০৭. সাইকিয়াট্রিস্টের নাম জয়েনউদ্দিন

সাইকিয়াট্রিস্টের নাম জয়েনউদ্দিন। আখলাক সাহেব এত বেঁটে মানুষ তাঁর জীবনে দেখেন নি। ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। টেবিলের উপর দিয়ে তাঁর চোখ দুটি শুধু বের হয়ে আছে। পাশাল পাগল ধরনের চোখ। ভদ্রলোক বসে আছেন একটা রোলিং চেয়ারে। স্থির হয়ে বসে নেই, সারাক্ষণ এদিক ওদিক করছে। চিড়িয়াখানার পশুদের যারা দেখাশোনা করে তাদের চেহারা এবং স্বভাব চরিত্র খানিকটা চিড়িয়াখানার পশুদের মতো হয়ে যায়। মিরপুর চিড়িয়াখানায় যে লোকটা জিরাফের দেখাশোনা করে তার গলাটা প্ৰতিবছর কিছুটা করে লম্বা হয়। সাইকিয়াট্রিক্টরা পাগলের চিকিৎসা করেন, কাজেই তাদের হাব ভাব পাগলদের মতোই হবে বলাই বাহুল্য। আখলাক সাহেব বেশ কৌতূহল নিয়ে সাইকিয়াট্রিক্ট জালালউদিনের চেয়ারে নড়াচড়া দেখছেন। ভদ্রলোক যেমন স্থির হয়ে বসতে পারেন না তেমনি স্থির চোখে তাকাতেও পারেন না। মনে হয় দুটা মাত্র চোখ থাকায় তার খুব অসুবিধা হচ্ছে। গোটা চারেক চোখ থাকলে সুবিধা হতো। আরাম করে এক সঙ্গে চারদিক দেখতে পারতেন।

তাহের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, জালাল সাহেব আমি পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি আমার স্ত্রী বা বড়ভাই, নাম আখলাক হোসেন। অধ্যাপনা করেন। আপনাকে তার কথা বলেছিলাম।

জালাল সাহেব হাসি মুখে বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা। বলেছিলেন তো বটেই। উনার কাছেই একটা ভূত আসে। গল্প গুজব করে। তাই না? ভূতের নাম লেখক সাতচল্লিশ।

আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, সাতচল্লিশ না চুয়াতুর।

ও আচ্ছা, আমার আবার সংখ্যা মনে থাকে না। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। আরাম করে বসুন। আজ অবশ্যি আমার হাতে সময় খুব কম। আমার মেয়ের জন্মদিন। এখান থেকে সরাসরি গুলশানে একটা খেলনার দোকানে যাব। খেলনা কিনব। কী কিনব ভেবে পাচ্ছি না। গত আধা ঘণ্টা ধরে শুধু তাই ভাবছি। তার পছন্দের খেলনা হচ্ছে বারবি ডল। গোটা বিশেক তার আছে বলে আমার ধারণা। আরো গোটা বিশেক পেলেও শখ মিটবে না। বারবি ডলই আজ আরেকটা কিনব। যাহা বাহান্ন তাহা একাশি।

আখলাক সাহেব বসলেন। সাইকিয়াট্রিস্টের মাথা যে পুরোপুরি খারাপ তা বোঝাই যাচ্ছে। অকারণে এতগুলি কথা বলল। যাহা বাহান্ন তাহা একাশি আবার কী?

সাইকিয়াট্রিক্ট আখলাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ভূতের ব্যাপারটা কী পরিষ্কার করে বলুন তো। কিছুই বাদ দেবেন না। তবে সংক্ষেপ করে বলবেন। হাতে একদম সময় নেই। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। একটা খেলনা কিনতে হবে। বারবি ডল।

আখলাক সাহেব চুপ করে রইলেন। লোকটার সঙ্গে তাঁর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। যে লোক সারাক্ষণ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, এক মিনিটের মধ্যে দুবার মেয়ের জন্মদিনের কথা বলছে তার সঙ্গে কথা বলবেন কী?

ভূতটা কি রোজ। আপনার কাছে আসে?

মাঝে মাঝে আসে।

দেখতে কেমন?

দেখতে ভূতের মতো।

সেই ভূতের মতোটাই কেমন? লম্বা, না বেঁটে। কালো না সাদা? বড় বড় দাঁত না ছোট ছোট দাতা? মাথায় চুল আছে না। টাক মাথা?

জানি না।

জানেন না কেন? আপনি কি তাকে দেখেন নি?

জি না। অন্ধকারে সে আসে। অন্ধকারে তাকে দেখব কীভাবে? আমি তো বিড়াল না। যে অন্ধকারে দেখব।

তাতো ঠিকই। আচ্ছা ভূতটা সম্পর্কে কিছু বলুন তো।

কী বলব?

তার স্বভাব চরিত্র। তার আচার-আচরণ। সে বোকা না বুদ্ধিমান–এইসব আর কী? আপনার কি ধারণা সে বুদ্ধিমান?

সে যথেষ্টই বুদ্ধিমান।

আপনার চেয়েও বুদ্ধিমান?

সেটা বুঝব কী করে?

সহজেই বোঝা যায়। যেমন ধরুন। একটা ধাঁধা আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো। আপনি সেটা পারলেন না। কিন্তু ভূতকে জিজ্ঞেস করা মাত্র সে পারল। তখন বুঝতে হবে ভূতটা বুদ্ধিমান।

আমি ভুতকে কখনো কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করি নি।

পরের বার যখন দেখা হবে, দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন। এমন একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করবেন যার উত্তর আপনার জানা নেই।

উত্তর জানা নেই এরকম ধাঁধা। আমি নিজেও জানি না। আমি যে সব ধাঁধা জানি তার উত্তরও জানি।

আমি আপনাকে একটা ধাঁধা শিখিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা এই ধাঁধার উত্তর আপনি জানেন না।

বাঘের মতো লাফ দেয়
কুকুবেব মতো বসে।
লোহার মতো জলে ড়ুবে
শোলার মতো ভাসে।

অর্থাৎ অদ্ভুত একটা জিনিস যে বসে কুকুরের মতো, কিন্তু লাফ দেয় বাঘের মত। পানিতে লোহার মতো টুপ করে ড়ুবে যায়, আবার শোলার মতো অবলীলায় ভাসে। আপনি কি জানেন জিনিসটা কী?

জি না।

তাহের সাহেব, আপনি জানেন?

জি না।

সাইকিয়াট্রিক্ট হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে কঠিন একটা ধাঁধা দিতে পেরে তিনি আনন্দিত। আখলাক সাহেবের মনে হলো তার আগে এই ভদ্রলোকের চিকিৎসা হওয়া উচিত।

আখলাক সাহেব।

জি।

আপনার ভূতের ব্যাপার সবটাই আমি জানি। তাহের সাহেব আমাকে খুব গুছিয়ে সব বলেছেন। তবু আপনার মুখ থেকে শোনা দরকার। এত লোক থাকতে ভূতটা আপনার কাছে আসে। কেন বলুন তো?

ও একটা সমস্যায় পড়েছে। সমস্যার সমাধানের জন্যে আমার কাছে আছে।

সমস্যাটা কী?

ওর বাবা-মা ওকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে, ও বিয়ে করতে চাচ্ছে না। ও ঠিক করেছে চিরকুমার থাকবে।

আমি যতদূর জানি আপনারও একই সমস্যা, তাই না? আপনার আত্মীয়স্বজন আপনাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে, আপনি রাজি না। আপনিও ঠিক করেছেন চিরকুমার থাকবেন। ঠিক তো?

আখলাক সাহেব চুপ করে রইলেন। সাইকিয়াট্রিক্ট বললেন, আপনার সমস্যা খুব সহজ সমস্যা। আপনার অবচেতন মনের চিন্তা-ভাবনাই ভূত হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। অন্য কিছু না। সময় থাকলে আরো পরিষ্কার করে আপনাকে বুঝিয়ে দিতাম। আজ আমার একটু কাজ আছে, আপনাকে বেশি সময় দিতে পারছি না। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। না গেলেই না। সাতটার সময় যাওয়ার কথা ছিল। আটটা বেজে গেছে। আমাকে একটা খেলনার দোকানে যেতে হবে। খেলনা কিনতে হবে। আর দেরি করা যাবে না। আখলাক সাহেব, আপনি পরেরবার আসবেন। আপনার ভূত সমস্যার সমাধান করে দেব। ভালো কথা ধাঁধার উত্তর ভূতের কাছ থেকে নিয়ে আসবেন।

আখলাক সাহেব বললেন, জি আচ্ছা। তার মাথার মধ্যে ধাঁধা ঘুরতে লাগল।

বাঘের মতো লাফ দেয়
কুকুবেব মতো বসে।
লোহার মতো জলে ড়ুবে
শোলার মতো ভাসে।

আশ্চর্য তো! জিনিসটা কী?

সাইকিয়াট্রিন্টের চেম্বার থেকে বের হয়ে তাহের বলল, ভাই সাহেব, আপনি দয়া করে আজ রাতটা আমার বাসায় থাকুন। আখলাক সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন?

আপনার বাসায় কাজের লোক নেই। মোতালেব চলে গেছে, রান্না বান্না…

এইসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

তারচেয়ে বড় কথা ভূতটা আবারো আপনাকে বিরক্ত করবে। আপনার এখন বিশ্রাম দরকার। ঘুম দরকার। ভূতটা তো আর আমার বাসা চেনে না। আমার বাসায় থাকলে সে আর আপনাকে বিরক্ত করতে পারবে না। ওর সঙ্গে তাহলে আর আপনার দেখা হবে না। আপনার ঘুমে ডিসটর্ব করতে পারবে না।

আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, বোকার মতো কথা বলো না তো তাহের। ভূতটার সঙ্গে দেখা হওয়া আমার বিশেষ দরকার। ওকে ধাঁধার উত্তর জিজ্ঞেস করতে হবে। তা ছাড়া সে দেখতে কেমন তাও জানি না। দেখা দরকার।

 

আখলাক সাহেব রাতে খাওয়া দাওয়ার পর শুয়েছেন। নিজে কিছু রাধেন নি। হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন। অতি অখাদ্য খাবার। মনে হচ্ছে ফুড পয়জনিং হয়ে যাবে। আখলাক সাহেব ভূতের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ভূত আসছে না। ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। আখলাক সাহেব চিন্তিত বোধ করছেন। ঝড় বৃষ্টিতে ভূতরা আসে কি না তা তিনি জানেন না। বৃষ্টিতে তাদের কি অসুবিধা হয়? তাদের কি ছাতা আছে? অনেক কিছুই তিনি তাদের সম্পর্কে জানেন না। ভূত সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। ভূত-এনসাক্লোপিডিয়া জাতীয় একটা বই থাকা দরকার ছিল। বৃষ্টির শব্দে তাঁর ঘুম এসে যাচ্ছে। চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে।

স্যার জেগে আছেন?

আখলাক সাহেব পোশ ফিরলেন। ভূতের কথা শুনে তাঁর ভালো লাগছে। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর চোখ থেকে ঘুম চলে গেল।

স্যারের কাচা ঘুম ভাঙলাম না তো?

না, আমি জেগেই ছিলাম। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

শুনে বড় ভালো লাগল স্যার। আপনার কোনো খেদমত কি করতে পারি?

প্রথমে একটা ধাঁধার জবাব দাও, নয় তো কথায় কথায় ভুলে যেতে পারি। ধাঁধাটা হচ্ছে–

বাঘের মতো লাফ দেয়
কুকুবেব মতো বসে।
লোহার মতো জলে ড়ুবে
শোলার মতো ভাসে।

এটা স্যার ব্যাঙ। ব্যাঙ বসে ঠিক কুকুরের মতো। লাফ দেয় বাঘের মত। পানিতে ড়ুবতে পারে আবার ভাসতেও পারে। ধাঁধা জিজ্ঞেস করছেন কেন স্যার?

আছে একটা ব্যাপার।

আমাকে বলা যাবে না?

এক ভদ্রলোক আমাকে ধাঁধাটা জিজ্ঞেস করেছিল, আমি উত্তর দিতে পারি নি।

এতে কি স্যার আপনার মন খারাপ হয়েছে?

একটু হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে আমার বুদ্ধি ভূতদের চেয়ে কম।

সব ভূতের চেয়ে কম না। স্যার, কিছু কিছু ভূতের চেয়ে কম। যেমন ধরুন আমার চেয়ে কম। তাতে লজ্জা বা অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। ভূতদের মধ্যে আমার জ্ঞান বেশি। আবার মহামুর্থ ভূতও আছে।

তোমাদের মধ্যে পাগল নেই?

পাগল?

হ্যাঁ পাগল। মানুষের মধ্যে যেমন পাগল আছে, পাগলের ডাক্তার আছে, তোমাদের মধ্যে সেরকম কিছু নেই?

আছে। মানুষের সঙ্গে আমাদের তেমন কোনো বেশিকম নেই। আপনারা যেমন কারো উপর রেগে গেলে বলেন, ব্যাটা ভূত, আমরাও তেমনি কোনো ভূতের উপর রেগে গেলে বলি, ব্যাটা মানুষ।

তাই নাকি?

জি স্যার। এ ছাড়াও আরো মিল আছে–যখন আপনারা খুব ব্যস্ত থাকেন তখন বলেন–হাতে সময় নেই। আমরা বলি–পায়ে সময় নেই।

আশ্চর্য তো।

আশ্চর্য হবার কিছুই নেই স্যার। ভূত ও মানুষ এক সুতায় গাঁথা। এই জন্যেই মহাকবি–ক–৫০০০০০০০ বলেছেন—

ভূ মা
এ মা–

আখলাক সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, এর মানে কী?

ভু মা মানে হচ্ছে–ভূত ও মানুষ। এ ম মানে হচ্ছে–এক সুতায় গাঁথা মালা। অসাধারণ একটা কবিতা না স্যার?

বুঝতে পারছি না। আমি আবার কবিতা ভালো বুঝি না।

আখলাক সাহেব বললেন, আরেকটা কী যেন কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। এখন মনে পড়ছে না।

চারপায়ে একটু হাঁটাহাঁটি করুন, মনে পড়বে।

ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। ভূত মেয়েটার খবর কী? ফা-৪০।

ওর কথা মনে করিয়ে মেজাজটা খারাপ করে দিলেন। আমার জীবন সে অতিষ্ঠা করে তুলেছে। মহাকবি ক–৫০০০০০০০ এর ভাষায়,

জী য়
জী ময়–

মানে কী?

মানে হচ্ছে— জীবন দুঃখময়, জীবন মহাদুঃখময়। ফা-৪০ এখন সারা আমার পিছ ছাড়ছে না। এই যে আমি আপনার কাছে এসেছি সেও এসেছে। জানালার ওপাশে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের প্রতিটি কথা শুনছে। স্যার, যাকে বলে মহাসমস্যা। আপনি কি তার সঙ্গে একটু কথা বলবেন?

আমি কী বলব?

একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলবেন। ওকে ভেতরে আসতে বলব স্যার?

বলো।

না, আপনিই বলুন। আমার ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। ফা-৪০ বলে ডাক দিন চলে আসবে।

ওকে কী বলব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

আমাকে যেন মুক্তি দেয় এইটুকু বলবেন। এর বেশি কিছু আমি চাই না। আমার জীবন রক্ষা করুন স্যার। আমি চিরঞ্চণী হয়ে থাকব। আমি স্যার এখন চলে যাচ্ছি। ওর সঙ্গে এক ঘরে থাকা আমার সম্ভব না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আমি মরে যাব। যাবার আগে একটা কথা বলে যাই সার। এই মেয়ে কিন্তু মহাবুদ্ধিমতী। যুক্তিতে তার সঙ্গে পারা কঠিন। তার সঙ্গে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হবে।

আখলাক সাহেব ডাকলেন, ফা-৪০।।

জানালার পর্দা একটু কঁপিল। আখলাক সাহেবের মনে হলো তীর মশারির পাশে কে যেন এসে বসল। তাঁর মেজাজ এখন কিছুটা খারাপ, এ-কী যন্ত্রণা! তাঁর নিজের সমস্যারই কুল কিনারা নেই। তাঁকে দেখতে হচ্ছে ভূতদের সমস্যা।

তুমি কি ফা-8०?

আমি ফা-৪০ হব কেন? আমার নাম হ্রিহ্রিলা। ফা-৪০ কারো নাম হয়?

তবে যে আমি শুনলাম..

ওর কাছে যা শুনেছেন সবই ভুল শুনেছেন। ওর মাথাটা হয়ে গেছে খারাপ। নিজের মাথা তো খারাপ হয়েছেই, অন্যের মাথাও খারাপ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। আপনারটাও প্ৰায় খারাপ করে এনেছে।

আমারটাও খারাপ করে এনেছে?

অবশ্যই। চারপায়ে হাঁটাহঁটি করছেন। এটা মাথা খারাপের লক্ষণ না? আপনি কি গরু না ছাগল যে চারপায়ে হাঁটবেন? ডাবউইনের থিওরি তো আপনি পড়েছেন, পড়েন নি?

আখলাক সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তেমনভাবে পড়ি নি। তবে মোটামুটি জানি।

মোটামুটি জানলে তো আপনার জানা থাকব কথা–প্ৰাণী বিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষ এসেছে। তার পূর্বপুরুষ এক সময় চারপায়ে হাঁটত। আপনি সেখানেই ফিরে যাচ্ছেন। এটা একটা লজাব কথা না?

আখলাক সাহেব দারুণ অস্বস্তি নিয়ে খুকগুক করে কাশতে লাগলেন। হ্রিহ্রিলা মেয়েটি তো আসলেই জটিল। ওব সঙ্গে আরো সাবধানে কথা বলতে হবে। হ্রিহ্রিলা বলল, ও কেমন পাগল সেটা কি স্যার আপনি দয়া করে একটু শুনবেন?

বলো।

রোজ সে আপনার কাছে আসছে। আপনাকে বিরক্ত করছে। আবার ওদিকে একটা বই লিখছে, যে বইয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে–মানুষ বলে কিছু নেই, মানুষ হলো ভূতের মাথার दgन्म!

বলো কী!

যা সত্যি সেটাই স্যার আপনাকে বলছি।

আখলাক সাহেব রীতিমত ধাঁধায় পড়ে গেলেন। কী বলবেন কিছু বুঝতে পারলেন না। হ্রিহ্রিলা বলল, ওর মাথায় স্যার পদাৰ্থ বলে এখন কিছুই নেই। আপনাকে নিয়ে সবাই যেমন হাসাহাসি করে, ওকে নিয়েও করে। আমার এমন কষ্ট হয়!

আখলাক সাহেব বললেন, তুমি একটু ভুল বলেছ হ্রিহ্রিলা, আমাকে নিয়ে কেউ হাসাহসি করে না।

অবশ্যই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কলেজ থেকে আপনাকে ছুটি দিয়েছে। আপনাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। নিয়ে যায় নি?

হুঁ।

আপনাকে নিয়ে শুধু যে হাসাহাসি করে তাই না, আপনাকে ভয়ও করে।

ভয় করে?

অবশ্যই ভয় করে।

আপনার কাজের ছেলে মোতালেব আপনাকে ছেড়ে চলে গেল কেন? আপনাকে ভয় পাচ্ছে বলেই চলে গেছে।

হুঁ।

এখন আপনার যারা অতি কাছের তারা আপনাকে ভয় পাচ্ছে। কিছুদিন পরে দেখা যাবে সবাই ভয় পাবে। ভয় হচ্ছে সংক্রামক। সবাই আপনাকে ভয় পেতে শুরু কবলে আপনিও সবাইকে ভয় পেতে থাকবেন।

হুঁ।

আপনার স্যার মহাদুঃসময়।

হুঁ।

আপনার এখন কী করা উচিত তা কি স্যার জানেন?

না।

প্ৰাণপণে চেষ্টা করা উচিত।ভোভোহাম্বর কাছ থেকে দূরে থাকা।

ভোভোহা কে?

যাকে আপনি লেখক-৭৪ নামে চেনেন সে-ই হলো ভোভোহা। এটাই তার আসল নাম। ভূতদের নামকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে সে যা বলেছে সবই বানানো। তার উর্বর মাথার কল্পনা। আমার নাম দিয়েছেন ফা-৪০, ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা।

আখলাক সাহেব কী বলবেন ভেবে পেলেন না। মাথা চুলকাতে লাগলেন। মেয়েটাকে তার পছন্দ হচ্ছে। ভূত হলেও চমৎকার মেয়ে। ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে।

স্যার।

হুঁ।

আপনাদের শহরের ট্রাকের পেছনে যেমন লেখা থাকে–১০০ গজ দূরে থাকুন। আপনিও অবশ্যই ভেভোহার কাছ থেকে ১০০ গজ দূরে থাকবেন। নয় তো আপনার ভয়াবহ বিপদ।

দূরে থাকব কী করে? রাত হলেই তো সে চলে আসবে।

সেই সমস্যার সমাধানও স্যার আছে।

বলো, কী সমাধান।

আমার সমাধান কি আপনি শুনবেন? আমি আপনার কে?

আখলাক সাহেব বললেন, তুমি আমার মেয়ের মতো। বলে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলেন। ভূতকে তিনি বলছেন, তুমি আমার মেয়ের মতো। তাঁর মাথা তো আসলেই খারাপ হয়ে গেছে। হ্রিহ্রিলা গাঢ় গলায় বলল, মেয়ে যখন বলেছেন তখন আপনার মঙ্গল দেখার দায়িত্ব আমার। চাচাজান, আপনি আমার কথা শুনুন। আপনার ভূত মেয়ের কথা আপনাকে শুনতেই হবে।

আখলাক সাহেব বললেন, বিলো মা কী কথা।

এটা বলে তিনি আবারো চমকালেন। একটা ভূত মেয়েকে তিনি মা ডাকছেন, কী আশ্চর্য কথা।

চাচাজান।

হুঁ।

আপনি একটা বিয়ে করুন চাচাজান।

সে কী?

সে কী ফোকী বললে চলবে না। আপনার বোন মিলি যে মহিলার কথা বলছে তাকে আমি দেখেছি–অতি ভালো একজন মহিলা… তাকে বিয়ে করলে আপনি খুব সুখী হবেন।

আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, এইসব ফালতু কথা বন্ধ করা তো।

ফালতু কথা আমি বন্ধ করব না। আপনি রাজি না হলে আমি কিন্তু কাঁদতে শুরু করব। ভূত মেয়েব কান্না সামলানো খুব কঠিন। আমরা মানুষ মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি কাঁদতে পাবি।

এ তো দেখি ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল।

হ্রিহ্রিলা হাসতে হাসতে বলল, ভূত কন্যাকে মেয়ে ডেকেছেন, যন্ত্রণা তো হবেই।

আখলাক সাহেব পিঁড়িবিড় করে বললেন, ভোভোহার সমস্যা মিটাতে গিয়ে নিজে কী সমস্যায় পড়ে গেলাম।

ওব সমস্যা নিয়ে আপনাকে মোটেই ভাবতে হবে না। আপনার সমস্যা যেমন আমি দেখব, ওরটাও আমি দেখব।

এই বয়সে বিয়ে, লোকে বলবে কী?

বলুক যার যা ইচ্ছা। সারাটা জীবন একা একা কাটাবেন? আপনি সারাজীবন অনেক কষ্ট করেছেন। আর আপনাকে কষ্ট করতে দেব না।

আখলাক সাহেব হ্রিহ্রিলার কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। ভূত মেয়ে কিন্তু কাঁদছে। ঠিক মানুষের মেয়ের মতো। কান্না শুনে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনি গাঢ় গলায় বললেন, কাঁদিস না তো মা। হ্রিহ্রিলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আরো কাঁদব। চিৎকার করে কাঁদব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *