৭. সাধারণ সূত্র সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান প্রসঙ্গে
আমরা পূর্ববর্তি অধ্যায়ে দেখেছি যে যদিও অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত যুক্তিসমূহের সত্যতা আরোহের সূত্রগুলোর উপর নির্ভরশীল, কিন্তু এই সূত্রগুলো স্বয়ং অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত নয়, তথাপি সবাই এগুলো নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে অন্তত বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে। এসব বৈশিষ্ট্যমূলক ক্ষেত্রে আরোহের সূত্রগুলো একা নয়। এ রকম আরও অনেক সূত্র আছে যেগুলোকে অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত করা যায় না, কিন্তু এগুলো অভিজ্ঞতালব্দ ক্ষেত্র থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন যুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।
এরকম কোন কোন সূত্রের আরোহের সূত্রের থেকে বেশি সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে এবং তাদের জ্ঞানের একই ধরনের নিশ্চয়তা থাকে যে রকম ইন্দ্রিয়-উপাত্তের অস্তিত্বের জ্ঞানের ক্ষেত্রে থাকে। এগুলো অনুমান গঠন করার মাধ্যমে যা সংবেদনে দেয়া রয়েছে, এবং যদি আমরা যা অনুমান করি তা সত্য হয় তাহলে এটা অবশ্যই প্রয়োজনীয় যে আমাদের অনুমানের সূত্রগুলো সত্য হবে, যে রকম আমাদের উপাত্তগুলোকেও সত্য হতে হবে। অনুমানের সূত্রগুলোর দিকে নজর না দিলেও চলে যেহেতু এগুলো স্বভাবতই স্পষ্ট-এখানে যে অনুমান থাকে তা গৃহিত হয় আমরা এটা বুঝে ওঠার আগেই যে এটি একটি অনুমান। কিন্তু সঠিত জ্ঞানতত্ত্ব আহরণ করতে হলে অনুমানের সূত্রগুলোর ব্যবহার অনুভব করা খুবই প্রয়োজনীয়, কেননা এগুলো সংক্রান্ত জ্ঞান আমাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও সমস্যাবহুল প্রশ্নের সম্মুখীন করায়।
আমাদের সব সাধারণ সূত্রের জ্ঞানে যা আসলে ঘটে তা হল-আমরা প্রথমে কোন সূত্রের বিশেষ প্রয়োগ অনুভব করি এবং তারপর আমরা বুঝি এর বিশেষত্ব অপ্রয়োজনীয় এবং এখানে এক ধরনের সামান্যত্ব রয়েছে যা গ্রহণ করা যায়। এটি অঙ্ক শেখার মত ক্ষেত্রগুলোতে পরিষ্কার বুঝা যায়: দুটি এবং দুই মিলে চার এটি প্রথমে শেখা হয় কোন বিশেষ জোড়ার ক্ষেত্রে, তারপর অন্য কোন বিশেষ ক্ষেত্রে এবং এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ না বুঝা যায় যে এটি যে কোন জোড়ার ক্ষেত্রেই সত্য। এই একই জিনিস যৌক্তিক সূত্রের ক্ষেত্রেও ঘটে। মনে করা যাক দুজন ব্যক্তি আলোচনা করছে আজকে মাসের কোনদিন। তাদের মধ্যে একজন বলল, অন্তত এটা তো তুমি মানবে যে যদি কাল পনেরো তারিখ হয়ে থাকে তাহলে আজ অবশ্যই ষোলো। হ্যাঁ, অন্যজন বলল, আমি তা স্বীকার করছি। এবং তুমি জানো, প্রথমজন বলল, গতকাল পনেরো ছিল কেননা তুমি জোনসের সঙ্গে ডিনার খেয়েছে এবং তোমার ডায়েরি তোমায় বলবে এইদিন পনেরো ছিল। হ্যাঁ, দ্বিতীয়জন বল, সুতরাং আজ হল ষোলো।
এখন এই ধরনের যুক্তি অনুসরণ করা খুব একটা কঠিন নয়, এবং যদি স্বীকার করা হয় যে এর যুক্তিবাক্যগুলো আসলে সত্য তাহলে কেউই অস্বীকার করবে না যে সিদ্ধান্তটি অবশ্যই সত্য। যৌক্তিক সূত্রটি হবে এরকম : মনে করা যাক যে যদি এটা সত্যি হয় তাহলে ওটাও সত্যি হবে। মনে করা হল যে এটা সত্য, তাহলে বেরিয়ে আসছে যে ওটাও সত্য। যখন ব্যাপারটি এরকম যে যদি এটা সত্য হয় তাহলে ওটাও সত্য, আমরা বলব যে এটা ওটা এটার থেকে বেরিয়ে আসছে। এভাবে আমাদের সূত্র বলছে যে যদি এটি ওটিকে বোঝায় এবং যদি এটি সত্য হয়, তাহলে ওটিও সত্য হবে। অন্য কথায়, কোন সত্য বচন যা বোঝায় তা সত্য অথবা কোন সত্য বচন থেকে যা বেরিয়ে আসে তা সত্য।
এই সূত্রটি, অন্তত এর মূর্ত উদাহরণ, সমস্ত রকম প্রয়োগের ক্ষেত্রে সত্যিই জড়িয়ে থাকে। যখনই কোন একটি বিষয়, যা আমরা বিশ্বাস করি, তা অপর কিছুকে প্রমাণিত করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং ফলস্বরূপ যেটিকেও আমরা বিশ্বাস করি, তখনই এই সূত্রটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যদি কেউ প্রশ্ন কর, কেন আমি সত্য যুক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যুক্তিকে মেনে নেব? সেক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র আমাদের সূত্রের উপর নির্ভর করেই তার উত্তর দিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে এই সূত্রের সভ্যতায় সন্দেহ করা অসম্ভব এবং এর গ্রহণযোগ্যতা এতই বেশি যে প্রথম দর্শনে একে তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু এই সূত্রগুলো দার্শনিকের কাছে। তুচ্ছ নয়, কেননা এগুলো দেখায় যে আমরা এমন অভ্রান্ত জ্ঞান অর্জন করতে পারি। যা। সংবেদনের বিষয় থেকে কোনভাবেই গৃহিত হয়।
উপরের সূত্রটি অনেকগুলো স্বয়ংসিদ্ধ যৌক্তিক যুক্তির অন্যতম একটি। এগুলোর মধ্যে কিছু সূত্রকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে কোন যুক্তি বা প্রমাণ প্রদর্শনের পূর্বে। যখন কয়েকটি স্বীকৃত হয়, তখন অন্যগুলোকেও প্রমাণ করা যায়, যদিও এই সূত্রগুলো যতক্ষণ সরল থাকে ততক্ষণ স্বীকৃত সূত্রগুলোর মতই স্পষ্ট থাকে। প্রথাগত কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই, এদের মধ্যে তিনটি সূত্রকে আলাদা থাকে। প্রথাগত কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই, এদের মধ্যে তিনটি সূত্রকে আলাদা করা হয়েছে চিন্তার সূত্রাবলি নামে।
এগুলো হল নিম্নরূপ :
১. সমানতার নিয়ম। যা আছে, তা আছে।
২. বিরোধবাধক নিয়ম। কোন জিনিস একইসঙ্গে আছে এবং নেই হতে পারে না।
৩. নির্মধাম নিয়ম : সবকিছুই হয় আছে অথবা নেই।
এই তিনটি নিয়ম হল স্বয়ংসিদ্ধ তর্কসূত্রের উদাহরণ। কিন্তু এগুলো একই ধরনের অন্যান্য সূত্রের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা স্বয়ংসিদ্ধ নয়। যেমন, আমরা এখনই যার সম্বন্ধে আলোচনা করলাম, যেখানে বলা হয়েছে সত্য যুক্তিবাক্য থেকে যা বেরিয়ে আসে তা সত্য। চিন্তার সূত্রাবলি এই নামটিও বিভ্রান্তিকর, কেননা যা গুরুত্বপূর্ণ তা এই নয় যে আমরা এই সূত্রগুলো চিন্তা করি, বরং তা হল এই যে বিষয়গুলো সূত্র অনুসারে কাজ করে। অন্যভাবে বললে যখন আমরা এই যে বিষয়গুলো সূত্র অনুসারে কাজ করে। অন্যভাবে বললে যখন আমরা এই সূত্র অনুসারে চিন্তা করি, তখন আমরা সঠিক চিন্তা করি। কিন্তু এটি একটি বড় প্রশ্ন, যে বিষয়ে আমরা পরবর্তি সময়ে আলোচনা করব।
যে যৌক্তিক সূত্রগুলো আমাদের একটি যুক্তিবাক্য থেকে প্রমাণ করতে সাহায্য করে যে কোনকিছু অবশ্যই সত্য, সেগুলো ছাড়াও আরও যৌক্তিক সূত্র আছে যা আমাদের একটি যুক্তিবাক্য থেকে প্রমাণ করতে সাহায্য করে যে কোন কিছু সত্য তা বেশি বা কম সম্ভাব্য। এই রকম সূত্রের উদাহরণ হল–সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ-আরোহের সূত্রগুলো যা আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করেছি।
দর্শনের জগতে একটি ঐতিহাসিক বিবাদ হল দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ যারা অভিজ্ঞতাবাদী ও বুদ্ধিবাদী নামে পরিচিত। অভিজ্ঞতাবাদী সম্প্রদায়– যারা ব্রিটিশ দার্শনিক লক, বার্কলে এবং হিউমের দ্বারা সবচেয়ে ভালভাবে উপস্থাপিত-বলেন যে আমাদের সমস্ত জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে। বুদ্ধিবাদী সম্প্রদায়-যারা সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় দার্শনিকদের দ্বারা, বিশেষত ডেকার্ট ও লাইবনিজ দ্বারা উপস্থাপিত–বলেন যে অভিজ্ঞতার দ্বারা যে জ্ঞান আমরা লাভ করি তা ছাড়াও কিছু সহজাত ধারণা ও সহজাত নীতি আছে যা আমরা অভিজ্ঞতা ছাড়াই লাভ করি। এই দুটি পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায়ের মতামতের সত্যতা বা অসত্যতা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করা এখন সম্ভব। পূর্বে যে কারণগুলো বলা হয়েছিল সেই ভিত্তিতে এটা অবশ্যই স্বীকার করা যায় যে যৌক্তিক নীতিগুলোকে আমরা জানি, এবং অভিজ্ঞতার সাহায্যে এদের প্রমাণ করা যায় না, কেননা সমস্ত প্রমাণই এদেরকে আগে থেকেই ধরে নেয়। সুতরাং এই বিবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বুদ্ধিবাদীরা ঠিক বলছেন।
অন্যদিকে, আমাদের জ্ঞানের এমনকি সেই অংশ যা যৌক্তিকভাবে অভিজ্ঞতাপূর্ব (অভিজ্ঞতা একে প্রমাণ করতে পারে না) তাও অভিজ্ঞতার দ্বারাই উদ্দীপিত ও সংগঠিত হয়। কোন বিশেষ অভিজ্ঞতার জন্য আমরা এই সাধারণ সূত্রগুলো সম্পর্কে অবহিত হচ্ছি যা তাদের যোগাযোগকে প্রমাণ করছে। এটা মনে করা অবশ্য অবাস্তব যে সহজাত নীতি এই অর্থে আছে যে শিশুরা বয়স্কদের মতন সমস্ত জ্ঞান নিয়ে গ্রহণ করে এবং সেই জ্ঞান অভিজ্ঞতার থেকে নিঃসৃত হয় না। এই কারণে সহজাত কথাটিকে এখন আমাদের যৌক্তিক নীতি বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা হবে না। পূর্বতর্সিদ্ধ শব্দটি কম আপত্তিজনক এবং আধুনিক লেখকরা এটি বেশি ব্যবহার করেন। সুতরাং সমস্ত জ্ঞান অভিজ্ঞতার দ্বারা উদ্দীপিত ও সংগঠিত হয় একথা স্বীকার করেও, আমরা বলব যে কিছু জ্ঞান হল পূর্বতসিদ্ধ, এই অর্থে যে, যে অভিজ্ঞতা আমাদের এটি ভাবতে সাহায্য করে তা এটিকে প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, বরং আমাদের মনোযোগকে সেই দিকে ধাবিত করে যেখানে আমরা সত্যতাকে জানি অভিজ্ঞতার দ্বারা সংগৃহীত কোন প্রমাণ ছাড়াই।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যেখানে অভিজ্ঞতাবাদীরা বুদ্ধিবাদীদের থেকে সঠিক। অভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে জানা যায় না। অর্থাৎ যদি আমরা প্রমাণ করতে চাই যে কিছু জিনিস আছে যার সম্বন্ধে আমাদের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা হয় না, তাহলে আমাদের যুক্তিবাক্যের মধ্যে এক বা একাধিক বিষয়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে যার সম্বন্ধে আমাদের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা হয়। উদাহরণস্বরূপ, চীনের সম্রাটের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের যে বিশ্বাস তা সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে এবং সাক্ষ্য হল ইন্দ্রিয়-উপাত্তের দেখা বা শোনা, পড়া বা বলার মাধ্যম। বুদ্ধিবাদীরা বিশ্বাস করেন সাধারণ আলোচনা থেকে বিষয়টি কি হতে পারে, এটা বা ওটার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে কিনা তা তারা নিঃসৃত করতে পারেন। মনে হয় তাঁদের এই বিশ্বাস ভ্রান্ত। সমস্ত জ্ঞান যা আমরা অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্বতসিদ্ধভাবে জানি তা হল প্রকল্পমূলক : এটি আমাদের বলে যদি একটি বিষয়ের অস্তিত্ব থাকে তাহলে আরও একটি অবশ্যই থাকবে, বা আরও সাধারণভাবে, যদি একটি বচন সত্য হয়, তাহলে আরেকটিও সত্য হবে। এটি সেই নীতির দ্বারা সমর্থিত যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি, যেমন যদি এটি সত্য হয় এবং এটি বলে যে ওটিও সত্য, বা যদি এটি এবং ওটি বারবার একত্রে সংগঠিত হতে দেখা যায়, তাহলে তারা পরবর্তি ক্ষেত্রেও সম্ভবত সংযোজিত থাকবে যদি তাদের মধ্যে একজনকে সেখানে পাওয়া যায়। এভাবে পূর্বতসিদ্ধ নীতিগুলোর ক্ষেত্র ও শক্তি অত্যন্ত সীমিত। কোন কিছুর অস্তিত্ব সংক্রান্ত সমস্ত জ্ঞান অবশ্যই কিছু অংশে অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। যখন কোন কিছু তাৎক্ষণিতভাবে জানা যায়, তার অস্তিত্ব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল; যখন কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়, তাৎক্ষণিকভাবে না জেনেই, তখন তার প্রমাণের জন্য অভিজ্ঞতা এবং পূর্বতসিদ্ধ নীতির অবশ্যই প্রয়োজন হয়। জ্ঞানকে ব্যবহারিক বলা হয় যখন এটি সম্পূর্ণ বা অংশত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। এভাবে সমস্ত জ্ঞান যা অস্তিত্বকে স্বীকার করে তাহলে ব্যবহারিক এবং একমাত্র বিষয় সম্পর্কে পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান হল প্রকল্পমূলক, যা বিষয়ের মধ্যে সম্বন্ধকে স্থাপন করে থাকতেও পারে বা না-ও পারে, কিন্তু বাস্তব অস্তিত্ব দেয় না।
এতক্ষণ আমরা যা আলোচনা করছিলাম সেসব পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান সবই যৌক্তিক নয়। সম্ভবত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অযৌক্তিক পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের উদাহরণ হল নৈতিক গুণের জ্ঞান। আমি কোন বিষয় প্রয়োজনীয় বা কোনটি সৎ এরকম বচনের কথা বলছি না, কেননা এরকম বচনগুলো অভিজ্ঞতভিত্তিক বাক্যের উপর নির্ভরশীল। আমি সেই বচনের কথা বলছি যে বিষয়ের অন্তর্নিহিত কাম্যতা রয়েছে। যদি কোন কিছু প্রয়োজনীয় হয় তাহলে তা অবশ্যই প্রয়োজনীয় যেহেতু এটি কোন লক্ষ্যে পৌঁছায়। এই লক্ষ্য অবশ্যই-যদি আমরা ততদূর যাই নিজের গুণের জন্যই গুণবান হবে এবং শুধুমাত্র কোন লক্ষ্যের জন্যই প্রয়োজনীয় হবে না। এভাবে সমস্ত বচনের প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করে সেসব বচনের উপর যার নিজস্ব গুণ আছে।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা মনে করি যে দুঃখের থেকে সুখ অনেক বেশি কাম্য, অজ্ঞানতার থেকে জ্ঞান, ঘৃণার থেকে সদিচ্ছা ইত্যাদি। এই ধরনের বিচার অন্তত কিছু অংশে অবশ্যই তাৎক্ষণিক ও পূর্বতসিদ্ধ হবে। আমাদের পূর্ববর্তি পূর্বতসিদ্ধ বচনের মতন, এরাও অভিজ্ঞতার দ্বারা উদ্দীপিত হবে এবং অবশ্যই হতে হবে, কেননা কোন কিছুর অন্তর্নিহিত গুণ বিচার করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না আমাদের ওই একই ধরনের কোন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। কিন্তু এটা পরিস্কার যে অভিজ্ঞতা দিয়ে এদের প্রমাণ করা যায় না, কেননা কোন বস্তুর অস্তিত্ব অনস্তিত্ব প্রমাণ করে না যে এটি ভাল বলে এর থাকা উচিত অথবা এটি খারাপ। এই বিষয়টির অনুধাবন নীতিবিদ্যার আওতায় পড়ে, যেখানে কোন কিছুর থেকে কোন কিছুর থাকা উচিত এরকম অসম্ভব নিঃসৃতকরণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমান প্রসঙ্গে এটি বুঝা প্রয়োজনীয় যে অন্তর্নিহিত মূল্যের যে জ্ঞান তা সেই অর্থের পূর্বতসিদ্ধ যে অর্থে যুক্তিবিজ্ঞান পূর্বতসিদ্ধ, অর্থাৎ এধরনের জ্ঞানের সত্যতা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হতে পারে না।
সমস্ত শুদ্ধ গণিত হল যুক্তি বিজ্ঞানের মতই পূর্বতসিদ্ধ। অভিজ্ঞতাবাদীরা এটি জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন। তারা বলেন অভিজ্ঞতা ঠিক সেইভাবেই গণিতের জ্ঞানের উৎস যেভাবে তা ভূগোলের জ্ঞানের উৎস। তারা বলেন যে বারবার দুটি বিষয় এবং দুটি অন্য বিষয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝা যায় যে উভয়ে মিল চার হয় এবং এ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসি যে দুটি বিষয় এবং দুটি অন্য বিষয় সর্বদাই একত্রে চারটি বিষয় তৈরি করে। যদি এটাই আমাদের জ্ঞানের উৎস হয় যে দুই আর দুইয়ে চার হয়, তাহলে আমরা এর সত্যতা অনুসরণ করার জন্য যেভাবে আমরা প্রকৃতপক্ষে অগ্রসর হই তার থেকে অন্যভাবে অগ্রসর হব। আসলে কিছু সংখ্যক উদাহরণ আমাদের এই দুইকে বিমূর্তভাবে ভাবতে সাহায্য করে, দুটি মুদ্রা বা দুটি বই বা দুটি লোক বা অন্য কিছু নির্দিষ্ট দুই-এর ধারণা ছাড়া। কিন্তু যে মুহূর্তে আমরা আমাদের চিন্তাকে অপ্রয়োজনীয় বিশেষত্বের হাত থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম হই, তখনই আমরা দুই আর দুই মিলে চার এই সাধারণ ধারণা উপলব্ধি করতে পারি; যে কোন একটি ক্ষেত্রে প্রতিরূপ বিশেষ হয়ে দাঁড়ায় এবং পরীক্ষার পর অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
এই একই ব্যাপার জ্যামিতির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব। যদি আমরা সমস্ত ত্রিভুজের কিছু গুণ প্রমাণ করতে চাই, তাহলে আমরা কোন একটি ত্রিভুজ একে তার সম্বন্ধে চিন্তা করি। কিন্তু যেসব গুণের ব্যাপারে এই ত্রিভুজটি অন্য সব ত্রিভুজের অংশীদার নয় সেগুলোকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি এবং এভাবে, এই বিশেষ ক্ষেত্রে, সাধারণ ফল লাভ করতে পারি। আসলে আমরা দুই আর দুই মিলে যে চার হয় তা আরও নতুন উদাহরণ সাহায্যে বাড়িয়ে নিশ্চিত হতে পারি না, কেননা যখনই আমরা এই বচনের সত্যতা সম্পর্কে অবহিত হই, তখনই আমাদের নিশ্চয়তা এত বেড়ে যায় যে আর বাড়ার সম্ভাবনা থাকে না। এছাড়া আমরা দুই আর দুই মিলে চার এই বচনের অনিবার্যতাও অনুভব করি, যা সব থেকে বেশি নিশ্চিত অভিজ্ঞতাবিত্তিক সামান্যকরণের মধ্যেও অনুপস্থিত।
এই ধরনের সামান্যকরণ সবসময় শুধু ঘটনাই থেকে যায়ঃ আমরা অনুভব করি এরকম কোন জগৎ হয়তো আছে যেখানে এর মিথ্যা, যদিও বাস্তব জগতে এরা সত্য বলেই পরিচিত। অন্যদিকে যে কোন সম্ভাব্য জগতে, আমরা মনে করি দুই আর দুই মিলে চার হবে এটা কোন একমাত্র ঘটনা নয়, বরং তা একটি অনিবার্য যাকে সমস্ত বাস্তব ও সম্ভাব্য অবশ্যই অনুমোদন করে।
এই ঘটনাটি আরও পরিষ্কার হবে একটি প্রকৃত ব্যবহারিক সামান্যীকরণের উদাহরণ আলোচনা করলে, যেমন সব মানুষ হল মরণশীল। প্রথমত, এটি স্পষ্ট যে আমরা এই বচনটি বিশ্বাস করি কেননা এ রকম কোন জানা ক্ষেত্র নেই যেখানে মানুষ একটি বিশেষ বয়সের পরও বেঁচে আছে, এবং দ্বিতীয়ত মানুষের দেহের মতো যে কোন জৈবিক জীবদেহ অবশ্যই আগে বা পরে নষ্ট হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে এবং শুধুমাত্র মানুষের মরণশীলতা সম্পর্কে। আমাদের অভিজ্ঞতা আলোচনা করলে, এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে আমরা শুধুমাত্র একটি মানুষের মরণের ক্ষেত্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। অপরপক্ষে, দুই আর দুই চার এই ক্ষেত্রে একটি উদাহরণই আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারে, যখন সাবধানতার সঙ্গে আলোচিত হয় যে এই একই ঘটনা অন্য ক্ষেত্রেও ঘটবে। এছাড়াও চিন্তা করে আমরা করতে বাধ্য হই যে যত সামান্যই হোক না কেন, সব মানুষ যে মরণশীল সে ব্যাপারে কিছু সংশয় আছেই। এই ব্যাপারটি দুটি ভিন্ন জগৎ কল্পনা করে বুঝা যেতে পারে, যেখানে একটিতে মানুষের মরণশীল নয় এবং আরেকটিতে দুই আর দুই মিলে পাঁচ হয়। যখন সুইফট আমাদের আমন্ত্রণ জানান স্ট্রাড্রাগের প্রজাতি সম্পর্কে ভাবতে যারা কখনও মরে না, তখন আমরা সেটি কল্পনা করতে পারি। কিন্তু যে জগতে দুই আর দুই পাঁচ তা সম্পূর্ণ অন্য ক্ষেত্রে নিয়ে যায়। আমরা মনে করি এ রকম কোন জগৎ যদি থাকে, তাহলে তা আমাদের জ্ঞানের সমস্ত দিককেই বিভ্রান্ত করে দেয় এবং আমাদেরকে চরম সন্দেহে পৌঁছে দেয়।
আসলে সরল গাণিতিক বিধানের ক্ষেত্রে যেমন দুই আর দুই চার এবং বহু যৌক্তিক বিধানের ক্ষেত্রে আমরা কোন উদাহরণের থেকে অনুমান না করেও সাধারণ বচন থেকে জানতে পারি, যদিও কিছু উদাহরণ সাধারণত প্রয়োজনীয় হয় আমাদের এটা বুঝাতে যে সামান্য বচন কি অর্থ বহন করে। অবরোহের প্রকৃত প্রয়োজনীতা এখানেই, যা সামান্য থেকে সামান্যে বা সামান্য থেকে বিশেষে যায়, একইভাবে আরোহের ক্ষেত্রেও যা বিশেষ থেকে বিশেষে বা বিশেষ থেকে সামান্যে উপনীত হয়। এটি দার্শনিকদের মধ্যেকার একটি পুরনো বিতর্ক যে অবরোহ কখনও নতুন জ্ঞান দিতে পারে কিনা। এখনও আমরা দেখতে পাব কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই এটি নতুন জ্ঞান দেয়। যদি আমরা আগে থেকেই জানি যে দুই আর দুই সর্বদা চার তৈরি করে এবং যদি আমরা যে জানি ব্রাউন ও জোনস হল দুজন এবং রবিনসন ও স্মিথও দুজন, তাহলে আমরা নিঃসৃত করতে পারি যে ব্রাউন, জোনস, রবিনসন ও স্মিথ হল চারজন। এটি হল নতুন জ্ঞান যা আমাদের যুক্তিবাক্যে নিহিত ছিল না, জোনস, রবিনসন ও স্মিথ নামে ব্যক্তিরা আছে, এবং বিশেষ যুক্তিবাক্যও আমাদের বলে না যে তারা হল চারজন, যেক্ষেত্রে নিঃসৃত হওয়া বিশেষ বচনটি আমাদের এই উভয় সম্পর্কেই অবহিত করে।
কিন্তু এই জ্ঞানের নতুনত্ব কম নিশ্চিত হয় যদি আমরা যুক্তিবিজ্ঞানের বইতে প্রদত্ত অবরোহের উদাহরণগুলো গ্রহণ করি, যেমন সব মানুষ হয় মরণশীল, সক্রেটিস একজন মানুষ, সুতরাং সক্রেটিস হলেন মরণশীল। এই ক্ষেত্রে যা আমরা সুন্দহাতীতভাবে জানি তা হল কিছু ক, খ, গ ব্যক্তি মরণশীল যেহেতু সত্যিই তারা মৃত যদি সক্রেটিস এই ব্যক্তিদের একজন হন, তাহলে সব মানুষ হয় মরণশীল-এর মধ্যে ঘুরে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বোকামি হবে যে সক্রেটিস সম্ভবত মরণশীল। যদি সক্রেটিস এই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন না হন যার উপরে আমাদের আরোহ দাঁড়িয়ে আছে, তাহলেও আমরা সোজাসুজি ক, খ, গ থেকে সক্রেটিসে পৌঁছাতে পারি, সব মানুষ হয় মরণশীল এই সামান্য বচনের মাধ্যমে না গিয়ে।
আমাদের সংগৃহীত উপাত্ত সক্রেটিসের মরণশীলতার সম্ভাব্যতাকে সব মানুষ হয় মরণশীলের সম্ভাব্যতার থেকে বেশি জোরদার করে (এটি একান্তই স্পষ্ট, কেননা যদি সব মানুষ মরণশীল হয় মরণশীল হয় তাহলে সক্রেটিসও হবেন, কিন্তু যদি সক্রেটিস মরণশীল হন তাহলে এটা অনুসৃত হয় না যে সব মানুষই মরণশীল)। এভাবে আমরা বেশি নিশ্চয়তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে সক্রেটিস হলেন মরণশীল যদি আমরা যুক্তিবাক্যকে সম্পূর্ণ আরোহের সাহায্যে ব্যাখ্যা করি, অবরোহের সাহায্য নিয়ে সমস্ত মানুষ হয় মরণশীল এই যুক্তিতে না গিয়ে।
এই বিষয়টি সামান্য বচন যা পূর্বতসিদ্ধ বলে পরিচিত যেমন দুই আর দুই চার এবং ব্যবহারিক সামান্যীকরণ যেমন সব মানুষ হয় মরণশীল–এই দুইয়ের পার্থক্যকে সূচিত করে। প্রথমোক্ত বিষয়ে অবরোহ হল যুক্তিবিন্যাসের সঠিক পদ্ধতি এবং শেষোক্ত বিষয়টিতে অবরোহ সর্বদাই তত্ত্বগতভাবে গ্রহণযোগ্য, এবং আমাদের সিদ্ধান্তের সত্যতাকে এটি বেশ আস্থা দেয়, কেননা সমস্ত ব্যবহারিক সামান্যীকরণই তাদের উদাহরণের থেকে বেশি অনিশ্চিত হয়।
এখানে আমরা দেখলাম যে পূর্বতসিদ্ধ বলে বচন আছে এবং এই বচনের মধ্যে যুক্তিবিজ্ঞানের ও শুদ্ধ গাণিতিক বচনও রয়েছে, সেইসঙ্গেই আছে নীতিবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ বচনও। পরবর্তী যে প্রশ্নটি আমাদের আলোচনা করতে হবে তা হল : এটা কিভাবে সম্ভব যে এরকম জ্ঞান হতে পারে? এবং বিশেষত, কিভাবে সেসব বিষয়ের সামান্য বচনের জ্ঞান হতে পারে যার সমস্ত ক্ষেত্র পরীক্ষিত হয়নি এবং পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, কেননা তাদের সংখ্যা হল অগণিত? এই সমস্ত প্রশ্ন সর্বপ্রথম পাদপ্রদীপে আনেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪–১৮০৪), যা খুবই দুরূহ এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।