৭
সূর্য ওঠার আগেই মিসির আলির ঘুম ভাঙল। অন্ধকার মাত্র কাটতে শুরু করেছে। টেবিলে রাখা হারিকেন নিভে গেছে। টেবিল ল্যাম্প দপদপ করছে। যেকোনো মুহূর্তেই নিভবে। মনে হচ্ছে হিসাব করে তেল দেওয়া। সূর্যের আলো ফুটবে আর এরা নিভে যাবে। মিসির আলি প্রথমেই তাকালেন দরজার দিকে ছিটকিনি লাগানো আছে, দরজা বন্ধ। তিনি বিছানায় উঠে বসে মেঝের দিকে তাকালেন—মেঝে ঝকঝক করছে। ঝড়বৃষ্টির রাতে কোনো কুকুর উঠে এলে মেঝেতে তার পায়ের দাগ থাকত। মেঝেতে কোনো দাগ নেই। গত রাতে মোটামুটি ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই, তবু সন্দেহটা যাচ্ছে না।
তিনি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সকালের প্রথম আলোয় নদী দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল নদীটা পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সঙ্গে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওই বাড়িটার সঙ্গে নদীর কোনো যোগ নেই। নদী দেখতে ভালো লাগছে না।
ভেতরের উঠোনে একটা জলচৌকির উপর বরকত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে পেতলের বদনা। সে মিসির আলিকে দেখতে পায় নি। মিসির আলি ডাকলেন, ‘এই বরকত।’ বরকত ভয়াবহভাবে চমকে উঠল। হাত থেকে বদনা জলচৌকিতে পড়ে ঝনঝন শব্দ হল। এতটা চমকানোর কোনো কারণ নেই। মিসির আলি বললেন, কী করছ?
নামাজের অজু করি। ফজরের নামাজ।
মিসির আলি বিস্মিত হলেন। এত দীর্ঘ বাক্য বরকত তাঁর সঙ্গে এর আগে ব্যবহার করে নি।
তোমার কুকুর কি বাঁধা আছে?
জি বান্দা। আসেন নিচে আসেন।
মিসির আলি নিচে নেমে এলেন। বরকত বলল, চা খাইবেন?
মিসির আলি বললেন, গরম চা খেতে পারলে ভালো হত।
নামাজ শেষ কইরা চা দিতাছি।
তোমার কুকুরগুলি কোথায় একটু দেখি।
বরকত আঙুল উঁচিয়ে পেয়ারা গাছের সঙ্গে বাঁধা কুকুরগুলি দেখাল। গলা নামিয়ে বলল, কাছে যান। শইলে হাত দেন। আপনেরে কিছু বলব না।
কিছু বলবে না কেন?
বরকত চাপা গলায় বলল, একটা ঘটনা ঘটাইছি। আপনের জুতা আর কাপড় শুকাইয়া দিছি। অখন এরা আপনের শইল্যের গন্ধ চিনে।
মিসির আলি বললেন, কাজটা তুমি নিজ থেকে করো নি। কেউ তোমাকে করতে
বলেছে। কে বলেছে?
বরকত জবাব দিল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিসির আলির মনে হল বরকত তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এখন আর কথা বলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে।
মিসির আলি বললেন, গেট খুলে দাও নদীর পাড়ে বেড়াতে যাব। এত কাছে নদী, অথচ নদীই দেখা হয় নি।
বরকত বলল, গেইট খুলন যাইব না। বড় সাবের নিষেধ আছে।
নিষেধ?
জি নিষেধ। আমি খুলতে চাইলেও খুলতে পারব না। চাবি থাকে বড় সাবের কাছে।
চাবি সব সময় বড় সাহেবের কাছে থাকে?
বরকত শীতল গলায় বলল, সব সময় চাবি উনার কাছে থাকে না। যখন আপনের মতো কেউ বেড়াইতে আসে তখন চাবি উনার কাছে থাকে।
মিসির আলি বললেন, যাতে অতিথিরা পালিয়ে যেতে না পারে সেই জন্যে?
কী জন্যে সেইটা আমি জানি না বড় সাহেব জানে।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি নামাজ পড়তে যাও। তোমার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শেষে নামাজ কাজা হবে।
বরকত গম্ভীর মুখে বলল, ফজরের নামাজ দুপুর পর্যন্ত কাজা হয় না। এর একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা শুনবেন?
বল শুনি।
নবীয়ে করিম একবার দেরি কইরা ঘুম থাইকা উঠছিলেন। নবীয়ে করিমের জন্যে আমরা মাফ পাইছি।
এটা জানতাম না।
ভদ্রলোকরা সব বিষয় জানে, ধর্মকর্ম বিষয়ে জানে না। এইটা একটা আফসোস।
আফসোস তো বটেই। বরকত তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। আমি বাগানের দিকে যাচ্ছি তুমি নামাজ শেষ করে চা নিয়ে এসো। দুকাপ চা আনবে। আমার জন্যে এক কাপ তোমার জন্যে এক কাপ। আমরা চা খেতে খেতে গল্প করব। ভালো কথা আমি যখন তোমাকে ডাকলাম তুমি এত ভয় পেলে কেন? ভয়ে হাত থেকে একেবারে বদনা পড়ে গেল।
বরকত জবাব দিল না, তার ঠোঁটের কোনায় অস্পষ্ট হাসির রেখা দেখা গেল। মিসির আলি হাঁটতে শুরু করলেন, চেরী গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দৃষ্টি মাটির দিকে। হুইল চেয়ারের কোনো দাগ কি মাটিতে আছে? থাকার কোনোই কারণ নেই। কাল রাতে যা দেখেছেন তার পুরোটই স্বপ্ন। এই সত্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। তারপরেও দেখা। মানুষের মন এমন যে একবার কোনো বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হলে সেই সন্দেহ আর যেতেই চায় না। কাপড়ে ময়লা লেগে যাবার মতো যত ভালো করেই ধোয়া হোক অস্পষ্ট দাগ থেকেই যায়। সেই দাগ বারবার ধুতে ইচ্ছা করে।
হুইল চেয়ারের পায়ের রেখা ভেজা মাটিতে আছে। মিসির আলির ভুরু কুঞ্চিত হল। স্বপ্নের একটি অংশ কি সত্যি? মানুষ যেমন মিথ্যা কথা বলার সময় মিথ্যার সঙ্গে কিছু সত্য মিশিয়ে দেয়, স্বপ্নেও কি সে রকম কিছু ঘটে? মস্তিষ্ক স্বপ্নের সঙ্গে সামান্য বাস্তব মিশায়। মিসির আলি হুইল চেয়ারের দাগ ধরে এগুতে লাগলেন। তাঁকে বেশিদূর যেতে হল না, তার আগেই থমকে দাঁড়াতে হল। লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে সুলতান বলল, স্যার কী করছেন? সুলতানের গলায় চাপা কৌতূহল।
মিসির আলি বললেন, কিছু করছি না। হাঁটছি, প্রাতঃভ্রমণ বলতে পার।
আমার কাছে মনে হচ্ছে মাটিতে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে এগুচ্ছেন। কী খুঁজছেন? হুইল চেয়ারের পায়ের দাগ?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ। তুমি কাল রাতে হুইল চেয়ার নিয়ে বাগানে ঘুরেছ। কোথায় কোথায় গিয়েছিলে তাই দেখছিলাম।
এই অনুসন্ধানের আপনার বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?
না তেমন কোনো কারণ নেই।
শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি থামল। আকাশ পরিষ্কার হল। আমি বাগানে ঘুরছিলাম, এবং আকাশ দেখছিলাম।
সুলতান হুইল চেয়ার নিয়ে লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে নিচে নামতে শুরু করল। হুইল চেয়ারে বারান্দা থেকে বাগানে নামার জন্যে ব্যবস্থা করা আছে। তার পরেও তাকে নামতে হচ্ছে সাবধানে। সুলতান সহজ গলায় বলল, পঙ্গু মানুষেরও মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে। বাগানে যেতে ইচ্ছা করে। শীতের সময় বাগানে ঘুরে বেড়ানো সহজ। বর্ষার সময় বেশ কঠিন। কাদায় চাকা ডেবে যায়। তখন পেছন থেকে কাউকে ঠেলতে হয়। স্যার আপনার রাতের ঘুম ভালো হয়েছিল?
হ্যাঁ ভালো হয়েছে।
বেশ ভালো, নাকি মোটামুটি ভালো?
বেশ ভালো।
আপনি কি আর্লি রাইজার?
না আজ কীভাবে কীভাবে যেন ঘুম ভেঙে গেছে। আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য নেই। শুধুই সূর্যাস্তের দৃশ্য।
সুলতান হালকা গলায় বলল, আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য প্রচুর পরিমাণে আছে। আমি রাতে ঘুমাই না। সকালে সূর্য দেখে ঘুমাতে যাই। আমার কপালে সূর্যাস্ত নেই।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমাকে ঘুম থেকে বঞ্চিত করছি, যাও শুয়ে পড়।
সুলতান বলল, না, আজ আমি আপনার সঙ্গে গল্প করব। চলুন নীল মরিচ ফুল গাছটার কাছে যাই। আপনি বেদিতে বসবেন। আমি বসব হুইল চেয়ারে। আমাদের আই লেভেল ঠিক থাকবে।
মিসির আলি বললেন, বরকতকে চা নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তুমি চা খাবে?
খেতে পারি।
চায়ে চিনি কতটুক খাও?
কেন জানতে চান বলুন তো?
বিশেষ কোনো কারণ নেই। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
দুচামচ।
আমার ধারণা ছিল তুমি চায়ে চিনি খাও না।
এ রকম ধারণা হবার কারণ কী?
মধু খাও না তো তাই ভাবলাম মিষ্টি জাতীয় কিছুই খাও না।
সুলতান শীতল গলায় বলল, মধু খাই না আপনাকে কে বলল?
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, কেউ বলে নি। আমার ধারণা তুমি খাও না। অন্যদের আগ্রহ করে খাওয়াও। আমার ধারণাটা কি ঠিক?
হ্যাঁ আপনার ধারণা ঠিক। আমি মধু খাই না এই ধারণা আপনার কেন হল এটা বুঝতে পারছি না। ব্যাখ্যা করবেন?
আমার সিক্সথ সেন্স এ রকম বলছিল।
সুলতান কঠিন গলায় বলল, সিক্সথ সেন্স বলে কিছু নেই। এটা আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। আমি মধু খাই না এটা কেন বললেন?
সুলতান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। তার হাতের মুঠি বন্ধ। প্রতিটি লক্ষণ বলে দিচ্ছে সে রেগে গেছে। রাগ সামলাতে পারছে না। মিসির আলি সুলতানের রাগটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। যেন তিনি ধরেই নিয়েছেন সুলতান রাগবে। মিসির আলি গাছের বেদিতে পা তুলে বসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, সুলতান তোমার কাছে কি সিগারেট আছে? দিনের প্রথম চা-টা সিগারেট দিয়ে খেতে হয়। আমি আমার প্যাকেট ভুলে উপরে রেখে এসেছি। সিগারেট হাতে নিয়ে বসে থাকি। এর মধ্যে চা চলে আসবে। সিগারেট হাতে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। যারা ধূমপান করে না তারা সুস্বাস্থ্যের আনন্দ পায়, সিগারেট হাতে বসে থাকার আনন্দটা পায় না।
বরকত চা নিয়ে এসেছে। দুজনের জন্যেই চা এনেছে। সুন্দর কাপে করে মিসির আলির জন্যে চা আর তার নিজের জন্যে গ্লাস ভর্তি চা। মিসির আলি বললেন, বরকত তুমি কাপটা তোমার বড় সাহেবকে দাও। আর আমি তোমার গ্লাসে করে চা খাব। গ্লাস ভর্তি চা খাওয়ায় আলাদা আনন্দ আছে। কাপের চা বাইরে থেকে দেখা যায় না। গ্লাসের চা দেখা যায়।
সুলতান সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, ‘আমি মধু খাই না’ এই ধারণার পেছনে আপনার ব্যাখ্যাটা এখন শুনি। আমি ব্যাখ্যাটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
আমার ব্যাখ্যা খুবই সহজ। তুমি আমাকে মধু দেবার সময় নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছিলে। রিফ্লেক্স একশান। সেখান থেকেই বুঝলাম তুমি মধু খাও না। খেলেও যে মধুটা আমাকে খেতে দিয়েছ সেটা খাও না।
তাহলে শুধু শুধু সিক্সথ সেন্সের কথা কেন বললেন?
আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা করলাম। আমি দেখলাম সিক্সথ সেন্সের কথা শুনে তুমি চমকে গেলে, খানিকটা রেগেও গেলে। চমকাও কি না এটাই ছিল আমার পরীক্ষা। বরকত দেখি চা ভালো বানায়।
সুলতান তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে অপেক্ষা করছে মিসির আলি কী বলেন তা শোনার জন্যে। মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তুমি যখন বললে সুন্দরবনে নানান ধরনের ফুলের মধু পাওয়া যায়— খলিসা ফুলের মধু, কেওড়া ফুলের মধু, গড়ান ফুলের মধু, তখন হঠাৎ করে আমার মনে হল—অনেক বিষাক্ত ফুলও তো প্রকৃতিতে আছে। যেমন ধুতরা ফুল। এমন কি হতে পারে না যে কিছু মৌমাছি ধুতরা ফুল থেকে মধু নেয়। সেই সব ফুলে ধুতরার ভয়ঙ্কর বিষ মিশবে। সেই বিষ হল a very powerful halucinating drug যা মানুষের চিন্তায় কাজ করে। চেতনাকে পাল্টে দেয়। রিয়েলিটির ভুল ব্যাখ্যা করে। সুন্দরবন হল একটা ট্রপিক্যাল ফরেস্ট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। সেখানে ধুতরা ফুল থাকারই কথা। তুমি বল থাকবে না?
হ্যাঁ থাকবে। এবং আছে। সুন্দরবনের ভেতর মাঝে মাঝে হঠাৎ কিছু ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। সেখানে প্রচুর ধুতরা ফুল ফোটে।
সেই ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে?
সব মৌমাছি করে না। বিশেষ এক ধরনের মৌমাছি করে। এদের মৌমাছিও বলে না। বলে মৌ পোকা।
মিসির আলি বললেন, যেকোনোভাবেই হোক বিশেষ ধরনের এই মধু তোমার সংগ্রহে আছে। তার খানিকটা তুমি আমাকে দুদফায় খাইয়েছ যে কারণে আমি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নের সঙ্গে বাস্তব মিশে ছিল। প্রথম রাতে সাপ নিয়ে কথা হল—আমি স্বপ্নে দেখলাম সাপ। দ্বিতীয় রাতে কুকুর নিয়ে কথা হল। লিলি আমাকে বলল দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে ঘুমুতে—মাঝে মাঝে কুকুর দোতলায় উঠে আসে। সেই রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম কুকুর। কুকুরটা ঘরে ঢুকে আমার বিছানার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সুলতান বলল, আপনার ডিডাকটিভ লজিক যে ভালো, আমি জানতাম। এতটা ভালো বুঝতে পারি নি। I am impressed.
মিসির আলি চায়ের গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, এখন তুমি কি আমাকে বলবে, কেন আমাকে এখানে এনেছ? তারা দেখানোর জন্যে নিশ্চয়ই আন নি। চিঠিতে তুমি টোপ ফেলার কথা বলেছ। সেটা কথার কথা ছিল না। আসলেই টোপ ফেলে এনেছ। কেন এনেছ? খোলাখুলি বলতে অসুবিধা আছে?
না অসুবিধা নেই। আপনার সঙ্গে অনেক লুকোচুরি খেলা হয়েছে। আর খেলার প্রয়োজন দেখছি না।
তাহলে তোমার উদ্দেশ্যটা বলে ফেল। তুমি কিছু মনে কোরো না—আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। আমি আজ চলে যাব। দুপুরের পর রওনা হতে চাই।
সুলতান বলল, আজ অমাবস্যা। আকাশে মেঘ নেই। আমি নিশ্চিত যে আজ রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আপনাকে আজ রাতে একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সি দেখাব। দেখার পর মনে হবে আপনার মানব জীবন ধন্য।
আমার গ্যালাক্সি দেখার শখ এখন নেই। আমি চলে যেতে চাচ্ছি। আকাশ দেখতে ইচ্ছা করছে না।
সুলতান শীতল গলায় বলল, স্যার শুনুন। আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা ভুলে যান। আমি আপনাকে এখান থেকে বের হতে দেব না।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, বের হতে দেবে না?
সুলতান বলল, না। এবং তার জন্যে কোনো সমস্যাও হবে না। কেউ জানবেও না আপনি কোথায় আছেন। আপনার পরিচিতজনরা জানে আপনার স্বভাব হচ্ছে মাঝে মধ্যে বাইরে কোথাও চলে যাওয়া। সবাই ভাববে এবারো তাই হয়েছে। আপনার এক ছাত্র আপনার জন্য টেকনাফে অপেক্ষা করছে। সে যখন দেখবে আপনি এসে পৌঁছান নি তখন সে খানিকটা খোঁজ করবে। সবাই জানবে টেকনাফ যাবার পথে আপনি হারিয়ে গেছেন। কিছুদিন পর মানুষ আপনাকে ভুলে যাবে। মানুষ বিস্মৃতিপরায়ণ জীব।
আমাকে এখানে আটকে রেখে তোমার লাভ কী?
লাভ আছে। সাইকোলজি বিশেষ করে প্যারাসাইকোলজির উপর আপনার দখল অসাধারণ। আপনি আমার উপর গবেষণা করবেন। আমার মাথার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখবেন সেখানে কী আছে। কেন আমি এ রকম?
তুমি কী রকম?
আপনার অনুমান শক্তি তো ভালো, আপনি অনুমান করুন। আপনাকে সামান্য সাহায্য করছি। আমার তুলনায় অশ্বিনী কুমার রায় একজন মহাপুরুষ। হা হা হা।
মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। সুলতানও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখন আর হাসছে না। কিন্তু হাসিটা শরীরের ভেতর আছে। কারণ তার শরীর কাঁপছে। মনের ছায়া চোখে নাকি পড়ে। চোখ হচ্ছে মনের জানালা। মিসির আলির মনে হল না—সুলতানের চোখে মনের কোনো ছায়া পড়েছে। শান্ত স্থির চোখ। যে চোখ বুদ্ধিতে ঝকমক করছে।
সুলতান বলল, স্যার আপনার কি ভয় লাগছে?
মিসির আলি বললেন, না।
সুলতান বলল, ভয় লাগছে না কেন?
বুঝতে পারছি না কেন।
সুলতান বলল, আপনি যে ভয় পাচ্ছেন না সেটা আপনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। ভয় পাবেন না জানলে আগেই আপনাকে বলতাম। যাই হোক আপনার উচিত আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া।
কেন বল তো?
সুলতান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনাকে জীবনের শ্রেষ্ঠতম গবেষণার সুযোগটা আমি করে দিচ্ছি। একজন অতি ভয়ঙ্কর মানুষকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। যে আপনার গবেষণায় আপনাকে সাহায্য করবে। আপনিও আমাকে কিছুটা সাহায্য করবেন।
আমি কী সাহায্য করব?
আমাকে সঙ্গ দেবেন। আপনার সঙ্গে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা নিয়ে আলাপ করব। আকাশের তারা দেখব। তাছাড়া আমি নিজেও ছোটখাটো কিছু পরীক্ষা করছি। মানসিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষাতেও আপনি সাহায্য করবেন। মনোজগতের যে পড়াশোনা আপনার আছে আমার তা নেই। পরীক্ষাটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না আপনি দেখে দেবেন।
কী পরীক্ষা?
সালমা নামের একটা মেয়ের কথা আপনাকে চিঠিতে লিখেছিলাম। তাকে নিয়েই পরীক্ষা। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, সব মানুষের ভেতরই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে। মানুষের মনে ভয়ঙ্কর চাপ দিয়ে সেই ক্ষমতা বের করে আনা যায়। আমি সালমার উপর এই চাপটাই দিচ্ছি।
মেয়েটা কোথায়?
মেয়েটা এ বাড়িতেই আছে। রাতে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।
লিলি বলছিল সালমা বলে আলাদা কেউ নেই। লিলিই সালমা।
লিলির সব কথা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার কিছু নেই। আমি এখন ঘুমুতে যাব। আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে জিজ্ঞেস করুন।
হুইল চেয়ারের কি তোমার প্রয়োজন আছে?
না, হুইল চেয়ারের আমার কোনোই প্রয়োজন নেই। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ একজন মানুষ। ইচ্ছা করেই হুইল চেয়ারে সময় কাটাই যাতে বাইরের লোকজন জানে এ বড়িতে পঙ্গু একজন মানুষ থাকে। পঙ্গু বলেই সে শহর ছেড়ে নির্জন বাস করে। এই কাজটা না করলে কথা উঠত সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ দিনের পর দিন এই নির্জনে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছে কেন? অবিশ্যি হুইল চেয়ারের একটা ভালো ব্যবহারও আছে। টেলিস্কোপ ফিট করে তারা দেখার সময় এটা খুব কাজে লাগে।
তুমি যে আমাকে এখানে আটকে রাখার জন্যে এনেছ তা কি এ বাড়ির লোকজন জানে?
জানবে না কেন? জানে। লিলি জানে, বরকত জানে। আপনার মতো অনেকেই এ বাড়িতে আসে। কেউ ফিরে যায় না। বুঝতেই পারছেন এ বাড়ি থেকে কাউকে জীবিত ফেরত পাঠানো আমার জন্যে সম্ভব না। কোনো ভয়ঙ্কর মানুষ যদি তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে সাবধানী হতে হবে। সিরিয়াল কিলারদের কথাই ধরুন—সব সিরিয়াল কিলারই চিতাবাঘের চেয়েও সাবধানী। তাকে একের পর এক মানুষ মারতে হবে। সাবধানী না হলে এই কাজটা সে করতে পারবে না। স্যার আমি ঠিক বলছি?
হ্যাঁ ঠিক বলছ।
থ্যাঙ্ক য়্যু। আমি সালমা মেয়েটিকে নিয়ে গবেষণাধর্মী যে কাজটা করেছি তা লেখার চেষ্টা করেছি। আমি পাঠিয়ে দেব। পড়ে দেখুন। লেখাটা গবেষণাধর্মী হয় নি। সায়েন্টিফিক পেপার কী করে লিখতে হয় জানি না। এই দায়িত্বটা আপনার। আমরা এই জঙ্গলে বসে একের পর এক রিসার্চ পেপার বিদেশী জার্নালে পাঠাব। মূল অথার আপনি আমি কো-অথার
সুলতান হাসল। সেই হাসি যা চট করে মুখ থেকে মুছে যায় কিন্তু শরীরে থেকে যায়। বেশ কিছুক্ষণ শরীর দুলতে থাকে। এই প্রথম মিসির আলির শরীর গুলিয়ে উঠল। তাঁর কাছে মনে হল ঘেন্নাকর কিছু তার সামনে বসে আছে।
সুলতান বলল, স্যার এখন আপনি আমাকে সামান্য ভয় পাচ্ছেন। আপনার চোখ- মুখ শুকিয়ে গেছে। কোম্পেনি হিসেবে আমি খারাপ হব না। আমি শিক্ষিত একজন মানুষ। অংকশাস্ত্রের মতো একটা জটিল বিষয়ে আপার পিএইচ. ডি. ডিগ্রি আছে। আপনি যদি অংকের ছাত্র হতেন তাহলে আমাকে চেনার সামান্য সম্ভাবনা ছিল—আমার পিএইচ. ডি.’র কাজ খুব ভালো হয়েছিল। গ্রুপ থিওরির সব বইতেই সুলতান ফাংশান বলে একটা ফাংশানের উল্লেখ আছে। আমার নামে তার নাম। যৌবনে এই দিকে কিছু মেধা ব্যয় করেছিলাম। পরে এইসব অর্থহীন মনে হয়েছে। স্যার আমি কী বলছি আপনি কি শুনছেন?
হ্যাঁ শুনছি।
এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে আসল রহস্য পদার্থবিদ্যা বা অংকে না—আসল রহস্য মানুষের মনে। আকাশ যেমন অন্তহীন, মানুষের মনও তাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ অংকবিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। আমিও ভালবাসি। আকাশের দিকে তাকালে জাগতিক সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়। We are so insignificant. আমাদের জন্ম-মৃত্যু সবই অর্থহীন।
মিসির আলি বললেন, তুমি কি মানুষ খুন করেছ?
সুলতান জবাব দিল না।
মিসির আলি বসে স্তব্ধ হয়ে আছেন। সুলতান হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। পেয়ারা গাছের নিচে বরকতকে দেখা যাচ্ছে সে কুকুরকে গোসল দিচ্ছে।
রোদ উঠেছে। আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম। চেরী গাছ থেকে একটা দুটা করে ফুল পড়ছে। ফুলগুলি গাছে যত সুন্দর দেখাচ্ছে—হাতে নেওয়ার পর তত সুন্দর লাগছে না। কিছু সৌন্দর্য দূর থেকে দেখতে হয়, কাছ থেকে দেখতে হয় না।