সুদাস (স্থান: কুরু-পঞ্চাল (উত্তর প্রদেশের পশ্চিম) ।। কাল: ১৫০০০ খৃষ্টপূর্ব)
বসন্তকাল শেষ হয়ে আসছিল। চন্দ্ৰভাগা নদীর তীরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পাকা সোনালী গমের শীষগুলি হাওয়ায় দোল খাচ্ছিল, আর এদিক সেদিক থেকে স্ত্রী-পুরুষ গান গাইতে গাইতে ক্ষেতের ফসল কাটছিল। কাটা ক্ষেতের যে সব জমিতে নতুন ঘাসের উদগম হয়েছে সেখানে বাচ্চাসমেত ঘোড়াগুলিকে চরবার জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে একজন ক্লান্ত পথিককে আসতে দেখা গেল তার পরনে মলিন ছিন্ন বসন, মাথায় একটি পুরনো চাদর। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে ছিন্ন উষ্ণীষে ঢাকা সোনালী চুলের জট দেখা যাচ্ছিল—পুরনো চাদরে শরীর আবৃত, কোমরে জড়ানো ছিলো অন্তর্বাস—হাঁটু পর্যন্ত একখণ্ড কাপড়।
হাতের লাঠির ওপর ভর করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিল, পিপাসায় গলার তালু পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে। তবু পরবতী গ্রামে পৌছাবেই এই পণ নিয়ে সে এগিয়ে চলছিল, কিন্তু পথের ধারে একটি কুয়া ও ছোট শমীবৃক্ষ দেখে তার পূর্ব প্রতিজ্ঞ ভেঙে গেল। প্রথমে সে উষ্ণীব বস্ত্র খুলল পরে উলঙ্গ হয়ে পরণের ধুতি খুলে একত্রে বেঁধে কৃয়ার মধ্যে একটি প্রান্ত ফেলে দিল, কিন্তু জলের নাগাল পেল না। একান্ত নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত গাছের। ছায়ায় গিয়ে বসল। তার মনে হতে লাগল আর কোনোদিন সে উঠতে পারবে না। ঠিক। সেই সময়ই এক কাঁধে একটি মশক, অন্য কাঁধে দড়ি আর হাতে চামড়ার কলসী নিয়ে হাজির হল একটি কুমারী মেয়ে। তরুণীটি কুয়ার কাছে এসে কলসীটা যখন জলে ডেবাতে যাচ্ছে, তার চোখ পড়ল পথিকের দিকে। পথিকের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে, ঠোঁট দুটো গেছে, চোয়াল গেছে চুপসে–কিন্তু তা সত্ত্বেও তারুণ্যের দীপ্তি তার মুখমণ্ডলে স্পষ্ট ফুটে বেরুচ্ছিল।
মাথাভরা সোনালী চুলে শিরস্ত্ৰাণ, পরণে কঁচুলি ও অন্তর্বাস আর শরীরের উপরাং উত্তরীয় দিয়ে ঘেরা– সাধারণ হলেও শালীনতা সম্পন্ন বেশভূষার সজ্জিত কুমারীকে পথিক দেখল। রৌদ্রে পথ চলার ফলে তরুণীটির মুখ রক্তিমাও, আর তাঁর কপাল ও ঠোঁটের ওপর দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল। তরুণীটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপরিচিত পুরুষটির দিকে তাকিয়ে। দেখল, তারপর মাদ্রদেশের মেয়েদের সহজাত মৃদু হাসিতে মুখখানিকে উদ্ভাসিত করে যুবকের অর্ধেক তৃষ্ণা মিটিয়ে মধুস্বরে প্রশ্ন করল, ‘ভাই আমার মনে হচ্ছে তুমি খুবই তৃষ্ণার্তা।’
পথিক ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ আমি খুবই তৃষ্ণাৰ্তা।’
‘বেশ, আমি তোমায় জল এনে দিচ্ছি।’
তরুণীর জলপাত্র ভর্তি হল। ততক্ষণে পথিকও আস্তে আস্তে উঠে তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার দীর্ঘ দেহ ও মোটা হাড়ের চেহারা লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, তার শরীরে অসাধারণ পৌরুষ বিদ্যমান। মাশকের সঙ্গে চামড়ার গেলাসটি ভরে তরুণী পথিকের হাতে দিল। পথিক এক চুমুক জল কোনো রকমে ঢোকা গিলে খেয়ে মাথা নিচু করে একটু বসে। রইল। তারপর এক নিশ্বাসে গেলাসের সমস্ত জলটাই শেষ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে গেলাসটা ছিটকে গড়িয়ে পড়ল আর নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করেও পেছনে ঢলে পড়ল। তরুণী কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর তরুণের চোখের দিকে চেয়ে বুঝল, সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। বুঝতে পেরেই সে চট করে নিজের মাথায় বাঁধা শিরস্ত্রাণের কাপড়টি জলে ভিজিয়ে চক্ষু ও কাঁপাল মুছে দিতে লাগল। এইভাবে কিছুক্ষণ। কাটার পর যুবকটি চোখ খুলল। তরুণীটিকে সেবা করতে দেখে লজ্জা ও কুষ্ঠার সঙ্গে বলল, ‘তোমাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত।’ ‘আমার কোনো কষ্ট হয় নি, আমি ভয় পেয়েছিলাম। এই রকম কেন হল ভেবে?’
‘বিশেষ কিছু নয়, পেটটা একেবারে খালি তার ওপর অত্যধিক তৃষ্ণায় বেশি জল খেয়েছিলাম–তাই। কিন্তু এখন আর কোনো কষ্ট নেই।’
‘তোমার পেট একেবারে খালি?’ এই কথাগুলি বলে পথিককে জবাব দেবার কোনো অবসর না দিয়ে তরুণী এক দৌড়ে এক পত্র দই, ছাতু ও মধুনিয়ে উপস্থিত হল। তরুণের চেহারায় সঙ্কোচ ও লজ্জার ভাব দেখে কুমারী বলল, ‘পথিক, কোনো সঙ্কোচ কর না। কয়েক বছর হল, আমার ভাই ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে, তোমার চেহারার সঙ্গে তার অনেকটা মিল আছে তাই তোমাকে সাহায্য করার সুযোগ পেয়ে আমার সেই হারানো ভাইএর কথাই মনে পড়ছে।’ [* প্ৰায় দেড়শত পুরুষ আগেকার কাহিনী।]
পথিক পত্র নিয়ে নিল। তরুণী বালতি থেকে জল দিল। যুবকটি সেই জলে ছাতুগুলে পান করল। খাওয়া-দাওয়ার পর তার চেহারা থেকে পথশ্রমের চিহ্ন প্রায় অর্ধেকটা মুছে। যেতে তার মুখে ফুটে উঠল একটা কৃতজ্ঞতার ভাব। কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়–সে ভাবছিল।
তরুণী তার মনের ভাব আঁচ করেই বলল, ‘সঙ্কোচ করার কোনো দরকার নেই। বোধহয় তুমি অনেক দূর থেকে আসছি, তাই না?’
‘ হ্যাঁ, অনেক দূর, পূর্বদিক–পঞ্চাল থেকে।’
‘কোথায় যাবে?’
‘এখানে ওখানে–যেখানে হোক।’
‘তবু?’
‘এখন তো আমি কাজ খুঁজছি, যাতে খাওয়া-পরার ব্যবস্থাটা হতে পারে।’
‘কোন করব না? চাষের সব কাজই পারি। মাড়াই করতেও জানি। গরু, ঘোড়ার রাখালিতাও পারি। আমার শরীরে শক্তিও যথেষ্ট, এখন একটু কাহিল হয়ে পড়েছি বটে কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে আবার কঠিন পরিশ্রমের উপর্যুক্ত স্বাস্থ্য আমি ফিরে পাব। এটা বলতে পারি যে, আমার কাজে কোনোদিনই কোনো মালিক অখুশী হয়নি।’
‘তা’হলে আমার মনে হচ্ছে আমার বাবা তোমাকে কাজ দেবে। জলের পাত্র ভরে নিই, তুমি আমার সঙ্গে চল।’
তরুণটি মশক বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে চেষ্টা করল, কিন্তু তরুণী কিছুতেই রাজী হল না। ক্ষেতের ওপর একটি লাল তাঁবু আর বাইরে বসেছিল প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন স্ত্রী-পুরুষ। এদের মধ্যে তরুণীর পিতা কে, পথিক সেটা আন্দাজ করতে পারল না। সকলেরই সাদা কাপড়, হরিতাভ কেশ, গৌরবর্ণ গায়ের রঙ ও প্রাণবস্তু মুখ। তরুণী জল-ভরা মশক ও বালতিটি রাখল, তারপর ষাট বছরের বৃদ্ধ কিন্তু বলিষ্ঠ দেহ পুরুষের কাছে গিয়ে বলল, ‘পিতা, এই পরদেশী তরুণ কাজ চাইছে।’
‘হে কন্যা! ক্ষেতের কাজ করতে চায় কি?’
‘ হ্যাঁ, যেখানে হোক।’
‘তাহলে এখানেই কাজ করুক। অন্যরা যা মজুরী পায় সেও তাই পাবে।’
তরুণ কথাবার্তা সবই শুনছিল। বৃদ্ধ তাকে ডেকে নিয়ে কথাগুলি আবার বলল, সে রাজী হল। বৃদ্ধ পুনরায় তাকে বলল, ‘এস আগন্তুক, আমরা এখন মধ্যাহ্ন ভোজন করছি—তুমিও যোগ দাও।’
‘হে আৰ্য! আমি এখনি খেয়েছি, তোমার মেয়ে আমাকে দিয়েছে।’
‘আৰ্য-টার্জ নই, আমার নাম জেতা, ঋজু-পুত্র মাদ্র। এস তুমি যা পার খাও ও পান। কর। অপালা, মেরীয় (ঘোটকীর দুধে তৈয়ারী কাঁচা মদ) দাও তো। রৌদ্র-তাপে দগ্ধ হলে শরীরে বল এনে দেবে। হে তরুণ! এখন আর কোনো কথা নয়। সন্ধ্যায় আমরা আলাপআলোচনা করব। তোমার নামটা বলা।’
‘সুদাস পঞ্চাল।’
‘সুদাস নয়, সুন্দা–সুন্দর দান দেয় যে! তোমরা পূর্ব-দেশের লোকেরা ঠিকমতো শব্দের উচ্চারণ করতে পার না। তোমার দেশ পঞ্চাল জনপদে? ভালো কথা। অপালা, এই পূর্ব-দেশের লোকেরা একটু বেশি লাজুক হয়। একে ভালো করে খাওয়াও, যাতে সন্ধ্যার মধ্যে কিছু কাজ করার উপর্যুক্ত হয়ে উঠতে পারে।’
অপালার উপরোধ সুদাস দু’তিন পাত্র মেরায় আর রুটি গলাধঃকরণ করল। গত দুদিন তার পেটে কিছু পড়েনি। তাই ক্ষুধাবোধও কমে গেছে। সূর্যের তেজ যতই কমতে লাগল সুদাসের শরীরেও তত বল ফিরে আসতে লাগল আর সন্ধ্যার কাজ শেষ হবার আগে দেখা গেল, ক্ষেতে গম কাটার ব্যাপারে সে কারুর পেছনে পড়ে রইল না।
জেতার ক্ষেত যে খুবই বড় ছিল তা মাড়াই করার জন্য উপস্থিত দুই শতের বেশি। লোক দেখে বোঝা যায়। ক্ষেতের এক প্রান্তে রন্ধন কাজে ব্যাপৃত লোকেরা ব্যস্ত। একটা পুষ্ট ষাঁড় আজ কাটা হয়েছে তার কিছু হাড়, নাড়িতুড়ি আর কিছুটা মাংস টুকরো করে বড় ডেকচিতে সন্ধ্যা হবার ঘণ্টা দিনেক আগেই চাপানো হয়েছিল। বাকিটা নুনের সঙ্গে জলে ফুটিয়ে রাখা হচ্ছে। ঘরগুলোর পাশেই বড় সমতলভূমি–মাড়াই এর কাজ হয়। জলের জন্য কাঁচা পাতকুয়া আর জলভর্তি কুণ্ড ছিল। স্ত্রী-পুরুষেরা এখানে হাত মুখ ধুচ্ছিল–কেউ কেউ অবগাহন করে নিল। রাত্রের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জলের ধারে সারি দিয়ে বসা স্ত্রী পুরুষের সামনে রুটি, মাংসখণ্ড ও পাত্রভর্তি মদ দেওয়া হল। সুদাসের লাজুকতার কথা মনে রেখে অপালা তাকে তার পাশেই বসিয়েছিল, সুদাসকে দেখে তার নিরুদ্দিষ্ট ভাই-এর কথাই মনে পড়ছিল। খাওয়ার পর নাচ-গান শুরু হল। আজকের রাতের নৃত্য আসরে সুদাস যোগ দেয়নি বটে, কিন্তু পরবর্তীকালে এই নৃত্যসভায় সে সর্বপ্রয় গায়ক ও নর্তক হয়েছিল।
মাস দেড়েক ফসল কাটা, মাড়াই ও বাঁধার কাজ চলতে লাগল। সপ্তাহ দুই যেতে না যেতে সুদাসকে যেন আর চেনাই যায় না–একেবারে নতুন মানুষ। তার গালে স্বাভাবিক রক্তাভা দেখা দিল। হাড় আর শিরাগুলো মাংস ও চামড়ার মধ্যে ঢাকা, পড়ে গেছে। প্রথম সপ্তাহের শেষে জেতা তাকে এক প্রস্থ কাপড় উপহার দিয়েছে।
ফসল মাড়াই-এর কাজ প্রায় শেষ হয়ে এল। পিতা-পুত্রী ও সুদাস সমেত মোট জনা ছয়েক তখনও কাজ করছিল–বাকি সকলে ফসলের ভাগ নিয়ে চলে গেছে। এইসব লোকদের জমির পরিমাণ খুবই কম, তাই তারা নিজেদের ফসল কাটার পর জেতার জমিতে এসে কাজ করত।
একদিন সন্ধ্যার পর জেতা সুদাসের সামনে পূর্ব-দেশ সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করল। অপালা পাশে বসে শুনতে লাগল। জেতা বলল, ‘সুন্দা’ পূর্ব-দেশে আমি খুব বেশীদূর পর্যন্ত যাইনি বটে, কিন্তু পঞ্চালপুরে (অহিচ্ছত্ৰে) আমি গেছি। সেখানে শীতকালে আমি ঘোড়া বিক্রী করতে যেতাম।
‘পঞ্চাল (রোহিলখণ্ড) তোমার কেমন লাগল, হে আর্যবৃদ্ধ!’
’জনপদ হিসাবে মন্দ নয়, আমাদের এই মাদ্র দেশের মতোই সুরক্ষিত ও সম্পন্ন বরং ক্ষেতের উর্বরতার দিক থেকে এখানকার চেয়ে বেশি সুফলা, কিন্তু…’
‘কিন্তু কি?’
‘ক্ষমা কর সুন্দা–ওখানে মানুষ থাকে না।’
‘মানুষ থাকে না! তাহলে থাকে কারা–দেবতা না দানব?’
‘আমি এইটুকুই শুধু বলব যে, ওখানে মানুষ থাকে না।’
‘আর্যবৃদ্ধ! আমি রাগ করব না, আমায় বল, কেন তোমার এই ধারণা?’
‘তুমি এখানে দু’শো নর-নারীকে আমার ক্ষেতে কাজ করতে দেখেছ?’
‘হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’
‘তারা আমার জমিতে কাজ করে। জমিতে কাজ করে বেতন পায় কিন্তু কখনও কি দেখেছি মাথা নিচু করে তাদের হীনতা প্ৰকাশ করতে?’
‘না, বরং মনে হয় সকলেই যেন তোমার পরিবারের মানুষ।’
‘হ্যাঁ, একেই মানুষ বলে। তারা আমার পরিবারেরই লোক। সকলেই মান্দ্রের নরনারী। পূর্ব-দেশেও এই রকম দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে দাস ও স্বামী সম্পর্ক, মানুষ নেই, বন্ধু পাওয়া যায় না।’
‘আর্যবৃদ্ধ! তুমি সত্য বলেছ। মানবতার মূল্য শতদ্রু পেরিয়ে এই মাদ্রভূমিতে এসে দেখছি। মানুষের মধ্যে বাস করতে পাওয়াটা আনন্দ ও সৌভাগ্যের কথা।’
‘পুত্ৰ, তোমার কথায় আমি খুশি হয়েছি। তুমি আমার কথায় রাগ করনি। আপন আপন জন্মভূমিকে সকলেই ভালোবাসে, তা হল দেশপ্ৰেম।’
‘কিন্তু প্রেম মানে দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে চোখ বুঁজে থাকা নয়!’
‘আমি কুরু-পঞ্চাল দেশে যাবার সময় বহুবার এ কথা ভেবেছি, এ দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনাও করেছি। এইসব দোষ কি করে এল। তার কারণ, বুঝতে পেরেছি, কিন্তু। প্ৰতিকার কি করে হবে জানি না।’
‘কারণগুলো কি আর্যবৃদ্ধ?’
‘যদিও পঞ্চালদের বাসস্থানকে পঞ্চাল জনপদ বলা উচিত, কিন্তু পঞ্চলের অর্ধেক অধিবাসীও পঞ্চাল-জনের নয়।’
‘ হ্যাঁ, বাইরে থেকে আসা আগন্তুকও অনেক আছে।’
‘আগন্তুক নয় পুত্র! আদি-নিবাসী অনেক আছে। ওখানকার শিল্পী, কারিগর, ব্যবসায়ী,ওখানকার দাস, সকলেই পঞ্চাল-জনের লোকেরা ওখানে পৌঁছবার অনেক আগে থেকেই বাস করত। তাদের গায়ের রঙ দেখেছ?’
‘হ্যাঁ, পঞ্চাল-জন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কালো অথবা তাম্রবর্ণ।’
অপালা প্রশ্ন করল, ‘পঞ্চাল-জনের গায়ের রঙ কি মাদ্রদের মতোই গৌরবর্ণ।’
সুদাস উত্তর দিল, ‘কম বেশি হবে।’
জেতা বলল, ‘হ্যাঁ কম বা বেশি। কেননা অন্যের সঙ্গে রক্ত সংমিশ্রণের ফলে এই পরিবর্তন ঘটেছে। আমার ধারণা, যদি মাদ্রদের মতোই ওখানে শুধু পিঙ্গল কেশ আর্যরা বাস. করত তাহলে হয়ত শুধু মানুষ দেখা যেত। আর্য ও আর্য-ভিন্ন দুই উঁচু-নীচু ধারণা থেকেই ভিন্ন বর্ণের সৃষ্টি হতে পারে।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। তুমি বোধহয় জান, এই আর্য-ভিন্নদের অর্থাৎ যাদের আগে অসুর বলা হত তাদের মধ্যে উঁচু-নীচু ও প্রভুর সম্বন্ধ বিদ্যমান ছিল।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু পঞ্চালেরা সকলেই তো আর্য-জনের এক রক্ত এক শরীর থেকে জন্মলাভ করেছে। কি করে তাদের মধ্যে উঁচু-নীচু ভেদাভেদ এসে অনুপ্রবেশ করল! পঞ্চলের রাজা দিবোদাস একবার আমার কাছ থেকে ঘোড়া কিনেছিল, আমাকে তার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সুগঠিত দেহ গৌরবর্ণের যুবক, কিন্তু মাথায় এক ভারী মুকুট, তাতে লাল হলদে। রঙ। কানে বড় বড় কুণ্ডল। তার আঙ্গুলো ও গলায় নানা অলঙ্কার। তাকে দেখে আমার মন, করুণায় ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পূৰ্ণচন্দ্রকে যেন রাহু গ্ৰাস করেছে। তার সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিল, তাকে যে-কোনো মাদ্র সুন্দরীর মতোই দেখাচ্ছিল। কিন্তু লাল-হলদে অলঙ্কারে বেচারী নুয়ে পড়েছিল।’
সুদাসের বুক দুরদুর করে উঠল। তার মনের চাঞ্চল্য যাতে মুখে ফুটে না ওঠে তারই চেষ্টা সে প্রাণপণে করতে লাগল, কিন্তু তাতে সফল না হয়ে কথাটা ঘুরিয়ে দেবার জন্যে বলল, ‘আর্যবৃদ্ধ! পঞ্চালরাজ কি তোমার ঘোড়াগুলো কিনল?’
‘হ্যাঁ, কিনল। তো বটেই, ভালো দামও দিল। কত দিয়েছে এখন আর মনে নেই। কিন্তু দেখতে দেখতে আমার জ্বর আসছিল, পঞ্চাল-জনের রাজার সম্মানে নতজানু হয়ে যেভাবে বন্দনা করছিল তা দেখে কার না গা ঘেন্নায় শিউরে ওঠে। যদি মাথাও কেটে নেওয়া হয় তবু। কোনো মাদ্র ওইভাবে মাথা নোয়াতে পারবে না।’
‘তোমাকে তো আর ওই রকম করতে হয়নি, আর্যবৃদ্ধ?’
‘আমাকে বললে ওইখানেই খুনোখুনী হয়ে যেত। পূর্ব-দেশের রাজারা কোনো ওই ধরনের হুকুম করতে সাহস পায় না। তবে ওখানে, ওটা তাদের সনাতন রীতি।’
‘কোন বলুন তো?’
‘কেন, জানতে চাও? সে এক বিরাট কাহিনী। যখন পশ্চিম থেকে এগোতে এগোতে পঞ্চাল-জনের লোকেরা যমুনা, গঙ্গা ও হিমালয়ের মধ্যবতী দেশে বসতি স্থাপন করল তখন তারা মাদ্র-জনের মতো একটি পরিবারের মতো থাকত। তারপর অসুরদের সঙ্গে ওদের মেলামেশা বাড়তে লাগল আর তাদের অনুকরণে পঞ্চাল-জনের লোকেদের মধ্যে অনেক সর্দার, রাজা বা পুরোহিত হবার জন্য লালায়িত হতে লাগল।’
‘কিন্তু লালায়িত হল কেন?’
‘লোভের জন্য, নিজে মেহনত না করে অন্যের পরিশ্রমের ফল ভোগ করার জন্যে। এই রাজা ও পুরোহিতরাই পঞ্চালদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে–এরাই আর তাদের মানুষ থাকতে দেয়নি’–কথা বলতে বলতে জেতা নিজের কাজে চলে গেল।
২.
মাদ্রপুরে (শিয়ালকোট) জেতার পরিবারের মধ্যে সুদাস চার বছর কাটিয়ে দিল। জেতার স্ত্রী ইতিপূর্বেই মারা গেছে। বিবাহিতা ভগ্নী ও কন্যাদের মধ্যে দু’একজন মাঝেমধ্যে এসে থাকত। কিন্তু গৃহের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল জেতা, সুদাস আর অপালা। অপালার বয়স এখন বছর কুড়ি। উভয়ের ব্যবহারে বেশ বোঝা যেত যে, অপালা ও র মধ্যে পারস্পরিক প্রেম বিদ্যমান। মাদ্রপুরের সুন্দরীদের মধ্যে অপালার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল আর সেখানে সুন্দর তরুণের অভাব ছিল না। যারা তার প্রেম প্রার্থনা করত। আবার সুদাসের মতো। সুপুরুষ যুবকের জন্যে সুন্দরী তরুণীরও অভাব ঘটত না। কিন্তু এখানকার লোকেরা সর্বদাই দেখেছে। সুদাসকে অপালার সঙ্গে আর অপােলাকে সুদাসের সঙ্গে নাচতে। জেতাও এ কথা জানত, এর পরিণামের কথা ভেবে সে খুশীও হত যদি সুদাস স্থায়ীভাবে তাদের মধ্যে বসবাস করতে রাজী হয়। কিন্তু সুদাস মাঝে মাঝে তার বাবা মা সম্বন্ধে উৎকণ্ঠিত হয়ে। পড়ে তাতেই জেতার ভাবনা, কারণ সে জানত, সুদাস মা-বাপের একমাত্র সন্তান।
চন্দ্ৰভাগা নদীর অপর নাম ছিল প্রেমিক-প্রেমিকদের নদী। একদিন অপালা ও সুদাস সেখানে স্নান করতে গেছে। এর আগেও অনেকবারই স্নানের সময়ে সুদাস অপালার নগ্ন। শারীরিক সৌন্দর্য দেখেছে, কিন্তু প্রায় পঞ্চাশটি নিরাভরণ দেহের সুন্দরীর নগ্ন সৌন্দর্যের। পাশে অপলার সৌন্দর্য দেখে মনে হল যে, আজই যেন প্রথম সে তার সঙ্গিনীর অপরূপ : লাবণ্যময়ী রূপ-মাধুরীর পূর্ণ পরিচয় পেল। ফিরবার পথে সুদাসকে মৌন দেখে অপালা প্রশ্ন করল, ‘সুদাস! আজ যে তুমি কথা বলছি না, খুব পরিশ্রান্ত না-কি? চন্দ্রভাগার খরস্রোতে দু’বার সাঁতরে পাড়ি দিলে পরিশ্রম তো হবেই।’
‘পরিশ্রম তো তোমারও হয়েছে অপােলা! তুমিও একবার পাড়ি দিয়েছ, আর আমি মাত্র দু’বার; সময় পেলে দশবার এপার-ওপার করতে পারতাম।’
‘জল থেকে উঠবার সময় আমি দেখছিলাম তোমার বুকের ছাতিটা চওড়া হয়েছে; তোমার হাত পায়ের পেশীগুলিও যেন দ্বিগুণ স্ফীত।’
‘সীতার কাটা খুবই ভালো এতে শরীর বলিষ্ঠ ও সুন্দর হয়। কিন্তু অপালা তোমার, সৌন্দর্যের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তুমি ত্ৰিভুবনের মধ্যে অনুপম সুন্দরী।’
‘নিজের চোখ দিয়েই দেখে বলছি তো সুদাস?’
‘হ্যাঁ! মোহের বশবতীর্ণ হয়ে বলছি না। অপালা!’
‘বেশ! কিন্তু তুমি কোনোদিন আমার চুম্বন প্রার্থনা করনি, অথচ তুমি জান, মাদ্র তরুণীরা এ জিনিস খুবই উদারভাবে বিতরণ করে থাকে।’
‘সে তো তোমাকে দেখে আমি আমার ভাই শ্বেতপ্রবাহকেই দেখতে পাই।’
‘তাহলে এখন আর চুমু দেবে না?’
‘চাইলে কেন দেব না?’
‘আর চাইলে তুমি আমার হবে?’
‘ও কথা বলো না। সুদাস! অস্বীকার করলে আমিই দুঃখ পাব।’
‘কিন্তু এ দুঃখ আসতে না দেওয়া তোমারই হাতে।’
‘আমার নয়, তোমারই হাতো।’
‘কি ভাবে?’
‘তুমি কি সারা জীবনের জন্যে আমার পিতার এই ঘরে থাকতে প্রস্তুত?’
সুদাস বহুদিন থেকেই এই মুহূর্তটির আশঙ্কা করছিল, যখন মধুভরা ওই মুখ থেকে এই কঠিন প্রশ্নটি শুনতে হবে। বিদ্যুতের মতো কথাটা মৰ্মস্থলে আঘাত করল এক মুহূর্তের জন্য মুখটা স্নান হয়ে উঠেছিল। দ্বিধা ও সঙ্কোচে। কিন্তু তার মনোভাব অপালাকে বুঝাতে না দিয়ে সে শান্তভাবে বলল, ‘আপালে, তোমায় আমি ভালোবাসি।’
‘তা আমি জানি, আর তুমিও আমার মনের কথা জােন। আমি চিরকালের জন্যই তোমার হয়ে থাকতে চাই, তাতে আমার বাবাও খুশী হবে। কিন্তু তার জন্যে তোমায় পঞ্চাল থেকে চিরবিদায় নিতে হবে!’পঞ্চাল চিরকালের জন্যে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন নয়; কিন্তু সেখানে রয়েছে আমার বৃদ্ধ মাতা-পিতা। আমি ছাড়া মায়ের আর কোনো সন্তান নেই। মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, মৃত্যুর আগে তার সঙ্গে দেখা আমি করবই।’
‘মাকে যে কথা দিয়েছ তার খেলাপ করাতে আমি চাই না, সুদাস! তোমার প্রতি আমার যে প্রেম তা চিরকালই থাকবে; এমন কি তুমি যদি আমায় ফেলে চলে যাও,.. তা’হলেও আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য–জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব।–কিন্তু আমাদের নিজেদের কাছে করা প্রতিজ্ঞা আমরা দু’জনেই ভাঙতে পারি না।’
‘তোমার মনের কথা বল, অপালে!’
‘মানবভূমি ছেড়ে অ-মানবভূমিতে কখনো যাব না।’
‘অ-মানবভূমি, পঞ্চাল জনপদ?’
‘হ্যাঁ, যে দেশে নারীর স্বাধীনতা নেই–সে দেশে মনুষ্যত্বের মূল্য নেই।’
‘তোমার সঙ্গে আমি একমত।’
‘আর এই জন্যেই তোমাকে এই চুম্বন দিচ্ছি।’ এই বলে অপালা তা অশ্রুসিক্ত গালটি। সুদাসের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল। সুদাসের চুম্বন শেষ হলে অপালা তার ঠোঁট দিয়ে সুদাসের ঠোঁটে দীর্ঘ চুমু খেল। তারপর বলল, ‘তুমি যাও, একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে এস; তোমার জন্যে আমি এই মাদ্রপুরে অপেক্ষায় থাকব।’
অপালার এই অকৃত্রিম কথাগুলি শুনে সুদাসের নিজের ওপর অসীম ঘৃণা জন্মল, যা কোনোদিনই সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মা বোপকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি চাইল, পিতা-পুত্রী উভয়েই সম্মতি দিল।
প্রস্থানের আগের দিনটা অপালা বেশি বেশি করে সুদাসের আশেপাশে অনুক্ষণ ঘুরতে। থাকল। তাদের দু’জনেরই পদ্ম পাপড়ির মতো নীল চোখ দুটো জলে ভেসে যাচ্ছিল, আর ওরা তা গোপন করছিল না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তারা চুম্বনে, নিভৃতে নীরব হয়ে চোখে চোখ রেখে বসে রইল, আবার কখনও দৃঢ় আলিঙ্গনে পরস্পরকে আবদ্ধ করল।
যাবার মুহূর্তে অপালা শেষবারের মতো তার কণ্ঠালগ্ন হয়ে বলল, ‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব, সুদাস!’
৩.
সুদাস তার মাকে ভালোবাসত গভীরভাবে। পিতা দিবোদাস ছিলেন একজন প্রভাবশালী রাজা—যাঁর গুণগানে বিশ্বমিত্র ও ভরদ্বাজ শ্লোক লিখেছেন। এই শ্লোকগুলি লিপিবদ্ধ আছে ঋগ্বেদে, (ঋগ্বেদ, ৬/২৬/২, ২৫) এগুলো সংগৃহীত হওয়াও ঋগ্বেদে স্থান পাওয়ায় নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, ঋষিদের চাটুকারের অভাব ছিল না।
সুদাসের ভালোবাসা ছিল তার মায়ের জন্য। সে ভালোভাবেই জানত, তার মায়ের মতো দিবোদাসের আরো স্ত্রী আছে, আছে অসংখ্য দাসী। পঞ্চলের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী-রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রের মা-হিসাবে বিশেষ সম্মান পেলেও বৃদ্ধ দন্তহীনার জন্যে। রাজার অন্তরে কোনো প্রেম ছিল না; দিবোদাসের অন্তঃপুরে রাত্রিবাসের জন্য নিত্য নব তরুণীর আনাগোনা ছিল। সুদাস মায়ের একমাত্র পুত্র হলেও তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র ছিল। না। তার অনুপস্থিতিতে বৈমাত্ৰেয় ছোট ভাই প্ৰতর্দন দিবোদাসের উত্তরাধিকারী হত।
বছরের পর বছর কেটে যাবার পর সুদাসকে না দেখে মা তাকে দেখবার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। আর অনবরত চোখের জল ফেলতে ফেলতে চোখের দৃষ্টি হয়েছিল ক্ষীণ সুদাস একদিন কাউকে খবর না দিয়ে, বাবার সঙ্গে দেখা না করে মায়ের সামনে এসে হাজির হল। মাকে নিষ্প্রভ চোখ দুটো মেলে সুদাসের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সুদাস বলল, ‘মা! আমি তোমার সুদাস।’
শুনে মায়ের চোখ দুটো দীপ্ত হয়ে উঠল। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে একটুও না নড়ে বলল, ‘তুই সত্যিই যদি আমার সুদাস, তবে আমার দৃষ্টির বাইরে দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরছিস্ না কেন? তোর দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরছিস্ না কেন? আমার কোলে মাথা রাখছিস না কেন?’
সুদাস মায়ের কোলে মাথা রাখল। মা হাত বুলিয়ে দেখল। নিজের চোখের জলে সুদাসের গাল, কপাল, চুল ভিজিয়ে দিয়ে বার বার চুমু খেতে লাগল। মায়ের চোখের জল বন্ধ করতে না পেরে সুদাস বলল, ‘মা! আমি তো এখন তোমার কাছে এসে গেছি, তবু কাঁদছ কেন তুমি?’
‘আজকের দিনটা, শুধু আজকের দিনটা আমায় কাঁদতে দাও। আজ আমি একটু কেঁদে নি। এই আমার শেষ কান্না সুদাস, আমার চোখের মণি!’
খবর গিয়ে পৌঁছাল অন্তঃপুর থেকে রাজার কানে। রাজা, এল দৌড়ে, সুদাসকে আলিঙ্গন করল, আনন্দীশ্রী বইতে লাগল তারও চোখে।
দিন কাটতে লাগল, দিন থেকে মাস গেল। বছর গেল–দুটো বছর শেষ হল। মাবাপের সামনে সুদাস মুখের প্রসন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করত, কিন্তু নির্জনে তার কানে সেই বজ্রচ্ছেদিকা ধ্বনি বেজে উঠত : ‘আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।’ আর–তার চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই কম্প্রমান রক্তাভ ওষ্ঠদ্বয়–চোখের দৃষ্টি যতক্ষণ না ঝাপসা হয়ে উঠত, সে যেন অপালাকে দেখতে পেত! মনের দোটানায় ছিঁড়ে পড়ত। একদিকে অপালার অকৃত্রিম প্রেম অপরদিকে বৃদ্ধ মায়ের বাৎসল্য-ভরা হৃদয়। মায়ের হৃদয় বিদীর্ণ করে চলে যাওয়া নিজের কাছে আত্মসর্বস্ব নিচ কাজ বলে মনে হত। তাই সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল, মা বেঁচে থাকা পর্যন্ত পঞ্চাল ছেড়ে যাবে না। কিন্তু রাজ-পুত্রের মতো বিলাসিতার জীবন সে মেনে নিতে পারছিল না। সে বুঝেছিল এটা তার সামর্থ্যের বাইরে। অইতার প্রতি তার সশ্রদ্ধ ব্যবহার বজায় রেখে তার আদেশ পালনের চেষ্টা করত।
একদিন বৃদ্ধ রাজা পুত্রকে ডেকে বললেন, ‘বৎস সুদাস! আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। আর আমার পক্ষে পঞ্চলের শাসনভার বহন করা সম্ভব নয়।’
‘তাহলে আর্য এই ভার পঞ্চালদের ওপর দিচ্ছ না কেন?’
‘পঞ্চালদের? তোমার অভিপ্ৰায় আমি বুঝতে পারলাম না।’
‘আৰ্য, এ রাজ্য আসলে পঞ্চালদেরই। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা পঞ্চাল-জনের সাধারণ লোক ছিল। তখন পঞ্চলের কোনো রাজা ছিল না। পঞ্চাল-জনের সাধারণ লোকেরাই শাসন চালাত। যেমন আজও মল্ল, মাদ্র অথবা গান্ধার-জনের লোকেরা চালায়। তারপর প্রপিতামহ বধ্যশ্ব; আত্মসুখের লোভ, ভোগের লোভ, অপরের পরিশ্রমের ফল ভোগের লোভে পড়েছিল। একদা সে হয়ত জন-পতি ছিল, পরে হয়ত সেনাপতি হয়েছিল, আর কয়েকটা যুদ্ধে জয়লাভ করে সারা জনের সম্মান লাভ করল। সেই সবের সুযোগ জনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল। জন-শাসন খতম করে অসুরদের মতো ব্যক্তি-শাসন রাজত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করল। অনসুরদের মতোই পুরোহিতদের সৃষ্টি করল, বশিষ্ঠ বা বিশ্বামিত্রের পূর্ব পুরুষকে পুরোহিত পদ ঘুষ দেওয়া হল, তার পরিবর্তে সেই সব পুরোহিতরা সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে প্রচার শুরু করে দিল—ইন্দ্ৰ অগ্নি, সোম, বরুণ, বিশ্বদেব এবং অন্যান্য দেবতারা রাজাকে পাঠিয়েছে পৃথিবীর প্রজাকে শাসন করার জন্যে। কাজেই জনের সাধারণ মানুষ যেন রাজার হুকুম মেনে চলে আর যথাবিহিত সম্মান করে। এর সবটাই ছিল বেইমানি। ডাকাতির ভাগ বাঁটোয়ারা। পিতা! আমাদের পূর্ব পুরুষ যে রাজত্ব গড়ে গেছে তা বিশ্বাসহন্তার রাজত্ব। তাদের নাম পর্যন্ত আমাদের ভুলে যেতে হবে-তাদের প্রতি আমাদের কোনো রকম কৃতজ্ঞতা বা মোহ থাকা উচিত নয়।’
‘না পুত্র! বিশ্ব (সারা) জনকে আমি আমার রাজকৃত (রাজা করার অধিকারী) বলে স্বীকার করি। অভিষেকের সময় জনের সাধারণ লোকেই রাজচিহ্ন পলাশদণ্ড দেয়।’
‘রাজার অভিষেকের উৎসব একটা তামাশা মাত্র। সত্যি সত্যি কি জনের লোকেরা (প্রজারা) রাজার মালিক? না! আর এ কথা খুবই স্পষ্ট, যখন আমি দেখি, রাজা নিজের জনের সঙ্গে একত্ৰে সকলের সমান হয়ে বসে না, আহার করে না, কাজও করে না। মাদ্র বা গান্ধার জন-পতি কি এ রকম করতে পারত?’
‘আমরা যদি তাদের মতো থাকি তাহলে যে কোনো শত্ৰু, যে-কোনো সময় আমাদের হত্যা করবে বা বিষ দিয়ে মেরে ফেলবে।’
‘চোর বা অপহারকদেরই এ ভয় হতে পারে। জন-পতি চোর নয়, অপহারকও নয়। বস্তৃত তারা জনের শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাদের ব্যবহারও সেইরকম–তাই তাদের ভয় নেই। আর রাজাদের কথা আলাদা, তারা জনের অধিকার অপহরণকারী, তাই সব সময়েই জনকে ভয় করে চলতে হয়। রাজাদের রাত্রিবাসের অন্তঃপুরের জন্য, সোনা-দানা রক্ষার জন্য সংগ্ৰহ করতে হয় ক্রীতদাস। রাজাদের রাজভোগ নিজের পরিশ্রমে অর্জিত নয় অপরের পরিশ্রম অপহরণ করে তা ভোগ করে।’
‘পুত্র! তুমি কি এর জন্য আমাকে দোষী সাব্যস্ত করছ?’
‘আৰ্য, তা মোটেই নয়! তোমার এ আসনে বসলে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক আমাকেও তোমার মতো হতে হবে। তাই আমার পিতা দিবোদাসকে আমি দোষী সাব্যস্ত করছি না।’
‘তুমি যে পঞ্চাল-জনের হাতে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে বলছ, তা কি সম্ভব? তোমাকে বুঝতে হবে, জনের অধিকার অপহারকা কেবলমাত্র পঞ্চালরাজ দিবোদাসই নয়; অপহারকদের মধ্যে আছে সামন্তরা। রাজা বড় হতে পারে। কিন্তু জনের সম্মিলিত শক্তির সামনে পঙ্গু। এদিকে আছে সামন্ত ও উগ্র রাজপুত্র (রাজবংশ-জাত সন্তানরা) এবং সেনাপতি ছাড়াও প্রধান সামন্ত হচ্ছে পুরোহিত।’
‘হ্যাঁ, পুরোহিতদের ক্ষমতার কথা জানি। জ্যেষ্ঠ পুত্র ছাড়া অন্যান্য পুত্ররা তো রাজপদ পায় না। তাই তারা পুরোহিত (ব্রাহ্মণ) হয়। আমার ছোট ভাই প্রতর্দনও হয়ত তাই হবে। রাজা ও পুরোহিতদের মধ্যে এখন রাজবেদী (সিংহাসন) ও যজ্ঞবেদী নিয়ে বাঁটোয়ারা হচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, ভবিষ্যতে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ দুটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী গড়ে উঠবে। মাদ্র ও গান্ধার দেশে যুদ্ধ ও যজ্ঞ উভয় কাজ একই লোক করতে পারে, কিন্তু পঞ্চালপুরের যুদ্ধবৃত্তি বাধ্যশ্ব পৌত্র দিবোদাসের হাতে, আর যজ্ঞ বিশ্বামিত্রের করায়ত্ত। ইতিমধ্যেই জনের অধিকার তিন ভাগে বঁটায়ারা হয়েছে। জনের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে রাজা ও পুরোহিতরা ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে, জনের অধিকার হরণের অংশীদার হিসাবে, বৈবাহিক বন্ধনের দ্বারা এক হতে পারে; কিন্তু এখন এরা আলাদা আলাদা শক্তি হিসাবে গণ্য তাই স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে পৃথক গোষ্ঠীতে পরিগণিত হতে চলেছে। এই কারণেই ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের সখ্য পুনঃস্থাপনের প্রয়াস দেখা দিয়েছে। জনের সাধারণ মানুষ এই দুই শ্রেণীর বাইরে। আজ এই বিশাল জনের নাম বদলে বিশ্ব (বিট) বা প্রজা বলা হচ্ছে। কি বিড়ম্বনা দেখ, একদিন যে জন (পিতা) ছিল, তাকে প্রজা (পুত্র) আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর্য! একে কি তুমি প্রবঞ্চনা বলবে না?’
‘পুত্র! এ ছাড়াও আরো অনেকে আছে যাদের তুমি গণনার মধ্যে ধরনি।’
‘হ্যাঁ, আর্য জনের বাইরের প্রজাবৃন্দ, যেমন শিল্পী, ব্যবসায়ী, দাসদাসী। হয়ত এই কারণেই জনকে ক্ষমতাচ্যুত করায় সামন্তরা সফল হয়েছে। অনার্য প্রজারা যখন দেখে যে তাদের শাসক-জনের লোকেরা অন্যের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে তখন তারা খুশীই হয়। আরএই ব্যাপারটাকেই রাজারা ন্যায়বিচার বলে জাহির করে।’
‘পুত্র! তুমি হয়ত ভুল বলছ না; কিন্তু আমায় বল তো, রাজ্য কার হাতে ছেড়ে দেব? চোর-অপহারক-সামন্ত ব্যবসায়ী এদের সকলকেই কি দেওয়া হবে? কেননা আৰ্য-জন ও অনাৰ্য প্ৰজা যারা সংখ্যায় যথেষ্ট তারা কি রাজ্যশাসন করতে পারবে? আর এদিকে ধর্মসামন্ত ও রাজা-সামন্তরা শুকনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রজাদের ওপর—তাদের গ্রাস করার জন্যে তারা প্রস্তুত হয়েই আছে। মাত্র ছ-সাত পুরুষ আগেই কুর পঞ্চাল জনের হাত থেকে ক্ষমতা অপহৃত হয়েছে, জনের শাসনের কথা লোকে এখনও ভুলে যায় নি। সে সময় কোনো দিবোদাসের রাজত্ব ছিল না, তখন এই দেশকে পঞ্চালাঃ অর্থাৎ সারা পঞ্চালবাসীর দেশ বলা হত, দেশটা ছিল তাদেরই। কিন্তু আজ আর সেই অবস্থায় ফিরে যাবার পথ। নেই।’
‘হ্যাঁ, পথে বলিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের মতো অনেক কুমীর লুকিয়ে আছে।’
‘এতে প্রমাণ হয় যে, আমি পরবশ হয়েছি, কালের গতি বদলাতে পারিনি, কাল কি ঘটবে তাও জানি না। কিন্তু আমি এতেই খুশী যে সুদাসের মতো পুত্র আমারই সন্তান। এক। সময় আমিও তরুণ ছিলাম। তখন পর্যন্ত বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের শ্লোক মানুষের জীবনের ওপর এত মায়াজাল ছড়াতে পারেনি। আমি ভাবতাম, রাজা যে দসু্যুবৃত্তি করে সেটা কমাতে হবে; কিন্তু নিজের দুর্বলতার জন্যে তা পারিনি। সে সময় তোমার মা-ই ছিল যথাসর্বস্ব। তারপর আমি যখন ভগ্নীমনোরথ ও নিরাশ হয়ে পড়লাম তখন এই পুরোহিতরা শুধু নিজেদের কবিতা ও স্ততিগাথাই নয় নিজেদের কন্যাদের পাঠিয়ে আমাকে জড়িয়ে দিল। আমার অন্তঃপুর শত, শত দাসীকন্যায় ভরে গেল–এর তুলনা কেবল ইন্দ্রের সঙ্গেই চলতে পারে। দিবোদাসের এই অধঃপতন থেকে তুমি শিক্ষা নাও, সতর্ক হও এবং যত্নের সঙ্গে চেষ্টা কর। হয়ত তোমার সামনে পথের সন্ধান মিলবে; দুসুবৃত্তির অবসান সম্ভব হবে, কিন্তু সুদাসের মতো সহৃদয় শাসককে সরিয়ে হৃদয়হীন প্রবঞ্চক, প্ৰতর্দন-এর মতো শঠের হাতে রাজ্য দিলে পঞ্চলের ভালো হবে না। আমি পিতৃলোকে গিয়েও তোমার সযত্ন চেষ্টা লক্ষ করে সুখী হব।’
৪.
দিবোদাস দেবলোক প্ৰয়াণ। সুদাস এখন পঞ্চলের রাজা। ঋষিমণ্ডলী তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করল। সুদাস বুঝল, ইন্দ্র বরুণ অগ্নি সোম প্রভৃতি দেবতার নাম নিয়ে এই শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধর লোকদের কিভাবে অন্ধবানিয়ে রাখে। তাদের শক্ত খপ্পরের আওতার পরিধি তার জানা ছিল। যাদের উপকার করবে বলে সে ঠিক করেছিল—সেই প্রজারাই তাকে ভুল বুঝল। অতীতের কথা মাঝে মাঝে তার মনে হত-ছিন্নবস্ত্ৰে, নগ্নপদে বিদেশে ঘুরে বেড়াবার সেই দিনগুলোর কথা। সেদিন তার মনে শান্তি ছিল অনেক বেশি। মুক্ত স্বাধীন সুদাসের হৃদয়ের ব্যথা বোঝবার মতো, তার প্রতি সহানুভূতি অনুভব করার মতো কোনো দরদী তার পাশে ছিল না। পুরোহিত ও ঋষিরা তাদের পৌত্রীদের, আর প্রদেশ সামন্তরী কুমারী মেয়েদের তার অন্তঃপুরে নিয়মিত পাঠাত। কিন্তু সুদাস নিজেকে আগুন লাগা ঘরে বসে থাকার মতো মনে করত। চন্দ্ৰভাগা নদীর তীরে অপেক্ষমানা সেই নীলনয়নী অপালার কথা সে ভুলতে পারত না।
সুদাস তার সমস্ত প্রজাদেরই-আর্য অনার্য নির্বিশেষে সকলেরই কল্যাণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ছিল। কিন্তু তার আগে তার দরকার হল–ঈশ্বরের কৃপার দিকে চেয়ে আছে যে প্রজা-সাধারণ, তাদের কাছে প্রমাণ করা যে, সুদাস ভগবানের করুণা লাভ করতে সমর্থ। আর এই অনুগ্রহ লাভের একমাত্র উপায় পুরোহিতদের প্রশংসাভাজন হওয়া। শেষ পর্যন্ত পুরোহিতদের কাছ থেকে এই প্রশংসা-বাণী আদায় করার জন্য তাকে হিরণ্য-সুবর্ণ, পশু-ধান্য, দাস-দাসী দান করা ছাড়া উপায় ছিল না। এইসবের পরেও চর্বিযুক্ত মাংস এবং সুস্বাদু মদ খাওয়ার পর পুরোহিতরা সিদ্ধান্ত করল, সত্যিই সুদাসের নামের যা অর্থসুদাতা তা সার্থক। এই সমস্ত চাটুকরেরা সুদাসের বদান্যতা সম্পর্কে অসংখ্য শ্লোক লিখেছিল–আজও সেগুলো ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। কিন্তু কে বলতে পারে, এই সমস্ত স্তুতিবাদের রচয়িতাদের সুদাস কি গভীর ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখত! সুদাসের যশোগান অনতিবিলম্বে শুধু উত্তর পঞ্চালে, অর্থাৎ বর্তমান রুহেলাখণ্ডে সীমাবদ্ধ রইল না–আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ল। নিজের ভোগ শূন্য জীবন দিয়ে সে যথাসাধ্য সমস্ত প্রজার কল্যাণার্থের কাজ করে চলেছিল। ।
পিতার মৃত্যুর কয়েক বছর পর তার মাতারও মৃত্যু হল। অভ্যস্ত হয়ে উঠবার আগে যে বেদনা অহোরাত্র তার হৃদয়ে বহ্নিমান ছিল তা আজ যেন বিপজ্জনক দুষ্ট ক্ষতের মতো তাকে পেয়ে বসল। প্রতি মুহূর্তে সে যেন দেখতে পেত, অপালা জলভরা চোখ আর কম্প্রমাণ ঠোঁট দুটি নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আমি অপেক্ষা করে থাকব তোমা্র জন্যে–এই মাদ্রপুরে।’ সুদাসের চোখের সমস্ত জলও তার এই জ্বলন্ত চিন্তাকে নেভাতে। পারত না। একদিন মৃগয়ার ছলে সে পঞ্চালপুর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল।
যে পুরাতন গৃহে সে অপালার প্রেমলাভ করেছিল সেটি সেদিনও দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু জেতা বা তার প্রিয় কন্যার দেখা সে পেল না। দু’জনেই তখন গতায়ু হয়েছে। অপােলা মাত্র এক বছর আগে মারা গেছে। অপালার যে ভাই নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিল, সে পরে ফিরে এসে সপরিবারে বাস করতে শুরু করছে; কিন্তু এই পরিবারের সঙ্গে নতুন করে সম্বন্ধ স্থাপন করার তার কোনো ইচ্ছা ছিল না। অপালার এক বান্ধবীর সঙ্গে সুদাসের দেখা হল। সে। কাঁদতে কাঁদতে সুদাসকে মৃত্যুর কতকগুলো রঙ্গীন পোষাক–ঘাঘরা, শাল, কাঁচুলি এবং ওড়না দেখিয়ে বলল, ‘আমার বান্ধবী তার শেষ দিনে সুদাসের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে তার জন্যে এখানে অপেক্ষা করে থাকবে।’
সুদাস পোষাকগুলো নিয়ে তার বুকে চেপে ধরল। অপালার দেহের ঘ্রাণ তখনও সেই পোষাকের ভাঁজে ভাঁজে।’ *
———–
* ১৪৪ পুরুষ আগেকার কাহিনী। এই সময় আদি ঋষিরা-বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহ রচনা করেছিলেন। আর পঞ্চালভূমির রাজন্যবর্গ এইসব আর্যপুরোহিতদের সাহায্যে পুরাকালের গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মূলে চূড়ান্তভাবে আঘাত হানতে পেরেছিল।