০৭. স্যার চার্লস টেগার্ট বনাম…

স্যার চার্লস টেগার্ট বনাম…

—একটা কাগজ-কলম হবে?

—নিশ্চয়ই। আর কিছু লাগলে বলতে পারো। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলো, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

শীর্ণকায় শ্যামবর্ণ যুবক মৃদু হাসেন।

—না না, কাগজ-কলম হলেই চলবে। চিঠি লিখব একটা।

প্রহরী বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যান খাতা-পেন আনতে। কী ধাতুতে যে গড়া এই ছেলেটি! কাল বাদে পরশু ফাঁসি। এই সময়টায় জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশই থাকে, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তের যাবতীয় ইচ্ছে যথাসাধ্য পূরণ করার। ছেলেটির প্রতি মায়াই পড়ে গেছে গত এক মাসে। ভারী শান্ত স্বভাবের। একে খুনি ভাবতে মন সায় দেয় না কিছুতেই। বই পড়ে প্রচুর। আর একটি ছোট্ট কালীমূর্তির সামনে ধ্যান করে সময় কাটায় চুপচাপ। নিজের কৃতকর্মের জন্য কোনও অনুতাপ নেই। কোনও বিশেষ ইচ্ছের কথাও বলে না হাজার প্রশ্ন করলেও। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে ফাঁসিকাঠে উঠতে হবে, বোঝা দুষ্কর হাবভাব দেখে। রোজ যেমন থাকে, তেমনই। কোনও হেলদোল নেই। কাল বাদে পরশু ফাঁসি। ভয় করছে না ওর?

—এই নাও কাগজ আর কলম। এতে হবে তো?

একগাল হাসে যুবক।

—হ্যাঁ হ্যাঁ… চিঠিটা পৌঁছে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা যদি…

—সে ব্যবস্থা হবে… তুমি লেখো।

নিশ্চিন্ত দেখায় যুবককে, লিখতে বসেন শেষ চিঠি।

‘শ্রীচরণেষু মা…’

.

বিশাল বাংলোয় সান্ত্রি-পেয়াদার ছড়াছড়ি। বন্দুক উঁচিয়ে নজরদারি অষ্টপ্রহর। অপরিচিত কারও প্রবেশের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। বাড়ির বাসিন্দা যিনি সপরিবারে, তাঁর নিরাপত্তায় কোনওরকম কার্পণ্য করেনি সরকার।

যাঁর জন্য এই নিশ্ছিদ্র আয়োজন, তিনি অবশ্য খুবই ডাকাবুকো প্রকৃতির। ভোরে ওঠা বরাবরের অভ্যাস। ভয়ডরের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বিশেষ। নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই বেরিয়ে যান প্রাতঃভ্রমণে। কিড স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রিট হয়ে চৌরঙ্গি, হেঁটে আসেন দ্রুতপায়ে। আশৈশব স্বাস্থ্যসচেতন, শারীরিক সক্ষমতার ব্যাপারে আপসহীন। ঘোড়ায় চড়ে কাকভোরে বেরিয়ে পড়েন কোনও কোনও দিন। সুঠাম চেহারার অশ্বারোহীকে চষে বেড়াতে দেখা যায় ময়দানের আদিগন্ত সবুজে। কখনও রিভলভার নিয়ে শুটিং প্র্যাকটিসে নেমে পড়েন সাতসকালে। আজ যেমন।

প্রশস্ত ছাদে মহড়া চলছে। পূর্ণবয়স্ক একটি লোকের ছবি আঁকা ক্যানভাসে, লোকটির হাতে উদ্যত পিস্তল। লক্ষ্যবস্তু ওই ছবিই। ওটাই টার্গেট। রাখা হয়েছে ছাদের এক প্রান্তে। দুই সাহেব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চল্লিশ মিটার দূরত্বে। কোমরের হোলস্টারে গোঁজা রিভলভার।

নিশানায় চোখ রেখে ধীরেসুস্থে পালা করে যে গুলি ছোড়া হচ্ছে, এমন নয়। বাস্তবের লড়াইয়ে অত সময় পাওয়া যায় না আগ্নেয়াস্ত্র তাক করার। সাহেবযুগল তাই মহড়ার সময় চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত পরিস্থিতিতে নিজেদের নিশানা যাচাই করে নেওয়ার। টার্গেটের দিকে পিছন ফিরে গল্পগুজব করতে করতেই হঠাৎ একজন চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সঙ্গীর।

—There! Fire!

সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন যথাসাধ্য ক্ষিপ্রতায় ঘুরে দাঁড়িয়ে রিভলভার বার করে গুলি ছোড়েন টার্গেটে। এভাবেই চলতে থাকে ঘণ্টাখানেক। চলতে থাকে নিশানার চুলচেরা বিচার। মাথা-বুক-পেটের ‘killing zone’-এ গুলি না লাগলে বিমর্ষ হয়ে পড়েন সাহেবরা। শরীরের নিম্নাংশে লাগলে তো শত্রু আহত হবে বড়জোর, প্রাণহানির সম্ভাবনা কম। ফের শুরু হয় লক্ষ্যভেদের মহড়া। গুলি যাতে ঝাঁঝরা করে দিতে পারে ক্যানভাসে আঁকা প্রমাণ সাইজের মানুষটির বক্ষস্থল বা তার আশেপাশের অংশ।

—Let’s start afresh Colson.

—Right Charles!

.

খুনের ‘কী-কখন-কোথায়’ ঝালিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।

—এমন সুযোগ আর আসবে না। মনে আছে তো গোপী… ব্যাটা একেবারে মৃত বলে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালিয়েই যাবি।

তথ্য সংগৃহীত হয়েছে কয়েকমাস ধরে বিস্তর খেটেখুটে। পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়েছে একাধিক বৈঠকে আলাপ-আলোচনার পর। প্রয়োগের সময় এসেছে এবার। চূড়ান্ত আঘাতের প্রাক্‌মুহূর্তে বিপ্লবীদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে মধ্য কলকাতার এক গোপন ডেরায়। বক্তার ভূমিকায় বিপ্লবী অনন্ত সিংহ।

—কয়েকটা জরুরি জিনিস আবার বলে দিই। ভোর ছ’টায় কিড স্ট্রিট থেকে মর্নিং ওয়াকে বেরোয়। সঙ্গে একটা টেরিয়ার কুকুর থাকে। আক্রমণটা হবে কিড স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গির মাঝামাঝি জায়গায়। বেড়াতে যাওয়ার সময় বা ফেরার সময়, যখন আমাদের সুবিধে।

গুলি গোপীমোহন করবে। বহুদিন ধরে ফলো করেছে সকালে। চেনে লোকটাকে। একহাতে রিভলভার থাকবে, অন্যহাতে পিস্তল। ধরো যদি গোপীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তবে খোকা গুলি করবে। খোকা… তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে গোপীর থেকে পঞ্চাশ-ষাট গজ দূরে।

টার্গেট যদি পূর্বদিকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট দিয়ে পালাতে চায় তবে আমি গুলি চালাব। অপেক্ষা করব গোপীর থেকে সত্তর-আশি গজ দূরে।

খোকা ইউরোপিয়ান পোশাক পরবে। সঙ্গে রিভলভার তো থাকবেই। আর থাকবে টাইম বোমা, যা লোশন দিয়ে সাত সেকেন্ডের মধ্যে ফাটানো যায়। একইরকম বোমা আর রিভলভার আমার সঙ্গেও থাকবে। আমি থাকব বাঙালির বেশে।

গোপীর সাজ হবে মুসলমানের মতো। মাথায় ফেজ টুপি। আর মুখের কাটা দাগটা ঢেকে রাখতে উলের স্কার্ফ পরবে। গোপী সফল হলে তো চুকেই গেল, না হলে আমি বা খোকা আক্রমণ করব, যেদিকে ব্যাটা দৌড়বে প্রাণ বাঁচাতে, ধাওয়া করে মারব।

জুলুদা, আপনার কাছে মাউজার পিস্তল থাকবে। আপনি সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে নজর রাখবেন এলাকায়। দরকারমতো সাহায্য করবেন আমাদের। আর খেয়াল রাখবেন সাদা পোশাকের চরগুলোর উপর। সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকে ওরা।

একটানা অনেকটা বলে দম নেন অনন্ত। তাকান গোপীমোহনের দিকে।

—কী রে গোপী? পারবি তো?

সাদামাটা দোহারা চেহারার যুবক রিভলভারে হাত বোলাতে বোলাতে সটান তাকান প্রশ্নকর্তার দিকে। চোখ দুটি ঝকঝক করছে উত্তেজনায়। উত্তর আসে অবশ্য আপাতনিরুত্তাপ গলায়।

—তোমাদের সন্দেহ আছে কোনও? তোমরা তো জানোই ওই লোকটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আমি যে-কোনও ঝুঁকি নিতে পারি। ওই লোকটার আর একদিনও বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

.

ওই লোকটা! যাঁর বেঁচে থাকার অধিকার নেই বলে মনে করতেন অগ্নিযুগের বঙ্গজ বিপ্লবীদের একটা বড় অংশ। যাঁর নামের আদ্যক্ষর থেকে ‘কোডনেম’ তৈরি করেছিলেন বিপ্লবীরা। CAT! Charles Augustus Tegart।

টেগার্টের জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডে, ১৮৮১ সালে। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে কেটেছিল ছাত্রাবস্থার কিছু সময়। ভারতীয় পুলিশে (Imperial Police) যোগ দেন ১৯০১ সালে। প্রথম পোস্টিং পাটলিপুত্রে। বিহার এবং ওড়িশা তখন বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯০৬ সালে বদলি হয়ে এলেন কলকাতায়, গোয়েন্দা বিভাগের Acting ডেপুটি কমিশনার হিসাবে। সেই থেকে টানা পঁচিশ বছর কর্মরত কলকাতা পুলিশে এবং উল্কাসদৃশ উত্থান।

স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের পত্তন এবং তার পরিকাঠামোগত বুনিয়াদ স্থাপনে সিংহভাগ কৃতিত্ব ছিল টেগার্টের। কলকাতা তো বটেই, রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত ছিল তাঁর দুর্ধর্ষ ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’। সঙ্গে যোগ হয়েছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং দুর্দমনীয় সাহস। ফলত তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনে ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং কিংবদন্তিসম। পুলিশ কমিশনারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন ১৯২৩ সালে, লাগাতার আট বছর ছিলেন কলকাতা পুলিশের অবিসংবাদিত সর্বাধিনায়ক।

স্যার চার্লস টেগার্ট ছিলেন এক বহুবিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। স্রেফ পেশাদারি মানদণ্ডের নির্মোহ বিশ্লেষণ বলবে, অফিসার হিসাবে যে-কোনও সরকারের কাছে তিনি সম্পদবিশেষ। যে বিপ্লবীদের তিনি বরাবরের চক্ষুশূল ছিলেন, তাঁদের একাধিকের লেখনীতেও ধরা রয়েছে টেগার্টের কর্মদক্ষতার প্রতি সম্ভ্রম, ‘টেগার্টের কাছে কলকাতাবাসীর একটি কারণে কৃতজ্ঞ থাকার কারণ ছিল। তিনি কলকাতাকে গুন্ডামুক্ত করিয়াছিলেন।’ প্রবল বিপ্লবী-বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও টেগার্টও শোনা যায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন অগ্রগণ্য দেশব্রতীদের প্রতি। ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, ‘বাঘা যতীন বা অরবিন্দ ঘোষের মতো নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক যদি ইংল্যান্ডে জন্মাতেন, জীবদ্দশাতেই সে দেশে সসম্মানে তাঁদের আবক্ষমূর্তি বসানো হত।’

রসজ্ঞানও পূর্ণ মাত্রায় ছিল টেগার্ট সাহেবের। একটি কাহিনির উল্লেখ করি। এক মহিলা মামলায় হেরে খুব চটেছেন। রাগে ফুটছেন টগবগ। সেই অবস্থায় এলেন টেগার্টের সঙ্গে দেখা করতে। দরখাস্ত করতে চান বন্দুকের লাইসেন্সের।

টেগার্ট প্রশ্ন করলেন মহিলাকে, কী প্রয়োজনে বন্দুক রাখতে চান?

—আমার প্রয়োজন? বন্দুক দিয়ে প্রথমে আমি টেগার্টকে গুলি করে মারতে চাই। তারপর যে ম্যাজিস্ট্রেট আমার মামলা করেছে, তাকে গুলি করব।

টেগার্ট উত্তর দিলেন সহাস্য।

—বেশ তো! কিন্তু লাইসেন্স তো দেওয়া যাবে না আপনাকে। যারা অন্তত দু’বারের বেশি ব্যবহার করবেন বন্দুক, লাইসেন্স শুধু তাদেরই দিয়ে থাকি আমরা!

তৎকালীন শহর কলকাতায় গুন্ডাদমনে টেগার্টের পারদর্শিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি আগে। কলকাতা পুলিশে অতিবাহিত দীর্ঘ কর্মজীবনে কত দাগী অপরাধীকে যে নিজস্ব সোর্স মারফত পাওয়া গোপন খবরের ভিত্তিতে জেলে পুরেছেন, কত দুঃসাহসিক অভিযানে যে নিজে নেতৃত্ব দিয়েছেন অকুতোভয়, হিসাব নেই সত্যিই।

সত্যের স্বার্থে আরও স্বীকার্য, যে দেশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে, সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিতদের ভাগ্যে কখনওই কৃতজ্ঞতা বরাদ্দ হয় না, জোটে না বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন। সরকারি নীতি যতই অপ্রিয় হোক, তার রূপায়ণে সরকারি চাকুরে তো দায়বদ্ধ থাকবেনই। বিবেক সায় না দিলেও থাকবেন, বাধ্যত।

তবু টেগার্ট অন্য ব্রিটিশ অফিসারদের তুলনায় কেন বহুলাংশে নিন্দিত, ধিক্কৃত? কারণ সহজবোধ্য। মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী টেগার্ট ছিঁচকে চোর বা বেপরোয়া ডাকাত বা ত্রাস সৃষ্টিকারী স্থানীয় গুন্ডাদের সঙ্গে বিভাজনরেখা মুছে দিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের।

চোর-ডাকাত-গুন্ডাদের সঙ্গে বিপ্লবীদের গোত্রের ফারাকটি তিনি বিলক্ষণ জানতেন। কিন্তু সরকারের প্রিয়পাত্র হওয়ার নিরন্তর তাগিদে সচেতনভাবেই বিসর্জন দিয়েছিলেন সকল শুভবুদ্ধি। নিছক বিপ্লবীদের গ্রেফতারিতেই ক্ষান্ত থাকতেন না, দমনপীড়নের নিষ্ঠুরতাকে এক অশ্রুতপূর্ব পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজদ্রোহীদের নির্মম নির্যাতন ক্রমে মজ্জাগত হয়ে উঠেছিল তাঁর। অত্যাচারের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন চর্চিত অনুশীলনে।

‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’-র নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বরাবর। উদাহরণ? এক বিপ্লবীকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা চলছে তখন। টেগার্ট ‘অপারেশন’-এর খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন অফিসারদের। যাঁদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলেন, ও তো fire open করতে পারে।

টেগার্ট জবাব দিলেন নির্বিকার।

—তোমরা তাকে fire open করতে দেবে কেন? তার আগেই তোমরা fire করবে।

—কিন্তু স্যার, ধরুন গুলি করলাম, মরে গেল লোকটা। আর তারপর দেখলাম, লোকটার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিলই না। তখন? আইনত পুলিশ ওভাবে নিরস্ত্র লোকের উপর গুলি চালাতে তো পারে না। আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালানো যায়। কিন্তু নিরস্ত্র লোকের ক্ষেত্রে সে যুক্তি তো খাটবে না। Firearms-ই যদি না থাকে?

—In that case you are to find out one.

নির্দেশ জলের মতো পরিষ্কার। অস্ত্র না থাকলে না থাকবে, মৃতদেহের হাতে বা পকেটে বা অন্যত্র অস্ত্র গুঁজে দিতে হবে। যাতে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় অকাট্য।

টেগার্ট এমনই ছিলেন। বিপ্লবী-দমনে নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করেননি কখনও। বিপ্লবী-বিদ্বেষ কী কল্পনাতীত তীব্র ছিল টেগার্টের, এই নিবন্ধের প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদে ইঙ্গিত রয়েছে। রয়েছে নগরপাল থাকাকালীন কিড স্ট্রিটের বাংলোর ছাদে রিভলভার নিয়ে মহড়ার প্রসঙ্গ।

—Let’s start afresh Colson.

—Right Charles!

স্বামীকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন টেগার্টের সহধর্মিণী ক্যাথেরিন। পাণ্ডুলিপিতে টাইপ করা পৃষ্ঠার সংখ্যা ৩৪০। ‘Memoir of an Indian Policeman’ শীর্ষক সেই বই শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। অপ্রকাশিত বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন S G Taylor, যিনি এক সময় বাংলার ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ ছিলেন। পাণ্ডুলিপিতে স্বামীর বীরগাথা রচনা করেছিলেন ক্যাথেরিন। সেখানেই পাওয়া যায় সেই শুটিং প্র্যাকটিসের বিবরণ—

‘He had a life-size sketch of Bengali assassin, levelling a pistol, made on canvas which was kept on the roof and when another officer (usually Mr. Colson, who succeeded him as Commissioner) joined in the practice. It was the custom for one or the other of them, while they did the morning exercise, to give a sudden unpremeditated yell; on this the other had to switch round with his automatic and shoot the canvas gunman in some vital part of his anatomy.’

এহেন টেগার্ট যে বিপ্লবীদের খতমতালিকার শীর্ষে বিরাজ করবেন একচ্ছত্র, প্রত্যাশিতই। তাঁর প্রাণনাশের একাধিক চেষ্টা হয়েছে সমসময়ে। যার একটির পরিকল্পনা করেছিলেন বিপ্লবী চতুষ্টয়, অনন্ত সিংহ, দেবেন্দ্রচন্দ্র দে (খোকা), যাঁর নামে এন্টালির ডি সি দে রোড, গোপীমোহন সাহা (কিছু নথিপত্রে ‘গোপীনাথ সাহা’ রয়েছে, তবে পুলিশ রিপোর্টে এবং মামলা-সংক্রান্ত কাগজপত্রে যেহেতু ‘গোপীমোহন’ আছে, সেই নামটিই ব্যবহৃত এ লেখায়) এবং নগেন্দ্রনাথ সেন (জুলু)।

—এমন সুযোগ আর আসবে না গোপী… মনে আছে তো… ব্যাটা একেবারে মৃত নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালিয়েই যাবি।

.

সকাল ছ’টা নাগাদ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে একটু নার্ভাসই লাগে অনন্তর। সব প্ল্যানমাফিক হবে তো? গোপীকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন, মাথায় ফেজ টুপি, উলের স্কার্ফ জড়িয়েছে কথামতো। খোকা দৃষ্টিপথের বাইরে। জুলুদা নিশ্চয়ই চরকিপাক খাচ্ছে সাইকেলে।

টেনশন কমাতে একটা সিগারেট ধরান অনন্ত। স্রেফ টেনশন কমাতেই নয় অবশ্য, অন্য উদ্দেশ্যও ছিল। সে যুগে বিপ্লবীদের মধ্যে ধূমপানের তেমন চল ছিল না। টেগার্টের জীবনরক্ষায় সদাসতর্ক সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা ছড়িয়ে থাকে তাঁর প্রাতঃভ্রমণের যাত্রাপথে। সিগারেট ঠোঁটে থাকলে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধূমপানে অনভ্যস্ত অনন্তর দম আটকে আসে কাশিতে। কী করে যে এই ধোঁয়া গেলে লোকে?

অপেক্ষা করতে করতে অনন্ত ভাবেন, এই বুঝি গোপীর পিস্তল গর্জে উঠবে, হবে শত্রুনিকেশ। কোথায় কী? সময় যেন আর কাটতে চায় না। কোনও গোলমাল হল?

‘গোলমাল’ যে একটা হয়েছে, অচিরেই জানান দিল সাইকেল নিয়ে ভগ্নদূতের মতো জুলুদার আবির্ভাব।

—এক্ষুনি ডেরায় ফিরে যাও। খোকার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আগুন লেগে গেছে ওর গায়ে। প্রোগ্রাম বাতিল।

অনন্ত হতাশায় ডুবে যান এবং আন্দাজ করতে পারেন ঠিক কী ঘটেছে খোকার সঙ্গে। বোমাতে অগ্নিসংযোগের জন্য পকেটে লোশনের শিশি ছিল। ইয়েলো ফসফরাস আর কার্বন ডাইসালফাইডের মিশ্রণে প্রস্তুত এই লোশনটি খুবই বিপজ্জনক। লোশনটির বিন্দুমাত্রও যদি শিশি থেকে বেরিয়ে পোশাকের কোন সামান্য অংশও ভিজিয়ে দেয়, তবে কার্বন ডাইসালফাইড দ্রুত উড়ে গিয়ে শুধু ফসফরাস পড়ে থাকবে। আর বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে ফসফরাস জ্বলে উঠবেই, জানা কথা।

ঘটেছিল তেমনটাই। কলকাতার রাজপথে ইউরোপিয়ান বেশভূষায় সজ্জিত এক যুবকের পোশাকে আগুন জ্বলছে দেখে থমকে গিয়েছিলেন পথচারীরা।

—সাহেব, ক্যা হুয়া? আগ ক্যায়সে লাগা?

—সিগ্রেট সে লাগ গিয়া…

ফসফরাসের আগুন খুবই বেয়াড়া প্রকৃতির। জল দিয়েও চাপা দেওয়া মুশকিল। যতক্ষণ জলে ভিজে থাকবে, ঠিক আছে। জল একটু শুকিয়ে গেলেই আগুন ফের মাথাচাড়া দেবে। ফসফরাস নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত নিভবে না।

খোকা রাস্তার হাইড্র্যান্ট থেকে জলের ধারা দিয়ে আগুনকে বশে আনার চেষ্টা চালালেন আপ্রাণ। বুঝতে পারছিলেন, আরও ভয়ংকর বিপদ ঘটে যেতে পারে যে-কোনও সময়। প্যান্টের পকেটে রয়েছে পিকরিক পাউডার ভর্তি একটা তাজা বোমা। তাতে gun cotton ফিউজ় লাগানো। কোনওভাবে আগুনের সংস্পর্শে এলেই বিস্ফোরণ ঘটবে এবং মুহূর্তের মধ্যে ভবলীলা সাঙ্গ। বোমাটাকে বার করে কোনওমতে ভিজিয়ে ফেললেন খোকা। টেগার্টকে মারতে গিয়ে নিজেরই প্রাণ নিয়ে টানাটানি তখন।

অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে টেগার্ট-নিধন অপারেশন। তালতলার ডেরায় মিলিত হয়েছেন হতোদ্যম চার বিপ্লবী। খোকা স্যুট খুলে বালতির জলে ডুবিয়ে দিয়েছেন। তবু ধোঁয়া বেরচ্ছে। অনন্ত তীব্র বকাঝকা করছেন খোকাকে।

—কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই তোর? সব সময় অসাবধান। বুকপকেটে সোজা করে রাখতে পারলি না শিশিটা? তোর আহাম্মকির জন্য সব প্ল্যান ভেস্তে গেল।

জুলুদা থামান উত্তেজিত অনন্তকে।

—যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তবে শিক্ষা নেওয়ার আছে আমাদের… টেকনিক্যাল দিকগুলোর ব্যাপারে এবার থেকে ঢের বেশি সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। খোকা তো আজ মরতে মরতে বেঁচে গেল। কী রে গোপী… তুই গোঁজ হয়ে বসে আছিস কেন? মন খারাপ করিস না। টেগার্ট তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। আবার সুযোগ আসবে…

গোপীমোহন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। রাগে মুখ থমথম করছে তার। চোখদুটি রক্তাভ। মাথার শিরা দপদপ করছে। স্বপ্নপূরণের উত্তেজনায় আগের রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। টেগার্টকে গত তিন মাস ধরে দূর থেকে অনুসরণ করেছে সে। কেমন দেখতে, কী পোশাক কখন পরেন, হাঁটার ভঙ্গিটাই বা কীরকম, সব। শেষে তীরে এসে তরী ডুবল অসাবধানে। জুলুদা বলছে, আবার সুযোগ আসবে। আর অনন্তদা গতকাল বলছিল, এমন সুযোগ আর আসবে না। কার কথা বিশ্বাস করবে? মাথা আর কাজ করছে না তার। কারও ভরসায় আর থাকবে না সে। যা করার, একাই করবে এবার। একাই মারবে টেগার্টকে।

এবং একাই মরিয়া চেষ্টা করলেন গোপীমোহন, কিছুদিন পর। সঙ্গী বিপ্লবীদের কাউকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না দিয়ে।

.

১২ জানুয়ারি, ১৯২৪। সকাল সোয়া সাতটা, বড়জোর সাড়ে সাত। সাদা ধুতি আর ঝোলা খাকি শার্ট পরিহিত গোপীমোহন দাঁড়িয়ে রয়েছেন পার্ক স্ট্রিট আর চৌরঙ্গি রোডের সংযোগস্থলে। ঘোরাঘুরি করছেন ইতস্তত। যেমন রোজই করেন টেগার্টকে অসতর্ক মুহূর্তে পেয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। সাহেব অতি ধূর্ত। রোজ মর্নিং ওয়াকে বেরোন না। যে ক’দিন বেরোন, রোজ আলাদা রাস্তা দিয়ে ফেরেন। তা ছাড়া সাদা পোশাকের টিকটিকিরা তো থাকেই আশেপাশে।

স্নায়ু হঠাৎই সজাগ হয়ে ওঠে গোপীর। আরে, মোড়ের বড় দোকান ‘Hall and Anderson’-এর সামনে কে দাঁড়িয়ে উনি? দোকান খোলেনি এখনও, বাইরে থেকেই কাচের শো-কেসে সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রে চোখ বোলাচ্ছেন দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। কে উনি? ভীষণ চেনা লাগছে তো!

কাছে গিয়ে পিছন থেকে এক ঝলক দেখেই নিশ্চিত হয়ে যান গোপী। আরে, যা ভেবেছি তা-ই, এ তো স্বয়ং টেগার্ট! দাঁড়ানোর ওই ভঙ্গি তার ভীষণ পরিচিত। খয়েরি রঙের লম্বা ওভারকোটটাও। অবশেষে! অবশেষে নাগালের মধ্যে প্রবল পরাক্রমী পুলিশ কমিশনার! যাঁকে খতম করা মানে ব্রিটিশরাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া।

উত্তেজনার বশে এক মুহূর্তও দেরি করলেন না গোপীমোহন। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন কয়েক হাত পিছনে, তড়িঘড়ি চাপলেন ট্রিগার। টেনশনে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আওয়াজে সচকিত সাহেব ঘুরে তাকানোর আগেই ফের ছুটল বুলেট। এবার লক্ষ্যভেদ। ফুটপাথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহে বুলেটবৃষ্টি করলেন গোপী। ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। মৃত্যু নিশ্চিত করতেই হবে।

ততক্ষণে লোক জমে গেছে আশেপাশে। পার্ক স্ট্রিট ধরে ছুটলেন গোপী। ধাওয়া করলেন কিছু পথচারী, পিছু নিল একটি ট্যাক্সিও। যা লক্ষ্য করে গোপী গুলি ছুড়লেন, পথচলতি একটি মোটরগাড়ি থামিয়ে চেষ্টা করলেন উঠতে। চালক অসম্মত হতে গুলি চালালেন ফের। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বুলেট। একটি ঘোড়ার গাড়ির পাদানিতে উঠে পালানোর শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হল। ধরে ফেলল পুলিশ। গোপীর কাছ থেকে উদ্ধার হল একটি বড় পিস্তল, একটি রিভলভার এবং চল্লিশটি তাজা কার্তুজ।

লালবাজার নিয়ে যাওয়ার পথে এক প্রস্থ এলোপাথাড়ি মারধর প্রথমে। তারপর আসামিকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল নগরপালের ঘরে। এবং ঢুকেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল গোপীমোহনের। এ কী! কমিশনারের চেয়ারে স্বমহিমায় বসে টেগার্ট! যাঁকে একটু আগেই বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়ে এসেছেন প্রকাশ্য রাজপথে!

স্তব্ধবাক্ গোপীমোহনের দিকে তাকিয়ে তখন বিদ্রুপের হাসি ছুড়ে দিচ্ছেন কমিশনার— ‘So you thought you’d killed Charles Tegart?’

গোপী অচিরেই বুঝলেন, মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন। টেগার্ট ভেবে খুন করে ফেলেছেন অনেকটা তাঁরই মতো দেখতে এক নিরপরাধ ইংরেজ নাগরিককে। নাম Ernest Day, এক বেসরকারি সংস্থার আধিকারিক। মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই। টেগার্ট জীবিত এবং বহাল তবিয়তেই। যাকে বলে, ‘alive and kicking’!

চোখে অন্ধকার দেখেন গোপী, বসে পড়েন মুখ ঢেকে। এত বড় ভুল কী করে হল? একটা নির্দোষ লোককে মেরে ফেললাম, আর টেগার্টের শরীরে এবারও আঁচড়টুকুও কাটা গেল না?

পরের দিনের খবরের কাগজে শিরোনাম, ‘Mistaken identity saves Tegart’, আর বাংলা কাগজে, ‘দৈবক্রমে স্যার চার্লস টেগার্টের জীবনরক্ষা। চৌরঙ্গীর উপর মিঃ আর্নেস্ট ডে নৃশংসভাবে নিহত। গোপী সাহা নামে একজন যুবক ঘটনাস্থলে ধৃত’।

এভাবেই কতবার যে বেঁচে গেছেন টেগার্ট! ভাগ্যের অলৌকিক কৃপাদৃষ্টি ছিল তাঁর উপর। গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া বোমা কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে অল্পের জন্য, কখনও কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা থাকলেও যাননি শেষ মুহূর্তে, সশস্ত্র বিপ্লবীদের ওত পেতে থাকার গোপন খবর পেয়ে। ১৯৩০ সালের ২৫ অগস্ট যখন লালবাজারে আসছেন বেলা এগারোটা নাগাদ, ডালহৌসির কাছে টেগার্টের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন দুই বিপ্লবী, দীনেশচন্দ্র মজুমদার এবং অনুজাচরণ সেনগুপ্ত। প্রবল শব্দে বোমা ফাটে গাড়ির বাঁ দিকে। এক চুলের জন্য রক্ষা পান টেগার্ট। পকেটে রাখা বোমা ফেটে অকুস্থলেই প্রাণ হারান অনুজা। পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয় দীনেশের।

১৯৩১ সালে কলকাতা ছাড়লেন টেগার্ট, ‘Secretary of State’s Indian Council’-এ মনোনীত হয়ে। বাংলার বিপ্লবীদের চিরকালীন আক্ষেপ হয়ে রইল টেগার্ট-হত্যায় ব্যর্থতা।

.

গোপীমোহনের বাঁচার রাস্তা ছিল না কোনও। ভবিতব্য ছিল মৃত্যুদণ্ডই। কারাবাসকালীন নির্যাতন সহ্য করেছিলেন অকথ্য। বিচারপর্বের শেষে ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ সেশন জজ মি. পিয়ার্সনের এজলাসে যখন ফাঁসির রায় ঘোষিত হচ্ছে, আদালতে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি টেগার্টকে মারতে চেয়েছিলাম। একজন নিরপরাধ মানুষকে মেরেছি বলে অনুশোচনার শেষ নেই আমার। মৃতের পরিবারের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু টেগার্টের ক্ষমা নেই। অত্যাচারী কমিশনারের প্রাণনাশ নিশ্চয়ই করবেন আমার কোনও দেশপ্রেমিক সহযোদ্ধা, যিনি আমার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করবেন, আমার থেকে অনেক বেশি যত্নবান হবেন হত্যার সময়। আমার প্রতি বিন্দু রক্ত ভারতের প্রতিটি ঘরে আমার মতো একনিষ্ঠ বিপ্লবী গড়ে তুলুক।’

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ধার্য হয়েছিল ১৯২৪-এর পয়লা মার্চ। ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান’-এর দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হল হুগলির যুবক গোপীমোহন সাহার নাম। যাঁর নামে একটি সেতু রয়েছে শ্রীরামপুরে।

গোপীমোহনের ফাঁসিতে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, শুধু বাংলায় বা পূর্ব ভারতে নয়, দেশ জুড়ে। ১৯২৪-এর ২ জুন সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গোপীমোহনের আত্মবলিদানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রস্তাব আনলেন। অহিংসার আদর্শে একনিষ্ঠ কংগ্রেসে ‘সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধি’-র ইঙ্গিতে নড়ে চড়ে বসল ব্রিটিশ প্রশাসন। বাংলার তৎকালীন ‘Intelligence Branch’ (আইবি)-র গোপন রিপোর্ট ‘Brief note on the alliance of Congress with terrorism in Bengal’-এ বলা হল—

‘গোপী সাহা প্রস্তাব পাস। কংগ্রেসের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী প্রভাব বৃদ্ধি।

১৯২৪ সালে স্বরাজ্য পার্টির সন্ত্রাসবাদী সভ্যরা কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসাররূপে সুভাষচন্দ্র বসুর মনোনয়ন সমর্থন করে এবং লক্ষ করবার বিষয় যে তাঁহার এই পদে নিয়োগের পর কর্পোরেশনের বহু চাকরি সন্ত্রাসবাদীদের দেওয়া হইতেছে।

সিরাজগঞ্জ কংগ্রেস কনফারেন্সে শ্রী সি আর দাশ তাঁহার সন্ত্রাসবাদী সমর্থকদের সাহায্যে তাঁহার হিন্দু-মুসলমান প্যাক্ট প্রস্তাব এবং তাঁহাদের এই সমর্থনের বিনিময়ে তিনি মিঃ ডে-র আততায়ী গোপী সাহার প্রশংসা সম্বলিত ঘৃণ্য প্রস্তাব পাস করাইয়াছেন। যাহার অর্থ বাংলার যুবকদের সেই আততায়ীর উদাহরণ অনুসরণ করিতে উত্তেজিত করা।’

সরকারের সমর্থক ইংরেজি পত্র-পত্রিকাগুলিতে তুমুল হইচই শুরু হল গোপীমোহনের সমর্থনে প্রাদেশিক কংগ্রেসে পাশ হওয়া প্রস্তাব নিয়ে। কংগ্রেস মুখে অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলে। সন্ত্রাসের নিন্দা করে। অথচ এক নিরপরাধ নাগরিকের খুনিকে সেই কংগ্রেসেরই প্রাদেশিক সম্মেলন শহিদের মর্যাদা দিচ্ছে? এ কেমন দ্বিচারিতা, প্রশ তোলা হল সরকারপক্ষের তরফে।

প্রশ্নের উত্তর দিতে আসরে নামলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। প্রস্তাবটি যে ভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, তা ছিল এরকম, ‘Although eschewing all kinds of violence and accepting the character and basic principle of non-violence, this conference make known its respect for Gopimohon Saha for the noble self sacrifice which he bearing in mind a high and noble ideal, has made for the preservation of the interests of the motherland.’

অর্থাৎ, ‘এই সম্মেলন সমস্ত প্রকারের হিংসার পরিপন্থী এবং অহিংসার নীতি আদর্শে বিশ্বাসী। তবু, গোপীমোহন সাহাকে শ্রদ্ধা জানাই তাঁর মহৎ আত্মবলিদানের জন্য। তাঁর এই আত্মত্যাগের নেপথ্যে ছিল দেশমাতৃকার স্বার্থরক্ষার মহতী আদর্শ।’

চিত্তরঞ্জন জানালেন, প্রস্তাবটি পাশ হয়েছিল বাংলায়। ইংরেজি অনুবাদের গোলমালে ভুল বার্তা প্রচারিত হচ্ছে। আসল প্রস্তাবটির ইংরেজি অনুবাদ হওয়া উচিত এরকম—

‘This conference, while denouncing (or dissociating itself from) violence (every kind of himsas) and adhering to the principle of non-violence, appreciates Gopimohon Saha’s ideal of self-sacrifice, misguided though that is in respect of the best interest of the country, and expresses its respect for this self-sacrifice.’

মানে, বাংলার পাশ হওয়া মূল প্রস্তাবে শুধু বলা হয়েছিল, ‘এই সম্মেলন সমস্ত রকম হিংসাকে নিন্দনীয় মনে করে (হিংসা থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেও অঙ্গীকারবদ্ধ) এবং বিশ্বাস রাখে অহিংসার নীতি-আদর্শে। গোপীমোহন যদিও দেশের স্বার্থরক্ষার নিরিখে সেই আদর্শ থেকে দিকভ্রষ্ট হয়েছিলেন, তবুও তাঁর আত্মবলিদানকে এই সম্মেলন প্রশংসার যোগ্য মনে করছে এবং তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।’

টেগার্ট স্বয়ং অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন চিত্তরঞ্জনের ব্যাখ্যা শুনে। ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, এ স্রেফ ভাষার কারসাজি ছাড়া কিছু নয়। এ তো নিন্দার মোড়কে প্রশংসাই।

গোপীর ফাঁসির কয়েক সপ্তাহ পরে টেগার্ট ডাকঘরের মাধ্যমে একটি টাইপ করা নোটিস পান।

BANDE MATARAM

Notice

The public is hereby informed that the Bengal Revolutionary council has passed a resolution of a campaign of ruthless assassination of Police Officers. Anyone in any way actively or passively putting obstruction to our comrade when in action or retiring or helping the government of this country as by taking brief from the government or giving evidence in favour of prosecution etc. when such comrade is in the hands of the government, or inciting the government to take repressive measures shall be considered as doing acts highly prejudicial to the best interest of our country and from the moment any such action taken by anyone, he shall be considered as condemned to be despatched forthwith.

PRESIDENT-IN-COUNCIL, RED BENGAL

.

গোপীমোহনের কাহিনিতে পূর্ণচ্ছেদ পড়ার আরও বাকি ছিল। সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে তীব্র বিতর্ক হয় গোপীর বিষয়ে দলের অবস্থান নিয়ে। গোপীর সপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন। বিপক্ষে ছিলেন অহিংসার আদর্শে স্থিত মহাত্মা গাঁধী। চিত্তরঞ্জনের প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছিল সামান্য কয়েকটি ভোটে। গোপীর সমর্থনে ভোটের সংখ্যা দেখে স্তম্ভিত গাঁধীজি বুঝেছিলেন, এ জয় একপ্রকার হারারই সামিল। বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘Defeated and humbled.’

মৃত্যুর দিনদুয়েক আগে প্রেসিডেন্সি জেলের প্রহরীর থেকে গোপী চেয়ে নিয়েছিলেন কাগজ-কলম। শেষ চিঠি লিখেছিলেন গর্ভধারিণীকে। যার নির্যাস তুলে দিলাম নীচে।

‘শ্রীচরণেষু মা,

সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা কোরো ভারতের প্রতিটি সংসার যেন তোমার মতো মা লাভ করে ধন্য হয় আর তাঁরা যেন তোমার গোপীর মতো সন্তান প্রসব করেন, যারা অক্লেশে প্রাণ দেবে দেশের জন্য।

তোমার স্নেহের গোপী।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *