সুরমা মেল রাত সাড়ে দশটায় ছাড়বে। জাফর সাহেব দুজনের একটা প্রথম শ্রেণীর স্লিপিং বার্থ বিজার্ভ করেছিলেন। এখন তিথি ঐ কামরায় একা যাবে। নুরুজ্জামান তার সঙ্গে যাচ্ছে তবে সে অবশ্যই অন্য কামরায় থাকবে। জাফর সাহেব বললেন, ভয় পাবি নাতো মা?
তিথি বলল, ভয় পাব কেন? আমি একাতে যাচ্ছি না। হাজার দু এক যাত্রী আমার সঙ্গে যাচ্ছে।
দ্যাটস টু। দরজা বন্ধ করে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকবি। ঘুম ভাঙ্গলে দেখবি সিলেট রেল স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
তুমি আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করবেনা তো বাবা।
আচ্ছা দুঃশ্চিন্তা করব না।
যেকোন কারণেই হোক–তুমি কোন ব্যাপার নিয়ে খুব আপসেট হয়ে আছ বলে আমার মনে হয়। আমি মাকে নিয়ে আসি তারপর তোমাদের ঐ সব ঝগড়া–মন কষাকষি পুরোপুরি দূর করে দেব।
জাফর সাহেব কিছু বললেন না। তিথি রাতের রান্না করতে চেয়েছিল। জাফর সাহেব রান্না করতে দিলেন না। তিনি হোটেল থেকে খাবার আনতে গেলেন। নুরুজ্জামান এখনো ফেরেনি। এ নিয়েও তিনি খানিকটা চিন্তিত বোধ করছেন। নুরুজ্জামান না ফিরলে তিথির যাওয়া তিনি বন্ধ করে দেবেন। তবে সে ফিরবে। তিথি বলেছে নুরুজ্জামান ঠিক সাড়ে নটার সময় হাতে একটা আনারস নিয়ে ফিরে আসে।
ঘড়িতে এখনো সাড়ে নটা বাজে নি। নটা দশ বাজে। হাতে সময় আছে। তিথির কাপড় গোছানোই আছে—তবু কোথাও যাবার আগে সমস্যা হয়। সব সময় দেখা যায় সব নেয়া হয়েছে শুধু জরুরি জিনিসটাই নেয়া হয় নি। টেলিফোনে অনেকক্ষণ ধরেই রিং হচ্ছে। তিথি বিরক্ত মুখে উঠে গেল। ওপাশ থেকে মারুফ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তিথি দুপুরে তুমি কোথায় ছিলে আমি এক লক্ষ বার টেলিফোন করেছি।
তিথি বলল, কেমন আছ?
আমি কেমন আছি সেটা বড় ব্যাপার না। তুমি কেমন আছ?
ভাল।
গলা শুনে মনে হচ্ছে রাগ করেছ।
আমার কি রাগ করার মত কারণ নেই?
থাকতে পারে তবে আমার কারণে তোমার রাগ করার মত গ্রাউণ্ড নেই। ব্যাখ্যা করব?
দরকার নেই।
অবশ্যই দরকার আছে মন দিয়ে শোন।
শুনছি।
একটু ধরে থাক আমি সিগারেট ধরিয়ে নি। জাষ্ট এ সেকেণ্ড।
তিথি রিসিভার ধরে আছে। মারুফ সিগারেট ধরাতে পরাতে অতি দ্রুত ভেবে নিচ্ছে কি বলবে। তিথির কাছে সকালবেলা কেন আসে নি তা খুব গুছিয়ে বলতে হবে। আগে থেকে সে কিছু ভেবে রাখেনি। মারুফ দেখেছে তার তাৎক্ষণিক গল্প অনেক সুন্দর হয়। সে নিশ্চিত এবারো তাই হবে।
তিথি।
হুঁ।
সরি তোমাকে স্ট্যাণ্ড বাই রেখে দিয়েছি। আসলে ভেজা সিগারেট। ধরাতে পারছিলাম না। কি হয়েছে শোন। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আমার অভিমান কুশলী পিতা বাসায় নেই। তার ব্যাগ নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। তবে আসল জিনিস ফেলে গেছেন।
আসল জিনিস কি?
আসল জিনিস হল তার মানিব্যাগ। মানিব্যাগ বালিশের নিচে রেখে ঘুমিয়েছিলেন। ঐটি ফেলে রেখে চলে গেছেন। আমার মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। দুঘণ্টার জন্যে চুক্তিতে একটা বেবীটেক্সি ঠিক করে বের হলাম পিতার খুঁজে। ইন সার্চ অব ফাদার। ঢাকার যেখানে যত আত্মীয় আছেন সবার বাসায় গেলাম।
তিথি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, উনাকে পাওয়া গেছে?
পাওয়া গেল দুপুর একটা কুড়ি মিনিটে। আমার ঘড়িতে সেকেণ্ডের কাটা নেই। সেকেণ্ডের কাটা থাকলে সেকেণ্ডও বলে দিতাম। উনাকে কোথায় পাওয়া গেছে আন্দাজ করতো?
আন্দাজ করতে পারছি না?
হাসপাতালে। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি হাসপাতালগুলিতে একবার খোঁজ নিলাম। ভাগ্য ভাল প্রথম খোঁজ করলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে–সেখানেই পাওয়া গেল।
বল কি?
আমার রাগী পিতা–রাগে এবং প্রখর রৌদ্র তাপে মাথা ঘুরে রাস্তায় পরে গিয়েছিলেন। সহৃদয় জনগন তাকে হাসপাতালে রেখে গেছে তবে তার হ্যাণ্ডব্যাগটি নিয়ে গেছে।
এখন উনি কেমন আছেন?
ভাল আছেন। কয়েকটা স্যালাইন শরীরে যাবার পর নড়ে চড়ে উঠেছেন। এখন আবদার ধরেছেন কোরান শরীফ পাঠ করবেন। আমাকে লক্ষ্মৌ টাইপের একস্টা কোরান শরীফ জোগাড় করে দিতে হবে।
লক্ষ্মৌ টাইপটা কি?
দু ধরনের টাইপে কোরান শরীফ ছাপা হয়–একটা কোলকাতা টাইপ একটা লক্ষে টাইপ। তিথি তুমি কি একটু ধরবে আমার সিগারেট নিভে গেছে ধরিয়ে নেই। তিথি রিসিভার ধরে আছে। মারুফ সিগারেট ধরাতে ধরতে এতক্ষণ কি বলল তা গুছিয়ে নিল। কোরান শরীফের ব্যাপারটা সে হঠাৎ করে নিয়ে এসেছে। বড় ধরনের মিথ্যা বলার এক পর্যায়ে কোরান শরীফ নিয়ে এলে সুবিধা হয়। যারা মিথ্যাটা শুনছে তারা নিশ্চিত হয় এটা মিথ্যা না। কোন মুসলমান ছেলে সংস্কারের কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক কোরান শরীফ জড়িয়ে মিথ্যা বলে না।
হ্যালো তিথি!
হুঁ।
শুনলেতো আমার ঘটনা?
শুনলাম। আই এম সরি।
তুমি কেন সরি হবে। সরি হলাম আমি। আমার যে কি খারাপ লাগছিল তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না।
আমি বুঝতে পারছি।
না তুমি বুঝতে পারছ না। যাই হোক এখন তোমার খবর বল।
আমার বলার মত কোন খবর নেই। আমি কিছুক্ষণ পর সিলেট রওনা হচ্ছি।
কোথায় রওনা হচ্ছ?
সিলেট?
কেন?
মাকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। বিয়ের ব্যাপারটা মাকে বলতে হবে না? বাবাকে রাজি করিয়েছি। মাকে রাজি করাতে হবে। মজার ব্যাপার কি জান। সিলেট যাচ্ছি আমি একা।
একা মানে?
একা মানে একা। অল বাই মাইসেলফ। বাবা আর আমি আমাদের দুজনের যাবার কথা ছিল। এখন ঠিক হয়েছে বাবা যাবেন না। আমি একা যাব। একটা স্লিপিং বার্থ রিজার্ভ করা আছে।
তিথি!
বল।
আমি কি যেতে পারি তোমার সঙ্গে? প্রথমত একা একা তুমি রাতের ট্রেনে যাবে ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে। দ্বিতীয়ত সারারাত গল্প করতে করতে যাওয়ার আলাদা আনন্দ আছে।
সারারাত গল্প করার আনন্দতো অনেক পাবে।
তা পাব, তবে সেটা হবে বিয়ের পরে। বিয়ের আগে সারারাত গুলি করার আনন্দ অন্য রকম।
তুমি জানলে কি ভাবে?
অনুমান করছি। কল্পনায় বুঝতে পারছি। প্রকৃতি আমাকে কল্পনা করার অসাধারণ ক্ষমতা দিয়েছেন। তোমার ট্রেন কটায়?
রাতে সাড়ে দশটায়।
আমি ঠিক দশটার সময় কমলাপুর রেল স্টেশনে উপস্থিত থাকব।
আরে না না। অসম্ভব।
শোন তিথি, নেপোলীয়ান যখন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আল্পস পর্বতমালার সামনে এসে দাড়ালেন এবং ঠিক করলেন তিনি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে পর্বতমালা অতিক্রম করবেন তখন তার সেনাপতিরা বলল, এটা অসম্ভব। তাঁর উত্তরে তিনি বললেন, অসম্ভব হচ্ছে এমন একটি শব্দ যা শুধু বোকাদের অভিধানেই পাওয়া যায়।
নেপোলীয়ানের পক্ষে যে কথা বলা সম্ভব তা-কি তোমার পক্ষে বলা সম্ভব? তুমিতো নেপোলীয়ান না।
কে বলল আমি নেপোলীয়ান না। আমি অবশ্যই নেপোলীয়ান। আমি ঠিক দশটায় ট্রেনে চেপে বসব। সারারাত গল্প করব। তুমি মনে করে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নেবে।
মারুফ শোন, দয়া করে এই কাজটা করবেন। প্লীজ। প্লীজ।
স্টেশনে দেখা হবে।
মারুফ টেলিফোন নামিয়ে রাখল। আজ তার মনটা খুব ভাল। আজিজ সাহেবের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। নীলা পাথর কেনার টাকা। বিয়েতে কাজে লাগবে। পরে সুন্দর কোন গল্প বলে আজিজ সাহেবকে ঠাণ্ডা করলেই হবে।