সপ্তম অধ্যায় — স্বার্থপরতা ও সম্পত্তি
পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে ভয় সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে, বর্তমান অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়টিও ভয়ের মতোই প্রবল আবেগসঞ্জাত, আংশিকভাবে প্রবৃত্তি হইতে উৎপন্ন এবং বিশেষভাবে অবাঞ্ছনীয়। এই রকম ক্ষেত্রে শিশুর স্বভাবকে হঠাৎ বাধা দিয়া সংশোধনের চেষ্টা বা তাহাকে মনোমতোভাবে চালাইবার চেষ্টা করা কখনই উচিত হইবে না। শিশুর স্বভাব এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে উদাসীন থাকায় কোনো লাভ নাই কিংবা শিশুর প্রকৃতি যদি অনুরূপ হইত তবে ভালো হইত মনে মনে কেবল এরূপ আশা করিয়াও কোনো উপকার হইবে না। শিশুকে তাহার স্বভাব ও প্রকৃতিজাত আবেগসহ কাঁচামালরূপে [Raw material] গ্রহণ করিতে হইবে। তারপর উপযুক্ত শিক্ষার ভিতর দিয়া এমনভাবে তাহার প্রবৃত্তিগুলির বিকাশ ঘটাইতে হইবে যাহাতে বাঞ্ছনীয় আচরণগুলি তাহার জীবনে অভ্যস্ত হইয়া যায়।
স্বার্থপরতা : যতই বিশ্লেষণ করা যায় ততই ইহা অস্পষ্ট হইতে থাকে। কিন্তু শৈশবে শিশুর জীবনে ইহা সুস্পষ্ট আকারে প্রকাশ পায়; এবং ইহার ফলে যে সমস্যার উদ্ভব হয় তাহার সমাধান একান্ত আবশ্যক। কোনোরূপ শিক্ষা না দিলে একজন শিশু তাহার অপেক্ষা কম বয়সীর খেলনা কাড়িয়া লইবে, নিজের ভাগ অপেক্ষা বেশি দাবি করিবে এবং তাহার কমবয়সী নিরাশ হউক আর নাই হউক সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করিয়া নিজের বাসনা পূর্ণ করিতেই চেষ্টা করিবে। বাহিরের চাপে যদি নিয়ন্ত্রিত ও সংযত না হয় তবে গ্যাসের মতো মানুষের সাহসিকতাও ক্রমেই বিস্তার লাভ করে। এ ব্যাপারে শিক্ষার উদ্দেশ্য হইল মানুষের ক্রমবর্ধমান স্বার্থপরতাকে সংযত করিবার জন্য বাহিরের চাপ প্রয়োগ করা; এ চাপ শিশুকে কিল, চড় বা অন্য শাস্তিদান নয়, শিশুর মনে সহানুভূতি, ভাল ভাব ও সদভ্যাস গড়িয়া তোলা। শিশুর মনে ন্যায় বিচারের ভাবটি দৃঢ় করিতে হইবে, আত্মত্যাগের ভাব নয়। সংসারে প্রত্যেক লোকেরই কিছু স্থানের উপর অধিকার আছে; সে যদি তাহার নিজের প্রাপ্য অধিকারের জন্য দণ্ডায়মান হয় তবে তাহাকে দোষ দেওয়া উচিত নয়। যখন স্বার্থত্যাগ শিক্ষা দেওয়া হয় তখন হয়তো (শিক্ষাদাতার) উপদেষ্টার মনে এই ধারণা বিদ্যমান থাকে যে, ইহা পুরাপুরি মাত্রায় অনুসরণ করা হইবে না; কাজেই বাস্তব ফল প্রায় ঠিকই হইবে অর্থাৎ ন্যায়সঙ্গতভাবে যেটুকু তাহার প্রাপ্য তাহার দাবি সে ছাড়িবে না। কিন্তু কার্যত লোকে এরূপ উপদেশ গ্রহণ করিতে পারে না কিংবা নিজেদের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করিতেও মনে মনে পাপ ও সঙ্কোচ বোধ করে, আর না হয় হাস্যকরভাবে আত্মত্যাগের চরম নিদর্শন দেখায়। যদি কেহ নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকার পর্যন্ত ত্যাগ করে তবে যাহার জন্য ত্যাগ করা হইল ত্যাগীর মনে তাহার প্রতি ক্ষীণ আক্রোশ লুক্কায়িত থাকে; স্বার্থপরতা কৃতজ্ঞতা লাভের বাসনার ছদ্মবেশে তাহাদের মনে মনের পিছন-দরজা দিয়া প্রবেশ করে। যাহাই হোক আত্মত্যাগ সত্য নীতি বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না, কেননা ইহাকে সর্বজনীন করা সম্ভবপর নয়। যাহা সত্য নয় তাহাকে গুণের উপায় হিসাবে শিক্ষা দেওয়া কখনোই সমীচীন নয়, কারণ মিথ্যা ধরা পড়িলেই গুণও কর্পূরের মতো উবিয়া যায়। পক্ষান্তের ন্যায়বিচার সকলের পক্ষে সমানভাবে প্রযোজ্য; ইহা সর্বজনীন। কাজেই শিশুর অভ্যাসে ও চিন্তায় আমাদিগকে ন্যায়ের ধারণা অনুপ্রবেশ করাইতে হইবে।
ন্যায়বিচার শিখানো : সঙ্গিনীর শিশুকে ন্যায়বিচার শিখানো অসম্ভব না হইলেও কঠিন। বয়স্ক ব্যক্তির অধিকার ও বাসনা এবং শিশুর আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে এত বেশি পার্থক্য যে, এগুলি শিশুর মনে কোনো সাড়া জাগায় না। একই প্রকার আনন্দলাভের জন্য উভয়ের মধ্যে কোনোরূপ সাক্ষাৎ প্রতিযোগিতাও নাই; অধিকন্তু বয়স্ক লোকেরা জোর করিয়া অন্যকে দিয়া তাহাদের দাবি পূরণ করাইতে পারে, কাজেই তাহাদের বিচারক তাহারা নিজেরাই। তাহাদের স্বার্থের সঙ্গে শিশুর স্বার্থের দ্বন্দ্ব রাখিলে শিশুরা নিরপেক্ষ লোকের নিকট হইতে ন্যায়বিচার পাইল বলিয়া ধারণা করিতে পারে না। বয়স্ক লোকেরা শিশুদের আচরণ সম্বন্ধে উপদেশ দিতে পারে, যেমন মা যখন কিছু গুনিতেছেন তখন মাঝখানে বাধা দিয়ো না, বাবা, যখন কাজ করেন তখন চিৎকার করো না, যখন বাড়িতে আগন্তুক আসে তখন কিছুর জন্য বায়না ধরো না ইত্যাদি। শিশুরা যদি অন্য সময় সদয় ব্যবহার পায় তবে উপদেশ মানিয়া লইয়া সংযত আচরণ করে কিন্তু ইহার যুক্তিযুক্ততা তাহারা বুঝিতে পারে না। শিশুদিগকে এরূপ নিয়ম মানিতে বাধ্য করা উচিত, কেননা তাহাদিগকে যথেচ্ছাচারী হইতে দেওয়া সঙ্গত। ইহা ছাড়া তাহাদিগকে ইহাও বুঝিতে হইবে যে অন্যলোকের কাছে তাহাদের কাজের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। কিন্তু এরূপ শিক্ষার ফলে শিশুদের নিকট হইতে বাহিরে-দেখানো ভদ্র আচরণ ছাড়া আর কিছু আশা করা যাইবে না; যখন শিশুর সমবয়সী অন্য বালক-বালিকা থাকে কেবল তখনই তাহার মনে ন্যায়বিচার সম্বন্ধে যথার্থ ধারণা জন্মানো যায়। শিশুকে বহুদিন একাকী সাথীবিহীন অবস্থায় না রাখার পক্ষে ইহা একটি যুক্তি বটে। যে দম্পত্তির একটিমাত্র সন্তান তাহাদিগকে মাঝে মাঝে শিশুর জন্য সঙ্গীর ব্যবস্থা করিতে হইবে। ইহার জন্য শিশুকে সাময়িকভাবে কাছছাড়া করিতে হইলে তাহা করা উচিত। নিঃসঙ্গ শিশুর বাসনাগুলি বয়স্ক ব্যক্তির হাতে নিগৃহীত, দমিত হয়, অথবা সে স্বার্থপর হইয়া বাড়িয়া উঠে।
কোনো পরিবারের একমাত্র শিশু যদি দ্র আচরণে অভ্যস্ত হয় তবে সে হয় অনুকম্পার পাত্র, আর যদি অভদ্র ব্যবহার শেখে তবে হয় বিরক্তিজনক। সমবয়সীদের সঙ্গলাভে বঞ্চিত হইলে শিশুর মনের অনেকগুলি গুণ পরিপূর্ণভাবে বিকাশের সুযোগ পায় না। সঙ্গীবিহীন শিশু সর্বদা বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকিলে তাঁহাদের উপদেশ পালন করিতে শেখে বটে কিন্তু সেইরূপ জোর করিয়া চাপানো আচরণ তাহার কাছে প্রীতিপ্রদ হইতে পারে না। নিরূপায় হইয়া সে প্রাণহীনভাবে কতকগুলি বাঁধাধরা ভদ্র আচরণ পালন করে। তাই সে কৃপার পাত্র। পক্ষান্তরে পিতামাতার অতিরিক্ত আদর যত্ন লাভ করিয়া শিশু যদি আত্মসর্বস্ব, স্বার্থপর, আবদারের হইয়া ওঠে তবে তাহার আচরণ অন্যের বিরক্তি উৎপাদন করে।
বর্তমানে ছোট পরিবারের সংখ্যাই বেশি; এজন্য অনেক পরিবারে শিশুর শিক্ষায় এই দিকটি সমস্যা সৃষ্টি করে। নার্সারি স্কুল এরূপ ক্ষেত্রে উপকারে আসে। সেখানে সমবয়সী শিশুদের পরস্পর মিলিয়া খেলা করিবার সুযোগ শিশুর জীবন গঠনে বিশেষ কাজে লাগে। এ সম্বন্ধে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে। বর্তমানে শিশুর স্বার্থপরতা কিভাবে দূর করা যায় তাহা আলোচনা করিবার সময় ধরিয়া লওয়া হইতেছে যে, পরিবারের অন্তত দুইটি প্রায় সমবয়সী শিশু আছে; তাহাদের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না হওয়ায় তাহাদের রুচিও প্রায় একইরূপ হইবে।
যেখানে খেলনা আছে মাত্র একটি অথবা খেলার আনন্দ একেবারে মাত্র একজন করিয়া উপভোগ করিতে পারে; যেমন ঘোট ঠেলাগাড়িতে চড়া, সেখানের শিশু সহজেই ন্যায়বিচার বুঝিতে পারে। অবশ্য প্রথমে সে অন্যকে বাদ দিয়া নিজেই সবটা আনন্দভোগ করিতে চায় কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তিরা যখন নিয়ম করিয়া দেন একজনের পর আর একজন পরপর সকলেই আনন্দ ভোগ করিবে, তখন শিশু তৎক্ষণাৎ রাজি হয়। ন্যায়বিচার বোধ যে শিশুর সহজাত তাহা মনে করিবার কোনো কারণ নাই। তবে কত শীঘ্র এ বোধ সৃষ্টি করা যায় তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। বিচার অবশ্য প্রকৃতই ন্যায় বিচার হওয়া চাই, কোনো একজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকিলে চলিবে না। আপনি যদি কোনো শিশুকে অপরের অপেক্ষা বেশি ভালোবাসেন, লক্ষ্য রাখিবেন তাহাদিগকে আনন্দ দিবার সময় আপনার আচরণে যেন পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ না পায়। এটা সর্বসম্মত নীতি যে একই বাড়ির শিশুদের খেলনা সমান হওয়ার দরকার।
ন্যায় বিচার ও নীতি উপদেশ : শিশু যখন ন্যায় বিচার দাবি করে তখন শুধু নীতি উপদেশে ভুলাইয়া রাখিলে কোনো ফল হইবে না। ন্যায়সঙ্গতভাবে যেটুকু তাহার প্রাপ্য তাহার তুলনায় বেশি দিবেন না কিন্তু ইহাও আশা করিবেন না যে, সে কিছু কম লইয়াই সন্তুষ্ট থাকুক। The Fair Child Family পুস্তকে অন্তরের গুপ্ত পাপ [The Secret Sins of the Heart] শীর্ষক একটি অধ্যায় আছে, যে যে প্রণালী বর্জন করা উচিত এখানে তাহার উল্লেখ আছে। লুসি জানে সে ভাল মেয়ে কিন্তু তাহার মা তাহাকে বলেন যে, তাহার আচরণ দৃশ্যত ভাল হইলেও তাহার চিন্তাগুলি খারাপ। তিনি বাইবেল হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলেনঃ হৃদয় সবচেয়ে বেশি প্রবঞ্চনাপূর্ণ এবং ভীষণ পাপে ভরা শ্ৰীমতী Fairchild তাঁহার মেয়ে লুসিকে একখানি ছোট খাতা দিলেন, তাহার বাইরের আচরণ যখন ভালো, তখন হৃদয়ে যে পাপ উঁকিঝুঁকি মারে তাই এই খাতায় লিখিয়া রাখিতে হইবে। একদিন প্রাতভোজনের সময় লুসির পিতামাতা তাহার বোনকে একটি ফিতা এবং তাহার ছোট ভাইকে চেরি ফুল দিলেন কিন্তু তাহাকে কিছুই দেওয়া হইল না। এই বিষয়ে লুসি তাহার খাতায় লিখিয়া রাখিল আমার মা-বাবা আমার অপেক্ষা ছোট ভাইবোনকে বেশি ভালোবাসে এই পাপচিন্তা আমার মনে উদয় হইয়াছিল। তাহাকে শিখানো হইয়াছিল এবং সে বিশ্বাসও করিত যে, নৈতিক-মানসিক শাসন দ্বারা এই পাপচিন্তা দূর করিতে হইবে। কিন্তু এইরূপ করিলে মনের স্বাভাবিক বাসনাকে শুধু দাবাইয়া রাখা হইবে এবং পরবর্তিকালে এই নিগৃহীত বাসনাই নূতন ও বিকৃত আকারে আত্মপ্রকাশ করিবে। এ ব্যাপারে প্রকৃত পন্থা ছিল–লুসির পক্ষে তাহার মনের কথা প্রকাশ করা এবং তাহার পিতা-মাতার পক্ষে উচিত ছিল লুসিকে কোনো উপহার দিয়া অথবা তখন দিবার মতো অন্য কোনো কিছু না থাকায় দেওয়া গেল না, পরে তাহাকেও দেওয়া হইবে ইহা বুঝাইয়া তাহার পিতামাতার ন্যায় বিচার ও পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে যে সন্দেহ জাগিয়াছিল তাহা নিরসন করা। সত্য কথা খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করিলে তাহা সন্দেহ দূর করে কিন্তু শুষ্ক নৈতিক উপদেশ দিয়া ও শাসন করিয়া ইহা দমন করিতে গেলে ইহাকে শুধু বাড়াইয়া দেওয়া হয়। সম্পত্তি বোধ :
ন্যায় বিচারের সহিত আরও একটি বিষয়ের নিবিড় সম্বন্ধ আছে; ইহা হইল সম্পত্তি বোধ অর্থাৎ কোনো জিনিস নিজের অধিকারে রাখিবার আত্মপ্রসাদ। এই মনোভাবটির ভালো এবং মন্দ উভয় দিকই আছে। কাজেই ইহাকে অতিরিক্ত উৎসাহ দিলে যেমন ক্ষতিকর হইতে পারে, শাসন দ্বারা দাবাইয়া রাখিলেও তেমনি শিশুর সুস্থ আত্মবিকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি করিতে পারে। এ সম্পর্কে শিশুর সঙ্গে কিরূপ আচরণ করিতে হইবে তাহার বাধা-ধরা নিয়ম ঠিক করিয়া দেওয়া যায় না। শিশুর প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝিয়া কিরূপ আচরণ করা সঙ্গত তাহা নির্ণয় করিতে হইবে। তবে এরূপ ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত।
শিশুর সম্পত্তি-প্রীতি যদি খুব বেশি হয় তবে পরবর্তী জীবনে ইহা হইতে অনেক দুর্বিপাকের সৃষ্টি হইতে পারে; পৃথিবীতে যত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতা অনুষ্ঠিত হয়, যত মতবাদ, কলহ ও দ্বন্দ্ব মানবসমাজকে আলোড়িত করে তাহার অন্যতম কারণ মূল্যবান সম্পত্তি হারানোর ভয়। কাজেই যতদূর সম্ভব নরনারী যাহাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর ভীতি না করিয়া সুখি হইতে পারে এইরূপ মনোভাব গড়িয়া তোলাই বাঞ্ছনীয়, অর্থাৎ কেবল নিজেদের সম্পত্তির রক্ষামূলক কাজে লিপ্ত না থাকিয়া তাহারা যাহাতে সৃজনাত্মক কাজে আনন্দ পাইতে পারে এইরূপ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এইজন্য শিশুদের সম্পত্তির অধিকার-বোধ উগ্রভাবে বাড়িতে না দেওয়া ভাল। তবে এই সম্বন্ধে মনে রাখিতে হইবে যে, কোনো জিনিসের অধিকার পাইবার বাসনা শিশুর জীবনে অত্যন্ত প্রবল থাকে। শিশু যখন দৃষ্ট জিনিস ধরিতে পারে, যখন তাহার হস্ত ও চক্ষুর মধ্যে সামঞ্জস্য সাধিত হয় তখন হইতেই এই অধিকার লাভের বাসনা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। যাহা সে হস্তে চাপিয়া ধরে তাহাই সে নিজের মনে করে এবং কাড়িয়া লইলে রাগান্বিত হয়। শিশুর যদি খেলনা না থাকে তবে সে ভাঙা কাঠি, ইটের টুকরা এবং এইটা সেইটা কুড়াইয়া আনিলে নিজের সম্পত্তি বলিয়া জমাইয়া রাখিবে। জিনিস থাকিলে শিশু তাহার যত্ন লইতে শেখে এবং ধ্বংস করা মনোবৃত্তি কমিয়া যায়। শিশু নিজে যাহা নিজের জন্য তৈয়ার করিয়া লয় তপ্রতি তাহার মমতা ও গর্ববোধ খুব বেশি। সম্পত্তির উপর অধিকার-বোধ জন্মিতে না দিলে শিশুর গঠন করার আবেগ আহত করা হয়।
পূর্বে বলা হইয়াছে যে শিশুর সম্পত্তির উপর অধিকার-বোধের অপকারিতা আছে, উপকারিতাও আছে। ইহাকে উৎসাহ দিয়া বৃদ্ধি করা যেমন ক্ষতিকর, দমন করাও তেমনি অপকারী। কি উপায়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করিয়া শিশুর সহিত আচরণ করা উচিত তাহা আলোচনা করা যাক।
খেলার মধ্যে কতক হইবে শিশুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, কতক হইবে সকলের সাধারণ সম্পত্তি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দোলনা, ঘোড়া সর্বদাই সাধারণ সম্পত্তি হইবে। ইহা হইতে একটি নীতি ঠিক করা যায় : যেখানে খেলনাটি ব্যবহার করিয়া সকলে আনন্দ পায় কিন্তু ব্যবহার করিতে হয় একে একে একজনের পর আর একজন পালা করিয়া সেখানে ইহা যদি বেশ বড় এবং দামি হয় তবে ইহাকে সাধারণ সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করা সঙ্গত। পক্ষান্তরে শিশুদের বয়সের কমবেশি হওয়ায় যদি কোনো খেলনা সকলের পক্ষে সমান আকর্ষণীয় না হয় তবে ইহা যাহাকে সবচেয়ে আনন্দ দেয় তাহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হইতে পারে। যদি কোনো খেলনা নাড়াচাড়া করিতে যত্নের প্রয়োজন হয় যাহা কেবল একটু বয়স্ক শিশুরাই করিতে পারে তবে ছোটদের হাতে দিয়া তাহা নষ্ট করিয়া ফেলা উচিত নয়। ছোট শিশুকে বরং তাহার বয়সের উপযোগী পুতুল বা খেলনা দিয়া তাহার অভাব পূরণ করা চলে। দুই বৎসর বয়সের পর শিশু যদি নিজের দোষে পুতুল ভাঙিয়া ফেলে তবে সঙ্গে সঙ্গে আবার নূতন খেলনা দিবেন না; খেলনার অভাব তাহাকে কিছুদিন বুঝিতে দিতে হইবে। শিশু যাহাতে তাহার খেলনা অন্য ছেলেকে খেলিতে দিতে সর্বদা অসম্মত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখিবেন। শিশুর যদি বেশি খেলনা থাকে তবে সে যেইগুলি ব্যবহার করে না, সেইগুলি অন্য শিশুর খেলার জন্য দিতে তাহাকে আপত্তি করিতে দিবেন না। তবে যে খেলনা অন্য শিশু হয়তো ভাঙিয়া ফেলিতে পারে কিংবা যে খেলনা দিয়া ইহার মালিক নূতন কিছু তৈয়ার করিয়াছে তাহা অন্যের হাতে না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়; যতদিন না সে তাহার সৃষ্টির কথা ভুলিয়া না যায় ততদিন তাহার পরিশ্রমের পুরস্কারস্বরূপ ইহা রাখা উচিত। এই ব্যতিক্রমটুকু মনে রাখিয়া শিশুর খেলার সরঞ্জাম দিয়া অন্য শিশুকে খেলিতে দিতে হইবে। শিশু হয়তো অনেক সময় স্বেচ্ছায় এইরূপ ভদ্র আচরণ করিবে না। সে ক্ষেত্রে কঠোর হওয়াই উচিত। শিশুর কোনো জিনিস অন্য কেহ হাতে লইলেই যে তৎক্ষণাৎ তাহার হাত হইতে তাহা কাড়িয়া লইবে এরূপ আচরণ কখনই বরদাস্ত করিবেন না। বয়স্ক শিশু যদি অপেক্ষাকৃত ছোট শিশুর প্রতি অসদয় ব্যবহার করে আপনিও তাহার প্রতি দ্রুপ ব্যবহার করুন এবং কেন আপনি ওইরূপ করিলেন তাহা সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে বুঝাইয়া দিন। এইরূপ আচরণ দ্বারা শিশুদের মধ্যে কিছুটা প্রীতির ভাব গড়িয়া তোলা যায়, যাহার ফলে তাহাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া ও কান্নাকাটি বন্ধ হইতে পারে। সময় সময় কিছুটা কঠোর হওয়ার এবং মৃদু শাস্তিদানের প্রয়োজনও হইতে পারে। কিন্তু কোনোক্রমেই দুর্বলের উপর অত্যাচার করার অভ্যাস গড়িয়া উঠতে দেওয়া সঙ্গত হইবে না।
সাধারণ সম্পত্তি : শিশুর নিকট প্রিয় কতকগুলি খেলনা তাহার নিজস্ব সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করিতে হইবে, আর যে খেলনাগুলি অন্যকেও ব্যবহার করিতে দেওয়া চলে সেইগুলির সম্বন্ধে এইরূপ নিয়ম করিতে হয় : যে যখন ব্যবহার করিবে সেইগুলির উপর তখনকার জন্য সম্পূর্ণরূপে তাহারই অধিকার থাকিবে। মন্তেসরি খেলার সরঞ্জামগুলি বিদ্যালয়ের সকল শিশুর সাধারণ সম্পত্তি কিন্তু একজন যখন কোনো একটি ব্যবহার করে তখন আর কেহ সেটি দাবি করিয়া তাহার খেলায় বাধা দেয় না। এইরূপ ব্যবস্থার ফলে শিশুর মনে ধারণা জন্মে যে, যতক্ষণ যে কোনো দ্রব্য ব্যবহার করিবে ততক্ষণ সেইগুলির মালিক সে নিজে। কাজই হইল তাহার মালিকানা-স্বত্বের ভিত্তি। পরবর্তিকালের কর্মপ্রণালী ও মনোভাবের সঙ্গে এ সময়কার মনোভাবের কোনো বিরোধ নাই।
অত্যন্ত কচি শিশুর পক্ষে এইরূপ ব্যবস্থা প্রয়োগ করা যায় না, কেননা তখনও তাহাদের গঠন ক্ষমতা প্রকাশ পায় নাই। ক্রমে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে ইহা প্রবর্তন করা উচিত। যখন তাহারা বুঝিতে পারে যে তাহাদের খেলিতে ইচ্ছা হইলেই খেলার সরঞ্জাম ফিরিয়া পাইবে তখন তাহাদের অন্যকে ব্যবহার করিতে দিতে বিশেষ আপত্তি থাকে না, থাকিলেও রীতি মানিয়া চলার ফলে ক্রমে তাহা দূর হয়।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি : তথাপি শিশুর বয়স কিছু বেশি হইলেই তাহাকে কিছু বই দেওয়া উচিত; এইগুলি হইবে তাহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পুস্তক প্রীতি তাহার পড়ার বাসনা উদ্রেক করিবে। তবে দেখিতে হইবে বইগুলি যেন প্রকৃতই ভালো বই হয়; তার শিশুরা যদি বাজে বই চায় তাহা বরং সকলের সাধারণ সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে।
মূলনীতি : স্বার্থপরতা এবং সম্পত্তি লাভের বাসনা দুই-ই শিশুর জীবনে সত্য এবং তাহার চরিত্রগঠনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে : পিতামাতাকে শিশুর প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করিয়া যত্নসহকারে এই উপযুক্ত আচরণ শিখাইতে হইবে। এই সম্পর্কে কয়েকটি মূলনীতি মনে রাখা আবশ্যক :
প্রথম, যথেষ্ট পরিমাণ খেলনা নাই বলিয়া শিশুর মনে যেন বিফলতা বা ব্যর্থতার ভাব জাগ্রত না হয়। এই ভাব বদ্ধমূল হইয়া গেলে শিশু পরবর্তিকালে হয় অনুদার, সংকীর্ণমনা, কৃপণ।
দ্বিতীয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি যখন শিশুর কতকগুলি সগুণ বিকাশ করে, বিশেষ করিয়া যখন তাহাকে নিজের জিনিসের প্রতি যত্ন লইতে শিখায়, তখন তাহাকে কিছু জিনিস ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে রাখিতে দিন। তবে লক্ষ্য রাখিবেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তিই যেন শিশুর আনন্দলাভের একমাত্র বা প্রধান উপায় না হয়।