হিন্দুস্থানি এক নগ্নগাত্র জাদুকর এসেছে সম্রাটকে ভোজবাজি দেখাতে। তার কোমরের কাছে মালকোঁচা দিয়ে পরা নোংরা ধুতি। মাথায় বিশাল সাদা পাগড়ি। পাগড়ি পরিষ্কার, ঝকঝক করছে। সে কৃশকায়, গাত্রবর্ণ পাতিলের তলার মতো কালো। ভোজওয়ালার সঙ্গে তার কন্যা। বয়স চার-পাচ। সেও নগ্নগাত্র। লাল টুকটুকে প্যান্ট পরেছে। মেয়েটির চোখ মায়াকাড়া। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে। একবারের জন্যেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে না। তার দৃষ্টিতে ভয় এবং বিস্ময়।
সম্রাট বসেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। পরিবারের বাইরে আছে অম্বা, কিছু পরিচারিকা এবং একদল খোজা প্রহরী।
সম্রাট বললেন, খেলা দেখাও।
বাজিকর সম্রাটকে কুর্নিশ করল। এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল তার দুই হাতই খালি, এখন তার ডান হাতে একটা আমের আঁটি দেখা গেল। সে আমের আঁটি মাটিতে পুঁতে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাটি ফুড়ে আমগাছ বের হতে শুরু করল। সম্রাট বললেন, সোবাহানাল্লাহ।
বাজিকর গাছের উপর দিয়ে একবার হাত বুলিয়ে নিতেই দেখা গেল। গাছে তিনটা পাকা আম ঝুলছে। বাজিকর আম তিনটা ছিড়ে সম্রাটের সামনে রেখে আবারও কুর্নিশ করল। সম্রাট বললেন, মারহাবা। বলেই বিস্ময়ে অভিভূত হলেন-যেখানে আমগাছ ছিল সেখানে গাছ নেই। কুণ্ডলী পাকিয়ে বিষধর গোখরো সাপ বসে আছে। সাপ ফণা তুলেছে। ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে।
মহিলারা অফুট শব্দ করে নড়েচড়ে বসলেন। জাদুকর মাথার পাগড়ি খুলে সাপ ঢেকে দিল। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিতেই দেখা গেল পাগড়ির ভেতর কোনো সাপ নেই। সাপের পরম শত্রু লালচোখা বেজি বসে আছে। এবার সবাই একসঙ্গে বলল, মারহাবা।
সম্রাট বললেন, তুমি কি আমার সঙ্গে দিল্লী যাবে? আমি তোমাকে জয়গির দেব। বিশেষ বিশেষ উৎসবে তুমি তোমার খেলা দেখাবে। (সম্রাট কথা বললেন দোভাষীর মাধ্যমে, তিনি হিন্দুস্থানি জানেন না।)
জাদুকর বলল, না।
না কেন?
নদী অতিক্রম করা আমার জন্যে নিষেধ। নিষেধ কে করেছেন?
আমার গুরু।
জাদুকর গুরুর উদ্দেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত জোড় করল। সম্রাট বললেন, জাদু দেখানোর সময় তুমি মন্ত্রপাঠ করেছ। মন্ত্র বলে কি কিছু আছে?
আছে।
সবচেয়ে কঠিন মন্ত্র কোনটি?
শূন্যে ভাসা মন্ত্র।
এই মন্ত্র পড়লে শূন্যে ভাসা যায়।
তুমি শূন্যে ভাসতে পার?
আমি পারি না, আমার গুরু পারেন।
জাদুকর আবারও গুরুর উদ্দেশে দুই হাত জোড় করল। তুমি কী পার? আমি পানির উপর হাঁটতে পারি। তবে নদীর পানি না, দিঘির শান্ত পানি। নদীর পানির উপর দিয়ে হাঁটা আমার গুরুর নিষেধ।
তুমি কি পানির উপর দিয়ে হাঁটার জাদু আমাকে দেখাতে পারবে?
পারব।
চিকিৎসক এবং সম্রাট এই দু’জনের কাছে সর্ব অবস্থায় সত্যি কথা বলতে হয়। তুমি সত্যি করে বলো, পানির উপর দিয়ে হাঁটার কি কোনো কৌশল আছে, না শুধুই মন্ত্র?
কৌশল আছে।
তুমি কি এই কৌশল আমাকে শিখাবে?
সম্রাট রাজ্য শাসন করবেন। ভোজবাজি কেন শিখবেন?
তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পার। আমি তোমার ভোজবাজি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তুমি আমার কাছে কী চাও বলো।
আমি ভগবান ছাড়া কারও কাছে কিছু চাই না। আপনি আমার খেলা দেখে খুশি হয়েছেন এতেই আমি খুশি। সম্রাটকে খুশি করতে পারা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি ভাগ্যবান।
সম্রাট তার কন্যা আকিকা বেগমকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। আকিকা ছুটে এল।
ভোজবাজির খেলা কেমন লাগল মা?
খুব ভালো লাগল বাবা।
এই জাদুকর আমাকে খুশি করেছে, আমি তাকে খুশি করতে চাই। কী উপহার পেলে সে খুশি এবং বিস্মিত হবে?
বাবা, আপনি তাকে একটা হাতি উপহার দিন।
হাতি?
হ্যাঁ হাতি। উপহার হিসেবে সে হাতি পাবে এটা কখনো কল্পনা করে নি। আপনার উপহার তার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবে।
তোমার সঙ্গে যে হিন্দুস্থানি মেয়েটি আছে সে কেমন আছে?
খুব ভালো আছে। আনন্দে আছে।
তার নাম যেন কী?
তার নাম অম্বা।
সে কি তার আত্মীয়স্বজনের কাছে ফেরত যেতে চায়?
না। আত্মীয়স্বজনরা তাকে ফেরত নেবে না। সে বাকি জীবন আমার সঙ্গে থাকবে। বাবা, আপনি কি জানেন আমরা দু’জন এক বিছানায় ঘুমাই?
জানতাম না। এখন জানলাম।
আপনি কি রাগ করেছেন?
আমি আমার আদরের আকিকা বেগমের উপর কখনো রাগ করব না।
আমি যদি কোনো অন্যায় করি তারপরেও না?
তারপরেও না। তুমি কি কোনো অন্যায় করেছ?
করেছি। বড় অন্যায় করেছি।
অন্যায়টা কি বলবো?
না।
আচ্ছা যাও। তোমার বড় অন্যায় ক্ষমা করা হলো।
সম্রাটের নির্দেশে হিন্দুস্থানি জাদুকরকে একটা হাতি উপহার দেওয়া হলো। হতভম্ব জাদুকর এবং তার মেয়েকে হাতির পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হলো। বাচ্চা মেয়েটি আতঙ্কে অস্থির হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকিল। (*হাতির পিঠে হিন্দুস্থানি জাদুকর এবং তার কন্যার মোঘল রীতিতে আঁকা একটি পেইন্টিং ব্রিটিশ জাদুঘরে রক্ষিত আছে।)
শের খাঁ তার সমরবিশারদদের নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেছেন। সমরবিশারদদের চারজনের মধ্যে আছে তার দুই পুত্র জালাল খা, সাইফ খাঁ এবং দুই সেনাপতি।
শের খাঁ বললেন, যুদ্ধ শুরুর আগে শত্রুর সবল এবং দুর্বল দিকগুলি খুঁজে বের করতে হয়। সম্রাট হুমায়ূনের সবল এবং দুর্বল দিক কী?
জালাল খা বললেন, সম্রাট হুমায়ূন ভীরু মানুষ, এটাই তার দুর্বল দিক। তার কামানবাহিনী হলো তার সবল দিক।
পুত্র! তুমি ভুল বললে। হুমায়ূন অসম্ভব সাহসী একজন মানুষ। আমোদপ্রিয়, তবে সাহসী। আর তাঁর বিশাল কামানবাহিনী তাঁর সবচেয়ে দুর্বল দিক।
কেন? কামানবহর নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না। এত কামান কীভাবে দ্রুত টেনে নেবে? কামানবহরকে স্থির হয়ে এক জায়গায় থাকতে হয়। বিশাল কামানবহর নিয়ে আক্রমণ করা যায় না। শক্ৰ প্রতিরোধ করা যায়।
জালাল খাঁ বললেন, আমি এইভাবে ভাবি নি। আপনার কথা সত্য। তবে সম্রাট হুমায়ূন যে কাপুরুষ এই কথাটি সত্য।
তুমি মনে হয় পানিপথের যুদ্ধের কথা ভুলে গেছ। পানিপথে সম্রাট বাবরের ডানবাহুর দায়িত্বে ছিলেন হুমায়ূন। তিনি অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়েছেন। বাহাদুর শাহ’র হাত থেকে তিনি চিতোর কীভাবে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাও সম্ভবত তোমার মনে নেই। সম্রাট হুমায়ূন সাহসী, কিন্তু খেয়ালি মানুষ। তার চরিত্রের খেয়ালি অংশই হলো তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আমরা তাঁর এই দুর্বলতাকেই ব্যবহার করব।
কীভাবে?
শের খাঁ শান্ত গলায় বললেন, নানান খেয়ালে তিনি যেন সময় পার করতে পারেন আমরা সেই চেষ্টা করব। জাদুবিদ্যার একটা প্রাচীন বই জোগাড় করেছি। সেই বই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বইটি প্রাচীন কোনো অপ্রচলিত ভাষায় লেখা। সম্রাটের সময় যাবে বইটির ভাষা উদ্ধার করতে। আমি ত্রিপুরা রাজ্য থেকে একটা হাতির বাচ্চা জোগাড় করেছি। হাতির বাচ্চার বিশেষত্ব হচ্ছে—প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সে দুটা শুঁড় নিয়ে জন্মেছে। সম্রাট দুই ওঁড়ের হাতির বাচ্চা নিয়েও সময় কাটাবেন। আমি কীভাবে শক্তি সংগ্ৰহ করছি তা তার চোখ এড়িয়ে যাবে।
সাইফ খাঁ বললেন, সম্রাট তো একা না। তার পরামর্শদাতারা আছেন। আমীররা আছেন, অতি বিচক্ষণ সেনাপতি বৈরাম খাঁ আছেন। এঁদের সবার চোখ আমরা কীভাবে এড়াব?
শের খাঁ অসহিষ্ণু গলায় বললেন, সম্রাট চোখ বুজলে তাঁর অনুসারীদেরও চোখ বুজতে হয় এটাই নিয়ম। সম্রাট এবং তাঁর অনুসারীদের বিভ্রান্ত করার জন্যে আমি কিছু কূটকৌশলের ব্যবস্থাও করেছি।
কী রকম?
আমি অতি দুর্বল একদল যোদ্ধাকে পাঠাব সম্রাটকে আক্রমণ করার জন্যে। তারা পরাজিত হবে। সম্রাটের ধারণা হবে শের খাঁ’র বাহিনী দুর্বল।
শের খাঁ’র প্রধান সেনাপতি ওসমান বললেন, কৌশলটা ভালো।
সম্রাটের কাছে আমি একটা পত্র পাঠাচ্ছি। এই পত্রেও আমার দুর্বলতা প্ৰকাশ পাবে।
জালাল খাঁ বললেন, কী পত্র পাঠাচ্ছেন আমরা কি শুনতে পারি? হ্যাঁ। পত্র আমি পড়ে শোনাচ্ছি।
হিন্দুস্থানের মালিক,
মহাপরাক্রমশালী সিংহহাদয় জ্ঞানতাপস মহান মোঘল সম্রাট বাদশাহ নামদার হুমায়ূন।
অধীন শের খাঁ’র বিনম সালাম গ্ৰহণ করুন।
আসসালামু আলায়কুম।
নিবেদন এই যে, বাদশাহর সম্মানে আমি দুটি সামান্য উপহার পাঠালাম।
দুই শুড়বিশিষ্ট একটি হস্তীশাবক, নাম হরিমতি। এইসঙ্গে জাদুবিদ্যার একটি প্রাচীন অপ্রচলিত ভাষায় রচিত গ্ৰন্থ। জাদুবিদ্যার প্রতি আপনার আগ্রহের কথা জেনেই এমন ক্ষুদ্র উপহার পাঠানোর সাহস করছি।
এখন আপনার প্রতি আমার সামান্য নিবেদন। অধীনের এই নিবেদন আপনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন কি না তা আপনার বিবেচনা। মাঝে মাঝে বৃহৎবাপু হন্তীকেও সামান্য মুষিকের কথা শ্রবণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
চুনার দুর্গের পতনের পর আমার দুই বীরপুত্ৰ জালাল খাঁ এবং সাইফ খাঁ মানসিকভাবে বিপর্যন্ত। তারা প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। যে-কোনোদিন আমার এই দুই পুত্র আপনার সেনাবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এর ফলাফল শুভ না হওয়ার কথা। আমার এই দুই পুত্র অসীম সাহসী। প্রতিশোধ গ্রহণের উত্তেজনায় এই সাহস বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে।
আমার পুত্রদের কাছে মোঘল বাহিনীর পরাজয় হলে হিন্দুস্থানের মালিক সম্রাট হুমায়ূনের জন্যে তা বিরাট কলঙ্ক। আমি সম্রাটকে এই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে দিল্লী প্রস্থানের কথা চিন্তাও করি না। সম্রাটের কলঙ্ক তার দীন সেবক শের খাঁ’র কলঙ্ক।
এখন আমার অনুরোধ (এবং উপদেশ), আপনি অতি দ্রুত দিল্লীর দিকে যাত্রা করুন। আমি আমার ধৃষ্টতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, পুত্রদের উপর আমার তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনি নিজে একজন মহাবীর, আপনি ভালোই জানেন বীররা নিয়ন্ত্রণ পছন্দ করে না।
বিনীত
সম্রাটের পদধূলিসম
শের খাঁ
শের খাঁ পত্র পাঠ শেষ করে দুই পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের কিছু বলার আছে?
জালাল খাঁ বললেন, আমরা দুই ভাইয়ের যে-কোনো একজন মোঘলদের সঙ্গে নকল যুদ্ধ করতে যাব এবং ইচ্ছাকৃতভাবে পরাজিত হব?
হ্যাঁ।
স্বেচ্ছা-পরাজয়ের ফলাফল হলো মোঘলদের হাতে বন্দি হওয়া। সে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। মোঘলদের হতে বন্দি হওয়া মানে হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ।
এই কথাও ঠিক। বড় মঙ্গলের স্বার্থে ক্ষুদ্ৰ অমঙ্গল গ্রহণ করতে হয়।
সাইফ খাঁ বললেন, নকল যুদ্ধ করতে কে যাবে?
শের খাঁ বললেন, তুমি যাবে। মূল যুদ্ধে জালাল খাঁকে আমার প্রয়োজন। সে তোমার চেয়ে অনেকগুণ বিচক্ষণ যোদ্ধা।
সাইফ খাঁ বললেন, কবে যুদ্ধে যাব?
সম্রাট যেদিন এই পত্ৰ পাবেন তার সাত দিন পর।
প্রধান সেনাপতি ওসমান বললেন, আপনার দুই পুত্রের কাউকেই পাঠানোর প্রয়োজন নেই। আপনার সেনাপতিদের একজন যাবে।
শের খাঁ বললেন, তাতে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। তবে সাইফ খা’র ভয়ের কোনো কারণ নেই। সে যদি ধরাও পড়ে তার পরিচয় পাওয়ার পর হুমায়ূন তাকে আমার কাছে সসম্মানে ফেরত পাঠাবেন। সম্রাট হুমায়ূনের চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে তার করুণা এবং ক্ষমা। আমরা তাঁর এই দুর্বলতা ব্যবহার করব।
শের খাঁ’র উপহার পেয়ে সম্রাট হুমায়ূন উত্তেজিত। জাদুর প্রাচীন বইটিকে স্বর্ণখনি বলে মনে হচ্ছে। তিনি ভাষা পড়তে পারছেন না, তবে বইয়ে অনেক ছবি। ছবিগুলি বইটির বিশেষত্ব বলে দিচ্ছে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা মানুষের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করা। তার পরের ছবিতে মুণ্ডু শরীরের সঙ্গে লাগানো। একটা ছবিতে মানুষের শরীরের সঙ্গে বিড়ালের মাথা লাগানো।
সম্রাট হিন্দুস্থানের বিভিন্ন ভাষার পণ্ডিতদের জড়ো করার নির্দেশ জারি করেছেন। তাদের কেউ-না-কেউ গ্রন্থের পাঠোদ্ধার করতে পারবে।
দুই ওঁড়ের হস্তীশাবক দেখেও তিনি উত্তেজিত। প্রকৃতির বিশেষ খেয়ালে এরকম একটি হস্তীশাবকের জন্ম হয়েছে, নাকি এটি বিশেষ কোনো প্ৰজাতির? বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।
হরিমতি এখন আছে আকিকা বেগমের তত্ত্বাবধানে। আকিকা। বেগম এবং তার বান্ধবী অম্বা হরিমতিকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আকিকা বেগম হন্তীশাবকের হিন্দু নাম বদলে মুসলমান নাম রাখতে চাচ্ছে। অনেকগুলি নাম সে তার কোরানপাঠ শিক্ষক ওস্তাদের সাহায্যে আলাদা করেছে। কোনোটিই পছন্দ হচ্ছে না। যেমন
নাম—অর্থ
শাহানা—রানী
লাবিবা—জ্ঞানী
আনিসা—কুমারী
সাইয়ারা–রাজকুমারী
সাইয়ারা নাম তার কিছুটা পছন্দ হচ্ছে। কিন্তু সে চাচ্ছে তার নামের প্রথম অক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখতে। আনিসা নাম সেই অর্থে ঠিক আছে। ‘আ’ দিয়ে শুরু। কিন্তু নামের অর্থ (কুমারী) পছন্দ হচ্ছে না। হরিমতি নিশ্চয়ই সারা জীবন কুমারী থাকবে না।
হরিমতিকে নিয়ে সম্রাটের অন্য পরিকল্পনা আছে। তিনি এই অদ্ভুত হস্তী শাবক পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্পকে উপহার হিসেবে দিতে চান। পারস্য-সম্রাটের জীবজন্তুর প্রতি প্রবল আগ্রহ। তাঁর চিড়িয়াখানা সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে আনা জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ। শাহ এই অদ্ভুত উপহার পেয়ে অবশ্যই আনন্দে আত্মহারা হবেন। পারস্যের সঙ্গে তখন সুসম্পর্ক হবে। এর ফলাফল হবে শুভ।
শুক্রবার জুমার নামাজ শেষ করে সম্রাট বিশ্রামে গেছেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তিনি দুপুরের খাবার খাবেন। ঘুমে সম্রাটের চোখ লেগে আসছে, তখনই তাকে ডেকে তোলা হলো। তাঁকে দুঃসংবাদ দেওয়া হলো। শের খাঁ’র পুত্র সাইফ খাঁ প্ৰায় এক হাজার অশ্বারোহী নিয়ে মোঘল শিবির আক্রমণ করেছে। যুদ্ধের জন্যে মোঘলদের প্রস্তুতি ছিল না বলে অল্পকিছু মোঘল সৈন্য নিহত হয়েছে। সাইফ খাঁ সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়েছে। তাকে বন্দি করা হয়েছে। সাইফ খাঁ’র সঙ্গের সৈন্যদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছে।
সাইফ খা-কে সম্রাটের সামনে আনা হলো। সম্রাট দেখলেন নিতান্তই অল্পবয়সী অতি সুপুরুষ এক যুবক।
মোঘলবাহিনীকে আক্রমণ করেছ। এটা কি তোমার নিবুদ্ধিতা নাকি কোনো কৌশল?
সাইফ খাঁ মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বিশাল বাহিনী নিয়েই এসেছিলাম। বেশিরভাগই ছিল ভাড়াটে সৈন্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্র তারা পালিয়ে গেছে।
বন্দি শক্রকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে মারার রেওয়াজ মোঘলদের আছে, এই তথ্য তুমি জানো?
জানি।
তুমি কি আমার কাছে প্ৰাণভিক্ষা চাও?
সাইফ খা’ বললেন, আপনার করুণা এবং দয়ার কথা আমি জানি। আপনি যে আমার প্রাণ ভিক্ষা দেবেন। সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আমি এখন দুপুরের খাবার খাব। তুমি আমার সঙ্গে খেতে বসে। খাওয়ার পর তোমার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আচ্ছা তুমি যেন শান্তিমতো খেতে পার আমি সেই ব্যবস্থা করছি। তোমাকে ক্ষমা করা হলো। তুমি শের খাঁ’র কাছে ফিরে যাবে এবং তাকে বলবে তার পাঠানো উপহার আমার পছন্দ হয়েছে।
আমি বাবাকে এই সংবাদ দেব।
সম্রাট বললেন, আমি তোমার পিতার সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে দিল্লী ফিরে যাব।
এই খবরও বাবাকে জানাব। তিনি খুশি হবেন।
সম্রাট হুমায়ূন সাইফ খাঁ-কে ডানপাশে বসালেন। অতি সম্মানিতজনকেই এমন সম্মান দেখানো হয়।