্থাৎ আপন পতির) নিকট গমন করে, সেই রকমেই সূর্যের আজ্ঞাক্রমে পৃথিবীর প্রাণীবর্গকে পীড়া প্রদানের নিমিত্ত আগমনশীল পীড়ক পিশাচদের হৃদয়দেশে এই (অভিমন্ত্রিত) শ্বেত ও পীত সরিষা তাড়িত করুক। ২৪
হে শ্বেত সরিষা! উৎপদ্যমান (উৎপন্ন হচ্ছে এমন) গর্ভস্থ শিশুকে রক্ষা করো। জায়মান (জন্মাচ্ছে, এমন) পুরুষ বা স্ত্রী শিশুকে আক্রান্ত হতে দিও না, (অথবা কোন কোন ভূত বিশেষের দ্বারা গর্ভস্থ পুরুষ-জ্বণকে স্ত্রী-ণে পরিণত হতে দিও না)। অণ্ডপ্রদেশ ভক্ষণকারী ও ইতস্ততঃ বিচরণকারী রাক্ষসগণকে, হে পীত সরিষা! এই গর্ভিণীর নিকট হতে অন্যত্র নীত পূর্বক পীড়া প্রদান করো। ২৫।
হে পীত-সরিষা! এই গর্ভিণীর সন্তানহীনতা (অপত্যবিধুরত্ব), মৃত সন্তানের মাতৃত্ব (মৃতবৎসত্ব), সর্বদা উৎপদ্যমান দুঃখ বা হৃদয়ের ক্রন্দন, পাপ বা তার ফলভূত দুঃখের আবর্তন–শত্রুর উপর এই প্রকার দুর্ভাগ্যগুলিকে মাল্যাকারে অর্পণ করো, যেমন আপন কোন প্রিয়তমের উপরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। ২৬।
বিনিয়োগঃ –পবীনসাৎ ইতি মন্ত্রস্য যৌ তে মাতা (৮/৬) ইত্যানেন সহ উক্তো বিনিয়োগঃ ॥ (৮কা, ৩অ. ২সূ–২১-২৬ঋক)।
টীকা –উপযুক্ত ছটি মন্ত্রও ৮ম কাণ্ডের ৩য় অনুবাকের ২য় সূক্তের অন্তর্গত। এইগুলির বিনিয়োগও ঐ সঙ্গে হবে এবং তা পূর্বেই উক্ত হয়েছে। (৮কা, ৩অ. ২-২১-২৬ঋক)।
[পূর্ববর্তী ৫ম কাণ্ডের মতো সায়ণাচার্য ৮ম কাণ্ডের ৪র্থ অনুবাক থেকে সমগ্র ১০ম কাণ্ড পর্যন্ত এবং পুনরায় দ্বাদশ কাণ্ড থেকে সমগ্র ১৬শ কাণ্ড পর্যন্ত অংশের ব্যাখ্যা প্রদানে বিরত থেকেছেন। অবশ্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে (৫ম কাণ্ডের মতোই) যথাযথ বিবরণ উল্লেখ করেছেন। পূজ্যপাদ স্বর্গীয় দুর্গাদাসও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে সায়ণাচার্যকেই অনুসরণ করেছেন। আমরা ৫ম কাণ্ডের মতোই হিন্দী বলয়ের পণ্ডিতবর্গের মনীষার সহায়তা নিয়ে উল্লিখিত অংশের সূক্তসার সংযোজিত করে বাঙালী পাঠকজনের পক্ষে অথর্ববেদ সম্পর্কিত মানসিক অপূর্ণতার আংশিক ক্ষতিপূরণে প্রয়াসী হয়েছি।]