০৭. সি সিকনেস

৭. সি সিকনেস

ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে তার ইঁদুরের মতো দাঁতগুলো বের করে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগল। আমি কখনো ইঁদুরের মুখ খুলে তার দাঁত দেখি নাই কিন্তু মনে হলো নিশ্চয় এরকমই হবে।

আমি প্রথমে খুবই ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকালাম, এভাবে তাকানোটা আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রীতিমতো প্র্যাকটিস করে শিখেছি। এভাবে তাকালে ছোটো বাচ্চারা অনেক সময় ভ্যা করে কেঁদে দেয়। এই ছেলেটা কাদল না তবে একটু থতমত খেয়ে গেল। বলল, “কী অবস্থা?”

আমি বললাম, “তুমি আমাকে ছ্যামড়া ডেকেছ?”

ছেলেটার মুখ শক্ত হয়ে গেল, বলল, “ডেকেছি তো কী হয়েছে? তুই ছ্যামড়া না? তুই কি ছ্যামড়ি?”

আমি বললাম, “তোমাকে আমি কী ডাকব? দামড়া?”

মনে হলো ছেলেটা আমাকে মেরে বসবে। মারল না, শুধু দাঁতে দাঁত ঘষল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “ভাবছিলাম এই জাহাজে আমার সাইজের ছেলেমেয়ে আসবে, ফুর্তি ফার্তা হবে। যা আসছে সব আন্ডা বাচ্চা, একটা আবার বোবা। কানেও শুনে না।”

আমার মেজাজটা গরম হলো। এটা কথা বলার ঢং হলো?

ছেলেটা বলতেই লাগল, “আরেকজন হয়ত আসবে কানা! আরেকজন লুলা না হয় ল্যাংড়া।” ছেলেটা আমার দিকে তাকাল, বলল, “তোর কী সমস্যা? বল।”

আমি বুঝতে পারলাম এই ছেলেটাকে সময়মতো সাইজ না করলে এই জাহাজে আমার জীবনটাই নষ্ট করে দিবে। কিন্তু একেবারে প্রথম দিন প্রথম দেখাতেই তো সাইজ করা যাবে না, একটু সময় দরকার। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে তার ফালতু কথা তো শোনার দরকার নাই, আমি আমার চিপসের প্যাকেট থেকে একটা চিপস মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে হাঁটতে লাগলাম। ছেলেটা পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, “কী হলো? রাগ করলি?”

আমি প্রশ্নের উত্তর দিলাম না, চিপস খেতে থাকলাম।

ছেলেটা আবার ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল, বলল, “একটু মজা করলাম। কথা বলার কেউ নাই ভাবলাম তোর সাথে কথা বলি।”

আমি বললাম, “তোমার কথা বলার স্টাইল ভালো না। তোমার সাথে কেউ কথা বলবে না।”

“তোর নাম কী?”

আমি বলব কিনা একটু চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বলে দিলাম, “টুলু। তোমার?”

“জেহ্‌হির।” নাম শুনে আমি একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম, তখন বুঝতে পারলাম আসলে তার নাম জহির, নামটা নিশ্চয়ই পছন্দ না তাই স্টাইল করে অন্যরকম করে বলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “জহির? জহিরুদ্দি?”

ছেলেটা আবার চোখ কটমট করে বলল, “বললাম তো, জেহির!”

আমি সামনে সামনে হাঁটছি সে পেছনে পেছনে। হঠাৎ করে টের পেলাম সে আমার ঘাড়ের কাছে টি-শার্টটা ধরে কিছু একটা দেখছে। আমি তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “কী করো?”

“দেখছি তোর শার্টটা কোন ব্র্যান্ডের। ফুটপাতের মাল।”

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, সে নিজের শার্টের কলারে টোকা। দিয়ে বলল, “আমার শার্ট অরিজিনাল ব্র্যান্ড। আমি ফুটপাতের মাল পরি না।”

কেউ এরকম করে কথা বললে তার উত্তরে কী বলতে হয় আমি সেটাও জানি না, তাই কিছু বলারও চেষ্টা করলাম না। সামনে একটা সিঁড়ি পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। জেহির কিংবা জহির উপরে উঠল না। নিচে রয়ে গেল। হাত দিয়ে তার চুল ঠিক করল, তারপর স্মার্টফোন দিয়ে নিজের একটা সেলফি তুলে ফেলল। কী আজব!

এই চিড়িয়া এই জাহাজে কোথা থেকে এসেছে? ছেলেটা কী বোকা নাকি পাজী? নাকি দুইটাই?

আমি রুমে এলাম, মামী বললেন, “দেখা হয়ে গেল জাহাজ? এত তাড়াতাড়ি?”

“না। পুরোটা দেখি নাই–” কিন্তু জহির নামে এক আজব চিজের যন্ত্রণায় যে ফিরে এসেছি সেটা আর বললাম না।

“ভালোই হয়েছে। যা হাত মুখ ধুয়ে আয়, নাস্তা করে আসি। চিপস দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলে হবে না।”

আমি হাত মুখ ধুয়ে মামীর সাথে নিচে নাস্তা করতে গেলাম। জহির নাই কিন্তু অন্য অনেকে আছে, সবাই মামীর সাথে কথা বলল, আমার পরিচয় নিল। আমি একটু বোকার মতো হাসি হাসি মুখ করে বসে রইলাম। নাস্তা শেষ করে মামী বলল, “আয় তোকে আমাদের জাহাজ ঘুরে দেখাই।”

আমি বললাম, “সেটাই ভালো। আমি একলা একলা হাঁটলে হারিয়ে যাই। একটু পরে পরে খালি সিঁড়ি। হয় উপরে না হয় নিচে।”

“এক দুদিনেই চিনে যাবি।”

মামী আমাকে পুরো জাহাজটা ঘুরে ঘুরে দেখালেন। ইঞ্জিন ঘরটা অসাধারণ বড়ো বড়ো ইঞ্জিনে গুমগুম শব্দ করছে। যখন চলতে শুরু করবে তখন নিশ্চয়ই ফাটাফাটি একটা ব্যাপার হবে। কয়েকজন মানুষ যন্ত্রের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে, কাপড়ে তেল কালি লেগে আছে, মাথায় একটা রুমাল বাঁধা–কী অসাধারণ লাগছে দেখতে। বড়ো হয়ে মনে হয় আমার এখানেই চাকরি নিতে হবে।

মামী তারপর আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন, বুড়ো মতন একজন মানুষ চিৎকার করছিল, মামীকে দেখে চিৎকার থামিয়ে বলল, “কেমন আছেন আপা?”

“ভালো। আপনি কার ওপর এত চিৎকার করছেন?”

“ইন্দুর।”

মামী হাসলেন, বললেন, “ইন্দুর আপনার চিৎকার শুনছে?”

“আপা, আপনি হাসছেন? আমরা থাকি পানির ওপরে–এই পানি সাঁতরাইয়া ইন্দুর জাহাজে আসে কেমন করে আপনি বোঝান আমাকে।”

“এরা সাঁতরিয়ে আসে না বাবুর্চি সাহেব। এরা এখানেই থাকে, ঘর সংসার করে। এখানে এদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার। আপনি এদের খাওয়া-দাওয়ার এত ভালো ব্যবস্থা করে রেখেছেন এরা যাবে কেন?”

বাবুর্চি মানুষটি দাঁত বের করে হাসল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার ভাগনা?”

“হ্যাঁ।”

“ম্যাডামের ভাগনা, বলো তুমি কী খাবা? ম্যাডাম আমাদের ইসপিশাল মানুষ, তার ভাগনাও ইসপিশাল।”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “আমার জন্য স্পেশাল রান্না করবেন?”

“একশবার!”

আমি বললাম, “মামীর সামনে বলা যাবে না। আমি একলা একলা এসে আপনাকে বলে যাব।”

মামী আমার মাথায় চাটি মারলেন আর বাবুর্চি মানুষটা হা হা করে হাসল। বলল, “ঠিক আছে, তোমার সাথে আমার গোপন চুক্তি।”

মামী বললেন, “দাঁড়া তোর গোপন খাওয়া আমি বের করছি!”

মামী তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন তাদের ল্যাবরেটরিতে। সেটা দেখে আমি বেকুব হয়ে গেলাম। দেওয়ালে বড়ো বড়ো স্ক্রিন। টেবিলে সারি সারি কম্পিউটার। এখন সবগুলো বন্ধ, যখন এক সাথে সবগুলো চালু হবে তখন দেখতে কী অসাধারণ লাগবে। পেছনের অংশ কাঁচ দিয়ে আলাদা করে রাখা, তার ভেতরে কত রকম যন্ত্রপাতি দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

মামী আমাকে ভেতরে নিয়ে একটা যন্ত্র দেখালেন, যন্ত্রটা গোল, নিচে দিয়ে কয়েকটা পা বের হয়ে আছে। পেছনে একটা প্রপেলর। সামনে বড়ো বড়ো দুটো লেন্স দেখে মনে হয় চোখ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বড়ো একটা পোকা। মামী জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কী বলতে পারবি?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না।”

“এটা হচ্ছে আমাদের রোবট। আমাদের নিজেদের তৈরি। পানির নিচে ঘুরে বেড়ায়, ছবি তুলে, ভিডিও করে।”

“রোবট?” আমি বললাম, “আমি মনে করতাম রোবট দেখতে মানুষের মতো হয়। হাঁটতে পারে। কথা বলে—”

মামী হাসলেন, “সেগুলো গল্পের রোবট। কাজের রোবটের কোনো চেহারা সুরত নাই।”

“এই রোবটের নাম কী মামী?”

“আমরা গলদা চিংড়ি ডাকি।”

“গলদা চিংড়ি?” আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “এত ফাটাফাটি একটা রোবটের নাম গলদা চিংড়ি?”

“কেন? সমস্যা আছে?”

“না।” আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “আমি ভেবেছি আরও সায়েন্টিফিক নাম হবে। এফ এক্স সেভেনটি নাইন–এইরকম।”

মামী ঠোঁট উলটালেন, বললেন, “আমার দেশী রোবটের নাম বিদেশী হবে কেন? দেশী রোবটের দেশী নাম। এর নাম বলতে গিয়ে বিদেশীদের দাঁত ভেঙে যায়। গলদা চিংড়ি বলতে পারে না। বলে গেল শিংড়ি!” মামী হি হি করে হাসলেন।

মামীর সাথে সাথে আমিও হাসলাম।

ল্যাবরেটরি থেকে বের হয়ে মামী আমাদের জাহাজের ছাদে নিয়ে গেলেন। এই জায়গাটা সবচেয়ে সুন্দর। চারিদিকে রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা, একটা লম্বা মই দিয়ে উঠতে হয়। মামী বললেন, “রাতের বেলা এখানে শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবি। দেখবি আকাশ জুড়ে ছায়াপথ। তারাগুলো মিটমিট করে একেবারে অপূর্ব!”

আমি কল্পনা করে দেখলাম, মনে হলো আসলেই অপূর্ব হতে পারে।

.

দুপুরবেলা আমাদের জাহাজটা ছেড়ে দিল, সেটা কী ভয়ানক একটা ব্যাপার! প্রথমে সাইরেনের মতো হুইসেল বাজল, তারপর গর্জন করে ইঞ্জিন চালু হলো, তারপর হইচই করে নোঙর তোলা হলো তারপর পুরো জাহাজটা কেঁপে উঠে নড়তে শুরু করল, চারিদিকে পানির ঢেউ তার মাঝে জাহাজটা আস্তে আস্তে এগুতে শুরু করেছে। সবাই রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, জাহাজটা চলতে শুরু করতেই সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, আমার গলার আওয়াজটা মনে হলো উঠল সবার ওপরে।

জাহাজটা যখন চলতে শুরু করেছে, আমরা যখন ধীরে ধীরে দূরে চলে গেলাম তখন আশেপাশে নোঙর করে থাকা অন্য জাহাজগুলো আস্তে আস্তে ছোটো হতে লাগল, বহুদূরে সমুদ্রতীরও ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গেল। তখন ডক্টর সারোয়ার নামের বুড়ো মতন মানুষটা যিনি বড়ো সায়েন্টিস্ট আর এখানকার টিম লিডার গলা উঁচিয়ে বললেন, “ওকে এভরিওয়ান! সবাই চলো, আমাদের মিটিং।”

আমি বুঝতে পারলাম না মিটিংয়ে আমাদেরও যেতে হবে কিনা। জিজ্ঞেস করব কিনা চিন্তা করেছিলাম তখন ডক্টর সারোয়ার আমাদের দিকে বললেন, “না! বাচ্চাদের আসতে হবে না। এটা আমাদের টেকনিক্যাল মিটিং। তোমরা তোমাদের মতো মজা করো।”

আরেকজন বলল, “তোমাদের কথা চিন্তা করে অনেক জাংক ফুড এনেছি দেখি শেষ করতে পারো কিনা।”

মামী বললেন, “সুপার ইমার্জেন্সি না হলে আমাদের ডাকাডাকি করো না।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সুপার ইমার্জেন্সি মানে কী?”

