সিঁথি ব্রাহ্মসমাজ-দর্শন ও শ্রীযুক্ত শিবনাথ প্রভৃতি ব্রাহ্মভক্তদিগের সহিত
কথোপকথন ও আনন্দ
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ২৮শে অক্টোবর
উৎসবমন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীশ্রীপরমহংসদেব সিঁথির ব্রাহ্মসমাজ-দর্শন করিতে আসিয়াছেন। ২৮শে অক্টোবর ইং ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, শনিবার। (১২ই কার্তিক) কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি।
আজ এখানে মহোৎসব। ব্রাহ্মসমাজের ষাণ্মাসিক। তাই ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের এখানে নিমন্ত্রণ। বেলা ৩টা-৪টার সময় তিনি কয়েকজন ভক্তসঙ্গে গাড়ি করিয়া দক্ষিণেশ্বরের কালীবাটী হইতে শ্রীযুক্ত বেণীমাধব পালের মনোহর উদ্যানবাটীতে উপস্থিত হইলেন। এই উদ্যানবাটীতে ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশন হইয়া থাকে। ব্রাহ্মসমাজকে তিনি বড় ভালবাসেন। ব্রাহ্মভক্তগণও তাঁহাকে সাতিশয় ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। ইহার পূর্বদিন অর্থাৎ শুক্রবার বৈকালে কত আনন্দ করিতে করিতে সশিষ্য কেশবচন্দ্র সেনের সহিত ভাগীরথী-বক্ষে কালীবাড়ি হইতে কলিকাতা পর্যন্ত ভক্তসঙ্গে স্টীমার করিয়া বেড়াইতে আসিয়াছিলেন।
সিঁথি পাইকপাড়ার নিকট। কলিকাতা হইতে দেড় ক্রোশ উত্তরে। উদ্যানবাটীটি মনোহর বলিয়াছি। স্থানটি অতি নিভৃত, ভগবানের উপাসনার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। উদ্যানস্বামী বৎসরে দুইবার মহোৎসব করিয়া থাকেন। একবার শরৎকালে আর একবার বসন্তে। এই মহোৎসব উপলক্ষে তিনি কলিকাতার ও সিঁথির নিকটবর্তী গ্রামের অনেক ভক্তদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া থাকেন। তাই আজ কলিকাতা হইতে শিবনাথ প্রভৃতি ভক্তগণ আসিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই প্রাতঃকালে উপাসনায় যোগদান করিয়াছেন, আবার সন্ধ্যাকালীন উপাসনা হইবে, তাই প্রতীক্ষা করিতেছেন। বিশেষতঃ তাঁহারা শুনিয়াছেন যে অপরাহ্নে মহাপুরুষের আগমন হইবে ও তাঁহারা তাঁহার আনন্দমূর্তি দেখিতে পাইবেন, তাঁহার হৃদয়মুগ্ধকারী কথামৃত পান করিতে পাইবেন, তাঁহার সেই মধুর সংকীর্তন শুনিতে ও দেবদুর্লভ হরিপ্রেমময় নৃত্য দেখিতে পাইবেন।
অপরাহ্নে বাগানটি বহুলোক সমাকীর্ণ হইয়াছে। কেহ লতামণ্ডপচ্ছায়ায় কাষ্ঠাসনে উপবিষ্ট। কেহ বা সুন্দর বাপীতটে বন্ধু সমভিব্যাহারে বিচরণ করিতেছেন। অনেকেই সমাজগৃহে শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন প্রতীক্ষায় পূর্ব হইতেই উত্তম আসন অধিকার করিয়া বসিয়া আছেন। উদ্যানের প্রবেশদ্বারে পানের দোকান। প্রবেশ করিয়া বোধ হয় যেন পূজাবাড়ি — রাত্রিকালে যাত্রা হইবে। চতুর্দিক আনন্দে পরিপূর্ণ। শরতের নীল আকাশে আনন্দ প্রতিভাসিত হইতেছে। উদ্যানের বৃক্ষলতাগুল্মমধ্যে প্রভাত হইতে আনন্দের সমীরণ বহিতেছে। আকাশ, জীবজন্তু, বৃক্ষলতা, যেন একতানে গান করিতেছে:
“আজি কি হরষ সমীর বহে প্রাণে — ভগবৎ মঙ্গল কিরণে!”
সকলেই যেন ভগবদ্দর্শন-পিপাসু। এমন সময়ে শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের গাড়ি আসিয়া সমাজগৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইল।
সকলেই গাত্রোত্থান করিয়া মহাপুরুষের অভ্যর্থনা করিতেছেন। তিনি আসিয়াছেন। চারিদেকের লোক তাঁহাকে মণ্ডলাকারে ঘেরিতেছে।
সমাজগৃহের প্রধান প্রকোষ্ঠমধ্যে বেদী রচনা হইয়াছে। সে-স্থান লোকে পরিপূর্ণ। সম্মুখে দালান, সেখানে পরমহংসদেব সমাসীন, সেখানেও লোক। আর দালানের দুই পার্শ্বস্থিত দুই ঘর — সে-ঘরেও লোক — ঘরের দ্বারদেশে উদ্গ্রীব হইয়া লোকে দণ্ডায়মান। দালানে উঠিবার সোপানপরম্পরা একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই সোপানও লোকে লোকাকীর্ণ; সোপানের অনতিদূরে ২/তটি বৃক্ষ পার্শ্বে লতামণ্ডপ — সেখানে কয়েকখানি কাষ্ঠাসন। তথা হইতেও লোক উদ্গ্রীব ও উৎকর্ণ হইয়া মহাপুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছে। সারিসারি ফল ও পুষ্পের বৃক্ষ, মধ্যে পথ। বৃক্ষসকল সমীরণে ঈষৎ হেলিতেছে দুলিতেছে, যেন আনন্দভরে মস্তক অবনত করিয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতেছে।
ঠাকুর পরমহংসদেব হাসিতে হাসিতে আসন গ্রহণ করিলেন। এখন সব চক্ষু এককালে তাঁহার আনন্দমূর্তির উপর পতিত হইল। যেমন, যতক্ষণ নাট্যশালার অভিনয় আরম্ভ না হয়, ততক্ষণ দর্শকবৃন্দের মধ্যে কেহ হাসিতেছে, কেহ বিষয়কর্মের কথা কহিতেছে, কেহ একাকী অথবা বন্ধুসঙ্গে পাদচারণ করিতেছে, কেহ পান খাইতেছে, কেহ বা তামাক খাইতেছে; কিন্তু যাই ড্রপসিন উঠিয়া গেল, অমনি সকলে সব কথাবার্তা বন্ধ করিয়া অনন্যমন হইয়া একদৃষ্টে নাট্যরঙ্গ দেখিতে থাকে! অথবা যেমন, নানা পুষ্প-পরিভ্রমণকারী ষট্পদবৃন্দ পদ্মের সন্ধান পাইলে অন্য কুসুম ত্যাগ করিয়া পদ্মমধু পান করিতে ছুটিয়া আসে!