তারপরদিন সকালবেলাও আমাকে হাসপাতালে যেতে হলো। তখন বোধ হয় বেলা দশটা এগারোটা হবে। তায়েবার মা, বড়ো ভাই, ডোরা, জাহিদুল হক এবং দোলা সবাই তায়েবার বিছানার চারপাশে ভিড় করে আছে। দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে পা দিতেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমি কেমন অন্য রকম হয়ে যাই। এই পারিবারিক সম্মেলনে আমার তো কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয়। স্বভাবতই আমি ভীরু এবং লাজুক প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু চলে আসাটা ছিলো আরো অসম্ভব। আমার দিকে প্রথম দৃষ্টি পড়লো তায়েবার। এই যে দানিয়েল ভাই, আসুন, ইতস্তত করছেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না মা এবং বড়ো ভাইয়া এসেছেন। আমি কেবিনে ঢুকে তায়েবার মাকে সালাম করলাম। মহিলা আমার মাথায় হাত রাখলেন। সহসা মুখে কোনো কথা যোগালো না। এ মহিলাকে তায়েবার বন্ধু বান্ধবেরা সবাই মা বলে ডাকে। আমিও চেষ্টা করেছি মা ডাকতে। কিন্তু বলতে পারবো না, কি কারণে জিভ ঠেকে গেছে। যা হোক, তিনি জিগ্গেস করলেন, কেমন আছো বাবা। আমি স্মিত হেসে বললাম, ভালো। তায়েবার বড়ো ভাইয়া তাঁকে আমরা হেনা ভাই ডেকে থাকি। জিগগেস করলেন, দানিয়েল তোমার সব খবর ভালো তো! তারপর বললেন, চলো, একটু বাইরে যাই। কেবিন থেকে বেড়িয়ে দু’জনে গেটের কাছের মহানিম গাছটির গোড়ায় এলে হেনা ভাই বললেন, চলো এখানে শানের ওপর একটু বসি। বসার পর জিগগেস করলেন, তোমার পকেটে সিগারেট আছে? ভুলে আমি প্যাকেটটা ফেলে এসেছি। নীরবে পকেট থেকে চারমিনার বের করে দিলাম। মুখে একটুখানি অপ্রিয় ভঙ্গি করে হেনা ভাই বললেন, আঃ চারমিনার খাচ্ছো। ভালো সিগারেটের প্রতি হেনা ভাইয়ের মস্ত একটা অনুরাগ আছে। মনক্ষুণ্ণ হলেও তিনি একটা চারমিনার ধরালেন। হেনা ভাই সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছেন। সারা গায়ে পাউডার মেখেছেন। চুলটাও বোধকরি আগের দিন কেটেছেন। আমাদের জীবনকে ঘিরে এতো সব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো যেন তাকে কিছু মাত্র স্পর্শ করেনি। আপাতত তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে গেন্ডারিয়ার বাড়ির খোস গল্প করার মুডে রয়েছেন। এ সময়ে তাঁর পায়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তিনি বললেন, এ বিদ্যাসাগরী চটি জোড়া গতকাল কলেজ স্ট্রীট মার্কেট থেকে কিনলাম। জানো তো বিদ্যাসাগরী চটির মাহাত্ম্য। নীলদর্পন নাটকে নীলকর সাহেব যখন ক্ষেত্রমণিকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছিলো বিদ্যাসাগর মহাশয় রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে পায়ের চটি জোড়া ছুঁড়ে মেরে ছিলেন। তা পরবর্তী দৃশ্যে গিরিশ ঘোষ যিনি নীলকর সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, চটিজোড়া মস্তকে ধারণ করে হল ভর্তি দর্শকের সামনে এসে বলেছিলেন, জীবনে আমি অভিনয় করে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চটি জোড়ার মতো এতো বড়ো পুরস্কার কোনোদিন পাইনি এবং পাবোও না। তারপর তো ড্রপসীন পড়ে গেলো। হল ভর্তি লোকের সেকি বিপুল করতালি। দৃশ্যটা একবার কল্পনা করতে চেষ্টা করো।
কেবিনে এসে দেখি ভাইবোন সবাই মিলে ডোরার রবীন্দ্র সঙ্গীতের গল্প করছে। জাহিদুল তাতে আবার মাঝে মধ্যে ফোড়ন কাটছে। উৎসাহটাই মনে হচ্ছে তায়েবার অধিক। এমন খোস গল্প করার আশ্চর্য প্রশান্তি এরা সকলে কেমন করে আয়ত্ব করলেন, আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই। তায়েবা জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ডোরা তার জীবনের মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটিয়ে বসে আছে। আমাদের সকলের অস্তিত্ব চেকন সূতোয় ঝুলছে। এই ধরনের অবস্থায় নির্বিকার মুখ ঢেকে এঁরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের আলোচনা কি করে করতে পারেন! জীবন সম্ভবত এ রকমই। আঘাত যতো মারাত্মক হোক, দুঃখ যতো মর্মান্তিক হোক, এসময় জীবন সব কিছু মেনে নেয়। দুনিয়াতে সব চাইতে আশ্চর্য মানুষের জীবন।
তায়েবার মা তায়েবার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। ভদ্রমহিলার তেজোব্যঞ্জক মুখমণ্ডলে এক পোঁচ ঘন গাঢ় বিষাদের ছায়া। সকলেই কথা বলছে, তিনি বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন। সাদা কালো চুলের রাশি এক পাশে হেলে পড়েছে। অসাধারণ ব্যক্তিমণ্ডিত চেহারা। যৌবনে কি সুন্দরীই না ছিলেন। মহিলার দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। চেহারায় এমন একটা আকর্ষণী শক্তি আছে, বারবার তাকাতে বাধ্য করবে। আপাতত মাধুর্যমণ্ডিত মনে হলেও ধারালো কঠিন কিছু আত্মগোপন করে আছে। অনেকবার এই মহিলার কাছাকাছি এসেছি। কিন্তু খুব কাছে যেতে সাহস পাইনি। মহিলার প্রতি যেমন গভীর আকর্ষণ অনুভব করতাম, তেমনি আবার ভয়ও করতাম।
উনারা যখন উঠলেন, তখন বেলা সাড়ে এগারোটা হবে। আমি কি করবো স্থির করতে না পেরে উশখুশ করেছিলাম। তায়েবার মা বলে বসলেন, বাবা দানিয়েল, তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি সসংকোচে জানতে চাইলাম, কোথায়? তিনি বললেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে আমার দেওরের বাসায়। আর কেউ যাবে না? না দোলা যাবে ক্যাম্পে। হেনা দিনাজপুরে লোকদের সঙ্গে থাকে। ডোরার কোথায় রিহার্সেল না কি আছে। তায়েবা কলকলিয়ে উঠলো, যান দানিয়েল ভাই, মার সঙ্গে যেয়ে চাচার সাথে পরিচয়টা করুন। আপনার অনেক ভালো হবে। চাচার সঙ্গে খাতির করতে পারলে উর্দু ভাষাটা তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারবেন। চাচাঁদের বাড়িতে কেউ বাংলা ভাষায় কথা বলে না। যান আপনার একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।
আমি একটা টানারিক্সা চেপে তায়েবার মাকে নিয়ে পথ দিলাম। যেতে যেতে তিনি আমাকে বললেন, আমার দেওরের বাসা যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে একটু সাবধানে কথাবার্তা বলতে হবে। ওরা কেউ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলে না, এমন কি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রাণের থেকে ঘৃণা করে। তথাপি আমি থাকছি, কারণ আমার অন্য কোথাও থাকার জায়গা নেই। ওরা আমাদের থাকতে জায়গা দিয়েছে। কারণ এই বাড়িটার অর্ধেকের দাবিদার ছিলাম আমরা। কিন্তু সে কথা আমরা কখনো উত্থাপন করিনি। ওদের জীবনের এমন একটা ধাঁচ তার সঙ্গে আমার একেবারেই মেলে না। আর আমাদের মধ্যে কি সব ঘটছে না ঘটছে সে বিষয়ে তাদের সামান্যতম জ্ঞান নেই। যেই কথাগুলো বললাম, মনে রাখবে। তোমাকে এই বাড়িটাতে অনেকবার আসতে হবে। তায়েবাদের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে আবছা আবছা অনেক কথা শুনেছি। সেগুলো কানে নেয়ার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করিনি। শুনেছিলাম তাদের বাবার পরিবারের কেউ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলেন না। বর্ধমান তাদের স্থায়ী নিবাস হলেও হাঁড়ে-মাংসে, অস্তি-মজ্জায় তায়েবার বাবা চাচারা মনে করেন তারা পশ্চিমদেশীয়। বাংলামুলুক তাদের পীরমুরিদী ব্যবসার ঘাঁটি হলেও অত্যন্ত যত্নে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের ভেদ চিহ্নগুলো ঘষে মেঝে তকতকে ঝকঝকে করে রাখে। এ ব্যাপারে উর্দু ভাষাটা তাঁদের সাহায্য করেছে সবচাইতে বেশি। স্থানীয় মুসলিম জনগণ তাদের এই বিচ্ছন্নতাবাদী মাসসিকতাকে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞান করে মেনে নিয়েছে। কারণ পীর বুজুর্গরা উর্দু ভাষার মাধ্যমে ধর্মোপদেশ দেবেন, কোরান কেতাবের মানে বয়ান করবেন এটাতো স্বাভাবিক। সাথে সাথে তারা যদি দৈনন্দিন কাজকর্মে ঐ ভাষাটিকে ব্যবহার করেন, তাতে তো দোষের কিছু নেই, বরং স্থানীয় জনগণের চোখে তাঁদের সম্ভ্রম অনেকগুণে বেড়ে যাওয়ার কথা। এই পরিবারটিতে তায়েবার মায়ের মতো একজন মহিলার বিয়ে হওয়া সত্যিকারের বিস্ময়ের ব্যাপার। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক অঘটন ঘটে যায়।
তায়েবার মা শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিবেশ থেকে। তাঁদের বাড়ি ছিলো বোলপুরের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের একেবারে সন্নিকটে। তায়েবার মা বালিকা বয়সে পাঁচ ছয় বছর শান্তিনিকেতনে পড়ালেখা করেছেন। বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুর বাড়িতে এসে একটা প্রকাণ্ড সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলেন। নতুন বৌ উর্দু ভাষায় কথা বলে না। এমনকি পারিবারিক ভাষাটি শিক্ষা করার কোনো চারও নতুন বৌয়ের নেই। দীর্ঘ ইতিহাস সংক্ষেপ করে বলতে গেলে শ্বশুর বাড়িতে স্বামী এবং দাসী চাকর ছাড়া আর কেউ তার সাথে কথা বলে না। এই অবস্থাটা অনেকদিন কেটেছে। এই সময়ে ভারতবর্ষ দু টুকরো হয়ে হিন্দুস্থান পাকিস্তান হলো। নতুন বউ স্বামীকে অনেক করে বুঝিয়ে সুজিয়ে বর্ধমান এবং কোলকাতার সমস্ত স্থাবর সম্পত্তির দাবি ছেড়ে দিয়ে পূর্বপাকিস্তানের দিনাজপুরে এসে নতুন সংসার পেতে বসেন।
নতুন সংসারে থিতু হয়ে বসার পর মহিলা তাঁর পুত্রকন্যাদের গড়ে তোলায় মনোযোগ দিলেন। শ্বশুর বাড়ি থেকে মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে একটা প্রচণ্ড ভীতি নিয়ে এসেছিলেন। দিনাজপুরে বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে অনেকদিন বসবাস করার পরও সে ভীতি তাঁর পুরোপুরি কাটেনি। সমাজে বাস করতেন বটে, কিন্তু একটা দূরত্ব সব সময় রক্ষা করতেন সে কারণে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য সব সময় হিন্দু শিক্ষক নিয়োগ করতেন। তাছাড়া বালিকা বয়সে তাঁর মনে শান্তিনিকেতনে যে সংস্কৃতির রঙ লেগেছিলো, অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সেও তা ফিকে হতে পারেনি। ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের গান শেখানো এবং রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ানোর একটা অনমনীয় জেদ মহিলাকে পেয়ে বসে। এই ফাঁক দিয়ে প্রগতিশীল রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টি এসব একেবারে বাড়ির অন্তঃপুরে প্রবেশ করে। তিনি নিজেও এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। মহিলার স্বামী নির্বিরোধ শান্তশিষ্ট মানুষ। সংসারের সাতে পাঁচে থাকেন না। অধিকন্তু মহিলা তার ইচ্ছাশক্তির সবটুকু পরিকল্পনার পেছনে বিনা বাধায় ব্যয় করতে পেরেছিলেন।
তায়েবারা তিন বোন যখন একটু সেয়ানা হয়ে উঠলো তিনি তাদের স্থায়ীভাবে ঢাকায় রেখে লেখাপড়া গানবাজনা ইত্যাদি শেখাবার একটা উপায় উদ্ভাবন করলেন। বিনিময় করে দিনাজপুরে যে ভূসম্পত্তিটুকু পেয়েছিলেন, তার একাংশ বিক্রি করে ঢাকা শহরে গেন্ডারিয়ায় এই ছোট্টো বাড়িটা কিনলেন। বাড়ির পেছনের খালি জায়গাটিতে দু’টি কাঠচেরাই কল বসালেন এবং ছোট্টো ছেলেটাকে তার দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন। সেই সময়ে ঢাকা শহরে জাহিদুলরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার প্রসার নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। এই রবীন্দ্র সঙ্গীতের সূত্র ধরেই জাহিদুল এবং রাশেদা খাতুনের সঙ্গে তায়েবাদের পরিচয়ের সূত্রপাত। তায়েবার মা তো জাহিদুলদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলেন। এতোদিন তিনি মনে মনে এমন সুরুচিসম্পন্ন কাউকে সন্ধান করছিলেন, যার ওপর তাঁর অবর্তমানে মেয়েদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তবোধ করতে পারবেন। একথা মানতেই হবে যে অনেকদিন পর্যন্ত জাহিদুল এবং রাশেদা খাতুনেরা সে দায়িত্ব। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছিলেন। আমি নিজের চোখেই দেখেছি রাশেদা খাতুন আপন পেটের মেয়েটির চাইতে ভোরার প্রতি অধিক যত্নআত্তি করেছেন। আর জাহিদুল প্রতিদিন তাদের খবরাখবর নিচ্ছে। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস! আজ রাশেদা খাতুন আর ভোরা পরস্পরের সতীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহিদুল ডোরাকে বিয়ে করেছে, আর জাহিদুলকে দেখিয়ে দেয়ার জন্যে রাশেদা খাতুন শশীভূষণকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে গেছেন। এই সবকিছুর জন্য কি একটা যুদ্ধই দায়ী? দেশে যদি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতো তাহলে এই জীবনগুলো কি এমনভাবে বেঁকে চুরে যেতো? কি জানি জীবন বড়ো আশ্চর্য জিনিস। জীবনের বিস্ময়ের অন্ত নেই।
এই মহিলা যার পাশে আমি বসে আছি, যার তেজোব্যঞ্জক মুখমণ্ডলে চিন্তার বড়ো বড়ো গভীর বলিরেখা পড়েছে, যাকে দেখলে সব সময় সিংহীনির কথা মনে উদয় হয়েছে, জানিনে তিনি কি ভাবছেন তিনি সারা জীবন যে সমস্ত বস্তুকে মূল্যবান মনে করে লড়াই করে এসেছেন, সেগুলো কি এখনো তাঁর মনে কাজ করে যাচ্ছে? সমস্ত জীবন ধরে যে অপার আগ্রহ নিয়ে আকাশ দেখবেন বলে অক্লান্ত জঙ্গল কাটার কাজ করেছেন, আজ সেই নীল নির্মেঘ আকাশ থেকে তাঁর মাথায় বজ্র ঝরে পড়লো। তিনি দোষ দেবেন কাকে? দায়ী করবেন কাকে? তায়েবার মার পাশাপাশি রিকশা চেপে যাচ্ছি। আমি জানি তিনি আমার কাছে কিছু জিগগেস করবেন না। আমিও কিছু জানতে চাইবে না। হঠাৎ গলায় ঘর্ঘর শব্দটি শুনতে পেলাম। ভদ্রমহিলার হাঁপানি ছিলো সেটি জাগতে চাইছে। ভদ্রমহিলা প্রাণপণ শক্তিতে ঠোঁট দুটো চেপে ধরে বললেন, এই রিকশা বাঁয়ে রাখো। এরই মধ্যে আমরা ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে এসে দাঁড়ালাম। বাড়িটার গঠনশৈলী দেখে মনে হবে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে যে ধরনের বাড়ি হতো এটি তার একটি। প্রকাণ্ড চওড়া দেয়াল। লাল ইটগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। দরোজা জানালাগুলো আকারে আয়তনে বেশ বড়োসরো। কার্ণিশের কাছে দু’তিনটে অশ্বথ গাছের চারা বেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। কতোকাল সংস্কার হয়নি কে জানে।
তায়েবার মা আমাকে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়াও আমি ভেতরে যাই। যা বলছি মনে থাকে যেনো। তোমার তো আবার অস্থির মেজাজ। একটু বুঝে শুনে। কথাবার্তা বলবে। আমার তো মনে হচ্ছে এখানে আমাকে অনেকদিন থাকতে হবে। মহিলা পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। আমার মনে হলো এই বাড়িতে এখনো সদর অন্দর মেনে চলা হয়।
একটু পর বুড়ো মতো দাড়িঅলা এক লোক এসে বললো, আপ মেরে সাথ আইয়ে। লোকটির পেছন পেছন আমি তিন তলা দালানের একটি ঘরে প্রবেশ করলাম। ছাদটি অনেক উঁচু। বিরাট বিরাট লোহার বীমের ওপর বসানো রয়েছে ছাদ। দরোজা জানালায় খুব দামী মোটা কাপড়ের পর্দা টাঙ্গানো আছে। কিন্তু সেগুলো এতো ময়লা যে দেখতে ইচ্ছে করে না। ঘরে হাল আমলের একজোড়া সোফা সেট আছে বটে। কিন্তু না থাকলেই যেনো অধিক মানানসই হতো। দেয়ালে মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ, বাগদাদ শরীফ ও আজমীর শরীফের ছবি মোটা মোটা দামী ফ্রেমে টাঙ্গানো। সোনালী অক্ষরে আরবীতে আল্লার নাম, মুহম্মদের নাম বাঁধিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া দেওবন্ধ থেকে প্রকাশিত একখানা ইসলামী ক্যালেন্ডার দেয়ালে ঝুলছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হলো আমি অন্য একটা জগতে এসে প্রবেশ করেছি। অবাক হয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছি। এই সময়ে খুবই মোলায়েম ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। তাকিয়ে দেখলাম, দোহারা চেহারার অত্যন্ত দীর্ঘকায় গৌরকান্তি এক ভদ্রলোক। মুখে অল্প অল্প দাড়ি। হঠাৎ করে দেখলে বাঙালি বলে মনে হতে চায় না। আমি উঠে দাঁড়ালাম, তিনি বললেন, বসেন বসেন, আমি তায়েবার চাচা। আমার নাম আসগর আলী শাহ্। বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকের মাতৃভাষা বাংলা নয়।
ভদ্রলোক বললেন, ভাবীর মুখে আপনার কথা শুনেছি। আপনি কেমন আছেন, তবিয়ত ভালো তো। আমি উপস্থিত মতো কিছু একটা বলে ভদ্রতা রক্ষা করলাম। তারপরে ভদ্রলোক মৃদু হাততালি দিলেন। সেই আগের লোকটি দেখা দিলো। তিনি আদেশ দিলেন, মেহমান কি লিয়ে শরবত আওর নাশতা লে আও। কিছুক্ষণ পর লোকটি খাঞ্চায় করে নাস্তা এবং শরবত নিয়ে এলো। খাঞ্চাটি রূপোর এবং ওপরে ফুলতোলা কাপড়ের ঢাকনা দেয়া, গেলাসটি মজবুত এবং কারুকাজ করা। এই বাড়িতে সব কিছুই পুরোনো। এমনকি তায়েবার চাচা যিনি আমার বিপরীতে বসে আছেন, বসনেভূষণে অপেক্ষাকৃত একালের সম্ভ্রান্ত মুসলমান ভদ্রলোক মনে হলেও কোথায় একটা এমন কিছু আছে আমার মনে হতে থাকলো ভদ্রলোকের সঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর একটা যোগ রয়েছে। ভদ্রলোক সেটা ঢেকে রাখার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। সে যা হোক, ভদ্রলোক ঢাকনা উঠিয়ে বললেন, নাস্তা নিন। আমি তো দেখে অবাক। পাঁচ ছটা বিরাট বিরাট পরোটা, আবার তার সঙ্গে পেয়ালা ভর্তি খাসির মাংস, হালুয়া, শরবত এতোসব খাবো কি করে। পেটে জায়গা থাকতে হবে তো। তাছাড়া আমি সকাল বেলা খেয়ে বেরিয়েছি। তিনি বললেন, কিছু মুখে দিয়ে দেখেন। একেবারে না করতে নেই। আমিও বুঝতে পারলাম একেবারে না খেলে তিনি অপমানিত বোধ করবেন। এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিলাম। পরোটা মাংসের স্বাদ পেয়ে মনে হলো আমি যে প্রথমে পেটে ক্ষুধা নেই মনে করেছিলাম সেটা সত্যি নয়। দেখতে দেখতে চারটা পরোটা, পেয়ালার সমস্ত মাংস খেয়ে ফেললাম। সেই লোকটি আমাকে চিলুমচিতে হাত ধুইয়ে দিলেন। আমি চামচ দিয়ে কেটে কেটে প্লেটের সব হালুয়া খেয়ে শেষ করলাম। ভদ্রলোক এক দৃষ্টে আমার খাওয়া দেখতে লাগলেন। হালুয়া খাওয়া শেষ হলে ভদ্রলোক শরবতের গেলাসটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, শরবত পান করেন। আমি ঢকঢক করে শরবতটাও খেয়ে নিলাম। ভদ্রলোক আমার খাওয়ার ধরন দেখে কিছু একটা মনে করেছেন। সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আমাকে লজ্জা থেকে উদ্ধার করার জন্যই বললেন, ভাবী বলেছেন, আপনি অনেক এলেমদার মানুষ। অনেক কেতাব লিখেছেন। তা এখন আপনাদের খবর কি? যুদ্ধ কেমন চলছে? আমি একটুখানি মুশকিলে পড়ে গেলাম। ভদ্রলোককে কি জবাব দেই। জানতে পেরেছি ভদ্রলোক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতরো বিরোধী। এই ফ্রী স্কুল এলাকাটিও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক স্থান। এখানকার কশাইরা ছেচল্লিশে হিন্দু মুসলমানের রায়টে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। এখনো ভারত পাকিস্তানে কোনো ধরনের গোলযোগ হলে এই ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে শহরের রাজপথে পাকিস্তানের সপক্ষে মিছিল বের হয়ে যায়। উনিশশো পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ সালের সেই বিখ্যাত শ্লোগানঃ কান মে বিড়ি মুমে পান, লেড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের রেশ এখানকার মানুষের মন থেকে একেবারে অবসিত হয়ে যায়নি। তথাপি ভদ্রলোককে সন্তুষ্ট করার জন্যে কিছু একটা বলতে হয়। তাই বললাম, সবটাতো আমি জানিনে তবে এটা নিশ্চিত যে একদিন আমরা জিতব। জিতবেন তো বটে, তবে আপনারা নয়, জিতবে হিন্দুস্থান এবং হিন্দুরা। আপনারা তো জানেন না, লাখো জান কোরবান করে মুসলমানেরা পাকিস্তান কায়েম করেছে। আর আপনারা সেটা ভেঙ্গে ফেলতে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক আমার হাত ধরে বললেন, একটু এদিকে আসুন। তিনি আমাকে জানালার পাশে নিয়ে গেলেন। তারপর একটা একতলা বাড়ির দিকে অঙুলি প্রসারিত করে বললেন, ওই যে দেখছেন ওটা আবদুল ওয়াহেদের বাড়ি। আবদুল ওয়াহেদ কে ছিলো জানেন? জবাবে আমি অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি অবাক হয়ে গেলেন। আপনি আবদুল ওয়াহেদের নাম শুনেননি? আমি আবার অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি দু’হাতে তালি দিলেন। সেই বুড়ো লোকটি দেখা দিলে তিনি বললেন, হান্নান সাহেবকো বোলাকে লে আও।
কিছুক্ষণ পর একজন পৌঢ় ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সালামালায়কুম দিলেন। ভদ্রলোক বেশ বুড়ো। চোখের ভূরু পর্যন্ত পেকে গেছে। শাহ আসগর আলী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আমাকেও দাঁড়াতে হলো। শাহ সাহেব বললেন, ইনি হান্নান সাহেব, আবদুল ওয়াহেদের চাচা। উনার সঙ্গে কথাবার্তা বলুন। তারপর পৌঢ় হান্নান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়ে জয় বাংলাকা আদমী হ্যায়। তাজ্জব কা বাত ইয়ে হ্যায় কভি আবদুল ওয়াহেদ কো নাম নেহি শুনা।
হান্নান সাহেবের সঙ্গে আমাকে বসিয়ে দিয়ে শাহ আসগর আলী সাহেব কাজের দোহাই দিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। হান্নান সাহেব আমার সঙ্গে বিশুদ্ধ বাংলায়। কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তিনি বলতে থাকলেন, এই কোলকাতা শহরে এক সময়ে তাঁরা মিষ্টির দোকানে বসে মিষ্টি খেতে পারতেন না। দোকানের বাইরে মুসলমানদের দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগলেন, তখনো আপনাদের জন্ম হয়নি। সে জন্য পাকিস্তান কি চীজ বুঝতে পারবেন না। আমি বিনীতভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, পাকিস্তান কি বস্তু সে বিষয়ে কিছুটা কঠিন জ্ঞান আমাদের হয়েছে। পাকিস্তানীরা তিরিশ বছর আমাদের ওপর শোষণ করেছে। বিগত পঁচিশে মার্চ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তারা আমাদের দেশের লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। স্মৃতি ভারাতুর বৃদ্ধকে যতোই বোঝাতে চেষ্টা করিনে কেন, তিনি তার স্মৃতি স্বপ্নের জগৎ থেকে এক তিলও অগ্রসর হতে রাজী নন। ফের তিনি বলে যেতে লাগলেন, জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের ডাক দিয়েছেন। কিছু কিছু এলেমদার মানুষকে সংগঠিত করবার কোনো লোক ছিলো না, আমার ভাইপো ওয়াহেদ মিয়া ছাড়া। ওই যে আপনাদের শেখ মুজিব। তিনিও তো আমার ভাইপোর পেছন পেছন ঘোরাফেরা করতেন। তখন টিঙটিঙে ছোকরা শেখ মুজিবকে চিনতো কে? ওয়াহেদের চেষ্টার ফলেই তো তিনি অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস মুসলিম লীগের সামনের কাতারের একজন নেতা বনে গেলেন। ওই যে একতলা বাড়িটা দেখছেন, ওখানে শেখ মুজিব কতোদিন কলোরাত কাটিয়েছেন। ওই বাড়িতে শুধু শেখ মুজিব কেনো, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, স্যার নাজিমুদ্দীন, আবুল হাশিম প্রমুখ মুসলিম লীগের বড়ো বড়ো নেতারা তশরিফ আনতেন। একবার তো স্বয়ং কায়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ অসুস্থ আবদুল ওয়াহেদকে দেখতে এসেছিলেন। আমি অনুভব করতে পারলাম, ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের বাসিন্দাদের চোখে এই বাড়িটা অত্যন্ত পবিত্র। কেননা এই বাড়িতে এমন একজন মানুষের জন্ম হয়েছিলো যিনি পাকিস্তান নামক একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে শ্রম, স্বপ্ন সব ব্যয় করে অকালে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি এই সমস্ত লোক এতো অনুগত, তথাপি তারা অন্যদের মতো পাকিস্তানে বসবাস করতে যাননি কেনো? সত্যিই তো এটা একটা গভীর প্রশ্ন। আমি হান্নান সাহেবকে জিগগেস করলাম, আপনারা পাকিস্তানকে এতো ভালোবাসেন, তবু বসবাস করতে পাকিস্তান যাননি কেনো? এই সময়ে তায়েবার চাচা শাহ আসগর আলী ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনিও শুনলেন প্রশ্নটা। জবাবে বললেন, হ্যাঁ এটা একটা কথার মতো কথা বটে। শুরুতে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, কোলকাতা পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত কোলকাতা তো হিন্দুস্থানের অংশ হয়ে গেলো। আমরা সাত পাঁচ পুরুষ ধরে এই কোলকাতায় মানুষ। এর বাইরে কোথাও যেতে হবে সে কথা চিন্তাও করতে পারিনি। তাছাড়া আমার মনে বরাবর একটা সন্দেহ ছিলো। পূর্বপাকিস্তানের মুসলমানেরা সত্যিকারের ইসলামী আহকাম মেনে চলে একথা বিশ্বাস করতে মন চাইতো না। আমার কিছু কিছু আত্মীয়স্বজন পূর্বপাকিস্তানে বসবাস করতে গেছেন। তাঁদের চলাফেরা দেখে মনটা দমে গিয়েছিলো। দেখে শুনে আমার ধারণা হয়েছিলো, তামাম হিন্দুস্থানের মুসলমানেরা লড়াই করে যে পাকিস্তান কায়েম করেছে এই মানুষগুলো সেই রাষ্ট্রটিকে টিকে থাকতে দেবে না। বাংলা ভাষার নামে কোনো মুসলমান এতো হল্লাচিল্লা করতে পারে, তাতো ছিলো আমার ধারণার অতীত। বলুন, এসব হিন্দুদের চক্রান্ত নয়? তখন পাকিস্তান ধ্বংসের আলামত স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম। হিজরত করতে পারতাম। কিন্তু লাভ হতো না। এখন যেমন হিন্দুস্থানে আছি তখনো হিন্দুস্থানে থাকতে হতো। আপনাদের বাংলাদেশ তো আরেকটা হিন্দুস্থান হতে যাচ্ছে, সেখানে সত্যিকার মুসলমানদের স্থান কোথায়? এঁদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। পাকিস্তান কি বস্তু বাস্তব অর্থে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ ধারণা এদের নেই। এঁরা আছেন তাঁদের স্বপ্ন এবং স্মৃতির জগতে। যেহেতু তারা মনের থেকে হিন্দুদের ঘৃণা করেন, সেজন্য তাঁদের একটা কল্পস্বর্গের প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারতীয় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ট অংশের চিন্তাভাবনা এই একই রকম। তারা ভারতে বসবাস করবেন, কিন্তু মনে মনে চাইবেন পাকিস্তানটা টিকে থাকুক। আমি ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে তায়েবার চাচার বাড়িতে এসেছি কোনো বিষয়ে বিতর্ক করার জন্য নয়। এ ব্যাপারে তায়েবার মা আমাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন। সুতরাং শাহ আসগর আলী এবং হান্নান সাহেব পাকিস্তানের পক্ষে যা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ করে শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো ছুটে পালিয়ে আসি। কিন্তু পারছিলাম না তায়েবার মার কথা ভেবে। যেখানে আমার এক দণ্ড অপেক্ষা করতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে সেই পরিবেশে এই মহিলা কি করে দিবসরজনী যাপন করছেন, সে কথা চিন্তা করে চুপ করে রইলাম। এই পুঁতিগন্ধময় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মহিলা সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে স্বেচ্ছায় এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তাঁর মনে অগাধ অটুট বিশ্বাস ছিলো। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য ভিন্ন রকমের একটা সুন্দর জীবন নির্মাণ করতে পারবেন। সামাজিক আচার সংস্কার দু’পায়ে দলে যা শ্ৰেয় উজ্জ্বল সুন্দর বলে মনে হয়েছে, সেদিকে সমস্ত কর্মশক্তিকে ধাবিত করেছেন। আজকে আবার তাঁকে সেই বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। এ যেনো বয়স্ক সন্তানের মাতৃগর্ভে ফিরে যাওয়ার মতো ব্যাপার। যে অবস্থায় তিনি এই বাড়ি এই আত্মীয়-স্বজনদের ছেড়ে গিয়েছিলেন সেই বাড়ির অবস্থা এখনও তেমনই আছে, তিল পরিমাণ পরিবর্তন হয়নি। আত্মীয় স্বজনেরা সেই স্মৃতির স্বপ্নের জগতে বসবাস করছেন। মাঝখানের তিরিশটি বছর যেনো কিছু নয়। চেষ্টা করলে তিনি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে পারতেন। এ বাড়িতে কেনো উঠলেন তা আমার বোধবুদ্ধির সম্পূর্ণ বাইরে। আমি বাইরের মানুষ। আমার কাছে এরা যেভাবে কথাবার্তা বললেন, তার মধ্যে গভীর একটা ঘৃণার রেশ রয়েছে। মহিলা কি উঠতে বসতে প্রতিনিয়ত আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হচ্ছেন না? এইসব কথা ঢেউ দিয়ে মনে বার বার জেগে উঠছিলো। তায়েবার মা আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছেন, নিশ্চয়ই তাঁর কোনো উদ্দেশ্য আছে।
অনেক কথাবার্তার পর শাহ আসগর এবং হান্নান সাহেব আমাকে রেহাই দিলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উঠে যাওয়ার সময় শাহ সাহেব বললেন, আপনি আরাম করে বসুন। ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন। ভাবী সাহেবা বোধ করি আপনার সঙ্গে কি আলাপ করবেন। উনারা চলে গেলে তায়েবার মা ঘরে প্রবেশ করেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে জিগেস করলেন, কি বাবা দানিয়েল, তোমার কি খুব খারাপ লেগেছে? এঁরা এ রকমই। সে কথা তো তোমাকে আগে বলেছি। আশা করি আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন সম্বন্ধে তোমার একটা ধারণা হয়েছে। আমি ঈষৎ হাসলাম। তিনি আমার উল্টোদিকে বসলেন। তারপর ঠোঁট ফাঁক করে একটুখানি হাসবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাসিটা ভারী মলিন দেখালো। তিনি বললেন, তোমাকে বাবা ডেকে এনেছি একটু কথাবার্তা বলার জন্য। দেখছে না চারপাশে কেমন দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। কথা না বলে না বলে ভীষণ হাঁফিয়ে উঠেছি। এভাবে কিছুদিন থাকলে আমি নিজেও অসুখে পড়ে যাবো। এখন যে এখানে সেখানে অল্প-স্বল্প হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি সেটিও আর সম্ভব হবে না। আসলে মহিলা কোন্ কথাটির অবতারণা করতে যাচ্ছেন। সেটি আমি অনুমান করতে চাইলাম। আমি জানতাম তার স্বভাব বড়ো চাপা। খুব প্রয়োজন না হলে মনের কথা কখনো মুখে প্রকাশ করবেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোলকাতা এসেছি কবে এবং চট্টগ্রামে আমার মাও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের কোনো বিপদ হয়েছে কিনা। তারপর তিনি এদিক ওদিক ভালো করে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, তায়েবার অসুখটা কি জানো? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ জানি। তিনি এ নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না। ডোরার খবরও কি পেয়েছো? আমি বললাম, হ্যাঁ পেয়েছি। মহিলা বললেন, আমার হয়েছে কি বাবা জানো চারদিক থেকে বিপদ। কাউকে কইতেও পারছিনে, আবার সইতেও পারছিনে। জাহিদুলটা এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে তা আমি কখনো বিশ্বাসই করতে পারিনি। তার সততা এবং ভালো মানুষীর ওপর আমি বড়ো বেশি নির্ভর করেছিলাম। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন। তিনি আবার জিগ্গেস করলেন, হেনার খবর শুনেছো কিছু? বললাম, হেনা ভাই সম্পর্কে আমি কিছু জানিনে। আজ সকালে হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। জানো হেনা একটা বিয়ে করে ফেলেছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এরই মধ্যে হেনা ভাই আবার বিয়ে করে ফেললেন? মনের ঝাঁঝ কথার মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়লো। চেপে রাখতে পারলাম না। আমার মনোভাব টের পেয়ে মহিলা হেনা ভাইয়ের পক্ষ সমর্থন করে বললেন, বিয়েটা করে হেনা মানুষের পরিচয় দিয়েছে। মেয়েটির স্বামীকে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। দেখাশুনা করার কেউ ছিলো না। কচি মেয়ে কোথায় যাবে? তাই বিয়ে করে এখানে নিয়ে এসেছে এবং বালুহাক্কাক লেনে আলাদা বাসা করে থাকছে। আমি মনে করি হেনা ভাই আরো কিছুকাল পর বিয়েটা করলে শোভন হতো। কি করবো ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেলে কি আর মা বাবার কথার বাধ্য থাকে! আমার হয়েছে কি বাবা জানো সমূহ বিপদ। কোথাও গিয়ে শান্তি পাইনে। মনে সর্বক্ষণ একটা উথাল পাতাল ঝড় বইছে। দু’দণ্ড স্থির হয়ে বসবো সে উপায় নেই। এরই মধ্যে আবার হাঁপানির জোরটা অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছে। আমার বড়ো মেয়েটি যে ছিলো আমার সব রকমের ভরসার স্থল, এখন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে। আমার বুকে ভীষণ ব্যথা, ভীষণ জ্বালা। কোথায় যাবো, কি করবো পথ খুঁজে পাচ্ছিনে। ভদ্রমহিলার দু’চোখ ফেটে ঝর ঝর করে পানি বেরিয়ে এলো। বুকটা কামারের হাপরের মতো ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। মাত্র অল্পক্ষণ। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা সহকারে আঁচলে চোখ মুছে নিয়ে অপেক্ষাকৃত শান্ত হয়ে বসলেন। আশ্চর্য সংযম। ভদ্রমহিলা স্বাভাবিক কণ্ঠে নিচু স্বরে বললেন, লোকে মনে করতে পারে এই ছেলেমেয়েরা আমার গর্ভের কলঙ্ক। কিন্তু মায়ের কাছে ছেলেমেয়ে তো ছেলেমেয়েই। তারা যতো ভুলই করুক আমি কিছু মনে করিনে। কথাগুলো নিজেকে না আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বললেন, বুঝতে পারলাম না।
মহিলা আমার আরো কাছে ঘেঁষে এলেন। আমার হাত দুটি ধরে বললেন, বাবা আমার একটি অনুরোধ রাখবে? আমি বললাম, বলুন। তিনি বললেন, আগে কথা দাও রাখবে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তোমার প্রতি তায়েবার একটা অন্ধ আকর্ষণ আছে। তুমি হাসপাতালে তাকে দেখতে এলে সে বড়ো খুশি হয়। তোমরাও খুব সুখে নেই জানি। তবু সময় করে যদি একটু ঘন ঘন দেখতে যাও। বলো মায়ের এই অনুরোধটা রক্ষা করবে? জবাব দিতে গিয়ে আমার চোখে পানি বেরিয়ে গেলো। তিনিও আমার মাথাটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললেন। আমরা দু’জন দু’জনকে বুঝতে পেরেছি। তবু আমি আমতা আমতা করে বললাম, কেউ যদি কিছু মনে করে। আমি হাসপাতালে যাই ওটা অনেকে সুনজরে দেখে না। কারো মনে করাকরি নিয়ে বাবা কিছু আসে যায় না। কথাবার্তা শেষ করে ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হলো মধ্যযুগীয় অন্ধকার গুহা থেকে মুক্তি পেলাম।
.
০৮.
ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে বৌ বাজারের হোস্টেলে এসে অবাক হয়ে গেলাম। ঘরের মধ্যেই মাদুর বিছিয়ে খাওয়া দাওয়া চলছে। খাসির মাংস, ভাত, ডাল সব দোকান থেকে আনা হয়েছে। খেতে বসেছেন নরেশদা, খুরশিদ, মাসুম, বিপ্লব এবং অপর একজন, যাকে আমি চিনিনে। বয়স তিরিশ টিরিশ হবে, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হবে উনি কোনো ক্যাম্প থেকে এসেছেন। খুরশিদই পরিচয় করিয়ে দিলো। ক্যাপ্টেন হাসান। মুর্শিদাবাদের লালগোলার কাছাকাছি একটি মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসে থাকবেন। উনারা খেতে বসেছেন, শেকহ্যান্ড করার উপায় ছিলো না। একটা ব্যাপার আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশ থেকে যতো মানুষ কোলকাতায় এসেছে, তাদের একটা অংশ কি করে জানিনে আমাদের এই আস্তানাটা শিগগির কি বিলম্বে চিনে ফেলেছে। আমাদের সঙ্গে কি করে জানিনে নানা জাতের, নানা পেশার অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের মধ্যে গায়ক আছে, এ্যাকটর আছে, সাংবাদিক, শিল্পী, ভবঘুরে বেকার, পেশাদার লুচ্চা, বদমায়েশ, চোরাচরও আছে। সকলের একটাই পরিচয় আমরা বাংলাদেশের মানুষ।
এই সময়ের মধ্যে আমাদের আস্তানাটির কথা গোটা কোলকাতা শহরে প্রচার হয়ে গেছে। আমরা সব ভাসমান কর্মহীন মানুষ। একে অপরকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করি। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের কাছে না যাবে তো কোথায় যাবে? তারপরেও খুরশিদের কৃতিত্বটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রায় প্রতিদিন নিত্য নতুন মানুষকে এই হোস্টেলে নিয়ে আসার কৃতিত্ব মুখ্যত খুরশিদের। সে বাইরে বড়ো গলা করে নিজেকে আওয়ামী লীগের লোক বলে ঘোষণা করে। পেছনে অবশ্য কারণও আছে। আওয়ামী লীগের ছোটো বড়ো মাঝারি নেতাদের অনেককেই খুরশিদ চেনে এবং তাঁরাও খুরশিদকে চেনেন। পারতপক্ষে তাকে তারা এড়িয়েও চলেন। তাই কার্যত খুরশিদ আমাদের ডেরায় এসে তার আওয়ামী লীগত্ব জাহির করে। আজকের ক্যাপ্টেন হাসান ভদ্রলোককেও নিশ্চয়ই খুরশিদ নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। এতোসব খাবারদাবারের আয়োজনের পয়সা এসেছে কোত্থেকে। নির্ঘাত টাকাটা ক্যাপ্টেনের পকেট থেকে গেছে এবং এতে খুরশিদের শিল্পকলার সামান্য অবদান থাকা বিচিত্র নয়।
নরেশদা বললেন, কাপড়চোপড় ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে তুইও বসে যা। যা খাবার আছে তাতে আরো দু’জনের হয়ে যাবে। আমি মুখ হাত ধুয়ে এসে খেতে বসে গেলাম। আজ খুরশিদের মেজাজটি ভয়ঙ্কর রকম উষ্ণ হয়ে আছে। এমনিতেও উত্তেজনা ছাড়া খুরশিদের জীবন ধারণ এক রকম অসম্ভব। একটা না একটা ঝগড়া বিবাদের বিষয়বস্তু খুঁজে আবিষ্কার করতে তার কোনো জুড়ি নেই। আজকে তার অসন্তোষটা অন্যান্য দিনের চাইতে পরিমাণে অনেক অধিক। আমি তাই কৌতূহলী হয়ে জিগ্গেস করলাম, খুরশিদ আজ তোমার আলোচ্য বিষয়সূচী কি? নরেশদা জবাব দিলেন, খোন্দকার মুশতাক আহমেদ। মুশতাকের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষও তোমার বিষয় হতে পারে, এতো আমি কল্পনাও করতে পারিনি। হলোই বা ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিদেশ মন্ত্রী। আমি তো তোমাকে আরো ওপরের তরিকার মানুষ বলে মনে করতাম।
আমার কথায় খুরশিদের মেজাজের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে প্রায় ধমক দেয়ার সুরে বললো, আরে মশায় শুনবেন তো। শালার বেটা শালা, নেড়িকুত্তার বাচ্চা কি কাণ্ডটা করে বসে আছে। এইখানে এই কোলকাতায় বসে বসে বেটা হেনরী কিসিঞ্জারের সঙ্গে এতোকাল যোগাযোগ করে আসছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী হিসেবে ভান করে মুক্তিসগ্রামকে পেছন থেকে ছুরিকাহত করাই ছিলো তার প্ল্যান। তলায় তলায় আমেরিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষের চেষ্টা করছিলো। শালা, মেনিবিড়াল কোথাকার। ফন্দি টন্দি এঁটে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার নাম করে ভারত থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলেই ঝুলির ভেতর থেকে সবগুলো বেড়াল বের করবে এটাই ছিলো তার ইচ্ছা। মাঝখানে ভারতের ইনটিলিজেন্স তার সমস্ত ষড়যন্ত্রের কথা উদ্ঘাটন করে ফেলেছে। তাজুদ্দিন তার নিউইয়র্কে যাওয়া আটকে দিয়েছেন। তাজুদ্দিনকে যতোই অপবাদ দিক আসলে কিন্তু মানুষটা খাঁটি। দেশের প্রতি টান আছে।
ক্যাপ্টেন হাসান হাত ধুয়ে এসে তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, তাজুদ্দিন বলুন, মুশতাক বলুন থিয়েটর রোডে যারা বসে তারা সকলে একই রকম। নিজেদের মধ্যে দলাদলি করছে, সর্বক্ষণ একজন আরেকজনকে ল্যাঙ মারার তালে আছে। দেখছেন একেকজনের চেহারার কেমন খোলতাই হয়েছে। খাচ্ছে দাচ্ছে, আমোদ-ফুর্তি করছে। সবাই তোফা আরামে আছে। যুদ্ধটা কি করে চলছে সেদিকে কারো কি কোনো খেয়াল আছে? কেউ কি কখনো একবার গিয়ে দেখেছে ক্যাম্পগুলোর কি অবস্থা? সাহেব আমরা যে অবস্থায় এখন থাকছি, বনের পশুও সে অবস্থায় পড়লে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। আমাদের বলা হয়েছে যুদ্ধ করো। কিন্তু কি দিয়ে যুদ্ধ করবে আমাদের ছেলেরা? শুধু হ্যান্ডগ্রেনেড দিয়ে কি পাকিস্তানী সৈন্যের দূরপাল্লার কামানের সঙ্গে পাল্লা দেয়া যায়? আমরা প্ল্যান করি ভারতীয়রা সে প্ল্যান নাকচ করে। নালিশ করে প্রতিকারের কথা দূরে থাকুক, কোনো উত্তর পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আমরা ছেলেদের সব জেনেশুনে প্রতিদিন আত্মহত্যা করতে পাঠাচ্ছি। একেকটা সামান্য অস্ত্র জোগাড় করতেও প্রতিদিন কত দুয়ারে ধন্না দিতে হয়। মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর দুঃখ হয়, এতো কষ্ট করে আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে কেনো মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে এখানে এলাম। ক্যাম্পে থাকলে তবু ভালো থাকি। ছেলেদের সঙ্গে এক রকম দিন কেটে যায়। কিন্তু কোলকাতা এলে মাথায় খুন চেপে বসে। ইচ্ছে জাগে এই ফর্সা কাপড় পরা তথাকথিত নেতাদের সবকটাকে গুলি করে হত্যা করি। এ্যায়সা দিন নেহি রহেগা। একদিন আমরা দেশে ফিরে যাবো। তখন এই সব কটা বানচোতকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে মারবো। দেখি কোন্ বাপ সেদিন তাদের উদ্ধার করে। কোলকাতায় নরোম বিছানায় ঘুমিয়ে পোলাও কোর্মা খাওয়ার মজা ভালো করে দেখিয়ে দেবো। ক্যাপ্টেন হাসান চেয়ারের হাতলে তোয়ালেখানা রেখে পকেট থেকে ইন্ডিয়া কিং এর প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন এবং নরেশদাকে একটা দিলেন।
থিয়েটর রোডের লোকদের বিরুদ্ধে এসব নালিশ নতুন নয়। সবাই নালিশ করে। কিন্তু তাদের করবার ক্ষমতা কততদূর তা নিয়ে কেউ বিশেষ চিন্তাভাবনা করে বলে মনে হয় না। আমি মনে মনে তাজুদ্দিনের তারিফ করি। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আমার বিশ্বাস সবদিক চিন্তা করে দেখার ক্ষমতা তাঁর আছে। কিন্তু তিনি কতোদূর কি করবেন। আওয়ামী লীগারদের মধ্যে অনেকগুলো উপদল। ভারত সরকার সবক’টা উপদলকে হাতে রাখার চেষ্টা করছে। আবার তাদের অনেকেই তাজুদ্দিনকে প্রধান মন্ত্রীত্বের আসন থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। পাকিস্তানী এবং আমেরিকান গুপ্তচরেরা এখানে ওখানে ফাঁদ পেতে রেখেছে। তাদের খপ্পরে আওয়ামী লীগারদের একটা অংশ যে পড়ছে না, একথাও সত্যি নয়। এই প্রবাসে অন্য একটি সরকারের দয়ার ওপর নির্ভর করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। ভারত সরকারের মর্জিমেজাজ যেমন মেনে চলতে হয়, তেমনি অজস্র উপদলীয় কোন্দলের মধ্যে একটা সমঝোতাও রক্ষা করতে হয়। ভারত সরকারের বিশেষজ্ঞদের আবার একেকজনের একেক মত। কেউ মনে করেন এদলকে হাতে রাখলে ভালো হবে। আবার আরেকজন মনে করেন, আখেরে এই উপদলের টিকে থাকার ক্ষমতা নেই। সুতরাং অন্য দলটিকে ট্রেনিং, অস্ত্র শস্ত্র, টাকা পয়সা দিলে উপকার হবে। দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্যুত অবস্থায় সবকটা উপদলই মনে করছে তারাই প্রকৃত ক্ষমতার দাবিদার। কোনো নেতা ক্ষমতা দাবি করছেন, কেনোনা তিনি শেখ মুজিবের আত্মীয়। আরেক নেতা ক্ষমতা দাবি করছেন, কারণ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয়-স্বজনদের দু’চোখে দেখতে পারেন না। হয়তো আরেক নেতা মনে মনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা করেন বলেই ক্ষমতা অধিকার করতে চান। ধৈর্য ধরে সবকিছু দেখে যাওয়া ছাড়া তাজুদ্দিনের আর করবার কি আছে?
সবাই মুখ হাত ধুয়ে বসে বসে পান চিবুচ্ছি। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে মাসুম ঘরে প্রবেশ করে বললো, নরেশদা, দানিয়েল ভাই শিগ্গির চলুন রেজোয়ান আত্মহত্যা করেছে। মাসুমের মুখে সংবাদটি শুনে আমরা সকলেই অভিভূত হয়ে গেলাম। দু’চারদিন আগেও আমাদের আড্ডায় এসেছিলো, সর্বক্ষণ অপরকে হাসাতো। সব সময়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নবদ্বীপ হালদারের কমিক মুখস্ত বলতো। এই যুদ্ধ, দেশত্যাগ, খুন, জখম, বীভৎসতা কিছুই যেনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, মানুষ এতো হাসে কেমন করে? স্বীকার করতে আপত্তি নেই, রেজোয়ানের প্রতি মনের কোণে একটুখানি বিদ্বেষ পুষে রাখতাম।
প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কাটি কেটে গেলে মাসুমের মুখে রেজোয়ানের আত্মহত্যার কারণটা জানতে পারলাম। কিছুদিন আগে রেজোয়ানদের আড্ডায় কুমিল্লা থেকে মজিদ বলে আরেকটি ছেলে আসে। রেজোয়ানরা থাকতো রিপন স্ট্রীটে। মজিদ আর রেজোয়ান দু’জনেই কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকার একই পাড়ার ছেলে। মজিদ কোলকাতা এসে সকলের কাছে রটিয়ে দেয় যে রেজোয়ানের যে বোনটি উম্যান্স কলেজের প্রিন্সিপাল, সে একজন পাকিস্তানী মেজরকে বিয়ে করে ফেলেছে। এই সংবাদটা পাওয়ার পর রেজোয়ান দু’দিন ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকে। কারো সঙ্গে একদম কথাবার্তা বলেনি। অনেক চেষ্টা করেও কেউ তাকে কিছু খাওয়াতে পারেনি। অবশেষে রাত্রিবেলা ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সকালে সে বিছানা ছেড়ে উঠছে না দেখে রুমের অন্যান্যরা ঘুম ভাঙ্গাতে চেষ্টা করে দেখে মরে শক্ত হয়ে গিয়েছে। আর মুখের লালা পড়ে বালিশ ভিজে গেছে। তার মাথার কাছে পাওয়া গেলো একটি চিরকুট। তাতে লিখে রেখেছে, বড়ো আপা, যাকে আমি বিশ্বাস করতাম সবচাইতে বেশি, সে একজন পাকিস্তানী মেজরের স্ত্রী হিসেবে তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোচ্ছে, একথা আমি চিন্তা করতে পারিনে। দেশে থাকলে বড়ো আপা এবং মেজরকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতাম। এখন আমি ভারতে। সুতরাং সে উপায় নেই। অথচ প্রতিশোধ স্পৃহায় আমার রক্ত এতো পাগল হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত নিজেকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই। যার আপন মায়ের পেটের বোন দেশের চরমতম দুর্দিনে, দেশের শত্রুকে বিয়ে করে তার সঙ্গে একই শয্যায় শয়ন করতে পারে তেমন ভাইয়ের বেঁচে থেকে লাভ কি? কি করে আমি দেশের মানুষের সামনে কলঙ্কিত কালো মুখ দেখাবো। আমার মতো হতভাগ্যের বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। সকলকে কষ্ট দিতে হলো বলে আমি দুঃখিত এবং সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ইতি রেজোয়ান।
শুনেই আমি, নরেশদা এবং খুরশিদ রিপন স্ট্রীটে ছুটলাম। সেখানে গিয়ে শুনি রেজোয়ানের লাশ থানায় নিয়ে গেছে। অগত্যা থানায় যেতে হলো। ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ বের করে আনতে কম হ্যাঙ্গামাহুজ্জত পোহাতে হলো না। এতে সমস্যার শেষ নয়। তারপরেও আছে কবর দেয়ার প্রশ্নটি। আমরা কোলকাতা শহরে সবাই ভাসমান মানুষ। মৃত ব্যক্তিকে এখানে কোথায় কবর দিতে হয়, কি করে কবর দিতে হয়, এসব হাজারটা কায়দাকানুনের কিছুই আমরা জানিনে। তাছাড়া আমাদের সকলের পকেট একেবারে শূণ্য। টাকা থাকলে বুকে একটা জোর থাকে। সেটাও আমাদের নেই। কি করি। আমাদের একজন ছুটলো কাকাবাবু মুজফফর আহমদের কাছে। তিনি নিজে অসুস্থ মানুষ। তাঁকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। তিনি এক সময়ে বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন, এই দাবিতে আমরা সময়ে অসময়ে তার কাছে গিয়ে হাত পেতেছি। তিনি সাধ্যমতো আমাদের দাবি পূরণ করেছেন। এই রকম একটা ব্যাপার নিয়ে তাঁকে বিব্রত করা ঠিক হবে কিনা এ নিয়ে আমাদের মনে যথেষ্ট দ্বিধা ছিলো। তবু তাঁর কাছে যেতে হলো। তিনি তাঁর পার্টির একজন মানুষকে বলে গোবরা কবরস্থানে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপরেও আমাদের টাকার প্রয়োজন। লাশকে গোসল দিতে হবে, কাফন কিনতে হবে, কবর খুঁড়তে হবে, কবরস্থানে নিয়ে যেতে হবে, জানাজা পড়াতে হবে-এসবের প্রত্যেকটির জন্য টাকার প্রয়োজন। টাকা কোথায় পাওয়া যাবে। আমাদের আরেকজন ছুটলো প্রিন্সেপ স্ট্রীটে অধ্যাপক ইউসুফ আলির কাছে। তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাহলেও আমাদের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে। ইচ্ছে করলে তিনি টাকাটা ম্যানেজ করে দিতে পারেন। আমাদের অনুমানই সত্য হলো। ইউসুফ সাহেব কাফন দাফনের টাকাটা ব্যবস্থা করলেন। ক্ষেত্র বিশেষে জীবিত মানুষের চাইতে মৃত মানুষের দাবি অধিক শক্তিশালী।
রেজোয়ানকে গোসল ইত্যাদি করিয়ে কবর দিতে দিতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। আমার ধারণা হয়েছিলো মৃত্যু আর আমাকে বিচলিত করে না। পঁচিশে মার্চের পর থেকে ভারতে আসার পূর্ব পর্যন্ত মৃত্যু তো কম দেখিনি। আমি নীলক্ষেত দেখেছি, রাজারবাগ দেখেছি, শাঁখারি বাজার দেখেছি। আমার নিজের কানের পাশ দিয়েও পাকিস্তানী সৈন্যের রাইফেলের গুলি হিস হিস করে চলে গেছে। কিন্তু রেজোয়ানের মৃত্যুটি একেবারে অন্যরকম। আমার সমস্ত সত্তার মধ্যে একটা আলোড়ন জাগিয়ে দিয়ে গেছে। যার বোন পাকিস্তানী মেজরকে বিয়ে করেছে, তাকে আত্মহত্যা করতে হয়। সেদিন আমাদের সকলের হৃদয় এমন গভীর বিষাদে ভারাক্রান্ত ছিলো যে কেউ কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি।
রেজোয়ানকে কবর দিয়ে সকলে চলে এলো। আমার সকলের সঙ্গে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। নরেশদা বললেন, কিরে দানিয়েল যাবিনে। আমি বললাম, আপনারা যান আমি পরে আসছি। সকলের অন্তঃকরণ গভীর ভাবাবেগে পরিপূর্ণ। কেউ কাউকে টেনে নিয়ে যাবার মতো অবস্থা ছিলো না। আমি রেজোয়ানের কাঁচা কবরের কাছে ছাতাধরা একটি পাথরের বেঞ্চির ওপর বসে রইলাম। চারপাশে সারি সারি কবর। গোবরা কবরস্থানে চারদিক থেকে চরাচরপ্লবী অন্ধকার নেমে আসছে। হাজার হাজার মৃত মানুষ ঘুমিয়ে আছে। আমি একা হাতের ওপর মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছি। কেবল কেয়ারটেকারের কুকুরটি অদূরে দু’পায়ের ওপর বসে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। বোধ করি ভাবছে কবরস্থানে এই ভরসন্ধ্যায় জীবিত মানুষ কেনো? মানুষের জীবন মৃত্যু এসব ছায়াবাজির খেলা বলে মনে হলো। নিজের অস্তিত্বটাও অর্থহীন প্রতীয়মান হলো। আকাশে ছায়াপথে লক্ষ লক্ষ তারা মানুষের পৃথিবীর গুরুত্ব কতোটুকু। আমার আগে পৃথিবীতে কতো মানুষ এসেছে, তারা কতো কি কাজ করেছে, চিন্তা করেছে, কতো যুদ্ধবিগ্রহ করেছে, তারপরে সকলে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। মানুষের সুখ দুঃখ, দ্বন্দ্ব বিবাদ ওই সুদূরের তারকারাজি অনাদিকাল থেকে সব কিছু মুগ্ধ চোখে দেখে আসছে। আমি যেনো মৃত মানুষদের চুপি চুপি সংলাপ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের অভিশপ্ত কামনা বাসনার ঢেউ যেনো আমার বুকে এসে আছড়ে পড়ছে। কেবল রেজোয়ানের কাঁচা কবরটির অস্তিত্ব কাটার মতো যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। ছেলেটা দুদিন আগেও আমাদের সঙ্গে হাঁটাচলা করেছে। অবিশ্রাম হেসেছে, অপরকে হাসিয়েছে। এতো সকালে তার মরার কথা নয়। বাংলাদেশের যুদ্ধটা না লাগলে হয়তো ছেলেটাকে এমন অকালে মরতে হতো না। আমার মগজের মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বদলে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের যুদ্ধটা চক্কর দিতে লাগলো। বড়ো ভাগ্যহীন এই বাঙালি মুসলমান জাতটা। আবহমানকাল থেকে তারা ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত। সেই হিন্দু আমল, বৌদ্ধ আমল, এমনকি মুসলিম আমলেও তারা ছিলো একেবারে ইতিহাসের তলায়। এই সংখ্যাগুরু মানবমণ্ডলি কখনো প্রাণশক্তির তোড়ে সামনের দিকের নির্মোক ফাটিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি। যুগের পর যুগ গেছে, তাদের বুকের ওপর দিয়ে ইতিহাসের চাকা ঘর ঘর শব্দ তুলে চলে গেছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। রেজোয়ান ছেলেটা যে অকালে মারা পড়লো তার মধ্যে ইতিহাসের দায়শোধের একটা ব্যাপার যেনো আছে।
বাঙালি মুসলমানেরাই প্রথম পাকিস্তান চেয়েছিলো। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্থান, সীমান্ত প্রদেশ কোথায়। লোকে পাকিস্তানের কথা বলতো। জিন্নাহ সাহেব বাংলার সমর্থন এবং আবেগের ওপর নির্ভর করেই তো অপর প্রদেশগুলোকে নিজের কজায় এনেছিলেন। যে বাঙালি মুসলমানদের অকুণ্ঠ আত্মদানে পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিলো, সেই পাকিস্তানই তিরিশ বছর তাদের ওপর বসে তাদের ধষর্ণ করেছে। একটা জাতি এতোবড়ো একটা ভুল করতে পারে? কোথায় জানি একটা গড়বড়, একটা গোঁজামিল আছে। আমরা সকলে সেই গোঁজামিলটাই ব্যক্তিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে অদ্যাবধি বহন করে চলেছি। পাকিস্তানের গণপরিষদে তো পূর্বপাকিস্তানের সদস্যরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাভাষার দাবিটি তো তারা সমর্থন করতে পারতেন। হলেনই বা মুসলিম লীগার। তবু তারা কি এদেশের মানুষ ছিলেন না? তাদের সাত পুরুষ বাংলার জলহাওয়াতে জীবন ধারণ করেননি? তবু কেন, বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের ছাত্র তরুণদের প্রাণ দিতে হলো? পূর্বপুরুষদের ভুল এবং ইতিহাসের তামাদি শোধ করার জন্য কি এই জাতিটির জন্ম হয়েছে?
উনিশশো আটচল্লিশ থেকে সত্তর পর্যন্ত এই জাতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। আর চূড়ান্ত মুহূর্তটিতে আমাদের সবাইকে দেশ ও গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছে। আমাদের হাতে সময় ছিলো, সুযোগ ছিলো। কোলাহল আর চিৎকার করেই আমরা সে সুযোগ এবং সময়ের অপব্যবহার করেছি। পাকিস্তানের কর্তাদের আমরা আমাদের বোকা বানাতে সুযোগ দিয়েছি। তারা সৈন্য এনে ক্যান্টনমেন্টগুলো ভরিয়ে ফেলেছে এবং সুযোগ বুঝে পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা আমাদের যুদ্ধটাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে ভারতে চলে এসেছি। হয়তো যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। তারপর কী হবে? আমাদের যুদ্ধটা ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার মন বলছে পাকিস্তান হারবে, হারতে বাধ্য। কিন্তু আমরা কি পাবো? ইতিহাসের যে গোঁজামিল, আমরা বংশপরম্পরা রক্তধারার মধ্য দিয়ে বহন করে চলেছি তার কি কোনো সমাধান হবে? কে জানে কি আছে ভবিষ্যতে।
ঢেউ দিয়ে একটা চিন্তা মনে জাগলো। যাই ঘটুক না কেন, আমার বাঙালি হওয়া ছাড়া উপায় কি? আর কি-ই বা আমি হতে পারি? দুনিয়ায় কোন জাতিটি আমাকে গ্রহণ করবে। গোরস্থানের কেয়ারটেকার এসে বললো দশটা বেজে গেছে। এখখুনি গেট বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং আমাকেও চলে আসতে হলো।
তারপরের দিন আমার পক্ষে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পয়সার ধান্ধায় কোলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি ছুটে বেড়াতে হয়েছে। তাছাড়া এক সঙ্গে আমরা অনেক মানুষ থাকি। যৌথ জীবনযাপনের নানা সমস্যা তো আছেই। আমাদের কাজ নেই, কর্ম নেই, তবু জীবন প্রতিনিয়ত সমস্যার সৃষ্টি করে যায়। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াবচসা, অভিমান এসব তো লেগেই আছে। সে সবের ফিরিস্তি দিয়ে বিশেষ লাভ হবে না।
রোববার দিনটিতে আমি সন্ধ্যের একটু আগেই হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি জমজমাট ব্যাপার। ডোরা এসেছে, দোলা এসেছে। তায়েবার মাও এসেছেন। আর তায়েবা বালিশে হেলান দিয়ে বসে অর্চনার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। আজকে তায়েবাকে খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চমৎকার একটা ধোয়া সাদা শাড়ি পরেছে। খোঁপায় বেলী ফুলের মালা জড়িয়েছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো গেন্ডারিয়ার বাড়িতে আনন্দঘন সময় কাটাচ্ছে। আমাকে প্রথম দেখতে পেলো অর্চনা। সে কলকল করে উঠলো, এই যে দানিয়েল, কাল থেকে টিকিটিরও দেখা নেই কেন। আমি হেসে বললাম, আটকে গিয়েছিলাম। তায়েবাদি হাসপাতালে, আর তুমি গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমি জিগগেস করলাম, অর্চনা তুমি কালও এসেছিলে নাকি? অর্চনাদি কালও এসেছিলেন এবং অর্ধেকদিন আমার সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন। আজকে আমার জন্য বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসেছেন। খোঁপা থেকে মালাটা খুলে হাতে নিয়ে দেখালো। কি ভালো অর্চনাদি। তার সঙ্গে কথা বললে মনটা একেবারে হাল্কা হয়ে যায়। অর্চনা কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, বাজে বকোনা তায়েবাদি, তোমার মতো এতো প্রাণখোলা মেয়ে এতোদিন হাসপাতালে পড়ে আছো এ খবর আমি আগে পাইনি কেন? দু’মহিলার এই পারস্পরিক প্রশস্তি বিনিময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। তায়েবার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাবা দানিয়েল, কাল কি তোমার কোনো অসুখবিসুখ হয়েছিলো। তোমাকে খুব দুর্বল এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, না আমি সুস্থই ছিলাম। তাহলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো। মা, তুমি যেনো একটা কি। মনে করতে চেষ্টা করো, তাঁকে কখন তুমি সুস্থ মানুষের মতো দেখেছিলে। সব সময় তো একই রকম দেখে আসছি। গোসল করবে না, জামাকাপড় পরিষ্কার রাখবে না, দাড়ি কাটবে না–আর এমন একটা মেক আপ করে থাকবেন, দেখলে মনে হবে রোগি অথবা সাতজন পাঁচজনে ধরে কিলিয়েছে। কথা বলা অবান্তর। এই নালিশটি তায়েবা আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই করে আসছে। তায়েবার কথা শুনে ডোরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। ডোরার এই হাসিটিও আমার পরিচিত। গেন্ডারিয়ার বাসায় তায়েবা অপরিচ্ছন্ন থাকার অনুযোগ করলেই ডোরা এমন করে হেসে উঠতো। আশ্চর্য ডোরা আজও তেমন করে নির্মলভাবে হাসতে পারে? নানা অঘটন ঘটে যাচ্ছে। তবু মনে হচ্ছে সকলে ঠিক আগের মতোই আছে। কিন্তু আমি একা বদলে যাচ্ছি কেন? বোধ করি মানুষের ভালো মন্দ সব কিছুর বিচারক সেজে বসি বলেই কি আমার এ দুরাবস্থা। মানুষের কৃতকর্মের বিচারক সেজে বসার আমার কি অধিকার? তায়েবার মা কথা বললেন, কি বাবা হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? ডোরা ফোড়ন কেটে বললো, একটুখানি গম্ভীর না দেখালে লোকে ইন্টেলেকচুয়াল বলবে কি করে? কথাটা তায়েবার, ডোরা ধার করে বললো। কোলকাতা এসে দেখেছি ডোরার মুখ খুলে গেছে। সে কায়দা করে কথা বলতে শিখে গেছে। এবার দোলা মুখ খুললো। বেচারিকে তোমরা খেপাচ্ছো কেন? আসলে দানিয়েল ভাই খুব সরল-সহজ ভালো মানুষ। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় নাক সিধে চলেন, ডানে বামে তাকান না। তার দোষ ঐ একটাই, তিনি রসিকতা বোঝেন না। আজকে হাসপাতালে এসে আমার একটা ভিন্নরকম ধারণা হলো। এতোদিন মনে করে এসেছি এরা তায়েবার এই ভয়ঙ্কর অসুখটিকে কোনো রকম গুরুত্ব না দিয়ে সবাই নিজের নিজের তালে আছে। আজকে মনে হলো, সবাই তায়েবাকে তার মারাত্মক অসুখটির কথা ভুলিয়ে রাখার জন্যই এমন হাসিখুশি এমন খোশগল্প করে। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে উঠলো। আমিই তো প্রথম থেকে তায়েবাকে তার একান্ত ব্যথার জায়গাটিতে আঘাত করে আসছি। হাবে ভাবে আচার আচরণে তায়েবাকে তার ভাই বোন আত্মীয় স্বজন থেকে আলাদা করে ফেলার একটা উগ্র আকাক্ষার প্রকাশ ক্রমাগত দেখিয়ে এসেছি। এটা কেমন করে ঘটলো? তায়েবার ওপর আমার কি দাবি? যদি বলি তায়েবাকে আমি প্রাণের গভীর থেকে ভালোবাসি। তাহলে ভালোবাসার এমন উদ্ভট দাবি কেমন করে হতে পারে যে আমি তাকে তার ডাল মূল থেকে আলাদা করতে চাইবো। আমি নিশ্চিত জানি সে মারা যাবেই। প্রতিদিন একটু একটু করে তার জীবনপ্রদীপের তেল শুকিয়ে আসছে। তথাপি আমার মনের অনুক্ত আকাক্ষা এই মৃত্যু পথযাত্রী তায়েবার সবটুকুকে আমি অধিকার করে ফেলবো। পারলে তার স্মৃতি থেকেও নিকটজনের নামনিশানা মুছে ফেলবো। নিজের মনেরে ভেতর জমাটবাঁধা একটা ঈর্ষার পিণ্ড যেনো দুলে উঠলো। এই প্রথম অনুভব করলাম, আমি একটা পশু, একটা দানব। যা পেতে চাই সব কিছু ভেঙ্গে চুরে ছত্রখান করে গুঁড়িয়ে পেতে চাই। অথচ মনে মনে একটা ভালো মানুষীর আত্মপ্রসাদ অনুভব করে দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে আসামী বানিয়ে বিচারক সেজে বসে আছি। সেই সন্ধ্যেয় হাসপাতালে আমার মনের এই কুৎসিত দিকটির পরিচয় পেয়ে ক্রমশ নিজের মধ্যেই কুঁকড়ে যেতে থাকলাম। স্বাভাবিকভাবে কোনো কথাবার্তা বলতে পারছিলাম না।
হাসপাতালের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠলো। অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তায়েবাদি আজ আসি। শিগগির আবার আসবো। সে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, শোনো দানিয়েল, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। থাক্ ভালোই হলো, কথাটা মনে পড়লো। পারলে এরই মধ্যে একবার সময় করে আমাদের বাড়িতে আসবে, একটা জরুরী ব্যাপার আছে। জরুরী ব্যাপারের কথা শুনে আমি অর্চনার পিছু পিছু করিডোর পর্যন্ত এলাম। জানতে চাইলাম, আসলে ব্যাপারটা কি? অর্চনা বললো, জানো আমার এক দূর সম্পর্কীয় দাদা এসেছেন ফ্রান্স থেকে। তিনি এক সময়ে অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর নেতাজী সুভাষ বোসের সঙ্গে আজাদ হিন্দুফৌজে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা অনেকদিন তার কোনো সংবাদ পাইনি। অনেক বছর পরে জানতে পারলাম, তিনি ফ্রান্সে চলে গিয়েছেন এবং এক ফরাসী মহিলাকে বিয়ে করেছেন। আমরা তো তাঁর। কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি তো তাকে কোনোদিন চোখেও দেখিনি। হঠাৎ করে গত সপ্তাহে তিনি আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বাড়ির লোকজন কলিযুগেও এমন আশ্চর্য কাণ্ড ঘটতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে। তিনি সংবাদপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ পাঠ করে আর টেলিভিশন রিপোর্ট দেখে সোজা কোলকাতা চলে এসেছেন। একেই বলে বিপ্লবী। তিনি এখন আমাদের বাড়িতেই আছেন। তুমি একদিন আসবে। তোমার সঙ্গে কথা বললে দাদা ভীষণ খুশি হবেন । অর্চনা চলে গেলো।
অর্চনাকে বিদায় করে তায়েবার কেবিনে ঢুকে দেখি জাহিদুল এবং হেনা ভাই দু’জন এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে সহজভাবে কথাবার্তা বলতে পারলাম। আমি নিজের ভেতরে সহজ হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছি বলেই যেনো চারপাশের জগতটা আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে। দোলা, ডোরা এবং তায়েবার মা উনারাও উঠে দাঁড়ালেন। দোলাকে যেতে হবে ধর্মতলা। সেখান থেকে অন্য মেয়েদের সঙ্গে দমদম তার ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে। ডোরা, জাহিদুলের সঙ্গে কোনো বাড়িতে গান গাইতে যাবে। আর মাকে হেনা ভাই ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে রেখে তারপর নিজের ডেরায় চলে যাবেন। আমি নিজে খুব অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। সকলে গেলো, অথচ আমি রয়ে গেলাম। ভাবলাম, চলেই যাই। কিন্তু তায়েবাকে বলা হয়নি। কথাটা কিভাবে তাকে বলবো, চিন্তা করছিলাম। কেবিনে আর কেউ নেই। উৎপলাকে বোধ হয় অন্য কোথায় শিফট করা হয়েছে। মাঝখানে শুনছিলাম, তার অসুখটির খুব বাড়াবাড়ি চলছে। জিগগেস করতে ইচ্ছে হয়নি। পাছে একটা খারাপ জবাব শুনি। তায়েবাই নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথম কথা বললো। আচ্ছা দানিয়েল ভাই, একটা কথা জিগগেস করি। আমি বললাম, বলো। আপনি এতো অপরিষ্কার থাকেন কেন? এটা বহু পুরোনো কথা। সুতরাং জবাব দিলাম না। সে বললো, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন ঝটার শলার মতো দাড়িগুলো কি রকম খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে। এভাবে গালভর্তি বিশ্রী দাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করতে আপনার লজ্জা লাগে না। চুপ করে রইলাম। আজকাল ওর কথার পিঠে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি। কি চুপ করে রইলেন যে, কথা বলছেন না কেন। তার কথার মধ্যে দিয়ে আঁঝ বেরিয়ে এলো। অগত্যা আমি বললাম, তায়েবা, লজ্জাবোধ সকলের সমান নয়।
সে বিছানা থেকে সটান সোজা হয়ে বসলো। আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে বললো, আপনি আমাকে খুব সোজা মেয়ে পেয়েছেন তাই না, সব সময় যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেন। অর্চনাদির মতো কোনো শক্ত মহিলার পাল্লায় পড়লে দু’দিনে আপনার মাথার ভূত ঝেটিয়ে একেবারে সিধে করে দিতো। আমি আর কদিন। আল্লার কাছে মুনাজাত করি অর্চনাদির মতো কোনো শক্ত মহিলার সঙ্গে যেনো সারা জীবন আপনাকে ঘর করে কাটাতে হয়। তায়েবা ঠাট্টাচ্ছলে কথাগুলো বললো বটে, কিন্তু আমি সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। সে অর্চনাকে নিয়ে কি অন্য রকম একটা ভাবনা ভাবতে আরম্ভ করেছে? আমি বললাম, এর মধ্যে অর্চনার কথা আসবে কেন? তার সঙ্গে আগে যোগাযোগ ছিলো, কিন্তু চাক্ষুস পরিচয় তো এই কদিনের। তায়েবা বললো, অর্চনাদির কথা বললে আপনি অতো আঁতকে উঠেন কেন? তার কথা আমি বার বার বলবো। একশো বার বলবো। অত্যন্ত ভালো মেয়ে। আমার ভীষণ মনে ধরেছে।
আমি উসখুস করছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে, শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। তারপরেও হাসপাতালে যদি থাকি কেউ কিছু বলতে পারে। এখানকার নিয়মকানুন বড়ো কড়া। কি কারণে বলতে পারবো না, আমি চলে আসতে চাই, একথাটা তায়েবাকে বলতে পারছিলাম না। কোথায় একটা সংকোচ বোধ করছিলাম। এই দোদুল্যমানতা কাটাবার জন্য একটা চারমিনার ধরাবো স্থির করলাম। কেবিনের বাইরে পা দিতেই তায়েবা অনুচ্চস্বরে বললো, কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম, একটা সিগারেট খেয়ে আসতে যাচ্ছি। বাইরে যেতে হবে না। এখানে ওই উৎপলার বেডে বসে খান। আমি ইতস্তত করছিলাম। তায়েবা বললো, আপনার ভয় নেই। মনের সুখে সিগারেট খেতে পারেন। ডাঃ ভট্টাচার্য আজ কোলকাতার বাইরে গেছেন। থাকার মধ্যে আছেন মাইতিদা, তাঁকে আমি সামাল দেবো। আমি সত্যি সত্যি উৎপলার বেডে বসে একট সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। সে বললো, বুঝলেন দানিয়েল ভাই, তাড়াতাড়ি চলে যাবেন না। আজকে আপনার সঙ্গে অনেক্ষণ গল্প করে কাটাবো। হোস্টেলে এক ভদ্রলোককে নয়টার সময় আসতে বলেছি। তার সঙ্গে আমার টাকা-পয়সার একটা ব্যাপার আছে। এসে যদি ভদ্রলোক ফেরত যান, আবার কবে দেখা হয় বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রয়োজনটা আমার। আমারই প্রয়োজনে ভদ্রলোককে আমি অনুরোধ করেছি আসতে। তাই মনে মনে একটুখানি দমে গেলাম। তায়েবা সেটা বুঝতে পারলো। কি, আপনার সঙ্গে গল্প করতে চাই সেটি বুঝি পছন্দ হলো না। পছন্দ না হয় তো চলে যান। আমি আপনাকে আটকে রাখিনি। আমি তো অর্চনাদি নই যে জরুরী প্রয়োজনে আপনাকে নির্দেশ দিতে পারি।
আমি সিগারেটটা ফেলে দিয়ে টুলটা টেনে তার বিছানার পাশে এসে বসলাম। বললাম, ঠিক আছে গল্প করো আমি আছি। কতোক্ষণ থাকবেন? আমি বললাম, যতোক্ষণ গল্প করো। আমি সারারাত গল্প করতে চাই, সারারাত আপনি থাকবেন? সারারাত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থাকতে দেবে? সে মাথার বেণীটি দুলিয়ে বললো, সে দায়িত্ব আমার। এবার সে সত্যি সত্যি রহস্যময়ী হয়ে উঠলো। জানেন দানিয়েল ভাই, আপনার সঙ্গে কথা বলতে ঘেন্না হয়, আপনি এতো বিষণ্ণ এবং অপরিষ্কার থাকেন। মাঝে মাঝে তো বমি বেরিয়ে আসতে চায়। এটাতো ভূমিকা মাত্র। আসলে তায়েবা গোটা রাত কিসের গল্প করতে চায়, সেটা আমাকে ভয়ানক কৌতূহলী করে তুললো। আমি ভুলে গেলাম যে সে একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগী। সে যেমন করে হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে বসেছিলো, তেমনি হঠাৎ আবার বিছানার ওপর নেতিয়ে পড়লো। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে লাগলো। আমি কেমন যেনো ভয় পেয়ে গেলাম। এই অবস্থায় কি করি। ডঃ মাইতিকে ডাকবো কিনা চিন্তা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর তার শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়ে এলো। চোখ মেলে আমার দিকে তাকালো। আহ্ দানিয়েল ভাই। আপনি আরেকটু এগিয়ে এই আমার মাথার কাছটাতে বসুন এবং হাতখানা দিন। ডান হাতখানা এগিয়ে দিলে দু’হাতে মুঠি করে ধরে দু’তিন মিনিট চুপ করে রইলো। স্বপ্নের মধ্যে কথা বলছে এমনি ফিস ফিস করে বললো, জানেন এবার আমি সাতাশে পা দিয়েছি। রাঙ্গা আমার দু’বছরের ছোটো। তার একটি মেয়ে আছে। গোলগাল পুতুলের মতো। আঃ কি সুন্দর! দেখলে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। রাঙ্গার বয়সে বিয়ে হলে এতোদিনে আমারও ছেলেমেয়ে থাকতো। গোটা জীবনটা কি করে কাটালাম, ভাবলে দুঃখে বুক ফেটে যেতে চায়। তায়েবার এসমস্ত কথার প্রত্যুত্তর আমার জানা নেই। বুকটা ভারাক্রান্ত হয়ে আসছিলো। বহু কষ্টে চোখের পানি চেপে রাখলাম। কিছু বললাম না। তায়েবা বলে যাক যা মন চায়। তার প্রাণ পাতালের তলা থেকে যদি অবরুদ্ধে কামনা বাসনার স্ফুলিঙ্গগুলো বেরিয়ে আসতে চায়, আসুক। এতোকাল মনে হয়েছিলো তায়েবা ঠিক মানবী নয়। সাধারণ মেয়েদের মতো সে কামনা বাসনার ক্রীতদাসী নয়। অন্য রকম। আজ এই সন্ধ্যেয় ওপরের নির্মোক বিদীর্ণ করে তার অন্তরালবর্তী নারী পরিচয় এমন স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হতে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। আমি তার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। দানিয়েল ভাই, আমার সারা শরীরে প্রচণ্ড আগুনের তাপ। আমি জ্বলে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি। আর বুকে কি ভয়াবহ তৃষ্ণা, মনে হয় সমুদ্র শুষে নিতে পারি। তৃষ্ণা, তৃষ্ণা, তৃষ্ণার তাপে আমি জ্বলে পুড়ে মরছি। আর বেশিদিন নয়, শিগগিরই আমি মারা যাবো। তারপর সবকিছুর শেষ হবে! ও মা! আপনি অতো দূরে কেনো? কাছে আসুন, আপনি এত লাজুক এবং ভীতু কেনো? কই আপনার হাত দুটি কোথায়? সে আমার দু’হাত টেনে নিয়ে বুকের ওপর রাখলো। স্তন দুটি কবুতরের ছানার মতো গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমার বুকের মধ্যে যেমন একটা ভূমিকম্প হচ্ছিলো, তেমনি একটা পুলকপ্ৰবাহও রি রি করে সমস্ত লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় কাঁপছিলো। এই নারী, এতোকাল যাকে মনে করে আসছি ধরাছোঁয়ার বাইরে, সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধির অতীত, কতো সহজে আমার কাছে নিজেকে উন্মোচন করেছে। মুসা নীলনদের তল দেখেও কি এতোটা পবিত্র পুলকে শিউরে শিউরে উঠেছিলেন? দানিয়েল ভাই শব্দটা বাদ দিয়ে শুধু আমার নামটা ধরে ডাকলো। জানো তোমাকে ভালোবাসি। এতোদিন বলিনি কেনো জানো? আমি অনেকদিন আগে থেকে, এমনকি তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পূর্ব থেকেই আমার অসুখটার কথা জানতাম। আমার ভয় ছিলো, জানালে কেটে পড়বে। আর তোমাকে ভালোবাসি একথা জানাতে পারিনি, একটা কারণে পাছে তুমি মনে করো, আমি প্রতারিত করেছি। এ দোটানার মধ্যে বহু কষ্টে আমার জীবন কেটেছে। আজকে আমার কোনো দ্বিধা কোনো সংশয় নেই। দুনিয়া শুদ্ধ মানুষের সামনে বলতে পারি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আজ আমার কোনো ভয়, কোনো ডর নেই। আমার ভেতর বাইরে এক হয়ে গেছে। আজ কোনো দ্বিধা, কোনো সংশয় নেই। আহঃ তোমাকে আমি দেখতে পারছিনে! ওইখানে যেয়ে একটু আলোর কাছে বসো। ভালো করে দেখি। আমি আলোর কাছে সরে বসলাম। আহঃ চুলে পাক ধরতে আরম্ভ করেছে! মনে আছে, যেদিন প্রথম আমাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলে গায়ে একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ছিলো। বুকের কাছটিতে রঙ লেগে লাল হয়ে গিয়েছিলো। মনে হয় গতোকাল এঘটনা ঘটে গেছে।
জুতো মচমচিয়ে ডঃ মাইতি কেবিনে প্রবেশ করলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরে দানিয়েল সাহেব যে। আসুন আপনার হেন্ডসেক করি। আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। করমর্দনের পালা সাঙ্গ হলে ডঃ মাইতি বললেন, এবার দানিয়েল সাহেব আপনাকে একটা কৈফিয়ত দিতে হবে। আমি বললাম, কিসের কৈফিয়ত ডঃ মাইতি। আপনার তো থাকার কথা নয়, হাসপাতালে ছ’টার পরে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। এখন আটটা বেজে তিরিশ মিনিট। মাইতিদা উনি চলে যেতে চেয়েছিলেন, আমি এক রকম জোর করেই রেখে দিয়েছি। জবাব দিলো তায়েবা। ভালো করোনি। এখানকার একটা ডিসিপ্লিন তো আছে। সেটা যদি জোর করে ভেঙ্গে ফেলো আমরা টলারেট করবো কেনো? তায়েবা ডঃ মাইতির কথায় কোনো জবাব না দিয়ে বললো, ঠিক আছে দানিয়েল ভাই, চলে যান। আমিও চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম। এমন সময় ডঃ মাইতি তায়েবার হাত ধরে হো হো করে হেসে উঠলেন। দিদি তোমার আচ্ছা রাগ তো। এটা যে হাসপাতাল, বাড়ি নয়। সে কথা তোমাকে কেমন করে বোঝাই । ঠিক আছে, সাহেব আর দশ মিনিট বসুন। বিছানার একপাশে বসলাম। এখনো তায়েবার রাগ কমেনি। দানিয়েল সাহেব আপনি কেমন আছেন? আমি বললাম, ভালো। সে রাতের পর আপনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মাঝে মধ্যে সময় হলে গরীবের দরোজায় একটু টোকা দেবেন। সে রাতের পর থেকে কেন জানিনে আমি ডঃ মাইতির মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কেমন ভয় ভয় করে। তায়েবা বললো, কালকে আসবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমাকে হাসপাতাল থেকে চলে আসতে হলো।