“কেউ পানিতে পড়ে গেলে সেটা ইমার্জেন্সি। পানিতে পড়ে যাওয়ার পর যদি হাঙর মাছ খাওয়া শুরু করে তাহলে সেটা সুপার ইমার্জেন্সি!”

মামীর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

বড়ো মানুষেরা একে একে সবাই চলে যাওয়ার পর আমরা শুধু তিনজন রয়ে গেলাম। তিনজনই তিনজনকে চিনি কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নাই! আমরা তিনজন ডেকের তিন জায়গায়–মিতি তার চেয়ারে মাথা গুঁজে তার মোটা বইটা পড়ছে (এতক্ষণে অনেকখানি পড়ে ফেলেছে), জহির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে তার স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে আছে, মাঝে মাঝে কিছু টেপাটেপি করছে। আমি একটা ডেক চেয়ারে আধ শোয়া হয়ে রেলিংয়ে পা তুলে দিয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছি। জাহাজটা তার মাঝে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রে ঢেউ নাই কিন্তু তার মাঝে জাহাজটা আস্তে আস্তে দুলছে।

এবং দুলছে।

এবং দুলছে।

এভাবে কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না, আমার মনে হয় চোখ দুটো একটু বন্ধ হয়ে আসছিল, একটা আরামের ঘুম ঘুম ভাব। হঠাৎ করে আমার ঘুম ঘুম ভাবটা ছুটে গেল, আমি দেখলাম জহির কেমন যেন সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর খপ করে রেলিংটা ধরল। আরেকটু হলে তার জান থেকে প্রিয় স্মার্টফোনটা সমুদ্রে পড়ে যাচ্ছিল। মনে হলো সেও পড়ে যাবে। সে পড়ল না কিন্তু মুখটাতে নানারকম অঙ্গভঙ্গী করতে লাগল। বোঝা যাচ্ছে পেটের ভেতর থেকে তার গলা দিয়ে কিছু একটা বের হওয়ার চেষ্টা করছে, তার চোখ দুটো উলটে গেল এবং যেটা বের হওয়ার চেষ্টা করছিল সেটা বের হলো–শুধুই শব্দ। “ওয়াক” করে একটা বিকট শব্দ।

আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, প্রত্যেকবারই শব্দ বের হবে তার কোনো গ্যারান্টি নাই, পরের বার আসল জিনিস বের হতে পারে। দূরে থাকা ভালো। আমি তাকে ধরার চেষ্টা করলাম, সে ঝটকা মেরে আমাকে সরিয়ে দিল, বলল, “খবরদার।”

আমি বললাম, “মনে হয় সি সিকনেস।”

জহির বলল, “কাছে আসলে খুন করে ফেলব।” তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চোখ লাল। দেখে মনে হয় খুন করেও ফেলতে পারে। আমি তাই সরে গেলাম।

জহির আবার বিচিত্র মুখভঙ্গী করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। প্রায় পড়েই যাচ্ছিল সেই অবস্থায় রেলিং ধরে নিজেকে সামলে নিল এবং দ্বিতীয়বার “ওয়াক করে একটা বিকট শব্দ করল।

আমি নিরাপদ দূরত্বে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাও?”

জহির বলল, “চোপ! আমার সাথে কথা বলবি না। মাথা ভেঙে ফেলব।”

এর থেকে অনেক সহজে মাত্র এক শব্দে সে কোথায় যাচ্ছে বলতে পারত!

সি সিকনেস হলে মাথা আউলে যায় সেই কথাটা মামী আমাকে বলেন নাই। আমি দূর থেকে দেখলাম জহির টলতে টলতে কোনো একটা কেবিনে ঢুকে গেল, বুঝতে পারলাম এটা নিশ্চয়ই তার কেবিন।

আমি পা টিপে টিপে কাছে গেলাম, শুনলাম আবার সে বিকট শব্দ করল, এবারের শব্দটা অন্যরকম, একটা হড় হড় শব্দ শুনতে পেলাম, বুঝতে পারলাম দুপুরের লাঞ্চ এবং মনে হয় সকালের ব্রেকফাস্টও বের হয়ে এলো। রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রে বমি করে দিলে বিষয়টা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতো, কিন্তু বন্ধ কেবিনে পুরো ব্যাপারটা অন্যরকম। এটাকে কি সুপার ইমার্জেন্সি হিসেবে ধরা যায়? মনে হয় না।

আমি আবার ডেকে ফিরে এলাম। মিতির দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। সে পিঠ সোজা করে বসে আছে, মুখ ফ্যাকাশে, চোখে আতঙ্ক।

আমার বুঝতে দেরী হলো না যে মিতিরও একই কেস!

আমি পায়ে পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, সে তখন উঠে দাঁড়িয়েছে, হাতে তখনো মোটা বইটা ধরে রেখেছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, কপালে ঘাম, মনে হয় দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা হচ্ছে। একবার আমার দিকে তাকাল, চোখে মুখে একটা অসহায় ভাব, মনে হয় কেঁদে ফেলবে।

আমি কাছে গিয়ে তার হাত থেকে বইটা নিয়ে পৃষ্ঠাটা ভাঁজ করে একটা চেয়ারে রাখলাম। সে কথা শুনে না, কথা বুঝে না, বলতেও পারে না কিন্তু তবু আমি তার সাথে কথা বলতে লাগলাম, মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, “তোমার কোনো ভয় নাই মিতি (সেটা বোঝানোর জন্য মাথা নাড়লাম)। তোমার যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে সি সিকনেস। আমি সি সিকনেস চিকিৎসার এক্সপার্ট! (বুকে টোকা দিয়ে বোঝালাম আমি এক্সপার্ট, মুখে এক্সপার্টের ভাব করলাম। এখন তুমি বই পড়বে না (বইটা দেখিয়ে না সূচকভাবে মাথা নাড়ালাম)। এখন তুমি দূরে তাকাবে, অনেক দূরে (আমি অনেক দূরে আঙুল দিয়ে দেখালাম), যখন সি সিকনেস হয় তখন দূরে তাকাতে হয়।”

মিতি একবার আমার দিকে তাকাল তারপর দূরে তাকাল। আমার ভুলও হতে পারে কিন্তু মনে হলো তার চোখে মুখে ভয়ের ভাবটা কমেছে। আমি আবার কথা বলা শুরু করলাম, “আজকে সকালে আমি সি সিকনেসের চিকিৎসা শিখেছি, এর পাঁচটা চিকিৎসা (আমি পাঁচ আঙুল দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলাম)। প্রথমটা দূরে তাকানো (একটা আঙুল ভাঁজ করে বোঝালাম এক নম্বর চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে)। দুই নম্বর চিকিৎসা হচ্ছে চোখে মুখে বাতাস (বাতাস দেওয়ার মতো কিছু না পেয়ে বইটা তুলে তার কভার দিয়ে খানিকক্ষণ তাকে বাতাস করলাম, মনে হলো তখন তার চোখে একটু হাসির ঝিলিক দেখা গেল)! তিন নম্বর হচ্ছে ক্র্যাকার আর কোল্ড ড্রিংকস (আমি ক্র্যাকার এবং কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ার ভান করে দেখালাম। তারপর তাকে অপেক্ষা করতে বলে এক দৌড়ে নিচে গিয়ে স্ন্যাক কর্নার থেকে দুইটা ক্র্যাকারের প্যাকেট আর একটা কোল্ড ড্রিংকসের ক্যান নিয়ে আবার দৌড়ে উঠে এলাম)।

আমি ক্র্যাকারের প্যাকেট খুলে সেখান থেকে একটা ক্র্যাকার বের করে মিতির হাতে দিয়ে বললাম, “খাও।”

সে মাথা নাড়ল, খেতে চায় না। আমি মুখ গম্ভীর করে বোঝালাম যে এটা তিন নম্বর চিকিৎসা, তাকে এটা খেতে হবে। তখন সে একটা ক্র্যাকার হাতে নিয়ে কুট কুট করে খেতে লাগল। আমি কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানটা খুলে হাতে ধরে রাখলাম। তাকে বোঝালাম এই ড্রিংকসও খেতে হবে।

আমার মনে হলো তখন তার শরীরটা একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। তারপর চারটে আঙুল তুলে ধরে আমার দিকে প্রশ্ন করার ভঙ্গীতে তাকাল, জানতে চাইছে চার নম্বর চিকিৎসাটা কী?

আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম, তখন মনে পড়ল সেটা হচ্ছে এটা ভুলে থাকার চেষ্টা করতে হবে। আমি মিতিকে বললাম, “চার নম্বরটা হচ্ছে সবচেয়ে সোজা চিকিৎসা। তুমি এটা ভুলে থাকার চেষ্টা করবে। ভুলে যাও তোমার শরীর খারাপ। ভুলে যাও তোমার মাথা ঘোরাচ্ছে, বমি বমি লাগছে। গরমে ঘেমে যাচ্ছ। মনে করো তুমি আকাশে পাখী হয়ে উড়ছ, সমুদ্রে মাছ। হয়ে সাঁতার কাটছ” (শুধু মুখে বললাম না, হাত পা নেড়ে পাখী হয়ে উড়া এবং মাছ হয়ে সাঁতার কাটা দেখালাম) মিতি কী বুঝল কে জানে মুখে হাত দিয়ে খিকখিক করে হেসে ফেলল। তখন সে পাঁচ আঙুল দেখিয়ে জানতে চাইল পাঁচ নম্বর চিকিৎসা কী।

আমি বললাম, “পাঁচ নম্বর চিকিৎসা হচ্ছে টোটকা চিকিৎসা। একু প্রেশার। পি সিক্সে হাত দিয়ে চেপে ধরতে হবে। এই যে এভাবে-” আমি মিতির হাত ধরে, তার তাল থেকে একটু নিচে চেপে ধরে দেখালাম। মিতি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, “হ্যাঁ। তোমার কাছে। এটা অবাক মনে হতে পারে কিন্তু এটি খাঁটি টোটকা চিকিৎসা!”

মিতি তখন তার হাতের ঠিক জায়গায় চেপে ধরার চেষ্টা করতে লাগল। আমার চিকিৎসার কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক কিছুক্ষণের মাঝেই মিতি বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠল। তখন আমরা দুজন মিলে বাকী ক্র্যাকারগুলো খেয়ে কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানটা শেষ করে ফেললাম।

আমার প্রথম রোগী এত সহজে ভালো হয়ে যাবে আমি চিন্তা করি নাই।

আমি তখন মিতিকে নিয়ে জহিরকে দেখতে গেলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি

দিয়ে দেখি সে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। পুরো কেবিনে তার বমি এবং দুর্গন্ধ। আমাদের দেখে চি চি করে বলল, “কাউকে ডাক। আমি মনে হয় মরে যাচ্ছি।”

আমি বললাম, “সি সিকনেসে কেউ মরে না। তুমি বাইরে এসে বসো। ভালো লাগবে।”

জহির কোঁকাতে কোঁকাতে বলল, “কথা কানে যায় না? বললাম মরে যাচ্ছি”

“না। তুমি মরে যাবে না।”

“বলছি মরে যাচ্ছি–“

“উঁহু। তুমি মরে যাচ্ছ না।”

“তোরে আমি খুন করে ফেলব। কাউকে ডাক–”

আমি আর মিতি তখন নিচে গেলাম, ডাইনিং রুমে একজন স্ন্যাক কর্নারে খাবার সাজাচ্ছে, তাকে বললাম, “এখানে কি কোনো ডাক্তার আছে?”

“কেন? আমি এখানে ডাক্তার, কম্পাউন্ডার, ইঞ্জিনিয়ার সবকিছু।”

“একজন বমি করছে।”

মানুষটা বলল, “প্রথম দিন সবাই বমি করে। ঠিক হয়ে যাবে।” বলে শীষ দিতে দিতে একইসাথে ডাক্তার, কম্পাউন্ডার এবং ইঞ্জিনিয়ার লোকটা খাবার সাজাতে লাগল।

আমি আর মিতি দুটি চকলেট বার নিয়ে খেতে খেতে জহিরকে খবর দিতে উপরে রওনা দিলাম।

খবর শুনে সে কী করবে কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *