০৭. সব ছন্দই কি সিলেবিক

সব ছন্দই কি সিলেবিক

যা বলবার বলেছি। এখন ছন্দের এই ব্যাপারটাকে আর-এক দিক থেকে দেখা যাক। তিন ছন্দের শারীরিক নির্মাণের উপরে নজর রেখে ভাবা যাক যে, এদের মাত্রা বিচারের কোনও সামান্য কৌশল আছে কি না। সামান্য বলতে এখানে তুচ্ছ কিংবা নগণ্য বোঝানো হচ্ছে না। ইংরেজিতে যাকে বলে “কমন, সামান্য এখানে তা-ই। (দৃষ্টান্ত : ইংরেজদের মধ্যে কেউ রোগা, কেউ মোটা, কেউ ঢাঙা, কেউ বেঁটে, কিন্তু এসব বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও তাদের যে একটা কমন ফ্যাকটর’ বা ‘সামান্য লক্ষণ” সকলের চোখে পড়ে, সেটা এই যে, তারা সবাই দিব্যি গৌরবরন।) এবং “সামান্য কৌশল’ বলতেও আমরা সেই কৌশলকে বোঝাচ্ছি, তিনটি ছন্দের মাত্রাবিচারেই যা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

কিংবা ‘সামান্য কৌশল না-বলে আমরা মাসটার কী’ও বলতে পারি। স্বৰ্গত দীনেন্দ্ৰকুমার রায় ইংরেজি এই ‘মাস্টার কীর ভারী সুন্দর একটি বাংলা করে। দিয়েছিলেন। “সবখোলাচাবি”। কথা হচ্ছে, অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত, এই তিন তালাকেই যা খুলতে পারে, এমন কোনও সবখোল চাবির আশা কি নেহাতই দুরাশা?

মোটেই নয়। সবখোল সেই চাবি আমাদের সামনেই রয়েছে। একটু লক্ষ করলেই আমরা দেখতে পাব যে, স্রেফ সিলেবল-এর চাবি ঘুরিয়েই আমরা তিন

মাত্রার ব্যাপারে, শুধু স্বরবৃত্ত নয়, তিনটি ছন্দই আসলে সিলেবল-এর উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে তারা পরস্পরের সগোত্র। অন্যদিকে, তাদের অমিলটা এইখানে যে, তাদের তিন জনের নির্ভরশীলতা তিন রকমের। যথা, স্বরবৃত্তে যেক্ষেত্রে সিলেবলমাত্রেই অনধিক একটি মাত্রার মূল্য পেয়েই খুশি, মাত্রাবৃত্তে সে-ক্ষেত্রে মুক্ত সিলেবল এক মাত্রার মূল্য পেলেও বুদ্ধ সিলেবল মূল্য পায়। দু-মাত্রার। আবার অক্ষরবৃত্তেও (ঠিক ওই স্বরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তেরই মতো) প্রতিটি মুক্ত সিলেবলকে আমরা এক-মাত্রার মূল্য দিই বটে, কিন্তু বুদ্ধ সিলেবল-এর ক্ষেত্রে আরও-একটু ব্যতিক্ৰম ঘটে যায়।

স্বরবৃত্তে কী মুক্ত, কী বুদ্ধ, কোনও সিলেবলই এক-মাত্রার বেশি মূল্য দাবি করে না; মাত্রাবৃত্তে সেক্ষেত্রে বুদ্ধ সিলেবল সর্বত্র দু-মাত্রা দাবি করে; আর অক্ষরবৃত্তে সেক্ষেত্রে রুদ্ধ সিলেবল কোথাও এক-মাত্রা দাবি করে, কোথাও দু-মাত্রা।

প্রশ্ন : অক্ষরবৃত্তে বুদ্ধ সিলেবল কোথায় এক-মাত্ৰা দাবি করে এবং কোথায় তাকে দু-মাত্রার মূল্য দিতে হয়?

উত্তর : বুদ্ধ সিলেবল যেক্ষেত্রে শব্দের আদিতে কিংবা মধ্যে যুক্তাক্ষরের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করে রাখে, সেক্ষেত্রে সে এক-মাত্রার বেশি মূল্য দাবি করে না; কিন্তু যুক্তাক্ষরের আশ্রয় নিয়েও যেক্ষেত্রে সে শব্দের অন্তে অবস্থিত, কিংবা শব্দের আদিতে বা মধ্যে অবস্থিত হয়েও যেক্ষেত্রে সে যুক্তাক্ষরের আশ্রিত নয়, সেক্ষেত্রে সে দু-মাত্রার মূল্য চায়।

দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। উদ্বন্ধন’ শব্দটি তিনটি বুদ্ধ সিলেবল দিয়ে গড়া। উদ-বন +ধন। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় বুদ্ধ সিলেবল (উদ, বন) যেহেতু যুক্তাক্ষরের আশ্রিত, এবং যেহেতু তাদের প্রথম জনের (উদ) অবস্থান শব্দের আদিতে ও দ্বিতীয় জনের (বন) অবস্থান শব্দের মধ্যে, অতএব অক্ষরবৃত্তে তাদের কেউই এক-মাত্রার বেশি মূল্য চায় না। তৃতীয় জন (ধন) সেক্ষেত্রে যুক্তাক্ষরের আশ্রিত হয়েও শব্দের অন্তে রয়েছে। ফলত অক্ষরবৃত্তে সে দু-মাত্রার মূল্য দাবি করবে। এবং সব মিলিয়ে উদ্বন্ধন’ শব্দটি অক্ষরবৃত্তে পাবে চার-মাত্রার মূল্য (১+১+২)।

যাই হোক, মাত্রা-বিচারের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে সব ছন্দেই সিলেবল নামক ব্যাপারটার ভূমিকা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাই বলেই কি দুম করে আমরা বলে বসব যে, সব ছন্দই আসলে সিলেবিক? না, তা নিশ্চয় বলব না। শুধু বলব যে, সিলেবিক ছন্দে অর্থাৎ স্বরবৃত্তে তো সিলেবলকে ভুলে থাকবার কথাই ওঠে না, উপরন্তু ছন্দটা যেখানে স্বরবৃত্ত নয়, সেখানেও সিলেবলকে ভুলে থাকবার উপায় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *