৭
মিসির আলি সাহেব,
এই সম্বোধন বারবার করতে আমার কুৎসিত লাগছে। নামের শেষে সাহেব আবার কী? নামের শেষে সাহেব লাগালেই মানুষটাকে অনেক দূরের মনে হয়। দূরের মানুষের কাছে কি এমন অন্তরঙ্গ চিঠি লেখা যায়? একবার ভেবেছিলাম ‘স্যার’ লিখি। তারপর মনে হল—স্যার তো সাহেবের মতোই দূরের ব্যাপার। মিসির আলি চাচা লিখব? না তাও সম্ভব না। মিসির আলি এমনই এক চরিত্র যাকে চাচা বা মামা ডাকা যায় না। গৃহী কোনো সম্বোধন তাঁকে মানায় না। দেখলেন আপনাকে আমি কত শ্রদ্ধা করি? না দেখেই কোনো মানুষকে এতটা শ্রদ্ধা করা কি ঠিক?
থাকুক তত্ত্বকথা—নিজের গল্পটা বলে শেষ করি। অনেকদূর তো বলেছি—আপনি কি বুঝতে পারছেন যা বলছি সব সত্যি বলছি? অর্থাৎ আমি যা সত্যি বলে বিশ্বাস করছি তাই বলছি।
যতটুকু পড়েছেন সেখান থেকে কি বুঝতে পারছেন যে বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো না।
বাবা আমাকে পছন্দ করেন না।
কেন করেন না, আমি জানি না। আমি কখনো জিজ্ঞেস করি নি। কিন্তু বুঝতে পেরেছি। পছন্দ করেন না মানে এই না যে তিনি সারাক্ষণ ধমকাধমকি করেন। এইসব কিছুই না। মাঝে মাঝে গল্প করেন। লেজার ডিস্কে ভালো ছবি আনলে হঠাৎ বলেন, মা এস ছবি দেখি। জন্মদিনে খুব দামি গিফট দেন। যতবারই বাইরে যান আমার জন্যে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। তারপরেও আমি বুঝতে পারি বাবা আমাকে তেমন পছন্দ করেন না। মেয়েরা এইসব ব্যাপার খুব সহজে ধরতে পারে। কে তাকে পছন্দ করছে কে করছে না—এই পর্যবেক্ষণশক্তি মেয়েদের সহজাত। এই বিদ্যা তাকে কখনো শিখতে হয় না। সে জন্মসূত্রে নিয়ে আসে। ওই যে কবিতা—
“এ বিদ্যা শিখে না নারী আসে আপনাতে”
আন্টি অসুস্থ হয়ে যাবার পর বাবা যেন কেমন কেমন চোখে আমাকে দেখতে লাগলেন। যেন আমিই আন্টিকে অসুস্থ করেছি। আমি যেন ভয়ঙ্কর কোনো মেয়ে— আমার সংস্পর্শে যে আসবে সেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
বাবার দুশ্চিন্তার কারণও আছে। ছোট মা অসুস্থ হবার পর আমার ঘরেই বেশিরভাগ সময় থাকতেন। তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমার বিছানাতে শুয়ে মারা যান। যে রাতে তিনি মারা যান সে রাতে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করেন। আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি ঘুমের ওষুধ খান—একটা চিঠি লেখেন। তারপর আমার সঙ্গে ঘুমাতে আসেন। আমি ভোরবেলা জেগে উঠে দেখি তিনি কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন—চোখ আধা খোলা। চোখের সাদা অংশ চকচক করছে। মুখ খানিকটা হাঁ করা। হাত-পা হিম হয়ে আছে। আমার তখন খুব কম বয়স। তারপরেও আমি বুঝলাম তিনি মারা গেছেন। আমি ভয় পেলাম না। চিৎকার দিলাম না। শান্ত ভঙ্গিতেই বিছানা থেকে নামলাম। দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি দেয়া। আমি চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছিটকিনি খুলে বাবার ঘরে গিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাবাকে বললাম, ছোট মা মারা গেছেন।
বাবা তখন কফি খাচ্ছিলেন। তিনি খুব ভোরবেলা ওঠেন। নিজেই কফি বানিয়ে খান। তিনি মনে হল আমার কথা বুঝতে পারলেন না, কাপ নামিয়ে রেখে বললেন—মা কী বললে?
আমি আবারো বললাম, ছোট মা মারা গেছেন।
বাবা দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণ করলেন না।
আমার ঘরে এসে ঢুকলেন। এক পলক ছোট মাকে দেখলেন।
তাঁর কপালে হাত রাখলেন। তারপর রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
ছোট মার পর শরিফা মারা গেল। সেও থাকত আমার ঘরে। সেও কি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল? আমরা যদি ধরে নেই কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নি, তা হলে বুঝতে হবে শরিফা নিজেই ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। যে মেয়ে পরদিন স্বামীর কাছে যাবে সে এই কাণ্ড কখন করবে? মানসিকভাবে অসুস্থ হলেই করবে। শরিফাও তা হলে অসুস্থ ছিল।
আন্টির অসুস্থতাতো চোখের সামনে ঘটল। আমার ঘরেই তার শুরু। কাজেই বাবা যদি ভেবে থাকেন প্রতিটি অসুস্থতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে তা হলে বাবাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না।
এক রাতে, খাবার টেবিলে তিনি বললেন—নিশি, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আমি বললাম, বল।
বাবা বললেন, খাবার টেবিলে বলতে চাচ্ছি না, খাওয়া শেষ করে আমার ঘরে আস। দুজন কথা বলি।
আমি বললাম, আচ্ছা।
তোমার বয়স এখন কত?
আমি বললাম, অক্টোবরে পনের হবে।
তা হলে তো তুমি অনেক বড় মেয়ে। তোমার বয়স পনের হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারি নি।
আমি হাসলাম। বাবা বললেন, তুমি যে খুব সুন্দর হয়েছ তা কি তুমি জান? ‘না।’
কেউ তোমাকে বলে নি? তোমার বন্ধুবান্ধবরা?’
‘না। আমার কোনো বন্ধুও নেই।’
‘নেই কেন?’
‘কারো সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় না।’
‘হয় না কেন?’
‘আমি তো জানি না কেন হয় না। মনে হয় আমাকে কেউ পছন্দ করে না।’
তোমাকে পছন্দ না করার তো কোনো কারণ নেই।’
‘তুমি নিজেই আমাকে পছন্দ কর না। অন্যদের দোষ দিয়ে কী হবে?’
‘আমি তোমাকে পছন্দ করি না?’
‘না কর না।’
‘তোমার এই ধারণা হল কেন?’
আমি চুপ করে রইলাম। বাবাও চুপ করে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। অস্বস্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিস্ময়বোধ। অতি কাছের একজনকে নতুন করে আবিষ্কারের বিস্ময়।
রাত দশটার দিকে বাবার ঘরে গেলাম। ইচ্ছে করে খুব সেজেগুজে গেলাম। লাল পাড়ের হালকা সবুজ একটা শাড়ি পরলাম। কপালে টিপ দিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চমকে গেলাম—কী সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বিয়েবাড়ির মেয়ে। কনের ছোট বোন।
বাবা আমার সাজগোজ দেখে আরো ভড়কে গেলেন। বিব্রত গলায় বললেন, মা বোস। তোমাকে তো চেনা যাচ্ছে না।
আমি বসতে বসতে বললাম, তোমার জরুরি কথা শুনতে এসেছি।
বাবা বললেন, এত সেজেছ কেন?
‘এমনি সাজলাম। মাঝে মাঝে আমার সাজতে ইচ্ছা করে।’
‘আমি আগে কখনো তোমাকে সাজতে দেখি নি।’
‘আমাকে কি সুন্দর লাগছে না বাবা?’
‘অবশ্যই সুন্দর লাগছে। কপালের টিপটা কি নিজেই এঁকেছ?’
আমি বললাম, বাবা তুমি নানান কথা বলে সময় নষ্ট করছ। কী বলবে সরাসরি বলে ফেল। অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই।
‘অস্বস্তি বোধ করার কথা আসছে কেন?’
‘তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি অস্বস্তি বোধ করছ। তুমি বরং এক কাজ কর, দুই পেগ হুইস্কি খেয়ে নাও—এতে তোমার ইনহিবিশন কাটবে। যা বলতে চাচ্ছ সরাসরি বলে ফেলতে পারবে।’
‘হুইস্কি খেলে ইনহিবিশন কাটে এই তথ্য জানলে কোথেকে?
‘গল্পের বই পড়ে। তোমার কাছ থেকে আমার গল্পের বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে। আমিও দিনরাত বই পড়ি।
‘এটা একটা ভালো অভ্যাস।’
‘বাবা তোমার কথাটা কী?’
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ দুম করে বললেন, তোমার ভেতর কিছু রহস্য আছে। রহস্যটা কী?
‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না বাবা। তুমি কোন রহস্যের কথা বলছ? সব মানুষের মধ্যেই তো রহস্য আছে।’
বাবা বললেন, সব মানুষের মধ্যে রহস্য আছে ঠিকই। তবে সেই সব রহস্য ব্যাখ্যা করা যায়। তোমার রহস্য ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি।
‘আমি এখনো তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। আলমারি খুলে হুইস্কির বোতল বের করলেন।
মিসির আলি সাহেব আপনাকে এতক্ষণ একটা কথা বলা হয় নি। লজ্জা লাগছিল বলেই বলতে পারি নি—আমার বাবা প্রচুর মদ্যপান করেন। এটা তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস। আমার ধারণা মা যে মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা যান তার কারণ মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে বাবা অ্যাকসিডেন্ট করেন। আমি অবিশ্যি এসব নিয়ে বাবাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করি নি। আরেকটা কথা আপনাকে বলা হয় নি—ছোট মা বাবার কাছ থেকে মদ্যপানের অভ্যাস করেছিলেন। এই অংশটি এতক্ষণ গোপন রাখার জন্যে আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।
বাবা বললেন, নিশি শোন। নিজের সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? তুমি নিজে কি মনে কর তোমার চরিত্রে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে?
‘না।’
‘তুমি নিশ্চিত যে তোমার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।’
‘আমি নিশ্চিত।’
‘তোমার আশপাশে যারা থাকে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করে কেন?’
‘আমি জানি না। তুমিও তো আমার আশপাশেই থাক—তুমি তো অস্বাভাবিক আচরণ কর না।’
‘তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করছ কেন?’
‘তর্ক করছি না। তুমি প্রশ্ন করছ আমি তার জবাব দিচ্ছি।’
‘আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে তোমাকে দেখাতে চাই।’
‘বেশ তো দেখাও।’
‘আগামী সপ্তাহে আমি মেরিল্যান্ডে যাচ্ছি। আমাদের সুপারসনিকের ওপর শর্ট ট্রেনিং হবে। তুমিও চল। সাইকিয়াট্রিস্ট তোমাকে দেখবে।’
‘আচ্ছা।’
‘মা ঠিক করে বল, তোমার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই?’
‘না।’
‘তুমি তোমার ছোট মাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাও এটা কি সত্যি? তোমার আন্টি আমাকে বলেছিল।’
‘হ্যাঁ সত্যি।’
‘তুমি শরিফা মেয়েটিকেও দেখতে পাও।’
‘আগে পেতাম এখন পাই না।’
‘তোমার কাছে কি মনে হয় না—এই ব্যাপারগুলি অস্বাভাবিক?’
‘না। কারণ শরিফাকে নীতু আন্টিও দেখেছেন।
‘হ্যাঁ সে আমাকে বলেছে। শরিফাকে এখন আর তুমি দেখতে পাও না?’
‘না সে তার স্বামীর কাছে চলে গেছে। তবে আমি চাইলে সে আবার চলে আসবে।’
‘বুঝিয়ে বল।’
‘আমি স্বপ্নে যা দেখি তাই হয়। স্বপ্নে কী দেখতে চাই এটাও আমি ঠিক করতে পারি। কাজেই আমি যদি ভাবি স্বপ্নে দেখছি শরিফা চলে এসেছে তা হলে সে চলে আসবে। এবং তখন তুমি চাইলে তুমিও তাকে দেখতে পাবে।’
‘এ ব্যাপারটাও তোমার কাছে নরমাল মনে হয়? অস্বাভাবিক মনে হয় না?’
‘না, আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না। আমার মনে হয় সব মানুষেরই ইচ্ছাপূরণ ধরনের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা আছে। কী করে সেই স্বপ্নটা দেখতে হয় তা তারা জানে না বলে স্বপ্ন দেখতে পারে না।’
‘নিশি!’
‘জি।’
‘তুমি এক কাজ কর। শরিফা মেয়েটিকে নিয়ে এস আমি তাকে দেখতে চাই।’
‘আচ্ছা।’
‘কদিন লাগবে তাকে আনতে?’
‘বেশি দিন লাগবে না। স্বপ্নটা দেখতে পেলেই সে চলে আসবে।’
‘যত তাড়াতাড়ি পার তাকে নিয়ে এস কারণ মেরিল্যান্ড যাবার আগে আমি তাকে দেখতে চাই।’
‘আচ্ছা।’
‘তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’
‘খুব ভালো হচ্ছে।’
‘গান শেখা কেমন হচ্ছে?’
‘গান শেখাও ভালো হচ্ছে।’
‘তোমার গানের স্যারের সঙ্গে কদিন আগে কথা হল। তিনি তোমার গানের গলার খুব প্রশংসা করলেন। তোমার নাকি কিন্নর কণ্ঠ।’
‘‘সব গানের স্যাররাই তাদের ছাত্রছাত্রীদের গানের গলা সম্পর্কে এ জাতীয় কথা বলে। আমার গানের গলা ভালো না।’
‘আমি তোমার গান একদিন শুনতে চাই।’
‘এখন গাইব?’
‘এখন গাইতে হবে না।’
‘তোমার জরুরি কথা বলা কি শেষ হয়েছে বাবা?’
‘আমি চলে যাব?’
‘হ্যাঁ যাও। শরিফা মেয়েটি এলে আমাকে খবর দিও।’
‘আচ্ছা।’
আমি আমার ঘরে এসে ঘড়ি দেখলাম, এগারটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। আমি রাত সাড়ে এগারটার সময় আবার বাবার ঘরে গেলাম। তিনি সম্ভবত ক্রমাগতই মদ্যপান করে যাচ্ছেন। তাঁর চোখ খানিকটা লাল। মুখে বিবর্ণ ভাব। এমনিতে তিনি সিগারেট খান না—আজ খুব সিগারেট খাচ্ছেন। ঘর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে। বাবা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার মা?
‘আমার ঘরে এস।’
‘কেন?’
‘শরিফাকে দেখতে চেয়েছিলে শরিফা এসেছে।’
‘তুমি না ডাকতেই চলে এসেছে?’
আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বললেন, শরিফা সত্যি এসেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করছে?’
‘আমার খাটের নিচে বসে আছে।’
বাবা হাসলেন। অবিশ্বাসী মানুষের হাসি। বাবা বললেন, তুমি কি তার সঙ্গে কথাও বল?
‘হ্যাঁ বলি।
‘সে কি আমার সঙ্গে কথা বলবে?’
‘জানি না। বলতেও পারে।’
আমার ধারণা সে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমি তাকে দেখতেও পাব না। কারণ শরিফা নামের মেয়েটি খাটের নিচে বসে নেই। তোমার মাথার ভেতর একটা ঘর আছে, যে ঘর অবিকল তোমার শোবার ঘরের মতো। সেই ঘরের খাটের নিচে সে বসে আছে। কাজেই তাকে দেখতে পাবার কোনো কারণ নেই। বুঝতে পারছ?
‘পারছি।’
‘কাজেই মেয়েটিকে দেখতে যাওয়া অর্থহীন।’
‘তুমি যাচ্ছ না?’
‘না।’
আমি ফিরে আসছি বাবা পেছন থেকে ডাকলেন—নিশি দাঁড়াও আসছি। আমি দাঁড়ালাম। বাবার মদ্যপান আজ মনে হয় একটু বেশিই হয়েছে। তিনি সহজভাবে হাঁটতেও পারছেন না। সামান্য টলছেন। আমি বললাম, বাবা তোমার হাত ধরব? তিনি বললেন, না। আই অ্যাম জাস্ট ফাইন।
বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন। ঘরে টেবিলল্যাম্প জ্বলছে—মোটামুটি আলো আছে। বাবা নিচু হয়ে খাটের নিচে তাকালেন। আমি তাকিয়ে রইলাম বাবার দিকে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম—বাবার শান্ত ভঙ্গি বদলে যাচ্ছে—তাঁর চোখে ভয়ের ছায়া। সেই ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। তিনি হতভম্ব চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন খাটের নিচে। তাঁর চোখে পলক পড়ছে না। আমি বললাম, বাবা কিছু দেখতে পাচ্ছ?
তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করতে লাগলেন। যেন তাঁর বুকে বাতাস আটকে গেছে তিনি তা বের করতে পারছেন না। খুব যারা বুড়ো মানুষ তারা এ ধরনের শব্দ করে। তবে নিজেরা সেই শব্দ শুনতে পায় না। অন্যরা শুনতে পায়।
আমি বাবাকে হাত ধরে টেনে তুললাম। তাঁকে ধরে ধরে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলাম। তিনি প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন—প্রচুর মদ্যপান করেছি। আমার আবার লিমিট পাঁচ পেগ সেখানে আট পেগ খেয়েছি তো—তাই হেলুসিনেশন হচ্ছে। খাটের নিচে কিছুই ছিল না। কিছুই না। অন্ধকার তো, আলো-ছায়াতে মানুষের মতো দেখাচ্ছে। টর্চ লাইট নিয়ে গেলে কিছুই দেখব না।
‘টর্চ লাইট নিয়ে দেখতে চাও বাবা?’
তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন—না।
পরের সপ্তাহে আমি বাবার সঙ্গে মেরিল্যান্ড চলে গেলাম। মিসেস জেন ওয়ারেন নামের এক মহিলা সাইকিয়াট্রিস্ট আমার চিকিৎসা শুরু করলেন। মিসেস জেন ওয়ারেন এম ডি-র বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। আমেরিকান বৃদ্ধা মহিলারা খুব সাজগোজ করেন। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দেন, চুল পার্ম করেন, কানে রঙচঙা প্লাস্টিকের দুল পরেন। হাঁটুর উপরে খুব রঙিন—ঝলমলে স্কার্ট পরেন। তাঁদের দেখেই মনে হয় তাঁরা খুব সুখে আছেন।
মিসেস জেন ওয়ারেনও তার ব্যতিক্রম নন। এত নাম করা মানুষ কিন্তু কেমন খুকি সেজে ছটফট করছেন। আহ্লাদী ভঙ্গিতে কথা বলছেন।
সাইকিয়াট্রিস্টদের অনেক ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি। তাঁরা প্রথম যে কাজটি করেন তা হচ্ছে রোগীর সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলেন। যেন রোগী তাঁর অনেক দিনের চেনা প্রায় বন্ধু স্থানীয়। মিসেস জেন ওয়ারেন এই কাজটা ভালোই করেন। আমাকে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে যে কথাটা বললেন তা হল—’ও ডিয়ার, তোমাকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন?’ ভাবটা এরকম যেন তিনি আমাকে আগেও দেখেছেন তখন এত সুন্দর লাগে নি। বিদেশীরা গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে না—ইনি প্রথমবারেই গায়ে হাত রাখলেন।
‘তোমার নাম হল নিশি। আমার উচ্চারণ ঠিক হয়েছে?’
‘হয়েছে।’
‘নিশি অর্থ হল Night’
‘হ্যাঁ।’
‘মুন লিট নাইট?’
‘জানি না।’
‘অফকোর্স মুন লিট নাইট। তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তোমার জীবন আলোময়।’
‘থ্যাংক য়্যু।’
‘তোমার বয় ফ্রেন্ডের নাম কী?’
‘আমার কোনো বয় ফ্রেন্ড নেই।’
‘এমন রূপবতী কন্যার বয় ফ্রেন্ড থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। তুমি বলতে চাচ্ছ না? এইসব চলবে না—তোমার বয় ফ্রেন্ডের নাম বল, তার ছবি দেখাও।’
ভদ্রমহিলা আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছেন, আমিও কিন্তু তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করছি। আমি যে তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করছি সেটা মনে হয় তিনি ধরতে পারছেন না। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদেরকে অন্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে। মিসেস জেনও তাই করছেন। আমাকে কিশোরী একটা মেয়ে ভেবে কথা বলছেন, মন জয় করার চেষ্টা করছেন। আমি এমন ভাব করছি যেন ভদ্রমহিলার কথাবার্তায় অভিভূত। আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। ঠিক যে জবাবগুলি তিনি শুনতে চাচ্ছেন—সেই জবাবগুলিই দিচ্ছি। কোনো মানুষ যখন প্রশ্ন করে তখন সে যে জবাব শুনতে চায় সেই জবাবটা কিন্তু প্রশ্নের মধ্যেই থাকে।
জেন ওয়ারেন বললেন, আচ্ছা নিশি বাবাকে কি তুমি খুব ভালবাস?
প্রশ্ন করার মধ্যেই কিন্তু যে জবাবটা তিনি শুনতে চাচ্ছেন সেটা আছে। তিনি শুনতে চাচ্ছেন যে বাবাকে আমি মোটেই ভালবাসি না। এই জবাব শুনলে হয়তো তাঁর রোগ ডায়াগনোসিসে সুবিধা হয়। কাজেই তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম এবং খুব অনিচ্ছার ভঙ্গিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
ভদ্রমহিলা দারুণ খুশি হয়ে গেলেন।
শোন নিশি—ইয়াং লেডি। যদিও তুমি এফারমেটিভ ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছ তারপরেও মনে হয় তুমি সত্যি কথা বলছ না। আমরা বন্ধু—একজন বন্ধু অন্য বন্ধুকে অবশ্যই সত্যি কথা বলবে তাই না! এখন বল—তুমি কি তোমার বাবাকে খুব ভালবাস?
আমি হ্যাঁ-না কিছুই বললাম না।
ভদ্রমহিলা আমার আরো কাছে ঘেঁষে এসে বললেন, তুমি কি বাবাকে পছন্দ কর না? আমি আবারো চুপ করে রইলাম। ভদ্রমহিলা এবার প্রায় ফিসফিস করে বললেন— তুমি কি তোমার বাবাকে ঘৃণা কর? আচ্ছা ঠিক আছে মুখে বলতে না চাইলে এখানে দুটা কাগজ আছে একটাতে লেখা Yes এবং একটাতে No, যে কোনো একটা কাগজ তুলে নাও। প্রশ্নটা মন দিয়ে শোন—
তুমি কি তোমার বাবাকে ঘৃণা কর?
আমি Yes লেখা কাগজটা তুললাম। এবং এমন ভাব করলাম যে লজ্জায় দুঃখে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। আমার চোখে পানি চলে এল। আমি এমন ভাব করছি যেন চোখের জল সামলাতে আমার কষ্ট হচ্ছে। একসময় হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। বিদেশীরা চোখের পানি কম দেখে বলে চোখের পানিকে তারা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। বাঙালি মেয়েরা যে অতি সহজে চোখের পানি নিয়ে আসতে পারে এই তথ্য তারা জানে না। তা ছাড়া আমি যে কত বড় অভিনেত্রী তাও তিনি জানেন না। তিনি ছুটে গিয়ে টিস্যু পেপার নিয়ে এলেন। নিজেই চোখ মুছিয়ে দিলেন। করুণা বিগলিত গলায় বললেন, শোন মেয়ে তোমার লজ্জিত বা দুঃখিত হবার কিছু নেই। আমেরিকান স্ট্যাটিসটিকস বলছে শতকরা ২৮.৬০ ভাগ আমেরিকান পুত্র-কন্যারা তাদের বাবাকে ঘৃণা করে। তুমি আমাকে যা বলেছ তোমার বাবা তা কোনো দিন জানবেন না। এই বিষয়ে তোমাকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এখন একটু শান্ত হও। কফি খাবে?
আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম, খাব।
আমরা কফি খেলাম। ভদ্রমহিলা আনন্দিত গলায় বললেন—আমার ধারণা তোমার সমস্যা আমি ধরতে পারছি। সেই সমস্যার সমাধান করা এখন আর কঠিন হবে না। অবিশ্যি তুমি যদি আমাকে সাহায্য কর। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
‘হুঁ।’
‘ভেরি গুড। আমরা দুজনে মিলে তোমার সমস্যা সমাধান করব। কেমন?’
‘আচ্ছা।’
‘তোমার বাবাকে তুমি কেন ঘৃণা কর?’
‘বাবা মদ খায়।’
‘শুধু মদ্যপান করে বলেই ঘৃণা কর?’
‘মাতাল হয়ে তিনি একদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন তখন অ্যাকসিডেন্ট হয়। সেই অ্যাকসিডেন্টে আমার মা মারা যান।’
‘তোমার বাবা আমাকে তোমার মার মৃত্যুর কথা বলেছেন। কিন্তু কীভাবে মারা গেছেন তা বলেন নি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।’
জেন ওয়ারেন সিগারেট ধরালেন। তিনি বেশ কায়দা করে সিগারেট টানছেন।
‘নিশি, সিগারেটের ধোঁয়ায় তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘জি না।’
‘আমি সিগরেট ছাড়ার চেষ্টা করছি পারছি না। যে কোনো ভালো অভ্যাস সামান্য চেষ্টাতেই ছেড়ে দেয়া যায়—খারাপ অভ্যাস হাজার চেষ্টাতেও ছাড়া যায় না। ঠিক না?’
‘ঠিক।’
‘এখন বল তুমি নাকি তোমার মাকে দেখতে পাও এটা কি সত্যি?’
‘না, সত্যি না।’
‘তা হলে বল এই মিথ্যা কথাটা কেন বলতে?’
‘বাবাকে ভয় দেখাবার জন্যে বলতাম।’
‘বাবাকে ভয় দেখানোর জন্যে তুমি তা হলে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথাই বলেছ?’
‘জি।’
‘যা বলেছ তোমার বাবা তাই বিশ্বাস করেছেন?’
‘জি।’
‘আচ্ছা আজকের মতো তোমার সঙ্গে আমার কথা শেষ। কাল আবারো আমরা বসব। কেমন!’
‘জি আচ্ছা।’
‘মেরিল্যান্ডে দেখার মতো সুন্দর সুন্দর জিনিস অনেক আছে। তুমি কি দেখেছ?’
‘জি না।’
‘কাল আমি তোমাকে লিস্ট করে দেব। দেশে যাবার আগে তুমি দেখে যাবে।’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি কি জান যে তুমি খুব ভালো মেয়ে?’
‘জানি।’
ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে আরো তিন দিন সিটিং দিলেন। আমি তাঁকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করলাম। তাঁকে যা বিশ্বাস করাতে চাইলাম তিনি তাই বিশ্বাস করলেন এবং খুব আনন্দিত হলেন এই ভেবে যে তিনি বিদেশিনী এক কিশোরী মেয়ের জীবনের সমস্ত জটিলতা দূর করে ফেলেছেন। তাঁর অন্ধকার ঘরে এক হাজার ওয়াটের বাতি জ্বেলে দিয়েছেন।
আমার সম্পর্কে তিনি যা ধারণা করলেন তা হচ্ছে—
১) আমি খুব ভালো একটা মেয়ে, সরল, বুদ্ধি কম, জগতের জটিলতা কিছু জানি না। (খুব ভুল ধারণা।)
২) আমি নিঃসঙ্গ একটি মেয়ে। আমার সবচে বড় শত্রু আমার নিঃসঙ্গতা। (ভুল ধারণা। আমি নিঃসঙ্গ নই। আমি কখনো একা থাকি না। নিজের বন্ধুবান্ধব নিজে কল্পনা করে নেই। কল্পনাশক্তিসম্পন্ন মানুষ কখনো নিঃসঙ্গ হতে পারে না।)
৩) আমি খুব ভীতু ধরনের মেয়ে।
(আবারো ভুল। আমার মধ্যে আর যাই থাকুক ভয় নেই। যখন আমার সাত আট বছর বয়স তখনো রাতে ঘুম না এলে আমি একা একা ছাদে চলে যেতাম। )
৪) বাবাকে আমি অসম্ভব ঘৃণা করি।
(খুব ভুল কথা। বাবা চমৎকার মানুষ। আমার ক্ষুদ্র জীবনে যে কজন ভালো মানুষ দেখেছি তিনি তাদের একজন। )
আমি ভদ্রমহিলার মাথায় এইসব ভুল ঢুকিয়ে দিয়েছি। তিনি খুশি মনে ভুলগুলি গ্ৰহণ করেছেন।
মানুষ কী অদ্ভুত দেখেছেন? মানুষ কত সহজেই না ‘ভুল’–সত্যি ভেবে গ্রহণ করে।