০৭. হোটেলের নাম সাংগ্রিলা

হোটেলের নাম সাংগ্রিলা। হোটেল না, স্বপ্নপুরী। স্বপ্নপুরীর লনে আমিন মুখ ভোঁতা করে বসে আছে। তার সামনে টলটলে পানির নহর। সেখানে রঙিন মাছ ঘুরঘুর করছে। আমিনের মাথার ওপর লাল টালির ছাদ। বাগানবিলাস ছাদকে ঘিরে রেখেছে। বাগানবিলাস ফুটিয়েছে নীল পাতা। কিছুদূর পরপর বার্ড অব প্যারাডাইস নামের কলাবতি ধরনের গাছ। গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবী এত সুন্দর কেন?

আমিন ভাই পীরের প্রতি কৃতজ্ঞ। তার ধারণা যা ঘটেছে ভাই পীরের তাবিজের কারণে ঘটেছে। এই তাবিজ এখনো তার গলায় পরা। আমিন ঠিক করে রেখেছে বাকি জীবন সে তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে রাখবে।

ভাই পীরের তাবিজ বেশ অদ্ভুত। তিনি তার খাওয়া সিগারেটের ছাই খানিকটা ভরে দিয়েছেন। বলেছেন, কাজ হলে এতেই হবে। কাজ যে হয়েছে তা তো দেখাই যাচ্ছে।

সামিনা দুগ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে ঢুকল। আমিনের সামনে গ্লাস রাখতে রাখতে বলল, মুখ ভোঁতা করে রেখেছ কেন?

আমিন বলল, আফতাব বদটা কোথায়?

সে কোথায় আমি কী করে জানব! যেই সে টের পেয়েছে আমি তাকে এনেছি চরণদার হিসেবে, তারপর থেকে সে নিখোঁজ। সুন্দর একটা জায়গায় বসে আছ। মুখ থেকে ভোঁতা ভাব দূর করো। দুএকটা ভালো কথা বলো। চার-পাঁচ লাইনের একটা কবিতা বলো।

আমার কবিতা মুখস্থ থাকলে তো কাজই হতো। স্কু

লে পড়া কোনো কবিতা মনে নাই?

ঐ দেখা যায় তালগাছটা মনে আছে।

তালগাছের কবিতাই বলো।

সত্যি বলব?

হ্যাঁ। দুলাইন হলেও বলো।

ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ
ঐ খানেতে বাস করে কানাবগির ছা।

সামিনা বলল, তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। কতটা ভালো লাগছে জানতে চাও?

চাই।

মনে হচ্ছে আমার জীবনে কোনো দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। আমি বেহেশতে আছি। দেখো, আমার চোখে পানি এসে গেছে। আনন্দে যখন চোখে পানি আসে সেই চোখের পানি লোনা হয় না, এটা জানো?

না।

আঙুলে করে চোখের পানি নিয়ে জিভে লাগিয়ে দেখোলোনা লাগবে না।

মিষ্টি লাগবে?

লাগতেও পারে। তবে লোনা লাগবে না।

আমিন আঙুলে করে চোখের পানি নিয়ে জিভে ছোঁয়াল। অবাক হয়ে বলল, আসলেই তো নোনা লাগছে না, বরং মিষ্টি ভাব আছে।

কমলার রসটা খাও। এর মধ্যে কিছু একটা দিয়েছে। খেতে অদ্ভুত ভালো হয়েছে।

আমিন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, আসলেই তো অদ্ভুত।

সামিনা বলল, এদের কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে যাব।

আমিন বলল, তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে!

সামিনা বলল, প্রেগন্যান্সির সময় সব মেয়েকে সুন্দর লাগে। তখন ব্যালেন্সড হরমোন সিক্রেশন হয় এই কারণে। এখন কাজের কথা বলি। আমি তোমাকে নিয়ে এক মাস ঘুরব।

অবশ্যই।

আজ শপিংয়ে যাব। যমজ বাচ্চাদের জন্য বেবি স্ট্রলার পাওয়া যায় সেটা কিনব।

তোমার যমজ বাচ্চা হবে নাকি?

আমার ধারণা তাই। হোক বা না হোক, আমি ডাবল স্ট্রলার কিনব।

তোমার কিনতে ইচ্ছে হলে অবশ্যই কিনবে।

আমি ওদের একজনের নামও ঠিক করে রেখেছি–আলিতা। অন্যজনের নাম তুমি রাখবে।

মেয়ে হচ্ছে?

এখনো তো জানি না কী হচ্ছে। আমার মন বলছে যমজ মেয়ে। চার মাস পার হলে ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাফি করে বলতে পারবেন।

আমিন বলল, একজন ভালো ডাক্তারের খোঁজ বের করো তো। আমি ডাক্তার দেখাব।

তোমার কি হয়েছে যে ডাক্তার দেখাবে।

গায়ে দুর্গন্ধ।

সামিনা বলল, তোমার গায়ে কোনো দুর্গন্ধ নেই। তোমাকে রাগাবার জন্য এইসব বলেছি।

বলো কি?

সামিনা হাসতে হাসতে বলল, আমি একটা বই কিনেছি সেখানে মানুষকে রাগানোর নানান কৌশল দেয়া আছে। বইটার নাম How to annoy some one।

দু-একটা কৌশল বলো তো। আমিও শিখে রাখি।

সামিনা জুসে চুমুক দিতে দিতে বলল, পুরুষ মানুষ সবচে বেশি রাগে যখন দ্রভাবে তাকে বোকা বলা হয়। তুমি যদি কাউকে বলো তোমার 1.Q. রুই মাছের চেয়ে বেশি, তাহলে সে রাগবে।

আমিন বলল, রাগবে কেন?

সামিনা বলল, তুমি বাংলাদেশের সেরা বোকাদের একজন। কাজেই তুমি বুঝতে পারবে না।

আমিন হাসল। সামিনা তাকে বোকা বলছে, এটাও শুনতে ভালো লাগছে।

আমিন বলল, অরেঞ্জ জুস খেয়ে মাথা ঘুরছে কেন বলো তো?

সামিনা বলল, তুমি অরেঞ্জ জুস খাচ্ছ না। তুমি খাচ্ছ Tequila Sunrise। এই জন্যে মাথা ঘুরছে। অরেঞ্জ জুসের সঙ্গে টাকিলা মেশানো।

টাকিলা জিনিসটা কি? মদ নাকি?

হুঁ।

নামধাম কোত্থেকে শিখেছ?

তোমার বন্ধু আফতাব সাহেবের কাছে শিখেছি। ওস্তাদ লোক।

তোমার মতো ওস্তাদ না।

সামিনা হাসতে হাসতে বলল, তা ঠিক। তোমাকে আরেকটা টাকিলা সানরাইজ দিতে বলি?

পাগল নাকি?

আমার কথা শোনো, আরেকটা নাও, খেয়ে মাতাল হয়ে যাও।

লাভ?

মাতাল হলে একেকজন একেক ধরনের কাণ্ড করে। তুমি কি করো সেটা আমার দেখার ইচ্ছা।

মাতাল হয়েছে কি না বুঝবে কিভাবে?

সামিনা হাসতে হাসতে বলল, যখন দেখবে তোমার সামনে দুজন সামিনা বসে আছে তখন বুঝবে তুমি মাতাল।

দুটা সামিনা?

হুঁ। একটা রিয়েল, আরেকটা আনরিয়েল।

আমিন আগ্রহ নিয়ে টাকিলা সানরাইজ খাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে দুজন সামিনা দেখে।

 

রুস্তম মুনিয়ার আউট লাইন করা ক্যানভাস নিয়ে বসেছে। তার ছবি আঁকা আগ্রহ নিয়ে দেখছে তার পুত্র বিভাস।

রুস্তম খুব ভালো করে জানে বিভাস তার সামনে নেই। তার ব্রেইন বিভাসকে তৈরি করেছে। এমনভাবে করেছে যে, রুস্তম ইচ্ছা করলে ছেলেকে স্পর্শও করতে পারে।

বাবা! তোমার ছবিটা খুব সুন্দর হচ্ছে।

ধন্যবাদ।

ছবিটার গায়ে কাপড় নেই কেন?

আমার আর্ট টিচার আউট লাইন এইভাবে করে দিয়েছেন।

তুমি কাপড় পরিয়ে দিও।

আচ্ছা।

মেয়েটা কে?

ওর নাম মুনিয়া।

ছবিতে মেয়েটাকে যত সুন্দর লাগছে সে কি এত সুন্দর?

হুঁ।

আমার আঁকা জবা ফুলের ছবিতে তুমি কি এই মেয়েটির ঠিকানা লিখে রেখেছ?

না। মুনিয়ার ঠিকানা আমি জানি না। জবা ফুলে ছগীরের ঠিকানা লেখা।

ছগীর কে?

সে একজন দুষ্টলোক।

দুষ্টলোকদের কোনো ঠিকানা থাকে না বাবা। দুষ্টলোকরা থাকে জেলখানায়।

কিছু দুষ্টলোক জেলখানার বাইরে থাকে। আবার কিছু ভালোমানুষ থাকে জেলখানায়। আমার বাবা কোনো খুন করেন নাই। মা নিজে শাড়ি পেঁচিয়ে ফাঁস নিয়েছিলেন। অথচ দেখো খুনের দায়ে বাবা জেলখানায়।

তোমার বাবা ভালো মানুষ?

ধান্দাবাজ বোকা মানুষ, তবে জেলে থাকার মতো খারাপ না।

বাবা! আমি এখন চলে যাই। দেরি করলে মা বকা দেবে।

আচ্ছা যাও।

তোমার জানালাটা বন্ধ করে দাও বাবা। বৃষ্টির পানি ঢুকছে।

রুস্তম জানালা বন্ধ করে দেখল, বিভাস নেই। ঘর ফাকা। সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ছবি আঁকতে বসল।

দরজার বাইরে থেকে ছগীর বলল, রুস্তম ভাই! কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি দেখলাম আপনি হাত-পা নেড়ে কথা বলছেন। আপনার অবস্থা তো ভালো না। পাগলের তেলটা নিয়া আসা দরকার। নারায়ণগঞ্জ থেকে আনতে হবে। দেখি কাল-পরশু চলে যাব।

রুস্তম বলল, আচ্ছা।

আপনি তো ভালো পিকচার আঁকেন! আমার এক বন্ধু ছিল শামীম নাম। সেও ভালো পিকচার আঁকত। রিকশার পিছনে ভালো ভালো পিকচার সব তার আঁকা। শাবানা ম্যাডামের এমন এক পিকচার এঁকেছিল আমি বললাম, দোস্ত পায়ের ধুলা দে চেটে খাব। আপনি যে মেয়েটারে আঁকতেছেন সে কে?

তার নাম মুনিয়া।

ও আচ্ছা এর কথাই আমাকে বলেছিলেন। মেয়ে তো বেহেশতের হুরের চেয়েও সুন্দর। চোখ বন্ধ করে ফিলমের হিরুইন হইতে পারবে।

রুস্তম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। পেইন্টিংয়ে মেয়েটা যত সুন্দর এসেছে বাস্তবে ততটা সে না। এ ছবির মেয়ের সৌন্দর্য আরোপিত। কে আরোপ করেছে?

এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

ছগীর ঘরে ঢুকে রুস্তমের সামনে বসল। হাই তুলতে তুলতে বলল, আপনার এখানে আরামে থাকলাম। এখন চলে যাব।

রুস্তম বলল, কোথায় যাবেন?

কোথায় যাব বলব না। বিপদ আছে।

কি বিপদ?

ধরেন আমার খোঁজে পুলিশ এসে ধরল আপনাকে। ডলা দিতে দিতে বলল, বিরানি ছগীর কোথায়? আপনাকে তখন বলতেই হবে। পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে যাব। বুঝেছেন সমস্যা?

হুঁ।

তবে আপনাকে বলা যায়। আমি উঠব তাজ হোটেলে। তাদের সাথে ব্যবস্থা আছে।

যেখান থেকে আপনার জন্য বিরানি আনা হয় সেই হোটেলে?

হুঁ।

আপনার ছেলেমেয়ে নাই?

এক মেয়ে ছিল। তার হিস্টোরি শুনবেন?

শুনব।

মেয়ের নাম সখিনা। আমি ডাকতাম সখি। আমি, মেয়ে আর মেয়ের মা থাকতাম বিএনপি বস্তিতে। বিএনপি বস্তি চিনেন?

না।

চিনলেও চলবে। সখির বয়স তখন ছয় কিংবা সাত। সে বিরানি খাবে। ভাত খাবে না। আমি ঠেলা চালাই, মেয়ের জন্যে বিরানি কই পাব। তারে বুঝায়ে বললাম, সে বুঝ মানে না। শেষে দিলাম থাপ্পড়। রাত্রে মেয়ের আসল জ্বর। জ্বরের মধ্যেও বিড়বিড় করে বলে, বাবা বিরানি খাব। মেয়েটা মারা গেল পরদিন দুপুরে। তার মিত্যুর পর থেকে আমি বিরানি ছাড়া কিছু খাই না। যে বিরানির জন্যে আমার সখি মা মারা গেল, আমি ঠিক করলাম বাকি জীবন এই জিনিসই খাব।

মেয়ের মা কোথায়?

জানি না কই আছে। পাঁচ বছর জেল খাটলাম। বাইর হইয়া তারে আর পাই নাই।

খোঁজ করেছেন?

হুঁ। একেক জন একেক কথা বলে। কেউ বলে মারা গেছে, কেউ বলে বেশ্যাপল্লীতে আছে।

রুস্তম বলল, আপনার বিরানি খাবার গল্প শুনে মন খারাপ হয়েছে। আমার সহজে মন খারাপ হয় না। আজ হয়েছে। আপনার মেয়ের কোনো ছবি কি আছে? তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।

আমার কইলজার মইধ্যে ছবি আছে আর কোনোখানে নাই। রুস্তম ভাই! আমি সকালে চলে যাব। আপনার জন্যে পাগলের তেলের ব্যবস্থা করব। এই বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। আপনার কোনো শত্রু থাকলে নামঠিকানা বলেন, শেষ করে দিয়ে যাব, তার জন্যে কোনো টাকা-পয়সা নিব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *