০৭. হযরত দাউদ ও ইয়াহয়া (আ)-এর মধ্যবর্তী ইসরাঈল বংশীয় নবীগণের ইতিহাস

হযরত দাউদ ও ইয়াহয়া (আ)-এর মধ্যবর্তী ইসরাঈল বংশীয় নবীগণের ইতিহাস

উপরোক্ত সময়ের মধ্যে আগমনকারী নবীদের মধ্যে হযরত শাইয়া ইব্‌ন আমসিয়া (L–>-1) অন্যতম (বাইবেলের ভাষায় আমোসোর পুত্র যিশাইয়) মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাকের মতে, তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল যাকারিয়া ও ইয়াহিয়া (আ)-এর পূর্বে। তিনি সেই সব নবীর একজন, যারা হযরত ঈসা ও মুহাম্মদ (সা) এর আগমনের সুসংবাদ প্রচার করেছিলেন। ঐ সময়ে বায়তুল মুকাদাসে বনী ইসরাঈলের শাসক ছিলেন রাজা হিযকিয়া। যে কোন সংস্কার ও সংশোধনমূলক কাজে তিনি নবী শাইয়ার আদেশ-নিষেধ মেনে চলতেন। বনী ইসরাঈলের মধ্যে তখন ব্যাপক হারে দুনীতি, পাপাচার ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তাদের রাজা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর পায়ে একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়। এ সুযোগে ব্যাবিলনের রাজা সানহারীব বায়তুল মুকাদ্দাস আক্রমণে উদ্যোগী হয়। ইব্‌ন ইসহাক (র) বলেছেন, এ অভিযানে ছয় লক্ষ পতাকাবাহী সৈন্য অংশগ্রহণ করে। তাতে লোকজন অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। রাজা হযরত শাইয়ার নিকট জিজ্ঞেস করেন যে, সানহারীব ও তার সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কী ওহী প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেন, তাদের সম্পর্কে আমার নিকট কোন প্রকার ওহী আসেনি। কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর হযরত শাইয়ার নিকট এই মর্মে ওহী আসে যে, অল্প দিনের মধ্যে রাজার মৃত্যু হবে। সুতরাং তিনি যেন তাঁর পছন্দমত কাউকে স্থলাভিষিক্ত করেন। নবীর মাধ্যমে এ সংবাদ পেয়ে রাজা কিবলামুখী হয়ে সালাত ও তাসবীহ পাঠ করে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে ধৈর্যের সাথে কেঁদে কেঁদে এই দোয়া করেন :

হে আল্লাহ, মহা প্রতিপালক, রাজাধিরাজ, দয়াময়, পরম দয়ালু! হে ঐ সত্তা, যাকে তন্দ্ৰা বা নিদ্ৰা স্পর্শ করে না। আমার জ্ঞান, আমার কার্যাবলী ও বনী ইসরাঈলদের উপর আমার ন্যায়-বিচারের দিকে লক্ষ্য করে আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। আমার এ যা কিছু কৃতিত্ত্ব,

সবই আপনার করুণার দান। এ সম্পর্কে আপনি সর্বাধিক অবগত। আমার ভিতর ও বাহির সব আপনাতে ন্যস্ত।

আল্লাহ রাজার দেয়া কবুল করে তাঁর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন এবং শাইয়ার (যীশাইও) নিকট ওহীর মাধ্যমে সুসংবাদ দেন যে, তার কান্নাতে আল্লাহ সদয় হযেছেন। তিনি তার আয়ু পনের বছর বৃদ্ধি করেছেন এবং তাঁর শত্রু সানহারীবের কবল থেকে তাঁকে রক্ষা করেছেন। নবীর নিকট থেকে এ সুসংবাদ শুনে রাজার অন্তর থেকে ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তা দূরীভূত হয় এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে সিজদাবনত হয়ে তিনি নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করেন :

و الباطن وانت ترى حم و تستجيب دعوة المضطرين . হে আল্লাহ! আপনি সেই মহান সত্তা, আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নেন; যাকে ইচ্ছা মর্যাদা দান করেন, যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন। দৃশ্য-অদৃশ্য যাবতীয় বিষয়ে আপনি সম্যক অবগত। আপনি আদি ও অন্ত এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য। বিপদগ্ৰস্তাদের আহবানে আপনিই সাড়া দেন ও অনুগ্রহ করেন।

সিজদা শেষ হলে আল্লাহ শাইয়ার নিকট ওহী প্রেরণ করেন এবং রাজাকে এ কথা জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন ডুমুরের রস পায়ের ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেন, তাতে তিনি আরোগ্য লাভ করবেন। রাজা এ নির্দেশ পালন করেন এবং আরোগ্য লাভ করেন। এরপর আল্লাহ সানহারীবের সৈন্য-বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। ফলে সানহারীব ও তার পাঁচজন সঙ্গী ব্যতীত তার গোটা সৈন্যবাহিনী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন বুখত নসর।*

বনী ইসরাঈলের রাজা লোক পাঠিয়ে এদেরকে ধরে এনে বেড়ি পরিয়ে সত্তর দিন পর্যন্ত শহরের অলি-গলিতে ঘুরিয়ে লাঞ্ছিত করেন। প্রত্যহ এদের প্রতি জনকে মাত্র দুটি করে যবের রুটি খেতে দেয়া হতো। এরপর তাদেরকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। আল্লাহ তখন শাইয়ার নিকট ওহী প্রেরণ করেন। তিনি রাজাকে এদের ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন, যাতে এরা আপন সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিজেদের শাস্তি ও লাঞ্ছনা ভোগের বিবরণ শোনাতে পারে।

বিবরণ দেয়। প্রতি উত্তরে গণক ও যাদুকররা বলল, আমরা পূর্বেই আপনাকে ইস্রাঈলীদের প্রতিপালক ও নবীগণ সম্পর্কে অবহিত করেছিলাম; কিন্তু আপনি আমাদের কথায় কান দেননি। এরা এমন একটি জাতি, যাদের প্রতিপালকের মুকাবিলা করার ক্ষমতা কারও নেই। এভাবে সানহারীবের পরিণতি তাই হল, যে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্বেই তাদেরকে সাবধান করেছিলেন। এ ঘটনার সাত বছর পর সানহারীবের মৃত্যু হয়। ইব্‌ন ইসহাক বলেন, বাদশাহ হিযকিয়ার মৃত্যুর পর বনী ইসরাঈলের মধ্যে পাপ প্রবণতা, অপরাধ, বিশৃংখলা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। হযরত শাইয়া তখন আল্লাহর প্রত্যাদেশ পেয়ে বনী ইসরাঈলের লোকদেরকে

* টীকা – একেই নেবুচাদ নেযার বা নেবুকাদ নেযার বলা হয়ে থাকে।

আহবান করলেন এবং আল্লাহর আদেশ পালনের জন্যে উপদেশ দান করলেন। নবী তাদেরকে সতর্ক করেছিলেন যে, আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করলে ও তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলে তাদের উপর শাস্তি অবধারিত। হযরত শাইয়ার বক্তব্য শেষ হলে উপস্থিত জনগণ তাঁকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল এবং হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাঁর পশ্চাতে ধাওয়া করল। শাইয়া (আ) আত্মরক্ষার জন্যে সেখান থেকে পালিয়ে যান। এমন সময় তিনি সম্মুখে একটি বৃক্ষ দেখতে পান। বৃক্ষটি নবীকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষার জন্যে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তিনি তাতে প্রবেশ করেন এবং বৃক্ষের ফাটল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শয়তান তার কাপড় টেনে ধরায় তার আঁচল বাইরে থেকে যায়। ইতিমধ্যে শত্রুরা সেখানে এসে উপস্থিত হয়। তারা বৃক্ষের মধ্যে কাপড় আটকা দেখে করাত দ্বারা বৃক্ষটি দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। ফলে হযরত শাইয়ার দেহও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়–ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি। রাজিউন।

লাবী* ইব্‌ন ইয়াকুবের বংশধর:হযরত আরমিয়া ইব্‌ন হালকিয়া

যাহহাক (র) ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, আরমিয়া ইব্‌ন হালকিয়া হচ্ছেন হযরত খিযির (আ)। কিন্তু এ বর্ণনাটি গরীব। পর্যায়ের এবং তা বিশুদ্ধ নয়। ইব্‌ন আসাকির কোন কোন গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, দামিশকে হযরত ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়া (আ)-এর

রক্ত! তুমি তো বহু মানুষকে পরীক্ষায় ফেলেছি, এখন থাম। তখন রক্ত থেমে যায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। আবু বকর ইব্‌ন আবিদ-দুনয়া……আবদুল্লাহ ইব্‌ন আবদুর রহমান থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আরমিয়া একদা আল্লাহর নিকট জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনার নিকট প্রিয়তম বান্দা কে? উত্তরে আল্লাহ বলেছিলেন, সৃষ্টিকুলের পরিবর্তে আমাকে অধিক স্মরণ করে নশ্বরের ধোকায় সে পড়ে না এবং দুনিয়ার স্থায়ী থাকার বাসনাও করে না। পার্থিব জীবনের সুখ শান্তিকে সে উপেক্ষা করে চলে এবং বিলাস-সামগ্ৰী থেকে বঞ্চিত হলে খুশী হয়। এ জাতীয় বান্দাদেরকে আমি আমার নৈকট্য দান করব এবং কল্পনাতীতভাবে পুরস্কৃত

করব।

বায়তুল মুকাদদাসের ধ্বংস এ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী :

* টীকা বাইবেলে তাকে লেবী বলা হয়েছে।

আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম ও তাকে করেছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্যে পথ নির্দেশক। আমি আদেশ করেছিলাম তোমরা আমাকে ব্যতীত অপর কাউকেও কর্মবিধায়করূপে গ্রহণ করো না। হে তাদের বংশধর! যাদেরকে আমি নূহের সাথে আরোহণ করিয়েছিলাম, সে তো ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা। এবং আমি কিতাবে প্রত্যাদেশ দ্বারা বনী ইসরাঈলকে জানিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই তোমরা পৃথিবীতে দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকার-স্ফীত হবে। তারপর এ দুয়ের প্রথমটির নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হল, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম আমার বান্দাদেরকে, যুদ্ধে অতিশয় শক্তিশালী; তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সমস্ত ধ্বংস করেছিল। আর প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। তারপর আমি তোমাদেরকে পুনরায় তাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করলাম, তোমাদেরকে ধন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করলাম ও সংখ্যায়। গরিষ্ঠ করলাম। তোমরা সৎকর্ম করলে সৎকর্ম নিজেদের জন্য করবে এবং মন্দ কর্ম করলে তাও করবে নিজেদের জন্যে। তারপর পরবর্তী নির্ধারিত কাল উপস্থিত হলে আমি আমার বান্দাদেরকে প্রেরণ করলাম তোমাদের মুখমণ্ডল কালিমাচ্ছন্ন করবার জন্যে, প্ৰথমবার তারা যেভাবে মসজিদে প্ৰবেশ করেছিল পুনরায় সেভাবেই তাতে প্ৰবেশ করবার জন্যে এবং তারা যা অধিকার করেছিল তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করবার জন্যে। সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি দয়া করবেন; কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের পূর্ব আচরণের পুনরাবৃত্তি কর তবে আমিও পুনরাবৃত্তি করব। জাহান্নামকে আমি করেছি। কাফিরদের জন্যে কারাগার। (১৭ ইসরা : ২-৮)

ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ বলেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে যখন অনাচার ও পাপবৃত্তি সর্বগ্রাসীরূপ লাভ করে তখন তাদের নবী আরমিয়ার নিকট আল্লাহ এই মর্মে ওহী, প্রেরণ করেন যে, তুমি তোমার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে জানাও যে, তাদের হৃদয় আছে; কিন্তু তারা উপলব্ধি করে না, চক্ষু আছে কিন্তু দেখে না, কান আছে শুনে না। আমি তাদের পূর্ব-পুরুষদের উত্তম কর্মসমূহ স্মরণ করেছি।–ফলে তাদের সন্তানদের উপর আমার করুণাধারা বর্ষিত হয়েছে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখ, আমার আনুগত্যের সুফল তারা কিভাবে লাভ করেছে। আমার অবাধ্য হয়ে কেউ কি সৌভাগ্যবান হয়েছে, কিংবা আমার আনুগত্য করে কি কেউ দুর্ভাগা হয়েছে? সমস্ত প্রাণীই নিজ নিজ বাসস্থানের কথা স্মরণ করে এবং সে দিকেই ফিরে যায়। আর এই সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার সেই সব আদেশ লংঘন করেছে, যা মেনে চলার কারণে আমি এদের পূর্ব পুরুষদেরকে সম্মানিত করেছিলাম। এরা ভিন্ন পথে চলে সম্মান লাভ করতে চেয়েছে। তাদের

করেছে, তাদের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা নিজেদের জ্ঞান থেকে উপকৃত হয়নি এবং তাদের শাসকরা আমার ও আমার রাসূলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে। তাদের অন্তরে লুক্কায়িত আছে গভীর ষড়যন্ত্র আর মুখে আছে মিথ্যা বুলি। আমি আমার প্রতাপ ও মর্যাদার কসম করে বলছি, আমি তাদের উপর এমন এক জাতিকে চাপিয়ে দিব, যারা বুঝবে না। এদের ভাষা, চিনবে না। এদের চেহারা, বিগলিত হবে না তাদের অন্তর এদের কান্নায়। আমি তাদের মাঝে পাঠাব। এমন এক জালিম বাদশাহ, যার সৈন্য-বাহিনীর বহর হবে মেঘমালার ন্যায়, সৈন্যদের সারিগুলোকে মনে হবে প্রশস্ত গিরিপথ, তাদের পতাকার শব্দ ধবনি শোনা যাবে শকুন পালের উড্ডয়নের ধ্বনির ন্যায়। তাদের অশ্ব বাহিনীর আক্রমণ হবে ঈগল পাখীর ছোবলের ন্যায়। তারা নগরসমূহকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করবে এবং পল্লীগুলোকে করবে বিরান। হায়, কি দুর্ভাগ্য ঈলিয়া ও তার অধিবাসীদের। হত্যা ও বন্দীত্রে লাঞ্ছনা-রশিতে তাদেরকে আবদ্ধ করা হবে। সহসাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে বিবাহ অনুষ্ঠানের আনন্দ-কোলাহল বীভৎস চিৎকার ধ্বনিতে।

অশ্বের হ্রোসা ধ্বনির স্থলে শ্রত হবে হিংস্ৰ শ্বাপদের তর্জন-গর্জন। সুরম্য ভবনাদি ঘেরা মনোরম শহর পরিণত হবে বন্য জীব-জন্তুর আবাস ভূমিতে। রাত্ৰিবেলা যে স্থান থাকত আলোর দীপ্তিতে সদা ঝলমল, সেখানে নেমে আসবে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। এদের ভাগ্যে জুটবে সম্মানের পরিবর্তে লাঞ্ছনা, ঐশ্বর্যের পরিবর্তে দাসত্ব। তাদের স্ত্রীরা সুরভিত হওয়ার স্থলে হবে ধুলি ধূসরিত। উপাধান-আয়েশের স্থলে তারা চলবে নগ্নপদ। উটের মত। তাদের দেহগুলো হবে মাটির খাদ্য, পরিণত হবে জঞ্জালে এবং সূর্যের তাপে হাডিডগুলো চকচক করবে। এগুলো ব্যতীত আরও বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দ্বারা আমি তাদেরকে নিষ্পেষিত করব। এরপর আমি আকাশকে হুকুম দিব। ফলে আকাশ লৌহস্তরে পরিণত হবে এবং যমীন বিগলিত তামায় পরিণত হবে। এমতাবস্থায় বৃষ্টি হলেও ফসল উৎপাদিত হবে না, যদি অল্প কিছু উৎপাদিত হয়ও তবে বন্য জীবজন্তুর প্রতি আমার অনুগ্রহের কারণে হবে। ফসল উৎপন্ন হওয়ার সময় আমি বৃষ্টিপাত বন্ধ রাখব এবং ফসল উঠাবার সময় বৃষ্টিপাত ঘটাবো। এ সময়ের মধ্যে সামান্য পরিমাণ ফসল উৎপাদন করতে যদি তারা সক্ষমও হয় তবে ফসল নষ্ট করার বিভিন্ন দুর্যোগ আমি চাপিয়ে দেব। সে দুর্যোগ থেকে কিছু অংশ যদি রক্ষাও পায়, তা থেকে আমি বরকত উঠিয়ে নেব। যদি তারা আমার নিকট, ফরিয়াদও করে আমি তাতে সাড়া দেব না। তারা আমার অনুগ্রহ কামনা করলেও আমি কিছুই দান করব না। তাদের কান্নাকাটিতেও আমি সদয় হব না। তাদের কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও আমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব। এটি ইব্‌ন আসাকিরের বর্ণনা।

ইসহাক ইব্‌ন বিশর. ওহাব ইব্‌ন মুনব্বিহ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ নবী আরমিয়াকে বনী ইসরাঈলের মাঝে প্রেরণ করেন। তখন তাদের পাপের মাত্রা, অপরাধ প্রবণতা চরম পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল। এমনকি বহু নবীকে তারা হত্যা করেছিল। তখন আল্লাহ বুখত নসরের অন্তরে বনী ইসরাঈলের উপর হামলা করার ইচ্ছে জাগিয়ে দেন। তাই বুখত নসর তাদেরকে আক্রমণ করার উদ্যোগ নেন। এ সময় আল্লাহ আরমিয়ার নিকট ওহী পাঠান। তিনি জানান, আমি বনী ইসরাঈলকে ধ্বংস করব; তাদের পাপের সমুচিত শাস্তি দেবো। তুমি বায়তুল মুকাদ্দাসে সংরক্ষিত শুভ্ৰ পাথরের উপর দাঁড়াও। সেখানে তোমার নিকট আমার ওহী ও নির্দেশ আসবে। আরমিয়া সেখানে গিয়ে দাড়ালেন এবং পরিধানের জামা ছিড়ে ফেললেন। আপন মাথায় ছাই মাখলেন। তারপরে সিজদায় গেলেন। সিজদায় পড়ে তিনি বলতে লাগলেন, হে আমার প্রতিপালক! কত ভাল হত যদি আমার মা আমাকে প্রসব না করতেন। কেননা। আপনি আমাকে বনী ইসরাঈলের শেষ যুগের নবী বানিয়েছেন; আর আমার কারণেই বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস হবে এবং বনী ইসরাঈল নিৰ্মল হবে। আল্লাহ তাকে বললেন, সিজদা থেকে মাথা উঠাও। তিনি মাথা উঠালেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে আমার প্রতিপালক! বনী ইসরাঈলকে পরাভূত করবে কে? আল্লাহ জানালেন, তারা এক অগ্নিপূজারী সম্প্রদায়-তারা না। আমার শাস্তির ভয় করে, না পুরস্কার কামনা করে। আরমিয়া! তুমি উঠে দাঁড়াও এবং ওহী শ্রবণ করা! আমি তোমাকে তোমার নিজের ও বনী ইসরাঈলের সংবাদ দেবো। আমি তোমাকে সৃষ্টি করার পূর্বেই তোমাকে মনোনীত করেছি। তোমার মায়ের পেটে তোমার আকৃতি দেওয়ার পূর্বেই তোমাকে পবিত্র করেছি, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বেই তোমাকে নিষ্কলুষ বানিয়েছি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বেই তোমাকে নবুওত দান করেছি, পূর্ণ যৌবনে উপনীত হওয়ার পূর্বেই তোমাকে মনোনীত করেছি এবং এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্যে তোমাকে আমি বাছাই করেছি। তুমি দেশের রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে সরল-সঠিক পথ দেখাও। এ আদেশ পেয়ে নবী রাজার সাথে মিলিত হন ও সঠিক পথ প্ৰদৰ্শন করতে থাকেন। আল্লাহর নিকট থেকে নবীর নিকট প্রয়োজনীয় ওহী আসতে থাকে।

এরপর বনী ইসরাঈলরা ক্ৰমান্বয়ে জঘন্য পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের শত্রু সানহারীব ও তার সৈন্য বাহিনীর কবল থেকে আল্লাহ তাদেরকে যে রক্ষা করেছিলেন, সে কথাও তারা বেমালুম ভুলে যায়। তখন আল্লাহ নবীকে ওহীর মাধ্যমে জানান; আমি তোমাকে যে নির্দেশ দিই তা তাদের নিকট ব্যক্ত কর। আমার অনুগ্রহের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দাও; তারা যে সব পাপাচার ও বেদতমাতে লিপ্ত হয়েছে তা তাদেরকে দেখিয়ে দাও। আরমিয়া নিবেদন করল? হে আমার প্রতিপালক! আমি দুর্বল, যদি আপনি শক্তি না দেন; আমি অক্ষম, যদি আপনি ক্ষমতা প্ৰদান না করেন; আমি ভুল করব, যদি আপনি সঠিক পথে পরিচালিত না করেন, আমি অসহায় যদি আপনি সাহায্য না করেন; আমি লাঞ্ছিত যদি আপনি ইজ্জত না দেন।

আল্লাহ তাকে জানালেন, হে আরমিয়া, তোমার কি জানা নেই যে, যাবতীয় ঘটনা আমারই ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ, সৃষ্টি ও নির্দেশ সবই আমার এখতিয়ারে। সকলের অন্তর ও জিহবা আমারই হাতে, যেমন ইচ্ছ। আমি তা পরিবর্তন করি, সুতরাং আমারই আনুগত্য কর। আমার কোন সমকক্ষ নেই। আমার নির্দেশে আসমান, যমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু অস্তিত্ব লাভ করেছে। একক সত্তা কেবল আমিই এবং সকল ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আমিই। আমার নিকট যা কিছু আছে সে সম্পর্কে আমি ব্যতীত আর কেউই অবগত নয়। আমি এমন সত্তা যে,

সমুদ্রকে সম্বোধন করে বাক্যালাপ করেছি। সে তা বুঝতেও পেরেছে। আমি তাকে নির্দেশ দিয়েছি, সে সেই নির্দেশ পালনও করেছে। আমি তাকে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সে ঐ সীমানা অতিক্রম করেনি। সে পর্বতের ন্যায় সু-উচ্চ তরঙ্গমালা উত্থিত করে। তবে যখনই আমার নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত পৌছে যায় তখনই আমার আনুগত্য ও নির্দেশ পালনাৰ্থে ভীত শংকিত হয়ে তা গুটিয়ে ফেলে। আমি তোমার সাথেই আছি। আমি যখন আছি তখন কোন কিছুই তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। তোমাকে এক গুরুত্বপূর্ণ জাতির নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের নিকট তুমি আমার বাণী পৌঁছিয়ে দাও। যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের সমপরিমাণ ছওয়াব তুমিও লাভ করবে। এতে তাদের ছওয়াব থেকে কিছুই কমানো হবে না। তুমি সম্প্রদায়ের নিকট যাও। তাদেরকে সম্বোধন করে বল, আল্লাহ তোমাদের পূর্ব-পুরুষের উত্তম গুণাবলীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তোমরা নবী রাসূলগণের বংশধর। তাদের উত্তম কার্যাবলীর কারণেই তিনি তোমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন।

লক্ষ্য কর, তোমাদের পূর্ব-পুরুষগণ আমার আনুগত্য করার কি সুফল লাভ করেছে। আর আমার অবাধ্য হয়ে তোমাদের কি পরিণতি হয়েছে? ওদেরকে জিজ্ঞেস কর, তারা কি দেখেছে কোন লোক আমার অবাধ্য হয়ে সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছে? কিংবা তারা কি জানে, কেউ আমার আনুগত্য করে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে? বনের পশুরাও যখন তাদের উত্তম বাসস্থানের কথা স্মরণ করে তখন তথায় যাওয়ার জন্যে উদগ্ৰীব হয়ে পড়ে। অথচ এই সম্প্রদায়টি অতি উৎফুল্ল চিত্তে ধ্বংসের গহবরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে যেসব গুণাবলীর জন্যে সম্মানে ভূষিত করেছিলাম। এরা সেগুলো পরিহার করে ভিন্ন পথে মর্যাদা লাভে প্রয়াসী। তাদের ধর্মযাজকরা আমার বান্দাদেরকে নিজেদের গােলাম বানিয়ে রেখেছে। আমার কিতাবের শিক্ষা উপেক্ষা করে তারা জনগণকে নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালিত করছে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে এবং আমার কর্মনীতি ও স্মরণ থেকে তাদেরকে গাফিল করে রেখেছে। এরা জনসাধারণকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ফলে তারা আমার বান্দা হয়েও তাদের আনুগত্য করছে ও তাদের নৈকট্য লাভের প্রয়াসী হচ্ছে। অথচ এ ধরনের আনুগত্য পাওয়ার হক কেবল আমারই। এভাবে আমার অবাধ্য হয়ে লোকজন ধর্মযাজকদের আনুগত্য করছে।

তাদের শাসকবৰ্গ আমার অনুগ্রহ লাভ করে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করছে। এবং আমার নীতি-কৌশলের পরিণতি থেকে নিশ্চিত নিরাপদ থাকবে বলে ধারণা করছে। পার্থিব জীবন তাদেরকে প্রতারণার ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষেপ করেছে। ফলে তারা আমার প্রেরিত কিতাবকে পরিত্যাগ করেছে। আমার সাথে কৃত প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়েছে। আমার কিতাবের মধ্যে পরিবর্তন করেছে, আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপের দুঃসাহস দেখিয়েছে। আমার পবিত্ৰ সত্তা, সুউচ্চ মর্যাদা ও মহা প্ৰতাপ-প্রতিপত্তির জন্যে আমার রাজ্যের মধ্যে কারও অংশীদারিত্ব থাকা কি কখনও যুক্তিসংগত হতে পারে? আমার নির্দেশ উপেক্ষা করে অন্যের আনুগত্য করা কি কোন মানুষের পক্ষে বাঞ্ছনীয় হতে পারে? আমার পক্ষে কি কোন বান্দাকে মানুষের পূজনীয় করা কিংবা কাউকে কোন মানুষের পূজা করার অনুমতি দেওয়া শোভা পায়? নিরঙ্কুশ আনুগত্য তো কেবল আমারই প্রাপ্য।

এদের মধ্যে আলিম-ফকীহ ও শিক্ষিত শ্রেণীর অবস্থা এই যে, তারা তাদের পার্থিব স্বার্থ ংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে পড়াশুনা করে, শাসকবর্গের অনুগত হয়ে থাকে। ফলে শাসকদল যেসব বেদ আতী কাজে লিপ্ত হয় এরা সন্তুষ্টচিত্তে তা-ই অনুসরণ করে চলে; আমার সাথে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তারা শাসকদেরকে দেয়া অঙ্গীকার রক্ষা করে। এভাবে আলিম হয়েও তারা মুখের ভূমিকা পালন করছে। আমার কিতাবের যে জ্ঞান তারা অর্জন করেছিল তা থেকে তারা কোনভাবে উপকৃত হয়নি।

অপরদিকে নবীগণের বংশধরদের অবস্থা এমন শোচনীয় পর্যায়ে পৌছেছে যে, তারা অন্য শক্তির নিকট পরাজিত, বিভিন্ন প্রকার সমস্যায় জর্জরিত। বিভ্ৰান্তিমূলক আলাপ-আলোচনায় তারা লিপ্ত, তাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে আমি যেভাবে সাহায্য ও সম্মান দান করেছি। এরাও সেইরূপ সাহায্য ও সম্মান পাওয়ার প্রত্যাশা করে। তাদের ধারণা আমার অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য অধিকারী কেবল তারাই, অন্য কেউ নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে সততা ও সৎ চিন্তা নেই। তারা স্মরণ করে না তাদের পূর্ব-পুরুষ কিভাবে ধৈর্যধারণ করেছিল এবং অন্যেরা যখন প্রতারণার জালে আবদ্ধ হচ্ছিল তখন কত দৃঢ়তার সাথে তারা আমার নির্দেশ মেনে চলেছিল, কী পরিমাণ আত্মোৎসর্গ তারা করেছিল এবং রক্ত ঝরিয়েছিল। তারা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল এবং ঈমানের দাবিকে সত্য প্রমাণিত করেছিল। ফলে আমার বিধান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়। এবং আমার দীন বিজয় লাভ করে। তাদের বদৌলতেই এ জাতিকে আমি অবকাশ দিয়েছিলাম। আশা ছিল এরা লজিত হয়ে আমার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে।

এদেরকে আমি অবকাশ দিয়েছি। তাদের ত্রুটি-বিচূতি ক্ষমা করে দিয়েছি, তাদের সংখ্যা ও আয়ু বৃদ্ধি করে দিয়েছি। তাদের কাকুতি-মিনতি কবুল করেছি–যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। ফলে আকাশ তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেছে। যমীন খাদ্য উৎপাদন করেছে, সুস্থ দেহ ও স্বচ্ছন্দ জীবন তারা উপভোগ করেছে, শক্ৰদের উপর জয়লাভ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আরও বেশি পাপাসক্ত হয়েছে। অপরাধের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং আমার নৈকট্য থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছে। এ অবস্থা আর কতদিন চলতে দেয়া যায়? এরা কি আমার সাথে উপহাস করছে, নাকি আমার সাথে ধোঁকাবাজী করছে? তারা আমার সাথে প্রতারণা করছে, নাকি স্পর্ধা দেখাচ্ছে? আমার মর্যাদার কসম, তাদের জন্যে এমন এক ভয়াবহ বিপর্যয় আমি নির্ধারণ করে রেখেছি।–যার প্রচণ্ডতায় বিজ্ঞ-জ্ঞানী লোকও উদভ্ৰান্ত হয়ে যাবে, দার্শনিকের তত্ত্বজ্ঞান ও বিবেক সম্পন্ন লোকের বিবেক-শক্তি লোপ পাবে। তাদের উপর এক প্রতাপশালী, পাষাণ-হৃদয়, নির্দয় শাসক চাপিয়ে দেব। ভয়ংকর তার চেহারা, দয়া-মায়া শূন্য তার অন্তর। আঁধার রাতের ন্যায় বিশাল সৈন্য-বাহিনী অনুগামী হবে তার। সৈন্য-বাহিনীর বৃহগুলো হবে মেঘমালার ন্যায়।

ধোয়ার ন্যায় আচ্ছাদন করে চলবে সৈন্যদের খণ্ড খণ্ড মিছিলগুলো। বাহিনীতে ব্যবহৃত পতাকার শব্দ হবে শকুনপালের উডডয়নের শব্দের মত। অশ্বারোহীদের ধাবমান গতি হবে ঈগল পাখীর বাকের ন্যায়। গতিশীল। তারা সমস্ত শহর ধ্বংস করবে, গ্রাম উজাড় করবে এবং যা-ই হাতের কাছে পাবে, তা-ই বিনাশ করে ছাড়বে। তাদের অন্তর হবে কঠিন, কোন কিছুই পরোয়া করবে না, কারও অপেক্ষা করবে না, কারও প্রতি অনুগ্রহ দেখাবে না, কোন দিকে তাকাবে না,

কারও কথা শুনবে না। সিংহের মত গর্জন করতে করতে এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ঘুরে বেড়াবে। তাদের ভয়ংকর রূপ দেখে শরীর শিউরে উঠবে। তাদের কথা শুনে জ্ঞানীর জ্ঞান লোপ পেয়ে যাবে। এমন ভাষায় কথা বলবে, যা কেউ বুঝবে না, এমন চেহারায় প্রকাশিত হবে, যা কেউ চিনবে না। আমার ইজ্জতের কসম, এরপরে আমি তাদের বাড়ি-ঘর আমার পবিত্র কিতাব থেকে বঞ্চিত করে দেব। তাদের সভা-সমিতি ও বৈঠকাদিতে কিতাবের পাঠ ও আলোচনা বন্ধ করে দেব, তাদের মসজিদগুলো ঐসব আগন্তুক ও পরিচর্যকারী থেকে শূন্য করে ফেলব, যারা অন্যের উদ্দেশ্যে এগুলোকে সুসজিত করে রাখত, এর মধ্যে শয়ন করত। পুণ্য লাভের পরিবর্তে পার্থিব স্বাৰ্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে তারা ইবাদত করত, এখানে বসে দীনের পরিপন্থী চিন্তা-গবেষণা করত এবং এ মসজিদগুলোতে বসেই আমলবিহীন শিক্ষা গ্ৰহণ করত।

তাদের অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করব।–শাসক শ্রেণীর সম্মানের পরিবর্তে লাঞ্ছনা, নিরাপত্তার পরিবর্তে ভয়-ভীতি, ঐশ্বর্যের পরিবর্তে দাবিদ্র্য, স্বচ্ছলতার পরিবর্তে অনাহার, অনাবিল সুখ-শান্তির পরিবর্তে বিভিন্ন প্রকার সংকট-সমস্যা, রেশমী পোশাকের পরিবর্তে জীর্ণশীর্ণ পশমী জামা, তেল-সুগন্ধি যুক্ত সংগীদের পরিবর্তে নিহত মানুষের লাশ এবং মাথায় রাজ-মুকুটের পরিবর্তে গলায় লোহার বেড়ি ও পায়ে শৃংখল পরিধানের দ্বারা আমি তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করব। তাদের সুরম্য অট্টালিকা ও দুর্ভেদ্য দুৰ্গকে ধ্বংসস্তুপে, নিশ্চিছদ্র গম্বুজ বিশিষ্ট শয়ন-কক্ষকে হিংস্ৰ শ্বাপদের আবাস স্থলে, অশ্ব হেসার স্থলে নেকড়ের গর্জন, প্ৰদীপের আলোর স্থলে আগুনের ধোয়া এবং কোলাহল-কলরবের স্থলে নীরব-নিস্তব্ধ পরিবেশে রূপান্তরিত করব। তাদের স্ত্রীদের হাতে চুড়ির বদলে বেড়ি, গলায় স্বর্ণ ও মুক্তার হারের বদলে লোহার শিকল, সুগন্ধি ও সুবাসিত তেলের বদলে ধুলি-বালি। কোমল বিছানায় উচু বালিশে হেলান দিয়ে থাকার বদলে বাজার-ঘাটে রাত্ৰি-দিনে ঘুরে বেড়ানোর এবং অন্দর মহলে ঘোমটা দিয়ে থাকার বদলে অনাবৃত চেহারায় খর-তাপের মধ্যে ভবঘুরে জীবন যাপনে বাধ্য করব।

এরপর আমি এদেরকে বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দিয়ে নিষ্পেষিত করব। কেউ যদি সু-উচ্চ কোন স্থানে আশ্রয় নেয়, তা হলে আমার শাস্তিও সেখানে গিয়ে পৌছবে। যে আমাকে সমীহ করবে: আমি তার প্রতি অনুগ্রহ দেখাব, আর যার দ্বারা আমার নির্দেশ পদদলিত হবে, আমি তাকে লাঞ্ছিত করব। এরপর আমার নির্দেশে আকাশ তাদের উপরে লোহার ঢাকনায় পরিণত হবে এবং মাটি গলিত তামার মত কঠিন হবে। ফলে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে না এবং মাটি থেকে কিছুই উৎপন্ন হবে না। যদি অল্প কিছু বৃষ্টি হয়ও এবং তাতে যৎসামান্য ফসলও উৎপন্ন হয় তা হলে তা নষ্ট করার উপদ্রব সৃষ্টি করব। যদি কিছু ফসল রক্ষা পেয়ে যায়। তবে তার থেকে আমি বরকত উঠিয়ে নেব। আমার নিকট প্রার্থনা করলে সাড়া দেব না, কিছু পাওয়ার আবেদন করলে দান করব না, কান্নাকাটি করলে দয়া দেখাব না, করজোড়ে অনুনয়-বিনয় করলে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখব। তারা যদি এভাবে প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের পূর্ব-পুরুষদের উপর আপনার রহমত ও কৃপা দান করেছেন এবং আমাদের উপরেও প্রথম দিকে তা অব্যাহত রেখেছেন- আমাদেরকে আপনার নৈকট্য দানের জন্যে বাছাই করেছেন, আমাদের মধ্যে বহু নবী প্রেরণ করেছেন, আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন, বায়তুল মুকাদাস মসজিদ

আমাদেরকে দিয়েছেন, আমাদেরকে শক্তিশালী করেছেন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান করেছেন। আমাদেরকে ও আমাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে শিশুকালে আপন অনুগ্রহে লালন-পালন করেছেন এবং যৌবনকালে আপন রহমত দিয়ে সব রকম ক্ষতি থেকে হেফাজত করেছেন। আমরাই আপনার অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকজন। সুতরাং আমরা যদি বিপথগামী হয়েও থাকি তবুও আপনার অনুগ্রহ আমাদের উপর অব্যাহত রাখুন, আমরা যদি বদলে গিয়েও থাকি আপনি বদলে যাবেন না, বরং আপনার অনুগ্রহ, ইহসান, কৃপা ও দান পুরোপুরি আমাদের প্রতি বর্ষণ করুন। তারা যদি ঐভাবে প্রার্থনা করে তবে আমি বলবো, আমার বান্দাদের উপরে প্রথমে আমি দয়া ও রহমত দেখিয়ে থাকি। এরপর যদি তারা আমার দাসত্ব কবুল করে নেয়, তা হলে আমি আমার দান পূর্ণ করে দেই। যদি তারা তা বৃদ্ধি করে আমিও আমার দান বৃদ্ধি করি। যদি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আমি তখন আমার দান দ্বিগুণ করে দেই। যদি তারা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বিপথগামী হয় তখন আমিও আমার কার্যধারা পরিবর্তন করি। তারা বিপথগামী হলে আমি ক্রুদ্ধ হই। আমি ক্রুদ্ধ হলে শাস্তি দান করি। আর আমার ক্রোধের সামনে কিছুই টিকে থাকতে পারে না।

কাব বর্ণনা করেন, তখন নবী আরমিয়া (আ) বললেন, হে আল্লাহ! আমি তো আপনার কৃপায় বেঁচে আছি, যা জানার তা আপনার থেকেই জািনছি। আমি দুর্বল ও অসহায়, আপনার দরবারে কথা বলা আমার সাজে না। আজকের এই দিন পর্যন্ত আপনি নিজ রহমতে আমাকে জীবিত রেখেছেন। এ আযাব ও শাস্তির ঘোষণাকে আমার চেয়ে অধিক ভয় পাওয়ার আর কেউ নেই। দীর্ঘদিন যাবত আমি এসব পাপী লোকদের মধ্যে অবস্থান করে আসছি। আমার পাশে থেকেই এরা আপনার অবাধ্য হয়ে চলেছে। আমি কোন প্ৰতিবাদ ও পরিবর্তন করতে পারিনি। এখন যদি আপনি আমাকে শাস্তি দেন, তা হলে সে শাস্তি আমার ক্রটির জন্যেই ভোগ করব; আর যদি আমাকে ক্ষমা করে দেন, তা হলে আপনার দরবারে আমার প্রত্যাশা ৷

এরপর নবী আরমিয়া (আঃ) বলেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি পবিত্র, যাবতীয় প্রশংসা আপনার; হে আমার প্রতিপালক! আপনি বরকতময় ও সুমহান। আপনি কি এ জনপদ ও পার্শ্ববতী অঞ্চল ধ্বংস করে দেবেন, এটা তো আপনার প্রেরিত অসংখ্য নবীর বাসস্থান এবং আপনার ওহীর অবতারণ স্থল। হে আমার প্রতিপালক! আপনি পবিত্র, প্রশংসার অধিকারী, হে আমার প্রতিপালক! আপনি বরকতময়, মহান। এ মসজিদ (বায়তুল মুকাদ্দাস) ধ্বংসের প্রাককালে আমার ফরিয়াদ—এ মসজিদের চতুষ্পার্শ্বে আরও বহু মসজিদ ও বাড়ি-ঘর আছে, যেগুলো আপনার যিকর ও স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। হে আমার রব! আপনি পবিত্র, প্রশংসনীয়, কল্যাণময় ও মহান, এ জাতিকে আপনি হত্যা ও শাস্তি দিতে যাচ্ছেন, এরা তো আপনার খলীল ইবরাহীম (আ)-এর বংশধর; আপনার সাথে একান্তে সংলাপকারী মূসা (আ)-এর অনুসারী এবং আপনার মনোনীত নবী দাউদ (আ)-এর সম্প্রদায়। হে আমার প্রতিপালক! ইবরাহীম খলীলুল্লাহর বংশধর, মূসা নাজীউল্লাহর উন্মত এবং দাউদ খলীফাতুল্লাহর সম্প্রদায়, যাদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে আপনি অগ্নি পূজারীদেরকে চাপিয়ে দেবেন- এরপর আর কোন জনপদটি অবিশষ্ট থাকবে, যারা আপনার শান্তি থেকে রক্ষা পাবে?

আল্লাহ বলেন, হে আরমিয়া! যে কেউ আমার অবাধ্য হয় সে আমার শাস্তি থেকে আদৌ অনবহিত থাকে না। ঐসব লোকদেরকে আমি সম্মানিত করেছিলাম, কারণ তারা আমার আনুগত্য করেছিল। যদি তারা আমার অবাধ্য হত, তবে অবশ্যই আমি তাদেরকে অবাধ্যদের অন্তর্ভুক্ত করতাম। তবে আমি তাদের প্রতি সদয় হলে নিজ দয়ায় তাদেরকে সংশোধন করে থাকি

আরমিয়া (আ) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি নবী ইবরাহীমকে আপন খলীলরুদ্ধপে গ্ৰহণ করেছেন এবং তার বদৌলতে আমাদেরকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছেন। নবী মূসাকে আপনি একান্তে ডেকে নিয়ে সংলাপ করেছেন। সুতরাং আমাদের প্রার্থনা, তার ওসীলায় আমাদেরকে রক্ষা করুন এবং আমাদের শক্ৰদেরকে আমাদের উপরে চাপিয়ে দেবেন না। তখন আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ওহী নাযিল করলেন : হে আরমিয়া! তুমি যখন মায়ের উদরে ছিলে তখন থেকেই আমি তোমাকে পবিত্র রেখেছি এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত জীবিত রেখেছি। তোমার সম্প্রদোয় যদি ইয়াতীম, বিধবা, মিসকীন ও পথিক লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা করত। তবে আমি তাদেরকে আপন আশ্রয়ে রাখতাম। তারা আমার নিকট এমন একটি উদ্যানের ন্যায়। সমাদৃত হত, যার বৃক্ষগুলি সতেজ এবং পানি স্বচ্ছ-পবিত্র এবং যার পানি কখনও শুকিয়ে যায় না। ফল নষ্ট হয় না এবং শেষও হয় না। কিন্তু তোমার সম্প্রদায় বনী ইসরাঈলের অবস্থাটা কী? তাদের ব্যাপারে আমার অনুযোগ হচ্ছে- আমি তাদেরকে দয়ালু আহবানকারীর মত আমার দিকে আহবান করেছি, সকল প্রকার দুর্যোগ ও দুৰ্ভিক্ষ থেকে নিরাপদে রেখেছি। সচ্ছল ও সজীব জীবন তারা উপভোগ করেছে। কিন্তু আমার এ নিয়ামত ভোগ করে তারা মোটা-তাজা মেষের মত পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে। তাদের জন্যে শত আক্ষেপ, আমি তো কেবল ঐসব লোকদেরকে সম্মানিত করি, যারা আমার প্রতি সম্মান দেখায়। পক্ষান্তরে যারা আমার বিধানকে পদদলিত করে আমি তাদেরকে লাঞ্ছিত করে ছাড়ি। বনী ইসরাঈলের পূর্বে যে সব জাতি এসেছে, তারা পাপাচারে লিপ্ত হতো গোপনে, আর এরা পাপ কাজ করে প্রকাশ্যে। এরা পাপ করে মসজিদে, বাজারঘাটে, পর্বত শিখরে এবং বৃক্ষের ছায়ায়। ওদের ঘূণ্য পাপাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বত চিৎকার করে আমার নিকট ফরিয়াদ করেছে; বন্য-জীবজন্তু ও কীট-পতংগ এলাকা ত্যাগ করে দূর-দূরান্তে পালিয়ে গিয়েছে। এর পরেও তারা পাপাচার থেকে নিবৃত্ত হচ্ছে না এবং আমার কিতাবের যে জ্ঞান তারা লাভ করেছে তা থেকে কোন উপকার লাভ করছে না।

তারপর আরমিয়া যখন বনী ইসরাঈলের নিকট গিয়ে এসব কথা জানালেন এবং সবকিছু খুলে বললেন, তখন তারা এ শাস্তি ও আযাবের কথা শুনে নবীর অবাধ্য হয়ে নবীকে বলল, তুমি মিথ্যা বলছ এবং আল্লাহর উপরে মিথ্যা আরোপ করছ! তুমি কি মনে করছ যে, আল্লাহ তার এ যমীনকে ও মসজিদসমূহকে নিজের কিতাব, তাঁর ইবাদত ও তাওহীদ থেকে শূন্য করে দেবেন? এ সব চলে যাওয়ার পর তিনি এ পৃথিবীতে আর কাকে পাবেন? তুমি আল্লাহর উপর জঘন্য মিথ্যা আরোপ করেছ, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি পাগল হয়েছ। এ কথা বলে তারা নবীকে ধরে বন্দী করল এবং জেলখানায় আবদ্ধ করল। আল্লাহ এ সময় তাদের বিরুদ্ধে বুখত

নসরকে প্রেরণ করেন। বুখত নসর সসৈন্যে বনী ইসরাঈলের এলাকায় উপনীত হয় এবং সকলকে অবরোধ করে রাখে। এ অবস্থার কথাই আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন : L. —তারপর তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সবকিছু ধ্বংস করেছিল।.,} خلال الريار (বনী ইসরাঈল : ৫)। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার পর বাধ্য হয়ে তারা বুখত নসরের নিকট আত্মসমর্পণ করল এবং শহরের তোরণ খুলে দিল; সাথে সাথে বুখত নসরের সৈন্যবাহিনী শহরের অলিতে-গলিতে এবং ঘরে ঘরে প্রবেশ করল। বুখত নসর তাদের ব্যাপারে নিষ্ঠুর জাহিলী নীতি অবলম্বন করে এবং অত্যাচারী শাসকসুলভ কঠিন নির্দেশ জারী করে। ফলে বনী ইসরাঈলের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশকে হত্যা করা হয়। এক তৃতীয়াংশকে বন্দী করা হয় এবং পঙ্গু, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। তারপর নিহতদের মৃত দেহের উপর ঘোড়া চালিয়ে সেগুলোকে দলিত-মথিত করে। বুখত নসর বায়তুল মুকাদাস ধ্বংস করে, শিশু-বালকদেরকে ধরে নিয়ে যায়, নারীদেরকে ঘোমটা মুক্ত করে বাজারে উঠায়, যুদ্ধক্ষম পুরুষদেরকে হত্যা করে, দুর্গসমূহ গুড়িয়ে ফেলে, মসজিদগুলো বিধ্বস্ত করে, তাওরাত কিতাব জুলিয়ে দেয় এবং দানিয়াল (আঃ)-কে খোজ করে, যার নিকট বুখত নসর পূর্বেই পত্ৰ লিখেছিল। কিন্তু দেখা গেল, তিনি ইতিপূর্বেই ইনতেকাল করেছেন। দানিয়ালের পরিবারবর্গ সে পত্রটি বের করে দিল। নিহত দানিয়ালের পরিবারে যারা জীবিত ছিলেন, তারা হলেনহিযকীল-তনয় ছোট দানিয়াল, মিশাঈল, আযরাঈল ও মিখাঈল। উক্ত চিঠির মর্ম অনুযাসী তাদের প্রতি আচরণ করা হয়। দানিয়াল ইব্‌ন হিযকীল (ছোট দানিয়াল) বড় দানিয়ালের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন।

বুখত নসর তার সৈন্যবাহিনীসহ বায়তুল মুকাদদাসে প্রবেশ করে, সমগ্র সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং বনী ইসরাঈলকে সমূলে বিনাশ করে। ধ্বংসলীলা সম্পন্ন করে বুখত নসর সংগৃহীত ধন-সম্পদ ও বন্দীদেরকে নিয়ে স্বদেশে ফিরে যায়। বন্দীদের মধ্যে কেবল ধর্ম-যাজক ও শাসক শ্রেণীর পরিবারভুক্ত শিশু-বালকদের সংখ্যা ছিল নব্বই হাজার। বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত উপাসনালয়গুলো পাথর ছুড়ে ধূলিসাৎ করে দেয়া হয় এবং মসজিদের অভ্যন্তরে শূকর যবোহ করা হয়। বন্দী বালকদের মধ্যে সাত হাজার ছিল দাউদ পরিবারের, এগার হাজার ইউসুফ ইব্‌ন ইয়াকুব ও তাঁর ভাই বিনয়ামীন এর বংশধর, আট হাজার ঈশা ইব্‌ন ইয়াকুব-এর বংশের, চৌদ্দ হাজার হযরত ইয়াকুবের দুপুত্র যাবালুন ও নাফতালী-এর বংশের, চৌদ্দ হাজার দান ইব্‌ন ইয়াকুবের বংশের, আট হাজার ইয়াসতাখির ইব্‌ন ইয়াকুবের বংশ, দুহাজার যাবালুন ইব্‌ন ইয়াকুবের অন্য এক শাখার, চার হাজার রূবেল ও লেবীয় বংশের এবং বার হাজার ছিল বনী ইসরাঈলের অন্যান্য শাখার। এসব কিছু সংগে নিয়ে বুখত নাসর বাবিল শহরে গিয়ে পৌছে।

ইসহাক ইব্‌ন বিশার বলেন, ওহাব ইব্‌ন মুনাববিহ বলেছেন, বায়তুল মুকাদাস ও বনী ইসরাঈলের ধ্বংস কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর বুখত নসরকে বলা হয় যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক ব্যক্তি তাদেরকে এই পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করবেন, আপনার বৈশিষ্ট্যাবলী তাদের নিকট তুলে ধরবেন এবং এই কথাও শুনাতেন যে, আপনি তাদের যোদ্ধাদের হত্যা করবেন, শিশু সন্তানদের বন্দী করবেন, মসজিদসমূহ ধ্বংস করবেন এবং উপাসনালয়সমূহ জুলিয়ে দেবেন।

কিন্তু এরা তার কথা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়, তাকে অপবাদ দেয়, প্রহার করে, বন্দী করে ও জেলে আবদ্ধ করে রাখে। তখন বুখত নসর সেই ব্যক্তিকে হাজির করার নির্দেশ দেয়। ফলে আরমিয়াকে জেলখানা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। বুখত নসর তীকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি এই পরিণতি সম্পর্কে ঐ সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিলেন? আরমিয়া বললেন, হ্যাঁ।

বুখত নসর জিজ্ঞেস করল, আপনি তা কিভাবে জানতে পারলেন? আরমিয়া (আঃ) বললেন, আল্লাহ আমাকে তাদের নিকট রাসূল রূপে পাঠিয়েছেন। তিনিই আমাকে ত জানিয়েছিলেন। বুখত নসর জিজ্ঞেস করল, তারা কি আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রহার করে জেলে আবদ্ধ করেছে? আরমিয়া বললেন, হ্যাঁ, তাই করেছে। বুখত নসর বলল, ঐ জাতি বড়ই দুর্ভােগা, যারা তাদের নবীকে মিথ্যাবাদী বলে, আল্লাহর রাসূলকে অস্বীকার করে। তখন বুখত নসর আরমিয়াকে বলল, আপনি যদি আমাদের সাথে যেতে চান, তবে চলুন, আমি আপনাকে সম্মান করব, সহযোগিতা করব; আর যদি নিজ শহরে থাকতে চান তা হলে থাকুন, আমি আপনাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দান করব। এ প্রস্তাবের উত্তরে আরমিয়া বুখত নসরকে জানালেন, আমি সর্বদা আল্লাহর নিরাপত্তায় আছি, এক মুহুর্তের জন্যেও তাঁর নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে আসিনি। বনী ইসরাঈলও যদি তার নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে না। আসত তা হলে তারা আপনাকে বা অন্য কাউকে ভয় করত না এবং আপনিও তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে পারতেন না।

আরমিয়ার মুখে এ বক্তব্য শুনার পর বুখত নসর তাকে তার স্ব-স্থানে রেখে চলে গেল। আরমিয়া নিজ শহর ঈলিয়ায় বসবাস করতে থাকেন। এ বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের। তবে এর মধ্যে উপদেশ ও সূক্ষ্ম তাৎপর্য নিহিত আছে। এ বর্ণনার আরবী ভাষা শৈলী নেহাৎ দুর্বল।

হিশাম, ইব্‌ন মুহাম্মদ আল-কালবী বলেছেন, বুখত নসর ছিল পারস্য সম্রাটের অধীনে আহওয়াজ ও রোমের মধ্যবর্তী অঞ্চলের শাসনকর্তা। সম্রাটের নাম ছিল। লাহরাসিব। তিনি বলখ শহর নির্মাণ করেন, যা খানসা নামে অভিহিত। তিনি তুর্কদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে কোণঠাসা করে ফেলেন। পারস্য সম্রাট বুখত নসরকে সিরিয়ায় বনী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে প্রেরণ করেন। তিনি যখন সিরিয়ায় পৌছেন। তখন দামেশকের অধিবাসীগণ তার সাথে সন্ধি করে। কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন, পারস্যের যে সম্রাট বুখত নসরকে যুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন, তার নাম ছিল বাহমান। তিনি লাহ্রাসবের পুত্র বাশতাসবের পরে পারস্যের সম্রাট হন। বাহমান কর্তৃক প্রেরিত দূতকে লাঞ্ছিত করার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে বনী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে এ অভিযান প্রেরিত হয়েছিল।

ইব্‌ন জারীর . সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিাব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বুখত নসর দামেশকে এসে একটি আবর্জনাস্তুপের মধ্য থেকে অবিরাম রক্ত উত্থিত হতে দেখে লোকের নিকট এর কারণ জিজ্ঞেস করে। তারা জানায়, আমাদের পূর্ব-পুরুষদের আমল থেকেই এ অবস্থা চলে আসছে এবং আমরা এ রকমই সর্বদা দেখে আসছি। এ রক্তের উপর যখনই আবর্জনা ফেলে ঢেকে দেয়া হয় তখনই তা আবর্জনার উপরে উঠে আসে। আর বুখত নসর ঐ স্থানে সত্তর হাজার লোক হত্যা করে। ফলে রক্ত ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। উপরোক্ত ঘটনা সাঈদ ইবনুল-মুসায়িত্ব (রা) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এটা হযরত ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়ার

রক্ত বলে হাফিজ ইব্‌ন আসাকিরের যে মন্তব্য পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে, তা যথার্থ নয়। কেননা, ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়ার আগমন হয় বুখত নসরের পর। তবে এ কথা সত্য যে, এটা হয় কোন নবীর রক্ত, না হয় কোন পূণ্যবান লোকের রক্ত অথবা অন্য কারও রক্ত- যা আল্লাহই ভাল জানেন।

হিশাম, ইব্‌ন কালবী বর্ণনা করেন, তারপর বুখত নসর বায়তুল মুকাদাসে যায় এবং সেখানকার শাসক তার সাথে সন্ধি করেন। শাসক ছিলেন দাউদ (আ)-এর বংশধর। তিনি বনী ইসরাঈলের পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপ গ্ৰহণ করেন। বুখত নসর উদ্ভূক্ত শাসকের নিকট থেকে মুচলেকা স্বরূপ কিছু লোক সংগে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে। তিবরিয়া নামক স্থানে পৌঁছে বুখত নসর সংবাদ পায় যে, সন্ধি করার কারণে ইসরাঈল বংশীয়রা তাদের শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাকে হত্যা করে। এ সংবাদ শুনামাত্র বুখত নসর মুচলেকাস্বরূপ নেয়া লোকগুলোকে হত্যা করে অতর্কিতে শহর আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং সকল সক্ষম লোকদেরকে হত্যা করে এবং শিশু-বালকদেরকে বন্দী করে।

হিশাম আরও বলেছেন, বুখত নসর জেলখানা থেকে নবী আরমিয়াকে বের করে আনে। নবী তার নিকট বনী ইসরাঈলকে এ পরিণতি থেকে সতর্ক করার জন্যে যা যা করেছিলেন। সবকিছু খুলে বলেন; তারা নবীকে মিথ্যাবাদী বলে জেলে আটক করার কথাও তাকে তিনি জানান। বুখত নসর বলল, যারা আল্লাহর নবীকে অমান্য ও অবমাননা করে, তারা একটি নিকৃষ্ট সম্প্রদায়। বনীর সাথে উত্তম ব্যবহার করে বুখত নসর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। এরপর নবী ইসরাঈলের অবশিষ্ট দুর্বল লোকজন আরমিয়ার নিকট এসে সমবেত হয় এবং করুণ কষ্ঠে ফরিয়াদ জানিয়ে বলে, আমরা অপরাধ করেছি, জুলুম করেছি, এখন আল্লাহর নিকট নিজেদের কৃত অপকর্মের জন্যে তওবা করছি। আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, যাতে তিনি আমাদের তওবা কবুল করেন। নবী আল্লাহর নিকট আবেদন করলে তিনি জানান, তুমি যা বলছি তা হবার নয়। দেখ, তারা যদি আন্তরিকভাবেই বলে থাকে, তবে তোমার সাথে যেন তারা এই শহরে অবস্থান করে। নবী তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ কথা জানালেন। তারা বলল, এ শহরে কীভাবে থাকা যায়, এখানকার অধিবাসীদের উপর আল্লাহর গযব পড়েছে। শহর ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং এখানে অবস্থান করতে তারা অস্বীকার করল।

ইবনুল কালবী বলেন, তখন থেকে বনী ইসরাঈল বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে- একদল যায় হিজাযে, একদল ইয়াছরিবে, এক দল যায় ওয়াদিল কুরায় এবং একটি ক্ষুদ্র দল যায় মিসরে। তখন বুখত নসর নবী ইসরাঈলের বাদশাহর নিকট এই মর্মে পত্র লিখে যে, তাদের যে সব

বাদশাহ এতে অস্বীকৃতি জানান। তখন বুখত নসর সসৈন্যে উক্ত শহরে আক্রমণ চালিয়ে তাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। সে তাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদের স্ত্রীলোকদেরকে বন্দী করে এবং সেখান থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। এ অভিযান অব্যাহতভাবে শেষ প্ৰান্ত পর্যন্ত চালিয়ে মরক্কো, মিসর, মিসর, বায়তুল মুকাদ্দাস, ফিলিস্তান ও জর্দান থেকে অসংখ্য বন্দী সাথে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। উক্ত বন্দীদের মধ্যে দানিয়াল (আঃ)-ও ছিলেন। তবে ইনি হলেন দানিয়াল ইব্‌ন হিযকীল (ছােট দানিয়াল), দানিয়াল আকবার (বড় দানিয়াল) নন। এ বর্ণনাটি

ওহাব ইব্‌ন মুনাববিহর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *