হপ্তা দেড়েক আগে সেদিন বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছিল আবিদ। তাহমিনা সেদিনও বাধা দিয়েছিল, না আজ যেও না। কিন্তু নিষেধ সে শোনেনি। বেরিয়ে গিয়েছিল। আর বিকেলেই সবাই ধরাধরি করে নামিয়ে এনেছে অচৈতন্য আবিদকে। হরিয়াল টিপ করেছিল ও। আর সেই হরিয়াল ডানা লুটিয়ে ঝুপ করে পড়ে গিয়েছিল নদীতে। এত বড় সুন্দর হরিয়াল নাকি সচরাচর মেলে না।
উত্তেজনায় ওটা ধরবার জন্য নিজেই যখন সে নদীতে নেমেছে তখন একটা কুমির জলের অতল থেকে ভেসে এসে ওর পা কামড়ে ধরেছিল। আর সে কী যমে মানুষে টানাটানি। চোখের পলকে যে কী হয়ে গেল তা কেউ ঠাহর করে উঠতে পারে নি। মেমসায়েবের কপাল ভালো, সায়েবের হায়াত দারাজ; অবশেষে আদালী আর মাঝিরা মিলে অসাধ্য সাধন করেছে। ডান পা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে তখন। খুবলে নিয়েছে মাংস। আর আবিদ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
একটা বার্নিশ করা প্রশস্ত খাড়াপিঠ চেয়ার টেনে দিয়েছে আবিদের বেয়ারা আবদুল। খুলে দিয়েছে বাংলার জানালার শার্সী। সেখানে রাত্রি চোখে আসে। ফারুক পিঠ সোজা করে খানিকটা উবু হয়ে ঝুঁকে পড়ে কথাগুলো শোনে। আর একটা হারিকেন জ্বালতে জ্বালতে আবদুল বলে চলেছে, অজ্ঞান হয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। বাংলোতে নিয়ে এসে ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দেয়া হলো পা। সন্ধ্যেয় একবার জ্ঞান ফিরেছিল। কিন্তু রাত্রে এলো বেহুশ জ্বর। এমন সে জ্বর যে ধান দিলে খৈ হয়ে যায়। আর ভুল বকতে লাগলেন শুধু। —-এইখানে একটু থেমে দেশলাই নেভাতে নেভাতে সে বলল, শুধু মেম সায়েবকে বকতে লাগলেন। প্রলাপে, খুন করে ফেলেন আর কী।
ফারুক শুধালো তারপর?
তারপর, সকালে মেনসায়েবকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এসেছি। এখন আল্লা মালেক।
ফারুক একটু আড় হয়ে বসলো চেয়ারে। তাকিয়ে রইল বাতাস দোলানো হারিকেন শিখার দিকে।
হাসপাতালে আবিদকে রেখে সেদিনই সন্ধ্যেয় তাহমিনা ফিরে এসেছে বাংলোয়। কাল আবার খবর পেয়ে গেছে সদরে। এখনো ফেরেনি। আবদুলের হারিকেন জ্বালানো শেষ হলো। সলতে একটু উঁচিয়ে নিয়ে ও বেরিয়ে গেল একটু সামনের দিকে ঝুঁকে।
ফারুক তেমনি বসে রইল অনেকক্ষণ। বাইরের প্রান্তর কেমন অদ্ভুত আবছা লাগছে। কেন সে এসেছে এখানে? অরণ্যের বাংলোতে? প্রেতের ডানার রং যেন চারদিকে। ফারুকের সমস্ত কিছু মিলিয়ে গেল, মিশে গেল। যুক্তি বুদ্ধি বিশ্বাস সবকিছু। শুধু কি এরই জন্য তাহমিনা তাকে ডেকে এনেছে এতদিন পরে ঢাকা থেকে? কেন সে ডাকল না তার ভাইকে, যদি আবিদের বিপদটাই মুখ্য হয়?—-ফারুক তাকে কী দিতে পারে?—-কী করতে পারে সে? —-সে ভাবল।
গোটা পৃথিবীতে যেন কেউ নেই। তাহমিনা নেই, আবিদ নেই। কেউ না। একেলা এই বাংলোয় সে একা। একেল এক অরণ্যের রাত্রি নিঃসঙ্গতায় পূর্ণ। এ বাংলোয় বুঝি আর কেউ থাকে না। আর কারো সাড়া নেই। এ অরণ্যে বুঝি মানুষ থাকে না। ফারুকের মন ভয়ে ভরে উঠল। ঠিক ভয় নয়, সূক্ষ্ম একটা উদ্বেগ মাত্র। আর সেটাই তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল এখন। এইমাত্র যে আবদুল ছিল তার সমুখে দাঁড়িয়ে তাও কেমন অবিশ্বাস্য মনে হলো। ফারুক মুখ ফিরিয়ে নিল জানালা থেকে। এমন সময় আবদুল ফিরে এল, হুজুর।
কে, আবদুল? ও।
আসুন হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলাবেন না? বাথরুমে পানি দিয়ে এসেছি।
ফারুক চুপ করে রইল। আবদুল বলল, মেমসায়েব কাল ভোরেই এসে যাবেন। আপনি কিছু ভাববেন না। এখন আসুন।
আবদুল, আমি এখুনি ফিরে যাচ্ছি।
হুজুর! বিস্মিত হলো আবদুল তার এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে।
হ্যাঁ এখুনি। একটা নৌকো ডেকে দাও ঘাটে লঞ্চ পাবোই। আর তোমার মেমসায়েব এলে আমার সালাম দিও।
হুজুর অসুবিধেটা কি, ঠিক
না, না, তার জন্যে নয়।
সায়েবের একটা কিছু খবর না নিয়ে—-
আবদুল তবু ধরে রাখতে চাইল। কিন্তু ফারুক বাধা দিল। উঠে দাঁড়াল। বলল, বোধ হয় বাংলো ফেলে তুমি যেতে পারবে না। কাছে ভিতে কোনো লোক থাকলে সাথে দাও। তার দরকার হবে না। আমি নিজেই আসছি। কিন্তু এই রাত বিরেতে না বেরিয়ে থেকে গেলেও পারতেন হুজুর!
একটা সিগারেট ধরিয়ে ফারুক উত্তর করল, সে হয় না আবদুল।
আবদুল নীরবে সুটকেশগুলো হাতে তুলে নিল। দরোজায় লাগিয়ে দিল তালা। তারপর মুখে বলল, বেশ চলুন।
কিন্তু ডান দিকের করিডর ঘুরে সামনের বারান্দার ভাঁজে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল ফারুক। যেন ভীষণ একটা কিছু সে দেখেছে। এক পাও নড়তে পারল না। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দুর্বোধ্য দুএকটা শব্দ গড়িয়ে পড়ল শুধু।
নিচে, তাহমিনা উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। পেছনে কে একজন। সম্ভবত মাঝি কিংবা খানসামা কেউ হবে। তাহমিনা পেছন পানে তাকিয়ে উঠতে উঠতে বলছে, বাতিটা একটু ভালো করে ধর গফুর। পা হড়কে যেতে পারে। কে আবদুল?
ফারুক প্রার্থনা করল অন্ধকারের সাথে মিশে যাবার জন্যে। কিন্তু কিছুই সে করল না। শুধু একটুখন পরে উচ্চারণ করল অত্যন্ত নিচু গলায়, আমি তাহমিনা।
নিস্তব্ধতা।
ও। তুমি।
তাহমিনা মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। হারিকেনের মৃদু মালোয় তাকাল পরিপূর্ণ গভীর চোখে। তারপর তার দৃষ্টি হয়ে এল শূন্য। ফারুক সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল না। কেউই নিল না। তিন বছরে আরো সুন্দর হয়েছে তাহমিনা। নেবেছে আশ্চর্য ডার্ক আইভরির মসৃণতা। আর তাহমিনার সেই চঞ্চলা দেহে এখন মন্থরতা। চিবুকের সেই কোমল ভাঁজ এখনো রয়েছে। তেমনি ঈষৎ উত্তোলিত তার—-ভঙ্গ। কুয়াশা লাল ঠোঁট। উন্নত গ্রীবা। আরো একটু বয়স হয়েছে তাহমিনার স্নিগ্ধ লাবণ্যের ছায়া পড়েছে মুখের আদলে। আর অলসতর তার শ্রোণীর। ফারুক দেখল। ফারুক সম্মোহিত হলো। কিন্তু তাহমিনা দাঁড়াল। মুহূর্তের জন্য। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, ফিরে যাচ্ছিলে? কতক্ষণ এসেছ?
এ প্রশ্নের উত্তর নেই। আবদুল নীরবে ফিরে গিয়ে তালা খুলল। তাহমিনা এক পা ভেতরে গিয়ে তারপর ঈষৎ আনত পেছন ফিরে শুধালো, ভেতরে আসবে না?
.
ফারুক আবার গিয়ে ঠিক সেইখানে সেই চেয়ারে বসলো। এবারে দেখা দিল নতুন একটা সমস্যা। এতক্ষণ তবু তাহমিনা ছিল না, এখন সে এসেছে–ফারুক তার অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারল তীব্র করে। সে স্থির হয়ে, হয়ত কিছুটা বিসদৃশভাবে, বসে রইল। দূরে দাঁড়িয়ে আবদুল। আর তারো কিছুটা পেছনে তাহমিনা প্রায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। ফারুক তার পায়ের তলায় অনুভব করল কার্পেটের কোমলতা। আর শুনল তাহমিনা বলছে, পেট্রোম্যাক্স জ্বালো নি আবদুল?
না মেম সায়েব। আপনি নেই তাই আর ওটা জ্বালি নি। জ্বালব কী?
না থাক, এখন আর দরকার নেই। এইখানে সে তাকাল ফারুকের দিকে। ফারুক একটু পরে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন উনি?
তাহমিনা প্রশ্নের দৃষ্টিতে একবার ফারুক তারপর আবদুলের দিকে তাকাল। সংশোধনের হাসি হেসে বলল ফারুক, হ্যাঁ, ওর কাছ থেকেই শুনেছি।
তাহমিনা উত্তর করল, কিছুটা কম্পিত স্বরে, প্রায় আগের মতই। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
ডাক্তার কী বললেন?
এ প্রশ্নের কোন উত্তর পেল না ফারুক। তা না পাক। উত্তর তাহমিনার মুখেই লেখা ছিল। তাই আর সে কোনো প্রশ্ন করল না। তাহমিনা কোনো কথা না বলে রূপসার মত মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। অপসারিত হলো মেঝে থেকে তার দেহছায়া। আবদুলও চলে গেল প্রায় সাথে সাথে।
আবদুল ফিরে এসে বলল, মেম সায়েব শুধোচ্ছিলেন—- খাবার কথা।
খাবার ইচ্ছে নেই আবদুল। তুমি বরং ওকে ডাকো।
কিন্তু জিজ্ঞেস করলেন কি খাবেন জেনে আসতে।
সন্ধ্যের আগেই খেয়ে নিয়েছি। এত রাতে মিছেমিছি কষ্ট কোরো না।
সেকি কথা হুজুর!
অবশেষে ফারুক বলে দিল শুধু চায়ের কথা। আবদুল বলল, তার আগে চলুন হাত মুখ ধুয়ে নেবেন।
ফারুক উঠতে যাচ্ছিল। এতটা পথ স্টিমার আর লঞ্চে এসে অনেকটা শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল সে। ঘুমে ভারী হয়ে আসছিল চোখ। আঠার মত সারা গায়ে যেন ট্রাউজার আর শার্ট সেঁটে আছে। সেগুলো না ছেড়ে রাখা অবধি কিছুতেই স্বস্তি আসবে না। এমন সময় সিঁড়িতে বাইরে কার পায়ের আওয়াজ আর গলা শোনা গেল, আবদুল, আবদুল।
আবদুল প্রায় ফিসফিস স্বরে ফারুককে বলল, আশরাফ সায়েব আসছেন—- হুজুরের ম্যানেজার সায়েব।
ও।
বলেই সে বাইরে এগিয়ে গেল।
এমন একটা বিশ্রী অবস্থায় ফারুক যে এত শীগগীর এমনভাবে পড়ে যাবে তা সে এর আগে ভাবতেও পারে নি। সে আশা করে নি এত তাড়াতাড়ি বাইরের কারো সামনে তাকে আসতে হবে। কি দেবে তার পরিচয়? আর কেনই বা সে এখানে এসেছে, তার জবাবেই বা কি বলবে? কিছু না জেনেও তার স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেছে যে তাহমিনার চিঠির কথা কাউকে সে বলতে পারবে না। এই সময়ে চকিতে তার চোখের সামনে আরেকবার ভেসে উঠল চিঠিটা—-দ্রুত হস্তাক্ষরে বাঁকা দুর্বল লাইনে লেখা তাহমিনার চিঠি। আর সে যেন স্পষ্ট শুনতে পেল তাহমিনার স্বর—- “যদি কোনোদিন আমাকে তুমি তোমার একান্ত বলে ভেবে থাকো, তাহলে এ চিঠিকে তুমি উপেক্ষা করবে না, এ আমি জানি।” ফারুক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হরে চেয়ারে নিঃশব্দে আবার বসে পড়। ভ্রমণের ক্লান্তি যেন তাকে এখন ছুঁয়ে গেল গভীরতর। উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
বাইরে থেকে আশরাফের গলা শোনা গেল, কিরে আবদুল, তোর মেমসায়েব ফিরলেন নাকি এখন?
হ্যাঁ।
আবিদের খবর কী?
একই রকম তো বল্লেন। আর কিছু শুনিনি এখনো।
কাল তো ফেরার কথা ওর। আজকেই ফিরল যে?
কী জানি।
আশরাফ একটু কাশলো। তারপর আবার বলল, হঠাৎ কড়ানাড়ার শব্দ, তারপর অনেকক্ষণ পরে আবার ঘাট থেকে আলো দেখে ভাবলাম দেখে আসি একবার। ঘুমোস কত যে অমন করে দরজা ধাক্কাতে হয়? চল, চল, ভেতরে চল শুনি।
আবদুল গলা একটু নামিয়ে বলল, ফারুক তবুও শুনতে পেল, নতুন এক সায়েব এসেছেন, তিনিই কড়া নেড়েছিলেন।
কে সায়েব রে?
ফারুক স্থির হয়ে বসল। আবদুল উত্তর করল, ঢাকা থেকে এসেছেন। আর মেমসায়েব তো এলেন এইমাত্র।
আশরাফ একটুখন চুপ করে রইল। তারপর শুধালো, তোর মেমসায়েব কোথায়?
উনি তো ভেতরে।
হুঁ।
এরপরেই আশরাফ এসে দাঁড়াল দরোজায়। ফারুক চোখ তুলে তাকালো। আশরাফের আসল বয়স বিয়াল্লিশের বেশি হবে না। কিন্তু চট করে দেখলে ঠাহর করা যায় না। আরো বেশি মনে হয়। কপালে দুটো ভাঁজ পড়েছে। তীক্ষ্ণ নাক। আর স্কুট চোয়ালের হাড়ে দৃঢ়তার। ছাপ। প্রশস্ত কাঁধ। লম্বায় প্রায় ছফুট কি তারো বেশি হবে। দীর্ঘকাল অরণ্যে কাটিয়ে মজুর খাঁটিয়ে চেহারাটা তার কঠিন হয়ে এসেছে অস্বাভাবিক রকমে। এখন পরনে তার ভাঁজ দুমড়ানো পাঞ্জাবি পাজামা। বাঁ হাতে দুব্যাটারির ছোট্ট তীব্র টর্চ। ডান হাতে রাইফেল। ফারুক একটু অস্বস্তি বোধ করল, বিব্রত হলো। তারপর উঠে দাঁড়াল। আশরাফ হেসে বলল, আরে বসুন, উঠছেন কেন? এ অরণ্যে তার বালাই আমরা রাখিনি। সব ক–বে ভুলে মেরে দিয়েছি।
বলেই উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল আশরাফ। ফারুক প্রথমে বিস্মিত হলো, তারপর নিচু গলায় সেও হাসিতে যোগ দিল। তার সম্বন্ধে যে ধারণা সে প্রথমে করেছিল এক মুহূর্তে তা কেটে গেল।
ঢাকা থেকে আসছেন বুঝি?
হা। ফারুক শুকনো গলায় বলল।
আবিদের ব্যাপারটা শুনেছেন তো? বড় বিপদে পড়ে গেছি সবাই। এ সময়ে আপনি এলেন। ভালো কথা, আপনার পরিচয়টা আমার জানা হোলো না।
ফারুক কিছু একটা বলবার আগেই দরোজার কাছ থেকে এই মাত্র সে এসে দাঁড়িয়েছে—- তাহমিনার উত্তর এলো, ও আমার মার সম্পর্কে ভাই হয় আশরাফ সায়েব।
দুজনেই প্রায় একসাথে তার দিকে ফিরে তাকাল, আপনি দেখেন নি ওকে। অনেকদিন। থেকেই আসতে চেয়েছিল এখানে বেড়াতে। তারপর তাহমিনা ফারুকের দিকে তাকিয়ে বলল, আর ইনি আমাদের ফার্মের সব, আশরাফ আহমদ।
তাহমিনা শান্ত স্বরে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ভেতরে এসে বসল। হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে এসেছে ও। অনেকটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওকে। ফারুক একবার তার দিকে তাকাল। ঘরে কিছুকাল তীব্র নিস্তব্ধতা। অবশেষে আশরাফ প্রথমে বলল, ও তারপর বলল, ঘাটে আলো দেখে ভাবলুম তুমি এসেছ। তাই উঠে এসেছি। খবর কী?
ভালো। —-ভালোই।
ডাক্তার কী বললেন?
উনি তো আশা রাখছেন এখনো।
পা কি বাঁচানো যাবে?
তাই তো বলছেন।
যাক তবু ভালো। আমার একবার যাওয়া দরকার আবার দেখতে। কিছু বলেছে নাকি আমার কথা?
তাহমিনা একটু অন্যমনা হয়ে পড়েছিল। চকিতে চমক ভেঙে বলল, না, বলে নি।
নতুন কয়েকটা বড় অর্ডার এসেছিল, তাই বলছিলাম। দেখি কি করা যায়।
তাহমিনা কোনো কথা বলল না। আশরাফ হঠাৎ ফারুকের দিকে তাকিয়ে বলল, এ সব কাজ বুঝলেন ঝামেলার একশেষ। একা কুলিয়ে ওঠা যায় না। এসেছেন, সবি দেখবেন আস্তে আস্তে।
ফারুকের একটা কিছু বলা দরকার, সে অনুভব করল, তাই বলল, সে তো নিশ্চয়ই।
দেখছেন তো কাঠের কারবার, কিন্তু ধারণা করতে পারবেন না কী কাঠখড় এর পেছনে পোড়াতে হয়।
ফারুক একটু হাসল শুধু। তাহমিনা তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কাপড় বদলালে না? আবদুল চা নিয়ে আসছে এখুনি।
হু, বদলাচ্ছি।
আশরাফ বলল, তাই তো, আপনার এসব এখনো হয় নি। আমার খেয়ালই ছিল না। রাত তো অনেক হয়েছে। আচ্ছা তাহমিনা, আমি তাহলে যাই। আসি আমি, কাল সকালে আপনার সাথে আলাপ করব।
আশরাফ উঠছিল। ফারুক বাধা দিল, বসুন চা খেয়ে যাবেন।
খেপেছেন! এই রাতে চা খেলে ঘুম হবে মনে করেছেন? তার ওপর বাসায় ও আবার জেগে রয়েছে।
এমন কিছু দেরি হবে না আপনার একটু বসলে। তাছাড়া চা খেলে রাতে ঘুম হয় না কে বলল?
তাহমিনা বলল, বসুন না। এক কাপ চা–ই তো। আবদুল, আবদুল।
আচ্ছা।
আশরাফ চেয়ারে একটু আড় হয়ে বসলে৷। আবদুল এলে পর তাহমিনা বলল, যাও ওকে বাথরুম দেখিয়ে দাও। যাও তুমি।
.
আবদুলের সাথে করিডর ঘুরে পেছনের বারান্দার শেষ প্রান্তে বাথরুমে ঢুকলো ফারুক। আবদুল হারিকেনটা এগিয়ে দিল। টাবে পানি তোলা রয়েছে কানায় কানায়। র্যাকে পরিষ্কার টাওয়েল রাখা। দেয়ালে লম্বা আয়না। আর তার নিচেই কেসে রাখা নতুন সাবানের শুভ্র কেক। সমস্ত মেঝে সদ্য ভিজে। আর কেমন একটা চেনা মিষ্টি সুবাস বাতাসে। শিরশির করা! ফারুক কেকটা তুলে নিল।
সমস্ত কিছুই তার কাছে কেমন রহস্যময় আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। কদিন আগেও সে কি ভাবতে পেরেছিল তাকে এখানে আসতে হবে? তাহমিনার সাথে দেখা হবে? আর ওর ব্যবহারটা অদ্ভুত ঠেকল তার কাছে। চিঠি পেয়ে, এমন কী এখানে এসে অবধি আকাশ পাতাল অনেক কিছু মনে হয়েছিল তার। কিন্তু তাহমিনা অস্বাভাবিক রকমে শান্ত স্নিগ্ধ আর উজ্জ্বল। কত সহজে সে তার পরিচয় নিজে দিল আশরাফের কাছে। ও কেন লুকালো তার আসল পরিচয়? কী হয়েছে তাহমিনার? আবিদের দুর্ঘটনা যে এর কারণ নয় তা সে বুঝতে। পারল। তাহলে কী? চোখের সমুখে একবার তাহমিনার চেহারাটা মনে করতে চেষ্টা করল সে।
ফিরে এল যখন, তখন নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হোল তার। আবদুল এর মধ্যেই সব কিছু সাজিয়ে ফেলেছে। রেকাবিতে রাখা পুডিং আর রূপোর চামচ। ট্রের ওপর ঢাকনা দেয়া কেটলি। চা ঢেলে দিল তাহমিনা। তিনজনে হাতের ওপর টেনে নিল সোনালি বর্ডার দেয়া নীল ফুল তোলা সোনালি পানিয়ের কাপ।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আশরাফ গল্প করতে লাগল—-বার্মার গল্প, ইরাবতী তীরের কথা। কথাটা উঠল আবিদের দুর্ঘটনা থেকে। তখন আশরাফ আবিদের বাবার সাথে ইরাবতীর তীরে নতুন জঙ্গলের ইজারা নিয়ে ঘুরছে। কাটা হচ্ছে গাছ। হাতি দিয়ে গড়িয়ে নদীর কিনারে নিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে ভেলা বেঁধে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কুলিরা। আশরাফ দাঁড়িয়ে তদারক করছিল। সেই সময় মাঝ নদীতে এক কুলি পড়ে যায় হঠাৎ। একই দুর্ঘটনা ঘটেছিল তারো। তবে কুমির নয়, কুমিরের সগোত্রই এক জলজ জন্তু কামড়ে ধরেছিল তার পা। আর সেকি তার বুক ফাটা আর্তনাদ! শেষ অবধি যখন তাকে তীরে তুলে নিয়ে আসা হলো তখন স্রোতের মত ধারায় রক্ত পড়ছে। আশরাফ এরপর একটু থেমে বলল, অবাক হয়েছি সবচে, বুনো লতাপাতা খেয়ে–বেঁধে লোকটা সেরে উঠেছিল। অনেকদিন আগের কথা, এখনো স্পষ্ট আমার মনে আছে। কাজেই ভয়ের কিছু নেই তাহমিনা। আচ্ছা, এবার তাহলে, আমি চলি। আশরাফ ফারুকের দিকে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। তুলে নিল টর্চ আর রাইফেল। একবার রাইফেলটা ঝাঁকাল, তারপর চলে গেল। ফারুক তার পেছনে পেছনে তাকিয়ে রইল। আবদুল আস্তে আস্তে সব নিয়ে গেল। এখন শুধু নিস্তব্ধতা। কেউ কোন কথা বলল না। কেউ কারো দিকে তাকাল না। হঠাৎ যেন স্তব্ধ স্পন্দনহীন হয়ে গেছে সবকিছু এক নিমেষে।
তাহমিনা।
বলো। স্বর তার কেঁপে গেল।
আমি কিছুই বঝুতে পারছি নে।
তাহমিনা আয়ত গভীর চোখ মেলে তাকাল তার দিকে। ফারুক হঠাৎ তার কথার খেই হারিয়ে ফেলল যেন। এবারে বলল, ফিসফিস করে, আশরাফের কাছে আমার মিথ্যে পরিচয় দিলে কেন? যদি ও জানতে পারে, যদি আবিদ জানে, তাহলে কী হবে? তোমার কী হবে?
তুমি চলে যেতে চাও? তাহলে এলে কেন?
ফারুক হঠাৎ চুপ করে গেল একথায়। মাথা নিচু করল।
আমি ক্লান্ত। তোমার ঘর ঠিক করে দিয়েছি। আবদুল বিছানা করে রেখেছে। আমি যাই। তাহমিনা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেল। তার পায়ের নরোম শব্দ মিলিয়ে গেল একটু পরে। আবদুল এসে হারিকেনটা হাতে নিয়ে বলল, আসুন।
হ্যাঁ, চল।
পাশের কামরাতেই শোবার ব্যবস্থা হয়েছে তার। অনেকটা লম্বা আর কম প্রশস্ত কামরা। একধারে পাতা নিচু পালং। পুরু তোষকের ওপর নীল বর্ডার দেয়া ধবধবে চাদর পাতা। অনেক বড় দুটো বালিশ সাদা চিকন লেস আঁকা। ঠিক যেমন ভালোবাসে ফারুক। আর এ ধারে দেয়ালে ঝোলানো জলরংয়ের ল্যান্ডস্কেপ। বাঁ হাতে দৈর্ঘ্যের দিকে দুটো জানালা। ছবির ফ্রেমের মত দেখতে। শার্সির ওপরে একটু বাতাসে কাঁপছে সিলভার সবুজ পর্দা। ফারুক অবসাদে এলিয়ে দিল তার সারা শরীর। আবদুলের পদশব্দ দূরে নেবে হারিয়ে গেল। আর কিছুই সে ভাবতে পারছে না, সমস্ত অনুভূতি যেন তার অবশ হয়ে গেছে। শুধু ঘুম পাচ্ছে। এক সময়ে আধো ঘুম আধো জাগার ভেতরে সে শুনতে পেল কিছুটা কাছেই, অথচ কাছেও নয়, একটা দরোজা বন্ধ হয়ে গেল। তার ঝাঁকুনিতে বুঝি একটু শিরশির করে উঠল কাঠের দেয়াল। হারিকেনের ছোট্ট সলতেয় কামরার ভেতরে দীর্ঘ চিকন কাঠের প্রাঙ্কের অসংখ্য সমান্তরাল রেখায় ছায়ার ভাঁজ পড়েছে। অন্ধকার লাগছে তাব ক্রীমরঙ পেন্ট। ফারুক ঘুমিয়ে পড়ল ধীরে ধীরে।
অনেক রাতে কী করে যেন ঘুম ভেঙে গেল তার। কী একটা ধ্বনিতে, কিসের একটা নরোম শব্দে সে জেগে উঠল। এমন কিছু নয়, খুব মিহি, তবু তার ঘুম ভাঙলো। প্রথমটায় তন্দ্রা, তারপর চোখ মেলে তাকাল ও। ওপরে সিলিংয়ে শুধু পুঞ্জীভূত অন্ধকার।
চোখ সয়ে এলে পর কান পাতলো শোনবার জন্য। কে যেন হাঁটছে তার কোমল পা ফেলে, সাবধানে আর ধীরে। বুকের ভেতরে গিয়ে সেই পদশব্দ যেন ঢেউ তুললো। রক্তে তার নামলো আশ্চর্য অনুরণন। আর জাগলো বিচিত্র একটা অনুভূতি। থেমে গেল সেই শব্দটা। ফারুক উঠে বসলো। জানালার পাশে দুধ–সুপুরির একটা উন্নত ডালে বাতাস উঠলো শিরশিরিয়ে। সেও সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো।
রেলিং ধরে একেলা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল তাহমিনা। সে এসে দাঁড়াল ঠিক তার পেছনে। রাত্রির অতল থেকে গড়ে উঠেছে যেন তাহমিনার শুভ্র দেহ! শিথিল শাড়ি সরে গেছে মাথার ওপর থেকে। একরাশ চুল কাজল মেঘের মত অথবা এই অরণ্যের মত বিস্তৃত তার পিঠের ওপরে। আর তার মিহি সৌরভ বাতাসে। বাইরে বেলে জোছনা। এমনি কোনো চন্দ্ররাতে হরিণ আর হরিণীরা বুঝি টের পায় কিসের আভাস। নির্জন তাদের বাসা ছেড়ে ঘাসের ভিতর দিয়ে পরস্পর নদীর জল শেষে। ফারুক অনুভব করল এক আকর্ষণ। সে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে। দাঁড়াল। তাহমিনা চকিতে মুখ ফিরিয়ে তারপর শ্বাস ফেলে উচ্চারণ করল, ও, তুমি।
ফারুক বলল, এখনো ঘুমোও নি তাহমিনা?
তাহমিনা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল অন্ধকারে। কোনো কথা বলল না। একটু চুপ কবে থাকল ফারুক। তারপর এত নিচু গলায় বলল যে তার কথা প্রায় শোনা গেল না, আমি চলে গেলেই ভালো ছিল। শুধু শুধু আমাকে ধরে রাখলে। এমন হবে জানলে আমি আসতাম না।
কী জানলে?
আমি বলে বোঝাতে পারছি নে।
তুমি যেতে চাইলে আমি বাধা দেবার কে?
সে কথা নয় তাহমিনা, একটু থামল, ও নেই, তাই বলছিলুম।
তুমি পাগল। তুমি ঘরে যাও।
ফারুক দূরে ঘন ঝোঁপের দিকে তাকিয়ে রইল খানিক। তারপর সেদিকে চোখ রেখেই বলল, তোমার ভয় করে না? এক বাংলোর নিচে একেলা আর একজনের সাথে থাকতে তোমার ভয় হয় না?
তাহমিনা হাসল মৃদুস্বরে। একটু সরে গেল রেলিংয়ে।
তাহলে তোমাকে থাকতে বলতাম না।
প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যেই ফারুক একটুখন পর বলল, তোমার চিঠি পেয়ে এক মুহূর্ত আমি দেরি করিনি। সমস্ত কাজ ফেলে এসেছি তোমার কাছে।
আমি জানতাম।
হঠাৎ আমাকে তুমি আবার লিখলে কেন তাহমিনা?
একটু যেন চমকে উঠল ও। মুহূর্তের জন্য বুঝি ম্লান হয়ে গেল তার মুখ। উন্নত বুক তার স্ফীত হয়ে উঠল। কয়েকটা দৃঢ় টোল পড়ল গালে। ছায়াভাঁজ। মিলিয়ে গেল। কী যেন সে বলতে চাইল। অথচ পারল না। চলে যেতে চাইল। ফারুক স্পর্শ করল তার বাহুতে। তুলে নিল মুঠোয়। বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে গেল সেই স্পর্শ পরস্পরের ভিতরে। বলল, শোনো, তুমি চলে যাচ্ছ?
তাহমিনা দাঁড়াল, কিন্তু সরিয়ে দিল না তার স্পর্শ। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টি মেলে তাকাল তার দিকে। ফারুক বোকার মত হাত সরিয়ে নিল, আমি দুঃখিত তাহমিনা, একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।