হে নির্বোধ আরববাহিনী। তোমরা এ অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে দিতে পারবে বটে কিন্তু পৌত্তলিকতা এদেশের মানুষের রক্তের সাথে মিশে গেছে। পৌত্তলিকতার প্রেতাত্মাদের এ দেশ থেকে নির্মূল করতে পারবে না।
নিরূন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ছিল রাজা দাহিরের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। কিন্তু আরমান ভিলা বেদখল হয়ে যাওয়ার পর দাহিরের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নিক্সনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুর্গশহর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় রাজা দাহিরের প্রতিক্রিয়া হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিরূন বেদখল হয়ে যাওয়ার পর রাজা দাহিরের প্রাসাদে তার সকল পরিষদ ও মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ এবং উপদেষ্টারা সমবেত হলো।
একজন সামরিক উপদেষ্টা বলল, “মহারাজ! আরববাহিনীকে নিরূন থেকে আর সামনে অগ্রসর হতে দেয়া যাবে না।”
আমাদের নির্দেশ দিন মহারাজ। আমরা অকৃতজ্ঞ সুন্দরীকে গোষ্ঠীসহ নিপাত করে দেই। আর ওর শরীর থেকে মাথা দ্বিখণ্ডিত করে আপনার পায়ের কাছে এনে ফেলে দেই, বলল অপর একজন সামরিক কর্তকর্তা।
শুনতে পেলাম আরব বাহিনীর সেনাপতি একটা বালক। কিন্তু ওর চাল চলন খুবই তেজস্বী। আমাদের সামরিক কৌশল পরিবর্তন করা দরকার, মহারাজ! বলল অপর একজন।
“ওকে রাজধানী পর্যন্ত আসতে দেয়া ঠিক হবেনা মহারাজ! আমরা ওদের নিরূনেই শেষ করে দিতে পারি, বলল অপর এক সেনাধ্যক্ষ।
মহারাজ! আমরা নিরূন অবরোধ করতে পারি। ওদের মিনজানিকগুলো এখনো বহুদূরে নদীতে রয়ে গেছে।” বলল আর একজন সামরিক উপদেষ্টা।
রাজা দাহির পিছনে হাত বেধে তার কক্ষে পায়চারি করছিল। তার দৃষ্টি অবনত। যখন তার উদ্দেশ্যে কেউ উপদেশ দিতো, রাজা এক পলক
আড়চোখে কড়া দৃষ্টিতে তাকে একটু দেখে নিতো। প্রত্যেকের পরামর্শ শুনে রাজা দাহির রহস্যজনক ভঙ্গিতে একটু শুষ্ক হাসির ভাব করতো। যতোলোক রাজার দরবারে হাজির ছিল, প্রত্যেকেই কোন না কোন কথায় রাজাকে উপদেশ দিল। সবার কথা বলা শেষ হলে কক্ষে নেমে এলো নীরবতা। রাজা দাহিরের পায়চারির সামান্য আওয়াজ ছাড়া কক্ষে কারো নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না।
এক পর্যায়ে পায়চারিরত রাজা থেমে গেল। রাজা দাহিরের অভ্যাস এই ছিল যে, সে যখন কোন কথা বলতো, তখন পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীন শব্দে উচ্চ আওয়াজে বলতো। ঘুমন্ত মানুষও তার আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠত। আর সে যখন কোন শাহী ফরমান জারী করতো, তখন তার সিংহাসনে বসে রত্নখচিত হীরের তরবারীর হাতলে মুষ্টিবদ্ধ করে এমন এক ধরনের গাম্ভীর্য কণ্ঠে ঘোষণা দিতো যে, দেখে মনে হতো সে শুধু সিন্ধু অঞ্চলের নয় যেন গোটা মহাভারতের মহারাজা।
তখন তার সকল দরবারী রাজা দাহিরের দিকে এক পলকে তাকিয়ে থেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যেতো। সকল উপদেষ্টা ও সেনাকর্মকর্তাদের পরামর্শ শোনার পর রাজা দাহির তার সিংহাসনে আরোহণ করে সকলের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। অতঃপর মহারাজার মতো ভাবগাম্ভীর্য কণ্ঠে বলল, “আমি ওদেরকে এখানে আসতে দেবো, কিন্তু ওরা আসবে বটে তবে আমাদের পায়ের নীচে ওদের গর্ব অহংকার মিটিয়ে দেয়ার জন্যে আসবে। কোন আরব মায়ের নির্বোধ শিশুটি হয়তো এখন নিজেকে জঙ্গলের বাঘ ভাবছে। আমরা তাকে একথাই বলে দিতে চাই, সেই মূর্খ বাঘ বটে কিন্তু রাজধানী এসে সেই বাঘ দেয়ালের দূরে বসে নিজের ক্ষতস্থানগুলো চাটবে। তোমরা কি জানোনা, সিন্ধু অঞ্চলের সিংহ জয়সেনা ওর পথে পাহাড়ের মতো প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে? তোমরা জেনে রেখো, ব্রাহ্মণবাদে এক আরব বালক ও এক সিন্ধি যুবকের মোকাবেলা হবে। এরপরই নির্ধারিত হবে এদেশে হিন্দুত্ববাদ থাকবে না ইসলাম। তোমরা হৃদয়ে একথা ভালো ভাবে লিখে নাও যে, আমরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের সেনা বাহিনীকে প্রতিরোধ করছিনা, ইসলামকে প্রতিরোধ করছি যা অতি অল্প সময়ে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
তোমরা কেউ জানো, কেন এতো অল্প সময়ে চারদিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে? শহরের প্রধান হিন্দু পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে দাহির বলল, ঋষি মহারাজ। এখন আপনি ওদের সেই কারণটি জানিয়ে দিন।
ইসলাম প্রসার লাভ করার কারণ হলো, এ পর্যন্ত ইসলামের মোকাবেলা হয়েছে যেসব ধর্মের সাথে সেই সব ধর্ম সত্য ছিলনা।” বলল পণ্ডিত। এক দিকে ছিল অগ্নিপূজারী পারসিক আর অপর দিকে ছিল যীশুখৃস্টের পূজারী খৃস্টান। এসব ধর্মের নিজস্ব কোন শক্তি ছিলনা। পক্ষান্তরে হিন্দুধর্ম দেবদেবীদের ধর্ম। আমাদের দেবদেবীরা ইচ্ছা করলে আকাশ থেকে আগুন বর্ষণ করতে পারে, ইচ্ছা করলে একটি পাহাড় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তুলে নিয়ে বসিয়ে দিতে পারে। ইচ্ছা করলে শত্রুদের ওপর পাহাড় চাপিয়ে দিতে পারে। এসব মুসলমান হিন্দুদেরকে অগ্নিপূজারী আর খৃস্টানদের মতো মনে করে বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের দেশে চলে এসেছে।
“আমাদের ধর্ম এমন এক ধর্ম আমাদের মেয়েরা পর্যন্ত যে ধর্মের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে পারে।” বলল রাজা। ধর্ম ও দেশের জন্য আত্মদানকারী নারীকে দেবতারা মাটি থেকে উঠিয়ে আকাশে তুলে নেন এবং তাদেরকে দেবতাদের সান্নিধ্যে রাখেন।”
“মহারাজের জয় হোক! আমাদের নারী সমাজ তখনই কেবল আত্মদান করবে যখন আমরা সবাই মরে যাবো” বলল এক প্রবীণ যোদ্ধা।
“আরে আমি যা বলেছি, তুমি তা বুঝতে পারনি। আমাদের তরুণী মেয়েরা ইতিমধ্যে এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে।
কি যেন নাম… ছেলেটার! বলল পণ্ডিত। হ্যাঁ, বিন কাসিম। সে তরবারী আর যুদ্ধটাকে একটা খেলা মনে করছে। সে বুঝতে পারছেনা, দেবদেবীদের আগুন নিয়ে খেলছে সে। আমাদের কোন সুন্দরী তরুণী যদি ওর সামনে চলে যায় তাহলে ওর হাত থেকে তরবারী পড়ে যাবে। কোন বোকা শিশুকে যদি সামান্য একটা খেলনা দেখাও তাহলে হাতের দামি খেলনাটাও সে ফেলে ওইটার প্রতি ঝুঁকবে এমনটা কি তোমরা কখনো দেখেছ? সবাইকে জিজ্ঞেস করল পণ্ডিত।
“কিন্তু এসব স্নেচ্ছের বিরুদ্ধে আমরা এখন সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করিনি।” বলল রাজা। ওকে যখন উন্মুক্ত ময়দানে আমাদের মুখোমুখি আসতে বাধ্য করব, তখন সে সব মারপ্যাচ ভুলে যাবে। আমরা তাকে এমন খারাপ অবস্থায় আমাদের সামনে আনবো যে, হাত জোড় করে আমাকে বলবে, মহারাজ। ভগবানের দোহাই, আপনি আমাকে আপনার কাছে আশ্রয় দিন। বলল রাজা দাহির। রাজা দাহিরের সেই দিনের বৈঠকে উজির বুদ্ধিমান ছিলনা। উজির বুদ্ধিমান রাজ মহলেরই অপর একটি কক্ষে রাজার স্ত্রীরূপী বোন মায়ারাণীর
সাথে বৈঠক করছিল। যে সুন্দরী অস্ত্র প্রয়োগের কথা রাজা বৈঠকে সামরিক উপদেষ্টাদের জানালো, সেই কৌশল প্রয়োগের নানা বিষয় নিয়ে বুদ্ধিমান মায়ারাণীর সাথে কথা বলছিল। মায়ারাণী ও বুদ্ধিমান এই কৌশল প্রয়োগের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষী, দুটি জাতি ধোকা প্রতারণা এবং কাপুরুষতাকে অস্ত্রের চেয়েও বেশী মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত করেছে, তন্মধ্যে একটি হলো ইহুদি আর অপরটি পৌত্তলিকতাবাদী হিন্দু। ইহুদিরা কখনো প্রকাশ্য রণাঙ্গনে মুসলমানদের মোকাবলায় অবতীর্ণ হয়না। ইহুদিরা সব যুগেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। ওদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার সম্পদ আর প্রশিক্ষিত সুন্দরী নারী। হিন্দুদের ইতিহাসও কাপুরুষতা, দুর্নীতি ও চক্রান্তের বেড়াজালে ভরপুর। হিন্দুরা যখনই রণাঙ্গনে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছে তখন ওদের সুন্দরী ললনাদেরকে মুসলমানদের হাতে তুলে দিয়েছে। পরবর্তীতে এই নারীদের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের শিকড় কেটেছে। হিন্দুদের নারী অস্ত্র প্রয়োগের সবচেয়ে বড় উদাহরণ মুগল শাসক আকবর। যে জন্য এখনো হিন্দুরা আকবরকে মোগলে আযমের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। মোগল সম্রাট আকবরের হেরেম হিন্দু চক্রান্তকারীরা প্রশিক্ষিত ও ধোকাবাজ রমণীদের দিয়ে ভরে ফেলেছিল। হিন্দু রমণীদের ফাঁদে পড়ে মোগল শাসক আকবর এতোটাই বিভ্রান্ত হয়েছিল যে, পৌত্তলিকতা, খৃস্টবাদ ও তৌহিদের মিশ্রণ ঘটিয়ে সে দীনে ইলাহী’ নামে একটি কুফরী মতাদর্শের জন্ম দিয়েছিল। যে জাতি মেয়েদের এক রাতের স্বামীর স্পর্শ পাওয়ার পর বিধবা হলে স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে সেই জাতির পক্ষে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কন্যা জায়েদের সম্ভ্রম বিকিয়ে দেয়া নিন্দনীয় না হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিরূনবাসী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে এভাবেই তাদের শহরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল যেন কোন অবতার আসমান থেকে জমিনে অবতরণ করেছে। বিন কাসিম নিরূন শাসক সুন্দরীকে স্বাধীন শাসকের মর্যাদায় অভিসিক্ত করলেন। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তিনি জাহিল বাসরী নামে এক সহযোদ্ধাকে নিরূনের কোতোয়াল নিযুক্ত করলেন। অতঃপর শহর শাসন সম্পর্কে সাধারণ ঘোষণা দিয়ে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। বর্তমানে এটা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল তখনকার নিরূন আর বর্তমানের হায়দারাবাদের কোন মসজিদটির ভিত্তি মুহাম্মদ বিন কাসিম নিজ
হাতে করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম নিরূন শহরের কব্জা পূর্ণ করলেও অগ্রাভিযান শুরু করা সম্ভব ছিলনা। কারণ হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশনা মতো সাহায্যকারী রসদপত্র পৌছা এবং সামানপত্র পরিবহণের পথ নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার আগে অগ্রাভিযান ছিল অসম্ভব। বিন কাসিম এ বিষয়টা যথার্থই অনুধাবন করেছিলেন যে, রাজা দাহিরের লক্ষ আরব সৈন্যদের ডাভেল বন্দর থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া; যাতে তাদের রসদ সরবরাহ পথ দীর্ঘ হয় আর সরবরাহ লাইন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
রাস্তা নিরাপদ রাখার পাশাপাশি গোয়েন্দাদের অগ্রিম অনুসন্ধানী তৎপরতাও জটিল হয়ে উঠল। আরব সৈন্যরা সিন্ধু অঞ্চলের যতোই ভিতরে প্রবেশ করছিল তাদের জন্যে পথ ঘাট, শত্রু পক্ষের অবস্থান ও স্থানীয় ভাষা ইত্যাকার সমস্যাবলী তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠল।
এদিকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল সিন্ধু অভিযানের দিকে। তিনি রীতিমত সরবরাহ পাঠাচ্ছিলেন। সরবরাহ পাঠাতে ডাভেল বন্দর প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হলো। মুহম্মদ বিন কাসিম কোন সামরিক সংঘর্ষ ছাড়াই নিরূন শহর দখল করেন। নিরূনের পরিবর্তিত সেনাধ্যক্ষ বিন কাসিমের শহরে পদার্পণের সময়েই কয়েকজন জুনিয়রকে নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে শহর ত্যাগ করেছিল। অথচ বিন কাসিমের কাছে গোয়েন্দারা খবর দিয়েছিল, নিরূনের সেনাবাহিনী এখন মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত কিন্তু নিরূন শাসক সুন্দরী যখন দাহিরের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিরূন পৌছলেন এবং শহরে প্রবেশ করেই প্রহরীদেরকে প্রধান গেট খুলে দিয়ে আরব বাহিনীকে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা করলেন, তখন শহরের বাসিন্দারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুসলিম সৈন্যদের স্বাগত জানায় এবং সেনা বাহিনীকেও প্রতিরোধ থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয়।
নিরূনবাসীর প্রতিক্রিয়া ও গোয়েন্দাদের পূর্ব রিপোর্টের ভিত্তিতে বিন কাসিম এই সিদ্ধান্তে উপণীত হলেন, হিন্দু সৈন্যরা যে কোন সময় আমাদের জন্য হুমকি হতে পারে। সেই ধারণা থেকে শহর দখলে আসার পর তিনি হিন্দুদেরকে একটা ময়দানে সমবেত করে দুভাষীর মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হিন্দু রাজের সৈন্যরা শোনো, তোমাদের মধ্যে এখনো হয়তো এই ভয় রয়েছে যে, আমরা তোমাদের হত্যা করব। অবশ্য তোমাদের বেলায় তাই
হওয়া স্বাভাবিক ছিল। দুনিয়া জুড়ে এই রীতিই চলে এসেছে যে, বিজিত রাজ্যের সৈন্যদেরকে বিজয়ী বাহিনী হত্যা করে কিন্তু এই নীতি সেই শাসকের সৈন্যরাই করে থাকে যারা রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করে। এরা পরাজিত সৈন্যদের বিপদের ঝুঁকি মনে করে হত্যা করে। আমরা সাম্রাজ্য বিস্তার ও শাসন করার লিঙ্গ নিয়ে এদেশে আসিনি। আমরা আল্লাহর পবিত্র পয়গাম নিয়ে হিন্দুস্তানে এসেছি। তোমরা পরাজিত হয়েছ বলে তোমাদের ওপর আমরা আমাদের ধর্ম-চাপিয়ে দেবোনা। আমরা তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিচ্ছি অবশ্য সেই সাথে তোমাদেরকে আহবান করছি তোমরা আমাদের ধর্মকে দেখো, যদি তোমাদের দৃষ্টিতে আমাদের ধর্ম সত্য মনে হয় তাহলে তা গ্রহণ করো; সেই সাথে একথাও ভেবে দেখার কথা বলব, তোমাদের কথিত দেবদেবীর যেসব মূর্তি আমাদেরকে শহরে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি, ওরা তোমাদের কি উপকার করতে পারবে। ওরাতো নিজেদের শরীর থেকে একটা মাছিও দূর করতে পারে না। এসব মানুষের তৈরী প্রভু। আসলে ইবাদতের উপযুক্ত মাত্র একজন, যিনি নিরাকার অদ্বিতীয় যিনি সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মনে রাখবে, তোমাদের ক্ষমা করে দেয়ার অর্থ এই নয় যে, তোমরা স্বাধীনতা পেয়ে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে মেতে উঠবে। এমন তৎপরতায় লিপ্ত হলে মনে রেখো, তোমাদের কোন তৎপরতাই আমাদের অজানা থাকবেনা। মনে রাখবে, তোমাদের প্রতিটি কথা আমাদের কানে পৌছবে। তোমাদের জানিয়ে দিতে চাই তোমাদের কেউ যদি শহর থেকে চলে যেতে চাও তবে যেতে পারো, কিন্তু সে আর এই শহরে আসার অনুমতি পাবে না।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, তাৎক্ষণিত ভাবেই কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এদের ইসলাম গ্রহণের প্রধান কারণ হয়তো ছিল জীবনাশঙ্কা। কারণ সামরিক সদস্যদেরকেও সাধারণ ক্ষমার আওতায় ক্ষমা করে দেয়া হবে এটা অনেকের বিশ্বাস হচ্ছিল না। জীবন রক্ষার জন্য এদের কেউ তাৎক্ষণিক রক্ষাকবচ হিসাবে ইসলাম গ্রহণকেই যৌক্তিক মনে করেছিল। কিন্তু সকল সৈন্যকেই যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো, তখন অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে এরা “আরব শাহজাদার জয়” শ্লোগানে ময়দান মুখরিত করে তুললো। শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম সৈন্যদের ব্যাপারে চরম ভীতি বিরাজ করছিল। কারণ আরমান ভিলা মুসলিম বাহিনী কব্জা করার পর থেকেই
শহরের মন্দিরগুলোতে পুরোহিত পূজারীদের মধ্যে প্রচারণা চালাচ্ছিল, মুসলিম মানে অত্যাচারি জালেম। ওরা কোন শহর দখল করলে সেখানকার কোন ঘরের জিনিসপত্র অক্ষুন্ন রাখেনা এবং যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে শ্লীলতাহানি ঘটায়। কিন্তু নিরূনের অধিবাসীরা দেখলো হিন্দু পুরোহিতদের সব প্রচারণাই অবাস্তব। বিজয়ী মুসলিম সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করে লুটতরাজ তো দূরের কথা কোন ঘরে উকি দিয়েও দেখেনি। শহর জুড়ে সুশৃঙ্খল নিরাপত্তা বিরাজমান। পণ্ডিত পুরোহিতদের আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় এবং মুসলিম বাহিনীর অভাবনীয় সদাচার শহরের অধিবাসীদের এতোটাই মুগ্ধ করেছিল যে, বিন কাসিম শহরের কেন্দ্রস্থলে যে মসজিদের ভিত্তিস্থাপন করেন স্থানীয় অধিবাসীরা স্বেচ্ছা শ্রম দিয়ে সেই মসজিদ নির্মাণে সৈন্যদের সাথে সহযোগিতা করেছিল। শহরের নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে বিন কাসিমের কয়েক দিন ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে। তিন চার দিন পর এশার নামাযান্তে সারা দিনের ক্লান্তি ও পরিশ্রমে কারণে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে তিনি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় প্রহরীরা তাকে খবর দিলো, স্থানীয় কিছু সংখ্যক মহিলা প্রধান সেনাপতির সাথে সাক্ষাত করতে চায়। বিন কাসিম সাথে সাথেই তাদেরকে ভিতরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। সাক্ষাত প্রার্থীদের মধ্যে সাত আটজন ছিল যুবতী আর একজন অর্ধবয়স্কা মহিলা। তারা সবাই ছিল হিন্দু এবং একজনের চেয়ে অপরজন সুন্দরী।
ভিতরে প্রবেশ করেই তারা সবাই হিন্দু রীতি অনুযায়ী বিন কাসিমকে হাত প্রসারিত করে প্রণাম করল। অর্ধবয়স্কা মহিলা সামনে অগ্রসর হয়ে বিন কাসিমের পায়ে সিজদা করল। বিন কাসিম মহিলাকে সিজদা করতে দেখে পিছনে সরে গেলেন। এরপর যুবতীরা অগ্রসর হয়ে কেউ তাঁর হাতে চুমু খেতে লাগল, আর কেউ তার জামা ধরে চোখে লাগাল সেই সাথে প্রাণখোলা আবেগপূর্ণ ভাষায় তাঁর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা প্রকাশ করতে লাগল। বিন কাসিম সাথে সাথে তাঁর দুভাষীকে ডেকে তার মাধ্যমে তাদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন।
তিনি জানতে চাইলেন, রাতের বেলায় তোমরা এখানে কেন এসেছ? বয়স্কা মহিলা বলল, এসব তরুণীকে বেশ কিছু দিন ধরে মাটির নীচে গোপন কক্ষে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই লুকানো অবস্থা থেকে এদেরকে বের করে আনা হয়েছে। আমাদের লোকজন এদেরকে লুকিয়ে রেখেছিল।”
লুকিয়ে রেখেছিল কেন?’
“আমাদেরকে বলা হয়েছিল মুসলিম সৈন্যরা যে শহর জয় করে প্রথমেই সেই শহরের যুবতী তরুণীদের ধরে এনে সৈন্যরা ভাগাভাগি করে নেয়।” বলল অর্ধবয়স্কা মহিলা। আমাদের আরো বলা হয়েছিল, মুসলমান খুবই হিংস্র জাতি, এদের আচার ব্যবহার হিংস্র জন্তুর মতো। মুসলিম সৈন্যরা যখন শহরে প্রবেশ করছিল, তখন শহরের সকল হিন্দু তরুণী যুবতীদেরকে যে যেখানে পেরেছে। লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমাদের যেমনটা বলা হয়েছিল মোটেও তেমন কিছু হয়নি। গতকাল আমরা জানতে পেরেছি, আপনি সামরিক বেসামরিক সবার জন্যই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। আমাদের যে ধরনের ভয় দেখানো হয়েছিল, আপনার সৈন্যরা যদি তেমনই হতো তাহলে ইতিমধ্যে তেমন কিছু ঘটত। কিন্তু আপনার সৈন্যদের সদাচার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা দেয়ার কথা শুনে সকল তরুণী যুবতীদেরকেই লুকানো অবস্থা থেকে বের করে আনা হয়। কোন বিরূপতা না দেখে সবাই অবাধে শহর জুড়ে ঘোরা-ফেরা করে কিন্তু আপনার কোন সৈন্য অত্যাচার উৎপীড়ন করবে তো দূরে থাক কোন তরুণির প্রতি তাকিয়েও দেখেনি।”
“তোমারতো কোন ভয় ছিল না, তুমিতো বাধকে উপনীত হয়েছে।”
‘এরা আমাকে নিয়ে এসেছে। আপনার মহানুভবতা, মমতা ও দয়ার কথা শুনে এরা আপনাকে দেখার জন্য, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এরা আপনার দয়ার জন্য আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতে চায়। কেন এরা আপনার কৃতজ্ঞতা জানাবে না, চেয়ে দেখুন, এদের মতো সুন্দরী রূপসীদের প্রতি কোন বিজয়ী সৈন্যরা হাত না বাড়িয়ে থাকতে পারে? এদের আগ্রহকে সম্মান দিয়ে আমি তাদের এখানে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছি।” ‘তোমরা যেটাকে বিস্ময়কর মনে করেছ, এটা আমাদের কাছে মোটেও বিস্ময়কর নয়, আমরা এতো দূর থেকে আনন্দ ফুর্তি করতে আসিনি। আমরা তোমাদেরকে বাদী দাসী বানাতেও আসিনি। তোমাদের ইজ্জত সম্মান ধনসম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা আমাদের প্রধান কর্তব্য। এটা আমাদের ধর্মের নির্দেশ। তোমরা এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে পারো।’
“তরুণীদের মনোভাব এমন ছিল যে, তারা কেউ এখান থেকে ফিরে যেতে চায়না। একতো এরা প্রত্যেকেই ছিল সুন্দরী রূপসী, তদুপরি এদের অঙ্গভঙ্গিও ছিল যে কোন পুরুষের মধ্যে কামনা জাগানোর মতো উত্তেজক। কিছুক্ষণ পর আবারো বিন কাসিম তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা স্মরণ
করিয়ে দিলে তরুণিরা ঘর ছেড়ে যেতে উঠল কিন্তু তরুণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী রূপসী তরুণী তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সে বলল,
‘আমি আরো কিছু সময় আপনার সামনে একান্তে থাকতে চাই।’ ‘এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে তুমি?’
আপনাকে মানুষ নয় দেবতা মনে হয়। আমি আপনাকে জানতে চাই, আপনাকে বুঝতে চাই।”
অর্ধবয়স্কা মহিলা অন্যদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। সে ভিতরে থাকা তরুণির জন্য অপেক্ষা করে অন্যদের নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর দুভাষীও বেরিয়ে গেল। শুধু সেই তরুণী বিন কাসিমের কক্ষে রয়ে গেল।
পরদিন সকাল বেলায় শোনা গেল শহরের প্রধান পুরোহিতকে মন্দিরের ভিতরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এই খবর দিনের আলো বেড়ে ওঠার সাথে সাথে শহরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। মুহাম্মদ বিন কাসিম অমুসলিমদেরকেও ধর্মীয়, স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। হিন্দু, বৌদ্ধ যার যার মতো নিজ নিজ ধর্মালয়ে উপাসনা করছিল। এমতাবস্থায় শহরের সুরক্ষিত প্রধান মন্দিরের গ্রান্ডপুরোহিতের আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটি কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না। খবরের নানা ডালপালা গজিয়ে শহরময় নানা গুঞ্জনের জন্ম দিল। প্রধান সেনাপতি বিন কাসিমের কানেও গেল সেই খবর। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত মৃত্যুর কারণ উদঘাটনের জন্যে গোয়েন্দা বিভাগকে নির্দেশ দিলেন। গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী সাথে সাথে ছুটে গেলেন অকুস্থলে। শাবান ছাকাফী মন্দিরের ভিতরে শয়ন কক্ষে পুরোহিতের মৃতদেহ দেখেই বলে ফেললেন, একে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বিন কাসিমের কাছে বিষ প্রয়োগে হত্যার রিপোর্ট দিলেন।
বিন কাসিম রিপোর্ট শুনে বললেন, এটা উদঘাটনের চেষ্টা করুন, বিষ প্রয়োগের সাথে কোন মুসলমান জড়িত কি না। শাবান ছাকাফী মন্দিরের অন্যান্য পুরোহিত ও সেখানে অবস্থানকারী দেবপুত্রদের (যেসব ছেলেদেরকে শৈশবেই দেবতার নামে মন্দিরে উৎসর্গ করা হয় অথবা মন্দিরে অবস্থানকারী দেবদাসীদের পাপাচারে যেসব ছেলে সন্তান জন্ম নেয় তাদেরকে দেবপুত্র বলে) প্রত্যেককে ন্নি ভিন্ন ভাবে জিজ্ঞেস করেন, জানতে চাইলেন, প্রধান পুরোহিতেব সাথে কারো কোন ধরনের শত্রুতা ছিল কি-না। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, গভীর রাতে একজন সুন্দরী তরুণী
মন্দিরে এসে প্রধান পুরোহিতের কক্ষে প্রবেশ করে কিন্তু সে কখন মন্দির থেকে বেরিয়ে গেছে এ সম্পর্কে কেউ কিছুই জানাতে পারলো না।
আচ্ছা! সেই তরুণির নাম শিমুরাণী? এক পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেন শাবান। হ্যাঁ ওর নাম শিমুরাণী, বলল এক পুরোহিত। শাবান ছাকাফী শিমুরাণীর কথা শুনে নিহত পুরোহিতের কক্ষে গিয়ে কক্ষটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি দেখতে পেলেন, কক্ষে একটি পানপাত্র পড়ে আছে এবং সেই পাত্রে এক দুই ঢোক খাবার পাণীয়ও অবশিষ্ট রয়েছে। শাবান ছাকাফী পানপাত্রটি তুলে নিয়ে মন্দিরের বাইরে এসে একটা কুকুর কিংবা বিড়াল ধরে আনার নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরা কিছুক্ষণের মধ্যে একটি কুকুর ধরে নিয়ে এলো। শাবান ছাকাফী কুকুরের মুখ হাঁ করিয়ে পানপাত্রের অবশিষ্ট পাণীয়টুকু কুকুরের গলায় ঢেলে দিলেন এবং কুকুরটিকে ছেড়ে দিতে বললেন। কুকুরটি ছাড়া পেয়ে দৌড় দিলো কিন্তু সামান্য এগিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। সেই সাথে কয়েকটা ঝাকুনি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল কুকুরটি। মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল কুকুরটি প্রাণ ত্যাগ করেছে।
শিমুরাণী এখন কোথায়? মন্দিরের পুরোহিত ও দেবপুত্রদের জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা প্রধান।
সবাই অজ্ঞতা সূচক জবাব দিল। শাবান ছাকাফী সবাইকে মন্দিরের দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড় করিয়ে ছিলেন। এরা ছিল সংখ্যায় ১২ জন। ১২ জন তীরন্দাজকে ওদের থেকে আট দশ গজ দূরে দাঁড় করিয়ে নির্দেশ দিলেন, প্রত্যেকেই ওদের দিকে একটা করে তীর তাক করো।
গোয়েন্দা প্রধান নির্দেশ দিলেন, শিমুরাণী কোথায় আছে যে সেই কথা বলবে তাকে প্রাণে বাঁচানো হবে। কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না। গোয়েন্দা প্রধানের নির্দেশে তীরন্দাজরা কামানের ধনুক দিয়ে তীর ছোড়ার জন্য উদ্যত হলো এমন সময় হঠাৎ এক পুরোহিত বলে উঠল আমি বলব। সাথে সাথে শাবান ছাকাফী তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেললেন। পুরোহিত গোয়েন্দা প্রধানের কাছে ব্যক্ত করল, রাতেই সে জানতে পারে শিমুরাণী বড় পুরোহিতকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। রাতের বেলায় অপর এক পুরোহিত বড় পুরোহিতের কক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল শিমুরাণী তখন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বড় পণ্ডিত তখন বহুকষ্টে শুধু এতটুকুই বলতে পেরেছিল, “ওকে ধরো আমাকে বিষ খাইয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।” বড় পুরোহিতের কথা অন্য লোকেরা তাড়াতাড়ি শিমুকে পাকড়াও করে এবং সকাল বেলায় শহরের
দরজা খোলা হলে পুরুষের পোষাক পরিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘কোথায় নিয়ে গেছে? জিজ্ঞেস করলেন ছাকাফী।
‘এতক্ষণে সে হয়তো উরুঢ়ের অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে।” বলল পুরোহিত। উরুঢ় পৌছলেই ওকে হত্যা করে ফেলা হবে।
“ওকে হত্যা করাই উচিত, প্রধান পুরোহিতের হত্যা কোন সাধারণ অপরাধ নয়” বললেন ছাকাফী। শিমুকে হয়তো কিছুদিন শাস্তি দেয়া হবে বলল, পুরোহিত। অপরাধ শুধু এই নয় যে, সে প্রধান পুরোহিতকে খুন করেছে। তার বড় অপরাধ হলো যাকে খুন করানোর জন্য তাকে পাঠানো হয়েছিল তাকে বিষ পান না করিয়ে সে পণ্ডিতের জীবন নিয়েছে।
কাকে বিষ খাওয়ানোর জন্যে পাঠানো হয়েছিল? ‘আপনার প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে?
‘শিমু হয়তো মন্দিরে এসে বলেছিল কেন সে আমাদের সিপাহসালারকে বিষ পাণ করায়নি।’
না সে এসেই বড় পণ্ডিতের কক্ষে ঢুকে পড়েছিল।
বল এই মন্দিরে আর কি কি চক্রান্ত হয়? তোরা অসুস্থ কুকুরের মতো যদি ধুকে ধুকে মরতে না চাস, তাহলে বল, এখন তোদের সবার জীবন মরণ আমার হাতে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে বললেন গোয়েন্দা প্রধান।
‘মিথ্যা নয় সত্যই বলব, প্রতিশ্রুতি দিলো পুরোহিত। সে বলল, গত রাতে এক মহিলা কয়েকজন তরুণীকে নিয়ে আপনার সিপাহসালারের কাছে গিয়েছিল। সেটি হলো একটা চক্রান্ত। আমরা খবর পেয়েছিলাম, মুসলিম সৈন্যরা সুন্দরী মেয়েদের প্রতি খুবই আকৃষ্ট। আমাদের রাজার প্রধান উজির বুদ্ধিমান খুবই জ্ঞানী লোক। তিনি বলেছিলেন, মুসলিম বাহিনীর সিপাহসালার তরুণ লোক। সুন্দরীদের ফাঁদে সে অবশ্যই ধরা দেবে এবং ভোগ বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে অগ্রাভিযান বন্ধ করে দেবে। শিমুর প্রতি নির্দেশ ছিল সে সিপাহসালারের কাছে থেকে যাবে এবং তার রূপের যাদু ও ছলনা দিয়ে তাঁকে। ভুলিয়ে রাখবে। এমতাবস্থায় আমাদের রাজা একদিন মুসলিম বাহিনীকে অবরোধ করবে ঠিক সেই সময় শিমু সিপাহসালারের পানিতে বিষ প্রয়োগ করবে।
“কি ভাবে বিষ দেয়ার কথা ছিল?
“শিমুর হাতে যে আংটিটি ছিল সেটির টোপটি ছিল ঢাকনা ওয়ালা। কাছ থেকে দেখেও কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিলনা এর মধ্যে ঢাকনা আছে।” বলল পুরোহিত। ঢাকনার ভিতরে বিষ মাখানো তুলা ভরা ছিল। এই বিষ এতোটাই ভয়াবহ যে, মুহূর্তের মধ্যে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। তরুণির পক্ষে আপনার সেনাপতির পাণীয়দ্রব্যে বিষ প্রয়োগ করা মোটেও কঠিন ব্যাপার ছিলনা। কিন্তু বলা যাচ্ছে না এই পরিকল্পনা কি করে উল্টো হয়ে গেল। আপনি আমার জীবন ভিক্ষা দেয়ার ওয়াদা দিয়েছেন, আমি আপনার উপকারের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জানাতে চাই, আপনার সিপাহসালারকে বাঁচিয়ে রাখুন। এটা হিন্দুস্তান। রহস্যময়ী, যাদুটোনা আর তিলিসমাতির জন্য এই অঞ্চল বিখ্যাত। আপনি দুর্গের পর দুর্গ জয় করতে পারেন, লড়াইয়ের ময়দানে বিজয়ী হতে পারেন, কিন্তু একদিন না একদিন এই চক্রান্তের ফাঁদে আপনাকে অবশ্যই আটকে ফেলা হবে।” টার্গেট ব্যর্থ হওয়ার পর হিন্দু চক্রান্তকারীরা অর্ধবয়স্কা মহিলা ও তরুণীদেরকে অস্বাভাবিক কৌশল ও দ্রুততায় নিরূন থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিল। চক্রান্তের উৎস উদঘাটিত হওয়ার পর গোয়েন্দা প্রধান মন্দিরের সকল পুরোহিত ও বাসিন্দাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। পুরোহিতরা স্বীকার করে নিয়েছিল বিন কাসিমকে হত্যার চক্রান্তে তারাও জড়িত ছিল। তারা একথাও জানালো এর চক্রান্তের মূল হোতা রাজা দাহিরের প্রধান উজির বুদ্ধিমান ও মায়ারাণী।
“আমরা তোমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলাম।’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী। ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তোমাদের ওপর আমরা কোন চাপ সৃষ্টি করিনি। তোমরা আমাদের এই উদারতার প্রতিদান হিসাবে আমাদের সিপাহসালারকেই হত্যা করার চক্রান্ত করেছ। এর অর্থ হলো তোমরা নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যাহার করে নিয়েছ।”
‘হে দখলদার আরব! আমি জীবন ত্যাগ করতে পারি কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করতে পারি না। তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলল পুরোহিত। আমরা শুধু তোমার সেনাপতিকেই হত্যা করতে চাইনি, হত্যা তালিকায় তুমিও ছিলে। তোমার সেনাবাহিনীর ছোট বড় সকল সেনাধ্যক্ষ ও কমান্ডারকেও হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
তোমাদের সাথে আমাদের কোন বৈষয়িক শত্রুতা নেই, শত্রুতার মূল কারণ ধর্ম। আমরা ধরা পড়লে নির্ঘাথ নিহত হবে এই আশঙ্কা থাকার পরও
জেনে শুনেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিলাম। তোমরা তোমাদের ধর্মের জন্য যেভাবে জীবন ত্যাগ করতে পারো, আমরাও ধর্মের জন্যে জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলাম।
‘খুবই নির্বোধ তোমরা। বাতিলের অনুসারীদের অবস্থা এমনটাই হয়ে থাকে, প্রকৃত বাস্তবতা এরা অনুধাবন করতে পারে না।’
‘হে নির্বোধ আরব সৈনিক। আমি তোমার সাথে তর্কে লিপ্ত হবনা’ তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে বলল পুরোহিত। আমার জীবনটাতো তোমাদের তরবারীর আঘাতের জন্য অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে।
শোনো, তোমাকে একথা বলে দিচ্ছি। তোমরা এই অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে দিতে পারবে বটে কিন্তু হিন্দুত্ববাদ মানুষের রক্তের সাথে বিষের মতো মিশে থাকবে এবং ধীরে ধীরে সনাতন ধর্মের প্রতিক্রিয়া দেখাবে। আমাদের আত্মাগুলো প্রেতাত্ম হয়ে এ অঞ্চলে ঘুরে বেড়াবে। পুরোহিত দু’হাত প্রসারিত করে ওপরে উঠিয়ে বলল, আমি তোমাকে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করছি, শুনে রেখো-তোমাদের সিপাহসালার মুহাম্মদ বিন কাসিম শেষ পর্যন্ত নিহত হবে। হিন্দুদের হাতে যদি সে নিহত নাও হয় তবে আপনজনদের হাতে হলেও সে নিহত হবে।’
‘কেন সে নিহত হবে? জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা প্রধান। আমার দৃষ্টি বহুদর দেখতে পারে। বলল পুরোহিত। হে সৈনিক, আমি জ্যোতিষী বা গণক নই, কিন্তু দিব্য দৃষ্টিতে আমি যা দেখতে পাচ্ছি তাই তোমাকে বললাম।’
“তোমরা হয়তো বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নয়তো জ্ঞানান্ধ পুরোহিত? সত্য উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান তোমাদের নেই নয়তো সত্যকে সত্য জেনেও তোমরা তা স্বীকার করো না।” বললেন গোয়েন্দা প্রধান। অতঃপর পুরোহিতকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সে দিনই মুহাম্মদ বিন কাসিম নিরূনের সকল মন্দির বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং হিন্দুদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে পূজা অর্চনা করার হুকুমজারী করলেন। সেই সাথে মন্দিরের চক্রান্তে জড়িত সকল পুরোহিতের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিলেন।
নিরূনে যখন চক্রান্তকারী পুরোহিতদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছিল ঠিক সেই সময় রাজা দাহিরের রাজধানীতে হত্যাকাণ্ডের চেয়েও জঘন্য অপরাধের
অপরাধী হিসেবে অবনত মস্তকে মায়ারাণী ও উজির বুদ্ধিমানের সামনে শিমু দণ্ডায়মান। পথিমধ্যে শিমুকে কোন পানাহার করতে দেয়া হয়নি। তার হাত পা রশিতে বাধা ছিল। দীর্ঘ ভ্রমণে রশিতে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পানাহার বঞ্চিত থাকার কারণে শিমুর শারীরিক অবস্থা এতোটাই কাহিল হয়ে পড়েছিল যে, সে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিল না। এমতাবস্থায় মায়ারাণী তাকে জেরা করছিল, বিন কাসিমের পরিবর্তে তুমি পুরোহিতকে কেন বিষ পান করালে?
কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরও সে শুধু এতটুকুই বলতে পারছিল আমাকে এক গ্লাস পানি দিন…। কিন্তু শিমুকে একফোঁটা পানিও পান করতে দেয়া হলো না।
এক পর্যায়ে শিমু অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, পিপাসায় যদি আমি মারা যাই তাহলে আপনারা আমার কাছ থেকে তো কিছুই জানতে পারবেন না। আমি কথা দিচ্ছি, আমাকে পানি পান করান, আমি কোন সত্যই গোপন করবো না। পানি না খাইয়ে মেরে ফেললে আপনারা সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবেন না।
অতঃপর তাকে সামান্য খাবার ও পানি পান করতে দেয়া হলো। সামান্য পানাহারের পর শরীরে কিছুটা শক্তি ও সতেজতা ফিরে পেলে শিমু চক্রান্ত সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছিল, তা ছিল এমন- আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতো একজন অর্ধবয়স্কা মহিলার নেতৃত্বে কয়েকজন তরুণী মুহাম্মদ বিন কাসিমের আবাসগৃহে পৌছি। মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে গিয়ে আমাদের দলনেত্রী বিন কাসিমকে মোবারকবাদ জানায় এবং তার সৈন্যরা শহরের নারী শিশুদের ইজ্জত আব্রুর সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে এজন্য তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। অতঃপর পরিকল্পনা মতো শিমু বিন কাসিমের পাশে বসে পড়ে। অন্যান্য তরুণিরা বয়স্কা মহিলার সাথে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গন্তব্যে ফিরে যায়। তারা সবাই যেহেতু চক্রান্ত সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল তাই শিমুর জন্য তারা আর অপেক্ষা করেনি। শিমু বিন কাসিমের কক্ষেই অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে শিমুকে কক্ষে থাকতে দেখে বিন কাসিম তাকে বললেন, তুমিও চলে যাও। তোমার সাথীরা হয়তো তোমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। জবাবে শিমু বলল—আপনি কি আর কিছুটা সময় আপনার পবিত্র সান্নিধ্যে আমাকে থাকার অনুমতি দিতে পারেন না? আরবী ভাষায় আবেগাপ্ত কণ্ঠে মিনতি করলো শিমু।
হিন্দুস্তানী বংশোদ্ভূত তরুণির কণ্ঠে আরবী কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বিন কাসিম জিজ্ঞেস করলেন, আরো তুমিতো আরব কন্যা নও, আরবী কোথেকে শিখলে?
মাত্র দেড় বছরে মারকানের এক আরবের কাছ থেকে আমি আরবী শিখেছি। আরবের লোকজনকে আমার খুব ভালো লাগে। তাই বলছিলাম, আপনার পবিত্র সান্নিধ্যে আর কিছুটা সময় আমাকে দয়া করে একান্তে বসতে দিন।
আমার কাছে একান্তে বসে তুমি কি করবে? আমি জানি, আপনার পক্ষেই এ ধরনের নির্দেশ জারী করা সম্ভব যে, বিজিত এলাকায় কোন নারীপুরুষের ওপর যে বিজয়ী সৈন্য কোন ধরনের অত্যাচার নির্যাতন না করে। এতেই প্রমাণিত হয় আপনি দেবতাতুল্য। দেবতাদের চেয়ে আপনি কোন অংশেই কম নয়। প্রথমে আমি মনে করেছিলাম, আপনি হয়তো বয়স্ক ব্যক্তি। কারণ এমন ধরনের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় একমাত্র বয়স্ক অভিজ্ঞলোকদের দ্বারাই ঘটে থাকে। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হয়েছে, আপনি ধারণার চেয়েও অনেক বেশি জ্ঞানী বিচক্ষণ ও সুন্দর। আপনার কথা শোনার পর থেকেই আমি আপনার ভক্ত পূজারীণী হয়ে গেছি।
“এটাই হলো তোমাদের ধর্মের সবচেয়ে মন্দ দিক। তোমরা কোন বিস্ময়কর জিনিস দেখলেই সেটিকে পূজা করতে শুরু করো। কোন জিনিসকে ভয় করলেও তোমরা সেটিকে পূজা করতে থাকো। আমি পূজনীয় হওয়ার মতো কিছুই করি না। আমি যা কিছু বলি যা কিছু করি সবই আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য করি।” আমি স্বধর্ম ত্যাগ করতে প্রস্তুত। আপনি যদি আমাকে আপনার সান্নিধ্যে থাকার অনুমতি দেন তাহলে আমি আর বাড়িতে ফিরে যাব না। তোমাকে বিয়ে করা ছাড়া আমার কাছে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। কিন্তু আমি এদেশে বিয়ে শাদী করতে আসিনি। আমি এই সব শাসকদের মতোও নই, যারা কোন শহর জয় করার পর সেখানকার সুন্দরী তরুণীদের মধ্য থেকে দু’ চারজনকে বিয়ে করে বিবি বানিয়ে রাখে নয়তো শক্তির দাপটে রক্ষিতা করে রাখে। আমি বিলাস ব্যাসনের জন্য এখানে আসিনি। আমি এদেশে এসেছি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে।
শিমু উজির বুদ্ধিমান ও মায়ারাণীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে বিন কাসিম সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল এবং যে ভাবে যা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে আমি সবই করেছি। আমি তাকে কামোদ্দিপ্ত করার সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করেছি। আমি কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি, হাসি, চাউনী তথা আমার রূপ সৌন্দর্যের সবটুকুর প্রয়োগ করে বিন কাসিমের পৌরুষকে আন্দোলিত করার চেষ্টা করেছি, লোকটি আমার কথায় আচরণে হাসতো,
কথা বলতো, কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন একটা স্থির ও নির্লিপ্ততা লক্ষ্য করেছি যেন সে আশি বছরের কোন বৃদ্ধ, তার শরীরটা যেন আকাশ থেকে পতিত শিলার মতোই ঠাণ্ডা শীতল।
এক সময় তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। মনে মনে ভাবলাম, এবার তাহলে বরফ গলতে শুরু করেছে। আমি তার এতোটাই কাছে চলে গেলাম যে, আমার জামার আঁচল তার দেহ স্পর্শ করছিল। তিনি আমার ডান হাতটি তার হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন, আমি ভাবলাম এবার তাহলে শিকার আমার ফাঁদে পা দিয়েছে। আমি অপর হাতটিও তার হাতের ওপর দিয়ে দিলাম। তার ভাবদেখে মনে হচ্ছিল, তিনি আমার রূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। আমার দৃষ্টি আকর্ষণীমূলক আচরণ তাকে আকৃষ্ট করেছে। তিনি আমার প্রতি আসক্তি বোধ করছেন ভেবে আমি মনে মনে দারুণ উৎফুল্ল। হয়ে উঠি। হঠাৎ তিনি আমার ডান হাতের আংটি পরিহিতা মধ্যাঙ্গুলিটা চেপে ধরলেন। আংটিটি ছিল খুবই ভারী এবং টোপ ওয়ালা। দেখতে দারুণ কারুকার্যময় ছিল সেটি।
তিনি আংটিটির টোপের ওপরে হাত বুলিয়ে বললেন, দারুন সুন্দর আংটিতে।
এটি আপনি নিয়ে নিন। হয়তো আপনার কনিষ্ঠা আঙুলে এটি ধারণ করা সম্ভব হবে? তার আগ্রহের জবাবে আবেগপূর্ণ ভাষায় বললাম আমি। না, আংটির দরকার নেই। এর ভিতরে করে আমার জন্য যা নিয়ে এসেছে, সেটি আমাকে দিয়ে দাও। তাহলেই হবে।
একথা শুনে চকিতে আমি হাত সরিয়ে নিলাম এবং অপর হাতে আংটিটি চেপে ধরলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার চেহারার রং হয়তো বদলে গিয়েছিল। তিনি আমার আংটিওয়ালা হাতটি হঠাৎ ধরে ফেললেন এবং খুব জোরে আমাকে হেচকা টান মেরে তার কাছে নিয়ে নিলেন। আমি এরপরও তার শরীরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমার শরীরের কোমলতা ও ঘ্রাণে তার মধ্যে মাদকতা সৃষ্টির প্রয়াস নিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে প্রায় জড়ানো ভাবে ধরে তার হাতের আংটির কোণা দিয়ে আমার আংটির টোপের নীচের দিকে একটা খোচা মারলেন, তাতে আমার আংটির টোপ খুলে গেল এবং ভিতরে সংরক্ষিত বিষ মেশানো তুলা বেরিয়ে গেল।
আংটির ভিতরে তুলা দেখে বিন কাসিম ঈষৎ মুচকি হাসলেন। আমার তখন প্রাণবায়ু উড়ে যাওয়ার অবস্থা। আমি বিষন্ন চেহারায় এক পলকে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তিনি কিছুক্ষণ পর আমার দিকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে বললেন, সত্যি করে বলো তো? এটি কি তুমি আমার জন্য আনোনি? অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার মাথা তাঁর কথায় দুলে উঠল কিন্তু অস্পষ্ট কণ্ঠে বললাম, না। তিনি দৃঢ় ও শান্তভাবেই বললেন, এই বিষ তুমি আমাকে কি ভাবে পান করানোর চিন্তা করেছিলে? আমার মনে হয়েছিল কাজটি মোটেও কঠিন হবে না, বলল শিমু। কারণ মন্দিরের পুরোহিত; পণ্ডিত ও ঋষিরতী আমার মতো সুন্দরী তরুণির স্পর্শ পেলে প্রখর রুদ্রতাপে বরফের মতোই গলতে থাকে। সেক্ষেত্রে আপনার মতো সুঠাম সুশ্রী যুবক আমার সংস্পর্শে সহজেই গলে যাবেন বলেই আমি মনে করেছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, মুসলমানরা মদ পান করে না। কিন্তু তোমার মতো সুন্দরী রূপসীর সংস্পর্শে সহজেই যে কোন মুসলিম তরুণ মুগ্ধ ও উত্তেজিত হবে। তোমার রূপ সৌন্দর্যে মাতাল করার মতো শক্তি আছে। আপনাকে রূপ সৌন্দর্যের যাদু বলে মুগ্ধ বিমোহিত করে পানি কিংবা শরবতের মধ্যে এই বিষ প্রয়োগ করার কথা আমাকে বলা হয়েছিল… এখন আমি একটি কথা বললে আপনি বিশ্বাস করবেন কি-না জানি না।
“যা বলতে ইচ্ছা করে বলো?”
“এখানে এসে আপনার আচরণ ও ব্যবহারে আমি আপনাকে বিষ পান করাতে পারতাম না। আপনার উন্নত নৈতিকতা ও আদর্শবাদিতা আমার মিশনকে ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। আপনি হয়তো একথা বিশ্বাস করবেন না। হয়তো বলবেন, ধরা পড়ে যাওয়ার কারণে প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমি একথা বলছি। শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি বাহানা তালাশ করছি। দয়া করে আপনি আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য অন্য কারো কাছে তুলে দেবেন না। আমার আনা বিষ আমাকে পান করতে দিন। কারণ এই বিষ এতোটাই তীব্র যে মরতে বেশি সময় লাগবে না। এর পর আমার মরদেহ যেখানে ইচ্ছা ফেলে দিন তাতে আমার কোন আফসোস থাকবে না। না তরুণী, তুমি যা ভেবেছ আমি তেমন কিছুই করব না। তুমি যদি কোন আরব মুসলমান কন্যা হতে তাহলে তোমার এই যাদুকরী রূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত দেহ আমার এই তরবারী দিয়েই দ্বিখণ্ডিত করে দিতাম। কিন্তু তুমি অমুসলিম ও শত্রু পক্ষের অবলা নারী। তোমাকে অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করেছে আমার শত্রু পক্ষ। কিন্তু কোন শত্রু নারীর ওপর আমার তরবারীর কার্যকারিতা প্রয়োগের অবকাশ নেই। ইসলাম খুবই মানব হিতৈষী ধর্ম।
রাজা দাহির, উজির বুদ্ধিমান তোমরা নিজের কৃতকর্মের আত্মউপলব্ধি করার জন্য তোমাকে অক্ষত অবস্থায় তোমার কর্তাদের কাছেই ফিরিয়ে দেবো। একথা শুনে শিমু বলল, আপনি মানুষ নন, সত্যিই একজন দেবতা। কিন্তু দেবদেবীতে আপনি বিশ্বাসী নন বলে আপনাকে আমি ফেরেশতা বলতে চাই। আগে আমি আপনাকে প্রতারিত করার জন্য আপনার সান্নিধ্যে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলাম এখন একান্তভাবেই আবেদন করছি, আপনার সেবাদাসী হিসাবে আপনার সংস্পর্শে আমাকে থাকার অনুমতি দিন। আমি আপনার কাছে কখনো আসব না। শুধু দূর থেকে আপনাকে দেখে দেখে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে দিন। আমাকে আপনার দাসী হিসেবে বেঁচে থাকার সুযোগ দিন। তোমার সব কথার জবাব আমি ইতোমধ্যেই দিয়ে দিয়েছি। তোমার সব আকাক্ষাও আমি পূর্ণ করেছি। তোমার পূর্বেও আমরা তোমার মতো আরো তিন তরুণীকে রাজা দাহির ও উজির বুদ্ধিমানের কাছে পাঠিয়েছি। এরা মাকরানে বসবাসকারী আরব যুবকদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। তুমি হয়তো ওদের সম্পর্কে জানেনা। ওদেরকেও দাহিরের উজির সেখানে নিযুক্ত করেছিল। তাদের চক্রান্তও ব্যর্থ হয়েছে। আমি সেই তরুণীদের বলেছিলাম, তোমাদের রাজাকে গিয়ে বলবে, যোদ্ধাদের লড়াই মুখোমুখি রণাঙ্গনে তরবারীর সাহায্যে হয়ে থাকে। এখন তুমি গিয়ে রাজা দাহির ও উজির বুদ্ধিমানকে বলো, “হে কাপুরুষ রাজা! আরবদের সাথে যদি মোকাবেলা করার এতোই সাধ থাকে তাহলে মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হও।” সে কি ভেবেছে, তার দুর্গের উঁচু দেয়াল তাকে আরব যোদ্ধাদের তরবারী আর আল্লাহ্র সৈনিকদের বর্শা ও তীর থেকে রেহাই দিতে পারবে?
বিন কাসিম যখন শিমুকে একথাগুলো বলছিলেন, তখন শিমু হাঁটু গেড়ে বসে দুহাত জোড় করে দেবতার মুখোমুখি পূজা করার মতো করে বসে রইলো। যেন সাক্ষাত কোন দেবতার কণ্ঠে সে আশ্চর্য কিছু শুনছে। ঘটনার আকস্মিকতায় শিমুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
বিন কাসিম বললেন, হে হতভাগী মেয়ে। আমরা এমন ধর্মের অনুসারী যে ধর্মে নারীর ইজ্জত সম্ভ্রম রক্ষা করাকে জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করা হয়। নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় আমরা জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করি না। আমরা কখনো নারীর জীবন উৎসর্গ করে ধর্ম ও রাজ্য রক্ষার চেষ্টা করি না। তুমি জানো, তোমাদের রাজা শুধু আরব মুসাফিরদের জাহাজই লুট করেনি,
জাহাজের অধিবাসীদের কয়েদখানায় বন্দি করে রেখেছে। আমরা সেই বন্দীদেরই মুক্ত করতে এসেছি। কিন্তু আমাদের আগে আরো দু’বার আমাদের সৈন্যরা এখানে এসে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছে এবং আমার আগে দু’জন সেনাপতি শাহাদাতবরণ করেছেন। এজন্য আক্রমণের আগে আমাকে অনেক ভেবে চিন্তে এগুনোর কথা ছিল। কিন্তু এক আরব কন্যার মুক্তির ফরিয়াদী পয়গাম পেয়ে আমার চাচা হাজ্জাজ আমাকে এই বলে নির্দেশ পাঠালেন, “তুমি যেখানে যে অবস্থায় আছে এবং যা-ই করছ না কেন সেই অবস্থাতেই সিন্ধু রওয়ানা হয়ে যাবে, সৈন্যরা তোমার সাথে গিয়ে মিলিত হবে। ফলে সেই অবস্থাতেই আমি রওয়ানা হয়ে এসেছি কোন প্রস্তুতিই নিতে পারিনি। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দয়ার ভরসা ছাড়া আমার আর কোন বাহ্যিক শক্তি নেই।
বন্দীদের তো আপনি মুক্ত করে নিয়েছেন? বলল শিমু।
হ্যাঁ, এক অত্যাচারী রাজার হাত থেকে শুধু আরব মজলুম বন্দীদেরই আমরা মুক্ত করিনি, শহরের অধিবাসীদেরকেও মুক্তি দিয়েছি। তুমি কি এই রাজাকে অত্যাচারী বলবে না? নিজের ক্ষমতার স্বার্থে যে তোমার মতো তরুণীদেরকে সম্ভ্রম বিক্রি করে দেয়ার কাজে লিপ্ত করে। তোমার কি সাধ ছিল, তুমি কোন বীর বাহাদুর স্বামীর বন্ধু হবে, স্বামীর বীরত্বে গর্ববোধ করবে? হে আরব শাহজাদা, আমি ও আমার মতো এদেশের অসংখ্য সুন্দরী তরুণী কোন ভদ্র ঘরের বধু হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছি। অতি শৈশব থেকেই আমাদেরকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে। আমাদের আবেগ অনুভূতি সুখ আহ্লাদকে হত্যা করা হয়েছে। যারা আমাদেরকে এই ঘৃণ্য কাজের জন্য তৈরি করেছে আমরা তাদের হাতের খেলনা মাত্র। মন্দিরের পুরোহিতরাও অবাধে আমাদের ভোগ করে…। কিন্তু আজ আপনি আমার মৃতপ্রায় অনুভূতিকে জাগিয়ে দিয়েছেন। আমি এখন অনুভব করতে পারছি, আমার আত্মপরিচয়।
এখন তুমি চলে যেতে পারো? তবে যাবে কোথায়? বললেন বিন কাসিম। প্রধান মন্দিরে যাব। বলল শিমু। ঠিক আছে, আমি তোমার সাথে দু’জন প্রহরী পাঠাচ্ছি।
আমি একাকীই যাব। শিমু আর দেরী না করে বিন কাসিমের কক্ষ থেকে বেরিয়ে প্রধান মন্দিরের দিকে চলে গেল।
মৃত্যুর আগে আমি সব কিছু উগড়ে দেবো’ উজির বুদ্ধিমান ও মায়ারাণীর কাছে বিন কাসিমকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ার বর্ণনা শেষে দৃঢ় কণ্ঠে বলল শিমু। শিমু আরো বলল, বিন কাসিমের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পর তিনি যখন আমাকে মুক্ত করে দিলেন, আমি সোজা প্রধান মন্দিরের দিকে রওয়ানা হলাম। তখন আমার মনে হচ্ছিল, আরব সেনাপতি আমার পিছু পিছু আসছেন। হয়তো বা তিনি শক্তিশালী যাদুকর। যাদুর সাহায্যেই আমার মিশন ব্যর্থ করে দিয়েছেন এবং আমার মনোভাব বদলে দিয়েছেন। আমি যাদুগ্রস্তের মতোই অবচেতন মনে মন্দিরে পৌছলাম। আসার পথে মনে হয়েছিল আংটির বিষ নিজের মুখে দিয়ে মৃত্যুবরণ করব কিন্তু মন্দিরে পৌছে পাথরের নিপ্রাণ মূর্তিগুলো দেখে আমার মন বিদ্রোহ করল। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম মূর্তিগুলোর কার্যকারিতা ব্যর্থ প্রমাণ করেই আমি মরবো।
একথা শুনে উজির বুদ্ধিমান খুব জোরে শিমুর গালে একটা চপেটাঘাত করল।
হতভাগী, তুই ওই স্নেচ্ছের প্রভাবে এতটাই মাতাল হয়েছিলে যে, মন্দিরে এসে দেবদেবীদের অমর্যাদা করতেও তোর বিবেকে বাধলো না। দাঁতে দাঁত পিষে বলল উজির। আমি ওর শরীরের একেকটি রগ কেটে কেটে ওকে হত্যা করবো, বলল মায়ারাণী। শয়তানীটা এই লুটেরা সেনাপতির বধূ সাজতে চেয়েছিল, তা না পেরে শেষতক দাসী হয়ে থাকতে চেয়েছিল।
অ্যাহ! রাজরাণী সাজার সখ হয়েছিল? বল, এরপর কি হলো? রাগে ক্ষোভে গজরাতে গজরাতে বলল উজির বুদ্ধিমান।
ওদের কথায় শিমুর হাসি পেলো। মুচকি হাসিটা আর চেপে রাখতে সক্ষম হলো না সে। খিক করে হেসে ফেলল। অতঃপর বলল, এরপর আমি মন্দিরে প্রবেশ করলাম। অন্যান্য তরুণিরা মন্দিরের মাতাল কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অন্যান্য পুরোহিতরা যার যার কক্ষে শুয়ে পড়েছিল। শুধু প্রধান পুরোহিত জাগ্রত ছিল। বুদ্ধিমান আবারো শিমুর মুখে একটা চপেটাঘাত করে বলল, বেতমিজ বল, পণ্ডিতজী মহারাজ। আমি যা একবার বলেছি শতবার বললেও তাই বলবো। আমার মন থেকে যার শ্রদ্ধা শেষ হয়ে গেছে, তার বেলায় সম্মানজনক ভাষা আমার মুখে আনা সম্ভব নয়। তার নাম আমি ঘৃণা ভরেই উচ্চারণ করব।
উজির! ও যা বলতে চায় বলতে দিন।
এই কুলাঙ্গীনী যা বকছিলে বকে যা। বলল মায়ারাণী। শিমু বলতে শুরু করল,
বড় পণ্ডিত আমার অপেক্ষায় তখনো জেগে ছিল। আমাকে দেখেই সে বলল, কাজ সেরে এসেছ? আমি বললাম করে এসেছি। পণ্ডিত আনন্দে জয়ধ্বনী দিলো এবং দুহাত আমার দিকে প্রসারিত করে এগিয়ে এসে আমাকে পাজাকোলা করে তার শয়ন কক্ষে নিয়ে গেল। তার মুখের লালার দুর্গন্ধ এখনো আমার মুখে লেগে রয়েছে। সে আমাকে বিছানার ওপর ফেলে পাগলা ষাড়ের মতো ঘুতাতে লাগল। পণ্ডিতের এই উন্মত্ততা দেখে আমার ইচ্ছা সম্পূর্ণ বদলে গেল। পুরুষের শয্যাসঙ্গী হওয়াটা আমার জীবনে আশ্চর্যজনক কিছু না। এই পণ্ডিতের কাছেও ইতোপূর্বে দু’বার আমি কাটিয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মধ্যকার বোধ ও বিবেক সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। আমি আর আগেকার মতো পণ্ডিতের সান্নিধ্যকে পবিত্র মনে করতে পারছিলাম না। কারণ এমন এক যৌবনদীপ্ত সুঠাম যুবকের কাছে আমাকে পাঠানো হয়েছিল, যে কোন সুন্দরী নারীর সংস্পর্শে এলে এমন যুবকের পক্ষে নিজেকে সামলে রাখা মুশকিল কিন্তু শত চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমি তার পৌরুষ নাড়াতে পারিনি। সে আমাকে সম্পূর্ণ পবিত্র ও অস্পর্শ অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছে। অপরাধের আহবানকেও সে কঠিন অপরাধ মনে করে। আমি তাকে বিষপানে হত্যা করতে চেয়েছিলাম তা ধরতে পেরেও সে আমাকে কোন শাস্তি
দিয়ে সসম্মানে বিদায় করেদিল। আমি তাকে হত্যা করার কথা স্বীকার করার পরও সে আমাকে কোন শাস্তি না দিয়ে নিরাপদে আমার মন্দিরে পৌছার জন্য আমার সাথে দু’জন সিপাহী পাঠানোর প্রস্তাব করল। আর পণ্ডিত এমন এক ব্যক্তি দেবালয়েও অবৈধ নারী সম্ভোগে বিন্দুমাত্র পরওয়া করে না। যার অন্তরে মন্দিরের এতটুকু সম্মান নেই…।
আমি মনে মনে পণ করেছিলাম, মিশনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য তোমরা হয়তো আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবে, তাতে কি আমি নিজেই এই বিষপানে আত্মহত্যা করবো। কিন্তু হঠাৎ আমার ইচ্ছা বদলে গেল। পণ্ডিতের প্রতি আমার মনে প্রচণ্ড ঘৃণার উদ্রেক হলো। আমি অনেক কষ্টে একথা বলে বিছানা থেকে তার পাঞ্জা মুক্ত হলাম যে, আমি একটু পানি পান করবো। আপনিও পান করে নিন। সে আমার কথায় লাফিয়ে উঠে বলল, আরে আজ রাত কি শুধু পানি পান করার নাকি? সে লাফিয়ে উঠে তাক থেকে একটি সুরাহী ও দুটি পেয়ালা নামিয়ে এনে বললো, এটা পান করো, আমাকেও পান করাও।
আমি উভয় পানপাত্রে সুরাহী থেকে অল্প অল্প শরাব ঢেলে দিলাম এবং পণ্ডিতের দিকে পিঠ দিয়ে তাকে আড়াল করে খুব দ্রুত আংটির বিষ তার পানপাত্রে ঢেলে দিয়ে একটু নাড়িয়ে পণ্ডিতের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। সে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু শরাব নিঃশেষ করে ফেলল। অবশ্য তখনো আমার জানা ছিল না এই বিষ এতটা শক্তিশালী, এতো অল্প সময়ে…।
কয়েক ঢোক শরাব গলধঃকরণের পরই পণ্ডিত দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। অতঃপর সে দু’হাতে বুক মালিশ করতে শুরু করল। খুব কষ্টে সে শুধু এতোটুকুই বলতে সক্ষম হলো, তুমি আমাকে কি পান করিয়েছো? আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, পণ্ডিতজী মহারাজ! এটা কাউকে না কাউকে তো পান করতেই হতো…। এরপর আমি মন্দির থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলাম। সদর দরজার কাছে পৌছলে মন্দিরে অচেনা এক লোককে প্রবেশ করতে দেখলাম। তখনো পণ্ডিতের কক্ষে প্রদীপ জ্বলছিল আর পণ্ডিত এক হাতে বুক চেপে ধরে বুকে ঘোঙাচ্ছিল। পণ্ডিতের ঘোঙানীর শব্দ শুনে লোকটি দৌড়ে পণ্ডিতের কক্ষে প্রবেশ করল। এদিকে তখন আমি মন্দিরের প্রধান ফটক পেরিয়ে রাস্তায় নেমে গেছি। পণ্ডিত হয়তো মরতে মরতে লোকটিকে বলেছিল, আমিই তাকে বিষ পান করিয়ে পালাচ্ছি। তুমি কোথায় যেতে চাচ্ছিলে? জিজ্ঞেস করল মায়ারাণী। কোথায় যাব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি। আমার কোন বোধই তখন কাজ করছিল না।
পরে আমি বুঝেছি আমি আনমনে মুসলিম সেনাপতি যে দিকে থাকে সে দিকেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি বেশী দূর এগুতে পারলাম না। পিছনে অনেক লোকের দৌড়ানোর আওয়াজ পেয়ে আমি পথ বদল করে ফেললাম। আমি একটি গলিতে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু গলিটির পথ এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়ে গেল। সামনে অগ্রসর হওয়ার মতো আর কোন পথই ছিল না, ফলে পিছু ধাওয়াকারীরা আমাকে গলির মাথায় ধরে ফেলল। এরা আমাকে ধরে মন্দিরে নিয়ে গেল। এর আগেই পণ্ডিত মরে গেছে। এর পরের ঘটনা তোমরা জানো, আমাকে কিভাবে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
সেই রাত শেষে ভোর বেলায় বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাকারীণী মহিলা দলের দলনেত্রীসহ অন্যান্য তরুণীদেরকে কাঠের বেষ্টণীতে ভরে উটের ওপর তুলে নগর ফটক পেরিয়ে আনা হলো। ওদের শহর থেকে নিরাপদে বের করে দিয়ে শহরময় প্রচার করা হলো কে বা কারা মন্দিরের প্রধান পণ্ডিতকে
বিষ পান করিয়ে হত্যা করেছে। আর সেই তরুণী শিমুকে চরম অমানবিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করল উজির। সেই দিন সকাল বেলায় গোয়েন্দা প্রধান বিন কাসিমের কক্ষে গিয়ে বললেন, খবর পেলাম, গত রাতে বড় মন্দিরের প্রধান পণ্ডিতকে অজ্ঞাত লোকে বিষ পানে হত্যা করেছে? গোয়েন্দা প্রধান তাকে আরো জানালেন, আমি নিজে মরদেহ দেখে এসেছি। মরদেহ ও তার মুখের লালা দেখে নিশ্চিত হয়েছি, তাকে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হ্যাঁ তাকে বিষ পানেই হত্যা করা হতে পারে। আর আমি তোমাকে একথাও বলে দিতে পারি কে তাকে বিষ পান করিয়েছে? বললেন বিন কাসিম। আমি তোমাকে ডেকে পাঠাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ঠিক সময়েই তুমি এসে গেছে। গতকাল আমার এখানে কিছু মেহমান এসেছিল। …বিন কাসিম গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে রাতের পূর্বাপর পুরো ঘটনা শোনালেন। শিমুর প্রতিটি কথা ও আচরণ সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। আমি তোমাকে বলবো বলে মনস্থ করেছিলাম, এসব মন্দির বন্ধ করে দিতে হবে। মন্দিরগুলো রাজা দাহিরের চক্রান্তকারীদের নিরাপদ আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস পণ্ডিতকে সেই তরুণীই বিষ পান করিয়েছে, যে গতরাতে আমার কাছে এসেছিল।
বিন কাসিমের কথা শুনে দ্রুত সেখান থেকে উঠে গোয়েন্দা প্রধান মন্দিরের সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন। তিনি গভীর নিরীক্ষা করে দেখতে পেলেন পণ্ডিতের কক্ষে একটি পান পাত্রে তখনো কিছুটা পানীয় অবশিষ্ট রয়ে গেছে। এই অবশিষ্টটুকু আসলে শরাব ছিল পানি নয়। শা’বান ছাকাফী সেখানে অবস্থানরত সৈন্যদেরকে একটি লা ওয়ারিশ কুকুর ধরে আনতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সৈন্যরা একটি কুকুর ধরে আনলো। কুকুরটিকে অবশিষ্ট পানীয় খাইয়ে দেয়া হলো। দেখতে দেখতে কুকুরটার মাথা কয়েকবার ঝাকুনী দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অতঃপর গোয়েন্দা প্রধান যে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন তা ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে।
মন্দির থেকে সেনাপ্রধানের কাছে এসে গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফী বললেন। সম্মানিত সেনাপতি। আমাদের ও আপনার চার পাশে যেসব বিপদ ও আশঙ্কা ভিড় জমেছে আপনি হয়তো এসবকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আপনি রণাঙ্গনে পারদর্শী বটে কিন্তু আমাদের শত্রুতা অদৃশ্য যেসব আক্রমণ আমাদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করছে এসব হয়তো পুরোপুরি আপনার
বোধগম্য নাও হতে পারে। আমি এখানে এমন কিছু বিপদাশঙ্কা করছি। যেগুলোর খুঁটিনাটি আপনার গোচরীভূত নাও হতে পারে। আমি আপনাকে পরিষ্কার বলে দিতে চাই, আজ থেকে সরাসরি আপনার সাথে কাউকে দেখা করতে দেয়া হবে না।
যুদ্ধ ছাড়াই নিরূন জয় করেছিলেন বিন কাসিম। নিরূন পর্যন্ত নৌকা করে মিনজানিকগুলো বহণ করা হয়েছিল। নিরূন অবরোধ করার সময়ও সব মিনজানিক সেখানে ব্যবহার করা হয়নি। মাত্র কয়েকটি মিনজানিক অবরোধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অধিকাংশই রয়ে গিয়েছিল নৌকায়। নৌকাগুলো ছিল সাকিরা নদীতে। আর সাকিরা নদী নিরূন থেকে কয়েক মাইল দূর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিন কাসিম জানতেন, নিরূনের শাসক সুন্দরী বিন কাসিমের মোকাবেলা করবেন না, তিনি প্রস্তাবিত শান্তি চুক্তির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। তিনি দৃঢ় আশাবাদী ছিলেন নিরূনে তাকে কোন আক্রোশের মুখোমুখি হতে হবে না। বাস্তবেও তাই ঘটল। যেহেতু নিরূন অঞ্চল বিন কাসিমের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল গুপ্ত হামলার সম্ভাবনা তেমন ছিল না সেই সাথে যেসব মিনজানিক নৌকায় রাখা ছিল সেগুলোর মধ্যে কোন হামলার আশঙ্কাও কম ছিল। এরপরও নদীর তীরে রাতের বেলায় পাহারা ও টহলের ব্যবস্থা রাখা হলো। নদীতে যারা মাছ ধরতো তাদের সবাইকে বলা হলো, তোমরা ক’দিন রাতের বেলায় মাছ ধরা বন্ধ রাখবে এবং নৌকাগুলো আমাদের কাছে জমা থাকবে।
বিন কাসিমের পরবর্তী গন্তব্য ছিল সিহুন। পথিমধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দুর্গ ছিল কিন্তু এগুলোর ব্যাপারে কোন আশঙ্কা ছিল না। কারণ সুন্দরী তঁাকে এসব ছোট ছোট দুর্গের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিলেন। এগুলোর শক্তি সৈন্যবল ও নিয়ন্ত্রকের অবস্থা জেনে নিয়েছিলেন বিন কাসিম। সিহুনের শাসকও ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধরা যুদ্ধ সংঘাত ও হত্যাকাণ্ডকে খুবই অপরাধ বলে বিশ্বাস করতো, তাই আশা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে, সিহুনও সংঘর্ষ ছাড়াই কব্জা করা যাবে। কিন্তু সেখানকার সেনাবাহিনীর সিংহভাগ ছিল হিন্দু। এদিক থেকে একটা আশঙ্কা রয়েই গিয়েছিল হিন্দু সৈন্যরা বিনা বাধায় দুর্গ বিন কাসিমের হাতে তুলে দেবে না। নিরূন শাসক সুন্দরী এক দূতকে সিহুনের শাসকের কাছে আগেই এই খবর দিয়ে পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি যেন লড়াই থেকে বিরত থাকেন এবং
মুসলিম বাহিনীকে দুর্গফটক খুলে স্বাগত জানান। কিন্তু তখনো সুন্দরীর দূত ফিরে আসেনি, এজন্য বিন কাসিম যাত্রা বিলম্বিত করছিলেন। সেই সাথে আরো রসদ ও জরুরি সামগ্রী এসে পৌছার জন্যও কিছুটা অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল।
হঠাৎ একদিন খবর এলো, যেসব সৈন্য নদী তীরে মিনজানিক পাহারায় দিচ্ছিল, এদের মধ্যে দু’জনকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে পাওয়া গেছে আর দু’জনের কোন খোঁজ নেই।
পাহারা দেয়ার জন্য এক সপ্তাহের জন্য চারজন সৈন্য পাঠানো হতো। তাদের দু’জন সেখানে তাঁবুতে বিশ্রাম করত আর দুজন নদীতীরে বাঁধা নৌকাগুলো পাহারা দিতে টহল দিতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে কিছুক্ষণ পরপর পালা বদল করে কর্তব্য পালন করতো। নদীর তীরের প্রায় এক মাইলের মতো জায়গায় সামরিক সরঞ্জাম ভর্তি নৌকাগুলো বাঁধা। বিন কাসিমের কাছে সংবাদটি ছিল খুবই দুশ্চিন্তার। দু’জন মৃত আর দুজন নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপাটি মোটেও স্বাভাবিক কোন ঘটনা ছিল না। মৃতদেরকে খঞ্জরাঘাতে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেল।
সংবাদ পেয়েই বিন কাসিম ও গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী তাদের একান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে অকুস্থল পরিদর্শন করলেন।
তারা দেখতে পেলেন, উভয়ের মৃতদেহ নদীতীরে পানি থেকে কিছুটা দূরত্বে পড়ে রয়েছে। শা’বান ছাকাফী সেখানকার মাটিতে মানুষের পদচিহ্ন নিরীক্ষা করলেন, পদচিহ্ন দেখে বুঝতে পারলেন এখানে সংঘর্ষ তেমন হয়নি। উভয়ের তরবারী ছিল কোষবদ্ধ, তাতে বোঝা যায় মোকাবেলা করার মতো সুযোগ তারা পায়নি।
আকষ্মিক আক্রমণ করা হয়েছে এদের ওপর, বললেন শাবান ছাকাফী। ধোকা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এদেরকে। তাহলে যে দু’জন নিখোঁজ হয়েছে, এরাই এদের ঘাতক? জানতে চাইলেন বিন কাসিম।
আল্লাহর কসম? এটা আমি বিশ্বাস করব না! বললেন গোয়েন্দা প্রধান।
গভীরভাবে সেখানকার মাটি পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন শাবান ছাকাফী। এলাকাটি ছিল অনাবাদী ও বালুকাময়। পায়ের ছাপ পরিষ্কার বোঝা যায়। পায়ের ছাপ দেখে দেখে শাবান ছাকাফী নদীতীর থেকে অনেক দূর অগ্রসর হলেন। এক পর্যায়ে তিনি নিখোঁজ প্রহরীদের মৃতদেহও পেয়ে গেলেন। নদীতীর থেকে অনেক দূরে তাদের খরাঘাতে হত্যা করে ফসলী খেতের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল।
সেই জায়গা থেকে পদচিহ্ন দেখে দেখে শা’বান ছাকাফী আবার নদীর তীরের দিকে অগ্রসর হয়ে একেবারে সর্বশেষ মিনজানিক বহণকারী নৌকার কাছে পৌছলেন। ঘাতকের পদচিহ্ন তাকে এই পর্যবেক্ষণে বাধ্য করল। এখানে এসে তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, মিনজানিক কতগুলো আছে তা এক্ষুণি গুণে দেখো। সব মিনজানিক ও সামরিক সরঞ্জাম তল্লাসী করা হলে জানা গেল, মিনজানিকের সংখ্যা একটি কম এবং সবচেয়ে ক্ষুদ্র মিনজানিকটি নেই। শাবান ছাকাফী বিন কাসিমকে রিপোর্ট দিলেন, “এই হত্যাকাণ্ড শত্রুপক্ষের কাজ শক্ত ঘাতকরা এদের হত্যা করে ছোট্ট মিনজানিকটি নিয়েগেছে।”
অবশ্য এটা জানা সম্ভব হয়নি, কি করে মিনজানিকটি হিন্দুরা এখান থেকে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল। শা’বান ছাকাফী আশঙ্কা করলেন, রাজা দাহির এখন তার কারিগরদের দিয়ে দ্রুত মিনজানিক তৈরি করার চেষ্টা করবে। তখনকার দিনে মিনজানিক ছিল এক বিস্ময়কর সামরিক অস্ত্র। আরবরা যখন মিনজানিক ব্যবহার করতে শুরু করে হিন্দুস্তানে এর কোন নামগন্ধও ছিল না। মিনজানিকের অদ্ভুত কার্যকারিতা দেখে রাজা দাহির তার উজির বুদ্ধিমানকে বলল, যে কোনভাবে অন্তত একটা মিনজানিক হাত করার চেষ্টা করো। যাতে আমরাও এমন মিনজানিক তৈরির চেষ্টা করতে পারি। মিনজানিক নিয়ে ওরা যেভাবে আমাদের দুর্গের ভিতরে বিরাট বিরাট পাথর নিক্ষেপ করছে, তাতে দুর্গ রক্ষা করা মুশকিল।
বিন কাসিমের নিরাপত্তারক্ষীদের নদীর তীরবর্তী এলাকায় তল্লাশী করে দুর্ঘটনার সূত্র উদঘাটনের নির্দেশ দেয়া হলো। নির্দেশ পাওয়া মাত্র দ্রুত ঘোড়া দৌড়াল চৌকস বিশেষ বাহিনী। বিন কাসিম ও গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফীও দু’দিকে ঘোড়া দৌড়ালেন। নদীর যে তীরে নৌকাগুলো বাধা ছিল সেই তীরবর্তী বহু দূর পর্যন্ত গোটা এলাকা তারা তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করলেন কিন্তু কোন দুষ্কৃতিকারীর কোন চিহ্নও খুঁজে পেলেন না। অবশেষে হতাশ হয়ে উভয়েই অকুস্থলে ফিরে এলেন।
সম্মানিত সেনাপতি। বললেন গোয়েন্দা প্রধান। আমি নদীর অপর তীরে যাচ্ছি। আপনার দুজন নিরাপত্তারক্ষী আমাকে দেন আর আপনি শিবিরে চলে
যান। শত্রুরা খুবই গভীর ফাদ তৈরী করেছে। আপনার এখানে থাকা ঠিক হবে না। নিরূনে আমাদের আর অবস্থান করাটাই ঠিক হবে না, বললেন বিন কাসিম। আমাদেরকে এখন দ্রুতগতিতে অভিযানে নামতে হবে। শত্রুরা আমাদের মিনজানিক এজন্যই চুরি করেছে, যাতে এটা দেখে তারা মিনজানিক বানিয়ে নিতে পারে। আমি তাদেরকে মিনজানিক তৈরি করে প্রতিরোধ করার সুযোগ দিতে চাই না। হতে পারে আমি চোরকে পথিমধ্যে পাকড়াও করবো, বললেন গোয়েন্দা প্রধান। মিনজানিক এতোছোট জিনিস নয় যে, তাড়াতাড়ি এটিকে যে কোন দিকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।
এ এলাকা থেকে আপনার চলে যাওয়া উচিত। এমন না হয় যে, লুকিয়ে থাকা কোন শত্রুর তীর আপনাকে বিদ্ধ করে। বিন কাসিম মৃত সৈন্যদের লাশগুলোকে তুলে আনবার জন্য কয়েকজন সেনাকে নির্দেশ দিলেন।
রাতের কোন সময় মিনজানিক এখান থেকে নিয়ে গেছে এ ব্যাপারটি কারো পক্ষে জানার উপায় ছিল না। এটাও জানার উপায় ছিল না, কোন দিকে নিয়ে গেছে এগুলো। শা’বান ছাকাফীর একান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের কয়েকজন তার সাথে ছিল। তাছাড়া বিন কাসিমের একান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের থেকে আরো দু’জনকে তিনি সাথে নিয়ে গেলেন। গোয়েন্দা প্রধান সৈন্যদের নিয়ে নদীতীর দিয়ে ভাটির দিকে অগ্রসর হয়ে এমন একটি জায়গায় গিয়ে থামলেন সেখানে নদীটা বেশ চওড়া। সেখানে তিনি সবাইকে ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিলেন এবং সাথীদের নিয়ে ঘোড়াসহ সাতরিয়ে নদী পার হলেন। নদী পার হয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি ভাটিতীর ধরে ভাটির দিকে বহুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হলেন। তীরের এক জায়গায় একটি নৌকার অর্ধেকটা ডাঙ্গায় উঠানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন এটিই সেই হারিয়ে যাওয়া নৌকা যেটাতে সবচেয়ে ছোট মিনজানিকটি বোঝাই করা ছিল। নৌকাটি তখন ছিল খালি। নদীতীরে মিনজানিক নৌকা থেকে টেনে নামানোর স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পেলেন গোয়েন্দা প্রধান। মিনজানিকটির চারটি চাকা ছিল। এগুলোর চিহ্নগুলো মাটিতে স্পষ্ট রয়ে গেছে। গোয়েন্দা প্রধান দেখতে পেলেন সেখানে হাতি ও ঘোড়ার পদচিহ্নও রয়েছে। শাবান ছাকাফী বুঝতে পারলেন শত্রু বাহিনী মিনজানিকটি চুরি করে এখানে এসে হাতি দিয়ে টেনে তুলে হাতি ব্যবহার করে সেটিকে টেনে নিয়ে
গেছে। হাতির শক্তি সামর্থ ও গতি সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ। তদুপরি পদচিহ্ন ধরে কয়েক মাইল অগ্রসর হলেন তিনি। কিন্তু মিনজানিক বহণকারী কোন দলকে দেখতে পেলেন না। অনেকদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে মিনজানিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে শত্রু সেনারা তা আন্দাজ করতে পারলেন তিনি। তাই যাত্রা বিরতি দিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে। ফিরে এলেন নিরূন।
সম্মানিক সেনাপতি! তল্লাশী অভিযান থেকে ফিরে এসে বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। আমাদের মিনজানিকটি শত্রু সেনারা নিয়ে গেছে। ওরাই প্রহরীদের হত্যা করেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি মিনজানিকটি ওরা সিস্তান নিয়ে গেছে। এখন আমাদের দ্রুত অগ্রাভিযান চালাতে হবে। আপনি গতকাল ঠিকই বলেছেন, অনুরূপ মিনজানিক তৈরি করার সুযোগ আমরা শত্রুদের দেবো না। এতো দ্রুত আমরা ওদের ওপর আক্রমণ করব, মিনজানিক বানানো দূরে থাক জিনিসটি ওরা ভালোভাবে দেখার সুযোগও পাবে না। নিরূন থেকে বিন কাসিম সিস্তান অভিযানেরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু এতো শীঘ্র অভিযানের সংকল্প তাঁর ছিল না। যতোটাই সিন্ধু অঞ্চলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল মুসলিম বাহিনী, বিন কাসিমকে ততোটাই ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। রাজা দাহিরের রণকৌশল আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বিন কাসিম। দাহির ভেবে ঠিক করেছিল আরব সৈন্যরা একেরপর এক অভিযান চালিয়ে দুর্গের পর দুর্গ জয় করে শক্তিক্ষয় ও অংশ বিশেষকে বিজিত এলাকার নিয়ন্ত্রণে রেখে যখন সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে, তখন প্রবল প্রতাপে এক আক্রমণেই মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দেবে দাহির বাহিনী। তাই প্রতিটি অগ্রাভিযানের আগে সঠিক পরিকল্পনা এবং জনশক্তি ক্ষয়ের জন্য গভীরভাবে ভাবতে হতো বিন কাসিমকে। কিন্তু বেশি ভাবনার সুযোগ তার হলো না। পরিস্থিতি দ্রুত অভিযান চালাতে বাধ্য করল। নিরূন শাসক সুন্দরী তার অনুগত এক বৌদ্ধকে সিস্তানের বৌদ্ধ শাসকের কাছে পয়গাম দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। যাতে সেখানকার শাসক বিন কাসিমের মোকাবেলা না করে স্বাগত জানায়। বিন কাসিম এই দুতের ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ইতোমধ্যে সেই দূতও ফিরে এলো।
দূত এসে সুন্দরীর উপস্থিতিতে বিন কাসিমকে জানালো, সিস্তান এখন শুধু একটি দুর্গ নয়, সেটি পাহাড়ের মতো দুর্ভেদ্য হয়ে গেছে। রাজা দাহির
সিস্তানের বৌদ্ধ শাসককে রাজধানীতে তলব করেছেন আর তার পরিবর্তে তার ভাতিজা বিজয় রায়কে সেখানকার শাসক বানিয়েছেন। বিজয় রায় এসেই সেনাবাহিনীর মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সে সেনাদেরকে নতুনভাবে তৈরি করেছে। এমনিতেই সিস্তান দুর্গ মজবুত। তদুপরি বিজয় রায় দুর্গটিকে আরো দুর্ভেদ্য বানিয়ে ফেলেছে। সিস্তান দুর্গ অবরোধ করে জয় করা সহজসাধ্য হবে না। তাছাড়া দুর্গ রক্ষার জন্য তারা কোথেকে জানি একটি মিনজানিক নিয়ে এসেছে।
মিনজানিক ওখানে কখন এনেছে ওরা? দূতকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
আমি সেখানে থাকাবস্থায়ই মিনজানিকটি এনেছে তারা। দুর্গের ভিতরে সেটিকে নিয়ে আসার দৃশ্যও আমি দেখেছি, বলল দূত। দুটি হাতি সেটিকে টেনে নিয়ে আসছিল, আর বারো তোরোজন অশ্বারোহীও সেটির সাথে ছিল। আমিতো দেখে অবাক। মিনজানিক কোথেকে আনলো এরা। কারণ এই অঞ্চলে এমন যন্ত্র বানানোর কোন কারিগর নেই।
দুর্গের প্রধান ফটকের ওপরের দুর্গপ্রাচীরে সেটিকে স্থাপন করেছে। মিনজানিকের পাশে পাথরের বিশাল স্তুপ করেছে।
দূতের কথা শুনে স্মিত হেসে বিন কাসিম বললেন, আল্লাহর কসম। এরা আসলে বোকা। এরা এক দিকে দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, এখানে এসে আমাদের চার সিপাহীকে হত্যা করে মিনজানিক চুরি করে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে, কিন্তু এরা এটা জানা ও বোঝার চেষ্টা করেনি, মিনজানিক কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করতে হয়। ঠিক আছে তুমি আর কি দেখে এসেছ বলো…। ‘সিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বলল দূত। আমি ওখানে গিয়ে যখন জানতে পারি শাসক বদলে গেছে, তখন আত্মপরিচয় গোপন করে শহরে ঘুরতে থাকি। শহরের সাধারণ মানুষ যুদ্ধে আগ্রহী নয় কিন্তু বিজয় রায় তাদেরকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করছে। বিজয় রায় তাদেরকে মুসলমানদের সম্পর্কে ভয় দেখাতে বলছে, মুসলিম সৈন্যরা এতোটাই হিংস্র যে, ওরা শহরে প্রবেশ করলে নির্বিচারে গণহত্যা চালাবে, শহর তছনছ করে ফেলবে, তাছাড়া শহরে সকল যুবতীদের ধরে নিয়ে সৈন্যরা ভাগাভাগি করে তাদের সাথে…?
বিজয় রায়ের এ অপপ্রচার ছিল সকল অমুসলিমদের অপপ্রচারেরই একটা অংশ। সেও মুসলিম বিদ্বেষীদের প্রচলিত রীতি অনুসরণ করেই সিস্তানের
অধিবাসীদেরকে মুসলিম সৈন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছিল। কিন্তু বিজয় রায়ের এই অপপ্রচার ছিল বিন কাসিমের বাহিনীর কার্যক্রমের বিপরীত। বিন কাসিমের বাহিনী সিন্ধু এলাকার যেসব দুর্গ ও শহর জয় করেছিল সেখানকার অধিবাসী ও হিন্দু বাসিন্দারা পর্যন্ত বিন কাসিম ও মুসলিম সৈন্যদের সব্যবহারে ছিল মুগ্ধ। তারা রাজা দাহির ও হিন্দু শাসকদের অপপ্রচারের বিপরীত প্রত্যক্ষ করছিল মুসলিম সেনাদের মধ্যে। ফলে তাদের ইতিবাচক প্রচারণা হিন্দু শাসকদের মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডাকে অকার্যকর করে দিচ্ছিল। ডাভেল, নিরূন বিজিত হওয়ার পর সেখানকার বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ ব্যবসায়ী নানা কাজে সিস্তানসহ অন্যান্য এলাকায় গিয়ে মুসলিম সৈন্যদের সব্যবহার ও তাদের সুশাসনের প্রচার করছিল। তারা যেখানেই যেত সর্বাগ্রে আলাপ আলোচনায় স্থান পেতো মুসলিম সৈন্যদের ন্যায়নীতি ও সুশাসনের প্রশংসা।
বিজিত শহর আরমান ভিলা, ডাভেল ও নিরূনের কিছু ব্যবসায়ী ও নাগরিক সিস্তানে এসে মুসলিম সৈন্যদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করায় বিজয় রায়ের অপপ্রচার হালে পানি পাচ্ছিল না। বিজিত এলাকার ব্যবসায়ীরা এসে সিস্তানবাসীদের জানালো, বিজয়ী সৈন্যরা ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে না, কোন বাড়িঘরে হামলা করে না, কারো ওপর জুলুম অত্যাচার করে না, বিশেষ করে কোন নারীর প্রতি তারা তাকিয়েও দেখে না। তারা নারীকে খুবই ইজ্জত ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে।
সুন্দশ্রীর দূত আরো বলল, সিস্তানের সাধারণ নাগরিক আর সৈন্যদের মধ্যে ঐক্য নেই। হিন্দু সেনাবাহিনী ও সেখানকার সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ নাগরিকদের মধ্যে আদর্শিক মত পার্থক্য প্রবল।
বিন কাসিম একজনকে নিরূনের শাসক নিযুক্ত করে এবং সেনাদের একটি ইউনিটকে নিরূনের প্রশাসনিক দায়িত্বে রেখে সিস্তানের দিকে অগ্রাভিযানের নির্দেশ দিলেন। বিন কাসিম কোন সালের কোন মাসে কোন তারিখে নিরূন থেকে সিন্তানের দিকে অগ্রাভিযান শুরু করেছিলেন এর সুস্পষ্ট কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। মিনজানিক চুরি হওয়া এবং চারজন সৈন্য গুপ্তঘাতকের আক্রমণে মারা যাওয়ার পর বিন কাসিম খুবই সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। পূর্বের চেয়ে তিনি আরো বেশি সতর্ক ও সচেতনতার সাথে পা মেপে মেপে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কোন ধরনের ঝটিকা আক্রমণে যাতে শত্রু বাহিনী তাদের ঘায়েল করতে না পারে এজন্য সৈন্যদেরকে তিন ভাগে বিভক্ত করে অভিযান শুরু করলেন।
তিনি মধ্যভাগে অবস্থান নিলেন। সবার আগে পাঠিয়ে দিলেন অগ্রবর্তী – দল। আর দু’পাশের বাহুতে উষ্ট্রারোহী বাহিনীকে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলেন, যাতে শত্রু বাহিনী হঠাৎ পিছন দিক কিংবা কোন বাহুতে ঝটিকা আক্রমণ করে সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করতে না পারে। যথাসম্ভম যাত্রা বিরতি কম করে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়ার জন্য সেনাদের নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। রাজা দাহিরের সৈন্যবাহিনীর তুলনায় বিন কাসিমের জনবল ছিল কম কিন্তু কম হলেও তারা প্লাবনের মতো দ্রুতগতিতে শত্রু ঘাটির প্রতি অগ্রসর হচ্ছিল। এদিকে রাজা দাহির সিস্তানের বৌদ্ধ শাসককে রাজধানীতে ডেকে নিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিস্তানের শাসক ও সেনাপ্রধানের ক্ষমতায় আপন ভাতিজা বিজয় রায়কে বসায়।
অভিযানের তৃতীয় দিনে বিন কাসিমের সৈন্যরা মৌজ নামক স্থানে পৌঁছে গেল। মৌজ সিস্তান শাসকের অধীনে ছিল। এলাকাটির অবস্থান ছিল একটি নদীর তীরে। নদীর তীরে বসতিও ছিল তবে এরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বিন কাসিমের বাহিনী যখন সেখানে শিবির স্থাপন করল, তখন সেখানকার বৌদ্ধদের একটি প্রতিনিধি দলকে নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু বিন কাসিমের কাছে হাজির হলো। ভিক্ষুরা গিয়ে বিন কাসিমকে জানালো, আমরা আপনার কাছে শান্তির পয়গাম নিয়ে এসেছি। আমরা কোন সংঘাতে বিশ্বাস করি না। বৌদ্ধধর্ম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। হিংসা বিদ্বেষ রক্তপাত আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ ও মহাপাপ। আমরা আপনার কাছে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করছি। আপনি আমাদেরকে মিত্র হিসাবে গ্রহণ করুন। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন, মৌজ এলাকার বৌদ্ধরা সিস্তানের পরিবর্তিত শাসক বিজয় রায়ের কাছে এক প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে এই আবেদন করেছিলেন যে, আপনি দুর্গভ্যন্তরে রয়েছেন আপনার হাতে রয়েছে সেনাবাহিনী। আমরা খুবই দুর্বল, আমাদের লড়াই করার সামর্থ নেই। লড়াই করতে চাইলেও আমরা তা পারব না, কারণ আমরা লড়াই ও সংঘাতে অভ্যস্ত নই। আমাদের ধর্ম যুদ্ধ সংঘাতের বিরোধী। আমাদের ধর্ম গুরু মহাত্মা বৌদ্ধ বলেছেন, সৈন্য দিয়ে কোন জনবসতিকে তোমার পযুদস্ত করে দিতে পারো, তরবারী দিয়ে করো দেহ দ্বিখণ্ডিত করে দিতে পারো, তীর চালিয়ে বুক ঝাজরা করে ফেলতে পারো কিন্তু অত্যাচার চালিয়ে কোন মানুষের মন জয় করতে পারবে না। আপনি যদি চান যে, আমরা মুসলিম সৈন্যদের আনুগত্য না করি, তাহলে আমাদের সাথে কিছু সৈন্য পাঠিয়ে দিন কিন্তু আমরা যুদ্ধ করতে পারবো না।
বিজয় রায় বৌদ্ধদের এই পয়গাম শুনে তার সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, এদেরকে অপমান করে দুর্গ থেকে বের করে দাও। বিজয় রায়ের কাছ থেকে অপমাণিত হয়ে ফিরে এসে বৌদ্ধদের একটি দল বিন কাসিমের কাছে হাজির হয়। তারা বিন কাসিমকে প্রস্তাব করে, আপনি যদি এই বসতি দখল করতে চান তাহলে করতে পারেন, আপনাকে কোন প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে না।
আপনি যদি এখান থেকে আপনাদের ঘোড়া ও উটের খাবার সংগ্রহ করতে চান, করতে পারেন, আপনি ইচ্ছা করলে সৈন্যদের জন্য খাবার ও তরিতরকারীও সংগ্রহ করতে পারেন। আপনি যদি নগত টাকা পয়সা নিতে আগ্রহী হন তাহলে তাও আমরা আপনার দরবারে হাজির করতে প্রস্তুত। ‘শান্তি ও বন্ধুত্বের চেয়ে আর কিছুই বেশি দামী হতে পারে না।’ ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বললেন বিন কাসিম। আপনারা যেহেতু বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেছেন, তাই আমরাও আপনাদের ধন সম্পদ ও জীবনের ‘ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এখন থেকে আমরাই হবো আপনাদের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত সম্ভ্রমের পাহারাদার।
বিন কাসিম সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে সিস্তানে পৌছে দেখলেন দুর্গের। সব ক’টি ফটক বন্ধ। দুর্গপ্রাচীরের প্রশস্ত দেয়ালের ওপর সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। মুসলিম সৈন্যদের আসার খবর পেয়েই বিজয় রায় দুর্গের প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করেছিল।
মুসলিম সৈন্যরা দেখলো একটি মিনজানিক দুর্গের সদর দরজার ওপরের দেয়ালে রাখা হয়েছে। বিন কাসিমের নির্দেশে এক ডেপুটি সেনাপতি ফটকের কাছে গিয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, কোন ধরনের প্রতিরোধের চেষ্টা না করে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গের ফটক খুলে দাও। না হয় আমাদেরকে যদি দুর্গ দখল করতে হয় তাহলে তোমাদের কাছ থেকে আমরা অধীনতামূলক জিজিয়াসহ যাবতীয় যুদ্ধ ব্যয় আদায় করবো এবং তোমাদের সম্পদ গনীমতের সম্পদে পরিণত হবে, আর সেনাবাহিনীর কোন কর্মকর্তাকেই জ্যান্ত রাখা হবে না।
“যদি সাহস থাকে তাহলে হামলা করে দেখো, শক্তি থাকলে দুর্গ দখল করেই দেখিয়ে দাও।” জবাব এলো দুর্গপ্রাচীর থেকে।। দুর্গপ্রাচীরের কাছাকাছি মিনজানিক স্থাপন করতে মিনজানিক ইউনিটকে নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। মিনজানিক এগিয়ে নিতে গেলে দেয়ালের ওপর
থেকে শত্রু বাহিনী তীর বৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করল। সেই সাথে দুর্গফটকের ওপরে স্থাপনকৃত মিজানিক থেকে পাথর নিক্ষেপ শুরু করল হিন্দু সৈন্যরা। তবুও মুসলিম সৈন্যরা দুর্গপ্রাচীরের কাছাকাছি চলে গেল কিন্তু দুর্গপ্রাচীরের – এমন কোন জায়গা দেখা গেল না, যেখানে মিনজানিক থেকে পাথর নিক্ষেপ করে ভাঙ্গন সৃষ্টি করা যাবে।
দুর্গের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিজয় রায় ও তার অনুগত সেনাদের অনুকূলে ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ অধিবাসীদের একটি প্রতিনিধিদল মুসলিম সেনারা অবরোধ করার পরপরই বিজয় রায়ের কাছে গিয়ে আবেদন করল, “মহামান্য শাসক! আপনি দুর্গফটক খুলে দিন। শহরের অধিবাসীরা যুদ্ধ চায় না। আপনি তাদের পক্ষ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পাবেন না। বিজয় রায় তাদেরকে হুমকি ধমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখার নির্দেশ দিলো। অতঃপর দুর্গব্যাপী হুকুম জ্বারি করল, যারা যুদ্ধ করতে চায় না, তারা যেন নিজ নিজ বাড়িঘরে দরজা বন্ধ করে অবস্থান করে আর যারা যুদ্ধ করতে চায় তারা যেন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দুর্গপ্রাচীরে এসে হাজির হয়।
বিজয় রায়ের সৈন্যরা মুসলিম বাহিনী যে দিক থেকে পাথর নিক্ষেপ করে দেয়ালে ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা করছিল, সে দিকে তীরের তুফান বইয়ে দিচ্ছিল। তাছাড়া বিজয় রায়ের সৈন্যরা হঠাৎ কোন দরজা খুলে শত শত অশ্বারোহী ঝড়ের বেগে এসে মুসলিম সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে আবার ঝড়ের বেগে দুর্গে প্রবেশ করে পরিস্থিতি সংকটময় করে তুলছিল।
অবস্থা দেখে বিন কাসিম সর্বশ্রেষ্ঠ মিনজানিক উরূস এর পরিচালক জাউনা সালমীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাকে বললেন, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, আমাদের কাছ থেকে চুরি করে আনা মিনজানিক দিয়ে শত্র সেনারা আমাদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করছে। ছোট মিনজানিকগুলো দিয়ে ওটাকে আঘাত করা যাচ্ছে না। তুমি ডাভেল মন্দিরের চূড়া ভেঙে সেখানকার ঝাণ্ডা গুড়িয়ে দিয়েছিল। আজও এই মিনজানিকটাকে উড়িয়ে দাও।
এটি উড়িয়ে দেবো ইনশাআল্লাহ। সম্মানিত সেনাপতি! আপনি চিন্তা করবেন না। এতে আমার মাত্র তিনটি পাথর ব্যবহার করতে হবে। জাউনা সালমী উরুসকে এগিয়ে নিয়ে সুবিধা মতো স্থানে স্থাপন করে তিনটি বিরাটকায় পাথর সেটিতে রাখল। পাঁচশ সৈন্য তার নির্দেশে মিনজানিক উৎক্ষেপণ করলে লক্ষভেদী নিক্ষিপ্ত পাথর গিয়ে দুর্গফটকের ওপরে শত্রু
সেনাদের স্থাপিত মিনজানিকের একপাশে আঘাত হানলো। এতে শত্রুদের মিনজানিকটি এক দিকে কাত হয়ে গেল। এরপর আরেকটি পাথর নিক্ষেপ করলে সেটি গিয়ে মিনজানিকের মাথায় আঘাত করলে সেটি ধ্বসে গিয়ে স্থান থেকে সরে গেল। তৃতীয় পাথরটির আঘাতে শত্রুদের মিনজানিক দুর্গপ্রাচীরের নিচে নিক্ষিপ্ত হলো। … :
এরপর মুসলিম সৈন্যদের আর শত্রুদের নিক্ষিপ্ত পাথরের মোকাবেলা করতে হলো না। শুরু হলো এক তরফা মুসলিম বাহিনীর মিনজানিক থেকে শত্রুদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ। বিজয় রায় মুসলিম সৈন্যদের অবরোধ ভাঙার জন্য দুর্গফটক খুলে হঠাৎ ঝটিকা আক্রমণ করে আবার দুর্গে ফিরে আসার নির্দেশ দিলো। যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে বিজয় রায়ের সৈন্যরা ঝটিকা আক্রমণ করে ফিরে যেত। মুসলিম সেনারা ওদের তাড়া করতেই তারা দুর্গপ্রাচীরের ভিতরে চলে যাচ্ছিল। এভাবে চলে গেল এক সপ্তাহ। উল্লেখযোগ্য তেমন কোন অগ্রগতি মুসলিম সৈন্যরাও সাধন করতে পারল না। এমন সময় রাতের বেলায় মুসলিম বাহিনীর প্রহরীদল দু’লোককে পাকড়াও করে নিয়ে এলো। তাদের শরীর কাদাপানিতে একাকসার। তারা সৈন্যদের বলল, আমরা দুর্গের ভিতর থেকে এসেছি, মুসলিম বাহিনীর সেনাপতির সাথে আমরা সাক্ষাত করতে চাই। সৈন্যরা এদেরকে সেনাপতি বিন কাসিমের কাছে না নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর কাছে নিয়ে এলো। কারণ এদেরকে শত্রু সেনাদের গোয়েন্দা হওয়ার আশঙ্কা করছিল তারা।
“তোমরা যে দুর্গের ভিতর থেকে এসেছ, এটা কিভাবে বিশ্বাস করব?” ধৃতদের জিজ্ঞেস করলেন শাবান ছাকাফী। শুধু তোমরা দু’জনের জন্যই কি দুর্গফটক খুলে দেয়া হয়েছে?
তোমাদের কি ধারণা শুধু ফটক দিয়েই দুর্গের বাইরে আসা যায়, আর কোন রাস্তা নেই? বলল এক আগন্তুক। দুর্গের ওই দিকটা পাহাড় টিলা ও জঙ্গলাকীর্ণ। ওদিকে দুর্গের বর্জ পানি বের হওয়ার জন্য দুর্গপ্রাচীরের নিচ দিয়ে একটি ড্রেন আছে। যেহেতু ওদিকটা জঙ্গলাকীর্ণ ও ময়লা আবর্জনার স্তুপে দুর্গন্ধময়। এ জন্য ওদিকে তেমন কেউ যায় না। ওখানকার রাস্তাও লোকজন চেনে না। আমরা দু’জন সেই ড্রেনের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দেয়ালের নীচের সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। বের হওয়ার কাজটি সহসাধ্য ছিল না।
কি উদ্দেশ্যে তোমরা বেরিয়ে এসেছো? জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফী।
আমরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বলল অপরজন। সিস্তান ও মৌজের অধিবাসীরা তোমাদেরকে কি বলেনি সিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসী বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। এখানে আমাদের ধর্মগুরু ভিক্ষু রয়েছেন। বৌদ্ধরা কারো সাথে সংঘাত সংঘর্ষ ও যুদ্ধ করে না, এটা তোমরা ইতোমধ্যেই জেনেছ। আমরা জানি, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে না, তাদেরকে তোমরা ভালো জানো। নিরূনে আমাদেব শাসক সুন্দরী বিনা বিবাদে তোমাদের কি স্বাগত জানায় নি? এখানে দুর্গভ্যন্তরে তোমরা যেসব পাথর নিক্ষেপ করছে, সেগুলো আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমরা শান্তি প্রিয় মানুষ। আমরা এখানে নির্বিবাদে জীবন যাপন করছি। আমাদের কোন লোক দাহিরের সেনাবাহিনীতে নেই।
আমরা এ অবস্থায় তোমাদের কি ধরনের সাহায্য করতে পারি? জানতে চাইলেন গোয়েন্দা প্রধান। তোমাদের লোকজন দুর্গের ভিতরে বসবাস করছে, কি করলে তোমাদের বাচানো যাবে?
তোমাদের সাহায্যের জন্য নয়, আমরা এসেছি তোমাদের সহযোগিতা করতে। বলল এক বৌদ্ধ। যে পথে আমরা দুর্গের বাইরে এসেছি এ পথ দিয়ে তোমরা দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করতে পারো। কিন্তু এ পথটিকে সুড়ঙ্গ করে আরো প্রশস্ত করতে হবে। সেখানকার নীচে মাটি নরম। তোমরা রাতারাতি সুড়ঙ্গ বড় করে সকাল হওয়ার আগেই দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়ে। আমাদের ভিক্ষুরা বলেছেন, দুর্গের ভিতরে তোমাদের সহযোগী লোকের অভাব হবে না। আমরা তোমাদেরকে ভিতরে প্রবেশের পথ দেখিয়ে দিতে এসেছি।
শাবান ছাকাফী তাৎক্ষণিকভাবে এদেরকে বিন কাসিমের কাছে নিয়ে গেলেন এবং এদের সামগ্রিক অবস্থা সবিস্তারে সেনাপ্রধানকে অবহিত করলেন।
বিন কাসিম বর্ণনা শোনা মাত্র সেই স্থানটি দেখার জন্য বের হলেন। গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন জায়গাটা এতোটাই পুতি দুর্গন্ধময় যে সেখানে দাঁড়ানোই সম্ভব নয়, ময়লা আবর্জনা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে একাকসার। তিনি ময়লা পানি সেখান থেকে সরানোম পথ খুঁজতে লাগলো। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই তিনি একটা পরিকল্পনা করলে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যোদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন। যে দিক দিয়ে দুর্গের পানি
বাইরে বের হচ্ছিল এদিকে বেশি করে পাথর নিক্ষেপের জন্য মিনজানিক চালকদের তিনি নির্দেশ দিলেন কিন্তু কোন মিনজানিককে এ দিকে এগিয়ে আনতে নিষেধ করলেন। সেই সাথে সৈন্যদের বললেন, যেকোন মূল্যে ভোর হওয়ার আগেই সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। যে পথে দুর্গের পানি বের হচ্ছিল সেটিকেই খনন করে বড় করার কাজ শুরু হলো। সেখানকার মাটি ছিল কাদা পানিতে একাকসার। কিন্তু পানি আটকিয়ে খনন কাজ শুরু করতেই খননকৃত জায়গায় পানি এসে ভরে যাচ্ছিল। এতে খনন কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিন কাসিম সেখানেই দাড়িয়ে খনন কাজ তদারকি করছিলেন। সৈন্যরা কোমর পানিতে শরীর ডুবিয়ে খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। জায়গাটি জঙ্গলাকীর্ণ বিধায় ছিল প্রচণ্ড অন্ধকারাচ্ছন্ন। এদিকে মিনজানিক থেকে দুর্গের এ পাশে অবিরাম পাথর নিক্ষেপের ফলে দুর্গের এ পাশে কেউ আসার সাহস করল না। আরব সৈন্যদের মধ্যে এ ধরনের সুড়ঙ্গ তৈরিতে পারদর্শী লোকের অভাব ছিল না। তারা জীবনবাজী রেখে সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ দ্রুততার সাথে সমাপ্ত করতে জানপ্রাণ দিয়ে লেগে গেল।
ভোর হওয়ার আগেই সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ সমাপ্ত হয়ে গেল। সময়ের অভাবে সুড়ং পথটি খুব বেশি বড় করা সম্ভব হয়নি। ভোর হওয়ার আগেই মুসলিম বাহিনীর জানবাজ কিছু সংখ্যক সৈন্যকে সুড়ঙ্গ পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। দু’জন সৈন্য গায়ে গা মিশিয়ে কোন মতে ভিতরে প্রবেশ করার মতো সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল। দু’জন ভিতরে প্রবেশ করেই পিছনে আশা সাথীকে বলল, এদিকে পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করতে বলল। সাথীরা পরস্পর একথা দুর্গের বাইরের সাথীদের মাধ্যমে দ্রুত বিন কাসিম পর্যন্ত পৌছে দিলো।
দুর্গ থেকে আগত বৌদ্ধ দু’জনও প্রবেশকারী সৈন্যদের সাথে ছিল। এদেরই অপর এক সাথী দুর্গের ভিতরে তাদের দেখার অপেক্ষায় ছিল। মুসলিম সৈন্যদের কয়েকজন ভিতরে প্রবেশ করলে বৌদ্ধরা তাদেরকে সবচেয়ে নিকটবর্তী দুর্গফটকের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে তখন কয়েকজন হিন্দু সৈন্য পাহারা দিচ্ছিল। হিন্দু সৈন্যরা কল্পনাও করেনি, কোন মুসলিম সৈন্য রাতের অন্ধকারে সেখানে পৌছে যাবে। এ দিক থেকে ওরা ছিল অনেকটাই নিশ্চিন্তে। মুসলিম জানবাজরা অতর্কিতে হিন্দু প্রহরীদের ওপর হামলে পড়ে অল্পক্ষণের মধ্যে সবপ্রহরীকে ধরাশায়ী করে দ্রুত দুর্গের দরজা খুলে দিল।
ইঙ্গিত পেয়ে মুসলিম সৈন্যরা বাধ ভাঙা শ্রাবনের মতো দুর্গভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সেই সাথে মুসলিম সৈন্যরা আরেকটি দরজা খুলে দেয়। রাজা দাহিরের ভাতিজা বিজয় রায় ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারার মতো প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করতে লাগল এবং পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে সে পালানোর পথ খুঁজছিল। ভোরের অন্ধকার ফুড়ে সকালে প্রথম আলোতেই দুর্গের অধিবাসীরা দেখতে পেল, প্রধান ফটকের ওপরে ইসলামী ঝাণ্ডা উড্ডীন।
বিজয়ী মুসলিম সৈন্যরা বিজয় রায়ের সৈন্যদের গ্রেফতার করতে শুরু করলে দুর্গব্যাপী তালাশ করেও বিজয় রায়কে কোথাও পাওয়া গেল না। বিজয় রায়ের ধৃত সৈন্যরা বিন কাসিমকে জানালো, মুসলিম বাহিনী দুর্গে প্রবেশ করতে দেখেই বিজয় রায় তার বিবি বাচ্চা ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে রাতের অন্ধকার থাকতেই প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বিন কাসিম তার সৈন্যদেরকে বিজয় রায়ের পশ্চাদ্ধাবন করার নির্দেশ দিলে বিজয় রায়ের এক কমান্ডার জানালো, তাকে এখন আর পাওয়া যাবে না। এতোক্ষণে সে সিসিম দুর্গে পৌছে গেছে।
বিন কাসিম বিজয় রায়ের সৈন্যদের মধ্য থেকে ধৃত কমান্ডারদের জড়ো করার নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে আরো বললেন, এদেরকে বলো, যারা আমাদের মিনজানিক চুরি করেছিল এবং আমাদের চারজন সাথীকে হত্যা করেছিল, তাদেরকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে। এরা যদি ওদের চিহ্নিত করতে গড়িমসি করে তাহলে এদের প্রত্যেকের মাথা উড়িয়ে দাও এবং এদের ঘরবাড়ির সকল সহায় সম্পদ গণীমতের সম্পদ হিসেবে নিয়ে এসো। শাবান ছাকাফী বিজয় রায়ের ধৃত কমান্ডারদের একত্রিত করে বিন কাসিমের নির্দেশের কথা জানালেন। সেই সাথে তিনি এই হুমকিও দিলেন, তোমরা যদি ওদের চিহ্নিত করতে গড়িমসি কিংবা অজ্ঞতা প্রকাশ করো, তাহলে সবাইকে হাত পা বেধে জমিনের ওপর শুইয়ে ওপর দিয়ে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেয়া হবে। ধৃত কমান্ডাররা আতঙ্কিত হয়ে মিনজানিক চোরাই কাজে জড়িতদের নাম বলে দিলো এবং তাদের দেখিয়ে দিলো। বিজয় রায়ের সকল সৈন্যই ছিল যুদ্ধাপরাধী। সবাইকে বেধে এক জায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তন্মধ্যে চিহ্নিত দশজনকে উঠিয়ে বিন কাসিমের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। মিনজানিক চুরি করার সময় এই দলের লোকছিল চৌদ্দজন কিন্তু তাদের মধ্য
থেকে চারজন বিজয় রায়ের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে যে দলনেতা ছিল সে নিজ থেকেই বিন কাসিমের কাছে এসে আত্মস্বীকৃতি দিলো। তাদের কাছ থেকে জানা গেল, মূলত মিনজানিক চুরির পরিকল্পনা করেছিল রাজা দাহির ও তার উজির বুদ্ধিমান। এ কাজটি সম্পাদন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিজয় রায়ের ওপর। বিজয় রায় মুসলিম বাহিনীর মিনজানিক চুরি করার জন্য তার সৈন্যদের মধ্য থেকে অত্যন্ত দুর্ধর্ষ চৌদ্দ জনকে নিয়োগ করে এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন কমান্ডারকে এদের দলনেতা নিযুক্ত করে। এর আগে বিজয় রায় গোয়েন্দার মাধ্যমে খবর নিয়ে। ছিল মুসলিম বাহিনীর কয়েকটি মিনজানিক এখনো নৌকায় রয়ে গেছে এবং সেই নৌকাগুলো নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা আরো জানালো, সেখানে প্রতি রাতে চারজন সৈন্য পালাক্রমে পাহারা দেয়। একটি তাঁবুতে সৈন্যরা অবস্থান করে। বিজয় রায়ের নির্দেশে চৌদ্দজন সৈনিক শক্তিশালী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অনেকটা পথ ঘুরে সাকিরা নদীর তীরবর্তী মিনজানিক বোঝাই করা নৌকাগুলোর কাছে পৌছে গেল।
নদীর তীর থেকে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করে তাদের মধ্য থেকে দু’জন সৈনিক ঘেঁড়া ফাটা মলিন পোশাক পরিধান করে পাহারারত মুসলিম সৈন্যদের কাছে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফরিয়াদ করল, “আমরা আপনাদেরকে আপনাদের প্রভুর দোহাই দিয়ে বলছি, দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আরো বলল, আমরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। সফরে বের হয়েছি, আমাদের সাথে দুটি যুবতী মেয়ে ছিল। এখান থেকে একটু দূরে ডাকাতরা আমাদের কাছ থেকে তাদের কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ডাকাতরা আমাদের কাছ থেকে সহায় সম্পদ অর্থকড়ি সোনাদানা সবই নিয়ে গেছে। আমাদের সাথে বয়স্ক দু’জন ছিল, ডাকাতরা তাদের মেরে ফেলেছে। আমরা প্রাণ নিয়ে এদিকে পালিয়ে এসেছি। আমরা যেহেতু মহাত্মা বৌদ্ধের অনুসারী, এজন্য আমরা সাথে কোন অস্ত্র রাখি না। কারো সাথে আমরা মারামারিও করতে পারি না।
ডাকাতরা কি ঘোড়া বা উটের ওপর সওয়ার? সাহায্য প্রার্থীদের জিজ্ঞেস করল এক পাহারাদার। না, এরা পায়দল। দয়া করে আপনারা আমাদের সাহায্য করুন। এখনতো এখানে আপনারাই রাজা বাদশা।
বিজয় রায়ের পাঠানো সৈন্য দু’জন মুসলিম পাহারাদারদের সাথে নির্যাতিত ও অসহায়ত্বের এমন নিপুণ অভিনয় করল যে, মুসলিম সৈন্যরা
অত্যাচারিতের সাহায্যের জন্য আবেগে উদ্বেলিত হয়ে গেল। হাতে তরবারী তীর বর্শা নিয়ে পাহারাদার দু’জন সাহায্য প্রার্থীদের নিয়ে তাদের দেখানো জায়গার দিকে দৌড়াতে শুরু করল। এ দিকে তাদের গন্তব্য স্থলের দিক থেকে ভেসে আসছিল নারী কন্ঠের আর্তনাদ ও আর্তচিৎকার, ফলে সাহায্যকারীগণ নির্যাতিতদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে আরো বেশি আবেগ উত্তেজনা নিয়ে দৌড়াতে লাগল। এলাকাটি ছিল ঘন ঝোপ ঝাড়ে পরিপূর্ণ। সাহায্যকারীগণ দৌড়ে যাচ্ছিলো কল্পিত ডাকাতদের ধরতে আর মজলুম নারীদের উদ্ধার করতে কিন্তু গোটা ঘটনাটাই যে ছিল পরিকল্পিত নাটক তা ঘূর্ণাক্ষরেও তারা ভাবতে পারেনি। এদিকে ওৎপেতে থাকা চার পাঁচজন হিন্দু সৈন্য হঠাৎ দৌড়ে আসা মুসলিম প্রহরীদের ওপর খঞ্জর নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা করল। এদিকে আরো কয়েকজন হিন্দু সৈন্য চুপি চুপি নদীর তীরবর্তী তাঁবুর দিকে অগ্রসর হলো। পাহারাদারদের দু’জন তখন তাবুতে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হিন্দু ঘাতকরা পা টিপে টিপে তাবুতে ঢুকে অতর্কিতে তাদের বুকে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিলো। মুসলিম সৈন্য দুজন প্রতিরোধের কোন অবকাশই পেল না।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই শত্রু সেনাদের খঞ্জরাঘাতে নিহত হলো তারা। পাহারাদারদের হত্যার পর বিজয় রায়ের সৈন্যরা নদীতীরে জড় হয়ে সর্বশেষ মিনজানিক বোঝাই নৌকাটির বাধন খুলে সেটিকে বেয়ে কিছুটা ভাটিতে নদীর অপর পাড়ে নিয়ে এলো। এ পাড়ে প্রশিক্ষিত দু’টি জঙ্গী হাতিসহ কয়েজন তাদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাই মিলে মিনজানিক বোঝাই নৌকাটিকে টেনে কিছুটা ডাঙ্গায় উঠিয়ে মিনজানিকটি রশি দিয়ে হাতির সাথে বেঁধে দিলো। জঙ্গী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতিগুলো দু’টি মিনজানিক দ্রুত টেনে নিয়ে রাতারাতি এতোদূর অগ্রসর হলো যে তাদের আর মুসলিম বাহিনী ধরতে পারল না।
ধৃত হিন্দু সৈন্যরা বিন কাসিমকে জানালো, রাজা দাহিরের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মিনজানিকটি রাজধানী উরুটে পৌছে দেয়ার জন্য কিন্তু বিজয় রায় গোয়ার্তুমী করে মুসলিম সৈন্যদের অবরোধ ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য দুর্গপ্রাচীরের ওপরে মিনজানিক স্থাপন করে। সে গর্ব ভরে বলছিল, আরব বাহিনী যদি সিস্তান দখল করতে আসে তাহলে এই মিনজানিক দিয়েই সে আরবদের পরাস্ত করে দেবে। কিন্তু দেখা
গেল, আরব সৈন্যরা এসে মাত্র দুটি পাথর নিক্ষেপ করেই সেই মিনজানিক বেকার করে ফেলল। বিজয় রায় হয়তো জানতোই না, রাজা দাহির কেন এ মিনজানিকের প্রতি এতোটা আগ্রহী ছিলেন। রাজা তার কারিগরদেরকে এটি দেখিয়ে তাদের দিয়ে অনুরূপ বহু সংখ্যক মিনজানিক তৈরি করিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন। একথাও জানা গেছে যে, দাহির যেসব দেশত্যাগী আরবকে মাকরানে আশ্রয় দিয়েছিল, তাদের ডেকে এনে জানতে চেয়েছিল, এই আরবদের মধ্যে কেউ মিনজানিক তৈরির কাজ জানে কি-না। কিন্তু আশ্রিত মুসলমানদের সর্দার আলাফী রাজাকে জানান, তাদের এখানে মিনজানিক তৈরি জানে এমন কেউ নেই।
অথচ বাস্তবে আলাফীর সাথীদের মধ্যে দু’জন মিনজানিক তৈরির কাজে পারদর্শি ছিল। কিন্তু তারা এ কাজ জানে এমনটি স্বীকার করেনি, কারণ তারা জানতো, স্বীকার করলে তাদেরকে ব্যবহার করে রাজা দাহির তাদেরই জ্ঞাতি, ও জাতি ভাইদের বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করবে। বিন কাসিম মিনজানিক চোরাই কাজে জড়িত দলনেতাসহ সবাইকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন।