০৭. সেই স্কুলে পড়ার সময়

দ্বিতীয় পর্ব

সেই স্কুলে পড়ার সময় আমার ডায়েরী ছিল। তাতে লিখতে হতো কবে কি পড়া, কি কি হোম-টাক্স করতে হবে, স্কুলে কবে কোন উৎসব, নানা প্রতিযোগিতায় নাম দেবার দিন, কবে কোন দুটি ইত্যাদি ইত্যাদি এইসব।

দিল্লিতে ডাক্তারী পড়তে এসে এই ধরনের ডায়েরী লেখার দরকার হয়নি।

ছোটবেলা থেকে ব্যক্তিগত ডায়েরী লেখার অভ্যাস খুব কম মানুষের থাকে; তবে বড় হবার পর অনেকেই ডায়েরী লেখেন। তার কারণ বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের মন ডানা মেলে উড়তে শুরু করে। কত কি স্বপ্ন দেখে, কত নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা ভাব-ভালবাসা সুখ-দুঃখের টুকরো টুকরো মেঘ মনের আকাশে আনাগোনা আসা-যাওয়া করে। জমতে থাকে ছোট্ট-ছোট্ট, টুকরো-টুকরো একান্ত ব্যক্তিগত কথা।

যে কথা, যে চিন্তা-ভাবনা-ভাব-ভালোবাসা-সুখ-দুঃখের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করা না গেলেও প্রকাশ করতে মন চায়। সেইজন্যই ব্যক্তিগত ডায়েরীতে সেসব লিপিবদ্ধ করতে মন চায়, ইচ্ছে করে। কোন গোপন কথাই মানুষ চিরদিন নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারে না। অসম্ভব।

যাইহোক আমি যৌবনে পদার্পণ করার পরও আমার মনে তেমন কোন আবেগ বা ভাব-ভালবাসা সুখ-দুঃখের চোরা মেঘ আনাগোনা করেনি। আমার সব ব্যাপারই ছিল খোলামেলা। সব কিছুই ঘটতে প্রকাশ্যে, নানাজনের সামনে। তাছাড়া আমার জীবনের সব চাইতে কাছের, সব চাইতে প্রিয়, সব চাইতে কাম্য যে দুটি নারী, তাঁরা তো মহীয়সী মা-বড়মা। এরাই আমার খেলার সাথী, এরাই, আমার সব চিন্তা ভাবনার অংশীদার। এদের স্পর্শে গন্ধে সান্নিধ্যে আমি আনন্দের মানস সরোবরে ভেসে বেড়াই।

এই দুটি নারীর সঙ্গে আমার একান্ত ঘনিষ্ঠতা, একাত্মতার ব্যাপার কে না জানে?

যে ডায়েরীতে একান্ত নিজস্ব বা গোপন কথা লেখা হয়, সেখানে মা-বড়মাকে টেনে আনা যাবে না।

দিল্লীতে ডাক্তারী পড়তে এসে আলাপ-পরিচয় হলো বহু মেয়ের সঙ্গে। এরা সবাই আমার ব্যাচের ছাত্রী না কিছু মেয়ে আবার দু’এক বছরের সিনিয়র, কিছু মেয়ে আমার পরবর্তী ব্যাচের। তাহোক। এদের অনেকের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা, হৃদ্যতা ও বন্ধুত্ব। কত হাসি-ঠাট্টা হয় ওদের সঙ্গে।

আজ ডায়েরী লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে।…

.

একেবারে প্রথম দিনের কথা। প্রথম সাত-দশ দিনের মধ্যেই অধ্যাপক

ডাক্তাররা আমাদের মগজ ধোলাই করে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন, অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি যে যত ভাল জানবে, সে তত ভাল ডাক্তার হবে।

ডাক্তারী যখন পড়তে এসেছি, তখন অবশ্যই ভাল ডাক্তার হতে হবে। তবে সব ছাত্র-ছাত্রীরাই এই ব্যাপারে এক মত কিন্তু…

হ্যাঁ, সত্যিই বেশ বড় একটা কিন্তু আছে। অ্যানাটমি ভাল করে জানতে হলে প্রতিদিন দু’চার ঘণ্টা একাগ্র চিত্তে ডিসেশান করতে হবেই।

ডিসেক্‌শান?

মানে পচা মড়া কাটা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মড়া কাটা। শুনেই অনেক চমকে উঠল কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া তো চলবে না।

কিছু ছেলে-মেয়ে জামাকাপড়ে প্রচুর সেন্ট দিয়ে ডিসেশান হল-এ পা দিয়েই নাকে রুমাল দিতে বাধ্য হলো।

সত্যি ডিসেকশান হল-এর গন্ধ সহ্য করা প্রায় দুঃসাধ্য। হল-এর মধ্যে পঁচিশ তিরিশ থেকে পঞ্চাশ-ষাটটা ডেডবড়ি পড়ে থাকে। কোন ডেডবডিই অক্ষত না। ছাত্র-ছাত্রীদের কাটাকুটির কৃপায় এক একটা মৃত দেহের একেক রকম অবস্থা। দেখেই শিউরে উঠতে হয়। তাছাড়া সারা ঘরে অসহ্য বিকট দুর্গন্ধ। সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বমি করে। অনেকেই কিছু খেতে পারে না দীর্ঘ দিন।

তবে পচা ভাদরের মেঘও একদিন কেটে যায়। নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ মনের আনন্দে নেচে বেড়ায়। সূর্যের আলোয় ঝলমল করে পৃথিবী। ঠিক সেই রকম মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীদেরও ডিসেকশন করার আতঙ্ক ভয় যন্ত্রণা আস্তে আস্তে চলে যায়।

.

হঠাৎ সেদিন আমার ডিসেকশন টেবিলের পাশে এসেই বিপাশা ত্রিপাঠী এক গাল হেসে বলে, শুভ, চলো, চলো, অনেক হয়েছে।

যাস্ট এ মিনিট।

এক মিনিট তো দূরের কথা, দশ-পনের মিনিট পরেও আমি নড়তে পারি না।

বিপাশা গলা চড়িয়ে বলে, সবাই কখন চলে গিয়েছে জানো?

এবার আমি মুখ তুলে দৃষ্টি ঘুরিয়েই বলি, সবাই কখন গেলো? আমি তো টেরও পাইনি।

যাইহোক ডিসেকশান বন্ধু গুছিয়ে হাত ধুয়ে বিপাশার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসি।

মাস খানেকের মধ্যে অন্তত পাঁচ-ছ’ দিন সবাই চলে যাবার পর আমি আর বিপাশা ডিসেকশান রুম থেকে রেরোই।

সেদিন ডিসেকশান হল থেকে বেরুতেই আমাদের ব্যাচের আট দশজন ছেলে মেয়ে আমাদের ঘিরে ধরলো। সবার মুখেই অর্থপূর্ণ হাসি সবার চোখেই কৌতুক-দৃষ্টি।

বাসুদেব কুলকার্নি হাসতে হাসতে বলে, তোদর তান্ত্রিক সাধনা কেমন হলো?

বিপাশা চাপা হাসি হেসে ডান হাত দিয়ে ওর গাল টিপে বলল, বাসুদেব, রিয়েলী ইট ওয়াজ ওয়ান্ডারফুল।

ও এক নিঃশ্বাসেই বলে, আর ইউ হ্যাপি?

আই উইল বী হ্যাপি যদি আমাদের খাইয়ে দাও।

ওর মুখের কথা ফুরুতে না ফুরুতেই বিপাশা ওর গালে একটা চড় মেরে বলে, আরো খাবি?

বাসুদেবও সঙ্গে সঙ্গে ওকে চড় মারতে যায় কিন্তু বিপাশা ঝড়ের বেগে সরে যায়।

সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।

কিছুদিন আমাকে আর বিপাশাকে নিয়ে দু’চারজন কিছুদিন হাসি-ঠাট্টা করলেও আস্তে আস্তে সবাই বুঝেছিল, আমরা নিছকই বন্ধু। এই বন্ধুত্ব দিন দিন আরো গভীর, আরো মধুর হয়েছে। দিল্লীতে যাবার পর বিপাশাই আমার হাতে প্রথম রাখী পরায়।

তখন আমরা থার্ড ইয়ারে উঠেছি। কফি খেতে খেতে আমি বিপাশাকে বলি, তুমি কী হতে চাও? গাইনি? পিডিয়াটিশিয়ান, জেনারেল প্রাকটিশানার…

ও একটু হেসে বলে, ব্যস! ব্যস! আর এগিয়ো না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বিপাশা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুভ, অন্য কাউকে বলিনি, বলতে পারবও না কিন্তু তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই যে আমার বাবা অতি সাধারণ সরকারী চাকুরে।

আমি জিজ্ঞাস দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই ও একটু ম্লান হেসে বলে, হি ইজ যাস্ট অ্যা আপার ডিভিশন ক্লার্ক।…

তোমার বাবা কোথায় কাজ করেন?

বেনারসের জেলা জজের অফিসে।

বিপাশা একটু থেমে বলে, আমরা তিন বোন; কোন ভাই নেই। তাছাড়া আমার মা-র কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে।…

আই সী।

বাবার আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। সংসার চালানো ছাড়াও মা-র জন্য প্রতি মাসে যথেষ্ট খরচ করতে হয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে মেয়েদের বিয়ে দেবার ক্ষমতা নেই বলেই বাবা আমাদের পড়াচ্ছেন।

তুমি কি এম. বি. বি. এস. পাশ করেই চাকরি করবে নাকি…

চাকরি করতেই হবে।

বিপাশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবাকে সাহায্য করতে না পারা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। তাছাড়া মা-র চিকিৎসা আর ছোট বোনদের দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে।

দিন দিন বিপাশার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কখনো কখনো ও আমার কথা জানতে চায়, জানতে চায় বাবার মৃত্যুর কথা, মা-বড়মার কথা, জ্যেঠু আর ভাইদার কথা।

এইসব সোনার পর বিপাশাও কত কথা বলে।

শুভ, তোমার বাবার মৃত্যুর কথা যখনই মনে হয়, তখনই মন খারাপ হয়ে যায়। তুমি তোমার বাবাকে এক মুহূর্তের জন্যও দেখতে পাওনি ভাবলেই আমার চোখে জল আসে। নিঃসন্দেহে তোমার জীবনের অর্ধেক অন্ধকার।

আমি কোন কথা বলি না; চুপ করে থাকি।

বিপাশা আমার একটা হাত ওর দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে দু’এক মিনিট চুপ করে থাকার পর বলে, আবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়, একদিক দিয়ে তোমার মা আর তোমার মত ভাগ্যবান খুব বেশি দেখা যায় না।

ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, অমন জ্যেঠু, বড়মা আর ভাইদা পাওয়া সত্যি অভাবনীয় সৌভাগ্যের ব্যাপার।

আমি একটু হেসে বলি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিপাশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তাছাড়া অমন দাদা, বন্ধুও বোন আর বাবাইসোনা পেয়েছিলেন বলেই তোমার মা স্বামীকে হারাবার দুঃখ সহ্য করতে পেরেছেন।

হ্যাঁ, বিপাশা তুমি ঠিকই বলেছ।

সময় ও সুযোগ হলে আমরা আরো কত কথা বলি।

একদিন একটা ক্লাশ শেষ হতেই বিপাশা ইসারায় আমাকে ডাক দেয়। তারপর করিডরের এক কোনায় গিয়ে বলে, শুভ, তোমাকে একটা কথা বলব; কিছু মনে করবে না তো?

কি আবার মনে করব? বলো, বললো, কি বলতে চাও।

কাল রাত্তিরে বাবা হস্টেলে ফোন করেছিলেন।

ফোন করেছিলেন কেন?

বাবা বললেন, এখুনি টাকা পাঠাতে পারছেন না কিছুদিন দেরি হবে।

ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, এদিকে পরশুর মধ্যেই হস্টেলে টাকা দিতে হবে। তুমি কি আমাকে…।

ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি একটু হেসে বলি, বিপাশা, ভুলে যেও না, তুমি আমার হাতে রাখী পরাও ইউ আর মাই সিস্টার।

আমি না থেমেই বলি, তুমি কোন ফি করো না। আমি আজই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রাখবো। তুমি কাল হস্টেলে টাকা দিয়ে দিও।

তোমার কোন অসুবিধে হবে না তো?

না, না, কোন অসুবিধে হবে না।

আমি সঙ্গে সঙ্গেই আবার একটু হেসে বলি, আমি জন্মাবার পর পরই মা আমার হায়ার এডুকেশনের জন্য যে ইন্সিওর করেন; তার পুরো টাকাই আমার ব্যাঙ্কে আছে। তাছাড়া মা আর জ্যেঠু প্রত্যেক মাসেই বেশ কিছু টাকা ব্যাঙ্কে জমা করেন।

বিপাশা একটু হেসে বলে, তার মানে তুমি বেশ মোটা টাকার মালিক।

দ্যাটস রাইট।

আমি এক নিঃশ্বাসেই বলি, সেইজন্যেই তো বললাম তোমার কোন চিন্তা নেই।

তোমার কথা শুনে খুব নিশ্চিন্ত হলাম। বাবা টাকা পাঠালেই আমি তোমাকে দিয়ে দেব।

হ্যাঁ, টাকা ফেরত দিও কিন্তু আর কোনদিন আমার হাতে রাখী পরাতে পারবে না।

কি আশ্চর্য।

কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার না। রাখী পরাবে আবার ধার-দেনার সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তা হয় না।

বিপাশা মুগ্ধ বিস্ময়ে আমার দিকে তাকায়। কোন কথা বলে না।

জীবনে কখনও তুমি আমার সঙ্গে হিসেব-নিকেশ করবে না; আমিও করব না। তুমি সারাজীবন আমার পাশে থাকবে, আমিও সারাজীবন তোমার পাশে থাকব।

হ্যাঁ, শুভ, তাই হবে।

.

মা-বড়মা ছাড়া যে নারীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে সে বিপাশা। ওকে দেখতে সত্যি ভাল। তাছাড়া ওর চোখে মুখে স্নিগ্ধ লাবণ্যে ভরা। এই ভরা যৌবনেও ওর চোখে-মুখে-শরীরের কোথাও যৌবনোচিত ঔদ্ধত্য নেই। দিল্লিতে এম. বি. বি. এস. পড়ার সময় ওর সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি কিন্তু কোনদিন কোন মাদকতার ভাব আসেনি আমার মনে। কোন বিনিদ্র রজনীও যাপন করিনি ওর চিন্তায়।

কোন দিন এক মুহূর্তের জন্যও বিপাশাকে নিয়ে ভবিষ্যতে জীবন কাটাবারও স্বপ্ন দেখিনি। আমার সঙ্গে এত ভাব-ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও ওর মধ্যেও কোনদিন কোন দুর্বলতা দেখিনি।

সেই সেবার ওকে টাকা দেবার সপ্তাহ খানেক পরই বিপাশা একটা খাম আমার হাতে দিয়ে একটু হেসে বলল, বাবা তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছেন।

চিঠিা হাতে নিয়েই পড়ি।…

স্নেহের শুভব্রত, আমার মেয়ে বিপাশা দীর্ঘ চিঠি লিখে সবকিছু জানিয়েছে। কৃতজ্ঞতায় না, তোমার জন্য গর্বে আর আনন্দে বুক ভরে গেছে। মেয়ের চিঠিতে তোমার কথা জেনে আমার স্ত্রী যে কি খুশি হয়েছে, তা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। আমার অন্য দুই মেয়ে-গঙ্গা আর কাবেরীও এই চিঠি পড়েই ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করেছে। ওরা দিনরাত বলছে, ভাইয়া পেয়েছে।

অফিসে বসে চিঠি লিখছি। দীর্ঘ চিঠি লেখার সময় সেই। তবে একটা কথা জানিয়ে পারছি না। দশেরা দেওয়ালীর ছুটিতে বিপাশা আমাদের কাছে আসবে। ঐ সময় তুমিও নিশ্চয় কলকাতায় যাবে। আমাদের সবার একান্ত ইচ্ছা আর অনুবোধ কলকাতা যাতায়াতের পথে তুমি আমাদের সঙ্গে কয়েকটি দিন কাটাও। তোমাকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমি আর আমার স্ত্রী বড়ই ব্যগ্র। তুমি নিশ্চয়ই এসো। আমরা সবাই খুব খুশি হবো, খুব আনন্দ পাবো। আশা করি তোমারও ভাল লাগবে।

প্রাণভরা আশীর্বাদ নিও।

–বিশ্বনাথ ত্রিবেদী

খুব ভাল লাগলো চিঠিটা পড়ে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বিপাশাকে বললাম, তুমি লিখে দিও আমি তোমার সঙ্গেই কাশী যাবে; তারপর ওখান থেকে কাতা যাবে।

সেবায় পুজোর ছুটিতে কলকাতা যাবার পথে বিপাশাদের সঙ্গে ক’দিন কাটাবার স্মৃতি আমি কোনদিন ভুলব না।

.

।ভোরবেলায় ডিলুক্স এক্সপ্রেস বেনারস ক্যাষ্ট স্টেশনে পৌঁছবার পর প্ল্যাটফর্মে নামতে না নামতেই ছুটে এলেন বিপাশার বাবা আর গঙ্গাকাবেরী। আমি বিপাশার বাবাকে প্রণাম করতেই উনি দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি জানতাম, তুমি আসবেই। তুমি এসেছ বলে খুব খুশি হয়েছি।

বিপাশার এক বোন আমাকে প্রণাম করেই এক গাল হেসে বলল, ভাইয়া, আমি গঙ্গা।

অন্য বোন প্রণাম করে বলল, ভাইয়া, আমি কাবেরী।

টাঙায় সামনের দিকে গঙ্গা আর কাবেরী আমাকে মাঝখানে নিয়ে বসলো; পিছনে বিপাশা আর ওর বাবা।

গঙ্গা আর কাবেরী আমার দুটো হাত ধরে কত কথা বলে। গঙ্গা বলে, জানো ভাইয়া, তোমার চিঠি পাবার পর থেকেই আমরা ক্যালেন্ডারে দাগ দিতে শুরু করি; আর মাকে বলি, মা ভাইয়া আর কত দিন পর আমাদের কাছে আসবে।

মা কি বলেন?

বলেন, আমিও তো দিন শুনছি ওর আসার জন্য।

কাবেরী এক হাত দিয়ে আমার মুখোনা ওর দিকে ঘুরিয়েই হাসতে হাসতে বলে, ভাইয়া, আজ তুমি ঘুমুতে পারবে না। আমরা সারারাত গল্প করব।

সারারাত গল্প করবে?

এত কথা জমে আছে যে সারারাত তো জাগতেই হবে।

জঙ্গম বাড়ির একটা গলির মুখে টাঙা থেকে নেমেই বিপাশার বাবা আমাকে সামনের একটা পুরনো একতলার বাড়ি দেখিয়ে বলেন, শুভব্রত, এই বাড়িরই পিছন দিকে আমরা থাকি।

দরজা দিয়ে ঢুকেই এক চিলতে উঠোন। তারই একপাশে বাথরুম-পায়খানা। উঠোনের পরই চার-পাঁচ ফুট চওড়া বারান্দা; ঐ বারান্দার এক পাশে রান্নাবান্না হয়। দুটি মাঝারি সাইজের ঘর। দুটি ঘরেই দুটি করে তক্তাপোষ। একটা ঘরের একদিকে একটা বেঞ্চির উপর বইপত্তর দেখেই বুঝলাম, এই ঘরেই গঙ্গা আর কাবেরী থাকে।

গঙ্গা বলল, ভাইয়া, তুমি আমাদের ঘরেই থাকবে।

আমি শুধু হাসি।

ঠিক সেই সময় গঙ্গাস্নান করে বাবা বিশ্বনাথের মাথায় জল ঢেলে বাড়ি ফিরলেন বিপাশার মা আরতি দেবী। পরনে অত্যন্ত সাধারণ সাদা খোলের শাড়ি। এক হাতে ভেজা শাড়ি-ব্লাউজ, অন্যহাতে তামার ঘটি। বুঝলাম, ওতেই গঙ্গাজল নিয়ে বাবার মাথায় ঢেলেছেন; বোধহয় একটু গঙ্গা জল নিয়েও এসেছেন। মাথায় এক রাশ চুল; তখনও জল ঝরছে। মুখে স্নিগ্ধ প্রশান্ত হাসি। সব মিলিয়ে এক কল্যাণী মাতৃ মুর্তি। এক ঝলক দেখেই শ্রদ্ধায় ভক্তিতে মাথা নুয়ে আসে।

ওনাকে দেখেই কাবেরী দু’হাতে তালি দিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে, ভাইয়া এসে গেছে।

আমি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করি। উনি হাতের কাপড় আর তামার ঘটি নামিয়ে রেখে দু’হাত দিয়ে আমার মুখোনা ধরে কপালে স্নেহচুম্বন দেবার পর এক গাল হেসে বলেন, আমি আজকাল বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলি, আমার ছেলেও দিল্লীতে ডাক্তারী পড়ছে।

শুনে আমার মন ভরে যায়। আমিও এক গাল হেসে বলি, নিশ্চয়ই আমি আপনার ছেলে।

আরতি দেবী দুহাত দিয়ে আমার মুখোনা ধরে অপলক দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে বলেন, একটা ছেলে ছিল না বলে মনে বড় দুঃখ ছিল। তোমাকে পেয়ে আমার সব দুঃখ চলে গেছে।

আমিও একটু হেসে বলি, আমাকে না দেখেই এত ভালবেসে ফেলেছেন!

কি করব বাবা!

উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, এই যে বাবা বিশ্বনাথের মাথায় প্রতিদিন জল ঢেলে আসি কিন্তু তাকে তো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শুধু তার কথা জেনেই তাকে ভক্তি করি, পুজো করি।

আরতি দেবী সঙ্গে সঙ্গেই একটু হেসে বলেন, তাহলে তোমার কথা জানার পর তোমাকে কেন ছেলে মনে করবো না?

গঙ্গা দু’হাতে দু’কাপ চা নিয়ে আমাদের পাশে এসে বলে, ও মা, পরে ছেলেকে আদর করো এখন ভাইয়াকে চা খেতে দাও।

এইভাবেই হলো শুরু।

সাড়ে ন’টার আগেই বিপাশার বাবা অফিসে রওনা হলেন। বেরুবার আগে উনি আমাকে বললেন, আফিস থেকে ফিরে আসার পর তোমার সঙ্গে গল্প করবো।

তারপর আমাদের পাঁচজনের কত কথা কত গল্প। চা খেতে খেতে গল্প, রান্না করার সময় গল্প, দুপুরে সবাই মিলে বারান্দায় খেতে বসেও গল্প।

না, তাতেও যেন কথা ফুরোয় না। সারা দুপুর কত কথা, কত হাসি।

সকালে জলখাবার খেতে খেতেই আমি আরতি দেবীকে বললাম, আপনি তো জানেন, আমার মা আছেন, বড়মা আছেন।

উনি একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, বিপাশা সব জানিয়েছে।

তাই আমি আপনাকে ছোট মা বলব। আপনার আপত্তি নেই তো?

না, বাবা, কোন আপত্তি নেই।

বিপাশা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, শুভ, তোমাকে কি গঙ্গার হায়ার সেকেন্ডারীর রেজাল্টের ডিটেলস্ বলেছি?

তুমি শুধু বলেছিলে, ও ফার্স্ট ডিডিসন পাশ করেছে।

তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে গঙ্গা শুধু ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করেনি, ও ও ফিজিক্স-কেমিস্ত্রী আর ম্যাথ-এ হাইয়েস্ট নম্বর পেয়েছে।

আমি কোন মন্তব্য করার আগেই কাবেরী গলা চড়িয়ে বলে, ভাইয়া, মেজদি সমস্ত ইউ-পি’র মধ্যে এই রেকর্ড করেছে।

গঙ্গা আমার আমার বাঁ দিকেই বসেছিল। আমি বাঁ হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে একটু কাছে টেনে নিয়ে বলি, সারাজীবন তোমাকে এইভাবে জয়ী হয়ে মা বাবার মুখে হাসি ফোঁটাতে হবে।

ও মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়েই মুখ নীচু করে বলে, আমরা তিন বোনেই সব সময় সেই চেষ্টা করি।

তা আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মেয়েদের ঘরেই আমাদের আড্ডার আসর বসলো। একটা তক্তাপোষে বিপাশা আর ওর মা, অন্য তক্তাপোষে আমি আর অন্য দুই মেয়ে।

বিকেলের দিকে বিপাশা আমাকে বলে, শুভ, তুমি কি এখানকার গঙ্গায় নৌকা চড়েছে?

না।

তাহলে তুমি গঙ্গা আর কাবেরীকে নিয়ে নৌকা চড়ে এসে খুব ভাল লাগবে। আমিও ভাবছিলাম, একটু ঘুরে আসি।

.

চা খেয়েই আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। সত্যি, নৌকায় চড়ে ঘাটগুলি দেখতে দেখতে কত কি মনে হলো। মনে হলো, যুগ-যুগান্তর ধরে ভারতবর্ষের মানুষ দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা সাফল্য-ব্যর্থতা ভুলে আত্মার মুক্তি সাধনায় নিজেদের মগ্ন রাখতে জানে। এটাই ভারতবর্ষের চিরন্তন রূপ। গঙ্গার বুকে নৌকায় বসে বসে অসংখ্য মন্দিরের সন্ধ্যারতির কাসর-ঘণ্টার আওয়াজ শুনলাম। তারপর শেষ হয় আমাদের নৌকা বিহার।

বাড়ি ফেরার পথে গঙ্গা আর কাবেরী দু’জনেই বলল, ভাইয়া, এখনই বলে দিচ্ছি, রাত্রে তোমাকে একা শুতে দেব না। আমরা দুজনে দু’পাশে সোব।

আমি একটু হেসে বলি, একটা খাটে কি তিনজনে শুতে পারবো?

ওরা দু’জনে একসঙ্গে বলে, দুটো খাট জোড়া দেব।

বাড়ি ফিরেই কাবেরী সগর্বে ঘোষণা করে, রাত্রে আমরা দুজনে ভাইয়ার দু’পাশে শোবো।

বিপাশা একটু হেসে বলে, আমি কোথায় শোবো?

গঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে জবার দেয়, তুমি মা-র কাছে শোবে।

ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসে বিশ্বনাথবাবু এক গাল হেসে বলেন, দেখছে শুভব্রত, তোমাকে পেয়ে তোমার বোনেরা কি দারুণ একসাইটেড?

ওদের কাছে পেয়ে আমিও খুব একসাইটেড।

মুহূর্তের জন্য থেমে বলি, আমি তো জীবনে কোনদিন এই আনন্দ পাইনি, তাই খুব ভাল লাগছে।

বিপাশা দুটো আসন পেতে বলে, তোমরা বসে কথা বলল।

হ্যাঁ, আমরা দুজনে মুখোমুখি বসতেই বিশ্বনাথবাবু বলেন, সারাদিন কেমন কাটালে?

খুব ভাল।

খুব ভাল কেন?

আমি একটু হেসে বলি, এমন আন্তরিকতা আর প্রাণ ঢালা ভালবাসা পেয়েও ভাল থাকব না?

হ্যাঁ, শুভব্রত, আমাদের সংসারে আন্তরিকতা আর ভালবাসার কোন অভাব নেই।

মনের দুর্বলতা থেকেই তো অভাব বোধের জন্ম।

তুমি ঠিকই বলেছ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লোভ থেকেও অভাববোধ জন্মায়।

আপনি ঠিকই বলেছেন; যে লোভী, তাকে কোনভাবেই খুশি করা যায় না।

আরো কত কথা হয় আমাদের। মাঝে মাঝেই যোগ দেন আরতি দেবী। আলোচনা চলল খাবার সময় পর্যন্ত।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার সময় বিপাশা অন্য দুই বোনকে বলে, তোরা দু’জনে শুভ’র সঙ্গে জমিয়ে গল্প করবি আর আমি বুঝি ভাল মেয়ে হয়ে মা-র কাছে। শুয়ে থাকব?

কাবেরী চাপা হাসি হেসে বলে, দিদি, তুই বরং আমাদের সঙ্গে ঘণ্টা খানেক গল্পগুজব করে শুতে যাস।

ইস! তুই কী উদার!

বিপাশা বলে, আমিও তোদের ঘরেই শোবো।

শেষ পর্যন্ত আমরা চারজনেই ঐ ঘরে শুই। তবে গঙ্গা আর কাবেরীকে দু’পাশে নিয়ে শুতে খুবই অশ্বস্তিবোধ করি। গঙ্গা কুড়ি বছরের যুবতী; কাবেরীও নেহাত ছোট না। ওর বয়স সতের। আমি ওদের দুজনের মাঝখানে প্রায় কাঠের মতো শুয়ে থাকি।

ওরা দু’জনে আমার অবস্থা না বুঝলেও বিপাশা ঠিকই বুঝতে পারে। ও একটু হেসে বলে, শুভ, গঙ্গা আর কাবেরী তোমার চাইতে অনেক ছোট। তোমার অস্বস্তিবোধ করার কোন কারণ নেই।

কাবেরী সঙ্গে সঙ্গে এক হাত দিয়ে আমার মুখোনা ওর দিকে ঘুরিয়ে বলে, ভাইয়া, আমি আর মেজদি তোমার পাশে শুয়েছি বলে তোমার খারাপ লাগছে?

না, না খারাপ লাগছে না।

গঙ্গা বলে, ভাইয়া, তুমি প্লীজ স্বাভাবিক হয়ে শোও। তা না হলে আমার খারাপ লাগছে।

আমি দুটো হাত ওদের মাথায় রেখে বলি, আমার তো কোন ছোট বোন নেই; তাই অভ্যাস নেই। তবে আজ তোমাদের দুজনকে দুপাশে পেয়ে আমার সত্যি খুব ভাল লাগছে।

এর পর আমি সত্যি একটু স্বাভাবিক হয়ে শুই কিন্তু সতর্ক না হয়ে পারি না।

যাই হোক আস্তে আস্তে জমে ওঠে আমাদের গল্পগুজব। কি ভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, তা আমরা কেউই টের পাই না। হঠাৎ একবার টর্চ জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখেই বিপাশা হাসতে হাসতে বলে, শুভ, আড়াইটে বাজে।

গঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে বলে, বাজুক ভাইদার ঘুম পায়নি।

তাই নাকি?

ইয়েস মাই ডিয়ার দিদি! ভাইদার সত্যি ঘুম পায়নি।

তোরা কি ওকে সারা রাত্তির ঘুমোতে দিবি না?

আমি বলি, বিপাশা, তুমি ঘুমোও। আমি আর একটু ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই ঘুমোব।

শুভ, আমি ঘুমোচ্ছি। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। তুমি কিছু মনে করো না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ঘুমোও। আমি কিছু মনে করবো না।

বিপাশা বোধহয় চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে, মিনিট দশেকের মধ্যে কাবেরীও ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের দু’জন ঘুমিয়ে পড়ায় গঙ্গা মহা খুশি। এক গাল হেসে বলে, ভাইয়া, এবার তুমি আমার দিকে পাশ ফিরে শোও।

হ্যাঁ, আমি ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়েই বলি, তোমার ঘুম পাচ্ছে না?

না।

কেন?

তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, আমাদের মধ্যে দৈন্যও নেই, দুঃখও নেই; আমরা পাঁচজনেই খুব সুখী কিন্তু আমাদের কোন ভাই নেই বলে আমরা সবাই এত বছর ধরে একটা বিচিত্র শূন্যতাবোধ করেছি।

তা তো খুবই স্বাভাবিক।

আজ মা ছেলে পেয়েছে, আমরা ভাইয়া পেয়েছি। এমন আনন্দের দিনে কি ঘুম আসে?

আমি আলতো করে ওর মুখের উপর হাত রেখে বলি, গঙ্গা, আমিও এত বছর ধরে যে শূন্যতা, যে অভাববোধ করেছি, তা তোমাদের পেয়ে চলে গেল।

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, আজ আমারও পরম আনন্দের দিন।

গঙ্গাও আমার মুখের উপর একটা হাত রেখে বলে, মা কি বলছিলেন জানো?

কি বলছিলেন?

বলছিলেন, শুভব্রতর মত ছেলে পেয়ে আমার বল-ভরসা হাজার গুণ বেড়ে গেল। এখন যে সমস্যাই আসুক, আমার ছেলেই সব সামলে নেবে।

হ্যাঁ, গঙ্গা, আমি সারাজীবন তোমাদের পাশে থাকব। সে বিশ্বাস, সে আস্থা আমাদের আছে।

.

আমার ডায়েরীর পাতায় ওরা বার বার ফিরে এসেছে। ফাইন্যাল এম. বি. বি. এস. পরীক্ষার পর ওদের তিন বোনকে নিয়ে কলকাতা যাবার কাহিনী, ওদের তিনজনকে কাছে পেয়ে মা-বড়মা আর জ্যেঠু-ভাইদার আনন্দে খুশিতে মেতে ওঠার কথা, ওদের তিনজনের পাল্লায় পড়ে ওদের সঙ্গেই মা-বড়মার কাশী যাওয়ার বৃত্তান্তে ভরে গেছে পাতার পর পাতা।

বিপাশাদের পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা অভাবনীয় না হলেও অপ্রত্যাশিত,। পৃথিবীতে অনেকেই অপ্রত্যাশিত ভাবে পেয়ে যায় আপনজনের সান্নিধ্য, স্নেহ মমতা-ভালবাসা। কিন্তু আজ যা লিখতে বসেছি, তা যেমন অপ্রত্যাশিত, সেইরকমই অভাবনীয়। আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, এমন একজনের সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য পাবো; আমি ভাবতে পারিনি, আমার এত বছরের সযত্নে লালিত পালিত চিন্তা-ভাবনা-আদর্শ-দৃষ্টিভঙ্গী কয়েকটি অবিস্মরণীয় মুহূর্তের মধ্যে বদলে যাবে।

ফাইন্যাল এম. এস. পরীক্ষার পর কলকাতা গেলাম আমার প্রিয়তম চারটি মানুষের সান্নিধ্যে আনলে কয়েকটি দিন কাটাবার জন্য। আমি যত উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে গিয়েছিলাম, বড়মার কাছে ভাইদার বিয়ের খবর শুনে আমি ঠিক তত দুঃখ ও আঘাত পেলাম। ভীষণ রাগও হলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি তখনই আবার এয়ারপোর্টে ফিরে যাই পরবর্তী ফ্লাইটে দিল্লীতে আসার জন্য। না, তা পারলাম না। মা-বড়মা-জ্যেই-ভাইদাকে কোন রকম দুঃখ বা আঘাত দেবার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। পারলাম না। বড়মা জ্যেঠুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদেছি কিন্তু ওদেরই বুকের উপর মুখ রেখে সব দুঃখ ভুলেছি।

এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল কিন্তু যে মুহূর্তে ভাইদার স্ত্রীর রূপ-গুণের কথা শুনলাম, আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারি না। আমি দপ করে জ্বলে উঠি। আমি চিৎকার করে বড়মাকে বলি, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী হার ফেস!

তারপর?

ভাইদার স্ত্রী আমার ঘরে ঢুকে আমার চোখের উপর চোখ রেখে বলল, তাতাই, আসামী হাজির। আমাকে কি শাস্তি দেবে দাও।

আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। মুহূর্তে মনে হলো, খাজুরাহোর সব চাইতে অপরূপ, সব চাইতে মোহময়ী, সব চাইতে উত্তেজক নারী মূর্তি হঠাৎ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আর আমি?

ঠিক মর্মর মূর্তির মত আমি একই রকম অপলক দৃষ্টিতে রূপ-মুগ্ধ, মোহগ্রস্থ, কামনায় জর্জরিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

ও আরো কত কি বলে কিন্তু আমি শুনতে পাই না। শুনব কী করে? আমার অনেক ইন্দ্রিয়ই যে অবশ হয়ে গেছে। আমার শিরা-উপশিরার মধ্যে দিয়ে তখন অশান্ত দুর্বিনত এক পাগলা ঘোড়া ছুটছে।

দিল্লীতে ডাক্তারী পড়তে গিয়ে কত সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম, তাদের অনেকের সঙ্গেই মেলামেশা করলাম কিন্তু কেউ আমাকে এভাবে পাগল করেনি।

সামনের মূর্তি দেখে আমার শরীরের প্রতি অণু পরমাণুতে দাউ দাউ করে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে। এক একটি মুহূর্তে মনে হয় আমি বোধহয় আর নিজেকে সংযত রাখতে পারবো না; মনে হয় কোন ন্যায়-অন্যায় বোধ আমার এই কামনার আগুন নেভাতে পারবে না।

না, না, আর সহ্য করা যায় না।

আমাকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হবে, এই খাজুরাহোর জীবন্ত রম্ভা উর্বশীর যৌবন সুধা উপভোগ না করে আমি বাঁচতে পারবো না।

হঠাৎ মাথাটা ঘুরে ওঠে। নিজেই যেন নিজের গালে সজোরে থাপ্পড় মারি।

ছি! ছি! আমি কি ভাবছি? আমার প্রাণপ্রিয় ভাইদার স্ত্রীর সম্মান রাখতে জানি না?

না, না, এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না। অসম্ভব অকল্পনীয়। কিন্তু তবুও কি একটা মোহে আমি তখনো অপলক দৃষ্টিতে ওর দিতে তাকিয়ে থাকি।

হঠাৎ দুর্বা আমার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত মেলাতেই মনে হলো হাজার হাজার ভল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহ আমার সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেল।

কী আছে এই মেয়েটির মধ্যে? গন্ধে স্পর্শে দর্শনে এই উম্মাদনা?

মনে মনে বলি, ঈশ্বর, কি উপাদান দিয়ে তুমি এই নারীকে সৃষ্টি করেছ?

এই সর্বনাশী আমার দু’গালে চুম্বন করতেই মনে হলো যেন সারা পৃথিবী টলমল করে উঠলো।

আবার এই ছলনাময়ী নারী আমার দু’হাত ধরে গেয়ে ওঠে–আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব…।

আচ্ছা, এইসব মিথ্যে কথা বলে আমার সর্বনাশ করার কি দরকার? তুমি আমাকে ভালবাসবে, সে কথাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?

আমি মনে মনে না হেসে পারি না। মুখে বলতে পারি না কিন্তু মনে মনে বলি, সেই সৃষ্টির আদিমততম কাল থেকে তোমরা তোমাদের রূপ-যৌবনের পসরা সাজিয়ে পুরুষকে প্রলুব্ধ করে চলেছ, ভালবাসার অভিনয় করে পুরুষদের এক অলীক আনন্দময় জগতে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করেনি। মূর্খ পুরুষ যুগ যুগ ধরে তোমাদের কামনা-বাসনার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেরাই পুড়ে মরেছে। তোমরা পুরুষকে আনন্দও দাও না, শান্তিও দাও না। যে ঔদার্য মহত্ত থাকলে নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দেওয়া যায়, নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া যায়, তা তোমাদের নেই। প্রেমের খেলায় পুরুষ চিরকাল ব্যর্থ, পরাজিত, সর্বশান্ত হয়েছে। আর তোমরা? সতী-সাধ্বীর ধবজা উড়িয়ে অন্য পুরুষকে দিয়ে নিজের কামনা বাসনার জ্বালা মিটিয়েছ।

দূর্বা! তুমিও তো এদেরই উত্তরসুরী, তাই না?

.

এক সপ্তাহ কলকাতায় কাটিয়ে দিল্লীতে ফিরেই প্রফেসর রাও-এর কাছে যাই। উনি যথারীতি এক গাল হেসে বলেন, ইয়েস মাই ডিয়ার বয়, কলকাতায় গিয়ে নিশ্চয়ই খুব আনন্দ করেছ?

হ্যাঁ, স্যার।

তোমার মা-ষড়মা-জ্যেঠু-ভাইদাও নিশ্চয়ই তোমাকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন?

হ্যাঁ, স্যার।

গুড!

উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, শুভ, দেখো তো ফ্ল্যাঙ্কে কফি আছে কিনা। যদি কফি থাকে, তাহলে তুমি এক কাপ নাও, আমাকেও এক কাপ দাও।

প্রফেসর রাও কফির কাপে চুমুক দিয়েই বলেন, তোমাদের ব্যাচের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই দিল্লী ছেড়ে চলে গেছে পরীক্ষার পরপরই। শুনছিলাম, দু’চারজন বিদেশ যাবার তোড়জোড় করছে। অন্যেরা নিশ্চয়ই মোটা মাইনের ভাল চাকরির চেষ্টা ব্যস্ত।

আমি চুপ করে ওনার কথা শুনি। কোন কথা বলি না।

শুভ, আমি চাই না, তুমি এখুনি কোন চাকরি নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। আমি চাই তুমি কয়েক মাস আমার সঙ্গে কাজ করো।

শুনে আমি খুশি হই। বলি, হ্যাঁ স্যার, আমিও তাই চাই।

ইনস্টিটিউটের গভর্নিং বডি তোমাকে এখানেই চাকরি দিতে চায় কিন্তু যদি এখনই চাকরি করতে না চাও, তাহলে তোমাকে ফ্রী অ্যাকোমোডিশেন আর মাসে মাসে দশ হাজার টাকা অ্যালাউন্স দেবে।

উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আশা করি, তোমার কোন অসুবিধে হবে না।

আমি একটু হেসে বলি, স্যার, আমি অত টাকা দিয়ে কী করবো?

তুমি প্রতি মাসে মা-বড়মাকে তো কিছু পাঠাবেই। তাছাড়া যা পাবে, জমাবে। ভবিষ্যতে নিজে কিছু করলে জমানো টাকা খুবই কাজে লাগবে।

প্রফেসর রাও কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলেন, বোধহয় গভর্নমেন্টও তোমার জন্য কিছু করার কথা ভাবছে।

আমি হাসতে হাসতে বলি, স্যার, যা হচ্ছে বা ভবিয়্যতে হবে, সবই তো আপনার কৃপায়…

না, না, আমি কিছু করিনি তুমি নিজের গুণেই অনেক কিছু পাবে।

পরদিন থেকেই শুরু হলো আমার কর্মজীবনের প্রথম পাঠ।

সপ্তাহে তিন দিন আউটডোর, তিন দিন ইমার্জেন্সী তাছাড়া প্রতিদিনই অপারেশন। কোনদিন একটা, কোনদিন তিনটে। শুধু তাই না। সঙ্গে সঙ্গে চলে প্রফেসরের নির্দেশ মতো পড়াশুনা।

না, এখানেই আমার দৈনন্দিন কাজ বা কর্তব্য শেষ হয় না। প্রফেসর রাও নিজে যখন অপারেশন করেন, তখন আমাকে তার প্রধান সহকারীর কাজ করতে হয়।

অপারেশন থিয়েটারে অনেক নার্স কাজ করেন। অধিকাংশই মধ্যবয়সী; তবে পাঁচ-সাতজন নার্স যুবতী। ললিতা তেওয়ারী শুধু, সর্বকনিষ্ঠা না, সব চাইতে মজাদার মেয়ে। সব সময় মুখে হাসি, ও যেন সব সময় প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ায়; হাজার কাজের চাপ থাকলেও ও হাসতে হাসতে সব সামলে নেয়। তাছাড়া টিকা-টিপ্পনী দেবার ওস্তাদ।

সেদিন প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে লিভারের একটা খুবই জটিল অপারেশনের পর আমরা তিন-চারজন ডাক্তার আর চার-পাঁচজন নার্স কফি খাচ্ছি। তার মধ্যে ললিতাও ছিল। কফি খেতে খেতেই আমরা টুকটাক কথা বলছিলাম। ঐ সব কথাবার্তার মধ্যেই হঠাৎ ললিতা মিসেস তলোয়ারকে বলে, তুমি জানো ব্যাচেলার শশুরের ঘর-জামাই হবার জন্য ডক্টর ব্যানার্জী দিনরাত পরিশ্রম করছে?

মিসেস তলোয়ার জবাব দেবার আগেই আমি বলি, ললিতা, তুমি জানো না, প্রফেসর রাও ঠিক করেছেন তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন?

ও চাপা হাসি হেসে বলে, তাই নাকি?

ইয়েস, ললিতা, ইয়েস!

আমি না থেমেই বলি, আমি প্রফেসরকে কি বলেছি জানো?

কী বলেছ?

বলেছি, স্যার, ললিতা যখন ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, তখনই ও পুরনো বন্ধুর সঙ্গে রেজেস্ট্রি করেছে।

ললিতা সঙ্গে সঙ্গে পাশের ট্রে থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ডক্টর, আই উইল কিল ইউ।

মিসেস নায়ার বলেন, ললিতা, বেশি ন্যাকামো করিস না। তখন তোদের রেজেস্ট্রি না হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তো…

ললিতা তাড়াতাড়ি ওর মুখ চেপে ধরে।

ললিতার ঠাট্টা-ইয়ার্কি বাদ দিলেও আমাকে নানাজনে বলে, প্রফেসর রাও তোকে গাধার মতো খাটাচ্ছেন।

তবে যে যাই বলুক, আমি বেশ বুঝতে পারছি, প্রফেসর রাও-এর কথামত কাজ করে আমার যথেষ্ট উপকার হচ্ছে। প্রত্যেক রুগীর সমস্যা আলাদা, প্রত্যেক অপারেশনও আলাদা। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের রুগী দেখে আর অপারেশন করে আমার অভিজ্ঞতাও বাড়ছে। আস্থাও বাড়ছে। নিয়মিত বিভিন্ন জার্নাল পড়ে কত কি জানছি!

.

সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আমি যেন নেশার ঘোরে কাটাই। এক মুহূর্তের জন্যও নিজের কথা ভাবার অবকাশ পাইনা কিন্তু রাত্রে শোবার পরে?

ঐ খাজুরাহোর সর্বনাশী আমার সামনে হাজির হয়। মুখে চাপা হাসি, চোখে বিদ্যুতের ছটা। আমি অজানা মন্ত্রশক্তিতে সব শক্তি হারিয়ে ফেলি। শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি, ওর দেহের চড়াই-উতরাই, দেখি সর্বনাশা যৌবনের প্রলয়কারী নাচ। আমি চিৎকার করতে পারি না কিন্তু সহ্য করতেও পারি না। বার বার মনে হয়, পাগলের মত চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই, আমি দুর্বাকে, আমার প্রেয়সীকে চাই। ওকে না পাবার দুঃখ কষ্ট জ্বালা আমি সহ্য করতে পারছি না।

সমাজ-সংসারের নিয়ম কানুন বিধি নিষেধ যাই থাকুক, মানুষের মন তো মুক্ত বিহঙ্গ। সে শরতের নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের মত স্বচ্ছন্দে মনের মহাকাশে বিচরণ করে।

শুক্লা ত্রয়োদশীর এই রাত্রে আমার শরীর যেন আরো একটা শরীর খোঁজে অনাস্বাদিত আনন্দ আর উষ্ণতার জন্য কিন্তু কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।

এইভাবেই কেটে গেল প্রায় পাঁচ মাস।

সেদিন শনিবার। প্রফেসর রাও আমাকে বললেন, কাল সকালে একবার আমার ওখানে এসো।

হ্যাঁ, স্যার, আসব।

রবিবার সকাল ন’টা নাগাদ আমি প্রফেসরের কোয়ার্টারে গেলাম।

শুভ, প্লীজ সীট ডাউন।

আমি সামনের একটা চেয়ারে বসতেই উনি বললেন, আমি চাইনি তুমি যেখানে-সেখানে চাকরি করে মোটা মাইনে পাও। যাইহোক আমার এক প্রিয় ছাত্র মাথাই ব্যাঙ্গালোর অ্যাপোলোর সার্জারি ডিপার্টমেন্টের হেড। ও দিন দশেক আগে একটা জরুরী কাজে দিল্লী এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

আমি মন দিয়ে প্রফেসরের কথা শুনি।

প্রফেসর বলে যান, মাথাই-এর সঙ্গে তোমার বিষয়ে অনেক কথা হলো। তোমাকে সহকর্মী হিসেবে পেতে ও খুবই আগ্রহী। শুধু তাই না; ও কথা দিয়েছে, তোমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতেও দেবে।

আমি একটু হাসি।

উনি একটা খাম আমার হাতে দিয়ে বলেন, মাথাই ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে তোমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়েছে। ওরা শুধু ভাল মাইনেই দেবে না; তোমাকে ফার্নিস কোয়ার্টর আর বিনা সুদে গাড়ি কেনার টাকাও দেবে। তাছাড়া গাড়ির খরচ বাবদ মাসে মাসে কয়েক হাজার টাকা দেবে।

স্যার, আমি কি এত পাবার যোগ্য?

অ্যাপোলো তো রামকৃষ্ণ মিশন না যে বিনা স্বার্থে মানুষের উপকার করবে?

ওনার মন্তব্য শুনে আমি না হেসে পারি না।

প্রফেসর একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, দিন দশেক পরই তোমাকে জয়েন করতে হবে; তবে জয়েন করার দু’একদিন আগে পৌঁছনোই ভাল।

হ্যাঁ, স্যার, তাই করবো।

কাল-পরশু কলকাতা যাও। সেখানে ক’দিন কাটিয়ে ব্যাঙ্গালোর যেও।

উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন,ঐ খামের মধ্যেই দিল্লী-কলকাতা ব্যাঙ্গালোরের এয়ার টিকিটও ওরা পাঠিয়েছে।

আমি একটু জোরেই হেসে উঠে বলি, স্যার, আপনি আর কিছু ব্যবস্থা করেন নি?

আমি আবার কি ব্যবস্থা করবো?

কফি খাবার সময় প্রফেসর বলেন, বছরে অন্তত দুবার আমার কাছে এসে কয়েকদিন কাটিয়ে যেও।

স্যার, আমি নিশ্চয়ই আসব।

আর হ্যাঁ, মাথাই বলছিল, তোমাদের ব্যাচের একজন মাস তিনেক আগে ওখানে জয়েন করেছে। ভালই হলো কি বলো?

হ্যাঁ, স্যার, আমাদের ব্যাচের কাউকে ওখানে পেলে আমার অনেক উপকার হবে।

আমি প্রণাম করতেই উনি বলেন, যাও, মন দিয়ে কাজ করো। কয়েক বছরের মধ্যেই তোমার খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বেই।

আমি আবার ওনাকে প্রণাম করে বিদায় নিই।

.

হঠাৎ দিল্লী ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই মন বিষণ্ণতায় ভরে গেল। দু’এক বছর না, দীর্ঘ সাত আট বছরের নিবিড় সম্পর্ক হস্টেলের এই ঘরের সঙ্গে। তাছাড়া হস্টেলের প্রত্যেক কর্মীর সঙ্গেও আমার মধুর সম্পর্ক। বছরের পর বছর ওরা আমার দেখাশুনা না করলৈ কি পড়াশুনা করতে পারতাম? তাছাড়া ইনস্টিটিউটে কতজনের সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এদের সবার সঙ্গে দেখা না করে ইভনিং ফ্লাইটে বুকিং করেই ভাইদাকে অফিসে ফোন করে সব খবর জানালাম।

ভাইয়া, আমি সোজা অফিস থেকে এয়ারপোর্টে যাবো। তুই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাবি না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি এসো। প্লীজ দেখো, আমি আসছি তা যেন আগে থেকে কেউ জানে।

না, না, আগে থেকে কাউকে বলব না।

মোড়ের মাথাতেই আমি ভাইদার গাড়ি থেকে নামলাম। ও যথারীতি বাড়ি গেল। আমি হাঁটি হাঁটি পা পা করে নিঃশব্দে মা-র ঘরে ঢুকেই চিৎকার করি, তোমরা এখনও আড্ডায় মত্ত?

মা-বড়মা ঝাঁপিয়ে পড়েন আমার উপর।

বড়মা বলেন, তুই আসার আগে এটা খবর দিতে পারিস না?

আমি কোনমতে হাসি চেপে বলি, আমার কে আছে যে খবর দেব? তোমরা দু’জনে কলেজ আর আড্ডায় ব্যস্ত, জ্যেঠু কারখানা নিয়ে ব্যস্ত, ভাইদা কুৎসিত বউ নিয়ে মত্ত।…

ঠিক সেই সময় ভাইদা আর প্রেয়সীর প্রবেশ।

প্রেয়সী ঘরের ভিতর এগিয়ে আসতে আসতে বলে, বয়ফ্রেণ্ড, মুখ সামলে কথা বলবে। আমি কুৎসিতও না, তোমার ভাইদাও আমাকে নিয়ে মত্ত না।

নটী বিনোদিনী, বাজে বকো না। ভাইদা অফিস থেকে এসেই তো তোমার। আঁচলের তলায়…

তোমার ভাইদা অফিস থেকে এসেই আমায় আঁচলের তলায় ঢুকেছে বলেই গাড়িতে তোমার মালপত্র…

বড়মা গলা চড়িয়ে বলেন, এই শিবানী, তার মানে বাবাই এয়ারপোর্টে গিয়েছিল।

আমি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দু’হাত দিয়ে মা-বড়মাকে জড়িয়ে ধরি। ওরাও আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নেন।

ওদের দুজনের আদর করার পর্ব চলতে চলতেই ভাইদা আমার মালপত্র ঘরে এনে রাখে। মালপত্র দেখেই মা প্রশ্ন করেন, হারে তাতাই, তুই কি পাকাঁপাকি ভাবে দিল্লী ছেড়ে চলে এলি?

আমি মা-র কথার জবাব না দিয়ে ব্রীফ কেসের ভিতর থেকে অ্যাপোলোর খামটা বের করে বড়মার হাতে দিই। উনি সঙ্গে সঙ্গে খামের ভিতর থেকে চিঠিপত্র বের করে পড়তে পড়তেই চিৎকার করেন, শিবানী, শিগগির পড়ে দেখ।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পড়েই মা খুশি আর গর্বের হাসি হাসতে হাসতে বলেন, ওরে ভারতী, তাতাই পঁয়ত্রিশ হাজারে জীবন শুরু করবে আর আমরা। রিটায়ার করার আগেও এত মাইনে পাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।

শিবানী, ভুলে যাচ্ছিস কেন তাতাই সোনা দু’দুবার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পেয়েছে। এর সঙ্গে আমাদের কেন, অনেকেরই তুলনা হয় না।

ভাইদার পর দুর্বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পড়েই হাসতে হাসতে বলে, বয়ফ্রেন্ড, তোমাকে অ্যাপোলো গাড়ি দেবে, থাকার জন্য সাজানো গোছানো বাড়ি দেবে, তার উপর এত টাকা দিয়ে কী করবে?

ব্যাঙ্গালোরের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে বাঁদরামী করে ওড়াব।

সে সাহস তোমার নেই।

ও না থেমেই বলে, যে আমার সঙ্গে.সহজভাবে মিশতে পারে না, সে আবার…

ওহে প্রেয়সী, আমি ভাইদার মত গোবেচারী গুড বয় না। তোমার মত আলতু-ফালতু মেয়ের দিকে আমার চোখ ফেরাতেও ইচ্ছা করে না।

জ্যেই এসে হাজির হওয়ার ঝগড়া জমল না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখে জ্যেঠুও খুব খুশি। উনি মা-র দিকে তাকিয়ে বলেন, বৌমা, এবার থেকে আমরা মাঝে মাঝেই ব্যাঙ্গালোর যাবো।

হ্যাঁ, দাদা, নিশ্চয়ই যাব।

জ্যেঠু হাসতে হাসতে বলেন, বুঝলে বৌমা, তাতাই সোনার বাড়িতে থাকব খাবো, তাতাই সোনার গাড়ি চড়ব আর তাতাই সোনার টাকায় যাতায়াত করবো। ভাবতে পারো কি মজা হবে?

আমি বলি, জ্যেঠু, আপনারা যখন খুশি যাবেন; নো প্রবলেম কিন্তু যে ছেলে ছেলে বলে অভিনয় করে, শুধু সেই নটী বিনোদিনীকে এখানে রেখে যাবেন।

দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত দিয়ে আমার দুটো কান ধরে বলে, মাই ডিয়ার বয় ফ্রেন্ড, আমি এক মাসের মধ্যে তোমার কাছে আসছি।

অসম্ভব।

অসম্ভব কেন?

সেই মহারাজার আমল থেকেই কসবার মেয়েদের ব্যানোর-মাইশোরে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

আমার কথা শুনে সবাই হো হো করে হাসেন।

প্লেনেই খেয়ে এসেছি; তবু আমাকে জ্যেঠু আর ভাইদার সঙ্গে বসতে হলো একটু কিছু খাবার জন্য। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটে যাবার পর জ্যেঠুর ঘরেই শুরু হলো আমাদের আড্ডা। আমি জ্যেঠুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে শুয়েই কথাবার্তা শুনি, বলি। মাঝে মাঝে জ্যেঠু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

দুর্বা জ্যেঠুকে বলে, ছেলে, এই বুড়ো ধাড়ী তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছে কেন? তাছাড়া ওর মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দেবারই বা দরকার কি?

জ্যেই না, আমিই ওর কথায় জবাব দিই। বলি, ওহে নটী বিনোদিনী, ভুলে যাও কেন আমি তাতাইসোনা? তাছাড়া জ্যেঠু আমার খামখেয়ালী ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

তাই বলে আমার বুড়ো ছেলেকে তোমার সেবা করতে হবে?

না করে জ্যেঠু শান্তি পাবে নাকি?

হাসি-ঠাট্টার পর আমি বলি, জ্যেঠু, আমার একটা কথা আছে।

হ্যাঁ, বল।

মা আর বড়মা এবার কলেজের চাকরি ছেড়ে দিক।

জ্যেঠু কিছু বলার আগেই বড়মা বলেন, দ্যাখ তাতাই সোনা, সপ্তাহে দু’দিন কলেজে যাই বলেই আমাদের দুজনের শরীর ভাল আছে। কাজকর্ম না করে বাড়িতে বসে থাকলেই একটার পর একটা রোগ আমাদের ধরবেই।

মা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ভারতী, তুই ঠিক বলেছিস।

জ্যেঠু বলেন, হ্যাঁ, তাতাই সোনা, ওরা ঠিকই বলেছে। চুপচাপ বসে থাকলেই ওরা অসুস্থ হয়ে পড়বে।

আমি বলি, তার মানে আমার কাছে মা-বড়মার থাকা সম্ভব না।

দুর্বা বলে, বয়ফ্রেন্ড, কিছু চিন্তা করো না। আমি বছরে ছ’মাস এখানে থাকব; দু’মাস তোমার কাছে থাকব।

ওহে প্রেয়সী, তুমি থাকলে তো আমার ফ্ল্যাটের দেয়াল ছাদ সব ফেটে যাবে।

রাত প্রায় দেড়টা-পৌনে দুটো পর্যন্ত আড্ডা চলার পর আমি জ্যেঠুর বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ি।

আমি সোমবার রাত্রে এসেছি শনিবার ভোরের ফ্লাইটেই আমি ব্যাঙ্গালোর যাবে। মাঝখানে মাত্র চারটে দিন। মা-বড়মার খুব ইচ্ছা ছিল ছুটি নেবার কিন্তু কলেজে পরীক্ষা চলছিল বলে তা কিছুতেই সম্ভব হলো না। তথৈ ব চ জ্যেঠু আর ভাইদার অবস্থা। অর্থাৎ সারাদিন আমি আর প্রেয়সী আড্ডা দিই।

আমি শুয়েই থাকি। ও আমার পাশেই বসে।

বয়ফ্রেন্ড, ব্যাঙ্গালোরে তোমার রান্নাবান্না কে করে দেবে।

না, না, ওসব ঝামেলায় আমি যাবো না।

তবে খাবে কোথায়?

অ্যাপেলোর ক্যান্টিন খুব ভাল। এক বেলা তো হাসপাতালই খেয়ে নেবো; সম্ভব হলে ওখান থেকেই খাবার এনে অন্য বেলা চালিয়ে দেব।

তা যদি সম্ভব না হয়?

তাহলে অন্য কোন ব্যবস্থা করবো।

কিন্তু তোমার চা-টা বা ব্রেকফাস্ট কে করে দেবে?

ওখানে যাই; তারপর দেখা যাবে।

একটু চুপ করে থাকার পর প্রেয়সী বলে, তোমাকে নিশ্চয়ই বেশ বড় ফ্ল্যাট দেবে?

দেওয়া উচিত।

তুমি এত বছর হস্টেলে কাটিয়েছ কিন্তু সেখানে তো অনেকেই থাকতো। সেখানে কথাবার্তা বলার লোকের অভাব হয়নি।

ও আমার মাথায় মুখে হাত দিতে দিতে বলে, ব্যাঙ্গালোরের অত বড় ফ্লাটে কথা বলার মত একজনও থাকবে না। তোমার কষ্ট হবে না?

কষ্ট হবে কিনা জানি না কিন্তু নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না।

তুমি তো হাসপাতালে এক মিনিটও চুপচাপ বসে থাকতে পারবে না। তাছাড়া অপারেশনের সময় তোমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অত পরিশ্রম করে ফ্ল্যাটে ফেরার পর কে তোমাকে এক গেলাস জল বা এক কাপ চা দেবে, তার তো ঠিক নেই।

আমি একটু হেসে বলি, ওসব আমার অভ্যাস আছে।

তোমার অভ্যাস আছে বললেই তো আমি শান্তি পাবো না।

আমি হাসতে হাসতেই বলি, প্রেয়সী, অপাত্রের জন্য এত চিন্তা করো না।

একটু পরে আমি বলি, প্রেয়সী, অনেকক্ষণ গল্প করেছ। এবার তুমি তোমার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো।

তুমি মাত্র চারদিনের জন্য এসেছ আর আমি তোমাকে একলা রেখে বিশ্রাম করতে যাবো?

একলা থাকতে তো আমার কষ্ট হয় না। তুমি যাও।

না, ও যায় না। কখনও কখনও অদ্ভুতভাবে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে; আবার কখনো ও চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস দৃষ্টিতে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমিও ওর উদ্ধত যৌবনের উপ সহ্য করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখি। এক একবার মনে হয়, প্রেয়সীও কি আমারই মতন পাবার জ্বালায় জ্বলছে? নাকি ও আমাকেই চায়। আমাকে না পাবার দুঃখেই কি মনে শান্তি পাচ্ছে না?

জানি না।

শুধু সেদিনের জন্য আমার মনে এই প্রশ্ন আসেনি। পর পর চারদিন সারা দুপর এক মিনিটের জন্যও আমাকে একলা থাকতে দেয়নি। একইভাবে আমার বিছানায় আমার পাশে বসে থেকেছে। কখনও মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিয়েছে, কখনও আবার একটা হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে।

আমার কত কি ইচ্ছা করেছে কিন্তু পারিনি। কোনদিন সে ইচ্ছা পূর্ণ করতেও পারব না।

বয়ফ্রেন্ড, আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

কি অনুরোধ রাখতে হবে?

আমাকে কথা দাও, আমার অনুরোধ রাখবে; তা না হলে বলে কি লাভ?

আমি একটু হেসে বলি, হ্যাঁ, তোমার অনুরোধ রাখব।

ও একগাল হেসে আমার গাল টিপে বলে, এইজন্যই তো তোমাকে ভালবাসি।

এখন আসল কথাটা বলো তো।

প্রেয়সী ঝুঁকে পড়ে আমার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, তুমি নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে রাত্তিরের দিকে ফোন করবে কিন্তু সবার সামনে আমি আমার কথা বলতে পারব না। প্লীজ তুমি দুপুরের দিকে আমাকে ফোন করবে।

ওর কথা শুনে আমি না হেসে পারি না।

ও দু’হাতের মধ্যে আমার একটা হাত নিয়ে বলে, কি হলো? ফোন করবে তো?

মুখে না, মাথা নেড়ে বলি করব।

চারটে দিন যেন হাওয়ার উড়ে গেল। আনন্দে-বিষাদে সবাই আমাকে বিদায় জানান আমিও বিচ্ছেদের বেদনা বুকে নিয়ে কলকাতা ত্যাগ করি।

.

জীবনে প্রথম চাকরি করতে চলেছি। ভাল-মন্দ নানা চিন্তা করতে করতেই প্লেন ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। টার্মিনাল বিল্ডিং-এ পৌঁছে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি; হঠাৎ এক নারীকণ্ঠে ‘শুভ’ ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াতেই মৃণালিনী ছুটে এসে এক গাল হেসে আমার দুটো হাত ধরে বলে, শুভ, তুমি অ্যাপোলোয় জয়েন করছো শুনে আমি যে কি খুশি হয়েছি, তা বলতে পারবো না।

মৃণালিনী, তুমিও অ্যাপোলোতে?

ইয়েস, ইয়েস; আমি তোমার কলিগ হবো।

মাই গড! হোয়াট এ কিউরিয়াস কো-ইন্সিডেন্স। এক সঙ্গে এম. বি. বি. এস. পড়লাম, এক সঙ্গে এম. এস. করলাম, আবার এক সঙ্গে আমরা চাকরি করবো।

মৃণালিনী ছাড়া অ্যাপোলোর এক বড় কর্তাও এসেছিলেন আমাকে রিসিভ করতে। মিঃ বৈদ্যনাথন আমার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে বললেন, ওয়েলকাম টু ব্যাঙ্গালোর টু জয়েন অ্যাপোলো ফ্যামেলী।

গাড়িতে যেতে যেতে মিঃ বৈদ্যনাথন একটু হেসে আমাকে বলেন, আপনি আর মৃণালিনী এক সঙ্গে এম. বি. বি. এস আর এস. এস, করেছেন বলে ডাঃ মাথাই আপনাকে ওর পাশের ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করে…

আমি এটুকু শুনেই হেসে উঠি। বলি, হ্যাঁ, ভালই হলো; চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।

আমি একটু থেমে বলি, মৃণালিনী, তোমার মা কোথায়?

এখানে আমার কাছেই আছেন।

আন্টির শরীর কেমন আছে?

তুমি তো মার শরীরের কথা জানো। এমনি মোটামুটি ঠিক আছেন কিন্তু যখন-তখন অঘটন ঘটতে পারে।

ইন্দিরা নগরের তিনতলা বাড়ির তিনতলার ছ’নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছেই দেখি, পাশের ফ্ল্যাটের দরজায় লেখা–ডাঃ মৃণালিনী দেশপাণ্ডে! না হেসে পারি না। যেমন খুশি তেমনই বিস্মিত হই।

আমাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়েই মিঃ বৈদ্যনাথন বলেন, হসপিট্যাল ক্যান্টিন থেকে আজ আর কাল দু’বেলাই আপনার খাবার-দাবার আসবে। তারপর আপনি যা বলবেন, সেইরকম বিধিব্যবস্থা করা হবে।

আমি বলি, আজ একবার ডাঃ মাথাই-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

মৃণালিনী সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।

মিঃ বৈদ্যনাধন বিদায় নেবার পর মৃণালিনী আমাকে ফ্ল্যাটটি ভাল করে দেখায়। হ্যাঁ, ফ্ল্যাটটি যেমন ভাল, তেমনই সুন্দর করে সাজানো। ড্রইংরুম, দুটো বেডরুম, একটা স্ট্যাডি, কিচেন ও তার পাশেই ডাইনিং রুম। বেডরুম সংলগ্ন বাথরুম ছাড়াও ব্যালকনি আছে।

কি শুভ, পছন্দ হলো?

আমি কোনমতে হাসি চেপে বলি, সবই ভাল কিন্তু এই ফ্ল্যাটে একলা রাত কাটাবো কি করে?

ও আলতো করে আমার গালে একটা চড় মেরে হাসতে হাসতে বলে, সে সমস্যার সমাধানও কি আমাকে করতে হবে?

আর কে করবে?

.

যাইহোক আমার নতুন জীবন বেশ ভালভাবেই শুরু হলো। ডাঃ মাথাই নিঃসন্দেহে একজন বিখ্যাত সার্জেন; তাছাড়া হাসপাতালের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি কিন্তু তাঁর ব্যবহার দেখে মনেই হলো না, এখানেই আমাদের পরিচয়। মনে হলো, উনি আমার বড় ভাই। যে প্রকৃত শিক্ষালাভ করে, সে যে বিনয়ী হয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ডাঃ মাথাই। বুঝলাম, উনি সত্যি প্রফেসর রাও-এর প্রিয় শিষ্য।

আরো অনেককেই ভাল লাগলো। তবে খুব ভাল লাগলে অপারেশন থিয়েটারের এক দল নার্সের প্রধান মিস প্যামেলা নায়ারকে। বছর পঞ্চাশেক বয়স। গায়ের রঙ বেশ কালো কিন্তু মুখের হাসি ঠিক ততটাই উজ্জ্বল। সার্জিক্যাল নার্স হিসেবে অতুলনীয়া আর অসম্ভব স্নেহপ্রবণ। দিদি না, আমাদের বয়সী ডাক্তার-নার্সদের উনি সন্তানের মতই স্নেহ করেন।

অ্যাপোলোতে কাজ শুরু করার দিন পনের-কুড়ি পরের কথা। প্রায় ঘণ্টা চারেক ধরে একটা অত্যন্ত জটিল অপারেশন করার পর সবাই মিলে কফি খাচ্ছি। মিস নায়ার কফি খেতে খেতেই বলেন, ডাঃ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইউ আর রিয়েলী এ ম্যাজিসিয়ান ইন অপারেশন থিয়েটার। বুঝলাম, কেন তুমি দু’বার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পেয়েছ।

আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, প্লীজ, আপনি আমাকে ডাঃ বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন না; বলবেন, শুভ। আমি তো আপনার সন্তানের বয়সী; আমি আপনাকে আম্মা বলব।

মিস নায়ার কফির কাপ নামিয়ে দু’হাত দিয়ে আমার মুখোনা ধরে কপালে স্নেহ্নম্বন দিয়ে বলেন, বিয়ে করলে আমার ছেলেমেয়ে তোমার বয়সীই হতো। আমি তোমাকে শুভ বলেই ডাকব।

ইয়েস আম্মা, দ্যাটস ফাইন।

সব ডাক্তার-নার্সরা কফির কাপ তুলে ধরে বলেন, চিয়ার্স টু আম্মা-শুভ।

আমার আর মৃণালিনীর ডিউটি পড়ে কখনো আলাদা, কখনো একই সময়ে। যখন ও হাসপাতালে আর আমি ফ্ল্যাটে থাকি, তখন ফুরসত পেলেই আন্টির কাছে যাই।

মৃণালিনী যখন প্রথম দিল্লী আসে, তখন থেকেই আন্টি মাঝে মাঝেই ওকে দেখতে আসতেন; থাকতেন সাউথ এক্সটেনশনে এক দূর সম্পর্কের মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে। মৃণালিনীর সঙ্গে আমিও মাঝে মাঝে গিয়েছি ওখানে। সুতরাং ওনার সঙ্গে খুবই ভাল পরিচয় ছিল; আমাকে খুবই স্নেহ করেন। মেয়ে যখন হাসপাতালে থাকে, তখন আন্টিকে একাই থাকতে হয়; লাঠি ভর দিয়ে কোনমতে ফ্ল্যাটের মধ্যে ঘোরাঘুরি করেন। তাইতো এখানে আমাকে পেয়ে উনি খুব খুশি।

কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তায় পরই আন্টি আমার হাতের উপর হাত রেখে বলেন, শুভ, এফ. আর. সি. এস. পাত্রের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে বাবা ভেবেছিলেন, মেয়ে খুব সুখে থাকবে। যখন উনি ন’বছরের ছেলে, সাত বছরের মৃণালিনী আর আমাকে ফেলে অন্য একজনকে বিয়ে করে বিলেত চলে গেলেন, তখন সে আঘাত আমি সামলে নিয়েছিলাম ছেলে-মেয়ের মুখ চেয়ে।

এইটুকু বলেই উনি হাঁপিয়ে ওঠেন। দু’এক মিনিট চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, কত কষ্ট করে ছেলেকে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ালাম, বিয়ে দিলাম কিন্তু সে যে ওর বাবার মতই বিশ্বাসঘাতকতা করে বিদেশ চলে যাবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

আন্টি, এইসব কথা যত চিন্তা করবেন, ততই দুঃখ পাবেন। আপনি কেন ভাবেন না মৃণালিনীর মত মেয়ে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার?

হ্যাঁ, বাবা, আমি একশ বার স্বীকার করব, ওর মতো মেয়ে পেয়ে আমি যেমন সুখী, তেমনই গর্বিত।

উনি মুহূর্তের জন্য থেমে একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, দু’দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে; আমি যখন-তখন চলে যেতে পারি কিন্তু মেয়েটার জন্য খুবই চিন্তা হয়। আমি ছাড়া ওর আপনজন তো কেউ নেই।

আন্টি, মেয়েকে নিয়ে অত চিন্তা করবেন না। মৃণালিনী নিশ্চয়ই ভাল থাকবে।

কিন্তু ও যে প্রতিজ্ঞা করেছে বিয়ে করবে না কিন্তু একলা একলা কি এই পৃথিবীতে থাকা যায়?

হ্যাঁ, আন্টি, নিশ্চয়ই যায়। তা না হলে পৃথিবীর কোটি কোটি নারী-পুরুষ বিয়ে না করে বেঁচে আছে কী করে?

একই সঙ্গে ডিউটি পড়ুক বা না পড়ুক, আমি আর মৃণালিনী রোজই আড্ডা দিই। তবে আন্টির শরীরের কথা ভেবে মৃণালিনী আমার ফ্ল্যাটে এসেই গল্পগুজব করতো। তবে দিনের বেলা আন্টি ঘুমুতেন না বলে ও খুব বেশিক্ষণ আড্ডা দিতে না; অধিকাংশ সময়ই মা-র কাছে থাকতো। কিন্তু রাত্রে আন্টি ঘুমুবার ওষুধ খেয়ে শোবার পর মৃণালিনী ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমার সঙ্গে আড্ডা দিতো।

একদিন কথায় কথায় মৃণালিনী বলে, শুভ, তুমি না এলে আমি ঠিক এই চাকরি ছেড়ে চলে যেতাম।

কেন?

এখানে তো আমার একজনও বন্ধু নেই। হাসপাতাল থেকে এসে সব সময় কি মা-র সঙ্গে গল্প করতে ভাল লাগে?

ও না থেমেই বলে, তাছাড়া মা-র পক্ষে খুব বেশিক্ষণ কথা বলাও সম্ভব।

আমি একটু হেসে বলি, তোমাকে না পেলে আমিও যে কতদিন এখানে থাকতে পারতাম, তা জানি না।

মৃণালিনী লম্বা সোফায় একটা কুশন মাথায় দিয়ে শুয়েছিল আমার চোখের সামনে। আমি ওকে একবার খুব ভাল করে দেখে নিয়ে চাপা হাসি হেসে বলি, তোমার মত সুন্দরী যুবতী বান্ধবীকে এইভাবে নাইটি পরে সামনে শুয়ে থাকতে দেখে যে কি আনন্দ পাই, তা তো তুমি জানো না।

আমি না থেমেই বলি, আচ্ছা মৃণালিনী, এভাবে এই রাত্রে আমার এখানে আসতে তোমার ভয় করে না?

ও হো হো করে হেসে উঠে বলে, তোমাকে দেখে আমি ভয় পাবো? বলো, আমাকে দেখে তুমি ভয় পাও।

মুখে স্বীকার করি না কিন্তু সত্যি আমার ভয় হয়। বার বার মনে হয়, মৃণালিনীর রূপ, যৌবন, মাদকতা ও গভীর রাত্রিতে আমার কাছে থাকা, কোন অঘটন ঘটাবে না তো?

জানি না।

কিন্তু প্রেয়সী আমার দেহে, মনে যে আগুন জ্বালিয়েছে, তা যে আমাকে একটা নারীদেহের নিবিড় ও উষ্ণ সান্নিধ্য পাবার জন্য পাগল করে তুলেছে। আমি প্রেয়সীকে নিয়েই পাগল হতে চাই কিন্তু ও ভাইদার স্ত্রী। তাইতো আমি কখনই সীমা অতিক্রম করতে পারিনি, পারব না।

সবই বুঝি কিন্তু মনের আগুন, দেহের জ্বালা মিটবে কী করে?

আমি এখানে আসার পর প্রত্যেক রবিবার কলকাতায় ফোন করে সবার সঙ্গে কথা বলি। তখন প্রেয়সী নেহাতই মামুলি কথা বলে কিন্তু দুপুরের দিকে কথা বললেই একেবারে ভিন্ন সুর।

বয়ফ্রেন্ড, তুমি বিশ্বাস করো, তোমাকে একটু কাছে পেতে, একটু আদর করতে খুব ইচ্ছে করে।

ওহে নটী বিনোদিনী, কেন মিথ্যে কথা বলছো?

না, তাতাই, আমি মিথ্যে কথা বলছি না। তোমাকে আমার মনের কথাই বললাম।

হাজার হোক তুমি ভাইদার স্ত্রী। আমি কলকাতা গেলেই তো তুমি আমাকে কাছে পাও তখন আদর করলেই পারো। কে তোমাকে বাধা দিয়েছে?

না, না, অন্য কারুর সামনে তোমাকে আদর করবো না।

তাহলে চলে এসো এখানে।

সম্ভব হলে নিশ্চয়ই যেতাম।

আমি কখনই ওকে ইন্ধন যোগাই না কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই কথাও স্বীকার করব, আমার প্রতি ওর দুর্বলতার ইঙ্গিত দেখে মনে মনে উৎসাহিতও হই, উত্তেজিতও হই।

এই ভাবেই কেটে যায় তিন-চার মাস।

.

সেদিন ইভনিং শিফট-এ আমার ডিউটি ইমার্জেন্সীতে, মৃণালিনীর ডিউটি সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে। দু’জনেরই ডিউটি শেষ হবার কথা দশটায় কিন্তু সাতটার পর পরই একটা বাস দুর্ঘটনার দশ-বারোজন গুরুতর আহত পেশান্ট হাজির হতেই শুধু আমি বা ইমার্জেন্সীর অন্য দু’জন সার্জেনকে না, মৃণালিনীকেও অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে হলো। আমরা দুজনে হাসপাতাল থেকে বেরুলাম সাড়ে এগারোটায়।

লিফট-এ তিনতলায় উঠে মৃণালিনী ব্যাগ হাড়ে আবিষ্কার করলো যাবার সময় দরজার চাবি নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। বলল, শুভ, এখন বেল বাজিয়ে মাকে ঘুম থেকে তুললে উনি সারা রাত্তির আর ঘুমুতে পারবেন না। তাই…

নো প্রবলেম। তুমি আমার ফ্ল্যাটে থেকে যাও।

হ্যাঁ, তাই থাকতে হবে।

ভিতরে ঢুকেই মৃণালিনী বলে, শুভ, আমি কিন্তু স্নান না করে ঘুমুতে পারবো না।

নো প্রবলেম। আমি সাবান-তোয়ালে দিচ্ছি।

আমি আমার পাশের বেডরুমের বাথরুমে আলো জ্বালিয়ে সাবান-তোয়ালে রেখে বলি, মৃণালিনী, যাও, স্নান করো। আমিও আমার বাথরুমে ঢুকছি।

হ্যাঁ, যাও।

আমি স্নান করে পায়জামা-গেঞ্জি পরে বেরুতে না বেরুতেই শুনতে পাই পাশের ঘর থেকে মৃণালিনী ডাকছে। তাড়াতাড়ি ঐ ঘরে ঢুকেই দেখি, বাথরুমের দরজা সামান্য একটু ফাঁক করে ও তাকিয়ে আছে।

ডাকছ কেন?

আমি কি পরে বেরুব?

ও মাই গড!

একটু হেসে বলি, আমার পায়জামা-কুর্তা পরবে?

তোমার পায়জামা কি আমার হয়?

মৃণালিনী সঙ্গে সঙ্গেই বলে, শুভ, তোমার ধুতি আছে?

হ্যাঁ, একটা আছে।

তাহলে ধুতি-কুর্তা আর পাউডার দাও তো।

শেষ পর্যন্ত মৃণালিনী যখন ধুতিকে লুঙির মত করে পরে আর গায় আমার ঢিলেঢালা আৰ্দির পাঞ্জাবি পরে আমার ঘরে আমার সামনে হাজির হলো, তখন আমি যেমন হাসি, তেমনই খুশি।

হাসছ কেন?

তোমার অসীম ঐশ্বর্য দেখে।

ও একবার আনত দৃষ্টিতে নিজেকে দেখে নিয়েই বলে, খুব খারাপ লাগছে? একটু বেশি ভাল লাগছে। আজ রাত্তিরে আর আমার ঘুম হবে না।

কেন?

মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে তোমাকে দেখতে হবে না?

না দেখে থাকতে পারবে না?

অসম্ভব।

সত্যি?

হানড্রেড পার্সেন্ট সত্যি।

মৃণালিনী সঙ্গে সঙ্গেই দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে করতে আমাকে নিয়ে আমার বিছানা লুটিয়ে পড়ে আর আমি?

প্রেয়সী আমার দেহ-মনের যে সুপ্ত কামনা-বাসনার আগুন-জ্বালিয়েছে, তারই জোয়ারে আমিও ভেসে গেলাম।

চোখ বুজে দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে শুয়েছিলাম। রোমন্থন করছিলাম সদ্য সমাপ্ত আনন্দ-মহোৎসবের স্মৃতি। এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছু সময়।

তারপর মৃণালিনী ডাকল, শুভ।

বলো।

তুমি কিছু বলবে না?

শুধু বলব থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।

ফর হোয়াট?

ফর এভরিথিং।

এভরিথিং মানে?

আমি একটু হেসে ওর চোখের পর চোখ রেখে বলি, এত আদর, ভালবাসা, আনন্দ দেবার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাব না?

তুমিও তো আমাকে আদর-ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছ।

তুমি খুশি?

নিশ্চয়ই খুশি কিন্তু…

মৃণালিনী কথাটা শেষ করে না শুধু মুখ টিপে হাসে।

আমি বলি, কিন্তু কি?

সত্যি বলব?

হ্যাঁ, বলো।

রাগ করবে না বা আমাকে খারাপ মনে করবে না?

আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে তোমাকে খারাপ মনে করব?

ও আমার মুখের উপর মুখ রেখে বলে, শুভ, আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। তুমি মাঝে মাঝে আমাকে এইরকম আনন্দ দেবে।

আমি শুধু হাসি কোন কথা বলি না।

দু’এক মিনিট নীরব থাকার পর মৃণালিনী বলে, তুমি খুব ভাল করেই জানো, বাবা আমাদের দু’ভাই বোন আর মা-কে ফেলে নতুন বউ নিয়ে বিলেত যাবার পর থেকে কিভাবে মা আর আমার জীবন কাটছে।

ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, বাবার উপর রাগ করেই আমি এম. এস. করলাম।

হ্যাঁ, তা জানি।

আমি নিশ্চয়ই তোমার মত ব্রিলিয়ান্ট ছিলাম না কিন্তু তুমি তো জানো, আমি পড়াশুনার ক্ষতি করে একটি দিনও নষ্ট করিনি বা কারুর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করার স্বপ্নও দেখিনি।

আমি দু’হাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে বলি, মৃণালিনী, এইসব কি আমি জানি না? সাত-আট বছর ধরে আমি তোমাকে দেখছি, তুমিও আমাকে দেখছ। আমি তোমার সবকিছু জানি, তুমিও আমার সব খবর রাখো।

শুভ, তোমাকে এখানে পেয়ে আমি যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছি। ঠিক যখন একলা একলা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, ঠিক তখনই তোমাকে কাছে পেলাম।

আমি একটু হেসে বলি, তুমি তো আমার মনের কথাই বললে। আমারও আর একা একলা ভাল লাগছিল না।

মৃণালিনী আলতো করে আমাকে চুম্বন করে বলে, আজ থেকে আমিও একলা, তুমিও একলা না।

আমি ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলি, ঘুমোবে না?

ঘুম আসছে না।

হাতের ঘড়ি দেখে বলি, জানো, তিনটে বেজে গেছে।

বাজুক, আজ তোমার বুকের উপর শুয়ে শুয়ে সূর্য ওঠা দেখব।

মৃণালিনী, শুধু সূর্যোদয় দেখব না; আমরা সূর্যকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করব, আমরা কোনদিন অন্ধকারে তলিয়ে যাব না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দুজনে মিলে মানুষের সেবা করব।

ও পরম তৃপ্তির হাসি হেসে বলে, আমি কি শুধু শুধু নিজেকে তোমার কাছে বিলিয়ে দিলাম? তোমাকে আমি শুধু ভালবাসি না, তোমাকে শ্রদ্ধাও করি; তুমি আমার গর্ব, তুমি আমার অহঙ্কার।

দেখতে দেখতে ব্যাঙ্গালোর আসার পর তিন মাস কেটে গেল।

.

সেদিন শুক্রবার। সেদিন সকালেই আমার আর মৃণালিনীর ডিউটি তবে ওর ডিউটি অপারেশন থিয়েটারে,আমার ডিউটি ইমার্জেন্সীতে।

আন্টির খাবার হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে বারোটার মধ্যেই শুধু পৌঁছে যায় না, ক্যান্টিনের লোকটি ওনাকে খাইয়ে আসে। মর্নিং-এ ডিউটি থাকলে দুটো আড়াইটের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ হয়। তারপর ক্যান্টিন থেকেই খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরি। বিশ্রাম করি। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হলো না।

বিকেলের দিকে আন্টির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। নানা কথাবার্তার ফাঁকে উনি আমার একটা হাতের উপর হাত রেখে বলেন, শুভ, তুমি এখানে আসায় আমার খুব লাভ হয়েছে।

আমি একটু হেসে বলি, কি লাভ হয়েছে?

সব সময় তোমাদের দু’জনে তো একই সময়ে ডিউটি পড়ে না। তাই মেয়ে যখন হাসপাতালে থাকে, তোমাকে আমি কাছে পাই। তাছাড়া রোজই কোন না কোন সময়ে তোমাদের দুজনকেই কাছে পাই।

উনি একটু হেসে বলেন, একি কম লাভ?

আমিও আপনার কাছে মায়ের স্নেহে পাচ্ছি; আপনার চাইতে আমিই বেশি লাভবান।

সাড়ে সাতটার পর পরই মৃণালিনী আন্টিকে খেতে দিল। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলে, শুভ, তুমি স্নান করতে যাও। মাকে ঘুম পাড়িয়ে আমি আসছি।

আমি স্নান করে বিছানায় আধা-শোওয়া অবস্থায় মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব সার্জারির জার্নাল পড়ছিলাম। মৃণালিনী ঘরে ঢুকেই বলল, মেলবার্ন ইউনিভার্সিটির জার্নাল পড়ছো?

হ্যাঁ।

তুমি এই জার্নাল পড়া শেষ করলে তোমাকে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির জার্নাল দেব। লিভার অপারেশনের উপর দুটো অসাধারণ লেখা আছে।

হ্যাঁ, দিও।

তোমার পড়ার পর অমি দু’একটা কথা জানতে চাইব। ঠিক সেই সময় টেলিফোন। রিং শুনেই বুঝলাম, বাইরের ফোন।

মৃণালিনী একটু হেসে বলে, নিশ্চয়ই মা-বড়মার ফোন। আমি রিসিভার তুলতেই শুনি জ্যেঠুর গলা, তাতাইলোনা, আমি, বৌমা আর তোর বড়মা গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা করব।

আমি অবাক হয়ে বলি, তার মানে?

ওরে তাতাইসোনা, তুই আমাদের তিনজনকে মাসে মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা পাঠাচ্ছিস, তা দিয়ে আমরা কী করবো?

তোমরা খাও-দাও, ওড়াও, দান করো বা জমিয়ে রাখো-এককথায় তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করবে।

তাইতো বলছি, গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা করব বলে আমরা ঐ টাকা দিয়ে প্লেনের টিকিট কেটেছি তোর কাছে যাবো বলে।

আমি চিৎকার করে বলি, জ্যেঠু, সত্যি তোমরা তিনজনে আসছে?

আসছি মানে কালই আসছি। নে, বৌমার সঙ্গে কথা বল।

মা ‘তাতাই সোনা’ বলতে না বলতেই আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে বলি, মা, তোমরা এলে দারুণ মজা হবে।

শুধু তুই কেন, আমরাও তো খুব আনন্দ পাবো।

মা মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, মৃণালিনীকেও খবরটা দিন।

ও এখানেই আছে; কথা বলো।

মৃণালিনী -র সঙ্গে কথা বলার পর বড়মার সঙ্গেও কথা বলে। তারপর বড়মা আমাকে বলেন, তাতাইসোনা, তোকে কাছে পাবার জন্য তিনজনেই ছটফট করছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত তিনজনেই ছুটি নিয়ে তোর কাছে আসছি।

তোমাদের যে শুভবুদ্ধি হয়েছে তা জেনেই ভাল লাগছে।

আমি মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলি, বড়মা, ভাইদা আর প্রেয়সী আসছে না?

তোর ভাইদা এখন শুধু ঘুমুতে বাড়ি আসে। সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যায় আর ফিরতে রাত দশটা-সাড়ে দশটা।

বড়মা একটু থেমেই বলেন, আমাদের সল্টলেকে কত চুরি-ডাকাতি হয়, তা তো তুই ভাল করেই জানিস। তাই দুটো বাড়ি শুধু দুই মাসীর উপর ছেড়ে রেখে যাওয়া যায় না।

এর পর ভাইদা একটু সুযোগ পেলেই যেন…

সে কথা আর আমাকে বলতে হবে না। তোর কাছে যাবার জন্য ওরা দু’জাই পা বাড়িয়ে আছে।

ঠিক আছে। আমি এয়ারপোর্টে থাকব আর মনে রেখো, কাল তোমাদের তিনজনকে ঘুমুতে দেব না।

ভয় দেখাচ্ছিস কি! আমরাও তোকে ঘুমুতে দেব না।

আমি রিসিভার নামিয়ে রাখতেই মৃণালিনী বলে, তোমার কাছে ওদের তিনজনের কথা এত শুনি যে আমিও ওদের দেখার জন্য হাঁ করে বসে আছি।

আমি একটু হেসে বলি, মৃণালিনী, ওদের তিনজনকে তোমার যেমন ভাল লাগবে, সেইরকম ওরাও তোমাকে ঠিক মেয়ের মতই স্নেহ করবেন।

হ্যাঁ, সে বিশ্বাস আমার আছে।

আমরা পাশাপাশি শুয়ে কথা বলি।

মৃণালিনী, কাল সকালে হাসপাতালে গিয়েই ওদের তিনজনের খাবার-দাবারের ব্যাপারে…

শুভ, ওদের খাবার-দাবারের ব্যাপারে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। আমি মিঃ রেড্ডির সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করবো। তুমি ডাঃ মাথাইকে বলে একটা বড় গাড়ির ব্যবস্থা করো।

উনি কিছু মনে করবেন না তো?

না, না, কিছু মনে করবেন না বরং খুশি হবেন। মৃণালিনী একটু থেমে বলে, যখন আমি পারবো না, তখন তুমি ওদের নিয়ে বেরুবে; আবার যখন তোমার সময় হবে না, তখন আমি ওদের নিয়ে বেরুব।

হ্যাঁ, তাহলে খুব ভাল হবে।

ও একটু হেসে বলে, শুভ, তুমি আমাকে যত অপদার্থ ভাবো, আমি ঠিক তত অপদার্থ না। একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে।

মৃণালিনী; তুমি যেভাবে আষ্টির দেখাশুনা সেবা-যত্ন করছে, তা দেখে কেউ তোমাকে অপদার্থ মনে করবে না।

ওপাশ ফিরে আমার গলা জড়িয়ে বলে, আর কথা বলো না। এবার ঘুমোণ্ড সাড়ে পাঁচটায় দু’জনকেই উঠতে হবে।

হ্যাঁ, আমরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

পরের দিন সকালে ডাঃ মাথাইকে সব কথা বলতেই উনি একটু হেসে বলেন, আজ দুপুরেই তোমাকে একটা বড় গাড়ি দিয়ে দেব। ওরা যে কদিন থাকবেন সেই ক’দিন এইগাড়ি তোমার কাছেই থাকবে। দ্বিতীয়তঃ তোমার আর মৃণালিনীর ডিউটি সকাল আর আফটারনুন-এ থাকবে, যাতে তোমরা একজন ওদের কাছে থাকো।

আমি খুশির হাসি হেসে বলি, স্যার, দ্যাট উড বী ফাইন।

আগে আমার কথা শোনো।

হ্যাঁ, স্যার, বলুন।

তুমি একদিন ওদের মাইশোর নিয়ে যেও। ওদের প্রত্যেকেরই বয়স হয়েছে। সেজন্য সকালে গিয়ে বিকেলে-সন্ধেয় ফিরে আসা ঠিক হবে না। আমাদের গেস্ট হাউসেই তোমরা থাকবে।…

স্যার, মাইশোরে আমাদের গেস্ট হাউস আছে?

ডাঃ মাথাই একটু হেসে বলেন, ভারতবর্ষের পনের-কুড়িটা শহরে আমাদের গেস্ট হাউস আছে।

শুনে আমি হাসি।

উনি হাসতে হাসতেই বলেন, ওরা যেন বুঝতে পারেন, তুমি-গ্রেট অ্যাপোলো পরিবারের একজন। অল দ্য বেস্ট!

.

ওরা ঠিক এক সপ্তাহ এখানে ছিলেন। হাসপাতাল কতৃপক্ষের সহযোগিতা দেখে ওরা মুগ্ধ হন। আর প্রথম দিন খেতে বসেই জ্যেঠু চিৎকার করেন, ওরে তাতাই সোনা, এত দামী হোটেলের খাবার এনেছিস কেন?

জ্যেঠু, খাবার এসেছে হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে।

এই খাবার তোদের ক্যান্টিনের?

হ্যাঁ।

একটু থেমে বলি, ফাঁইভ স্টার হোটেলে যত রকমের খাবার পাওয়া যায়, তার চাইতে অনেক বেশি ধরনের খাবার আমাদের ক্যান্টিনে পাওয়া যায়।

বলিস কিরে?

জ্যেঠু শুধু পেশান্টদের জন্যই সত্তর-আশি রকমের খাবার তৈরি হয়। তাছাড়া ডাক্তার-নার্স-হসপিট্যাল স্টাফ ও গেস্টদের জন্য কত কি হয়।

আশ্চর্য!

খাবার-দাবারে উপর দিয়ে চোখ বুলিয়েই উনি বলেন, এই বয়সে এত খাও? যায়?

খাবার-দাবারের ব্যবস্থা আমি করিনি; মৃণালিনী করেছে। নিন্দা-প্রশংসা সবই ওর প্রাপ্য। এবার জ্যেঠু মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, মা, এই বয়সে কি আমরা এত খেতে পারি?

জ্যেঠু, আমাদের হাসপাতালে তিনজন হাইলি কোয়ালিফায়েড ডায়াটিসিয়ান আছেন। তাদের একজন ক্যালোরি ও আপনাদের শরীরের প্রয়োজন বুঝে খাবা তৈরি করেছেন।

ওর কথা শুনে মা-বড়মা হো হো করে হেসে উঠে বলেন, শোনো মেয়ে কথা।

এবার মৃণালিনী ওনাদের শাসন করে বলে, চুপচাপ খেয়ে নিন; তা না হলে তিনজনই আমার কাছে বকুনি খাবেন।

জ্যেঠু মা-র দিকে তাকিয়ে বলেন, বৌমা, চুপচাপ খেয়ে নাও তা না হলে এই বুড়ো বয়সে ডাক্তার মেয়ের বুকুনি খেতে হবে।

মহীশূরে দুপুরে পৌঁছে গেস্ট হাউসে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করার পর ওদের বৃন্দাবন গার্ডেন দেখিয়ে চামুণ্ডা মন্দিরে নিয়ে যাই আরতির সময়। পরদিন ব্রেকফাস্টের পর ওদের নিয়ে যাই প্যালেস দেখাতে। তারপর খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করে ফিরে আসি ব্যাঙ্গালোর।

মা-বড়মা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আন্টির কাছেই থাকেন। অমি বা মৃণালিনী জ্যেঠুকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাই; বিকেলে তিনজনকে নিয়েই বেড়াতে যাওয়া হয়। তাই সোনা, আমি আর শিবানী ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ির দোকানে যাব।

বড়মা, আমি তো জানি না, কোন দোকানে ভাল ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায়। মৃণালিনী আড়াইটের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ফিরবে; তোমরা ওর সঙ্গে যেও।

ঠিক আছে।

যাবার দিন বড়মা একটা খুব সুন্দর ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ি মৃণালিনীকে দিয়ে বলেন, মা, তুমি এই শাড়িটা পরবে। এর সঙ্গে ব্লাউজ পিস্ আছে; বানিয়ে নিও। তারপর এই শাড়ি পরে একটা ছবি তুলে আমাদের পাঠাবে।

মৃণালিনী -বড়মাকে প্রণাম করে বলে, মা ছাড়া অন্য কেউ আমাকে কোন উপহার দেয় নি আপনাদের কাছ থেকেই প্রথম উপহার পেলাম।

ও প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, ছবি পাঠাবো।

এয়ারপোর্টে আমি আর মৃণালিনী ওদের তিনজনকে প্রণাম করি ওরা আমাদের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করেন।

মা মৃণালিনীর থুতনি ধরে বলেন, আমারা এসেছিলাম ছেলেকে দেখতে। ছেলেকে দেখা ছাড়াও তোমার মত সোনার টুকরো মেয়েকেও আমরা পেলাম।

মৃণালিনী একটু হেসে বলে, মা, আপনাদের চাইতে আমার ঝুলিতে অনেক বেশি জমা হলো। আমি দুটো মা ছাড়াও একটা জ্যেঠু পেলাম।

জ্যেঠু ওকে বলেন, আমি বেশ অহঙ্কারী হয়ে কলকাতা যাচ্ছি। এবার থেকে সবাইকে জোর গলায় বলব, শুধু আমাদের ছেলে না, মেয়েও এম. এস।

.

এই পৃথিবী বার বার রঙ বদলায়। গ্রীষ্মের দাহ শেষ হয় বর্ষার আগমনে পচা ভাদ্দরে যখন মন বিষণ্ণতায় ভরে যায়, তখনই শরতের নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের নাচানাচি দেখে আমাদের মন আনন্দে ভরে যায়। আবার বসন্তের মাদকতার পিছনেই লুকিয়ে থাকে শীতের জড়তা। মানুষের জীবনেও একইভাবে চলে আলো-আঁধারের খেলা।

সেদিন রবিবার; আমার আর মৃণালিনীর অফ ডে। আন্টিকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিচ্ছিল মৃণালিনী; হঠাৎ উনি ঢলে পড়লেন। ওর বিকট চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম আমি কিন্তু দেখলাম, উনি সব সুখ দুঃখের সীমানা ছাড়িয়ে এক অজানা দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। আর্তনাদ ও বিলাপে মৃণালিনী কিছুক্ষণের জন্য মুছাও গেল।

তারপর?

ডাঃ মাথাই থেকে শুরু করে হাসপাতালের এক দল ডাক্তার-নার্স-কর্মীর চোখের সামনে সূর্যাস্তের বিষণ্ণ আলোয় আন্টির মরদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল।

খবর পেয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এলেন মা-বড়মা আর বম্বে থেকে এলেন দেশপাণ্ডে পরিবারের পরমাত্মীয়ের মত প্রতিবেশী দম্পতি সদাশিব পাতিল ও শ্ৰীমতী প্রমীলা পাতিল। ওদের চারজনকে কাছে পেয়ে মৃনালিনী একটু স্বাভাবিক হয়।

অধ্যাপক পাতিল একদিন আমাকে বলেন, মৃণালিনী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হলে আপনি একটা বিষয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করবেন।

কী বিষয়ে?

মৃণালিনীদের বোম্বের বাড়িটা তৈরি করেছিলেন ওর ঠাকুর্দা। পুরনো বাংলো ধরনের বাড়ি কিন্তু চারপাশে প্রচুর জমি।

উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন ক্যান ইউ ইমাজিন শিবাজী পার্কের কাছে প্রায় দু’একর জমির উপর ওদের বাড়ি।

বলেন কি?

এখন ঐ জমির দাম দেড়-দু কোটি টাকা।

মাই গড!

আমার মত হচ্ছে, মৃণালিনী ঐ জমি-বাড়ি বিক্রী করে দিক। ওখানে যে মাল্টি স্টোরি হবে, তাতে দু’একটা ফ্ল্যাট ছাড়াও মোটা টাকা পাবে।

অধ্যাপক পাতিল একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আমার মনে হয়, এটাই বাস্তব ব্যবস্থা হবে। এই বিষয়ে আপনি ওর সঙ্গে আলোচনা করলে খুব ভাল হয়।

হ্যাঁ, করবো কিন্তু একমাস দু’মাস পরে করবো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করবেন। আমরা কাল চলে যাবো বলেই আজ আপনাকে এইসব কথা বললাম।

পাতিল দম্পতি চলে যাবার পরদিনই -বড়মাও কলকাতা গেলেন। মৃণালিনী শুরু করলো হাসপাতাল যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে ও আরো বেশি আমাকে আঁকড়ে ধরে।

রাত্রে আমার গলা জড়িয়ে শুয়ে বলে, তুমি পাশে না থাকলে আমি কিছুতেই এই বিপদ সামলে স্বাভাবিক হতাম না। তাছাড়া মা-বড়মা আর পাতিল আংকল আন্টি দেশের দুই প্রান্ত থেকে এলেন বলে মনে হলো, মা চলে গেলেও আমি একেবারে নিঃসঙ্গ হইনি।

মৃণালিনী, তুমি যেভাবে তোমার মা-র সেবা-যত্ন করতে, তা চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না। তোমাকে নিয়ে আন্টির যে কত শান্তি, কত গর্ব ছিল, তা তুমি ভাবতে পারবে না।

ও একটু হেসে বলে, মা বুঝি তোমাকে এইসব বলতেন?

প্রতিদিন বলতেন।

আস্তে আস্তে ও আরো স্বাভাবিক হয়। ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, চোখের চাহনিতে দেখা যায় মাদকতার ইঙ্গিত। তারপর হঠাৎ একদিন রাত্রে শোবার পর পরই শুরু হয় ওর পাগলামী।

আমি নিশ্চিন্ত হলাম। মৃণালিনী আবার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়েছে।

.

মাস দেড়েক পরে একদিন রাত্রে ভাইদার ফোন-ভাইয়া, একটা বড় প্রজেক্টের কাজে আমাকে তিন সপ্তাহ হায়দ্রাবাদ থাকতে হবে।

কবে হায়দ্রাবাদ যাবে?

আমাকে সামনের সোমবার পৌঁছতে হবে।

তুমি আমার কাছে আসবে না?

হায়দ্রাবাদ যাবো আর তোর কাছে যাবো না, তাই কখনো হয়?

ভাইদা না থেমেই বলে, আমি শনিবার তোর কাছে আসছি; ওখান থেকে সোমবার সকালের ফ্লাইটে হায়দ্রাবাদ যাবো।

ভেরি গুড।

আবার ফেরার পথেও তোর কাছে যাবো।

ভেরি ভেরি গুড!

 আমি হাসতে হাসতে চিৎকার করে বলি, থ্রী চিয়ার্স ফর ভাইদা।

শনিবার এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি, শুধু ভাইদা না, প্রেয়সীও এসেছে।

আমি কোনমতে হাসি চেপে বলি, ও ভাইদা, সঙ্গে এই পোঁটলা নিয়ে এসেছে কেন?

ভাইদা একটু হেসে বলে, ও এমন কাণ্ড শুরু করলো…

এমন কাণ্ড মানে?

ও শুধু রার বার. সবাইকে বলে, তোমরা সবাই বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাচ্ছো কিন্তু আমাকে কেন কেউ নিয়ে যাচ্ছে না?

ও মাই গড!

তারপর মা-বাবা-ছোট মা বললেন, ওকে নিয়ে যেতে। ওর টিকিট কাটলাম তো এয়ারপোর্টে এসে।

গাড়িতে আসতে আসতে বলি, ওহে প্রেয়সী, আমি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী; আমি তো কোন যুবতীর সঙ্গে এক ছাদের তলায় রাত কাটাই না।

প্রেয়সী চাপা হাসি হেসে বলৈ; বয়ফ্রেন্ড, আমি তো রাত্তিরে তোমার ওখানে থাকব না।

আমি গলা চড়িয়ে বলি, ও ভাই, তোমার বউ বিকাশদার সঙ্গে রাত কাটাতে এখানে এসেছে?

ওরা দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর ভাইদা হাসতে হাসতেই বলে, ভাইয়া, তুই কি কিছুতেই বিকাশদাকে ভুলতে পারছিস না?

তোমার বউয়ের অসভ্যতার জনই তো ঐ হতভাগাকে ভুলতে পারি না।

যাইহোক প্রেয়সীকে দেখে মৃণালিনী মুগ্ধ হয়ে ওকে বলে, তোমার পাশে তো কোন বিখ্যাত হিরোইনও দাঁড়াতে পারবে না।

আমি বলি, মৃণালিনী, তোমার কি মাথা খারাপ হলো? এই অপদার্থ, কুৎসিত, ছলনাময়ীকে দেখে মুগ্ধ? তোমার কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।

দুটো দিন অসম্ভব আনন্দে কাটে। তারপর ভাইদা চলে যায়। আমার আর মৃণালিনীর ডিউটি এক শিফট-এ পড়ছে না বলে প্রেয়সীরও সময় বেশ ভাল কাটে। তবে যখন শুধু আমি আর প্রেয়সী থাকি, তখন ও আমার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে মেলামেশা করে যে আমি অস্বস্তিবোধ না করে পারি না। আবার খুব জোর করে বলতেও পারি না, আমার ভাল লাগে না। তবু আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলি না, ও ভাইদার স্ত্রী।

এইভাবেই একটা সপ্তাহ কাটে।

পরের সপ্তাহে পর পর দু’দিন ইমার্জেন্সিতে আমার নাইট ডিউটি পড়লো। বাড়ি ফিরে আসার পর প্রেয়সীর কত প্রশ্ন। সারারাত কি করে ডিউটি দাও? একটুও ঘুমুবার সময় পাও না? অত রাত্তিরে তো বিশেষ পেশেন্ট যায় না তবে ঘুমোত পারো না কেন?

আমি আর মৃণালিনী:দুইজনেই হেসে উঠি। আমি কিছু বলার আগেই মৃণালিনী বলে, দুর্বা, এমন কোনদিন যায় না, যেদিন কেস আসবে না। আর অ্যাকসিডেন্ট কেস হলেই আমাদের মতো সার্জেনকে দুতিনটে অপারেশন করতেই হবে।

অত রাত্তিরে অপারেশন করতে অসুবিধে হয় না?

না, না, কোন অসুবিধে হয় না।

সপ্তাহের শেষের দিকে পর পর দু’দিন মৃণালিনীর নাইট ডিউটি পড়লো।

সাড়ে ন’টার মধ্যেই মৃণালিনী হাসপাতালে রওনা হয়। তারপর প্রেয়সী বলে, বয়ফ্রেন্ড, আমি গা ধুয়ে চেঞ্জ করে আসি। তারপর আমরা এক সঙ্গে খাবো।

হ্যাঁ, তুমি বাথরুমে যাও।

প্রেয়সী যে পোষাকে বাথরুম থেকে বেরুলো, তা দেখে আমি অবাক। একে ঐ খাজুরাহোর জীবন্ত মূর্তি, তার উপর এই পাতলা ফিনফিনে মাইটি। ওকে এই পোষাকে দেখে যে কোন পুরুষ উন্মাদ হয়ে যাবে।

আমি ওকে দেখে একটু হাসি কিন্তু কোন মন্তব্য করি না। প্রেয়সী পাশের ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়ে আমার সামনে এসে পঁড়িয়ে একটু হেসে দুহাত দিয়ে আমার মুখোনা ধরে দু’গালে চুমু খেয়ে বলে, এসো, বয়ফ্রেন্ড, খেয়ে নিই।

হ্যাঁ, চলো।

টুকটাক গল্পগুজব করতে করতেই আমরা খেয়ে নিই।

আমি শুয়ে পড়ার দু’পাঁচ মিনিট পরই প্রেয়সী আমার পাশে এসে বসে। আমার একটা হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, তুমি কি খুব টায়ার্ড? এখনই ঘুমোবে?।

আমি একটু হেসে বলি, সব স্বাভাবিক মানুষই তো রাত্তিরে ঘুমোয়।

কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময় তো রাত জাগতে ইচ্ছে করে, তাই না?

আমি হাসতে হাসতেই বলি, নাইট ডিউটি ছাড়া মনের মত মেয়ে পেলে রাত জাগতে পারি কিন্তু সে রকম মেয়ে তো আজ পর্যন্ত পেলাম না।

সত্যি পাও নি?

পেলে তো জানতেই পারতে।

এইসব কথাবার্তা চলতে চলতেই ও আমার পাশে শোয়। আমার মাথায় মুখে হাত দিতে দিতে বলে, বয়ফ্রেন্ড, একটা কথা বলব, বিশ্বাস করবে?

কেন বিশ্বাস করবো না?

ও হঠাৎ উপুড় হয়ে শুয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে আমার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার একটুও ভাল লাগে না।

সব সময় আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে?

ও এক গাল হেসে বলে, হ্যাঁ।

দু’এক মিনিট আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর ও আমার বুকের উপর মুখ রেখে দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ওর এই নিবিড় আলিঙ্গন আমাকে চঞ্চল করে তোলে কিন্তু খুবই অস্বস্তি বোধ করি। বলি, প্রেয়সী, প্লীজ এভাবে জড়িয়ে ধরো না।

কেন?

তুমি বুঝতে পারছে না কেন বারণ করছি?

না তো।

তোমার এই খাজুরাহোর জীবন্ত মূর্তি আমার মত যুবককে জড়িয়ে ধরলে কি হয়, তা জানো না?

কি আবার হবে?

প্রেয়সী, প্লীজ ঠিক হয়ে শোও।

তোমার খারাপ লাগছে?

হ্যাঁ, খারাপ লাগছে।

তুমি মিথ্যে কথা বলছে।

কী করে জানলে?

তা বলব না কিন্তু জানি।

প্রেয়সী মুখ উঁচু করে মুহূর্তেই জন্য আমার দিকে তাকিয়েই আবার বুকের উপর মুখ রেখে বলে, তোমাকে জড়িয়ে যে আমার কি ভাল লাগছে, তা বলতে পারবো না।

আমি দু’হাত দিয়ে ওকে সরাবার যত চেষ্টা করি, ও তত বেশি আমাকে জড়িয়ে ধরে।

এইভাবে দু’পাঁচ মিনিট কাটার পর প্রেয়সী মুহূর্তের জন্য উঠে বসেই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মাদিনীর মতো আমাকে চুম্বন করতে শুরু করে।

আমি কোন মতে ওর মুখোনা সরিয়ে দিয়ে বলি, তুমি কি শুরু করলে বলল তো? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

ও সত্যি উম্মাদিনীর মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, বয়ফ্রেন্ড, তোমার পায়ে পড়ি। আজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচব না। প্লীজ আজ আমাকে তুমি…

আমি আর সহ্য করতে পারি না। আমি এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিয়েই উঠে বসে সজোরে ওর গালে এক চড় মেরে বলি, গেট আউট ফ্রম মাই রুম।

প্রেয়সী ধীর পদক্ষেপে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

.

আমি পাশ ফিরে শুয়ে শূন্য দৃষ্টিতে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ভাবি, একি করলাম? আমি ভাইদার স্ত্রী গায় হাত দিলাম! ওকে মারলাম। ছি! ছি!

আমি দুঃখে, অনুশোচনায় মরে যাই। আরো কত কি ভাবি! আমি কি জীবনে কোনদিন ওর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো? ও যদি আর কোনদিন আমার সঙ্গে কথা না বলে, তাহলে মা-বড়মা জ্যেঠু-ভাইদা কি মনে করবে?

ভাবতে গিয়েও আমার মাথা ঘুরে ওঠে।

আকাশ-পাতাল আরো আরো কত কি ভাবি কিন্তু কোন কুলকিনারা পাই না। আমি নিজেকেই নিজে ঘেন্না করতে শুরু করি। একবার মনে হলো, একটা চাবুক দিয়ে নিজেকে পেটাই।

কিন্তু না, আমি কিছুই করি না। আমি প্রাণহীন পাথরের মূর্তির মত শুয়ে থাকি নড়তে-চড়তেও যেন ভয় করে।

এভাবে কতক্ষণ কাটলো, তা জানি না।

তারপর কি যেন একটা অদ্ভুত শব্দ হঠাৎ আমার কানে আসে। দশ-পনের মিনিট ভালভাবে খেয়াল করার পর মনে হলো, অনেক দূরে কে যেন কাঁদছে। কিন্তু…

প্রেয়সী না তো?

এবার আমি না উঠে পারি না। ধীর পদক্ষেপ দু’এক পা এগুতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, অন্য কেউ না, প্রেয়সীই কাঁদছে।

নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় এগিয়ে গিয়ে দেখি, ও ঘরের বিছানা খালি। তারপর দেখি, দরজার পাশে মেঝেতে বসে মাথায় হাত দিয়ে প্রেয়সী কঁদছে। আমি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করি না। এগিয়ে ওর দুটি পা ধরে বলি, প্রেয়সী, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি মুহূর্তের জন্য বোধহয় মানুষ ছিলাম না বলেই এমন জঘন্য অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে আমি আর কলকাতায় যেতে পারবো না।

ও কোন কথা না বলে আমার হাত দুটো সরিয়ে দেয়। দু’এক মিনিট ও কোন কথা বলে না। তারপর মুখোনা তুলেই আবার নামিয়ে নিয়ে বলে, আমিও একটা খুব খারাপ কাজ করেছি।

কী করেছ?

তোমার ডায়েরীর অনেকগুলো পাতা পড়েছি।

বেশ করেছ।

আমি ওর মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলি, প্রেয়সী, প্লীজ এভাবে বসে থেকো না।

আমি ওর হাত দুটি ধরে বলি, ওঠো।

হ্যাঁ। ও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। আমি ওর হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে যাই চোখে-মুখে জল দেবার পর তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিই। তারপর ওর হাত ধরে আস্তে আস্তে আমার ঘরে নিয়ে আমার বিছানায় শুইয়ে দিই। আমিও পাশে শুই।

আমি ওর একটা হাত দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে বলি, তুমি ঠিকই বলেছিলে; আমি তোমার সব চাইতে কাছের মানুষ হবো, তুমিও আমার সব চাইতে কাছের মানুষ হবে। তোমার এই বিশ্বাস, আস্থা কোনদিন আমি হারাতে পারবো না।

আমি আলতো করে একটু টান দিতেই প্রেয়সী পাশ ফিরে শোয়। নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমিও ওর চোখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারি না।

এই নীরবতার মধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়।

আমি ওর মুখের উপর হাত রেখে বলি, তোমার ছেলের নাম হবে বিবেক, মেয়ের নাম হবে প্রেরণা। তুমি আর ভাইদা আপত্তি না করলে তোমার প্রথম সন্তানকে আমি মানুষ করবো।

প্রেয়সীর মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে তারপর বলে, পারবে?

নিশ্চয়ই পারবো।

আমার মুখের উপর একটা হাত রেখে বলে, আমি হাসি মুখে আমার সন্তানকে তোমার হাতে তুলে দেব কিন্তু একটা কথা বলো।

বলল, কি জানতে চাও।

আমার সন্তানকে কেন রাখতে চাইছো?

ভাইদা আর তোমার অর্ধেক তো তোমার সন্তানের মধ্যে পাবো, ওকে নিয়েই আমার জীবন বেশ আনন্দে কেটে যাবে।

ও আমার হাতে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, তুমি একটা আস্ত পাগল।

হঠাৎ ঘরের মধ্যে আলো দেখেই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাই।, অন্ধকার রাত্রির মেয়াদ শেষ, রাজার রাজা দিবাকর আসছেন।

প্রেয়সী, দেখো, দেখো, অন্ধকার শেষ; একটু পরেই সূর্যের আলোয় ভরে যাবে চারদিক।

ও খুব আস্তে আগে গেয়ে ওঠে–

আলো আমার, আলো ওগো,
আলো ভুবন-ভরা,
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার,
আলো হৃদয়-হরা।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *