০৭-৮. আজ দেওয়ালি

আজ দেওয়ালি।

চারণ, দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা আর গঙ্গার সঙ্গমস্থলের সোজা উপরে কালো পাথরের মধ্যে খোদিত যে সব আশ্রয়স্থল আছে, যাদের দূর থেকে বৌদ্ধ গুম্ফার মতন দেখায়, তারই একটিতে বসে ছিল। বেশ ঠাণ্ডা। আর তেমনই হাওয়া। নানা মন্দির থেকে ঘণ্টাধ্বনি, মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে। প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বলছে দিকে দিকে। হাওয়াতে তাদের শিখা সতত আন্দোলিত।

স্থানভেদেও শিশু ও কিশোরদের স্বভাবের কোনও তারতম্য হয় না। তারা পটকা ফাটাচ্ছে। তারাবাজি। রংমশাল। তবে সামান্যই। মেয়েরা সুন্দর আবরণে আভরণে সেজেছে। রাতভর পুজো হবে ঘরে ঘরে। মন্দিরে মন্দিরেও।

আজকে চন্দ্রবদনীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল চারণের হৃষীকেশ-এ। মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন গড়ে তুলেছিল তাকে নিয়ে। জানে না, সত্যি সত্যি দেখা হলে, আলাপিত হলে, তারপর কেমন লাগত। তবে একটা কথা ঠিক যে, চারণ যে পাটনের সঙ্গে ত্রিবেণী ঘাটে, ভীমগিরি ও ধিয়ানগিরির সঙ্গ ছেড়ে এমন না বলেকয়ে হৃষীকেশ ছেড়ে চলে আসতে পেরেছে, এই মস্ত কথা। এতবছর কলকাতাতে শত বন্ধনের মধ্যে অজানিতেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। কোনও বাঁধনই যে ছিন্ন করা যাবে আদৌ, তা ভাবার মতন সাহস পর্যন্ত ছিল না ওর। অথচ দিব্যি তো পারছে।

ভীমগির, ধিয়ানগিরি, মাদ্রী এবং অদেখা চন্দ্রবদনীদের নিয়ে হৃষীকেশে এই নতুন করে বিনিসুতোর সংসার পাততে পাততেও যে সদ্য-নামানো শিকড় উপড়ে নিয়ে এমন করে চলে আসতে পেরেছে তাতে ওর ভেতরের ছেড়ে-আসার ক্ষমতা সম্বন্ধে ও ক্রমশই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। এবারে ও পারবে। আগুন যেমন হাতে একটু একটু করে সওয়াতে হয়, অভ্যেস এবং অনুষঙ্গ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতেও বোধহয় তেমনই একটু একটু করে নিজেকে অভ্যস্ত করতে হয়। একটু সইতে সইতেই অনেক সয়।

কোথায় কতদুরে পড়ে রইল কলকাতার উচ্চকিত, তারস্বরে টিভি ও রেডিও চালানো, মিউজিক সিস্টেমস-এর গগন-নিনাদি শব্দময় জগৎ। ট্রামবাস, মিনিবাস, অকারণে হর্ন বাজানো সারি-সারি গাড়ি। আর কোথায় এসে পৌঁছেছে সে! সিনিবালি অমাবস্যার অন্ধকারের মধ্যে বহু নীচ দিয়ে তীব্র বেগে বয়ে-যাওয়া গঙ্গা আর অলকানন্দার ঝরঝরানি আর সঙ্গমের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সাধু সন্নিসীদের অস্ফুট মন্ত্রোচ্চারণ, ঘণ্টাধ্বনি, নারী ও শিশু কণ্ঠের নিক্কণ।

এক অবিশ্বাস্য, অনাবিল, নতুন জগৎ। চারণ ভাবছিল, এইরকম সব জায়গাতেই প্রাচীন ভারতবৰ্ষর অবস্থান, হিন্দু ভারতবর্ষ। ঈশ্বর-বিশ্বাসী। একশভাগ দিশি। ভারতীয় সংস্কৃতি ও সংস্কৃত ভাষাতে ঋব্ধ কিছু ভারতবাসীর বাস এখানে। এখানে হাফ-গেরস্তর মতন পণ্ডিতম্মন্য হাফ-আঁতেলদের ভিড় নেই। মিডিয়ারও কোনও ভূমিকা নেই। এখানের ভারতবর্ষ তার নিজের আত্মিক জোরে, নিজের মধ্যের উৎসারিত জ্ঞানগম্যি নিয়ে, ধ্যান-ধারণা নিয়ে, মহানন্দে ঈশ্বর-ভজনা করে কালাতিপাত করে। কোনওরকম ঐহিক ও জাগতিক বাসনা কামনাই নেই এখানে বাস করা মানুষদের। দিনান্তে দুমুঠো জুটবে কি জুটবে না, সেই চিন্তাও নেই।

আনন্দের এবং সুখের সংজ্ঞাই যেন চারণের কাছে পুরোপুরি পালটে যাচ্ছে। তবে সবই কি আর অনাবিল? সাদা থাকলে কালো থাকবেই। আর কালো না থাকলে সাদার ভূমিকাই বা পরিস্ফুট হবে কী করে! এই তো কীওয়োস্কিওরা (chiaroscuro) রেমব্রান্ট-এর জমিদারি।

গতকাল পাটনের গুরুর আশ্রমে বসেছিল সে এই সময়েই। আশ্রমটি দেবপ্রয়াগের ওপারে তো বটেই, অলকানন্দারও ওপারে। পুরনো পায়ে-চলা যে পাথুরে পথটি আছে ভিয়াসি থেকে দেবপ্রয়াগের, তারই পাশে পাহাড়ের উপরের এক কন্দরের অভ্যন্তরে সেই আশ্রম। সেই কন্দরের চাতাল থেকে পুরো দেবপ্রয়াগ, অলকানন্দা, গঙ্গা এবং সঙ্গমও ছবির মতন দেখা যায়। অলকানন্দার উপরের একটি সরু ঝুলোনো সেতু পেরিয়ে আসতে হয় দেবপ্রয়াগে ওদিক থেকে। এদিকটা আজকাল শান্ত। কারণ, একেবারেই জনমানবহীন। পাহাড়ের মধ্যে মধ্যে যেসব গ্রাম আছে সেইসব গ্রামের দুএকজন মানুষ ছাড়া বড় কেউই ঐ পথ আর ব্যবহার করে না। আশ্রমের উপযুক্ততম জায়গা। তবে আজ দিওয়ালি তাই ঘোর কমলা-রঙা সিঁদুর পরে রং-চঙে নতুন শাড়ি পরে পেতলের এবং সোনার গয়না পরে ফসা ও দোহারা গাড়োয়ালি মেয়েরা চারদিক থেকেই পায়ে হেঁটে আসছে দেবপ্রয়াগে। কেউ কেউ হয়তো থেকেও যাবে। কেউ কেউ কলকল করে কথা বলতে বলতে নিস্তব্ধ পাহাড় নদী আর গাছ-গাছালিকে চমকে দিয়ে, হ্যাজাক অথবা টর্চ-এর আলোতে আলো-ছায়ায় হেয়ালি সৃষ্টি করে নদীর পাশের সুউচ্চ পাহাড়ি পথে ফিরে যাবে যে যার গ্রামে।

তবে সন্ধের পরে নানারকম দেহধারী ও বিদেহীদের ভয়ে কেউই বড় একটা ঘরের বাইরে যায় না এসব অঞ্চলে। বহু যুগের সংস্কার। তবে আজ দিওয়ালি। আজ সব সংস্কার এবং ভয়েরও বোধহয় ছুটি।

পাটনের গুরুর আসল নাম ভোলানন্দ। ওঁর সঙ্গে কিন্তু ভোলানন্দগিরি মহারাজের কোনও সম্পর্ক নেই। ওঁর, মানে, ভোলানন্দজির কোনও গুরু আদৌ ছিল না কি না তাও জানে না চারণ। হয়তো পাটনও জানে না। শিষ্য তো নেইই! চামচেগিরিতে ওর বিশ্বাস নেই। অনেকেই আকৃষ্ট হয়ে আসে ওঁর কাছে। আবার চলেও যায়। কেন যে আকৃষ্ট হয়, তা ওঁকে না দেখলে, ওঁর সঙ্গে কথা না বললে, কেউই বুঝবেন না। নইলে পাটনের মতো রাবণ বধ হয়ে যায় ওঁর হাতে!

ওঁর ব্যবহার একেবারেই সাধু-সন্নিসীর মতন নয়। সত্যিই মুখখিস্তিও করেন। তবে অত্যন্ত উচ্চস্তরের সাধক যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভোলানন্দ কারওকে আসতেও বলেন না, যেতেও বলেন না।

মাধুকরী করে খাওয়া কাকে বলে, তা ওই সাধুকে না দেখলে চারণ জানতেও পারত না।

 এই তিন-চারদিনেই চারণ তাঁর পাণ্ডিত্যে এবং নিরভিমান সাধারণ মানুষের মতন ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে। তবে কথা বড় একটা বলেন না। সপ্তাহের মধ্যে পাঁচদিন মৌনী থাকেন। যে দুদিন কথাবার্তা বলেন, সেই দুদিন অবশ্য সাধারণ মানুষের মতনই বলেন। জিজ্ঞাসুদের প্রশ্নর জবাব দেন।

তবে ইনকামট্যান্সের ঝামেলা মিটবে কি না? সন্তান হবে কি না? ভায়ের সঙ্গে মামলাতে হার হবে না জিত? নির্বাচনে জিতবেন কি না, এই সব প্রার্থী এবং প্রশ্নকারীর ঢোকা বারণ আছে তাঁর এই আগলহীন ছোট্ট আশ্রমে। কেউ উদ্দেশ্য ভাঁড়িয়ে ঢুকে যদি পড়েনও তবেও তাঁর মুখের তোড়ে কুটোর মতন ভেসে যান নিজেদের মান-সম্মান নিয়ে। যার যত পয়সা তার মান তো তত বেশি। অন্তত তাঁদের নিজেদের কাছে!

মৌনী থাকাটা বোধহয় সকলের পক্ষেই ভাল। আত্মা তাতে শান্ত হয়। চিন্তার ক্ষমতা বাড়ে। সমুদ্রে দিশেহারা নাবিকের মতন যখন অবস্থা হয়, চারণেরই মতন অনেকই গৃহীর, তা তার স্ত্রী-পুত্র থাক আর নাই-ই থাক, তখন To correct his own bearingsসঠিক দিক নির্ণয়ের জন্যে মৌনতা অবশ্যই ওষুধের মতন কাজ করে। করে যে, তা চারণ দেবপ্রয়াগে আসার পরে এই তিনদিনেই বুঝতে পারছে।

চারণ যেখানে বসেছিল সেখান থেকে ভোলানন্দ মহারাজের আশ্রমটি দেখা যায় না। আশ্রমের সামনে ঘন রডোডেনড্রনের ঝোঁপ আছে আর বড় বড় হর্স চেস্টনাট গাছের সারি। আরও নানা গাছের জটলা আছে। সিলভার-ওক। কিছু প্রাচীন ওক গাছও আছে। অনেক শীতবসন্তর সাক্ষী। বার্চ। অর্কিড ঝোলে অনেক গাছে গাছে। কী কী অর্কিড আছে এখানে তার সন্ধান করতে বেরোবে একদিন। চারণ ঠিক করেছে।

আশ্রমটিকে ও এখন যেখানে বসে আছে, সেখান থেকে দেখা যায় না, কারণ, মানুষের চোখের দৃষ্টি শুধু সোজাই যায়, ট্যানজেন্ট-এ যাবার ক্ষমতা নেই তার। অথচ আশ্রমের সামনের চাতালে বসে পুরো দেবপ্রয়াগকেই ছবির মতন দেখা যায় দিনে এবং রাতেও।

কথা না বলার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথের একটি লেখার কথা মনে পড়ে গেল চারণের। মাদ্রাজের আদিয়ার থেকে সাবিত্রী দেবীকে (কৃষ্ণান) সংগ্রহ করে নিয়ে আসার আগে শ্রীঅরবিন্দর কাছে গেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ফিরে এসে, পুত্রবধু মীরাদেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন :

ঠিক করেছি এখন থেকে দীর্ঘকাল প্রচ্ছন্ন থাকব। কারও সঙ্গে কোনো কারণেই দেখা করব। কেবল বুধবার দিনে নিজেকে প্রকাশ করা যাবে। আত্মীয়দের চিঠি ছাড়া পড়ব না।

এখানে আত্মীয় বলতে সাধক রবীন্দ্রনাথ কাকে বা কাদের বোঝাচ্ছেন তা জানে না চারণ, কারণ রবীন্দ্রনাথ তো মধ্যজীবনে এসে এই সার কথাটি বুঝেছিলেন যে, রক্তসুত্রর আত্মীয়তাটা আসল আত্মীয়তা নয়।

তারপর লিখেছিলেন, গভীরভাবে, সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়ে থাকব। যদি লেখা জমে আসে তো লিখব। পণ্ডিচেরীতে অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করে আমার মনে হল আমারো কিছুদিন এইরকম তপস্যার খুবই দরকার। নইলে ভিতরকার আলো ক্রমশই কমে আসবে। প্রতিদিন যাতা কাজ করে যাতা কথা বলে মনটা বাজে আবর্জনায় চাপা পড়ে যায়। নিজেকে দেখতে পাইনে।

ভোলানন্দ গিরির আশ্রমটির সঙ্গেও এই নিজের ভিতর থেকে বাইরে এসে নিজেকে দেখার মধ্যে যে একধরনের নৈর্ব্যক্তিক মুক্তি থাকে তার মিল আছে। আশ্রমটি দেবপ্রয়াগে অবস্থিত হয়েও দেবপ্রয়াগে নয়। এই জন্যেই ভাল লেগে গেছে চারণের এতখানি। আর ভোলানন্দবাবাকে তো লেগেছেই।

এই প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে এরই কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে লিখেছিলেন,

দেশে গিয়ে সম্পূর্ণ নির্জনবাসের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে দীর্ঘকাল বাক্য ও কর্ম থেকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি নেব ঠিক করেছি।

নিষ্কৃতি পাওয়ার কথাই জানত চারণ। তাই রবীন্দ্রনাথের মতন শর নির্ভুলতা সম্বন্ধে শুচিবায়ুগ্রস্ত মানুষ কেন নিষ্কৃতি নেব বললেন, তা জানা নেই ওর।

তারও পরে লিখেছিলেন, ছোট ঘোট দাবীর শিলাবৃষ্টিতে আমার দেহমনের সমস্ত ডাটাগুলো একেবারে আলগা হয়ে গেছে। ডাক্তার বলছে স্থির হয়ে থাকা ছাড়া আর ওষুধ নেই। অন্তরের মধ্যে তার একান্ত প্রয়োজনও বোধ করছি।

এই নিরবচ্ছিন্ন নির্জনতার মধ্যে এসে পড়ে সত্যিই বড় ভাল লাগছে চারণের। ত্রিবেণী ঘাটে হয়তো সৎসঙ্গ আছে, কলকাতাকে সেখানে পৌঁছে ভোলা সহজ। কিন্তু দেবপ্রয়াগের মতন ঘোর লাগানো নির্জনতা সেখানে নেই।

এই নির্জনতার প্রসঙ্গে কত কথাই যে মনে ভিড় করে আসছে। এই নির্জনতার মধ্যে না এলে, নিজের মন নির্জন না হলে তো এসব ভাবনা ভাবতেও পারত না। এইসব কথা, বড় মানুষদের এইসব চিঠির কথা তো সে ডাইরিতে লিখেই রেখেছিল। বার বার পড়তে পড়তে তা মুখস্থও হয়ে গেছিল। কিন্তু এমন জায়গাতে না এলে সেইসব কথা তো মনেই আসত না!

ও ভাবছিল হৃষ্টপুষ্ট গাভীরই মতন এতদিন মনে মনে খেল অনেকই। গলকম্বলের নীচে আর খাদ্যনালীতে এবং পেটেও তো খাবার সব ভরাট হয়েই আছে। কিন্তু জাবর না কাটতে পারলে তো সে খাদ্য মনের পুষ্টিবর্ধন করবে না। আঁতেলদের মতন জ্ঞানের বুকনি ছুটোনো যাবে তাতেই কিন্তু নিজের মনের মধ্যে গভীর প্রশান্তি, যে পরম গন্তব্যর কারণেই মানুষের সমস্ত জ্ঞানার্জন, তা তো আসবে না।

অন্ধ শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের খুবই ভক্ত চারণ। সত্যজিৎ রায়ের মাস্টারমশাই ছিলেন তিনি, নন্দলাল বসুরই মতন। এইসব বড় মানুষদের মধ্যে প্রায় অধিকাংশই যখন ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন তখন কোনও কোনও সর্বজ্ঞ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না তা নিয়ে মাথা ঘামাতে আদৌ রাজি নয় ও।

সেদিন হৃষীকেশ-এ ভীমগিরি মহারাজের সঙ্গে তুমুল তর্ক জুড়েছিল যে ও সে কথা সত্যি। কিন্তু ভীমগিরি মহারাজ তাকে ভাবতে বলেছিলেন। অনেকই ভেবেছেও চারণ সেদিন থেকে। ভাবাভাবির শেষে ভীমগিরি মহারাজের মতামতকে যে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পেরেছে ও এমনও নয়। আবিষ্কার আর উদ্ভাবন এই দুটি শব্দ তার মনোজগতে এক বিস্ফোরণ অবশ্যই ঘটিয়েছে।

ভীমগিরি মহারাজই কি তাহলে ঠিক? না, ওই ঠিক?

এই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় এত সহজে মিলবে না।

বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় একটি চিঠিতে ঈশ্বর এবং নির্জনতা প্রসঙ্গেই লিখেছিলেন, যাঁরা আমাদের চেয়ে সকল বিষয়ে বড় তাঁরা সকলেই ঈশ্বর এবং মঙ্গল এক করে উপলব্ধি করেছেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মেন্টাল-ওয়ার্ল্ড-এর গণ্ডির বাইরে প্রায়ই যেতে পারে না। এ বিষয়ে আমি ছবি আঁকতে গিয়ে বুঝেছি।

এখানে মেন্টাল-ওয়ার্ল্ড বলতে বিনোদবিহারী কী বুঝিয়েছিলেন ঠিক বোঝেনি চারণ।

Extreme mental shock (লাঞ্ছনা, অপমান, কাম ইত্যাদি)-এর প্রভাবে আমাদের মনের যেরকম বৈরাগ্যভাব জমে বা তীব্রভাবে আমরা কোনও কোনও বিষয়বস্তুতে আকৃষ্ট হই, তখন একরকমের মুক্তি অনুভব করি। সৃষ্টিক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে এই অবস্থা থেকেই আমরা একটা অন্ধকার জগতে গিয়ে পৌঁছই, মানসিক নরক।

অলৌকিক অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আছে। আসলে নির্জনতা ও জনতার মধ্যে বাস করার মধ্যে অভিজ্ঞতার পথে জমিন-আসমান তফাৎ রাখে। আপনি ঠিকই লিখেছিলেন, নির্জনতা কখনও আমাদের শূন্যহাতে ফেরায় না।

লেখাপড়া, ছবি সবই নির্জনতার অবদান। বাইরে নির্জনতা থাকলেও মনের মধ্যে ভিড় জমে ওঠে। বাইরেও নির্জন, মনের ভেতরেও নির্জন–একেই বোধহয় বলে শান্তি, বা Peace! একই সঙ্গে ধ্যানের কথা উল্লেখ করতে হয়। এর পরই ঈশ্বর আছেন না নেই, সৌন্দর্য আছে না নেই এ সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, সর্বশক্তিমান আমাদের ভালমন্দর হতর্কতা ভগবানকে আমি ঠিক দেখিওনি, বুঝিওনি। আমি অলৌকিকে বিশ্বাস করি।…মুক্তির পথ, উপলব্ধির পথ ভিন্ন। যুক্তির পথে ছবি আঁকতে পারিনি। ছবি আঁকার জন্যই উপলব্ধির পথ অনুসরণ করতে হয়েছে।

চারণ ভাবছিল, রবীন্দ্রনাথ হলেও কি এই কথাই বলতেন? লেখার জন্যই উপলব্ধির পথ অনুসরণ করতে হয়েছে?

কী সব গভীর উপলব্ধির চিঠি। আরেকটি চিঠিতে বিনোদবিহারী লিখছেন,

তলায় পাঁক, মাঝখানে জল, ওপরে পানা, এই হল মোটামুটি আমাদের জীবন। কোনওরকম করে পানা সরাতে পারলে একটু সুর্যের আলো পড়ে। সেই হল ঈশ্বরের আশীর্বাদ। পাহাড়, সমুদ্র, তারায় ভরা অন্ধকার রাতের কথা মনে হলে পানা পুকুর থেকে মুক্তি পাবার আকাঙ্ক্ষা জাগে। মুক্তি হয়তো হবে না, তবু বৃদ্ধবয়সের পরম সম্পদ এই অভিজ্ঞতা : যা আমাদের মুহূর্তে মুহূর্তে জানিয়ে দিচ্ছে যে আরও কিছু আছে।

যৌবন হল অ্যাকশন আর বার্ধক্য হল কনটেমপ্লশান। এই সত্যটি জানতে অনেকদিন লাগল।

গত রাতেই পাটনের গুরু ভোলানন্দ মহারাজ বলছিলেন, এই পুরো পৃথিবীটাই মানুষের মনের সৃষ্টি। জুলিয়ান হাক্সলিকে quote করে বলেছিলেন :

There is only one substance which possesses not only material properties but also properties for which the word mental is the nearest approach.

আবার PLATOর কথা উল্লেখ করে ভোলানন্দ বলছিলেন Mind is the sum total of other vibrations. So, if the mind is made still and subtle, the union of protons and electrons in an atom of an element in suitable proportion becomes possible. When it is done, one element is changed into another because a gross element is nothing but the aggregrate of its subtlest particles.

বাণিজ্য আর আইনের ছাত্র চারণের কাছে ইলেকট্রন প্রোটন, অ্যাটম, ইথার এইসব শব্দগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছিল। পাটন তাকে পরে বুঝিয়েছিল।

বলেছিল যে, যে-কোনও বস্তুর অ্যাটমই অনেক প্রোটন আর ইলেকট্রন নিয়ে গঠিত। একটি অ্যাটম-এর মধ্যে ইলেকট্রন আর প্রোটনের ভাগ হচ্ছে ১-১০৪ আর ১-২৪৫। একটি ইলেকট্রন একটি প্রোটনের চারদিকে প্রতি সেকেন্ডে পঞ্চাশ হাজার মাইল থেকে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিতে (যা, আলোর গতি) আবর্তিত হচ্ছে। পোটন আর ইলেকট্রনের উপাদানের তারতম্যই বিভিন্ন উপাদানের জন্ম দেয়।

পাটন চারণকে বোঝাবার জন্য বলেছিল, মনে করুন, রুপোর মধ্যের অ্যাটমে প্রোটন আব ইলেকট্রনের মধ্যে যদি সোনার অ্যাটমের মধ্যে প্রোটন আর ইলেকট্রনের যে সাযুজ্য তা আনা যায়, তবে রুপোকে সোনা করা কিছুমাত্রই অসুবিধের নয়।

এই ইংরেজি ইলেকট্রনকেই আমাদের সংস্কৃতে বলে মরুৎ। মরুৎ, ব্যোম, ক্ষিতি, অপ ইত্যাদিই সৃষ্টির মূল উপাদান। রবীন্দ্রনাথের ঘোড়া শীর্ষক একটি ছোট গল্প আছে। পড়েছিলেন কি?

চারণ বলল, না।

এ কদিনে তার অশিক্ষিত ক্রিমিন্যাল ট্রিলিয়নিয়র মক্কেলের ছেলেকে কাছ থেকে দেখে চারণের ভিরমি খাবার অবস্থা হয়েছে।

মিস্টার ব্রহ্মার এইসব তো Raw meterial। এইসব দিয়েই তো সৃষ্টি তাঁর। অপ হচ্ছে জল, আগুন হচ্ছে তেজ, হাওয়া হচ্ছে মরুৎ, আর গুরুজি যে বললেন ETHER সেই ইথারই হচ্ছে ব্যোম।

ব্যোম শংকরের ব্যোম বলছ?

হেসে বলল চারণ।

পাটন উত্তরে বলল, ব্যোমশংকরের ব্যোমকে নিয়ে ঠাট্টা করবেন না। শংকর ভগবানই একমাত্র ভগবান যিনি ব্রহ্মার ক্রিয়েশনকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারেন প্রলয়-নাচন নেচে।

চারণ বলল, তাহলে ইলেকট্রন কি?

ইলেকট্রন হচ্ছে মরুৎ। বুঝলেন না এছাড়া আর একরকম বৈদ্যুতিক শক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে বহুদিন হল। তাকে বলে Positron। Gamma Rays-এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। একটি Positron এবং একটি Electron-এর মিলনই গাম্মা রশ্মির জন্ম দেয়। আবার গাম্মা রশ্মিকে বিভক্ত করে তার মধ্যে Positron আর Electron-কেও আলাদা করা যায়। তবে মনে হচ্ছে matter আর Energy মূলত আলাদা কিছু নয়। একের মধ্যে অন্য ওতপ্রোতভাবে, অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে।

চারণ বলেছিলে, এবার ক্ষ্যামা দাও। ঈশ্বর বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সঙ্গে নির্জনতার অনুভূতির সঙ্গে যে এতসব গোলমেলে বৈজ্ঞানিক ব্যাপার জড়িয়ে আছে তা ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না। এর চেয়ে তো রবিঠাকুরের সেই গানই অনেক ভাল ছিল।

কোন গান?

 ওদের কথায় ধাঁধাঁ লাগে তোমার কথা আমি বুঝি।

তোমার আকাশ তোমার বাতাস এই তো সবই সোজাসুজি।

সে কথা ঠিক। তাই তো আলটিমেট সিনথেসিস। কিন্তু সবাই তো রবিঠাকুর নন। তাছাড়া, অবিশ্বাসীদের ভিড়ও তো কিছু কম নয়। বিজ্ঞানই তো মানুষকে সব সত্যকেই যাচাই করে নিতে শিখিয়েছে। সেই গুণ অথবা দোষ আসলে বিজ্ঞানের নয়, মানুষেরই।

কেন, মানুষের কেন?

বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে পড়ে মানুষ বিজ্ঞানের উৎস সম্বন্ধেই অনবহিত হয়ে উঠছে। জ্ঞান থেকেই যে বিজ্ঞানের জন্ম। আমাদের দেশের এই আধ-ন্যাংটো সাধু-সন্নিসীদের অনেকেই যে, যেকমণ্ডলু থেকে উট খাবার খেয়েছিল, সেই কমণ্ডলুতেই বিজ্ঞান গুলে খেয়েছেন সে খবর উদ্ধত পশ্চিমীরা আর তাদের অন্ধ অনুকরণ করা কিছু প্রকৃতার্থে অশিক্ষিত এনআরআই আর দিশি সাহেবরা আর কম্যুনিস্টরা জানতে চান না। না চান, তো না চান। জ্ঞানের সীমা তো চিরদিনই ছিল, অজ্ঞতার, সীমা কোনওদিনও ছিল না। যাঁরা বিজ্ঞানের জয়গান করতে গিয়ে নিরীশ্বরবাদী হয়ে ওঠেন তাঁদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ। কারণ It is the dream of science that all the recognise chemical elements will one day be found to be modifications of a single element.

জ্ঞানীরা যা ইতিমধ্যেই জানেন, তাই অধুনা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা প্রমাণ-সাবুদের সঙ্গে জানবার জন্যে ইলাহি কাণ্ড কারখানা করে চলেছেন। গতরাতে ভোলানন্দ মহারাজ বিজ্ঞান এবং ঈশ্বরবোধ এব মধ্যে যে কোনও বিরোধ নেই এই কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন কিছু কথা।

সেইসব কথা স্বামী বিবেকানন্দরই কথা। সখ করে সাধু-সঙ্গ করতে এসে, মনের অশান্তি নির্বাপিত করতে এসে যে এমন সাংঘাতিক আবর্তে নিক্ষিপ্ত হবে তা চারণ একবারও ভাবেনি।

কত কী জানার আছে, বোঝার আছে, পড়াশুনো করার আছে। এই সব দীনহীন সাধুসন্নিসীদের বাইরে থেকে দেখে এঁদের জ্ঞানের সীমা, গভীরতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণাও করা যায় না। কিন্তু চারণের হাতে যে সময় খুব বেশি নেই। পাটন ছেলেমানুষ, ওর হয়তো আছে। এত দেরি করে এই মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, এই অলীক জ্ঞানভাণ্ডারের কতটুকুই বা ও করায়ত্ত করতে পারবে?

নিজের জন্য ভারী কষ্ট হল চারণের। হৃষীকেশ-এ আসার পর থেকেই হচ্ছিল। সেই কষ্টটা বহুগুণ বেড়ে গেছে দেবপ্রয়াগে এসে।

ভোলানন্দ মহারাজকে দেখে এবং তাঁর সঙ্গে মিশে, (মানে যখন তিনি মৌনী থাকেন না) একবারও মনে হয় না যে, তিনি একজন অসাধারণ মানুষ, এতবড় পণ্ডিত, জন্মজন্মান্তরের সুকৃতির ধারক ও বাহক। পণ্ডিতম্মণ্য মানুষ মাত্ররই উচিত তাঁর কাছে এসে জেনে যাওয়া যে পণ্ডিতমণ্যতা আর মূখামি সমার্থক।

অন্ধকারের পর ওপারের পথ দিয়ে ট্রাক বাস বা গাড়ি যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। কখনও কখনও আর্মির ট্রাক বা জিপ যায়। বা, কনভয়। অন্ধকারে দুই নদীর সঙ্গমের শব্দের দিকে মুখ করে বসে সেই শব্দের প্রতি মনোনিবেশ করে নিজের মধ্যে স্থিতি আনবার চেষ্টা করছিল চারণ। সেখানে বসে ওর মনে পড়ছিল যে, ওর দাদুর শোবার ঘরের খাটের উপরে শ্রীরামকৃষ্ণ আর স্বামী বিবেকানন্দর দুটি বাণী বাঁধানো ছিল। কিন্তু ইংরেজিতে লেখা বাণী। ইংরেজিতে কেন? তা ও বলতে পারবে না। দাদু বাংলা তো অবশ্যই, সংস্কৃতও অত্যন্ত ভাল জানতেন।

লেখা ছিল, He is born to no purpose, who having the privilage of being bom a man, is unable to realise God in this life. শ্রীরামকৃষ্ণ।

আর স্বামী বিবেকানন্দর বাণীটি ছিল এইরকম Each soul is potentially divine. The goal is to manifest this divine within by controlling nature external and internal.

কে জানে! ওর মধ্যে দাদুর জিন ছিল কি না! চারণের বাবা ঘোর নাস্তিক ছিলেন। চারণের মনের মধ্যে সবসময়ে কি যেন নেই, কি যেন পাওয়া হল না, জানা হল না, সে যে কোন পরম ধন। সে সম্বন্ধে এক আশ্চর্য ও গভীর আকুতি যে কেন জন্মাল, তা কে জানে!

হঠাৎ তার ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিয়ে পাটন, পেছন থেকে তাকে চমকে দিয়ে ডেকে উঠল, এই যে, স্যার। চলুন। আশ্রমে, চন্দ্রবদনী নাম্নী এক সাংঘাতিক সাইকেডিলিক মাল এসেছে। সাঁটুলি দ্য গ্রেট। যাচ্চলে! আমার আর এ জন্মে সাধু হওয়া হল না। আমার যখন হলই না তখন আপনার কেসটাও যাতে কেঁচে যায় তা তো দেখতে হবে। গুরু-মোটা আপনাকে ডাকতে বললেন। গান-টান হবে নাকি। দিওয়ালির দিন বলে কতা।

গুরু-মোটা মানে?

 চারণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

মানে, ভোলাগিরি। তিনি কি মোটা নন?

তা মোটা। তবে গুরু কে কি এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা উচিত?

 চারণ ডান হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে চারণের বক্তব্যকে ডিসমিস করে দিয়ে হঠাই গেয়ে উঠল,

দেখা হ্যায় পহেলি বার,
 সজনকে আঁশখামে পেয়ার,
ঝিংকু চিকুর! ঝিংকু ঝিংকুর! ঝিংকু চিকুর!

.

ঐ পাথরে-খোদিত গুম্ফাদের সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে প্রায় পুরো দেবপ্রয়াগের এলাকা পেরিয়ে অনেকখানি উতরাই নেমে অলকানন্দার উপরের সরু সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে আবার অনেকখানি চড়াই উঠে যখন আশ্রমে পৌঁছল ওরা তখন দেখল প্রায়, জনাদশেক সাধু-অসাধু চেহারার মানুষ জমায়েত হয়েছেন আশ্রমে।

বেলা থাকতে থাকতেই বেরিয়েছিল চারণ আশ্রম থেকে। ভোলানন্দ তখন কন্দরের অভ্যন্তরে ছিলেন। সেই জনমণ্ডলীর মধ্যে একজন মাত্র নারী। এবং পুরুষদের মধ্যে দুজন শ্বেতাঙ্গ।

সেই নারীর রূপবর্ণনা করবে তেমন ক্ষমতা চারণের নেই। তার মুখের রং ম্যাগনোলিয়া গ্রাডিফ্লোরার মতন। কিন্তু লজ্জা পেলেই তা রডোডেনড্রনের মতন লালচে হয়ে যাচ্ছে। ধুনির আগুন যখন তার দীপশিখার মতন মুখে নাচানাচি করছে তখন মনে হচ্ছে একমুঠো আলোর প্রজাপতিকে কে যেন ছেড়ে দিয়েছে তার মুখে। কিছুক্ষণ নাচানাচি করে তারপরই আবার সরে যাচ্ছে তারা। ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা আবার তার শুভ্রতা ফিরে পাচ্ছে।

রূপসী এ জীবনে অনেকই দেখেছে চারণ। কলকাতার যে-সমাজে তার ঘোরাফেরা ছিল তা পুরনো রাজা-মহারাজা থেকে শিল্পপতি রাজা-মহারাজা সকলেরই খাস দরবার ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র রূপে রূপসী হলেই কারওকে রূপসী বলে মানতে রাজি হয়নি সে কোনওদিনই। যতক্ষণ কথা না বলছে এবং শুনছে, ততক্ষণ রূপসী শুধু রূপেই রূপসী। কিন্তু গুণের গরিমা ছাড়া পৃথিবীর সব রূপই যে ব্যর্থ! মুখ খুললেই যে কত সুন্দরী কদর্য হয়ে ওঠে, কত রূপবান পুরুষ মর্কট-শ্রেষ্ঠ, তা যাঁরা না জানেন, তাঁদের বোঝানো যাবে না।

চন্দ্রবদনী!

 এই নারীই নিশ্চয়ই চন্দ্রবদনী হবে।

একটি সাদা-রেশমের ফুলহাতা ব্লাউজের সঙ্গে পোড়ামাটি-লাল জমি আর কচি কলাপাতা রঙা পাড় ও আঁচলের একটি গাদোয়াল শাড়ি পড়েছে। চোখে ও চোখের পাতাতে কাজল। কপালে কালো টিপ। গলাতে পীত পোখরাজের মালা। একটি বড় পোখরাজকে লকেট করা হয়েছে। কানে, পীত পোখরাজের ইয়ার-টপ। হাতেও পীত পোখরাজের বালা। সোনা দিয়ে বাঁধানো। পায়ে সোনার পায়জোর। ঘন কালো কুঞ্চিত চুল। র‍্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো পাখির ডানার মতন, উজ্জ্বল কালো চেকনাই সেই চুলে। কী তেল এবং কী সুগন্ধ সে মেখেছে তা জানা নেই চারণের কিন্তু গুহামুখ থেকেই তার সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। অথচ কোনও বিদেশি পারম নয়। এই দেবভূমিরই কোন ফুল বা আরক মেখেছে, কে জানে। মুখ খুললেই সুন্দর যুঁইফুলের মতন সাদা দুপাটি দাঁত ঝিকমিক করে উঠছে।

চারণ চুপ করে দাঁড়িয়েই রইল গুহামুখে।

ভিতর থেকে ভোলাগিরি মহারাজ বললেন, এসো এসো চারণবাবু আমরা সকলে তোমারই জন্য অপেক্ষা করছি।

কানের পাশে ফিসফিস করে পাটন বলল, শাল্লা। মেনকা আর রম্ভাকে এক হামানদিস্তেতে কমলালেবুর মধু আর যত গুষ্টির যষ্টিমধু একসঙ্গে মেরেছে র‍্যা! আমার এখন কি হবে গা?

বলেই, নিজৌষধি গান গেয়ে উঠল, প্রায় চারণের কানে কানে,

দেখা হ্যায় পহেলি বার
সজন কি আঁখোমে পেয়ার
ঝিংকু চিকুর! ঝিংকু চিকুর! ঝিংকু চিকুর।

 ভোলানন্দজি বললেন, তুই আবার কি গাইতাছস পাটন?

পাটন, দাগী মিথ্যুক আসামীর মতন দুকানে দুহাতের দুশ আঙুল ঠেকিয়ে বলল, কই? কিছু না ততা।

ভোলানন্দ বললেন, চন্দ্রবদনী, এরই নাম পাটন। যার সঙ্গে তোকে আলাপ করানো হয়নি অথচ যার কথা তোকে বলেছিলাম। এক নম্বরের বিচ্ছু। কিন্তু ও যেদিন পুরো সাধক হবে সেদিন অনেকই বড় বড় সাধু-সন্তকে লুঙি-ল্যাঙোট আর বাঘছাল গুটিয়ে তুলে উদ্বাস্তু হতে হবে। এখানে ওকে পুঁতে দিলে নর্থ চায়নার হিমালয়ে, যেখানে আমাদের স্বর্গ, সেখানে কোনও বদবু গাছ হয়ে ও জন্মাবে।

সকলেই ভোলানন্দজির কথাতে হেসে উঠলেন।

 শুধু অবাক হল চারণ।

এই ভোলানন্দজিকে দেখে কে বলবে যে, ইনিই যখন মৌনী অবস্থাতে ঋজু হয়ে ধ্যানে বসে থাকেন এবং মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হন তখন এর মনের ভাব কেমন হয়।

প্রসন্নতার প্রতিমূর্তির মতন ভোলানন্দজি বললেন, নেশা-ভাঙ করে, মহা ট্যাঁটোন, কিন্তু হলে কি হয়, পাটনের আত্মা মুক্ত হবার জন্য পাখা মেলে রয়েছে। ও আমার দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে। সেই যে আছে না? রবিবাবুর গানটা। আঃ তোমরা বল না কেউ?

কেউই যখন কিছু বললেন না তখন বিরক্ত হলেও হাসিমুখে বললেন সেই যে গো!

আমি তারে শুধাই যবে কী তোমারে দিব আনি
সে শুধু কয়, আর কিছু নয়, তোমার গলার মালাখানি।
 দিই যদি তো কী দাম দেবে
 ফিরে এসে দেখি ধুলায় বাঁশিটি তার গেছে ফেলে।
দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে।

তারপরই সকলকে চমকে দিয়ে বললেন, গা তো পাটন, যে গানটা গাইছিলি এখুনি।

কোন গানটা?

চমকে উঠে এবং ভয় পেয়ে পাটন বলল।

 আরে ওই যে রে! দেখা হ্যায় পহেলি বার সজনকে আঁশখামে পেয়ার।

সকলে হো হো করে হেসে উঠলেন।

 চন্দ্রবদনীও।

 কিন্তু সেই হাসি দেখে চারণের বুক হু হু করে কেঁপে উঠল। নানারকম মিশ্র ভয়ে।

এই চন্দ্রবদনীই সেই চন্দ্রবদনী! ভীমগিরি আর মাদ্রীর কাছে যার কথা শুনেছিল?

পাটন মুখ গোঁজ করে বসেছিল। ভোলানন্দ ধমক দিয়ে বললেন, হইল কি রে! ফাইজলামি রাইখ্যা এহনে গানখান শোনা দেহি।

এইরকম সময়ে বোঝা যায় যে, ভোলানন্দ পুর্ব বাংলার মানুষ। বাংলায় যখন কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন তখন এই ভাষাতেই কথা বলেন। এই মানুষই যখন আবার বদ্রীবিশাল বা কেদারনাথের বরফের গুহা থেকে নেমে-আসা কোনও সাধুসন্নিসীর সঙ্গে চোস্ত হিন্দিতে অথবা প্রয়াগ (ইলাহাবাদ) বা কাশী থেকে উঠে আসা কোনও পণ্ডিতের সঙ্গে শুদ্ধ সংস্কৃতে কথা বলেন তখন বোঝারই উপায় থাকে না যে ইনিই তিনি।

সাদা চামড়ার কোনও মানুষের সঙ্গেও এই তিনদিনে কথা বলতে শোনেনি চারণ ভোলানন্দ মহারাজকে। কিন্তু ওঁর মুখে ইংরেজি উচ্চারণ শুনে এবং শব্দচয়নে দেখে সহজেই বুঝতে পেরেছে যে, ইংরেজিও অত্যন্ত ভালই জানেন তিনি। হয়তো অন্য বিদেশী ভাষাও জানতে পারেন। আশ্চর্য নয় কিছু। প্রথম দর্শনেই বুঝতে পেরেছিল চারণ যে, উনি একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। ক্ষণজন্মা না হলে পাটনও এমন উৎপাটিত হয়। পাটন মুখে ওকে কিছুই বলেনি বা বলবেও না। কিন্তু চারণের সন্দেহ হয় যে পাটন সম্ভবত ভোলানন্দর দেখা পায় ইউনাইটেড স্টেটস এই। নইলে, সেখানেব পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ এমন করে দেশে ফিরে এসে কোটি-কোটি টাকার সম্পত্তিকে দূর-ছাই করে, পরিবারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে যে সে সম্নিসী হয়ে যাবে এবং হঠাৎই ভোলানন্দ মহারাজের দর্শন পাবে দেবপ্রয়াগে এসে, এমন বিশ্বাস করাও শক্ত। এবার ভোলানন্দ বাবা বললেন, সময় নষ্ট হইতাছে পাটন। তুই জানস যে আজ এখানে এতজন সাধুসন্ত জমায়েৎ হইছেন নানা বিষয়ে আলোচনার জইন্য। নষ্ট করার মতন সময় নাই আইজ। গা গানটা।

পাটন গুহার ছাদের দিকে মুখ করে হঠাৎই ধরে দিল,

 দেখা হ্যায় পহেলি বার।
সজনকি আঁখোমে পেয়ার।

গানটা শেষ হলে ভোলাগিরি বললেন, আর ঝিংকু চিকুর! ঝিংকু চিকুর। ঝিংকু চিকুরটা। গাইব। কেডা?

পাটন গান থামিয়ে বলল, ওটা তো গানের বডি নয়। ওটা তো মিউজিক।

ভোলানন্দজি বললেন, তা হউক গা। আমাগো হলের বডি যখন ওই মিউজিকই শুনতা চাইতাছে তুই শোনা আমাগো।

পাটন অগত্যা ঝিংকু চিকুর! ঝিংকু চিকুর। ঝিংকু চিকুর! গাইল।

চারণ ভাবছিল, পাটন চারণের কানের মধ্যে একেবারে Earful of Whisper এরই মতন করে গানটা গেয়েছিল। ভোলাগিরির শোনার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ওরা তার থেকে অনেকখানি দূরেও ছিল। এই ব্যাপারটাতেই বড় আন-নার্ভড বোধ করে চারণ। দূরে বসে কে কি ভাবছে, কমোডে বসে, (এখানে যদি কমোড থাকত) কে কোন গান গুণগুনাচ্ছে সবই যদি Sensor এ ধরা পড়ে, কমপুটার-এ স্টোরড হয়ে যায়, তাহলে বেচারা পাটন কমপুটার-সর্বস্ব স্টেটস ছেড়ে মরতে এখানে এল কেন?

রিয়্যালি!

বেচারি!

একজন রোগা টিংটিং-এ কিন্তু লম্বা সাধু বসেছিলেন ভোলানন্দজির ঠিক বাঁপাশে। খালি গা। তাঁর মাথা, বুক আর পেটময় কাঁচাপাকা চুল। বললেন, অব বেটিকি গান শুনা যায়।

জি হাঁ।

ভোলানন্দজি বললেন।

তারপর চন্দ্রবদনীর দিকে ফিরে বললেন, অব গাও বেটি।

কওসি গানা গাঁউ?

চন্দ্রবদনী গুরুজির দিকে চেয়ে বললেন।

তোমার গলায় যে গান শুনতে আমি ভালবাসি, ধিয়ানগিরি ভালবাসে, সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাও বেটি।

তারপরই অন্যদের দিকে ফিরে বললেন, হিয়াতে বহতই কিসিমকি গানা হামে শুননে মিলতাই হ্যায়। ক্যা ভাইলোগ? রভীন্দরনাথভিতে ইক বহত বড়া সন্তহি থে। উনকি গানা আজ দিওয়ালিকি রাতমে জারা শুন লেনে সে হরজ ক্যা?

তারপরই বললেন, আজ মামুলি দিওয়ালিভি নেহি না হ্যায়। আজ সিনিবালি দিওয়ালি। দেওয়ালির রাতে দীপাবলী রাগ শোনাবি মা আমাদের?

দীপাবলী?

এই রাগের কথা তো শুনিনি।

আমরা সকলে কতটুকুই বা জানি! আমাদের জানার বাহিরে তো কত কিছুই আছে। দীপাবলী আমিও অবশ্য কারও কণ্ঠে শুনিনি, শুনেছি বাঁশিতে। আলি আকবর খাঁ সাহেবের রেকর্ডও আছে এই রাগে।

কেমন রাগটি যদি বলেন একটু।

চন্দ্রবদনী আবদারের গলাতে বলল।

 রাতের বেলাতে গাওয়ার রাগ, বুঝতেই পারছিস। দিনে নাম দীপাবলী হত না। কল্যাণ ঠাটের অন্তর্ভুক্ত রাগ। মা মধ্যম বাদী, মা সমবাদী। হাতি ঔরসার। ক্ষা, শুদ্ধ মা কোমল মা দুইই লাগে কিন্তু এই রাগ পা বর্জিত।

মানে, পদবিহীন?

পাটন মাঝে একটু ফক্কুরি করল। রাত দশটার পরে গাওয়া হয়।

আরোহণ অবরোহণটা কেমন?

 চন্দ্রবদনী বলল।

আরোহণ সারা গা মা ক্ষা মা ধা নি সা।

অবরোহণ।

সা না ধা মা মা গা মা গা রে সা। বলেই বললেন, গলায় ভোলার চেষ্টা করিস তো মা। আর যদি তুলতে পারিস তত শুনিয়ে যাস আমাকে একদিন।

হর্জ কওন চি ক্যা?

 জরুর। জরুর।

 কাহে নেহি?

ইত্যাদি ধ্বনি উঠল।

ধিয়ানগিরিকে ভোলানন্দজি যে চেনেন তা বোঝা গেল। তাহলে চন্দ্রবদনীও চেনে। তাহলে এই চন্দ্রবদনীই সেই চন্দ্রবদনী? দিওয়ালির দিনে দেখা হবে বলে আশা করেছিল চারণ খুবই। দেখা হয়েও গেল। তবে হৃষীকেশ-এ নয়, দেবপ্রয়াগে। একেই বলে, সাধু সন্তদের ভাষায় সনযোগ।

কোনওরকম ন্যাকামি বা ভান-ভড়ং না করেই চন্দ্রবদনী একবার গলাটা পরিষ্কার করে নিয়েই হংসধ্বনির মতন গানটা ধরে দিল।

কী গলা! আর কী গান!

কে বলবে যে এ, মেয়ে পর্বতদুহিতা, হিমালয়চারিণী। শান্তিনিকেতন, দক্ষিণী, গীতবিতান, রবিতীর্থ, সৌরভ সব কিছুকে বেটে বড়ি বানালে যা হত না, এই কন্যে সেই অঘটনঘটন পটিয়সী বটিকা।

সহজ সোজা গান। কিন্তু এই আশ্চর্য সুন্দর গম্ভীর পরিবেশে সেই গানের বাণী যেন অমরাবতীর বার্তা বহন করে আনল। গানটির বাণী শুনলে প্রেমের গান বলেও অনভিজ্ঞর মনে হতেও পারে কিন্তু এ গান যে ঈশ্বরকে উদেশ্য করেই বাঁধা তা চন্দ্রবদনীর গলাতে শুনলে, কারওই সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিতে কোনও অসুবিধে থাকবে না।

তুমি হঠাৎ হওয়ায় ভেসে আসা ধন
তাই হঠাৎ পাওয়ায় চমকে ওঠে মন।
গোপন পথে আপন-মনে বাহির হও যে কোন লগনে
হঠাৎ গন্ধে মাতাও সমীরণ।
নিত্য যেথায় আনাগোনা হয় না সেথায় চেনাশোনা,
উড়িয়ে ধুলো আসছে কতই জন।
কখন পথের বাহির থেকে হঠাৎ বাঁশি যায় যে ডেকে
 পথহারাকে করে সচেতন।

গান শেষ হলে সকলেই বাক্যহারা। গুহাভ্যন্তরে এবং বাইরের চাতালেও পূর্ণ নিস্তব্ধতা নেমে এল। চাতালের মুখে ধুনি জ্বলছিল। শুধু তারই ফুট-ফাট অস্ফুট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। গানের চেয়েও গানের রেশ যে অনেকই বেশি আনন্দ-বেদনাবাহী হয়, তা যাঁরা গান প্রায়ই শোনেন, তাঁরাই জানেন।

অনেকক্ষণ পরে ভোলানন্দজি বললেন, তোর আত্মদর্শন তোক মা। যাই চাস, তুই তাই যেন পাস জীবনে। এই আশীর্বাদ করি।

যা, না যাকে?

দুঃসাহসী পাটন অতজনের সামনেই বলল, ফুট কেটে।

ভোলানন্দ, মনে হল সামান্য বিরক্ত হলেন। কিন্তু মুখে সেই বিরক্তি প্রকাশ না করে বললেন, যা বা যাই-এর মধ্যে যেও পড়ে।

বলেই, চারণকে বললেন, তোমার সঙ্গে তো চন্দ্রবদনীর আলাপ নেই। এর নাম চন্দ্রবদনী। আর এ চারণ চ্যাটার্জি।

চারণ সাহস করে বলে ফেলল, আপনার তো আজ হৃষীকেশে থাকার কথা ছিল। ভীমগিবি মহারাজ আর মাদ্রীদের কাছে যাবার কথা ছিল, তাই না?

চন্দ্রবদনী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল।

বলল, চেনেন নাকি আপনি হৃষীকেশের ওঁদের?

তারপরই বলল, হ্যাঁ। কথা তাই ছিল বৈকি। তবে, এখানে এসেই আটকে গেলাম। নামতে পারলাম না। বদ্রীবিশাল যা করবেন তাইই তো হবে।

আপনি নামতে পারলেন না বলেই হয়তো, আমি উঠে এলাম। দিওয়ালির দিনে দেখা হওয়ার কথা ছিল, তাই হয়ে গেল।

তারপর চারণ চন্দ্রবদনীকে জিজ্ঞেস করল, হৃষীকেশ থেকে ঠিক কতদুর দেবপ্রয়াগ?

চন্দ্রবদনী উত্তর দেওয়ার আগেই ভোলানন্দজি চারণকে বললেন, আরে! বেটি কি করে জানবে? ও কি অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের রুট-চার্ট বানায়?

তারপরেই ওঁর পাশে বসা সেই দীর্ঘাঙ্গ, রোগা, সল্ট-অ্যান্ড-পেপার চুল-দাড়ির সাধুকে শুধদলেন কিউ শ্যামানন্দজি? দেবপ্রয়াগ সে হৃষীকেশ কিতনি দূর পড়েগি?

শ্যামানন্দজি একটু হাসলেন। ঋষিসুলভ হাসি। তারপর বললেন, হৃষীকেশ সে দেবপ্রয়াগ যিতনি দূর পড়তি হ্যায়, দেবপ্রয়াগ সে হৃষীকেশ ইতনাহি দূর পড়না চাহিয়ে ভোলানন্দজি।

সমবেত সাধুদের মধ্যে থেকে কে যেন বললেন, ওয়াহ! ওয়াহ! বহতই আচ্ছা বোলা আপনে।

তারপরই বললেন, বাবা বদ্রীবিশালকি প্যায়ের সে তুমারা শর যিতনা দূর, তুমহারা শর সে বাবা বন্দরীবিশালকি প্যায়েরভি উতনাহি দূর! ক্যা শ্যামানন্দ? ঠিক কি নেহি?

যো বোলা তুম।

বলেই, সল্ট-অ্যান্ড-পেপার শ্যামানন্দজি তাঁর দিকে ছোঁড়া খোঁটাটাকে না ছুঁয়েই অদৃশ্য হাতে উপড়ে নিয়ে প্রশ্নকারীর দিকেই ছুঁড়ে দিলেন।

চন্দ্রবদনী উঠে দাঁড়াল। তারপর এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে দুহাত দিয়ে ভোলানন্দজির দুপা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সে যখন প্রণাম করার জন্যে অবনতা হল, তার শারীরিক সৌন্দর্য যেন পূর্ণ মহিমাতে পূর্ণচন্দ্রর মতন বিকশিত হল। খোঁপাতে পোড়ামাটিরঙা একগুচ্ছ নাম-না-জানা পাহাড়ি ফুল গুঁজেছিল। শ্বেতপদ্মর মতন মুখমণ্ডলে সেই ফুলের আভা লাগল।

আভভি আভভি চল পড়েগি বেটি? ইতনা জলদি?

 সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন তাকে ভোলানন্দজি।

 জি হাঁ চাচাজি। রাওয়ালজিকি ঘরমে যানা আভভি। খনা ভি হুয়াই খানা।

বলেই, অন্য সকলকে কোমর ঝুঁকিয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করল। বলল, নমস্তে আপ সব লোঁগোকি। মুঝপর দোয়া রাখিয়েগা।

ভোলানন্দ মহারাজ বললেন, আমরা মাধুকরী বৃত্তি করে খাই, তোকে আমরা কি দেব মা? শুধু মনের শান্তি ছাড়া আমাদের তোকে দেবার মতন কিছুই তো নেই।

তার চেয়ে, বড় দান আর কি আছে চাচাজি?

চন্দ্রবদনী চলে যাচ্ছে শুনে চারণের মনটা যতখানি খারাপ হবে ভেবেছিল ততখানি খারাপ হল না দেখে নিজেই অবাক হল। চলে যাচ্ছে মানে কি, দেবপ্রয়াগ ছেড়েই চলে যাচ্ছে? এখানে কতদিন থাকবে ও তাই বা কে জানে। সে যদি নেমে হৃষীকেশে যায়, তবে চারণও নেমে যাবে কি? ওঠার চেয়ে নামাটা তো চিরকালই সোজা!

ভোলানন্দজি পাটনকে ডেকে বললেন, এই বাঁদর! চন্দ্রবদনীকে সাবধানে রাওয়ালজিদের বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিয়া আয়। অন্ধকার রাত। সঙ্গে আলো লইয়া যা।

হুঁ।

পাটন বলল,

হুঁ ক্যান? কী ব্যাপার? তুই তো দেখতাছি দিনে দিনে আমার ইয়ার হইয়া উঠতাছস। হারামজাদা।

চন্দ্রবদনী, তার সামনেই পাটনের এরকম হেনস্থা দেখে অপ্রতিভ হয়ে উঠল।

কিন্তু পাটন বলল, সঙ্গে চন্দ্রবদনী থাকলে তো অমাবস্যার রাতের পথ এমনিতেই আলো হয়ে যাবে। আপনারই গুরুজি বুদ্ধিশুদ্ধি দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে। কত বলি যে শীর্ষাসন বেশি করবেন না। তা, কথা শোনেন কই?

সমবেত সাধু-সন্ত মণ্ডলী পাটনের সাহস দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু হেসে উঠলেন। সবচেয়ে অবাক হল এবং মজা পেল চন্দ্রবদনী নিজে। সে ফিক করে হেসে দিল।

পাটন বলল চারণকে, স্যার আপনি?

ভোলানন্দজিই বললেন, পাটনের কথার পিঠে, না! চারণবাবু এখানেই থাকবেন। নষ্ট করার মতন সময় ওঁর নেই। তোর তো আর কিছুই হবে না। এই সব ডিউটিই কর। ইচ্ছে করলে, রাজনীতিও করতে পারিস। আজ আমরা সৃষ্টি রহস্য নিয়ে আলোচনা করব। যা তুই। পালা এখন। তারপর চন্দ্রবদনীর দিকে ফিরে বললেন, আয় মা। আবার আসিস।

এসে কি লাভ? আপনি তো মৌনীই থাকবেন।

আরে আসিসই না। আমি যখন মৌনী থাকি তখনই তো অন্য অনেকে মুখর হয়। আমরা কাছে নাই বা এলি, এখানে এসে তোর ভক্তর অভাব তো কখনই হবে না। তুই নিজেকে জানিস না। নিজেকে জানা উচিত।

আত্মানং বিদ্ধি। পাটন বলল।

বাঁদরামি না কহরা অরে লইয়া যা হনুমান।

তাও একটু প্রোমোশন হল।

পাটন বলল, বিনয়ের সঙ্গে, মুখটি অধোবদন করে।

কিসের প্রমোশান?

এই! বাঁদর থেকে হনুমান।

 আস্ত মর্কট একখান।

ভোলানন্দজি বললেন।

পাটন বলল, আচ্ছা। বাঙালদের ভাষা কিন্তু রত্নগর্ভা। এক বাঁদরকে নিয়েই কতরকম শব্দ আছে আপনাদের তুণে।

যা, যা, পালা। ভোলানন্দজি বললেন।

পাটন চলে গেলে আবারও মৃদু হাসির রোল উঠল। কম সন্নিসীই বাংলা বোঝেন। যাঁরা বা একটু বোঝেন, তাঁরাও পূর্ববঙ্গীয় ভাষা একেবারেই বোঝেন না। হাসিটা ওরা হাসলেন আন্দাজেই। বিদেশি দুজন তত বোঝেনই না। হিন্দিও ভাঙা ভাঙা বলেন। তিন-চতুথাংশ বোঝেন।

চারণ বুঝল যে, চন্দ্রবদনী এই সন্নিসীদের কারও কাছেই নগন্তুক নয়। বিদেশিদের কথা বলতে পারবে না। অন্যরা সকলেই ওঁর সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।

আপনি যদি পাটনের সঙ্গে যেতে চান তো যেতে পারেন চারণবাবু। ওরা সামান্য পথই গেছে।

না, না। বলল চারণ।

এই না কিন্তু মন থেকেই বলল ও। যদিও নিজের কানেই যেন প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি জোর শোনাল।

এখানে এসে অবধি এবং বিশেষ করে বিভিন্ন মহারাজের সংস্পর্শে আসা অবধি ওর মনোজগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে যেতে শুরু যে করেছে তা ও বুঝতে পারছে। এ এক বিশাল আদি-অন্তহীন জ্ঞানের জগৎ। সে জগৎ যে আদৌ ছিল, সে সম্বন্ধে ওর কোনও ধারণাই ছিল না। সত্যিই জানে না চারণ তার জীবন তাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে। সন্নিসী মাত্রই যে ধান্দাবাজ নন, স্বার্থান্বেষী নন, এই সব স্বল্পাহারী, অনাহারী গিরিকর-মরুভূমি এবং নদীপ্রান্তে বসবাসকারী মানুষগুলির মধ্যে অনেকেই যে এক একটি চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া, পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের সংজ্ঞা, সে বিষয়ে ওর কোনও সন্দেহই নেই। এখন জানছে যে, গৃহীদের সাধু-সন্তদের সম্বন্ধে অনেকই ভ্রান্ত ধারণা থাকে। গৃহীদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের বিদ্রুপের চোখে দেখেন যে একথা তারা জানেন বলেই হয়তো যাচাই করতেও দেন না, নিজেদের ঔদাসীন্যর মুখোসও খোলেন না।

পাটন কাল সকালেই বলছিল, বাবারও বাবা আছে স্যার। এহ বাহ্য আগে কহ আর। এ গুরু, আমার যোগ্য হয়তো। কিন্তু এই দেবপ্রয়াগ এক সাংঘাতিক জায়গা। এই বাঙল ভোলাকেও সহজে ঘোল খাওয়াতে পারেন এমন বহত সাধুসন্ত এই জায়গার আনাচেকানাচেতে ছড়িয়ে আছেন। সব সন্তই তো আর রক্তচন্দন-রঙা সিল্ক বা টেরিকটের পোশাক পরে বিদেশী পারফম মেখে মহিলা ও অর্থ বেষ্টিত হয়ে মোক্ষর পথপ্রদর্শক হন না। যার প্রার্থনা যত বড়, তার সাধনাও তত কঠোর। আপনার হয়তো এঁর চেয়েও অনেক বেশি উচ্চমার্গের কোনও গুরু মিলবে। কেরিয়ারিস্টরা যেমন নানাজনকে নানাভাবে ব্যবহার করার পরে মইয়ের মতনই জোড়া পায়ে লাথি মেরে ঠেলে ফেলে দেন, তেমনই গুরুদেরও স্টেপিং-স্টোন হিসেবে ব্যবহার করে আপনি ত্যাগ করে যেতে পারেন। তবে ওঁরা তাতে একটুও রাগ করবেন না। একের কাছে পাওয়া শেষ হয়েছে তো অন্যের কাছে যান, এঁর কাছে পাওয়া শেষ তো এঁকে ত্যাগ করে ওঁর কাছে চলে যান। আপনাকে ঠেকাচ্ছেটা কে? সত্যজিৎ রায়ের ছবির রাজকন্যারই মতন গুরুও তো আর কম পড়ে নাই।

মা ভৈঃ।

চারণ বলেছিল, আমাকে স্যার স্যার কোরো না তো। দাদা বলবে।

মাত্বা খারাপ! আমার জন্মদাতা পিতা যাঁকে স্যার বলে অ্যাড্রেস করতেন, রামভক্ত হনুমানের মতন হাত জোড় করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন যাঁর সামনে, তাঁকে আমি দাদা বলে মহাপাতকের কাজ করতে পারি! আপনি আবার বাবার স্যার, আমারও স্যার। ওয়ানস আ স্যার অলওয়েজ আ স্যার।

শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ করল যে স্যার না ষাঁড় ঠিক বুঝতে পারল না চারণ।

 ছেলেটা সত্যিই বাঁদর। শুধু বাঁদরই নয়, বাঁদর টু দ্য পাওয়ার এন।

ভোলানন্দজি কি যে দেখেছেন এর মধ্যে তা তিনিই জানেন।

.

শ্যামানন্দজি বললেন, হ্যাঁ! কোথায় যেন ছিলাম আমরা?

অ্যানি বেসান্ট-এর কথা বলছিলাম আমি সেদিন।

 একজন শ্বেতাঙ্গ অবাক হয়ে বললেন, অ্যানি বেসান্ট?

হ্যাঁ। উনি লিখেছিলেন…

No particles of matter is in contact with any other particles but each swings in a field of cther.

চারণ বুঝল, সেদিন ভোলানন্দজি যে আলোচনা করেছিলেন তারই সূত্র ধরে ঐ কথা বললেন শ্যামানন্দজি।

শ্যামানন্দজি বললেন, শুধু উনি একা কেন? বেদান্ত সম্বন্ধে যাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল সেই জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের কথাতে বলতে গেলেও বলতে হয় যে…

The cosmic presents itself to us objectivly under the form of great natural forces.Gravitation, heat, light, clectricity, chemical affinity etc. then as the organising power in vegetables and animals; finally as human self-consciousness and sociabıllty.

ছান্দোগ্যোপনিষদও বলছে যে এই ইথারই জন্মদাতা এবং প্রকাশক, সব কিছুরই। এক উপাদানই অন্য উপাদানে রূপান্তরিত হয়ে যায় নানা ক্রিয়া-বিক্রিয়ায়। কোনও উপাদানই নষ্ট হয় না, আত্মারই মতন। এই ইথারই জীবিত বা মৃত যা-কিছুকেই আমরা জানি বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতিতে, বা জানতাম, তার সব কিছুরই জন্মদাতা।

গীতাতে বলছে :

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবক।
ন চেনং ক্লেদয়ষ্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥

অর্থাৎ, শস্ত্রসমূহ ইহাকে (আত্মাকে) ছেদন করতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, জল আর্দ্র করতে পারে না এবং বায়ুও ইহাকে দগ্ধ করতে পারে না।

একজন বিদেশী জিজ্ঞেস করলেন, আত্মা কি? সত্যিই কি আত্মার বিনাশ নেই? হিন্দু ধর্মে যে বলা হয় পরজন্ম আছে, পরলোক আছে। তার প্রমাণ কি?

শ্যামানন্দজি বললেন, সব কিছুর অস্তিত্বরই প্রমাণ দাবি করার গভীর বদভ্যাস আছে তোমাদের মানে পশ্চিমীদের। তোমরা বাইবেল আর কোরান বা হাদিসকে অকাট্য প্রমাণ বলে অবলীলায় মেনে নেবে আর হিন্দুধর্মের যে সব মূল শাস্ত্র আছে, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ, উপনিষদ, শুধুমাত্র এদেরই প্রামাণ্য নয় বলে সহজে তাচ্ছিল্যর সঙ্গে উড়িয়ে দেবে, তা কি করে হয়? তাছাড়া তুমি আমাদের পুরাণে, শাস্ত্রে, বেদ-বেদান্তে বিশ্বাসই না করা এবং সেই অবিশ্বাস আমাদেরই সামনে, যারা এই সব শাস্ত্রে বিশ্বাস করি বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, এমন কঠোর কৃচ্ছসাধনের জীবন যাপন করছি, প্রকাশ করছ? তা করতে অবশ্যই পারো। সব মতই এখানে গ্রাহ্য। কিন্তু বলতে পারো, পৃথিবীর আর কোনও ধর্মাবলম্বীদের সাধু-সন্ত বা পীর বা ফাদার এইরকম কঠোর কৃসাধনের ব্রত নেন? তোমার কি ধারণা ভারতের হাজার হাজার বছরের এই সাধনা সবই শুন্য কুম্ভে গেছে? এবং যাবে?

তাই যদি মনে করব, তাহলে এতদূরে কিসের খোঁজে এলাম। আমিও তো এখানে ফাইভস্টার হোটেলে নেই। কায়মনোবাক্যে আপনাদেরই তো অনুগমন করার চেষ্টা করছি অনুক্ষণ।

শ্বেতাঙ্গ যুবকটি বলল।

সেই শ্বেতাঙ্গ যুবকটির নাম স্টিভেন্স, তার বয়স হবে, বেশি হলে তিরিশ।

ভোলানন্দজি তারপর বললেন, তুমি জামান কম্পোজার বিঠোভেন-এর কোনও কম্পোজিশান কি শুনেছ?

স্টিভেন্স হেসে বললেন, বিঠোভেন শোনেননি এমন শিক্ষিত পশ্চিমী হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্মে কেউ কেউ থাকবে কিন্তু আমাদের প্রজন্ম অবধি কেউই নেই অন্তত।

চারণ বলল, শুধু পশ্চিমেই বা কেন, পুবেও হয়তো কেউ নেই।

চারণ ভাবছিল যে, যেমন আমাদের বাঙলার রবীন্দ্রসংগীত। এমন প্রজন্মও পরে হয়তো আসছে বাঙালিদের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের গান যে কি তাই জানবে না। জীবনমুখী গান, মরণমুখী গান, নীল ব্যানার্জি, লাল সেন, হলুদ ভৌমিকদের গানকেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া বলে জেনে তারা আহ্লাদবোধ করবে।

তা বিঠোভেনের কথা কেন ওঠালেন মহারাজ?

গর্ডন প্রশ্ন করলেন।

 বিঠোভেন-এর last quartet-এর movement তিনটি motifs-এর উপরে ভর করা।

কি? কি motifs? সেগুলি নিশ্চয়ই জার্মান ভাষাতেই।

obviously

যেমন?

 স্টিভেন্স শুধোল।

Muss es Sein?

Es Muss Sein!

Es muss Sein!

মানে?

চারণ প্রশ্ন করল এবারে।

চারণের প্রশ্নে স্টিভেন্স-এর মুখে স্মিতহাসি ফুটে উঠল।

স্টিভেন্স বলল, Must it be?

 It must be!

 It must be!

ভোলানন্দজি বললেন, তুমি জানো কি না জানি না স্টিভেন্স–এই বাক্যবন্ধর অর্থ সম্বন্ধে যাতে শ্রোতাদের মনে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা না থাকে সেই জন্যেই Beethoven introduced the movement with a phrase DER SCHEWER GEFFASSTE ENTS CHLUSS.

স্টিভেন্স-এর মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল।

এই ফ্রেজ-এর মানে?

চারণ ভোলানন্দজিকে জিজ্ঞেস করল।

উনি হেসে বললেন, মানে হচ্ছে, দ্য ডিফিকাল্ট রেজ্যুলশান।

তারপরই স্টিভেন্স-এর দিকে ফিরে বললেন, কি? ঠিক বলেছি?

 কন্দরের মধ্যে যে স্বল্প কজন মানুষ বসে ছিলেন তাঁরা চুপ করেই রইলেন। সব চেয়ে বেশি অবাক হলেন সেই দুই বিদেশি, গর্ডন আর স্টিভেন্স। দেবপ্রয়াগের অলকানন্দা আর গঙ্গার তীরের এই সুউচ্চ শিবালিক পর্বতমালার গায়ের গুহাভ্যন্তরের বাসিন্দা এই লুঙি-পরা বাঙালি সন্ন্যাসীর জ্ঞানের বহরে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন যেন। ভারতীয়রা তো ইংরেজরই চাকর ছিল। ইংরেজি ভাষাটা শিক্ষিত ভারতীয়রা ভাল জানতেই পারেন। কিন্তু জার্মান?

চারণের মনে হচ্ছিল, পাটন তার একটি মস্ত বড় উপকার করেছে। তার এই মুখখিত্যানন্দ বাবা অচিরেই চারণের মনে যে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন নিজেকে, বিনা চেষ্টাতে, বিনা আড়ম্বরে, সেই আসন টলানো কোনওমতেই হয়তো সম্ভব হবে না। ভাবছিল ও যে, যে-কোনও সম্পর্কেই শ্রদ্ধাই হচ্ছে আসল। সিমেন্টিং ফ্যাক্টর। সে সম্পর্ক প্রেমেরই হোক, দাম্পত্যেরই হোক, আর ভক্তিরই হোক। শ্রদ্ধাই বেঁধে দেয় বিনিসুতোর মালা, দুজনের মধ্যের সম্পর্ককে।

এমন সময় পাটন ফিরে এল।

ভোলানন্দজি বললেন, আস্ত পৌঁছাইছে তো আমার বন্ধুর মাইয়াডা? না কি পথেই বর্ষার দিনে শিয়ালে যেমনে কইমাছের মাথা চিবাইয়া ক্ষ্যাত-এর আল-এর উপরে ফ্যালাইয়া থোয়, তেমনি কইরা তারে চিবাইয়া চিৎ-কইর‍্যা ফেইল্যা আইছস? বদনাম হইব অনে এই বুড়ারই।

আপনাকে কেউ বদনাম দেবেই না। আর আপনি যদি বুড়ো হন তো ছোঁড়া কে?

ক্যান? বদনাম হইব না ক্যান?

আপনি তো এই প্রকারের কইমাছ কখনও খানইনি! তার মাথা আর লেজ! যদি কোনওদিন খেয়ে থাকেনও তবুও কী করে খেতে হয় তা এখন নিশ্চয়ই পুরোপুরি ভুলেই গেছেন। আপনার কোনওই ভয় নেই। বদনাম করলে, কি খুন করলে, লোকে আমাকেই করবে।

চারণ, পাটনের ধৃষ্টতা ও সাহসে হতবাক হয়ে গেল। তাছাড়া, যদি ভোলানন্দজি একা থাকতেন তাও না হয় অন্য কথা ছিল। এতজন মানুষের সামনে।

কিন্তু ভোলানন্দ মহারাজ তো নন, যেন বাঙাল শ্রীরামকৃষ্ণ। আশ্চর্য শিশুসুলভ হাসি হেসে বললেন, হারামজাদা। তরে আমি একদিন মাইর্যাই ফ্যালাইমু।

আনডন্টেড রাসকেল, রাসকেল অফ দ্য ফারস্ট ডিগ্রি, পাটন, হেসে বলল, কইমাছই খেতে পারেন তার আমাকে খাবেন। ফুঃ! আমাকে হজম করতে আপনার পঞ্চাশবার জন্মে আসতে হবে। আমার বাবা হারামি টু দ্য পাওয়ার ওয়ান মিলিয়ান আর আমি হলাম হারামি টু দ্য পাওয়ার এন। আমাকে খেলে, সারাটা জীবন আপনি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগে মরবেন।

সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেল পাটনের এক্তিয়ারবহির্ভূত তাচ্ছিল্যময় বাগাড়ম্বরে।

 কিন্তু নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ভোলানন্দ মহারাজই সবচেয়ে আগে হাসলেন। আর সে কি হাসি! রামকৃষ্ণদেবকে ঢারণ তো চোখে দেখেনি। দেখলে, হয়তো তাঁর হাসিও এমনই দেখাত।

হাসি থামলে উনি বললেন, কোনও সাকাসই যেমন একজন জোকার ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকে তেমনই আমাদের এই দেবপ্রয়াগের ছোট্ট সাকাসও পাটন না থাকলে অসম্পূর্ণ থাকত।

কথাটা বললেন ইংরেজিতেই, যাতে গর্ডন এবং স্টিভেন্স নামক দুই বিদেশি বুঝতে পারেন।

ভোলানন্দজি এবারে পাটনকে বললেন, ধুনির আগুনটা একটু নেড়েচেড়ে দিয়ে এসে বোস। বাইরে ঠাণ্ডাটা কি বাড়ল?

পাটনের সঙ্গে ভোলানন্দজি অনেক সময়েই বাঙাল ভাষাতে কথা বলেন দেখে চারণ ভেবেছিল পাটনদের আদি বাড়িও বোধ হয় পুব বাংলায়। ওকে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল আমার ঠাকুর্দা হাওড়া জেলার ডাকাত ছেল! বাবা, প্রথম জীবনে ওয়াগান ব্রেকার। তারপরে ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্ট। সাতজম্মেও আমরা কেউ যাইনি পুব বাংলাতে।

শুনে অবাক হয়েছিল চারণ।

ঐ রকমই।

 পাটনের হাবভাব কথাবার্তা শুনলে কে বলবে যে ও ন-দশ বছর স্টেটসে ছিল। দেশে হা-ভাতে এবং বিদেশে গিয়ে অ্যাফ্লুয়েন্ট প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই দিশি বাঙালিদের মানুষ-প্রজাতির মধ্যেই গণ্য করেন না। সেখানে যাঁরা বিরাট বাড়ি ও ঢাউস গাড়ি নিয়ে গরিব বাঙালি-পাঁঠার মতনই নিরীহ এবং কুপমণ্ডুক দিশি আত্মীয় বন্ধুদের ঈর্ষান্বিত করেন বলে ভাবেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই দেশেই যদি থাকতেন তাহলে হয়তো মাসে পাঁচ হাজার টাকাও রোজগার করতে পারতেন না। টাকার অঙ্কের পরিমাণের উপরেই মানুষের মনুষ্যত্বর দীপ্তি বাড়ে না বরং অনেকক্ষেত্রেই তা জিওমেট্রিক প্রোগ্রেশানে হ্রাসই পায়, এই সরল সত্যটি অনেক এনআরআই-ই কনভিনিয়েন্টলি ভুলে যান।

শ্যামানন্দজি বললেন, গর্ডনকেই উদ্দেশ্য করে, এবার আমরা সকলে মিলে একটু ভজন করি? আজ দিওয়ালির রাত। কী বলুন।

আমাদের তো রোজই দিওয়ালি।

 ভোলানন্দ মহারাজ বললেন, আজ যে সিনিবালি।

তা বটে।

ভজন শুরু করার আগে যদি গর্ডন আর স্টিভেন্স-এর আর কোনও প্রশ্ন থাকে তো তারা করে নিতে পারে। আজ আমি একটু পরেই ধ্যানে বসব। তোমরা অবশ্য এখানেই থাকতে পারো। আমি বাইরে যাব।

স্টিভেন্স বললেন, একটা প্রশ্ন, গোড়ার প্রশ্ন, আমার মন ভোলপাড় করছে বহুদিনই হল কিন্তু কারওকে জিজ্ঞেস করেই স্যাটিসফ্যাক্টরি উত্তর পাইনি আজও।

কী প্রশ্ন?

 ধর্ম কি?

 সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

ভোলানন্দ মহারাজ হিন্দিতে বললেন, ভাল দিনে ভাল প্রশ্নই করেছে স্টিভেন্স। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে তো এক রাতে কুলোবে না। তারপরেও কত রাত কত দিন যে কেটে যাবে কে বলতে পারে।

শ্যামানন্দজি বললেন,

যতহোভদয়-নিঃশ্রেয়স-সিদ্ধিঃ স ধর্ম

 গর্ডন বোধহয় একটু সংস্কৃত জানেন। তাঁর বাঁ কানটা দুবার নড়ে উঠল। কিন্তু শ্লোকটি পুরোপুরিই চারণের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। লজ্জাতে দুকানই লাল হয়ে গেল ওর।

মানেটা বুঝিয়ে দাও শ্যামানন্দজি। ভোলানন্দ বললেন।

হ্যাঁ। তারপর বললেন, ধর্ম যে কি? তা তো এক কথাতে বলা মুশকিল। যে কাজে ইহলোব এবং পরলোকের সুখ নির্বিঘ্ন হয়, ঈশ্বরের সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ, যে পথ ও পন্থাতে চলতে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুখ সমৃদ্ধি লাভ করে এবং যে সব কাজ করলে, পরলোকে সুখের পথের বাধা আসতে পারে, সেই সব কাজ ও পন্থা পরিত্যাগ করে যা-কিছুই ইহলোক এবং পরলোকের মঙ্গলসাধক, তেমন কর্ম করাই মানুষের ধর্ম। তাই ধর্ম।

ঠিক পরিষ্কার হল না।

স্টিভেন্স বললেন।

অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় ধারণাদ্ধমমিত্যাহঃ ধর্মেণ বিধৃতা প্রজাঃ।

এই শ্লোকটির মানে কি?

এবারে চারণ বলল।

শ্যামানন্দজি বললেন, এর মানে হচ্ছে, যা না হলে সংসার চলতে পারে না বা স্থির থাকতে পারে না এবং যা পৃথিবী এবং ব্রহ্মাণ্ডর অন্যান্য সকল লোককে ধারণ করে থাকে, তাই ধর্ম। এবং যা-কিছুই এর বিপরীত অথবা এর বিপরীত ফল উৎপন্ন করে, তাই অধর্ম।

বাঃ।

ভোলানন্দজি স্বগতোক্তি করলেন।

তারপরে ভোলানন্দজি বললেন, রবীন্দ্রনাথ সোজা করে বলেছিলেন এক কথায়, যাহা ধারণ করে তাহাই ধর্ম। A force which binds together.

তারপরই বললেন, কী অবস্থা হল বলুন তো। বিদেশে, বিশেষ করে জার্মানিতে সংস্কৃত চচা হচ্ছে এত, আর স্বদেশেই সেই ভাষার কোনও কদর নেই। শুধু সংস্কৃতই নয়, আরবি এবং ফারসিরও সেই একই অবস্থা। আমরা আমাদের ছেলেবেলাতে দেখেছি যে, অনেক শিক্ষিত বাঙালিই বাংলার উপরে ইংরেজি যেমন জানতেন, তেমন সংস্কৃত ও আরবি অথবা ফারসিও জানতেন। দুই থ্রি-পিস-স্যুট পরা সাহেব, মানে, নেহরু আর জিন্না সাহেব, বিভাজিত দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বনে গিয়ে ফারসি, আরবি আর সংস্কৃতর সর্বনাশ করে দিলেন। অথচ দেখো, ভারতবর্ষ আর পাকিস্তানের মূল সংস্কৃতি, ধর্ম, সামাজিকতা সব কিছুরই গোড়া হচ্ছে ওই সব ভাষাই। উর্দু তো এই সেদিনের ভাষা! খিচুড়ি ভাষা। Commoner-এর ভাষা। অবশ্য খুবই সুললিত ভাষা। কিন্তু মুসলমানেরা নামাজ পড়েন বা মোল্লারা আজান দেন কি উর্দুতে?

চারণ বলল, সে কথা ঠিক। সংস্কৃতর মতন ভাষাও হয় না। কী ঝংকৃত। কী তার সাহিত্য, কাব্য।

পাটন মাঝে পড়ে বলল, আমার এক বন্ধুর বিয়েতে পার্ট-টাইম, গাঁট-কাটা এক পুরুত পুরোহিত-দর্পণ বই দেখে বিয়ের মন্ত্র পড়তে গিয়ে বিয়ের মন্ত্রর বদলে শ্রাদ্ধর মন্ত্র পড়ে দেওয়াতে তাব স্ত্রীর সঙ্গে অনুক্ষণ মারামাবি-কাটাকাটি লেগেই আছে সেই ফুলশয্যার রাত থেকেই। শিগগির হযভো ছাড়াছাড়িই হয়ে যাবে। নেহাতই লোকভয়ের ভয়েই এখনও জুড়ে রয়েছে। কী ব্যাপার একবার ভাবুন তো দেখি!

ভোলানন্দজি হেসে ফেললেন।

শ্যামানন্দজিকে বললেন, দেখছ তো! আমি যা বলে আসছি এতদিন তা ঠিক কি না! সংস্কৃতভাষা থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে টিভি-র হমে শশাচনা হ্যায় মাকা হিন্দির পত্তন করে এত বড় একটা মহান দেশকে তার মূল ধার্মিক, সাহিত্যিক, লৌকিক, সাঙ্গীতিক উৎস থেকে জবরদস্তি করে দূরে সরিয়ে এনে দেশটার সর্বনাশ করে দিলেন ওঁরা।

চারণ অবাক হয়ে ভোলানন্দজির দিকে চেয়ে বলল, আপনি যে এতসব বিষয় নিয়ে ভাবেন এবং নিজেকে উত্তেজিতও করেন তাতে আপনার মনের শান্তি, চিন্তার স্বচ্ছতা বিঘ্নিত ও আলোড়িত হয় না?

ভোলানন্দজি হাসলেন।

 বললেন, মানুষের মন কি আর পানা-পুকুর চারণবাবু? মন হচ্ছে সমুদ্র। তার কত গভীরতা, তার গভীরে কত পাহাড়, রাজপথ, ফুল, জীবজন্তু বাস করে। সমুদ্রের গভীরে কতরকমের তাপ ও শৈত্য, কতরকমের প্রবাহ, প্রস্রবণ, আগ্নেয়গিরি, হিমবাহ। মানুষের মনে যা আঁটে, তা পৃথিবীতেও আঁটে। শান্তি বা মনোসংযোগ যদি একবার আয়ত্ত করে ফেলা যায় তবে কোনও চিন্তাই আর সেই শান্তি এবং মনোসংযোগকে একটুও বিঘ্নিত করতে পারে না।

তাই তো দেখছি।

মুগ্ধ চারণ বলল।

 পরলোক কি সত্যিই আছে?

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকা গর্ডন নামের বিদেশি জিজ্ঞেস করলেন।

মনে হয়, মানুষটি আমেরিকান।

ভোলানন্দ মহারাজ বললেন, ভূলোক ছাড়াও যখন অন্য অনেক লোক আছে তখন পরলোকও আছে। দেবতাশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার সৃষ্ট এই ব্রহ্মাণ্ডর মধ্যে অনেকই লোক আঁটে।

তারপর বললেন, এই তোমরা যাকে বল UNIVERSE আমরা তাকেই বলি ব্রহ্মাণ্ড। অণ্ড মানে EGG। ব্রহ্মাণ্ডর অবয়ব অনেকটা ডিমের মতন তাই তার নাম ব্রহ্মাণ্ড। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ভুবলোক, স্বরলোক, মহালোক এবং ব্রহ্মলোকও আছে। পৃথিবীর চারদিকে ঘিরে আছে সুউচ্চ সব পর্বতমালা, যাদের নাম লোক ও অলোকা। আমাদের শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ-এ আছে মৃত্যুর পরে ব্ৰহ্মরন্ধ্র দিয়ে, দেবতা ইন্দ্র, যাঁর পরলোকে যাওয়ার বাধা আছে তার শরীর আছে বলে, সেই সব বিদেহী আত্মাদের নিরন্তর পরলোকের পথে পাঠান। পৃথিবী আর ব্রহ্মলোকের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে আছে এক মৃদু এবং প্রায় অনুপস্থিত হাওয়া। প্রাণ হচ্ছে একক সত্তা আর হিরণ্যগর্ভ হচ্ছে বহু প্রাণের সমষ্টি। সম্মিলিত প্রাণ। এই পৃথিবী, এই প্রাণ, এই হিরণ্যগর্ভ সবই ব্রহ্মারই মধ্যে লীন।

শ্যামানন্দজি বললেন, মহাভারতে পাণ্ডবদের স্বর্গবাসের কথা আছে। অনেকেরই মতে, স্বর্গ এই পৃথিবীতেই আছে।

ভোলানন্দজি বললেন, ঋগ্বেদে ইলাস্বর্গর কথা আছে। অনেকের ধারণা এই ইলা হচ্ছে চীনদেশের উত্তরভাগের অলতাই পর্বতমালা। স্বর্গ পৃথিবীতেই আছে। পরলোক আর স্বর্গ এক নয়। ওই অঞ্চলে যেসব মানুষের বাস তাঁদের বলে দেব, তাঁদের আবাসস্থলকে বলে দেবভূমি, তাদের ভাষা, সংস্কৃতকে বলে দেবভাষা। আমরা যাঁদের ব্রাহ্মণ বলি, তাঁদের নাম ভূদেব।

শ্যামানন্দজি বললেন, ভাল কাজ করলে মানুষের যে স্বর্গবাস হয়, এই ভাবনার মধ্যে তো কোনও দোষ নেই। এই ভাবনা ভুল হলেও দোষ নেই। আমি অন্তত দোষ দেখি না।

গর্ডন বলল, আর একটু বুঝিয়ে বলুন।

ধর্মবোধ এর সঙ্গে অনাদিকাল থেকেই ভারতের মানুষদের কাছে শুভাশুভ বোধ, ন্যায়-অন্যায় বোধ ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে। কেউ ঈশ্বরকে স্বীকার করলেন কি না (কম্যুনিজম-এর থিওরির মধ্যে আমি কোনও দোষ দেখি না) বা তথাকথিত ভারতীয় ইনটেলেকচুয়ালরা ঈশ্বর বা ধর্ম মানলেন কি না মানলেন, তাতে ভারতের এবং বাংলাদেশের এমন কি পাকিস্তানেরও মূল সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধার্মিক প্রবাহের কিছুমাত্র যায় আসেনি। আসবে না। তবে সর্বধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই যাঁরা প্রকৃত শিক্ষিত তাঁদেরই নিজের নিজের ধর্মর গোঁড়া জনসাধারণের সঠিক পথে চালিত করতে হবে। মুশকিল হচ্ছে এই, গর্ডন যে, তোমাদের সব পশ্চিমী দেশও এখন ভারতীয় ইনটেলেকচুয়ালদেরই মতন ছদ্ম আঁতেলকচুয়ালস-এ ভরে গেছে।

গুরু, ধর্ম, ঈশ্বর, ঈশ্বরবোধ, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী, পরলোক, এই সব ব্যাপার অত্যন্তই গোলমেলে গর্ডন। আজ থাক। পরে হবে। আজ দিওয়ালির দিনে কথা কম বলে, এসো আমরা কৃষ্ণা উলঙ্গিনীর ভজনা করি।

পাটনের সঙ্গেই গুহার ভিতর থেকে বেরোল চারণ। তারপর চাতাল পেরিয়ে ধুনির পাশ কাটিয়ে বাইরে এসে পড়ল। বাইরে আসতেই বুঝতে পারল ঠাণ্ডার বহর। গুহার ভিতরে অনেকে থাকায় মানুষের শরীরের উত্তাপ তত ছিলই, তার উপরে গুহামুখে ধুনি জ্বলাতে ভিতরটা গরমও হয়ে ছিল বেশ।

পাটন বলল, মাথা ধরেনি আপনার চারণদা?

 বাবা। হঠাৎ চারণদা?

নাঃ। পরীক্ষাতে পাশ করিয়ে দিলাম আপনাকে। বাবার স্যার ছিলেন এখন আমার দাদাতে প্রমোশন দিলাম। এবারে বলুন, মাথা গরম হয়েছে কি না?

তা একটু হয়েছে বই কী!

উঃ রিঃ ফাদার। এক সঙ্গে এত জ্ঞান কি সহ্য হয়? গাঁজা খেলেও মাথা এত গরম হয় না। আর ঐ অ্যামেরিকান দুটোও কেমন আদেখলাপনা করছিল লক্ষ করেছেন? ওদের জন্য সিম্পল ইংরেজিতে মোক্ষ মেড ইজি বলে একটা বই লিখব আমি। ভাবছি, সিরিয়াসলি। মোক্ষলাভের জন্য কোনও ট্যাবলেট বানানো গেলেও বানানো যেত। ইনস্ট্যান্ট কফিরই মতন ইনস্ট্যান্ট মোক্ষ। আধ-গেলাস জলের সঙ্গে গিলে ফেললেই বাসস। ও ব্যাটাদের কি অত ধৈর্য আছে যে আমাদের সাধু-সন্নিসীদের কাছ থেকে জ্ঞান নিয়ে মোক্ষলাভ করবে? যারা নিজেরা হাত দিয়ে দাঁত মাজে না, দুছু করে না, গাড়ির গিয়ার চেঞ্জ করে না, গ্যারাজের গেট খোলে না, ঘরের দরজাও, যে মহৎ ও ব্যস্ত মানুষদের সময়ের এতই দাম, তারা করবে এত সময় নষ্ট!

তা করছে বলেই তো মনে হল। চারণ বলল।

ওরা দুজনে করছে। কিন্তু ওরা একসেপশান। একসেপশান প্রভস দ্য রুল। দশ দশটা বছর ওদের মধ্যে থেকে ওই নিজেদের স্বাস্থ্য আর অর্থ-সর্বস্ব মোটা-মাথা, ঘোর তামসিক জাতটা সম্বন্ধে আমার ঘেন্না জন্মে গেছে। সারা পৃথিবীকে অর্থলোভী, মুনাফাসর্বস্ব বিজ্ঞাপনসর্বন্ধ করে তোলার পেছনে ওদের যা অবদান তা বলার নয়। সমস্ত পৃথিবীকেই নষ্ট করে দেওয়ার মূলে ওরা। ওদের বিচার একদিন করবে সারা পৃথিবীর মানুষে।

ওদের নাম কি?

 কাদের?

আরে। ওই যে! ওই অ্যামেরিকানদের।

 একটার নাম রনাল্ড গর্ডন। হুস্টনে বাড়ি। আর অন্যটার নাম জিম স্টিভেন্স, সেটার বাড়ি কেচাম-এ।

কোনজন স্টিভেন্স? দুজনের মধ্যে যে বয়সে বড়?

 না, দেখতেই বড়। কিন্তু গর্ডনটাই ধাড়ি আর স্টিভেন্সটা ছোট।

তাই? তা কেচাপটা কোথায়?

চারণ শুধোল।

কেচাপ নয়, স্যার, থুরি চারণদা, কেচাম। আপনি কি টোম্যাটো কেচাপ ভাবলেন না কি? কেচাম হল গিয়ে আইডাহো স্টেট-এর একটি জায়গা।

আইডাহো! নামটা যেন চেনা চেনা লাগছে।

লাগতেই পারে। আর্নেস্ট হেমিংওয়েতো আইডাহোর কেচাম-এই আত্মহত্যা করেছিলেন।

 পাখি শিকারে গিয়ে। না?

না না। ওঁর বাড়িতেই। আমি দেখে এসেছি সেই বাড়ি।

 ইনকামট্যাক্সওয়ালারা বহতই তংক করেছিল। আইনস্টাইন আর হেমিংওয়ে দুজনেই ইনকামট্যাক্সওয়ালাদের ভীষণই ভয় পেতেন। আর রঙ্গই বটে! চোর বদমাস গাঁটকাটা-স্মাগলার সকলকে বগলের তলা দিয়ে পার করে দিয়ে, ধরত ধর গরীব কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-গায়ককে।

তুমি নিজে গেছ হেমিংওয়র সেই বাড়িতে?

গেছি মানে, ঢুকিনি। বাইরে থেকে দেখেছি। স্কুলে পড়ার সময়ে SNOWS OF KILLIMANZARO…দেখেছিলাম। তখন থেকেই আমি ওঁর ভক্ত।

তারপর বলল, ভারী চমৎকার বাড়ি চারণদা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে। বাড়িটা একটা টিলার উপবে। নীচ দিয়ে সাপের মত এঁকে বেঁকে একটা রূপোলি নদী বয়ে গেছে। তার নামও SNAKE RIVER.

খুব সুন্দর নদী? নামটাও সুন্দর তো!

হ্যাঁ। খুবই সুন্দর।

তারপরে একটু চুপ করে থেকে বলল, তবে ওরা আর অলকানন্দা, মন্দাকিনী, গঙ্গা, ইউওল…কোথায় পাবে বলুন? আমাদের যে দেবভূমি! এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।

তারপরই বলল, স্বগতোক্তির মতন, আশ্চর্য। সারা পৃথিবীর মানুষে এ কথাটা বুঝল, বুঝলাম না শুধু আমরাই!

শুধু নদী আর পর্বতমালা দিয়ে তো একটা দেশ হয় না পাটন। দেশের মানুষ দিয়েই দেশ হয়। মানুষ হিসেবে যে আমরা বড়ই খারাপ হয়ে গেছি। এত মূল্যহ্রাস তো আর কোনও কিছুই হয়নি।

অন্য দেশের মানুষও কি খুব ভাল আছে চারণদা? অন্য কোনও দেশে ভোলানন্দ বা শ্যামানন্দজিদের মতন বেশি মানুষ পাবেন? আপনার অনেক পূর্বজন্মের কৃতি ছিল যে ওঁদের দেখ পেয়েছেন। আপনি যদি গাড্ডুবাবা বা ভোঁদাইবাবার খোঁজ না করতে আসতেন, মানে, আপনার মনে যদি ভোঁদাইবাবা সম্বন্ধে জেনুইন ইন্টারেস্ট না জম্মত, তবে আপনাকে আমি এখানে আনতামই না।

তুমি হৃষীকেশে এসেছিলে কেন? এবারে?

 চারণ জিগ্যেস করল, পাটনকে।

আপনাকেই ঢুঁড়তে।

সত্যি?

সত্যি।

কেন?

 বললামই তো! তাছাড়া স্বামীজিকে আপনার ভোঁদাইবাবা-গাড্ডুবাবা এক্সপিডিশান-এর কথ বলেছিলাম। হেসে গড়াগড়ি গেলেন। তারপর বললেন, লইয়া আয় তারে। দেহি,কোন মালে স্য তৈরি।

কথাবার্তার ফাঁকে হঠাৎ মাথার উপরে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল চারণ।

কী হল? খুব ঠাণ্ডা লাগছে না কি? এখনই কী! সবে তো দীপাবলী এল। জানুয়ারির শেষ অবধি শনৈঃ শনৈঃ এগোন তবে তো বুঝবেন ঠাণ্ডা কাকে বলে! তবে এসব জায়গাতে আপনা মস্তিষ্ক সবসময়ে এমনই সজাগ থাকে, এমনই চিন্তাক্লিষ্ট যে আপনার মস্তিষ্কর আগুনই আপনা শরীরে ওম ধরাবে। শীত-গ্রীষ্মের বোধই চলে যাবে। আগুন পোড়ায় শরীরকে, চিন্তা পোড়া মনকে।

চারণের ভীমগিরি মহারাজের কথা মনে পড়ে গেল।

না। সেজন্যে নয়। মানে, শীত লাগছে বলে নয়। তারা দেখছি। হৃষীকেশ-এও আকাশ পরিষ্কারই ছিল। কিন্তু এমন নয়! সত্যিই বোধহয় এসব দেবভূমিই।

হৃষীকেশে প্রতিদিন কয়েক হাজার ভটভটিয়া ডিজেলের কালো ধোঁয়া আর কান-ফাটানে আওয়াজ তুলে যাওয়া-আসা করে হরিদ্বার থেকে। সকাল থেকে রাত নটা দশটা অবধি। সেখানেও পলুশান আছে। রামঝুলা-লছমনঝুলা পেরিয়ে আসার পরই শুধু সেসবের হাত থেকে বাঁচোয়া!

মন্ত্রমুগ্ধর মতন চারণ স্বগতোক্তি করল, এত তারা।

বুকের মধ্যে গুনগুন করে উঠল সেই গানটা।

জয়িতা ভারী ভাল গাইত।

 আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নিজ্বলে।
 নিদ্রাবিহীন গগনতলে।
ওই আলোক-মাতাল স্বর্গসভার মহাজন
হোথায় ছিল কোন যুগে মোর নিমন্ত্রণ ॥

হ্যাঁ চারণদা। একেই বলে ব্রহ্মাণ্ড। দ্য উনিভার্স। কে যে একে ধারণ পালন করছেন, কে যে যুগযুগান্ত ধরে এদের আবর্তিত করছেন, লক্ষ লক্ষ প্রজাতির ফুলের গায়ে, পাখির গায়ে, প্রজাপতির গায়ে, তুলি বুলিয়ে এমন বিচিত্রারঙা করেছেন তাদের প্রত্যেককে, তাদের প্রত্যেকের গলাতে আলাদা আলাদা গান দিয়েছেন, ছন্দ দিয়েছেন, ওড়ার ঋতি দিয়েছেন, চলার, এ এক আশ্চর্য কাণ্ডমাণ্ড চারণদা!

তারপর একটু থেমে বলল, ভাবলেও আমার গা শিউরে ওঠে বিস্ময়ে।

 সাধে কি আর গর্ডন, হুস্টনের NASA থেকে এখানে এসে আছে! এখন NAUSEA-র সঙ্গে NASA-কে নাসা করে উগরে দিয়েছে পুরোপুরি। রকেট উৎক্ষেপণ করে আর ব্রহ্মাণ্ডর মধ্যে সাঁতরে বেড়াবার জন্যে কিছু ছারপোকার মতন স্যাটালাইট ছেড়ে দিয়ে ইমিটেশান জুয়েলারিরই মতন নিজেদের ইমিটেশান-ব্রহ্মা মনে করে গর্বে আর শ্লাঘাতে বেঁচে না থেকে তাইতো ORIGINAL MR ব্রহ্মার খোঁজে চলে এসেছে সে স্বামীজির পায়ে পায়ে।

তারপর বলল, রনান্ড গর্ডন কত বড়লোক পরিবারের ছেলে জানেন? ট্ৰিলিনিয়র বললেও ওর বাবা মিকি গর্ডনকে কিছুই বলা হয় না। আর রনাল্ডই একমাত্র সন্তান ওদের মা বাবার। তবে বাঙালি মাবাবা তো নন! তাদের নিজেদের জীবন আছে বাঁচা-মরার জন্যে। ছেলের দুঃখে কেঁদে কেঁদে রুমাল ভেজাননি তাঁরা। তবে গত ক্রিসমাসের সময় রনাল্ডকে দেখতে এসেছিলেন ওঁরা দুজনে। মানে একমাত্র সন্তানের বকে-যাওয়ার রকম সম্বন্ধে সরেজমিনে তদন্ত করতে। এই আশ্রমেও এসেছিলেন।

কী করলেন? কান্নাকাটি?

তা নয় দাদা। উলটে এতই অভিভূত হয়ে গেছিলেন যে, তা বলার নয়। স্বামীজীকে BLANK CHEQUE-ও দিয়েছিলেন সই করে একটা। বলেছিলেন, সাত অঙ্ক আট অঙ্ক যা খুশি অঙ্ক বসিয়ে নিতে।

কী করলেন উনি?

স্বামীজি ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, ইচ্ছে করলে কিছু টাকা কালিকমলি বাবার আশ্রমে দিয়ে দিন অথবা ভারত সেবাশ্রম সঙেঘ। ওঁরা সত্যিই ভাল কাজ করেন। আমি নিয়ে কী করব? আমি তো কারও সেবা করি না। আর নিজের টাকার প্রয়োজন, শুধু টাকাই বা কেন, অন্য সব কিছু জাগতিক জিনিসের প্রয়োজনই আমার মিটে গেছে।

বনান্ডের বাবা বলেছিলেন, আমার ছেলেকে আশীর্বাদ করুন স্বামীজি, বড়লোক হওয়ার আশীর্বাদ নয়, বড় মানুষ হওয়ার আশীর্বাদ। টাকার সাধনাতেই তো আমরা ঝুঁদ হয়ে আছি। সাফল্য আর টাকা SYNONYMUS হয়ে গেছে আমাদের কাছে। আমাদের ছেলে টাকাকে কাগজ মনে করার সাফল্য অর্জন করুক। তাই হবে তার দিগ্বিজয়। আমরা জল খেতে আসা হাতিরই মতন কাদাতে আটকে গেছি। আমাদের না জলে যাওয়া হল, না হল বাঁচা, মানে, বাঁচার মতন বাঁচা।

চারণ জিজ্ঞেস করল, শুধুই কালি কমলি বাবা আর ভারত সেবাশ্রম কেন, রামকৃষ্ণ মিশনের নাম বললেন না কেন ভোলানন্দজি?

রামকৃষ্ণ মিশন তো কোটিপতি।

পাটন বলল। তারপর বলল, তেলা মাথাতে তেল ঢালা হবে ভেবেছিলেন হয়তো। তাছাড়া, কথাবাতাতে বুঝেছি যে, উনি রামকৃষ্ণ মিশনের TOP HEAVY ব্যাপার-স্যাপার বোধহয় বিশেষ পছন্দ করেন না। তাছাড়া, একদিন শ্যামানন্দজির সঙ্গে আলোচনা করতেও শুনেছিলাম স্বামীজিকে যে, অনেকই দিন হল রামকৃষ্ণ মিশন হিন্দুধর্মের প্রচার আর প্রসারের চেয়ে সাংস্কৃতিক ব্যাপার-স্যাপারের দিকেই নাকি বেশি ঝুঁকেছেন। POMP AND SPLENDOUR-এর দিকে। তাঁদের ধর্মনিরপেক্ষতাটা এমনই এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, যেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হিন্দুধর্মের নাকি এখন আর বিশেষ যোগই নেই। অথচ হিন্দুধর্মের প্রচার ও প্রসারেরই জন্য ওই মিশনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একদিন।

সত্যি?

আমি কী করে জানব? স্বামীজি এবং শ্যামানন্দজিরই মতামত এসব।

ওঁরা ভ্রান্তও তো হতে পারেন।

চারণ বলল।

হতেও পারেন। নিজেদের অভ্রান্ত বলে দাবি তো ওঁরা কখনওই করেন না। আমি দুদিনের চিড়িয়া কতটুকুই বা জানি! অত বেশি জ্ঞানগম্মি হলে আমার মাথা চুঁইয়ে বাইরে গড়িয়ে পড়ে যাবে যে। ছুছুরকা শরপর চামেলিকা তেল-এর মতন আনওয়ানটেড সিচুয়েশান হবে।

চারণ মুগ্ধ গলাতে বলল, বাঃ দ্যাখো! দ্যাখো। ওই গাছগুলোকে তারার আলোতেও কী সুন্দর দেখাচ্ছে। না?

হ্যাঁ। ওগুলো তো সিলভার-ওক। দেখাবেই তো! আর পূর্ণিমার রাতে যা দেখায় না!

একটু বসি এখানে পাথরে। একটু আকাশ দেখি পাটন। তোমার আপত্তি আছে? আহা! মনটা জুড়িয়ে গেল যেন।

আপনি তারা চেনেন?

পাটন জিজ্ঞেস করল।

 কিছু কিছু চিনি। একটা সময়ে প্ল্যানেটোরিয়াম-এ নিয়মিত যেতাম। আমাদের কলকাতার কলেজের অবসার্ভেটরির টেলিস্কোপও বিখ্যাত ছিল।

কোন কলেজে পড়তেন আপনি?

 সেইন্ট জেভিয়ার্স।

তাই? আমিও তো ওই কলেজেরই ছাত্র। তাহলে আমরা দুজনেই জ্যাভেরিয়ানস!

বলেই বলল, আপনি তারাদের ভারতীয় নাম জানেন? ভারতীয়রা যে সময়ে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করেছিলেন এবং আমাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যা কিছু আবিষ্কার করেছিলেন সে-সম্বন্ধে পশ্চিমীরা কিছুই জানে না। দুশো বছর পরাধীন থাকাতেই ইংরেজদের দেওয়া চশমা পরে সবই ইংরেজিতে পড়েছি, জেনেছি। নিজেদের কোনও কিছু সম্বন্ধেই আমরা সচেতন বা অবহিত ছিলাম না। বিশেষ করে বাঙালিরা। খুবই লজ্জার কথা। আর ইংরেজ তাড়িয়ে স্বাধীন হওয়ার পরে, বিলিতি পোশাক, বিলিতি পণ্য পুড়িয়ে, তারা নিষ্ক্রান্ত হবার পরে দাঁতে দাঁত চেপে পুরোদস্তুর সাহেব হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।

তারপর বলল, একটা কথা কি লক্ষ করেছেন চারণদা? স্বাধীনতা আসার পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের একটা NATIONAL IDENTITY ডেভলাপ করল না, ভারতীয় বলে আমরা এখনও পরিচয় দিতে দ্বিধা বোধ করি। আমরা এখনও বাঙালি, বিহারি, অসমিয়া, ওড়িয়া বা পাঞ্জাবি মাড়োয়ারিই রয়ে গেলাম। ভারতীয় হয়ে উঠতে পারলাম না।

তা ঠিক। চারণ বলল।

ওই স্তব্ধ শীতার্ত অন্ধকারের মধ্যে বসে মাথার উপরের তারা-ভরা আকাশের দিকে এবং নদীপথের সিনিবালি দীপাবলীর রাতের দীপান্বিতা দেবপ্রয়োগের দিকে চেয়ে চারণের মনে এক আশ্চর্য মুগ্ধতা এসেছিল। কথা, কোনওরকম কথাই ভাল লাগছে না ওর। এ মুগ্ধতা, অনুষঙ্গর মুগ্ধতা। স্থান-মাহাত্ম্য।

একটা বড় পাথরের উপরে বসল ওরা পাশাপাশি। শিশিরে বৃষ্টির জলের মতন ভিজে ছিল পাথরটি। শিবালিক পর্বতমালার গা থেকে রাতের গন্ধ উঠছে। হাওয়াতে আন্দোলিত হওয়া পার্বত্য গাছ-গাছালি, আর ঘাসে, সেই গন্ধ। নাম-না-জানা রাতচরা পাখির আর পাহাড়ি ঝিঁঝির ডাক এবং অনেক নীচের অলকানন্দার শব্দ সেই নিস্তব্ধতার গাম্ভীর্য ছিদ্রিত করছিল শুধু। কত হাজার বছর ধরে হাওয়া, এই নদী, দুই সুউচ্চ গিরির মধ্যবর্তী খাদ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, কে জানে তা!

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল ওরা পাশাপাশি। নৈঃশব্দ্যর মতন শব্দময়তা যে আর নেই সেই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে বুঝল চারণ আবার। ভীমগিরি মহারাজের কথা হঠাৎই মনে পড়ল ওর। পড়তেই, মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরক্ষণেই মনে হল, এসব বৈকল্য তো গৃহীদেরই মানায়। সষিসী হবার যার সাধ আছে, তার তো অন্য সন্নিসীর জন্যও মন খারাপ হওয়ার কথা নয়।  

অনেকক্ষণ পরে চারণ বলল, তুমি তারাদের সংস্কৃত নাম জানো কি পাটন?

 পাটন বলল, সব তারাদের দিশি নাম তো জানি না তবে কিছু কিছু জানি।

চিনিয়ে দাও তো আমাকে। আমি জানি কিছু ইংরেজি নামই। তাও সামান্যই।

বলেই, উপরে মুখ করে সোজা হয়ে বসল চারণ।

 পাটন ওর পাশে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, এটা কার্তিক মাস তো?

হ্যাঁ। এ বছরে পুজো তো একেবারে শেষে ছিল আশ্বিনের। তাই না?

তারপরই পাটন স্বগতোক্তি করল, কী লজ্জার কথা। আমরা আমাদের দিশি ক্যালেন্ডারের খোঁজ পর্যন্ত রাখি না আজকাল। আমার এক পিসতুতো দিদির সাত বছরের ছেলে, লা মাটিনিয়রে পড়ে, সেদিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, একলা বৈশাখটা আর দুইরা জ্যৈষ্ঠটা কি ব্যাপার বলো তো গো পাটু মামা!

শুনুন কথা।

একলা বৈশাখ মানে?

আরে পয়লা বৈশাখকে ১লা বৈশাখ আর দোসরাকে ২রা লেখে না বাংলায়?

চারণ হো হো করে হেসে উঠল।

.

একটু পরে চারণ বলল, তবে এটা মানতেই হবে যে, এসব জায়গাতে সত্যিই ভারতীয়ত্ব এখনও পুরোপুরি বেঁচে। সব ব্যাপারেই। দেখলেও ভাল লাগে। জওহরলাল নেহরু ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া লিখেছিলেন। আমিও ভাবছি একটি বই লিখব। তার নাম দেব ভেরি বিলেটেড ডিসকভারি অফ মাই মাদার ল্যান্ড।

পাটন বলল, উত্তরে তাকান, উপরে। দেখুন। ওই যে ধ্রুবতারা। উ্য কান্ট মিস ইট।

 তারপরই বলল, জানেন, প্রত্যেকটি তারার দিশি নাম শিখে নিয়েছে জিম।

জিম কে?

আরে জিম স্টিভেন্স। ওর সাবজেক্টই তো ছিল অ্যাস্ট্রনমি। ইংরিজি নাম তো সব ও জানতই। এখানে আসার পরে হামলে পড়ে সব সংস্কৃত বা ভারতীয় নামগুলি শিখে নিয়েছে। খুব পছন্দ ওর নামগুলো। প্রায়ই বলে, কী সুন্দর সব নাম। কী রোম্যান্টিক। গায়ে কাঁটা দেয়।

আরে বলই না নামগুলো। কেবলই যে এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছ তুমি।

হ্যাঁ জানি। আই হ্যাভ আ গ্রাসহপার মাইন্ড।

বলেই বলল, ওই দেখুন ধ্রুবতারার নীচে একগুচ্ছ তারা। দেখতে পাচ্ছেন? আ ক্লাস্টার। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত। সাতটা তারা। দেখতে পাচ্ছেন? ওই হল গিয়ে শিশুমার। তারপরে পূবে দেখুন। দেখছেন? উত্তর-পূবে অ্যাবাউট টেন-ও-ক্লক এ একটি একলা তারা দেখতে পাচ্ছেন? তার নাম ব্ৰহ্মহৃদয়।

কি নাম বললে?

 ব্রহ্মহৃদয়।

বাঃ।

তারপর দেখুন। উত্তর-পশ্চিমে অ্যাবাউট টু-থার্টিতে, অভিজিৎ। ব্রহ্মহৃদয় আর অভিজিৎ-এর পায়ের তলায় পুং থেকে পশ্চিমে টেন-ও-ক্লক থেকে ফোর-ও-ক্লক এর মধ্যে রয়ে গেছে একটি ছায়াপথ।

নাম কি?

জানতাম কিন্তু, ভুলে গেছি।

তারপরে বলল, এরপবে পূব থেকে পশ্চিমে দেখুন। আগে তাকান উত্তর পুবে, একেবারে দিগন্তের দিকে।

রাতে কি দিগন্ত দেখা যায় নাকি?

চারণ বলল।

কী যে বলেন না চারণ দা! দিক থাকলেই দিগন্ত থাকবে। তার রাত আর দিন কি?

তা বলছি না। এই পার্বত্য জায়গাতে কি দিনেও দিগন্ত দেখা যায়? এ তো আর মরুভূমি বা সমুদ্র নয়, কী প্রেইরি বা সাভান্নাই ল্যাভস!

তা অবশ্য ঠিক। তবে আপনার দিগন্ত দেখার দরকাটাই বা কি? দেখছেন তো তারাই। দিগন্তে গিয়ে হোঁচট খাবার কোনও দরকার তো নেই। তারারা তো গরু-ছাগল নয় যে দিগন্তে দাঁড়িয়ে বসে ঘাস খাচ্ছে বা জাবর কাটছে। দিগন্তের দিকেই দেখতে বলেছি আমি আপনাকে, দিগন্তে নয়।

বলল এবারে।

চারণ বলল। এত কথা ভাল লাগছিল না ওর।

দেখুন। একেবারে পুবে আছে কৃত্তিকা, ক্রান্তিবৃত্তর একটু উপরের দিকে। কৃত্তিকার বাঁদিকে, একটু নিচেই বৃষরাশি।

জ্যোতিষীরা যেসব রাশিটাশির কথা বলেন তা কি এইসব তারাদেরই কথা?

ইয়েস স্যার। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি তাহাদের কথা দেখতে দৌড়লেন আর তারাদের কথা শোনার সময় পেলেন না? সত্যই সেলুকাস। কী বিচিত্র দ্যাশ এই ভারতবর্ষ।

তারপরে বল। আবারও উড়লে তুমি অন্য গ্রহের দিকে। আশ্চর্য ছটফটে মানুষ তুমি। তোমাকে নিয়ে সত্যিই পারা যায় না।

হাঃ। আমার জন্মদাতা খসসর-চূড়ামণি বাপ পারল না, শিক্ষাদাতা পাল-পাল গুরুরা পারলেন না, আর আপনি যে পারবেন তা ভাবলেন কী করে!

বলো।

হ্যাঁ। ওই দেখুন বৃষরাশির ডানদিকে, প্রায় প্যারালালে, অশ্বিনী। অশ্বিনীর উপরে মেষরাশি। কি? পাচ্ছেন দেখতে?

দাঁড়াও। দাঁড়াও। অত হড়বড় করলে কি হয়!

তবে এই দাঁড়ালাম।

বলল পাটন, দেখুন অশ্বিনীর প্রায় প্যারালালে, তবে ডানদিকে, মীনরাশি। MEAN রাশি নয় কিন্তু। মীন মানে সংস্কৃতে মাছ তা জানেন তো? মহামুশকিলেই পড়লাম এই কালো সাহেবকে নিয়ে। সাদা সাহেবরা ফটাফট শিখে ফেলল, দেশ কুলের যত কুলাঙ্গার সব আমারই ঘাড়ে এসে পড়ে! ছিঃ!

একটু চুপ করে থেকে বলল পাটন, মীন রাশির প্রায় পায়ের কাছে রেবতী। রেবতীর ডানদিকে শতভিষা, নিচে কুম্ভরাশি, ডানদিকে শ্রবণা। শতভিষার নিচে এবং পশ্চিমে মকররাশি। তার পশ্চিম-উত্তরে উত্তরআষাঢ়া।

তারপরই বলল, ও চারণদা দেখুন! দেখাতে ভুলে গেছিলাম, কুম্ভরাশির পশ্চিমে এবং একটু নীচে মকররাশি। উত্তর আষাঢ়ারার নীচে এবং পুবে বৃশ্চিকরাশি এবং পশ্চিমে মূলা।

কী সব মূলা, তুলা, বৃশ্চিক, মকর ইত্যাদির নামই শুধু বলছ, তারাদের সেইসব সুন্দর নামগুলো সব কোথায় গেল?

যায়নি কোথাওই। এক একটি CLUSTER-এর মধ্যে বহুতই তারা আছে।

যেমন?

যেমন ক্রতু, মরীচি, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা এবং বশিষ্ঠ। এরা হলেন সাত ঋষি। জানে তো? এঁদের স্ত্রীদের নাম হল সম্ভূতি, অনসূয়া, ক্ষমা, প্রীতি, সন্নতি, অরুন্ধতী এবং লজ্জা। রেসপেক্টিভলি।

লজ্জা কি তারার নাম?

শুধু তারাই নয়। ঋষিপত্নীও বটেন তিনি।

তারপর?

তারওপর যদি এই গপ্পেদের’র দেশের একটি গল্প শুনতে চান, তা তাও বলতে পারি।

আমার আর কাজ কি? এখানে তো অকাজ করতেই আসা! কাজ তো এতদিন অনেকই করলাম। বাকি জীবনটা এবারে অকাজই করব।

ফাস কেলাস।

 পাটন বলল।

 তারপর বলল, গল্পটা কি?

আমি গুরুমারা কাজ কখনও করি না। অন্য কারও কৃতিত্ব নিজের বলে চালাই না। চালাইনি কোনওদিনই। এই গল্পটি, ভুলভাল হয়ে যাবে হয়তো এতদিন পরে বলতে বসে। অনেকদিন আগে পড়েছিলাম অরূপরতন ভট্টাচার্য মশায়ের আকাশ চেনো বইয়েতে।

কে তিনি? জ্যোতির্বিদ?

তা বলতে পারব না। শুনেছি যে অধ্যাপক এবং শান্তিনিকেতনবাসী।

 কোন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন? জ্যোতির্বিদ্যা?

তাও জানি না। সম্ভবত নয়। বঙ্গভূমে তো ঋষিরা গোস্ত-বিরিয়ানি খায় আর মোচলমান কসাই একাদশী পালন করে। অরূপরতনবাবু বাংলার বা ইংরেজির অধ্যাপক হওয়াটাই মোস্ট ব্যাবল। ক্ষণজন্মাদের রাজ্য তো আমাদের। তবে যে বিষয়েই অধ্যাপনা করুন না কেন, একথা বলতেই হবে যে, সহজ ভাষায় ছোটদের জন্যে একটি চমৎকার বই লিখেছেন। ছোটরা এবং তাদের মাবাবারাও সমান উপকৃত হবে ওই বই পড়ে।

পাবলিশার কে?

দেজ পাবলিশিং। কলকাতার।

ও। তা গল্পটা বলো এবারে।

শোনেননি? কোষকুষি থেকে যজ্ঞে ঘি ছিটোবার সময়ে পুরোহিতরা বলেন ওঁ স্বাহা! ওঁ স্বাহা। তা কি অগ্নিদেবকে তাঁর স্ত্রীর দ্বারা উজ্জীবিত করার জন্য?

তা জানি না। যত উদ্ভট প্রশ্ন।

চারণ বলল।

 শাস্ত্রে আছে, অগ্নিদেব একা, তাঁর পরিবার পরিজন কেউ নেই, তিনি আকাশে আপন মনে ঘুরে বেড়ান। হঠাৎ একদিন আকাশে তিনি সপ্তর্ষির সাত স্ত্রীকে দেখতে পেলেন। ভাবলেন, এঁদের বিয়ে করতে পারলে বেশ হয়। সেই মতন তিনি প্রস্তাব পাঠালেন ঋষিপত্নীদের কাছে।

কিন্তু ঋষিপত্নীরা বড় বড় ঋষির স্ত্রী, তাঁরা রাজি হলেন না অগ্নিদেবের কথায়।

ভয়ানক অপমানিত হয়ে তখন লজ্জায় প্রাণত্যাগের জন্যে গভীর জঙ্গলে বসে অগ্নিদেব কঠিন ধ্যান করতে লাগলেন।

দক্ষের এক কন্যার নাম স্বাহা। তিনি আকাশ থেকে অগ্নিদেবের এই কাণ্ড দেখে দুঃখ পেলেন, তাঁব মনে দয়াও হল। কিন্তু কি করতে পারেন তিনি? স্বাহার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। নিজের চেহারা বদলে অঙ্গিরার স্ত্রী শিবার রূপ ধরে অগ্নিদেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

স্বাহাকে পেয়ে তো অগ্নিদেব খুবই খুশি। তিনি স্বাহাকে বিয়ে করলেন আর সেই থেকে স্বাহা হয়ে গেলেন অগ্নিদেবের স্ত্রী।

দিন কাটতে লাগল।

সপ্তর্ষির অন্যান্য স্ত্রীদেরও পাবার গোঁ অগ্নিদেবের কিন্তু গেল না। ঋষিদের ঝোঁক যখন চাপে তখন তা মানুষের ঝোঁকের উপর দিয়ে যায়।

স্বাহা কি করেন! একে অঙ্গিরার স্ত্রী শিবার রূপ ধারণ করে তিনি অন্যায় করেছেন। তার উপরে অন্যান্য ঋষিপত্নীদের রূপ ধরতে তাঁর আর ইচ্ছে করল না। স্বাহা ঠিক করলেন পাখি হয়ে তিনি বাইবেই উড়ে যাবেন। তাই সবচেয়ে ভাল হবে। করলেনও তাই। স্বাহা পাখি হয়ে বনের বাইরেই উড়ে গিয়ে এক পাহাড়ের চুড়োয় বাসা বাঁধলেন।

কিন্তু অগ্নিদেবকে ছেড়ে স্বাহার বেশিদিন থাকা হল না। স্বাহা নেই, অগিদে অস্থির, দিশেহারা। অগ্নিদেবের সেই অবস্থা দেখে ফিরে এলেন স্বাহা।

আগে স্বাহা শুধু অজিরার স্ত্রী শিবার রূপই ধরেছিলেন। এখন তিনি হয় ঋষিপত্নীর রূপ ধরে অগ্নিদেবকে তুষ্ট করতে লাগলেন। সকলের রূপই ধরলেন। কিন্তু ধরলে কী হয়, বশিষ্ঠের স্ত্রী অরুন্ধতীর রূপ তিনি ধরতে পারলেন না। বশিষ্ঠ যেমন মহাজ্ঞানী ও তপস্বী ছিলেন, অরুন্ধতীও ছিলেন ঠিক সেইরকম মহাবিদূষী ও তাপসী। ফলে, অরুন্ধতীর রূপ ধরতে স্বাহা সাহসই পেলেন না।

দিন কাটতে লাগল। স্বাহা একটি পুত্রের মা হলেন। অদ্ভুত দেখতে ছেলেটি। ছেলেটিকে কিন্তু তিনি অগ্নিদেবের কাছে রাখলেন না। যে পাহাড়ে স্বাহা পাখি হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই পাহাড়েরই একটি গুহাতে ছেলেটি বড় হতে লাগল। তার নাম রাখলেন স্বাহা, স্কন্দ।

এদিকে কেলেঙ্কারি হল। সপ্তর্ষির ছয় ঋষিই শুনতে পেলেন যে, তাঁদের স্ত্রীরা অগ্নিদেবের দাসী হয়েছেন। খুবই রুষ্ট হলেন ঋষিরা। কী, এত বড় সাহস! আমাদের স্ত্রীরা করবেন দাসীপনা।

তাঁরা স্ত্রীদের খুবই ভর্ৎসনা করলেন আর বললেন, যাও, আমাদের সঙ্গে আর তোমরা থাকতে পারবে না।

বেচারি, অসহায় ঋষিপত্নীরা! তাঁদের আর কোথাওই থাকবার জায়গা নেই।

তাঁরা সকলে স্বাহার ছেলে স্কন্দের কাছে এসে সব বললেন। স্কন্দ বলল, চিন্তার কি আছে! আকাশে ছটি তারা হয়ে একসঙ্গে আপনারা থাকুন। তাঁরা তাই থাকলেন। ঐ দেখুন। কৃত্তিকায় চোখে দেখা যায় যে ছটি তারকা, ওই ছটি তারকাই ছয় ঋষিরই ছয় স্ত্রী।

আর অরুন্ধতী?

 তিনি রইলেন বশিষ্ঠের সঙ্গে সপ্তর্ষি তারকামণ্ডলে।

বৃষরাশির ওই যে উজ্জ্বল তারা রোহিণী ওটি শুধু একটি তারা নয়।

কৃত্তিকার তারারা তো ছিলেন ঋষিপত্নী। আর রোহিণী?

রোহিণী ছিলেন চাঁদের পত্নী।

 চাঁদের নাকি অনেকই বৌ? শুনেছিলাম।

চারণ বলল।

ঠিকই শুনেছেন। কোনও পুরুষ ভাগ্যবান হলে অন্যের বুক তো ফাটেই।

তারপর পাটন বলল, প্রজাপতি দক্ষ, তাঁর ছিল সাতাশটি কন্যা। দক্ষ, তাঁর সবকটি মেয়েকেই চাঁদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। চাঁদ যেমন রূপবান, চাঁদের পত্নীরাও ছিলেন তেমনই সুন্দরী। কিন্তু রোহিণীর মতন এমন সুন্দরী আর কেউই ছিলেন না। চাঁদ তাই রোহিণীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। চাঁদের প্রত্যেক স্ত্রীর নামগুলি সত্যিই ভারি সুন্দর।

যেমন?

যেমন, অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তর ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্ব আষাঢ়া, উত্তর আষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্ব ভাদ্রপদা, উত্তর ভাদ্রপদা এবং রেবতী।

বাবাঃ। চাঁদ এতো বউয়ের নাম মনে রাখতেন কী করে।

চাঁদের স্ত্রীরা কিন্তু সকলেই আকাশের নক্ষত্র। এক একটি নক্ষত্রে সাধারণভাবে একের চেয়ে বেশি তারা আছে, রোহিণীতেও তাই। রোহিণী নক্ষত্রে আছে পাঁচটি তারা। প্রতিটি নক্ষত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটিকে প্রাচীন কালের জ্যোতিষীরা বলতেন যোগতারা। আর নক্ষত্রের নামে সেটিরও নামকরণ করতেন। তাই যে-তারাটিকে রোহিণী বলা হয়, সেটিও আসলে রোহিণী নক্ষত্র নয়, ওটি হল রোহিণী নক্ষত্রের যোগতারা। আর রোহিণী নামেই তার পরিচয়।

তাই?

হ্যাঁ। কৃত্তিকার নাম যোগতারা। নাম ALCYONE, স্টিভেন্স শিখিয়েছে আমাকে। তার নামও কৃত্তিকা। আর্দ্রায় একটিই তারা। ফলে তার যোগতারা আর নক্ষত্রের একই নাম, একই পরিচয়।

পাটন তারপরে বলল, আকাশে চাঁদের স্ত্রীরা চাঁদের কক্ষপথে এমনইভাবে সমান দূরে আছে যে মনে হয় যেন চাঁদ একদিন করে একএক স্ত্রীকে দেখা দিয়ে প্রায় সাতাশ দিনে আকাশকে চক্র দিয়ে আসেন।

বাঃ। কত কি জানবার শোনবার আছে, না?

চারণ বলল, পাটনের চন্দ্ৰচর্চা শেষ হলে।

আছেই তো! তবে এবারে ওঠো। চলল। আজ দেবপ্রয়াগের দিওয়ালির রাতে দীপজালানো বাড়ি ঘর দোকান-পাট ঘেরা পথে পথে ঘুরে বেড়াই।

পাটন বলল, আজ কেন জানি না, খুব পুরী-হালুয়া খেতে ইচ্ছে করছে গরম গরম। সঙ্গে একটু রাবড়িও।

 চলো।

বলল, চারণ।

বলেই উঠল সেই শিলাসন ছেড়ে।

আরও একটা জিনিস খেতে ইচ্ছে করছে।

আপনার করছে না?

কি? আগে বলুন, করছে কি না।

আরে। জিনিসটা কি তা বলবে তো?

চন্দ্রবদনী।

বলেই, পাটন চুপ করে গেল।

ঝুলোনো ব্রিজের উপর দিয়ে অলকানন্দা পেরিয়ে দেবপ্রয়াগে গিয়ে যখন ওরা ঢুকল তখন দেবপ্রয়াগের চেহারাটাই পালটে গেল। দূর থেকে যে-কোনও জায়গাকেই, বিশেষ করে উঁচু জায়গা থেকে, একরকম মনে হয়, আর সেই জায়গার অভ্যন্তরে পৌঁছলে একেবারেই অন্যরকম। স্থান বা জায়গারই মতন হয়তো মানুষের বেলাতেও এই একই কথা খাটে।

ঘরে ঘরে ঘণ্টা বাজছে, মন্ত্রেচ্চারণ করা হচ্ছে, প্রদীপ জ্বলছে। ধূপ ধুনোর গন্ধ ভাসছে বাতাসে। ভারী সুন্দর লাগছে দেখতে। নিজেদের কোনওরকম চেষ্টা ব্যতিরেকেই এই আলোকিত, পবিত্র পার্বত্যগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল যেন ও। এমনই মনে হচ্ছে চারণের।

রাওয়ালদের বাড়িতে যাবেন নাকি?

কেন?

বাঃ! চন্দ্রবদনীকে দেখতে। আমার কোনও কেস নেই চারণদা! আমি ওয়াক-ওভার দিচ্ছি।

চারণ হাসল। তারপর বলল, তোমার সঙ্গে কি পরিচয় আছে?

এখুনি পৌঁছে দিয়ে এলাম তো চন্দ্রবদনীকে। এইটুকুই তো যথেষ্ট পরিচয়।

তারপর বলল, পাটন যেখানে সূঁচ হয়ে ঢোকে, সেখানেই ফাল হয়ে বেরোয়।

এই গুণ তোমার বাবারও ছিল।

সেই শালার কোনও গুণই ছিল না! কার সঙ্গে কার তুলনা!

তারপর বল, এখন বলুন, যাবেন কি না!

বয়সের এবং অন্য নানা ব্যবধান ভেঙে বলল, থ্যাঙ্ক উ্য। বাট, নো।

 বলেই বলল, কিন্তু মেয়েটি কে? মানে, চন্দ্রবদনী?

অত সহজেই কি চন্দ্রবদনী কে তা জানা যাবে চারণদা? এ তো আর অ্যামেরিকান মেয়ে নয়। সে যে ভারতীয়। সে-বেটিদের বুঝতে মোটামুটি একটি ডেট পেলেই যথেষ্ট। দিশি মেয়েরা তো এই অলকানন্দারই মতন গভীর। বোঝা অত সহজ নয়।

আরে বোঝার কথা কে বলছে? সে কে? শুধু তাই তো জানতে চাইছি।

সব আমি জানি না। শনৈঃ শনৈঃ জানা যাবে হয়তো। তবে এটুকু জেনেছি যে, চন্দ্রবদনীর মা বাঙালি। শান্তিনিকেতনে পড়াশুনো করেছেন। সংগীতভবনের ডিগ্রিও ছিল। ওয়াঝালকার সাহেব এবং সাবিত্রী দেবী কৃষ্ণানের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী ছিলেন না কি।

আর বাবা?

বাবা হচ্ছেন গাড়োয়ালি। আর্মির ফুল কর্নেল ছিলেন। চন্দ্রবদনীর মায়ের পরিবার দিল্লি প্রবাসী। বাবা রুদ্রপ্রয়াগের মানুষ।

চন্দ্রবদনীর বয়স যখন আট কী নয়, তখন তার মা এক অ্যামেরিকান বিজনেস টাইকুন-এর সঙ্গে চলে যান স্টেটস-এ।

আবার আমেরিকা!

 চারণ বলল, স্বগতোক্তির মতন।

ইয়েস।

চন্দ্রবদনী কি এখন পার্মানেন্টলি রুদ্রপ্রয়াগেই থাকেন?

না। ও তো পড়াশুনো করেছিল ল্যান্সডাউনের পাবলিক স্কুলে। তারপর দিলিতে জওহরলাল নেহরু উনিভার্সিটিতে। তারও পরে শান্তিনিকেতনে গিয়ে সংগীতভবনের ডিগ্রি নেয়। খুব ভাল বিয়ে দিয়েছিলেন কর্নেল কেশর সিং তার। এয়ারফোর্সের এক টেস্ট পাইলটের সঙ্গে। অজানা অচেনা ছেলেও নয়, দুজনে দুজনকে চিনতও। পছন্দেরই বিয়ে। উইং কম্যান্ডার নরেশ নেগি ছিল তাঁর স্বামীর নাম। কিন্তু প্রথম বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন নরেশ নেগি প্লেন ক্র্যাশে মারা যায়। একবছর তিন মাস হয়ে গেছে তাঁর মৃত্যুর। চন্দ্রবদনী এখন দেরাদুনেই থাকে বাবার সঙ্গে। চাকরি অথবা ব্যবসা করবে ঠিক করতে পারছে না। পুজোর সময়ে রুদ্রপ্রয়াগে এসেছিল ওঁর ঠাকুর্দা ও বড় পিসির কাছে। ক্ষেতি-জমিন আছে। ভারী শান্তি পায় নাকি রুদ্রপ্রয়াগে থাকতে।

তোমাকে এত কথা বলল কে?

কে আবার? ভোলানন্দজির কাছেই শুনেছি।

তা, তোমাদের ভোলানন্দজির সঙ্গে চন্দ্রবদনীর বাবার আলাপ হল কী করে।

 ঠিক বলতে পারব না। তবে শুনেছি, একজন বাঙালি মেজর-জেনারেল খুব ভক্ত ছিলেন ভোলানন্দজির। চন্দ্রবদনীর বাবার বড় সাহেব। তিনি যখন এই সেক্টরে পোস্টেড ছিলেন তখন প্রায়ই আসতেন ভোলানন্দজির কাছে। সেই সূত্রেই…

এদিকে আর্মির লোকজন থাকেন নাকি?

আর্মির লোকজন?

হেসে উঠল পাটন।

বলল, এই যে গঙ্গার বাঁ পাড়ের চওড়া রাস্তা, এই যে সব ব্রিজ, কিসের জন্যে বানানো? বদ্রীবিশাল-এর মন্দিরের থেকে আরও অনেক অনেক পেছনে আমাদের মাউনটেইন রেজিমেন্টস, এয়ার ফোর্স-এর ইউনিট, আর্টিলারি রেজিমেন্ট সব আছে। চীনেরা কি বরাবর নাকে ঝামা ঘষবে আমাদের?

তাহলে ইলা স্বর্গে যেতে হলে ইন্ডিয়ান আর্মি, চাইনিজ আর্মি দুপক্ষকেই তুষ্ট করে যেতে হবে বলো?

তা যা বলেছ।

তারপর যা বলছিলে বলল।

অলকানন্দা কি পুরোটাই এমনই গিরিখাদের মধ্যে দিয়েই বয়ে আসছে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে? অথবা আরও উঁচু থেকে?

 চারণ শুধাল।

না, না। দেবপ্রয়াগে এসে পৌঁজার আগেই তো অলকানন্দার রূপ খুলেছে। সেখানে নদী অনেক চওড়া। সেখানে নদীর বালির সৌন্দর্য দেখবে, না নুড়ির, না জলের? শ্রীনগরের কাছাকাছি অলকানন্দা যেন আরও সুন্দরী।

শ্রীনগর তো কাশ্মীরে!

 হাঃ!

পাটন।

তারপর বলল, ভুলে গেলে চলবে কেন যে, দেশটার নাম ভারতবর্ষ চারণদা। এই দেশের বিভিন্ন এলাকাতে হুবহু একই নামের জায়গা কম করে শ-খানেক করে পাবে। শ্রীনগর মস্ত জায়গা। উপত্যকা তো! সেখানে ভুরু প্লাক করা, বগল কামানো, নাভি-দেখানো বিস্তর সাঁটুলি থেকে, ডিশ-অ্যান্টেনা, চাইনিজ রেস্তোরাঁ সবই পাবে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, অফিস, কাছারি সবই আছে। শ্রীনগর থেকে যেমন রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, কেদারনাথ, বদ্রীনাথে যাওয়া যায়, তেমনই আবার যাওয়া যায় পউরি।

পউরি মানে কি?

 পউরি মানে পদচিহ্ন। হরিদ্বারকে হর কি পউরিও বলে। জানেন না?

আমি আর কী জানি বলল। সাহেবরা অবশ্য বলতেন পাউরি। তা, পউরিতে কার পদচিহ্ন?

 তা আমি বলতে পারব না।

জিম করবেট-এর লেখাতে পউরির কথা পড়েছি বটে। ডিভিশনাল কমিশনার মিস্টার ইটসন-এর হেডকোয়াটার ছিল এখানে। জিম করবেট সাহেবের খুব বন্ধু ছিলেন ইটসন আর তাঁর স্ত্রী জীন ইকটসন।

তাই? হবে হয়তো।

 পাটন বলল। জিম করবেট-এর বই আমি পড়িনি।

বলেই বলল, এই যে! তিরলোকনাথের দোকান। এমন পুরী-হালুয়া আলুর চোকা আপনি ভূ-ভারতে পাবেন না। আর রাবড়ি যা করে না! কোথায় লাগে চন্দ্রবদনী। যাই বলুন আর তাই বলুন চারণদা, চন্দ্রবদনীকে দেখার পর থেকে আমার স্তন্যপায়ীবাবা হবার ভারী সাধ জেগেছে মনে।

তুমি একটি বর্বর জানোয়ার!

চারণ স্তম্ভিত হয়ে বলল।

জানোয়ারের ছেলে, অন্যরকম হই কি করে। তবে আমার বাবার খাদ্য বলুন, পানীয় বলুন, সবই হচ্ছে কারেন্সি নোট। আমার খাদ্য-পানীয়তে ভ্যারাইটি আছে। তাছাড়া আমি জানি যে, আমি Beast। এবং Beast-দেরই তো চিরদিন Beauty-রা পছন্দ করে এসেছে। থাক পড়ে আমার ভোলানন্দ, থাক পড়ে তেত্রিশ কোটি দেবতা, আমি ওই দেবীটি পেলেই মোক্ষ লাভ করব। অবশ্যই করব।

দুধ পায় কোথা থেকে?

চারণ বলল।

আজ্ঞে? চমকে উঠে বলল পাটন।

ভাল রাবড়ি যে করে, দুধ পায় কোথা থেকে?

কী অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। সত্যি! আপনি না…

 তারপর বলল, সবই জুটে যায়। আপনার মতন কালো কোট-পরা নম্বরী পাপী এসে জুটতে পারলেন এখানে আর দেবভূমিতে গোমাতার দুধ পাওয়া যাবে না!

ঠাট্টার স্বরে বলল পাটন। তারপরে দোকানের মস্ত বড় কাঠের উনুনের সামনের কাঠের বেঞ্চে বসল অন্য আরও অনেকের গা ঘেঁষে।

জয় বদ্রীবিশালজিকি।

পাটন বলল।

জয় বদ্রীবিশালজিকি।

হালুইকর তিলোকনাথ বলল।

রোগা টিঙটিঙে চেহারা তিরলোকনাথের। তবে খুব লম্বা। মাথায় সিঁদুরের টিপ, কপালের নীচের ভাগে চন্দন, মাদ্রাজী ব্রাহ্মণদের মতন পাথালি করে লেপা।

চারণের অর্ডার অনুযায়ী গরম গরম পুরী আর হালুয়া দিতে বলল ওদেরকে। অল্পবয়সী যে দুটি ছেলে খিদমদগারী করছিল তাদেরই একজন স্টেনলেস স্টিলের প্লেটে করে খাবার এগিয়ে দিল।

খিদেও পেয়েছিল। সকালে আশ্রমে দুটি হাতে-গড়া রুটি আর আলুর চোকা খেয়েছিল। পাটন আটা মেখেছিল, চারণ আর জুগনু সেই রুটি সেঁকেছিল আর আলুর চোকা বানিয়েছিল।

এই জুগনুও আশ্রমেই থাকে। বারো-তেরো বছরের ছেলে। শ্যামানন্দজি হরিদ্বার থেকে মরে-যাওয়া ভিখিরি-মায়ের সন্তানকে তুলে এনেছিলেন দুবছর বয়সে। জুগনু Errand Boy-এর কাজ করে কিন্তু কোনও মাইনে নেয় না। দেবেই বা কে? সকলের সঙ্গে সেও প্রাণায়ম করে, সকাল-সন্ধেতে ভজন গায়। তার মুখে সবসময়ে হাসি লেগেই থাকে। কোনওরকম দুঃখ, জামাকাপড়ের, খাওয়া-দাওয়ার, তার যে আদৌ আছে, তা মনে হয় না। এই জমিতে, ভোলানন্দ প্রেমানন্দদের সান্নিধ্যে থাকলে কোনওরকম দুঃখবোধই সম্ভবত জন্মায় না। আর থেকে থাকলেও, মরে যায়।

পাটনের পাশে, সেই দীপাবলীর রাতের দেবপ্রয়াগের তিরলোকনাথের দোকানে কাঠের আগুনের সামনে বিবর্ণ, কাঁটা-ওঠা বেঞ্চে বসে পুরী-হালুয়া খেতে খেতে চারণ ভাবছিল যে, এখন কলকাতাতে তার বাড়ি দিওয়ালির ডালিতে ডালিতে ভরে গেছে। স্কচ-হুঁইস্কি, ফ্রেঞ্চ-ওয়াইন, নানারকম শুকনো ফল, মেওয়া, বেলজিয়ান কাট-গ্লাসের অ্যাশ-ট্রে, ক্যাসারোল, ফ্লাস্ক, আইস বাকেট আরও কত কী! প্রফুল্ল, বীরেন, আর রাম সিং হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে জবাবদিহি করতে করতে। পুলিশও জেরা করে থাকতে পারে। তবে ওদের মাইনে পত্তর ইত্যাদি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। অফিসে গোপালকে বেয়ারার চেক দিয়ে এসেছে। এক বছর না ফিরলেও কারওই অসুবিধা তো নেইই বরং মজাই হবে।

হু-হু করে হাওয়া আসছে নীচের গিরিখাত থেকে। না কি উত্তরের বরফ ঢাকা সারসার শৃঙ্গগুলি থেকে? কে জানে! এই পরিবেশে, এমন দোকানে চারণ চ্যাটার্জিকে কোনওও মকেল, উকিল বা হাকিম হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললে হয়তো হার্ট-অ্যাটাকেই ফওত হয়ে যাবেন। নিছক SHOCK-এই।

ভাবছিল ও, মানুষ ইচ্ছে করলে কত সহজে নিজের অনুষঙ্গ, পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে বদলাতে পারে!

পরমুহূর্তেই ভাবল, ও কি করতে এসেছে এখানে? হৃষীকেশে বেশ কদিন কাটিয়ে দিল। এখন এসেছে দেবপ্রয়াগে। পাটনের গাধাবোট হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর চন্দ্রবদনী। এক নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে।

আশ্চর্য! গর্ডন আর স্টিভেন্স কিন্তু সেই যে গর্তে ঢুকেছে আর বেরোবার নামটিও নেই। চারণ বলল, পাটনকে।

ওরা তো কনডেন্সড-কোর্স করতে এসেছে। আপনার তাড়াটা কিসের? হাতে অনন্ত সময়। সব কিছুই শনৈ শনৈ হবে। তবে এখানে আপনি আর বেশি থাকুন তা আমার ইচ্ছে নয় চারণদা।

কেন?

অবাক হয়ে বলল চারণ।

 কেন?

কেন আবার? চন্দ্রবদনী।

চন্দ্রবদনী তোমার চেয়ে বয়সে বড়ও হতে পারে। বেশি ইয়ার্কি কোরও না। চারণ বলল।

হাঃ। এখন তো নিজের চেয়ে বড় মেয়ে বিয়ে করাটাই voGUE। গরু-মোয কুকুর-মেকুরের মধ্যে তো এই সিসটেম সৃষ্টির আদি থেকেই চালু আছে। মানুষই বা পেছিয়ে থাকবে কেন?  

তাই?

ইয়েস স্যার। আপনি মানে মানে অন্যত্র কাটুন।

তাই যাব ভাবছি।

 প্লেটটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল ও।

 চায়ে নেহি পিজিয়েগা বাবু?

 জরুর। দো চায়ে। এক মে শর্কর আর মালাই কমতি দেনা।

পাটন বলল।

মালাইমেহিলো চায়েকা পাত্তি উবালতা হ্যায়।

 ও হো! ভুল গ্যয়া থা। ঠিক হ্যায়।

কোথায় যাবেন ভাবছেন?

ঘুরব। একা একা না ঘুরলে এসব হয় না। তুমি আমার সঙ্গ ছাড়ো।

আমি? হাঃ। আপনিই তো এঁটুলির মতন আমার পেছু পেছু উঠে এলেন এখানে হৃষীকেশ থেকে।

সে তো ভোঁদাইবাবা, থুড়ি, ভোলানন্দ বাবার জন্যে।

এসেছেন যখন তখন দিনকতক থাকুন। চোখ দুটি শুধু চন্দ্রবদনীর দিকে না ধায়। নইলে এখানে থাকলে আমার আপত্তি কি? সমুদ্র এত স্বল্পসময়ে কি পুরনো হয় চারণদা? তীর থেকে ঢেউগুলোকে একইরকম লাগে বটে, দূরের সমুদ্রকে মনে হয় সবুজ, নীল, খয়েরি, কালো সমতল মাঠ। কিন্তু আসলে তো তা নয়! থাকুন। আপশোষ করবেন না। আপনি গভীর মানুষ, আমার চেয়ে পড়াশোনা এবং অধীত-বিদ্যে হজম করার ক্ষমতা বেশি। আপনার মতন, স্টিভেন্স আর গর্ডনের মতন মানুষদেরই তো দরকার ভোলানন্দজির। আমি তো একটা মর্কট। Total Waster in all Spheres of Life! যার বাপই বেঠিক তার সবই বেঠিক।

চারণ চুপ করে রইল।

দেব-দেবী, ধর্ম, শাস্ত্রর কথা ও জানে না বটে কিন্তু নিজের এই বিশাল দেশের প্রাচীনত্ব, কোটি-কোটি মানুষে অবশ্যই কোনও কিছুর টানে যে হাজার হাজার বছর থেকে এই দেবভূমিতে আসে, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিল ও। এক ধরনের ভারতীয়ত্বে সম্পৃক্ত হচ্ছিল চারণ খুব ধীরে ধীরে, উগ্র বিড়ির গন্ধে, দিশি, হাতে-বোনা কম্বলের বোঁটকা গন্ধে, এই দুধের মধ্যে সেদ্ধ করা চায়ের পাতার চা-এর মধ্যে, এই মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে, ঘণ্টাধ্বনির মধ্যে, ধূপধুনোর গন্ধের মধ্যে, গাঁজার ধোঁয়ার মধ্যে। কলকাতাতে ও ইংল্যান্ডে পড়াশুনো করার সময়ে এবং কলকাতা ও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করার সময়ে এই সাধারণ, গরীব, গভীর ঈশ্বরবিশ্বাসী, জাগতিক কামনা ও লোভহীন, ঐতিহ্যপূর্ণ আসল ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ওর কোনও ধারণাই ছিল না। দেশমাতৃকা শব্দটা বঙ্কিমচন্দ্রর লেখাতে পড়েছিল। দরিদ্র ভারতবাসী আমার ভাই একথা পড়েছিল বিবেকানন্দর লেখাতে। দেশপ্রেম কাকে বলে তা নেহরু বা জিন্নার চেয়েও অনেক বড় ভারতপ্রেমী জিম করবেট-এর My Indiaর মুখবন্ধ পড়ে জেনেছিল।

এই ভারতবর্ষকে চারণ জানতেও পারত না হঠাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এই দেবভূমিতে এসে উপস্থিত না হলে। পাটনের পাশে গায়ে গা লাগিয়ে শীতের মধ্যে বসে ওর মন হঠাৎই এক তীব্র দুঃখমিশ্রিত সুখে ছেয়ে গেল।

তিরলোকনাথের দোকানে একটি ছবি ছিল মহাদেবের। যেমন ছবি সর্বত্রই দেখা যায়। মাথাতে, সাপ জড়ানো, হাতে ত্রিশূল। মাথার পেছনে একটি ওঁ চিহ্ন। এই ওঁ চিহ্নটি প্রায় সব ধর্মস্থানেই দেখেছে চারণ। অনেককে চিঠি লেখবার সময়েও চিঠির উপরে ওঁ লিখতে দেখেছে।

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের খুব ভক্ত চারণ। তাঁর পার্থিব উপন্যাস পড়ে তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিল ও। তার উত্তরে পোস্টকার্ডে ছোট্ট উত্তর দিয়েছিলেন সাহিত্যিক। সেই চিঠির উপরে উনি লিখেছিলেন রা। ওঁ এরই মতন। রা মানেই বা কি, তা কে জানে?

পাটনকে শুধোল চারণ, ওঁ-এর মানে জানো?

জানতাম না। ভোলানন্দজির কাছ থেকেই জেনেছি। শ্যামানন্দজি বলেছিলেন যে এই। ও-কেই দার্শনিক কালাইল নাকি বলেছিলেন : The Everlasting Yeah –মানে হা। অনন্তকালের হ্যাঁ। একটা মস্ত হ্যাঁ।

ওঁ মানে, হ্যাঁ?

অবাক হয়ে প্রশ্ন করল চারণ।

ইয়ে। হ্যাঁ। পরে কখনও ভাল করে শুনে নেবেন ভোলানন্দজি বা শ্যামানন্দজির কাছ থেকে। গর্ডন আর স্টিভেন্সও শিখে গেছে ওঁ-এর মানে। ওরাও আপনারই মতন একদিন এই প্রশ্ন করেছিল আমাকে। আমি আর কতটুকু জানি বন? ওদের ইনকুইজিটিভনেস-এর জন্যেই এই প্রশ্নের উত্তর ওদেরই সঙ্গে আমিও পেয়ে গেছিলাম।

তারপর বলল, একটা কথা মনে প্রায়ই হয়। জানেন, চারণদা।

 কি?

শিক্ষা আর ইকুইজিটিভনেস বোধহয় সমার্থক। যে-মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত তার জিজ্ঞাসার কোনও শেষ নেই। আর যার কোনও জিজ্ঞাসাই নেই, সে সাথেই অশিক্ষিত। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।

তা উত্তর পেলে কার কাছ থেকে?

মোটার কাছ থেকেই।

মোটা মানে?

আঃ! কতবার যে বলব আপনাকে! মোটা মানে ভোলা ইজ ইকুয়াল টু ভোলানন্দজি।

চারণ, পাটনের এই অকারণের বাঁদরামিতে চুপ করে রইল।

.

০৮.

সিনিবালি দিওয়ালির হইচই শেষ হয়ে গেছে এই দেবভূমি দেবপ্রয়াগে। আবার সেই শান্ত নির্লিপ্ত জীবন। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত দুপাশ থেকে কিছু বাস, ট্রাক এবং গাড়ি যাতায়াত করে। আর্মির কনভয়ও যায়-আসে মাঝে মাঝে। কনভয়-এর সামনের গাড়িতে লাল আর পেছনের শেষ গাড়িতে সবুজ পতাকা লাগানো থাকে।

এখন শেষ বিকেল। এই সময়টাতেই এই সব জায়গাতে মন বড় বিধুর হয়ে ওঠে। দিনান্তবেলায় নানারকম পাখি ডাকে নীচের নদীর পাশের পর্বত-গাত্র থেকে। তাড় বা তোন গাছের পাতাগুলিও ঔদ্ধত্যের সঙ্গে মাথা উঁচিয়ে থাকে অন্য গাছেদের মাথার উপরে। কতরকম গাছ যে আছে এখানে। তার সামান্যই চেনে চারণ। এই দিকের পর্বতমালার বেশিটাই রুক্ষ ও ন্যাড়া। জঙ্গল গভীর, পর্বতের পাদদেশে।

চুপ করে বসেছিল চারণ অলকানন্দার এপারে পশ্চিমের পাড় আর আকাশে চেয়ে। জোড়াসনে বা শবাসনে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেও মনের মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন আসে। প্রাণায়াম করলে যেমন আসে। এসব একটু একটু করে শিখছে চারণ।

বেশ কদিন হল, এক বেলাই খাচ্ছে আশ্রমের অন্যদেরই মতন। একচড়া। আশ্চর্য। সারাদিনে ওই খাওয়াটুকুকেই যথেষ্ট বলে মনে হয় এখন। গেরুয়া পরে না অবশ্য। পরলে, ভেক ধরেছে বলে মনে হতে পারত হয়তো নিজেরই কাছে। অন্যের কাছে তো অবশ্যই। এখনও সাদাই পরে। ধুতি। তবে, পরে হয়তো পরবে কখনও গেরুয়া।

ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতই জানে।

পাটন বলেছিল, যদি মিলিটারিতে জয়েন করতেন তবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে থাকলে কি আপনার কাজের সুবিধা হত? না, আপনাকে তা পরতে দেওয়া হত? রেজিমেন্টাশেন-এর দরকার আছে চারণদা।

চারণ বলল, আর তুমি যে এই পরিবেশে, এই আশ্রমে দিব্যি জিনস পরেই চালিয়ে যাচ্ছ। সে বেলা কি?

আমি তো সন্নিসীগিরির অ্যাপ্রেনটিসশিপ নিইনি।

তুমি তাহলে কি? শাখামৃগ? রিয়্যাল মর্কট? ভোলানন্দজি ঠিকই বলেন। এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে পড়ে দোল খাচ্ছ।

চোখ নাচিয়ে পাটন বলল, খাব খাব। আমার আসল গাছে গিয়ে উঠি আগে। একটু সবুর করুন।

আলো ক্রমশই কমে আসছে। ঠাণ্ডাটাও বাড়ছে। দিনের বেলা একটা জোর হাওয়া সমতল থেকে পাহাড়ে উঠে আসে নদীর পথের বিপরীতে, আর রাত নামলে পাহাড় থেকে কনকনে হাওয়া নদীখাত ধরে বয়ে যায় সমতলের দিকে। হৃষীকেশ বা হরিদ্বারে বছরের এই সময়ে সেই হাওয়ার স্বরূপ খুবই বোঝা যায়।

মাথার বাঁদুরে টুপিটা টেনে দিল চারণ নীচে, কান ঢেকে। প্রহরে প্রহরে শীত বাড়বে এখন।

 ঠিক সেই মুহূর্তেই চারণের আবারও হঠাৎই মনে হল কি করছে ও এখানে বসে? সাধুসন্তদের অনুকরণ করে কি পাবে ও? অনুকরণ করে জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই কেউই কি কিছু পায়? কিসের জন্যে এসেছে ও এখানে? কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য যদি নাই থাকে, তাহলে তা সাধন হবেই বা কী করে!

গতকালই গর্ডন আর স্টিভেন্স-এর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছিল ও। ওরা বলছিল, উদ্দেশ্যহীনতাই নাকি ওদের এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য। কোনও উদ্দেশ্যর হাত ধরেই ওরা বাঁচতে চায় না। উদ্দেশ্য ব্যাপারটার মধ্যেই একধরনের স্বার্থপরায়ণতার গন্ধ জড়ানো থাকে। সব পশ্চিমী দেশেই শিশুকাল থেকেই প্রতিটি মানুষই তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপই এক বা একাধিক বিশেষ উদ্দেশ্যেই নিয়ন্ত্রিত করে। এবং সেই সব উদ্দেশ্যর মধ্যে প্রধানত হচ্ছে অথোপার্জন। জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা, অর্থবান, আরও অর্থবান হওয়া। মিলিয়নিয়র থেকে বিলিয়নিয়র, বিলিয়নিয়র থেকে ট্রিলিয়নিয়র। একমাত্র উদ্দেশ্যই এই, জীবনের, To Get Rich. By Hook or By Crook! অর্থই ইউনাইটেড স্টেটস এবং তার প্রভাবে প্রভাবিত সব দেশেই সমস্ত উদ্দেশ্যর শেষ উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্যকে ধাওয়া করে করে ওরা ক্লান্ত। সত্যি সত্যিই ক্লান্ত।

গর্ডন বলেছিল, তাইতো তোমাদের দেশে এসেছি অতদুর থেকে। আমরা নিজেরা পুরোপুরি নিরুদ্দেশ হয়ে উদ্দেশ্যহীনতার মজাতেই চিরদিনের মতন মজতে এসেছি। আর তুমি এই মহান, প্রাচীন এক দেশের নাগরিক হয়েও তোমার নিজের দেশের ঐতিহ্যে গৌরব বোধ করো না? নিজেদের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় সম্বন্ধে তুমি নিজেই অবহিত নও? ভারী আশ্চর্য তত!

চারণ লজ্জা পেয়েছিল।

স্টিভেন্স বলেছিল, মক্কেলের হয়ে ওকালতি তো অনেকেই করলে জীবনের অর্ধেকের চেয়েও বেশি সময়। এবারে নিজের জন্যে কিছু ওকালতি করো উপরওয়ালার কাছে। এই ওকালতির ফিস মোহরে গণ্য নয়। গণ্য, মনের শান্তি আর অর্থ বাসনাহীন আনন্দে। যা, আসল সুখ। নইলে আমরা সবই ছেড়েছুঁড়ে এলাম কী করে। আর চলে এলামই শুধু নয়! এসে, সর্বক্ষণ এত আনন্দেই বা থাকি কেন?

বিদেশিদের কাছে এই জ্ঞান নিতে ভাল লাগেনি চারণের। কিন্তু নিয়েছিল। নিতে হয়েছিল। কারণ, এ কথা তো সত্যিই যে ওরা সবই ছেড়ে এসেছে। রাজ্য-পাট, চোখ-ঝলসানো সাচ্ছল্য। চারণের মতন দুনৌকোতে পা তো নেই ওদের! গর্ডন এসেছে তিনবছর। পাটনেরই মতন। আর স্টিভেন্স এসেছে আড়াই বছর।

নির্জনে একা থাকা, একা ভাবা, এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনাতে আদৌ তাড়াহুড়ো না করে পর্বতারোহীদের মতন একের পর এক পায়ের পরে পা ফেলে ভাবনা-চিন্তার পাহাড়চুড়োর দিকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে এক গভীর জাগতিক-লাভ-শূন্য প্রশান্তি যে আছেই, তা এই কদিনেই বেশ বুঝতে পেরেছে চারণ। যে-পর্বতারোহী পর্বত শৃঙ্গে ওঠেন তিনি সমতলে দাঁড়িয়ে একবার শুহের দিকে তাকালে কোনওদিন সেখানে আদৌ পৌঁছতে পারতেন না। অসাধ্য-সাধন তাঁর দ্বারা কোনওদিনও হবে না ভেবে হতোদ্যম হয়ে যেতেন। তা তো নয়। যিনি পর্বতারোহী, তিনি শুধুই দেখেন পরের পদক্ষেপটি কোথায় করবেন।

গতকাল সকালে অবাক করেছিল পাটন, চারণকে। চন্দ্রবদনীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেবপ্রয়াগের কার বাড়ি থেকে যোগাড় করেছিল তা বলতে পারবে না, কিন্তু ছেঁড়াখোঁড়া প্রায় ভূর্জপত্রের মতন অবস্থা হয়ে যাওয়া একটি বই এনে ওকে দিয়েছিল।

এটা কি বই?

পাটন হেসে বলেছিল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের। উপনিষদের উপরে লেখা আছে এতে। আপনার ওঁ-এর উত্তরও পাবেন।

এখানে এই বই কোথায় পেলে তুমি?

 সবখানেই সব কিছু পাওয়া যায় চারণদা, যদি তেমন করে চাওয়া যায়।

বলেই বলল, আপনি তেমন করে চাইলেন না বলেই চন্দ্রবদনীকে পেতে পেতেও পেলেন না। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, বেড়ালের ভাগ্যেই হয়তো শিকে ছিঁড়বে।

তাই?

পাটন চারণের ভাবনা ছিঁড়েখুঁড়ে হঠাই গেয়ে উঠল

বড়লোকের বিটিলো লম্বা লম্বা চুল
এমন মাথা বেন্ধে দেব লাল গেন্দা ফুল।

পাটনের এই হঠাৎ উচ্ছল হয়ে ওঠা দেখে খুশি হয়েছিল চারণ। কিন্তু ওর মনে সেই খুশির রং পুরোপুরি লাগার আগেই পাটন আবারও গেয়ে উঠেছিল :

ও রাঙা বাবুরে শিমুল ফুলে রঙ লেগেচে
 সত্যি কথা বলতে কি তুকে আমার মইনে ধইরেচে
তুকে আমার মইনে ধইরেচে।

এ আবার কি? আরে আমার সম্পর্কে চন্দ্রবদনীর মনের কথাটা যদি এইরকম হত তাহলে বুঝতাম কেসটা পেকেছে। কিন্তু এখনও বহত বাঁও পানি। আমার পেরেমের শিমুল গাছে ফুল ফুটতে এখনও বহতই দেরি। তোমরা আমার কাঁচা পিরীত পাকতে দেবে কি না তাই বা কে জানে!

চারণ হেসেছিল। তারপর বলেছিল, এই সব গান শিখলে কোথায়?

আঃ। আপনি যে দেখি কোনও খোঁজই রাখেন না। স্বপ্ন চক্রবর্তীর গান। ক্যাসেট শোনেননি? দারুণ করেন, এইসব গান, মহিলা।

নাঃ।

গভীর আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিল চারণ।

জীবনটা বড় ছোট। ভুল পথে ঘোরাঘুরি করেই যে জীবনের অনেকখানিই নষ্ট করে ফেলেছে। বুঝতে পারে। প্রতি মুহূর্তেই বুঝতে পারে।

.

সকালে এত ঠাণ্ডা থাকে যে এখনও সূর্যোদয়ের আগে ওঠা রপ্ত করতে পারেনি ও। ভোলানন্দজির এই ছোট্ট আশ্রমে জেসুইট ব্রাদারদের ডর্মিটরির বা মসজিদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা নেই। সকালের প্রেয়ারে বা ফজিরের আজান-এ সকলকেই সামিল হতে হয় না। মঠ বা বড় আশ্রমে হয়তো নানা রেজিমেন্টেশান আছে। কিন্তু এখান কারওই রক্তচক্ষু বা খবরদারী নেই। পড়াশুনো, ভাবনাচিন্তা, লেখালেখি যা করার এদের মধ্যে অনেকেই তা করেন গভীর রাত অবধি। ধনি বা লণ্ঠনের বা প্রদীপের আলোতেই। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ভোরে-ওঠার অভ্যেস হয়ে যাবে হয়তো ওরও। সকলেই যখন ওঠে তখন ওই বা পারবে না কেন?

ওই ঠাণ্ডাতেও অনেক নীচের নদীতীরে কুয়াশার মধ্যে অগণ্য সুঠাম খালি-গা মানুষের মুর্তি নদীর দদিকে ঘাটেই দেখতে পায়। কুয়াশারই সঙ্গে তাদের মুখনিঃসৃত গরম বাষ্প মিশে যায়। উষাকালে উপরের দেবপ্রয়াগ এবং সংলগ্ন এলাকার প্রতিটি মন্দিরেই ঘণ্টা বাজে। সূর্যস্তবে গমগম করে খরস্রোতা, প্রভাতগন্ধী নদীতীর। সদ্যস্নাতা, যোগীদের, নারীদের শরীরের গন্ধ ওঠে।

সর্যপ্রণামের সেই মন্ত্র, খরস্রোতা অতল নদীর স্রোতের শব্দে মিশে গিয়ে, বাহিত হয়ে, দেবভূমি থেকে সমতলের নানা তীর্থক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হয়ে যায়।

ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং।
ধ্বস্তারিংসর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরং।

কেউ-বা গায়ত্ৰীমন্ত্র জপ করেন :

আদিত্যায় বিদ্মহে সহস্ৰকিরণায় ধীমহি তন্ন সর্যঃ প্রচোদয়াৎ।

এই ভারতবর্ষ!! ভারতবর্ষের এই আশ্চর্য, শাশ্বত, উদাত্ত রূপ সম্বন্ধে চারণের আগে কোনও ধাৰণাই ছিল না।

দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এল। শিলাসন ছেড়ে উঠে পড়ল চারণ। নির্জনতার এক আশ্চর্য নিজস্ব আচ্ছন্নতা আছে। প্রকৃতির বুকের কোরক থেকে সেই নির্জনতা যে-কোনও মানুষেরই বুকের মধ্যে উঠে আসে।

এবারে আশ্রমের দিকে ফিরবে, না কি দেবপ্রয়াগ বাজারের দিকেই যাবে ঠিক করতে পারল না। পথ চলতে চলতে ভাবছিল যে, জীর্ণ বইটি দিয়েছিল পাটন, সেইটিই বরং আজ পড়বে ফিরে গিয়ে।

ভোলানন্দজির আশ্রমের আরও কিছুটা উপরে একটি ছোট্ট গুহা আছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে। সেখানেই থাকেন ভোলানন্দজি, যখন মৌনী থাকেন, একেবারে একা। এখন উনি মৌনী।

কিছু খাবেনও না। জল খাবেন শুধু এবং একটু দুধ। আশ্রমেরই কেউ গিয়ে খাইয়ে আসবেন। পাটনও যায় কখনও কখনও।

শ্যামানন্দজি হৃষীকেশে গেছেন শিবানন্দগিরি মহারাজের আশ্রমে কোনও কাজে। বই-টই-এর জন্যেও হতেও পারে। গর্ডন গেছে মুনিকা-রেতিতে, হৃষীকেশ-এর একটু আগে। ওর দেশ থেকে এক বান্ধবী এসেছে নাকি। তারই সঙ্গে দেখা করতে গেছে। তাই আজ গুহাতে স্টিভেন্স আর চারণ বলতে গেলে একাই। কে যে কখন কোথায় থাকে, অন্যে জানে না। কোনও হাজিরা খাতা নেই এখানে, কাজের দিন, ছুটির দিন নেই, দেরি করে অফিসে পৌঁছলে লেট মার্ক দেওয়া হয় না। ক্যাজুয়াল-লিভ, সিক-লিভ, বাৎসরিক ছুটি, কিছুই নেই। রোজই ছুটির দিন, রোজই কাজের দিন। অন্যদের কারও সম্বন্ধেই অবশ্য ওর তেমন উৎসাহ নেই। আর ওর প্রতি তো কারও উৎসাহ নেই-ই। তবে সাম্প্রতিক অতীতে চন্দ্রবদনী সম্বন্ধে ওর উৎসাহটা অত্যন্তই তীব্র হয়েছিল। হয়েছিল যে, সে কথা পাটন বুঝতে পেরেছিল এবং পেরেছিল বলেই যখন তখন চন্দ্রবদনীর প্রসঙ্গ ওঠাত ও চারণকে একা পেলেই।

যেই চানে যায় নদীতে, সেই জল বয়ে আনে। কেউ ঘড়াতে, কেউ বা বড় ঘটিতে, কেউ কমণ্ডলুতে। এক ঘড়া, খাবার জন্যে আনে কেউ, আচমনের জন্যে আনে অন্য কেউ। হাত মুখ পা ধুয়ে, গুহার ভিতরে ঢুকে ওর গুটিয়ে-রাখা কম্বল-শয্যাখানি খুলে, তার উপরে বসে, ঝোলা থেকে সেই বইটি বের করল চারণ। স্টিভেন্স বাঁদিকে কাত হয়ে শুয়ে হেনরি ডেভিড থোরোর Walden পড়ছিল। তার শরীরের ছায়া পড়েছিল গুহার দেওয়ালে। প্রদীপের আলোর বিপরীতে। বাঁকানো কনুইয়ের ছায়াটিকে মনে হচ্ছিল একটি বাঁকানো ধনুক যেন।

চারণকে আসতে দেখেই ডান হাতের বুড়ো আঙুল তুলে থাম্বস আপ করল স্টিভেন্স।

তারপর আবার বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল।

স্টেটস-এ যখন প্রথমবার যায় চারণ, সেবারে ইস্টকোস্ট-এর বস্টন থেকে হীরকদার সঙ্গে গেছিল। Walden Pool দেখতে। কী যে রাগ হয়েছিল দেখে! হেনরি ডেভিড থাোেের Walden শেষ কৈশোরে পড়ে, মনের মধ্যে যে ছবিটিকে লালিত-পালিত করে রেখেছিল, সেই ছবিটি শুধু নড়ে-চড়েই যায়নি, ছিন্নভিন্নও হয়ে গেছিল। সেই মুহূর্তেই ইউনাইটেড স্টেটস-এর মানুষদের আত্মিক এবং নান্দনিক অবক্ষয় সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা হয়েছিল ওর। সেই ধারণা, পরে দৃঢ়তর হয়েছে নানা ধরনের কিছু এন আর আই-দের দেখে। মনে হয়েছে, কলকাতা চিড়িয়াখানাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, কিছু খাঁচা খোলা থাকলে তাদের মধ্যে কারও কারওকে ভরে দেবে। শিক্ষা, সহবৎ বা সংস্কৃতির খামতি থাকাটা দুঃখজনক হতে পারে কিন্তু দোষের নয়। কিন্তু শুন্যপার টংটং আওয়াজ অসহ্য। গভীরতা ব্যাপারটা এই এন আর আইদের মধ্যের এক শ্রেণীকে ইমপোর্ট করার জন্যে অনুরোধ করা উচিত। ভারত থেকে ম্যানহোল কভার এবং কনডোম যদি ওঁর ইমপোর্ট করতে পারেন তাহলে গভীরতা নিতেই বা লজ্জা কিসের? তবে এন আর আইদের মধ্যে গর্ব করার মতন মানুষ কি নেই? অবশ্যই আছেন।

কিন্তু তাঁরা ব্যতিক্রম।

একটি ভাল বই পড়ার আগে এন আর আই প্রসঙ্গ উঠিয়ে মনকে আবিল করে ফেলাতে খারাপ লাগল চারণের। মুখটাও যেন তেতো হয়ে গেল।

বইটা খুলল, ঔপনিষদ ব্রহ্ম। তারপর ডুবে গেল বইয়ের মধ্যে।

বইটি ছোটই। তবু বই পড়া যখন শেষ হল তখন রাত গভীর। কত যে গভীর তা জানে না। স্টিভেন্সও শুয়ে পড়েছে ততক্ষণে কম্বলের নীচে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে। বাইরে গিয়ে দাঁড়াল চারণ।

এই পর্বতরাজিতে এক ধরনের ঝি ঝি আছে তারা দিনে ডাকে না। রাতেই ডাকে শুধু। তাদেব ঝিনিঝিনি শব্দ E Sharp-এ মিলিয়ে বাঁধা হাজার তানপুরার নিক্কনের শব্দর মতন বাজছে। যে-শব্দ দুকান ভরে দিয়ে মস্তিষ্ককেও অবশ করে ফেলে। মাথার উপরে তারা-ভরা আকাশ। পাটন চিনিয়েছিল তারাদের। কিন্তু এরই মধ্যে ভুলে গেছে ও। বড় ভুলো হয়েছে আজকাল।

অলকানন্দার ওপারে হেমন্তের মধ্য রাতের ঘুমন্ত দেবপ্রয়াগ। কোনও সাড়াশব্দ নেই, নীচের নদীর শব্দ ছাড়া। কত হাজার বছর ধরে দুপাশের পর্বতরাজিকে সাক্ষী রেখে যে তারা প্রবল গর্জনে বয়ে যাচ্ছে, তা কে জানে! ভাগীরথী আর অলকানন্দার সঙ্গমের কাছ থেকে উচ্চগ্রামে শব্দ উঠছে। আর সেই রাতচরা হাওয়াটা বেগে ধেয়ে যাচ্ছে নদীর জলকে সাদা, দুরন্ত মেষপাল-এর মতন তাড়িয়ে নিয়ে।

ধিয়ানগিরি মহারাজের কথা মনে পড়ে গেল, ভেড়ার কথা মনে হওয়ায়।

ভেড়চাল।

 কে জানে কেমন আছেন ওঁরা!

ফিরে এসে, কম্বলের নীচে টানটান হয়ে শুয়ে যে বইটি এখুনি পড়ে শেষ করল, সেই বইটির কথাই ভাবছিল ও। রবীন্দ্রনাথ এতে উপনিষদ এবং ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। বলেছেন, ব্ৰহ্মকে জানা না হলে এই মানবজন্মই বৃথা।

ঈশোপনিষদে লেখা আছে :

 ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্।

 মানে হচ্ছে, ঈশ্বরই এই জগৎকে লালন পালন করছেন, তাঁর দ্বারাই সমস্ত জগৎ আচ্ছন্ন হয়ে আছে। (কেন ভোলো? মনে কর তাঁরে।) তিনি যা দিয়েছেন, যা দেন, যা কিছু দিয়েছে, তাই ভোগ করো। পরের ধন লোভ করো না।

এই যে লোভ, অন্যের যা আছে আমারও তা চাই, যে-কোনও ভাবেই চাই, চুরি করে ডাকাতি করে, টি এ বিল ইনফ্লেট করে, গরীব আত্মীয়র বাড়ি জমি বিক্রি করিয়ে দেওয়ার সময়েও আড়ালে দালালি নিয়ে, ঘুষ খেয়ে, স্মাগলিং করে, চুরি করে, জালিয়াতি করে পড়শী বা আত্মীয়র মতন বড়লোক হবার যে সাধনা সারা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে সেই তাপ গ্রিনহাউস এফেক্টের তাপের চেয়েও বেশি। এই সরল সত্যটি যদি নাই বুঝবে তবে আর গর্ডন এবং স্টিভেন্স সাচ্ছল্যের উচ্চতম সোপানে বসবাস করা সত্ত্বেও সেখান থেকে নেমে এই ভারতীয় দেবভূমিতে গঞ্জিকা-সেবী আধ-ন্যাংটো সন্নিসীদের আখড়াতে কেন দৌড়ে আসবে এত সমুদ্র পেরিয়ে?

ভাবনা একই।

তরঙ্গ খেলে যায় ইথারের মতন।

সেই Wave-Length-এ যারা একীভূত করতে পারে নিজেদের, তারাই ভাগ্যবান।

 রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তারপরই আসতে হয় ওঁ-এর কথাতে। ওঁ একটি ধ্বনিমাত্র। এর কোনও বিশেষ মানে নেই। ওঁ ব্রহ্মের ধারণাকে কোনও অংশেই সীমাবদ্ধ করে না। সাধনার মাধ্যমে আমরা ব্রহ্মকে যতদূর জেনেছি, যেমন করে পেয়েছি, এই ওঁ ধ্বনি তার সবটুকুই ব্যক্ত করে। কিন্তু ব্যক্ত করেও সেখানেই সেই প্রাপ্তির প্রকাশকে সীমিত করে না। সংগীতের স্বর যেমন গানের বাণীর মধ্যে এক অনির্বচনীয়তার সঞ্চার করে, তেমনি ওঁ ধ্বনি তার পরিপূর্ণ মাহাত্ম্যে ব্রহ্মধ্যান বা ধারণার মধ্যে এক অনির্বচনীয়তার অবতারণা করে। বাহ্য প্রতিমা দ্বারা আমাদের মনেব ভাবকে খর্ব ও আবদ্ধ করে! কিন্তু এই ওঁ ধ্বনি মানুষের মনের ভাবকে উন্মুক্ত ও পরিব্যাপ্ত করে দেয়। হয়তো সেইজন্যই উপনিষদ বলেছেন ওমিতি ব্ৰহ্ম। ওম শব্দ তো ব্রহ্মকেই বোঝায়। ওমিদীতং সর্বং, এসব যা কিছু সমস্তই ওঁ। এখন সমস্ত ভারতীয় ভাষাতে আমরা হ্যাঁ বা হাঁ দিয়ে যা বোঝাই।

প্রাচীন সংস্কৃত ভাষাতে ওঁ ধ্বনিটি ব্ৰহ্মকে নির্দেশ করে কিন্তু ওঁ শব্দের অর্থও তো আছে একটি। আছে, কিন্তু সেই মানে এতই উদার ও বিস্তৃত যে, তা মনকে অসীম মুক্তি দান করে। ওঁ শব্দ অনুকৃতিবাচক। মানে, এটা কর এই আদেশ করলে আমরা যেমন বলি, হা, ওঁ-ও সেইরকমই হ্যাঁ। ওঁ স্বীকারোক্তিও।

সংস্কৃত শাশ্বত-র তো ইংরেজি হয় না। Eternal বা অন্য কোনও ইংরেজি প্রতিশব্দ দিয়ে আমরা শাশ্বত বলতে যা বুঝি তাকে কখনই বোঝানো যায় না। কালাইল সাহেব everlasting yeah বলে কে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে ব্যাখ্যাটা রবীন্দ্রনাথের হয়তো মনঃপূত হয়েছিল, কিন্তু চারণের হযনি। সব ভাষাতেই এমন এমন বহু শব্দ থাকে তার সমার্থক কোনও শব্দই অন্যভাষাতে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আমরা কে কাকে স্বীকার করি তারই উপরে আমাদের একেকজনের আত্মার মহত্ত্ব। কেউ জগতের মধ্যে একমাত্র বিত্তকেই স্বীকার করি, কেউ বা মানকে, কেউ বা আবার করি, খ্যাতিকে, ফলকে।

আদিম আর্যরা ইন্দ্র চন্দ্র বরুণকে ওঁ বলে স্বীকার করতেন। তাই সেই সব দেবতার অস্তিত্বই তাঁদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হত। উপনিষদের ঋষিদের মতে, জগতে ও জগতের বাইরে ব্রহ্মই একমাত্র ও। তিনিই চিরন্তন হা। তিনিই everlasting yeah।

প্রাচীন ভাবতে ব্রহ্মের কোনও প্রতিমা ছিল না। কোনও প্রতীক অথবা চিহ্নও ছিল না। শুধু ছিল এই একটি মাত্র সংক্ষিপ্ত অথবা দিগ্বিদিক মন্দ্রিত করা ধ্বনি, ওঁ। এই ধ্বনির সাহায্যেই ঋষিরা তাদের উপাসনানিশিত আত্মাকে জ্যামুক্ত একাগ্রগামী তীরের মতন ব্রহ্মের মধ্যে পশিয়ে দিতেন। বিদ্ধ করতেন। নিমগ্ন করে দিতেন। এই ধ্বনির মাধ্যমেই ব্রহ্মবাদী সংসারীরা বিশ্বজগতের যা-কিছু সমস্তকেই ব্রহ্মের অনুক্ষণ এবং আদিগন্ত উপস্থিতি দিয়ে সমাবৃত করে রাখতেন।

ওমিতি সামানি গায়ন্তি
ওমিতি ব্রহ্মা প্রসৌতি

মানে ওঁ উচ্চরণেই সমস্ত সামগান গীত হয়। ওই আনন্দধ্বনি।

ওঁ ধ্বনি আদেশবাচকও বটে। ঋত্বিক যখন আজ্ঞা প্রদান করেন, যখন দীক্ষা দেন, তখনও ওঁ উচ্চারণ করেই তা দেন। সমস্ত জগৎ-সংসারের উপরে, আমাদের সার্বিক ক্রিয়াকার উপরে মহৎ আদেশরূপে নিত্যকাল এই ওঁ ধ্বনিই ধ্বনিত হয়ে আসছে। জগতের অভ্যন্তরে এবং জগৎকে অতিক্রম করে গিয়ে যিনি সব সত্যের চরম এবং পরম, যিনি চিরকালীন, যিনি আমাদের মতন প্রত্যেক মানুষেরই জীবনের ধ্রুবতারা, যিনি সর্ব আনন্দের পরমানন্দ, বোধের ভিতরকার বোধ, আমাদের মানব জীবনের সব ক্রিয়া-কৰ্মতে যিনি সমস্ত আদেশের পরমাদেশ, তিনিই ও।

এই প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল চারণের। সেই প্রকৃতি-পাগল, অরণ্য ও ঈশ্বর-সাধক, অথচ সাধারণ গৃহী মানুষটির কথা। বিভূতিভূষণ, চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা দেবীকে (যিনি বিভূতিভূষণের আত্মীয়া হতেন) একটি চিঠিতে একসময়ে লিখেছিলেন,

দেশে ফিরে এসেছি। ঘেঁটুফুল আর নেই। তবে পানকলম শেওলার সুগন্ধি কুচো কুচো সাদা ফুল ফুটেছে নদীজলে। আর শিরিষ ফুল ফুটেছে আমাদের আমবাগানের পেছনে। নক্ষত্রমালা ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর পুঞ্জে পুঞ্জে নব নবরূপে যিনি বিদ্যমান, তিনিই কখনো ঘেঁটুফুলের শুভ্রদলে, কখনো কুঁচকাটার সোনালি ফুলে ঘবের পেছনে এসে ধরা দেন। নিতে পারলেই হল।

তমেব ভান্ত মনুভাতি সর্বং
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।

 তিনি আছেন, তাই সব কিছু আছে, তার আলোতেই জগৎ আলো।

চারণ ভাবছিল, বিনোদবিহারী মুখার্জির কথারই অনুরণন তুলে যে, আমাদের চেয়ে যাঁরা সবদিক দিয়েই বড় তাঁরা সকলেই ঈশ্বরকে জেনেছেন, ঈশ্বর এবং মঙ্গলকে এক করে উপলব্ধি করেছেন।

চারণ ভাবছিল, একেই বোধহয় বলে, সনযোগ। দেবপ্রয়াগের বাজারে হালুইকর তিরলোকনাথের (ত্রিলোকনাথ) দোকানে পুরী হালুয়া খেতে খেতে যদি মহাদেবের ছবির সাপ জড়ানো মাথার উপরে ওঁ চিহ্নটি দেখে পাটনকে প্রশ্ন না করত, তবে কত কীই না জানা থেকে বঞ্চিত হতো।

সেই নক্ষত্রখচিত রাতে ক্ষীণকটি, লাজুক চাঁদও উঠল। যেন, শেষ রাতে দয়িতর সঙ্গে মিলিত হবে বলে অভিসারে বেরিয়েছে চুপিসারে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ শেষ রাতের দিকেই ওঠে। প্রতি রাতেই সে সন্ধ্যাকালের দিকে একটু একটু করে হেঁটে এগিয়ে আসে। এখন রাত কত কে জানে। চারণেব হাতঘড়িটা পুঁটুলির মধ্যেই ভরা আছে। ঘড়ির দাসত্ব আর করে না ও। করবে না। সময়কে, উরুগুয়ের টুপামাররা সন্ত্রাসবাদীদের মতন waylaid করে, সাবড়ে দিয়েছে সে। ঘড়ির নিজের মধ্যে, কোনও নিজস্ব দোষ নেই। কিন্তু নিয়মানুবর্তিতা আর সময়ের বিভাজন যদি শুধুমাত্র অর্থ, আর জাগতিক সাফল্য এবং আবও অর্থ একত্রিত করার সাধনাতেই নিয়োজিত হয়, তবে সেই নিয়ম বা সেই নিয়মে একনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন কি আদৌ আছে?

মনে হয় না আর চারণের। এখন অবশ্যই মনে হয় না।

ভারী ভাল লাগছিল ওর ওই মধ্যরাতে একা দাঁড়িয়ে থাকতে কালের প্রহরীর মতন, নীচের অলকানন্দা আর গঙ্গার শব্দের মধ্যে তারা-ভরা আকাশ আর কিশোরী চাঁদের আলোতে সিঞ্চিত হয়ে, হু-হু করে বয়ে-যাওয়া সুগন্ধি, নির্মল কলুষহীন হিমেল হাওয়ার মধ্যে ওপারের দেবপ্রয়াগের মিটিমিটি প্রদীপের আলো আর নিভু নিভু ধুনির আগুনের দিকে চেয়ে।

এতদিন পরে, এতগুলো বছর ভুল করে, ভুল পথে চলে, ও যেন হঠাই শাশ্বত ভারতবর্ষের সন্ধান পেয়েছে। হৃষীকেশে এসে ভাল তো করেছিলই কিন্তু মর্কট, শ্ৰীমান পাটন চন্দ্রর সঙ্গে দেখা না হলে তো এই ভোলানন্দজি বা শ্যামানন্দজিদের সংস্পর্শে আসতে পারত না। পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তশালী উন্নত দেশের গর্ডন আর স্টিভেন্স-এর চোখ দিয়ে তো নিজের গরিব অনুন্নত দেশকে দেখতে শিখত না! ইউনাইটেড স্টেটস আর অন্য পশ্চিমী দেশ এবং তেলের দৌলতে হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে ওঠা মধ্যপ্রাচ্যর কোনও কোনও দেশের দুর্গন্ধ, অশিক্ষিত, গোঁড়া, ধর্মান্ধ, অনুদার কিছু অমানুষদের কাছে উন্নতি বলতে যা বোঝায় তা যে আদৌ মানুষের উন্নতি নয় এই কথাটা হয়তো সারাজীবনেও বুঝে উঠতে পারত না চারণ, যদি এই সাধু-সঙ্গে এখানে জীবনের বিকেল বেলাতে এসে না পৌঁছত। টাকা, আরও টাকার জন্যে মধ্যপ্রাচ্যেও তত কম ভারতীয় গিয়ে জোটেনি। আশ্চর্য আমাদের এই চারিত্রিক দেউলেপনা।

সেই নিস্তব্ধ, প্রায় অলৌকিক এবং হয়তো আধিভৌতিক পরিবেশে দিগন্তব্যাপী নোমশ কৃষ্ণবর্ণ পুরুষের মতন, আকাশের কালপুরুষের মতন, লক্ষ বছর ধরে অতন্দ্র প্রহরাতে ঋজু দাঁড়িয়ে-থাকা নিথর শিবালিক পর্বতমালার দিকে চেয়ে হঠাৎই ওর দুচোখ ছলছল করে উঠল। এই দ্ৰবভাব, কোনওরকম ব্যক্তিগত আনন্দ-বিষাদের বোধশূন্য। কোনওরকম ব্যক্তিগত স্বার্থশূন্য। ও যে ভারতবাসী, ও যে এই বিরাট, স্বরাট, মহিমাময় এক সুপ্রাচীন দেশের নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের মানুষদের মধ্যের মূল সূত্রটি খুঁজে পেয়েছে, খুঁজে পেয়েছে ওর শিকড়, জেনেছে যে, ও এই শাশ্বত ভারতের এক কীটাণুকীট।

এই বহুধা-বিস্তৃত গভীর দুঃখমিশ্রিত আনন্দেরই কারণে আজ রাতে সে এতখানি দ্রব হল।

ফিরে এসে, ওর প্রদীপটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে চারণও শুয়ে পড়ল। বাইরে গিয়ে অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাতেই শীতের প্রকোপ বুঝতে পারল। ভাবছিল, এই হেমন্তেই এই, তো শীতের শেষে কি হবে?

বাইরে ধুনির আগুনও নিভু নিভু হয়ে এসেছে। আশ্রমে যখন ফেরে চারণ, তখন জুগনুকে দেখেনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে গুহার ভিতরে ঢোকার সময়েই লক্ষ করল যে জুগনু ধুনির দিকে পা দিয়ে গুহার দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে, গুঁড়িসুড়ি মেরে শুয়ে আছে।

পাটন কোথায়, তা পাটনই জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *