সপ্তম অধিবেশন
ঘরে-ঘরে বউ জাতির অত্যাচার। সেই অত্যাচার সম্পর্কে আমারও কিছু বলার আছে।
হ্যাঁ-হ্যাঁ বলুন-বলুন। আমরা শোনার অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছি। হাটে হাঁড়ি ভাঙুন।
আমার দাম্পত্য জীবনের বয়েস নিয়ারলি টোয়েন্টি ইয়ারস। সেই টোয়েন্টি ইয়ারস আমার হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গেছে।
বউটি কেমন?
কত রকমের বউ আছে জানেন?
আজ্ঞে না। রকম-রকম বউ নিয়ে ঘর করার সুযোগ হল কই?
বেশ তা যখন হয়নি তখন শুনে নিন। এক বোকা-বোকা ভালোমানুষ ধরনের। এঁদের ঠোঁট তেমন পাতলা নয়। নীচের ঠোঁট সামান্য ঝুলে থাকে। দাঁত উঁদুরের মতো নয়। নাক তেমন তীক্ষ্ম নয় একটু থ্যাবড়া মতো। গোল-গোল চোখ। গোল-গোল মুখ। চুল মোটা বালামচির মতো। এসরাজের ছড়ে ব্যবহার করা চলে। কপালে বড় টিপ পরেন। সেটা কখনই সেন্টারে প্লেস করতে পারেন না। হয় একটু বাঁয়ে না হয় একটু ভাঁয়ে সরে যায়। যত বয়েস বাড়তে থাকে ততই চর্বিযুক্ত হতে থাকেন। চুলের বহর কমতে কমতে শেষে মাথার টঙে একটি বড়ি খোঁপা। গলার স্বর বীণার মতো নয় ফ্লুটের মতো। শব্দে র-ফলা থাকলে জিভে জড়িয়ে যায়। ঋ-ফলারও সেই অবস্থা। দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ ঠিক মতো উচ্চারণ না হয়ে এইরকম শোনাবে–দাবিড় উতকল বঙ। তুমি হাড় কৃপণ বলতে গিয়ে বললেন–তুমি হাড় কিপটে। এঁদের হাঁটা চলায় ভূমিকম্পের এফেক্ট। সিসমোগ্রাফে ধরা পড়বে। রেগে কথা বললে তানসেন। ঘটি বাটি গেলাস আলমারি কাঁচ ঝিনঝিন করে উঠবে। দু একটা বা ফিউজ হয়ে যেতে পারে। ফ্লোরেসেন্টের স্টার্টার কেঁপে উঠবে। এঁরা চুরি করে স্বামীর ব্যাগ থেকে পয়সা বের করতে গেলে মেঝেতে ঝনঝন করে ছড়িয়ে ফেলবেনই। হিসেবে কঁচা। দরজায় ফেরিওয়ালা ডাকার অভ্যাস। দরদস্তুর করে ছটাকার জিনিস আট টাকায় কিনবেন এবং অম্লানবদনে ছেঁড়া নোট ফেরত নেবেন। বয়েসে বাত হবে। ঘনঘন সর্দির ধাত। এই হল টাইপ ওয়ান।
টাইপ টু। বুদ্ধিমান। পাতলা-পাতলা ছিমছাম চেহারা। পাতলা ঠোঁট, পাতলা নাক। নাকের ডগা ঘামে। চোখ টানা-টানা, রাগী-রাগী। হালকা হরধনু ভুরু। পাতলা চুল। সামান্য কেঁচকানো। বেশ লম্বা সামান্য কটা। একটু খোঁচাখোঁচা চেহারা। কপালের টিপ বিন্দুর আকারে সেন্টারে। এঁদের অভিমানের চেয়ে রাগ বেশি। রাগলে নাকের পাটা ফোলে, ঠোঁট কাঁপতে থাকে থিরথির করে। মন ভালো থাকলে গুনগুন গান। হিন্দি ছবির, বাংলা ছবির, সবই অবশ্য দু-লাইন করে। সময় সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত। এঁদের হাঁটা চলা হালকা পায়ে। প্রসাধন প্রিয়। সপ্তাহে একটা বড় সাবান খরচ করে থাকেন। মাসে দু-শিশি শ্যাম্পু। মাথায় খুসকির উপদ্রব। লিভার কমজুরি। মধ্যবয়েসে হাঁপানি হতে পারে। রাগের অভিব্যক্তি গুম হয়ে থাকা। মিনিমাম সাতদিন স্পিকটি নট। তোষামোদ প্রিয়। পিঠে হাত না বুলোলে রাগ পড়ে না! স্বামীদেরই এগিয়ে যেতে হয়–ওগো রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি। যা হয়ে গেছে এবারের মতো ভাব।
এই হল দুটো এক্সট্রিম টাইপ। এদেরই পারমুটেশান কমবিনেশানে আমাদের দেশের যাবতীয় বউ। সকলেই রাগী। কেউ বদরাগী কেউ আবার নিমরাগী। কেউ রেগে গেলে কেঁদে ফেলেন, কেউ খামচাখামচি করেন, কেউ কাপডিশ, জুতো, ঝ্যাঁটা ছোঁড়েন, কারুর হাঙ্গারস্ট্রাইক শুরু হয়ে যায়, কেউ বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, কেউ বাপের বাড়ি যাব বলে সুটকেস গুছোতে থাকেন। সংসারের স্থির জলে এঁরা হলেন উড়ুক্কু মাছ। দেওয়ালের গায়ে বসে শুড় নাড়া আরশোলাও বলতে পারেন। থেকে-থেকেই সংসারের এ-দেওয়াল ও-দেওয়ালে ফরফর করে উড়ে বেড়ান।
এখন বলুন আপনার বউ কোন প্রজাতির?
আজ্ঞে মিক্সড টাইপ। আপনি যেসব লক্ষণ বললেন তার কিছু কিছু মেলে তবে ইনি রেগে গেলে গান করেন আর খাওয়া বন্ধ হয় না বরং বেশি-বেশি খেতে থাকেন।
হুঁ, এঁরা খুবই সাংঘাতিক ধরনের। কোল্ড অ্যান্ড ক্যালকুলেটিং টাইপ। এঁদের সঙ্গে ঘর করতে পারেন। তারাই যারা মোটাসোটা গাবদাগোবদা একটু ব্লান্ট টাইপের। সামান্য ভুঁড়ি থাকবে, হাতে বড়-বড় খসখসে চুলের মতো লোম। চোখ ঘোলাটে লাল। নাকের ছিদ্রে চুল। ঘুমোলে গাঁকগাঁক করে নাক ডাকে। খেয়ে বাছুরের মতো ঢেঁকুর তোলেন। গুতিয়ে বাসে-ট্রামে ওঠেন। নামার স্টপেজ এলে আর ধৈর্য ধরতে পারেন না, সিট থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সদ্যোজাত ছাগলের মতো চঁট ছুঁড়তে-ছুঁড়তে হুড়মুড় করে নেমে যান। স্নানের পর মাথার চুলে সেরখানেক জল থাকবেই আর সেই অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সরু চিরুনি দিয়ে ফচাক-ফচাক করে সামনে টেনে পেছনে উলটে চুল আঁচড়াবেন। আয়নার কাঁচে তেল জলের ছিটে। স্নানের পর স্ত্রীর শাড়িই দুর্ভাঁজ করে কোমরে ফাঁপা গিট দিয়ে একটু উঁচু করে পরবেন এবং খেতে বসার সময় কাঁধে একটা ভিজে লাল গামছা অবশ্যই থাকবে। হাত ধুয়ে প্রথমে পাছায় ভিজে হাত লেপটাবেন তারপর শাড়ির সামনের দিকে মুছবেন। এঁদের কেউ-কেউ মোটরবাইক চালাবেন। হিন্দি সিনেমা প্রিয় হবেন। তারকাঁদের মধ্যে গব্বরকে ভালো লাগবে, নায়িকাঁদের মধ্যে আমান। আড্ডাবাজ হতে হবে। তাস দাবা চলতে পারে। পরস্ত্রীর দিকে অপাঙ্গ দৃষ্টি। ঘরে লালসুতোর বিড়ি বাইরে সিগারেট। সারি আসনে বসলে পা দুপাশে যতদূর সম্ভব ফাঁক করে থাকবেন। প্যান্টের পকেট থেকে পয়সা বা রুমাল বের করার সময় পাশে যিনি থাকবেন তার কোমরে, ওপরে পাঁজরে ইনভেরিয়েবলি খোঁচা মারবেন। ঘুমের ঘোরে হাত পা ছোঁড়ার অভ্যাস থাকবে। হুড়ুম করে পাশ ফিরবেন। পাশে আর কেউ শুয়ে থাকলে খাট থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হবে। সস্ত্রীক বেড়াতে বেরোলে শিশুটিকে নিজেই বুকে বহন করবেন। যানবাহনে সবুক-শিশু যাঁর সামনে দাঁড়াবেন তার প্রাণ বের করে দেবেন। শিশুর পায়ে ধুলোকাদা গোবর মাখা, লাল জুতো। সেই জুতো কখনও কপালে, কখনও গালে, কখনও ধবধবে জামার বুকে এসে সিলমোহরের মতো লাগতে থাকবে। বিরক্ত হলেও ভূক্ষেপ করবেন না। যাকে তেল দেওয়ার দরকার তাকে তেল দেবেন এবং কাজ মিটে গেলে তাকে আর চিনতে পারবেন না। বাড়িতে অচেনা কেউ এলেই ফিউরিয়াস হয়ে জিগ্যেস করবেন–কি চাই? বারোয়ারি পুজোর চাঁদা দেওয়ার সময়ে প্রতিবারই একটা করে লাঠালাঠি ফাটাফাটির নায়ক হবেন।
আপনি কি ওইরকম?
আজ্ঞে না। কিছু কিছু মিলছে তবে পুরোটা নয়।
তাহলে তো নির্যাতিত হতেই হবে। আচ্ছা শোনা যাক।
অতীতের ইতিহাস আমি বলতে চাই না। সে যা হওয়ার হয়ে গেছে। একবার আমাকে চুড়ি মেরেছিল।
সে আবার কি?
আমার শ্বশুমাতা আত্মরক্ষার জন্যেই বোধহয় মেয়ের হাতে কিরিকাটা দুটো বালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। একবার ঘষে দিলেই বিহারি পোকা।
বিহারি পোকা?
সাঁওতাল পরগনায় বর্ষাকালে সন্ধেবেলা একরকমের পোকা ওড়ে। গায়ের পাশ দিয়ে একবার উড়ে গেলেই হল। ছাল ছিঁড়ে কালো ঘা। আমার বউয়ের বালা দুগাছা সেই মাল। বেশি জোরজার করলেই যাও বলে একবার হাতঝামটা। ব্যাস দাগরাজি। সপ্তাহখানেক ভোগো। সুগার থাকলে ঘা শুকোতে মিনিমাম এক মাস। তার ওপর একা রামে রক্ষে নেই দোসর লক্ষ্মণ। হাতে একটি নোয়া। আছে। মুখটা সামান্য ফঁক ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষুরধার। মাথার ওপর দিয়ে একবার হাত ঘোরালেই এক খামচা চুল গন। তার ওপর ব্লাউজে ডেও-ডেও সেফটিফিন। তার ওপর নাকে একটি তিনকোণা পাথরের নাকছাবি। তার ওপর কানে মধ্যযুগের গ্ল্যাডিয়েটারদের ঢালের মতো কানের পাতা চাপা কানপাশা।
এ তো মশাই রণচণ্ডী, খড়গখেটকধারিণী!
আজ্ঞে পরকুপাইন, শজারু গোছের জিনিস। শরীরে লেবেল মেরে দিলেই হয়–হ্যান্ডল উইথ কেয়ার।
এখন এমত একটি বস্তুর আচার আচরণের কয়েকটি নিদর্শন : আমি খেটে খাওয়া মানুষ।
তিনি তো খেটে খাওয়া নারী, আপনার সংসারের যন্ত্রী।
দ্যাটস টু। তবে আমি বেশ খাঁটি। খেটেখুটে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। স্বাস্থ্যের নিয়মে বলে সলিড এইট আওয়ারস ঘুম। ভোর পাঁচটায় আমাদের কাজের লোক আসে। খটাখট কড়ার শব্দ। দরজা খুলে দিতে হবে। দুজনেরই কানে শব্দ আসছে। দুজনেই শুনছি। কে ওঠে, কে খুলে দেয়। মশাই, মটকা মেরে পড়ে থাকে। প্রতিদিন তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এই শর্মাকেই ঘুমচোখে উঠে টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলতে হয়। আর এমন শয়তান যেই এসে বিছানায় শুই অমনি মোলায়েম গলায় জিগ্যেস করে, কি গো খুলে দিয়ে এলে! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। এটা ইউনাইটেড নেশানে তুলে ধরার মতো একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। একেই আমার একটু কুসংস্কার আছে। সকালে আমি কারুর মুখ দেখতে চাই না, দিন ভালো যায় না। সেই আমাকে জোর করে দেখতে বাধ্য করাবে। ওই পাঁচটার সময় সাহস করে আর ঘুমোতে পারি না। ঘুমের সেকেন্ড এডিশান সহজে কাটতে চায় না। ভালো ঘুম হয় না বলে সারাদিনই শরীর খ্যাত খ্যাত করে, হাই ওঠে। এফিসিয়েনসি কমে আসছে বলে জুনিয়াররা টপাটপ প্রোমোশান নিয়ে মাথায় চেপে বসেছে।
এরপর ঝড়বৃষ্টির কাল আসছে, বর্ষা আসছে। সে আর-এক খেলা। সব জানালা খুলে শোয়া হল, মাঝরাতে তেড়ে ঝড়বৃষ্টি এল। আমার এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এমন একটা দিন দেখলাম না যে দিন আমার বউ উঠে জানালা বন্ধ করেছে। মশারি তিমির পেটের মতো ফুলে উঠেছে। হু-হুঁ করে ধুলো ঢুকছে। তিনি শুয়ে আছন কাঠের পুতুলের মতো। এই শর্মাকেই তেড়েফুঁড়ে বেরোতে হবে, সারা বাড়ির যেখানে যত জানালা দুমদাম করে পড়ছে। সব একে-একে জলঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বন্ধ করতে হবে। যেই ফিরে এসে শোব অমনি সেই মোলায়েম গলাসব বন্ধ করেছ তো?
হ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।
রান্না ঘরেরটা?
হ্যাঁ সেটাও।
রান্নাঘরের জানলা দেখেছেন? যমেও ছোঁবে না। হাতময় কালি। একদিন রেগে গিয়ে, হ্যাঁ সেটাও বলি, সেই কালি রাত দুটোর সময় সারামুখে মাখিয়ে দিয়েছিলুম। ভোর পাঁচটায় ট্যাক্সি ডেকে বাপের বাড়ি। হাতে হ্যারিকেন। পনেরো দিন পরে পায়ে ধরে নিয়ে এলুম। শ্বশুমাতা উপদেশ দিলেন– পরের বাড়ির মেয়ে নিয়ে গেছ বাবা, অত্যাচার করলে তোমারই নিন্দে হবে। কি বংশের ছেলে তুমি। এ তো বউয়ের মুখে কালি নয় তোমার বংশের মুখে কালি। তুমি দোলের দিনে মাখাও কেউ কিছু বলবে না। অ্যালুমিনিয়াম মাখাও, আলকাতরা মাখাও, গরুরগাড়ির চাকার কালি মাখাও, বচ্ছরকার দিনে কেউ কিছু বলবে না। মজা দেখুন, শ্বশুরবাড়ির কাউন্সিলে আমাদের কেস আনরিপ্রেজেন্টেড। আমাদের পক্ষে কেউ বলার নেই, কেউ শোনার নেই। সেন্টার টেবিলে স্টেনলেস স্টিলের থালা। চারটে ফুলোফুলো বাদামি লুচি। কড়কড়ে আলু ভাজা। দুটো রসগোল্লা। ঢাউস এককাপ চা। সামনে চশমা চোখে সিগারেট মুখে গম্ভীর শ্বশুরমশাই। আর-এক চেয়ারে ষণ্ডামার্কা আধুনিক চেহারার শ্যালক। ঘরের মাঝখানে কাঁচাপাকা চুল ক্ষয়ক্ষয়া শাশুড়ি। দরজার বাইরে পরদা ধরে ম্যাকসিপরা মহা আদুরি শ্যালিকা। লুচি সহযোগে উপদেশ শুনে বউ বগলে বাড়ি। বউয়ে অরুচি!
নাও কাম টু দি পাখা প্রবলেম। খাটের ধারে শোবেন বউ। দেওয়ালের দিকে শোবেন স্বামী। যুক্তি–আমাকে তো ভোরে উঠতে হবে, টুক করে পাশ থেকে খসে পড়ব, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে না।
অফিসের ভাত ধরায়। সাত খুন মাপ। কিন্তু আমাকে যে বাথরুমে যেতে হয়।
বাথরুমে যাবে কেন? শোওয়ার আগে বেশ করে জল খেয়ে ঘণ্টাখানেক বসে-বসে মশার কামড় খাও তারপর বাথরুম করে একেবারে ড্রাই হয়ে শুয়ে পড়ো। রাতে বারেবারে উঠতে নেই খোকাবাবু। টানা ঘুমোতে হয়। এক ঘুমে রাত কাবার।
বেশ বাবা তাই হোক। শ্বমাতা বলেছেন স্বামী মানেই স্যাক্রিফাইশ। সন্ন্যাসীও স্বামী, বউয়ের বরও স্বামী।
কিন্তু ম্যাডাম আসল খেল তো শুরু হবে শোওয়ার পর।
মশারির ভেতর তিনি, বাইরে তার ঝুলন্ত পা জোড়া। পাতায়-পাতায় ঘষে ধুলো ঝরাতে ঝরাতেই গোটাকতক মশা ঢুকবে। এরপর তিনি ভেতরে পা টেনে নিতে-নিতেই আরও গোটাকতক। এরপর চুড়িবাদ্য করতে-করতে লটরপটর হাতে মশারি খুঁজতে-গুঁজতে আরও খানকতক। এইবার খোঁপা আলগা করে শয়ন ও হাই উত্তোলন–আলো নেবাও।
হয়ে গেল আমার পড়া। চোখে আলো পড়লে ঘুম হবে না। ঘুম না হলে ভোরে ওঠা যাবে না। দায় আমার। আলো নিবল। একটু উসখুস। দু-চারবার পায়ের পাতায়-পাতায় ঘষাষষি।
উঃ মশা ঢুকেছে। আলো জ্বালো।
আলো জ্বলল।
–নাও মশা মারো।
হাঁটু গেড়ে মশারির আয়তক্ষেত্রের ভেতরে এক বাহু থেকে আর-এক বাহুতে আমার ছোটাছুটি আর দুহাতে তালি। মশা কি অত সহজে মরে! তিনি শুয়ে-শুয়ে নির্দেশ দিতে থাকবেন।
–ওই যে ওই যে, ওই তো ওই কোণে, ওই কোণে। হা-হা উড়ে এদিকে চলে এল। ধ্যাস ল্যাদাডুস। মশা মারতেও শেখোনি, চাকরি করো কি করে!
মশার সঙ্গে গাদি খেলা। শেষে তাঁর দয়া হবে।
–নাও নিবিয়ে দাও, হয়েছে-হয়েছে।
আবার আলো নিবল। ঘুম আসছে-আসছে। গলা শোনা গেল।
–শালা খুব জ্বালাচ্ছে।
–কে?
–মনে হয় একটা পুরুষ মশা।
–কি করে বুঝলে পুরুষ মশা?
–তা না-হলে কানের কাছে এত গুনগুন করে গান গাইবে কেন? কামড়াবি কামড়া। তোমার মতো স্বভাব আর কি! একবার শুরু করলে চাপড় না খাওয়া পর্যন্ত থামতে চাও না।
–বেশ তা না-হয় হল। স্বামী আর মসকুইটো এক শ্রেণীর মাল, তা আমাকে এখন কি করতে হবে?
–মারতে হবে। আলো জ্বালো।
আলো জ্বেলে আবার মশার সঙ্গে এক চক্কর চোর পুলিশ খেলা। আবার শুতে-শুতেই বায়নাক্কা–হে প্রাণনাথ গলা শুকিয়ে গেছে, এক গেলাস জল। মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে জলের গেলাস নিয়ে আধশোয়া হয়ে আলগোছে ঢকঢক করে জল খেয়ে একটি প্রাণঘাতী শব্দ ছাড়া হল–আঃ। বিছানার বাইরে আমি দাঁড়িয়ে আছি মহারানির খাস ভৃত্য। গেলাসটা নিয়ে রেখে দিতে হবে।
গেলাস রাখতে-না-রাখতেই হুকুম মনে হয় অম্বল হয়ে গেল, দুটি জোয়ান দাও তো গো।
জোয়ান খেয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়া হল। খাট কেঁপে উঠল। ভাবলুম শেষ হল। অতই সহজ!–পাখাটা পুরো করে দাও। বেশ তাই করে দি। বিছানায় এসে শুয়েছি। বেশ ঘুম আসছে। দুচোখ জুড়ে। শুনছ? হ্যাঁ গো শুনছ?
–বল।
–পাখাটা তিন করে দাও, শীত-শীত করছে।
–তুমি করে দাও না!
–আমি শুয়ে পড়েছি। নামতে গেলেই মশা ঢুকে যাবে, পায়ে ধুলো লেগে যাবে।
–আমারও তো তাই হবে।
–তুমি নামার কায়দা জানেনা, তোমার চটি আছে।
বউকে টপকে খাট থেকে নেমে রেগুলেটর ঘুরিয়ে তিনে করে দিলুম। তারপর আবার বউ লঙঘন করে নিজের জায়গায় শুলুম। আবার ঘুম আসছে।
–শুনছ?
–কি হল প্রাণেশ্বরী?
–সুবিধে হল না। ভোলটেজ ড্রপ করেছে। তুমি-আর একবার কষ্ট করে ফুল পয়েন্টে করে দিয়ে এসো, লক্ষ্মীটি।
আবার ঘাড়ের ওপর দিয়ে হুড়মুড় করে মেঝেতে এসে পড়লুম। এবার খুব রেগে গেছি। আর শোওয়া নয়। টুলে বসেই রাতটা কাটিয়ে দিই, জরুকা গোলাম।
–কি হল, শোবে না?
–শুয়ে তো লাভ নেই। আবার ওঠাবে, ভোলটেজ বাড়বে কমবে, ভোলটেজ স্টেবিলাইজার হয়ে বাইরেই বসে থাকি।
–রেগে যাচ্ছ কেন? কত সহজেই তোমরা রেগে যাও। একটুও সহ্য শক্তি নেই। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলে গেছেন তিনটে স–শ ষ স সহ্য কর, সহ্য কর, সহ্য কর তিনবার। নাও চলে এসো। এবার শীত করলে তোমাকে জড়িয়ে ধরে শোব।
মশাই এই হল আমার রাত। দিনের কথা শুনলে আঁতকে উঠবেন।