সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তগ্রামের যুদ্ধ
সন্ধ্যা আগত প্রায়, পশ্চিমে আম্রপণসের কুঞ্জে ভগবান্ মরীচিমালী আশ্রয় লাভ করিয়াছেন, বিশাল সপ্তগ্রাম নগরের অসংখ্য পথে সহস্র সহস্র দীপ জ্বলিয়া উঠিয়াছে। একটি প্রশস্ত রাজপথের পার্শ্বে দ্বিতল অট্টালিকার উপরে বারাণ্ডায় বসিয়া আমাদের পরিচিতা যুবতী সেতার বাজাইতেছিলেন, তাহার পার্শ্বে একখানি গালিচার উপরে বসিয়া ফতেমা চাঁদির বাটা লইয়া পান সাজিতেছিল এবং নাজীর আহমদ্ সঙ্গত করিতেছিল; বারাণ্ডার এক কোণে দাঁড়াইয়া বুড়া হবিব চাঁদির কলিকায় ফুঁ দিতেছিল। পুরবী কেদারা পুরিয়া ও গৌরী দুই তিন বার বাজিয়া গেল। অন্য দিন সপ্তগ্রাম সহরের মধ্যস্থলে প্রকাশ্য রাজপথে রূপসী যুবতীর সেতারের আওয়াজ শুনিলে লোক জমিয়া যাইত; কিন্তু আজি সপ্তগ্রামের পথে অসম্ভব জনতা, নগরের চারিদিক হইতে ভীষণ কোলাহল উত্থিত হইতেছে, সেতারের মিঠা আওয়াজ কাহারও কাণে পৌঁছিতেছে না। কোলাহল ক্রমশঃ বাড়িতে লাগিল, যুবতী বিরক্ত হইয়া সেতার রাখিল। এই সময়ে ভীষণ কোলাহল ভেদ করিয়া “ফিরিঙ্গি আসিল, ফিরিঙ্গি আসিল, বাজার লুটিবে” শব্দ উঠিল। দোকানদারগণ দোকানপাট বন্ধ করিতে আরম্ভ করিল। ফিরিঙ্গি আসিতেছে শুনিয়া যুবতী, ফতেমা ও নাজীর আহমদ্ উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল; সহসা নাজীর আহমদ বলিয়া উঠিল, “বিবি সাহেব, সর্ব্বনাশ হইয়াছে, আমার ত আফিম ফুরাইয়াছে, আমাকে এখনই একবার বাজারে যাইতে হইবে।” যুবতীর মুখ শুকাইয়া গেল, সে কহিল, “সে কি নাজীর? এই হাঙ্গামার মধ্যে আমাদের ফেলিয়া কোথায় যাইবে?” বুড়া হাতযোড় করিয়া কাতর কণ্ঠে কহিল, “দোহাই বিবি সাহেব, বুড়া মানুষ আফিম না পাইলে এখনই মরিয়া যাইব, দোকান পাট সব বন্ধ হইয়া গেল।” বুড়া বারাণ্ডার দুয়ারের দিকে অগ্রসর হইল, তাহা দেখিয়া যুবতী তাহার হাত ধরিল এবং কাতর কণ্ঠে কহিল, “নাজীর, এমন সময়ে আমাদের একা ফেলিয়া যাইও না।” সে শব্দ পাছে তাহার কর্ণে প্রবেশ করে সেই ভয়ে বৃদ্ধ কাণে আঙ্গুল দিয়া হাত ছাড়াইয়া পলাইল। তখন যুবতী হতাশ হইয়া বসিয়া পড়িল। নগরের কোলাহল বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, দেখিতে দেখিতে সপ্তগ্রামের অসংখ্য বিপণির সহস্র সহস্র দীপ নিবিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ নিঃশব্দে রোদন করিয়া যুবতী প্রৌঢ়াকে কহিল, “ফতেমা, এখন কি করিব? কোথায় যাইব? কি উপায় হইবে?” ফতেমা কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, “উপায় খোদার হাতে। তুমি কথা শুনিতে চাহ না, সপ্তগ্রামে না থাকিয়া আজি যদি জাহাঙ্গীর নগরে যাইতে তাহা হইলে কি এ বিপদে পড়িতে?”
“তোমার কথা শুনিয়া আজ বজ্রা ছাড়িলে এতক্ষণ হুগলী বন্দরে গেরেফ্তার হইতাম।”
“তাহাও ত বটে।” হবিব্ এতক্ষণ নীরবে বসিয়াছিল, সে বলিয়া উঠিল, “বিবি সাহেব, বিপদের সময় কাঁদিলে কি ফল হইবে? আমি দুয়ারটা বন্ধ করিয়া আসি।” হবিব্ উঠিয়া গেল এবং ক্ষণকাল পরে একখানি পুরাতন মরিচাধরা তলোয়ার অনিয়া তাহাতে শাণ দিতে বসিল। যুবতী অশ্রুপুর্ণনেত্রে হাসিয়া কহিল “হবিব, ভাঙ্গা তলোয়ার খানা কোথায় পাইলে?” হবিব্ গম্ভীর ভাবে কহিল, “আমার বাপ দাদার ছিল, আমার দাদা আক্বর বাদশাহের ফৌজে আহদী ছিলেন।”
“তলোয়ার লইয়া কি করিবে?” “কাফের ফিরিঙ্গির সহিত লড়াই করিব।” “তুমি কি লড়াই করিতে জান?” “জানি না জানি, দুই একটার ত মাথা লইতে পারিব।” “তাহারা যে বন্দুক লইয়া লড়াই করিবে?” “মরি স্বর্গে যাইব। বুড়া হবিব্ বাঁচিয়া থাকিতে তোমার গায়ে কেহ হাত দিতে পারিবে না।” “হবিব্ আমি নিজের ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছি।” “কি?”
যুবতী আঙ্গরাখার ভিতর হইতে একটি ছোট রূপার কৌটা বাহির করিল। হবিব্ উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “উহাতে কি আছে?” যুবতী হাসিয়া কহিল, “জহর।” ফতেমা শিহরিয়া উঠিল। এই সময় দূর হইতে বন্দুকের আওয়াজ আসিতে লাগিল, হবিব্ কহিল, “বিবি, আর বারান্দায় থাকিয়া কাজ নাই, ঘরের ভিতরে চল।” তিন জনে বারান্দা ত্যাগ করিয়া কক্ষে প্রবেশ করিলেন, হবিব্ সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া পুনরায় তলোয়ার শানাইতে বসিল।
ক্ষণকাল পরে দূর হইতে আর্ত্তনাদ শুনা গেল, ক্রমে তাহা নিকটে আসিতে লাগিল। সহসা কে অট্টালিকার দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলিল। যুবতী বিষের কৌটা বাহির করিল; কিন্তু ফতেমা তাহার হাত ধরিয়া ফেলিল। সেই সময়ে কক্ষের রুদ্ধদ্বার ভাঙ্গিয়া পাঁচ সাত জন ফিরিঙ্গি প্রবেশ করিল। হবিব্ তাহার ভাঙ্গা তলোয়ার হাতে করিয়া ফিরিঙ্গিদিগের সহিত লড়াই করিতে উদ্যত হইল; কিন্তু একজন ফিরিঙ্গির সঙ্গিনের আঘাতে তাহার তলোয়ার ভাঙ্গিয়া গেল, দ্বিতীয় ফিরিঙ্গির বন্দুকের আঘাতে তাহার চেতনা লুপ্ত হইল, এবং তৃতীয় ফিরিঙ্গি হবিবের হতচেতন দেহ পদাঘাতে দূরে নিক্ষেপ করিল।
তখন ফিরিঙ্গিগণ যুবতী ও ফতেমাকে বন্ধন করিয়া লুণ্ঠনে মনঃসংযোগ করিল এবং কিয়ৎক্ষণ পরে তাহাদিগকে লইয়া অট্টালিকা পরিত্যাগ করিল। পথে সহস্র পুরুষ ও স্ত্রী বালক ও বালিকা ফিরিঙ্গিদিগের হস্তে বন্দী হইয়া দাঁড়াইয়াছিল; তাহাদিগের দুই দিকে বন্দুক হাতে শ্রেণীবদ্ধ ফিরিঙ্গি সেনা পাহারা দিতেছিল। ফতেমা ও যুবতী বন্দীদিগের নিকটে গিয়া দাঁড়াইল। তখনও দূরে যুদ্ধ চলিতেছিল, মুহুর্মুহু বন্দুক ও কামানের আওয়াজ আসিতেছিল। একজন বৃদ্ধ সম্ভ্রান্ত মুসলমান যুবতীর পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি যুবতীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা, তোমাকে রক্ষা করিবার কি কেহ ছিল না? এখন কথা কহিতে লজ্জা করিও না, আমি তোমার পিতার বয়সী, বিপদের সময় লজ্জা করিতে নাই।” যুবতী মুখ তুলিয়া কহিল, “পিতা, সংসারে আমার কোন অভিভাবক নাই, এক বৃদ্ধ পরিচারক ছিল, ফিরিঙ্গিরা তাহাকে মারিয়া আমাদিগকে ধরিয়া আনিয়াছে।” বৃদ্ধ যুবতীর অসামান্য রূপলাবণ্য দেখিয়া কহিল, “মা, তোমার বয়স অল্প, তোমার দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার ন্যায় রূপ হিন্দুস্থানে বিরল, ফিরিঙ্গির হাতে তোমার অশেষ দুর্দ্দশা হইবে। তুমি মুসলমানের কন্যা, মরিতে শিখিয়াছ কি?” যুবতী কহিল, “শিখিয়াছি, আমার পোষাকের মধ্যে জহর আছে, অবসর পাই নাই বলিয়া খাইতে পারি নাই।” “যখন অবসর পাইবে খাইও, আর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহা হইলে আমার এই পুত্রবধূটিকে খাওয়াইও। আমার পুত্র আসদ্খাঁর সহিত লড়াই করিতে গিয়াছে, আমি বৃদ্ধ হইয়াছি তাহাকে রক্ষা করিতে পারি নাই।” বৃদ্ধের পশ্চাতে একজন মুসলমান দোকানদার দাঁড়াইয়াছিল, সে বৃদ্ধকে কহিল, “হুজুর, তখনই কহিয়াছিলাম যে ফিরিঙ্গির সহিত হাঙ্গামা বাধিবার পূর্ব্বে সপ্তগ্রাম ছাড়িয়া পলাইয়া যাইবেন, আপনি নূতন সপ্তগ্রামে আসিয়াছিলেন, এদেশের হাল চাল অবগত নহেন।” বৃদ্ধ কহিলেন, “ভাই শাহান্শাহ নূরুদ্দীন মহম্মদ জহাঙ্গীর বাদশাহের রাজত্বে এমন হইতে পারে তাহা জানিতাম না।” “ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ আফিম্চী, সুবাদার মোকরম্ খাঁ বহুদূরে জহাঙ্গীর নগরে, বাদশাহ আরও দূরে আগরায় অথবা দিল্লীতে, সরকার সপ্তগ্রাম, নামে মাত্র মোগল বাদশাহের ফৌজদারী, ইহা প্রকৃত পক্ষে ফিরিঙ্গি হার্মাদের রাজত্ব।”
“বন্ধু, আমরা যুদ্ধব্যবসায়ী, আমার পুত্র গোলন্দাজ, তাহার মুখে শুনিয়াছি আসদ্খাঁ থাকিতে বাদশাহের প্রজার কোন ভয়ের কারণ নাই।” “আসদ্খাঁ। বীর বটে, কিন্তু কলিমুল্লা খাঁ কাপুরুষ, তাহার কর্ম্মচারিগণ ঘুস্খোর।” “ভাই, মানুষে পড়িয়া শিখে আর ঠেকিয়া শিখে। দায়ে পড়িয়া সপ্তগ্রামে আসিয়া যাহা শিখিয়া গেলাম তাহা জীবনে ভুলিব না, আর যদি কখনও এ জীর্ণদেহ লইয়া বাদশাহী তখ্ৎ গাহের সম্মুখে পৌঁছিতে পারি তাহা হইলে সুবা বাঙ্গালা ফিরিঙ্গি দস্যুর অত্যাচার হইতে মুক্ত করিব।”
বৃদ্ধের কথা শেষ হইবার পূর্ব্বে একজন পর্ত্তুগীজ সেনানায়ক অশ্বপৃষ্ঠে আসিয়া একজন ফিরিঙ্গি সেনাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমাদের নায়ক কোথায়?” ফিরিঙ্গি সিপাহী ছুটিয়া গিয়া নায়ককে ডাকিয়া আনিল। সেনানায়ক তাহাকে কহিল, “সমস্ত বন্দী মুক্ত কর।” নায়ক বিম্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন? পাদ্রী আলভারেজ সমস্ত পৌত্তলিক ধরিয়া লইয়া যাইতে বলিয়াছিলেন।” “পাদ্রীদিগের জন্য পর্ত্তুগীজ রাজত্ব মজিতে বসিয়াছে; আমিরাল ডি সুজার আদেশ, বন্দীদিগকে মুক্ত কর। সম্মুখে গোকুলবিহারী ও পশ্চাতে আসদ্ খাঁ আমাদিগকে আক্রমণ করিয়াছে; গোকুলবিহারীর একজন বাঙ্গালী সেনানায়ক সমস্ত তোপ দখল করিয়াছে। যত সেনা আছে সমস্ত সম্মুখে পাঠাইয়া দাও।”
নায়কের অাদেশে বন্দিগণ মুক্ত হইল, সপ্তগ্রামবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা পর্ত্তুগীজ নৌসেনাধ্যক্ষ ডি মুজাকে আশীর্ব্বাদ করিতে করিতে যে যেদিকে পথ পাইল পলাইল। ফিরিঙ্গি সেনা শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চলিয়া গেল; বৃদ্ধ ওমরাহ, তাঁহার পুত্রবধূ, ফতেমা ও যুবতী দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, এখন কোথায় যাইবে?” যুবতী কহিল, “নিকটেই আমার গৃহ, সেইখানেই যাইব।” “সেখানে তোমার কে আছে?” “কেহই নাই। সেই বৃদ্ধ ভৃত্য যদি না মরিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে সেই আছে।” “চল তাহাকে দেখিয়া আসি।”
বৃদ্ধ রমণীগণকে লইয়া যুবতীর গৃহে প্রবেশ করিলেন। হবিব্, মূর্চ্ছিত হইয়াছিল, ফতেমা ও যুবতীর শুশ্রূষায় তাহার চেতনা ফিরিয়া আসিল। তখন বৃদ্ধ কহিলেন, “মা, অদ্য রজনীতে নগর নিরাপদ নহে, চল সপ্তগ্রাম ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লই।” যুবতী কহিল, “ত্রিবেণীর ঘাটে আমার বজরা আছে।” বৃদ্ধ কহিলেন, “চল ত্রিবেণীতেই যাই।” গৃহ পরিত্যাগ করিয়া সকলে পুর্ব্বদিকে যাত্রা করিলেন।
কিয়দ্দুর গিয়া বৃদ্ধ এক প্রশস্ত রাজপথে উপস্থিত হইলেন। পথের চারিদিকে স্তূপীকৃত মৃতদেহ পড়িয়াছিল, কামানের গোলায় চারিদিকে আগুন লাগিয়া গিয়াছিল, বৃদ্ধ সেই স্থানে দাঁড়াইয়া পথ নিরূপণের চেষ্টা করিতেছিলেন। যুবতী সহসা আর্ত্তনাদ করিয়া এক হিন্দু সৈনিকের দেহের উপরে পতিত হইল। বৃদ্ধ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, এ তোমার কে?” যুবতী রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “আমার খসম্।” ফতেমা বিস্মিতা হইয়া যুবতীর মুখের দিকে চাহিল, তাহা দেখিয়া যুবতী পুনরায় কহিল, “আমার খসম্ রাগ করিয়া আমায় পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।” বৃদ্ধ পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিল, “মা, তুমি যে বলিয়াছিলে, তোমাকে রক্ষা করিবার কেহই নাই?” যুবতী ময়ূখের উপরে মুখ দিয়া অম্লান বদনে মিথ্যা কহিল, সে কহিল, “আমার খসম্ যে সপ্তগ্রামে ছিলেন তাহা আমি জানিতাম না।” বৃদ্ধ পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন যে, যুবকের প্রাণবায়ু তখনও নির্গত হয় নাই। তিনি ও হবিব্ আহত যুবককে বহন করিয়া লইয়া ত্রিবেণীর দিকে যাত্রা করিলেন।