সেই বরই গাছটি। গাছটির দিকে চেয়ে থাকে নবিতুন।
গাছটির দিকে চেয়ে চেয়ে নবিতুনের চোখ আসে ঝাপসা হয়ে। টন টন করে চোখজোড়া। তবু চেয়ে থাকে নবিতুন। বুঝি ওই বরই গাছটির কাঁটায় কাঁটায় আটক নবিতুনের যত দীর্ঘশ্বাস। বুঝি ওই বরই গাছটির রুক্ষ্ম গায়ে জমাট বাঁধা ওর যত মনের বিলাপ।
বরই গাছটি এখন ন্যাড়া। প্রায় সব পাতাই মরে গেছে। এ ডালে সে ডালে দু-একটি মরা পাতা, যেন বিগত দিনের কোন ব্যর্থ কান্না। একেবারে মগডালের দিকে নতুন পাতার প্রথম কুঁড়ির ক্ষীণ সবুজটি সাদা চোখে এখানেনা অপরিস্ফুট।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সম্ভাবনার সেই অস্কুট ইঙ্গিতটাকেই বুঝি দেখছে নবিতুন। প্রথম কুঁড়ির সেই ক্ষীণ সবুজ ফুঁড়ে আবার পাতা বের হবে। আবার বরই আসবে। বরই পাকবে! আর একটি বছর ঘুরে আসবে। কিন্তু…।
এই কিন্তুর কথাটা মনে হতেই তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিল নবিতুন। হাতের সামনে ঝোলানো জালটার দিকে মন দিল। তাড়াতাড়ি সুতো টানল, ঘর ধরল। আর কিন্তুটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল অনেক দূরে।
চৌধুরী বাড়ির কামের ফাঁকে ফাঁকে ঝাঁকিজাল বুনছে নবিতুন। মিজিদের ফরমায়েশী। ওদেরই সুতো। নবিতুনের মজুরি দুটাকা। একখানি জাল শেষ হয়েছে। আর একখানির ঘাই অবধি পৌঁছে গেছে নবিতুন। দুচার দিনের মধ্যেই শেষ করার ইচ্ছে নবিতুনের।
এই জালখানি শেষ হলেই নগদ চারটি টাকা জমবে নবিতুনের হাতে। সেই টাকা দিয়ে আককিকে একটা শাড়ি কিনে দেবে ও। যুগিদের বাড়িতে গিয়ে একটি রংদার শাড়ির নমুনাও দেখে এসেছে নবিতুন।
খুশিতে বুকটা ভরে যায় নবিতুনের। এ্যাদ্দিন পর একখানা নতুন শাড়ির মুখ দেখবে মেয়েটি। নিজের কথা ভাবে না নবিতুন। চৌধুরীদের বৌর পুরনো তেনা মতো শাড়ি দিয়ে গা ঢাকবার কাজটা চলে যায় ওর।
গুঁজাবুড়ি এলো লাঠি ঠকঠকিয়ে। নবিতুনের দাওয়ায় লাঠিটা শুইয়ে দিল গুঁজাবুড়ি। লাঠির উপর পায়ের গোড়ালিটা চেপে আস্তে-আস্তে বসে পড়ল। গুঁজাবুড়ির মরণ নেই। এত লোক মরে কিন্তু গুঁজাবুড়ি মরে না। থুড়থুড়ে হয়েও আজরাইলের চোখটাকে ফাঁকি দিয়ে চলেছে গুঁজাবুড়ি। নবিতুনের গলার বিষ, নয়ন জ্বালা, গায়ের জ্বালা মূর্তিমতী বিভীষিকা হয়ে এখনো বেঁচে ঘরগুলোর উপর দ্বিগুণ মনোযোগ দেয় নবিতুন।
ডান হাতটা নবিতুনের দ্রুত ওঠে আর নামে। বাঁ হাতে ধরা জালের ঘাই। আঙুলের আগায় আগায় পাচিয়ে চলে সুতো। ঘরে-ঘরে ঘুরে চলে সুতোর গোঁজটা। সুতোয় সুতোয় গিঁট পড়ে। তৈরি হয়ে যায় শক্ত শক্ত সুতোর ঘর, যেখানে ধরা পড়ে যাবে পানির নিচের যত মাছ। হাজার লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, হাজার আথালি-পাথালি খেয়েও পথ পাবে না পালিয়ে যাবার।
ঝাঁকি জালের ঘাই বেঁধে চলেছে নবিতুন। একদৃষ্টিতে তাই দেখছে গুঁজাবুড়ি।
অমন নীরব কেন গুঁজাবুড়ি?
লুন্দুর শেখের কুটনী মাগী, ব্যভিচারের দূতি গুঁজাবুড়ি। নবিতুনের তেজের কাছে কি অবশেষে হার মানল গুঁজাবুড়ি?
পান্তা আছে রে নবিতুন, পান্তা? একমুঠ পান্তা খাওয়াবি?
হাতের গতি স্তব্ধ হয়ে যায় নবিতুনের। গোঁজটাকে জালের গায়ে ঝুলিয়ে রেখে জালটাকে হাত থেকে ছেড়ে দেয় ও। জালটা ঝুলতে থাকে। নবিতুন অবাক হয়ে দেখছে সগির মা গুঁজাবুড়িকে।
এত এত বান্দী, এত এত ধনদৌলত লুন্দর শেখের। মস্তবড় বালাখানা শেখবাড়ির। নবিতুন হবে সে বালখানার রাণী। নবিতুনের পায়ে গড়াগড়ি খাবে সোনা-চান্দি দাসীবান্দী আর খোদ লুন্দর শেখ। এসব না বলে আজ একমুঠো পান্তা চাইছে গুঁজাবুড়ি?
ও নবিতুন, দেনা এক মুঠ পান্তা। শুধু করুণ নয়, কী এক আর্তনাদের ব্যাকুলতা গুঁজাবুড়ির যাঞ্ছায়।
স্তব্ধ নবিতুন এবার চমকে যায়। উপোসের সাথে নবিতুনের পরিচয়। সেই পরিচয় দিয়ে ও শুনতে পায় গুঁজাবুড়ির স্বরে ক্ষুধার ডাক।
নবিতুন উঠে যায় ঘরের ভেতর।
চৌধুরীগিন্নীর কৃপণ হাতে মেপে মেপে দেয়া দুমালা ভাত। দুটি পেট ভরে ওতে। তবু কোন কোন দিন ও থেকেই দু-এক মুঠ ভাত হাঁড়িভর্তি পানিতে রেখে দেয় নবিতুন। ভাতের চেয়েও বড় কথা, এক মুঠ রাতভর ভিজে যে এক হাঁড়ি আমনি হয়, ওতে নুন মিশিয়ে পোড়া মরিচ ডলে স্বাদ জাগে অপূর্ব। ওই এক হাঁড়ি আমনি গিলে মা-বেটির পেট যায় ভরে। ক্ষিদেটাকে অনায়াসেই দুপুর অবধি ঠেলে রাখা যায়। রাতদিন ভেবেছে নবিতুন কচুবাটা পুরে দেবে গুঁজাবুড়ি দুষ্ট মুখে। কিন্তু সেটা তো ভাবনা পর্যন্তই থেকে গেল। আজ কচুবাটার বদলে নিজের ভাগের পান্তাটাই তুলে দিল গুঁজাবুড়ির মুখে।
বাকি পান্তাটুকু বাসনে তুলে আককিকে ডাকল নবিতুন। আককির সাড়া নেই। অনেকক্ষণ ধরেই ধারেকাছে দেখছে না আককিকে। বাসনটা রেখে ঘাটার দিকে এলো নবিতুন।
ঘাটার পর ক্ষেত। ক্ষেতের পর সেই রাস্তার ধু ধু। অজান্তেই নবিতুনের চোখটা চলে যায় ধু ধু ঘেরা রাস্তার দিকে।
এমনি হয়। ওই ধু ধু ঘেরা পথ, কদম সারেংয়ের বাড়ি ফেরার পথ। তাই ঘাটায় এলেই নবিতুনের চোখ জোড়া পড়ে থাকে সে পথের দিকে। কাজের কথা, চৌধুরী বাড়ি যাবার তাগদা, প্রায় শেষ করে আসা ঝাঁকি জালটার কথা, সব কাজের তাড়া কেমন করে যেন ভুল যায় নবিতুন। দূর রাস্তায় রৌদের ঝিকিমিকি আর ধু ধু অস্পষ্টতার মাঝেই যেন হারিয়ে যায় নবিতুন। সারেং বাড়ির ঘাটা ঘেঁষে পালবাড়ি যাবার পায়ে-হাঁটা পথ। কিছুদূর গিয়েই পথটা ঢাকা পড়েছে পালদের আম-কাঁঠালের বাগিচায়। বাগিচার দিকে যেন আককির গলা পাওয়া যাচ্ছে।
চেহারা-সুরত যেমন বাপের মতো তেমনি স্বভাবেও বুঝি দিনে-দিনে বাপের মতো উড়ুক্কু হয়ে চলেছে মেয়েটি। ওকে ঘরে রেখে যায় নবিতুন। কিন্তু নবিতুনের ছায়াটা মিলিয়ে যেতে না যেতেই পালবাড়ির দিকে ছুট দেয় আককি। সেখানে সখী জুটিয়ে নিয়েছে ও।
আজ কড়া হবে নবিতুন। শাসন করবে আককিকে। বড় হচ্ছে, বিয়ের লায়েক হচ্ছে, এসব যেন খেয়ালই নেই মেয়ের। মনে-মনে শক্ত হয়ে বাগিচার দিকে পা বাড়ায় নবিতুন।
আমের ডালপালা ভেঙে ঘর বানিয়েছে ওরা। ঘরের সুমুখে লেপে মুছে সুন্দর করে উঠোন বানিয়েছে। উঠোনে মাটি গোলা আর রঙ মিশিয়ে নানা ছবি এঁকেছে ওরা। কোনটা সূর্য, কোনটা চাঁদ, কোনটা তারা। উঠোনের এক পাশে মাটি তুলে তুলে উনুন বানাচ্ছে ওরা। সেখানে বুঝি জোলাভাতি রান্না হবে ওদের।
মাঘমণ্ডলের ব্রত হয়েছিল পালবাড়িতে। তারই অনুকরণে আককি আর ওর সখীরা ছবি আঁকা উঠোনে খেলছে, নাচছে, গান করছে, ছড়া কাটছে। ওরা গান ধরেছে–
কলই খেতে নাইকো ফুল
গৌরীর মাথায় দীগগল চুল।
দীগগল চুলে
মারল বাড়ি
ফুল ফুইটাছে সারি সারি।
আপন মনে গানে আর খেলায় মত্ত আককি আর ওর সখীদের দিকে চেয়ে থাকে নবিতুন। দুনিয়ার দুঃখ-বঞ্চনার তাপ এখনো স্পর্শ করেনি ওদের। তাই এমন করে ওরা গাছের ছায়ায় খেলতে পারে। মন খুলে গাইতে পারে, নাচতে পারে। ওদের দিকে তাকিয়ে আককিকে শাসন করার কথাটা মনে থাকে না নবিতুনের।
বুঝি মাকে দেখে উঠে আসে আককি। এসে মায়ের আঁচল ধরে টানে। মেয়ের হাত ধরে আর একবার দূরের সেই ধুধুটার দিকে চোখ রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নবিতুন।
জোলাভাতি রাঁধতে আসব না? ভয়ে ভয়েই শুধায় আককি। পান্তা খেয়ে, আমি চৌধুরী বাড়ি গেলে, তারপর আসবি। মেয়ের মাতৃভীতির বহর দেখে মনে মনে বুঝি খুশি হয় নবিতুন।
মায়ের উদারতায় আককিও মাথা দুলিয়ে হাসে।
ঘরে এসে দেখল নবিতুন খেয়েদেয়ে আককির পান্তাটা পাহারা দিচ্ছে গুঁজাবুড়ি। গুঁজাবুড়ির চোখে নেই কুটনামির কুটিল নাচন। গুঁজাবুড়ির জিবে নেই প্রলোভনের ডাক। গুঁজাবুড়ির লোলচর্ম মুখে নেই গোপন হাসি। এ যেন এক তাজ্জব ব্যাপার।
ফুরুৎ ফুরুৎ পানি টানছে আককি আর নবিতুন দেখছে গুঁজাবুড়িকে। ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রশান্তি গুঁজাবুড়ির মুখে। এক মুঠো পান্তা খেয়েই এত তৃপ্তি গুঁজাবুড়ির?
আল্লা তোর হায়াত দারাজ করুক, ইজ্জতে হরমতে রাখুক। গুঁজাবুড়ির প্রার্থনায় কি আন্তরিকতার সুর? তা নইলে সে সুর এমন স্পর্শ করে কেন নবিতুনকে? নবিতুনের মনে পড়ল বাপজানের মৃত্যুর পর এমন অন্তর নিংড়ানো দরদে কেউ তা কোন দিন দোয়া মাংগেনি নবিতুনের জন্য? আবারও তাজ্জব হয় নবিতুন।
কেমন করে জানবে নবিতুন, নবিতুনের তেজ, নবিতুনের দেমাকটাই আশ্রয়চ্যুত করেছে গুঁজাবুড়িকে? লুন্দর শেখ যদি না পায় তার মুখের গ্রাস তবে সগির মা গুঁজাবুড়ির অন্ন কোথায়?
কিন্তু সেসব কথা কিছুই বলল না গুঁজাবুড়ি। আর একবার আল্লার দরবারে নবিতুনের দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা জানিয়ে লাঠিটা হাতে তুলে নিল। ঠক্ ঠক্ শব্দ তুলে চলে গেল।
ব্যস্ত হয়ে উঠল নবিতুন। চৌধুরী বাড়ির কামে যেতে আজও দেরি হয়ে গেল। সেই পান্তার হাঁড়ি আর বাসনগুলো ধুয়ে নিল। জালটা গুটিয়ে ঘরে রেখে এলো। তারপর উঠোনে পা রাখল।
বুয়া গো, বাপজান তোমাকে ডাকে, ছেলে কোলে শরবতি এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে।
গেল সনে বিয়ে হয়েছে শরবতির। কোল ভরা ছেলে আর মুখ ভরা হাসি নিয়ে কদিন হলো নাইয়োর এসেছে বাপের বাড়ি।
কেন রে? বড় হিস্যার দিকে পা বাড়িয়ে শুধাল নবিতুন।
দুপা সামনে গিয়েই আর এগোল না নবিতুন। দাঁড়িয়ে পড়ল। –লুন্দর এইমাত্র এসেছে, বলল শরবতি।
শরবতির বাপজানের সাথে গল্প করছে লুন্দর শেখ। মাঝে মাঝে তার আড়চোখের দৃষ্টি চকিতে ঘুরে যাচ্ছে নবিতুনের উঠোনটায়।
ওই বদমাইশটার সুমুখে আমি যাব নারে শরবতি। দরকার কি, তুই জিজ্ঞেস করে আসবি কাকুকে? ঘোমটাটা মুখর উপর লম্বা করে টেনে দাওয়ায়ে ফিরে আসে নবিতুন।
আককি, আককি। তোর মা কোথায় রে? পশ্চিমের হিস্যা থেকে ডাকছে শরবতির দাদু কামিজ বুড়ো।
দাদুর ডাকটা শুনে বলল শরবতি, আককিকেই পাঠিয়ে দাও বুয়া। লুন্দর শেখের সুমুখ দিয়ে যেতে আমারও ইচ্ছে লয় না।
আককিকে পাঠিয়ে দিয়ে ঘোমটার ফাঁকে চেয়ে থাকে ওরা।
আয় মেয়ে, এদিকে আয়। তোর মা বুঝি এলো না? লুন্দর শেখই আককিকে ডেকে নেয় কাছে! বলে আবার!– তোর মা বান্দীগিরি করে চৌধুরীবাড়ি। আমরাই মরে যাই শরমে। কেন, কদমের রুজি নেই, না কি ওর আপন বলে কেউ নেই গ্রামে?
লুন্দর শেখের কথায় বুঝি সায় দেয় কামিজ বুড়ো। হতে পারে সারেং বাড়ি গরিবের বাড়ি। তা বলে সারেং বাড়ির মেয়েরা বড় বাড়ি গিয়ে দাসীবান্দীর কাম নিয়েছে এমন লজ্জাকর ঘটনা কেউ শোনেনি কোন দিন।
সে কি আমি জানি না? সারেং বাড়ির ছেলেরা হলো রোজগেরে ছেলে। তাদের বৌবা কবে গেছে অন্যের বাড়ি কাম করতে? বুঝি নবিতুনকে শোনাবে বলেই সুরটা বেশ উঁচিয়ে তোলে লুন্দর শেখ।
তোর মাকে দিয়ে আয় এগুলো, বলে আককির হাতে কিছু টাকা তুলে দেয় লুন্দর শেখ। তারপর উত্তরের হিস্যার দিকে সোজা চেয়ে বুঝি নবিতুনের উদ্দেশ্যেই বলল আবার ভাল-মন্দে তোর মা না হয় খবর-টবর দেয় না আমাদের। কিন্তু আমাদের যে খোঁজখবর নিতেই হয়। কদম তো আর পর নয় আমাদের।
কুটনী বুড়ির দৌত্য ব্যর্থ গিয়েছে। তাই কি সরেজমিনে নিজেই আসরে নাবল লুন্দর শেখ? লুন্দর শেখের লক্ষ্য নাকি অব্যর্থ। লুন্দর শেখের শিকার নাকি ফসকায় না কখনো। এই এক নবিতুনই বুঝি ব্যতিক্রম। তাই মৃগয়া ক্ষেত্রে স্বহস্তেই তুণ ধরেছে লুন্দর শেখ।
ছোঁ মেরে আককির হাত থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিল নবিতুন। দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়াল লুন্দর শেখের মুখোমুখি। ঘোমটা তার খসে পড়েছে। কাঁধ ছেড়ে নিচের দিকে ঢলে পড়েছে আঁচলটা। লুন্দর শেখের লুব্ধ চোখ লেহন করে যায় সারেং বৌর রূপের সুধা। কিন্তু সেদিকে হুঁশ নেই নবিতুনের। লুন্দর সেখের ওপর এসে পড়ল মোড়ানো কাগজের দলগুলো। দুমড়ানো নেটেগুলো ছড়িয়ে পড়ল এদিক-ওদিক।
দেখলে তো শরবতির বাপ! দেখলে তো কামিজ কাকু, দেখলে? দেখে রাখ মাগীর তেজ। সাক্ষী রইল তোমরা– টাকা দিলাম, টাকা নিল না মাগিটা। কদম এলে বলবে তোমরা। বলতে বলতে নোটের দলাগুলো কুড়িয়ে নিল লুন্দর শেখ।
তা এখন ওর কদমেরইবা দরকার কি, টাকারইবা কি ঠেকা? লাং-এর তো আর অভাব নেই, টাকারও কমতি নেই। বুঝলে শরবতির বাপ, কদম যতই দেরি করবে আসতে ততই ভাল! একেবারে না এলে আর ভালো। চৌধুরীবাড়িতে বান্দিগিরিতে বড় মধু গো, বড় মধু। আহা এমন মধু কী আর কদম দিতে পারে? বুঝলে শরবতির বাপ?
ক্যান, ক্যানে গলায় কেমন টেনে টেনে বলে লুন্দর শেখ। কথাগুলোর মতোই কুৎসিত বিসদৃশ এক হাসি লুন্দর শেখের মুখে। কিন্তু চোখে তার কামনার চিহ্ন। দেহময় কি এক আক্রোশে লোলুপতার তপ্ত প্রবাহ। বিস্রস্ত আঁচল নবিতুনের পুষ্ট বুকের ক্ষণ-উদ্ভাস লুন্দর শেখের রোয়ায় রোয়ায় আগুন ধরিয়ে গেছে।
আর কিছু বলার জন্য মুখ খুলেও থেমে গেল লুন্দর শেখ। কেননা নবিতুন তখন দরজাটা ভেজিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে উত্তরের গাছগাছালির আড়ালে। আককি চলে গেছে চড়ুইভাতির উৎসবে।
দেরি করে গেছে নবিতুন, অতএব ফিরতেও ওর দেরি হয়ে গেল। পাকা হিসেবি গিন্নি চৌধুরীবিবি। সকালের দেরিটুকু পুষিয়ে নিয়েছে বিকালের দিকে।
উঁচু উঁচু গাছের আগায় গোধূলির শেষ আভাটুকুও মিলিয়ে গেছে। ঝোঁপাল গাছগুলোর পাতা সরিয়ে সরিয়ে পথ করে নিচ্ছে অন্ধকার। গরু আর ঘাস নিয়ে ক্ষেত থেকে যাদের ফেরার কথা সেই কিষাণের দল বুঝি নবিতুনের আগেই ঘরে ফিরেছে আজ।
রাস্তাটা নির্জন, মাথায় ওপর নীড়ফেরা পাখির কিচিমিচি ব্যস্ততা। খাবার সন্ধানের সময় হলো বলে বাদুড়গুলোর তাড়াহুড়ো পাখা ঝাপটানি। এ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই কোথাও।
ভাতের শানকিটা হাতের তালুতে উঁচিয়ে ধরে তাড়াতাড়ি পা ফেলছে নবিতুন। চৌধুরী বাড়ির কাজ সেরে ফিরতে কখনো এত দেরি হয়নি ওর। অন্ধকারকে ভয় নবিতুনের। অন্ধকার রাতেই কুই পড়ে ঘরের চারপাশে, ওঁৎ পেতে থাকে গ্রামের গুণ্ডাসাণ্ডার দল। অন্ধকার রাতে তাই ঘর ছেড়ে এক পাও বের হয় না নবিতুন।
পাটক্ষেতের আলে নেবে গা-টা কেমন ছমছম করে নবিতুনের। আলটার দুপাশে ঘন পাট চারা নবিতুনের মাথা ছাড়িয়েও হাত দুহাত উঁচু সব পাটের মাথা। পাটপাতার ঘন অন্ধকারের মাঝে আলোর পথটা বড় আবছা। ভাতভর্তি শানকিটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতের তালুতে এনে যথাসম্ভব জলদি জলদি আল ভাঙে নবিতুন। কতটুকুইবা আলের পথ। আলটা পেরুলেই আবার রাস্তা। কিছুদূরে এসেই থমকে দাঁড়াল নবিতুন। পাতাভর্তি পাটের মাথাগুলো নড়ছে। আলের কাছ ঘেঁষে খসখস একটু শব্দও আবছা আঁধারে। দৃষ্টিটাকে যতটা তীক্ষ্ণ করা যায় ততটা তীক্ষ্ণ করে দেখল নবিতুন। না, পাটের মাথাগুলো এখন স্থির। হয়তো কোন উড়ো পাখির পাখার বাতাস নড়ে উঠেছিল। আলটার উপর নজর রেখে আবার হাঁটা দেয় নবিতুন।
কিন্তু তিন কি চার কদম, তার বেশি হাঁটতে হলো না নবিতুনকে। এবার একেবারে ওর পাশেই জোরে জোরে দুলে গেল পাটের ঘন-পাতা মাথাগুলো। পটাপট কাছের পাট গাছগুলো ভেঙে দুমরে কে যেন বেরিয়ে এলো জানোয়ার অথবা মানুষ।
নবিতুন কোন কিছু ঠাওর পাবার আগেই জানোয়ার অথবা মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়ল নবিতুনের ওপর। আলের উপর পড়ে দুখান হয়ে গেল ভাতের শানকিটা। ছিটিয়ে পড়ল ভাত তরকারি।
ভয় পেল নবিতুন। ভয়ে যেন স্তব্ধ হলো, কাঠ হলো। আত্মরক্ষার সহজাত তাগিদে হাত দুটো হয়তো উঠে আসতে চাইল উপরের দিকে। গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল একটা চিৎকার।
কিন্তু আচানক ভয়টা বুঝি একেবারেই কাবু করে ফেলেছে ওকে। হিম হয়েছে ওর গায়ের রক্ত। হিম হয়ে জমে গেছে হাত-পা। এমনকি গলার শব্দনালির সরু পথটুকুও।
কেন প্রয়োজন নেই, তবু জানোয়ারটা অথবা মানুষটা তার হাতের থাবা চেপে রাখল নবিতুনের মুখের ওপর। বিশাল ভারি আর শক্ত দুটো বাহুর চাপে যেন। ভেঙে ফেলল নবিতুনের গায়ের হাড়, বুকের হাড়। শ্বাস বুঝি রুদ্ধ হয়ে আসছে নবিতুনের।
এবার মানুষ অথবা জানোয়ারের হাতটা একটু আলগা হলো। সে হাত গামছা প্যাঁচিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল নবিতুনের মুখটা। যত খুশি গলা ফাটিয়ে মরুক নবিতুন, শব্দ আর বেরুচ্ছে না ওর মুখ দিয়ে।
কিন্তু সেই মানুষ অথবা জানোয়ারটি, এতক্ষণে সেও যেন ভয় পেল। কোন কারণ নেই তবু যেন ভয় পেয়েছে। এতটুকু প্রতিরোধ এলো না নবিতুনের কাছ থেকে, ধস্তাধস্তি পাছড়াপাছড়ি কিছুই হলো না। তবু সে যেন একটু ক্লান্তও।
তাই হাতের বেষ্টনী শিথিল করে সে যেন হাঁপিয়ে নিল কয়েক সেকেন্ড। মানুষ অথবা জানোয়ারটা এবার নবিতুনের বাঁধা মুখখানিকে বুকের উপর জাপটে ধরল। জাপটে ধরে ওকে হেঁচরাতে হেঁচরাতে নিয়ে গেল পাটক্ষেতের জঙ্গলে।
জঙ্গলে নিয়ে নবিতুনের শায়িত দেহের উপর চেপে বসল জানোয়ারটা। আচানক ভয় পেয়েছিল নবিতুন। ভয়ে স্তব্ধ হয়েছিল, কাঠ হয়েছিল। তেমনি আচানক হুঁশটাও পেয়ে গেল নবিতুন। হুঁশ পেয়ে শরীরের শক্তিটাকেও যেন ফিরে পেল নবিতুন।
পাটের ক্ষেতে ঘন অন্ধকার।
অন্ধকারেই চোখ মেলল নবিতুন। অন্ধকারেই দেখল জানোয়ার নয় মানুষ মানুষ বেশে এক জানোয়ার। জানোয়ারটাকে মুহূর্তে চিনে নিল নবিতুন। সেই জানোয়ারটার পায়ের চাপে আটক নবিতুনের। সেই জানোয়ারটার দেহের চাপে আর কব্জির শক্ত বাঁধনে বন্দি নবিতুনের দেহ, নবিতুনের দুখানি হাত। একটু হেলতে পারছে না, একটু নড়তে পারছে না নবিতুন। সেই জানোয়ারটার আঙুলের সুড়সুড়ি জাগে নবিতুনের নাভির কাছটিতে তার পর ধীরে ধীরে নাভির নিচে। আরো নিচে। কুটিল সরীসৃপের মতো গুটি গুটি হেঁটে যায় জানোয়ারের আঙুল।
জানোয়ারটার নিঃশ্বাসে যেন আগুল। পশুত্বের বন্যতার বর্বরতার হিংস্র এক আগুন। সে আগুনে বুঝি ঝলসে যায় নবিতুনের গলা, চিবুক আর মুখটা কিন্তু সে আগুন আর এক আগুন ধরিয়ে দিল সারেংবউ নবিতুনের রক্তে। স্যাঁতসেঁতে পাটক্ষেতের জংলি অন্ধকারেও বুঝি আগুন ধরে গেল।
নবিতুনের ডান হাতখানি কেমন করে যেন আলগা হয়ে গেল। খাপ থেকে যেমন করে বেরিয়ে আসে তলোয়ার তেমনি সরাক করে মাটি থেকে উঠে লক্ষ্যের দিকে ছুটে গেল নবিতুনের ডান হাতখানি। সে হাত ধরে ফেলল জানোয়ারটার অণ্ডকোষ।
প্রাণপণে দাঁত দাঁতে ঘষে শক্তি টানল নবিতুন, সমস্ত শক্তি ওর জড়ো হলো, দৃঢ় হলো পাঁচটি আঙুলে, একটি মুঠিতে। টিপে ধরল, চেপে ধরল নবিতুন। শক্ত করে, আরো শক্ত করে। আরো জোরে। প্রাণপণে।
মানুষবেশী পশুটা অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে বসে পড়ল। ছিটকে পালাতে চাইল। পারল না। কাতরিয়ে গোংগিয়ে নবিতুনের শরীরটাকে প্রথমে পা, পরে হাত দিয়ে পাড়িয়ে-দুমড়িয়ে কোন রকমে উঠে দাঁড়াল সে। কিন্তু ঝুলে রয়েছে নবিতুন। এক হাতের টানে কত শক্তি নবিতুনের! যেন ছিঁড়ে ফেলবে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সে বাতাসে ছিটিয়ে দেবে ওই মানুষটির বর্বর পশুত্বটাকে। পশুত্বের চিহ্নটাকে উপরে ফেলবে ওর দেহ থেকে।
তীক্ষ তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল মানুষবেশী জানোয়ারটা। স্যাঁতসেঁতে পাটক্ষেতের জঙ্গি অন্ধকার চিরে লোকালয়ের দিকে ছুটে গেল সে চিৎকার। সেই চিৎকারটার পিছুপিছু লুন্দর শেখও দৌড়ে চলে গেল পাটক্ষেতের অন্ধকার ছেড়ে।
নারী অনুপমা। কেননা লজ্জা তার ভূষণ। তাই নিষ্ঠুর উলঙ্গ মৃত্যুর মুহূর্তেও আপন আব্রু আর লজ্জা সম্পর্কে সচেতন।
সেই জানোয়ারটা খুলে ফেলেছিল নবিতুনের শাড়ি। ওটা পড়ে আছে হাত দুই দূরে। বাঁ হাতে শাড়িখানা তুলে নিল নবিতুন। পটপট পাটের গাছ ভাংতে ভাংতে বেরিয়ে এলো সেই আলের পথে। আলের পথ ধরে ছুটে চলল। উঠে এলো রাস্তায়। রাস্তা ছেড়ে ডাঙায়।
সেই জানোয়ারটা বুঝি এখনো ধাওয়া করে চলেছে নবিতুনকে। অন্ধকার যেন তারই অজস্র বাহু। পাশবিকতার সেই অজস্র বাহু যেন এখুনি আবার ধরে ফেলবে নবিতুনকে। গলাটিপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলবে। তাই বেঁহুশ উন্মাদিনীর মতে ছুটছে নবিতুন।
আঁধারে চেনা যায় না পথ। কাঁটা ফোটে পায়ে। রক্ত ঝরে। উঁচু-নিচু মাটিতে ঠোক্কর খেয়ে বসে পড়ে নবিতুন। গাছের গুঁড়িতে বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ে শরীরটা। তবু কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই নবিতুনের। ও ছুটছে বাড়ির দিকে।
এইটুকু তো পথ। তবু নবিতুনের মনে হয় সেই কখন থেকে ছুটছে ও। ছুটতে ছুটতে একসময় ও পৌঁছে গেল বরই গাছের সীমানা দেয়া উঠোনে।
আককি, আককি, ক্লান্ত দুটি স্বর যেন বহুদূর থেকে ডাকল। তারপর দোরগোড়ায় মূৰ্ছা খেয়ে পড়ে গেল নবিতুন।