০৭. সমালোচনা প্রতিরোধের উপায়
আমি একবার মেজর জেনারেল স্মেডলি বাটলারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। নানা বিশেষণেই তিনি ভূষিত হন। তাঁর কথা শুনেছেন তো? তিনি ছিলেন আমেরিকার নৌবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে খ্যাতনামা আর আঁকজমকপূর্ণ সেনাপতি।
তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর যখন বয়স কম ছিল খুব জনপ্রিয় হবার দারুণ চেষ্টা করতেন আর প্রত্যেকের উপর প্রভাব বিস্তারের আগ্রহ পোষণ করতেন। তখনকার দিনে সামান্য সমালোচনাও আঘাত লাগত আর হুল ফোঁটাতে চাইত। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, নৌবাহিনীতে ত্রিশ বছর কাটানোর ফলে তার চামড়া বেশ পুরু হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, আমাকে অপমান করে, নিন্দা করা হয়েছিল আর হলদে কুকুর, সাপ এবং এবং অন্যান্য জানোয়ারের সঙ্গে তুলনাও করা হয়। বিশেষজ্ঞরা আমাকে নিন্দা করেন। ইংরেজি ভাষায় যত রকম ছাপার অযোগ্য খারাপ কথা আছে সবই আমাকে বলা হয়। এতে আমি ভাবনায় পড়ি ভাবছেন? ফুঃ! এখন কেউ আমাকে গাল দিতে চাইলেও আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি না কে কথাটা বলেছে।
তীক্ষ্ণ-দৃষ্টিসম্পন্ন বাটলার হয়তো সমালোচনা গ্রাহ্য করতেন না, তবে একটা কথা নিশ্চিত, আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই ছোটোখাটো মন্তব্য আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বড় বেশি রকম বিচলিত বোধ করি। আমার বেশ কয়বছর আগেকার কথাটা মনে পড়ছে যখন নিউইয়র্ক সান পত্রিকার একজন রিপোর্টার আমার বয়স্ক শিক্ষার ক্লাসে এসে সব দেখে কাগজে ব্যঙ্গ করে জঘন্য সব কথা লেখেন। আমি কি ক্ষেপে গিয়েছিলাম? আমি ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অপমান বলেই ভেবেছিলাম। আমি টেলিফোন করে সানের কার্যকরী কমিটির চেয়ারম্যান গিল হাজেসকে প্রায় দাবি জানাই তিনি যেন সব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন–আর মস্করা না করেন। আমি মনে মনে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করি এই অপরাধের উপযুক্ত শাস্তিদান করবোই।
আজ অবশ্য আমি আমার সেদিনের কাজের জন্য লজ্জাবোধ করি। এখন বুঝতে পারি ওই কাগজ যারা কেনে তারা ওই প্রবন্ধটা হয়তো চোখেই দেখে নি। যারা কাগজ পড়েছে তাদেরও অর্ধেক বোধহয় ব্যাপারটাকে নির্দোষ আমোদ বলেই ভেবেছিলেন। আবার যে অর্ধেক সেটা পড়ে হেসে মজা পান তারাও আবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা ভুলেও যান।
এখন বুঝতে পারি মানুষ আমার বা আপনার সম্বন্ধে ভাবে না বা সেটা গ্রাহ্য করে না। তারা কেবল নিজেদের কথাটাই ভেবে চলে–প্রাতরাশের আগে, প্রাতরাশের, বা মাঝরাতের দশ মিনিট আগে বা ঠিক পরেও। আমার বা আপনার মৃত্যুর খবরের চেয়েও তাদের প্রায় হাজার গুণ বেশি ভাবনা নিজেদের সামান্য মাথা ব্যথা নিয়ে।
যদি আপনার বা আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা ছড়ানো হয়, ঠাট্টা করা হয়, ঠকানো হয়, অথবা পিঠে ছুরি মারা হয় বা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন যদি আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে–তাহলেও যেন আমরা আত্মা-ধিক্কারে অস্থির হয়ে না পড়ি। তার বদলে আসুন আমরা মনে মনে যিশু খ্রিস্টের কথাই ভাবি-কারণ তাঁর ভাগ্যে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে একজন সামান্য টাকার বিনিময়ে–আজকের টাকার হিসেবে মাত্র ঊনিশ ডলারের ঘুষ নিয়ে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তার বারোজন বন্ধুর মধ্যে আর একজন যিশু বিপদে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ত্যাগ করে তিনবার বলে দেয় সে যিশুকে চেনে না–কথাটা সে শপথ নিয়ে বলে। ঠিক ছয়জনের মধ্যে একজন। ঠিক এই রকম ঘটে যায় যিশুর জীবনেও। আমি বা আপনি এর চেয়ে আর ভালো আশা করি কেমন করে?
বেশ কয়েক বছর আগেই আমি আবিষ্কার করি যে, মানুষ অন্যায়ভাবে আমাকে সমালোচনা করে বন্ধ করতে পারি না বটে–তবে একটা ব্যাপার অবশ্যই বন্ধ করতে পারি, তা হল অন্যান্য সমালোচনা শুনে দুশ্চিন্তা করা। আমি নিশ্চয়ই ঠিক করতে পারি, অন্যায় এই নিন্দাবাদে আমি চিন্তায় পড়ব কিনা।
ব্যাপারটা পরিষ্কার করেই বলি। আমি এর মধ্য দিয়ে সবরকম সমালোচনা অগ্রাহ্য করার কথা বলছি না। একেবারেই না। আমি শুধু অন্যায় সমালোচনা অগ্রাহ্য করতে বলছি। আমি একবার এলিনর রুজভেল্টের কাছে জানতে চেয়েছিলাম অন্যায় সমালোচনার তিনি কীভাবে মোকাবিলা করেন। আর আল্লাহই জানেন এমন জিনিস তাঁকে কত সহ্য করতে হত। হোয়াইট হাউসে যত মহিলা বাস করেছেন তার মধ্যে তাঁরই বোধ হয় সবার চেয়ে বেশি বন্ধু আর সাংঘাতিক রকম শত্রু ছিল।
তিনি আমাকে বলেন, অল্পবয়সে তিনি সাংঘাতিক রকমের লাজুক মেয়ে ছিলেন। তাঁর খালি ভয় হত–লোক কি বলবে। সমালোচনা সম্বন্ধে তাঁর এমনই ভয় ছিল যে একদিন তিনি তাঁর চাচিমা, থিয়োডোর রুজভেল্টের বোনের কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন। তিনি যা জানতে চেয়েছিলেন সেটা
এই রকম : ‘চাচিমা, আমি যে কাজ করতে যাই খালি ভয় হয় লোকে কি বলবে।‘
তাঁর চাচিমা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন : ‘লোকে কি বলবে তা নিয়ে মোটেও ভাববে নাম যতক্ষণ তুমি জানো যে তুমি ঠিক পথেই আছ।’ এলিনর রুজভেল্ট আমাকে বলেছেন যে ওই পরামর্শই তার পরবর্তী হোয়াইট হাউসের জীবনে একেবারে একটা শক্ত ভিত হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আমাকে আরো বলেছিলেন, সমালোচনায় কান না দেয়ার একটা পথ হল চীনা মাটির মূর্তি যেমন আলমারীর তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সেই ভাবে থাকা। তার পরামর্শ ছিল এই রকম : নিজের মনে যা ঠিক বলে মনে হয় তাই করবে-কারণ তোমার সমালোচনার করা হবেই। কাজ করলেও লোকে তোমার সমালোচনা করবে–আবার না করলেও তাই।
প্রয়াত ম্যাথুসি ব্রাস ছিলেন ওয়াল স্ট্রিটের আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট। আমি তাকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম তিনি কোনোদিন সমালোচনায় চিন্তিত হতেন কিনা। তিনি জবাব দেন : ‘হ্যাঁ, ছোটবেলায় আমি এ ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর ছিলাম। তখন ভাবতাম আমার প্রতিষ্ঠানের সব কর্মচারীই মনে করুক আমি একদম ঠিক মানুষ। তারা না ভাবলেই আমার দুশ্চিন্তা হত। কোনো মানুষ আমার বিরুদ্ধে গেলেই আমি তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু তাতে আবার আর একজন ক্ষেপে যেত। এতে বুঝলাম-যতই একজনকে সন্তুষ্ট করতে চাইব ততই অন্যের অসন্তোষ বাড়বে। আমি শেষপর্যন্ত আবিষ্কার করলাম যে, আমি যতই মনের অসন্তোষ দূর করে কাউকে সুখী করার চেষ্টা করলাম, ততই আমি নিশ্চিন্ত হলাম আমি শক্ৰসংখ্যা বাড়িয়ে তুলছি। তাই নিজেকেই শেষ অবধি বললাম : ‘তুমি যদি সাধারণের মাথার উপর মাথা তুলে থাকার চেষ্টা করো ততই সমালোচনার সামনে পড়তে হবে। অতএব সমালোচনায় অভ্যস্ত হতে থাকো।’ এটা আমাকে দারুণ সাহায্য করেছে। এরপর থেকে যতটা ভালো হওয়া যায়, তাই হতে চেষ্টা করলাম এবং তারপরেই আমি আমার পুরনো ছাতাটা মাথায় মেলে ধরব তাহলে সমালোচনার বৃষ্টিধারায় আর শরীর ভিজবে না।
জেমস টেলর এ ব্যাপারে আর একটু এগিয়ে ছিলেন। তিনি সমালোচনার ধারায় অবগাহন করতেন আর প্রকাশ্যে হেসে সব উড়িয়ে দিতেন। তিনি প্রত্যেক রবিবারের বিকেলে বেতারে নিউইয়র্কের সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সংগীত-বিরামের উপর নানা রকম কথিকা প্রচার করতেন। এক মহিলা তাঁকে চিঠি লিখে চোর, বিশ্বাসঘাতক, সাপ আরো নানা সম্বোধনে ভূষিত করেন। মি. টেলর তাঁর অব মেন অ্যান্ড মিউজিক’ গ্রন্থে বলেছেন : আমার সন্দেহ ভদ্রমহিলা আমার বক্তৃতা পছন্দ করতেন না। মি. টেলর পরের রবিবার বেতার ভাষণের সময় চিঠিটার উল্লেখ করলেন এবং আবার সেই মহিলার কাছ থেকে চিঠি পেলেন ‘চোর’, ‘সাপ’, বিশ্বাসঘাতক’ বলে। যিনি সমালোচনাকে এমনভাবে নিতে পারেন তাঁকে প্রশংসা না করে সত্যিই পারা যায় না। আমাদের চোখে পড়ে তাঁর প্রশান্তি, অবিচলিত মনোভাব আর তাঁর হাস্যরসবোধ।
চার্লস্ শোয়ার যখন প্রিন্সটনে ছাত্রদের কাছে বক্তৃতা দিতেন তখন তিনি স্বীকার করেছিলেন যে জীবনে তিনি যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা লাভ করেন, সেটা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর ইস্পাত কারখানার একজন বৃদ্ধ জার্মানের কাছে। এই বৃদ্ধ জার্মানের সাথে তার সহকর্মীদের যুদ্ধের আমলের কিছু কথাবার্তা নিয়ে তর্কাতর্কি বেধে যায়। অন্য কর্মীরা তাঁকে রাগে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরপর যখন সে আমার কাছে আসে, শোয়ব লিখেছিলেন, তার সারা গায়ে কাদা আর পানি মাখামাখি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে কি এমন বলেছে যাতে তাঁকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে ওরা? সে জবাব দিয়েছিল : আমি কেবল হেসেছিলাম।
মি. শোয়াব স্বীকার করেছেন যে তিনিও ওই বৃদ্ধ জার্মানের নীতিই গ্রহণ করেছেন–শুধু হেসে ফেলা।
এই নীতি বিশেষ করেই ভালো, যখন আপনি অন্যায় সমালোচনার শিকার হবেন। যে আপনার কথার জবাব দেয় তার কথার উত্তর আপনি দিতে পারেন, কিন্তু যে কেবল হাসে, তাকে কি জবাব দেবেন?
লিঙ্কন বোধ হয় ভেঙে পড়তেন, গৃহযুদ্ধের সময়কার প্রচণ্ড চাপের সময় তাঁকে যে রকম বিষাক্ত সমালোচনা করা হত তার যদি উত্তর দিতে হত। এটা যে চরম বোকামি তা তিনি শিখেছিলেন। তাঁর সমালোচকদের তিনি কীভাবে মোকাবিলা করতেন তার বর্ণনা, সাহিত্যের দুনিয়ায় একরকম রত্নের মতই হয়ে আছে। জেনারেল ম্যাক আর্থার যুদ্ধের সময় এটা তাঁর সদর দপ্তরের ডেক্সে সাজিয়ে রাখতেন। উইনস্টন চার্চিল এটা তার চার্টওয়েলের পাঠকক্ষে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখতেন। এটা ছিল এই রকম : ‘আমাকে আক্রমণ করে যা লেখা হয় সেগুলো যদি আমি পড়ার চেষ্টা করি, উত্তর দেয়া তো দূরের কথা তাহলে এ জায়গাটা বন্ধ করেই দেয়া উচিত আমার অন্য কাজের জন্য। আমি সবচেয়ে ভালো কাজটি করার কৌশল আয়ত্ত করেছি আর তাই করে চলেছি–সবচেয়ে ভালো কাজ, আর আমি এই ভাবেই শেষপর্যন্ত কাজ করে যাওয়ার আশা রাখি। যদি শেষপর্যন্ত আমি সঠিক বলেই প্রমাণিত হতে পারি তাহলে আমার বিরুদ্ধে যা বলা হবে তাতে কিছুই যায় আসে না। শেষে যদি আমি ভুল বলে প্রমাণিত হই তাহলে দশজন ফেরেশতার সাক্ষ্যতেও আমি ঠিক প্রমাণিত হলে কিছু তারতম্য হবে না।’
আপনি বা আমি যখন অন্যায় সমালোচনার মুখোমুখি হব তখন এই নীতিটা মনে রাখুন :
‘সবচেয়ে ভালো যা করা সম্ভব করুন তারপর আপনার পুরানো ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে সমালোচনা বৃষ্টির হাত থেকে আত্মরক্ষা করুন।