০৭. সুপর্ণার সঙ্গে আমার বিশেষ

সুপর্ণার সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের একটা ইতিহাস আছে। আমরা দুজনে একসঙ্গে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হবার কদিন পরই হঠাৎ কি কারণে যেন স্ট্রাইক হল। ভাবছিলাম লাইব্রেরিতে বসে কাজ করব কিন্তু হঠাৎ সুপর্ণা এসে অনুরোধ করল, চলুন সিনেমায় যাই। বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও ওর অনুরোধে মত দিলাম। কিছুক্ষণ এর-ওর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এসপ্ল্যানেড পাড়ায় গিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেও কোনো হলে টিকিট পেলাম না। সুপর্ণার বাড়ি ফেরার মতলব ছিল না; তাই ওকে আমার আস্তানায় নিয়ে গেলাম।

সারা দুপুর-বিকেল আমরা আড্ডা দিলাম। কত কি বললাম আর শুনলাম, তার ঠিক ঠিকানা নেই। ওই এক দুপুরবেলা আড্ডা দিতে দিতে আমরা কখন যে আপনি-তুমি পেরিয়ে তুই-এ পৌঁছেছি তা কেউই জানতে পারলাম না।

বাড়ি ফেরার আগে সুপর্ণা হাসতে হাসতে বলল, যাই বলিস কবিতা, প্রেমে পড়লে তোর এই আস্তানাটা দারুণ কাজে লাগবে।

আমিও হাসতে হাসতে জবাব দিলাম, স্বচ্ছন্দে কাজে লাগাস।

এরপর থেকে সুপর্ণা মাঝে মাঝেই ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমার ওখানে কাটিয়ে যেত। বলতো, কবিতা, একটা সত্যি কথা বলবি?

কেন বলব না?

তোর বিয়ে করতে ইচ্ছে করে?

আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করি, কেন? তোর বুঝি ইচ্ছে করছে?

সুপর্ণা খোলাখুলিই বলে, ঠিক বিয়ে করতে ইচ্ছে না করলেও ঠিক এ রকম একলা একলা থাকতেও ভালো লাগে না।

আমি দুহাত দিয়ে ওর মখখানা আমার দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করি, তুই কি কারুর প্রেমে পড়েছিস?

পড়িনি, তবে পড়লে ভালো হয়।

ইউনিভার্সিটিতে তো কত মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে…

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ও বলল, একমাত্র শ্যামল ছাড়া আর কারুর পাশে বসতেও ইচ্ছে করে না।

শ্যামল সত্যি ভালো ছেলে। যেমন স্মার্ট তেমন…

আবার আমাকে বাধা দিয়ে বলল, সব চাইতে বড় কথা ভারি সুন্দর কথা বলতে পারে।

ওর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বললেও খারাপ লাগে না।

আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ওর আর কি গুণ আছে?

ওর সবচাইতে বড় গুণ ও তোকে ভালোবাসে।

কেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছিস? শ্যামল যে তোকে ভালোবাসে আর ওকে যে তোরও ভালো লাগে এ কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?

.

ভাই রিপোর্টার, এ কথা তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন একটা সময় আসে, যখন সে আর নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না। নিঃসঙ্গ থাকতে চায় না। সে তখন প্রাণের মানুষকে কাছে চায়। এই শত-সহস্র লক্ষ বছরের পুরনো পৃথিবীকেই নতুন করে আবিষ্কার করতে চায়।

এ কথা সর্বজনস্বীকৃত ছেলেদের চাইতে মেয়েরাই অনেক আগে নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। করবেই। তবে কারুর দুদিন আগে কারুর দুদিন পরে।

আমার বেশ মনে পড়ে, আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখনই কয়েকজনকে দেখেছি যারা দেহে ও মনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দুতিনজন তো তখনই সংসার করার জন্য বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এ সব খুব অস্বাভাবিকও নয়। এক বিশেষ সময়েই প্রকৃতির জীবনে বসন্ত আসে কিন্তু মানুষ তো কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার দাস নয়। তার জীবনে কখন বসন্ত আসবে, তা কেউ জানে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Age does not depend upon years, but upon temperament and health সত্যি, বছরের হিসাব করলেই বয়স জানা যায় না; মন ও স্বাস্থ্যের ওপরই বয়স নির্ভর করে।

ছেলেবেলায় শুনতাম বাঙালি মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি হয় কিন্তু এই নিউ ইয়র্কেই এক বাঙালি মহিলা আছেন যাকে দেখে মনে হয় তিনি কোনোদিনই বুড়ি হবেন না। বেশ কবছর আগে কলকাতার একজন বিখ্যাত গায়ক এ দেশে এসেছিলেন। এক অনুষ্ঠানে তার গান শুনতে গিয়েই মিসেস চ্যাটার্জির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই দেখা হয়। ওকে নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলতেন। কেউ বলতেন, ওর স্বামী মারা গিয়েছেন, কেউবা বলতেন, উনি ডির্ভোস করেছেন। আবার এমন কথা বলতেও শুনেছি যে ওর একাধিক বিয়ে। এ সব কথা শুনে আমি হেসেছি। কারণ আমরা যতই প্রগতিবাদী হই না কেন, যতই বিলেত আমেরিকায় থাকি না কেন, একজন মেয়েকে একা থাকতে দেখলেই আমরা সমালোচনা না করে থাকতে পারি না।

সে যাই হক মিসেস চ্যাটার্জির বয়স নিয়ে আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেও কোনো কিছু জানতে পারেনি। কেউ বলেন চল্লিশ, কেউ বলেন পঞ্চাশ। অনেকে আবার বলেন, কিছু না হলেও ওর বয়স ষাট হয়েছে। বয়স যাই হক মিসেস চ্যাটার্জিকে দেখে এখনও অনেক পুরুষের চিত্ত-চাঞ্চল্য হয়। আস্তে আস্তে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হবার পর উনি আমাকে একদিন বলেছিলেন, দ্যাখ কবিতা, যে মেয়েদের একলা একলা জীবন কাটাতে হবে, তাদের যৌবন আর অর্থ সব সময় মজুত রাখতে হবে।

আমি ওর কথা শুনে হাসি।

না, না, কবিতা, হাসির কথা নয়। যৌবন আর অর্থ না থাকলে আমাদের মতো মেয়েদের বেঁচে থাকাই মুশকিল।

মিসেস চ্যাটার্জি শ্যাম্পেনের গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে আবার বললেন, পৃথিবীর সব দেশের সব পুরুষরাই মেয়েদের যৌবনের মর্যাদা দেয়। আর অর্থ?

উনি একটু হাসলেন। অর্থাৎ অর্থের প্রয়োজনের কথা বলাই নিষ্প্রয়োজন।

আমার শ্যাম্পেনের গেলাস তখনও ভর্তি। ওর গেলাস খালি হয়ে গেছে। আমি আবার ওর গেলাস ভরে দিলাম।

মিসেস চ্যাটার্জি হাসতে হাসতে বললেন, হাজার হোক আমরা রামচন্দ্রের অকাল বোধনকেই যেমন সবচাইতে বড় উৎসব বলে মেনে নিয়েছি, সেই রকম জীবন যৌবনের ব্যাপারেও আমরা অকাল বোধন করতে অভ্যস্ত।

তার মানে?

আঠারো কুড়ি বাইশের পর আমাদের দেশের মেয়েরা আর যৌবন ধরে রাখতে পারে না। স্বামীর কাছে সে যৌবন উৎসর্গ করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে।

এবার আমি হাসতে হাসতে বলি, ঠিক বলেছেন।

অনেক দিন মিসেস চ্যাটার্জি সঙ্গে দেখা হয় না কিন্তু আজ তোমাকে সুপর্ণার কথা লিখতে বসে ওর কথাগুলো মনে পড়ছে। সত্যি, সুপর্ণা অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। ও মাঝে মাঝে আমাকে যা বলত তা শুনে মনে হত, ও আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারছে না। একদিন আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোর মতো বিয়ে পাগল মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।

সুপর্ণা একটু ম্লান হেসে বলল, আমার দাদা-বৌদির বেলেল্লাপনা দেখলে তুই আমার চাইতেও বেশি বিয়ে পাগল হয়ে উঠতিস।

তার মানে?

তার মানে আমি তোকে মুখে বলতে পারব না।

ওই কথা বলার পর আমি আর ওকে প্রশ্ন করিনি। এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করার সময় আমরা কেউই ভালো বা খারাপ কিছুই থাকি না। নিজেরা সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা দীক্ষা ও সর্বোপরি পরিবেশ আমাদের ভালো বা মন্দ করে। তোমরা ছেলেরা হয়তো জানতেও পারো না আশেপাশের মানুষের জন্য মেয়েদের জীবনে কি নিদারুণ সমস্যা বা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

যাই হোক, এম. এ. পরীক্ষা দেবার পরই সুপর্ণার বিয়ে হল। আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওর বিয়েতে যেতে পারিনি। বিয়ের পর ওরাও কলকাতার বাইরে চলে গেল। বোধহয় মাসখানেক পরের কথা। হঠাৎ একদিন সুপর্ণা আর অমিয় আমার ওখানে এসে হাজির।

সুপর্ণা হাসতে হাসতে অমিয়কে বলল, যে কবিতার কথা এতদিন শুধু শুনেছ, সে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

অমিয় বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি প্রশ্ন করলাম, কি এত ভাবছেন?

অমিয় একটু হেসে বলল, ভাবছি দু-এক মাস আগে আপনার সঙ্গে আলাপ হলে কি কেলেঙ্কারি হত!

সুপর্ণা প্রশ্ন করল, কি আবার কেলেঙ্কারি হত?

আমার আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে অমিয় নির্বিকার চিত্তে বলল, ওঁর সঙ্গে আগে আলাপ হলে আমি হয় বিয়ে, না হয় আত্মহত্যা করতাম।

আমি লজ্জায় মুখ নীচু করে হাসি। সুপর্ণা হাসতে হাসতে আমাকে বলল, এই লোককে নিয়ে আমি কি করে ঘর করব, বল তো?

এবার আমি বলি, তোর ভয় নেই। আমি তোর ঘর ভাঙব না।

অমিয় বলল, আপনাকে ভাঙতে হবে না; আমিই হয়তো আমাদের ঘর ভেঙে আপনার কাছে আসব।

আমি বললাম, আসলেও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।

কয়েক মাস পরের কথা। ভাইফোঁটার দিন সকালবেলায় সুপর্ণাকে নিয়ে অমিয় এসে হাজির। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার, হঠাৎ এতদিন পর এই সাত সকালে…।

অমিয় বলল, চটপট আমার কপালে একটা ফোঁটা দাও, নয়তো তোমার কাছে আসতে পারছি না।

কেন? সুপর্ণা আসতে দিচ্ছে না?

সুপর্ণা বলল, আমি কেন আসতে দেব না? ও নিজেই ভাইফোঁটা না নিয়ে তোর কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না।

কেন?

সুপর্ণা অমিয়র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বলব, কেন তুমি ওর কাছে আসতে ভয় পেতে?

অমিয় হাসতে হাসতে বলল, নির্বিবাদে।

ও বলে, বাবা, ভাই, সন্তান ছাড়া আর সব পুরুষ তোকে দেখে কামনার আগুনে জ্বলবেই।

এবার আমি লজ্জার হাসি হেসে বললাম, সুপর্ণা, তোর স্বামী এবার আমার কাছে মার খাবে।

যাই হোক সেদিন অমিয়কে ভাইফোঁটা দিলাম। তুমি শুনলে অবাক হবে এর আগে আমি আর কাউকে ভাইফোঁটা দিইনি।

ভাই বোনের সম্পর্ক যে কত মধুর, তা শুধু গল্প উপন্যাসে পড়েছিলাম; কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছিল না! অমিয় আমার সে অসম্পূর্ণতার দৈন্য সত্যি দূর করেছিল। কামনা লালসার আগুনে জর্জরিত না হয়ে যে কোনো পুরুষ সত্যি আমাকে ভালোবাসতে পারে, তার প্রথম অভিজ্ঞতা অমিয়।

সন্ধের পর অফিস থেকে ফিরেই অমিয় আমাকে বলল, তোমার ওপর আমি বেশ রাগ করেছি।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

আমার অনুমতি না নিয়ে বুঝি তুমি এখানে আসতে পারো না?

আমি একটু হেসে বললাম, নিশ্চয় পারি।

তাহলে কালই চলে এলে না কেন?

আমি কোনো জবাব না দিয়ে ওর হাতের ব্রীফকেসটা টেবিলের ওপর রেখে দিলাম।

অমিয় টাই-এর নট ঢিলা করতে করতে একটু মুচকি হেসে বলল, তারপর শুনছি, তুমি হস্টেলে চলে যাবে।

আমাকে দেখেই কি তোমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে? এবার আমি সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর স্বামী কি রকম ঝগড়া করছে, দেখছিস?

সুপর্ণা বলল, তোমাদের ভাই বোনের ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না।

অমিয় কোট খুলে বলল, কবিতা, একটা কথা শুনে রাখ। যতদিন কলকাতায় থাকবে, ততদিন এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না।

আচ্ছা যাব না। এবার তোমার শান্তি তো!

যেতে চাইলেও যেতে দিচ্ছে কে?

ভাই রিপোর্টার, অমিয় আমার জন্য কি করেছে তা বললে, অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তবু তোমাকে বলব।

তোমার আগামী জীবনের সঙ্গিনীকে বল, অনেক দিন তার চিঠি পাইনি। তুমিও চিঠি দিও। প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *