০৭. সেপ্টেম্বর যুদ্ধ : বাঙালি কবি-সাহিত্যিক

সেপ্টেম্বর যুদ্ধ : বাঙালি কবি-সাহিত্যিক

এক

কোনো দেশের লেখক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটে যুদ্ধবিগ্রহ অথবা ওই রকম কোনো দুর্যোগ বা বড় ঘটনার সময়। ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৭ দিন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন যুদ্ধ বাধে, তখন দলমত-নির্বিশেষে দেশরক্ষাটাই সবার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, কেউই বৈদেশিক শক্তির পক্ষ নিতে পারে না। নিলে তাকে বলা হবে দেশদ্রোহী, যা সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পঁয়ষট্টির পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময়ও বিরোধী দলের নেতারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের সরকারের পাশে থাকেন। তাঁর আহ্বানে সবাই তাকে সমর্থন দেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা ভাসানী, আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, সুফিয়া কামাল, আবুল হাশিমসহ প্রায় সব প্রধান কবি-সাহিত্যিক সরকারকে নৈতিক সমর্থন দেন।

আইয়ুব-মোনায়েম ছিলেন শেখ মুজিবের প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তারা যখন সব রাজনৈতিক নেতাদের একটি বৈঠকের আমন্ত্রণ জানান তাতেও সবাই যোগ দেন। মওলানা ভাসানী সভা-সমাবেশ নিয়ে ঢাকার বাইরে ব্যস্ত থাকায় ওই বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি, শেখ মুজিব যোগ দিয়েছিলেন। দলীয় নেতাদের থেকে জানা যায়, মোনায়েমের সঙ্গে বসতে ভাসানী অনিচ্ছুক ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ মুজিব তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন :

‘১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাঁহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।… যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি।’

[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড]

তাসখন্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ১৭ দিন পর যুদ্ধ থেমে গেলেও পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ও রেডিওতে ভারতবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত থাকে অনেক দিন। সে অস্বাভাবিক নয়। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর বহু বছর চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় পত্রপত্রিকা অব্যাহত লিখেছে। দেশ পত্রিকায় লেখা হতো ‘ড্রাগনের দাঁতে বিষ’ শিরোনামে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে শান্তি স্থাপন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের কবি সাহিত্যিকেরা এমন গল্প-কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখতে থাকেন, যাতে শুধু ভারতের সমালোচনা নয়, প্রকাশ পায় সাম্প্রদায়িকতা– যেন যুদ্ধটা হয়েছে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে। হিন্দুবিরোধী লেখা লিখে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা কেন্দ্রীয় সরকারের আনুকূল্য পেয়েছেন অনেক দিন। আইয়ুব খান বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রণাঙ্গন ঘুরে এসে হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন তাঁর সফরনামা সীমান্ত শিবিরে, যা দৈনিক পাকিস্তানে (পরে দৈনিক বাংলা) ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। আইয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে ঘুরিয়ে দেখতে যাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত সফরনামা লিখেছেন।

রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে তখন একটি রম্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, যা শ্রোতারা উপভোগ করলেও তাতে প্রচারিত হতো হিন্দুবিদ্বেষ। প্রবাসী হিন্দুদের সব সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করে এবং তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘শত্রুসম্পত্তি’, যে আইনের অভিশাপ থেকে হিন্দুরা আজও মুক্তি পাননি। হিন্দু লেখকদের মুসলমান ও ইসলামবিরোধী রচনার অংশবিশেষ রেডিও থেকে সম্প্রচারিত হতো, যদিও যুদ্ধটা মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের ছিল না, ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের। হিংটিংছট’ অনুষ্ঠানে গুরু-শিষ্যের সংলাপে সম্প্রচারিত হতো জীবন্তিকা। তাতে অংশ নিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তার মান খারাপ ছিল না। চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে একটি পুঁথিপাঠের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো, পাঠ করতেন বেলাল মোহাম্মদ।

যুদ্ধ-পরবর্তী কয়েক মাসে প্রধান কবিদের অনেকেই বহু দেশাত্মবোধক গান লেখেন, যা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। যেমন ফররুখ আহমদ জিন্নাহকে স্মরণ করে লিখেছিলেন :

তুমি চেয়েছিলে মুক্ত স্বদেশ ভূমি
তুমি চেয়েছিলে এ বিরান মাঠে
ফসলের মৌসুমী।

শামসুর রাহমানের একটি গান একসময় খুবই গীত হতো :

কালের সে তিমিরে দিল কে আলোর পায়রা
কার সে আভাসে এসেছে আলোর পায়রা।
মহিমার ইংগিত জানা নেই।
পঙ্কিল পথে যেতে মানা নেই,
জানি তবু বাতাসে ভেসেছে
আলোর পায়রা।

আহসান হাবীবের একটি গান এ রকম :

নতুন স্বপ্ন সুষমা জড়ানো
আমরা এনেছি নতুন দিন।
আমরা এনেছি নব জীবনের
নতুন প্রভাত রাঙা রঙিন ॥
আমরা এনেছি নতুন আকাশে নীল বিথার
বেঁধেছি নতুন সুরে জীবনের ছিন্ন তার,
নব গৌরবে জাগে নতুন ফসল নয়া জমীন।

যুদ্ধের সময় আহসান হাবীব লিখেছিলেন সৈনিকদের উদ্দেশে :

দুর্গম এ যাত্রা পথের
কোনো বাঁধা মানবো না
না না না।

আহসান হাবীব গীতিকার ছিলেন না। কিন্তু তখন বেশ কিছু গান লিখেছেন। তাঁর আরেকটি গান :

এলো রে ভয়ের পাখায় পাড়ি দেবার দিন
এলো রে,
জীবনে এলো আবার নতুন জোয়ার
নতুন ভোরে।

তালিম হোসেন লিখেছিলেন বেশ কিছু গান, যেমন–

না, না, না, দুশমনকে দেব না ছুঁতে সীমানা
সইব না সইব না দানবের হানা–।

সিকান্দার আবু জাফর লিখেছিলেন :

নয় নয় আমাদের কোনো সংশয় নয়
আমাদের কারো চোখে মৃত্যুর ভয় নয়।

শামসুর রাহমানের একটি গান ছিল এ রকম :

আজ নয় দ্বিধা, আজ নয় কোনো শোক,
অগ্নিশপথে জ্বলে অগুনিত চোখ?
শুধতেই হবে মাতৃভূমির ঋণ।

যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৬ সেপ্টেম্বর। যুদ্ধ নিয়ে অনেক কথাশিল্পী গল্পও লিখেছেন, কাব্যনাট্য লিখেছেন, কবিতা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে প্রচুর। সৈয়দ শামসুল হকের একটি গল্পের নামই ‘৬ই সেপ্টেম্বর’– তাতে তিনি ওই দিনের মানুষের অনুভূতি তুলে ধরেছেন। তখন তাঁর গদ্যের ভাষা ছিল অপেক্ষাকৃত কম অলংকারবহুল ও সরল। গল্পটির আরম্ভ এ রকম :

‘জাতির জীবনে দুর্যোগ আসে অভিশাপ হিসেবে নয়, অগ্নিপরীক্ষার পরম মুহূর্ত হিসেবে। সে মুহূর্ত বারবার আসে না, কিন্তু তার স্মৃতি সর্বমুহূর্তের। নব নব উপলব্ধি আর উদ্বোধনে সে স্মৃতিচারণ জাতীয় জীবনে অমূল্য হয়ে থাকে।

‘সেপ্টেম্বরের ছ’ তারিখ-সোমবার-ঢাকা। এটা ছিল নির্মল ঝরঝরে দিন। রোদ ছিল-গ্রীষ্মের তাপ ছিল বাতাসে। দু’এক টুকরো সাদা মেঘ, তাছাড়া আকাশ ছিল নীল। স্কুল-কলেজে বেরিয়ে পড়েছে ছেলেমেয়েরা। অফিস আদালত বসেছে। দোকানপাট খুলে গেছে। স্টেশনে ট্রেন এসেছে। সদরঘাটে দূর গ্রাম থেকে মোটর লঞ্চ বয়ে নিয়ে এসেছে যাত্রী। বাস চলেছে রৌদ্র-ঝলসিত পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানীতে কর্মের চাঞ্চল্য। জীবনের স্পন্দন অনুভব করা যাচ্ছিল যে কোনো দিনের মতো সেদিনও-সেপ্টেম্বরের ছ’ তারিখ।

 ‘কেবল একটি ব্যতিক্রম। সকালে দশটায় খবর পাওয়া গেল, পিআইএ-র যে বিমান করাচী থেকে ঢাকা আসছিল, তা করাচীতে ফিরে গেছে। ভারতের ওপর দিয়ে পিআইএ-র বিমান চলাচল নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আজ সকাল থেকে। আকস্মিক অপ্রত্যাশিত এই ছোট খবরের পেছনে যে কি গুরুতর কারণ লুকিয়ে ছিল, ঢাকার মানুষ তখনও তা জানতে পারেনি।

‘সেদিন করাচী থেকে পিআইএ-র বিমানে যারা ঢাকা আসছিলেন, তাদের মধ্যে সদ্য বিদেশ প্রত্যাগত একজন ছাত্রও ছিলেন। তার বৃদ্ধ পিতা পিআইএ-র অফিসে টেলিফোন করে বিমান না আসার অশুভ সংবাদ পেলেন। দীর্ঘ দু’বছর পরে ফিরে আসছে তাঁর ছেলে। সেদিন তিনি অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে নিজে বাজারে গিয়েছিলেন, ছেলের জন্য বিশেষ রান্না হবে-তার সওদা করতে। তার মন শংকিত হয়ে উঠল। দিশেহারা হয়ে তিনি টেলিফোন করলেন এক দৈনিক পত্রিকার দফতরে। যা শুনলেন –তা তাঁকে স্তম্ভিত-হতবাক করে দিল। ভারত বিনা যুদ্ধ ঘোষণায় আজ ভোরে লাহোরে আক্রমণ করেছে। ওয়াজিরাবাদে একটি দাঁড়ানো যাত্রীবাহী রেলগাড়ির ওপর ভারতীয় বিমান বোমা বর্ষণ করেছে। পত্রিকা দফতর থেকে আরও জানা গেল, প্রেসিডেন্ট আজ দুপুর দেড়টায় জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দিচ্ছেন।

‘স্নেহপরায়ণ পিতা, যারা বাৎসল্য ভরা চোখ তাকিয়েছিল পুত্রের আগমন পথের দিকে, সেই চোখে জ্বলে উঠল আগুন। ভারতের এ আক্রমণ-পৃথিবীর ইতিহাসে এক তুলনাহীন চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার নজির।…

‘ততক্ষণে সারা শহরে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই সংবাদ। ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে জাতি। কি দুঃসাহস এই পররাজ্য লোভী হিংস্র বর্বর ভারতের। একে একে হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, মানভাদার, গোয়া দখল করে কাশ্মীরের জনসাধারণের প্রতি দেয়া ওয়াদা খেলাফ করে পায়ের নিচে তাদের পিষে মারবার ঘৃণ্য আয়োজন করেও ক্ষুধা মেটেনি ভারতের। সে এখন পাকিস্তানের পবিত্র ভূমিতে তার নখর বিদ্ধ করেছে। দুপুর দেড়টার অনেক আগে থেকেই যেখানে যত রেডিও সেট ছিল, সবগুলো ঘিরে দাঁড়াল মানুষ। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে-ক্রোধ প্রশমিত করে-হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে রেডিও সেটের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে পথচারী, কুলি, মজুর, ব্যবসায়ী, কেরানি, অফিসার, ছাত্র, শিক্ষক। যে যে কাজে আছে, সব এই মুহূর্তে তুচ্ছ হয়ে গেছে। কান পেতে রয়েছে কখন প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।

‘বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। জনতা দাঁড়ালো আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে। যারা তখনও এসে পৌঁছুতে পারেনি-তারা দ্রুত পায়ে বাড়িয়ে তুলল ভীড়। পথের মোড়ে মোড়ে পান দোকানের সেটের চারপাশে পঞ্চাশ একশ-দু’শ করে তোক দাঁড়িয়ে আছে। অফিসে সেদিন অফিসারের কামরায় তিল ধারণের জায়গা নেই। বাড়িতে বাড়িতে রান্না ফেলে মা-বোনেরা হলুদ মাখা হাতে রেডিও সেটের সামনে এসেছে। যে ছোট ছেলেটা খেলা ছাড়া আর কিছু বোঝেনা-সেও বড়দের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে উৎকর্ণ হয়ে। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ শোনা গেল—”আমার প্রিয় দেশবাসী, আজ দশ কোটি পাকিস্তানির জন্য অগ্নিপরীক্ষার সময় এসেছে।” জনতা শুনল পাকিস্তানের ওপরে ভারতের অতর্কিত আক্রমণের কথা। মুহূর্তে রচিত হয়ে গেল জ্বলন্ত ইতিহাস-যখন প্রেসিডেন্ট বললেন, “লাহোরের নির্ভীক বীর জনসাধারণ সর্বপ্রথম শত্রু মোকাবিলা করার সুযোগ পেয়েছে। শত্রুদের চরম আঘাত হানতে পেরেছে বলে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম অমর হয়ে থাকবে। আর তার পরমুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট উচ্চারণ করলেন, “পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের হৃদয়ে ‘লা-ইলাহা-ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, এই ধ্বনি স্পন্দিত। ভারতের কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত দশ কোটি পাকিস্তানি বিশ্রাম গ্রহণ করবে না।”

‘৬ই সেপ্টেম্বর ঠিক প্রথাগত গল্প নয়– আলেখ্যবিশেষ। বর্ণনায় বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে। পাক্ষিক এলান-এ প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হক রচনাটি শেষ করেছেন এভাবে :

‘প্রেসিডেন্টের ভাষণ শেষে আবার বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। জনতা তখনও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নতুন দৃপ্ত, মহীয়ান মনে হচ্ছে, এই সুর। তাঁর প্রতিটি ধ্বনি যেন ডাক দিচ্ছে-”জাগো জাগো জাগো।” বলছে “এগিয়ে যাও, আমি তোমার স্বদেশ, আমি তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, আমাকে রক্ষা করো, শত্রুকে আঘাত হানো।” জাতীয় সঙ্গীতের শেষ ধ্বনি বাতাসে মিলিয়ে গেল। ধীরে ধীরে জনতা চলতে লাগল। ফিরে গেল যে যার কাজে, যে যার গন্তব্যের দিকে। আকাশে প্রখর রৌদ্র, তাদের পদক্ষেপে প্রতিজ্ঞার ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। আমরা সে দিন বিশ্বের এক মহান দৃশ্য দেখেছি। আমরা দেখেছি, যে জনতা রেডিওর চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের এক আশ্চর্য রূপান্তর। এক কঠিন স্বাজাত্য চেতনা, স্বদেশ প্রেরণা আর দুর্জয় সাহস তাদের প্রত্যেককে উন্নততর একেকটি সজীব মানুষে পরিণত করে দিয়ে গেছে ৬ সেপ্টেম্বর।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে লেখকেরা এ জাতীয় লেখাকে অস্বীকার করেন অথবা গোপন করে যান। কলকাতা সফরে গিয়ে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন কে কত বেশি ভারতপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন।

দুই

পঁয়ষট্টিতে যুদ্ধটা বেধেছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে, রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন দুই দেশের সব বাহিনীর সদস্যরা, পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় ছিলেন দুই দেশের রাজনৈতিক নেতা ও কূটনীতিকেরা। কোনো মৃত ব্যক্তি কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। ওই যুদ্ধের পুরো দুই যুগ আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গত হন। তাঁর পরলোকগমনের ছয় বছর পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিক। সাতচল্লিশ-পূর্ব উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যেকোনো কিছুর অভিন্ন উত্তরাধিকারী ভারত ও পাকিস্তান। লালন শাহ হোন বা আবদুল লতিফ ভিটাই হোন, কিংবা গালিব, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল দুই রাষ্ট্রেরই সম্পদ। দুই দেশেরই উর্দুভাষীদের প্রিয় কবি গালিব ও ইকবাল এবং উপমহাদেশের বাংলাভাষীদের পরম প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। এ নিয়ে কোনো রকম প্রশ্ন তোলাই, বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিবাদ করা নিতান্তই মূর্খ।

ভারতের আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথের গান যত সম্প্রচারিত হতো, সে তুলনায় রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কেন্দ্র থেকে কম হতো। তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ও অন্যান্য কেন্দ্র থেকে সকালে ও সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশিত হতো। পঞ্চাশের দশকে বিলকিস নাসিরুদ্দিন, মালেকা আজিম খান, আফসারী খানম, ফরিদা বারী মালিক প্রমুখ রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ষাটের দশকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আরও অনেকে– নারী ও পুরুষ শিল্পী। সাধারণত যিনি সকালে গাইতেন তিনিই সন্ধ্যায়ও রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করতেন। যুদ্ধের সময় অলিখিতভাবে সরকার নির্দেশ দেয় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন বন্ধ করতে। বিষয়টি সে রকমভাবে কেউ খেয়াল করেনি বা করলেও তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন বোধ করেনি। যুদ্ধের মতো জরুরি অবস্থায় অনেক কিছুই মানুষ মেনে নেয়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও যখন কয়েক মাস রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার বন্ধ থাকে, তখন সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে বিষয়টি আলোচ্য হয়ে ওঠে। এর মধ্যে আসে পঁচিশে বৈশাখ, সেদিন খুব সামান্য রবীন্দ্রসংগীত ঢাকা, চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হয়, কিন্তু সেটাও শাসকশ্রেণির বিরক্তির কারণ ঘটায়। ১৯৬৭ র জুনে বিরোধী দলের সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন জাতীয় পরিষদে বলেন, পাকিস্তানের কালচারাল ভ্যালুজের বা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথের গান রেডিওতে সম্প্রচারিত হবে না। তিনি সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করেন যে শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, যেকোনো গান, যা পাকিস্তানের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী, তা প্রচার বন্ধ থাকবে। কেন্দ্রের যোগাযোগমন্ত্রী খান আবদুস সবুর খানও ওই ধরনের মন্তব্য করেন।

শুধু পাকিস্তানের নয়, যেকোনো রাষ্ট্রেরই আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছুই সে দেশের সরকারি প্রচারযন্ত্র থেকে প্রচারিত হবে না, সেটা সাধারণ বুদ্ধির কথা। ভারত রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছু আকাশবাণী থেকে যদি সম্প্রচারিত না হয়, তাতে ভারত সরকার ও আকাশবাণী কর্তৃপক্ষকে দোষ দেওয়া যায় না। আকাশবাণী থেকে নজরুলের হামদ্-নাত্ নয়, কীর্তন ও শ্যামাসংগীতই প্রচারিত হতো, তাতে বলার কী থাকতে পারে। এদিকে পাকিস্তান রেডিও থেকে শ্যামাসংগীত নয়, নজরুলের ইসলামি গান ও হামদ-নাত পরিবেশিত হতো, তা নিয়ে বাগবিতণ্ডা করা অর্থহীন। পাকিস্তান-ভারত বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি ছিল পাকিস্তানের নেতাদের নির্বুদ্ধিতা ও গভীরতম সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমনকি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিপুল রবীন্দ্রসাহিত্যের কোথাও একটি শব্দও নেই। বরং তাঁর হিন্দুসমাজে তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।

সরকারি বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার সীমিতকরণ বা বন্ধের সংবাদে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হন জসীমউদ্‌দীন। তিনি কমলাপুরে তার ‘পলাশবাড়ীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে কয়েকজন প্রবীণ লেখক-বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদাও ছিলেন। ড. খুদাও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করে জসীমউদ্‌দীন এক বিবৃতিতে বলেন :

‘…রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীদের নাড়ির বন্ধন। কোনো সরকারি আইনের সহায়তায় সে বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না। পূর্ব বাংলার বেতার থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ হলে জনগণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য আকাশবাণী শুনবে।’

লক্ষ করার বিষয়, প্রথাগত বিবৃতির চেয়ে জসীমউদ্‌দীনের এই বিবৃতির বক্তব্য ছিল কিছুটা ভিন্ন। অল্প কথায় সরকারকে ঘায়েল করা হয় এবং সরকারি নীতিনির্ধারকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া হয় যে তোমাদের রেডিও কেউ শুনবে না, তার পরিবর্তে তোমাদের শত্রু ভারতের বেতারই বাংলাদেশের মানুষ শুনবে এবং সে শোনা তোমরা বন্ধ করতে পারবে না।

একই দিনে ১৮ জন কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রসংগীত প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক বিবৃতি দেন। তারা বলেন :

‘…রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, কাজী মোতাহার হোসেন, সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, এম এ বারী, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, সিকান্দার আবু জাফর, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।

বক্তব্যটি এসেছিল যেহেতু মন্ত্রী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুখ থেকে, শাহাবুদ্দীন ছিলেন একজন মুসলিম লীগের নেতা, তাই অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতাদের থেকেই প্রতিক্রিয়া আসা উচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা নিশুপ রইলেন, যার অর্থ মৌনতাসূচক সম্মতি। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। দলের নেতাদের মধ্যে যারা বাইরে ছিলেন, তাঁদের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রস্টেট অপারেশন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন, রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ওপর আঘাত। রোগশয্যা থেকে তিনি এক বিবৃতিতে বলেন: তথ্যমন্ত্রী শাহাবুদ্দীন ঘোষণা করেছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত ইসলাম ও পাকিস্তানের ঐতিহ্যপরিপন্থী বিধায় আর বেতার ও টেলিভিশন মারফত পরিবেশিত হবে না। কিছুদিন পূর্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবুর খানও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তাঁদের এই বক্তব্য পাকিস্তান সরকারের মনোভাবের প্রকাশ কিনা, ইহাই সরকারের নিকট আমার জিজ্ঞাস্য।

‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য-সাহিত্য, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস ও সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে নতুন গৌরবে অভিষিক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অবদান সার্বজনীন। ইসলাম সত্য ও সুন্দরের ঘোষণা করেছে। এই সত্য ও সুন্দরের। পতাকাকে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই, যারা ইসলামের নামে রবীন্দ্রনাথের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন তারা আসলে ইসলামের সত্য ও সুন্দরের নীতিতে বিশ্বাসী নন। তাই আমি এই দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৮ জুন ১৯৬৭]

১৮ লেখক-কবি-শিক্ষাবিদের বিবৃতি এবং ভাসানীর বিবৃতির পরই ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, মোহাম্মদ মোহর আলীসহ পাঁচজন অধ্যাপক এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁদের ওই বিবৃতিতে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে এবং তা পাকিস্তানবিরোধী প্রচারে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা বলেন, ‘বিবৃতির ভাষায় এই ধারণা জন্মে যে, স্বাক্ষরকারীরা বাংলাভাষী পাকিস্তানি ও বাংলাভাষী ভারতীয়দের সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোনো পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। বাংলাভাষী-পাকিস্তানিদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত নই।’

[দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ জুন ১৯৬৭]

সরকারি নীতির সমর্থনে আরও ৪০ জন কবি-সাহিত্যিকের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তাঁরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উক্তির প্রতিবাদ করতে আমরা বাধ্য এই কারণে যে, এই উক্তি স্বীকার করে নিলে পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্কৃতি যে এক ও অবিচ্ছেদ্য এ কথাই মেনে নেয়া হয়।

ওই বিবৃতিতে যে ৪০ জনের স্বাক্ষর ছিল, পরবর্তীকালে জানা গেছে, তাদের সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সই করেননি, কেউ করছেন অনুরোধে, কেউ চাকরি বাকরি রক্ষার স্বার্থে চাপে পড়ে। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, বিচারপতি আবদুল মওদুদ, মুজিবর রহমান খা, কবি বেনজীর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, কবি আহসান হাবীব, কাজী দীন মোহাম্মদ, আ ন ম বজলুর রশীদ, আশরাফ সিদ্দিকী, হাসান জামান প্রমুখ। বিবৃতি প্রকাশের পরদিন আহসান হাবীব, তিনি তখন প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্য সম্পাদক, তার এক ভায়রা জিয়াউল হকের কমলাপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমি সেখানে ছিলাম। তিনি খুবই বিব্রত বোধ করেন। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তার একটির লেখক ছিলেন অনিলচন্দ্র ঘোষ এবং অন্যটির আ ন ম বজলুর রশীদ। তাঁর রবীন্দ্রসংগীত বিরোধিতার কারণ থাকতে পারে না। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রধারার একজন কবি ও রবীন্দ্রপ্রেমিক। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বাংলা সাহিত্যের প্রফেসর। স্বাক্ষর না করে সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন একজন সরল-সজ্জন প্রকৃতির মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রকাশিত হয় বজলুর রশীদের জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ নামের একটি বড় বই।

খুব বড় প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব ছাড়া সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। পূর্ব বাংলায় ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বা সায়েন্স ল্যাবরেটরিজের পূর্বাঞ্চলের পরিচালক ছিলেন। সরকারি বাংলা উন্নয়ন বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে তাঁর ভূমিকা ছিল শক্ত। তাঁর পুত্রবধূ খালেদা মঞ্জুর-ই-খুদা ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত শিল্পী। সেকালে শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রায় কেউই সৎসাহসের পরিচয় দিতে পারেননি। সেদিক থেকে আমরা ব্যতিক্রম দেখেছি রাজনীতিবিদ ও ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাশিম, তাঁর পুত্র বদরুদ্দীন উমর এবং Islamic Culture and Philosophy শীর্ষক অসামান্য গ্রন্থের লেখক দর্শনতত্ত্ববিদ অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমানকে। অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমান প্রকাশ্যেই সিন্ধু হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কায়ানির মতো হাস্যরস করে আইয়ুব সরকারের সমালোচনা করতেন। অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা উল্লেখ করতে হয়। বাম প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি। ন্যাপের এলিফ্যান্ট রোডের অফিস নির্মাণের সময় শুধু নগদ অর্থ নয়, ঠিকাদারদের থেকে ইট-সিমেন্ট জোগাড় করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমান এবং ডাক্তার এম এ ওয়াদুদ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরাও তাদের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হননি। স্বৈরশাসনের সময় সেটা কম সৎসাহসের কাজ নয়।

রবীন্দ্রসংগীতের বিরোধিতায় যারা সরকারকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁদের নানাভাবে কটাক্ষ করে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। তাতে তাদের কেউ কেউ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলার মতো সাহস তাদের ছিল না। বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি শ্রেণির নিজেদের অধিকতর প্রগতিশীল বলে জাহির করার একটি প্রবণতা রয়েছে। গত ৪৫ বছরে রবীন্দ্রবিরোধিতার প্রসঙ্গটি অব্যাহত উচ্চারিত হচ্ছে।

তিন

পাঞ্জাবের শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানের জন্য দরদ শুধু তাঁদেরই; বিশেষ করে জনসংখ্যার দিক থেকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর অংশ পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের ভালোবাসা দেশের জন্য বিশেষ নেই; তারা ভুলে থাকতে চাইতেন যে সত্য তা হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনগণের ভোটে এবং সেই ভোটারের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাঙালি মুসলমান। শুধু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং পাঞ্জাবি রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের কৃতিত্ব নয়। তাই পাকিস্তানি শাসকেরা গভীর দেশপ্রেম থেকে একাত্তরে গণহত্যা ঘটিয়ে ‘অ দেশপ্রেমিক’ বাঙালিদের রক্তে সয়লাব করেন বাংলার পলিমাটি। পাকিস্তানের অসামরিক নেতা ও বীর জেনারেলদের প্রয়োজন ছিল মাটির– মানুষ নয়।

পাকিস্তানের সেনাপতিদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তারা গ্রিক আলেকজান্ডার এবং মঙ্গলীয় দিগ্‌বিজয়ী চেঙ্গিস খাঁর চেয়ে বড় বীর। তাদের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এমন শক্তি কোনো দেশের নেই। যুদ্ধ ছিল তাদের কাছে প্রিয় জিনিস। ভারতের সঙ্গে ১৯৪৭-এ জন্মলগ্নেই একবার যুদ্ধ হয়ে গেছে। নতুন রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক উন্নতি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বিষয়টিই প্রাধান্য পাওয়ার কথা, যুদ্ধবিগ্রহ করে শক্তি ক্ষয় উন্নয়নের পথে বড় বাধা। কয়েক মাস ধরেই দুই দেশের প্রস্তুতি বা । পাঁয়তারা চলছিল। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান না করে বাধিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫। সত্যি সত্যি কে কাকে প্রথম আক্রমণ করে, তা কোনো দেশের ভাষ্য থেকেই জানা যাবে না, বিধাতা বলতে পারেন।

কোনো দেশ আক্রান্ত হলে অথবা নিজেই যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য সরকারকে সহযোগিতা বা সমর্থন দেওয়া। পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত না হলেও পূর্ব বাংলার মানুষও বিপন্ন বোধ করে এবং সরকারের পাশে থাকে। বাঙালি লেখক-সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেবেন। সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁদের ভাষা এবং সাম্প্রদায়িক শাসকশ্রেণির নেতাদের ভাষা একই রকম হবে, সেটা স্বাভাবিক নয়। যুদ্ধ নিয়ে সব দেশেই কবি-সাহিত্যিকেরা লেখালেখি করেন। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে মহৎ সাহিত্য রচিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, ১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা প্রচুর লিখেছেন। কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় একটি লেখার শিরোনাম ছিল “ড্রাগনের দাঁতে বিষ’, বহুদিন আমরা সেটা পড়েছি।

যুদ্ধ হয়েছিল ১৭ দিন। দৈনিক পাকিস্তান-এর সহকারী সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান ‘এ মুহূর্তে লেখকবর্গ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছিলেন :

‘পবিত্র মাতৃভূমি রক্ষার সংগ্রামে শরীক হওয়া মাত্রই আমাদের লেখকবৃন্দও এক মহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠলেন। জাতির বীর্যবত্তা এবং অমিত তেজ আমাদের চেতনায় আন্দাজ মাত্র ছিল, সে ত এখন বাস্তবে সত্য হয়ে উঠল, জ্বলন্ত নিদর্শন রূপে দীপ্ত দৃষ্ট হয়ে উঠল। আর সেই সঙ্গে প্রবহমান সুপ্রাচীন শৌর্যের অন্তর শক্তি যা আমরা ধারণ করছি বলে একটা সুপ্ত আশ্বাস মাত্র ছিল, তা বর্তমানের প্রগাঢ় উদ্দীপনায় প্রবল বিশ্বাসে পরিণত হল, পরীক্ষিত হতে উত্তীর্ণ হয়ে উঠল আমাদের মনে।…

‘আমাদের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে তাই এই উদ্দীপ্ত বর্তমান মহত্তম ঘটনা। এতে আমরা আমাদের অন্তর্জগৎ দেখেছি, আমাদের সম্প্রসারণের পূর্ণতার ব্যাপ্তিও দেখেছি। প্রথমত আমরা জানতে পেলাম আমাদের প্রতিরোধ শক্তি অজেয়। দ্বিতীয়ত ন্যায় ও নীতির জন্য আমাদের ত্যাগের মজ্জাগত শক্তি রয়েছে। নির্যাতিতের সপক্ষে দাঁড়াবার সাহস আমাদেরকে যে কোন বিপদের সম্মুখেও অটল থাকার প্রেরণায় অনিঃশেষ, অকুতোভয়। তৃতীয়ত, মাতৃভূমির মর্যাদা ও মানুষ হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানবোধ আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়।… এই সবই একটি বীর জাতির গুণাবলী। আমাদের এই মহৎ জাতীয় পরিচয় আজ দ্ব্যর্থহীন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল।

‘কোন মহৎ ঘটনা ছাড়া একটি জাতি নিজেকে পুরোপুরি চিনতে পারে না। নতুনভাবে জানতে পারে না, সম্পূর্ণ আত্মোপলব্ধি তার ঘটে না। বর্তমান বিপদকে এক মহৎ ঘটনাই বলব। কারণ, এর ফলে আমরা রাষ্ট্রিক দিক থেকে যেমন নিঃসন্দেহে এক বহুমুখী বিজয়ের সম্মুখীন হয়েছি, তেমনি এ আমাদের আত্মিক জগতের বহুমুখী সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। আমাদের লেখকবর্গ এই আত্মিক সম্ভাবনার রূপায়ণের প্রবর্তনার এবং প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।’

যুদ্ধের মধ্যে এবং যুদ্ধের পরে বহুদিন বাংলাদেশের প্রধান কবি-সাহিত্যিকেরা লেখালেখির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমের আবেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি মাত্র পাঁচ বছর পরে পাকিস্তান সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী হবে বাঙালির জঘন্য দুশমন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমস্ত বীরত্বের প্রকাশ ঘটবে নিরপরাধ বাঙালির রক্তলেহনে। অক্টোবর ১৯৬৫-তে বাংলা একাডেমির পরিচালক (তখনো মহাপরিচালক পদটি সৃষ্টি হয়নি) কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন :

‘শান্তিকামী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ করে সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুস্তান পাক-ভারতের সেপ্টেম্বর যুদ্ধ তার ওপর চাপিয়ে দিল তখন পাকিস্তান অপূর্ব শৌর্য ও বীরত্বের সঙ্গে সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে। সকল রণাঙ্গনে শত্ৰু পিছু হটে গেছে এবং প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি বরণ করেছে। অবশ্য পাকিস্তানের দিক থেকে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। সব সমস্যার মূল সেখানে, অর্থাৎ জম্মু ও কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার যতদিন পর্যন্ত বাস্তব ব্যবস্থায় কার্যকরী না হয় ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রত্যাশা করতে পারে না। তার অতীত ইতিহাস দিয়ে বিচার করলে এ সিদ্ধান্ত অবধারিত হয়ে পড়ে যে, হিন্দুস্তানের মতো জঘন্যতম প্রতিবেশী কল্পনা করাও দুষ্কর। সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে নেবার পরও হিন্দুস্তান ক্রমাগত সে চুক্তি লংঘন করে চলেছে, যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা অতিক্রম করে তার সামরিক ক্রিয়াকলাপ প্রসারিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আমরা যথাসাধ্য ধৈর্য ও বিবেচনার পরিচয় দিয়ে চলেছি কিন্তু বেশীদিন আমাদের এরকম একতরফা শান্তি প্রচেষ্টা চলতে পারে না। আমাদের বীর। জোয়ানরা, দেশের সর্বস্তরের প্রতি মানুষ, আজ হিন্দুস্তানের সমরলিন্সাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবার দৃঢ়সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। আবার যদি বৃহত্তর সংগ্রাম জ্বলেই ওঠে, পাকিস্তান তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এই সত্যটিকে অন্তরের মধ্যে সুস্পষ্ট উপলব্ধি করেই আমাদের বলতে হবে যে, সেপ্টেম্বরের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এই কথাটিকে মনে রেখেই আমাদের সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণায় ব্রতী হতে হবে।’

[কবীর চৌধুরী, ‘যুদ্ধ ও আমাদের নবচেতনা’, এলান, অক্টোবর ১৯৬৫]

সেপ্টেম্বর যুদ্ধ নিয়ে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের লেখাগুলো, প্রশংসামূলক বিশ্লেষণধর্মী নয়। যুদ্ধে শুধু পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর শৌর্য-বীর্যের প্রকাশ ঘটেছে এবং ভারতীয় বাহিনী বিপর্যস্ত হয়েছে– এই বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ নেই। কবীর চৌধুরী তার ওই প্রবন্ধে বলেন :

‘সব কিছুর আগে যে কথা ধরা পড়েছে তা হলো এই যে, এই পাক-ভারতের সেপ্টেম্বর যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা পাকিস্তানের সত্যিকার শক্তি ও সম্ভাবনার স্বরূপ আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছি। জাতির জীবনে সংকট মুহূর্তও যে মাঝে মাঝে অভাবিত শুভ ও কল্যাণের বীজ বহন করে আনতে পারে তার প্রমাণ রয়েছে বিগত সংগ্রামের। ফলাফলের মধ্যে। পাকিস্তানের সামরিক শক্তি সম্পর্কে আমরা বরাবরই শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান ছিলাম; এবং এবারকার যুদ্ধ যে আমাদের সেই শ্রদ্ধা ও আশাকে পূর্ণ করেছে তাই নয়, তাকে বহু গুণ ছাড়িয়ে গেছে। সংখ্যায় তার চাইতে দশগুণ বেশি সৈন্যের মোকাবিলা করেছে পাকিস্তান, তবু শত্রু সৈন্যকে তারা বারবার ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, পিছনে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে, চরম বিপর্যয় বরণ করতে বাধ্য করেছে। গত মহাযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ার মরু প্রান্তরে আল-আমীনের রোমেল ও মন্টগোমারীর বাহিনীর মধ্যে যে বিরাট ও প্রচণ্ড ট্যাঙ্ক যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার চাইতেও ভয়ঙ্কর ট্যাঙ্ক সংঘর্ষ হয়েছে এবার শিয়ালকোটের রণপ্রাঙ্গণে। হিন্দুস্তান তার সাঁজোয়াগাড়ীর সংখ্যাধিক্যের অহমিকায়– প্রচুর সৈন্য-সমাবেশ করে এই সেক্টরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু আমাদের সিংহবিক্রম জোয়ানদের সামনে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধেই তাদের ট্যাঙ্ক বাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে, হিন্দুস্তানের সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে যে অপূর্ব বীরত্ব, মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস ও আশ্চর্য রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করেছে তা আমাদের ইতিহাসে চিরদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

আমরা তখন তরুণ লেখক। লক্ষণীয় যে, ষাটের তরুণ লেখকেরা পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ নিয়ে মোটেই মাতামাতি করেননি। প্রবীণ সব লেখকই ওই যুদ্ধকে পাকিস্তানের সংহতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করেন। নবীন লেখকদের অনেকেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যকেই বড় করে দেখতেন। রাষ্ট্রে বৈষম্য টিকিয়ে রেখে সংহতি সম্ভব নয়। ওই লেখায় কবীর চৌধুরী আরও বলেছিলেন :

‘সংখ্যাগুরু হিন্দুস্তানের সামরিক বিপর্যয় ও সংখ্যালঘু পাকিস্তানের শক্তি মত্তার অবিসংবাদিত পরিচয় শুধু এশিয়ার নয়, আজ সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি চরম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর জন্য সব প্রশংসা পরম করুণাময় আল্লাহর, যার অপার অনুগ্রহেই আমাদের সত্য ও ন্যায়ের যুদ্ধ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।

‘এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। সে হচ্ছে সংকট মুহূর্তে পাকিস্তানের আশ্চর্য জাতীয় চেতনার উন্মেষ– এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য, ইমান ও শৃঙ্খলার অভিব্যক্তি। সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের ভেতর নানা প্রশ্নে আমরা বিভিন্ন মতবাদের প্রকাশ দেখেছি; তর্ক, মতানৈক্য, আলোচনা ও সমালোচনা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবেই আমরা লক্ষ্য করেছি। একটি স্বাধীন, জীবন্ত এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেইটিই ছিল সঙ্গত ও স্বাভাবিক। মূল লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সেইসব মতানৈক্য ও বিভেদ প্রশ্রয় পেতো। অন্তত তাই ছিল আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু সে বিশ্বাস যে কতখানি সত্য ও যথার্থ এবারকার অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে জাতি তার অবিস্মরণীয় প্রমাণ দিল। সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুস্তানের নির্লজ্জ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সারা পাকিস্তান, পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত, এক বজ্র কঠিন ঐক্য বন্ধনে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ হল। নিজেদের আভ্যন্তরীণ প্রশ্নের সকল রকম তুচ্ছ বিবাদ-বিসম্বাদ বিস্মৃত হয়ে সারা জাতি হিন্দুস্তানের বর্বর আক্রমণ প্রতিহত করবার দৃপ্ত শপথ নিয়ে জীবনপণ করে রুখে দাঁড়াল। খাইবার থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত সর্বত্র দেখা গেল এক আশ্চর্য মৈত্রীর বন্ধন, সে বন্ধনের পশ্চাত্যে মূল সূত্রটি অত্যন্ত সহজ অথচ ইস্পাতের মতো কঠিন। তা হল, আমরা পাকিস্তানি, পাকিস্তান আমাদের প্রাণাপেক্ষা প্রিয় মাতৃভূমি, এই দেশের সেবায় আমরা সর্বস্ব দান করতে শুধু প্রস্তুত নই, উন্মুখ।…

‘এক আশ্চর্য সংহতি ও ঐক্য দেশের সর্বস্তরের মানুষকে আজ উদ্দীপিত করেছে। শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিল্পপতি, শ্রমিক, চাষী, ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে দেশের ডাকে গভীর ব্যগ্রতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন; কোনো রকম সরকারি নির্দেশের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেননি; নিজেরাই নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে সৃষ্টিশীল গঠনমূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যে নবচেতনার স্রোত সারা দেশে প্রবাহিত হল, তারই ফসল হিসেবে সৃষ্টি হলো কত নতুন গান, কবিতা, নাটক ও অন্যান্য রচনা।

[কবীর চৌধুরী, ‘যুদ্ধ ও আমাদের নবচেতনা’ এলান]

যুদ্ধ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে, পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হয়নি। সেটাও খুবই তাৎপর্যের ব্যাপার। এই প্রদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমান সৈনিকদের বীরত্বগাথাকেই উপজীব্য করেন তাদের লেখায়। যুদ্ধের সঙ্গে ইসলামেরও কোননা সম্পর্ক ছিল না, যুদ্ধ হয়েছিল এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের –এক ধর্মের সঙ্গে আরেক ধর্মের নয়।

সেদিন বাঙালি মুসলমান কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ প্রমুখের লেখায় যে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিল, তা কি মিথ্যা ছিল? তা কি কৃত্রিম ছিল? সে প্রশ্নের জবাব শুধু সেই লেখকেরাই দিতে পারবেন।

চার

যেকোনো যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে প্রপাগান্ডা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে কাজটি সরকারের প্রচার বিভাগই করে থাকে। কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদেরও ভূমিকা থাকে, কারণ জাতীয় নিরাপত্তা সবার ওপরে। বহু ব্যাপারে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে দ্বিমত থাকে না কোনো নাগরিকেরই। ৬৫-র পাকিস্তান-ভারত সেপ্টেম্বর যুদ্ধে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ ছিল অনেকটাই রণাঙ্গনের সৈনিকদের মতো। যুদ্ধ-পরবর্তীকালের একটি লেখা থেকে বোঝা যায়, তখন আমাদের লেখকেরা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন :

‘মুখে গণতন্ত্রের মুখোশ, কণ্ঠে শান্তির সুললিত বুলি, গায়ে পরম বৈষ্ণবের নামাবলী, সাম্রাজ্যবাদী ভারত পূর্বাহ্নে যুদ্ধ ঘোষণা না করেই সন্তর্পণে আক্রমণ করল পাকিস্তানের পাকভূমি। আন্তর্জাতিক চুক্তিকে উপহাস করে লাহোর জিমখানায় চা পান করবার মোহে অন্ধ হয়ে ভারতের ট্যাংকবাহিনী আক্রমণ করল পশ্চিম। পাকিস্তানের রাজধানী লাহোর। কিন্তু ভারতের এই সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি ও হীন আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিয়ে পবিত্র মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে বজ্রের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিয়ে রুখে দাঁড়াল পাকিস্তানের বীর সেনানী। জলে-স্থলে আকাশে বীর সেনানীরা শত্রুর হামলাকে পর্যুদস্ত করল। ইতিহাসে তাদের বীরত্বের গাথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হল।

‘ভারতের এই তস্কর সুলভ আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে সেদিন শুধু বীর সৈনিকদের কামানই গর্জে উঠেছিল না, প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল খাইবার থেকে টেকনাফের প্রতিটি জনপদ। সবাই এক সঙ্গে এক কণ্ঠে গর্জে উঠল, শক্রকে ধ্বংস করতেই হবে। রণাঙ্গনে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের বীর সৈনিকরা, তেমনি দেশপ্রেমিক লেখক ও কবিদের লেখনী হয়ে উঠল ক্ষুরধার। কামানের মতো তাদের লেখনীও আগুন ছড়াল। আর সেইসব রচনা শিল্পীর অন্তরের উত্তাপে প্রাণস্পর্শী সুরে বেজে উঠল কণ্ঠে কণ্ঠে।

[মোবারক হোসেন খান, ‘রক্ত-লেখা’]

দেশবাসীকে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা দোষের কিছু নয়, বরং খুব বড় গুণ। কিন্তু আমাদের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো কথা বলতেন না। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিল। কবি-লেখক-সাংবাদিকেরা শুধু সেনাবাহিনীর বীরত্বগাথাকেই তুলে ধরেছেন। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে আত্মতৃপ্তিও ছিল খুব বেশি। ওই প্রবন্ধে সে কথাই বলা হয়েছে :

‘আমাদের সেনাবাহিনীর বীরত্বের সঙ্গে আমাদের দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও শিল্পীরা যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় অধ্যায় রচনা করলেন তা ভবিষ্যৎ দেশবাসীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।’

বাঙালি জাতির নিয়তির নির্মম পরিহাস, মাত্র পাঁচ বছর পর ওই পাকিস্তানি সেনারাই আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি লেখক, সংগীতশিল্পী, কবি ও বুদ্ধিজীবীর ওপর। অসংখ্য কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দালাল আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের হাতে পাশবিক নির্যাতনে শহীদ হন একাত্তরে। ভারতীয় বাহিনী তখন বাঙালির মিত্রবাহিনী।

পঁয়ষট্টিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া তমদ্দুন মজলিশের তৎপরতা ছিল সবচেয়ে বেশি। তারা কয়েক মাস ঘন ঘন সভা-সমাবেশ করেছে। কখনো আলোচনা সভা করেছে বাংলা একাডেমিতে। সেখানে খ্যাতিমান বৃদ্ধ-বুদ্ধিজীবীরাই অংশ নিতেন। যুদ্ধের পরেও তারা ‘সমর সাহিত্য’ রচনার ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক ‘জঙ্গি সাহিত্য সভা’য় সভাপতিত্ব করেন একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান। বক্তারা পূর্ব বাংলার ‘সাহিত্যের ধারা বীররসে উজ্জীবিত’ করে প্রবাহিত করার উপদেশও দেন।

ওই সময় কবি-লেখকদের প্রায় সবাই কম-বেশি দেশপ্রেমমূলক লেখা লিখেছেন। পরিমাণে যারা সবচেয়ে বেশি লিখেছেন, তাঁদের একজন হাসান হাফিজুর রহমান, পাকিস্তানি ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রশ্নে তিনি নানা পরামর্শ দেন। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের প্রশ্নে’ নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। আমাদের সাহিত্যে যাতে পাকিস্তানি জাতির বহুমুখী জীবনচেতনার প্রকাশ ঘটে, সে কথাও বলেন। যুদ্ধের পরেও তাদের আবেগ থেকে যায়, সে জন্য তাঁদের রচনার ভাষাও ঝরঝরে নয়, আবেগে অস্পষ্ট। হাসান হাফিজুর রহমানকে বলতে দেখি ‘সমগ্র জাতির ভেতরে এক অবিচ্ছিন্ন ঐক্য-শিহরণ সঞ্চার করা লেখকদের দায়িত্ব। যুদ্ধের পরে যেসব লেখক-সাংবাদিককে পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গন ও আজাদ কাশ্মীর ঘুরিয়ে আনা হয় হাসান ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন তিনি তার সীমান্ত শিবির বইতে।

দেশপ্রেম ও কাশ্মীর নিয়ে কবিতা লিখেছেন প্রধান প্রায় সব কবিই। তাঁদের মধ্যে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দুই মাসে তালিম হোসেন লিখেছেন অনেক কবিতা। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর এক দীর্ঘ কবিতায় বলেন :

আকাশের বিদ্যুতে দেখি স্বদেশের অন্য এক রূপ
অনিন্দ যুগ ধূপ
জনে জনে মনে মনে প্রদীপ্ত প্রগাঢ় উৎসুক্য
পুঞ্জিত সাহসে আজ ছড়ায় প্রবাল সখ্যে
বিপদে বিপন্ন নয় দেখে মুখ অজেয় অপার
বরাভয়ে শক্রজয়ী অকাতর স্বদেশ আমার।

[‘বিপদে বিপন্ন নও’]

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরোধ ও যুদ্ধ যেহেতু কাশ্মীর নিয়ে, তাই আমাদের কবিদের রচনার অন্যতম প্রধান উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায় কাশ্মীরও। ওই সময় প্রকাশিত ফররুখ আহমদের একটি সনেট এ রকম :

শহীদের খুন-রাঙা রুধিরাক্ত মাটির জান্নাত,
বর্বর পশুর বন্য অত্যাচার বিধ্বস্ত কাশ্মীর
আজাদীর স্বপ্ন দেখে দীর্ঘদিন, দীর্ঘতর রাত;
আবদ্ধ জিঞ্জির বেয়ে ঝরে তার শহীদি রুধির।
জাফরানের স্বপ্ন তার ধূলিস্নান রক্তাক্ত সগ্রামে
শান্তির পসরা তার চূর্ণ হলো সুতীব্র সংঘাতে,
সেই জেহাদের সঙ্গে মুমিনের মন ওঠে-নামে;
উদগ্র ব্যাকুল চিত্ত তার সঙ্গে শোণিত ঝরাতে।
তার আজাদীর দাম দিতে আজ সগ্রাম উৎসুক
প্রতি মুমিনের মন –শহীদ মৃত্যুর বিনিময়ে,
শৃংখলিত জীবনের কারাবন্ধে একাগ্র উন্মুখ
নিপীড়িত জনমন মুক্তি চায় ব্যাকুল হৃদয়ে।
শহীদের খুন-রাঙা বন্দিনী যে জান্নাত মাটির
স্বপ্নে দেখে আজাদীর;-অত্যাচার বিধ্বস্ত কাশ্মীর।

[কাশ্মীর]

যুদ্ধের সময় শামসুর রাহমান একটি ছোট কাব্যনাটক লিখেছিলেন, সেটিরও বিষয়বস্তু কাশ্মীরে যুদ্ধ। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকার হাডিয়ারা নামক একটি গ্রামে এক মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। ‘পাকিস্তানের ওপর হিন্দুস্থানের আচমকা হামলার দুর্যোগ-মুহূর্তে হাডিয়ারা গ্রামের মসজিদের ইমাম দুশমনদের সামনে মরদে-মোমিনের মতোই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং হানাদার বর্বর দুশমনদের হাতে অবশেষে শাহাদত্বরণ করেন। সেই পুণ্যকাহিনী বিবৃত হয়েছে এই কাব্য-নাট্যে। শামসুর রাহমানের কোনো কাব্যগ্রন্থে কাব্য নাটকটি আগে প্রকাশিত হয়নি। পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে আমি তাঁকে কাব্য নাটকটি দিয়েছিলাম। ‘তিনটি গোলাপ’ শীর্ষক কাব্য নাটকটির আরম্ভ এ রকম:

ইমাম :
কী নিবিড় শান্তি চতুর্দিকে রক্ত গোলাপের মতো
ফুটে ওঠে ভোর আর বাতাসে ছড়ায় সুরভি অনেক পাখিদের গানে।
হৃদয় ঝংকৃত হয়। রাত্রি ছিঁড়ে সকালকে ডেকে আনে রোজ
মোরগের ডাক– হে রাম্বুল আলামীন আমাকে দিয়েছো ঠাঁই তোমার এ ঘরে।
প্রাণের চেয়েও প্রিয় এ ধূলিকণা, বুঝি তাই
এই মাটি মেখেছি তো চোখে বুকে, করেছি চুম্বন
পরম পবিত্র জেনে, ধুয়েছি সিঁড়ির ধাপ, রৌদ্রে বৃষ্টি মাখা
এই যে মিনার সেও ছুঁয়েছে হৃদয়
দূর নীল আসমানে ওড়ে কবুতর এক ঝাঁক–
মহানন্দে, আন্দোলিত পত্র গুচ্ছে, ফলে ফুলে
তোমারই মহিমা মূর্ত। বহুদিন পর
কাল রাতে স্বপ্নে আমি দেখেছি তো তিনটি গোলাপ, দেখেছি হৃদয়ে
তিনটি গোলাপ ফুটে উঠেছিলো স্বর্গীয় বিভায়।
কে ওখানে দাঁড়িয়ে একাকী?

গ্রামবাসী :
আমি এ গাঁয়ের লোক, মাঝে মাঝে আসি
এখানে নোয়াতে মাথা খোদার এ ঘরে

ইমাম :
জামাত হয়েছে শেষ, সূর্যের সোনালি আলো হয়েছে প্রখর;
অবশ্য খোদার ঘর খোলা সর্বদাই, দ্বিধাহীন আসুন করুন এবাদত।

গ্রামবাসী :
ধন্যবাদ, তবে আমি আসিনি এখন
বন্দেগির পুণ্যলোকে মগ্ন হতে, আজ শুধু এ মুহূর্তে এসেছি জানাতে
কিছু কথা, আপনি কি শুনেছেন কিছু?

ইমাম :
কেন কী হয়েছে? আমি তো জানি না কিছু–
পড়ে থাকি এখানেই এক কোণে একা,
কারো সাতে পাঁচে মন যায় না সহজে।

গ্রামবাসী :
শত্রুরা দিয়েছে হানা আমাদের গ্রামে, আমাদের প্রিয় হুদায়রা
হয়েছে আক্রান্ত আজ, শত্রুর ভীষণ ক্রুর থাবা পড়েছে মাটির বুকে, শকুন
ফেলেছে ছায়া শান্তি ছাওয়া ঘরে।
গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে লোক, হয়েছে হুকুম–
চলুন না আপনিও যাবেন এখন শত্রুরা পড়বে এসে কিছুক্ষণ পরে।

ইমাম :
শত্রুরা দিয়েছে হানা আমাদের গ্রামে?
লোকজন যাচ্ছে চলে? যাক, সব যাক,
আমি তো যাবো না ভাই। এই মসজিদ ছেড়ে আজ
বলুন কোথায় যাবো? জীবনের অনেক বছর কাটিয়েছি
এর ধূলিকণা মেখে সর্বাঙ্গে আমার।
এখন কোথায় যাবো? না, না, কিছুতেই পারবো না যেতে।

সোরিশ কাশ্মীরির একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, তার শিরোনাম ‘সালাম পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বের প্রশংসা করা হয়েছিল কবিতাটিতে। কবিতাটির শুরু এ রকম :

দেখেছি তাদের আমি কোষমুক্ত তরবারি যেন,
তাদেরে প্রণতি আজ
হে বাংলার আগ্নেয় যৌবন,
তোমাদের সালাম, সালাম ॥
তাদের অমিত তেজ, বীর্য চির তারুণ্য আভায়
ঝলমল, যেন চিরন্তন
তাদের অশনি ভরা কণ্ঠে শুধু ওই বজ্র ভেরী
প্রতিশোধ, চাই প্রতিশোধ।
তাদেরে প্রণতি আজ
হে বাংলার আগ্নেয় যৌবন
তোমাদের সালাম সালাম।
আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত শত্রুসেনা
হানাদার বৈরী ভারতীয়–
মরণ বরণে, উল্লসিত কণ্ঠে তার বজ্র ভেদী ধ্বনি
আল্লাহু আকবর।
লাহোর রক্ষায় তারা পরাক্রান্ত বাহু
হয়েছে জাতির কাছে চির-বরণীয়।
হে বাংলার আগ্নেয় সন্তান
তোমাদের সালাম, সালাম।

একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও সেনাপতিদের নিয়ে ‘জল্লাদের দরবার’, ‘চরমপত্র’ প্রভৃতি হাস্যরসমূলক রচনা সম্প্রচারিত হতো, তেমনি পঁয়ষট্টিতে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে নানা রকম কৌতুক হতো ভারতকে নিয়ে। যেমন ফতেহ লোহানীর একটি কৌতুক রচনা, যার শিরোনাম ‘হিন্দুস্থানের পাঁচালী’। সেই পাঁচালীর নমুনা এ রকম :

প্রথমে বন্দিনু আমি সেই বিধাতারে,
অপার করুণা যার বিশ্ব চরাচরে।
এবার নমিনু আমি মোর বাপমায়
লভেছি জনম আমি যাদের কৃপায়।
এমন করিয়া স্মরণ যত গুরুজনে
জানাই সালাম যত সুধী জনগণে।
শোনো ভাই শোনো সবে শোনো দিয়া মন,
ভারত পাঁচালী তবে করহ শ্রবণ।
নয়ন মুদিয়া শোনো সুধা কর পান,
ভজেন লোহানী তবে ভারতের গান ॥

ধুয়া : আহা বেশ বেশ—

ভারত তাহার নাম কুহকিনী ভূমি
ভূগোলেতে জানি তাহা পড়িয়াছ তুমি।
অহিংসা বাণী যত বড় বড় বাত–
ছলনায় কত করে মহারথী কাত ॥

ধুয়া : আহা বেশ বেশ

… … …

তাকায়ে দেখ না দাদা প্রভুদের দিকে
পাঠায়ে তোমারে রণে তারা হাসি মুখে–
ঘরে বসে ছাড়ে বুলি গরম গরম–
প্রাণের বয়ান দিয়ে তুমি যে খতম।
ছেড়ে ছুঁড়ে ঘরে যাও, না হও বাতুল,
ঘরে বসে বাঁচা বাপু বামনের কূল।
যবনের হাতে মরে ফল কিরে ভাই,
মরে শুধু ভূত হবি আর গতি নাই।
সব শেষে খাঁটি কথা গোপনে জানাই–
হাতিয়ার ফেলে বল, তাই তাই তাই।
হাততালি দিয়ে বল, তাই তাই তাই ॥

ধুয়া : আহা বেশ বেশ…

[পুবালী, ভাদ্র, ১৯৭২)

পাঁচ

প্রচারমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সব কালের সব দেশের শাসকদের অভিন্ন নীতি। পাকিস্তান যুগে গণমাধ্যম বলতে ছিল সংবাদপত্র, রেডিও পাকিস্তান এবং একমাত্র টেলিভিশন মাধ্যম পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা। ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিতে পড়ে বেতারের ভূমিকা এবং কী করে তাকে পুরোপুরি সরকারি দলের নীতির বশবর্তী করা যায়। বিশেষ করে, ভারতবিরোধী প্রচারণাকে আরও জোরদার কীভাবে করা সম্ভব তার উপায় খুঁজে বের করা। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার মাসখানেক পরেই কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঘোষণা করেন, সরকার বর্তমান বাস্তবতায় একটি নতুন বেতার নীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, আকাশবাণী থেকেও পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা ব্যাপকভাবে চলছিল। সেগুলো বাংলাদেশের শ্রোতারা শুনতেন। তাতে সত্য-মিথ্যা নানা বিষয় সম্প্রচারিত হতো। নোংরামি তাতে কম থাকত না।

১৯৬৫-র অক্টোবরে শাহাবুদ্দিন তার এক বক্তৃতায় বলেন, “রেডিও পাকিস্তানে ভারত হইতে প্রচারিত শত্রুতামূলক প্রচারণার পাল্টা কর্মসূচীর প্রচার অব্যাহত রাখা উচিত। সরকার অতি দ্রুত তার নয়া বেতার নীতি ঘোষণা করে। সেই বেতার নীতিতে অনেকগুলো নির্দেশনা ছিল। তার একটি এ রকম :

‘নাটকের অনুষ্ঠান আরও বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ফসল তোলার গান, জিপসি গান, মৌসুমি গান, মুসলিম দেশসমূহের সংগীত, মহান মুসলিম গীতিকারদের জীবনী ও সংগীত ও অন্যান্য আকর্ষণীয় সংগীতানুষ্ঠান প্রচার করিতে হইবে। নৈরাশ্যবাদী গজল এবং গান পরিহার করিয়া প্রাণবন্ত ও উদ্দীপনাময় সংগীত অথবা নাটকীয় আবৃত্তি হিসাবে তেজোদ্দীপক কবিতা পেশ করিতে হইবে। নজরুল, ইকবাল ও অন্যান্য জাতীয় কবিদের সংগীত প্রচারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হইবে।

এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া ছিল শিল্পী ও কর্মকর্তাদের হাত-পা বেঁধে দেওয়ার শামিল। নৈরাশ্যবাদী গজল ও গানের সংজ্ঞা কী? এই সংজ্ঞা হিসেবে নজরুলের

গানগুলি মোর আহত পাখির সম
লুটাইয়া পড়ে তব পায়ে প্রিয়তম।

কিংবা

বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ঐ
ঘনায় নয়নে অন্ধকার।
হে প্রিয়, আমার যাত্রাপথ
অশ্রু-পিছল করো না আর।

অথবা

আনো সাকি শিরাজী আলো আঁখি-পিয়ালায়।
অধীর করো মোরে নয়ন-মদিরায়।

প্রভৃতি রেডিও-টেলিভিশন থেকে সম্প্রচার করা যাবে না। শুধু প্রচারিত হবে ‘বীর-রসে উজ্জীবিত’ করার মতো গান। কিন্তু নজরুল ভারতীয় বাঙালি মুসলমান ছিলেন, পাকিস্তানের ‘জাতীয় কবি’ ছিলেন না।

এই জাতীয় আরও অদ্ভুত ফরমান-সংবলিত নীতিমালা তখন ঘোষিত হলো। এই নীতিমালা সমগ্র পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য হলেও মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতারা। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠানে পূর্ব বাংলার শ্রোতা প্রভাবিত হতে পারে, সেই শঙ্কা থেকেই এই ‘নয়া বেতার নীতি’। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, এই নীতিমালা ঘোষণার প্রতিবাদে অথবা এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আমাদের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা একটি শব্দও বলেননি। তারা এটা মেনে নিলেন।

ফওজিয়া খান রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে ১৯৬৭-তে একটি গীতি-বিচিত্রা প্রচার করেন। তাতে ধারাবিবরণীতে তিনি বলেন, ‘আমাদের আজাদ ওয়াতান যেন আল্লারই দান। দেশের মাটির তরে এ দেশের প্রতিটি মানুষ উৎসর্গকৃত প্রাণ। জান দিয়ে হলেও দেশের মান ফিরিয়ে আনবার জন্যই যেন জন্মেছে এ দেশের লক্ষ কোটি নরনারী।’ [এলান]

শিক্ষিত বাঙালি অনেকেই সেদিন মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ‘আজাদ ওয়াতান’ বলতেই পছন্দ করতেন। যে শব্দ দুটি বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতো। ওই ‘গীতি-বিচিত্রা’য় পরিবেশিত হয়েছিল যে গানটি, তা কবি হাবিবুর রহমানের রচনা : ‘আমাদের এই পাক আজাদ ওয়াতান/ দুনিয়ার জান্নাত আল্লার দান।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক-দেড় বছর আগেও এসব গান রচিত ও পরিবেশিত হতো বেতারে। ফররুখ আহমদের একটি গানও ছিল খুবই প্রচলিত :

আজাদ ওয়াতান, স্বাধীন পাকিস্তান
মজলুমানের মঞ্জিল মহীয়ান।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের একনায়কত্বের সময় দেশে শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, অবকাঠামো প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি হয়েছিল, কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা হয়। বাম প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনেকেই কারারুদ্ধ হন। এমনকি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সবচেয়ে। সোচ্চার আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে একটির পর একটি মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছিল। তারপর তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে প্রায় মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। দেশের লেখক-শিক্ষাবিদেরা এসবের। প্রতিবাদ না করে তাঁরা মৌলিক গণতন্ত্র ও নতুন বেতার নীতি বা প্রপাগান্ডা নীতির প্রশংসাই করতে থাকেন। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতনের মাত্র চার মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে যিনি বিরামহীন গালাগালি করতেন, এক প্রবন্ধে আইয়ুব সরকারকে পরামর্শ দিয়ে লেখেন :

‘বর্তমান বিশ্বে যে কোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের একটি মস্ত বড় সোপান প্রচারকার্য। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক সর্বক্ষেত্রেই আজ প্রচারের মাধ্যমে কেউ বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে, আর কেউ বা এর অভাবে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।…

‘প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেতার। আজকাল এখান থেকে নিয়মিত মৌলিক গণতন্ত্রের উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে।… পল্লী অঞ্চলের মৌলিক গণতন্ত্রীদের সহায়তায় আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে। ঘন ঘন এ ধরনের সভা সমিতি ডাকলে নিশ্চয়ই গ্রামবাসীদের সাড়া পাওয়া যাবে।’

[নীলিমা ইব্রাহীম ‘সমবায় ও প্রচারকার্য’, দৈনিক পাকিস্তান, ৩ নভেম্বর ১৯৬৮]

আইয়ুব ক্ষমতা গ্রহণের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে ১৯৬৭-র শেষ দিক থেকেই ব্যাপক প্রচারাভিযান শুরু করে সরকার। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘উন্নয়নের দশ বছর’। সেটা যেকোনো সরকারই করতে পারে। আইয়ুব স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছিলেন বাঙালি বিদ্বৎসমাজের। ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ আজিজন নেসা (তমঘা-ই-কায়েদে আজম) লিখেছিলেন :

‘উন্নয়ন দশকের পটভূমিকায় দেখা যায়, জাতি তখন অনিশ্চয়তার পথে অগ্রসর হচ্ছিল। শঙ্কিত জনসাধারণ আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, কে দেখাবে আলো? কোন পথে চলব? একদিকে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত, অন্যদিকে বিপর্যস্ত দেশ নানা সমস্যার সম্মুখীন। দেশ ও জাতির এই চরম দুঃসময়ে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এগিয়ে এলেন নির্ভীক অকুতোভয়, একনিষ্ঠ, দুর্জয় মনোবলের অধিকারী এক নেতা ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। বিহ্বল, মোহগ্রস্ত জাতিকে উদাত্ত আহ্বানে জাগিয়ে তুললেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শাসনভার গ্রহণ করে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শাসনব্যবস্থার সনাতন কাঠামো ভেঙে আনলেন এক নববিপ্লব। শুধু শাসনব্যবস্থায় নয়, যা অসুন্দর, অসার্থক, অকল্যাণকর তা দৃঢ়চিত্তে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে দূর করে আহ্বান করলেন সুন্দর, সার্থক ও কল্যাণকে। তাই কল্যাণের মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত হলো চারদিক, সূচিত হলো শুভ পদধ্বনি।…

‘প্রেসিডেন্ট শাসনভার গ্রহণ করেছেন তা আজ এক দশক পূর্ণ হতে চলেছে। এই এক দশকের মধ্যে সারা দেশে এক নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব উন্নয়ন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। প্রেসিডেন্টের কর্তব্যপরায়ণতা প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করে সজীব করে তুলেছে। যে দিকে তাকানো যায় চোখে পড়ে কাজ আর কাজ। গোটা দেশটাই যেন হঠাৎ এক সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছে। কেউ আর আলস্যভরে আয়েশী জীবনযাপনের অবকাশ পাচ্ছে না। তামাম দেশটা এমনি কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে তা কেউ কি দশ বছর আগে ধারণা করতে শিখেছিল। একজন কিন্তু শিখেছিলেন তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে, দূরদৃষ্টি ও মননশীলতা দিয়ে। তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান।

[‘প্রদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি, দৈনিক পাকিস্তান, ৩ নভেম্বর, ১৯৬৮]

এই স্তৃতিমূলক লেখা প্রকাশের এক মাস পরেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করেন মওলানা ভাসানী এবং দুই মাসের মধ্যে ঘটে গণঅভ্যুত্থান। আইয়ুব পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি যার হাতে ক্ষমতা দেন, তিনি মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যাকারী।

আইয়ুব প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্র, যা সর্বজনীন ভোটাধিকারের পরিপন্থী, যার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ সংগ্রাম করছিল, তার প্রশংসা করে প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। কবি, কথাশিল্পী, প্রবন্ধকার ও শিক্ষাবিদ অনেকেই মৌলিক গণতন্ত্রের প্রশংসা করে লিখেছেন। সেকালের একজন খ্যাতিমান লেখক ও শিক্ষাবিদ জহুরুল হক লিখেছিলেন :

‘.. জাতির ইতিহাসের এক অত্যন্ত জরুরি মুহূর্তে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আবির্ভাব ঘটেছিল।

‘দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের স্তূপীকৃত আবর্জনা অপসারণ করে নুতনকে ও নির্মলকে নির্মাণ করে তোলার ব্রত তিনি গ্রহণ করেছিলেন।’

[জহুরুল হক, রাষ্ট্রপ্রথার বিবর্তন ও মৌলিক গণতন্ত্র, পাকিস্তানী খবর, পাকিস্তান দিবস সংখ্যা, ২৩ মার্চ ১৯৬৮, পৃ. ৩৯]

কেউ কেউ অনুরোধেও হয়তো-বা লিখে থাকবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখার দায় লেখকেরই। মোহাম্মদ বরকতউল্লাহর মতো সৎ ও মননশীল ব্যক্তিত্ব এক নিবন্ধে লিখেছিলেন:

‘মৌলিক গণতন্ত্রের যে আদর্শ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছেন, তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত ও পূর্ণ হওয়ার সুযোগ রয়েছ যথেষ্ট।… ক্রমশ যোগ্যতর মানুষ সদস্য হয়ে হয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলে আসছে এবং গণতান্ত্রিক আদর্শকে পূর্ণভাবে রূপায়িত করতে এগোচ্ছে। ইহাই বর্তমান সরকারের আশা ও বিশ্বাস। ইহার চাবিকাঠিও জনগণেরই হাতে। তারা যদি ভোট দেবার সময় যোগ্য লোকদিগকে বাছাই করে ইউনিয়ন কাউন্সিলে পাঠায় তা হলে সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে।’

[পাকিস্তানী খবর, ২৩ মার্চ ১৯৬৮]

যিনি ছিলেন আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিজগতের অভিভাবকতুল্য, সেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পল্লী তথা, দেশ উন্নয়নে এর [মৌলিক গণতন্ত্রের] উপকারিতা সম্বন্ধে’ লিখেছিলেন, এই গণতন্ত্রের এখনও শৈশব অবস্থা। কাজেই ভবিষ্যতেই আমরা তার পূর্ণ বিকাশ দেখতে আশা রাখি। যেমন ছেলে বড় হলে তবে তার ষোলআনা গুণ প্রকাশ পায়। … তারা নামাজ-রোজা প্রভৃতি ধর্মকার্যের জন্য উপদেশ দিয়ে, এবং যারা তা মানে না, তাদের জন্য সামাজিক শাসনের বিধান করে পাকিস্তানকে আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেন। …এমন অনেক কাজ রয়েছে, যা মৌলিক। গণতন্ত্রের কল্যাণে আমরা সম্পাদন করতে পারি, যাতে করে একদিন এ দেশে government of the people, by the people, for the people অর্জন করা। সম্ভব হয়ে ওঠে।

[পাকিস্তানী খবর, ২৩ মার্চ ১৯৬৮]

মানুষ চাইছিল সর্বজনীন ভোটাধিকার ও সংসদীয় গণতন্ত্র, পরোক্ষ ইলেকটোরাল কলেজের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়। এসব প্রপাগান্ডায় মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং তিন মাস পরে গণরোষে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *