সপ্তম অধ্যায় – সমাজ
পলাশির যুদ্ধের পর দুইশত বৎসরের মধ্যে বাংলার হিন্দুসমাজে কয়েকটি গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। ইহার পূর্বে পাঁচ-ছয়শত বৎসরে স্বাভাবিক বিবর্তন ও মুসলমান আক্রমণের ফলে যে পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, ইংরেজীশিক্ষা ও তজ্জনিত পাশ্চাত্ত্য ভাব ও সামাজিক রীতিনীতির সহিত প্রত্যক্ষ পরিচয়ের ফলে পূর্বোক্ত দুইশত বৎসরের পরিবর্তন তাহার অপেক্ষা অনেক বেশী ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, ১২০০ সনের হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির সহিত ১৭৫৭ সনের হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির যে প্রভেদ দেখা যায়, ১৭৫৭ সনের হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি হইতে ১৯৫৭ সনের হিন্দু সমাজের ও সংস্কৃতির প্রভেদ তাহা অপেক্ষা অনেকগুণে বেশী। কেহ কেহ মনে করেন যে, মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়ে এই দুই পৃথক সংস্কৃতি লুপ্ত হইয়া এক নব ভারতীয় সংস্কৃতির উদ্ভব হইয়াছিল। ইহা সত্য হইলে বলিতে হইবে যে সেই তথাকথিত ভারতীয় সংস্কৃতির অস্তিত্বও আজ আর নাই। পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতির সহিত সমন্বয়ে আর-এক সম্পূর্ণ নূতন সংস্কৃতির উদ্ভব হইয়াছে। ইহা হিন্দু নহে, মুসলমান নহে, ভারতীয় নহে–কিন্তু এই তিনের সহিত পাশ্চাত্ত্যের সংমিশ্রণে এক আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি। হাস্যকর হইলেও এরূপ প্রস্তাব যে পূর্বোক্ত নব ভারতীয় সংস্কৃতিরূপ মতবাদ হইতে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত এবং অধিকতর তথ্যবহুল প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, বর্তমান রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও তাহাদের অনুজীবী, অনুগত, অন্ধ ভক্ত ও পৃষ্ঠপোষকেরা ব্যতীত আর কেহই তাহা অস্বীকার করিবে না। বস্তুতঃ নব ভারতীয় সংস্কৃতি বর্তমান রাজনীতিকদের সৃষ্ট একটি মতবাদ মাত্র–ইহার অস্তিত্ব ইতিহাসে পাওয়া যায় না। হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্র সত্তা কোনদিনই লোপ পায় নাই; মুসলমান সংস্কৃতিও ভারতে আসিয়া তাহার স্বাতন্ত্র বিসর্জন দেয় নাই; যদিও বহুদিন এক দেশে একত্র বসবাসের ফলে উভয়েই উভয়ের দ্বারা কম-বেশী প্রভাবান্বিত হইয়াছে। গত দুইশত বৎসর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উভয়ের উপরেই যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিলেও উভয়েরই স্বতন্ত্র মূল কাঠামো বজায় আছে।
সুতরাং এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড অর্থাৎ মধ্যযুগের ইতিহাসের ন্যায় এই খণ্ডে আধুনিক যুগের আলোচনায় হিন্দু ও মুসলমানের ধর্ম ও সমাজ পৃথকভাবে আলোচিত হইবে। পাশ্চাত্ত্য প্রভাবে হিন্দুসমাজেই গুরুতর পরিবর্তন ঘটিয়াছে, সুতরাং তাহাই প্রধানত এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়।
১. নাগরিক সমাজ
বর্তমান যুগে নাগরিক ও গ্রাম্য সমাজের মধ্যে একটি অলঙ্ঘ্য ব্যবধান গড়িয়া উঠিয়াছে। নাগরিক সমাজ প্রধানত কলিকাতাকেই কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে এবং উনিশ শতকেই ইহা একটি বিশিষ্ট রূপ ধারণ করিয়াছে।
প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চ নীচ নানা জাতি ও স্তরের বিভিন্নতার উপর সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু ইংরেজীশিক্ষা, শিল্প বাণিজ্য প্রভৃতির নূতন রীতি এবং ইংরেজশাসনের নূতন আদর্শের প্রভাবে পূর্বেকার উচ্চ, নীচ জাতি ও শ্রেণীর প্রভেদ ও বৈষম্য ঘুচিয়া এখন নূতন নূতন সামাজিক স্ত র গড়িয়া উঠিয়াছে। জমিদারী প্রথার ফলে এক নূতন অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়াছে। অর্থই পরমার্থ, এই পাশ্চাত্ত্য আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া শিল্প-বাণিজ্যের ফলে যে সমুদয়-প্রধানতঃ সুবর্ণবণিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত–ধনশালী লক্ষপতি বা ক্রোড়পতির উদ্ভব হইয়াছে তাহারাও এক নূতন অভিজাত সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়াছেন।
ইংরেজীশিক্ষা ও তাহার ফলে যে একদল বড় বড় সরকারী চাকুরী পাইয়াছেন বা অন্য কোন নূতনভাবে জীবিকা অর্জনের পথ প্রশস্ত করিয়াছেন, জমিদারদের অধীনস্থ কর্মচারী ও মধ্যস্বত্বভোগীগণ এবং ব্যবসায় ও শিল্প-বাণিজ্যের দ্বারা লক্ষপতি না হইলেও মোটামুটিভাবে যাহারা স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করিয়াছেন–এই সমুদয় মিলিয়া এক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় গঠিত হইয়াছে।
নাগরিক মধ্যবিত্তশ্রেণী প্রধানত কলিকাতা শহরেই প্রথম স্পষ্ট রূপ ধারণ করে। ছোটখাট ব্যবসায়ী এবং প্রধানত চাকুরীজীবীরাই ছিল এই মধ্যবিত্তশ্রেণীর মেরুদণ্ড। চাকুরীর মধ্যে শিক্ষকতা এবং সওদাগরী ও সরকারী বেসরকারী অফিসের উচ্চ-নীচ শ্রেণীর কেরানীরাই ছিল প্রধান। সরকার নামে একশ্রেণীর লোক দেশীয় ধনী ও বিদেশীয় পরিবারের সাংসারিক সকল রকম কেনাকাটার কাজ করিত। তাহাদের মাসিক বেতন সাধারণ কেরানীর সমান হইলেও ন্যায্য দস্তুরী এবং অন্যায্য অনেক উপায়ে তাহারা বহু অর্থ উপার্জন করিত। আমার বাল্যকালে এদেশীয় এক হাইকোর্টের জজের সরকার আমাদের বাড়ীর নিকট থাকিতেন। তাঁহার মাসিক বেতন ছিল ১৫ টাকা, কিন্তু সাংসারিক ব্যয় ছিল অন্তত দুইশত টাকা। ইহা ছাড়াও তাঁহার স্ত্রীর গাত্রে বহু স্বর্ণ-অলঙ্কার শোভা পাইত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে এই শ্রেণীর লোকের সংখ্যা ও আয় অনেক বেশী ছিল তাহা বলাই বাহুল্য।
ইংরেজী শাসনপ্রণালীর পরিবর্তনে এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদানে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট, সদরআলা, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতির সৃষ্টি হওয়ায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্প্রসারণ হইল।
মধ্যবিত্তশ্রেণীর আনুকূল্যে নগরে একটি নিম্নমধ্যবৃত্তিরও উদ্ভব হইল। খুচরা ব্যবসায়ী, ছোট ছোট দোকানদার, নানারকম ছোটখাট শিল্পের সাহায্যে জীবিকা অর্জনকারী, ছোটখাট মুদ্রাযন্ত্রের চালক ও মালিক, ধনীর অধীনস্থ কর্মচারী প্রভৃতি ইহার অন্তর্গত। ইহাদের নীচে ছিল পারিবারিক ভৃত্য, কুলি, মজুর, দপ্তরী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণী। কারখানা শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক মজুর প্রভৃতি সংখ্যাবহুল এক শ্রেণী ইহার অন্তর্ভুক্ত হইল। গ্রামে কৃষি বা কুটিরশিল্প দ্বারা জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা না-হওয়াতে দলে দলে লোক ক্রমশ এইসব কার্যের লোভে শহরে আসিতে আরম্ভ করিল। গ্রামের তুলনায় শহরে জীবনযাত্রার উপায় সহজলভ্য হওয়ায়, গ্রামবাসীর সংখ্যা কমিল এবং নগর ও নগরবাসীর সংখ্যা বাড়িতে লাগিল। বাঙ্গালীর সমাজ ও আর্থিক অবস্থার উপর ইহার যে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল, তাহার পূর্ণ বিকাশ হইল বিংশ শতাব্দীতে। ইহার ফলে ধীরে ধীরে সবার অলক্ষ্যে যে বাঙ্গালী হিন্দুসমাজ ছিল গ্রাম ও পরিবারকেন্দ্রিক, তাহা পুরাপুরি নগর ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হইয়া উঠিল। ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহারের যে-সকল পরিবর্তন পরে বিবৃত হইবে, গ্রাম হইতে নগরের প্রাধান্য তাহার একটি মুখ্য কারণ। মুসলমান সমাজের এই পরিবর্তন কখনও খুব গুরুতর হয় নাই।
উপরে যাহা বলা হইল তাহাতে সহজেই বোঝা যাইবে যে, গ্রাম্য সমাজের গুরুতর পরিবর্তন হইয়াছিল এবং এই পরিবর্তনের কারণ প্রধানত দুইটি। প্রথমত, নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায় চাকুরীজীবী, সুতরাং কলিকাতা ও অন্যান্য শহরের দিকেই তাহাদের আকর্ষণ বাড়িল এবং গ্রামে বাস ক্রমে ক্রমে কমিতে লাগিল। প্রথম প্রথম শিক্ষিতেরা চাকুরীস্থলে থাকিতেন, স্ত্রী-পরিবারস্থ অন্যান্য সকলে গ্রামে বাস করিতেন, দুর্গাপূজা বা অন্য উৎসব উপলক্ষে তাঁহারা গ্রামে আসিতেন। ক্রমে ক্রমে, অনেকটা পাশ্চাত্ত্য প্রভাবে, স্ত্রীর মর্যাদা ও সাংসারিক প্রতিষ্ঠার উন্নতি হওয়ায়, চাকুরীজীবীরা সস্ত্রীক শহরে বাস করিতে লাগিলেন। ইহার ফলে গ্রামের সহিত সম্পর্ক কমিতে লাগিল এবং একান্নবর্তী পরিবারের বন্ধন শিথিল হইয়া আসিল। এই দুইটি গুরুতর পরিবর্তনের সূচনা হয় উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথম হইতে ইহা বাংলার সামাজিক জীবনে বিশেষভাবে পরিপুষ্ট হইয়া ওঠে।
দ্বিতীয়ত, অশিক্ষিত নিম্নশ্রেণীদের কুটিরশিল্প ধ্বংস হওয়ার ফলে কুলগত বৃত্তি লোপ পাওয়ায় অনেকে জীবিকা অর্জনের জন্য শহরে যাইতে বাধ্য হয়। কারণ, ক্রমবর্ধমান মজুরশ্রেণীর পক্ষে কৃষিকার্যের উপর নির্ভর করিয়া সংসার চালান ক্রমশঃই অসম্ভব হইয়া ওঠে। ছোটখাট যে-সকল শিল্প গ্রামে ছিল, শহরের সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্রবের ফলে শহর হইতেই তাহার আমদানি বেশী হইত; সুতরাং জীবিকানির্বাহের পক্ষে তাহার যথেষ্ট চাহিদা গ্রামে ছিল না। যখন উচ্চ নীচ এই উভয়শ্রেণী গ্রাম হইতে শহরে যাইতে আরম্ভ করিল, তখন তাহাদের স্থান অধিকার করিল ভূমি ও শাসনসংক্রান্ত নূতন দুই সম্প্রদায়–অর্থাৎ জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার, গোমস্তা, দারোগা, পাইক, পিওন, শিক্ষক প্রভৃতি মধ্যবিত্ত এবং চৌকিদার, দফাদার, কনেষ্টবল, ইহাদের ভৃত্য ও অনুগ্রহজীবী প্রভৃতি নিম্নবিত্ত। এইভাবে গ্রাম্য সমাজের শিক্ষা, আর্থিক সচ্ছলতা, স্বাস্থ্য, উৎসব, আমোদ, প্রমোদ প্রভৃতির রূপান্তর হইল। সাধারণভাবে বলিতে গেলে, সব দিক দিয়াই অবনতি ঘটিল। ইহার ফলে শিল্পজীবী ও কৃষকদের যে দুরবস্থা হয় তাহার বিবরণ পূর্বে দেওয়া হইয়াছে।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব বাংলার সমাজে যে অভিনবত্বের সৃষ্টি করিয়াছিল, সমসাময়িক পত্রিকাতে তাহার আভাস পাওয়া যায়। ১৮২৯ সনের ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকার নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
“যে সকল লোক পূর্বে কোন পদেই গণ্য ছিল না এক্ষণে তাহারা উৎকৃষ্ট নিকৃষ্ট উভয়ের মধ্যে বিশিষ্টরূপে খ্যাত হইয়াছে। এই মধ্যবিত্তেরদিগের উদয়ের পূর্বে সমুদয় ধন এতদ্দেশের অত্যল্প লোকের হস্তেই ছিল তাহারদিগের অধীন হইয়া অপর তাবৎ লোক থাকিত ইহাতে জনসমূহ সমূহ দুঃখে অর্থাৎ কায়িক ও মানসিক ক্লেশে ক্লেশিত থাকিত অতএব দেশব্যবহার ও ধর্মশাসন অপেক্ষা ঐ পূর্বোক্ত প্রকরণ এতদ্দেশে সুনীতিবর্তনের মূলীভূত কারণ হইতেছে ও হইবেক।”৩
প্রধানত বাঙ্গালীর ধনবৃদ্ধিই যে এই নূতন মধ্যবিত্তশ্রেণীর উদ্ভবের কারণ তাহার উল্লেখ করিয়া বঙ্গদূত এই ধনবৃদ্ধির কয়েকটি নিদর্শন দিয়াছে। প্রথম ভূম্যাদির মূল্যবৃদ্ধি-৩০ বৎসর আগে যে ভূমির মূল্য ছিল ১৫ টাকা এখন তাহা বৃদ্ধি পাইয়া অন্ততঃ ৩০০ টাকা হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ, “এমতে ভূম্যাদির মূল্য বৃদ্ধির দ্বারা সম্পদ হওয়াতে জনপদের পদবৃদ্ধি হইয়াছে”। দশ বৎসরের মধ্যে যে লোকের মাসিক বেতন দুই টাকা ছিল তাহা পাঁচ টাকা ও সূত্রধরের মাসিক বেতন আট হইতে কুড়ি টাকা হইয়াছে এবং “পূৰ্ব্বে এক তঙ্কায় ১২ জন কৃষক লোক সমস্ত দিন শ্রম করিত এক্ষণে ৪ জনের অধিক এক তঙ্কায় পাওয়া যায় না।” ‘শালিভূমির মালিকেরা বিঘা প্রতি রাজস্ব এক টাকার স্থানে চারি টাকা আদায় করেন-ওদিকে চাউলের দাম প্রতি মণ আট আনার পরিবর্তে দুই টাকা হইয়াছে। ইহার কারণ নির্দেশ করিতে যাইয়া বঙ্গদূত লিখিয়াছে : “এই প্রকার অবস্থান্তর ও রীতি পরিবর্তনের কারণ অবাধে বাণিজ্য বিস্তার ও ইংলণ্ডীয় মহাশয়েরদিগের সমাগম ইহাই সাব্যস্ত বোধ হইতেছে।”৪
বঙ্গদূত এই প্রসঙ্গে সাধারণ অর্থনীতি সম্বন্ধে নিম্নলিখিত যে-মন্তব্যটি করিয়াছে তাহা সে-যুগের বাঙ্গালীদের বুদ্ধিবৃত্তির ও সূক্ষ্ম অর্থনীতিক জ্ঞানের পরিচয় প্রদান করে :
“ফলিতাৰ্থ এ প্রকার এদেশের অবস্থান্তর হওয়াতে যে সকল উপকারোপযোগি ফলোৎপত্তির সম্ভাবনা তন্মধ্যে অর্থের চলাচল এক প্রধান ফল দৃষ্ট হইতেছে যে হেতুক ধন আর সার মৃত্তিকা ইহা রাশিকৃত হইলে কোন ফলোদয় হয় না কিন্তু বিস্ত ীর্ণ হইলেই ফলোৎপত্তির নিমিত্ত হয়।”৫
অর্থের সঞ্চয় অপেক্ষা সচলতাই যে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করে এই অর্থনীতিক তথ্যটি যে ১৮২৯ সনেই বাঙ্গালীর বোধগম্য হইয়াছিল অথচ তদনুযায়ী ব্যবসায় বাণিজ্যের দিকে বেশীদূর তাহারা অগ্রসর হয় নাই, ইহা বাস্তবিকই বিস্ময়ের বিষয়।
এই মধ্যবিত্তশ্রেণী যে সমাজের অশেষ উন্নতির মূল তাহা বাঙ্গালীদের বোধগম্য হইয়াছিল। ১৮৯৬ সনে ‘অমৃতবাজার পত্রিকায় নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হয়
“মধ্যবিত্ত লোক যেরূপ অবস্থায় অবস্থিত তাহাতে ইহাদের ধনাঢ্যগণের অবস্থার দোষের ভাগ থাকে না, অথচ গুণটি থাকে। ইহারা দরিদ্রগণের ন্যায় অন্নচিন্তায় দিবারাত্র জর্জরিত হন না, অথচ কর্মঠ হন, সুতরাং ঘঁহারা যেরূপ আত্মোকর্ষের সুবিধা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন, স্বীয় উন্নতির প্রবৃত্তি ও প্রয়োজন ইঁহারা সেইরূপ প্রবলভাবে অনুভব করেন। সুতরাং মধ্যবিত্ত লোক সকল সময়েই সমাজে অধিক উপকারী রূপে পরিগণিত হন। এদেশের সৌভাগ্য অনেক অংশে এই শ্রেণীর লোকের উপর নির্ভর করে। যদি কোন কালে এদেশে কোনরূপ সামাজিক কি অন্য কোন বিপ্লব হয়, হঁহাদের দ্বারাই তাহা সম্পাদিত হইবে। এখন দেশেতে যতরূপ শুভ সূচক কার্যের উদ্যোগ হইতেছে তাহা ইহাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে রক্ষা ও পোষণ করা দেশহিতৈষী রাজার অতি কর্তব্য।”৬
এই মন্তব্যটি যে কতদূর সত্য, উনিশ শতকের শিক্ষা, ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতির সংস্কারের বিবরণ পড়িলেই তাহা উপলব্ধি করা যায়। কারণ এই সমুদয় বিষয়েই মধ্যবিত্তশ্রেণীর লোকেরাই নেতৃত্ব ও প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন।
কিন্তু পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্যের উপসংহারে পত্রিকা দুঃখ-প্রকাশের সহিত লিখিয়াছে যে ক্রমে ক্রমে এই মধ্যবিত্তশ্রেণীর সংখ্যা ও প্রতিপত্তি লোপ পাইতেছে। ইহার কারণ বলা হইয়াছে : “মধ্যবিত্ত লোকের দুইটি জীবনোপায় ভূমি সম্পত্তি এবং চাকুরী এবং ইংরেজ শাসন প্রভাবে দুইটি ক্রমশঃ অন্তর্ধান করিতেছে।” ইহার যে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“মধ্যবিত্ত লোকগণ প্রায়ই গাঁতিদার।….
“১০ আইনের নিমিত্ত গাঁতিদারগণ এক প্রকার উচ্ছন্ন গিয়াছেন এবং যাহারা বজায় আছেন, তাঁহারা জমিদারগণের সম্পূর্ণ কৃপার অধীন। মনে করিলে মুহূর্ত মধ্যে তাঁহারা গাঁতিদারগণকে সর্বস্বচ্যুত করিতে পারেন। যশোর ও নদীয়ায় সৌভাগ্যশালী গাঁতিদার অতি কম আছেন। এমন কি অনেককে এক্ষণ অন্নকষ্টে দিন অতিবাহিত করিতে হয়।
“এদেশে পল্লীগ্রাম মাত্রেই দুই একজন মধ্যবিত্ত লোকের বাস, এবং যিনি কখন ইতিমধ্যে পল্লীতে ভ্রমণ করিয়াছেন, তিনিই বুঝিয়াছেন ইঁহাদের কেমন ভগ্নদশা, প্রায় অনেকের গৃহ ইষ্টকনির্মিত, এমন কি অনেকের গৃহ প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড, কিন্তু সকলেই প্রায় ভগ্ন হইয়া পতিত হইতেছে। বট বৃক্ষ প্রভৃতি দ্বারা বনাকীর্ণ হইতেছে। বাটীতে আর লক্ষ্মীশ্রী দৃষ্ট হয় না, অপিচ অপরিষ্কার বন, পুতিগন্ধ সম্বলিত প্রাসাদ, প্রভৃতি দারিদ্র্যদশার চিহ্ন লক্ষিত হয়। যাহাদের পিতামহগণ দান ধ্যানে দেশমান্য ও প্রাতঃস্মরণীয় ছিলেন, তাঁহাদের সন্তান সন্ততিগণের হয়ত দিনান্তে এক সন্ধ্যা আহার সংগ্রহ হওয়া কঠিন। অনেকেই দুর্দশান্বিত হইয়া কখন কখন ঘৃণাস্কর জীবিকা দ্বারা উদর পূর্তি করিতেছেন। অনেক সময় অবস্থা দৃষ্টে অনেকে তাহাদের নিজ পরিচয়ও বিশ্বাস করে না। ফলে উভয় দিক হইতে মধ্যবিত্ত লোকদিগের শোষণ করিয়া জমিদার ও দরিদ্র প্রজাগণ পুষ্টিবর্ধন করিতেছে এবং ক্রমে সমাজের এরূপ হিতকর সম্প্রদায়ী অন্তর্হিত হইতেছে।”৭
এই অবনতি কতকটা স্বাভাবিক কারণেও ঘটিয়াছিল। ভূমিসম্পত্তি যত বেশী পরিমাণে টুকরা টুকরা ভাগ হইল, প্রতি পরিবারের জীবিকা নির্বাহের পক্ষে তাহা ততই অপ্রচুর হইল। আর শিক্ষিত লোকের সংখ্যা যে-গতিতে বৃদ্ধি পাইতেছিল, চাকুরী ও অন্যান্য জীবিকানির্বাহের উপায় সে-পরিমাণে বাড়ে নাই। সুতরাং মধ্যবিত্তদের প্রধান জীবনোপায়-ভূমিসম্পত্তি ও চাকুরী–আক্ষরিক অর্থে ‘অন্ত ধান’ না করিলেও কার্যতঃ বহু পরিমাণে হ্রাস পাইয়াছিল। বঙ্গদূত ‘অবাধ বাণিজ্য বিস্তার’ ও ‘ইংরেজদের আগমন’ এদেশের ধনসম্পদ বৃদ্ধির আকর বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিল কিন্তু ইহার সুফল বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। এ-সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে।
এই দুরবস্থা নাগরিক অপেক্ষা গ্রাম মধ্যবিত্ত সমাজেই বেশী ঘটিয়াছিল। কারণ জমিদার ও ধনী লোকেরা গ্রাম ছাড়িয়া শহরে যাওয়ার ফলে তাহাদের অনুজীবীদের জীবিকার্জন অপেক্ষাকৃত অধিক কষ্টসাধ্য হইল। অন্যদিকে নাগরিক ভোগবিলাসের আস্বাদ পাইয়া এবং তাহাতে কতকটা অভ্যস্ত হইয়া গ্রামের মধ্যবিত্তশ্রেণীর জীবনধারণের মানদণ্ড অপেক্ষাকৃত উচ্চতর, সুতরাং অধিকতর ব্যয়সাধ্য হইয়া উঠিল।
নাগরিক সমাজ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে নীচজাতীয় লোক লেখাপড়া শিখিয়া সামাজিক মর্যাদালাভে তৎপর হইল। ‘সংবাদ ভাস্করের’ নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
“পূৰ্ব্বে যে সকল নীচ লোকেরা এ দেশে রাজ মজুরী করিত এইক্ষণে তাহারা কর্ণিকাদি পরিত্যাগ করিয়া কাগজ কলম ধরিয়া বসিয়াছে। ধোপা, নাপিত, ছুতার, মেথরাদি ও কেরানি, বিল সরকার, মেট, দালালাদির কর্মে গিয়াছে। নীচ কর্মের লোকের অত্যন্ত অপ্রতুল হইয়াছে। সভ্যরাজ্যে ইতর লোকেরাও লেখাপড়া করিয়া থাকে কিন্তু তাহারা স্ব স্ব জাতীয় নীচকৰ্ম্মে লজ্জা জ্ঞান করে না। ডিউক বংশেরাও যদি অযোগ্য হন তবে স্বচ্ছন্দে নাবিকাদির কৰ্ম্ম করিতে যান। এদেশে ইতর জাতিরা লেখাপড়া শিক্ষা না করিয়া যদি ইংরেজী ভাষায় কয়েকটা কথাও কহিতে পারে তথাপি সে সিপসরকার হইয়া উঠিল প্রাণ গেলেও আর স্বজাতীয় কর্মে হস্ত দিবে না অতএব সর্ব সাধারণে বিদ্যা প্রদানে এই এক মহদ্দোষ হইয়া উঠিয়াছে এতদপ্রতুল নির্মূল করণের কি সদুপায় হইবেক তাহা পরমেশ্বর জানেন।”৮
ইহার ফলে সমাজে জাতিভেদের কঠোরতা ক্রমে ক্রমে শিথিল হইয়া আসিল। উচ্চ নীচ জাতি-বর্ণগত বৃত্তির অনুসরণ যেমন হ্রাস হইল–জন্মগত জাতির মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠাও তেমন ধীরে ধীরে হ্রাস পাইল। ব্রাহ্মণ আর জন্মগত অধিকারে সমাজের শীর্ষস্থান অধিকার করিত না, এবং ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি তথাকথিত উচ্চ ও গোপ, কর্মকার, সূত্রধর, তন্তুবায় প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নজাতির স্তরভেদের পরিবর্তে শিক্ষা, অর্থ ও উপজীবিকাই সমাজে মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠার মানদণ্ডরূপে গৃহীত হইল। ইহার অবান্তর ফল হইল যে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে জন্মগত ভেদাভেদ ক্রমশই ঘুচিতে লাগিল। পরস্পরের অনুগ্রহণ ও সামাজিক ব্যাপারেও একত্রে এক পংক্তিতে ভোজন নাগরিক সমাজে দ্রুতবেগে প্রচলিত হইল, গ্রাম্য সমাজেও ইহার প্রভাব ধীরে ধীরে বিস্তৃত হইল। একমাত্র বিবাহের বিষয়ে প্রাচীন জাতিভেদের কঠোরতা উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত অটল ছিল; বিশ শতকে নাগরিক সমাজে ইহার হ্রাসের সূচনা দেখা দিয়াছে। কিন্তু এখন পর্যন্তও জাতিভেদ মানিয়া চলিলেও একই জাতির মধ্যে শিক্ষা, অর্থ, মর্যাদা প্রতিপত্তি বিষয়ে অনুরূপ পরিবারের মধ্যেই সাধারণতঃ বৈবাহিক সম্বন্ধ ঘটিয়া থাকে। বিশ শতকে অসবর্ণ বিবাহ ধীরে ধীরে প্রচলিত হইতেছে এবং ইহার আইনগত বাধাবিঘ্নও দূর হইয়াছে।
নাগরিক সমাজের কিরূপ অবনতি হইতেছিল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়’ ১৭৬৮ শকে (১৮৪৬ সনে) প্রকাশিত একটি সুদীর্ঘ মন্তব্য হইতে তাহার কতকটা পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করিতেছি–
প্রাচীনপন্থী অশিক্ষিত ধনী সম্প্রদায় সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে:
“এইক্ষণকার প্রাচীন লোক এবং প্রাচীনদিগের সম্পূর্ণ মতানুগামি যাহারা বিষয়োপযোগী হস্তলিপি এবং কিঞ্চিৎ অঙ্কপাত মাত্র যাহাদিগের বিদ্যার সীমা, এবং যাহারদিগের এই প্রত্যয় যে কেবল অর্থ উপার্জনই সমুদয় বিদ্যার তাৎপৰ্য্য এবং তাবৎ জীবনের সুখ-স্বদেশের মঙ্গলামঙ্গল, তাহারা চিন্তাই করেন না-দেশের উপকার’, এ বাক্যের অর্থও তাঁহারদিগের সম্যক হৃদয়ঙ্গম হয় না। তাহারা কেবল স্বার্থের প্রতিই দৃষ্টি রাখেন-এই সীমাকে উল্লঙ্ঘন করিয়া এক পাদও অগ্রসর হয়েন না–সৎ বা অসৎ যে উপায় দ্বারা হউক ধন সঞ্চয় করিয়া তাহা পুত্র ও পৌত্রাদির নিমিত্তে রক্ষা করিতে পারিলেই আপনারদিগকে কৃতকাৰ্য্য বোধ করেন। ইহার জন্যই দিবারাত্রি ব্যতিব্যস্ত, এ কৰ্ম্মের সমাধা পরে যে কিঞ্চিকাল অবশিষ্ট থাকে, তাহা প্রায় অলীক আমোদেই ক্ষেপণ করেন। ইহারদিগের মধ্যে যাঁহারা আপনারদিগকে ধাৰ্মিক বলিয়া অভিমান করেন, তাহারা বাল্য ক্রীড়ার ন্যায় ধর্মের অনুষ্ঠান করেন। বিষয় সম্পত্তি লাভের আশ্বাসের সহিত আমোদ সম্ভোগ এবং সুখ্যাতির আকাঙ্ক্ষা তাঁহারদিগের ধর্ম প্রবৃত্তির প্রধান সূত্র; নতুবা প্রতিমা অর্চনাতে নৃত্য, গীত, গৃহসজ্জা প্রভৃতির জন্যই বিশেষ মনোযোগি হইয়া প্রচুর অর্থ ব্যয় অনেকে কেন করেন? বিশেষতঃ তাহারদিগের উপাসনায় সাত্ত্বিকতার কি অপূৰ্ব্ব চিহ্ন দেখা যায়, যাঁহারা আড়ম্বরের সহিত বিবিধ পূজার সামগ্রী সকল সম্মুখে রাখিয়া বিষয় ব্যাপার তাবৎ নিপুণরূপে তৎকালে সমাধা করেন। এই সমুদয় মনুষ্যের ক্রোড়ে রাশীকৃত ধন স্থাপিত হইলেও তদ্বারা স্বদেশের বিন্দুমাত্র উপকার হইবার সম্ভাবনা নাই। এই সম্প্রদায়ভুক্ত দাতাও অনেকে আছেন, স্বীয় মণ্ডলী মধ্যে যশ উপার্জন করা তাঁহারদিগের প্রধান তাৎপৰ্য্য; অতএব বিবাহ ও দলাদলি প্রভৃতি কৰ্ম্মে কেহ কেহ এককালে সহস্র সহস্র মুদ্রা অক্লেশে দান করেন। যিনি পুত্রের বিবাহ উপলক্ষ্যে পঞ্চাশৎ সহস্র টাকা একদিনে ব্যয় করিয়া থাকেন, তিনি সেই পুত্রের অধ্যয়ন হেতু মাসিক পাঁচ টাকাও প্রদান করিতে ক্লেশ বোধ করেন।”
এই সম্প্রদায় যে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদিগের অবনতির অন্যতম কারণ তাহা দেখাইবার জন্য মন্তব্য করা হইয়াছে :
“সম্পূর্ণ অজ্ঞ হইলেও যে কোন ব্রাহ্মণ বিবিধ ধর্ম চিহ্ন ধারণ করিয়া আপনাকে ধাৰ্মিকরূপে প্রকাশ করে, অথবা তাঁহারদিগের মাত্রা মহোৎসবাদি ক্রিয়া সম্পাদনের প্রয়োজনীয় মন্ত্র সকল কেবল উচ্চারণ করিতে সমর্থ হয়, তাহাকেই যথেষ্ট সমাদর পূৰ্ব্বক ধন প্রদান করিয়া থাকেন, সে ব্রাহ্মণ জ্ঞানাপন্ন কিনা ইহা ভ্রান্তিতেও বিবেচনা করেন না। এই প্রকার উৎসাহ প্রাপ্ত হইয়া অনেক ব্রাহ্মণ দশকর্মোপযোগি কতকগুলীন মন্ত্র অভ্যাস করিয়াই আপনারদিগকে কৃতার্থ বোধ করেন; কঠোর জ্ঞানাভ্যাসে আর কেন পরিশ্রম করিবেন? তথাপি ব্রাহ্মণেরা আপনাদিগের পূৰ্বাভিমানেই মগ্ন রহিয়াছেন–বিবেচনা করেন না যে ব্রাহ্মণ নামের উপযুক্ত তাঁহারদিগের আর কি পদার্থ আছে? অন্যকে ধর্মের উপদেশ দিবেন কি? আপনারা তাহার সম্যক বিরুদ্ধ আচরণ করিতেছেন, এবং অজ্ঞান ও কুপ্রবৃত্তিপ্রযুক্ত বিজ্ঞ সমাজে ক্রমাগত হতাদর হইতেছেন। ইহা কি ব্রাহ্মণদিগের সামান্য লজ্জার বিষয় যে, যে শূদ্রেরা পূৰ্ব্বে তাঁহারদিগের আজ্ঞাকারি দাস ছিল, এইক্ষণে তাঁহারা সেই শূদ্রদিগের আজ্ঞানুবর্তি হইয়াছেন–ধন সেবা জন্য তাঁহারদিগের সেবাতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন? যাঁহারা ব্রাহ্মণত্ব ও পণ্ডিতত্ব লইয়া দম্ভ করেন, অনাহূত, অনাদৃত, তিরস্কৃত হইলেও ধনিদিগের উপাসনা আন্তরিক ধৰ্ম্মানুষ্ঠান হইয়াছে। কি জানি তাঁহারা অনুষ্ঠানের ত্রুটি দেখেন, এ নিমিত্তে কপালে দীর্ঘরেখা, হস্তেতে কোষাপাত্র এবং তদুপরি গঙ্গাস্নানের প্রত্যক্ষ চিহ্ন স্বরূপ সিক্ত বস্ত্রখণ্ড পরিপাটি রূপে সংস্থাপনপূৰ্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে আশীৰ্বাদ করত উপস্থিত হয়েন। অনেক মহোপাধ্যায় পণ্ডিত কিঞ্চিৎ ধন প্রাপ্ত হইলে দাতার মনোরম্য যে কোন অভিপ্রায় তাহাকে শাস্ত্ৰসিদ্ধ বলিয়া প্রায়বক্ত্য (?) করেন এবং কত অশাস্ত্রীয় ব্যবস্থা স্বহস্তেতেও লিখিয়া প্রদান করেন।…..।
“শিষ্য সমীপে নানা প্রকার ছদ্ম ব্যবহার দ্বারা আপনারদিগকে পরম পবিত্র ঋষি তুল্য দেখান। যাঁহার আমিষ ভোজন ব্যতীত এক সন্ধ্যা যাপন হয় না, এবং কুলটা সংসর্গ বিনাও এক রজনী ক্ষেপণ হয় না, শিষ্য গৃহে তিনি হবিষ্যাশী হইয়া অতি শুদ্ধ সত্ত্বরূপে অবস্থান করেন, এবং সংযম উপবাসাদি কঠিন কঠিন নিয়ম পালন পূৰ্ব্বক পরমতপস্বির ন্যায় আপনাকে প্রকাশ করেন। শিষ্যের বিত্ত গ্রহণ জন্য গুরুদিগের এই প্রকার বিবিধ কৌশল, কিন্তু তাহার পরিত্রাণের উপায় বিষয়ে তাহারদিগের জিজ্ঞাসা করিলে কহেন যে প্রতিমাদি স্থূল ধ্যান দ্বারা ক্রমে জ্ঞানের সোপান লাভ হইবেক। হা! এক দিবস একবার মাত্র তাহার কর্ণফুহরে মন্ত্র ধ্বনি প্রবিষ্ট করিয়া উপযুক্ত উপদেশ করিতে চিরকাল ক্ষান্ত থাকিলে সোপান সে কোথায় পাইবে যে তদ্দারা জ্ঞানভূমিতে আরোহণ করিবেক? পরিত্রাণ দূরে থাকুক, অনেকে শিষ্যের অধধাগতির কারণ হয়েন। গোস্বামিরা কৃষ্ণমন্ত্রে বা রাধামন্ত্রে বা যুগলমন্ত্রে শিষ্যদিগকে দীক্ষিত করিয়া গোপাঙ্গনাদিগের সহিত কৃষ্ণের রাসলীলা প্রভৃতিকে অহরহ আলোচনা করিতে অনুমতি করেন। ভণ্ড কথকদিগের সহায়তা দ্বারা শিষ্যেরাও সেই অনুমতি পালন করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করেন না,–বরঞ্চ কোন কোন নিপুণ শিষ্য সেই রাসলীলাদির অনুরূপ অনুষ্ঠান করিতে প্রবৃত্ত হয়েন। শক্তিমন্ত্রের উপদেশক বামাচারিরাও অল্প অনর্থের কারণ নহেন। তাঁহারা প্রচুর মদ্য মাংস ভোজনাদিগকে উপাসনার অঙ্গরূপে উপদেশ করেন, চণ্ডালী প্রভৃতি স্ত্রী সঙ্গকেও অতি গুহ্য পরমার্থ সাধন রূপে ব্যাখ্যা করেন, এবং কদাপি স্বয়ং চক্র মধ্যে বৈরবী সমভিব্যাহারে উপবিষ্ট হইয়া চক্রেশ্বর রূপে কারণবলে ও মন্ত্রবলে চক্রিদিগকে অভিভূত করেন, যেখানে গলিত নরমাংস পৰ্য্যন্ত তাঁহারদিগের লোভ হইতে পরিত্রাণ পায় না।”
ইংরেজীশিক্ষিত সম্প্রদায় সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে :
“এই সমুদয় প্রাচীন ব্যক্তিদিগের সন্তানেরা, যাহারা ইংলণ্ডীয় ভাষায় বিদ্যা অভ্যাস করে, তাহারদিগের বুদ্ধি বিদ্যা সংস্কার সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন হয়। প্রাচীনদিগের সহিত তাহারদিগের ধর্মাধর্ম বিষয়ে কিছুমাত্র ঐক্য হয় না। পিতা অতি যত্নপূৰ্ব্বক স্বীয় গৃহে প্রতিমা অর্চনার আয়োজন করেন, পুত্র তাহাকে কাল্পনিক জানিয়া অবহেলা করেন। পিতা অন্যের সহিত অসংশ্রবে আহারাদি সমাধা করেন, পুত্র কোন জাতি বিচার করেন না-স্নেচ্ছেরও সহিত এক পান ভোজন করিয়া পিতার মানসিক ক্লেশের কারণ হয়েন। এই প্রকার পরিবারের মনে ক্লেশ প্রদান মাত্র অনেকের বিদ্যা শিক্ষার ফল হইয়াছে।”
“কতক ব্যক্তি কেবল মৌখিক বাগাড়ম্বর করিয়াই কাল হরণ করেন। তাহারা মনঃকল্পনাতে স্ত্রীদিগের নিমিত্তে কদাপি প্রকাশ্যে পাঠশালা স্থাপন করিতেছেন, কদাপি বিধবার বিবাহের উদ্যোগ করিতেছেন, কদাপি সমুদয় দেশ হইতে পৌত্তলিকতাকে এক দিবসে উচ্ছেদ করিতেছেন। তাঁহারা দেশের স্বরূপ অবস্থাকে আলোচনা করেন না–নিবিড় অন্ধকারময় পল্লীগ্রামকে স্মরণ করেন না–জ্ঞান ধর্মের যৎকিঞ্চিৎ আন্দোলন এই কলিকাতা ও তৎপার্শ্ববর্তি স্থানে দৃষ্টি করিয়া তদ্বারা বিস্তীর্ণ ভারতভূমিকে একই দিবসে উজ্জ্বল করিতে ইচ্ছা করেন। কিন্তু তাহারা মৌখিক যে প্রকার আন্দোলন করেন, তদনুসারে কি কাৰ্য্য করিয়া থাকেন?”
এই ইঙ্গ বঙ্গ শ্রেণীর ইংরেজের অনুকরণ করার কি কুফল হইয়াছে তাহার বর্ণনা নিম্নরূপ :
“এইরূপে এইক্ষণকার বিদ্বান্ নামে খ্যাত যাহারা, তাহারদিগের দ্বারা উপকার হউক, অপকার নানা প্রকার হইতেছে। তাহারা স্বদেশের আচার ব্যবহারকে অগ্রাহ্য করিয়া ইংলণ্ডীয় লোকের দৃষ্টান্তকে গ্রহণ করিতেই শিক্ষা করেন। বিশেষ দুঃখের বিষয় এই যে তাঁহারদিগের উত্তম ব্যবহার সকলকে গ্রহণ না করিয়া যদ্বারা অনেক অনিষ্টের সম্ভাবনা এমত আচরণ সকলের অনুবৰ্ত্তি হইতেই অভ্যাস করেন। সম্প্রতি মদিরা পানের দৃষ্টান্ত তাঁহারদিগের বিনাশের হেতু হইয়াছে। তাহারা প্রথমতঃ অল্প পরিমাণে এই ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়েন, পরে লোভ সম্বরণে অসমর্থ প্রযুক্ত ক্রমাগত উপভোগ দ্বারা তাহাতে প্রগাঢ় আসক্ত হইয়া এককালে মোহাচ্ছন্ন এবং হতজ্ঞান হয়েন। মদিরা পানে যাহার আসক্তি, তাহার দ্বারা কোন দুষ্কর্মের অসম্ভাবনা হয়? শুভ কর্মের প্রবৃত্তিই বা তাহার কি প্রকারে হইতে পারে? ব্যক্ত করিতে অশ্রুপাত হয় যে কলিকাতার প্রধান প্রধান বিদ্যালয়ের কত সুশিক্ষিত ছাত্র এই মোহকারি দুষ্কর্মে মুগ্ধ হইয়া অবশেষে ব্যভিচার প্রভৃতি কুব্যবহার দ্বারা মনুষ্য নামের অযোগ্য হইয়াছে।”
ইহাদিগের অসৎ দৃষ্টান্তে অশিক্ষিত লোকের চরিত্রও যে কলুষিত হইয়াছে তাহার বর্ণনা :
এই কলিকাতা মধ্যে স্থানে এমত সমূহ ব্যক্তির অধিষ্ঠান আছে, যাহারা দলবদ্ধ হইয়া বিবিধ কুকর্মে অজস্র লিপ্ত থাকে। তাহারদিগের ধর্মের নিয়ম নাই; কোন কৰ্ম্মেরও নিয়ম নাই; কখন পৌত্তলিকের ন্যায়, কখন ভক্ত ব্রহ্মজ্ঞানীর ন্যায়, কদাপি নাস্তিকের ন্যায়ও ব্যবহার করিয়া থাকে। কদাপি দেব বিশেষের প্রতিমা সমীপে দণ্ডবৎ ভূমিষ্ঠ হইতেছে, পুনৰ্ব্বার পরিহাসচ্ছলে সেই দেবতার প্রতি অযোগ্য বাক্য প্রয়োগ করিতেছে; কদাপি ইতর জাতিকে স্পর্শ করিয়া আপনারদিগকে অশুচিত জ্ঞানে গঙ্গানীরে অবগাহন করিতেছে, তৎপরক্ষণেই সকল বর্ণের সহিত একত্র হইয়া একাকার রূপে পান ভোজনে প্রবৃত্ত হইতেছে। মাদক দ্রব্য সেবন এবং লাম্পট্য ব্যবহার এই দলভুক্ত ব্যক্তিদিগের জীবনের সার কৰ্ম্ম হইয়াছে।
“পূৰ্বে এই স্বাধীন ভারতবর্ষস্থ ধৰ্মশীল রাজাদিগের শাসনানুসারে মদ্য ব্যবসায় বা মদ্য ব্যবহার এদেশে প্রায় ছিল না। কিন্তু ইংলণ্ডীয় লোকের অধিকার হওয়া অবধি তাঁহারদিগের নিত্য প্রয়োজনীয় যে মদিরা তাহার ব্যবসায় দেশময় প্রচলিত হইয়াছে, এবং তাহারদিগের দৃষ্টান্তে এদেশস্থ লোক সকল অপরিমিত মদ্যপানে প্রবৃত্ত হইয়াছে। মাদক দ্রব্যের কর সগ্রহ জন্য নিযুক্ত কর্মচারিরা অধিক ধনাগম করিতে পারিলেই রাজপুরুষদিগের নিকটে প্রতিপন্ন হয়েন, এ প্রযুক্ত স্বীয় অধিকারে মদ্যাদির অধিক বিপণী স্থাপন দ্বারা অধিক কর সংগ্রহ জন্য তাঁহারদিগের একান্ততঃ যত্ন হয়। ইহাতে মাদক দ্রব্যের বাণিজ্য বৃদ্ধির সহিত এতন্নগরস্থ লোকেরা ধনে প্রাণে বিনষ্ট হইতেছে। অধুনা এই নগরে রাজশাসন অভাবে যেমন মদ্য পানের বাহুল্য হইতেছে তদ্রূপ দিন দিন বেশ্যা শ্ৰেণীও বৃদ্ধি হইতেছে। পূৰ্ব্বকালে রাজশাসনে নগর বা গ্রামের প্রান্ত ব্যতীত কদাপি তাহারা তন্মধ্যে বসতি করিতে সমর্থ হইত না; ইহার কতক দৃষ্টান্ত পল্লীগ্রামে অদ্যাপি রহিয়াছে। কিন্তু ইদানীং এই রাজধানীতে তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত হইয়াছে। লোক যখন স্বীয় বাটীর চতুর্দিকে বেশ্যাদিগের হাব ভাব, কটাক্ষ সৰ্ব্বদা দেখিতে পায়, তখন সহজেই তাহারদিগের মন তাহাতে আসক্ত হয়। কেবল পুরুষেরা কুপথগামী হয় না, অনেক। অন্তঃপুরস্থ স্ত্রী এই কুদৃষ্টান্ত দ্বারা ধৰ্ম্ম হইতে প্রচ্যুত হয়।
“বেশ্যাগমন পাপ এইক্ষণে কলিকাতা মধ্যে যে কি প্রকার বিস্তারিত হইয়াছে তাহা বর্ণনা করা যায় না। ধনী, মধ্যবর্তী, অতি দীন পৰ্য্যন্ত এই দুষ্কর্মে এমত সাধারণ রূপে মগ্ন হইয়াছে যে অন্য অন্য কৰ্ম্মের ন্যায় ইহাকে পরস্পর কাহারও নিকটে কেহ বিশেষ গোপন করে না–আপনার এই পাপ স্বীয় মুখে ব্যক্ত করিতেও কেহ লজ্জা বোধ করে না। এই নগর মধ্যে এমত পল্লী নাই যেখানে শত শত বেশ্যা একত্র বাস না করে, এবং তন্মধ্যে প্রায় এমত বেশ্যা নাই যাহার আলয়ে বহু লম্পট ব্যক্তিকে অহর্নিশি একত্র দেখা না যায়? সন্ধ্যার পর নগর মধ্যে পাপের মহোৎসব উপস্থিত; কোন স্থানে বহু ব্যক্তি দলবদ্ধ হইয়া গণিকার গৃহে প্রবেশ করিতেছে, কুত্রাপি কোন বাবুর কদাচারের সাক্ষী স্বরূপ অশ্বযান তাঁহার রক্ষিতা বেশ্যা-দ্বারে স্থাপিত রহিয়াছে; কোন কোন বেশ্যার আলয় হইতে মাদকোন্মত্ত সমূহ লম্পটের উল্লাস কোলাহল ধ্বনিত হইতেছে, কুত্রাপি গণিকার অধিকার জন্য বিমোহিত পুরুষেরা বিবাদ, কলহ, সংগ্রামে প্রাণপণে প্রবৃত্ত হইতেছে। কুকর্মদ্বারা চিত্তের বিকৃতি ইহা অপেক্ষা আর অধিক কি সম্ভব হয় যে আপনার রক্ষিতা গণিকালয়ে স্বীয় বালক পুত্ৰাদি তাঁহার সাক্ষাতে, বরঞ্চ তাঁহার অনুমতিক্রমে স্বচ্ছন্দে গমনাগমন করে এবং তথায় পরিপাটীরূপে লাম্পট্য বিদ্যায় সুশিক্ষিত হইয়া চিরজীবন পাপের বর্জ্যে ভ্রমণ করে। তাহারা জন্মকালে দুশ্চরিত্র পিতার অসৎ স্বভাব সকলকে অধিকার করিয়া ভূমিষ্ঠ হয়, এবং জীবনকালে তাঁহার কুদৃষ্টান্তের অনুগামী হইয়া সংসারে মহা উপদ্রবের হেতু হয়। এবম্পরম্পরানুসারে এই জঘন্য দুষ্কৰ্ম্ম গঙ্গা প্রবাহের ন্যায় বহমান হইতেছে এবং ক্রমশঃ বিস্তারিত হইয়া পল্লীগ্রাম পর্যন্ত প্লাবিত করিতেছে।
“এই দলভুক্ত ধনি সকল এই দুষ্কর্মের প্রসঙ্গ, আয়োজন এবং উপভোগে সৰ্ব্বদা মগ্ন থাকেন, এবং ইহার আনুষঙ্গিক অশ্বনের শোভা, পরিচ্ছদের পারিপাট্য ও বিহঙ্গ ক্রীড়া প্রভৃতি বিবিধ ইন্দ্রিয় সুখের নিমিত্তে অপরিমিতরূপে রাশি রাশি ধন ক্ষেপণ করেন কেহ কেহ সকল সম্পত্তি নষ্ট করিয়া নানা প্রকার অপমানের আস্পদ হয়েন। ইহারা কেবল স্বীয় অমঙ্গলের কারণ আপনারা হয়েন
, ইহারদিগের পার্শ্ববৰ্ত্তি আশ্রিত যুবকগণের বিষম দুরদষ্টের হেতু হয়েন। তাহারা বাবুর তুষ্টির নিমিত্তে তাঁহার সকল প্রিয় কুকর্মে উৎসাহ প্রদান করিতে থাকে, বরঞ্চ তাহার সম্পাদন জন্য উল্লাসের সাহত যত্নবান হয়। এইরূপে অনেক নির্দোষি ব্যক্তি ধনি বাবুদিগের সংসর্গ দ্বারা দুষ্কর্মের আমোদে সুশিক্ষিত হয় এবং তদ্বারা তাহারদিগের বিদ্যা, বুদ্ধি, যশ, বীৰ্য্য একেবারে বিনষ্ট হয়।
“যাহারদিগের কুকর্ম সম্পাদনের উপযোগী ধন নাই, অথচ বুদ্ধি বিদ্যার হীনতা প্রযুক্ত ন্যায় পূৰ্ব্বক উপার্জন করিতে যাহারা ক্ষমতাবান্ নহে, তাহারা সামান্য কোন বিষয় কর্মে প্রবৃত্ত হইয়া চৌর্য প্রবঞ্চনাকে ধন লাভের প্রধান উপায় রূপে স্থির করে। বেশ্যা গমন তুল্য কৰ্ম্মস্থলে চৌর্য ব্যবহার এইক্ষণকার সাধারণ পাপ হইয়াছে এবং অভ্যাস দ্বারা অনেকের চিত্ত এমন কঠিন হইয়াছে যে এই কদাচারকে তাহারা কুকৰ্ম্ম বলিয়া জ্ঞান করে না এবং প্রভুর সকল সম্পত্তি হরণ করিতে পারিলেও তজ্জন্য আপনারদিগের দোষ বোধ করে না।
“পুরুষদিগের এই প্রকার অত্যাচারে এবং দেশের নানা প্রকার কুপ্রথাতে এদেশীয় অবোধ স্ত্রীলোকেরা যেরূপ ক্লেশ প্রাপ্ত হইতেছে, তাহা স্মরণ করিলে রোদন করিতে হয়।…..
“অনেক পুরুষ এ প্রকার দুরাচার যে ভাৰ্যার সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাহারদিগের প্রবৃত্তিই হয় না-মাসান্তেও একবার তাহারা অন্তঃপুরের সংবাদ গ্রহণ করে না। অনেকে উপপত্নীর বশীভূত প্রযুক্ত কোপ দৃষ্টি ব্যতীত একদিনের নিমিত্তে প্রণয় দৃষ্টিতে ভাৰ্য্যার প্রতি অবলোকন করে না, এবং প্রায় অপ্রিয় ব্যতীত প্রিয় শব্দে তাহাকে সম্ভাষণ করে না। ব্যক্ত করিতে হৃদয় বিদীর্ণ হয় যে কোন পতির নিতান্ত নিদারুণ কুব্যবহার জন্য যন্ত্রণা সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া কত স্ত্রী আত্মঘাতিনী পর্যন্ত হইয়াছে।”৯
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সম্বন্ধে পূর্বে উদ্ধৃত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মন্তব্যের প্রসঙ্গে ‘সম্বাদ ভাস্করের’ নিম্নলিখিত মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্য :
“কলিকাতা নগরীর বিধবাবিবাহ সভায় যে সকল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা গমন করিয়াছিলেন তাঁহারদিগের মধ্যে অনেকের নিমন্ত্রণাদি বন্ধ হইয়াছে বিধবাবিবাহ সপক্ষেরা যদি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের ক্ষতি পূরণ না করেন তবে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা চতুস্পাঠী রাখিতে পারিবেন না, অগত্যা “শ্রীবিষ্ণু” বলিয়া বিপক্ষ দলের শরণাপন্ন হইবেন, আমরা শুনিলাম ইহার মধ্যেই কেহ কেহ বিষ্ণু স্মরণ করিয়াছেন, বিপক্ষ পক্ষে সম্মান পাত্র কমলা পুত্রেরা ঐক্যবাক্য হইয়াছেন তাহারা যদি বৃত্তি বিধান না দেন আর স্ব স্ব দলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের নিমন্ত্রণাদি রহিত করেন তবে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কি উপায়ে জীবন ধারণ করিবেন? এই ক্ষণে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের লভ্য কি আছে? পূৰ্ব্বে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মহাশয়েরা প্রাতঃস্নান করিয়া সন্ধ্যা পূজা করিতেন তৎপর ধনিগণকে আশীর্বাদ করিতে যাইতেন এইক্ষণে আশীৰ্বাদ গমন উঠিয়া গিয়াছে; ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা আশীৰ্ব্বাদ করিতে গেলে দূরে থাকিতেই অনেকে কহেন “এই অসভ্য বেটারা পোড়াইতে আসিতেছে কতকগুলা সংস্কৃত শ্লোক ছাড়িবে আর কথায় কথায় অর্থ চাহিবে” ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের এমনি দুর্দশা হইয়াছে “আশীৰ্বাদ” বলিয়া অগ্রে হস্ত পাতিতে হয়, আশীৰ্বাদ বলিয়া হস্ত পাতিলে ধনিরা কি করেন? কেহ কেহ বলিদানের ন্যায় হস্ত তোলেন, অনেকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া প্রণাম সারেন, পরে মনোভ্রমে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা যদি বেলা দুই প্রহর পর্যন্তও বসিয়া থাকিয়া সংস্কৃত কবিতা বকাবকি করেন তথাচ কপর্দক দেখিতে পান না, পরিশেষে প্রণাম চিহ্ন রম্ভা দর্শন করিয়া বিদায় হন, তবে কোন ব্যাপার প্রয়োজনে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিমন্ত্রণ না করিলে নয় আর দুর্গোৎসবাদি কৰ্ম্মে বৃত্তি প্রদান পূৰ্ব্বাবধি চলিত হইয়া
আসিয়াছে, ধার্মিকেরা তাহা রহিত করিতে পারেন না, এই কারণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে ডাকেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরাও সেই বৃত্তি দান বিদায় দানে কোন প্রকারে সিদ্ধান্নে জীবন যাপন করিতেছেন তাহাও যদি যায় তবে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কি করিয়া সংসার চালাইবেন?”১০
ইহার প্রতিকারের জন্য উক্ত পত্রিকায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব করা হইয়াছে:
“যদি আমারদিগের পরামর্শ শ্রবণ করেন তবে ধৰ্ম্ম রক্ষার উপায় দেখুন, হিন্দু মাত্র সকলে একত্র হইয়া অর্থ সংগ্রহ করুন দান পত্রে প্রতিজ্ঞা লিখিবেন যাহার যত উপার্জন হইবে মাসে তাহার একাংশ ধৰ্ম্মার্থে রাখিবেন, একৰ্ম্ম অল্প ধনের কর্ম নহে, প্রচুর ধন সংগ্রহ করিতে হইবেক কোন বিশ্বাসযোগ্য স্থলে তাহা সঞ্চয় থাকিবে ঐ ধনে কোন বাণিজ্যালয় হইবে, বাণিজ্য দ্বারা তাহা বৃদ্ধি পাইবে এদিকে মাসে মাসে সকলে স্ব স্ব উপার্জনের একাংশ দিবেন, মাসিক দানে মূলধন পুষ্ট হইতে লাগিল, বাণিজ্য দ্বারা নানা দেশ হইতে বৃদ্ধি ধন আসিল, বাণিজ্য লভ্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে বিভক্ত করিয়া দিবেন, সে দান এইরূপ দান হইবে পণ্ডিতগণ স্বচ্ছন্দে থাকিয়া শাস্ত্র ব্যবসায় করিতে পারেন, তাহাদিগকে অন্ন বস্ত্রাদি জন্য অন্য চিন্তা করিতে হইবে না অন্য চিন্তায় চিন্তিত না হইয়া অন্তেবাসিগণকে সুশিক্ষা দিবেন, ছাত্রদিগের মধ্যে যিনি শিক্ষা বিষয়ে সুপাত্র হইবেন তিনি মাসে মাসে বৃত্তি পাইবেন সেই বৃত্তি এমন হইবে মাসে মাসে তাঁহার বাটীর সকলের দিনবৃত্তি চলিবে, ইহা হইলে সে ছাত্রকে পারিবারাদি প্রতিপালন জন্য অন্য চিন্তা করিতে হইবেক না।”১১
জন্মগত জাতিভেদের বন্ধন শিথিল হইলেও, বৃত্তিভিত্তিক জাতির মধ্যে ঐক্য বন্ধন শহরে বেশ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সমসাময়িক পত্রিকায় এইপ্রকার। জাতীয়তা ও তাহার নিদর্শনস্বরূপ ধর্মঘটের উল্লেখ আছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি :
(ক) ১৮৫৯ সনের জুন মাসে গোপ ও মোকদের ধর্মঘট।১২
“কলিকাতা এবং ইহার নিকটস্থ গ্রামনিবাসি গোপ এবং মদকেরা পরস্পর বিবাদ উপস্থিত করিয়া যে প্রকার প্রতিজ্ঞা করিয়াছে তাহাতে মণ্ডলোভি বাবু ও বিপ্রবর্গের বিলক্ষণ ক্লেশ বোধ হইয়াছে, দেশীয় ছানার উত্তম সন্দেশ আর কেহ দেখিতে পান না, বড়বাজারের রাতাবি আর প্রস্তুত হয় না, এই বিবাদের মূল কারণ মদকেরা পূৰ্ব্বে গোপদিগের নিকট হইতে গামছা বদ্ধ ছানা ওজন করিয়া লইত তাহার জলাংশ বাদ দিত না, পরে তাহারা ছানার বন্ধন খুলিয়া তাহার মধ্যে ভাগ কাটিয়া জল বাদ দিয়া ওজন করার নিয়ম করাতে গোপগণ বিলক্ষণ ক্ষতিবোধ করিয়া একেবারে পরস্পর ঐক্য হইয়া ধৰ্ম্মঘট করিয়াছে, যে মদকদিগকে ঐরুপ ছানা বিক্রয় করিবেক না, এবং মদকেরাও প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, জল বাদ না দিলে গোপদিগের ছানা ক্রয় করিবেক না, এইক্ষণে আনারপুরের ছানা যাহা….বলিয়া প্রসিদ্ধ আছে, তাহাই ক্রয় করিতেছে, গোপ-মদকের এই প্রতিজ্ঞা কত দিবস থাকে তাহা বলা যায় না, আপাততঃ এতদ্বারা কলিকাতার বাজারে উত্তম সন্দেশ অদৃশ্য হইয়াছে শ্রাদ্ধ ও বিবাহ সময়ে যাহারা আহারের সময়ে উৎকৃষ্ট মণ্ডার প্রতি অধিক লালসা প্রকাশ করেন, অধুনা তাহারদিগের ঐ লালসা পূর্ণ হয় না, গোপেরা অধিক পরিমাণে ছানা প্রস্তুত না করাতে কলিকাতা এবং ইহার পার্শ্ববর্তি স্থানাদিতে দুগ্ধ বিলক্ষণ সস্তা হইয়াছে; সকল রাজপথে গোপেরা ভারে ভারে তাহা বহন করিয়া প্রত্যেক সের দুই তিন পয়সা মূল্য বিক্রয় করিয়া বেড়াইতেছে, দুগ্ধ হইতে ক্ষীর, মাখন, ননী, স্বর, মালাই, দধি অনেক প্রস্তুত হইতেছে, যে সকল দুঃখি লোক ঐ উপাদেয় দ্রব্যাদির আস্বাদ প্রাপ্ত হয় নাই, তাহারা তাহা আহার করিয়া কৃতার্থ মানিতেছে।”
(খ) গো শকট, মুটের ধর্মঘট।১৩
“বিধি নিৰ্ব্বন্ধ হইয়াছে কলিকাতা নগরীতেও গাড়িঘোড়া প্রভৃতির ট্যাক্স হইবে, ইহাতে গো শকট বাহকেরা ঐক্যবাক্য হইয়া গত সোমবারাবধি তাহাদিগের গাড়ি চলায়ন বন্ধ করিয়াছে তাহাতে নগরবাসীদিগের বিশেষতঃ বণিকগণের অনেক ক্ষতি হইতেছে বণিকেরা দ্রব্যাদি আমদানী রপ্তানী করিতে পারেন না, এবং আমরা গত বৃহস্পতিবারে নারিকেলডাঙ্গার গোলা হইতে সুন্দরীকাষ্ঠ আনয়নার্থ লোক পাঠাইয়াছিলাম আমারদিগের লোকেরা গো শকটাভাবে কাষ্ঠ আনয়ন করিতে পারে নাই এবং মুটেরাও গাড়োয়ানদিগের সহিত যোগ দিয়াছে, গাড়োয়ান ও মুটে পাঁচ ছয় সহস্র লোক একত্র হইয়া ডেপুটি গভর্নর বাহাদুরের নিকট প্রার্থনা করিয়াছে তাহারদিগের প্রতি এই ট্যাক্স ক্ষমা হয় কিন্তু উক্ত মহাশয় সাহেব তাহাদিগের উত্তর প্রদান করিতে অসমর্থ হইয়াছেন, উড়ে বেহারা, রোমানি বেহারা গরু গাড়োয়ান ইত্যাদি নীচ লোকেরা ঐক্যবাক্য আছে কিন্তু আশ্চৰ্য্য এই যে ইহা দেখিয়াও এতদ্দেশীয় মান্য লোকেরা লজ্জা জ্ঞান করেন না, আমরা সকলে পরামর্শ করিয়া কি গাড়িঘোড়া পরিত্যাগ করিতে পারি না, এদেশে যখন গাড়িঘোড়া ছিল না তখন কি যানবাহন দ্বারা মান্য লোকদিগের কর্ম চলে নাই, সম্ভ্রান্ত লোকেরা গাড়িঘোড়ার কর নিবারণ করিতে পারিলেন না এইক্ষণে গাড়োয়ানদিগকে আশীৰ্বাদ করুন।”
(গ) ধোপার ধর্মঘট।১৪
“কলিকাতা নগরীয় কৃষ্ণবাগানে অনেক ধোপ বসতি করে, তাহারা দেখিয়াছে। মুট্যে মজুর পর্যন্ত সকলে স্ব স্ব কৰ্ম্মে দ্বিগুণ ত্রিগুণ বেতন লইতেছে এই কারণ জ্ঞাতি বন্ধুগণকে আবাহন পূৰ্ব্বক এক সভা করিয়াছিল তাহাতে প্রামাণিক ধোপারা বক্তৃতা করিয়া সকল ধোপাকে জানাইল এক টাকার চাউল দুই টাকা হইয়াছে, এক পয়সার মাছ দুই পয়সায় বিক্রি হইতেছে, মুট্যেরা মোট লইয়া যে স্থানে এক পয়সায় মাছ যাইত দুই পয়সা না পাইলে সে স্থানে যায় না, আমরা এক পয়সার হাঁড়ি দুই পয়সা না দিলে পাই না পূৰ্ব্বে টাকায় ছয় মণ কাঠ বিক্রয় হইত এখন তিন মণের’ অধিক দেয় না এইরূপ সকল বিষয়ে দ্বিগুণ লাভ হইতেছে তবে আমরাই বা কি কারণ চিরকাল এক মূল্যে থাকিব? অতএব সকলে প্রতিজ্ঞা কর এক পয়সায় যে কাপড় কাচিয়া থাকি দুই পয়সা না পাইলে তাহা কাচিতে পারিব না। ইহাতে সভাস্থ সমস্ত ধোপা প্রতিজ্ঞা করিয়াছে আর এক পয়সায় কাঁচাখানা ও কাঁচা হইবেক না, যাহারা নগদ পয়সায় কাপড় ধোলাই করাইত তাহারা ঘোর বিপদে পড়িয়াছে, ধোপারা তাহারদিগের কাপড় লয় না, দরিদ্র লোকেরা দুই চারিখানা কাপড় কাঁচাইতে গেলে রজকেরা কহে ‘প্রতি কাপড় দুই পয়সা অগ্রে রাখ তবে কাপড় লইব নতুবা চলিয়া যাও, আমরা আর কাপড় কাঁচা ব্যবসায় করিব না, সন্তানদিগে পাঠশালায় দিয়াছি কাপড়ের মোট বহন কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিলাম, এদিগে কাপড় ধোলাই জন্য দরিদ্র লোকেরা দুঃখ পাইতেছে ধোপারাও প্রতিজ্ঞা করিয়াছে কাপড় ধোলাই করিবেক না।”
এরূপ উড়িয়া কাষ্ঠবাহী ও কাষ্ঠছেদক, মজুর, পাল্কীবাহক, নৌকার মাঝি প্রভৃতিরও ধর্মঘটের বিবরণ পাওয়া যায়।
বৃত্তিভিত্তিক জাতির ঐক্যবন্ধনের আর-একটি পরিচয় পাওয়া যায় কলিকাতার বৃত্তিভিত্তিক বসতিবিন্যাসে। এক বৃত্তি অবলম্বনকারীরা যে পূর্বে এক পাড়ায় বাস করিত এখন পর্যন্তও কলিকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের নাম তাহার সাক্ষ্য দেয়, যদিও কার্যতঃ নামগুলি অনেক স্থলেই এখন একেবারে অর্থহীন। এবিষয়ে নিম্নলিখিত কয়েকটি পাড়ার নাম উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে-কলুটোলা, কুমারটুলি, বেনিয়াটোলা, জেলেপাড়া, কসাইটোলা, পটুয়াটোলা, শাখারিপাড়া, কাঁসারিপাড়া। গোপ লেন, ঘোষ লেন, হালদারপাড়া, বোসপাড়া লেন, দত্ত লেন, ব্রাহ্মণপাড়া লেন, বসাক লেন, চাউলপটি লেন, ছুতারপাড়া লেন, গোঁসাই লেন, হাজরা রোড, কাঠগোলা লেন, কুণ্ড লেন, রায়পাড়া লেন, স্যাকরাপাড়া লেন, তাঁতিবাগান রোড, তেলিপাড়া লেন, যোগীপাড়া লেন–প্রভৃতিও এইরূপ বসতিবিন্যাসের নিদর্শন বলিয়া গৃহীত হইতে পারে।
বলা বাহুল্য, বর্তমানকালে এইসকল নামের প্রায়ই কোন সার্থকতা নাই, কারণ কুমারটুলীতে এখনও বহু কুমার থাকিলেও প্রায় সমস্ত অঞ্চলের নামের সহিতই সেই সেই বৃত্তি অবলম্বনকারীর সম্বন্ধ ঘুচিয়া গিয়াছে।
২. বেশ্যা
কলিকাতায় বেশ্যাবৃত্তির প্রসার আর-একটি দুরপনেয় কলঙ্ক।
১৮৪৬ সনে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কলিকাতায় বেশ্যাগমনরূপ ব্যভিচারের সম্বন্ধে উক্তি পূর্বে উদ্ধৃত হইয়াছে। কলিকাতাবাসীরা সমাজের এই ব্যাধি দূর করার সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন না। স্বনামখ্যাত কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয় এ-বিষয়ে বহুলোকের স্বাক্ষরিত যে আবেদনপত্র পাঠাইবার ব্যবস্থা করেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি :
“নিম্নস্বাক্ষরিত বঙ্গদেশবাসীদিগের সবিনয় নিবেদন এই : এক্ষণে পোলিস কর্তৃক যেরূপ শান্তিরক্ষা হইতেছে তাহা বর্ণনা বাহুল্য, অতি সুচারুরূপেই হইতেছে তাহা সন্দেহ নাই, নগরীর যাবতীয় শান্তিরক্ষার মধ্যে বেশ্যাকুল দ্বারা তাহার অনেক অংশের ত্রুটি হয়, কারণ বারঘোষাকুল সমস্ত রাত্রি মদ্যপান দ্বারা গীতবাদ্যাদির কোলাহলে এই উৎপাত আরম্ভ করে যে ভদ্রলোক মাত্রেই উক্ত পল্লীতে শয়নাগার ত্যাগ করণে বাধ্য হন চৌৰ্য্য কাৰ্য্যদ্বারা যে সমস্ত দ্রব্যাদি সংগৃহীত হয় তাহা কেবল ঐ বারললনাগণের ব্যবহার কারণ। রাত্রিকালে মদ্য বিক্রয় যাহা ভয়ানক শান্তিভঙ্গ করে তাহা কেবল এই বারঘোষগণের নিমিত্ত হয়, কলহ মদ্যপান দ্বারা জীবন সংহার, ব্যসন, দূতক্রীড়া ইত্যাদি ভয়ানক অত্যাচার করণ এই বারস্ত্রীগণের আলয়েই সম্পাদিত হয়, আরো বঙ্গীয় যুবকবৃন্দের ইহা স্বভাব সংশোধন বলিলেও বলা যাইতে পারে, কারণ তাহারা কি প্রাতঃকালে কি সায়ংকালে সাবকাশ হইলেই এই কদাচার কর্মে প্রবৃত্ত হয়, বেশ্যা সংখ্যার ক্রমশঃ উন্নতি হইতেছে তাহার তাৎপর্য কি কেবল তাহাদিগের প্রতি কোন উত্তম নিয়ম অদ্যাবধি প্রচলিত হয় নাই বলিয়াই তাহারা স্বেচ্ছাচারিণী হইয়া যথেচ্ছা তাহাই করিতেছে, কেবল যে বেশ্যাদিগের সংখ্যা বৃদ্ধি হইবার এত উৎপাত হইতেছে তাহাও নহে, বঙ্গদেশীয় ধনবানগণ স্বীয় স্বীয় বশত বাটীতেও অধিক ভট্টালোভী হইয়া ভদ্রপল্লীর মধ্যে বেশ্যাগণকে স্থানদান করিয়া অতুল সুখপ্রাপ্ত হইতেছেন যদ্বারা একঘর বেশ্যা বৃদ্ধি হইবায় সেই ভদ্রপল্লী একেবারে অভদ্র নিয়মে পরিপূর্ণ হইতেছে অতি নিৰ্ম্মল নিষ্কলঙ্ক ধনবান মান্য বংশের প্রাসাদাদির নিকটেই বেশ্যা নিকেতন কেবলই ভয়ানক ব্যবহার প্রদর্শিত হইতেছে। অতএব হে সভ্য মহোদয়গণ, আপনারা মনোযোগী হইয়া বেশ্যাগণকে নগরের প্রান্তে একত্রে নিবসতি আজ্ঞা করুন নতুন কোন প্রকারেই ভদ্র ধনবান এই বিশাল ধনপূর্ণ ভদ্র নগর বাসের উত্তম স্থল বোধ করিতে পারেন না।”১৫
এ-বিষয়ে জনমত প্রকাশ করিবার জন্য ১৮৫৮ সনের ২৩ মে বিদ্যোৎসাহিনী সভায় “বেশ্যাগণের বাস করিবার নিমিত্ত এক নির্দিষ্ট পল্লী নিরূপিত হয়”–এই মর্মে লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলে আবেদন করার প্রস্তাব বিচার ও সেই বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। শ্রীকালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় তখন সেই সভায় সম্পাদক ছিলেন।১৬
পাঠশালার নিকট বেশ্যালয় থাকাতে ছাত্রদের চরিত্রহানি আশঙ্কা করিয়া ইংলিশম্যান পত্রিকায় এক চিঠি প্রকাশিত হয় এবং ইহার ফলে কতিপয় বেশ্যাকে ইংরেজী স্কুলের নিকট হইতে উঠাইয়া দেওয়া হয়। ১২৬১ সনের ৩রা আশ্বিন তারিখের সংবাদ প্রভাকরে ইহার বিরুদ্ধে বেশ্যাগণের নামে এক প্রতিবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ইহাতে তাহাদের দুঃখ-দুর্দশার উল্লেখ করিয়া তাহাদের সপক্ষে যে যুক্তি প্রদর্শন করা হইয়াছিল তাহার কিঞ্চিৎ নীচে উদ্ধৃত করিতেছি :
“ভদ্রকুলবধূ সুলোচনাগণ সৰ্বসাধারণের লোচনানন্দদায়িনী হইয়া নিঃশঙ্কায় স্বামী বর্তমানে পরপুরুষকে সুখ সম্ভোগ করিতেছে, কিন্তু তাহাতেও তাহারা ধন গৌরবে এক স্বামী সত্ত্বে সাধ্বী হইয়া পরমারাধ্যা ও অহল্যাদি পঞ্চকন্যা তুল্যা প্রাতঃস্মরণীয়া হইয়াছে, হায় কি দুঃখ! আমরা পতি প্রতি অপ্রীতি প্রকাশ ও ত্যাগ করিয়াই কি এই অপরাধিনী হইয়াছি? এই প্রবলা কল্পিত কুলবালারা পুরুষ মন বিহঙ্গ ধৃত জন্য যে নবনিতম্ব বাগুরা বিস্তার করত ঈষদ্বস্ত্রাচ্ছাদিত বঙ্কিম নয়নে সহাস্য আস্যে যকালীন বারি আনয়ন ছলে স্কুলের নিকটবর্তি বয়েঁ গমন করে তৎকালীন কি বিদ্যার্থি বালকবৃন্দ নেত্র যুগল অঞ্জলী (? অঙ্গুলী) আচ্ছাদন দেয়? না সে সময়ে ফুলবান বাণে পরাভূত করে? অথবা কি কন্দর্প দর্পশূন্য হয়?”১৭
এই প্রসঙ্গে কলিকাতা-নিবাসিনী বেশ্যাস্বাক্ষরিত ‘বিদ্যাদর্শন পত্রিকার’ সম্পাদককে লিখিত এক চিঠিতে (১৭৬৪ শক) স্ত্রীলোকের ব্যভিচারের কারণ সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইয়াছে তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“মহাশয় যে নিয়মক্রমে বিদ্যাদর্শন প্রকাশ করিতেছেন, তাহাতে আমি অতিশয় আহ্লাদিত এং ভরসাযুক্ত হইয়াছি। আমার নিকট এক পণ্ডিত সৰ্ব্বদা গমনাগমন করেন তিনি বিদ্যাদর্শনের প্রথম সঙ্খ্যাবধি চতুর্থ সংখ্যা পর্যন্ত আমার সম্মুখে পাঠ করিয়াছেন, তাহার সকল ব্যাপার শ্রবণ করিয়া নিতান্ত বোধ হইল, যে এই পত্র কেবল আমারদিগের অর্থাৎ (স্ত্রীলোকদিগের) হিতার্থেই সৃষ্টি হইয়াছে। এই সুযোগে আমি আপন দুঃখের বৃত্তান্ত প্রকাশ করিতে বাসনা করি, এবং বোধ করি যে তাহা জনসমাজে উপদেশজনক হইবে। যদিও আমার বিদ্যা এবং লিপিনৈপুণ্য নাই, কেননা আমি বঙ্গদেশের স্ত্রী, কিন্তু আমার অভিপ্রায় সকল কথিত পণ্ডিত মহাশয় দ্বারা লিপিবদ্ধ করিয়া প্রেরণ করিতেছি, অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক প্রকাশ করিতে কৃপণ হইবেন না।
“আমি শান্তিপুর নিবাসী এক কুলীন ব্রাহ্মণের কন্যা ছিলাম, শৈশবকাল বাল্যক্রীড়ায় যাপন হইয়া যৌবনের প্রারম্ভ হইল, তথাপি পিতামাতা বিবাহের উদ্যোগ করেন না; ইহাতে একদিন আমি প্রতিবাসিনী কোন রমণীর নিকটে এই প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া অবগত হইলাম, যে তিন বৎসর অপেক্ষাও অল্প বয়ঃক্রম কালীন আমার বিবাহ হইয়াছে। এই বাক্য শ্রবণ মাত্র আমি একেবারে স্তব্ধ রহিলাম। পরন্তু যখন আমার ষোড়শবর্ষ বয়স তখন কোন দিবস অপরাহে পঞ্চাশত্বর্ষ বয়স্ক একজন মনুষ্য আমারদিগের গৃহদ্বারে উপস্থিত হইলেন, এবং পরিচয় গ্রহণ দ্বারা জানা গেল মাত্র অন্তঃকরণ কম্পিত হইল। লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষোভ, ক্রোধ, সংশয় প্রভৃতি ভাবের এ প্রকার আন্দোলন হইয়াছিল, যে আমি আর লোক সমাজে মিশ্রিত হইবার অভিলাষ একেবারে ত্যাগ করিয়াছিলাম তাহার কুৎসিত আকৃতি, গলিত অঙ্গ এবং পক্ কেশাদি দর্শন করিয়া আমি হতবুদ্ধি হইয়াছিলাম। আমি জ্ঞানতঃ তাঁহাকে বরণ করি নাই, কদাপি তাঁহার সহিত জ্ঞানাবস্থায় সাক্ষাৎ নাই, তাঁহার সহিত আমার মনের ঐক্য বা প্রণয়ের সঞ্চার হয় নাই অথচ তিনি আমার পতি আমার সুখের মূলাধার, কি আশ্চর্য্য তাহার মূর্তি যেমন কুৎসিত রজনীতে তাঁহার ব্যবহারও তদ্রূপ প্রত্যক্ষ হইল। যাহা হউক পরদিন প্রাতঃকালে তিনি আমার পিতার নিকট কিঞ্চিৎ ধনসংগ্রহ পূর্বক যে প্রস্থান করিলেন সেই পৰ্য্যন্ত আর দর্শন হয় নাই। একে আমার যৌবনোদ্যম, তাহাতে এবপ্রকার বিড়ম্বনা সকল সঙ্টন হওয়াতে যেরূপ যাতনা বোধ হইল বিশেষতঃ জীবনের সুখ যে পতি সম্ভোগ, তাহাতে এককালীন বঞ্চিত হইয়া অন্তঃকরণ যে প্রকার অস্থির হইল, তাহা কি বলিব। মাসাবধি দিবারাত্রি কেবল ক্রন্দন করিয়াছি। যদিও আমার নিতান্ত চেষ্টা ছিল, সৎপথে রহিব এবং কুল ধৰ্ম্ম রক্ষা করিব। কিন্তু অবশেষে জ্বালাতন হইয়া ব্যভিচারের পথকে অবলম্বন করিয়াছি, এবং স্বাধীন মনে কলিকাতায় আগমন পূৰ্ব্বক মেছোবাজার বাসিনী হইয়াছি।
“আমি এ স্থলে বসতি করিলে আমার কনিষ্ঠা ভগ্নীও স্বামীর সহিত অনৈক্য এবং বিবাদ করিয়া গত বৎসর আমার সহবাসিনী হইয়াছে। তদ্ব্যতীত আমার বাল্যকালের বিংশতি জন সঙ্গিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাহারা আমার ন্যায় কলিকাতার স্থানে স্থানে অধিবাস করিতেছেন।”১৮
৩. আমোদ-উৎসব
হিন্দুজাতির ধর্মগত প্রাণ। সুতরাং আমোদ-উৎসবও যে অনেকটা ধর্মকেন্দ্রিক হইবে, ইহাই স্বাভাবিক। দুর্গাপূজা এদেশে কখন প্রথম প্রচলিত হয় সে-সম্বন্ধে সন্দেহ ও মতভেদ আছে। ইহা খুব প্রাচীন না হইলেও ষোড়শ শতকে ইহা যে একটি প্রধান ও লোকপ্রিয় ধর্মানুষ্ঠানে পরিণত হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। আঠারো শতকেই ইহা যে খুব আমোদ-প্রমোদের সহিত সম্পন্ন হইত সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহে বলা যায়।১৯
হলওয়েল সাহেব ১৭৬৬ সনে প্রকাশিত একখানি গ্রন্থে লিখিয়াছেন, দুর্গাপূজা হিন্দুদিগের একটি প্রধান উৎসব। এই উপলক্ষে সাহেব-মেমদের নিমন্ত্রণ হয় এবং প্রতি সন্ধ্যায় ভোজন, নৃত্যগীত প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকে। ১৭৯২ সনের Calcutta Chronicle পত্রিকায় সুখময় রায়ের বাড়ীতে নৃত্যগীতের বিশেষ প্রশংসা করা হইয়াছে এবং সঙ্গীতে হিন্দুস্থানী ও ইংরেজী সুরের সংমিশ্রণের উল্লেখ আছে.২০
১৮২৬ সনের ১২ অক্টোবর তারিখের Government Gazette পত্রিকায় দুর্গাপূজার ব্যয়বহুল ও বিচিত্র আমোদ-উৎসবের বিস্তৃত বিবরণ আছে। বাবু গোপীমোহন দেবের বাড়ীতে অনেক উচ্চপদস্থ সাহেব-মেমের সমাগমে ভোজ ও মদ্যপান হইয়াছিল। মুসলমানী বাইজী ছাড়াও ব্রহ্মদেশীয় কয়েকটি নর্তকী ও গায়িকার আমদানি করা হইয়াছিল। একজন লোক বোতলের কাঁচ খাইয়া এবং আর-একজন কাষ্ঠনির্মিত অশ্বের উপর দুইটি কাঠের রণ-পা (stilt) অবলম্বন করিয়া ভূমি হইতে ১০।১২ ফুট উচ্চে দাঁড়াইয়া থাকিয়া দর্শকগণের মনোরঞ্জন করিয়াছিল।২১
তৎকালে দুর্গাপূজার এই শ্রেণীর আমোদ-প্রমোদ কেবল কলিকাতাতেই আবদ্ধ ছিল না। চুঁচুড়া (হুগলী) শহর নিবাসী প্রাণকৃষ্ণ হালদার ১৮২৭ সনে ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে Government Gazette পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়া সাহেব মেম ও বাঙ্গালী জনসাধারণকে জানাইয়াছেন যে যাহারা নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছেন এবং যাহারা পান নাই, সকলেই যেন তাঁহার বাটিতে ২৭শে হইতে ৩০শে পর্যন্ত দুর্গাপূজা উপলক্ষে নৃত্যোৎসবে (Grand Nauch) যোগদান করেন। ইহা ছাড়াও ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়দিগকে আশ্বস্ত করিয়াছেন যে তাঁহাদের টিফিন, ডিনার ও সুরাপানের উত্তম বন্দোবস্ত থাকিবে।২২
১৮২৯ সনে উক্ত পত্রিকায় দুর্গাপূজার বিবরণে লেখা হইয়াছে, মেম ও সাহেবেরা সঙ্গীত ও খানাপিনার লোভেই এই উৎসবে যোগদান করেন। মদের প্রভাবে তাঁহারা বেসামাল হইয়া যেরূপ হৈ-হুঁল্লোড় করেন তাহাতে ইংরেজদের সম্বন্ধে বাঙ্গালীর মনে বিরূপ ধারণাই জন্মে।
এই উৎসবের ব্যয়বাহুল্যের উল্লেখ করিয়া লিখিত হইয়াছে, ওয়ার্ড (Mr. Ward) সাহেবের হিসাবমত কেবল কলিকাতা শহরেই দুর্গোৎসবের খরচ হয় (সেকালে) পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর হাজার পাঁঠাবলি হয়।২৩
১৮৫৪ সনে সংবাদ প্রভাকরে দুর্গাপূজার যে বর্ণনা আছে তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“নগরে মহামায়া মহেশ্বরীর মহা মহোৎসব অতি সমারোহপূৰ্ব্বক নিৰ্বাহ হইয়াছে, ধনাঢ্য পরিবারেরা অতি অকাতরে অর্থ ব্যয় করিয়াছেন, শোভাবাজারস্থ নৃপতিদিগের উভয় নিকেতনে নৃত্য গীতাদির মহাধুম হইয়াছিল, সাহেবেরা নিমন্ত্রিত হইয়া সেই নাচের সভা উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, লোভ (?) দেবের প্রিয় শিষ্য শ্বেতাঙ্গ ও আ পি গোমিস ও গানসেলবস্ প্রভৃতি কৃষ্ণাঙ্গগণ যাহারা মোদের বেলাত ও মোদের কুইন বলিয়া গৰ্ব্ব পৰ্ব্ব বৃদ্ধি করেন তাঁহারা এই পূজোপলক্ষে রাজভবনে উপস্থিত হইয়া বিলক্ষণরূপে উদর পূরণ করিয়াছেন।
“যোড়াসাঁকো নিবাসি মিষ্টভাসি পরহিত তৎপর শ্ৰীযুত বাবু নবকৃষ্ণ মল্লিক মহাশয় স্বীয় কুল-প্রতিমা সিংহবাহিনী দেবীর পূজার পালা প্রাপ্ত হইয়া আপনারদিগের রম্য নিকেতন অমর ভবনের ন্যায় সুসজ্জিভূত করিয়াছিলেন, নাচের মজলিস দর্শনে দর্শক মাত্রেরই চিত্তক্ষেত্র পুলকালোকে পরিদ্বীপ্ত হইয়াছিল, গায়িকাগণের তানমান শ্রবণ ও সুন্দর অঙ্গ ভঙ্গিমা দর্শনে অনেকেই মোহিত হইয়াছিলেন, বিশেষতঃ মধ্যে মধ্যে রণবাদ্যবৎ চিত্ত প্রফুল্লকর ইংলণ্ডীয় বাদ্য ব্যাদন হইবায় সকলেই এক একবার মহা আনন্দ অনুভব করিয়াছেন; যে দিবস ইংরেজদিগের সভা হইয়াছিল সেই দিবস অনেকানেক সম্ভ্রান্ত সাহেব তথায় সমাগত হইয়াছিলেন।”২৪
দুর্গাপূজার প্রায় এক মাস দেড় মাস পূর্ব হইতেই সর্বশ্রেণীর বাঙ্গালীর মনে কী আনন্দ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সে-সম্বন্ধে সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকার ১৮৫৬ সনের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত একখানি পত্রে চমৎকার বিস্তৃত বিবরণ আছে।
“বাই খেমটাওয়ালী প্রভৃতি নর্তকীগণ দুর্গোৎসবের সময় বড় মানুষ বাবুদিগের বাটীতে স্বকীয়া মনোমোহিনী বিশুদ্ধ তান লয় স্বরে গান করিয়া সকলের মনোমোহন করিতে পারিবে এই নিমিত্ত সংগীত শাস্ত্রের আলোচনা করিতেছে, যাত্রাওয়ালা, পাঁচালীওয়ালা, কবিওয়ালা, প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়স্থ লোকেরা সেইরূপ সংগীতালোচনা করিতেছে, যাহারা আবার দূরদেশে যাইবে তাহারা গমনোদ্যোগ করিতেছে, বারাঙ্গনাকুল দুর্গোৎসবোপলক্ষে চাতুরী করিয়া স্ব স্ব ক্রেতাদিগের মনোরঞ্জন করিতেছে, তাহারদিগের প্রেম যে মিথ্যা ও মৌখিক এবং ক্ষণিক ইহা সকলেই জানে গৃহস্থদিগের গৃহিণীরা বলিতেছে এবারে কর্তাটী পুত্রকন্যা, পুত্রবধূ, জামাতা, দৌহিত্র, দৌহিত্রী ও ভৃত্যবর্গকে কিরূপ কাপড় চোপড় দিবেন তাহার ঠিকানা নাই, যুবতীগণ শয়ন মন্দিরে যামিনীযোগে সুযোগ পাইয়া পূজার সময় কি কি আবশ্যক তাহা নিজ নিজ স্বামীর নিকট হাস্য পরিহাস ছলে কহিতেছে, অল্প বয়স্ক বালকেরা কাপড় জন্য ব্যস্ত হইয়াছে, পূজার সময় অনেক দিবস পাঠশালার ছুটি হইবে এ নিমিত্ত পাঠার্থিগণ মহানন্দ করিতেছে। কিরূপে এই বক্রী কয়টা দিবস যায় তাহা চিন্তা করিতেছে, যাহারা বিদেশীয় ছাত্র তাহাদিগেরও আমোদের সীমা নাই, তাহারা ছুটি প্রাপ্ত হইয়া স্ব স্ব বাটিতে গিয়া মাতা, ভ্রাতা, ভগিনীদিগকে সন্দর্শন করিতে পারিবে।”২৫
দুর্গোৎসব উপলক্ষে ধর্মভাবের অভাব, নৃত্যগীত, সাহেব ভোজন এবং অর্থের অপব্যয় প্রভৃতির জন্য প্রথম হইতেই একশ্রেণীর লোক তীব্র প্রতিবাদ করেন। ১৮২৬ সনের Government Gazette পত্রিকায় একজন ইংরেজ লেখক (সম্ভবতঃ সম্পাদক) ইহার অসারতা প্রতিপন্ন করিয়া নিমন্ত্রণকর্তা বাঙ্গালী ও ইংরেজ যোগদানকারী উভয়েই নিন্দা করিয়াছেন।২৬
জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা (১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দ) দুর্গাপূজার আমোদ-আহ্লাদের ন্যূনতা দেখিয়া আনন্দ প্রকাশ করিয়াছে :
“হিন্দুরা প্রধান কৰ্ম্ম যে দুর্গোৎসব তাহাও এবৎসরে অনেক ন্যূনতা শুনা যাইতেছে। পূৰ্ব্বে এতন্নগরে ও অন্যান্য স্থানে দুর্গোৎসবে নৃত্যগীত প্রভৃতি নানারূপ সুখজনক ব্যাপার হইয়াছে। বাইনাচ ও ভাঁড়ের নাচ দেখিবার নিমিত্তে অনেক ইংরেজ পর্যন্ত নিমন্ত্রণ করিয়া এমন জনতা করিতেন যে, অন্যান্য লোকেরা সেই সকল বাড়ী প্রবিষ্ট হইতে কঠিন জ্ঞান করিতেন। এবৎসরে সেই সকল বাড়ীতে ইতর লোকের স্ত্রীলোকেরাও স্বচ্ছন্দে প্রতিমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া দেখিতে পায় এবং বাইজীরা গলী গলী বেড়াইয়াছেন তত্রাপি কেহ জিজ্ঞাসা করে নাই অনেকে এ বৎসর পূজাই করে নাই এবং যাহাদের বাড়ীতে পাঁচ সাত তরফা বাই থাকিত এবৎসর কোন বাড়ীতে বৈঠকি গানের তালেই মান রহিয়াছে কোন কোন স্থলে চণ্ডীর গান ও যাত্রার দ্বারাই রাত্রি কাটাইয়াছেন দুর্গোৎসবে প্রায় বাড়ীতে এমন আমোদ নাই যে লোকেরা দেখিয়া সন্তুষ্ট হইতে পারে এবং যাহারা আল করিয়া কাল বিনাশ করিতেন তাঁহারাও প্রায় এতদ্বর্ষে বাতীর সাশ্রয় করিয়াছেন; অতএব দুর্গোৎসবে যে আমোদ প্রমোদ পূৰ্ব্বে ছিল এবৎসরে তাহার অনেক হ্রাস হইয়াছে অনেকে কহেন যে এতদ্দেশীয় লোকেরদের ধন শূন্য হওয়াতেই এরূপ ঘটিয়াছে ইহা হইতেও পারে…”।২৭
কিন্তু ঐ পত্রিকাই সাত বৎসর পরে (১৮৩৯) লিখিয়াছে :
“বর্তমান বর্ষীয় শারদোৎসবোপলক্ষে নৃত্য সংদর্শনার্থ খ্রীষ্টিয়ানগণের মধ্যে অত্যল্প মনুষ্য আগমন করিয়াছিলেন এতদ্দর্শনে আমরা অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি আর যখন সৰ্বসাধারণের একেবারে এতদ্বিষয়ে উৎসাহ পরিত্যাগ করিবেন তাহা আমরা আরো অধিক সন্তুষ্ট হইব কারণ তাহাতে তাঁহারদিগের জ্ঞান ও সুনীতি এবং অন্যান্য বিদ্যার আধিক্য হইবে। আমরা অনুমান করি যে এতদ্দেশীয় ধনী বিশিষ্ট মনুষ্য যাহারা নৃত্য বিষয়ে উৎসাহ করিতেন এইক্ষণে ঐ নৃত্য ধর্মশাস্ত্রে ও ধর্ম সভায় নিন্দিত এবং জ্ঞানি বিদ্বিষ্ট এই বোধ করিয়া পরিত্যাগ করিবেন যদ্যপি তাহারা উৎসবোপলক্ষে উৎসাহই করেন তবে তাঁহারা ঐ যবন রমণীর নৃত্যের পরিবর্তে অন্য কোন উৎসাহ করেন কেননা মহৎ ভদ্র জ্ঞানী জনগণ দর্শন করণে সমর্থন হয়েন।”২৮
দুর্গাপূজায় বাহ্যিক আড়ম্বর ও ধর্মভাবের অভাব সম্বন্ধে তত্ত্ববোধিনী। পত্রিকায় এক বিস্তৃত আলোচনা ১৮৬২ সনে প্রকাশিত হয়। ইহা প্রতিমাপূজা বিরোধী আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র, সুতরাং দুর্গাপূজায় উৎসাহ ও সহানুভূতির অভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ইহাতে যুক্তিতর্কের সহায়তায় দুর্গোৎসবের অন্তঃসারশূন্যতা সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে তাহাতে তৎকালীন আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের মনোভাব অনেক পরিমাণে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে এরূপ মনে করা অসঙ্গত নহে। সুতরাং ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“দুর্গোৎসব বঙ্গবাসীদিগের প্রধান উৎসব। পৌত্তলিকতার সঙ্গে যত প্রকার দোষ থাকিতে পারে, ইহার মধ্যে তাহার সকলই আছে। দুর্গোৎসবের সময় লোকের অর্থগৌরব প্রকাশ করিবার সময়। দুর্গোৎসবের সময় আমোদ, প্রমোদ, অত্যাচার ও উন্মত্ততার সময়। যেখানে যাও, ধূপ ধুনার গন্ধ-নৃত্যগীতের আমোদ–ছাগ মহিষের রক্তস্রোত-বাদ্যধ্বনি, জন কোলাহল নয়ন ও মন আকর্ষণ করে। এ সময়ে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকল লোকের মন মহা-উৎসাহে উত্তেজিত হয়, যথার্থ দেশহিতৈষীর মন নিরুৎসাহে পূর্ণ হয়। পৌত্তলিকতার দূষিত দুর্গন্ধ বায়ুর মধ্যে যখন আর আর সকলে উল্লসিতচিত্তে সঞ্চরণ করিতে থাকে, তিনি সত্যের মহিমা স্নান দেখিয়া এই উৎসব কোলাহলের মধ্যে মৌনভাব ধারণ করেন। …
“বাহিরের আড়ম্বর এই প্রকার যে তাহাতেই মন সম্পূর্ণরূপে মুগ্ধ হইয়া যায়। ঈশ্বর উপাসনার ভাব কিছুই নাই। মনকে ভুলাইয়া রাখিবার নানা সামগ্রী রহিয়াছে। নানাবিধ লোক একত্র হইয়াছে,-বলিদান হইতেছে-বাদ্যধ্বনি উঠিতেছে। যাহার নিকটে মনের কুপ্রবৃত্তি সকলকে বলিদান দিতে হইবে তাহার সম্মুখে নির্দোষী ছাগ-মহিষের রক্তস্রোত প্রবাহিত হইতেছে।…
“প্রায় বিংশতি বৎসর পূর্বে এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে দুর্গোৎসবের যে সকল দোষ উল্লেখ করা গিয়াছিল, এখনো সেই সকল দোষ সম্পূর্ণই আছে। দুর্গোৎসবের উদ্যোগে অমঙ্গল, উৎসবের সময়ে অমঙ্গল, এবং ইহার সমাপ্তিতেও প্রচুর অমঙ্গল দ্বারা প্রতি বৎসর এই সময়ে বঙ্গভূমি পরিপূর্ণ হইয়া থাকে।” এদেশে সম্বৎসর যত দুষ্কর্ম হয়, এই তিন দিবসে তাহা সম্পূর্ণরূপে কৃত হয়। এই সকল দুষ্কৰ্ম্ম স্বভাবতই অপরাধের কারণ, কিন্তু ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত থাকাতে তাহারা বিষম অপরাধের হেতু হইয়াছে। ধর্ম অনুশীলনের নির্দিষ্টকাল যাহারদিগের সম্পূর্ণ অধৰ্ম্ম আচরণের কাল হয় এবং ঈশ্বর উপাসনার নিমিত্তে নিৰ্ম্মিত স্থান যাহারদিগের কুকর্মসূচক আমোদের সম্ভোগস্থল হয়, তাহাদিগের আর নিষ্কৃতির উপায় কি? এদেশস্থ লোকের এই প্রকার বিপরীত প্রকৃতি দেখিয়া কে না বিস্মিত ও দুঃখিত হয়?
. “পূজার তিন দিন পাপের স্রোত বহিতে থাকে। এই তিন দিনে শত শত শরীর অবসন্ন হয়, মন দুৰ্বল হয়, নীচ প্রবৃত্তি সকল প্রদীপ্ত হয়।”২৯
কিন্তু ১৪ বৎসর পরে (১৮৭৬ সনে) উক্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় দুর্গাপূজা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্য ভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। দুর্গাপূজার ঐতিহাসিক তথ্য ও দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনার পর ইহার সামাজিক আকর্ষণ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে :
“তৃতীয় সমাজ, এই উৎসবে সমাজের বহুতর আয়োজন। লোকে সংবৎসরকাল মিতাচারে অবস্থানুরূপ ধন সংগ্রহ করিয়াছে এবং তাহা ব্যয় করিবার সময় উপস্থিত। হিন্দুজাতি স্বার্থপর নয় কেবল স্ত্রী-পুত্র ইহাদের সর্বস্ব নয় ইহারা লৌকিকতা রক্ষা করা বিলক্ষণ বুঝে। স্বসম্বন্ধী স্বগন্ধী কে কোথায় আছে এই সময়ে তাহার তত্ত্ব লওয়া হয়। ফলত এসময়ে হিন্দু সমাজ একটি নূতন জীবন ধারণ করিয়া থাকে। বিদেশী কৰ্ম্মস্থান হইতে বিদায় লইয়াছে, বহুদিবস পর গুরুজনের শ্রীচরণ দর্শন করিবে, পত্নী উৎসুক মনে পথের পানে চাহিয়া আছে, তাহাকে সাদর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করিবে, শিশুগুলি চটুল নেত্রে প্রতীক্ষা করিতেছে, তাহাদিগকে আলিঙ্গন করিবে এবং বন্ধু-বান্ধব বহুদিন যাবৎ দূরে আছেন, তাহাদিগকে পাইয়া সুখী হইবে; এইজন্যই দুর্গোৎসব মহোৎসব।”
উপসংহারে যাহা বলা হইয়াছে তাহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :
“দুর্গোৎসব কেবল বঙ্গদেশের নয়, ইহা ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিমেও দৃষ্ট হইয়া থাকে। তথায় এই উৎসব দশাহ নামে প্রসিদ্ধ। এই উৎসব থাকাতে এতদ্দেশীয় শিল্প নানারূপ শিল্পের উদ্ভাবন করিতেছে, বাণিজ্য সজীব রহিয়াছে, নৃত্যগীত বিলুপ্ত হয় নাই, কবিত্ব অপ্রতিহত স্রোতে চলিতেছে, দয়া নিৰ্ব্বাণ হয় নাই, প্রীতি স্নেহ নূতন বলে আবির্ভূত হইয়া থাকে, এবং শত্রুতা বিদূরিত ও সদ্ভাবও বদ্ধমূল হয়। ফলত এই উৎসবের উপকারিতা যথেষ্ট। ইহা দ্বারা কনিষ্ঠাধিকারীদিগের ধর্মভাবও রক্ষিত হইতেছে। কিন্তু এই উৎসবের যেরূপ গাম্ভীৰ্য্য ও পবিত্রতা যদি তাহা মূৰ্ত্তি বিশেষের প্রতি নিয়োজিত না হইয়া অনন্ত ঈশ্বরে প্রযুক্ত হইত তাহা হইলে ইহার শোভা কতই না বৃদ্ধি পাইত। যাহা হউক, এই উৎসবে হিন্দু সমাজে যতটুকু উপকার তাহা কিছুতেই অস্বীকার করি না; গুরুজনকে প্রণিপাত, স্নেহের পাত্রকে অশীৰ্বাদ এবং প্রীতিভাজনকে আলিঙ্গন এই সমস্ত সুরীতি অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু এই উৎসব প্রসঙ্গে যে ভয়ানক পাপাচার সকল প্রশ্রয় পায়, মদ্য যে অতিমাত্রায় হৃদ্য হইয়া উঠে আমরা হৃদয়ের সহিত তাহা ঘৃণা করিয়া থাকি।”৩০
১৮৭৭ সনে ইহা অপেক্ষাও অধিকতর সহানুভূতি ও হৃদয়াবেগের সহিত দুর্গোৎসবের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।
গোঁড়া হিন্দুদিগের পক্ষ হইতেও দুর্গোৎসবের কোন কোন অঙ্গের কঠোর সমালোচনা হইয়াছে। হিন্দুর পূজা উপলক্ষে সাহেবদের নিমন্ত্রণ সম্বন্ধে সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মন্তব্য করিয়াছেন :
“পরন্তু হিন্দুশাস্ত্রের ব্যবস্থানুসারে পৰ্বাহ দিবসে সাহেবদের নিমন্ত্রণ করা অতিশয় নিষিদ্ধ। একারণ বহুবাজার নিবাসি ধনরাশি পরম বদান্যবর দত্তবাবুরা রাসের কয়েকদিবস সাহেবদের নিমন্ত্রণ না করিয়া রাস শেষ হইলে এক দিবস তাহারদিগকে অতি সম্মানপূর্বক আহ্বান করত খানা ও নাচ দেন। অন্যান্য ধনাঢ্য হিন্দু মহাশয়েরা যদ্যপি এই নিয়মের অনুগামি হয়েন তবে অতি উত্তম হইতে পারে।”৩১
১৮৫১ সনে দুর্গাচরণ দত্তের বাড়ীতে রাসযাত্রার সময় সাহেবদের নিমন্ত্রণ না হওয়াতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁহাকে ধন্যবাদ দিয়াছিলেন।
১৮৫৬ সনের ৩০শে অগস্ট তারিখে সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকাতে দুর্গাদেবীর পদে প্রণামী দিবার প্রথা সম্বন্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা হইয়াছে :
“বঙ্গদেশে বিশেষতঃ মহানগর কলিকাতায় অনেক পূজা হইয়া থাকে, তাহাতে সকলেই প্রায় আপনার বান্ধব কটুদিকে দেবতা দর্শন জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া থাকেন, নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের নিয়ম মত সকলের ঘরেই দেবদর্শন জন্য প্রণামী দিতে হয়, এই নীতি যদিচ অতি প্রবলা হইয়া চলিতেছে তথাপি এতদ্দারা সামাজিকে অনেক অনিষ্ঠ ঘটিতেছে, ইহার জন্য অনেককেই দৈন্যদশা প্রযুক্ত স্বকীয় পরম মিত্রের ভবনেও গমন করিয়া দেবতা দর্শন ও অন্যান্য প্রকার আমোদ প্রমোদ হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।… নিমন্ত্রণ রক্ষা করিলে কাহারো গৃহে চারি আনা, কাহারো গৃহে আষ্ট আনা এবং কাহারো গৃহে এক টাকা দিতে হয় এইরূপ নিয়মে যদি ১৫।১৬ স্থানে মান রক্ষা করিয়া ভ্রমণ করেন তবেই দীন ব্যক্তির পক্ষে প্রতুল।
“ঠাকুর দর্শন করিয়া যাহা প্রণামী দেওয়া যায় তাহা গৃহস্থ ব্যক্তি লাভ করেন, কাহারো বা গুরু পুরোহিতেরাই সেই প্রণামী দিবার সময় কে কি দিল তাহা লিখিয়া রাখিতে হয়, ইহার অভিপ্রায় এই যে বাটীর কর্তা যখন আবার সেই সেই লোকের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইবেন তখন সেই সেই নিয়মে দিতে হইবেক ইহা এক প্রকার বার্ষিক বলিলেও বলা যাইতে পারে কিন্তু বড় মানুষদিগের পক্ষেই এইরূপ প্রণামী দেওয়া সাজে, দৈন্যদশাগ্রস্ত ভদ্র সন্তানদিগের তাহা মর্মান্তিক হয়।
“এইরূপ অনেককেই দেখা গিয়াছে তাহারা কোন কোন পূজা করিয়া অনেক অর্থ সংগ্রহ করেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মহাশয়গণও এইপ্রকার সরস্বতী পূজাদি করিয়া থাকেন এবং বারাঙ্গনারাও নানাপ্রকার পূজা করে, সকলের পক্ষে পূজা প্রণামী জমিদারীর খাজনার ন্যায় হইয়াছে।”৩২
পর বৎসর উক্ত পত্রিকায় উত্তরপাড়ার জমিদার শ্রীযুক্ত জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় কর্তৃক পুস্তকালয় বা গ্রন্থমন্দির প্রতিষ্ঠার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া মন্তব্য করা হইয়াছে :
“ধন থাকিলে কি হয়, সকৰ্ম্মে ব্যয় না করিলে সে ধনে কোন ধনী ধনী গণ্য হইতে পারেন না, অনেকের ধন আছে এবং তাঁহারা অপকর্মে ব্যয় করিতেও পারেন, বেশ্যালয়ে, দোল, দুর্গোৎসব, জগদ্ধাত্রী পূজা, শ্যামা পূজা, নন্দোৎসব, যাত্রা মহোৎসবাদি ব্যাপারে কত ব্যক্তি কত অপব্যয় করিতেছেন, সাধারণ মঙ্গল কাৰ্য্যে এক পয়সা দিতেও মস্তক নত করেন। যে দিবস পৃথিবী হইতে গমন করিবেন সেদিনে তাঁহাদিগের প্রচুর ধন কোথায় থাকিবে, অনেকে নানাপ্রকার অসুদপায়ে অর্থ সঞ্চয় করিয়াছেন স্ত্রী পুত্রাদি সে সকল ধন উড়াইয়া দিয়াছেন, তাঁহারদিগের পিণ্ডদানের উপযুক্ত ব্যয় করেন নাই, ধনীগণ প্রতিদিন এই সকল দেখিতেছেন তথাচ কেমন কুহকে পড়িয়াছেন সকৰ্ম্মে ধনের কৰ্ম্ম করিতে পারেন না, বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় সাধারণ কার্যে অকাতরে ধনের কৰ্ম্ম করিতেছেন অতএব আমরা পথপ্রদর্শক শ্রীযুক্ত বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মত সকৰ্ম্মে ধন দিয়া সকলের ধনের কর্ম করুন, অবশেষে প্রার্থনা করি দেশকুল কীলালতৃষ্ণ জয়কৃষ্ণবাবু দীর্ঘজীবি হইয়া কুশলে থাকুন।”৩৩
দুর্গাপূজা ব্যতীত শ্যামাপূজা, সরস্বতীপূজা, হংসেশ্বরী, রাসোৎসব প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে।
এই সমুদয় পূজা ও উৎসব সম্বন্ধে সমসাময়িক পত্রিকার বিবরণ কিছু কিছু উদ্ধৃত করিতেছি।
(ক) শ্যামাপূজা
‘সংবাদ ভাস্করের’ (১লা নভেম্বর, ১৮৫৬) সম্পাদকীয় মন্তব্য:
“কলিকাতার মধ্যে এবং চতুর্দিগে শ্যামাপৰ্ব্ব উত্তমরূপে সম্পন্ন হইয়াছে। ইহাতে কোন বিঘ্ন হয় নাই, কলিকাতা নগরীর প্রধান প্রধান ধনিদিগের সকলে সকলের বাড়ীতে শ্যামাপূজা হয় না। যাঁহারা করিয়া থাকেন তাঁহারাও শ্যামাপূজায় সমারোহ করেন না, নিয়মরক্ষার মত সংক্ষেপেই সারেন, কম্বোলীয়াটোলা নিবাসী শ্ৰীযুক্ত বাবু রামচন্দ্র মৈত্রি মহাশয় শ্যামাপূজায় সমারোহ করিয়াছিলেন, তাঁহার বাটীতে দান ভোজন ও নৃত্য গীতাদির বিলক্ষণ আমোদ হইয়াছিল এবং বাগবাজার নিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামাচরণ মিত্র মহাশয়ও শ্যামাপূজায় ব্যয় করিয়াছিলেন।…
“মিত্র বাবুরা প্রতি বৎসর শ্যামাপূজার ভগবতীর আপাদমস্তক স্বর্ণমণ্ডিত করিতেন, আর তৈজসবস্ত্রাদি কত দিতেন, তাহার সংখ্যা ছিল না। চারি পাঁচ মোন তণ্ডুল না হইলে এক একটি নৈবেদ্য হইত না, নৈবেদ্যের পশ্চাদ্ভাগে মনুষ্য লুক্কায়িত হইয়া থাকিতে পারিত এক একটি সন্দেশের পরিমাণ দশ সেরের ন্যূন। ছিল না অৰ্দ্ধ মোন পরিমিত এক এক সন্দেশ কেবল ঐ বাড়ীতেই হইত। মিত্রবাবুদিগের সে পূজার সহিত তুলনা করিলে শ্যামাচরণবাবুর এ পূজার ব্যয় তাহার একাংশও বলা যায় না। তথাচ শ্যামাচরণ-পরায়ণ শ্যামাচরণ শ্যামাচরণ পূজায় যাহা করিয়াছেন কলিকাতা নগরে অন্যত্র কুত্রাপি এমত হয় নাই, তবে অনেকে বিসর্জন দিন রাত্রি সাত আট ঘণ্টা পর্যন্ত পথে পথে প্রতিমা দেখিয়া বেড়াইয়াছেন বটে তাঁহারদিগের পূজার এই ব্যয় বহুব্যয় যে রাত্রিকালে আলো করিয়া পথে পথে প্রতিমা দেখিয়া বেড়ান, এ দেশের অধিকাংশ লোক হাটে বাটে ধর্মধ্বজিত্বের ঠাঁট দেখাইতে ভালবাসেন, শাস্ত্রে লেখেন শ্যাম সাধন অতি গুপ্ত সাধন, রাত্রিতেই পূজা, রাত্রিতেই বিসর্জন, যাঁহাকে রজনীতে আবাহন করিয়া আনিলেন, যে ভাবেই হোক ইষ্টভাব দেখাইয়া অর্চনা করিলেন এবং সেই রাত্রিতেই মন্ত্রযোগে বিদায় দিলেন যদি তন্ত্র মন্ত্র সত্য জ্ঞান করেন তবে মন্ত্র মতেই চলিতে হয় তাঁহাকে পরদিন চণ্ডীমণ্ডপে উপবাসে রাখেন, এক বিন্দু গঙ্গাজল একটি বিদল দিয়াও সম্বর্ধনা করেন না, রজনীতে সেই উপবাসিনী উলঙ্গিনী ঠাট হাটে বাটে বেশ্যাদিগকে দেখাইয়া বেড়ান, যাহাকে মাতা বলেন তাহার এই অপমান করেন ইহাতে কি তিনি সন্তুষ্ট হন? মহাদেব যাহার শ্রীচরণ ধ্যান করিয়া ধ্যান করিতে করিতে শবাকার হইয়া গিয়াছেন, সেই ভগবতীর এই প্রকার দুর্গতি কি ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম বলা যায়? তন্ত্র শাস্ত্রের কোন গ্রন্থে ইহার প্রমাণ আছে? বরং বিরুদ্ধ প্রমাণ সকল দৃষ্ট হইতেছে।”৩৪
(খ) সরস্বতী পূজা
সংবাদ ভাস্করের (৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৭) সম্পাদকীয় মন্তব্য :
“নগর বাহিরে সরস্বতী পূজার বিলক্ষণ আমোদ হইয়াছিল, বরানগর নিবাসি শ্ৰীযুত রায় মথুরানাথ চৌধুরী মহাশয়ের বাটীতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা অনেক বিদায় লাভ করিয়াছেন এবং রাত্রিযোগে নৃত্যগীতাদি সভায় নগরীয় মান্য লোকেরা গমন করিয়াছিলেন তাঁহারাও শ্ৰীযুত রায় চৌধুরী বাবুর শিষ্টাচার মিষ্টালাপে সন্তুষ্ট হইয়াছেন, কাশীপুর নিবাসি শ্ৰীযুত বাবু প্রাণনাথ রায়চৌধুরী মহাশয়ের বাটীতে ব্রাহ্মণ ভোজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিদায়াদির সমারোহ, রাত্রিযোগে নৃত্যগীতাদি সভাতেও ভদ্রলোকেরা আমোদ করিয়াছেন, শ্ৰীযুত মহারাজ ভৈরবেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুর বহুজন ব্রাহ্মণগণকে নানা প্রকার উপাদেয় দ্রব্যাদি দ্বারা মহাভোজ দিয়াছেন এবং নৃত্যগীতাদি দর্শন শ্রবণার্থ এতদ্দেশীয় মান্য লোক সকলকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন, তাহাতেও ভদ্রলোক মুখে প্রতিষ্ঠা লাভে নরবর বাহাদুর পরম সন্তুষ্ট হইয়াছেন অন্যান্য স্থলে সরস্বতী পূজায় দর্শকেরা হর্ষলাভ করিয়াছেন, সরস্বতী পূজায় কোন স্থলে কোন ব্যাঘাত শুনা যায় নাই।”৩৫
(গ) হংসেশ্বরী পূজা
সংবাদ ভাস্করের (২৪ এপ্রিল, ১৮৫৬) বর্ণনা :
“কলিকাতা নগরীয় হাটখোলা প্রবাসি পুণ্যরাশি ধনী মহাজনগণ প্রতিবৎসর নন্দিঘাট নামক প্রসিদ্ধ স্থানে হংসেশ্বরী দেবীর অর্চনা করিয়া থাকেন। এ বত্সর গত শনিবারে পূজারম্ভাবধি মঙ্গলবার পর্যন্ত মহাসমারোহ করিয়াছিলেন তৎপরে মহামায়া বিসর্জন দিয়াছেন। পাঠক মহাশয়েরা এ পূজাকে বারোয়ারি পূজা জ্ঞান করিবেন না, বাবুরা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া টাকা সংগ্রহ করেন না। সম্বৎসর ব্যাপিয়া আপনাদিগের বাণিজ্য লাভের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ রাখেন বৎসরান্তে এই পূজায় তিন চারি সহস্র টাকা ব্যয় করেন। পূজারম্ভের পূৰ্ব্বে শ্রীযুক্ত বাবু কৃষ্ণধন কুণ্ড মহাশয়ের নামে সৰ্ব্বত্র নিমন্ত্রণ পত্র প্রেরিত হয়, পরে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা নানা স্থান হইতে আসিয়া উপযুক্ত বিদায় লইয়া যান। এ বিদায়ও অল্প বিদায় নয়, এতদ্দেশীয় ধনী লোকেরা বহু ব্যয়সাধ্য শ্রাদ্ধাদি ব্যাপারে নানা দেশীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে যেরূপ বিদায় দিয়া থাকেন পূজক বাবুরাও সেইরূপ বিদায় করেন, প্রতি দিবস পূজায় বস্ত্র তৈজসাদি দ্বারা দেবী মণ্ডপ পরিপূর্ণ হয়, সামাজিক দানে চিনি পরিপূর্ণ উত্তমোত্তম থাল বিতরণ করেন এবং প্রতি দিবস ব্রাহ্মণাদি নানা জাতীয় ন্যূনাধিক দুই সহস্র লোকের আহার হয়। উত্তম উত্তম সন্দেশ ও নানা প্রকার মিষ্টান্নাদি সকল গৃহে প্রস্তুত করিয়া ইতর সাধারণ সকলকে ঐ সকল উৎকৃষ্ট দ্রব্যাদি ভোজন দ্বারা সমানরূপে তৃপ্ত করেন। হংসেশ্বরী পূজায় চিড়া মুড়কী ব্যবহার নাই। লুচী, কচুরী, সন্দেশ, মিষ্টান্নাদি যে যাহা খাইতে চায় তাহাই পায়।…
“একাদশজন মহাজনের বাণিজ্য ধনে পরমেশ্বরী হংসেশ্বরী সিদ্ধবিদ্যার সাঙ্গোপাঙ্গ পূজা হয়। বাবুরা প্রতি রাত্রিতেই নৃত্যগীতাদি দর্শন শ্রবণ করাইয়া মহামায়ার আরাধনা করেন। শ্রীযুক্ত বাবু কৃষ্ণধন কুণ্ড মহাশয় এই বৃহৎ কর্মের অধ্যক্ষতায় নিযুক্ত থাকেন তাহার অধ্যক্ষতায় সৰ্ব্ব বিষয়ে সুপ্রতিষ্ঠা হয়। ঐ সকল মহাজনগণ বৎসর বৎসর কেবল এই দান করেন এমৎ নহে, তাহারদিগের নিত্য দান অনেক আছে। যাহার যে বস্তুর বাণিজ্য প্রতি দিন বেলা দশ ঘণ্টা কালে বস্তুর কাঁটা উঠিলে যে যাইয়া যাচ্ঞা করে ঐ বস্তু অর্থাৎ চিনি তণ্ডুল লবণাদি পাইয়া সন্তুষ্ট হইয়া যায়। বাবুদিগের এই দানে কলিকাতা নগরে বহু দেবালয়ে ভোগ রাগাদি হয়, এতন্নগরে বহুজন ধনী লোক বসতি করেন কিন্তু পূর্বোক্ত বাবুদিগের দানের মত প্রতিদিন দান কোথায় আছে? বাবুরা বাহিরে আড়ম্বর দেখান না কিন্তু। দান বিষয়ে তাঁহারদিগের আড়ম্বরের ন্যায় আড়ম্বর প্রায় নাই, এই সকল ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম দ্বারা তাঁহারদিগের বাণিজ্যলাভ দিন দিন বৃদ্ধি হইতেছে আমরা প্রার্থনা করি মহেশ্বরী হংসেশ্বরী হৃদয়োপরি বিরাজমানা হইয়া বাবুদিগের আরও শ্রীবৃদ্ধি করুন।”৩৬
(ঘ) রাসের মেলা
সোম প্রকাশে (২১ বৈশাখ ১২৭১) প্রকাশিত চিঠি :
“জেলা ২৪ পরগণার অন্তঃপাতি হরিণাভি নিবাসী শ্ৰীযুক্ত বাবু নবীনচন্দ্র ঘোষ গত চৈত্র পূর্ণিমাতে এক রাস করিয়াছিলেন। ১০ই বৈশাখ অবধি ১২ই বৈশাখ পৰ্য্যন্ত তিন দিন এই রাসযাত্রা হইয়াছিল। আমি তিন দিনই উহা দর্শন করিয়াছি। যাহা দেখা গিয়াছে, অগ্রে সংক্ষেপে তাহার স্কুল স্কুল বিবরণগুলি বলিয়া এত দ্বারা যাহা বুঝিতে পারিলাম, নিম্নে লিখিয়া দিতেছি—
“১০ই বৈশাখ বৃহস্পতিবার অপরাহ্ন ৫ ঘটিকার সময় রাস দেখিতে গমন করি, প্রথমে সদর রাস্তার উপর নহবৎ ফটক ও লোকের ভিড়, তাহার পর দোকান। দোকান বড় অধিক আইসে নাই, কয়েকজন ময়রা মিঠাইকর, কয়েকজন মাদুরওয়ালা, জন দশবার মৎস্য ব্যবসায়ী, কয়েকজন মণিহারি, আর কয়েকজন ডাব-নারিকেল, আতোষবাজী, মাটির পুতুল, সরা ঢাক, বাঁশী, পাজী ও পট বিক্রয় করিতেছে। দোকানের পার্শ্বে অথবা রাস্তার দুই ধারে নানা প্রকার মাটির সঙ। সঙেরা যেন বিপণিগুলির প্রহরিস্বরূপ হইয়াছে, যত অগ্রসর হইতে লাগিলাম, ততই নতুন নতুন সঙ আমার নয়নগোচর হইতে লাগিল। কতকদূর যাইয়া দেখি, একটা দরমার বেড়া দেওয়া ক্ষুদ্র গৃহের মধ্যে কলের পুতুল নাচ হইতেছে, ঢুলিরা নীচে দাঁড়াইয়া তালে তালে সঙ্গত করিতেছে। পুতুল নাচের পর একটি পুষ্করিণী, পুষ্করিণীতে কমলে কামিনী সঙ হইয়াছে। জলের উপর কতকগুলি সোলার পদ্ম ফুল এবং জেলে ডিঙি চড়া সকাণ্ডারী মাটির শ্ৰীমন্ত সওদাগর ভাসিতেছে। কামিনীরূপা মাটির ভগবতী একধারে বসিয়া গজ গিলিতেছেন।
“রাস্তার সঙ দেখা শেষ হইলে বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম। ভাবিয়াছিলাম। এখানেও কোন প্রকার আশ্চর্য্য সঙ থাকিতে পারে, কিন্তু সে কল্পনা সম্পূর্ণরূপে সত্য হইল না। বাটীর ভিতরে অতিশয় লোকের ভিড়। সেই ভিড়ের ভিতর একটি স্ত্রীলোক কীৰ্ত্তন করিতেছে।…
“কীৰ্ত্তনের সম্মুখেই দালানের উপর কাষ্ঠময় সিংহাসনে সকিশোরী ত্রিভঙ্গ রাসবিহারী দুলিতেছেন। চৌকীর পার্শ্বে মাটির গোপীগণ ও সোলার ফুল প্রভৃতি সাজাইয়া দেওয়া হইয়াছে। নিম্নে কতকগুলি প্রকৃত পুস্পরিকী রহিয়াছে। এই স্থানে বলিয়া রাখা আবশ্যক, কি দালান, কি কীৰ্ত্তন স্থানে, কি পুতুল নাট্যশালা এবং কি রাস্তা, সকল স্থানেই প্রায় স্ত্রীলোকের সংখ্যা অধিক।
“গ্রীষ্মের কল্যাণে সর্দিগরমি হইবার উপক্রম হইল, আমি বাটী হইতে বহির্গত হইয়া গঙ্গাতীরে আসিলাম। তথায় দুখানি ময়ূরপঙ্খীর উপর একদল স্ত্রী ও একদল পুরুষের সারি গাওয়া হইতেছিল। সারির কুৎসিৎ খোড় ও দর্শকদলের করতালি ও হরিবোলের ধ্বনিতে গঙ্গা যেন এক একবার লজ্জায় অধোবদন হইতেছেন। আমি ঐরূপ ব্যবহার দর্শন করিয়া দুঃখিত চিত্তে তথা হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইলাম। রাত্রিতে খেমটার নাচ, একদিন বৈঠকী গাওনা ও দুইদিন যাত্রা হইয়াছিল।– “এই স্থানে রাসযাত্রার ফলের বিষয়ে কিছু বলিতে ইচ্ছা করি। নানা প্রকার দ্রব্য বিক্রয় ও নানা স্থানের লোকের সমাগম হওয়াতে ব্যবসায়ের বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হয় বটে, কিন্তু ভিড়ের ভিতর অনেক লম্পট স্ত্রীলোকের প্রতি অনুচিত ব্যবহার করে।…
“কীৰ্ত্তনের দ্বারা হিন্দুধর্মাবলম্বিদিগের ধর্মচর্চা ও ধৰ্ম্মকথা শ্রবণ করা হয় বটে, কিন্তু কাজে তাহা ঘটিয়া উঠে না। আমি দেখিলাম, অনেক শ্রোতা নীচে ও উপরের বারাণ্ডার দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া আছেন। ফলতঃ নবীন বাবু অনাবৃত স্থানে স্ত্রীলোক বসাইবার নিয়ম করিয়া ভাল করেন নাই। গঙ্গায় সারি গাওয়ার কথা
ত মুখেই আনিবার নয়। খেমটার নাচও অতিশয় অনিষ্টকর। নর্তকীরা যত নৃত্য করিতে পারুক আর না পারুক, বাবুদিগকে কটাক্ষে মোহিত করিয়া অর্থ শোষণ করে। এই দুটী বিষয় দর্শকদিগের চরিত্রদোষ সম্পাদনের প্রধান কারণ, রাসযাত্রা যখন হিন্দুশাস্ত্রের অনুমোদিত তখন হিন্দুধর্মাবলম্বিরা উহা করিতে পারিবেন না, ইহা বলা অন্যায়, কিন্তু এ সকল উপসর্গ কেন? ভদ্রলোকের বাটীর ভিতর গোপাল উড়ের যাত্রা দেওয়া কোন্ যুক্তির অনুসারী কাৰ্য্য? এই যাত্রার সকল অঙ্গই প্রায় আদিরস ঘটিত, বিশেষতঃ যখন মালিনী আইসে, তখন কোন্ ভদ্রলোক অনাবৃত কর্ণে বসিয়া স্থির থাকিতে পারেন?…
“উপসংহার স্থলে নবীন বাবুর প্রতি আমার একটি বক্তব্য আছে। তিনি পূজার ন্যায় অঙ্গ ব্যতিরেকে জলকীৰ্ত্তন, খেমটা এবং গোপাল উড়ের যাত্রাতে যত টাকা ব্যয় করিলেন, অথবা জলে ফেলিয়া দিলেন, অন্য কোন সকাৰ্য্যে এই টাকা দিলে কি ইহা অপেক্ষা অধিকতর আমোদ, প্রশংসা ও পুণ্যলাভ করিতে পারিতেন না? শাস্ত্রে কি বেশ্যার নৃত্য ও খেউড়ে পূজার অঙ্গ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে? একটি আহ্লাদের বিষয় এই যে নবীনবাবু বাজী পোড়াইয়া কতকগুলি টাকা হুতাশন মুখে আহুতি প্রদান করেন নাই। ইতিপূৰ্ব্বে জগদ্দলনিবাসী শ্ৰীযুক্ত বাবু গোলকনাথ ঘোষ গোষ্ঠযাত্রা উপলক্ষে তিন দিন অনেকগুলি টাকা জলে ও অনলে নিক্ষেপ করিয়াছেন।”৩৭
(ঙ) চৈত্রপর্ব
সোম প্রকাশে (২৯ চৈত্র, ১২৭৮) প্রকাশিত চিঠি :
“মহাশয়! এই পর্বোপলক্ষে আমাদিগের গ্রামের লোকেরা অসীম অর্থ ব্যয় করিয়া যে কতদূর আনন্দ প্রকাশ করেন, তাহা বর্ণনাতীত। এই গ্রামবাসী লোকেরা চারিটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত অর্থাৎ এই পৰ্ব্বোপলক্ষে চারি পাড়ার লোকে এক একদল হইয়া মহোৎসাহ সহকারে এই কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন, এবং এই কাৰ্য্য সমাধা করিতে পারিলেই তাঁহারা আপনাদিগকে চরিতার্থ জ্ঞান করেন। ইহারা চৈত্রমাসের প্রথমদিবসে আনন্দ সূচক ধ্বজা উত্তোলন করিয়া অন্য সম্প্রদায়ের বিপক্ষবর্গকে অবগত করাইয়া থাকেন যে আমরা অপেক্ষাকৃত অধিক অর্থব্যয় করিয়া এবং নানাবিধ বাদ্য বাদন করিয়া এই কাৰ্য্য সম্পাদন করিব। এই রূপে প্রথম দিবসাবধি সংক্রান্তি পৰ্য্যন্ত প্রত্যহ মহা মহোৎসবে নানাবিধ নৃত্যগীত হইয়া থাকে। গ্রামস্থ অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পর গানের উত্তর প্রত্যুত্তর দেন এবং মাসের শেষ দুই দিবসে উত্তম যাত্রা ও নৃত্যাদি হইয়া পৰ্ব্ব সমাপ্ত হয়। মহাশয় চৈত্রপৰ্ব্বের কি অপূৰ্ব্ব মাহাত্ম! এ সময়ে দ্রাভদ্রের কিছুই বিচার থাকে না, সকলেই সমবেত হইয়া নৃত্যাদি করেন।
“সম্পাদক মহাশয়! বরং ছেলে ছোকরাদের পার আছে কিন্তু গ্রামের অশীতিবর্ষ বয়স্ক ব্যক্তিগণ যে কি পৰ্য্যন্ত ঘৃণিত কাৰ্য্যে রত হন তাহা বলা যায় না, এমন কি আমিও এক সময়ে আহ্লাদে মগ্ন হইয়া বাঁশ বহন এবং নৃত্যাদি করিয়াছি। আপনি বিবেচনা করিয়া দেখুন অস্মদ্দেশীয় লোকেরা কিরূপ ভ্ৰমান্ধ, তাঁহারা প্রাণে প্রাণে এরূপ অলীক আমোদে মত্ত হইয়া অকাতরে অজস্র অর্থ ব্যয় করিতে কুণ্ঠিত হন না, কিন্তু তাহাদিগের নিকটে দেশের কোন শুভ সাধনোদ্দেশে বা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে তাহারা সাধ্যমতে তাহার বাধা জন্মাইয়া থাকেন।”৩৮
(চ) গাজি সাহেবের মেলা
সোমপ্রকাশ (১১ আষাঢ়, ১২৭৯) :
“এই অম্বুবাচীতে মাতলা রেলওয়ের বাঁশড়া ষ্টেসনের নিকটে গাজিসাহেবের মেলা বলিয়া একটি মেলা হয়। এটি মুসলমানদিগের মেলা। আমরা দেখিলাম, শত শত মুসলমান মেলাস্থলে যাইতেছে। এত জনতা হইয়াছে যে গাড়িতে স্থান সমাবেশ হইতেছে না। অধিকাংশ যাত্রির সঙ্গে ছাগল ও মুরগী আছে। শুনিলাম, উহারা মেলাস্থলে উপস্থিত হইয়া ঐ সকল ছাগল ও মুরগী জবাই করিবে।….
“অম্বুবাচীতে এই মেলাটির সৃষ্টি হইবার এই কারণ বোধ হয়, অম্বুবাচীর তিনদিন কৃষিকাৰ্য্য নাই। কৃষকদিগের অবসর থাকে। মাতলা রেলওয়ের পার্শ্ববর্তী এক এক গ্রামে অধিকাংশ কৃষকের বাস। তাহারা এই অবসরকালে আমোদপ্রমোদ অতিবাহিত করে।”৩৯
(ছ) বারয়ারী
সোমপ্রকাশ (২৯ আষাঢ়, ১২৯৩) :
“আমাদের কোন সহযোগী বারয়ারীর বড় পক্ষপাতি হইয়াছেন। তাঁহার মতে বারয়ারী অনেক লোকের আমোদের আহ্লাদের স্থান এরূপ ‘জাতীয় আমোদ একতার আমোদ’ উঠাইয়া দেওয়া তাঁহার মতে বুদ্ধিমান কাৰ্য্য নয়।
“আমাদের আহাদ যে মনুষ্য জীবনের নিতান্ত প্রয়োজনীয় একথা সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন, কিন্তু সেই আমোদ দূষিত হইলেই প্রয়োজনটা কিছু সামান্য হইয়া পড়ে। যদি গ্রামের ভিতর একটি শুড়ীর দোকান ব্যতীত আমোদ আহ্লাদের আর স্থান না থাকে, তবে কি সেখানকার আমোদ প্রমোদ জীবনের কোন অভাব পূরণ করে? আজকালকার বারয়ারীতে বিশুদ্ধ আমোদ লাভ করা যায় না। প্রায়ই মদ বেশ্যা ইত্যাদি লইয়া বারয়ারীর পাণ্ডাদিগের আমোদ প্রমোদ হয়।….
“বারয়ারী পাণ্ডারা প্রায়ই নিষ্কর্মা। দেশের ভিতর তাহারা কেবল পরনিন্দা পরগ্লানি করিয়া দিনাতিপাত করে। যাহাদের কোন সঙ্গতি নাই, এমন কোন সামর্থ্য নাই, যাহাতে স্বীয় ভরণপোষণের উপায় করিতে পারে, চৌর্যবৃত্তি যাহাদের অভ্যস্থ, দেশে গ্রামে প্রায়ই যাহাদের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাওয়া যায় এই প্রকার লোকেই বারয়ারীর গন্ধ পাইয়া নাচিয়া উঠে, পাণ্ডা সাজিয়া চাঁদা আদায়ের জন্য গ্রামের লোকের উপর উৎপীড়ন করে কাহারও চাঁদা দিবার সামর্থ্য না থাকিলে ঘরের ঘটি-বাটী ঝাড়ের বাঁশ কাড়িয়া লইয়া যায়। যে যে গ্রামে এই প্রকার বারয়ারীর পাণ্ডারা বাস করে সেখানে বিবাহ দিতে যাওয়া ভদ্রলোকের পক্ষে বড় বিপদের কথা। বরকন্যা বিদায়কালীন বরপক্ষীয় ও কন্যাপক্ষীয় আত্মীয়দিগের ভিতর অপ্রণয় জন্মাইবার প্রধান কারণ এই সকল বারয়ারীর পাণ্ডা। ইহারা অভদ্রোচিত গালাগালি দিয়া বরযাত্রের নিন্দা করাকে বড় পুরুষত্ব মনে করে, তাই বরযাত্রীরা যতই কোন বারয়ারীর জন্য টাকা দিন না, পাণ্ডাদের নিন্দা কুৎসা অপমানসূচক বাক্য এমন কি কুৎসিৎ ভাষায় গালি পৰ্য্যন্ত না খাইয়া ফিরিতে পারেন না। এই সকল ব্যক্তি যখন বারয়ারীর পাণ্ডা তখন যে তাহাদের কার্যে বিশুদ্ধ আমোদ পাওয়া যাইবে তাহা কখনও সম্ভব নহে।
“বারয়ারী নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী ব্যক্তিদিগের উৎসন্ন যাইবার হেতু। পল্লীগ্রামে জোরজবরদস্ত করিয়াও আশানুরূপ চাঁদা উঠে না, প্রায়ই একটী যাত্রার খরচ যোগাইবার সংস্থান হওয়া কোন কোন স্থানে ভার হইয়া উঠে, কিন্তু বারয়ারীর আদায়ের আগে খরচের ব্যবস্থা। টাকা সংগ্রহ না করিয়া বারয়ারীতে যাত্রার বায়না হয়। শেষে এই টাকার অধিকাংশ সংগ্রহ করিতে না পারিয়া যাত্রাওয়ালা বিদায়ের সময় পাণ্ডাদের মোড়লকে ঘরের টাকা বাহির করিয়া দিতে হয়। আমরা কোন দরিদ্র মোড়লকে স্ত্রী ও পুত্রবধূর গহনা বন্ধক দিয়া যাত্রাওয়ালা বিদায় করিতে দেখিয়াছি।
“বারয়ারী বালকগণের মাথা খাইবার সহজ উপায়। বারয়ারীর দুই চারিদিন পূৰ্ব্ব হইতে পল্লীগ্রামের বালকেরা পড়াশুনা স্কুল পাঠশালা ছাড়িয়া পাণ্ডাদের সঙ্গী হয়, তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে চাঁদা আদায়ের জন্য বাহির হয়। পাণ্ডাদের কুৎসিৎ বিদ্রূপ কদর্য গীত, পাষণ্ডের ন্যায় ব্যবহার এই চারি পাঁচদিন কি সপ্তাহকালের মধ্যে তাহারা বেশ অনুকরণ করিতে শিখে ….
“বারয়ারীর উদ্যোগের পর, উৎসবের দিন এই সকল পাণ্ডাদের মাদক সেবন, দাঙ্গা হাঙ্গামা, গালাগালি বীভৎস কৌতুক এসকলও বালকদিগের বেশ অনুকরণের সামগ্রী, বারয়ারীতে বালকেরা হলাহল পান করে আর তাহাদের চরিত্রের মাথা খায়।
“এই সকল কথাই আমরা পল্লীগ্রামের বারয়ারীর সম্বন্ধে বলিলাম। সহরের বারয়ারীতে লোকের উপর উৎপীড়ন হয় না বটে কিন্তু সেখানেও পাপের স্রোত বন্ধ নাই। মদ ও বেশ্যার কাণ্ডটা সহরেই কিছু বাড়াবাড়ী। যে আমাদের সঙ্গে মদ ও গণিকার সংস্রব রহিল তাহাকে আমরা আমোদের মধ্যে গণ্য করি না।”৪০
(জ) কথকতা
উনিশ শতকে কথকতার এক সময়ে খুব সমাদর ছিল। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের বিশেষতঃ পুরাণের ও রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী সহজ ভাষা বর্ণনা করিলে আমাদের একসঙ্গে ধর্ম ও জ্ঞানোপার্জনের সম্ভাবনা আছে, ইহা উপলব্ধি করিয়াই প্রথমতঃ কথকতার সূত্রপাত হয়। কেবল নীরস ব্যাখ্যায় শ্রোতারা আকৃষ্ট হয় না। এজন্য তাহাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ক্রমে ক্রমে উহাতে গীত ও সুরযোগ করা হয়। ১৮৬৩ সনে সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ইহার সম্বন্ধে নিম্নলিখিত উক্তি প্রণিধানযোগ্য :
“বেদীর উপর উপবেশন পূৰ্ব্বক স্বর ও গীত সংযুক্ত কথকতারীতি বঙ্গদেশ ব্যতিরিক্ত আর কোন দেশেই নাই। যিনি ইহার প্রথম সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ লোক ছিলেন সন্দেহ নাই। ভাল লোক ইহাতে হস্তাৰ্পণ করিলে অবশ্যই লোকের মনোরঞ্জন হইয়া থাকে।…
“গদাধর শিরোমণি ইহার সৃষ্টিকর্তা বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। তিনি একশত বৎসরের অধিক দিনের লোক নহেন। তাঁহার পর কৃষ্ণহরি শিরোমণি ও রামধন তর্কবাগীশ প্রভৃতি কয়েকজন সবিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া ঐশ্বৰ্য্যশালী হইয়া গিয়াছেন।”৪১
লেখক বলেন :
“দিনকতকাল এই ব্যবসায়ের বিশেষ প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। এক্ষণে দিন দিন হিন্দুসমাজের অবস্থা পরিবর্ত সহকারে যেমন লোকের মনে ভাব পরিবৰ্ত্ত হইতেছে তেমনি কথকতার প্রাদুর্ভাব হ্রাস হইতেছে। সুশিক্ষিত দলে ইহা আর অধিকার পায় না, এক্ষণে কেবল অশিক্ষিত দল হইতেই কথঞ্চিৎ ইহার জীবন রক্ষা হইতেছে। অশিক্ষিত দলের মধ্যে কেবল স্ত্রীলোক ও নীচ লোকেরাই ইহার অধিকতর ভক্ত। সুশিক্ষিত দলের এ বিষয়ে অরুচি জন্মিবার তিনটি কারণ আছে। এক, ইহা হিন্দুধৰ্ম্মে গ্রথিত, যাহাদিগের সেই ধৰ্ম্মে অশ্রদ্ধা জন্মিয়াছে, তাহাদিগের এ বিষয়ে শ্রদ্ধা থাকিবার সম্ভাবনা নাই। যে সকল পুরাণাদি লইয়া কথকতা করা হয়, তদ্বারা সৎ ও অসৎ উভয়বিধ শিক্ষার সম্ভাবনা আছে। মানুষের মন অসৎ উপদেশ গ্রহণে যেরূপ অগ্রসর হয়, সদুপদেশ গ্রহণে সেরূপ হয় না। কৃষ্ণলীলা বর্ণনাবাসরে রাস ও বস্ত্রহরণাদি বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অশিক্ষিত যুবতীর চিত্ত অবিচলিত থাকা সম্ভাবিত নয়। এই অসৎ উপদেশ শিক্ষাশঙ্কা শিক্ষিতদলের এ বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শনের দ্বিতীয় কারণ। তৃতীয়, এতন্মধ্যে কতকগুলি বিশেষ দোষ প্রবেশ করিয়াছে।…
“কথকদিগের অনেকে লম্পট স্বভাব হন, এক্ষণকার শ্রোতাগণের মধ্যেও বেশ্যা, অসতী ও লম্পটই বাহুল্য পরিমাণে দৃষ্ট হইয়া থাকে।”৪২
কুশদহ নিবাসী বিখ্যাত পণ্ডিত রামরাম তর্কালঙ্কারের পৌত্র রামধন তর্কবাগীশ একদিকে যেমন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত ছিলেন অন্যদিকে তেমনি কথকতার গুণে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এ-সম্বন্ধে “কুশদ্বীপ-কাহিনীতে নিম্নলিখিত মন্তব্য করা হইয়াছে :
“যথার্থ কথা বলিতে কি, রামধনের পূৰ্ব্বে গদাধর শিরোমণি ও কৃষ্ণহরি ভট্টাচার্য্য প্রভৃতি যে কথকতা করিতেন, তাহা মহাভারত ও ভাগবতীয় কথা বলিয়াই সাধারণের ভক্তি আকর্ষণ করিত ও তাহাই লোকে একমনা হইয়া শ্রবণ করিত। কিন্তু তৎপরে রামধন যে প্রণালী উদ্ভাবন করিলেন, তাহা সাধারণের ধৰ্ম্মশিক্ষার ও ভক্তি আকর্ষণের যেমন মহাস্ত্র স্বরূপ হইয়াছিল, উহার রচনাপারিপাট্য, সঙ্গীত সমাবেশ, সাময়িক বর্ণনা, সুললিত বাক্যবিন্যাস যোগ্যতা প্রভৃতিও লোকসাধারণের তেমনই প্রীতিকর হইয়াছিল। ফলতঃ সাত্ত্বিক, রাজসিক বা তামসিক যিনি যে ভাবেই তাহার কথকতা শ্রবণ করিতেন, তিনি সেইভাবেই চরিতার্থ ও মোহিত হইতে পারিতেন। বলিতে কি, রামধনের কথকতা এরূপ শ্রুতিমনোহর ও লোকশিক্ষার অমোঘ উপায় হইয়া উঠিল এবং সাধারণে এতদূর আগ্রহ সহকারে তাহার কথা শ্রবণ করিত যে, দ্বিসহস্র আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সমাবেশ একটি সামান্য সূচীপাত স্বর অনায়াসে শ্রুতিগোচর হইত। ফলতঃ আমরা সাহঙ্কারে বলিতে পারি যে, কুশদ্বীপে বহুতর মহামমিহপাধ্যায় সুধীমণ্ডলীর জন্মস্থান; কিন্তু সেই সকল খ্যাতনামা মহাপুরুষগণের জন্ম না হইয়া, কুশদ্বীপে এক রামধনই যদি জন্মগ্রহণ করিতেন, তাহা হইলেও কুশদ্বীপের মুখচন্দ্র স্বতঃ আলোকিত হইত এবং কস্মিন্ কালেও সেই বিমল মুখমণ্ডল কলঙ্কিত ও রাহুগ্রস্ত হইত না” ৪৩
(ঝ) পাঁচালী, কবিওয়ালার গান, যাত্রা এবং রঙ্গমঞ্চে নাট্যাভিনয়
এই সমুদয় খুবই প্রচলিত ছিল। শেষোক্ত দুইটির এখনও আদর আছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে এ সমুদয়ের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইবে।
(ঞ) অন্যান্য আমোদ-প্রমোদ
সাহেবদের অনুকরণে কলিকাতার ধনীবাবুরা আলাদা ঘোড় দৌড়’-এর ব্যবস্থা করেন। কলিকাতার উত্তরভাগে পোস্তার রাজা নরসিংহের বাগানে ছিল তাঁহাদের ঘোড়দৌড়ের মাঠ। জকি, বুকি, জুয়া প্রভৃতি কোন অনুষ্ঠানেরই অভাব ছিল না।৪৪
আর-একটি আমোদ ছিল দুইদল বুলবুলি পক্ষীর লড়াই। শীতকালে খুব বড় একটা মাঠে দুই বাবুর দুই দলে, মোট প্রায় তিনশত ‘শিক্ষিত’ (trained) বুলবুলির মধ্যস্থলে কিছু খাদ্যদ্রব্য ছড়াইয়া দেওয়া হইত এবং তাহা লইয়া বেলা ১১টা হইতে ৪টা পর্যন্ত দুইদলের বুলবুলি লড়াই করিত–পরাজিত দল উড়িয়া পলাইত।৪৫
ঘুড়ি ওড়ান ও পরস্পরের ঘুড়ি কাটাকাটি আর-একটি আমোদের উৎস ছিল।
৪. নিষ্ঠুর প্রথা
চড়কপূজা উপলক্ষে অনেক অমানুষিক নিষ্ঠুরতা ঘটিত, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ১৮৫৬-৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা গভর্নমেন্টের দৃষ্টি এ-বিষয়ে আকৃষ্ট হয় এবং বিলাতের ডিরেকটার সভাও এই বিষয়ে আলোচনা করেন। কলিকাতায় খ্রীষ্টান মিশনারীরা এই নিষ্ঠুর প্রথা রহিত করিবার জন্য গভর্নমেন্টকে অনুরোধ করেন। কিন্তু গভর্নমেন্ট এ-বিষয়ে কোন আইন না করিয়া মিশনারী ও শিক্ষকদের এই সমুদয় নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করিতে উপদেশ দিলেন।
মিশনারীরা পুনরায় এ-বিষয় গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে ছোটলাট জে. পি. গ্র্যান্ট বিভাগীয় কমিশনারদিগকে এ-বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে বলেন। তাহাদের রিপোর্ট হইতে দেখা যায়, এই নিষ্ঠুর প্রথা কেবল বাংলা ও উড়িষ্যায় সীমাবদ্ধ ছিল। গভর্নমেন্ট স্থানীয় কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন যে, যেখানে এই নিষ্ঠুর প্রথা বহুদিন ধরিয়া প্রচলিত আছে, সেখানে জমিদারদের সহায়তায় জনসাধারণকে যুক্তিতর্ক দ্বারা ইহা বন্ধ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। অন্যত্র ম্যাজিষ্ট্রেট ইহা শান্তিরক্ষা ও নীতির দোহাই দিয়া বন্ধ করিয়া দিবেন।
এই প্রথা ক্রমে ক্রমে কমিলেও একেবারে রহিত হইল না। অবশেষে ছোটলাট বিডন হিন্দুনেতাগণের ও ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সম্মতিক্রমে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই মার্চ এক ইস্তাহার জারী করিয়া এই নিষ্ঠুর প্রথা আইন অনুসারে দণ্ডীয় বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণকে ইহা বন্ধ করিবার জন্য কড়া নির্দেশ দিলেন।৪৬
হিন্দুদের মধ্যে আর দুইটি নিষ্ঠুর প্রথা ছিল, গঙ্গাযাত্রা ও অন্তর্জলি। পীড়িত কোন ব্যক্তির মৃত্যু আসন্ন হইলে তাহাকে গঙ্গাতীরে নিয়া রাখা হইত। কোন কোন স্থলে মৃতপ্রায় ব্যক্তির দেহের নিম্নভাগ গঙ্গার জলে ডুবাইয়া রাখা হইত। কারণ, হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল যে, গঙ্গাতীরে মৃত্যু হইলে, বিশেষতঃ গঙ্গাজলের মধ্যে দেহত্যাগ করিলে, মৃত ব্যক্তির পুণ্য ও আত্মার সদ্গতি হয়। কিন্তু অনেক স্থলেই যে ইহা আশু মৃত্যুর কারণ হইত তাহাতে সন্দেহ নাই। শিক্ষিত হিন্দুরা এই প্রথার তীব্র নিন্দা করিলেও আইন বা সরকারী হুকুমে ইহা রহিত করিবার পক্ষপাতী ছিলেন না। গভর্নমেন্ট তদনুযায়ী ইহা বন্ধ না করিয়া আদেশ দিলেন যে কোন মৃত্যুপথযাত্রীকে গঙ্গাতীরে নিবার পূর্বে পুলিশকে জানাইতে হইবে যে রোগীর বাঁচিবার আর কোন আশাই নাই। রোগীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়েরা এই মর্মে পত্র দিবেন এবং সম্ভব হইলে এই মর্মে চিকিৎসকের সার্টিফিকেটও দাখিল করিবেন।৪৭।
মুসলমানী আমলে কেহ জুতা পায়ে দিয়া দরবারে বা রাজকর্মচারীদের নিকট যাইতে পারিত না। শিক্ষিত বাঙ্গালীরা যখন ইউরোপীয় পোষাক-পরিচ্ছদ গ্রহণ করিল তখন কলিকাতায় রাজভবনে এবং সরকারী বা আধা-সরকারী অনুষ্ঠানে জুতা পায়ে দিয়া যাইতে পারিবে এই মর্মে ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে এক সরকারী ইস্তাহার বাহির হয়। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও মফঃস্বলে উচ্চপদস্থ ভারতীয়েরাও ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সম্মুখে জুতা পায়ে যাইতে পারিতেন না। ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে এক সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে এইপ্রকার বৈষম্য রহিত করিয়া সর্বত্র ভারতীয়েরা সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে জুতা পায়ে দেখা করিতে পারিবে এই নির্দেশ দেওয়া হইল।৪৮
৫. ব্যয়বাহুল্যমূলক প্রথা
শ্রাদ্ধের ব্যয়–এ বিষয়ে সংবাদ প্রভাকরের’ (১৮৫৪ সন, ৭ জুন ও ১ জুলাই) নিম্নলিখিত দুইটি উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য :
“মৃত বাবু মতিলাল শীলের পুত্রেরা অতি সমারোহ পূৰ্ব্বক তাহার শ্রাদ্ধ করিবার মানস করিয়াছেন, শ্রাদ্ধ দিবসে আহূত রবাহূত কাঙ্গালী ইত্যাদি লোকের সমাগম হইবে, একারণ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সাহেবেরা মতিবাবুর পুত্রদিগের প্রতি এ-প্রকার অনুমতি করিয়াছেন যে ঐ লোক সমারোহ জন্য নগরবাসিদিগের যদ্যপি কোন ক্ষতি হয় তবে তাহা পূরণ করণার্থ তাঁহারদিগকে অগ্রে এক লক্ষ টাকা কোর্টে জমা দিতে হইবেক, যেহেতু মৃত বাবু গোপালকৃষ্ণ মল্লিকের মাতৃ শ্রাদ্ধ সময়ে তিনি ও তাঁহার ভ্রাতৃগণ কাঙ্গালী বিদায় করণে অক্ষম হওয়াতে কাঙ্গালীরা আহারাভাবে নগরের বাজার সকল লুট করিয়াছিল, এই বিষয় মতিলাল বারুর পুত্রেরা কি উত্তর করিয়াছেন তাহা জানা যায় নাই।”৪৯
“বাঙ্গাল হরকরা”র সম্পাদক মহাশয় লিখিয়াছেন যে “মৃত বাবু মতিলাল শীলের পুত্রেরা তাঁহার আদ্য শ্রাদ্ধে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করিবেন, ঐ টাকায় অনায়াসে এক চিরস্থায়ী কালেজ স্থাপিত হইতে পারে…আদ্য শ্রাদ্ধে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় হইলে মহা সমারোহ হইবেক এবং শীলবাবুর শ্রীমান পুত্রেরা যশোলাভ করিবেন তাঁহার সন্দেহ নাই কিন্তু শ্রাদ্ধের দানাংশ যাহারা পাইবেন তাহারদিগের বিশেষোপকার কিছুই হইবেক না অতএব শ্রাদ্ধের ব্যয় ন্যূন করিয়া কোন সাধারণ হিতজনক বিষয়ে অর্থদান করা শীলবাবুর সুশীল পুত্রদিগের কর্তব্য হয়।” হরকরা সম্পাদক মহাশয়ের এই উপদেশ অতি উত্তম বটে, কিন্তু এদেশে শ্রাদ্ধে বহু ব্যয় বিধান করণের বিধি থাকাতে ধনবান লোকেরা পিতামাতার শ্রাদ্ধে অর্থব্যয় করা আপনারদিগের কর্তব্য কাৰ্য্য বলিয়া গণনা করেন…অতএব মৃত শীলবাবুর পুত্রেরা তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করিবেন ইহার বিচিত্র কি?”৫০
এই ব্যয়বাহুল্য কিরূপ আকার ধারণ করিত নিম্নলিখিত বিকৃতি হইতে তাহার কতকটা ধারণা করা যাইবে।
“গত বৃহস্পতিবারে রাজা সত্যচরণ ঘোষাল বাহাদুরের আদ্য শ্রাদ্ধ হইয়াছে, ভূকৈলাস রাজপরিবারেরা কোন কালেই শ্রাদ্ধাদি বিষয়ে সভামধ্যে দানাদি সাজাইয়া আড়ম্বর দেখান না, সঙ্গোপনে অন্তঃপুরে দানোৎসর্গ করেন, তাঁহারদিগের দানের পারিপাট্য এই যে একটা রূপার ঘড়ায় দান সাগরের ষোলটা ঘড়া হয়, দানাদির সংখ্যা অল্প কিন্তু পরিমাণে অধিক, রাজকুমার বাহাদুরেরা এইরূপ দানাদি এবং বৃষোৎসর্গ করিয়াছেন, ব্রাহ্মণ ভোজনের অনেক পারিপাট্য হইয়াছিল। শ্রাদ্ধ দিনে ভূকৈলাসের চতুর্দিক হইতে ন্যূনাধিক দুই সহস্র ব্রাহ্মণ আসিয়াছিলেন, শ্ৰীযুক্ত রাজা সত্যশরণ ঘোষাল বাহাদুর এবং রাজপুত্র ও ভ্রাতৃপুত্রাদি সকলে তাঁহারদিগকে যথোচিত সমাদরপূৰ্ব্বক গ্রহণ করিয়া যথাস্থানে বসাইলেন এবং বেলা দুই প্রহর তিন ঘণ্টাকালে তাবৎ ব্রাহ্মণ সমাগত হইলে আমলা বাটী ও পতিতপার্বণীর বাটী ইত্যাদি নানা প্রকোষ্ঠে একেবারে সকলকে বসাইয়া দিলেন, উপস্থিত সময়ে কলিকাতা নগরে যে সকল উত্তম দ্রব্যাদি আছে এবং মিষ্টান্নাদি যতপ্রকার প্রস্তুত হইতে পারে রাজা সত্যশরণ ঘোষাল বাহাদুর তাহার কিছু অবশিষ্ট রাখেন নাই, ভোক্তারা আহার করিয়া রাজা বাহাদুরকে ধন্য ধন্য বলিয়াছেন।”৫১
এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে শ্রাদ্ধে ব্যয়বাহুল্য বাংলা দেশে পূর্বেও ছিল। আঠারো শতকে শোভাবাজারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ মুন্সী তাঁহার মাতৃশ্রাদ্ধে আট লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন। বাংলা দেশে এইরূপ আরও দুই একটি চিরাচরিত সামাজিক প্রথা ছিল, যাহা ভাল কি মন্দ বিবেচনা করা তখনকার দিনে সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু কোন কোন সমসাময়িক পত্রিকায় এগুলি বাঙ্গালীর দারিদ্র্যের কারণ বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে ‘সোমপ্রকাশের’ (১২৮০, ২৪ অগ্রহায়ণ) মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :
‘দারিদ্র্য বঙ্গসমাজের বর্তমান প্রধান কষ্ট বলিয়া বোধ হয়। সমাজের মধ্যে যাহারা উচ্চ শ্ৰেণী বলিয়া গণ্য অর্থাৎ অনেক অর্থ উপার্জন করিয়া থাকেন, তাঁহারাও বিশেষ সঞ্চয় করিয়া যাইতে পারিতেছেন না। তদপেক্ষা নিম্নশ্রেণীস্থ ব্যক্তিদিগের কথা বলা বাহুল্য মাত্র। তাহারা ঋণ দায়ে বিব্রত ও অন্ন চিন্তায় জর্জর হইয়া যেরূপে দিনপাত করিতেছেন, তাহা স্মরণ করিলে মনে ভয় ও ক্লেশের উদয় হয় এবং এই দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণ কি? বারম্বার এই প্রশ্ন উপস্থিত হইতে থাকে। একটু চিন্তা করিয়া দেখিলে ইহার অনেকগুলি কারণ দেখিতে পাওয়া যায়। প্রথমত দিন দিন দেশের রপ্তানীর ও বাণিজ্যের বৃদ্ধি হওয়াতে পূৰ্ব্বাপেক্ষা দ্রব্যাদি দুর্মূল্য হইয়াছে সুতরাং সংসার নির্বাহ করা পূৰ্ব্বাপেক্ষা বহু অর্থসাপেক্ষ হইয়া পড়িয়াছে। দ্বিতীয়তঃ সভ্যতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনের সংস্কার ও হৃদয়ের ইচ্ছা ব্যতিক্রম ঘটাতে অনেক নূতন-বিধ ভোগ্য বস্তু, নূতন-বিধ সামগ্রী অত্যাবশ্যক হইয়া উঠিয়াছে। সেগুলি না হইলে সমাজে হেয় ও অবগণিত হইতে হয়, সুতরাং সেগুলির আহরণের জন্য লোকে ব্যয় স্বীকার করিয়া থাকে।” লেখকের মতে হিন্দুসমাজের নিম্নলিখিত কয়েকটি পুরাতন রীতি, নীতি এবং প্রথাও এই দারিদ্র্যের জন্য দায়ী।
“প্রথমতঃ একান্নবর্তিতা। এই প্রথার সপক্ষে বলিবার অনেক কথা আছে; কিন্তু ইহা যে লোকের দরিদ্রতা বৃদ্ধির অন্যতর কারণ তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এই প্রথা প্রচলিত থাকাতে একদিকে দশজন নিষ্কর্মা, অথবা অল্লোপাজ্জক একজন উপার্জনশীল ও পরিশ্রমী ব্যক্তির গলগ্রহ হইয়া থাকে। অনায়াসে আপনাদের এবং পরিবারদের উদরের অন্নের সংস্থান হয় বলিয়া শ্ৰম করিতেও তাহাদের প্রবৃত্তি জন্মে না। অপরদিকে পরিশ্রম করিয়া নিজের নিজের ও নিজ পরিবারের উন্নতির বিশেষ আশা না থাকাতে সেই উপার্জনশীল ব্যক্তিরও অধিক উপার্জনের জন্য প্রয়াস হয় না। অথচ সেই উপার্জিত অর্থ বহু ভাগ হওয়াতে কাহারও অভাব সম্পূর্ণরূপে দূর হয় না।
“দ্বিতীয়তঃ বাল্যবিবাহ। এই প্রথা প্রচলিত থাকাতে উপার্জন সম্বন্ধে দুইটী অপকার হয় : (১) পুত্র-কন্যাদিগকে উপার্জনের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া কঠিন হইয়া পড়ে, (২) ক্রমেই ব্যয় বাড়িতে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মনে কর, এক ব্যক্তির একটি পুত্র আছে। সে ব্যক্তি মাসে ৩০ টাকা উপার্জন করে, তাহাতে কোনরূপে তাহার পরিবারের ভরণপোষণ চলিয়া যায়। পুত্রটির ১৪। ১৫ বৎসরের সময় একটি বিবাহ দিল, তাহাতে একটি পরিবার বৃদ্ধি হইল। পরে ১৮। ১৯ বৎসর হইতে পুত্রটির সন্তান জন্মিতে আরম্ভ হইল। আর ৩০ টাকাতে সংসার নিৰ্বাহ হয় না। সুতরাং তিনি পুত্রটিকে বিদ্যালয় ছাড়াইয়া অর্থোপার্জনের চেষ্টায় কর্মে নিযুক্ত করিলেন, শিক্ষা অসম্পূর্ণ সুতরাং তাহারও উপার্জন অল্প হইতে লাগিল, কিন্তু সন্ত নের স্রোত অপ্রতিহত রহিল। এদিকে বৃদ্ধ পিতা উপার্জনক্ষম হইয়া পড়িলেন। এরূপ অবস্থায় অন্নকষ্ট ও সাংসারিক অসচ্ছল অপরিহার্য।
“তৃতীয়তঃ পিতামাতার শ্রাদ্ধ ও পুত্রকন্যার বিবাহ প্রভৃতি। এই কাৰ্যগুলির বিরুদ্ধে আমাদের কিছু বক্তব্য নাই। এগুলি অত্যাবশ্যক ও পুণ্য কৰ্ম্ম কিন্তু এগুলির এত প্রকার ব্যয়ের সহিত সংস্রব আছে, যে অনেক সময় তজ্জন্য অনেক ব্যক্তিকে বিপদগ্রস্ত হইতে হয়।
“চতুর্থতঃ চিরবৈধব্য। এই প্রথা প্রচলিত থাকাতে কতকগুলি নিরুপায় স্ত্রীলোকের জীবনযাত্রা নির্বাহের ভার আত্মীয়স্বজনদিগকে লইতে হয় এবং চিরদিন তাহা বহন করিতে হয়। অন্যান্য দেশে তাহারা পুনরায় পত্যন্তর গ্রহণ করেন সুতরাং তাহাদের জন্য কোন পরিবারপোষী আত্মীয়কে ব্যতিব্যস্ত হইতে হয় না।
“পঞ্চমতঃ জাতিভেদ ও জাত্যভিমান। যদিও ইংরাজী শিক্ষা বহুল প্রচার হওয়াতে ক্রমেই ভিন্ন ভিন্ন জাতির সমতা হইয়া আসিতেছে এবং অনেক উচ্চ জাতির লোক জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য শাস্ত্র-বিরুদ্ধ ও হীন জাতিদিগের চিরাবলম্বিত অনেক কাৰ্য্য অবলম্বন করিতেছেন, তথাপি এখনও অনেকে জাত্যভিমান নিবন্ধন অশেষ কষ্ট ও সাংসারিক অসচ্ছল সহ্য করেন, কিন্তু কষ্ট নিবারণের উপায় থাকিতে নীচ ও হেয় বলিয়া তাহাতে প্রবৃত্ত হইতে পারেন না।”৫২
এই প্রসঙ্গে উক্ত সোমপ্রকাশ পত্রিকার ১২৭১ সালের ১৪ই বৈশাখ সংখ্যায় কন্যাদায় সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে তাহাও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, কারণ শতাধিক বর্ষ অতীত হইলেও এখন পর্যন্ত এই কুপ্রথা বহুল পরিমাণে এদেশে প্রচলিত আছে।
“কন্যা জন্মিলেই সর্বনাশ। বরের অথবা বরের পিতামাতার অসঙ্গত অর্থলোভই এই বিপত্তির কারণ। অনেক স্থলে এই রীতি দেখিতে পাওয়া যায়, পরিণয় সম্বন্ধ উপস্থিত হইলে বরের পিতামাতা কন্যার পিতামাতার নিকট অসঙ্গত অর্থ প্রার্থনা করেন। উচ্চ ঘরে কন্যা সম্প্রদান না করিলে কুলক্ষয় হইবে এই শঙ্কায় কন্যার পিতামাতাকে সৰ্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়াও অগত্যা সেই প্রার্থনা পরিপূরণ করিতে হয়। কুৎসিত রীতি নিবন্ধন অযোধ্যায় কন্যাহত্যা প্রথা প্রবর্তিত হইয়াছিল। কন্যা জীবিত থাকিলে সম্প্রদানকালে আপনাদিগকে দরিদ্র হইতে হইবে, এই ভয়ে মাতাপিতা কন্যার স্নেহ বন্ধন ছেদন করিয়াও তাহার প্রাণ বধ করিত। উহা প্রথারূপে পরিণত হইল। বৃটিশ গভর্নমেন্টের যত্নে উহা নিবারিত হইয়াছে।
“বঙ্গদেশে কন্যাহত্যা প্রথা নাই, কিন্তু অনেক স্থলে কন্যার মাতাপিতাকে বরের মাতাপিতার যেরূপ অসঙ্গত অর্থলোভতৃষ্ণা চরিতার্থ করিতে হয়, তাহাতে অনেকে এককালে দরিদ্র হইয়া পড়েন। কলিকাতার সুবর্ণবণিকদের যিনি দরিদ্রমধ্যে পরিগণিত, তিনিও ৫০ ভরি সুবর্ণের নৃনে কন্যা সমপ্রদানকালে অব্যাহতি পান না। কুলীন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদিগের প্রতিজ্ঞাপূৰ্ব্বক অর্থগ্রহণপ্রবাদ চিরপ্রসিদ্ধ আছে। এই সকল কারণে কন্যার পিতামাতা আপনাদিগকে কন্যাদায়গ্রস্ত বিবেচনা করেন। এই কুৎসিত প্রথা যে পূৰ্ব্বে ছিল না তাহা ধর্মশাস্ত্রকারদিগের বচন দ্বারাই সপ্রমাণ হইতেছে।”৫৩
কলিকাতার বসাক-সম্প্রদায়ে কন্যার বিবাহের দায় সম্বন্ধে এই সোমপ্রকাশ পত্রিকায় (১২৭৯ সাল ১লা শ্রাবণ) একজন পত্রপ্রেরক যে বিস্তৃত মন্তব্য করিয়াছেন৫৪ তাহা পড়িলে এই কুপ্রথা যে কী ভয়ানক আকার ধারণ করিয়াছিল তাহা বোধগম্য হইবে। ১২৯১ সালের ১০ আষাঢ় উক্ত পত্রিকায় বঙ্গদেশে পুত্রবিক্রয় সম্বন্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ এবং ঐ সম্বন্ধে রূপচাঁদ পক্ষী বিরচিত একটি সুদীর্ঘ সঙ্গীত প্রকাশিত হয় ৫৫
বিংশ শতাব্দীতেও এই কুপ্রথার হ্রাস হয় নাই। স্নেহলতা নামে একটি বালিকা তাহার বিবাহের বরপণ যোগাইবার জন্য পিতা বসতবাটি বিক্রয় অথবা বন্ধক দিবার ব্যবস্থা করিতেছেন-এই সংবাদ শুনিয়া নিজের গাত্রবস্ত্র কেরোসিন তেলে ভিজাইয়া তাহাতে অগ্নি প্রদান করে। তাহার এই আত্মহত্যায় বরপণের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হয় এবং স্থানে স্থানে অবিবাহিত যুবকেরা বিবাহে পণ গ্রহণ করিবে না এইরূপ শপথ গ্রহণ করে। কিন্তু কিছুদিন পরে এ-সমস্তই অসার প্রতিপন্ন হয় এবং বরপণের কুপ্রথা পূর্ববৎ চলিতে থাকে। বর্তমানেও ইহা খুবই প্রচলিত আছে। কিন্তু কন্যাকে নির্দিষ্ট অল্পবয়সের মধ্যে বিবাহ না-দেওয়া অথবা একেবারে বিবাহ না-দেওয়া আর পূর্বের মত নিন্দনীয় না-হওয়ায় দরিদ্র পিতার উপর বরপণের বোঝা অনেকটা লাঘব হইয়াছে।
৬. সমুদ্রযাত্রার বিরোধিতা
কেহ সমুদ্রযাহা করিলে তাহাকে জাতিচ্যুত করা বাংলার হিন্দুসমাজের একটি কলঙ্ক। কেহ উচ্চ শিক্ষা বা উচ্চ চাকুরী লাভের উদ্দেশ্যে বিলাতে গমন করিলেও দেশে ফিরিয়া আসিলে তিনি স্বীয় পরিবারে স্থান পাইতেন না। এই কারণে বহু উচ্চশিক্ষিত উচ্চপদস্থ হিন্দু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে। অনেকে শাস্ত্রমতে প্রায়শ্চিত্ত করিয়াও সমাজে স্থান পান নাই। ইহার তীব্র প্রতিবাদ বিভিন্ন সমসাময়িক পত্রিকায় দেখিতে পাওয়া যায়। ১২৯৩ সালের ২১ অগ্রহায়ণ তারিখের সোমপ্রকাশ হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :
“সম্পাদক মহাশয়! বিলাত প্রত্যাগত ব্যক্তিদিগকে হিন্দুসমাজে গ্রহণ করা শাস্ত্র সম্মত ইহা ভট্টপল্লি, নবদ্বীপ, কলিকাতা প্রভৃতি প্রসিদ্ধ স্থানের অনেক মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতগণ প্রমাণ করিয়াছেন। বিশেষতঃ স্বর্গীয় মহাত্মা রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের পতিতোদ্ধার গ্রন্থে ইহার বিশেষ স্বপ্রমাণ হইয়াছে। আশ্চর্যের বিষয়, শিক্ষিত সচ্চরিত্র ব্যক্তি সমাজ হইতে দূরীকৃত হইবে, আর অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত অসচ্চরিত্র ব্যক্তি দ্বারা সমাজের সৌষ্ঠব সাধন হইবে ইহা কি আকাশ-কুসুমের ন্যায় অসম্ভব নহে? বিশ্বাসই ধৰ্ম্ম। বিলাতাগত ব্যক্তিগণের হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা না থাকিলে কখনও প্রায়শ্চিত্তাদি স্বীকার করিতেন না। যাঁহারা ইহাদিগকে অধাৰ্মিক বলিয়া ঘৃণা করেন তাহারা কি এদেশস্থ ধনশালী ব্যক্তিদিগের আচরণ জানেন না? অধিকাংশ ধনী সন্তানেরা যে অভক্ষ্য ভক্ষণ, অগম্য গমন চিরব্রত করিয়াছেন অথচ ইহারাই আবার সমাজে মান্যগণ্য ধার্মিক বলিয়া পরিচিত। ইহা কি সামান্য পরিতাপের বিষয়? যে সমাজ পবিত্রতার আধার, ন্যায় ধর্মের আকর ছিল, তাহাতে এখন আর কি আছে। দেখুন কলিকাতার অদূরবর্তী আদিগঙ্গার সমীপস্থ কোন ধনাঢ্য ব্রাহ্মণদিগের বাটীতে মুসলমান সুপকার নিযুক্ত। ইহাতেও তাঁহারা সমাজের উচ্চ আসন অধিকার করিয়া বসিয়াছেন। সকল জাতির শবশ্চেদ করিয়া ডাক্তারেরা জাতি প্রাপ্ত হইলেন। সুরাপান, কলের চিনি, লবণ এবং চৰ্ব্বি মিশ্রিত ঘৃত ভক্ষণ করিয়া হিন্দুত্ব গেল না। কেবল বিদ্যাশিক্ষার্থ বিলাত যাত্রাতেই হিন্দুত্ব বিলোপ হইল? যদিও ইহা ধৰ্ম্মবিরুদ্ধ হয় তথাচ তাঁহারা শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত করিতে সম্মত। অপিচ ইঁহারা অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন নাই। তবে কি কারণে সমাজ হইতে দূরীভূত হইবেন?”৫৬
ইহার কয়েক মাস পূর্বে বিলাত-প্রত্যাগত অমৃতলাল রায়ের প্রসঙ্গে, এই সমাজবিধি যে দেশের পক্ষে কত অনিষ্টকর, সোমপ্রকাশে (১১ শ্রাবণ, ১২৯৩) তাহার সুদীর্ঘ আলোচনা আছে। উপসংহারে বলা হইয়াছে :
“কেহ কেহ লাভ ক্ষতি ছাড়িয়া কেবল ধর্মের দোহাই দিয়া বিলাতফেরতকে সমাজ হইতে তাড়াইতে চান। অনেকেই এই বৃদ্ধের ধর্মোপদেশ অনেকবার শুনিয়াছেন, এখন যাঁহারা কৃতবিদ্য হইয়া সংবাদপত্রের সম্পাদক হইয়া ধর্ম ও সমাজ সম্বন্ধে স্ব স্ব অভিমত ব্যক্ত করিতে শিখিয়াছেন তাহাদের অনেককেই বিদ্যাসাগরের ক, খ পড়িতে দেখিয়াছি। তাঁহারা একবার যেমন বৃদ্ধের কথা শুনিয়াছিলেন এখন তেমনি আর একবার শ্রবণ করুন। ম্লেচ্ছদেশে বাস, ম্লেচ্ছন্ন ভোজন ও ম্লেচ্ছ স্ত্রীগণ ইত্যাদি জ্ঞানকৃত অপরাধের জন্য যথাবিধি প্রায়শ্চিত্ত করিলে শাস্ত্রানুসারে অপরাধীকে হিন্দু সমাজে গ্রহণ করা যাইতে পারে প্রমাণের জন্য শাস্ত্রীয় বচন উদ্ধৃত করিবার অধিক আবশ্যক নাই। বাবু অমৃতলালকে সমাজে গ্রহণ করিবার জন্য ভট্টপল্লীবাসী পণ্ডিতবর চন্দ্রনাথ, রাখাল চন্দ্র ও মধুসূদন ভট্টাচাৰ্য মহোদয় প্রমুখ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ যে সকল প্রমাণাদি প্রয়োগপূৰ্ব্বক ব্যবস্থা দিয়াছেন তাহাই আমাদের মত সমর্থনের জন্য যথেষ্ট হইবে। আমরা শুনিয়া সুখী হইলাম বাবু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উদ্যোগী হইয়া পণ্ডিতগণের মতামত গ্রহণ পূৰ্ব্বক অমৃতলালকে সমাজে লইবার চেষ্টা করিতেছেন। বৈদ্য সমাজের অন্তর্ভূত অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিও এই মতের স্বপক্ষ হইয়াছেন। কলিকাতা এবং অন্যান্য স্থানে যে সকল বৈদ্যসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি অমৃতলালকে সমাজে লইবার পক্ষে প্রতিবাদী হইয়াছেন আমরা তাঁহাদিগকে ক্ষান্ত হইতে উপদেশ দি। বিলাত ফেরতগণকে সমাজে গ্রহণ করিলে সমাজবন্ধনী শিথিল হইবে না, ধর্মের পক্ষে বিশেষ কোন ব্যাঘাত হইবে না। আমাদের দেশের যে সকল ব্যক্তি বিলাতে না গিয়া ঘরে বসিয়া স্লেচ্ছাচার করিয়া থাকেন তাঁহারা যেমন হিন্দু ধর্মের শত্রু, বিলাতে গিয়া ম্লেচ্ছ ভোজনে বাধ্য হইয়া বিলাত ফেরতগণ হিন্দু ধর্মের ততদূর শত্রু হইতে পারেন না। যাঁহারা আমাদের মতের প্রতিবাদী তাঁহারা ঘরের শত্রু অগ্রে দূর করিতে পারিলে তবে বাহিরের লোককে শত্রু বলিবার অধিকার পাইবেন, লোকাঁচারের উপর ধৰ্ম্মের শাসনও তাঁহাদিগকে গ্রাহ্য করিতে হইবে।”৫৭
বিশ শতকের প্রথম ভাগে (১৯০৮-১৯১০ খ্রী.) বর্তমান লেখকের ভ্রাতা বিলাত হইতে ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়া এদেশে উচ্চ সরকারী পদে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু এই অপরাধের জন্য বৈদ্যসমাজ প্রায় ২০ বৎসর পর্যন্ত তাঁহার পরিবারের সঙ্গে সামাজিক সম্বন্ধ রহিত করিয়াছিল। কিন্তু কালক্রমে এই প্রথা এখন একেবারে বিলুপ্ত হইয়াছে। লেখকের ভ্রাতা প্রায়শ্চিত্ত করিলেও তাঁহার পরিবার সমাজচ্যুত হইয়াছিল, কিন্তু ৫০ বৎসর পরে লেখক সস্ত্রীক বিলাত গেলেও সেই বৈদ্যসমাজে, তাঁহার প্রায়শ্চিত্ত তো দূরের কথা কোনরূপ উচ্চবাচ্যই হয় নাই।
স্ত্রীলোকের অবরোধ প্রথাও উনিশ শতকে খুবই কঠোরভাবে প্রতিপালিত হইত কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তাহা কমিতে থাকে এবং এখন একেবারে বিলুপ্ত হইয়াছে।
৭. বাংলার নাগরিক সমাজের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য
(ক) সুরাপান
ইংরেজীশিক্ষার অশেষ কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে যে কয়েকটি কুফল ফলিয়াছিল সুরাপান তাহাদের মধ্যে প্রধান। ইংরেজীশিক্ষিত যুবকগণের মধ্যে সুরাপান সভ্যতার লক্ষণ বলিয়া বিবেচিত হইত এবং পিতাপুত্রে একসঙ্গে সুরাপান করিতেন এরূপ দৃষ্টান্তও আছে। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিয়াছেন :
“ডিরোজিও যে স্বাধীন চিন্তার স্রোত প্রবাহিত করিয়া দিয়া গিয়াছেন তাহা এই সময়ে বঙ্গসমাজে পূর্ণমাত্রায় কাজ করিতেছিল। শিক্ষিত দলের মধ্যে সুরাপানটা বড়ই প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দু কলেজের ষোল সতের বৎসরের বালকেরা সুরাপান করাকে শ্লাঘার বিষয় মনে করিত। বঙ্গের অমর কবি মধুসূদন দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, সুপ্রসিদ্ধ রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি এই সময়ে হিন্দু কালেজে পাঠ করিতেছিলেন। সে সময়ে লোকের মুখে শুনিয়াছি যে কালেজের বালকেরা গোলদিঘীর মধ্যে প্রকাশ্য স্থানে বসিয়া মাধব দত্তের বাজারের নিকটস্থ মুসলমান দোকানদারের দোকান হইতে কাবাব মাংস কিনিয়া আনিয়া দশজনে মিলিয়া আহার করিত ও সুরাপান করিত। যে যত অসমসাহসিকতা দেখাইতে পারিত তাহার তত বাহাদুরী হইত, সে তত সংস্কারক বলিয়া পরিগণিত হইত।”৫৮
রাজনারায়ণ বসু তাঁহার ‘আত্মচরিতে’ লিখিয়াছেন :
“তখন হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা মনে করিতেন যে, মদ্যপান করা সভ্যতার চিহ্ন, উহাতে দোষ নাই।…আমাদিগের বাসা তখন পটলডাঙ্গায় ছিল। আমি পাড়ার ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল (ইনি পরে ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া শান্তিপুরে অনেক দিন কাৰ্য্য করিয়াছিলেন), প্রসন্নকুমার সেন এবং নন্দলাল মিত্র প্রভৃতির সহিত কালেজের গোলদিঘীতে মদ খাইতাম, এবং এখন যেখানে সেনেট হাউস হইয়াছে, সেখানে কতকগুলি শিক্-কাবারের দোকান ছিল, তথা হইতে গোলদিঘীর রেল টপকাইয়া (ফটক দিয়া বাহির হইবার বিলম্ব সহিত না) উক্ত কাবাব কিনিয়া আনিয়া আমরা আহার করিতাম। আমি ও আমার সহচরেরা এই রূপ মাংস ও জলস্পর্শশূন্য ব্রাণ্ডি খাওয়া সভ্যতা ও সমাজ সংস্কারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শক কাৰ্য্য মনে করিতাম।৫৯
সুরাপানের কুফল ও প্রসার যে এদেশের একশ্রেণীর লোকের মনে বিষম উদ্বেগের সঞ্চার করিয়াছিল সমসাময়িক পত্রিকার মন্তব্য হইতে তাহার স্পষ্ট ধারণা করা যায়। কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি :
“সুরাপান রূপ মহাপাপ এ দেশে প্রবিষ্ট হওয়াতে যে অশেষ অনর্থের উৎপত্তি হইতেছে, তাহা এক্ষণে সকলেরই বিদিত হইয়াছে…এবং তাহার নিবারণাৰ্থ হিন্দু ও খ্রীষ্টান উভয় সম্প্রদায়ি লোকে ইংলণ্ডস্থ পার্লিয়ামেণ্ট নামক রাজসভায় আবেদন করিয়াছেন।” (তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, কার্তিক, ১৭৭৪ শক)।৬০
উক্ত পত্রিকায় (শ্রাবণ, ১৭৭২ শক) মন্তব্য করা হইয়াছে যে, হিন্দু ও মুসলমান যুগে এই পাপের বিশেষ প্ৰাচুৰ্য্য ছিল না। কিন্তু অধুনা সুসভ্য ইংরাজদিগের রাজশাসনে সর্বাপেক্ষা মদ্যপান অতি ভয়ানক রূপে বিস্তার হইয়াছে। প্রথমে যে সমস্ত পরিবারে মদ্যের নামগন্ধ মাত্র ছিল না, এইক্ষণে তাঁহারদের মধ্যে অনেক ব্যক্তিকে অকুতোভয়ে এই মহা অনিষ্টজনক দ্রব্য ব্যবহার করিতে নিয়তই দেখা যায়।
“সম্প্রতি এই ভারত রাজ্য ইংরাজ জাতির অধিকৃত হওয়া অবধি মদ্য প্রস্তুত হইবার স্থান ও মদ্যালয় দিন দিন যাদৃশ বাহুল্য হইতেছে তৎসহকারে পান দোষও অতি ভয়ঙ্কররূপে প্রবল হইয়া আসিতেছে।
“যখন রাজার আজ্ঞাক্রমে মদ্য প্রস্তুত করিবার স্থান স্থানে স্থানে সংস্থাপিত হইয়াছে এবং এই একমাত্র কলিকাতার মধ্যেই শতাধিক মদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত আছে, এবং দিন দিন বৃদ্ধি হইতেছে, তখন ইহা কে না কহিবে যে রাজাই এক পাপালন প্রবল করিবার প্রধান কারণ? কালের গতিকে ইদানীং মদ্যপানকে সভ্যতার চিহ্ন বলিয়া অনেকে মানিতেছে,–প্রবল মোহাচ্ছন্নতা বশতঃ ইংরাজ জাতির উত্তমোত্তম রীতি অপেক্ষা যত অধম ব্যবহারের অনুকরণ করাই তাহারদিগের বিশেষ লক্ষ্য হইয়াছে।
“ইংরাজ জাতির এ দেশ অধিকার হইবার পূর্বে সাধারণরূপে মদ্য ব্যবহার কতিপয় নীচ জাতির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল; কিন্তু এইক্ষণে উচ্চ শ্রেণীর লোকেরদের মধ্যেও সুরাপান অধিক দৃশ্য হয়; বিশেষত নব্য সম্প্রদায়ী প্রায় তাবৎ বিদ্বান্ ও ধনি যুবককে ইহাতে সাতিশয় লিপ্ত হইতে দেখা যাইতেছে।
“এদদ্ভিন্ন মদিরার অন্য এক দুর্জয় প্রভাব এই যে, তদ্বারা মনুষ্যের বুদ্ধি নাশ হইয়া কুকর্ম সাধনের দুই প্রধান প্রতিবন্ধক যে লজ্জা আর ভয় তাহা সম্যকরূপে অন্তর্হিত হয়, তাহাতে আমারদিগের মনোগত যাবতীয় কু-প্রবৃত্তি অত্যন্ত প্রবল হইয়া ওঠে, এবং স্ব স্ব ক্ষমতা প্রকাশে পূর্ণ উৎসাহ প্রাপ্ত হয়। ইহার দ্বারা কামের আতিশয্য হইয়া নানাবিধ ঘৃণিত ইন্দ্রিয় দোষাচারে মনুষ্য সকল প্রবৃত্ত হয়, ক্রোধ প্রবৃদ্ধ হইয়া অল্প কারণে প্রলয় ব্যাপার উপস্থিত করে এবং লোভের প্রার্দুভাবে দস্যু বৃত্তিতে লোকের উৎসাহ জন্মে; ফলে সংক্ষেপে বলা যাইতেছে, এই মর্ত্য লোকে যত প্রকার অতি জঘন্য অসৎ কৰ্ম্ম মনুষ্য হইতে সম্ভব হইতে পারে, এক অতিরিক্ত মদিরা পান দ্বারা সে সমুদয়ের কিছুমাত্র অকৃত থাকে না।
“ইংরাজ রাজার অধীনতায় এদেশস্থ ভদ্র প্রজা সমস্ত যে যে কারণে অসন্তুষ্ট আছেন, তন্মধ্যে প্রচুর মদ্যপান দ্বারা মত্ততার বৃদ্ধি এক প্রধান কারণরূপে অবধারিত আছে। অতএব যাহাতে এদেশে অপর্যাপ্ত মদ্য প্রস্তুত না হয় এবং পাপের প্রধান আকর মদ্যালয় সকল এদেশ হইতে উঠিয়া যায়, তাহা অধন সধন সমুদায় বিজ্ঞ ব্যক্তিদিগের প্রার্থনীয়, এবং তদ্বিষয়ে তাঁহারদিগের সকলেরই সমান অভিপ্রায় ব্যক্ত আছে। এই পত্রিকায় আমরা বারম্বার ইহার আন্দোলন করিয়াছি এবং এখনও ইহার উত্থাপন করিতেছি; ইহাতে রাজপুরুষদিগের আর উপেক্ষা করা উচিত নহে।”৬১
কলিকাতায় সুরাপানের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন হয় এবং নানা সময়ে নানা স্থানে সুরাপান নিবারণী সভা স্থাপিত হয়। প্যারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি ইংরেজীশিক্ষিতগণ এই আন্দোলনের অগ্রণী ছিলেন।
(খ) বিলাতের অনুকরণ
ইংরেজের সংস্পর্শে আসার আর একটি প্রত্যক্ষ ফল অশন বসন, গৃহসজ্জা প্রভৃতি জীবনযাত্রার প্রায় সকল বিভাগেই ইংরেজী সভ্যতা ও সমাজের অন্ধ অনুকরণ। অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ইহা এমন প্রবল আকার ধারণ করিয়াছিল যে, উচচপদস্থ ইংরেজগণও ইহার নিন্দা করিয়াছেন। বাড়ীঘর, বাগানবাড়ী, ঘোড়ার গাড়ী, বৈঠকখানার আসবাবপত্র সবই ইউরোপীয়দের অনুকরণে নির্মিত হইত।
(গ) সমাজসংস্কার
প্রধানত ইংরেজীশিক্ষার ফলে হিন্দুসমাজের নানাবিধ গ্লানি ও কুপ্রথা দূর করিয়া সমাজসংস্কারের চেষ্টা বিশেষ প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল। ধর্ম ও সমাজসংস্কার এবং রাজনীতিক অধিকারের আন্দোলন-এ দুইটিকে উনিশ শতকের বাংলার প্রধান বৈশিষ্ট্য বলিলে খুব অত্যুক্তি করা হয় না।
সমাজসংস্কার সম্বন্ধে কয়েকটি মৌলিক তত্ত্ব কিরূপে ধীরে ধীরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে জাগিয়া উঠিয়াছিল তাহার নিদর্শনস্বরূপ ১৭৮৯ শকের (১৮৬৭ খ্রী.) কার্তিক মাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় যে সুচিন্তিত সুদীর্ঘ মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছিল তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“কোন সমাজের আচার ব্যবহার ও রীতি নীতি চিরকাল এক ভাবে থাকে না। কালক্রমে মানুষের অবস্থার পরিবর্ত হয়; সেই পরিবর্তের সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন আচার ব্যবহারও অন্ততঃ কিয়ৎ পরিমাণ পরিবর্তন করা আবশ্যক হইয়া উঠে। তাহা না হইলে সমাজস্থ লোকদিগকে অনেক প্রকার উন্নতি হইতে বঞ্চিত থাকিতে ও অশেষ ক্লেশ ভোগ করিতে হয়। তিন সহস্র বৎসর পূৰ্ব্বে হিন্দু জাতির যেরূপ অবস্থা ছিল, অধুনা তাহা বহু অংশে পরিবর্তিত হইয়াছে। তৎকালে যে সকল আচার ব্যবহার ও রীতি নীতি প্রচলিত ছিল, তদানীন্তন হিন্দু সমাজের পক্ষে তৎসমুদায় নিতান্ত হিতকর ও একান্ত আবশ্যক হইলেও তদ্বারা ইদানীন্তন লোকদিগের হয়তো যৎপরোনাস্তি অপকার হইতে পারে। যখন এই রূপ অপকার ঘটনার সম্ভাবনা হইয়া উঠে, তখন লোক আপনা হইতেই পুরাতন রীতি পদ্ধতি পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হয়। প্রতিবন্ধকতা করিতে গেলে কেবল বিবাদ বিসম্বাদই ঘটে; পরিবর্তন রোধ করা যায় না।
“আমাদের হিন্দু সমাজ এক্ষণে এই দুঃস্থাবস্থায় নিপতিত হইয়া রহিয়াছে। ইহার সভ্যগণের অধিকাংশের মন কলুষিত ও সংকীর্ণ; সঙ্কৰ্ম্ম সাধনের সাহস কিছুই লক্ষিত হয় না; পদে পদে ভীরুতা ও দুৰ্ব্বলতা প্রদর্শন করে। অধিকাংশের চিত্তই অজ্ঞান-তিমিরে আচ্ছন্ন হইয়া আছে। ইহাদিগের মনের ভাব উন্নত না হইলে ভারতবর্ষের অবস্থা কখনই সমুন্নত হইবে না; সমাজ সংস্কারকদিগের সেই মঙ্গল কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইতে হইলে, যে সকল আচার ব্যবহার তাহাদের উন্নতি লাভের অন্ত রায় হইয়া আছে, তাহা অবশ্যই পরিবর্তিত করিতে হইবে।
“কাৰ্যগতিকে নানাবিধ পরিবর্তন অবশ্যই উপস্থিত হইবে। কিন্তু এই সকল অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনকে যদি যদৃচ্ছাক্রমে চলিতে দেওয়া যায়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বলা যাইতে পারে যে তদ্বারা হিন্দু সমাজ কখন সুখী হইতে পারিবে না। যদি কোন উন্নত লক্ষ্য এই সকল পরিবর্তনের নিয়ামক না হয়, যদি কোন গম্যস্থান মনে মনে না রাখিয়া হিন্দু সমাজকে এই পরিবর্তন স্রোতে ভাসিতে দেওয়া হয়, তাহা হইলে হিন্দু জাতি নিশ্চয়ই ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যাইবে।
“এক্ষণে হিন্দু সমাজ এইরূপ লক্ষ্যহীন পরিবর্তনের বিষময় ফল ভোগ করিতেছে, বোধ হয় এই পাপের ভোগ আরও বৃদ্ধি হইতে চলিল। আপনাদের পাপাচার, অবিমৃষ্যকারিতা ও আলস্য প্রভৃতি দোষে পূৰ্ব্বাবধিই আমরা প্রায় মৃত্যুমুখে প্রবিষ্ট হইয়া আছি; আবার নূতন নূতন পাপের ফল ভোগ করিতে হইলে আর আশা ভরসা থাকিতেছে না। এখনও সকলে সতর্ক হউন স্নেহের সহিত স্বদেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। যাহাতে স্বদেশানুরাগই সকলের মনে প্রদীপ্ত হইতে থাকে তাহার আন্দোলন করিতে থাকুন। স্বদেশানুরাগ স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধনের প্রধান উপায়। স্বদেশানুরাগ ব্যতিরেকে স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধনের চেষ্টা করা আর কৃত্রিম শোকে অভিভূত হইয়া নাটকের অভিনয় করা উভয়ই তুল্য। এক্ষণে যে চাকচিক্যশালী বাহ্য সভ্যতা আমাদের দেশে সঞ্চারিত হইতেছে তাহাতে স্বদেশানুরাগের সম্বন্ধ দেখা যায় না; এ সভ্যতা স্বদেশানুরাগ হইতে উৎপন্ন নহে; অনুকরণ দ্বারা ঋণ করা হইতেছে। সুতরাং কাকের ময়ূর-সজ্জাবৎ ঈদৃশ সভ্যতা দ্বারা ভারতবর্ষের স্থায়ী কল্যাণের সম্ভাবনা নাই।
“আমরা এরূপ বলিতেছি না যে স্বদেশানুরাগে অন্ধ হইয়া স্বদেশের দোষ দর্শনে পরাজুখ হইয়া থাক; সেরূপ করা যথার্থ স্বদেশানুরাগীর লক্ষণ নহে। কি প্রকারে স্বদেশের ও স্বজাতির গৌরব বৃদ্ধি হইবে, কি উপায়ে স্বদেশীয় আচারব্যবহার সকল পরিশুদ্ধ হইবে, কিসে স্বদেশীয় লোকে বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান ধর্মে বিভূষিত হইবে এবং কি প্রকারে স্বদেশের সুখ স্বচ্ছন্দতা পরিবর্ধিত হইতে থাকিবে, এই সকল চিন্তাতেই স্বদেশানুরাগীর অন্তঃকরণ উদ্যম ও উৎসাহে পরিপূর্ণ থাকে। যে সকল আচার ব্যবহার দ্বারা বাস্তবিক স্বদেশের অনিষ্ট উৎপন্ন হইতেছে, যে সকল কুসংস্কার স্বদেশীয়দিগের উন্নতির পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে এবং যে সকল রীতিনীতি স্বদেশীয়দিগের অভ্যুদয়ের অন্তরায় হইয়া রহিয়াছে, তাহা স্বদেশীয় ও স্বজাতীয় বলিয়া পরিবর্তিত করিতে আমরা কখনই সঙ্কোচ প্রকাশ করি না।
“এক্ষণে হিন্দু সমাজের যেরূপ অবস্থা, তাহাতে কোন্ বিষয়ের অগ্রে সংস্কার সম্পাদন করা আবশ্যক, ইহা লইয়া অনেকে অনর্থক উৎকণ্ঠিত হইয়া থাকেন, কিন্তু সংসারের গতি ও সংস্কারের রীতি অন্য প্রকার।
“কে সংসারের কোন্ দিকে থাকিয়া কোন্ কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়া যাইবে, কেহই অগ্রে বলিয়া তাহার নিয়ম করিতে পারে না। চতুর্দিক হইতে নানা লোকে নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন; তাঁহাদিগের ভিন্ন ভিন্ন চেষ্টা দ্বারা একই উদ্দেশ্য সম্পাদিত হয়। কেহ ধৰ্ম্মনীতির উৎকর্ষ সাধনে প্রবৃত হন, কেহ বিদ্যা বিস্তারের জন্য ব্যস্ত হইয়া থাকেন; কেহ রাজনীতির সংশোধন করেন; কেহ আচার ব্যবহারের সংশোধনে অগ্রসর হন; কেহ কৃষিকর্মে, কেহ বাণিজ্যে, কেহ শিল্পকার্যে নিযুক্ত হইয়া থাকেন। যাঁহার যে বিষয়ে যতদূর ক্ষমতা, তাহা দ্বারা সেই বিষয়ের ততদূর উন্নতি সম্পাদিত হয়। এইরূপে নানাবিধ চেষ্টা দ্বারা এক এক সমাজ সংস্কৃত ও সংশোধিত হইতে থাকে, অতএব হিন্দু সমাজে যাঁহারা যে বিষয়ে যতদূর ক্ষমতা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা তাহা অনর্থক আলস্য-সলিলে নিক্ষিপ্ত না করিয়া হিন্দু সমাজের মঙ্গল সাধনে নিয়োজিত করুন। কেবল এই মাত্র নিয়ম করা যাইতে পারে যে, যাহার যে বিষয়ে সমধিক ক্ষমতা ও অভিরুচি, তিনি স্বদেশের সেই বিষয়ের উন্নতি সাধনে অগ্রসর হউন; কিন্তু ধৰ্ম্ম-সংস্কারে সকলেরই সহায়তা আবশ্যক।”৬২
সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সকলে একমত হইলেও মোটামুটি সামাজিক সংস্কারের প্রণালী কী হইবে ইহা লইয়া বিলক্ষণ মতভেদ ছিল। ১১৮১ শকের (১৮৮৯ খ্রী.) ভাদ্রমাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ইহার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“আজকাল যাঁহারা কিয়ৎ পরিমাণে শিক্ষার আলোক লাভ করিয়াছেন এবং শিক্ষোপার্জিত জ্ঞানকে যাহারা জীবনে পরিণত করিতে ইচ্ছা করিতেছেন, তাঁহারা অল্পাধিক পরিমাণে সকলেই সংস্কারেছুক। বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ, জাতি ভেদ প্রভৃতি অতি গুরুতর বিষয়ে আমরা আজকাল যাকে তাকেই বাদ প্রতিবাদ করিতে দেখি। এই সংস্কারের ভাব একপ্রকার দেশব্যাপ্ত দেখিতে পাই। একদল নূতন শিক্ষা, নূতন জ্ঞান ও নূতন আলোক লাভ করিয়া প্রাচীনকালের চিরপূজ্য প্রথা সকলকে সমূলে উৎপাটন করিবার চেষ্টা করিয়া সমাজে অশান্তি কোলাহল আনয়ন করেন। আর একদল চির সেবিত প্রথার মোহে মুগ্ধ হইয়া আপনাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের সূচনাকে অমঙ্গলের চিহ্ন মনে করিয়া প্রাণপণে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন।
“যাহারা য়ুরোপীয় সমাজের অনুকরণে সমাজ সংস্কার করিতে চান, বিলাতে ইহা আছে, অতএব এখানেও না হইবে কেন, এরূপ যুক্তি অবলম্বন করিয়া যাহারা সংস্কার কাৰ্যে প্রবৃত্ত হন, তাহাদিগকে আমরা ভ্রান্ত মনে করি। অনুকরণপ্রিয়তা সৰ্বৰ্থা দূষণীয় নহে–কিন্তু অনুকরণ মাত্রেই প্রার্থনীয় নহে। দেশকালের প্রকৃতির সঙ্গে মিলাইয়া অনুকরণ করিলেই উপকারের সম্ভাবনা।
“অনেক সময় বিদেশীয় সভ্যতার বাহ্য শোভা ও চাকচিক্যময় উজ্জ্বল সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া আমরা দেশীয় স্নিগ্ধ মনোরম আমাদের প্রকৃতির যথোপযুক্ত অথচ দোষশূন্য সামাজিক প্রথাগুলিকে পদদলিত করিয়া সমাজ সংস্কারে অগ্রসর হই। ইহা আমাদের ভয়ানক ভ্রম সন্দেহ নাই। যাহা কিছু দেশীয়, তাহাই অপকৃষ্ট নহে, এবং যাহা কিছু বিলাতী আমদানী তাহাই উৎকৃষ্ট নহে। দোষণীয় প্রথা পরিত্যাগ করিয়া যথার্থ হিতকর প্রথা প্রবর্তিত করাই সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য। কিন্তু হঠকারিতা দোষে এই উদ্দেশ্য অনেক সময় সিদ্ধ হয় না।
“একশ্রেণীর সংস্কারক আছেন, যাঁহারা “জাতীয়” “দেশীয়” এই সকল কথা শুনিলেই অগ্নিশর্মা হইয়া উঠেন। তাঁহারা বৈদেশিক ভাবে এতই অন্ধ, যে দেশীয় কিছুই ভাল দেখিতে পান না। ভাষা, পরিচ্ছদ, আহার ব্যবহারাদি বিষয়ে ইঁহাদের স্বদেশের প্রতি অনুরাগ দেখিতে পাওয়া যায় না। ইঁহারা বৈতালিক (বৈলাতিক?) অনুকরণেই তৎপর। কিন্তু অনুকরণ মাত্রেই উন্নতি নহে–এ কথা উঁহারা বুঝিতে পারেন না।”
“যে শিক্ষা ও সভ্যতাতে আমাদের অন্তর্নিহিত সদ্ভাবগুলি প্রস্ফুটিত হয় ও দোষগুলি নির্মূল হয়, সেই শিক্ষা ও সভ্যতা প্রবর্তন করাই আমাদের কর্তব্য। যে সকল সামাজিক রীতি পদ্ধতির দোষে আমাদের অনিষ্ট হইতেছে তাহা দূর করিতে প্রাণপণে চেষ্টা কর, কিন্তু সংস্কারের নামে বিকৃত পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে সমাজ গঠন করিতে গিয়া আমাদের জাতীয় প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারী হইও না।”৬৩
যে দুইটি বিরোধী মতের সমালোচনা করা হইয়াছে তাহা যে উনিশ ও বিশ শতকে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এই ‘সনাতনপন্থী ও চরম ‘অগ্রগতিশীল মতের বিরোধের মধ্যদিয়াই বাংলার সমাজসংস্কারের কার্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়াছিল। স্বামী বিবেকানন্দ এই উভয়ের মধ্যে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে যে মতবাদ প্রচার করেন তাহাই সাধারণতঃ গৃহীত হয়। কিন্তু পূর্বোক্ত দুই বিরোধীদলের অস্তিত্ব এখনও আছে।
যাহারা সামাজিক সংস্কার বিষয়ে একমত ছিলেন তাঁহাদের মধ্যেও একটি বিষয়ে গুরুতর মতভেদ ছিল। একদলের মতে প্রয়োজন বোধ করিলে সরকারী আইন প্রণয়ন করিয়া সামাজিক কুপ্রথা রহিত করা আবশ্যক। অন্য দলের ইহাতে ঘোরতর আপত্তি ছিল–তাহারা বলিতেন, বিদেশী সরকারকে আমাদের ধর্ম বা সামাজিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে দেওয়া সঙ্গত নহে। লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা আইন দ্বারা রহিত করিবার প্রস্তাব করিলে রাজা রামমোহন রায়ের মত উদার সমাজসংস্কারক ইহার প্রতিবাদ করেন। উনিশ শতকের শেষভাগে (১৮৯১) বিশেষভাবে বেহারাম মালাবারির চেষ্টায় স্ত্রীর বয়স ১২ বত্সরের কম হইলে স্বামী তাহার সহিত সহবাস করিতে পারিবে না এই মর্মে যখন সহবাস সম্মতি (Age of consent) আইন বিধিবদ্ধ হয়, তখন লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। পুরুষের বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইন করার সপক্ষে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ বাংলার বহু গণ্যমান্য লোক ইহার বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। বিধবা-বিবাহ অনুমোদক আইন প্রসঙ্গে ইহার বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে।
প্রথম প্রথম ইংরেজ সরকার আইন দ্বারা সমাজসংস্কারের বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু আইন দ্বারা সতীদাহ নিবারণ ও বিধবা-বিবাহ অনুমোদন প্রভৃতি সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম কারণ মনে করিয়া তাহার পর সরকার আইন দ্বারা সমাজ সংস্কারের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং এদেশীয় অনেকেই তাহা সমর্থন করে।
এ সম্বন্ধে নিম্নে উদ্ধৃত সোমপ্রকাশের মন্তব্য (১২৯৩, ১৬ কার্তিক) বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য :
“মালাবারি যে হিন্দু বিবাহ সম্বন্ধে আইন করিবার জন্য বড়লাটের নিকট আবেদন করেন তাহা আমরা ইতিপূৰ্ব্বে পাঠকগণকে অবগত করিয়াছি। লর্ড ডফরিণ প্রত্যুত্তরে ইণ্ডিয়ান গেজেটে প্রকাশ করিয়াছেন যে এইরূপ আইন করিতে স্থানীয় গভর্নমেন্ট সকল এবং গভর্নমেন্টের প্রধান কর্মচারিগণের সম্মতি নাই। লর্ড ডফরিণও তাঁহাদের সহিত একমত হইয়া হিন্দুবিবাহে হস্তক্ষেপ করিতে সম্মত নহেন। তাঁহার অসম্মতির কারণগুলি গেজেটে নির্দিষ্ট হইয়াছে।
“বড়লাট বলেন : মালাবারি যে বিষয়ের প্রস্তাব করিয়াছেন তদনুরূপ কাৰ্য্যে ভারত গভর্নমেন্ট কয়েকটি নীতি দ্বারা পরিচালিত হইয়া থাকেন। যেখানে জাতিগত অথবা দেশাচারগত কোন কাৰ্যে বৰ্তমান ফৌজদারী আইনের ব্যাঘাত হয় গভর্নমেন্ট সেখানে আইনের বশবর্তী হইয়া কাৰ্য্য করিবেন। যেখানে জাতি বা দেশাচারগত কোন নিয়ম দেওয়ানী আদালতের দ্বারা কাৰ্য্যকরী হইতে পারে কিন্তু যাহাতে সাধারণনীতি অথবা ধৰ্ম্মনীতির ব্যাঘাত জন্মে গভর্নমেন্ট সে নিয়ম কার্যে পরিণত করিতে অস্বীকার করিবেন। যে কোন বিষয়ের নিয়মাদি করিবার ক্ষমতা প্রজাগণের হস্তে এবং যাহা কাৰ্য্যে পরিণত করিতে দেওয়ানী আদালতের সাহায্য আবশ্যক করে না, তাহাতে গভর্নমেন্ট কোন সম্পাদক (?) রাখিতে ইচ্ছা করেন না।
“এই সকল সাধারণ নীতি বিশেষ বিশেষ কাৰ্য্যে প্রয়োগ করিবার সময় অনেক মতভেদ হওয়া সম্ভব। সেজন্য একটি সামান্য নিয়মে এই সকল বিষয় স্থির করিতে হয়। সে নিয়মটি এই-গভর্নমেন্টের হস্তে যতটুকু শাসন ক্ষমতা আছে তাহার চালনা করিয়া প্রস্তাবিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে পারা যায় কিনা, যদি না পারা যায় তবে বর্তমান কাৰ্য্য-পদ্ধতির ব্যতিক্রম করিয়া কোন ব্যবস্থা করা গভর্নমেন্টের অভিপ্রেত নহে। এই সামান্য নিয়মের প্রয়োগ করিয়াই মালাবারির প্রস্তাবে গভর্নমেন্ট সম্মতি প্রদান করিতে পারেন নাই। এ সকল বিষয় প্রজাবর্গের বিবেচনার উপর নির্ভর। কালক্রমে দেশের ভিতর শিক্ষার ক্রমবিস্তার হইয়া অধিবাসিগণেরা যেমন উন্নত হইবেন সেই পরিমাণেই তাঁহাদের সমাজও উন্নত হইয়া উঠিবে।
“ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ব্যবস্থামতে ধৰ্ম্মনীতির যেরূপ আদর্শ ধরা হইয়াছে তাহা এতদ্দেশীয় জাতিবৈষম্যগত ধৰ্ম্মনীতির সহিত কোন কোন স্থলে অসদৃশ। গভর্নমেন্টের আদর্শ ধৰ্ম্মনীতি প্ৰয়োগ করিলে দেশীয় নীতিপদ্ধতি ক্রিয়াকলাপ দেশাচার এবং চিন্তা প্রণালী সংস্কৃত হইলেও হইতে পারে, কিন্তু উপদেশ দেওয়া আইনের উদ্দেশ্য নহে। এই কারণেই একদিক হইতে আইন এবং অন্যদিক হইতে জাতিভেদ ও দেশাচারের বিবাদ বাধিলে আইনের কর্তব্য স্বীয় নির্দিষ্ট গণ্ডীর ভিতরে কাৰ্য্য করা।
“আমরা লর্ড ডফরিণের কথায় আপ্যায়িত হইয়াছি। কথাগুলি তাঁহার ন্যায় বিবেচক রাজনীতিজ্ঞের উপযুক্তই হইয়াছে। মালাবারি সমাজসংস্কার ভ্রমে সমাজের যে মহানিষ্ট সাধন করিতে গিয়াছিলেন লর্ড ডফরিণ তাহা নিবারণ করিয়া প্রজাবর্গের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। মালাবারি একজন উন্নতমনা শিক্ষিত ব্যক্তি। লর্ড ডফরিণের উপদেশবাক্যে তিনিও জ্ঞানলাভ করিতে পারিবেন। আমাদের রাজা বিদেশী, তাঁহাদের রুচি ভিন্ন, চিন্তাপ্রণালী ভিন্ন এবং ধৰ্ম্মনীতি ও ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে ব্যবস্থা করিতে যাওয়াও নিতান্ত অযুক্তি। রাজা যদি স্বদেশী হইতেন সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের উপর তাহার কর্তৃত্ব স্বীকার করিতে কাহারও আপত্তি থাকিত না। হিন্দুরাজাই পূৰ্ব্বাপর দেশাচারের ব্যবস্থা করিয়া আসিয়াছেন এখন ইংরাজের হস্তে সেই ক্ষমতাটুকু যাচিয়া দিতে গেলে আমাদের সর্বনাশ। বিবেচক শাসনকর্তাও তাহা বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়া মালাবারির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়াছেন। সমাজসংস্কারের জন্য যদি মালাবারির তৃষ্ণা বাড়িয়া থাকে তিনি সামাজিক উপায় অবলম্বন করিয়া সে তৃষ্ণা নিবারণ করুন। একে ত যে সকল বিষয়ে আইনের প্রয়োজন, তাহাতেই আমরা আইনের জ্বালায় অস্থির, তাহার উপর আবার যদি সামাজিক বিষয়ে আইন প্রবিষ্ট করা হয় তাহা হইলে চতুর্দিকে হাহাকার শব্দ পড়িয়া যাইবে। মালাবারি অনেকবারই রাজনীতি ছাড়িয়া সমাজসংস্কারক হইয়াছেন। তাই এখনও আইনের আকর্ষণ পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। যদি সমাজসংস্কারের প্রয়োজন হয়, তবে আমরা বলি মালাবারি অগ্রে হিন্দুধর্মের আলোচনা করুন। যিনি স্বধৰ্ম্মের গূঢ় ভেদ করিতে না পারিয়াছেন তাহার পক্ষে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা বিড়ম্বনা মাত্র। হিন্দুধৰ্ম্মের সহিত হিন্দুর আচারব্যবহারের নিকট সম্বন্ধ। মালাবারি অগ্রে ধর্মের আলোচনা না করিয়া সমাজসংস্কার করিতে গেলে পদে পদেই ভ্রমে পতিত হইবেন।”৬৪
৮. স্ত্রীজাতির উন্নতি
(ক) স্ত্রীজাতির অবস্থা
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সম্পন্ন নিষ্ঠাবান হিন্দু গৃহস্থের গৃহিণীর জীবনযাত্রা কিরূপ ছিল ১৮৫৬ সনের ১১ নভেম্বর তারিখের ‘সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকার নিম্নলিখিত সম্পাদকীয় মন্তব্যে তাঁহার দৈনন্দিন কর্মতালিকা হইতে সে সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা যায়।
“সংসর্গ দোষ গুণা ভবন্তি’ নগরীর ঠাকুর গোষ্ঠী, রাজ গোষ্ঠী, দেব গোষ্ঠী, ঘোষ গোষ্ঠী, মিত্র গোষ্ঠী, দত্ত গোষ্ঠী প্রভৃতি প্রধান প্রধান সকল গোষ্ঠীর অন্তঃপুরে স্ত্রীলোকেরা প্রাতঃস্নান ও পূজানুষ্ঠান, জপ, যজ্ঞ, ব্রাহ্মণ ভোজনাদি না করাইয়া জলগ্রহণ করেন না। এক এক বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগের নৈবেদ্যাদি নিত্য দানে গুরু, পুরোহিত ও আশ্রিত ব্রাহ্মণগণের পিত্ত রক্ষা হইতেছে, প্রতি স্ত্রীলোকের ধৰ্ম্ম কৰ্ম্মাদির বিষয় ভিন্ন ভিন্ন রূপে লিখিত হইলে এতৎ প্রস্তাব গুরুতর হইয়া উঠিবে অতএব অদ্য এক স্ত্রীলোকের ধৰ্ম্ম দৃষ্টান্তে প্রস্তান্তে (?) প্রস্তাব সমাপ্ত করি।
“আন্দুল নিবাসি ভূম্যধিকারী শ্ৰীযুক্ত বাবু জগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক মহাশয়ের স্ত্রী প্রতিদিবস যে ব্যবহার করেন তাহা শ্রবণ করিলে ধৰ্ম্মপরায়ণা হিন্দু রমণীরা ধৰ্ম্ম কৰ্ম্মে উপদেশ প্রাপ্তা হইবেন এই কারণ আমরা বিশেষ করিয়া লিখিতেছি, গঙ্গাতীর হইতে আন্দুল গ্রাম ছয় ক্রোশ ব্যবহিত, ইহাতেও প্রতিদিবস ঐ স্ত্রীলোকের প্রাতঃকালে প্রাতঃস্নান ও পূজ্যাদি জন্য ভারে ভারে গঙ্গাজল যায়, তিনি গঙ্গাজলে প্রাতঃস্নান করিয়া পূজাগারে প্রবেশ করেন, বেলা দুই প্রহর পর্যন্ত যথোপচারে পূজা, জপ সাঙ্গ করিয়া বাহিরে আইসেন, সেই সময় দাসীসকল নিকটে থাকে। জিজ্ঞাসা করেন রন্ধনাদির কি কি ব্যবস্থা হইয়াছে অন্তঃপুর বহিঃপুরে লুচি, রুটী, অন্নব্যঞ্জনাদি যাহা প্রস্তুত হইবে পূৰ্ব্ব রজনীতে সজনীগণকে তাহা বলিয়া রাখেন এবং সেই রাত্রিতেই বাজার আসিবার টাকা দেন, দাসীরা কহে এই এই হইয়াছে, সেই সময়ে পুত্র কন্যাদিকে ডাকেন, তাহারদিগকে অগ্রে জিজ্ঞাসা করেন কৰ্ত্তার আহারাদি হইয়াছে? তোমরা আহার করিয়াছ, বহিৰ্বাটীতে যাহারা খায় তাহারদিগের আহারীয় দ্রব্যাদি প্রস্তুত হইয়াছে? অতিথি কতজন আসিয়াছেন? তাঁহারদিগের আহারীয় সমস্ত দিয়াছ? ইহাতে জ্যেষ্ঠ পুত্র বাবু যোগীন্দ্রচন্দ্র মল্লিক এবং অন্যেরা গৃহিণীর কথায় যেমন যেমন উত্তর করিতে হয় করেন, সেই সময় দুইজন প্রাচীন ভৃত্য আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহারা তাঁহার শ্বশুরের কালে বিশ্বাসিত রূপে কৰ্ম্ম নিৰ্বাহ করিয়াছিল শ্রীমতী তাঁহারদিগকে বৃত্তিভোগী করিয়াছেন, এইক্ষণে তাহারা অন্য কোন কর্ম করে না, কেবল তাঁহার পূজার নৈবেদ্য এবং ইষ্টোদ্দিশ্যে উৎসৃষ্ট ভোজ্য লইয়া ব্রাহ্মণদিগের বাড়ী বাড়ী যায়, অতি প্রশস্ত এক থালের মধ্যস্থলে অভ (ত্যু?)ত্তম /৫ পাঁচ সের নৈবেদ্য তণ্ডুল সাজানো হয় তাহার চতুর্দিকে দ্বাদশ বাটী, তৎসঙ্গে এক গ্লাস থাকে ঐ সকল পাত্রে ফলমূল দধি দুগ্ধ ঘৃত সন্দেশাদি ও পানীয় জল তাম্বুল পৰ্য্যন্ত দেন, এবং এক চাঙ্গারীতে ভোজ্য সাজান যায়, তাহার তণ্ডুল পরিমাণ পঞ্চসের, তাবৎ প্রকার আনাজ, অতি পরিষ্কৃত অড়হর দাইল, তৈল, ঘৃত, পান, সুপারি এবং তাম্বুলোপকরণ, এক যজ্ঞপোবীত দক্ষিণা চারি পয়সা, পূর্বোক্ত প্রাচীন দুই ভূত্য এই সকল দ্রব্যাদি লইয়া ব্রাহ্মণদিগের বাড়ী বাড়ী দিয়া আইসে, ইহাতে কি পাঠকমহাশয়েরা বুঝিতে পারিবেন না ঐ আৰ্য্যার নৈবেদ্য ভোজে পঞ্চদশ পরিবারস্থ এক গৃহস্থের এক দিনের দক্ষিণ হস্তের সমস্ত কৰ্ম্ম সম্পন্ন হয়, যোগীন্দ্র বাবুর মাতা এইরূপে প্রতিদিবস দলস্থ সমস্থ (স্ত?) ব্রাহ্মণগণকে রক্ষা করিতেছেন, দরিদ্র লোকেরা প্রতিদিবস তাহার দানে প্রতিপালন হইতেছে, মাতৃদায়, পিতৃদায়, কন্যাদায়, যে দায় হউক দায় জানাইলেই দরিদ্রেরা তাঁহার নিকট কিছু কিছু পায়, বেলা দুই প্রহর তিনঘণ্টা পর্যন্ত অনুসন্ধান করেন সকলের আহারাদি হইয়াছে কিনা, তৎপরে শেষ বেলায় নিয়মিত যৎকিঞ্চিৎ আহার করেন, এই আহারেই আহার, রাত্রিতে কিঞ্চিদুগ্ধপান মাত্র, এই সংযতা স্বামী সেবায় ভক্তি যুতা রহিয়াছেন, পরমেশ্বর ধর্ম কৰ্ম্ম দৃষ্টে তাহার প্রতি শুভ দৃষ্টি করিয়াছেন, তিন পুত্র, দুই কন্যা, পতি বৰ্ত্তমান, প্রচুর বিষয়, আমরা অনুমান করি ভূম্যধিকার হইতে প্রতিবৎসর নির্বিবাদে পঞ্চাশৎ সহস্র টাকা আসিতেছে এবং প্রজাসকল ঐ শ্ৰীমতীর উন্নতি প্রার্থনা করিতেছে আমরা প্রার্থনা করি অন্যান্য ধনি স্ত্রীলোকেরা এই ধৰ্ম্ম কর্মে কালক্ষেপ করুন।”৬৫
কিন্তু নিম্নবিত্ত সাধারণ গৃহস্থঘরের স্ত্রীলোকদের অবস্থা খুব ভাল ছিল না।
১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে রামমোহন রায় সাধারণভাবে বাংলা দেশের স্ত্রীজাতির দুরবস্থার যে বর্ণনা করিয়াছেন তাহা যথাসম্ভব তাহারই ভাষায় সংক্ষেপে উদ্ধৃত করিতেছি :
“দেখ কি পৰ্য্যন্ত দুঃখ, অপমান, তিরস্কার, যাতনা, তাহারা কেবল ধর্ম ভয়ে সহ্য করে। অনেক কুলীন কন্যারই বিবাহের পর যাবজ্জীবনের মধ্যে দুই চারিবার স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ হয়, তথাপি ঐ সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে অনেকেই পিতৃগৃহে বা ভ্রাতৃগৃহে নানা দুঃখ সহ্যপূৰ্ব্বক থাকিয়াও যাবজ্জীবন ধৰ্ম্ম নিৰ্বাহ করেন।..আর সাধারণ গৃহস্থের বাটিতে স্ত্রীলোক কি দুঃখ না পায়? বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী বলিয়া স্বীকার করেন কিন্তু তাহাদের সহিত পশুর অধম ব্যবহার করেন। স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জন, ভোজনাদি পাত্র মার্জন, গৃহ লেপনাদি তাবৎ কৰ্ম্ম করিয়া থাকে; এবং বৃহৎ পরিবারের সূপকারের কর্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাত্রিতে করে।…ঐ রন্ধনে ও পরিবেষণে যদি কোন অংশে ত্রুটি হয় তবে তাহাদের স্বামী, শাশুড়ি, দেবর প্রভৃতি কি কি তিরস্কার না করেন। এ সকলই স্ত্রীলোকেরা ধৰ্ম ভয়ে সহ্য করে, আর সকলের ভোজন হইলে ব্যঞ্জনাদি উদর পূরণের যোগ্য অথবা অযোগ্য যৎকিঞ্চিৎ অবশিষ্ট থাকে তাহা সন্তোষপূৰ্ব্বক আহার করিয়া কাল যাপন করে। আর দরিদ্র ব্রাহ্মণ কায়স্থ বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা গো-সেবাদি কৰ্ম্ম করে, পাকাদির নিমিত্ত গোময়ের ঘসি স্বহস্তে দেয়, বৈকালে পুষ্করিণী অথবা নদী হইতে জল আনয়ন করে, রাত্রিতে শয্যাদি করা যাহা ভৃত্যের কৰ্ম্ম তাহাও করে, মধ্যে মধ্যে কিঞ্চিৎ ত্রুটি হইলে তিরস্কার পায়। যদি দৈবাৎ ঐ স্বামী ধনী হয় তবে ঐ স্ত্রীর সর্বপ্রকার জ্ঞাতসারে এবং দৃষ্টিগোচরে প্রায়ই ব্যভিচার দোষে মগ্ন হয় এবং মাসমধ্যে এক দিবসও স্বামী-স্ত্রীর আলাপ হয় না।
“যাহার স্বামী দুই তিন স্ত্রীকে লইয়া গার্হস্থ্য করে তাহারা দিবা রাত্রি মনস্তাপ ও কলহের ভাজন হয়। কখনও স্বামী এক স্ত্রীর পক্ষ হইয়া অন্য স্ত্রীকে সৰ্ব্বদা তাড়ন করে, আবার কেহ কেহ সামান্য ত্রুটি পাইলে বা বিনা কারণে সন্দেহবশতঃ স্ত্রীকে চোরের তাড়না করে (অর্থাৎ চোরের ন্যায় প্রহার করে)। অনেক স্ত্রীই ধৰ্ম্মভয়ে এ সকলই সহ্য করে, কিন্তু যদি কেহ এইরূপ যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া পৃথক থাকিবার নিমিত্ত পতির গৃহ ত্যাগ করে, তবে রাজদ্বারে পুরুষের প্রভাব থাকায় পুনরায় পতির হস্তে আসিতে হয়, এবং পতিও পূৰ্ব্বজাতক্রোধের নিমিত্ত নানা ছলে স্ত্রীকে ক্লেশ দেয়, কখনও বা ছলে প্রাণ বধ করে।”৬৬
রামমোহনের এই বর্ণনার প্রায় শতবর্ষ পরে আমার বাল্যকালের অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি, তাহার উক্তি অতিরঞ্জিত বলিয়া মনে করিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই। উপসংহারে রামমোহন গোঁড়া হিন্দুনেতাদের লক্ষ্য করিয়া লিখিয়াছেন–এই সকল বর্ণনা প্রত্যক্ষসিদ্ধ সুতরাং অপলাপ করিতে পারিবেন না, দুঃখ এই যে এই পর্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনী স্ত্রীলোকদিগকে দেখিয়াও আপনাদের কিঞ্চিৎ দয়া উপস্থিত হয় না যাহাতে বন্ধনপূর্বক দাহ করা (অর্থাৎ সহমরণ) হইতে রক্ষা পায়।
সমাজে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দুর্ব্যবহার একটি সুপরিচিত ব্যাপার ছিল। সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকায় ১৮৫৬ সনের ২০শে মার্চ তারিখের নিম্নলিখিত সম্পাদকীয় মন্তব্য হইতে এ-বিষয়ে তৎকালীন জনমত জানা যায় :
“কোন সম্ভ্রান্ত হিন্দু স্বীয় রমণীর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিলে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব ঐ স্ত্রীর আবেদন মতে অত্যাচারের প্রমাণ লইয়া দুর্জন স্বামী হস্ত হইতে তাহাকে মুক্ত করিতে পারেন কি না? জেলা ২৪ পরগণার জজ ও ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবদিগের মধ্যে এই বিষয়ের মতের অনৈক্য ঘটিয়াছিল, ম্যাজিষ্ট্রেট কহিয়াছিলেন তিনি ঐ প্রকার রমণীকে স্বামী হস্ত হইতে মুক্তি দিতে পারেন, শেসন জজ সাহেব কহেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের তদ্বিষয়ে হস্তক্ষেপ করণের কোন ক্ষমতা নাই, অবশেষে এই প্রশ্ন সদর দেওয়ানী আদালতে আইসে, সদরীয় জজেরা ম্যাজিষ্ট্রেটের মতেই মত দিয়াছেন।
“এইক্ষণে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা ঐ প্রকার রমণীগণকে দুবৃত্ত স্বামীদিগের হস্ত হইতে মুক্ত করিবার ক্ষমতা পাইলেন ইহাতে হিন্দুদিগের মধ্যে মান্য লোকেরা অপমানিত হইবেন, কুলবালারা অনেকে স্বামীর অত্যাচার অসদ্ব্যবহার সহ্য করিতে না পারিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটী আজ্ঞায় স্বতন্ত্র হইবেন, আমরা এ নূতন বিধি শ্রবণে দুঃখিত নহি কেন না এ দেশীয় অনেক লোকে স্ত্রীদিগকে দাসীজ্ঞানে তাহারদিগের প্রতি অত্যন্ত কুব্যবহার ও অত্যাচার করেন, এই বিধানে তাঁহারা নম্র হইবেন আর মহিলাদিগের উপর অকারণ কণ্ঠ গৰ্জন করিতে পারিবেন না।”৬৭
এদেশীয় স্ত্রীলোকের মানসিক অবনতি ও তাহার কুফল সম্বন্ধে সংবাদ প্রভাকরে’ লিখিত হইয়াছে :
“দ্বেষ, হিংসা, কলহ, দ্বন্দ্ব, ক্রোধ, অহঙ্কার, বিচ্ছেদ, আলস্য, মূর্খতা এবং দুঃখ প্রভৃতির এদেশে আধিক্য শুদ্ধ স্ত্রীজাতির দোষেই কহিতে হইবেক, কারণ আমরা যাহারদিগের উদরে জন্মগ্রহণ করিয়াছি তাহারা অহরহ কেবল দ্বেষ হিংসায় প্রমত্তা। বালিকাদিগের কবে বিবাহ হইবেক তাহার নিশ্চয়তা নাই, বিবাহ হইলে তাহার একটি স্বতীন হইবে কি না তাহাও অনিশ্চিত, অথচ তিনি পঞ্চম বর্ষ বয়স্কা হইয়া এক ব্রত করত কল্পনা পূৰ্ব্বক অগ্রেই তাহার মাথা খাইয়া বসিতেছেন, যথা :
“হাতা হাতা হাতা, খা স্বতীনের মাতা”
“বেড়ী বেড়ী বেড়ী, স্বতীন বেটী চেড়ী”
ভগিনী ব্রত করিতেছেন, যথা :
“গুয়া গাছে গুয়া ফলে আমার ভাই চিবয়ে ফ্যালে,
আর লোকের ভাই কুডুয়ে খায়।”
বিবেচনা করুন, যাঁহারা আমাদের প্রসব করেন ও লালন পালন করেন যখন তাঁহারাই এরূপ হইলেন তখন আমরা কত ভাল হইব?”৬৮
উনিশ শতকে যে সমুদয় সমাজসংস্কার প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল তাহাদের কেন্দ্রস্থল ছিল শিক্ষা, সাধারণ জীবনযাত্রা ও সামাজিক পদমর্যাদা প্রভৃতি বিষয়ে স্ত্রীজাতির উন্নতি সাধন এবং তাহাদের প্রতি প্রথাগতভাবে যে-সকল পীড়ন ও অত্যাচার সমাজে প্রচলিত ছিল তাহার দূরীকরণ। সুতরাং এই উন্নতির সম্বন্ধেই প্রথমে আলোচনা করিব।
এই উন্নতির মূলে ছিল নারীজাতির দুরবস্থা সম্বন্ধে জাতীয় চেতনার উদ্বোধন। সম্ভবত ইংরেজীশিক্ষা ও তৎসহ পাশ্চাত্ত্য জাতির প্রভাবেই এই চেতনার উন্মেষ ও বৃদ্ধি হয়। কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে এই চেতনার অর্থাৎ স্ত্রীজাতির দুর্দশায় সমাজে বেদনার অনুভূতির কোন লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায় না। মহারাজা রাজবল্লভ নিজের বিধবা কন্যার দুঃখে ব্যথিত হইয়া বিধবা-বিবাহের পুনঃপ্রচলনের চেষ্টা করিয়াছিলেন–এইরূপ ব্যক্তিগত প্রয়াসের দৃষ্টান্ত হয়ত আরও দুই একটি আছে। কিন্তু সাধারণভাবে হিন্দুসমাজে বহু শতাব্দীব্যাপী স্ত্রীলোকের দুরবস্থায় ব্যথিত হইয়া, ইহার প্রতিকারের চেষ্টা তো দূরের কথা, ইহার জন্য দুঃখ প্রকাশের কোন পরিচয়ও উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে পাওয়া যায় না। অথচ ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক হইতেই বাংলাভাষার মাধ্যমে এই বেদনাবোধ পুনঃপুনঃ প্রতিধ্বনিত হইয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গমহিলাদের দুঃখময় জীবনের একটি জীবন্ত চিত্রও ফুটিয়া উঠিয়াছে। পূর্বে উদ্ধৃত রামমোহনের উক্তির ন্যায় এ-বিষয়ে এইরূপ প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট প্রমাণ ইহার পূর্বে পাওয়া যায় না।
রামমোহন রায়ের এই লেখা প্রকাশিত হইবার দুই বৎসর পূর্বে ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। ইংরেজীশিক্ষায় শিক্ষিত ও পাশ্চাত্ত্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত এই কলেজের ছাত্রেরা এবং অন্যান্য অনেকেও স্ত্রীজাতির দুরবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হন এবং তাঁহাদের উন্নতিসাধনকল্পে অগ্রসর হন। পারিপার্শ্বিক প্রভাবে ও শিক্ষার ফলে স্ত্রীজাতির মনেও নিজেদের দুরবস্থা সম্বন্ধে তীব্র চেতনার সঞ্চার হয়। ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে ১৪ই মার্চ ‘সমাচার দর্পণ’ নামে প্রসিদ্ধ সংবাদপত্রে প্রকাশিত কাচিৎ শান্তিপুর নিবাসিনী’ স্বাক্ষরিত একখানি পত্রে ইহার পরিচয় পাওয়া যায়। এই পত্রের সারমর্ম নিম্নে দিতেছি :
“ইংরেজ রাজ্যের অনেক স্থলেই বিধবাদের পুনরায় বিবাহ হয়। কেবল বাঙ্গালীর মধ্যে কায়স্থ ও ব্রাহ্মণ কন্যা বিধবা হইলে পুনরায় বিবাহ হয় না এবং কুলীন ব্রাহ্মণের শুদ্ধ সমমেল না হইলে বিবাহ হয় না। যদি ঐ স্ত্রীলোকেরা উপপতি আশ্রয় করে তবে যে কুলোদ্ভবা সে কুল নষ্ট হয়। কিন্তু বিশিষ্ট কুলোদ্ভব মহাশয়েরা অনায়াসে বেশ্যালয়ে গমন পূৰ্ব্বক উপস্ত্রী লইয়া সম্ভোগ করেন তাহাতে কুল নষ্ট হয় না। বরং তাঁহারা মান্য হইয়া ধন্যবাদ পাইতেছেন। কেবল স্ত্রীলোকের নিমিত্ত সমন্বয়ের সৃষ্টি হইয়াছিল। বাঙ্গালা শাস্ত্রমতে এমত আছে যে অপ্রৌঢ়া বিধবা হইলে পুনরায় বিবাহ হইতে পারে। প্রাচীনকালে রাণীরা পতি অভাবে পুনঃ স্বয়ম্বরা হইয়াছেন এবং স্বামিসত্ত্বে অনায়াসে উপপতি লইয়া সম্ভোগ করিয়াছেন তাহাতে ধৰ্ম্ম বিরুদ্ধ হয় নাই। অদ্যাপিও তাঁহাদিগের নাম উচ্চারণে এবং স্মরণে পাপধ্বংস হয়। এইক্ষণে ঐ সকলে পুরুষদিগের ধর্মবিরুদ্ধ হয় না। কেবল স্ত্রীলোকের সুখ সম্ভোগ নিষেধার্থে কি ধৰ্ম্মশাস্ত্র ও পুরাণ তন্ত্র সৃজন হইয়াছিল? আমাদের বেশভূষা উত্তম আহাৰ্য্য দ্রব্য ও পতি সংসর্গ বর্জিতা হইয়া অসহ্য বিরহ বেদনায় বাহ্যজ্ঞান রহিত হইয়া কি নিমিত্ত কাল যাপন করিতে হয়? আমাদিগের ধর্মশাস্ত্রে এই যাতনা নিবারণের উপায় আছে। অতএব নিবেদন এই যে ধার্মিক রাজা ইংরেজ বাহাদুর অনুগ্রহ পূর্বক প্রাচীন শাস্ত্রানুসারে আইন করুন। কিম্বা বিশিষ্ট কুলোদ্ভব মহাশয়দিগের উপস্ত্রী সহিত সম্ভোগ রহিত করুন।”৬৯
এই পত্র প্রকাশিত হইবার এক সপ্তাহ পরে উক্ত পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় কুঁচুড়ানিবাসিনী স্ত্রীগণের একখানি পত্র প্রকাশিত হয়। ইহাতে তাহারা তাহাদিগের ‘পিত্রাদি ও ভ্রাতৃবর্গের’ উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ও আবেদন করিয়াছেন। তাহার সারমর্ম এই :
“১। সভ্যদেশীয় স্ত্রীগণের যেমন বিদ্যাধ্যয়ন হয় সেইরূপ আমাদিগের কেন হয় না?
২। অন্য দেশীয় স্ত্রীলোকেরা যেমন স্বচ্ছন্দে সকল লোকের সঙ্গে আলাপাদি করে আমাদিগকে তদ্রূপ করিতে দেন না কেন?
৩। বলদ ও অচেতন দ্রব্যাদির ন্যায় আমাদিগকে কি নিমিত্ত পরহস্তে দান করেন? আমরা কি নিজেরা বিবেচনাপূৰ্ব্বক স্বামী মনোনীত করিতে পারি না? আপনারা কুল, ধর্ম ও সম্ভম বজায় রাখিবার জন্য যাহাদের সঙ্গে আমাদের কখন কিছু জানা শোনা নাই এবং বিদ্যা বা রূপ ধনাদি কিছুই নাই এমত পোড়াকপালিয়াদের সঙ্গে কেবল ছাইর কুলের নিমিত্ত আমাদের বিবাহ দিতেছেন এবং ১০।১২ বৎসর বয়সে অজ্ঞানাবস্থায় আমাদিগকে দান করিতেছেন। সংসারের মধ্যে প্রবেশের এই কি উচিত সময়? ইহাতে কি কুফল হইতেছে তাহাও আপনারা বিলক্ষণ জ্ঞাত আছেন।
৪। আপনারা কেহ কেহ টাকা লইয়া আমাদিগকে বিবাহ দিতেছেন। তাহাতে যাহারা মূল্য অধিক ডাকেন তাঁহারাই আমাদের স্বামী হন এবং আমরা তাঁহাদের ক্রীত সম্পত্তির মধ্যে গণ্য হই।
৫। যাহাদের অনেক ভাৰ্য্যা আছে তাহাদের সঙ্গে কেন আমাদের বিবাহ দিতেছেন? যাঁহার অনেক ভাৰ্য্যা আছে তিনি প্রত্যেক ভাৰ্য্যা লইয়া সাংসারিক যেমন রীতি ও কর্তব্য তাহা কিরূপে করিতে পারেন?
৬। ভাৰ্য্যার মৃত্যুর পরে স্বামী পুনর্বিবাহ করিতে পারে। তবে কেন স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর পরে বিবাহ করিতে না পারে? পুরুষের যেমন বিবাহ করিতে অনুরাগ তেমন কি স্ত্রীর নাই? এই স্বাভাবিক বিরুদ্ধ নিয়মেতে কি দুষ্টতার দমন হয়?”৭০
এইরূপ আরও অনেক পত্র এবং তাহার উত্তর সমসাময়িক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। কেহ কেহ মনে করেন যে পূর্বোদ্ধৃত পত্র দুইখানি বাস্তবিক স্ত্রীলোকের লেখা নহে, কোন পুরুষ স্ত্রীলোকের নামে লিখিয়াছে। কিন্তু যাহারই লেখা হউক এই পত্রগুলি হইতে বেশ বুঝা যায় যে, স্ত্রীজাতির দুরবস্থা সম্বন্ধে বাঙ্গালী হিন্দুসমাজে বেদনাবোধ জাগিয়া উঠিয়াছে এবং এই নবজাগ্রত চেতনা স্ত্রী পুরুষ উভয়ের মনেই সাড়া জাগাইয়াছে। এই সময় হইতে স্ত্রীজাতির সর্ববিধ উন্নতির জন্য যে-আন্দোলনের পরিচয় পাওয়া যায় তাহা ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাড়িয়াই চলিয়াছে এবং ক্রমে ক্রমে সুফল প্রসব করিয়াছে। ইহার পূর্বে পাঁচ ছয়শত বৎসরের মধ্যে স্ত্রীজাতির দুরবস্থা সম্বন্ধে এরূপ বেদনাবোধ বা প্রতিকারের চেষ্টা হইয়াছে এরূপ কোন প্রমাণ নাই। যদিও প্রধানত পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রভাবেই ইহার সূত্রপাত হয়, তথাপি ইহাও স্মরণ রাখা উচিত যে একশ্রেণীর শাস্ত্রজ্ঞ বাঙ্গালী পণ্ডিতও কালধর্মের প্রভাবে সমাজসংস্কার বিষয়ে অগ্রণী হইয়াছিলেন। ইঁহাদের সমবেত চেষ্টায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আরম্ভ হইয়া বিগত একশত বৎসরে স্ত্রীজাতি দ্রুতবেগে উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছে। আধুনিক যুগে বাঙ্গালী তথা ভারতীয় নারীর যে মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা দেখিতে পাওয়া যায় তাহা সত্যই বিস্ময়কর ও অভাবনীয়। প্রধানত স্ত্রীলোকের শিক্ষাবিস্তারই এইরূপ অসাধ্য সাধন করিয়াছে। বংশপরম্পরাগত শত শত কুসংস্কারের ফলে স্ত্রীজাতির লেখাপড়া প্রায় লোপ পাইয়াছিল। কিরূপে ইহা ধীরে ধীরে বহু লোকের চেষ্টার ফলে আবার প্রসার লাভ করিয়াছে, প্রথমে তাহারই আলোচনা করিব।
(খ) স্ত্রীশিক্ষা
অষ্টাদশ শতকে কয়েকজন বিদুষী মহিলা থাকিলেও সাধারণ গৃহস্থের ঘরে যে মেয়েদের লেখাপড়ার প্রথা এরকম উঠিয়া গিয়াছিল-এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে তাহা বিবৃত হইয়াছে।
সরকারের আদেশে মি. অ্যাডাম (Adam) বাংলাদেশে সর্বত্র ঘুরিয়া প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে যে রিপোর্ট দেন[৭১] তাহা পাঠ করিলে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যায়। তখন মেয়েদের শিক্ষার জন্য কোন পাঠশালা ছিল না, দুই-চারিজন বাড়ীতে কিছু লেখাপড়া করিতেন। ইহার কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ বাংলাদেশের রাজধানী ছিল। কিন্তু, অ্যাডাম লিখিয়াছেন যে সমগ্র মুর্শিদাবাদ জিলায় মাত্র নয়টি স্ত্রীলোক বই পড়িতে ও কোনমতে নিজের নাম স্বাক্ষর করিতে পারিত। অন্য যেসব স্থানে তদন্ত করা হইয়াছিল সেখানে দুই একটি জমিদার পরিবার বা বৈষ্ণবের আখড়া প্রভৃতি ধর্মসম্প্রদায়ের বাহিরে কোনমতে লিখিতে বা পড়িতে পারে এমন একটি স্ত্রীলোকও ছিল না। ইহার প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ, অবরোধপ্রথা ও তৎকালে প্রচলিত একটি বদ্ধমূল সংস্কার যে স্ত্রীলোকেরা লেখাপড়া শিখিলে বিধবা হইবে। অবশ্য কলিকাতায় ও অন্যত্র সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কয়েকটি বিদুষী ছিলেন–কিন্তু তাঁহাদের সংখ্যা ছিল খুবই অল্প। ইহাদের মধ্যে মহারাজা সুখময় রায়ের পৌত্রী ও রাজা শিবচন্দ্র রায়ের কন্যা হরসুন্দরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি পাঁচ বৎসর বয়সে এক বৈষ্ণবীর নিকট অক্ষরশিক্ষা করেন এবং রাজবাটির এক প্রাচীন ব্রাহ্মণের নিকট সংস্কৃতশিক্ষা করেন। কিন্তু এ-সকলই গোপনে করিতে হইত। একদিন অন্তঃপুরে একাকিনী এক কক্ষে বসিয়া মৃদুস্বরে রামায়ণ পাঠ করিতেছিলেন এমন সময় তাঁহার পিতা হঠাৎ অন্তঃপুরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এ ঘরে পাঠ করে কে? রাজকন্যা ভীতা হইয়া গোপনীয় স্থানে গ্রন্থ রাখিয়া লজ্জিতভাবে পিতার সম্মুখে দাঁড়াইলেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কী লেখাপড়া শিখিয়াছ, কী কী পড়িয়াছ, আমার সাক্ষাতে বল, কোন ভয় নাই। রাজকন্যা সমুদয় বলিলে পিতা সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে বিশ হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ দিয়া বলিলেন, ইহার সুদ হইতে তুমি ইচ্ছামত গ্রন্থাদি ক্রয় করিবে। অতঃপর তাঁহার বিবাহ হইল। শ্বশুরবাড়ীতে প্রকাশ্যে গ্রন্থপাঠ করিতে পারিতেন না, কিন্তু গোপনে নানা পুস্তক পাঠ করিতেন। তাঁহার স্বামী ইন্দ্রিয়পরায়ণ লোকনাথ মল্লিক নিরক্ষর ছিলেন।৭২ এই কাহিনী হইতে সেকালে সম্ভ্রান্ত ঘরের কন্যাদেরও বিদ্যাভ্যাস কিরূপ দুরূহ ও আয়াসসাধ্য ছিল তাহা বুঝা যাইবে। এই প্রসঙ্গে দ্রবময়ী দেবীর নামও উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই বালবিধবা ব্রাহ্মণকন্যা পিতা চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের নিকট শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করিয়া, পিতা বৃদ্ধ হইলে তাঁহার টোলে ছাত্রদের পড়াইতেন।৭৩ কিন্তু এইরূপ দুই-একটি ব্যতিক্রম থাকিলেও সাধারণ গৃহস্থঘরের বালিকারা প্রায়ই নিরক্ষর ছিল।
বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের প্রথম চেষ্টা করেন খ্ৰীষ্টীয় মিশনারীরা। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহারা Calcutta Female Juvenile Society নামে একটি সমিতি স্থাপিত করিয়া এদেশীয় বালিকাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। প্রথম বছরে ৮০ জন এবং ছয় বছর পরে ছয়টি স্কুলে মোট ১৬০ জন ছাত্রী ছিল। কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়েরা এইসব বিদ্যালয়ে যাইত না। বাগদী, বৈরাগী, বেদে এবং গণিকাদের কন্যারাই পড়িত।
১৮২১ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ডের Foreign School Society কলিকাতা স্কুল সোসাইটির সাহায্যে এদেশে নারীদের শিক্ষার জন্য বিলাতে চাঁদা তুলিয়া মিস্ কুক নামে একজন শিক্ষয়িত্রী পাঠাইলেন।৭৪ এ-বিষয়ে আলোচনার জন্য কলিকাতা স্কুল সোসাইটির একটি সভা আহ্বান করিবার প্রস্তাব হইলে ইহার ভারতীয় সম্পাদক রাজা রাধাকান্ত দেব ইউরোপীয় সম্পাদককে লিখিলেন, “ভদ্র হিন্দু পরিবারেরা মিস্ কুকের স্কুলে মেয়ে পাঠাইবে না, তাঁহাকে নিজেদের বাড়ীতে যাইয়া মেয়েদের শিখাইবার অনুমতি দিবে না। সুতরাং এ-বিষয়ে আলোচনার জন্য সভা ডাকিবার প্রয়োজন নাই।” মেমদের স্কুলে পাঠাইবার দুইটি গুরুতর বাধা ছিল। খ্রীষ্টান ধর্মশিক্ষার ভয় এবং নীচজাতীয় ও গণিকার কন্যাদের সঙ্গে একত্রে পড়াশুনা করা।
এইসব বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও মিস্ কুকের যত্ন ও অধ্যবসায়ের ফলে প্রায় ৩০টি স্কুল স্থাপিত হইল, মোট ছাত্রীসংখ্যা ছিল ৬০০। অতঃপর আর ছোট ছোট স্কুলের সংখ্যা না-বাড়াইয়া একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইল। পূর্বোক্ত মহারাজা সুখময় রায়ের পুত্র বৈদ্যনাথ রায় ইহার জন্য বিশ হাজার টাকা চাঁদা দিলেন এবং ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে বড়লাটের পত্নী লেডী আমহার্স্ট এই বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করিলেন। এইরূপে মিশনারীরা বহু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিলেন, কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়েদের শিক্ষার বিশেষ প্রসার হইল না। তাহাদের কুসংস্কার দূর করার জন্য ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার “স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক” নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশিত করেন। দুই বৎসরের মধ্যেই ইহার দুই সংস্করণ নিঃশেষিত হয়। ১৮২৪ সনে প্রকাশিত ইহার তৃতীয় সংস্করণের গোড়ায় দুইটি বধূর কাল্পনিক কথোপকথন সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। ইহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।
“প্রথমা-ওগো এখন যে অনেক মেয়্যা মানুষ লেখা পড়া করিতে আরম্ভ করিল এ কেমন ধারা, কালে কালে কতই হবে–ইহা তোমার মনে কেমন লাগে?
দ্বিতীয়-তবে মন দিয়া শুন দিদি। সাহেবরা এই যে ব্যাপার আরম্ভ করিয়াছেন, ইহাতেই বুঝি এত কালের পর আমাদের কপাল ফিরিয়াছে, এমন জ্ঞান হয়।
প্র.-কেন গো। সে সকল পুরুষের কাজ। তাহাতে আমাদের ভাল মন্দ কি?
দ্বি-স্ত্রীলোকেরা লেখা পড়া করে নাই ইহাতেই তাহারা প্রায় পশুর মত অজ্ঞান থাকে। কেবল ঘর দ্বারের কাজ করিয়া কাল কাটায়।
প্র.- স্ত্রীলোকের ঘর দ্বারের কাজ, রাধা বাড়া, ছেলাপিলা প্রতিপালন না করিলে চলিবে কেন? তাহা কি পুরুষেরা করিবে?
দ্বি-না পুরুষেরা করিবে কেন, স্ত্রীলোকেরই করিতে হয়, কিন্তু লেখা পড়াতে যদি কিছু জ্ঞান হয় তবে ঘরের কাজ কৰ্ম্ম সারিয়া অবকাশ মত দুই দণ্ড লেখা পড়া নিয়া থাকিলে মন স্থির থাকে, এবং আপনার গণ্ডাও বুঝিয়া পড়িয়া নিতে পারে।
প্র.কিন্তু সেকালের স্ত্রীলোকেরা কহেন যে লেখা পড়া যদি স্ত্রীলোক করে তবে সে বিধবা হয়। যদি এটা সত্য হয় তবে মেনে আমি পড়িব না, কি জানি ভাঙ্গা কপাল যদি ভাঙ্গে।
দ্বি-না বইন; আমার ঠাকুরাণী দিদি ঠাই শুনিয়াছি যে কোন শাস্ত্রে এমত লেখা নাই যে মেয়ে মানুষ পড়িলে বিধবা হয়। কত স্ত্রীলোকের বিদ্যার কথা পুরাণে শুনিয়াছি-সংপ্রতি সাক্ষাতে দেখনা কেন, বিবিরা তো সাহেবের মত লেখা পড়া জানে, তাহারা কেন বিধবা হয় না।
প্র.-যদি দোষ নাই তবে এতদিন এদেশের মেয়্যা মানুষে কেন শিখে নাই? কন্যারা পাঠশালায় যায় না কেন?
দ্বি.-হেদে দেখে দিদি বাহির পানি তাকাইতে দেয় না। যদি ছোট ছোট কন্যারা বাটির বালকের লেখা পড়া দেখিয়া সাধ করিয়া কিছু শিখে ও পাত্তাড়ি হাতে করে তবে তাহার অখ্যাতি জগৎ বেড়ে হয়। সকলে কহে যে এই মদ্দা চেঁটি ছুঁড়ি বেটা ছেলের মত লেখা পড়া শিখে, এ হুঁড়ি বড় অসৎ হবে। এখনি এই, শেষে না জানি কি হবে। যে গাছ বাড়ে তাহার অঙ্কুরে জানা যায়।”
এই সুদীর্ঘ কথোপকথনের মধ্যদিয়া সেকালের চিত্র স্পষ্ট ফুটিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু আর বেশী উদ্ধৃত করা সম্ভব নহে। পরে এই দুইটি স্ত্রীলোক স্থির করিল যে পাড়ার যে সমুদয় নীচজাতীয় স্ত্রীলোকেরা পাঠশালায় যায় তাহাদের নিকট গোপনে অক্ষরপরিচয়ের ব্যবস্থা করিবে।
মিশনারীদের চেষ্টার ফলে যে বাংলার হিন্দুসমাজে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে খুব একটি সাড়া জাগিয়াছিল এবং ইহার বিরুদ্ধবাদী প্রাচীনপন্থীদের সঙ্গে ইহার সমর্থনকারী নব্য একদলের সংঘর্ষ বাধিয়াছিল, সমসাময়িক সংবাদপত্রে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। সমাচার দর্পণ, সমাচার চন্দ্রিকা প্রভৃতি পত্রিকায় এ-বিষয়ে খুব বাদানুবাদ হয়, তাহার একটু নমুনা দিতেছি।
১৮২২ সনে ৬ই এপ্রিল জনৈক লেখক স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে প্রাচীনকালের মৈত্রেয়ী, অনসূয়া, দ্রৌপদী, রুক্মিণী, চিত্রলেখা, লীলাবতী, কর্ণাট রাজ-স্ত্রী, লক্ষ্মণ সেনের স্ত্রী ও খনা ইত্যাদি এবং আধুনিককালের মহারাণী ভবানী, হটী বিদ্যালঙ্কার, শ্যামাসুন্দরী ব্রাহ্মণী প্রভৃতির নানা শাস্ত্র ও দর্শনবিদ্যাতে পারদর্শিতা উল্লেখ করিয়া স্ত্রীশিক্ষার উপযোগিতা এবং ইহাতে-যে কোন দোষ নাই তাহা প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন।
১৩ই এপ্রিল আর-একজন লেখকও কয়েকজন বিদুষী মহিলার উল্লেখ করিয়া পরে লিখিয়াছেন : “এখনও প্রত্যক্ষ দেখা যাইতেছে ইংলণ্ডীয় স্ত্রীগণের আনুকূল্যে কন্যাদিগের পাঠার্থে যে পাঠশালা হইয়াছে তাহাতে যে বালিকারা শিক্ষা করিতেছে তাহার মধ্যে কেহ এক বৎসরে কেহ দেড় বৎসরে লিখাপড়া শিখিয়াছে। তাহারা যে ভাষা পুস্তক কখন দেখে নাই তাহা অনায়াসে পাঠ করিতে পারে। ইহাতে বোধ হয় যে স্ত্রীলোক যদি বিদ্যাভ্যাস করে তবে অতি শীঘ্র জ্ঞানাপন্না হইতে পারে। অতএব যেমত গৃহকর্মাদি শিক্ষা করান সেমত বালককালে বিদ্যা শিক্ষা করান উচিত। যেহেতু স্ত্রীলোক অবীরা (অনাথা) হইলেও বার্তা বিদ্যা দ্বারা আপন ধন রক্ষা করিয়া কাল যাপন করিতে পারে, অন্যের অধীন হইতে হয় না এবং অন্যে ‘প্রতারণা করিতে পারে না।”
এবারে স্ত্রীশিক্ষা-বিরোধীদের উক্তিরও দুইটি নমুনা দিতেছি।
১৮৩১ সনে একজন লিখিয়াছেন :
“স্ত্রীলোকের লেখাপড়া করাওনের প্রয়োজন কি? যদি বল লিখন পঠন বিনা তাহাদের জ্ঞান জন্মিতে পারে না তাহার উত্তর এই–প্রথমতঃ এমন কোন পুরুষবর্জিত দেশ নাই, যেখানে পাটোয়ারিগিরি, মুহুরিগিরি, নাজীরী, জমিদারী ও আমীরী নারী বিনা সম্পন্ন না হওনের সম্ভাবনা আছে। দ্বিতীয়ত কেবল বাংলা ফলা বানান প্রভৃতি শিখিলেই যে পারমার্থিক ও নীতি ও পূৰ্ব্ববৃত্তান্ত অথবা অন্য লৌকিক জ্ঞান জন্মিবে এমন ভাবা পাগলের প্রলাপ মাত্র। যেহেতু বাংলা ভাষাতে এমন কোন গ্রন্থ নাই যাহাতে এই সমুদয় বিষয়ে জ্ঞান জন্মে।”
ইহার একমাস পরে আর-একজন লিখিয়াছেন : “দর্পণ প্রকাশক মহাশয় লেখেন যে মনুষ্য হইয়া অৰ্দ্ধাঙ্গ স্ত্রীকে যে পশুভাবে দেখা কোন ধৰ্ম্ম? উত্তর–ইহাই তাব বিশিষ্ট হিন্দু জাতির কুলধৰ্ম্ম। অপর লেখেন যে এখনকার রাণী ভবানী, হঠী বিদ্যালঙ্কার, শ্যামাসুন্দরী ব্রাহ্মণী ইহারাও দর্শন বিদ্যাতে অতি সুখ্যাতি পাইয়াছেন। উত্তর-শ্রুতি, স্মৃতি ও দর্শন অধ্যয়নে স্ত্রীজাতির আদৌ অধিকার নাই। উক্ত কয়েকজন বিপ্রকন্যার বিদ্যাবিষয়ের উপাখ্যান আমাদিগের কোন শাস্ত্রে লেখা নাই। তবে কি শুদ্ধ স্কুল বুক সোসাইটির গদ্য পদ্য রচিত পুস্তকের প্রমাণে হিন্দু বিশিষ্ট সন্তানেরা আপন কুলাঙ্গনাদের পাঠশালায় পাঠাইয়া বারাঙ্গনা করিবেন।” আর-একজন লিখিয়াছেন স্ত্রীলোকের বেদপাঠ নিষিদ্ধ করা হইয়াছে যেহেতু তাহারা শূদ্রতুল্য। ইহার উত্তরে একজন লিখিয়াছেন তবে তাঁহার স্ত্রীর অন্নভোজনে শূদ্ৰান্ন ভোজনের দোষ হয়। কেহ কেহ লিখিয়াছেন যে হিন্দু স্ত্রীলোকেরা যদি মেমদের মতন বিদ্যালয়ে যাইতে পারে তবে তাহাদের মতন একাধিকবার বিবাহও করিতে পারে। আবার কেহ কেহ লিখিয়াছেন মেয়েরা বিদ্যালয়ে গেলে দুশ্চরিত্রা হইবে এবং এমন অনেক উক্তি করিয়াছেন যাহা বর্তমান যুগে ইতর ও অশ্লীল বলিয়া গণ্য হইবে।৭৫
রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের প্রবল বিরোধিতাসত্ত্বেও ক্রমে ক্রমে কলিকাতায় ও মফঃস্বলে নানা স্থানে অনেক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেও যে বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন কিরূপ কষ্টকর ছিল তৎকালীন একটি বিখ্যাত ইংরেজী সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত নিম্নলিখিত বিবরণ হইতে তাহার কতকটা ধারণা করা যাইবে।
১৮৪৯ সনে কয়েকটি নব্যপন্থী নেতার চেষ্টায় বারাসতে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বহু আয়াসে তাঁহারা কয়েকটি ভদ্র গৃহস্থঘরের মেয়েদের ছাত্রীরূপে সংগ্রহ করিলেন। ইহাতে বিরোধীদল উত্তেজিত হইয়া এইসব ছাত্রীর অভিভাবকদের এবং বিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে নানারূপ মিথ্যা অভিযোগ আনিয়া অপদস্থ করিতে চেষ্টা করিল, প্রকাশ্য রাস্তায় তাহাদিগকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি এবং নানা উপায়ে উৎপীড়ন করিতে লাগিল। একদিন প্রাতে দেখা গেল স্কুল কমিটির এক সদস্যের বাড়ীর সম্মুখে রাতারাতি একটি প্রকাণ্ড নালা কাটিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু এইসব উৎপাত সহ্য করিয়াও স্কুলটি টিকিয়া ছিল। অন্যান্য স্থানেও বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাগণকে বহু নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল।৭৬
বাংলার আধুনিক যুগের সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্রস্থল কলিকাতার অনতিদূরবর্তী বারাসত শহরের এই কাহিনী হইতে সহজেই বুঝা যায় যে সুদূর মফঃস্বলে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কিরূপ দুরূহ ব্যাপার ছিল।
এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের এ-বিষয়ে ঔদাসীন্যের উল্লেখ করা আবশ্যক। ১৮৫৮ সনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তদানীন্তন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যাঁলিডে সাহেবের মত লইয়া বর্ধমান, হুগলী প্রভৃতি স্থানে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। হ্যাঁলিডে সাহেব পূর্বে এ-বিষয়ে বড়লাটের মত গ্রহণ করেন নাই, এই অজুহাতে মাসিক মাত্র সহস্র মুদ্রা ব্যয় বড়লাট নামঞ্জুর করিলেন। কিন্তু পরে তিনি ইহার অনুমোদন করিলেও ইংলণ্ডের কর্তৃপক্ষ এই সামান্য ব্যয় অনুমোদন করিলেন না।৭৭
এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের অনেকগুলি বিঘ্ন ছিল। ইহা সত্ত্বেও জনমত ক্রমশঃ ইহার অনুকূল হইয়া উঠিয়াছিল। সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় এ-সম্বন্ধে বহু মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে। ১২৭২ সনের ১৭ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছিঃ
“স্ত্রী-শিক্ষার বান্ধবগণ সৰ্ব্বদা আমাদিগকে এ বিষয়ে স্বদেশীয়দিগের চিত্তকে আকর্ষণ করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়া থাকেন। সেই অনুরোধ বশবর্তী হইয়া অদ্য এবিষয়ে আমাদিগকে হস্তক্ষেপ করিতে হইতেছে। এ দেশের অবলাগণ বিদ্যাশিক্ষা করিলে যে যে বিষয়ে উন্নতি হয় এবং তাহার অভাবে যে কত অপকার হইতেছে তাহা একাল পর্যন্ত অনেকে বর্ণনা করিতে ত্রুটি করেন নাই। অতএব ঐ পুরাতন বিষয়ের আন্দোলন করা বিফল। তবে এই মাত্র বলিলেই পৰ্য্যাপ্ত হইবে যে বালীরাজা একশত মূর্খ লইয়া স্বর্গ গমন কষ্টকর বিবেচনা করিয়াছিলেন। আমরা স্ত্রী কন্যা প্রভৃতি সহস্র সহস্র মূর্খ বেষ্টিত হইয়া যে এই মর্ত্যলোকে সুখী হইব ইহা কোন ক্রমেই সম্ভাবিত নহে। ইহার কিছুদিন পূর্বে স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষা দূর থাকুক, তাহার নামোল্লেখ করিলেও নিস্তার থাকিত না। এক্ষণে তাহার বহু বিপৰ্যয় হইয়াছে।
“স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষার নিমিত্ত এখন অনেক কৃতবিদ্য ব্যক্তি যত্ন পাইতেছেন, কিন্তু যে কয়েকটি প্রতিবন্ধক থাকাতে তাঁহারা আশানুরূপ ফলোভে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিতেছেন না, তাহা নিম্নে লিখিত হইতেছে।
১। এ দেশের পুরুষেরা অদ্যাপিও ভাল করিয়া লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই। সুতরাং যাঁহারা এদেশীয় অবলাগণের হর্তাকর্তা বিধাতা ও (?) তাঁহারা যখন স্বয়ং সিদ্ধ হইতে পারিলেন না, তখন অন্যকে কেমন করিয়া সিদ্ধ করিবেন?
২। বাল্য বিবাহ প্রচলিত থাকাতে বালিকারা অধিক দিন বিদ্যালয়ে থাকিয়া শিক্ষা পায় না। সুতরাং অল্পবিদ্যা সবিশেষ ফলোপধায়িনী হয় না।
৩। অল্প বেতনের লোকদ্বারা শিক্ষাকার্য সুন্দররূপে সম্পন্ন হয় না, দুর্ভাগা বালিকাগণের অদৃষ্টে প্রায় তাহাই ঘটিয়া থাকে। ইহা সামান্য প্রতিবন্ধক নয়।
৪। অল্পমাত্র শিখিতে শিখিতে বালিকাদিগকে শ্বশুরালয়ে গমন করিতে হয়। সেখানে গিয়া গৃহকাৰ্য্যে এমনি ব্যাপৃত হইতে হয় যে পূৰ্ব্বে যে কিছু শিক্ষালাভ হয় তাহা বিস্মৃতিসাগরে মগ্ন হইয়া যায়। বিশেষতঃ এদেশে জাত্যভিমান ও বিবাহ প্রণালীগত দোষ থাকাতে প্রায় অনেকেই উপযুক্ত পাত্রের হস্তগত হয় না, সুতরাং তৎকালে আলোচনার অভাবে তাহার বিবাহের পূর্বে যে যৎকিঞ্চিৎ শিক্ষা হয়, তাহা বৃথা হইয়া যায়।”৭৮
বাল্যববিবাহ ও অবরোধ প্রথা ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত স্ত্রীশিক্ষার প্রধান অন্তরায় ছিল। কিন্তু অন্যান্য বিঘ্ন দূর করিবার চেষ্টা করা হইয়াছিল। উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রীর অভাব দূর করিবার উদ্দেশ্যে স্ত্রী-শিক্ষিকা প্রস্তুত করিবার জন্য স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। মিস্ মেরী কার্পেন্টার ১৮৬৬ সনে কলিকাতায় আসেন এবং প্রধানত তাঁহারই চেষ্টায় গভর্নমেন্ট ইহার ব্যবস্থা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথমে এই প্রস্তাব সমর্থন করিলেও ইহা যে কার্যকর হইবে তাহার আশঙ্কা করিয়া বাংলার ছোটলাটকে নিম্নলিখিত পত্রখানি লেখেন :
“আমাদের দেশের হিন্দু সমাজের গ্রহণযোগ্য একদল দেশীয় শিক্ষয়িত্রী প্রস্তুত করিবার জন্য মিস্ কার্পেন্টারের প্রস্তাব কার্যে পরিণত করা কঠিন। এ দেশের ভদ্র পরিবারের হিন্দুরা যখন অবরোধপ্রথার গোঁড়ামির জন্য দশ এগার বছরের বিবাহিত বালিকাদেরই গৃহের বাহিরে যাইতে দেয় না, তখন তাহারা যে বয়স্কা মহিলাদের শিক্ষায়িত্রীর কাজ গ্রহণ করিতে সম্মতি দিবে এ আশা দুরাশা মাত্র। বাকী থাকে অনাথা বিধবারা–কিন্তু আমি নিঃসন্দেহে বলিতে পারি যে তাহারা যদি অন্তঃপুর ছাড়িয়া বাহিরে সাধারণ শিক্ষয়িত্রীর কাজ করে তাহা হইলে লোকের কাছে অবিশ্বাসের পাত্রী হইয়া উঠিবে এবং তাহার ফলে এই প্রতিষ্ঠানের সমস্ত মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইবে।
“মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্ত্রী-শিক্ষয়িত্রী যে কত আবশ্যক ও অভিপ্রেত তাহা আমি বিশেষভাবে জানি। দেশবাসীর দৃঢ়মূল সামাজিক কুসংস্কার যদি দুর্লঙ্ বাধা হইয়া না দাঁড়াইত তাহা হইলে সকলের আগে আমি ইহা কাৰ্য্যে পরিণত করিবার জন্য সহযোগিতা করিতে কুণ্ঠিত হইতাম না। কিন্তু যে কাৰ্য্যে সফলতার কোন সম্ভাবনা নাই তাহা আমি নিজেও যেমন সমর্থন করি না তেমনি সরকারকেও তাহা করিতে পরামর্শ দিতে পারি না।”৭৯
বিদ্যাসাগরের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হইল। তিন বৎসর পূর্ণ হইবার পূর্বেই নাল স্কুল বন্ধ হইয়া গেল।
অবরোধ প্রথার বাধা দূর করিবার নিমিত্ত প্রধানত মিশনারিগণের চেষ্টায় ‘অন্ত ওপুর শিক্ষা প্রণালীর’ প্রবর্তন হইয়াছিল।
সোমপ্রকাশের সম্পাদক লিখিয়াছেন (১২৭৫, ৬ আশ্বিন) :
“বঙ্গদেশের অন্তঃপুরের স্ত্রীগণ আজিকালি যে শিক্ষানুরাগী হইয়াছেন, মিসনরিদিগের যত্নই তাহার প্রথম কারণ। আমরা প্রায়ই দেখিতে পাই, কয়েকজন খৃষ্টধর্মাবলম্বিনী রমণী এদেশের অন্তঃপুরস্থিত স্ত্রীলোকদিগের শিক্ষার নিমিত্ত কয়েক বৎসরকাল বিলক্ষণ পরিশ্রম করিতেছেন। তার কি ফল ফলিল, বোধ হয় পাঠকগণ তদ্বৃত্তান্ত অবগত হইবার নিমিত্ত একান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইবেন সন্দেহ নাই। মৃত বিবি মলেন্স প্রথমতঃ আমাদিগের বর্তমান অন্তঃপুর শিক্ষা প্রণালীর উদ্ভাবন করেন। তাহার পর বিবি মরে নামে এক গুণবতী মিসনরিপত্নী এই প্রণালীর অনুসরণে প্রবৃত্ত হন। বিবি মরে কতগুলি ইউরোপীয় ও এতদ্দেশীয় খৃষ্টীয়ান শিক্ষয়িত্রীকে স্থানে স্থানে প্রেরণ করেন, তাঁহারা লিখন পঠন ও সূচির কাজের শিক্ষা দিতেন। বিবি মরে সকলের তত্ত্বাবধান করিতেন। ঐ গুণবতী রমণী ইংলণ্ডে গমন করিলে পর তাঁহার বিদ্যালয় সকল মিস ব্রিটনের হস্তে পতিত হয়। ইনি আমেরিকাবাসিনী। ডাক্তার জারবোর সাহায্যে তিনি অন্তঃপুরে শিক্ষাকার্য্যের ভার গ্রহণ করেন। তাঁহার অধীনে ১৭ জন ইউরোপীয় এবং ১৩ জন এতদ্দেশীয় শিক্ষয়িত্রী আছেন।…
“যাহারা শিক্ষা করিবার অভিলাষী হন, তাহাদিগের বাটীতে এক একজন এতদ্দেশীয় খৃষ্টীয়ান শিক্ষয়িত্ৰী প্রেরিত হইয়া থাকেন। আপাততঃ সামান্য সাহিত্য পুস্তক, অঙ্ক ও বিদ্যাসাগরের বঙ্গদেশীয় ইতিহাস পাঠ করান হয়। ছাত্রীগণ সূচির কাজও শিক্ষা করেন। প্রতি সপ্তাহে একজন ইউরোপীয় শিক্ষয়িত্রী ছাত্রীদিগের উন্নতির পরীক্ষা করেন। মিস ব্রিটন নিজে মধ্যে মধ্যে গিয়া সকল বিষয় স্বচক্ষে দর্শন করিয়া থাকেন। ছাত্রীরা প্রায় ২ টাকার অধিক বেতন দেন না। যেখানে ইংরেজী শিক্ষা হয় তথায় ৪ টাকাই উৰ্দ্ধসংখ্যা বেতন। বিধবাদিগের নিকটে এক পয়সাও লওয়া হয় না, বরং অনেকে মিস্ ব্রিটনের নিকটে সাহায্য পান। তিনি বিধবাদিগকে নিজের বাটীতে আসিয়া সঙ্গীত ও অন্য অন্য বিষয় শিক্ষা দিবার চেষ্টা পাইয়াছিলেন তাহাতে কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। এই প্রকারে প্রায় ৮০০ শত এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোক ও বালিকা মিস্ ব্রিটনের যত্নে শিক্ষা লাভ করিতেছে। গবর্নমেন্ট প্রতি ছাত্রীকে একটাকা সাহায্য দান করেন। আমেরিকার মিসনরিরা মাসিক ১২০০ টাকা দিয়া থাকেন; কিন্তু যে ব্যয় হয় তাহাতে শিক্ষয়িত্রী ও মিস ব্রিটনকে নিজে অতি সামান্য অবস্থায় অবস্থান করিয়া কালহরণ করিতে হয়। …
“মিস্ ব্রিটনের বিদ্যালয় সকলে সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক ছাত্রী আছেন। ডাক্তার, রবসনের স্ত্রী প্রায় ১৫০ স্ত্রীলোক ও বালিকাকে শিক্ষা দিতেছেন; কিন্তু বিবি রবসনের শিক্ষয়িত্রীগণ ইউরোপীয় বলিয়া অনেকে উচ্চ বেতনের ভয়ে তাঁহাদিগকে লইয়া যাইতে পারেন না।…
“তৃতীয় মিসন মুজাপুরের মিস্ নিকলসনের অধীনস্থ। এ মিসনে বিস্তর এতদ্দেশীয় শিক্ষয়িত্ৰী আছেন। উহাদিগের সুশিক্ষা ও সচ্চরিত্রতা নিবন্ধন অনেক উপকার হইতেছে। বিবি লুইস নিজের ব্যয়ে প্রায় ১৫০ ছাত্রীকে শিক্ষা দিতেছেন।
“এই প্রকারে বিনা আড়ম্বরে কতকগুলি খৃষ্টীয়ান স্ত্রীলোক আমাদিগের অন্তঃপুরের বিশেষ শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিতেছেন।৮০
কিন্তু এই ব্যবস্থায় যে সুফল হয় নাই তাহার প্রধান কারণ পূর্বোক্ত সম্পাদকের নিম্নলিখিত মন্তব্যগুলি পড়িলে বুঝা যাইবে।
“বিবি রবসন ভিন্ন আর সকল শিক্ষয়িত্রীই খৃষ্টধর্ম পুস্তক পাঠ করা শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ বলিয়া জ্ঞান করেন এবং মিস্ ব্রিটন প্রভৃতি নিজেই বলেন, খৃষ্টীয়ান করাই তাঁহাদিগের প্রধান উদ্দেশ্য। তাহাদের স্বধর্মের প্রতি যে এত ভক্তি তন্নিমিত্ত তাঁহারা প্রশংসনীয় হইবেক, সন্দেহ নাই; কিন্তু এতন্নিবন্ধন তাঁহাদিগের শিক্ষাদান কাৰ্যটী সম্পূর্ণ ফলোপধায়ী হইতেছে না।”৮১
প্রায় ষোল বছর পরে, এ-সম্বন্ধে সোমপ্রকাশের ১৭ বৈশাখ, ১২৯১ সংখ্যায় লিখিত হইয়াছে :
“এই দূষিত অন্তঃপুর শিক্ষা দিবার প্রথা প্রবর্তিত হওয়াতে যে কয়েকটী বিষময় ফল ফলিয়াছে তদ্বারা তাহার পরিণাম অনুমিত হইতেছে। মিশনরিগণ অন্ত :পুরে আপনাদিগের রমণীগণকে প্রেরণ করিয়া খৃষ্টীয় ধর্ম প্রচারের সদুপায় করিয়াছেন, কতকগুলি কুলবধূ ও কুলকন্যাকেও গৃহ হইতে লইয়া গিয়া আপনাদের দলে নিবিষ্ট করিয়াছেন। তাহারা ইহাতেও সন্তুষ্ট নহেন, সমুদয় হিন্দুসমাজ যীশুমন্ত্রে দীক্ষিত হন, ইহাই তাহাদিগের মুখ্য অভিপ্রায়। এই অভিপ্রায় সাধন জন্য তাঁহারা বিবিধ উপায় চিন্তা করিতেছেন।৮২
“হিন্দু সংসারে এপ্রকার বিকৃত সংঘটন হইতে দেওয়া কোন দেশহিতৈষী ব্যক্তির উচিত নহে। প্রায় ৩০ বৎসর হইল, এইরূপ অন্তঃপুর শিক্ষা-প্রণালী, এতদ্দেশে প্রবর্তিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে কতগুলি কুলবধূ ও কুলকন্যা জাতীয় ধর্ম ও আচার ব্যবহার পরিত্যাগ করিয়া মিশনরিদলে প্রবিষ্ট হইয়াছেন, তাহা কে গণনা করিয়া দেখিয়াছেন? হিন্দু পরিবারের মধ্যে এরূপ ঘটিবার মূল কারণ, খ্রীষ্ট মিশনরিদিগের অন্তঃপুর শিক্ষাদান।”৮৩
স্ত্রীলোকের বাল্যবিবাহ, অবরোধপ্রথা, এবং উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রীর অভাব ব্যতীত স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে পুরুষের ঔদাসীন্য ছিল স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের আর-একটি গুরুতর বাধা। নবপ্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ, বিশেষতঃ ইহার যুবক সভ্যদল ও তাহাদের নেতা কেশবচন্দ্র সেন এই চারিটি বাধাই দূর করিবার চেষ্টা করেন, এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রসার বিষয়ে বিশেষ সাহায্য করেন। অবরোধপ্রথা সে-যুগে কতদূর কঠোর ছিল ও কেশবচন্দ্র সেন কিরূপ দৃঢ়তার সহিত ইহা দূর করিয়া এ-বিষয়ে পথপ্রদর্শক হইয়াছিলেন, নিম্নলিখিত ঘটনা হইতে সে-বিষয়ে কিছু ধারণা করা যাইবে।
ব্রাহ্মসমাজ অবরোধপ্রথার বিরোধী হইলেও প্রগতিশীল যুবক ব্রাহ্মেরা পর্যন্ত স্ত্রী বা পরিবারের মহিলাদের লইয়া প্রকাশ্য রাজপথে বাহির হইতেন না, বা সভা সমিতিতে যোগদান করিতেন না। কেশবচন্দ্র সেন এই সমাজের আচার্য পদে নিযুক্ত হইলে এই পদে অভিষেকের উৎসবে সস্ত্রীক জোড়াসাঁকোয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গৃহে যাইবেন এরূপ মনস্থ করেন। কিন্তু তাঁহার পিতৃব্য ও অন্যান্য বহু আত্মীয়-স্বজন ইহাতে বাধা দানে কৃতসঙ্কল্প হইয়া বাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া ভোজপুরী দরওয়ান ও অন্যান্য ভৃত্যকে বাধা দিবার জন্য নিযুক্ত করিলেন এবং নিজেরা সকলে সমবেত হইলেন। কেশবচন্দ্র স্থানীয় পুলিশ ইনস্পেক্টরকে সাহায্য করিবার জন্য চিঠি লিখিয়াছিলেন। কিন্তু পুলিশ আসিবার পূর্বেই ধীর পদক্ষেপে, দৃঢ়চিত্তে পঞ্চদশ বর্ষীয় অবগুণ্ঠিতা স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া আত্মীয়-স্বজনের ব্যুহ ভেদ করিয়া দরজার নিকটে আসিলেন এবং দরজার হুড়কা খুলিতে আদেশ দিলেন। দরজা খুলিয়া গেল, কেশবন্দ্র সস্ত্রীক জোড়াসাঁকোর উৎসবে যোগদান করিলেন। কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যার পূর্বেই তিনি সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের স্বাক্ষরিত এক পত্র পাইলেন যে, কলুটোলার যে পৈতৃক ভবন হইতে তিনি সকালে যাত্রা করিয়াছিলেন সেখানে আর তাঁহার স্থান হইবে না। এই বিপদে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার নিজ ভবনে কেশবচন্দ্রকে আশ্রয় দিলেন, কেশবচন্দ্রও দীর্ঘকাল তথায় ছিলেন।৮৪ এই ঘটনার তারিখ-১৮৬২ সনের ১৩ই এপ্রিল-বাংলার অবরোধপ্রথা দূরীকরণের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্মরণীয় দিন।
এই ঘটনার পূর্ব হইতে কেশবচন্দ্র ও তাঁহার সহযোগী নব্য যুবক ব্রাহ্মদল নিজ নিজ স্ত্রীকে শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। অন্যান্য উপায়েও কেশবচন্দ্র স্ত্রীজাতির উন্নতিবিধানে যত্নবান ছিলেন। ১৮৭২ সনে বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি একটি স্ত্রী-শিক্ষয়িত্রী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিলেন এবং সরকারী সাহায্য পাইলেন। ইহাতে স্ত্রীশিক্ষার অনেক উন্নতি হইল। কেশবচন্দ্র নিজে, ধর্মজগতে প্রসিদ্ধ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী ও আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এই বিদ্যালয়ের কার্যে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। বিদ্যালয়ের ছাত্রীগণ ‘বামাহিতৈষিণী সভা’ প্রতিষ্ঠিত করেন। সমাজের অনেক গণ্যমান্য মহিলারাও ইহাতে যোগদান করিয়া নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কিরূপে তাহারা কন্যা, গৃহিণী ও মাতার উচ্চ আদর্শ পালন করিতে পারে তাহার আলোচনা করিতেন। এই সময়ে ‘অন্তঃপুর স্ত্রী-শিক্ষা’ নামে আর-একটি সভা স্থাপিত হয়। ইহার প্রচেষ্টায় অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রীলোকের, অর্থাৎ বালিকা, বধূ, প্রবীণা, সকলের শিক্ষাদান ও পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়। প্রশ্নপত্র পাঠাইয়া দেওয়া হইত ও ঢাকা, রাজসাহী, পাবনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থান হইতে ছাত্রীরা উত্তরপত্র পাঠাইত। পরীক্ষার ফল অনুসারে তাহাদিগকে পুরস্কার দেওয়া হইত।
এইরূপ নানাভাবে চেষ্টা হইলেও, প্রধানতঃ সাধারণ বালিকা বিদ্যালয়ের মাধ্যমেই যে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার হইয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এ বিষয়েও যে খ্ৰীষ্টীয় মিশনারীরাই প্রথম পথপ্রদর্শক তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যে বহু বাধাবিপত্তিসত্ত্বেও এদেশীয় লোকেরা নানা স্থানে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল তাহারও উল্লেখ করা হইয়াছে।
১৮৪৯ সনের ৭ই মে তারিখে বেথুন সাহেব (J.E. D. Bethune) কর্তৃক Hindu Female School বা হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। ইহাই বেথুন কলেজ নামে অদ্যবধি স্ত্রীশিক্ষার একটি প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান বলিয়া পরিগণিত এবং শতাধিক বৎসর যাবৎ স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে বিশেষ সহায়তা করিয়া আসিতেছে। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিন ইহাকে স্বাগত-সম্ভাষণ জানাইয়া সংবাদ প্রভাকর যে উচ্ছ্বাসপূর্ণ বিস্তৃত মন্তব্য করিয়াছিল তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।
“অদ্যকার প্রভাত অতি সুপ্রভাত…
“ভারতবর্ষের ব্যবস্থাপক তথা বিদ্যাধ্যাপনীয় সমাজের অধিপতি করুণাময় ড্রিঙ্কওয়াটর বেথিউনি সাহেব বাঙ্গালি জাতির বালিকা বর্গের বঙ্গভাষার অনুশীলন নিমিত্ত বিপুল বিত্ত ব্যয় ব্যসন পূৰ্ব্বক “বিক্টরিয়া বাঙ্গালা বিদ্যালয়” নামক এক অভিনব স্ত্রী বিদ্যার স্থাপন করিয়াছেন, অদ্য প্রাতে তাহার কৰ্ম্মারম্ভ হইবেক, আপাততঃ সিমূলার অন্তঃপাতি সুকিএস্ স্ট্রীট মধ্যে দয়ার্দ্রচিত্ত বাবু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বৈঠকখানা বাটীতে কৰ্ম্ম সম্পন্ন হইবেক, পরে তাহার জন্য স্বতন্ত্র স্থানে এক স্বতন্ত্র বাটী নিৰ্মাণ করা যাইবেক, এই স্থলে স্থাপন কৰ্ত্তার কথাইতো নাই, তাঁহাকে এদেশের মহোপকারী অদ্বিতীয় বন্ধু বলিয়া বাচ্য করিতে হইবেক, যেহেতু দেশীয় ভ্রাতারা চিরদুঃখিনী আশ্রিতা সহোদরাদিগের প্রতি যে এক অতি প্রয়োজনীয় সদ্ব্যবহার করণে অদ্যাপি ভ্রান্ত হইয়াছিলেন, সাহেব ভিন্ন। দেশীয় মনুষ্য হইয়া তাহারদিগকে কন্যার ন্যায় জ্ঞান করত পিতার ন্যায় স্নেহ পূৰ্ব্বক সেই সদ্ব্যবহার দ্বারা তদ্দিগের অজ্ঞানাবস্থা দূরীকরণার্থ এক বলবৎ উপায় করিতেছেন, সুতরাং এতদ্বিষয়ে এতদ্দেশীয় স্থিরদর্শি মানুষ মাত্রকেই চিরকাল কৃতজ্ঞতার সহিত তাঁহার সদ্গুণ সমূহ স্মরণ করিতে হইবেক, কিন্তু শ্রীমান্ দক্ষিণারঞ্জন বাবুর বদান্যতা এবং সগুণের বিষয় এইক্ষণে বাক্যদ্বারা ব্যাখ্যা হইতে পারে না, ঐ মহাশয় কিছুদিনের জন্য পাঠশালার কৰ্ম্ম নিৰ্বাহ নিমিত্ত বিনা বেতনে বাটী দিয়াছেন এবং নূতন বাটী নিৰ্মাণার্থে এক কালী ৮০০০ অষ্ট সহস্র মুদ্রা দান করিয়াছেন, আর সময়ানুসারে সাধ্যমত আনুকূল্য করণে অঙ্গীকার করিয়াছেন।”৮৫
ইহার দুইদিন পরে উক্ত পত্রিকায় লিখিত হইল, শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এককালীন ৮০০০ টাকা দান ছাড়াও দশহাজার টাকা মূল্যের সম্পত্তি উক্ত বিদ্যালয়ের সাহায্যে দিয়াছেন এবং ইহার পরেও যাহা দান করিবেন তাহার মূল্য ততোধিক হইবেক।৮৬
এই স্কুলের কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে ১২৬৩ সনের ১লা মাঘ নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রকাশিত হয় :
“কলিকাতা ও তৎসান্নিধ্যবাসী হিন্দুবর্গের প্রতি বিজ্ঞাপন।
“বীটন প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয় সংক্রান্ত সমুদায় কার্যের তত্ত্বাবধান। করিবার নিমিত্ত গভর্নমেন্ট আমাদিগকে কমিটি নিযুক্ত করিয়াছেন। যে নিয়মে বিদ্যালয়ের কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন হয় এবং বালিকাদিগের বয়স ও অবস্থার অনুরূপ শিক্ষা দিবার যে সকল উপায় নির্ধারিত আছে, হিন্দু সমাজের লোকদিগের অবগতি নিমিত্ত, আমরা সে সমুদায় নিম্নে নির্দেশ করিতেছি।
“উক্ত বিদ্যালয় এই কমিটির অধীন। বালিকাদিগকে শিক্ষা দিবার নিমিত্ত এক বিবি প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত আছেন। শিক্ষাকাৰ্যে তাঁহার সহকারিতা করিবার নিমিত্ত আর দুই বিবি ও একজন পণ্ডিতও নিযুক্ত আছেন।”
“বালিকারা যখন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকে, প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ সভাপতির স্পষ্ট অনুমতি ব্যতিরেকে, নিযুক্ত পণ্ডিত ভিন্ন অন্য কোন পুরুষ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিতে পান না।
“ভদ্র জাতি ও ভদ্র বংশের বালিকারা এই বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে পারে, তদ্ব্যতীত আর কেহই পারে না। যাবৎ কমিটির অধ্যক্ষদের প্রতীতি না জন্মে অমুক বালিকা সদ্বংশজাত, এবং যাবৎ তাঁহারা নিযুক্ত করিবার অনুমতি না দেন, তাবৎ কোন বালিকাই ছাত্রীরূপে পরিগৃহীত হয় না।
“পুস্তক পাঠ, হাতের লেখা, পাটিগণিত, পদার্থবিজ্ঞান, ভূগোল ও সূচীকৰ্ম্ম, এই সকল বিষয়ে বালিকারা শিক্ষা পাইয়া থাকে। সকল বালিকাই বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা করে। আর যাহাদের কর্তৃপক্ষীয়েরা ইঙ্গরেজী শিখাইতে ইচ্ছা করেন তাহারা ইঙ্গরেজীও শিখে।
“বালিকাদিগকে বিনা বেতনে শিক্ষা ও বিনা মূল্যে পুস্তক দেওয়া গিয়া থাকে, আর যাহাদের দূরে বাড়ী এবং স্বয়ং গাড়ী অথবা পাল্কী করিয়া আসিতে অসমর্থ, তাহাদিগকে বিদ্যালয়ে আনিবার ও বিদ্যালয় হইতে লইয়া যাইবার নিমিত্ত গাড়ী ও পাল্কী নিযুক্ত আছে।”৮৭
কিন্তু এই সকল সতর্কতা সত্ত্বেও এই বিদ্যালয়টিকে বহু বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হইতে হইলেও নানা বিপত্তির ভিতর দিয়া ক্রমে ক্রমে তাহা গড়িয়া উঠিয়াছিল। যাহাতে সম্ভ্রান্ত ঘরের কন্যারা এই হিন্দু বালিকা-বিদ্যালয়ে যোগদান করিতে পারে সেইজন্য প্রথম হইতেই কয়েকটি বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইয়াছিল। ভর্তি করার পূর্বে ছাত্রীদের কুলশীলের পরিচয় নেওয়া হইত। বাটী হইতে মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার জন্যে ঘোড়ার গাড়ীর বন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। এরূপ নিয়ম করা হইয়াছিল, যে-পর্যন্ত মেয়েরা বিদ্যালয়ে থাকিবে সে-পর্যন্ত কোন পুরুষ তথায় যাইতে পারিবে না, এবং বিদ্যালয়ে খ্রীষ্টধর্মের কোন প্রসঙ্গ আলোচনা করা হইবে না। এই সমুদয় ব্যবস্থাসত্ত্বেও রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি অনুরাগী ছিল না বরং ইহার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হয়। প্রথমে ছাত্রীসংখ্যা ৬০টির বেশী হয় নাই। বেথুন সাহেবের মৃত্যুতে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যয়নির্বাহ কষ্টকর হইলে বড়লাটের পত্নী লেডী ডালহৌসী ইহার ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর ডালহৌসী ইহার খরচ দেন। তাঁহার সুপারিশে তাঁহার পদত্যাগের পরে ইহা সরকারী বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
বেথুন স্কুলের সফলতার মূলে যে কয়জন বাঙ্গালী ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরই বেথুন সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাসাগর অবৈতনিক সম্পাদকরূপে ইহার পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রভৃতি প্রগতিশীল ইয়ং বেঙ্গল দলের নেতারাও বেথুনকে খুব সাহায্য করিয়াছিলেন। প্রথম যে ২১ জন ছাত্রী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তাঁহাদের মধ্যে মদনমোহনের দুই কন্যা ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গল দল, ব্রাহ্মসমাজ ও ইংরেজীশিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ন্যায় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতও বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান সমর্থন করিয়াছিলেন।৮৮
১৮৬২ সনের ১৫ই ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুল সম্বন্ধে যে রিপোর্ট পাঠান তাহার সামান্য একটু অংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“স্কুলের শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লিখন-পঠন, পাটীগণিত, জীবন-চরিত, ভূগোল, বাংলার ইতিহাস, নানা বিষয়ে মৌখিক পাঠ এবং সেলাইয়ের কাজ। বাংলা ভাষাতেই ছাত্রীদের শিক্ষা দেওয়া হয়। একজন প্রধান শিক্ষয়িত্রী, দুইজন সহকারী শিক্ষয়িত্রী এবং দুইজন পণ্ডিত এই বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করেন। ১৮৫৯ সাল হইতে বিদ্যালয়ের ছাত্রীসংখ্যা যেভাবে বাড়িয়া চলিয়াছে তাহাতে কমিটি মনে করেন, যাহাদের উপকারের জন্য বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল সমাজের সেই শ্রেণীর লোকের কাছে ইহার সমাদর ক্রমশই বাড়িয়া চলিয়াছে।”৮৯
কিন্তু এই আশা ফলবতী হয় নাই। স্ত্রীশিক্ষার প্রসার খুব ধীরে ধীরেই অগ্রসর হইয়াছিল। ইহার প্রধান কারণ অবরোধ প্রথা, বাল্যবিবাহ এবং সর্বোপরি সাধারণ শিক্ষিত বাঙ্গালীর ঔদাসীন্য। ইহাদের অনেকেই স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে বক্তৃতা দিতেন অথবা মুখে বিশেষ আগ্রহ দেখাইতেন, কিন্তু মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাইতেন না এবং গৃহেও শিক্ষা দিতেন না। ফলে বেথুন স্কুলের অবস্থাও ক্রমশঃ খারাপ হইতে লাগিল। ১৮৬৩ সনে উমেশচন্দ্র দত্ত ‘বামাবোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত করেন। ইহা নারীদের গদ্যে-পদ্যে অনেক রচনা প্রকাশ করিয়া এবং স্ত্রীশিক্ষার সম্বন্ধে বহু আলোচনা করিয়া ইহার উন্নতি বিধানে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিল। ১৮৬৮ সনে বামাবোধিনী পত্রিকায় নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হয় :
“আমরা শুনিয়া দুঃখিত হইলাম যে এদেশের সর্বপ্রধান বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ে এক্ষণে ৩০টি মাত্র ছাত্রী অধ্যয়ন করিতেছে। ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া’ সংবাদপত্র লিখিয়াছে, যে এই বিদ্যালয় উনিশ বত্সর স্থাপিত হইয়াছে, এই সময়ের মধ্যে গভর্নমেন্টের ইহার শিক্ষার কাৰ্য্যে এক লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার সাত শত ছিয়াত্তর টাকা ব্যয় হইয়াছে। এতদ্ভিন্ন ইহার সংস্থাপক এককালে ষাট হাজার টাকা দান করেন এবং প্রতি তিন বৎসর অন্তর বাটির সংস্কারকার্যে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় হয়। এরূপ প্রচুর অর্থ ব্যয় হইয়া যখন শুধু ৩০টি মাত্র সাত আট বৎসর বালিকার সামান্য শিক্ষালাভ হইতেছে, তখন ইহাতে অর্থের কেবল অপব্যয় হইতেছে বলিতে হইবে।”৯০
এই মন্তব্য যথার্থ হইলেও কালের পরিবর্তনে এই বেথুন স্কুলরূপ ক্ষুদ্ৰ চারাটি যে মহামহীরূহে পরিণত হইয়া বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার সাধন করিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। তবে এই কার্য যে কিরূপ দুরূহ ছিল উদ্ধৃত মন্তব্য হইতে তাহা বুঝা যায়। ধীরে ধীরে হইলেও স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাইতেছিল। ১৮৬৬-৬৭ সনের শিক্ষাসংক্রান্ত রিপোর্টে লিখিত হইয়াছে :
“এক্ষণে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয়বিধ স্ত্রী-বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা ২৮১। পূৰ্ব্ব বৎসর অপেক্ষা গত এগার মাসে ৬৪টি বিদ্যালয় বৃদ্ধি পাইয়াছে, পূৰ্ব্বে পাঠার্থিনীর সংখ্যা ৫৫৫৯ ছিল, গত এগার মাসে ৬৫৩১ হইয়াছে।”৯১ ইহা হইতে বুঝা যায় গড়ে প্রতি বিদ্যালয়ের ছাত্রীসংখ্যা কুড়ির বেশী হয় নাই।
ইহার একটি কারণ সম্ভবত এই যে, হিন্দুসমাজের অনেক শিক্ষিত গণ্যমান্য ব্যক্তিও বালিকাগণের বিদ্যালয়ে যোগদান সম্বন্ধে খুব বিরুদ্ধভাব পোষণ করিতেন। প্রসিদ্ধ পত্রিকা সমাচার চন্দ্রিকার সম্পাদক বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে যে কুৎসিত মন্তব্য করিয়াছিলেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংঘটনের শঙ্কা আছে, কেননা বালিকাগণ কামাতুর পুরুষের দৃষ্টিপথে পড়িলে অসৎপুরুষেরা তাহারদিগকে বলাকার করিবে, অল্প বয়স্ক বলিয়া ছাড়িবে না, কারণ খাদ্য খাদক সম্বন্ধ। ব্যাঘ প্রভৃতি হিংস্র জন্তুরা কি ছাগাদির শাবককে পশু বলিয়া দয়া করে, ধনবানদিগের কন্যারা পথিমধ্যে ভৃত্যদ্বারা রক্ষিত হইয়া গমন করিলে তথাপি কৌমার হরণের ভয় আছে কেননা রক্ষকেরাই স্বয়ং ভক্ষক হইবেক।…যাহারা উক্ত বিদ্যালয়ে কন্যা প্রেরণ করেন তাঁহারা মান্য ও পবিত্র হিন্দু কুলোব না হইবেন।”৯২
এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে সংবাদ প্রভাকরে’ ইহার তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল।
বাংলার ভূম্যধিকারী সভাও বেথুন স্কুলের বিরোধী ছিল এবং উক্ত বিদ্যালয়ে কন্যা পাঠাইবার অপরাধে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে সদস্যপদ হইতে বহিষ্কৃত করিয়াছিল। এই শ্রেণীর দলপতি মহাশয়দের অনুচরবর্গ গৃহস্থদের বাড়ী বাড়ী গিয়া ভয় দেখাইয়া তাহাদিগকে এইরূপ কার্য হইতে নিবৃত্ত করিত (৯৩ সংবাদ প্রভাকরে এবং সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ইহার প্রতিবাদ করিয়া স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে বহু মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছিল।৯৪
বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠার ২১ বৎসর পরে ১৮৭০ সনে কেশবচন্দ্র সেন স্ত্রীশিক্ষার জন্য ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রধানত কয়েকজন ব্রাহ্মনেতার চেষ্টায় ১৮৮৭ সনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা পরীক্ষা দিবার অধিকার পাইল। ইহার পর হইতেই স্ত্রীজাতির উচ্চশিক্ষা মন্থর গতিতেও হইলেও ক্রমশঃ উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছে। এস্থলে বলা আবশ্যক যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষের ন্যায় নারীকে শিক্ষাদানের বিরুদ্ধে কেবল প্রাচীনপন্থী হিন্দুগণ নহে, ব্রাহ্মসমাজের অনেকেও ঘোরতর আপত্তি করিয়াছিলেন। ‘আদি ব্রাহ্মসমাজে’র মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’তে (চৈত্র, ১৮০২ শকাব্দ) নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হয়:
“স্ত্রী ও পুরুষ জাতির প্রকৃতির বিভিন্নতার নিমিত্ত দুইয়ের পক্ষে এক প্রকার শিক্ষার উপযোগিতা অসম্ভব। স্ত্রী-প্রকৃতি স্বভাবতঃ হৃদয়-প্রধান এবং পুরুষ-প্রকৃতি প্রধানতঃ বুদ্ধি-প্রধান। অতএব তাহাকেই প্রকৃত স্ত্রী-শিক্ষা বলা যাইতে পারে, যাহার মুখ্য উদ্দেশ্য হৃদয়ের উন্নতি এবং গৌণ উদ্দেশ্য বুদ্ধির উন্নতি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার জন্য যেরূপ শিক্ষা প্রদত্ত হয় তাহা বুদ্ধি-প্রধান শিক্ষা, হৃদয়-প্রধান শিক্ষা নহে; অতএব ঐ প্রকার শিক্ষা স্ত্রীজাতির পক্ষে উপযুক্ত শিক্ষা নহে।”
বর্তমানকালেও এইপ্রকার আপত্তি মাঝে মাঝে শুনা যায়। ইহার যৌক্তিকতা বিচার বর্তমান প্রসঙ্গে অনাবশ্যক। কিন্তু কার্যতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষাই যে সমাজে মেয়েদের জন্যও গৃহীত হইয়াছে, বর্তমানকালে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ক্রমবর্ধমান ছাত্রীসংখ্যাই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সে-যুগেও যে ইহার বহু সমর্থক ছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় কবিতায়। ১৮৮৩ সনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু বি. এ. পরীক্ষা পাশ করেন। সর্বপ্রথম দুই বঙ্গললনার এই কৃতিত্ব উপলক্ষে কবিতাটি রচিত হয়। ইহার শেষ কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করিতেছিঃ
“হরিণ-নয়না শুন কাদম্বিনী বালা,
শুন ওগো চন্দ্রমুখী কৌমুদীর মালা,
যে ধিক্কারে লিখিয়াছি “বাঙ্গালীর মেয়ে”, ৯৫
তারি মত সুখ আজি তোমা দোঁহে পেয়ে ॥
বেঁচে থাক, সুখে থাক, চিরসুখে আর
কে বলেরে বাঙ্গালীর জীবন অসার।
কি আশা জাগালি হৃদে কে আর নিবারে?
ভাসিল আনন্দ ভেলা কালের জুয়ারে।
ধন্য বঙ্গনারী ধন্য সাবাসি তুহারে।”
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বিরোধী হইলেও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃবর্গ পুরুষের ন্যায় স্ত্রীর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা প্রয়োজনীয় মনে করিতেন। আনন্দমোহন বসু, দুর্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি এই মতের পৃষ্ঠপোষকগণ বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় নামে কলিকাতায় একটি বোর্ডিং স্কুল পরিচালনা করিতেন; কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, লেডী অবলা বসু, সরলা রায় প্রভৃতি এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। এই বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক ‘অবলা বান্ধব’ নামে প্রসিদ্ধ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁহার রচিত সঙ্গীত, না জাগিলে সব ভারত ললনা, এ ভারত আর জাগে না জাগে না, এখনও বাংলা দেশে সুপরিচিত। তাঁহার চেষ্টায় ছাত্রীগণের মনেও জাতীয় চেতনার উন্মেষ হয় এবং তাঁহার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া লেডী অবলা বসু ছাত্রী-অবস্থায় হিন্দুমেলায় একটি কবিতা আবৃত্তি করিয়াছিলেন।
ব্রাহ্মনেতাদের চেষ্টায় নারীজাতির শিক্ষার উৎকর্ষের জন্য পত্রিকা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা নানা সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। কেশবচন্দ্র সেনের স্ত্রী ‘আৰ্য্য নারী সমাজ করেন (১৮৭৯ খ্রী.) এবং প্রতাপচন্দ্র মজুমদার পরিচারিকা’ নামে মাসিক পত্র সম্পাদনা করেন। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত’ মহিলাবৃন্দ বঙ্গ মহিলা সমাজ’ নামে একটি সভা স্থাপনা করেন ও একটি শিল্পপ্রদর্শনীর আয়োজন করেন। কলিকাতা এবং মফঃস্বলে নারীপ্রগতির উদ্দেশ্যে এইরূপ নানা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। ইহাদের মধ্যে মধ্য বঙ্গ সম্মিলনী’, ‘বিক্রমপুর সম্মিলনী’ ও ‘উত্তরপাড়া হিতকারী সভার’ নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নারীদের মধ্যে শিক্ষাপ্রচার ও বিধবাদের শিল্প শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থার জন্য ১৮৮৬ সনে স্বর্ণকুমারী দেবী সখী সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
হিন্দুসমাজের স্ত্রীশিক্ষার জন্য স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি যে ক্ষুদ্র বিদ্যালটি প্রতিষ্ঠা করিয়া বহু বাধা, বিঘ্ন ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আজীবন যাহার উন্নতিকল্পে আত্মনিয়োগ করেন, তাহা আজ একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং তাহার স্মৃতির বিশিষ্ট নিদর্শনরূপে। পরিগণিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার ফলেই যে বর্তমানকালে বাঙ্গালী নারী নিরক্ষরতা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও অবরোধ-প্রথা প্রভৃতি বহুদিনের সঞ্চিত লাঞ্ছনা ও অপমানের হাত হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছে এবং স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পাইয়া ও নানাবিধ উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া উপযুক্ত মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে অনেক পরিমাণে সমর্থ হইয়াছে, এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সুতরাং সর্ববিধ উন্নতির মূলস্বরূপ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, হিন্দুসমাজের স্ত্রীলোকের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এই প্রসঙ্গে উনিশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরেও নারীর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৫৫-৫৬ সনে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় কয়েকটি মহিলার কবিতা প্রকাশিত হয়। ইহার সম্পাদক প্রসিদ্ধ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নিজে ইহার কোন কোন কবিতা সম্বন্ধে মন্তব্য করেন। ইহার পরে দশ বৎসরের মধ্যে আরও সাতজন মহিলা লেখিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাস সুন্দরীর আত্মকথা নামক পুস্তকে একটি হিন্দু রমণীর বিদ্যাচর্চার পরিচয় যাওয়া যায়। এই গ্রন্থখানি বাংলাগদ্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
পরবর্তীকালে মানকুমারী দেবীর ‘কাব্য কুসুমাঞ্জলি’ ও কামিনী রায়ের আলো ও ছায়া তাঁহাদিগকে বাঙ্গালী কবিদের মধ্যে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বঙ্গের মহিলা কবি’ ও ‘ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গ সাহিত্যে মহিলা’–এই দুইখানি গ্রন্থে বহু মহিলা সাহিত্যিকের পরিচয় পাওয়া যায়। Condition of Bengali Women গ্রন্থে ডক্টর শ্রীযুক্তা উষা চক্রবর্তী স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন। ইহাতে আধুনিক যুগে রাজনীতিক ও সমাজসংস্কার বিষয়ে বঙ্গনারীর অবদান, উনবিংশ শতকের ১৬ জন সুপ্রসিদ্ধা বঙ্গমহিলার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত, ১৯৩ জন গ্রন্থরচয়িত্রী বঙ্গমহিলার বর্ণানুক্রমিক নাম ও গ্রন্থের তালিকা, ২৫ জন সংবাদপত্রের সম্পাদিকা ও এই শ্রেণীর ২১টি সংবাদপত্র, বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য লিখিত ১৬টি পত্রিকার ও তাহাদের। সম্পাদকের নাম, এবং যে-সকল বঙ্গনারী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ১৮৮৪ হইতে ১৯০৮ সনের মধ্যে এম.এ. ও ১৮৮৩ হইতে ১৯১০ সনের মধ্যে বি. এ. পরীক্ষা পাশ করিয়াছেন তাহাদের তালিকা দেওয়া হইয়াছে।
স্বর্ণকুমারী দেবী নিজে সুলেখিকা ছিলেন। তাঁহার সম্পাদনায় “ভারতী” একখানি প্রথমশ্রেণীর মাসিকপত্রে পরিণত হয়। নয় বৎসর (১২৯১-৯৯) সম্পাদনা কার্যের পর তিনি অবসর গ্রহণ করিলে তাহার দুই কন্যা হিরন্ময়ী দেবী ও সরলা দেবী ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করিয়া যোগ্যতার সহিত তাহা পরিচালনা করেন। বাংলার জাতীয় জাগরণে এই প্রতিকার ও সরলা দেবীর দান অবিস্মরণীয়। বহুকাল অবধি লুপ্ত নারীর সঙ্গীতশিল্পের চর্চাও ঠাকুরবাড়ীর কয়েকটি মহিলার কল্যাণে পুনরুজ্জীবিত হয়।
শিক্ষিতা নারীর মনে নানাভাবে নবজাগ্রত জাতি-চেতনার উন্মেষের পরিচয় পাওয়া যায়। অবলা দাস ছাত্রী-অবস্থায় হিন্দুমেলায় কবিতা আবৃত্তি করেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারাদণ্ডে ছাত্রীরা কালো ফিতা পরিয়াছিল। বড়লাট লর্ড রিপনের অভ্যর্থনায় প্রায় ৩০। ৪০টি ছাত্রী একরকম পরিচ্ছদে সজ্জিতা হইয়া রেলস্টেশনে তাহার উপর পুষ্পবৃষ্টি করে।
১৮৯০ সনে কলিকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। স্বর্ণকুমারী দেবী, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজন বঙ্গমহিলা প্রতিনিধিরূপে এই সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। কাদম্বিনী দেবী সাধারণ অধিবেশনে প্রায় পাঁচহাজার দর্শকের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সভাপতিকে ধন্যবাদ দেওয়ার প্রস্তাব উপস্থিত করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্তা অ্যানি বেসান্ত How India Wrought for Freedom নামক তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া মন্তব্য করিয়াছেন, এই সর্বপ্রথম একজন মহিলা কংগ্রেস-প্লাটফর্মে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা করিলেন। ভারতের স্বাধীনতা যে ভারতীয় নারীর মর্যাদা কতদূর উন্নত করিবে ইহা তাহারই প্রতীক। অ্যানি বেসান্তের এই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইয়াছে।
(গ) সতীদাহ [৯৬]
স্ত্রীশিক্ষা প্রসার ব্যতীত উনিশ শতকে স্ত্রীজাতির উন্নতিমূলক যে-সকল সংস্কার সাধিত হইয়াছিল সতীদাহ নিবারণ তাহাদের মধ্যে প্রধান। মৃত পতির জ্বলন্ত চিতায় সদ্যবিধবাকে জীবন্ত অবস্থায় দগ্ধ করা, অর্থাৎ সহমরণ প্রথা, আমাদের নিকট নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত বলিয়া মনে হইলেও ইহা যে প্রাচীনকাল হইতে আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন স্মৃতিশাস্ত্রে ইহার উল্লেখ আছে এবং খ্রীষ্টজন্মের তিন-চারিশত বৎসর পূর্ব হইতে এদেশে, সহমরণের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মধ্যযুগে অনেক মুসলমান নরপতি, গোঁয়ার পর্তুগীজ শাসনকর্তা এবং হিন্দুরাজাদের মধ্যে কেবলমাত্র পেশোয়া বাজীরাও ইহা রহিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হন নাই।
‘শঙ্খ’ ও ‘আঙ্গিরস’ সংহিতার মতে মানুষের গায়ে লোমের সংখ্যা অর্থাৎ সাড়ে তিন কোটি পরিমিত বৎসর কাল সহমৃতা স্ত্রী স্বর্গে বাস করিবে এবং অপ্সরাগণের স্তুতি লাভ করিয়া অনন্তকাল স্বামীর সঙ্গে ক্রীড়ার আনন্দ লাভ করিবে। স্বামী যদি ব্রহ্মঘ্ন, কৃতঘ্ন, বা সুরাপায়ী হন তথাপি স্ত্রী সহমৃতা হইলে তাহার সর্বপাপ বিনষ্ট হইবে। বৃদ্ধ হারীতে’র মতে স্ত্রী সহমৃতা হইলে তাহার পতি, পিতা ও মাতার কুল পবিত্র হয়। সাধ্বী নারীর সহমরণ ভিন্ন অন্য গতি নাই। ধর্মশাস্ত্রের এই সকল উক্তিই যে সহমরণের জনপ্রিয়তার মূলে ছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ, বহু স্ত্রীলোক স্বেচ্ছায় সহমৃতা হইতেন, বহু অনুরোধ ও উপরোধেও সংকল্প হইতে নিবৃত্ত হইতেন না।
ইংরেজ গভর্নমেন্ট ‘হিন্দুর ধর্মে হস্তক্ষেপ করিবেন না’–এই সাধারণ নীতি অনুসরণ করার ফলে, শাস্ত্রের এই বিধি অমান্য করিয়া সতীপ্রথা রহিত করিবার কোন চেষ্টা করেন নাই। কিন্তু কলিকাতার সুপ্রীম কোর্ট তাহাদের অধিকারের সীমার মধ্যে ইহা দণ্ডনীয় বলিয়া ঘোষণা করায় কলিকাতার অধিবাসীরা কলিকাতা শহরের বাহিরে যাইয়া এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করিত। ডেন, ওলন্দাজ, ফরাসী প্রভৃতি বণিক সম্প্রদায়ের এলাকায়ও সতীপ্রথা নিষেধ ছিল, কিন্তু সেখানকার লোকেরাও উহার সীমানার বাহিরে যাইয়াই সহমরণ অনুষ্ঠান করিত।
ইংরেজ গভর্নমেন্টের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিসত্ত্বেও কয়েকজন ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেট এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দে মেদিনীপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট লেখেন যে, তিনি কোনমতে একটি নয় বৎসর বয়সের বালবিধবাকে আপাততঃ সহমরণ হইতে নিবৃত্ত করিয়াছেন, কিন্তু সরকারী আদেশ জারি করা না হইলে সম্ভবত ইহা বন্ধ করা যাইবে না। অন্যান্য ম্যাজিষ্ট্রেটরাও এইরূপ রিপোর্ট করেন। কিন্তু গভর্নমেন্ট তাহার উত্তরে বলেন, উপদেশ দিয়া নিবৃত্ত করা ছাড়া তাঁহারা যেন আর কোন উপায় অবলম্বন না করেন। ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে নদীয়ার এক কুলীন ব্রাহ্মণের ২২টি স্ত্রী তাহার সহিত সহমৃতা হয়। ঐ সময়েই শ্রীরামপুরের নিকটবর্তী সুকচরা গ্রামে এক কুলীন ব্রাহ্মণের মৃত্যু হয়। তাহার ৪০টি পত্নীর মধ্যে যে ১৮টি জীবিত ছিল সকলেই সহমৃতা হয়। ১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার চতুর্দিকে ৩০ মাইল বিস্তৃত সীমানার মধ্যে প্রায় তিনশত বিধবা সহমৃতা হয়। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে কাশিমবাজার হইতে গঙ্গানদীর মধ্যবর্তী স্থানে যে প্রায় ৭০টি বিধবা সহমৃতা হইয়াছিল তাহার একটি তালিকা পাওয়া গিয়াছে।৯৭ ইহাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ হইতে আরম্ভ করিয়া কামার, কুমার, তেলী, ছুতার, স্বর্ণকার, কৈবর্ত, ধোপা, নাপিত, তাঁতী, বাণী প্রভৃতি সব জাতির বিধবা আছে এবং তাহাদের বয়স ১৬ হইতে ৬০ বৎসর। ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে একটি সরকারী আদেশ জারি হয় যে মাদকদ্রব্য দ্বারা বিধবাকে অজ্ঞান করিয়া এবং গর্ভিণী বা ঋতুমতী সমাজ হইবার পূর্বে কোন বালবিধবার সহমরণ ম্যাজিষ্ট্রেট রহিত করিতে পারিবেন। ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে আদেশ হয়, যেসব বিধবার স্তন্যপায়ী শিশু অথবা সাত বৎসরের ছোট সন্তান আছে অথচ তাহাদের পালন করার আর কেহ নাই–তাহারা সহমৃতা হইতে পারিবে না, উপরন্তু সহমরণের পূর্বে অভিভাবকেরা পুলিশকে না জানাইলে দণ্ডনীয় হইবে। কিন্তু ইহাতে বিশেষ কোন ফল হয় নাই। ১৮১৮ হইতে ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কলিকাতা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, পাটনা, বেনারস ও বেরিলী–এই ছয় বিভাগে গড়ে প্রতি বৎসর ছয়শতেরও বেশী বিধবা সহমৃতা হইত। বাংলা দেশে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা সহমরণ বেশী হইত।
ইতিমধ্যে বহু ইংরেজ কর্মচারী ও খ্রীষ্টীয় মিশনারীগণ এই নিষ্ঠুর প্রথা রহিত করিবার জন্য পুনঃপুনঃ গভর্নমেন্টকে লিখিতে লাগিলেন। পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং উদারভাবাপন্ন বাঙ্গালীরাও ক্রমে ক্রমে প্রাচীন সংস্কারের বন্ধনমুক্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ১৮১৫ ও ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে সতীপ্রথার নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বোক্ত দুইট রাজশাসন রহিত করিবার জন্য যখন হিন্দুরা গভর্নমেন্টের নিকট আবেদন করেন তখন রামমোহন রায় এবং তাঁহার বন্ধু ও সহযোগিগণ ইহার বিরুদ্ধে গভর্নমেন্টের নিকট পাল্টা আবেদন করেন (১৮১৮ খ্রী.)। এই সময় হইতে রামমোহন রায় সতীপ্রথার বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন করেন ও শ্মশানঘাটে যাইয়া সহমরণার্থী বিধবাগণকে অনেক প্রকারে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করেন। হিন্দুশাস্ত্রে যে বিধবাদের সহমরণে যাইতে হইবে এইরূপ কোন নির্দেশ বা বিধান নাই, ইহা প্রতিপন্ন করিবার জন্য তিনি সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ এই নাম দিয়া ১৮১৮ ও ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে দুইখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ইহাতে দুই ব্যক্তির কথোপকথনচ্ছলে সহমরণের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা হইয়াছে। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সহমরণ বিষয়ে আর-একখানি গ্রন্থ লেখেন।
ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন খুব তীব্র হইয়া উঠে। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে দুইটি পৃথক দল ছিল। এক দলের অভিমত ছিল সরাসরি আইন করিয়া এই নিষ্ঠুর প্রথা রহিত করা হউক। আর এক দলের ইহাতে আপত্তি ছিল, তাঁহাদের মতে এ-বিষয়ে আন্দোলনের ফলেই ক্রমে ক্রমে লোকেরা এই প্রথার নিষ্ঠুরতা উপলব্ধি করিবে এবং আপনা হইতেই এই প্রথা রহিত হইবে। রামমোহন রায় এই শেষোক্ত দলে ছিলেন। লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক যখন অনেক ইতস্ততের পর সতীপ্রথা নিষেধের আইন জারি করা স্থির করিয়া রামমোহনের সহিত পরামর্শ করেন, তখন রামমোহন ইহা অনুমোদন করেন নাই। ইহার কারণ সম্ভবত এই যে, বিদেশী গভর্নমেন্ট আইন দ্বারা হিন্দুসমাজের ব্যবস্থা করিবেন ইহা সাধারণ নীতি হিসাবে গ্রহণ করিতে রামমোহন অনিচ্ছুক ছিলেন। রামমোহনের পরে অনেক উদারপন্থী হিন্দুনেতারাও অনুরূপ কারণে বিধবা-বিবাহ, বহু-বিবাহ প্রভৃতি রহিত করিবার জন্য আইনের আশ্রয় লওয়া সঙ্গত মনে করেন নাই। কিন্তু রামমোহন বেন্টিঙ্ককে পরামর্শ দিলেন, আইন না করিয়া এই অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করিয়া পুলিশের সাহায্যেই ইহা রহিত করা সম্ভব হইবে। লর্ড বেন্টিঙ্কের পূর্ববর্তী কোন বড়লাট সহমরণ নিষেধসূচক আইন করিতে সম্মত হন নাই। হিন্দুধর্মের ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে সাধারণ নীতি ছাড়াও তাঁহাদের আশঙ্কা ছিল, ইহাতে হয়ত হিন্দু জনসাধারণ এবং বিশেষতঃ দেশীয় সৈন্য বিদ্রোহ করিতে পারে। বেন্টিঙ্ক সামরিক কর্মচারী ও অন্যান্য অনেকের সঙ্গে আলোচনা করিয়া এ-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইয়া ১৮২৯ সনে ৪ঠা ডিসেম্বর এক আইন পাশ করিয়া সতীদাহ প্রথা দণ্ডনীয় ঘোষণা করিলেন।
এই আইন পাশ হওয়ামাত্রই প্রাচীনপন্থী হিন্দুগণ ইহার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন আরম্ভ করিলেন। বহু বহু উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত ও প্রতিপত্তিশালী হিন্দু এই বিরুদ্ধ-আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, মহারাজা কালীকৃষ্ণ ঠাকুর বাহাদুর, গোপীমোহন দেব প্রভৃতি। ১৯শে ডিসেম্বর তারিখে কলিকাতানিবাসী ৮০০ লোকের স্বাক্ষরিত এক আবেদনে গভর্নমেন্টকে সতীপ্রথা নিষেধ-বিধি প্রত্যাহার করিতে অনুরোধ করা হইল। সতীপ্রথার সমর্থনে ১২০ জন পণ্ডিতের স্বাক্ষরিত বহু শাস্ত্রীয় প্রমাণযুক্ত একখানি ক্রোড়পত্র এই আবেদনের সঙ্গে পাঠান হইয়াছিল। কলিকাতার নিকটবর্তী বেলঘরিয়া, আড়িয়াদহ প্রভৃতি স্থানের অধিবাসী ৩৪৬ জনের স্বাক্ষরিত অনুরূপ আর-একখানি আবেদনপত্রও গর্ভনমেন্টের নিকট পাঠান হইল।
রামমোহন রায় আইনের দ্বারা সহমরণ রহিত করায় আপত্তি করিলেও এই আইন পাশ হইবার পর তাহা পুরাপুরি সমর্থন করেন। প্রাচীনপন্থীদের প্রতিবাদের উত্তরে কলিকাতার ৩০০ হিন্দু ও ৮০০ খ্রীষ্টান অধিবাসীর স্বাক্ষরিত একখানি অভিনন্দনপত্র বড়লাটকে দিবার জন্য রামমোহন রায়, কালীনাথ চৌধুরী প্রভৃতি ১৬ই জানুআরি (১৮৩০ খ্রী.) বড়লাট ভবনে উপস্থিত হন। বাংলায় লেখা অভিনন্দনপত্রখানি ও তাহার ইংরেজী অনুবাদ পাঠ করা হয়। এই অভিনন্দনপত্রে উক্ত দুইজন ব্যতীত দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতির স্বাক্ষর ছিল। অনেকের বিশ্বাস যে, রামমোহন রায়ই এই অভিনন্দনপত্র রচনা করেন। ইহার মর্মার্থ এই যে, হিন্দুপ্রধানেরা আপন আপন স্ত্রীর প্রতি সন্দিগ্ধচিত্ত হইয়া যাহাতে বিধবারা কোনক্রমে অন্যাসক্ত না হয় তাহার জন্য সজীব বিধবাদের দগ্ধ করার রীতি প্রচলন করেন। কিন্তু নিজেদের এই গর্হিত কর্ম নির্দোষ প্রতিপন্ন করিবার জন্য শাস্ত্রের দোহাই দিতেন।
এই অভিনন্দনপত্রেই সতীদানের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, বিধবাদের আত্মীয় ও অন্তরঙ্গেরা দাহকালীন এই বিহ্বলাদের প্রায় বন্ধন করিতেন এবং যাহাতে তাহারা চিতা হইতে পলাইতে না পারে এ নিমিত্ত রাশীকৃত তৃণ কাষ্ঠাদি দ্বারা তাহাদের গাত্র আচ্ছাদিত করিতেন।৯৮
এই উক্তিটি অনেকে অতিরঞ্জন বলিয়া মনে করেন। কিন্তু ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে ৫ই মে তারিখে ‘সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত একখানি পত্রে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণেও ইহার উল্লেখ আছে। তিনি লিখিয়াছেন, “গরিফা গ্রামে ২২শে বৈশাখে ২২ বৎসর বয়স্কা এক ব্রাহ্মণের কন্যা সতী হইয়াছে। সাক্ষাৎ যমদূতের ন্যায় হস্ত ধারণপূৰ্ব্বক ঘূর্ণপাকে সাত বার ঘুরাইয়া শীঘ্র চিতারোহণ করাইয়া শবের সহিত দৃঢ় বন্ধন পুরঃসরে জ্বলদগ্নিতে দগ্ধকরণ ও বংশদ্বয় দ্বারা শবের সহিত তাহার শরীর দাবিয়া রাখন ও তাহার কথা কেহ শুনিতে না পায় এ নিমিত্তে গোলমাল ধ্বনি করণ অতি দুরাচার নির্মায়িক মনুষ্যের কৰ্ম্ম।”৯৯
বেন্টিঙ্ক প্রাচীনপন্থীগণের আবেদন অগ্রাহ্য করিলে তাহারা বিলাতে সপারিষদ রাজার (King-in-council) নিকট আপীল করেন। রামমোহন ইহার বিরুদ্ধে যুক্তিতর্কসম্বলিত একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করিয়া উক্ত আপীলের প্রতিবাদে আর একখানি আবেদন রচনা করেন। তিনি ইহা নিজে সঙ্গে করিয়া বিলাতে লইয়া যান এবং Commons সভায় দেন। বিলাতে প্রিভি কাউন্সিল যখন প্রাচীনপন্থীদের আপীল বরখাস্ত করেন তখন রামমোহন উপস্থিত ছিলেন। এইরূপে সতীদাহ আন্দোলনের উপর যবনিকাপাত হইল এবং নিষ্ঠুর প্রথা চিরকালের জন্য রহিত হইল।
(ঘ) বিধবা-বিবাহ [১০০]
সতীপ্রথা রহিত হওয়ায় এবং ব্রাহ্মসমাজে বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়ায় হিন্দুসমাজেও বিধবা-বিবাহ প্রবর্তনের সপেক্ষ আন্দোলন আরম্ভ হয়। ইহার ফলে ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় আইন কমিশন কলিকাতা, এলাহাবাদ ও মাদ্রাজের সদর আদালতে বিচারকদিগকে এ-বিষয়ে মতামত প্রকাশের জন্য অনুরোধ করেন, কিন্তু সকলেই বাল-বিধবার পুনবিবাহ সমর্থন করিলেও ইহার জন্য আইন করার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। অতঃপর এই বিষয়ে দুই বিরোধীদলের মধ্যে বহু বাদানুবাদ হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মহারাজা রাজবল্লভ বিধবা-বিবাহের পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা করেন, কিন্তু কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিকূলতায় ইহা ব্যর্থ হয়, ইহা পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু ইহার শতবর্ষ পরে কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধর রাজা শ্রীশচন্দ্র রাজবল্লভের অনুকরণে বিধবা-বিবাহ যে শাস্ত্ৰসিদ্ধ ইহা প্রতিপন্ন করিবার জন্য স্মার্ত পণ্ডিতগণের নিকট হইতে একটি ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেন। অনেক পণ্ডিত ইহা স্বাক্ষর করিতে রাজী হইলেন, কিন্তু তাঁহাদের ভয় হইল যে, এরূপ মত ব্যক্ত করিলে সমাজে তাঁহারা ‘একঘরে’ হইবেন এবং বিবাহ শ্রাদ্ধ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে তাহাদের নিমন্ত্রণ বন্ধ হইবে। কেহ কেহ পরিষ্কার বলিলেন, মহারাজা যদি চিরদিনের মত জীবিকা সংস্থানের ব্যবস্থা করিতে পারেন তবে তাঁহারা ব্যবস্থাপত্রে স্বাক্ষর করিবেন। শ্রীশচন্দ্র ইহাতে অসম্মত বা অসমর্থ হওয়ায় পণ্ডিতেরা ব্যবস্থা দেন নাই। কলিকাতার বহুবাজার অঞ্চলের নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য কয়েকজন দলবদ্ধ হইয়া এ-বিষয়ে চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থকাম হন। পটলডাঙ্গা নিবাসী শ্যামাচরণ দাস তাঁহার বাল-বিধবা কন্যার বিবাহ দিবার চেষ্টা করেন। অনেক পণ্ডিত এক ব্যবস্থাপত্রে স্বাক্ষর করে, কিন্তু পরে তাঁহারাই বিরোধিতা করেন। ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে British India Society বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে ‘ধর্মসভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র সহিত আলোচনা করে; কিন্তু কোন সভাই কোন উৎসাহ দেখায় নাই। এই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি বিধবা-বিবাহ সমর্থনকল্পে শাস্ত্রীয় প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়া ১৭৭৬ শকের ফাল্গুন মাসে (১৮৫৪ খ্র.) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। ইহার ফলে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে আন্দোলন খুব তীব্র আকার ধারণ করে। এই সময় ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিপক্ষ পণ্ডিতগণের যুক্তি খণ্ডন করিয়া বিধবা-বিবাহের সমর্থনে দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশিত করেন। ইহাতে আন্দোলন সর্বশ্রেণীর মধ্যে বিস্তৃত হয়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নানা ছন্দে কবিতা রচনা করেন। ইহা ছাড়াও পথে ঘাটে সুন্দর সুন্দর ছড়া, গান কবিতা লোকের মুখে-মুখে ফিরিত। শান্তিপুরের তাঁতিরা বিদ্যাসাগরপেড়ে শাড়ী প্রস্তুত করিয়া চড়া দামে বিক্রয় করিত। ইহার পাড়ের উপর যে-গানটি লেখা ছিল তাহার কয়েক লাইন উদ্ধৃত করিতেছি
“বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবি হয়ে,
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।
আর কেন ভাবিস লো সই ঈশ্বর দিয়েছেন সই,
এবার বুঝি ঈশ্বরেচ্ছায় পতি প্রাপ্ত হই।
রাধাকান্ত মনোভ্রান্ত দিলেন নাকো সই।”
সহমরণ বিষয়ে রামমোহনের ন্যায় বিদ্যাসাগরও শাস্ত্রীয় প্রমাণ দ্বারা বিধবা-বিবাহ সমর্থনের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীর হৃদয়বৃত্তির কাছে মর্মস্পর্শী আবেদন করেন। কিন্তু কেবলমাত্র ইহার উপর নির্ভর না করিয়া তিনি বিধবা-বিবাহ প্রচলনের জন্য রাষ্ট্রীয় বিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে ৪ঠা অক্টোবর তিনি হিন্দুসমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ও বিভিন্ন স্তরের ৯৮৭ জনের স্বাক্ষরিত একখানি আবেদনপত্র ভারত-সরকারে প্রেরণ করেন। ইহাতে বলা হয় যে, দেশাচার অনুসারে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু এই নিষেধ শাস্ত্রসঙ্গত নহে। আবেদনকারীরা মনে করেন শাস্ত্রের অপব্যাখ্যার জন্য যে সামাজিক বাধা প্রবল আকার ধারণ করিয়াছে, ব্যবস্থাপক সভার কর্তব্য তাহা অপসারণ করা।
১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ব্যবস্থাপক সভায় বিধবা-বিবাহ আইনের খসড়া পেশ করা হইলে ভারতের সর্বত্র ইহার স্বপক্ষে ও বিপক্ষে তুমুল আন্দোলন হয়। রাজা রাধাকান্ত দেব ইহার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৭,০০০ লোকের স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্র ভারত-সরকারে প্রেরণ করেন। নবদ্বীপ, ত্রিবেণী, ভট্টপল্লী (ভাটপাড়া) প্রভৃতি স্থানের প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণের পক্ষ হইতেও বিধবা-বিবাহের বিরুদ্ধে সরকারের নিকট আবেদনপত্র পাঠানো হয়। অপরপক্ষে বাংলা দেশের বহু স্থান হইতে বিধবা-বিবাহ আইনের সমর্থনে আবেদনপত্র প্রেরিত হইয়াছিল। অবশেষে বহু আন্দোলন ও তর্কবিতর্কের পর ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ২৬শে জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হইল। কিন্তু এই আইন পাশ হওয়া সত্ত্বেও বিধবা-বিবাহ সমাজে খুব প্রসার লাভ করে নাই।
(ঙ) বাল্যবিবাহ
স্ত্রীজাতির মানসিক ও সামাজিক অধোগতির আর দুইটি প্রধান কারণ ছিল বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ।
ধর্মসূত্রে, স্মৃতিতে ও মহাভারতে বাল্যবিবাহের বিধি থাকিলেও ইহার ব্যতিক্রমের অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মহাভারতে কোন বালিকার বিবাহের উল্লেখ নাই। যে-সকল মহিলার উল্লেখ আছে তাহারা প্রত্যেকেই পূর্ণ যুবতী অবস্থায় বিবাহ করিয়াছিলেন। ইতিহাসে যে একাধিক স্বয়ম্বরের কাহিনী আছে তাহাও বাল্যবিবাহের বিরোধী। কিন্তু মধ্যযুগে অন্ততঃ বাংলা দেশে বাল্যবিবাহ প্রথা কঠোরভাবে প্রতিপালিত হইত। এ-যুগের প্রধান স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ষোড়শ শতাব্দীর লোক। তাঁহার ব্যবস্থাই বঙ্গদেশে বেদবাক্যের ন্যায় গৃহীত হইত। তিনি উদ্বাহতত্ত্বে লিখিয়াছেন : “কন্যার রজোদর্শন হইবার পূৰ্বেই কন্যাদান প্রশস্ত। ৮ বৎসরের কন্যাকে গৌরী বলে, ৯ বৎসরের কন্যা রোহিণী, ১০ বৎসরে কন্যকা এবং ইহার পর রজঃস্বলা হয়। অতএব দশ বৎসরের মধ্যে যত্নসহকারে কন্যাকে প্রদান করা কর্তব্য।…যে কন্যা ১২ বৎসর বয়স পর্যন্ত অপ্রদত্তা হইয়া পিতৃগৃহে বাস করে তাহার পিতা ব্রহ্মহত্যা পাপের ভাগী হয়; এরূপ স্থলে ঐ কন্যার স্বয়ংবর অন্বেষণ করিয়া বিবাহ করা উচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত যে রঘুনন্দনের বিধি অনুসারে বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। অবশ্য রঘুনন্দন প্রাচীন শাস্ত্রকারদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াই বিধি দিয়াছিলেন, কিন্তু মধ্যযুগের অন্ধ সংস্কার এই মতটিকে ধর্মের অঙ্গরূপে গণ্য করিয়া বিনাবিচারে ইহা পালন করিত এবং গৌরীদান করিয়া ঐ কন্যার গর্ভজাত সন্তানের পিতৃকুলে একুশ পুরুষ এবং মাতৃকুলে ছয় পুরুষের অক্ষয় স্বর্গবাসের পাকাপাকি বন্দোবস্ত করিত।
আঠারো ও উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথমে যে সাধারণত রজঃস্বলা হইবার পূর্বে, এবং অনেক স্থলে ইহার বহু পূর্বে, এমনকি তিন-চারি বৎসর বয়সেও কন্যার বিবাহ হইত, এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। অবশ্য সকল বিধির ন্যায় ইহারও যে ব্যতিক্রম না হইত তাহা নহে।
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও নব্যপন্থী হিন্দুরা আন্দোলন আরম্ভ করে। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে পার্শী বেহরামজী মেরবানজী মালাবারি একখানি বই লেখায় এ-বিষয়ে সরকারের ও সাধারণের দৃষ্টি এই প্রথার কুফলের দিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু প্রাচীনপন্থীরা এ-সম্বন্ধে কোনো আইন করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও ঘোর আন্দোলন করেন। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে হরি মাইতি তাহার বালিকা স্ত্রী ফুলমণির সঙ্গে বলপূর্বক সহবাস করায় তাহার মৃত্যু হয়। ইহাতে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বাংলায় ও বাংলার বাহিরে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। কলিকাতায় Health Society এবং ৫৫ জন মহিলা চিকিৎসক মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নিকট এক আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। অবশেষে প্রধানতঃ মালাবারির চেষ্টায় ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে সহবাস-সম্মতি বয়স সম্বন্ধে এক আইন বিধিবদ্ধ হয়। ইহাতে ১২ বৎসরের কম বয়সের বালিকাবধূর সঙ্গে সহবাস করিলে স্বামী দণ্ডনীয় হইবে এইরূপ ব্যবস্থা হয়।১০১
বিংশ শতাব্দীতে হিন্দু পুরুষ ও স্ত্রীলোকের বিবাহের ন্যূনতম বয়স বৃদ্ধির অনেক চেষ্টা করা হয়। নানা সভা-সমিতিতে এ-বিষয়ে আন্দোলন ও নানা প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে হরবিলাস সর্দার প্রস্তাবিত আইন পাশ হওয়ায় ১৪ বৎসরের কম বলিকা ও ১৮ বৎসরের কম বালকের বিবাহ হইলে উভয়ের কর্তৃপক্ষ দণ্ডনীয় হইবে এইরূপ ব্যবস্থা হয়।
(চ) বহু-বিবাহ [১০২]
বাল্যবিবাহের ন্যায় বহু-বিবাহও যে প্রাচীন হিন্দুযুগে প্রচলিত ছিল তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু মধ্যযুগে বাংলার ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথার ফলে যে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয় পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার তুলনা মিলে না। মধ্যযুগে এই প্রথার উৎপত্তি ও প্রকৃতির এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে সংক্ষেপে বিবৃত হইয়াছে।
বাংলা দেশে প্রবাদ এই, বল্লালসেন আচার, বিনয়, বিদ্যা প্রভৃতি নয়টি গুণ থাকার জন্য যে-সকল ব্রাহ্মণকে কৌলীন্য-মর্যাদা দেন তাহাদের সংখ্যা কুড়ির বেশী ছিল না। সমস্ত কুলীনই এক-পর্যায়ভুক্ত ছিলেন এবং অকুলীনের কন্যা বিবাহ করিতেও তাঁহাদের কোন বাধা ছিল না। বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেনের সময় একটি গুরুতর পরিবর্তন হইল। প্রথম প্রথম গুণানুসারে মাঝে মাঝে নূতন নূতন ব্যক্তিকে কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হইত। লক্ষ্মণসেন কুলীনের বৈবাহিক সম্বন্ধের বিষয়ে অনেক নিয়ম করিলেন এবং এই নিয়ম কাহারা কতদূর অনুসরণ করিয়াছে তাহার বিচার করিয়া কুলীনদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ করিলেন। কিছুকাল পরে এই শ্ৰেণী-বিভাগ নূতন করিয়া করা হইত-ইহার নাম সমীকরণ। লক্ষ্মণসেনের সময় এইরূপ দুইটি সমীকরণ হয়। ধ্রুবানন্দ মিশ্র সম্ভবত খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে বর্তমান ছিলেন–তাহার কুলজী গ্রন্থে এইরূপ ১১৭টি সমীকরণের উল্লেখ আছে।
এই সময়ের পূর্বেই কৌলীন্য-মর্যাদা ব্যক্তিগত গুণের উপর প্রতিষ্ঠিত না হইয়া পৈতৃক বংশগত মর্যাদায় পরিণত হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, ইহাদের মধ্যে অনেকেরই পূর্বোক্ত নবগুণ তো দূরের কথা, তাহার একটিও ছিল কিনা সন্দেহ। বরং ক্রমে ক্রমে কুলীনদের মধ্যে নানা দোষ ঘটিতে লাগিল। ইহার ফলে দেবীবর ঘটক কুলীনদের দোষ অনুসারে তাহাদিগকে পৃথক্ পৃথক্ সম্প্রদায়ে ভাগ করে। অর্থাৎ, যাহারা একই প্রকার দোষে দোষী তাহাদের লইয়া এক একটি ভিন্ন সম্প্রদায় হইল। এইসব সম্প্রদায়ের নাম হইল ‘মেল’–সম্ভবত মেলন শব্দের অপভ্রংশ। দেবীবর কুলীনদিগকে এইরূপ ৬৬ মেলে বিভক্ত করেন। স্থির হয়, প্রত্যেক কুলীনকেই নিজ নিজ মেলের মধ্যে কন্যার বিবাহ দিতে হইবে। ক্রমে ক্রমে এক-একটি মেলের মধ্যে লোকসংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় আঠারো ও উনিশ শতকে ইহার ফল হইল বিষময়। একদিকে উপযুক্ত পাত্র মিলিত না, সুতরাং কন্যাকে আজীবন কুমারী থাকিতে হইত। অন্যদিকে, পুরুষ একাধিক বিবাহ করিত। বহু কুমারীর বিবাহ হইত না। যাহাদের বিবাহ হইত তাহারা প্রায় সারাজীবন পিতৃগৃহেই থাকিত, স্বামীর সঙ্গে কদাচিৎ দেখা হইত। কারণ অনেক কুলীনের ৫০, ৬০ বা তাহারও অধিক স্ত্রী থাকিত। সুতরাং ইহার মধ্যে মাত্র কয়েকজন তাহার গৃহে স্থান পাইত।
অনেক কুলীন ব্রাহ্মণের পেশাই ছিল বিবাহ করিয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করা। তাঁহারা ঘুরিয়া ঘুরিয়া বিবাহ করিতেন–প্রতি বিবাহের ফলেই কিছু অর্থ মিলিত। কখনও কখনও একই পরিবারের একাধিক অনূঢ়া কন্যা একসঙ্গে একই বরের হস্তে সম্প্রদান করা হইত। এরূপ অনেক ঘটনা শোনা যায় যে মুমূর্ষ কুলীনের সঙ্গে দিদি, পিসি, ভাইঝি প্রভৃতি সম্পর্কের একই পরিবারস্থ ১০-১২টি কন্যার একসঙ্গে বিবাহ হইয়াছে এবং ১০ হইতে ৫০ বা তদূর্ধ্ব বয়সের এক সকল স্ত্রী কয়েক দিনের মধ্যেই একসঙ্গে বিধবা হইয়াছে। তখনকার দিনে বিশ্বাস ছিল, অনূঢ়া স্ত্রীলোক মৃত্যুর পর স্বর্গে যাইতে পারে না। সুতরাং মৃত্যুপথযাত্রীর সঙ্গে একদল বালিকা-যুবতী-বৃদ্ধার বিবাহ দিয়া তাহাদের কুমারীত্ব ঘুচাইয়া স্বর্গের পথ মুক্ত করা হইত। কুলীনদের বিবাহের সংখ্যা প্রায় এত অধিক হইত যে স্বামী একটি খাতাতে বিবাহিতা স্ত্রীগণের নাম-পরিচয় লিখিয়া রাখিতেন, প্রয়োজন বোধ করিলে এবং সময় পাইলে খাতা দেখিয়া শ্বশুরবাড়ী যাইতেন। ইহাতে বেশকিছু অর্থোপার্জনও হইত। কুলীন জামাতা শ্বশুরবাড়ী গেলে তাঁহার মর্যাদার জন্য নানা উপলক্ষে টাকা দিতে হইত। তন্মধ্যে একটি ছিল শয্যা-গ্রহণী–অর্থাৎ টাকা না দিলে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে শয়ন করিবেন না।
এইসব কাহিনী বিশ্বাস করা কঠিন, তথাপি ইহা যে অমূলক নহে সে-বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। যে গ্রামে আমার জন্ম সেখানে এক বাড়ীতে দুই কুলীন ভাই ছিলেন। বাল্যকালে তাহাদের একজনের ছেলে গ্রামের বিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়িত বলিয়া তাহাদের বাড়ী যাইতাম। এইরূপে তাহাদের অনেক খবর শুনিয়াছিলাম। দুই ভাইয়ের প্রত্যেকেরই ৫০ ৬০টি করিয়া স্ত্রী ছিল। কয়েকটি মাত্র তাঁহাদের সঙ্গে থাকিত, সম্ভবত পালাক্রমে নূতন নূতন বধূর দল আসিত যাইত। আমার বেশ মনে আছে, গ্রামের নাম ধরিয়া তাহাদের ডাকা হইত –অমুক গ্রামের বউ, অমুক গ্রামের মা, খুড়ী, জেঠী ইত্যাদি। এই প্রকার সম্বোধন ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না। তখনকার দিনে গল্প শুনিতাম, কুলীন ব্রাহ্মণ স্ত্রীর পিত্রালয় কোন গ্রামে গিয়া শ্বশুরবাড়ী চিনিতে পারিলেন না। কিন্তু, খাতায় শ্বশুরের নাম লেখা ছিল; তাহার নাম করিয়া নদীর ঘাটে একটি মহিলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মা, অমুকের বাড়ীটা কোন দিকে?’ পরে জানিতে পারিলেন ঐ মহিলাই তাঁহার স্ত্রী। এই ঘটনা সত্য কিনা জানি না, কিন্তু অনুরূপ ঘটনা আমি নিজে বাল্যকালে প্রত্যক্ষ করিয়াছি।
আমাদের গ্রামে একটি ডাকঘর ছিল, সকালে চিঠি আনিবার জন্য অনেকেই সেখানে একত্র হইতেন। একদিন আমিও উপস্থিত ছিলাম। একটি অপরিচিত যুবক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী কোন্ পথে যাইব? প্রশ্নের উত্তরে জানাইল, শ্যামাচরণ তাঁহার পিতা। শ্যামাচরণ ঐখানেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি যুবকের মাতামহের নাম জিজ্ঞাসা করিয়া নিজের পিতৃত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইয়া তাহাকে বাড়ী লইয়া গেলেন। ঘটনাটি আমার নিকট এত অদ্ভুত মনে হইয়াছিল যে ৭৫ বৎসর পরে আজও তাহা মনে আছে। যতদূর মনে পড়ে সেখানে উপস্থিত বৃদ্ধের দল কিঞ্চিৎ হাস্যকৌতুক করিলেও বিশেষ আশ্চর্য বোধ করিলেন না। ইহাতে মনে হয় তাঁহাদের কাছে এরূপ ব্যাপার খুব নূতন বা অদ্ভুত মনে হয় নাই। কিন্তু, পরবর্তীকালে নিজের এই অভিজ্ঞতায় আমার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে প্রথাবদ্ধভাবে পবিত্র বিবাহপদ্ধতির এরূপ অবমাননা এবং স্ত্রীর প্রতি এরূপ অশ্রদ্ধার চিত্র বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও দেখা যায় না। নানা দেশের ইতিহাস পড়িয়াও আজ পর্যন্ত আমার মনে সেই ধারণাই আছে। এইরূপ প্রথার অবশ্যম্ভাবী ফলে কুলীন ব্রাহ্মণের পরিবার নানারূপ ব্যভিচারের ক্ষেত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, আর হিন্দুসমাজ সমস্ত জানিয়া-শুনিয়াও যে শতাব্দীর-পর-শতাব্দী এই অবস্থা মানিয়া চলিয়াছিল, ইহা হিন্দুর অধঃপতনের একটি চরম নিদর্শন বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে।
উনিশ শতকে ইংরেজীশিক্ষার ফলে বাংলা দেশে বহু-বিবাহের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন হয়। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে ২৩শে এপ্রিল তারিখের ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একখানি পত্রে ২৭ জন ব্রাহ্মণের নাম, ধাম ও স্ত্রীর সংখ্যা উল্লিখিত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে ৩ জনের স্ত্রীর সংখ্যা ৬০ বা ততোধিক, ৩ জনের ৫০ হইতে ৬০, ২ জনের যথাক্রমে ৪৭ ও ৪০, ২ জনের যথাক্রমে ৩৪ ও ৩৭, ৭ জনের ২০ হইতে ৩০, ৯ জনের ১০ হইতে ২০, ও একজনের মাত্র ৮। আমার বাল্যকালে আমাদের গ্রামের দুই কুলীন ভ্রাতার প্রত্যেকের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৫০ হইতে ৬০। সুতরাং ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথমেও এই কুপ্রথার বিশেষ পরিবর্তন হয় নাই। বিদ্যাসাগর বহু-বিবাহ’ নামক পুস্তকে এই প্রথার তীব্র নিন্দা করিয়া লিখিয়াছেন, “এ দেশের ভঙ্গ কুলীনদের মত পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই। তাঁহারা দয়া, ধৰ্ম্ম, চক্ষুলজ্জা ও লোকলজ্জায় একেবারে বর্জিত।” বাংলা দেশের নব্য সম্প্রদায় সতীপ্রথার ন্যায় বহু-বিবাহের বিরুদ্ধেও আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিলেন। ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে বন্ধুবর্গ সমবায়’ বা ‘সুহৃদ সমিতি’ নামক সভা হইতে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় বহু-বিবাহ নিবারণের জন্য একটি আবেদনপত্র পাঠানো হয়।
ইহার অল্পকাল পরেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভারত-সরকারের নিকট এ বিষয়ে আবেদন করেন এবং ইহার পরে বাংলা দেশ হইতে কয়েক হাজার লোকের স্বাক্ষরিত ১২৭খানি আবেদনপত্র ভারত-সরকারের নিকট প্রেরিত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা বহু-বিবাহ নিষিদ্ধ করা সঙ্গত কিনা ইহা লইয়া বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে মতভেদ হইল। অন্যদিকে বাংলার প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ বহু বিবাহ সমর্থন করায় বিদ্যাসাগর তাঁহাদের মতামত, যুক্তি ও শাস্ত্রীয় প্রমাণের অসারতা প্রতিপাদন-পূর্বক বহু-বিবাহের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় একখানি পুস্তক লেখেন। ইহার ফলে এই আন্দোলন বাংলা দেশের সর্বত্র বিস্তৃত হয়।
এই প্রসঙ্গে পূর্ববঙ্গের রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ইংরেজীতে অনভিজ্ঞ ও প্রাচীন সম্প্রদায়ের লোক হইলেও বহু-বিবাহের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নানা স্থানে ঘুরিয়া বক্তৃতা দেন, গ্রন্থ প্রকাশ করেন ও অনেক ছড়া ও গান রচনা করেন। সেগুলি বহুদিন লোকের মুখে-মুখে ফিরিত। অন্যান্য অনেকেও এইরূপ ছড়া রচনা করিয়াছিলেন। তাহার একটি উদ্ধৃত করিতেছি। যাহাতে তদানীন্তন বাংলার ছোটলাট ক্যাম্বেল রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা বহু-বিবাহ প্রথা রহিত করেন তজ্জন্য মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে অনুরোধ করিয়া এই লৌকিক গীতটি রচিত হইয়াছিল।
“কেম্বলকে মা মহারাণী কর রণে নিয়োজন।
(রাজা) বল্লালেরি চেলাদলে করিতে দমন।
কাজ নাই সিক সিফাইগণ, চাইনা গোলা বরিষণ,
(একটু) আইন অসি খরষাণ করগো অর্পণ,
বিদ্যাসাগর সেনাপতি
(মোদের) রাসবিহারী হবে রথী,
মোরা কুলীন যুবতী সেনা হব যে এখন।”১০৩
১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর ও বর্ধমানের মহারাজা বহু-বিবাহ নিষিদ্ধ করিবার জন্য আইনসভায় আবেদন করেন। অপরদিকে রাধাকান্ত দেব ইহার স্বপক্ষে আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। নানা কারণে বহুদিন ইহার আলোচনা স্থগিত থাকে এবং ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা গভর্নমেন্ট এই বিষয়টি বিবেচনার জন্য বাঙ্গালী ও ইংরেজ সদস্য লইয়া একটি কমিটি গঠন করেন। বিদ্যাসাগর ব্যতীত আর সকল বাঙ্গালী সদস্যই এ-বিষয়ে সরকারী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই মতের সমর্থন করেন। সুতরাং গভর্নমেণ্ট এই বিষয়ে আইন করিতে অস্বীকার করিলেন। ইহার পর বহু বর্ষ অতীত হইয়াছে এবং আইনের সাহায্য ছাড়াও কুলীনের বহু-বিবাহ প্রথা রহিত হইয়াছে।
৯. দাসত্ব-প্রথার উচ্ছেদ [১০৪]
খুব প্রাচীনকাল হইতেই ভারতে দাসত্ব-প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু প্রাচীনকালে গ্রীস ও রোমে এবং আধুনিক যুগে আমেরিকায় ক্রীতদাসদের উপর যে নিষ্ঠুর অত্যাচার হইত তাহার তুলনায় এদেশে দাসদাসীদের অবস্থা অনেক ভাল ছিল। তাহারা অনেকটা পারিবারিক ভূতের ন্যায় ব্যবহার পাইত। বাংলা দেশে এখনও দাসদাসী শব্দ সাধারণ বেতনভোগী ভৃত্য’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে কয়েকজন ইংরেজ কর্মচারী একটি সরকারী রিপোর্টে ইহা স্বীকার করিয়াছেন। তবে কোন কোন স্থলে যে ক্রীতদাসদের উপর নানাবিধ অত্যাচার হইত সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। দাসের কপালে তপ্ত লোহার দাগ দিয়া চিহ্নিত করার প্রথা প্রচলিত ছিল।
নানা কারণে ক্রীতদাসের উদ্ভব হইত। ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে এক বিধান অনুসারে বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত দস্যুদের পরিবারবর্গ দাস-শ্রেণীভুক্ত হইত। দুর্ভিক্ষের সময় অনেকে প্রাণরক্ষার জন্য নিজেকে ও সন্তান-সন্ততিকে অন্যের নিকট বিক্রয় করিত। অনেক সময় অর্থলোভে লোকে যুবতী কন্যা বা স্ত্রীকে বিক্রয় করিত ধনীরা ইহাদিগকে ক্রয় করিয়া উপপত্নীরূপে রাখিত। দাস-ব্যবসায়ীদের ভাড়াটিয়া গুণ্ডারা বালক-বালিকা চুরি করিত এবং বলপূর্বক বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষকে ধরিয়া নিয়া নৌকাযোগে কলিকাতায় ও অন্যান্য শহরে আনিত। আবার সেখান হইতে আরও দূরদেশে দাসরূপে চালান দিত। ইংরেজ, পর্তুগীজ, ফরাসী, আর্মেনিয়ান প্রভৃতি এই দাস-ব্যবসায়ে প্রচুর লাভ করিত।
আঠারো ও উনিশ শতকে কলিকাতায় সাহেবেরা বহু দাসের মালিক ছিল ও তাহাদের উপর নানারূপ অত্যাচার করিত। এইসব দাসেরা নফর, হুঁকাবরদার, বর্কাদার (মেসিনের চাকা ঘুরাইয়া জল ঠাণ্ডা করার লোক), পা-টানা, সহিস, নাপিত, মেথর প্রভৃতির কার্যে নিযুক্ত হইত। ক্রীতদাসীরা মেমসাহেবদের চুলবাঁধা, পোশাক পরান, এবং যাবতীয় গৃহকর্ম করিত। ইহারা কোন মাহিনা পাইত না। সাহেবের মৃত্যু হইলে তাহার দাসদাসী উত্তরাধিকারীরা পাইত। বাঙালীরা উচ্চ ইংরেজ রাজকর্মচারীদিগকে দাস উপহার দিত। অনেক দাসের মালিক কলকারখানায় ও কৃষি-মজুররূপে দাসগুলি ভাড়া দিয়া বহু অর্থ লাভ করিত। সাধারণ সম্পত্তির ন্যায় প্রকাশ্য স্থানেও দাসদাসীর ক্রয়-বিক্রয় হইত। মালগুদামে হাতে-পায়ে শিকল-বাঁধা দাসদাসীরা সারি বাধিয়া দাঁড়াইত-ক্রেতাগণ তাহাদিগকে পছন্দ করিয়া ক্রয় করিত। অনেক বাজারে বান্দা, গোলাম প্রভৃতি নামে পরিচিত ক্রীতদাসের দল খুঁটিতে বাঁধা থাকিত, যাহাতে লোকে দেখিয়া তাহাদিগকে কিনিতে পারে।
অনেক সাহেব ও মেমসাহেবেরা এই সমুদয় দাসদাসীকে পশুর ন্যায় খাটাইতেন; কোনমতে জীবন রক্ষা পায় এই পরিমাণ আহার্য দিতেন, উপরন্তু সামান্য দোষত্রুটি হইলে চাবুক মারিতেন। মেমেরা এবিষয়ে অগ্রণী ছিলেন, কেবল দাসী নহে দাসদেরও স্বহস্তে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করিতেন। অনেক দাসদাসীর শরীর হইতে রক্তস্রোত বহিত। সারাদিন খাঁটিয়া অনেক দাসকে খাঁচায় রাত্রি যাপন করিতে হইত। একজন ওলন্দাজ মহিলা লিখিয়াছেন, ক্রীতদাসীদিগকে প্রহারে জর্জরিত করা হইত এবং সামান্য অপরাধে পরিবারস্থ লোক ও অন্যান্য দাসদাসীর সম্মুখে সম্পূর্ণরূপে উলঙ্গ করিয়া শীতকালেও তাহাদের গায়ে ঘড়া ঘড়া ঠাণ্ডা জল ঢালা হইত।১০৫
ক্রীত দাসদাসীদের শাস্তি দিবার জন্য কলিকাতায় ইতরশ্রেণীর লোকদের দ্বারা পরিচালিত কয়েকটি বেত্র-গৃহ (whipping-house) ছিল। চুরি, বাসনপত্র ভাঙ্গা, প্রভৃতি অপরাধ করিলে অল্পবয়স্কা ক্রীতদাসীদের সেখানে পাঠান হইত। প্রত্যেক বেত্রাঘাতের জন্য মালিককে এক আনা দিতে হইত। কয়বার বেত্রাঘাত করিতে হইবে ইহা একখানি কাগজে লিখিয়া উপযুক্ত মূল্যসহ ক্রীতদাসীগণকে সেখানে পাঠান হইত। বলা বাহুল্য, বেত্রাঘাত ছাড়াও তাহাদের উপর পাশবিক অত্যাচার হইত। অনেক সময় ক্রীতদাসীগুলি সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িত। কোন দাসদাসী পলাইবার পর ধরা পড়িলে ম্যাজিষ্ট্রেট তাহাকে বেত্রদণ্ডের শাস্তি দিতেন।
বিলাতে দাসত্ব-প্রথার লোপ হইলে এদেশেও তাহার প্রতিক্রিয়া হয়। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে দাস চালান দেওয়া নিষিদ্ধ হয়। ১৮০৭ খ্রীষ্টাব্দে দাস-ব্যবসায় বেআইনী বলিয়া ঘোষিত হয়। ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দে বিদেশ হইতে ভারতে দাস আনা বন্ধ করা হয়। এক জিলা হইতে দাস কিনিয়া আনিয়া অন্য জিলায় বিক্রয় করা ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া পরিগণিত হয়। ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে দাসত্ব প্রথা বেআইনী বলিয়া ঘোষিত হয়। ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় পিনাল কোডে দাস প্রথা বা দাস-ব্যবসায় দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য করা হয়। এইরূপে একটি বর্বর প্রথা তিরোহিত হয়।
***
পাদটীকা
(সাংকেতিক চিহ্ন : ঘোষ=শ্রীবিনয় ঘোষ প্রণীত “সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র”। প্রথম সংখ্যাটি খণ্ড ও দ্বিতীয় সংখ্যাটি পৃষ্ঠার নির্দেশক)।
১. ইহাদের বিবরণ পরবর্তী অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য।
২. শ্রীবিনয় ঘোষ এ-সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন, ঘোষ ৫১৬৯-২২৬ পৃষ্ঠা
৩. ঘোষ ৫। ১৬৯
৪. ঐ, ১৭০
৫. ঐ
৬. ঐ, ১৭২
৭. ঐ, ১৭৩
৮. ঐ, ৩। ৪৮
৯. ঐ, ২। ৯৭-১০৩
১০. ঐ, ৩। ৩৭৫
১১. ঐ, ৩২৬
১২. ঐ, ১। ৪৬৯-৭০
১৩. ঐ, ৩। ৫১-৫২
১৪. ঐ, ৫২-৫৩
১৫. ঐ, ৩৩৭
১৬. ঐ ১। ৪৮২
১৭. ঐ, ১৫১-৫২, ২১২
১৮. ঐ, ৩। ৫৭১-৭২
১৯. এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড (মধ্যযুগ)
২০. ঘোষ ১৫১০-১১
২১. The Days of John Company, Selections from Calcutta Gazette 1824 1832. Compiled and edited by Anil Chandra Das Gupta, pp. 155-6
২২. ঘোষ ২৫৮
২৩. ঐ, ৪১৯
২৪. ঐ ১। ৪৩৪-৩৫
২৫. ঐ, ৩৪৯৮
২৬. Calcutta Gazette (২১নং পাদটীকা) ১৫৬, ৪১৯ পৃ.
২৭. ঘোষ ৪। ৭৯৩-৯৪
২৮. ঐ, ৮১০
২৯. ঐ, ২। ২১৮-১৯
৩০. ঘোষ ২৭০-৭১
৩১. ঐ, ১। ৪৩৫
৩২. ঐ, ৩। ৪৮৯-৯০
৩৩. ঐ, ৫২৩
৩৪. ঐ, ৩৩১-৩২
৩৫. ঐ, ৫২৩-২৪
৩৬. ঐ, ৪৭৬-৭৭
৩৭. ঐ, ৪। ৭০২-৪
৩৮. ঐ, ৭০৫
৩৯. ঐ, ৩০৫
৪০. ঐ, ৩০৯-১১
৪১. ঐ, ৭০১
৪২. ঐ, ৭০০-৭০১
৪৩. ঐ, ১০০৭
৪৪. ঐ, ১। ৫৩৫
৪৫. ঐ, ৫৩৬। এখন যেখানে বিডন স্কোয়ার, আগে সেখানে একটি বিরাট মাঠ ছিল; সেখানেই এই খেলা হইত।
৪৬. Buckland, C.F., Bengal under the Lieutenant Governors, Vol. I, p. 177. R.C. Majumdar, Glimpses of Bengal in the Ninettenth Century, pp. 15, 69-70.
৪৭. Buckland, op. cit., p. 323
৪৮. ঘোষ পৃ. ৪২৮
৪৯. ঐ, ১৪৩২
৫০. ঐ
৫১. ঐ, ৩৪৫৯
৫২. ঐ, ৪১২০-২১
৫৩. ঐ, ২০৬-৭
৫৪. ঐ, ২৬০-৬১
৫৫. ঐ, ৩১২-১৫
৫৬. ঐ, ৩৭০-৭১
৫৭. ঐ, ৩৬১-২
৫৮. শিবনাথ শাস্ত্রী-রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ
৫৯. রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত, কলিকাতা ১৩৫৯, পৃ. ৪৫-৪৬
৬০. ঘোষ ২।১৩৯
৬১. ঐ, ৫০৮-১১
৬১ (ক). Reginald Heber, Narrative of a Journey from Calcutta to Bombay 1824-5 (London, 1828), Vol. III, pp.232, 234, 252.
৬২. ঘোষ ২।২৩৭-৪৩
৬৩. ঐ, ৩৪৪-৪৬।
৬৪. ঐ ৪। ৩৬৯-৭০
৬৫. ঐ, ২। ৩৩৪-৩৫
৬৬. সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক নিবর্তকের দ্বিতীয় সংবাদ। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় “রামমোহন রায়, পৃ. ৭৪-৫
৬৭. ঘোষ ৩৪৭১
৬৮. ঐ, ১৩০৬
৬৯. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-সংবাদপত্রে সেকালের কথা (সং, সে.ক) ২।১৮৬
৭০. ঐ, পৃ. ১৮৭
৭২. W. Adam, Reports on Vernacular Education in Bengal and Bihar 1835 1836 and 1838.
৭২. ব্রজেন্দ্রনাথ সং, সে, ক, ১। ৪০৫
৭৩. ঐ, ৪০৭।
৭৪. এই বিষয়ে বিস্তৃত বিস্তৃত বিবরণের জন্য History and Culture of the Indian People (Bomby) Vol. X, pp. 285 ff. 164
৭৫. বজেন্দ্রনাথ-সং, সে, ক, ১১৩-১৫; ২৬৭; ৩।২২১
৭৬. The Calcutta Review, 1855, p. 79
৭৭. ঘোষ ৪৪৮৯
৭৮. ঐ, ৫০৮
৭৯. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ১৪৮-৪৯
৮০. ঘোষ ৪৫২৩-২৫
৮১. ঐ, ৫২৫
৮২. ঐ, ৫৭৮
৮৩. ঐ, ৫৮০
৮৪. বিস্তৃত বিবরণের জন্য ইংরেজিতে লিখিত প্রতাপচন্দ্র মজুমদার বিরচিত কেশবচন্দ্রের জীবনী (৯০-৯২ পৃ.) দ্রষ্টব্য।
৮৫. ঘোষ ১৩০৫
৮৬. ঐ, ৩০৯
৮৭. ঐ, ৩৬৫
৮৮. ব্রজেন্দ্রনাথ, সং, সে, ক, ১৪০৫
৮৯. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর, ১৩৮-৩৯
৯০. ঐ, ১৪২-৪৩
৯১. ঘোষ ৪। ৫১৯
৯২. ঐ, ১৩১১
৯৩. ঐ, ৩১৩
৯৪. ঐ, ১৩১৪-১৭; ৪৫০৮; ৫১৯-২০; ৫৭১-৫৭২
৯৫. এই ব্যঙ্গাত্মক কবিতায় হেমচন্দ্র বঙ্গনারীর বহু নিন্দা করিয়াছিলেন।
৯৬. সতীদাহ প্রথা এবং ইহা রহিত করিবার বিস্তৃত বিবরণের জন্য কালীকিঙ্কর দত্ত প্রণীত Education and Social Amelioration of Women in Pre-Mutiny India তৃতীয় অধ্যায় (৬৩-১২৬ পৃ. এবং Appendix I-VIII) দ্রষ্টব্য।
৯৭. ঐ, পৃ. ৭৯-৮২
৯৮. ব্রজেন্দ্রনাথ সং, সে, ক, ৩১৪৮-৪৯
৯৯. ঐ, ১৪৭
১০০. এই প্রসঙ্গের বিস্তৃত বিবরণের জন্য, বিনয় ঘোষ প্রণীত বিদ্যাসাগর’ (১৬০-২৩০ পৃ.) দ্রষ্টব্য।
১০১. এই বিলের বিরুদ্ধে হিন্দুসমাজে তুমুল আন্দোলন হয়। বিপিনচন্দ্র পাল ইহার সমর্থন করায় একজন তাঁহাকে গুলি করিয়াছিল। (Studies in the Bengal Renaissance, Edited by Atul Chandra Gupta, pp. 433-4)
১০২. বহু-বিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিস্তৃত বিবরণের জন্য বিনয় ঘোষ প্রণীত ‘বিদ্যাসাগর’ (২৩১-২৬২ পৃ.) দ্রষ্টব্য।
১০৩. ঐ, ২৫৮
১০৪. আধুনিক যুগে ‘দাসত্ব প্রথার বিস্তৃত বিবরণের জন্য অমলকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত Slavery in Inida’ চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
১০৫. ঐ, ৫৪-৫৭ পৃ.।